হেমলতা জলপাইগুড়িতে আসার পর হঠাৎ যেন বুড়িয়ে যাচ্ছেন। প্রায়ই অম্বল হচ্ছে আজকাল, কিছু খেলে হজম হয় না ঠিক। সব কাজ শেষ করে খেতে-খেতে চারটে বেজে যায়। সেই সময় অনিমেষ আসে। পিসিমার আলোচালের ভাত নিরামিষ তরকারি দিয়ে খেতে ও খুব ভালোবাসে। সরিৎশেখরের সন্দেহ অনিমেষের সঙ্গে খাবার জন্যেই হেমলতার চারটের আগে খেতে বসা হয় না। অনেক বকাঝকা করেছেন, কোনো কাজ হয়নি। নিজের হাতে রান্না সেরে সরিৎশেখরকে খাইয়ে সমস্ত বাড়ি ঝেড়েমুছে বাসন মেজে তবে নিজের নিরামিষ রান্না রু করবেন হেমলতা। একটু পিটপিটে স্বভাব আগেও ছিল, সরিৎশেখর লক্ষ করেছেন ইদানীং সেটা আরও বেড়েছে। চব্বিশ ঘণ্টা জল ঘেঁটে ঘেঁটে দুপায়ের আঙুলের ফাঁকে সাদা হাজা বেরিয়ে গেছে, অনিমেষের মুখে সরিৎশেখর সদ্য সেটা জানতে পারলেন। বিকেলে যখন ওরা মুখোমুখি খেতে বসে সে-দৃশ্য বেশ মজার। পিড়িতে বাবু হয়ে বসে অনিমেষ, হেমলতা অত বড় ছেলেটাকে ভাত, তারকারি মেখে গোল্লা পাকিয়ে দিয়ে নিজে মাটিতে উবু হয়ে বসে খাওয়া শুরু করেন। প্রায় একই সংলাপ দিয়ে খাওয়া শুরু হয় রোজ, সরিৎশেখর চুরি করে শুনেছেন। অনিমেষ বলে, মাকে তুমি ফ্রক পরা দেখেছ?
হেমলতা খেতে-খেতে বলেন, পনেরো বছরের মেয়ে ফ্রক পরবে কী! তবে বিয়ের আগের দিনও নাকি রান্নাঘরে ঢোকেনি। তোর দাদু যখন দেখতে গিয়েছিল তখন ওর বাবা খুব ভুজুং দিয়েছিল-এই রাঁধতে পারে সেই রাঁধতে পারে।
তারপর?
তারপর আর কী! বিয়ের পর আমি বেঁধে দিতাম আর তোর দাদু জানত মাধুরী বেঁধেছে। তবে খুব চটপট শিখেছিল।
মা দেখতে খুব সুন্দরী ছিল, না?
মুখটা খুব মিষ্টি ছিল তবে ভীষণ মোটা। হাতটাতগুলো কী, এক হাতে ধরা যায় না! মাথায় চুল ছিল বটে, হাঁটুর নিচ অবধি নেমে আসত। দুহাতে চুল বাঁধতে হিমশিম খেতে হত। একদিন রাগ করে অনেকটা কেটে দিলাম।
মা মোট ছিল? অনিমেষের গলায় বিস্ময়।
হুঁ। বাবার তো ঐরকম পছন্দ ছিল। আমার প্রথম মার নাকি পাহাড়ের মতো শরীর ছিল। বিয়ের পর আমরা তোর মাকে নিয়ে খুব ঠাট্টা করতাম। তারপর তুই হতে কেমন রোগা-রোগা হয়ে গেল।
তারপর অনেকক্ষণ চুপচাপ দুজনে কথা না বলে খেয়ে যায়। বিকেলের অনির এই ভাত খাওয়াটা একদম পছন্দ করেন না সরিৎশেখর। কিন্তু মেয়ের জন্য কিছু বলতেও পারেন না। অনেক কিছু এখন মেনে নিতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে। সরিৎশেখর বুঝতে পারছেন তাঁর পুঁজি দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। এতদিন চা-বাগানের চাকরিতে মাইনে ছাড়া বাড়িতে কোনো উপার্জন করেননি। বিলাসিতা ছিল না তাই জমানো টাকার বেশির ভাগ দিয়ে এই বাড়িটা তৈরি করার পর হাতে যা আছে তাতে মাত্র কয়েক বছর চলতে পারে। এখনও তার স্বাস্থ্য ভালো, ইচ্ছে করলে এই শহরে কোনো দেশি চা-বাগানের হেড অফিসে একটা চাকরি জুটিয়ে নিতে পারেন, কিন্তু আর গোলামি করতে প্রবৃত্তি হয় না। চা-বাগানের ইতিহাসে এতদিন পেনশনের ব্যাপারটাই ছিল না। রিটায়ার করার পর অনেক লেখালেখি করে কলকাতা থেকে তার জন্য পঁচাত্তর টাকার একটা মাসিক পেনশনের অনুমতি আনিয়েছেন। সরিৎশেখরের ধারণা তাঁর চিঠির চেয়ে ম্যাকফার্সনের সুপারিশ বেমি কাজ করেছে। মেমসাহেব এখনও প্রতি মাসে তাকে চিঠি লেখেন ডিয়ার বাবু বলে। স্বৰ্গছেঁড়ার জন্য কষ্ট হয় তার, সরিৎশেখরকে তিনি ভোলননি-এইসব। টানা-টানা হাতের লেখা। অনিমেষকে সে-চিঠি পড়ান সরিৎশেখর। খামের ওপর ডাকঘরের ছাপ থেকে দেশটাকে বাতির কাছ উপস্থিত করতে চেষ্টা করেন। মিসেস ম্যাকফার্সন লিখেছিলেন তোমার গ্রান্ডসন যখন এখানে ব্যারিস্টারি পড়তে আসবে তখন সব খরচ আমার। সরিৎশেখর অনিমেষকে বিলেতে পাঠাবেন বলে যখন ঘোষণা করেন তখন সময়ের হিসাব তার হারিয়ে যায়। পেনশন পাবার পর চলে যাচ্ছে একরকম। তিনটে তো প্রাণী, এতবড় বাড়িটা খালি পড়ে থাকে। মহীতোষ তাকে টাকা পাঠাতে চেয়েছিলেন প্রতি মাসে, রাজি হননি তিনি। বলেছিলেন তা হলে ছেলেকে হোস্টেলে রাখে। আর কথা বাড়াননি মহীতোষ। টাকার দরকার হলে বাড়ি ভাড়া দিতে পারেন সরিৎশেখর। এটা তার একধরনের আনন্দ। কেউ ভাড়া চাইতে চলে তাকে মুখের ওপর না, বলে দিয়ে মেয়ের কাছে এসে বলেন, বুঝলে হেম, এই যে বাড়িটা দেখছ-এই হল আমার আসল ছেলে, শেষ বয়সে এই আমাকে দেখবে।
হেমলতা খেতে-খেতে বলেন, পনেরো বছরের মেয়ে ফ্রক পরবে কী! তবে বিয়ের আগের দিনও নাকি রান্নাঘরে ঢোকেনি। তোর দাদু যখন দেখতে গিয়েছিল তখন ওর বাবা খুব ভুজুং দিয়েছিল-এই রাঁধতে পারে সেই রাঁধতে পারে।
তারপর?
তারপর আর কী! বিয়ের পর আমি বেঁধে দিতাম আর তোর দাদু জানত মাধুরী বেঁধেছে। তবে খুব চটপট শিখেছিল।
মা দেখতে খুব সুন্দরী ছিল, না?
মুখটা খুব মিষ্টি ছিল তবে ভীষণ মোটা। হাতটাতগুলো কী, এক হাতে ধরা যায় না! মাথায় চুল ছিল বটে, হাঁটুর নিচ অবধি নেমে আসত। দুহাতে চুল বাঁধতে হিমশিম খেতে হত। একদিন রাগ করে অনেকটা কেটে দিলাম।
মা মোট ছিল? অনিমেষের গলায় বিস্ময়।
হুঁ। বাবার তো ঐরকম পছন্দ ছিল। আমার প্রথম মার নাকি পাহাড়ের মতো শরীর ছিল। বিয়ের পর আমরা তোর মাকে নিয়ে খুব ঠাট্টা করতাম। তারপর তুই হতে কেমন রোগা-রোগা হয়ে গেল।
তারপর অনেকক্ষণ চুপচাপ দুজনে কথা না বলে খেয়ে যায়। বিকেলের অনির এই ভাত খাওয়াটা একদম পছন্দ করেন না সরিৎশেখর। কিন্তু মেয়ের জন্য কিছু বলতেও পারেন না। অনেক কিছু এখন মেনে নিতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে। সরিৎশেখর বুঝতে পারছেন তাঁর পুঁজি দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। এতদিন চা-বাগানের চাকরিতে মাইনে ছাড়া বাড়িতে কোনো উপার্জন করেননি। বিলাসিতা ছিল না তাই জমানো টাকার বেশির ভাগ দিয়ে এই বাড়িটা তৈরি করার পর হাতে যা আছে তাতে মাত্র কয়েক বছর চলতে পারে। এখনও তার স্বাস্থ্য ভালো, ইচ্ছে করলে এই শহরে কোনো দেশি চা-বাগানের হেড অফিসে একটা চাকরি জুটিয়ে নিতে পারেন, কিন্তু আর গোলামি করতে প্রবৃত্তি হয় না। চা-বাগানের ইতিহাসে এতদিন পেনশনের ব্যাপারটাই ছিল না। রিটায়ার করার পর অনেক লেখালেখি করে কলকাতা থেকে তার জন্য পঁচাত্তর টাকার একটা মাসিক পেনশনের অনুমতি আনিয়েছেন। সরিৎশেখরের ধারণা তাঁর চিঠির চেয়ে ম্যাকফার্সনের সুপারিশ বেমি কাজ করেছে। মেমসাহেব এখনও প্রতি মাসে তাকে চিঠি লেখেন ডিয়ার বাবু বলে। স্বৰ্গছেঁড়ার জন্য কষ্ট হয় তার, সরিৎশেখরকে তিনি ভোলননি-এইসব। টানা-টানা হাতের লেখা। অনিমেষকে সে-চিঠি পড়ান সরিৎশেখর। খামের ওপর ডাকঘরের ছাপ থেকে দেশটাকে বাতির কাছ উপস্থিত করতে চেষ্টা করেন। মিসেস ম্যাকফার্সন লিখেছিলেন তোমার গ্রান্ডসন যখন এখানে ব্যারিস্টারি পড়তে আসবে তখন সব খরচ আমার। সরিৎশেখর অনিমেষকে বিলেতে পাঠাবেন বলে যখন ঘোষণা করেন তখন সময়ের হিসাব তার হারিয়ে যায়। পেনশন পাবার পর চলে যাচ্ছে একরকম। তিনটে তো প্রাণী, এতবড় বাড়িটা খালি পড়ে থাকে। মহীতোষ তাকে টাকা পাঠাতে চেয়েছিলেন প্রতি মাসে, রাজি হননি তিনি। বলেছিলেন তা হলে ছেলেকে হোস্টেলে রাখে। আর কথা বাড়াননি মহীতোষ। টাকার দরকার হলে বাড়ি ভাড়া দিতে পারেন সরিৎশেখর। এটা তার একধরনের আনন্দ। কেউ ভাড়া চাইতে চলে তাকে মুখের ওপর না, বলে দিয়ে মেয়ের কাছে এসে বলেন, বুঝলে হেম, এই যে বাড়িটা দেখছ-এই হল আমার আসল ছেলে, শেষ বয়সে এই আমাকে দেখবে।