বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে মহীতোষ দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন, বন্যা এসে গেছে, এখন তো নিয়ে যাওয়ার কোনো প্রশ্ন ওঠে না।
প্রিয়তোষ বলল, কী হয়েছে?
মহীতোষ বললেন, তোর বউদির পড়ে গিয়ে ব্লিডিং হচ্ছে, অবস্থা সিরিয়াস।
প্রিয়তোষ বলল, সে কী! হয়েছে?
মহীতোষ বললেন, সে কী! কখন?
সরিৎশেখর একবার ওপরের দিকে তাকিয়ে জলের মধ্যে গেলেন। অন্ধকারে চলতে কষ্ট হচ্ছে, প্রিয়তোষ ওঁর পিছনে। ছোট ঘরে তখন পায়ের পাতার ওপর জল। কী নেওয়া যায় কী নেওয়া যায় ভাবতে না পেরে আবিষ্কার হল অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। দ্রুত জল বাড়ছে। হাঁটুর কাছটা যখন ভিজে গেল তখন মহীতোষ টর্চটা খুঁজে পেলেন। খাটের অনেকটা এখন জলের তলায়। লেপ তোশক নিয়ে যাবার কোনো মানে হয় না। মেঝেয় রাখা সুটকেসটা তুলে নিলেন। মহীতোষের টাকা এই সুইটকেস আছে। সুটকেসটা এর মধ্যে ভিজে ঢোল হয়ে গেছে।
নতুন বাড়ির বারান্দায় ইঞ্চি কয়েক নিচে জল। মহীতোষ ছাদের সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়াতে দেখলেন সরিৎশেখর ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলছেন। হারিকেনের আলোয় দেওয়ালে ওদের ছায়া কাঁপছে। ছেলেকে দেখে সরিৎশেখর কাপা-কাঁপা গলায় বললেন, আমি কিছু ভাবতে পারছি না মহী, ভগবান এ কী করলে!
মহীতোষ ডাক্তারবাবুর দিকে তাকাতেই তিনি বললেন, হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারলে একটা চেষ্টা করা যেত। কিন্তু যা অবস্থা-জল শুনলাম বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়েছে! মহীতোষ ঘাড় নাড়লেন।
হয়ে গেল তা হলে! ডাক্তারবাবু ছটফট করে উঠলেন, ভোরের আগে কোনোবার জল কমে। এইজন্যেই আমি আসতে চাইছিলাম না। এখন আমি যাই কী করে! অন্ধকারে জল ভেঙে যেতে কোথায় পড়ব-ইস!
মহীতোষ বললেন, ডাক্তারবাবু, আপনি চলে গেলে ওকে নিয়ে আমরা-না, আপনার যাওয়া চলবে না। আপনি ওকে দেখুন, আমি আপনার বাড়িতে খবর দিয়ে আসছি।
কথাটা শেষ হতে প্রিয়তোষ আমি খবর দিয়ে আসি বলে অন্ধকারে ছুটে বেরিয়ে গেল। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ডাক্তারবাবু বললেন, আমি আর দেখে কী করব! চোখের সামনে মেয়েটা চলে যাচ্ছে আমি ফ্যালফ্যাল করে দেখছি। ভগবানকে ডাকুন।
সেটা বেরুলে তো বুঝতে পারা যেত। এতগুলো ইঞ্জেকশন দিলাম, রক্ত বন্ধ করা যাচ্ছে না। বিড়বিড় করে বকতে বকতে ডাক্তারবাবু ওপরে উঠে গেলেন।
এখন এখানে শুধু ঝোড়ো বাতাস ছাড়া কোনো শব্দ নেই। বাইরে তিস্তার জল নতুন বাড়ির বারান্দার গায়ে ধাক্কা লেগে যে-শব্দ তুলছে তাও বাতাসে চাপা পড়ে গেছে। মহীতোষ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে। সরিৎশেখর নাতিকে দুহাতে জড়িয়ে ওপরের দিকে মুখ করে বসে আছেন সিঁড়িতে। লণ্ঠনের আলোয় দেওয়ালে-পড়া তাদের ছায়াগুলো নিয়ে বাতাস উদ্ভ ছবি এঁকে এঁকে যাচ্ছে। সময় এখন খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগুচ্ছে। যে-কোনো মুহূর্তে ওপর থেকে কোনো শব্দ ভেসে আসবেএইরকম একটা আশঙ্কায় দুটো গরম কাঁটা হয়ে রয়েছে। দাদুর বুকের ওপর মাথা রেখে অনি অনেকক্ষণ ধরে দুপদুপ বাজনা শুনছিল। এতক্ষণ যেসব কথাবার্তা এখানে হয়ে গেল তার প্রতিটি শব্দ ওর কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। মা আর থাকবে না। ডাক্তারবাবু ওদের ভগবানকে ডাকার কথা বললেন, কিন্তু কেউ ডাকছে না কেন? অনির মনে পড়ল স্বৰ্গছেঁড়ায় এক বিকেলবেলায় হেমলতা ওকে বলেছিলেন সবচেয়ে বড় ভগবান হল মা। অনি সমস্ত শরীর দিয়ে মনে মনে মাকে ডাকতে লাগল। চোখ বন্ধ করে নিঃশব্দে, মা, মা উচ্চারণ করতে করতে অনি দেখতে পেল মাধুরী ওর কাছে এসে দুহাতে ওকে জড়িয়ে ধরেছেন। মায়ের গায়ের সেই গন্ধটা বুক ভরে নিতে নিতে ও শুনতে পেল পিসিমা সিড়ির মুখে এসে বলছেন, অনিকে একটু ওপরে নিয়ে আসুন।
কথাটা শুনে তড়াক করে উঠে দাঁড়াল অনি। অন্ধকারে সিঁড়িগুলো লাফ দিয়ে পেরিয়ে এসে পিসিমার মুখোমুখি হয়ে গেল ও। অনিকে দেখে হেমলতা দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন। অনি বুঝতে পারল পিসিমা কাঁদছেন। কয়েক পা এগিয়ে হেমলতা আবার থমকে দাঁড়ালেন। অনির মাথাটা ওঁর প্রায় কাঁধবরাবর। অনি শুনতে পেল কেমন কান্না-কান্না গলায় পিসিমা ওকে বলছেন, অনি বাবা, আমার সোনাছেলে, তোমার মা এখন ভগবানের কাছে চলে যাচ্ছেন, যাওয়ার আগে তোমাকে দেখতে চাইছেন। হুহু করে কেঁদে ফেললেন হেমলতা।
অনি বলল, মা-ই তো ভগবান। তবে মা কার কাছে যাচ্ছে।
ফিসফিস করে হেমলতা বললেন, আমি জানি না বাবা, তুমি কোনো কথা বোলে না, বেশি কেঁদো, তাহলে মার যেতে কষ্ট হবে। পিসিমার বারণ তিনি নিজেই মানছিলেন না।
প্রিয়তোষ বলল, কী হয়েছে?
মহীতোষ বললেন, তোর বউদির পড়ে গিয়ে ব্লিডিং হচ্ছে, অবস্থা সিরিয়াস।
প্রিয়তোষ বলল, সে কী! হয়েছে?
মহীতোষ বললেন, সে কী! কখন?
সরিৎশেখর একবার ওপরের দিকে তাকিয়ে জলের মধ্যে গেলেন। অন্ধকারে চলতে কষ্ট হচ্ছে, প্রিয়তোষ ওঁর পিছনে। ছোট ঘরে তখন পায়ের পাতার ওপর জল। কী নেওয়া যায় কী নেওয়া যায় ভাবতে না পেরে আবিষ্কার হল অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। দ্রুত জল বাড়ছে। হাঁটুর কাছটা যখন ভিজে গেল তখন মহীতোষ টর্চটা খুঁজে পেলেন। খাটের অনেকটা এখন জলের তলায়। লেপ তোশক নিয়ে যাবার কোনো মানে হয় না। মেঝেয় রাখা সুটকেসটা তুলে নিলেন। মহীতোষের টাকা এই সুইটকেস আছে। সুটকেসটা এর মধ্যে ভিজে ঢোল হয়ে গেছে।
নতুন বাড়ির বারান্দায় ইঞ্চি কয়েক নিচে জল। মহীতোষ ছাদের সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়াতে দেখলেন সরিৎশেখর ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলছেন। হারিকেনের আলোয় দেওয়ালে ওদের ছায়া কাঁপছে। ছেলেকে দেখে সরিৎশেখর কাপা-কাঁপা গলায় বললেন, আমি কিছু ভাবতে পারছি না মহী, ভগবান এ কী করলে!
মহীতোষ ডাক্তারবাবুর দিকে তাকাতেই তিনি বললেন, হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারলে একটা চেষ্টা করা যেত। কিন্তু যা অবস্থা-জল শুনলাম বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়েছে! মহীতোষ ঘাড় নাড়লেন।
হয়ে গেল তা হলে! ডাক্তারবাবু ছটফট করে উঠলেন, ভোরের আগে কোনোবার জল কমে। এইজন্যেই আমি আসতে চাইছিলাম না। এখন আমি যাই কী করে! অন্ধকারে জল ভেঙে যেতে কোথায় পড়ব-ইস!
মহীতোষ বললেন, ডাক্তারবাবু, আপনি চলে গেলে ওকে নিয়ে আমরা-না, আপনার যাওয়া চলবে না। আপনি ওকে দেখুন, আমি আপনার বাড়িতে খবর দিয়ে আসছি।
কথাটা শেষ হতে প্রিয়তোষ আমি খবর দিয়ে আসি বলে অন্ধকারে ছুটে বেরিয়ে গেল। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ডাক্তারবাবু বললেন, আমি আর দেখে কী করব! চোখের সামনে মেয়েটা চলে যাচ্ছে আমি ফ্যালফ্যাল করে দেখছি। ভগবানকে ডাকুন।
সেটা বেরুলে তো বুঝতে পারা যেত। এতগুলো ইঞ্জেকশন দিলাম, রক্ত বন্ধ করা যাচ্ছে না। বিড়বিড় করে বকতে বকতে ডাক্তারবাবু ওপরে উঠে গেলেন।
এখন এখানে শুধু ঝোড়ো বাতাস ছাড়া কোনো শব্দ নেই। বাইরে তিস্তার জল নতুন বাড়ির বারান্দার গায়ে ধাক্কা লেগে যে-শব্দ তুলছে তাও বাতাসে চাপা পড়ে গেছে। মহীতোষ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে। সরিৎশেখর নাতিকে দুহাতে জড়িয়ে ওপরের দিকে মুখ করে বসে আছেন সিঁড়িতে। লণ্ঠনের আলোয় দেওয়ালে-পড়া তাদের ছায়াগুলো নিয়ে বাতাস উদ্ভ ছবি এঁকে এঁকে যাচ্ছে। সময় এখন খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগুচ্ছে। যে-কোনো মুহূর্তে ওপর থেকে কোনো শব্দ ভেসে আসবেএইরকম একটা আশঙ্কায় দুটো গরম কাঁটা হয়ে রয়েছে। দাদুর বুকের ওপর মাথা রেখে অনি অনেকক্ষণ ধরে দুপদুপ বাজনা শুনছিল। এতক্ষণ যেসব কথাবার্তা এখানে হয়ে গেল তার প্রতিটি শব্দ ওর কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। মা আর থাকবে না। ডাক্তারবাবু ওদের ভগবানকে ডাকার কথা বললেন, কিন্তু কেউ ডাকছে না কেন? অনির মনে পড়ল স্বৰ্গছেঁড়ায় এক বিকেলবেলায় হেমলতা ওকে বলেছিলেন সবচেয়ে বড় ভগবান হল মা। অনি সমস্ত শরীর দিয়ে মনে মনে মাকে ডাকতে লাগল। চোখ বন্ধ করে নিঃশব্দে, মা, মা উচ্চারণ করতে করতে অনি দেখতে পেল মাধুরী ওর কাছে এসে দুহাতে ওকে জড়িয়ে ধরেছেন। মায়ের গায়ের সেই গন্ধটা বুক ভরে নিতে নিতে ও শুনতে পেল পিসিমা সিড়ির মুখে এসে বলছেন, অনিকে একটু ওপরে নিয়ে আসুন।
কথাটা শুনে তড়াক করে উঠে দাঁড়াল অনি। অন্ধকারে সিঁড়িগুলো লাফ দিয়ে পেরিয়ে এসে পিসিমার মুখোমুখি হয়ে গেল ও। অনিকে দেখে হেমলতা দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন। অনি বুঝতে পারল পিসিমা কাঁদছেন। কয়েক পা এগিয়ে হেমলতা আবার থমকে দাঁড়ালেন। অনির মাথাটা ওঁর প্রায় কাঁধবরাবর। অনি শুনতে পেল কেমন কান্না-কান্না গলায় পিসিমা ওকে বলছেন, অনি বাবা, আমার সোনাছেলে, তোমার মা এখন ভগবানের কাছে চলে যাচ্ছেন, যাওয়ার আগে তোমাকে দেখতে চাইছেন। হুহু করে কেঁদে ফেললেন হেমলতা।
অনি বলল, মা-ই তো ভগবান। তবে মা কার কাছে যাচ্ছে।
ফিসফিস করে হেমলতা বললেন, আমি জানি না বাবা, তুমি কোনো কথা বোলে না, বেশি কেঁদো, তাহলে মার যেতে কষ্ট হবে। পিসিমার বারণ তিনি নিজেই মানছিলেন না।