What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected উত্তরাধিকার - সমরেশ মজুমদার (2 Viewers)

মেয়েটি চলে যাবার পর অসাড় হয়ে অনি শুয়ে থাকল বালির ভেতর। ওর মাথা ঘুরছিল এবং বুঝতে পারছিল ওরা খুব খারাপ কিছু করছিল যেটা সবার সামনে করা যায় না। মেয়েটা তা হলে। প্রথমে অত ছটফট করছিল কেন? কেন লোকটাকে ঘুসি মারছিল। আবার পরে লোকটা যখন ওর বুকে। অমন দাঁত বসিয়ে দিল তখন ও কেন যন্ত্রণা পায়নি? কেন তখনও ও মজুরটাকে আদর করছিল। হঠাৎ ওর মালবাবুর ছোট মেয়ে সীতার কথা মনে পড়ে গেল। সীতা ওর চেয়ে এক বছরের ছোট। বাড়ি থেকে খুব কম বের হয়। কিন্তু ওর হাত একটু শক্ত করে ধরলে ভ্যা করে কেঁদে ফেলে। সীতাও কি বুকে ওরকম করে কামড়ে দিলে কাঁদবে না। সঙ্গে সঙ্গে ওর মনে পড়ল সীতার বুক তো ওদের মতোই একদম সমান। তা হলে বড় হলে সীতার বুক নিশ্চয়ই এই কামিনটার মতো হয়ে যাবে। আর বুক বড় হলে মেয়েটার নিশ্চয়ই ব্যথা লাগে না। সমস্যাটার এইরকম একটা সমাধান করতে পেরে অনির অন্যমনস্ক হয়ে পড়তেই চাপ লেগে বালির দেওয়াল ধসে পড়ল। অনি দেখল ওপরের বালি হুড়মুড়িয়ে তাকে চাপা দিতে আসছে। কোনোরকমে টেনে-হিঁচড়ে ও বাইরের খোলা হাওয়ায় বেরিয়ে এল।

বাড়ি শেষ হয়ে গেলে হেমলতার চাপে সরিৎশেখর ঘটা করে গৃহপ্রবেশের ব্যবস্থা করলেন। ঝকঝকে তকতকে বাড়ির দিকে তাকালে তার চোখ জুড়িয়ে যায়। নতুন রঙ আর সিমেন্টের গন্ধ নাক ভরে নেন তিনি। সাধুচরণের সঙ্গে এখানকার কালীবাড়ির পুরোহিতদের খুব ভাব আছে। তিনি সরিৎশেখরকে কলকাতার কাছে হালিশহরে এক তান্ত্রিকে খবর দিলেন, যিনি নাকি সিদ্ধ পুরুষ। অনেক চেষ্টাচরিত্র করে তাকে আনানোর ব্যবস্থা হল। স্বৰ্গছেঁড়া থেকে সবাই এসে হাজির। এখানে আসার পর অনি একদিনও স্বৰ্গছেঁড়ায় যায়নি। সরিৎশেখর পাঠাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু মহীতোষ জানিয়েছিলেন এত ঘনঘন এলে শহরে মন বসবে না। মাধুরী আসার পর হেমলতা বললেন, দ্যাখ, তোর ছেলে কত রোগা হয়ে গেছে।

মাধুরী ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, নোগা কোথায়, ও দেখছি বেশ লম্বা হয়েছে!

হেমলতা বললেন, হবে না কেন? এ-বংশের ধারাই তো লম্বাটে।

একসময় একটু একলা পেয়ে মাধুরী ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁ রে, আমার জন্যে তোর মন-কেমন করে না? আর সঙ্গে সঙ্গে অনি ভ্যা করে কেঁদে ফেলল।

সেই কান্না শুনে বাড়ির সবাই ছুটে এসে দেখল অনি মাধুরীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। মাধুরী ছেলেকে যত থামাতে চান কান্না তত বেড়ে যেতে লাগল। শেষ পর্যন্ত হেমলতা বললেন, না ভাই, এতদিন পর দেখা হল আর তুমি ওকে বকাবকি করছ-এটা উচিত হয়নি।

এমনকি সরিৎশেখর অবদি যেতে-যেতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে বললেন, না বৌমা, তুমি বড় ছেলেকে শাসন কর। মাধুরী লজ্জায় মরে যান। ছেলে যে এভাবে কেঁদে উঠবে বুঝতে পারেননি তিনি।

তোড়জোড় চলতে লাগল গৃহপ্রবেশের। কাল মঙ্গলবার, সব মিলিয়ে দিন ভালো। আত্মীয়স্বজন তো আছেনই, সরিৎশেখর শহরের সমস্ত বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করেছেন। কিন্তু আজ সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা, টিপটিপিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। কে যেন এসে বলে গেল তিস্তার জল বেড়েছে। তোরে বেড়াতে যাবার সময় সরিৎশেখর তেমন কিছু লক্ষ করেননি। উঠোনে ভিয়েন বসেছে। কাল দুপুরে খাওয়াদাওয়া হলেও আজ থেকে মেয়েদের রান্নাঘরে যেতে হচ্ছে না। সন্ধের ট্রেনে হালিশহরের সিদ্ধপুরুষ একজন শিষ্যসমেত এসে গেলেন। সরিৎশেখর মহীতোষকে নিয়ে স্টেশনে গিয়েছিলেন তাকে আনতে। কিন্তু তিনি সোজা গিয়ে কালীবাড়িতে উঠলেন। ঠিক হল পরদিন ভোরে পুরোহিমশাই-এর সঙ্গে উনি চলে আসবেন। খাওয়াদাওয়া সারতে রাত হয়ে গেল। ঠিক হল টিনের চালায় মেয়েরা বাচ্চাদের নিয়ে শোবেন। যেহেতু গৃহপ্রবেশ এখনও হয়নি তাই সরে নয়, নতুন বাড়ির ঢাকা বারান্দায় শতরঞ্জি বিছিয়ে ছেলেদের শোওয়ার ব্যবস্থা হল। শোওয়ার আগে ক্যাম্পখাট পেতে সরিৎশেখর একবার অনির খোঁজ করতে হেমলতা বললেন, ও মায়ের সঙ্গে শোবে।
 
বড় ঘর থেকে খাটটা সরানো গেল না। তাই মেয়েরা মাটিতে ঢালাও বিছানা পেতে শুলেন। খাটের ওপর মাধুরী আর অনি। মাধুরী নিচেই শুতে চেয়েছিলেন, হেমলতা বকাবকি করাতে রাজ হতে হল।

মায়ের কাছে এতদিন বাদে শুয়ে অনির কিছুতেই ঘুম আসছিল না। মায়ের গন্ধ মায়ের নরম হাত ওকে কেমন আবিষ্ট করে রেখেছিল। মাধুরী একসময় চাপা গলায় বললেন, তুই সকালে অমন বোকার মতো কাদলি কেন? সবাই আমাকে বকল!

অন্ধকার ঘরে মায়ের বুকের কাছে মুখ রেখে অনি বলল, তুমি আমাকে বললে কেন তুমি জান

বুঝি! মাধুরী ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। মায়ের বুকের ওপর গাল রাখতে গিয়ে অনির চট করে সেই কামিনটার কথা মনে পড়ে গেল। ও বলল, মা, তোমার বুকে যদি আমি কামড়ে দাগ করে। দিই তা হলে তোমার লাগবে না।

চাপা গলায় ছেলের প্রশ্নটা শুনে মাধুরী হকচকিয়ে গেলেন। অনি যে এ-ধনের প্রশ্ন করবে ভাবতেই পারেননি। কোনোরকমে বললেন, মানে?

অনি বলল, জান, এখানে না একটা কামিনের বুকে একটা কুলি অনেক দাঁত বসিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু কামিনটা একদম কাদেনি। বড় বুকে কামড়ালে লাগে না, না?

উত্তেজনায় মাধুরী উঠে বসতে যাচ্ছিলেন, কোনোরকমে কৌতূহল চেপে জিজ্ঞাসা করলেন, তুই কী করে জানলি?

তখন অনি পুটুরপুটুর করে মাকে সব কথা বলল, এমনকি সীতার কথাটাও। মাধুরী কী করবেন প্রমটা বুঝতে পারছিলেন না। ব্যাপারটা খারাপ বললে ছেলের যদি কৌতূহল বেড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত মাধুরী বললেন, ওরা ভীষণ অন্যায় করেছে তাই লুকিয়েছিল। তুমি ওসব আর দেখো না। ওসব দেখলেও পাপ হয়, ভগবান রাগ করেন।

অনি বলল, আমার তা হলে পাপ হয়েছে।

মাধুরী ছেলের মাথায় হাত রাখলেন, না না, মায়ের কাছে সব কথা খুলে বললে কোনো পাপ আর থাকে না। তুমি চিরকাল আমাকে সব কথা খুলে বোলা অনি।

মাধুরীর খেয়াল হল তার পেটে আর-একটি সন্তান এসে গেছে। এই অবস্থায় টানটান হয়ে শোওয়া উচিত নয়। মাধুরী হাঁটু দুটো পেটের কাছে নিয়ে এসে পাশ ফিরে শুলেন।

সিদ্ধপুরুষ তান্ত্রিকের নামশনিবাবা। বিশাল তার চেহারা, যেমন ভূঁড়ি তেমনি লম্বা। লাল কাপড় পরে খড়ম-পায়ে রিকশা থেকে যখন নামলেন তখন অনির ভয়ে চোখ বন্ধ হবার যোগাড়। পিসিমা আগে গল্প করেছিলেন, তান্ত্রিকেরা নাকি ইচ্ছে করলে যা-খুশি করতে পারে। শনিবাবাকে দেখলেই বুক হিম হয়ে যায়, সামনে যাবে কী!
 
পূজোয় বসার আগে শনিবাবা একবার নতুন বাড়ির চারপাশে পাক দিয়ে এলেন। যে-ঘরটা ঠাকুরঘর হবে বলে হেমলতা ঠিক করেছিলেন সেখানেই পূজোর আসন পাতা হয়েছে। আসনে বসে অনেকক্ষণ ধ্যানস্থ হয়ে থাকলেন শনিবাবা। ওর সামনে কোনো মূর্তি নেই। শুধু চারটে মোটা চন্দনকাঠের টুকরো ছড়ানো বালির ওপর সাজানো রয়েছে। শনিবাবার অনেকটা পিছনে ঘরের মধ্যে সরিৎশেখর হাঁটু গেড়ে বসে, তার পেছনে পুরোহিতমশাই, মহীতোষ এবং সাধুচরণ বসে আছেন। প্রিয়তোষ রান্নাবান্নার দিকটা তদারক করছে। মেয়েরা ভিড় করে দরজায় দাঁড়িয়ে, ভেতরে ঢুকতে সাহস পাচ্ছে না কেউ। ওঁদের আড়ালে দাঁড়িয়ে সামান্য ফাঁক দিয়ে অনি শনিবাবার পিঠটা দেখতে পাচ্ছে। হেমলতা মাধুরীকে বলেছেন অনিকে যেন শনিবার সামনে খুব একটা যেতে না দেওয়া হয়। কারণ তান্ত্রিক-মানুষকে বিশ্বাস নেই, ছোট ছেলেমেয়ের প্রতি ওঁদের নাকি আগ্রহ থাকে। শোনার পর থেকে মাধুরী ছেলেকে আগলে-আগলে রাখছেন।

হঠাৎ শনিবাবা টানটান হয়ে বসলেন। তারপর চোখ খুলে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। ঘরের সবাই অবাক হয়ে তার দিকে তাকাতেই বাজখাই গলায় তিনি ডাকলেন, সরিৎশেখর।

সরিৎশেখর চমকে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন।

শনিবাবা বললেন, এত অমঙ্গলের ছায়া কেন? এত শক্ত কেন তোমার?

উত্তরে সরিৎশেখর কোনোরকমে বললেন, সে কী!

শনিবাবা বললেন, এর মধ্যেই ওরা কাজ শুরু করে দিয়েছে। এভাবে চললে খুব শীঘ্ৰ তোমার অঙ্গহানি হবে। আমি বাড়িতে ঢুকতেই অনুভব করেছিলাম কেউ-একজন খুশি হল না।

সরিৎশেখর হাতজোড় করে বললেন, আমি তো জেনেশুনে কোনো অন্যায় করিনি বাবা-আপনি দেখুন।

শনিবাবা বললেন, এই বাড়ি বাঁধতে হবে। তোমরা একটা কুলোয় চারটে প্রদীপ, চার পাত্র দুধ, রটে ফল আর চারটে জবাফুল তুলসীপাতার ব্যবস্থা করো এক্ষুনি! কথা শেষ হওয়ামাত্র সরিৎশেখর রজায় দাঁড়ানো মেয়েদের দিকে তাকালেন। সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড় করে মেয়েরা ছুটল জিনিসগুলোর ব্যবস্থা করতে। মোটামুটি সবই পুজোর ব্যাপারে আনা ছিল। কয়েক মিনিটের মধ্যে সরিৎশেখর কুলোটাকে শনিবাবার সামনে ধরলেন। সেদিকে একবার চোখ বুলিয়ে শনিবাবা মাটিতে রাখা তার লাল ঝুলিটা থেকে একটা কাঠোর বাক্স বের করলেন। কাঠের বাক্সের ডালাটা সন্তর্পণে খুলতে সরিৎশেখর দেখতে পেলেন তার মধ্যে দুইঞ্চিটাকে লম্বা চারটে ফণাতোলা গোখরে সাপ রয়েছে। কুচকুচে কালো ইস্পাতের তৈরি সাপগুলোর ফণার ডগা খুব উঁচলো। চট করে জ্যান্ত বলে ভুল হয়। শনিবাবা সেগুলো বের করে কুলোর উপর রাখলেন। তারপর বললেন, এরা তোমার বাড়ি রক্ষা। করবে। এই কুলোটাকে মাথার ওপর নিয়ে তুমি বাইরে চলো। এদের প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

সম্মোহিতের মতো সরিৎশেখর কুলো মাথায় তুলে নিলেন। মেয়েরা সঙ্গে সঙ্গে দরজা ছেড়ে দল। মাধুরী ছেলেকে আড়াল করে সবে দাঁড়ালেন। প্রথমে শনিবারা, তার পেছনে কুলো-মাথায় সরিৎশেখর, পুরোহিত মশাই, মহীতোষ, সাধুচরণ লাইন দিয়ে ঘর থেকে বেরুলেন। যেতে-যেতে শনিবাবা বললেন, একটা কোদাল আনতে বলল কাউকে। কথাটা শুনে দূরে দাঁড়ানো প্রিয়তোষ একছুটে কোদাল নিয়ে এল।
 
শনিবাবা প্রথমে গেলেন বাড়িটার পূর্ব-দক্ষিণ কোণে। তারপর কী ভেবে বাগান পেরিয়ে একদম বাউভারির কোণায় চলে এসে ইঙ্গিতে প্রিয়তোষকে মাটি খুঁড়তে বললেন। প্রিয়তোষ যখন অনেকটা গর্ত করে ফেলেছে তখন তিনি গম্ভীর গলায় মা বলে ডেকে উঠে সরিৎশেখরের কুলো থেকে প্রথমে একটা সাপকে সযতে গর্তের ভেতর বসিয়ে দিলেন। তারপর নৈবেদ্যর মতো প্রদীপ, ফল, ফুল একটা করে তার সামনে সাজিয়ে তিনি নিজের হাতে মাটিচাপা দিতে লাগলেন। মাটি সমান হয়ে গেলে বললেন, সাত দিন যেন কেউ এখানে পা না দেয়। যে দেবে তার মৃত্যু অনিবার্য।

একে একে বাড়ির আর তিনটে কোণে সাপ প্রতিষ্ঠা করা হয়ে গেলে হঠাৎ হাওয়া উঠল বেশ। গাছের ডালপালাগুলো শব্দ করে দুলতে লাগল। শনিবাবা একবার আকাশের দিকে মুখ করে কিছু দেখলেন, তারপর সরিৎশেখরের দিকে তাকিয়ে বললেন, বেঁচে গেলি।

পুজো শুরু হতে নিমন্ত্রিতদের আসা শুরু হয়ে গেল। সরিৎশেখরের নির্দেশে পুজো শেষ না হলে খাওয়াদাওয়া হবে না। বৃষ্টি আসতে পারে যে-কোনো মুহূর্তে, তাই ঢাকা লম্বা বারান্দায় খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। পূজো করতে করতে শনিবাবা অদ্ভুত রহস্যময় হয়ে উঠেছেন। মাঝে-মাঝে অদৃশ্য কাউকে ধমক দিচ্ছেন, হাসছেন, আর ছেলেমানুষদের মতো অভিমান করছেন। শেষে চন্দনকাঠে আগুন জ্বালালেন তিনি। পুড়ছে কাঠ, অদ্ভুত সুগন্ধযুক্ত ধোয়া বেরুচ্ছে তা থেকে। হঠাৎ ঝুলি থেকে কিছু একটা বের করে তাতে ছুড়লেন শনিবাবা। সঙ্গে সঙ্গে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। শনিবাবা সরিৎশেখরকে বললেন, এবার অগ্নি আমায় আকর্ষণ করবে। তোমরা আমাকে ধরে রাখবে। কথাটা বলে শনিবাবা উঠে দাঁড়িয়ে সেই বস্তুটি আরও ঐ আগুনে ছড়িয়ে দিয়ে মা মা বলে ডাকতে লাগলেন। সঙ্গে সঙ্গে আগুনের শিখা বাড়তে লাগল। ক্রমশ তা বিশাল আকার ধারণ করে শনিবার মাথা ছাড়িয়ে উঠে গেল। আর তখনই শনিবাবার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল। খুব। আলতো করে সরিৎশেখর শনিবাবাকে স্পর্শ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন, হঠাৎ মনে হল শনিবাকে কে যেন সামনের দিকে টানছে প্রচও জোরে। একসময় তিনি নিজে যেন আর শনিবাবাকে ধরে রাখতে পারবেন না বলে মনে হল। ওর অবস্থা দেখে পুরোহিত মশাই উঠে এসে হাত লাগালেন। শনিবাবা তখন অনর্গল সংস্কৃত শব্দসংযোগে মাকে ডেকে যাচ্ছেন। ওঁর শরীরের উত্তাপে যেন সরিৎশেখরের হাত পুড়ে যেতে লাগল। শেষ পর্যন্ত কেউ যেন পলতে কমানোর মতো আগুনটাকে কমিয়ে দিতে শনিবার কাঁপুনিটা থেমে গেল। শনিবাবার কাঁপুনিটা যে ইচ্ছাকৃত নয় এটুকু বুঝতে পারছিলেন সরিৎশেখর। কোনো মানুষকে ধরে রাখলে সেটা বোঝা যায়।

পুজো শেষ হয়ে গেলে অনেকক্ষণ আচ্ছন্ন হয়ে রইলেন সরিৎশেখর। অঙ্গহানি কেন হচ্ছিল তার। অঙ্গহানি বলতে উনি কী বোঝালেন? শারীরিক কোনো আঘাত, না কি কোনো প্রিয়জনকে হারানো! আজীবন ম-বাগানের চাকরিতে থেকে ধর্মকর্ম কোনোদিন করেননি তিনি-জ্যোতিষচর্চা অথবা এ-ধরনের ভবিষ্যৎ-বক্তাদের প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র আস্থা নেই। এখন তার যে-বয়েস সেখানে এলে বেশির ভাগ ভাঙালিরা দীক্ষা নেয়। সরিৎশেখরের চিন্তা তার ধার দিয়েও যায় না। এমনকি হেমলতা যখন সেই কুড়ি-বাইশ বছরে তার কাছে এসে বলল যে সে দীক্ষা নিতে চায়-ভীষণ অস্বস্তিতে পড়েছিলেন তিনি। বালবিধবা মেয়েকে পুনর্বিবাহ দেবার মতো পরিবেশ চা-বাগানে ছিল না। হেমলতা সেটাকে পাপ বলে মনে করত। ফলে অনুমতি দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। কিন্তু দীক্ষা। নিয়ে হেমলতার কী হয়েছে। মাঝে-মাঝে জয়গুরু বলা ছাড়া তিনি আর কোনো পরিবর্তন দেখতে পাননি।

শনিবাবাকে দেখে তাঁর প্রথমে ভক্তি জাগেনি। কিন্তু ক্রমশ এই অনুভব তাকে আচ্ছন্ন করেছে যে লোকটি তার চাইতে আলাদা জাতের। মানুষের স্তর বলে যদি কিছু থাকে, শনিবাবা সেদিক দিয়ে তার চেয়ে এগিয়ে আছেন। হোমের সময় তিনি শনিবাবাকে স্পর্শ করে বিদ্যুতের স্বাদ পেয়েছেন। সরিৎশেখরের মনে তান্ত্রিকদের সম্পর্কে একটা প্রচ্ছন্ন মোহ কোথাও লুকিয়ে ছিল, শনিবাবাকে দেখে সেটা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। অথচ শনিবাবাকে আলাদা করে প্রশ্ন করে তিনি উত্তর পেলেন না অঙ্গহানি বলতে কী বোঝাচ্ছেন। এমনকি পূজোআচ্চা শেষ হয়ে গেলে শনিবাবা যখন কিঞ্চিৎ বিশ্রাম নিচ্ছেন মাটিতে গড়িয়ে তখনও তিনি নিরুত্তর থাকলেন।
 
শনিবাবা এখানে রাত্রিবাস করবেন না। সন্ধের ট্রেনেই ফিরে যাবেন। বাইরে মহীতোষ পরিতোষ খাওয়াদাওয়ার তদারকি করছে। সাধুচরণকে অন্যান্য বয়স্ক লোকের সঙ্গে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। শনিবাবা শুধু এক গ্লাস দুধ আর মিষ্টি খেয়ে ঠাকুরঘরের মাটিতে চিত হয়ে বয়ে আছেন। তাঁর শিষ্যটি পায়ের কাছে বসে পদসেবা করছে। পুরোহিত মশাই একটা হাতপাখা নিয়ে বাতাস করছেন তাকে। পাশে বসে সরিৎশেখর খুব নম্র গলায় আবার প্রশ্নটি তুললেন। শনিবাবা হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে তার দিকে বিশাল লাল চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। সে-দৃষ্টির সামনে সরিৎশেখরের খুব অস্বস্তি হতে লাগল। হঠাৎ শনিবাবা বললেন, এই পৃথিবীতে তোমার সবচেয়ে প্রিয়জন কে সরিৎশেখর?

খুব ধীরে নিজের অজ্ঞাতেই সরিৎশেখর বললেন, প্রিয়জন!

হ্যাঁ। যাকে তুমি নিজের পরেই ভালোবাসা!

আমার-। সরিৎশেখর কথাটা শেষ করতে পারলে না।

তাকে আমার সামনে নিয়ে এসো।

সরিৎশেখর বাইরে এলেন। হইহই করে খাওয়াদাওয়া চলছে। প্রিয়তোষ খাবারের ঝুড়ি নিয়ে দৌড়ে গেল। মহীতোষ পরিবেশন তদারকি করছে। মেয়েদের দিকে হেমলতা আর মাধুরী খোরাঘুরি করছে। ছেলে-মেয়ে-বউমার মুখের দিকে তাকালেন তিনি-এরা সবাই তার প্রিয়জন। এই মুহূর্তে বড় ছেলে পরিতোষের কথা তার মনে পড়ল-অহানি তো হয়েই গেছে। হঠাৎ দেখলেন পেয়ারাগাছটার তলায় অনি একা দাঁড়িয়ে, গাছের ডালের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে। ধীরপায়ে নেমে এলেন তিনি। দাদুকে দেখে অনি হাসল। নাতির কাঁধে হাত রাখলেন সরিৎশেখর, কী করছ দাদু,

একটা নীলরঙের পাখি এই মাত্রই উড়ে গেল! অনির মুখ উজ্জ্বল।

খেয়েছ?

হ্যাঁ।

আমার সঙ্গে এসো। বাবা তোমাকে ডাকছেন। সরিৎশেখর নাতিকে নিয়ে ঘরমুখো হলেন। কথাটা শুনেই অনি আড়ষ্ট হয়ে,লে। হেমলতার কথা সে শুনেছে। শনিবার কাছে নিয়ে যাচ্ছে দাদু অথচ পিসিমা বারণ করেছেন। শনিবাবাকে দেখলেই তার ভয় লাগে। বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। তার সরিৎশেখর নাতির অবস্থাটা বুঝতে পেরে বললেন, ভয় কী। উনিও তো মানুষ, তোমার কোনো ক্ষতি করবেন না। আর আমি তো আছি।

দাদুর শরীরের সঙ্গে লেপটে অনি হাঁটতে লাগল। দৃশ্যটা প্রথমে মাধুরীর নজরে পড়ল। তিনি কয়েক পা এগিয়ে হেমলতাকে বললেন। ওরা সবাই অবাক হয়ে দেখলেন অনিকে নিয়ে পুজোর ঘরে ঢুকে সরিৎশেখর দরজার ভেজিয়ে দিলেন ভেতর থেকে।

কাচের জানলা ভেতর থেকে বন্ধ, দরজা ভেজানো, ফলে ঘরটার আলোকম, কেমন অস্পষ্ট লাগল অনির। কিন্তু শনিবাবাকে ও স্পষ্ট দেখতে পেল। চিত হয়ে শুয়ে আছেন। বিশাল ভূঁড়ি নিশ্বাসের তালে তালে দুলছে। গলার রুদ্রাক্ষের মালা একপাশে নেতিয়ে পড়েছে। ওর সেই শিষ্য পা টিপে যাচ্ছে, পুরোহিত মশাই পাখা-হাতে মাথার কাছে বসে ওদের দিকে তাকালেন। অনি দেখল শনিবার চোখ বোজা। ওরা যে ঘরে ঢুকল যেন টেরই পেলেন না।

সরিৎশেখর নাতিকে পাশে নিয়ে মাটিতে বসলেন। অনি অবাক হয়ে দেখল দাদুর মুখটা কেমন পালটে যাচ্ছে। ঝাড়িকাকু যখন কোনো অন্যায় করে দাদুর সামনে দাঁড়াত তখন এরকম মুখ করত। শনিবাবার শরীর থেকে মাত্র হাত তিনেক দূরে বসে ওর ভয়-ভয় ভাবটা হঠাৎ চলে গেল। বরং শনিবাবার শরীরের ওঠানামা দেখতে দেখতে ওর বেশ মজা লাগছিল এখন। সরিৎশেখর বললেন, ওকে এনেছি!

শনিবাবা চোখ খুললেন, এনেছ! তোমার প্রিয়জন তা হলে এই কে হয় তোমার?

সরিৎশেখর বললেন, আমার নাতি।

শনিবাবা বললেন, আর নাতি আছে।

সরিৎশেখর উত্তর দিলেন, না। এ আমার দ্বিতীয় পুত্রের একমাত্র সন্তান। প্রথম পুত্র বিবাহ করেনি এবং আমার সঙ্গে সম্পর্ক নেই।

শুয়ে শুয়ে শনিবা হাত নেড়ে অনিকে ডাকলেন, এদিকে এসো।

ডাকের মধ্যে এমন একটা সহজ ভাব ছিল যে অনির একটুও ভয় লাগল না। ও স্বচ্ছন্দে উঠে এসে কাছে দাঁড়াতেই পিছন থেকে দাদু ওকে প্রনাম করতে বললেন। হাত নেড়ে নিষেধ করলেন শনিবাবা, না, তুমি আমার সামনে বসো। কেউ শুয়ে থাকলে কক্ষনো তাকে প্রণাম করবে না। নাম কী?

বসতে বসতে অনি উত্তর দিল, অনিমেষ।

একগাল হাসলেন শনিবাবা, বীর, মানুষ আমরা নহি তো মেষ। অনিমেষ মানে জান?

ঘাড় নাড়ল অনি, স্থির, শান্ত।

শনিবাবা বললেন, যার নিমেষ নেই, দেবতা। আবার মাছকেও অনিমেষ বলা হয়, জান তোমার বয়স কত?

পেছন থেকে সরিৎশেখর বললেন, সাত।

শনিবাবা বললেন, আমার দিকে তাকাও।
 
অনি শনিবাবার মুখের দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেল। অনি হঠাৎ টের পেল ওর শরীর কেমন হয়ে যাচ্ছে, ও যেন নড়তে-চড়তে পারছে না অথচ সবকিছু বুঝতে দেখতে পারছে। শনিবার চোখের মধ্যে ওগুলো কী? নিজের চোখ বন্ধ করতে গিয়েও পারল না অনি।

শনিবাবা বললেন, সরিৎশেখর! তোমার এই নাতি বংশছাড়া, যৌবন এলে একে আর তোমাদের মধ্যে পাবে না। এর জন্যে মায়া আর বাড়িও না। এই ছেলে যতটা নরম হৃদয়ের ততটাই নির্দয়। তবে হ্যাঁ, এ যদি তোমার সবচেয়ে প্রিয়জন হয় তবে তোমার আর অঙ্গহানির সম্ভাবনা নেই। জন্ম থেকে এ প্রতিরোধশক্তি নিয়ে এসেছে।

সরিৎশেখর ফিসফিস করে বললেন, ভবিষ্যৎ

কেউ বলতে পারে না সরিৎশেখর, কারণ সেটা প্রতিমুহূর্তের আবর্তনে পালটে যেতে পারে। অতীত স্থির থাকে চিরকাল তাই সেটা বলা যায়। তবে মনে ও বিদ্বান হবে কিন্তু আঠারো বছর বয়সে রাজনৈতিক কারণে ওকে জেলে যেতে হতে পারে। যদি তা-ই যায় তা হলে আমি আর কিছু বলতে পারব না। কিন্তু একটা জিনিস বলছি, এর জীবনে বহু নারী আসবে, নারীদের কাছে ও চরম দুঃখ পাবে, নারীদের জন্য কষ্ট হবে, আবার কোনো কোনো নারীর জন্য ও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে। সরিৎশেখর, একে তুমি কোনো কাজে বাধা দিও না কখনো।কথাগুলো একটানা বলে চোখ বন্ধ করলেন শনিবাবা। তারপর স্থির হয়ে গেলেন। পুরোহিত মশাই-এর ইঙ্গিতে সরিৎশেখর উঠে এসে অনিকে বাইরে নিয়ে এলেন। অনির মনে হল, অনেকক্ষণ বাদে একটা অন্ধকার ঘর থেকে সে আলোয় এল।

কাজকর্ম সারতে বিকেল হয়ে এল। সকাল থেকে টুপটাপ হালকা চালে যে-বৃষ্টিটা খেলা করে যাচ্ছিল, দুপুরের পর সেটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ব্যান্ডেজ জড়ানোর মতো আকাশটা মেঘে ঢাকা রইল। এখনও এখানে শীত পড়েনি। মাত্র ত্রিশ মাইলের ফালাকে স্বৰ্গছেঁড়া আর জলপাইগুড়ির মধ্যে প্রকৃতিদেবী দুরকম বেহারা নিয়ে বিরাজ করেন। ভোরের দিকে একটু হিম হয়। কাল রাত্রে মেঝেতে যারা বিছানা করে শুয়েছিল শেষরাত্রে তারা তাই অড়িঘড়ি উঠে পড়েছে। এবার পূজা কার্তিকের কিছুটা পেরিয়ে। মনে হচ্ছে কালীপুজোর অনেক আগেই শীত পড়ে যাবে। কাল রাত্রে আকাশে মেঘ ছিল, আজ হিমেল হাওয়া দিচ্ছে। মাধুরী অনিকে সোয়েটার পরিয়ে দিয়েছেন। আকাশ দেখে কে বলবে এটা শরৎকাল, কদিন বাদেই পুজো!

শনিবাবা বিকেলের ট্রেনে শিষ্যসমেত ফিরে গেলেন। জোলো হাওয়া লাগলে টনসিল ফুলবে বলে অনিমেষকে স্টেশনে নিয়ে যাননি সরিৎশেখর। ওঁরা ফিরতে ফিরতে মেঘে মেঘে প্রায় সন্ধে হয়ে গেল। অনি আজ সারাদিন মায়ের কাছাকাছি। শনিবাবা ওর সম্বন্ধে যা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন তা এখন সবাই জেনে ফেলেছে। হেমলতা ঠাট্টা করে বলেছেন, বাবার তো দুটো বিয়ে ছিল, এ-ছোঁড়াকে যদি মেয়েমানুষ ধরে কটা বিয়ে করে কে জানে! মাধুরী চাপা গলায় বলেছিলেন, ঐটুকুনি ছেলের সামনে এসব কথা কেন যে ওঁরা বললেন।

হেমলতা বলেছিলেন, ভিমরতি গো, ভিমরতি। নাতি নাতি করে বাবা হেদিয়ে গেলেন। তুমি জান না এই কটা মাস আমাকে সবসময় পিটপিট করেছেন যেন অনির কোনো কষ্ট না হয়। তুমি হাসছ যে!

মাধুরী বলেছিলেন, আপনার ভাই বলে, আপনিই নাকি ওকে বেশি প্রশ্রয় দেন!

হেমলতা কিছু বললেন না প্রথমটা, তারপর আস্তে-আস্তে বলেছিলেন, কিন্তু জেলে যাবার কথাটা শুনে অবধি ভালো লাগছে না আমার। যাগো, লোকটা সত্যিই সিদ্ধপুরুষ নাকি?

কথাটা একফাঁকে মহীতোষকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন মাধুরী। সিগারেট খেতে ছাদে গিয়েছিলেন মহীতোষ। এখনও ছাদের অনেক কাজ বাকি। চিলেকোঠার ঘরে প্লাস্টার হয়নি। ইটগুলো সিমেন্টের ভজ গায়ে জড়িয়ে রয়েছে। ছাদ থেকে তিস্তা নদীর দিকে চোখ পড়তেই অবাক হয়ে গেলেন মহীতোষ। এত জল বেড়েছে যে ওপার দেখা যাচ্ছে না। জলের রং এই এত দূর থেকে কেমন কালচেকালচে লাগছে। এমন সময় অনিকে নিয়ে মাধুরী ছাদে এলেন।.ন্যাড়া ছাদে ছেলেকে একা ছাড়তে চাননি মাধুরী। এসে স্বামীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আর তখনই জনির কথাটা, জেলে যাবার কথাটা বললেন তিনি। মহীতোষ কথাটা শুনে হোহো করে হেসে উঠলেন, তোমার মাথা-খারাপ হয়েছে, এসব কেউ বিশ্বাস করে। শনিবাবা বোধহয় ভুলে গিয়েছেন যে, দেশ স্বাধীন হয়ে গিয়েছে। এখন আর আঠারো বছর বয়সে কাউকে জেলে যেতে হবে না।

মাধুরী বললেন, কিন্তু এতবড় সিদ্ধপুরুষ—

মহীতোষ হাসলেন, কত বড়?

মাধুরী ভ্রূকুটি করলেন, সবতাতে ঠাট্টা ভালো লাগে না। দুম করে উনি ছেলেটার নামে এসব বলবেনই-বা কেন? যত্ত সব।

মাধুরী বললেন, মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল।
 
মাধুরীর মুখটা খুব বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। অনিকে এক হাতে জড়িয়ে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন। সেদিকে তাকিয়ে মহীতোষ বললেন, তা দেশ যখন উদ্ধার হয়ে গিয়েছে ও নিশ্চয় চুরি-ডাকাতি করে বা নারীঘটিত ব্যাপারে জেলে যাবে-শনিবাবা মেয়েদের সঙ্গে ওর সম্পর্কের কথা কি যেন বললেন?

মাধুরী ভ্রূকুটি করে সরে দাঁড়াতে গেলেন, কী যে সব ছাইপাশ বল। ঘুরে দাঁড়াবার মুহূর্তে ওঁর মাথাটা কেমন করে উঠল। ভিজে ছাদের ওপর পা যেন স্থির থাকছে না। সারাদিন খুব পরিশ্রম হয়ে গিয়েছে, হেলতার নিষেধ শোনেননি। খাওয়াদাওয়ার ঠিক ছিল না আজ অবেলায় খেয়ে অম্বল হয়। গিয়েছিল, হঠাৎ দেখে অন্ধকার দেখলেন।

অনি এতক্ষণ হাঁ করে বাবা-মায়ের কথা শুনছিল, এখন ঘাড়ে মায়ের দুই হাতের প্রচণ্ড চাপ পড়তে চিৎকার করে উঠে দেখল মা পা পিছলে পড়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ও মায়ের কোমর জড়িয়ে ধরতে গেল। পেটে চাপ পড়তে মাধুরী চিৎকার করে ছাদের ওপর উপুড় হয়ে পড়লেন। মহীতোষ দৌড়ে এসে স্ত্রীকে আঁকড়ে ধরলেন, কী হল, পড়ে গেলে কেন? চোখের সামনে ওঁকে পড়ে যেতে দেখে হতভম্ব হয়ে পড়েছিলেন প্রথমটা। মারাত্মক কিছু ঘটে গেছে একটা এইরকম বোধ হতে মাধুরীর মুখটা তুলে জিজ্ঞাসা করলেন, কষ্ট হচ্ছে?

মাধুরী ঘাড় নাড়লেন, না। কিন্তু তার মুখ দেখে মহতোষ চমকে উঠলেন। দরদর করে ঘছেন মাধুরী। স্ত্রীকে ছাদের ওপর শুইয়ে দিয়ে ছেলেকে বললেন, যা, শিগগির পিসিমাকে ডেকে আন। মাধুরীর চেতনা ছিল, তিনি হাত নেড়ে নিষেধ করতে-না-করতে অনি একলাফে ছাদ থেকে চিলোকাঠার সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এল।

পাতলা অন্ধকার নেমে এসেছে বাড়িটার ওপর, ছাদে এতক্ষণ বোঝা হয়নি। নিচে নামতেই অনি দেখল পিসিমা ছোটঘরের বারান্দায় লণ্ঠনগুলো জড়ো করেছেন। ও চিৎকার করে উঠল, পিসিমা তাড়াতাড়ি এসো-মা কেমন করছে! চিক্কারটা হঠাৎ কান্না হয়ে যেতে হেমলতা চমকে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। লণ্ঠন পড়ে রইল, তিনি দুদ্দাড় করে অনির দিকে ছুটে এলেন। সরিৎশেখর সবে স্টেশন থেকে এসে পাঞ্জাবি খুলে হাতপাখার বাতাস খাচ্ছিলেন, অনির চিৎকার শুনে তিনিও, হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন।

হেমলতা তার ভারী শরীর নিয়ে অনির কাছে এসে দেখলেন ছেলের মুখ সাদা হয়ে গেছে ভয়ে। তোর মা কোথায়, কি হয়েছে?

অনি কথা বলতে পারছিল না, আঙুল দিয়ে ছাদটা দেখিয়ে দিল। এক পলক ওপরদিকে তাকিয়ে হেমলতা গজগজ করতে করতে ছাদের সিঁড়ির দিকে ছুটলেন, আঃ, এই সন্ধেবেলায় আবার ছাদে উঠল কেন! এত করে বললাম পেটের বাচ্চা নড়াচড়া করছে যখন, তখন খাটাখাটুনি কোরো না, তা শুনবে আমার কথা!

সরিৎশেখর দ্রুত এসে অনিকে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে দাদু?

অনি কেঁদে ফেলল, মা পড়ে গেছে!

সরিৎশেখর আর দাঁড়ালেন না। অনি দাদুর পেছনে পেছনে ছাদে ছুটল।

বৃষ্টিটা এতক্ষণ থমকে ছিল, বেশ আবার ছোট ছোট ফোঁটা পড়া শুরু হল। এ এক অদ্ভুত ধরনের বৃষ্টি। মেঘ ডাকছে না, সামান্য হাওয়াও নেই, আকাশ চিরে ঝলকে-ও। বিদ্যুতের দেখা নেই। তবু বৃষ্টি পড়ছে, থমথমে মেঘগুলো নিঃশব্দে গলে গলে পড়ছে। মহীতোষ বোকার মতো স্ত্রীর পাশে বসে ছিলেন, দিদিকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। হেমলতা কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে।

যন্ত্রণার মাধুরীর চোখ বোজা ছিল, হেমলতার গলা শুনে কিছু বলতে গিয়ে না পেরে মাথা নাড়ারেন। মহীতোষ বললেন, হঠাৎ মাথা ঘুরে গেছে। কথাটা শেষ হতে-না-হতে মাধুরীর শরীরটা কাপতে লাগল। তারপর প্রচণ্ড যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবার জন্য শরীর মোচড়ানো শুরু হল। সারা শরীর ওঁর ঘামে ভিজে যাচ্ছে, তার উপর বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে এখন। বেশিক্ষণ এভাবে থাকলে ভিজে একশা হয়ে যাবে।
 
হেমলতা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ভাইকে বললেন, ওকে নিচে নিয়ে চল। মহীতোষ একটু বিব্রত হয়ে পড়লেন। দিদিকে ডাকতে পাঠিয়ে তিনি মাধুরীকে পাজাকোলো করে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু মাধুরীর শরীর এমনিতেই ভারী, এখন যেন আরও ওজন বেড়েছে। সিঁড়ি দিয়ে নিচে যাওয়া খুব সহজ নয়, ওঁর পক্ষে অসম্ভব।

মহীতোষ বললেন, তুমি একটা দিক ধরো, চিলেকোঠার দিকে নিয়ে যাই, বৃষ্টিতে ভিজরে না হেমলতা বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন মাধুরীকে একা মহীতোষের পক্ষে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না, তাই দুজনে ধরাধরি করে চিলেকোঠার ঘরে নিয়ে এলেন। বিড়িটা এখানে চট করে ছাদে উঠে আসেনি। সিড়ি শেষ হবার পর খানিকটা সমতল জায়গাকে ঘরের মতো ঢেকে ছাদের শুরু। মাধুরীকে সেখানে রাখা হল। এটুকু আনতেই হেমলতা টের পেলেন যে ওকে নিচে নিয়ে যাওয়া বোকামি হত, সামান্য নাড়াচাড়ায় ওর কষ্ট যে অনেক গুণ বেড়ে যাচ্ছে এটা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না।

যৌবন আসতে-না–আসতে বিধবা হয়েছিলেন হেমলতা। স্বামী ছিল তার, মুখ-চোখ ভালো করে মনে ধরার আগেই একরাত্রির অসুখে মরে গেল লোকটা। তারপর এতগুলো বছর শুধু পার করে দেওয়া, একরাত্রির জন্য নারী হওয়া যার ভাগ্যে ঘটেনি, মা হবার কোনো প্রশ্নই তো ওঠে না। স্বৰ্গছেঁড়ার নির্জন চা-বাগানে বসে সরিৎশেখর মেয়ের আবার বিয়ে দেবার কথা ভাবতেন। বিদ্যাসাগর মশাই অত চেষ্টা করলেন, হয়তো কলকাতা শহরে অহরহ বিধবা-বিবাহ হচ্ছে, কিন্তু স্বৰ্গছেঁড়ার নির্জন চা-বাগানে সরিৎশেখর মেয়ের আবার বিয়ে দেবার কথা ভাবতেন। বিদ্যাসাগর মশাই অত চেষ্টা করলেন, হয়তো কলকাতা শহরে অহরহ বিধবা বিবাহ হচ্ছে, কিন্তু স্বৰ্গছেঁড়ার লোকজন ব্যাপারটা চিন্তা করতে পারে না। এমনকি হেমলতাও। স্ত্রীকে দিয়ে মেয়েকে বলিয়েছিলেন, শুনে মেহলতা বলেছিলেন, ছি! আর কথা বাড়াননি সরিৎশেখর। বিয়ের সময় ভালো করে কাপড় পরত না যে, জীবনে আর ড্রেস করে শাড়ি পরা হল না তার। একেবারে সরুপাড় সাদা শাড়ি অঙ্গে উঠল। বয়স যত বাড়ছে পাড় তত ছোট হতে-হতে নরুনে ঠেকেছে। ছোটমা যখন স্বৰ্গছেঁড়ায় এল তখন। হেমলতার বয়স বড়জোর আট। সেই বয়স থেকে হাত-পোড়ানো শুরু হয়েছে। মহীতোষ বা। পরিতোষকে নাইয়ে খাইয়ে দেবার জন্য আর কোনো লোক ছিল না। সে একরকম। ছোটমা আসার। পর হেমলতা চট করে অনেক বড় হয়ে গেলেন। বছর ঘোরার আগেই ছোটমা সন্তানসম্ভবা হলেন। স্বৰ্গছেঁড়ার চৌহদ্দিতে তখন ভালো ডাক্তার নেই। নতুন ডাক্তারবাবু তখনও আসেননি। একজন কম্পাউন্ডার কোনোরকমে কাজ চালাচ্ছেন। আর তখন লোকজনই-বা কত ছিল, এক আঙুল যদিবা ফুরোয়! সরিৎশেখর চেয়েছিলেন বউকে বাপের বাড়ি পাঠাবেন। কিন্তু সেই নদীয়ায় নিয়ে যাওয়া আর। হল না। ছোটবউ-এর বাড়ির লোকজন আসব-আসব করে শেষ পর্যন্ত এল না। কুলি-লাইনের এক বুড়ি যে নাকি মদেসিয়াদের দাই-এর কাজ করে, হেমলতাকে সঙ্গে নিয়ে আঁতুড়ঘরে ঢুকল। সরিৎশেখরের পক্ষে সম্ভব নয়। ভেতরে যাওয়া, তিনি বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মেয়েকে নির্দেশ দিতে লাগলেন। হেমলতা প্রথম সন্তানজন দেখলেন। একটু ভয় ছিল প্রথমটা, কিন্তু বাড়ি তৈরি করার নিষ্ঠা নিয়ে পরপর কাজগুলো করে গেলেন। ছোটমার প্রথম সন্তান আঁতুরঘরেই মারা গিয়েছিল। ছোটমা যতটা-না কেঁদেছেন, হেমলতা বোধহয় অনেক বেশি। তখনও তার বিয়ে হয়নি। বিয়ের পর পরিতোষ জন্মাল! সেদিন আর বুড়ি ধাই ছিল না। হেমলতা একাই সব দিক সামলাচ্ছেন। রান্না করে সবাইকে খাইয়েছেন, কাপড় ছেড়ে আঁতুড়ঘরে গিয়েছেন, সময় এলে নাড়ি কেটেছেন। এমনকি সেদিন অনি যখন হল, তখন তো ডাক্তারবাবু ছিলেন, কিন্তু হেমলতাকে ছাড়া চলেনি। অনি হয়েছিল দুপুরে। সরিৎশেখর ঘরের চেয়ারে বসে ঘড়ির ওপর নজর রেখে মাঝে-মাঝে উঁচুগলায় জিজ্ঞাসা করছেন। বারবার করে বলেছেন ঠিক জন্মমুহূর্তে যেন হেমলতা তাঁকে জানান। শিশুর মতো ছটফট করছেন সরিৎশেখর। তারপর যখন হেমলতার খুশির চিৎকার তার কানে এল ছেলে হয়েছে, তখন সরিৎশেখরকে দেখে কে! এক হাতে ঘড়ি নিয়ে লাফাচ্ছেন তিনি একটা বেজে পনেরো মিনিট-পাজিতে লিখেছে মাহেন্দ্রক্ষণ-শখ বাজাও শখ বাজাও, দুর্গা দুর্গা।
 
এখন চিলেকোঠার ঘরে মাধুরীকে শুইয়ে দিয়ে মুখ তুলতেই হেমলতা সরিৎশেখরকে দেখতে পেলেন। উদ্বেগ মুখে নিয়ে উঠে আসছেন তড়িঘড়ি। চোখাচোখি হতে হেমলতা খুব সাধারণ গলায় বললেন, তাড়াতাড়ি ডাকার ডাকুন, মাধুর বাচ্চা হবে।

সরিৎশেখর থমকে দাঁড়ালেন। বউমার বাচ্চা হবে তিনি জানতেন, কিন্তু তার তো সময় হয়নি। কোনো গোলমাল হল না তো? বোকার মতো বললেন, সে কী। তার তো দেরি আছে।

কোনোদিকে না তাকিয়ে হেমলতা বাবাকে বললেন, সেসব আপনি বুঝবেন না। তাড়াতাড়ি যান!

মেয়ের মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে থেকে সরিৎশেখর তাড়াতাড়ি নিচে নেমে গেলেন। মহীতোষ ব্যাপারটা এইরকম দাঁড়াবে ভাবতে পারেননি। এখনও তো মাস দুয়েক দেরি আছে। হঠাৎ ওঁর খুব ভয় হল। মাধুরীর যদি কিছু হয়ে যায়। কোনো কথা না বলে মহীতোষ সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন, দরকার হলে ওকে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। হেমলতা দেখলেন মাধুরী ছটফট করছে। কী করবেন বুঝতে না পেরে মুখ তুলতেই দেখলেন অনি সিড়ির মুখে গাল চেপে করুণ চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। বোধহয় ওপরে উঠে আসতে সাহস পাচ্ছে না। হেমলতা হেসে বললেন, যা বাবা, তাড়াতাড়ি নিচ থেকে একটা বালিশ আর চাদর নিয়ে আয়। কাজ করতে পেরে অনি যেন বেঁচে গেল।

কোনোমতে বিছানা করে মাধুরীকে শুইয়ে দিয়ে হেমলতা বললেন, অনি, তুই মায়ের কাছে বোস, আমি গরম জল করি গে। পিসিমা চলে গেলে অনি খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। বাইরে এখন বেশ বৃষ্টি পড়ছে। ছোট বাড়ি থেকে চাদর-বালিশ আনতে গিয়ে ও একটু ভিজেছে। অন্য সময় মা নিশ্চয় বকত, এখন কিছু বলছে না। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ওর কান্না পাচ্ছিল। মা যে খুব কষ্ট পাচ্ছে এটা ও বুঝতে পারছিল।

পিসিমা তখন দাদুকে বলল মায়ের বাচ্চা হবে। বাচ্চা হলে এত কষ্ট পেতে হয় কেন? মায়ের মুখটা একদম সাদা হয়ে গিয়েছে। ও মায়ের পাশে এসে সন্তর্পণে বসে পড়ল। এখন কাছে পিঠে কেউ নেই, কারও গলা শোনা যাচ্ছে না। চিলেকোঠার দরজাটা আলো আসার জন্যে অথবা ভুলে খোলা রয়েছে। অনি এখান থেকে বৃষ্টি পড়া দেখতে পেল। জলের ছাঁট ঘরের মধ্যে সামান্যই আসছে। অনির খুব ইচ্ছে হল মায়ের মুখে হাত বোলাতে। ঠিক সেই সময় মাধুরী চোখ খুললেন। অনি দেখল মাধুরীর চোখের কোণে দু-ফোঁটা জল টলমল করছে। মাধুরী একবার দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ালেন, তারপর মাথা ঘুরিয়ে ঘরটাতে চোখ বোলালেন। মায়ের চোখে জল দেখতে পেয়ে অনি ফুঁপিয়ে উঠল। মাধুরী, খুব ধীরে ধীরে একটা হাত তুলে ছেলের কোলের ওপর রাখতেই অনি মায়ের বুকে ওপর ভেঙে পড়ল। অনেকক্ষণ ছেলেকে মধ্যে রেখে মাধুরী বললেন, হ্যারে বোকা, কাঁদছিস কেন?

ফিসফিসিয়ে অনি বলল, তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে, না?

আমার কষ্ট হলে তোর খারাপ লাগে, না রে!

অনি ঘাড় নাড়ল। মাধুরী আস্তে-আস্তে বললেন, আমি যদি না থাকি তুই আমাকে ভুলে যাবি তো!

অনি দুই হাতে মাকে আঁকড়ে ধরে কেঁদে উঠল শব্দ করে। মাধুরী কেমন যোরের মধ্যে বললেন, আমি যদি না থাকি তুই একা একা আকাশের দিকে তাকিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলিস, আমি ঠিক শুনতে পাব। অনি, আমি তোকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারব না রে।
 
অনি কোনো কতা বলতে পারছি না, র ঠাট দুটো থরথর করে কাঁপছিল। মাকে এরকম করে কথা বলতে ও কোনোদিন শোনেনি। মা কেন ওকে ছেড়ে চলে যাবে! বাচ্চা হলে কি কাউকে চলে যেতে হয়! ও দেখল মাধুরী একটানা কথা বলে কেমন নিস্তেজ হয়ে গেছেন, অনেক দূর দৌড়ে এলে যেমন হয় মায়ের বুক তেমনি ওঠানামা করছে। হঠাৎ ও মায়ের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে গেল। মাধুরী যেখানে শুয়ে আছেন তার নিচদিকটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। এটা কি সতি রক্ত? কোত্থেকে এত রক্ত এল? মায়ের তো কোথাও কেটে যায়নি! এর আগে কতবার তরকারি কুটতে গিয়ে মায়ের হাত বঁটিতে কেটে গিয়ে রক্ত পড়েছে, কিন্তু সে তো কয়েক ফোঁটা মাত্র। অনি আস্তে-আস্তে উঠে মায়ের পাশের কাছে এসে দাঁড়াল। কুঁজো ভেঙে গেলে যেমন জল গড়িয়ে যায় তেমনি একটা মোটা লাল ধারা চলে যাচ্ছে কোণার দিকে। মায়ের পায়ের গোড়ালি সেই স্রোতটা থেকে সরিয়ে দিতে গেল অনি আর তখনি ওর আঙুল চটচটে লাল হয়ে গেল। মাধুরী চোখ খুলে দেখলেন, ছেলে চোখের সামনে আঙুল নিয়ে দেখছে। চিৎকার করে উঠলেন, ওরে মুছে ফ্যাল, তোর হাত থেকে রক্ত মুছে ফ্যাল। কিন্তু ক্রমশ কথা বলার শক্তিটা চলে যাচ্ছিল ওঁর। চোখের সামনে সব ঝাঁপসা হয়ে আসছে। অনি ঝাঁপসা-মহীতোষ ঝাঁপসা-দু-চোখে এত জল থাকে কেন?

এই সময় সিঁড়িতে কয়েক জোড়া শব্দ পেল অনি। একটা অন্ধকার ঘরের মধ্যে যেন দম আটকে যাচ্ছিল ওর, হঠাৎ মনে হল ডাক্তারবাবু এসে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। হেমলতা একটা বড় লণ্ঠন নিয়ে আগে-আগে উঠে এলেন। ছাদের এই ঘরটা এতক্ষণে আবছা হয়ে এসেছে। হেমলতা পিছন পিছনে একজন বৃদ্ধ সরিৎশেখর, মহীতোষকে ব্যাগ হাতে নিয়ে উঠে আসতে দেখল অনি। ঘরে ঢুকেই থমকে দাঁড়াল সবাই, হারিকেনের আলোয় রক্তস্রোত পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। বৃদ্ধ লোকটি বললেন, ব্লিডিং হচ্ছে বলেননি তো!

হেমলতা বললেন, আমি একটু আগে নিচে গেলাম, তখনও দেখিনি। অনি বুঝতে পারল এই লোকটিই ডাক্তার, কারণ তৎক্ষণাৎ তিনি মাধুরীর পাশে বসে একটা হাত তুলে নিয়ে নাড়ি দেখতে লাগলেন। তারপর খুব গম্ভীরমুখে বললেন, আপনারা নিচে চলে যান। সরিৎশেখর অনিকে এক সসপ্যানটা এনে দে শিগগির।

মহীতোষ নিচ থেকে জল ওপরে দিয়ে এসে দেখলেন সরিৎশেখর অনিকে জড়িয়ে ধরে চুপচাপ সিঁড়ির শেষ ধাপে বসে আছেন। ছেলেকে দেখে সরিৎশেখর বললেন, হাসপাতালে রিমুভ করা যাবে?

ছোট ঘর থেকে আনা লণ্ঠনটা নামিয়ে মহীতোষ ঘাড় নাড়লেন, জানি না করতে হলে এখনই করা দরকার। সেনপাড়ার দিকটায় তিস্তার জল ঢুকে পড়েছে।

সরিৎশেখর বলেন, দেখলেন না মাইকে অ্যানউন্স করছে। মনে হচ্ছে এবার খুব ভোগাবে।

কথাটা শেষ করে মহীতোষ দেখলেন প্রিয়তোষ দরজায় দাঁড়িয়ে। এদের দেখেই সে চেঁচিয়ে উঠল, ফ্লাড আসছে, সামনের মাঠটা জলে ড়ুবে গেছে। চটপট মালপত্র ছাদে ভোলো।

মহীতোষ তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে শুনলেন ওঁদের উঠোনে বাগানে জল শব্দ করছে। এতক্ষণ খেয়াল ছিল না, হঠাৎ ঠাণ্ডা বাতাস লাগতে টের পেলেন ওঁর সমস্ত জামাকাপড় ভিজে চুপসে গেছে, সরিৎশেখরেরও এক অবস্থা অন্ধকারে এতক্ষণ যেটুকু দেখা যাচ্ছিল আর তাও দেখা যাচ্ছে না। ঝিমঝিম বৃষ্টি পড়ছে আর হঠাৎ সমস্ত পৃথিবী ধাধিয়ে দিয়ে বিদ্যুৎ চমকে উঠতেই মহীতোষ দেখলেন ঘোলাজলের স্রোত উঠোনামা কিলবিল করছে।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top