What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected উত্তরাধিকার - সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে মহীতোষ দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন, বন্যা এসে গেছে, এখন তো নিয়ে যাওয়ার কোনো প্রশ্ন ওঠে না।

প্রিয়তোষ বলল, কী হয়েছে?

মহীতোষ বললেন, তোর বউদির পড়ে গিয়ে ব্লিডিং হচ্ছে, অবস্থা সিরিয়াস।

প্রিয়তোষ বলল, সে কী! হয়েছে?

মহীতোষ বললেন, সে কী! কখন?

সরিৎশেখর একবার ওপরের দিকে তাকিয়ে জলের মধ্যে গেলেন। অন্ধকারে চলতে কষ্ট হচ্ছে, প্রিয়তোষ ওঁর পিছনে। ছোট ঘরে তখন পায়ের পাতার ওপর জল। কী নেওয়া যায় কী নেওয়া যায় ভাবতে না পেরে আবিষ্কার হল অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। দ্রুত জল বাড়ছে। হাঁটুর কাছটা যখন ভিজে গেল তখন মহীতোষ টর্চটা খুঁজে পেলেন। খাটের অনেকটা এখন জলের তলায়। লেপ তোশক নিয়ে যাবার কোনো মানে হয় না। মেঝেয় রাখা সুটকেসটা তুলে নিলেন। মহীতোষের টাকা এই সুইটকেস আছে। সুটকেসটা এর মধ্যে ভিজে ঢোল হয়ে গেছে।

নতুন বাড়ির বারান্দায় ইঞ্চি কয়েক নিচে জল। মহীতোষ ছাদের সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়াতে দেখলেন সরিৎশেখর ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলছেন। হারিকেনের আলোয় দেওয়ালে ওদের ছায়া কাঁপছে। ছেলেকে দেখে সরিৎশেখর কাপা-কাঁপা গলায় বললেন, আমি কিছু ভাবতে পারছি না মহী, ভগবান এ কী করলে!

মহীতোষ ডাক্তারবাবুর দিকে তাকাতেই তিনি বললেন, হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারলে একটা চেষ্টা করা যেত। কিন্তু যা অবস্থা-জল শুনলাম বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়েছে! মহীতোষ ঘাড় নাড়লেন।

হয়ে গেল তা হলে! ডাক্তারবাবু ছটফট করে উঠলেন, ভোরের আগে কোনোবার জল কমে। এইজন্যেই আমি আসতে চাইছিলাম না। এখন আমি যাই কী করে! অন্ধকারে জল ভেঙে যেতে কোথায় পড়ব-ইস!

মহীতোষ বললেন, ডাক্তারবাবু, আপনি চলে গেলে ওকে নিয়ে আমরা-না, আপনার যাওয়া চলবে না। আপনি ওকে দেখুন, আমি আপনার বাড়িতে খবর দিয়ে আসছি।

কথাটা শেষ হতে প্রিয়তোষ আমি খবর দিয়ে আসি বলে অন্ধকারে ছুটে বেরিয়ে গেল। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ডাক্তারবাবু বললেন, আমি আর দেখে কী করব! চোখের সামনে মেয়েটা চলে যাচ্ছে আমি ফ্যালফ্যাল করে দেখছি। ভগবানকে ডাকুন।

সেটা বেরুলে তো বুঝতে পারা যেত। এতগুলো ইঞ্জেকশন দিলাম, রক্ত বন্ধ করা যাচ্ছে না। বিড়বিড় করে বকতে বকতে ডাক্তারবাবু ওপরে উঠে গেলেন।

এখন এখানে শুধু ঝোড়ো বাতাস ছাড়া কোনো শব্দ নেই। বাইরে তিস্তার জল নতুন বাড়ির বারান্দার গায়ে ধাক্কা লেগে যে-শব্দ তুলছে তাও বাতাসে চাপা পড়ে গেছে। মহীতোষ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে। সরিৎশেখর নাতিকে দুহাতে জড়িয়ে ওপরের দিকে মুখ করে বসে আছেন সিঁড়িতে। লণ্ঠনের আলোয় দেওয়ালে-পড়া তাদের ছায়াগুলো নিয়ে বাতাস উদ্ভ ছবি এঁকে এঁকে যাচ্ছে। সময় এখন খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগুচ্ছে। যে-কোনো মুহূর্তে ওপর থেকে কোনো শব্দ ভেসে আসবেএইরকম একটা আশঙ্কায় দুটো গরম কাঁটা হয়ে রয়েছে। দাদুর বুকের ওপর মাথা রেখে অনি অনেকক্ষণ ধরে দুপদুপ বাজনা শুনছিল। এতক্ষণ যেসব কথাবার্তা এখানে হয়ে গেল তার প্রতিটি শব্দ ওর কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। মা আর থাকবে না। ডাক্তারবাবু ওদের ভগবানকে ডাকার কথা বললেন, কিন্তু কেউ ডাকছে না কেন? অনির মনে পড়ল স্বৰ্গছেঁড়ায় এক বিকেলবেলায় হেমলতা ওকে বলেছিলেন সবচেয়ে বড় ভগবান হল মা। অনি সমস্ত শরীর দিয়ে মনে মনে মাকে ডাকতে লাগল। চোখ বন্ধ করে নিঃশব্দে, মা, মা উচ্চারণ করতে করতে অনি দেখতে পেল মাধুরী ওর কাছে এসে দুহাতে ওকে জড়িয়ে ধরেছেন। মায়ের গায়ের সেই গন্ধটা বুক ভরে নিতে নিতে ও শুনতে পেল পিসিমা সিড়ির মুখে এসে বলছেন, অনিকে একটু ওপরে নিয়ে আসুন।

কথাটা শুনে তড়াক করে উঠে দাঁড়াল অনি। অন্ধকারে সিঁড়িগুলো লাফ দিয়ে পেরিয়ে এসে পিসিমার মুখোমুখি হয়ে গেল ও। অনিকে দেখে হেমলতা দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন। অনি বুঝতে পারল পিসিমা কাঁদছেন। কয়েক পা এগিয়ে হেমলতা আবার থমকে দাঁড়ালেন। অনির মাথাটা ওঁর প্রায় কাঁধবরাবর। অনি শুনতে পেল কেমন কান্না-কান্না গলায় পিসিমা ওকে বলছেন, অনি বাবা, আমার সোনাছেলে, তোমার মা এখন ভগবানের কাছে চলে যাচ্ছেন, যাওয়ার আগে তোমাকে দেখতে চাইছেন। হুহু করে কেঁদে ফেললেন হেমলতা।

অনি বলল, মা-ই তো ভগবান। তবে মা কার কাছে যাচ্ছে।

ফিসফিস করে হেমলতা বললেন, আমি জানি না বাবা, তুমি কোনো কথা বোলে না, বেশি কেঁদো, তাহলে মার যেতে কষ্ট হবে। পিসিমার বারণ তিনি নিজেই মানছিলেন না।
 
মা শুয়ে আছেন চুপচাপ। ওঁর শরীর নড়ছে না। ডাক্তারবাবু মাটিতে বাবু হয়ে বসে আছেন। হেমলতা অনিকে এগিয়ে দিলেন সামনে, মাধু, অনি এসেছে দ্যাখ।

চোখের পাতা নাচল, পুরো খুলল না। অনি দেল মায়ের চোখের কোল জলে ভরে গেছে। অনি মাধুরীর মুখের পাশে মুখ নিয়ে ডাকল, মা, মাগো!

মাধুরী ঘোরের মধ্যে বললেন, অনি, বড় কষ্ট হচ্ছে রে।

ফুঁপিয়ে উঠল অনি, মা, মাগো।

মাধুরী ফিসফিস করে বললেন, আমি তোর সঙ্গে থাকব রে, তুই জেলে গেলেও তোর সঙ্গে থাকব। অনি পাগলের মতো মায়ের বুকে মুছ চেপে ধরে ফোপাতে লাগল। অনেকক্ষণ পরে বাইরের বৃষ্টির শব্দ, হাওয়ার শব্দ ছাপিয়ে হেমলতার বুকফাটা চিক্কার কানে আসতে অনি মায়ের বুক থেকে মাথা সরিয়ে অবাক হয়ে দেখল পিসিমা আর বাব পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদছে। ওর পাশ দিয়ে দুটো পা দ্রুত ছাদের দিকে চলে গেল। পেছন থেকে অনি দেখল দাদু এই বৃষ্টির মধ্যে এই অন্ধকারে ছাদে হেঁটে যাচ্ছেন।

মায়ের দিকে তাকাল অনি। স্বৰ্গছেঁড়ায় অনেক রাত্রে ঘুম ভেঙে ও মাধুরীকে এমনিভাবে শুয়ে থাকতে দেখত। ঘুমিয়ে পড়লে মাধুরী সহজে চাইতেন না। ভীষণ বাথরুম পেয়ে গেলে অনি মায়ের গায়ে চিমটি কাটত। তখন মাধুরী ধড়মড় করে উঠে বসতেন। অনি বুঝতে পারছিল আর মা উঠে বসবে না। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে অনি চিৎকার করে কেঁদে উঠল।

মাঝরাতেই জল নেমে গিয়েছিল। ভোরের আলো ফুটতে চারধার একটা অদ্ভুত দৃশ্য নিয়ে জেগে উঠল। সমস্ত শহরটার ওপর কয়েক ইঞ্চি পলি পড়ে গেছে। সূর্যের আলো পড়ায় চকচক করছে সেগুলো। ভেসে-আসা মৃত গরু-ছাগল আটকে গেছে এখানে-সেখানে। তিস্তার জল করলার মধ্যে ঢুকে যাওয়ায় নিচু জায়গাগুলো এখনও জলের তলায়। শ্মশানটা শহরে একপ্রান্তে, মাষকলাইবাড়ির কাছে। উঁচু জায়গা বলে সে অবধি জল পৌঁছায়নি। লোকজন যোগাড় করে এই পাকের ওপর দিয়ে হেঁটে শোনে আসতে দুপুর হয়ে গেল। ছোট ধরের অনেক জিনিসপত্র গেলেও খাটটা বেঁচেছে। সরিৎশেখর সেখানে সকাল থেকে শুয়ে রইলেন। কাল রাতে বৃষ্টিতে ভিজে সর্দিজ্বর হয়েছে ওঁর। বারবার বলছেন, আমার অঙ্গহানি ঠেকাতে পারল না কেউ।

মৃতদেহ নিয় যাবার লোকের অভাব হয় না। তারা সবাই হরিধ্বনি দিতে দিতে মাধুরীকে নিয়ে যাচ্ছিল। প্রিয়তোষ কাঁধ দিয়েছ। হেমলতা কাল রাত থেকেই সেই যে অনিকে জড়িয়ে ধরে বসেছিলেন মাধুরীর পাশে, একবারও ওঠেননি। কাঁদতে কাঁদতে অনি কখন তাঁর বুকে ঘুমিয়ে পড়ছে, আবার জেগেছে, হেমলতা পাথর। দেহ নিচে নামিয়ে খাটিয়া স জয়ে কেউ-একজন ডাকল তাকে, এয়োস্ত্রীকে যাবার সময় সিঁদুর পরিয়ে দিতে হয়, সিঁদুর নিয়ে আসুন। ঠিক তখনই হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন হেমলতা, আমি চাইনি গো, কাল সকালে জোর করে আমাকে দিয়ে সিঁদুর পরাল ও, আমি যে বিধবা, সেই পাপে মেয়েটা চলে গেল গো-।

মহীতোষ কাঁদতে কাঁদতে বললেন, থাক, সিঁদুর পরাতে হবে না।

সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠলেন সরিৎশেখর, ছোট ঘরের খাটে শুয়ে কান কাড়া করে সব কথা শুনছিলেন, খবরদার, আমার বাড়ির বউকে সিঁদুর না পরিয়ে বাইরে নিয়ে যাওয়া চলবে না।

এখন সিঁদুর-মাথায় মাধুরী শোনে পৌঁছে গেলেন। ওদের থেকে খানিক দূরত্বে ছেলের হাত ধরে মহীতোষ হেঁটে এলেন। পলি-জমা রাস্তায় হাঁটতে ছেলেটার কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু মুখে কিছু বলছে না। মহীতোষ কাল থেকে ছেলের সঙ্গে কথা বলেননি। এখন আসার সময় ভয় পাচ্ছিলেন অনি হয়তো মাধুরীকে নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঁকে করবে। কিন্তু আশ্চর্য, অনি গম্ভীরমুখে হেঁটে এল। মহীতোষের মনে হল এক রাত্রে ছেলেটা অনেক বড় হয়ে গিয়েছে।
 
শ্মশানে ওরা যখন চিতা সাজাচ্ছিল তখন ছেলেকে জড়িয়ে ধরে চুপচাপ বসে ছিলেন মহীতোষ। কাঁদতে ভয় করছিল অনির জন্যে। আজকে এই শ্মশানে আর কোনো চিতা জ্বলছে না। একমাত্র যেটি সাজানো হচ্ছে সেটি মাধুরীর জন্য।

হঠাৎ অনি কেমন কাঠ-কাঠ গলায় বলল, মাকে ওরা শুইয়ে রেখেছে কেন? মহীতোষ জবাব দিতে গিয়ে দেখলেন তার গলা আটকে যাচ্ছে। অনেক কষ্টে বললেন, ভগবান কাউকে নিয়ে গেলে তার শরীরটা পুড়িয়ে ফেলতে হয়।

হঠাৎ একজন এগিয়ে এল ওঁদের দিকে, দাদা, আর দেরি করা ঠিক হবে না। মুখাগ্নি তো ওই করবে? মহীতোষ ঘাড় নাড়লেন। ছেলেটি অনির হাত রুল, এসো তুমি। তারপর অনিকে নিয়ে। হাঁটতে হাঁটতে বলল, মা তো চিরকাল থাকে না, আমারও মা নেই, বুঝলে?

পরপর সুন্দর করে কাঠ সাজিয় মাধুরীকে শোয়ানো হয়েছে। মাধুরীর ল খুব বড়, চিতার একটা দিক কালো করে ঢেকে রয়েছে। প্রিয়তোষ এসে অনির পাশে দাঁড়াল। জনি দেখল কয়েকজন পাটকাঠিতে আগুন ধরাচ্ছে। মাকে খুব শান্ত দেখাচ্ছে এখন। অনি, আমি তোমার সঙ্গে আছি। মা, মাগো! অনি ড়ুকরে কেঁদে উঠতে প্রিয়তোষ বলল, কাদিস না, অনি, কাদিস না।

আগের ছেলেটি একগোছা পাটকাঠিতে আগুন জ্বালিয়ে এনে অনির সামনে ধরল, নাও, মায়ের মুখে আগুনটা একটু ছুঁইয়ে দাও।

কথাটা শুনে আঁতকে উঠল ও। সদ্যজ্বালা আগুনের শিখাটা যদিও ছোট কিন্তু লকলক করছে। সেদিকে তাকিয়ে অনি বলে উঠল, আগুন দিলে মুখ পুড়ে যাবে না!

কথাটা মহীতোষের কানে যেতে মহীতোষ ড়ুকরে কেঁদে উঠলেন। ছেলেটি আর দেরি করল না, অনির একটা হাত টেনে নিয়ে পাটকাঠির উপর চেপে ধরে নিজেই জোর করে আগুনের শিখাটা মাধুরীর মুখেইয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে আরও কয়েকটা শিখা চিতার আশেপাশে লকলক করে উঠল। যেন। প্রিয়তোষ অনিকে সরিয়ে নিয়ে এল চিতার কাছ থেকে। ওকে ধরে উলটোদিকে হাঁটতে লাগল সে। কয়েক পা হেঁটে অনি শুনতে পেল পেছন থেকে অনেকগুলো গলায় চিক্কার উঠছে, বোল হরি, হরি বোল।

হঠাৎ কাকার হাতের বাঁধন থেকে ছিটকে সরে গিয়ে অনি মায়ের চিতার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। দাউদাউ করে অজস্র শিখা নিয়ে আগুন জ্বলছে। শব্দ হকোঠ পোড়ার। আগুন। মশ দলা পাকিয়ে লাল হয়ে নাচতে শুরু করেছে। অনি আগুনের মধ্যে অপই একটা অবয়ব দেখা পেল, যাকে মা। বলে কিছুতেই চেনা যায় না।

যে-ছেলেটি ওর হাত ধরে মুখাগ্নি করাল সে অনির দিকে এগিয়ে এল, তোমার হাতে কী লেগেছে? শুকিয়ে কালচে হয়ে আছে।

নিজের হাতটা চোখের সামনে ধরতেই অনির মনে পড়ে গেল একটা লাল হয়ে নাচতে শুরু করেছে। অনি আগুনের মধ্যে অস্পষ্ট একটা অবয়ব দেখতে পেল, যাকে মা বলে কিছুতেই চেনা যায় না।

যে-ছেলেটি ওর হাত ধরে মুখাগ্নি করাল সে অনির দিকে এগিয়ে এল, তোমার হাতে কী লেগেছে। শুকিয়ে কালচে হয়ে আছে!

নিজের হাতটা চোখের সামনে ধরতেই অনির মনে পড়ে গেল একটা লাল স্রোতের কথা, কাল রাত্রে মায়ের শরীর থেকে যেটা বেরিয়ে এসেছিল। কখন সেটা শুকিয়ে কালচে হয়ে গেছে, রক্ত বলে চেনা যায় না। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল সে, কাঁদতে কাঁদতে বলল, মার রক্ত।
 
তাঁকে প্রশ্ন করা হল, যিনি তোমাকে গর্ভে ধরেছেন, স্তন্যদান করে জীবন দিয়েছেন, তোমাকে জ্ঞানের আলো দেখিছেন সেই তিনি আর যিনি মাতৃজঠর থেকে নির্গত হওয়ামাত্র তোমার জন্য জায়গা দিয়েছেন, তার সংস্কৃতি তার সংস্কার রক্তে মিশিয়ে দিয়েছেন এই তিনি-কাকে তুমি আপন বলে গ্রহণ করবে? তিনি বলরেন, দুজনকেই। কারণ একজনের সঙ্গে নাড়ির বাধন ছিন্ন হওয়ামাত্রই আর-একজনের সঙ্গে নাড়ির বাঁধন যুক্ত হয়েছে। কিন্তু ছিন্ন না হলে যে যুক্ত হত না। তাই দুজনেই আমার আপন।

তাকে বলা হল, যদি একজনকে ত্যাগ করতে বলা হয় তবে কাকে ত্যাগ করবে? তিনি বললেন, এই মাটির তো তারও জননী। তাই এর জন্য জীবন দিয়ে তিনিই ধন্য হবেন। সে ত্যাগ মানে আরও বড় করে পাওয়া, সে-ত্যাগের আগেই আমার আনন্দ।

সমস্ত ক্লাস চুপচাপ, নতুন স্যার একটু থামলেন, তারপর উদগ্রীব-হয়ে-থাকা মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, সেই মায়ের পায়ে যখন লোহার বেড়ি পরিয়ে দিয়েছিল ইংরেজরা তখন তার এমন কত দামাল ছেলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দুঃখিনী মায়ের মুখে হাসি ফোঁটাতে। একবারে না পারলে বলেছিল, একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি। এই মা দেশমাতৃকা। তোমরা নতুন ভারতবর্ষের নাগরিক। আজ আমাদের মায়ের পায়ে বেড়ি নেইকো, অনেক রক্তের বিনিময়ে তিনি আজ মুক্ত, কিন্তু এতদিনের শোষণে তিনি আজ রিক্তা, মলিন, শীর্ণা। তোমাদের ওপর দায়িত্ব তার মুখে হাসি ফিরিয়ে আনবার। নাহলে তোমরা যাদের উত্তরাধিকারী তাদের কাছে মুখ দেখাতে পারবে না ভাই। ব্যস, আজ এই পর্যন্ত। টেবিলের ওপর থেকে ডাস্টার বই তুলে নিয়ে স্যার ক্লাসরুম থেকে সোজা-মাথায় বেরিয়ে গেলেন। তার খদ্দরের পাঞ্জাবির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অনিমেষ বুঝতে পারেনি ওর সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে। এইসব কথা এই স্কুলের নতুন স্যার আসার আগে কেউ বলেনি। ব্যাপারটা ভাবলেই কেমন হয়ে যায় মনটা। নতুন স্যার বলেছেন, শিবাজীও একজন স্বাধীনতা আন্দোলনের যোদ্ধা ছিলেন। শিবাজীর কথা শুনলে মনের মধ্যে কিছু হয় না, কিন্তু সুভাষচন্দ্র বসু যখন বলেন গিভ মি ব্লাড তখন হৃৎপিণ্ড দপদপ করে। এই ব্লাড শব্দটা উচ্চারণ করার সময় নতুন স্যার এমন জোর দিয়ে বলেন অনিমেষ চট করে সেই ছবিটা দেখতে পায়, নিজের আঙুলগুলোর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। ভীষণ কান্না পেয়ে যায়।

নতুন স্যার থাকেন হোস্টেলে। ওদের স্কুলের সামনে বিরাট মাঠ পেরিয়ে হোস্টেল। কদিনের মধ্যে অনিমেষের সঙ্গে খুব ভাব হয়ে গেল নতুন স্যারের। ওদের স্কুলের অন্যান্য টিচার দীর্ঘদিন ধরে পড়াচ্ছেন। ওঁরা নতুন স্যারের সঙ্গে ছাত্রদের এই মেলামেশা ঠিক পছন্দ করেন না। একমাত্র ড্রিল স্যার বরেনবাবুর সঙ্গে নতুন স্যারের বন্ধুত্ব আছে। ওঁরা দুজন এক ঘরে থাকেন।

অনিমেষের পড়ার চাপ পড়েছে বলে সরিৎশেখর ভোরে আর ওকে বেড়াতে যেতে বলেন না। কিন্তু এইটুকু ছেলের মধ্যে যে চাঞ্চল্য ছটফটানি থাকার কথা অনিমেষের মধ্যে তা নেই। সারাদিনই যখনই বাড়িতে থাকে তখনই মুখ গুঁজে বই পড়ে। বই পড়ার এই নেশাটা ওর মধ্যে ঢুকিয়েছিল প্রিয়তোষ। ঢুকিয়ে দিয়ে হাওয়া হয়ে গিয়েছে সে। সরিৎশেখরের জীবনে আর-একটি আঘাত এই ছোট ছেলে। দিনরাত বাড়ির বাইরে পড়ে থাকত, কখন যেত কখন আসত হেমলতা ছাড়া কেউ টের পেত না। রাগারাগি করতে করতে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন সরিৎশেখর। চাকরিবাকরি করে না, তার কোনো সাহায্য হচ্ছে না, এ-ছাড়া এই ছেলের বিরুদ্ধে ওঁর অভিযোগ করার অন্য কারণ নেই। অনি তখন সবে স্কুলে ভরতি হয়েছে। বাড়ি এলে অনির সঙ্গে আড্ডা হত খুব। স্বর্গহেড়ায় ওর যেআকর্ষণের আভাস তিনি হেমলতার কাছে পেয়েছেন সেটা নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা ছিল। কিন্তু ও যে আর স্বৰ্গছেঁড়ায় যায় না, জোর করেও তাকে স্বৰ্গছেঁড়ায় পাঠাতে পারেননি সেকথাও তো সত্যি।

তারপর সেই দিনটা এল। তিন দিন বাড়ি আসেনি প্রিয়তোষ। সরিৎশেখর এখানে-সেখানে ওকে খুঁজেছেন। যে-কজন ওর সমবয়সি-ছেলেকে ওর সঙ্গে ঘুরতে দেখেছেন তারাও ওর হাদিস দিতে পারেনি। বিরক্ত চিন্তিত সরিৎশেখর ঠিক করেছিলেন প্রিয়তোষ এলে পাকাপাকি কথা বলে নেবেন ভদ্রভাবে সে বাড়িতে থাকতে পারবে কি না।
 
তখন ওঁরা নতুন বাড়িতে উঠে এসেছেন। ছোট বাড়িটায় পুরনো জিনিসপত্রের গুদাম করে রাখা হয়েছে। মাঝখানে বড় ঘরটায় সরিৎশেখর একা শোন, লাগোয় ঘরটায় হেমলতা। বাইরের দিকের ঘরটায় প্রিয়তোষ এবং অনিমেষ থাকত। অনিমেষকে সে বছরই প্রথম স্কুলে ভরতি করা হয়েছে, খুব কড়া স্কুল। এ-জেলার মধ্যে এই স্কুলের নামডাক সবচেয়ে বেশি। সরিৎশেখর নিজে গিয়ে ওকে ক্লাসে বসিয়ে এসেছেন। ভেবেছিলেন ক্লাসে ঢুকে ছেলেটা নিশ্চয়ই কান্নাকাটি করবে। কিন্তু অনি ওঁর চলে আসার সময় খুব গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল। অদ্ভুত পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে ছেলেটার। সেই জন্ম থেকে তিনি ওকে দেখছেন, ওর নাড়িনক্ষত্র জানা, কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পর ছেলেটা রাতারাতি পালটে যাচ্ছে। বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে চুপচাপ ছাদে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। প্রিয়তোষ ওর। দিদিকে বলেছে রাতদুপুরে অনি নাকি জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের মনে কথা বলেব না। হেমলতাকে নিষেধ করে দিয়েছিলেন সরিৎশেখর এটাই চাইছিলেন।

মাধুরী বেঁচে থাকতে কাকার সঙ্গে অনির খুব একটা ভাব ছিল না। বরং কারণে–অকারণে প্রিয়তোষ ওর উপর অত্যাচার করত। অনির কান দুটো প্রিয়তোষের আঙুলের বাইরে থাকার জন্য তখন প্রাণপণ চেষ্টা করত। মা মরে যাবার পর প্রিয়তোষের ব্যবহার একদম পালটে গেল।

নতুন স্যার তখন সদ্য স্কুলে এসেছেন। ওঁর কথাবার্তা, হাসি অনিমেষের খুব ভালো লাগছে। মাঝে-মাঝে যখন খুব শক্ত কথা বলেন তখন অনিমেষরা বুঝতে পারে না। কিন্তু যখন দেশের গল্প করতে করতে নতুন স্যার জানতে পারলেন অনির মা নেই, অনি দেখল, ক্লাসের সমস্ত মুখগুলো ওর দিকে অবাক হয়ে চেয়ে আছে। যেন মা নেই ব্যাপারটা কেউ ভাবতে পারছে না। নতুন স্যার ওকে দিকে অবাক হয়ে চেয়ে আছে। যেন মা নেই ব্যাপারটা কেউ ভাবতে পারছে না। নতুন স্যার ওকে কাছে ডেকে আদর করে বললেন, মা নেই বোলো না। আমাদের তো দুটো মা, একজন চলে গেলেন ঈশ্বরের কাছে, কিন্তু আর-এক মা তো রয়েছেন। তুমি তার কথা ভাববে, দেখবে আর খারাপ লাগবে না। বঙ্কিমচন্দ্র বলে একজন বিরাট সাহিত্যিক ছিলেন, তিনি এই দেশকে মা বলেছিলেন, বলেছিলেন বন্দেমাতরম।

প্রিয়তোষ সেই রাত্রে বাড়িতে ছিল। অনেক রাত জেগে কাকাকে বইপত্র পড়তে দেখত অনিমেষ। নিজের খাটে শুয়ে শুয়ে প্রিয়ভোষকে নতুন দিদিমণি যখন বন্দেমাতরম শব্দটা ওদের উচ্চারণ করেছিলেন তখন শব্দটার মানেটা ও ধরতে পারেনি। নতুন স্যার ওকে সে-রহস্য থেকে মুক্ত করেছেন। সব শুনে প্রিয়তোষ বলল, শালা কংগ্রেসি!

এই প্রথম অনিমেষ কাকাকে গালাগাল দিতে শুনল। স্বৰ্গছেঁড়ায় বাজারের রাস্তায় অনেক মদেসিয়া মাতালকে এই শব্দটা ব্যবহার করতে শুনেছে ও। মাধুরীর শ্রাদ্ধের সময় নদীয়া থেকে অনির মামামরা এসেছিলেন। হেমলতা বলেছিলেন ওঁরা হলেন মহীতোষের শালা। রেগে গেলে এই সম্বোধনটাকে কেন লোকে গালাগালি হিসেবে ব্যবহার করে বুঝতে পারে না অনিমেষ। আবার মদেসিয়াদের মুখে শুনতে যতটা-না খারাপ লাগত এই মুহূর্তে কাকার মুখে খুব বিচ্ছিরি লাগল। কংগ্রেসি শব্দটা ও খবরের কাগজ থেকে জেনে গিয়েছিল। যেমন মহাত্মা গান্ধী কংগ্রেসি, জওহরলাল নেহরু কংগ্রেসি। দেশের জন্য যারা কাজ করে তারা কংগ্রেসি, তাদের মাথায় একটা সাদা টুপি থাকে। নতুন স্যারের মাথায় সাদা টুপি নেই, তা হলে তিনি কংগ্রেসি, তাদের মাথায় একটা সাদা টুপি থাকে। নতুন স্যারের মাথায় সাদা টুপি নেই, তা হলে তিনি কংগ্রেসি হবেন কী করে? আর যারা দেশের জন্য কাজ করে, দেশমায়ের জন্য জীবন দান করে তারা শালা হবে কেন? কিন্তু কাকার সঙ্গে তর্ক করা বা কাকার মুখেমুখে কথা বলতে সাহস পেল না অনিমেষ। কথা বলার সময় কাকার মুখ-চোখ দেখেছিল ও, ভীষণ রাগী দেখাচ্ছিল তখন। কিন্তু কাকার কথা মেনে নিতে পারেনি, নতুন স্যারকে গালাগালি দিয়েছে বলে কাকার ওপর ওর ভীষণ রাগ হচ্ছিল। সেদিন মাঝরাতে অনির ঘুম ভেঙে গেলে দেখল কাকা বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছে। একটা বই ওর মাথায় তলার চাপা পড়ে দুমড়ে যাচ্ছে। হারিকেনের আলোটা কমানো হয়নি। অনেক রাত অবধি আলে জ্বেলে রাখলে দাদু রাগ করেন, কেরোসিন তেল নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু অনি উঠে আলো নেবাল না, কাকাকে ডাকল না। দাদু যদি এখন এখানে আসে বেশ হয়। জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল ও। একটা-দুটো করে তারা গুনতে গুনতে আস্তে-আসতে সেগুলো মায়ের মুখ হয়ে গেল। অনি স্থির হয়ে অনেকক্ষণ মাকে দেখল, তারপর নিজের মনে বলল, মা, যারা দেশকে ভালোবাসতে বলে তারা কি খারাপ?

(না সোনা, কক্ষনো না।)

তাহলে কাকা কেন নতুন স্যারকে গালাগালি দিল?

(কাকা রেগে গেছে তাই।)

আমি যদি দেশকে ভালোবাসি তুমি খুশি হবে তো?

(আমি তো তা-ই চাই সোনা।)

মা, তোমার জন্য বড় কষ্ট হয় গো কথাটা বলতেই অনির চোখ উপচে জল বেরিয়ে এল সেই জলের আড়াল ভেদ করে আনি আর কিছুই দেখতে পেল না। অনি লক্ষ করেছে যখনই সে মায়ের সঙ্গে কথা বলে, কষ্টের কথা বলে, তখনই চোখ জুড়ে নেমে আসে আর সেই সুযোগে মা পালিয়ে যায়। চোখ মুছে আর খুঁজে পায় না সে।
 
কদিন কাকা বাড়িতে আসেনি। দাদু অনেক খুঁজেও ছোট কাকার খবর পাচ্ছেন না। জলাইগুড়িতে হঠাৎ একটা মিছিল বেরিয়েছে। অনি দেখেনি, কিন্তু ক্লাসে বন্ধুদের কাছে শুনেছে সেটা নাকি কংগেসিদের মিছিল নয়, তারা কংগ্রেসিদের গালাগালি দিচ্ছিল। পুলিশ নাকি খুব লাঠির বাড়ি মেরেছে। গোলমাল হবার ভয়ে সুর কদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। সেই সময় খবরের কাগজ পড়ে সরিৎশেখর খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ছিলেন। বাড়িতে খুব শক্ত ইংরেজি কাগজ রাখতে আরম্ভ করলেন তিনি, ওতে নাকি অনেক বেশি খবর থাকে।

কদিন বাদে অনেক রাত্রে দরজায় টকটক শব্দ হতে অনিমেষের ঘুম ভেঙ্গে গেল। কাকা না থাকলেও এক ওত ও। হেমলতা আপত্তি করতে ও বহিল ওর ভয় করবে না। পিসিমার বাবা দাদুর ঘর থেকে জানলা দিয়ে আকাশ দেখা যায় না। এনে ও দেখল পাশের জানলার নিচে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে ও চোখ বন্ধ করতে যালি, হঠাৎচাপা গলায় নিজের নাম শুনতে পেয়ে বুঝল, কাকা এসেছে। চট করে উঠ গিয়ে দরজা খুলতে কাকা মূখে আঙুল দিয়ে ইশারা করে ওকে চুপ। করতে বলল, তারপর ঘরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিল। অনিমেষ দেখল এই কয়দিনে কাকার চেহারা ভীষণ খারাপ হয়ে গিয়েছে। পাজামা আর শার্ট খুব ময়লা, গালরতি হোট ঘোট দাড়ি গজিয়েছে, স্নানটান হয়নি বোঝা যায়। ঘরে এসে কাকা প্রথমে হারিকেনটা বাড়িয়ে দিল, তারপর ওর খাটের তলা থেকে একটা টিনের সুটকেস টেনে বের করল। তালা খুলে ফেলতে দেখল, সামান্য কয়েকটা জামাকাপড় ছাড়া অনেকগুলো বই আর পত্রিকায় সেটা ভরতি। কাকা ওর সঙ্গে কথা বলছে না, একমনে বইগুলো উলটেপালটে দেখছে। তারপর অনেকক্ষণ দেখেশুনে কতগুলো বই আর পত্রিকা আলাদা করে বেঁধে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। চলে যেতে গিয়ে কী ভেবে আবার বান্ডিলের ওপরের পত্রিকাটার ওপর বড় বড় করে লেখা আছে-মার্কসবাদী। কাকা খুব ফিসফিস করে বলল, অনি, কেউ যদি আমার খোঁজে এখানে আসে তা হরে তাকে কক্ষনো বলবি না যে আমি এসে বইগুলো নিয়ে গেছি। বুঝলি?

অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, তারপর বলল, তুমি কেন চলে যাচ্ছ?

কাকা বলল, ওদের পুলিশ আমাদের ধরে জেলখানায় নিয়ে যেতে চাইছে। আমাদের পার্টিকে ভ্যান করে দিয়েছে ওরা। মুখে গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলবে, অথচ কাউকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেবে না।

অবাক হয়ে অনি বলল, কারা?

কাকা থেমে গেল প্রথমটা, তারপর হেসে বলল, ঐ বন্দেমাতরম পার্টি, কংগ্রেসিরা। তুই এখন বুঝবি না, বড় হলে যখন জানবি তখন আমার কথা বুঝতে পারবি।

অনিমেষ বলল, কিন্তু নতুন স্যার বলেছেন কংগ্রেসিরা দেশসেবক।

ঘৃণায় মুখটা বেঁকে গেল যেন, কাকা বলল, দেশসেবা? একে দেশসেবা বলে? ভিক্ষে করার নাম দেশসেবা! ইংরেজদের পা ধরে ভিক্ষে করে রাত্রের অন্ধকারে চোরের মত হাতে ক্ষমতা নিয়ে দেশসেবা হচ্ছে। আমরা বলেছি এ আজাদি ঝুটা হ্যায়। আমরা এইরকম স্বাধীনতা চাই না যে-স্বাধীনতা শোষণের হাত শক্ত করে। তাই ওরা আমাদের গলা টিপতে চায়। ওদের হাতে পুলিশ আছে, বন্দুক আছে, কিন্তু আমাদের শরীরে রক্ত আছে-যাক, এসব কথা এখন তুই বুঝবি না।

আমাদের শরীরে রক্ত আছে। কথাটা শুনেই অনি নিজের আঙুলের দিকে তাকাল, তারপর ওর মনে পড়ল, গিভ মি ব্লাড, আমাকে রক্ত দাও আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব। সুভাষচন্দ্র বসুর দুইরকম ছবি দেখেছে ও। একটা ছবিতে সাদা টুপি মাথায় আর একটা ছবিতে মিলিটারি জামা টুপিতে একটি হাত সামনের দিকে বাড়ানো। সুভাষচন্দ্র বসু কি কংগ্রেসি ছিলেন না। ও কাকার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে ফেলল, তোমরা কি সুভাষচন্দ্র বসুর লোক হয়েছ।

অবাক হয়ে গেল প্রিয়তোষ, তারপর বলল, না, আমরা কমিউনিস্ট। আমরা চাই দেশে গরিব বড়লোক থাকবে না, সবাই সমান, তা হলেই আমরা স্বাধীন হব। আমি যাচ্ছি অনি, তুই কাউকে বলিস না আমি এসেছিলাম। আর মনে রাখিস এ আজাদি ঝুটা হ্যায়।

খুব সন্তর্পণে যেমন এসেছিল তেমনি বেরিয়ে গেল প্রিয়তোষ। দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল অনিমেষ। কাকা যেসব কথা বলে গেল তার মানে কী? আমরা কি স্বাধীন হইনি! নতুন স্যারের কথার সঙ্গে কাকার কথার কোনও মিল নেই কেন? নতুন স্যার বলেছেন, স্বাধীনতা পাওয়ার পর আমরাই আমাদের রাজা। ইংরেজরা যে শোষণ করে দেশকে নিঃস্ব করে গেছে এখন আমাদের তার শ্রী ফিরিয়ে আনতে হবে। আর কাকা বলে গেল এ-স্বাধীনতা মিথ্যে, তবে কি আমরা এখনও পরাধীন? কিছুই ঠাওর করতে পারল না অনিমেষ। সবকিছু কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ ও দেখল, কাকা তাড়াতাড়িতে বইপত্র নিয়ে যাবার সময় ভুল করে সুটকেস বন্ধ করেনি। পায়ে পায়ে অনিমেষ সুটকেসটার কাছে এল। দুটো ধুতি, পাজামা, দুটো শার্ট রয়ে গেছে সুটকেসে। জামাকাপড় তুলতেই তলায় একটা পুরনো খবরের কাগজ। অনিমেষ দেখল, কাগজ জুড়ে একটা মানুষের ছবি, যার মাথাটা দেখা যাচ্ছে না। কৌতূহলী হয়ে কাগজটা তুলতে ও দেখল কাগজটা কাটা, ছবির মুখ নেই। একটা নীল কাগজ সুটকেসের তলায় সেঁটে থাকতে দেখল সে। কাগজটা বের করে আবার সবকিছু ঠিকঠাক রেখে সুটকেসের খাটের তলায় ঢুকিয়ে দিল ও।
 
নীল কাগজটা খুলতেই সুন্দর করে লেখা কয়েকটা লাইন দেখতে পেল অনিমেষ। গোটা-গোটা করে লেখা, কোনো সম্বোধন নেই। লেখার শেষে নামটা পড়ে অবাক হয়ে গেল ও। তপুপিসি লিখেছে? কাকে লিখেছে তা হলে শ্রীচরণেষু বা পূজনীয় নেই কেন? তপুপিসি তো কাকার চেয়ে অনেক ছোট। গুদামবাবুর বাড়িটার কথা মনে পড়ল। তপুপিসি কুচবিহারে পড়ত। চিঠিটা পড়া শুরু করল অনিমেষ। পৃথিবীতে চিরকাল মেয়েরাই ঠকবে এটাই নিয়ম, আমার বেলায় তার ব্যতিক্রম হবে কেন? আমি খুব সাধারণ মেয়ে, আমি সুন্দরী নই। তোমার ওপর জোর করব সে-অধিকার আমার কোথায়? এখানে যখন ছিলে তখন তোমায় কিছুটা বুঝতাম। শহরে যাওয়ার পর তুমি কী দ্রুত পালটে গেলে। তোমার রাজনীতিই এখন সব, আমি কেউ নই। হঠাৎ মনে হল, তুমি তো আমাকে কোনোদিন কথা দাওনি, তোমাকে দোষ দিই কী করে! তুমি তো যৌবনের ধর্ম পালন করেছিলে। কী বোকা আমি! তাই তুমি যত ইচ্ছা রাজনীতি করো, আমি দায় তুলে নিলাম।–তপু।

তপুপিসি কেন এই চিঠি লিখেছে বুঝতে পারছিল না অনিমেষ। কিন্তু তপুপিসি খুব দুঃখ পেয়েছে, কাকা রাজনীতি করে বলে তপূপিসির খুব কষ্ট হয়েছে। রাজনীতি করা মানে কী? এই যে কাকা। বাড়িতে থাকে না আজকাল, উশকোখুশকো হয়ে ঘুরে বেড়ায় চোরের মতো একে কি রাজনীতি বলে? এসব করলে কি আর তপুপিসির সঙ্গে ভাব রাখা যায় না? কিন্তু তপুপিসি কেন লিখেছে আমি সুন্দরী নই। সারা স্বৰ্গছেঁড়ায় তপুপিসির চেয়ে সুন্দরী মেয়ে তো কেই নেই, এক সীতা ছাড়া। কিন্তু সীতা তো ছোট্ট। বড় হলে নাকি চেহারা পালটে যায়। বড় হবার পর সীতদা তপুপিসির মতো সুন্দরী নাও হতে পারে। এমন সময় অনিমেষ শুনতে পেল একটি গাড়ি খুব জোরে এসে শব্দ করে বাড়ির সামনে থামল। তিন-চারটে গলায় কথাবার্তা জুতোর শব্দ চারধারে ছড়িয়ে পড়তে ও জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। প্রথমে বুঝতে-না-বুঝতে দরজার প্রচণ্ড জোরে আওয়াজ উঠল। আওয়াজটা ওর ঘরের দরজায়, দ্রুতহাতে কে শব্দ করছে, দরজা ভেঙে ফেলা যোগাড়। অনি কী করবে বুঝতে পারছিল না, এমন সময় সরিৎশেখরের গলা শুনতে পেল ও। শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে চিৎকার করছেন, কে কে? শব্দটা থেমে গেল আচমকা, একটা বাজখাই গলায় কেউ বলে উঠল, দরজা খুলুন, পুলিশ।

পুলিশ! অনিমেষ বুঝতে পারছিল না সে কী করবে। পুলিশ তাদের বাড়িতে আসবে কেন? ছেলেবেলা থেকে পুলিশ দেখলে ওর কেমন ভয় করে। সরিৎশেখরের চাচানি বন্ধ হয়ে গেল আচমকা। অনিমেষ শুনল দাদু উঠে তার নাম ধরে ডাকছেন। সে দখল তার গলা শুকিয়ে গেছে, দাদুর ডাকে সাড়া দিতে পারছে না। বিদ্যাসগরি চটিতে শব্দ করতে করতে ভেতরের দরজা খুলে দাদু এঘরে এলেন। ঘরের মধ্যিখানে আলো জ্বালিয়ে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দাদু খুব অবাক হলেন, কী হল, তুমি ঘুমোওনি?

ঘাড় নেড়ে অনিমেষ বলল, পুলিশ।

সরিৎশেখর বললেন, আমি দেখছি, তুমি পিসিমার কাছে যাও।

কথাটা শুনে অনিমেষ ভেতরের ঘরে ঢুতে থমকে দাঁড়াল। ঘরটা অন্ধকার, একদিকে পিসিমার ঘরে, অন্যদিকে দাদুর ঘরে যাবার দরজা। অনিমেষ শুনতে পেল পিসিমা বিড়বিড় করে জয় গুরু জয় গুরু বলে যাচ্ছেন। অনিমেষ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে উঁকিমেরে দেখল দাদু দরজা খুলে দিতেই হুড়মুড় করে কয়েকজন পুলিশ ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। প্রথমে যে এল তার হাতে রিভলভার দেখল। অনিমেষ। পুলিশরা ঘরে ঢুকে পড়তেই সরিৎশেখর ধমকে উঠলেন, কী ব্যাপার, এত রাত্রে আমার বাড়িতে আপনারা কেন এসেছেন, কী চান?

রিভলভার-হাতে পুলিশটা বলল, আপনার ছেলে কোথায়?

সরিৎশেখর অবাক হলেন, ছেলেও, আমার বড় ছেলের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই!

পুলিশটা বলল, ন্যাকামো করবেন না, আপনার ছোট ছেলে প্রিয়তোষের কথা জিজ্ঞাসা করছি।

সরিৎশেখর ঘাড় নাড়লেন, জানি না।

চিবিয়ে চিবিয়ে লোকটা বলল, জানেন না! এই বাড়ি সার্চ করো।

কথাটা বলতেই অন্য পুলিশগুলো রিভলভার বের করে ঘরময় ছড়িয়ে পড়ে জিনিসপত্র উলটেপালটে দেখতে লাগল। সরিৎশেখর দুহাত তুলে তাদের থামাতে গেলেন, আরে কী করছেন কী। আপনারা? আমি কালই ডি সি-র সঙ্গে কথা বলব। আমাকে আপনারা অপমান করতে পারেন না। কী করেছে আমার ছেলে?

প্রথম লোকটি বলল, বাপ হয়ে জানেন না ছেলে কমিউনিস্ট হয়েছে। দেশ উদ্ধার করেছেন সব। সরকারের বিরুদ্ধে প্রচার করছেন। ওর নামে ওয়ারেন্ট আছে। কাজে বাধা দেবেন না, ওর বইপত্র আমরা দেখব। ও বাড়িতে এসেছে এ-খবর আমরা পেয়েছি।

সরিৎশেখর বললেন, আজ কদিন সে বাড়িতে নেই। আমি বলছি সে বাড়িতে নেই। কিন্তু সে কমিউনিস্ট হল কবে?

লোকটি বলল, এই তো, বাপ হয়েছেন অথচ ছেলের খবর রাখেন না!
 
সরিৎশেখর রেগে গিয়ে চিষ্কার করে উঠলেন, মুখ সামলে কথা বলবেন। জানেন সারাজীবন আমি কংগ্রেসকে সাহায্য করছি। দরকার হলে এই জেলার মন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করবেন। আপনি কি ভাবছেন এখনও ব্রিটিশ আমল রয়েছে যে এইসব কথা বলবেন?

পুলিশ বলল, মশাই, আমল বদলায় আপনাদের কাছে আমরা হুকুমের চাকর। আমাদের কাছে ব্রিটিশরাও যা এই কংগ্রেসিরাও তা, হুকুম তামিল করব। সবাই আমাদের সাহেব। যান, বেশি বকাবেন না, আমাদের সার্চ করতে দিন।

অসহায়ের মতো সরিৎশেখর ধপ করে অনিমেষের খাটে বসে পড়লেন। অনিমেষ শুনল, দাদু বিড়বিড় করছেন, প্রিয় কমিউনিস্ট হয়েছে, কমিউনিস্ট। ততক্ষণে পুলিশগুলো ঘর তছনছ করে ফেলেছে। অনির বইপত্র ছ্যকার, কাকার, সুটকেসটা খালি হয়ে ঢং করে মাটিতে পড়ল। একটা লোক বলল, এ-ঘরে কিছু নেই স্যার।

প্রথম পুলিশ বলল, পালাবে কোথায় বাড়ি ঘেরাও করা আছে। অন্য ঘর দ্যাখো। পুলিশগুলোকে এদিকে আসতে দেখে অনিমেষ দৌড়ে পিসিমার ঘরে চলে এল। হঠাৎ ওর নজরে পড়ল হাতের মুঠোয় পুপিসির চিঠিটা রয়ে গেছে। এই চিঠিটা পেলে পুলিশরা নিশ্চয়ই কাকার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে! তপূপিসি তো লিখেছে কাকা রাজনীতি করে। অনিমেষের মনে হল, রাজনীতি করা মানে কমিউনিস্ট হওয়া। চিঠিটা লুকিয়ে ফেলা দরকার। কী করবে কোথায় রাখবে বুঝতে না পেরে সে চিঠিটাকে পেটের কাছে প্যান্টের ভাজের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে গেঞ্জিটা টেনে দিল। দিতেই সে দেখল হেমলতা তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন। ঘরের এককোণে ঠাকুরের ছবির তলায়। একটা ডিমবাতি জ্বলছে। হেলমতা নিজের বিছানার ওপর বাবু হয়ে বসে আছেন। চোখাচোখি টর্চ জেলে ঘরে ঢুকে পড়ল। একজন ওদের মুখে টর্চ ফেলতে হেমলতা বললেন, চোখে আয়ে ফেলবেন না, কী চাই আপনাদের?

একটা লোক খ্যাঁকখ্যাঁক করে হেসে বলল, রাতদুপুরে জেগে বসে আছেন যে, প্রিয়তোষ কোথায়?

হেমলতা সজোরে উত্তর দিলেন, রাতদুপুরে বাড়িতে ডাকাত পড়লে কেউ নাকে তেল দিয়ে ঘুমোয় না। আমার ভাই বাড়িতে নেই।

লোকগুলো তন্নতন্ন করে ঘরের জিনিসপত্র ঘাটছিল। হেমলতা উঠে দাঁড়ালেন, খবরদার, আমার ঠাকুরের গায়ে কেউ হাত দেবেন না।

যে-লোকটা সেদিকে এগিয়েছিল সে হেমলতার মূর্তি দেখে থমকে গেল। পেছন থেকে একজন বলল, ছেড়ে দে, ঠাকুর-দেবতার সঙ্গে কমিউনিস্ট পত্রিকা থাকে না।

হঠাৎ একটা লোক অনিমেষের দিকে এগিয়ে এল গটগট করে, ওহে খোকাবাবু, তোমার নাম কী?

অনিমেষ কোনোরকমে বলল, অনিমেষ।

লোকটি চিবুক ধরতে অনিমেষের হাত পেটের কাছে চলে গেল সড়াৎ করে, এই যে মিঃ মেষ, প্রিয়বাবু তোমার কে হয় বলো তো?

কাকা। মুখ উঁচু করে ধরে থাকায় অনিমেষের ঘাড়ে লাগছিল।

কাকা! গুড। একটু আগে সে এখানে এসেছিল আমরা জানি, তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল?

অনিমেষ কোনদিন মিথ্যে কথা বলেনি। মা বলেছেন, কখনো মিথ্যে কথা বলবে না। অনি এখন কী করবে? সত্যি কথা বললে কি কাকার খারাপ হবে? কাকা তো চলে গিয়েছে এখান থেকে এই বাড়িতে কাকাকে খুঁজে পাবে না ওরা। তা হলে? সত্যি কথাটা বলে দেবে? লোকটা তখনও ওর মুখ এমন জোরে উঁচু করে রেখেছে যে ঘাড় টানটান করছে। লোকটা ধমকে উঠল, কী হল?

অনিমেষ ফিসফিসিয়ে বলল, আঃ!

লোকটি বলল, কী? না বলে অনিমেষের মুখটা ছেড়ে দিল, শালা বাড়িসুদ্ধ লোক ট্রেইন্ড হয়ে রয়েছে। বুঝলে মিত্তির, এই বাচ্চাটা যখন বড় হবে তখন এই প্রিয়তোষদের চেয়ে থাইজেন্ড টাইমস ফেরোসাস হবে। ওইসব থিওরিটিকাল কমিউনিস্টগুলো তখন পাত্তাই পাবে না। শালা এইটুকুনি বাচ্চাও কেমন ট্রেইন্ড লায়ার। কথাগুলো বলে লোকগুলো অন্য ঘরে চলে গেল।

পাথরের মতো বসে ছিল অনিমেষ। হঠাৎ ওর খেয়াল হল পুলিশটা ওকে লায়ার বলল। লায়ার মানে মিথুক। কখনো না, ও মিথুক নয়। ও কিছুই বলেনি, পুলিশটা নিজে নিজে মনে করে নিয়েছে। ও দৌড়ে পুলিশটাকে কাছে যেতে উঠে পড়তেই হেমলতা ওকে চট করে ধরে ফেললেন, কোথায় যাচ্ছিস?

অনিমেষ ছটফট করছিল, ওরা আমাকে লায়ার বলে গালাগালি দিল। আমি কক্ষনো মিথ্যে বলি। মা তা হলে রাগ করবে। বলো আমি কি মিথ্যক।

দুহাতে ওকে কাছে টেনে নিলেন হেমলতা, কাকু কি এসেছিল?

ঘাড় নাড়ল অনি, যা, এসে বইপত্র নিয়ে গেছে।

হেমলতা জিজ্ঞাসা করেন, কী বই?

অনি বলল, জানি না। তবে একটা বই-এর নাম মার্কসবাদী। আমাকে ছাড়ো, আমি ওদের সত্যি কথা বলে দিয়ে আসি, আমি লায়ার নই। মা বলে গেছে সত্যি বলতে।

হেমলতা কেঁদে ফেললেন, অনি বাবা, যুধিষ্ঠিরও একসময় মিথ্যে বলেছিলেন। কিন্তু তুমি তো বলনি, ওরা তোমার কথা ভুল বুঝেছে। আমার কাছে বসে তুমি মনে মনে মাকে ডাকো, দেখবে তিনি একটুও রাগ করেননি।
 
সমস্ত বাড়ি তছনছ করে পুলিশের গাড়ি শব্দ করে ফিরে গেল। ওরা চলে গেলে বাড়িটা আচমকা নিস্তব্ধ হয়ে গেল যেন। কোথাও কোনো শব্দ নেই, পিসিমার পাশে অনি গা-ঘেঁষে বসে, সরিৎশেখরের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু তিস্তার একগাদা শেয়াল নিজেদের মধ্যে ডাকাডাকি শুরু করে দিল। এই রাত্রে, এখন, জলপাইগুড়ি শহরটা চুপচাপ ঘুমিয়ে। অনিমেষ প্রিয়তোষের কথা ভাবছিল, কাকা নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে নেই। কাকাকে খুঁজতে পুলিশটা চারধারে ছুটে বেড়াচ্ছে। কাকা তো কাউকে হত্যা করেনি, কিন্তু পুলিশগুলোর মুখ দেখে মনে হল সেইরকম খারাপ কিছু কাকা করেছে। এখন কাকা কোথায়? কাকা কেন স্বৰ্গছেঁড়ায় পালিয়ে যাচ্ছে না। স্বৰ্গছেঁড়ায় কোনোদিন পুলিশ যায় না, কাকা সেটা ভুলে গেল কী করে!

এমন সময় শব্দ করে বাইরে দরজাটা বন্ধ হল। বিদ্যাসাগরি চটির আওয়াজটা এ-ঘরের দরজায় এসে থামল! অনি তাকিয়ে দেখল দাদুর চোখে চশমা নেই, কেমন রোগা লাগছে মুখটা। অদ্ভুত শূন্য গলায় সরিৎশেখর বললেন, বুঝলে হেম, এই শুরু হল, আমাকে আরও যে কত দেখে যেতে হবে!

হেমলতা খুব ধীরে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে?

চিৎকার করে উঠলেন সরিৎশেখর, তোমার ভাই কমিউনিস্ট হয়েছে, আমার গুষ্টির পিণ্ডি হয়েছে।

হেমলতা বললেন কমিউনিস্টা সে আবার কী?

সরিৎশেখর বললেন, দেশ উদ্ধার করছেন, আমরা যে এতদিন পর স্বাধীনতা পেলাম তাতে বাবুদের মন উঠছে না, সারা দেশ তাতিয়ে বেড়াচ্ছেন। মেরে হাড় ভেঙে দেবে জওহরলাল। আমি এসব বরদাস্ত করব না, একটা মাতাল লম্পটকে তাড়িয়েছি, এটাও যেন কোনোদিন বাড়িতে না ঢোকে। এই ছেলের জন্য এত রাত্রে আমাকে হেনস্তা হতে হল!

হেমলতা বললেন, প্রিয় আবার কবে ওসব দলে ভিড়ল!

সরিৎশেখর খেঁকিয়ে উঠলেন, তোমারই তো দোষ, নিজের ভাই কী করছে খেয়াল রাখতে পার।

হেমলতা উত্তেজিত হরেন, আমার ভাই, কিন্তু আপনার তো ছেলে।

সরিৎশেখর একটুও অপ্রস্তুত না হয়ে বলে চললেন, তখন যদি গুদামবাবুর মেয়েটার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিতাম তা হলে আর এই দুর্ভোগ হত না। তুমিই তো তখন খ্যাঁক খ্যাঁক করেছিল।

হেমলতা কোনো জবাব দিলেন না। প্রিয়তোষের ব্যাপারটা তিনি বুঝতে পারছিলেন না ঠিক। কিন্তু গুদামবাবুর মেয়ে তপুকে বাড়ির বউ হিসেবে মাধুরীর পাশে তিনি ভাবতেই পারেন না।

এমন সময় সরিৎশেখর অনিমেষের দিকে তাকালেন, তুমি এত রাত্রে জেগে ছিলে কেন?

অনিমেষ ভয়ে-ভয়ে দাদুর দিকে তাকাল। রাগলে দাদুকে ভয়ংকর দেখায়। কী বলবে ভাবতে-না-ভাবতেই সরিৎশেখর ধমকে উঠলেন, কথা জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দাও না কেন? ভাগ্যিস হেমলতা একটা হাত ওর পিঠের ওপর ছিল নইলে সে কেঁদে ফেলত। সরিৎশেখর এবার সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন, প্রিয়তোষ কি এসেছিল। চট করে ঘাড় নাড়ল অনিমেষ, যা। প্রথম থেকেই এইরকম একটা সন্দেহ করেছিল সরিৎশেখর, কিন্তু নাতির মুখের দিকে তাকিয়ে এখন হতবাক হয়ে গেলেন। পুলিশ অফিসারটা যখন ধমকাচ্ছিল তখন অনিমেষ একথা স্বীকার করেনি তো! ঐটুকু শিশু! সরিৎশেখর জিজ্ঞাসা করলেন, আমাকে ডাকনি কেন?

বিড়বিড় করে অনিমেষ বলল, আমাকে শব্দ করতে মানা করেছিল কাকা। আমার মন-খারাপ লাগছিল।

কেন।

কাকার শরীর খুব খারপ হয়ে গেছে, জামাকাপড় ময়লা।

হুম্‌। কী করল সে?

বইপত্র নিয়ে চলে গেল।

কী বই?

অনেক বই। একটার নাম মার্কসবাদী।

ও! সর্বনাশ তা হলে অনেক ভেতরে গেছে। কী বলল?

আমি সব কথা বুঝিনি, শুধু একটা কতা মনে আছে-এ আজাদি ঝুটা হ্যায়।

ছাই হ্যায়! চিষ্কার করে উঠলেন সরিৎশেখর, সব জেনে বসে আছে, আজাদির তোরা কী বুঝিস রে। নেতাজিকে গালাগালি দিস, রবীন্দ্রনাথকে গালাগালি দিস, ক্ষুদিরাম বাঘা যতীন-এঁদের কথা ভুলে যাস-ননসেন্স ; হঠাৎ অনির দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, এসব একদম বাজে কথা, তুমি কান দিও না।
 
নিজের ঘরের দিকে যেতে-যেতে তার মনে পড়ল ঐ বালকটি আঠারো বছর বয়সে জেলে যাবে। বুকের ভিতর দুরমুশ শুরু হয়ে গেল ওর-কী জানি–আজ রাত্রে তার বীজবপন হয়ে গেল কি না। ওর দিকে নজর রাকতে হবে, ওকে নিজের মতো করে গড়তে হবে।

ঘাড় ঘুরিয়ে সরিৎশেখর দেখলেন পায়েপায়ে অনিমেষ তার দিকে এগেিয় আসছে। ওর হাঁটার ধরন দেখে খুব অবাক হলেন সরিৎশেখর। খুব শান্ত গলায় নাতিকে ডাকলেন তিনি, কছি বলবে? ঘাড় নাড়ল অনিমেষ। তারপর সরিৎশেখরের একদম কাছে এসে পেটের ওপর প্যান্টের ভাজ থেকে সেই নীল চিঠিটা বের করে দাদুকে দিল। অবাক হয়ে চিঠিটা নিয়ে নিজের ঘরে গেলেন সরিৎশেখর, টেবিলের ওপর রাখা চমশাটা তুলে সেটা পড়লেন। অনেকক্ষণ বাদে ডাক এল অনিমেষে, তুমি এটা কোথায় পেলে?

কাকার সুটকেসে।

পড়েছ?

মাথা নাড়ল অনিমেষ, হ্যাঁ।

চোখ বন্ধ করলেন সরিৎশেখর, কিছু বুঝেছ।

ভয়ে-ভয়ে অনি ঘাড় নাড়ল, না।

যাও। শুয়ে পড়ে। প্রিয়তোষ যদি আসে আমাকে না বলে দরজা খুলবে না।

চলে যেতে-যেতে অনিমেষ দেখল দাদু আলমারির ভেতর চিঠিটা রেখে দিয়ে তালা বন্ধ করছেন।

হঠাৎ অনির মনটা তপুপিসির জন্য কেমন করে উঠল।

স্কুলের প্রথম বছরে অনিমেষের স্বৰ্গছেঁড়ায় যাওয়া হয়নি। মহীতোষ ওখানে অত বড় কোয়ার্টারে একা আছেন ঝড়িকে নিয়ে। সে-ই রান্নাবান্না করে সংসার সামলায়। গরমের ছুটিতে বা পূজার সময় সরিৎশেখর ভেবেছিলেন নাতিকে পাঠাবেন, কিন্তু মহীতোষই আপত্তি করেছেন। ওখানে গেলে মাধুরীর কথা বারবার মনে হবে অনিমেষের। হেমলতার হয়েছে মুশকিল, হাজার দোষ করলেও ভাইপোকে বকামারা চলবে না, সরিৎশেখরের হুকুম। মহীতোষ দুদিন ছুটি থাকলেই শহরে চলে আসেন, কিন্তু ছেলের সঙ্গে ইচ্ছে থাকলেও মিশতে পারেন না ঠিকমতো। কোথায় যেন আটকে যায়। ঐটুকুনি ছেলে একা একা শোয়, একা একা বাগানে ঘোরে, কী গভীর দেখায়। পড়াশুনায় রেজাল্ট ভালোই হচ্ছে। হেডমাস্টারমশাই সরিৎশেখরকে বলেছেন, হি ইজ একসেপনাল, অত্যন্ত লাজুক। জলপাইগুড়ি শহরে কমিউনিস্ট পার্টির ব্যাপারে আর তেমন হইচই হচ্ছে না। কংগ্রেসের মিছিল বেরুচ্ছে ঘনঘন। প্রিয়তোষের খবর পাওয়া যায়নি আর। মহীতোষের এক ক্লাসমেট জলপাইগুড়ি থানায় পোস্টেড হয়ে এল, সেও কোনো খবর দিতে পারল না। পরিষ আসামে এক কাঠের ঠিকাদারের কাছে সামান্য মাইনেতে কাজ করছে এ-খবর মহীতোষ পেয়েছেন। যে খবর এনেছে সে পরিতোষের বউকে নাকি দেখেছে। খবরটা বাবাকে জানাতে পারেননি মহীতোষ। বড়দার কথা শুনলেই বাবার মেজাজ চড়ে যায়।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top