What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected উত্তরাধিকার - সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

হেমলতা জলপাইগুড়িতে আসার পর হঠাৎ যেন বুড়িয়ে যাচ্ছেন। প্রায়ই অম্বল হচ্ছে আজকাল, কিছু খেলে হজম হয় না ঠিক। সব কাজ শেষ করে খেতে-খেতে চারটে বেজে যায়। সেই সময় অনিমেষ আসে। পিসিমার আলোচালের ভাত নিরামিষ তরকারি দিয়ে খেতে ও খুব ভালোবাসে। সরিৎশেখরের সন্দেহ অনিমেষের সঙ্গে খাবার জন্যেই হেমলতার চারটের আগে খেতে বসা হয় না। অনেক বকাঝকা করেছেন, কোনো কাজ হয়নি। নিজের হাতে রান্না সেরে সরিৎশেখরকে খাইয়ে সমস্ত বাড়ি ঝেড়েমুছে বাসন মেজে তবে নিজের নিরামিষ রান্না রু করবেন হেমলতা। একটু পিটপিটে স্বভাব আগেও ছিল, সরিৎশেখর লক্ষ করেছেন ইদানীং সেটা আরও বেড়েছে। চব্বিশ ঘণ্টা জল ঘেঁটে ঘেঁটে দুপায়ের আঙুলের ফাঁকে সাদা হাজা বেরিয়ে গেছে, অনিমেষের মুখে সরিৎশেখর সদ্য সেটা জানতে পারলেন। বিকেলে যখন ওরা মুখোমুখি খেতে বসে সে-দৃশ্য বেশ মজার। পিড়িতে বাবু হয়ে বসে অনিমেষ, হেমলতা অত বড় ছেলেটাকে ভাত, তারকারি মেখে গোল্লা পাকিয়ে দিয়ে নিজে মাটিতে উবু হয়ে বসে খাওয়া শুরু করেন। প্রায় একই সংলাপ দিয়ে খাওয়া শুরু হয় রোজ, সরিৎশেখর চুরি করে শুনেছেন। অনিমেষ বলে, মাকে তুমি ফ্রক পরা দেখেছ?

হেমলতা খেতে-খেতে বলেন, পনেরো বছরের মেয়ে ফ্রক পরবে কী! তবে বিয়ের আগের দিনও নাকি রান্নাঘরে ঢোকেনি। তোর দাদু যখন দেখতে গিয়েছিল তখন ওর বাবা খুব ভুজুং দিয়েছিল-এই রাঁধতে পারে সেই রাঁধতে পারে।

তারপর?

তারপর আর কী! বিয়ের পর আমি বেঁধে দিতাম আর তোর দাদু জানত মাধুরী বেঁধেছে। তবে খুব চটপট শিখেছিল।

মা দেখতে খুব সুন্দরী ছিল, না?

মুখটা খুব মিষ্টি ছিল তবে ভীষণ মোটা। হাতটাতগুলো কী, এক হাতে ধরা যায় না! মাথায় চুল ছিল বটে, হাঁটুর নিচ অবধি নেমে আসত। দুহাতে চুল বাঁধতে হিমশিম খেতে হত। একদিন রাগ করে অনেকটা কেটে দিলাম।

মা মোট ছিল? অনিমেষের গলায় বিস্ময়।

হুঁ। বাবার তো ঐরকম পছন্দ ছিল। আমার প্রথম মার নাকি পাহাড়ের মতো শরীর ছিল। বিয়ের পর আমরা তোর মাকে নিয়ে খুব ঠাট্টা করতাম। তারপর তুই হতে কেমন রোগা-রোগা হয়ে গেল।

তারপর অনেকক্ষণ চুপচাপ দুজনে কথা না বলে খেয়ে যায়। বিকেলের অনির এই ভাত খাওয়াটা একদম পছন্দ করেন না সরিৎশেখর। কিন্তু মেয়ের জন্য কিছু বলতেও পারেন না। অনেক কিছু এখন মেনে নিতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে। সরিৎশেখর বুঝতে পারছেন তাঁর পুঁজি দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। এতদিন চা-বাগানের চাকরিতে মাইনে ছাড়া বাড়িতে কোনো উপার্জন করেননি। বিলাসিতা ছিল না তাই জমানো টাকার বেশির ভাগ দিয়ে এই বাড়িটা তৈরি করার পর হাতে যা আছে তাতে মাত্র কয়েক বছর চলতে পারে। এখনও তার স্বাস্থ্য ভালো, ইচ্ছে করলে এই শহরে কোনো দেশি চা-বাগানের হেড অফিসে একটা চাকরি জুটিয়ে নিতে পারেন, কিন্তু আর গোলামি করতে প্রবৃত্তি হয় না। চা-বাগানের ইতিহাসে এতদিন পেনশনের ব্যাপারটাই ছিল না। রিটায়ার করার পর অনেক লেখালেখি করে কলকাতা থেকে তার জন্য পঁচাত্তর টাকার একটা মাসিক পেনশনের অনুমতি আনিয়েছেন। সরিৎশেখরের ধারণা তাঁর চিঠির চেয়ে ম্যাকফার্সনের সুপারিশ বেমি কাজ করেছে। মেমসাহেব এখনও প্রতি মাসে তাকে চিঠি লেখেন ডিয়ার বাবু বলে। স্বৰ্গছেঁড়ার জন্য কষ্ট হয় তার, সরিৎশেখরকে তিনি ভোলননি-এইসব। টানা-টানা হাতের লেখা। অনিমেষকে সে-চিঠি পড়ান সরিৎশেখর। খামের ওপর ডাকঘরের ছাপ থেকে দেশটাকে বাতির কাছ উপস্থিত করতে চেষ্টা করেন। মিসেস ম্যাকফার্সন লিখেছিলেন তোমার গ্রান্ডসন যখন এখানে ব্যারিস্টারি পড়তে আসবে তখন সব খরচ আমার। সরিৎশেখর অনিমেষকে বিলেতে পাঠাবেন বলে যখন ঘোষণা করেন তখন সময়ের হিসাব তার হারিয়ে যায়। পেনশন পাবার পর চলে যাচ্ছে একরকম। তিনটে তো প্রাণী, এতবড় বাড়িটা খালি পড়ে থাকে। মহীতোষ তাকে টাকা পাঠাতে চেয়েছিলেন প্রতি মাসে, রাজি হননি তিনি। বলেছিলেন তা হলে ছেলেকে হোস্টেলে রাখে। আর কথা বাড়াননি মহীতোষ। টাকার দরকার হলে বাড়ি ভাড়া দিতে পারেন সরিৎশেখর। এটা তার একধরনের আনন্দ। কেউ ভাড়া চাইতে চলে তাকে মুখের ওপর না, বলে দিয়ে মেয়ের কাছে এসে বলেন, বুঝলে হেম, এই যে বাড়িটা দেখছ-এই হল আমার আসল ছেলে, শেষ বয়সে এই আমাকে দেখবে।
 
এখন প্রতি বছর তিস্তায় ফ্লাড আসে। যেমনভাবে নিয়ম মেনে বর্ষা আসে শীত আসে তেমনি বন্যার জল শহরে ঢুকে পড়ে। নতুন বাড়িতে ওঠার পর জল আর জিনিসপত্র নষ্ট করার সযোগ পায় না। শুধু প্রতি বছর সরিৎশেখরের বাগানের ওপর পলিমাটির স্তরটা বেড়ে যায়। এখন নদী দেখলে সরিৎশেখর বুঝতে পারেন দুএকদিনের মধ্যে বন্যা হবে কি না। এমনকি তিস্তা যখন খটখটে শুকনো, সাদা বালির চলে হাজার হাজার কাশগাছ বাতাসে মাথা দোলায়, যখন ওপারের বার্নিশঘাট অবধি জলের রেখা দেখা যায় না, ভাঙা ট্যাক্সিগুলো সারাদিন বিকট শব্দ করে তিস্তার বুকে ছুটে বেড়ায়, সেইরকম সময়ে একদিন হঠাৎ মাঝরাত্রে বোমা ফাটার শব্দ ওঠে তিস্তার বুকে আর সরিৎশেখর বিছানায় শুয়ে শুয়ে নিশ্চিত হয়ে যান কাল ভোরে বেড়াতে গিয়ে দেখতে পাবেন তিস্তার শুকনো বালি রাতারাতি শুয়ে শুয়ে নিশ্চিত হয়ে যান কাল ভোরে বেড়াতে গিয়ে দেখতে পাবেন তিস্তার শুকনো বালি রাতারাতি ভিজে গেছে। বিকেল নাগাদ ভুস করে জল উঠে স্রোত বইতে শুরু করবে। চোখের উপর এই শহরটার চরিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। চোখের উপর অনিকে বড় হয়ে উঠতে দেখেছেন। পড়াশুনায় ভালো ছেলে, পড়ার কথা কখনো বলতে হয় না।

এখন প্রতি বছর তিস্তায় ফ্লাড আসে। যেমনভাবে নিয়ম মেনে বর্ষা আসে শীত আসে তেমনি বন্যা জল শহরে ঢুকে পড়ে। নতুন বাড়িতে ওঠার পর জল আর জিনিসপত্র নষ্ট করার সুযোগ পায় না। শুধু প্রতি বছর সরিৎশেখরের বাগানের ওপর পলিমাটির স্তরটা বেড়ে যায়। এখন নদী দেখলে সরিৎশেখর বুঝতে পারেন দুএকদিনের মধ্যে বন্যা হবে কি না। এমনকি তিস্তা যখন খটখটে শুকনো, সাদা বালির চরে হাজার হাজার কাশগাছ বাতাসে মাথা দোলায়, যখন ওপারের বার্নিশঘাট অবধি জলের রেখা দেখা যায় না, ভাঙা ট্যাক্সিগুলো সারাদিন বিকট শব্দ করে তিস্তার বুকে ছুটে বেড়ায়, সেইরকম সময়ে একদিন হঠাৎ মাঝরাত্রে বোমা ফাটার শতো শব্দ ওঠে তিস্তার বুকে আর সরিৎশেখর বিছানায় শুয়ে শুয়ে নিশ্চিত হয়ে যান কাল ভোরে বেড়াতে গিয়ে দেখতে পাবেন তিস্তার শুকনো বালি রাতারাতি ভিজে গেছে। বিকেল নাগাদ ভুস করে জল উঠে স্রোত বইতে শুরু করবে। চোখের উপর এই শহরটার চরিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। চোখের উপর অনিকে বড় হয়ে উঠতে দেখেছেন। পড়াশুনায় ভালো ছেলেটা, পড়ার কথা কখনো বলতে হয় না। আজ অবধি কারোর কাছ থেকে কোনোরকম নালিশ শুনতে হয়নি ওর বিরুদ্ধে। কিন্তু ভীষণ লাজুক অথবা গতর হয়ে থাকে ছেলেটা। এই বয়সে ওরকম মানায় না। জোর করে বিকেলে স্কুলের মাঠ পাঠালে ওকে, খেলাধুলা না করলে শরীর ঠিক থাকবে কী করে! ক্রমশ মাথাচাড়া দিচ্ছে ওর শরীর, এই সময় ব্যায়াম দরকার।
 
অনিমেষ শুনেছিল দাদু সেকালে ফাষ্ট ক্লাস অবধি পড়েছিলেন। কলেজে যাননি কোনোদিন। কিন্তু এত ভালো ইংরেজি বুঝিয়ে দিতে পারেন যে ওদের স্কুলের রজনীবাবু অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। একবার প্রতিশব্দ লিখতে বলেছিলেন রজনীবাবু। অনিমেষ বাড়িতে এসে দাদুকে জিজ্ঞাসা করতে একটা শব্দের পাঁচটা প্রতিশব্দ পেয়ে গেল। রজনীবাবুর মুখ দেকে ক্লাসে বসে পরদিন অনিমেষ বুঝতে পেরেছিল তিনি নিজেও অতগুলো জানতেন না। ছোট ডিকশনারিতে অতগুলো না পেয়ে রজনীবাবু ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কোত্থেকে ও এসব লিখেছে। অনিষের মুখ থেকে শুনে রজনীবাবু বিকেলে এসে দাদুর সঙ্গে আলাপ করে গিয়েছিলেন। ম্যাকফার্সন সাহেব দাদুকে একটা ডিকশনারি দিয়েছিলেন যার ওজন প্রায় দশ সের হবে, অনিমেষ দুহাতে কোনোক্রমে এখন সেটাকে তুলতে পারে। রজনীবাবু মাঝে-মাঝে এসে সেটা দেখে যান।

শেষ পর্যন্ত কিছুই চোপে রাখা গেল না। সরিৎশেখর যতই আড়াল করুন মহীতোষের বিয়ের আঁচ এ-বাড়িতে লাগতে আরম্ভ করল। মহীতোষ নিজে আসছেন না বটে, কিন্তু তার হবু স্বত্তবাড়ির লোকজন নানারকম কথাবার্তা বলতে সরিৎশেখরের কাছে না এসে পারছেন না। সরিৎশেখর সকালে বাজারে গিয়ে একগাদা মিষ্টি নিয়ে আসেন, কখন কে আসে বলা যায় না। হেমলতা তা দিয়ে অতিথি আপ্যয়ন করেন। মেয়ের বাড়ি থেকে যারা আসেন তারা অনিকে দেখে একটু অস্বস্তির মধ্যে থাকেন সেটা অনি বেশ টের পায়। দাদু পিসিমা ওকে মুখে কিছু না বললেও ও যে ব্যাপার জেনে গেছে সেটা বুঝতে পেরে গেছেন। অনির ধারণা ছিল বিয়ে হলে খুব ধুমধাম হয়, অনেক আত্মীয়স্বজন আসে, কিন্তু ওদের বাড়িতে কেউ এল না। শুধু এক বিকেলে সাধুচরণ এক বৃদ্ধ ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে সরিৎশেখরের কাছে এলেন। ওদের সাজগোজ দেখে কেমন সন্দেহ হল অনিমেষের, পা টিপে ও দাদুর ঘরের জানলার কাছে এসে কান পাতল। সাধুচরণ বলেছিলেন, সব ঠিকঠাক আছে, এবার আপনাকে যেতে হয়।

সরিৎশেখর বললেন, সন্ধে-সন্ধে বিয়েটা হয়ে যাবে আশা করি, আমি আবার আটটার মধ্যে শুয়ে পড়ি।

বৃদ্ধ ভদ্রলোক বললেন, যা, সন্ধেবেলাতেই বিয়ে;, আপনি খাওয়াদাওয়া সেরে তাড়াতাড়ি ফিরতে পারবেন।

সরিৎশেখর বললেন, খাওয়াদাওয়া না বেয়াই মশাই, আমি তো খেতে পারব না। আমাকে এঅনুরোধ করবেন না।

বৃদ্ধ বললেন, সে কী? তা কখনো হয়?

সরিৎশেখর বললেন, হয়। আমার বাড়িতে আমার নাতি আছে যাকে আমরা এই বিয়ের কথা জানাইনি। তাকে বাদ দিয়ে কোনো আনন্দ-উৎসবে আহার করতে অক্ষম।

বৃদ্ধ বললেন, কিন্তু তাকে তো আপনি নিজেই নিয়ে যেতে চাননি।

সরিৎশেখর বললেন, ঠিকই। ঐ অনুষ্ঠানে ওর উপস্থিতি কি কারো ভালো লাগবে। তা ছাড়া একজনকে যখন এনেছিলাম তখন অনেক আমোদ-আহ্লাদ করেছি, তবু তাকে কি রাখতে পারলাম। ওসব কথা যাক। পাত্রের পিতা হিসেবে আমার কর্তব্যটুকু করতে দিন, এর বেশি কিছু বলবেন না।

অনি শুনল দাদু গলা চড়িয়ে ডাকছেন, হেম, হেম। রান্নাঘর থেকে সাড়া দিতে-দিতে পিসিমা এ ঘরের দরজা অবধি এসে থেমে গেলেন, কী বলছেন?

আমি চললাম, সেই হারটা দাও তো!

ঐ তো, আপনার ড্রয়ারের মধ্যে আছে। কিন্তু আপনি জামাকাপড় পালটালেন না? এরকম ময়লা পাঞ্জাবি পরে লোকে বাজারে যায়, বরকর্তা হয়ে যায় নাকি!

অনি ড্রয়ার খোলার আওয়াজ পেল। তারপর শুনল দাদু বলছেন, আমি আটটার মধ্যে ফিরে আসব। অনিকে বোললা ও যেন আমার জন্য অপেক্ষা করে, একসঙ্গে পাব।
 
পায়ের শব্দ পেতেই অনি দ্রুত সরে এল। আড়ালে দাঁড়িয়ে ও দেখল সাধুচরণ আর সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে দাদু বাইরে বেরিয়ে এলেন। পিসিমার গলায় দুর্গা দুর্গা শুনতে পেল সে। সাধুচরণ ও সেই ভদ্রলোকের পাশে দাদুকে একদম মানাচ্ছে না। লংক্লথের ময়লা পাঞ্জাবি, হাঁটুর নিচ অবধি ধুতি, লাঠি-হাতে দাদু ওঁদের সঙ্গে হেঁটে গলির বাঁক পেরিয়ে গেলেন। দরজা বন্ধ করে পিসিমা ডাকলেন, অনি, অনিবাবা!

সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষ সোজা হয়ে দাঁড়াল। দাদু কোথায় যাচ্ছেন সেটা বুঝতে পেরে ওর অসম্ভব কৌতূহল হতে লাগল। চট করে এপাশ-ওপাশ দেখে নিয়ে বারান্দায় ছেড়ে-রাখা চটিজোড়া এক হাতে তুলে ও লাফ দিয়ে ভেতরের বাগানে নেমে পড়ল।

বাড়ির পেছন দিয়ে দৌড়ে ও যখন গলির মুখে এসে দাঁড়াল ততক্ষণে সরিৎশেখররা টাউন ক্লাব ছাড়িয়ে গেছেন। দূর তেকে তাদের দেখতে পেয়ে নিশ্চিন্তমনে হাঁটতে লাগল ও। এখন প্রায় শেষুবিকেল। টাউন ক্লাবের মাঠে ফুটবল খেলা চলছে। রাস্তাটায় লোকজন বেশি, নিরাপদ দূরত্বে অনিমেষ হাঁটছিল। সাধুরচণ একটা রিকশা দাঁড় করিয়ে কী বলতে সরিৎশেখর ঘাড় নাড়ালেন। অনিমেষ জানে দাদু রিকশায় উঠবেন না। শরীর ঠিক থাকলে দাদকে রিকশায় ওঠানো সহজ নয়। অবশ্য এখন যদি দাদু রিকশায় উঠতেন তা হরে অনিমেষ কিছুতেই আর নাগল পেত না। রিকশায় না-ওঠার জন্য সময় সময় ওর দাদুর ওপর খুব রাগ হত, কিন্তু একন এই মুহূর্তে ওর খুব ভালো লাগল। দাদুর সঙ্গে হেঁটে তাল রাখতে পারছেন না সাধুচরণ। সঙ্গের ভদ্রলোকটি প্রায় দৌড়াচ্ছেন। বড় বড় পা ফেলে চলেছেন। সরিৎশেখর লাঠি দুলিয়ে। সাধুচরণকে ও কোনোদিন দাদু বলতে পারল না। এর জন্য অবশ্য হেমলতা অনেকটা যে কষ্ট দেয়, সে-মেয়ে মরে গেলে তো কষ্ট পাবেই না-এটা তো জানা কথা, কিন্তু তা বলে। পাঁচজনকে বলে বেড়াবে, অর্ধমুক্তি হল আমার। বাকি অর্ধেকটা যেন স্ত্রীর মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করছে। হেমলতা কোনোদিন ওকে কাকা জ্যাঠা বলতে পারেননি। সেটাই শুধু করেছিল অনি। সামনাসামনি কিছু বলত না, কিন্তু আড়াল হলেও পিসিমার মতো নাম ধরে বলা অভ্যাস করে ফেলল।

ঝোলনা পুল পার হয়ে করলা নদীর ধার ওঁদের থানার দিকে যেতে দেখে অনি দূরত্বটা বাড়িয়ে, দিল। এখানে রাস্তাটা অনেকখানি সোজা, চট করে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালে ও ধরা পড়ে যাবে। নিচে করলা নদীর জল কচুরিপানায় একদম ঢাকা পড়ে আছে। এখনও সন্ধে হয়নি। দাদুদের ওপর চোখ রেখে পুলের মাঝামাঝি এসে নতুন স্যারের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। পুলের তারের জালে হেলান দিয়ে নতুন স্যার দাঁড়িয়ে আছেন। ওঁকে দেখে নতুন স্যার হাসলেন, কোথায় যাচ্ছ অনিমেষ?

কী বলবে বুঝতে না পেরে অনি বলল, বেড়াতে।

ও, তোমাদের এই নদীকে আমার খুব ভালো লাগে, জান। কেমন চুপচাপ বয়ে চলে যায়। অথ এর নাম কেন একটা তেতো ফলের নামে রাখল বলো তো? নতুন স্যার বললেন।

অনি দেখছিল দাদুরা খুব দ্রুত দূরে চলে যাচ্ছেন। কিছু বলা দরকার তাই বলল, কমলা খেলে তো রক্ত পরিষ্কার হয়।

গুড! খুব খুশি হলেন নতুন স্যার, এই নদী শহরের দুষিত রক্ত পরিষ্কার করছে। এককালে এসব জায়গায় দেবী চৌধুরানী নৌকো নিয়ে বেড়াতেন। ইংরেজদের সঙ্গে ওর খুব যুদ্ধ হয়েছিল। তিস্তার পাড়ে এখনও নাকি একটা কালীমন্দির আছে যেটা শুনেছি ওরই প্রতিষ্ঠিত। তুমি দেবী চৌধুরানীর নাম শুনেছ?

অনি ঘাড় নাড়ল, না।

নতুন স্যার বললেন, ঠিক আছে, তোমাকে পরে একদিন ওর কথা বলব। আজ বরং তোমাকে একটা বই দিই। এটা চিরকাল তোমার কাছে রেখে দেবে। অনি দেখল নতুন স্যার তার কাধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে ওর দিকে এগিয়ে দিচ্ছেন। বইটার মলাটে পাগড়ি পরা একজন মানুষের মুখ যাকে দেখলে মারোয়াড়ি দোকানদার বলে মনে হয়। আর ওপরে লেখা রয়েছে আনন্দমঠ, নিচে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। নতুন স্যার বললেন, ইনি হলেন আমাদের সাহিত্যম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র। আর এই বল হল ভারতের স্বাধীনতার বীজমন্ত্র বন্দেমাতরমের উত্স। এই বই না পড়লে দেশকে জানা যাবে না, আমাদের ইতিহাসকে জানা যাবে না।
 
বইটা থেকে মুখ তুলে অনি দেখল থানার রাস্তায় দাদুদের কাউকে আর দেখা যাচ্ছে না। করল? ওপর আবছায়া সন্ধ্যার অন্ধকার কোন ফাঁকে চুইয়ে নেমে এসেছে। হঠাৎ কোনো কথা না বলে বই বগলে করে ও দৌগতে লাগল। নতুন স্যার অবাক হয়ে ওকে কিছু বললেন, কিন্তু সেটা শোনার জন্য সে দাঁড়াল না।

রাস্তাটা বাঁধানো নয়, একরাশ ধুলো উড়িয়ে ও থানার পাশে এসে দাঁড়াতেই ঢং ঢং করে পেটাঘড়িতে শব্দ হতে লাগল। এখান থেকে রাস্তা দুই ভাগ হয়ে গিয়েছে। কোন রাস্তা দিয়ে দাদু গিয়েছেন কী করে বোঝা যাবে? হঠাৎ খেয়াল হল সেদিন দাদু হোটেলের কথা বলছিলেন। থানার

ওপাশে কী-একটা হোটেলের সাইনবোর্ড দেখেছিল ও একদিন। সেদিনই পা চালাল অনি।

এখন সন্ধে হয়ে গিয়েছে। রাস্তায় তেমন আলো নেই। দুই-একটা রিকশা ছাড়া লোকজন কম যাওয়া-আসা করছে। থানার সামনে দুটো সিপাই বন্দুক ঘাড়ে করে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। একা সন্ধেবেলায় এইদিকে কখনো আসেনি ও। আনন্দমঠটা দুহাতে চেপে ধরে সামনে দিয়ে হেঁটে এল অনি। সামনেই একটা বিরাট বটগাছ, তার তলায় ভুজাওয়ালা দোকান। অনি গাছের তলায় চলে এল। এদিকে আলো নেই একদম, শুধু ভূজাওয়ালার দোকানের সামনে একটা গ্যাস পাইপ জ্বলছে। সেই আবহায়া অন্ধকারে দাঁড়িয়ে অনি দেখল বেশকিছু লোক হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। একটা কালো রঙের গাড়ির সামনের সিটে দাদু বসে আছেন। দাঁড়িয়ে-থাকা লোকগুলোর মধ্যে সাধুচরণ ছাড়া স্বৰ্গছেঁড়ার মনোজ হালদার, মালবাবুকে দেখতে পেল ও। একটু বাদেই অনি অবাক হয়ে দেখল কয়েকজন তোক মহীতোষকে দুপাশে ধরে হোটেলের সিড়ি দিয়ে নামিয়ে আনছে। বাবাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে এখন। এক হাতে টোপর, ধুতি কুঁচিয়ে ফুলের মতো অন্য হাতে ধরা, কপালে চন্দনের ফোঁটা, পাঞ্জাবিটা কেমন চকচকে করছে আলোয়। বাবা এসে গাড়ির পিছনে উঠে বসলেন। সাধুচরণ আর সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক মালবাবুকে নিয়ে গাড়িতে উঠলেন। গাড়িটা কিন্তু হুশ করে চলে যেতে পারল না। কারণ গাড়ির সামনে ধুতি পাঞ্জাবি পরা লোকজন হেঁটে যেতে লাগল পথ চিনিয়ে। সিটির দাঁড়িয়ে অনি গাড়িটাকে প্রায় ওর সামনে দিয়ে যেতে দেখল! দাদু গম্ভীরবে বসে আছেন। বাবা হেসে মালবাবুকে কী বলছেন। মুখ ফেরালেই ওরা ওকে দেখে ফেলতে পারতেন। দেখতে পেলে কি বাবা ওকে বকতেন? হঠাৎ ওর মনে পড়ল বাবার এইরকম পোশাক পরা একটা ছবি স্বৰ্গছেঁড়ার বাড়িতে মায়ের অ্যালবামে আছে। মা বলতেন, বিয়ের ছবি! আনন্দমঠ জড়িয়ে ধরে অনি চুপচাপ গাড়ি খানিক পেছনে হাঁটতে লাগল।

গলির মুখটায় বেশ ভিড়, গাড়ি ঢুকল না। তিন-চারটে গোরামনে মেয়ে শাঁখ বাজাতে বাজাতে এসে বাবাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে নিয়ে গেল, তারপর ভিড়টা সিনেমা হলে ঢোকার মতো গলির ভেতর চলে গেল। এখন চারিদিকে বেশ অন্ধকার। এ-রাস্তায় আলো নেই, শুধু বিয়েবাড়ি বলে গুলির মুখে একটা হ্যাজাক ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনির খুব কৌতূহল হচ্ছিল ভিতরে গিয়ে দেখতে বোনে। হচ্ছে। বাবা যখন মাকে বিয়ে করতে গিয়েছিল তখনও কি এইরকম ভিড় হয়েছিল? এইরকম আলো দিয়ে মায়েদের বাড়ি সাজানো হয়ছিল। মা বেঁচে থাকলে বাবা আর বিয়ে করতে পারত না এটা বুঝতে পাবে অনি। কিন্তু এখন, এই একটু আগে বাবাকে যখন মেয়েরা গাড়ি তেকে নামিয়ে নিয়ে গেল তখন তো একদম মনে হল না বাবার মনে কষ্ট আছে। বউ মরে গেলে যদি আবার বিয়ে করা যায় তো পিসিমা কেন বিয়ে করেনি? পিসিমা তো আবার শাড়ি পরে মাছ খেতে পারত। আজন্ম-দেখা পিসিমার চেহারাটায় ও মনেমনে শাড়ি সিঁদুর পরিয়ে হেসে ফেলল, দ্যৎ পিসিমাকে একদম মানায় না। ঠিক ওই সময় ও শুনতে পেল কে যেন ওর দিকে এগিয়ে আসতে আসতে জিজ্ঞাসা করছে, কী চাই খোন কা? এখানে দাঁড়িয়ে কী করছ?

অনিমেষ কী বলবে মনেমনে তৈরি করতে-না-করতে লোকটা এসে দাঁড়াল সামনে, নেমন্তন্ন খেতে এসেছ তো এখানে দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে যাও।
 
লোকটা ওর পিঠে হাত রেখে বলছে, ভেতরে যাও। এখন তো বেশ সহজে যেতে পারে। কিন্তু বাবা,-দাদু-অনিমেষ এক পা এগিয়ে আবার থমকে দাঁড়াল।

কী হল, দাঁড়ালে কেন? যাও। লোকটা কথাটা শেষ করতেই ওর মনে হল এবার একছুটে পালিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু ততক্ষণে একটা সন্দেহ এসে গেছে লোকটার মনে, তোমার নাম কী? কোন বাড়িতে থাকা

আমি এখানে থাকি না। অনিমেষ বলল।

কোন পাড়ায় থাক? কার সঙ্গে এসেছ?

আমি নেমন্তন্ন খেতে আসিনি। অনিমেষ প্রায় কেঁদে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে লোকটার চেহারা পালটে গেল, তা হলে এখানে দুরমুর করছিস কেন? চুরিচামারির ধান্দা, অ্যাঁ? যা ভাগ। অনিমেষ দেখল লোকটা চড় মরার ভঙ্গিতে একটা হাত উগড়ে তুলেছে। নিজেকে বাঁচাবার জন্য সরে যেতে না-যেতেই লোকটা খপ করে ওর হাত ধরল, তোর হতে এটা কী! বাই! কোত্থেকে মেরেছ বাবা! প্রায় ছোঁ মেরে বইটা কেড়ে নিয়ে লোকটা বেঁকিয়ে বেঁকিয়ে উচ্চারণ করল, আনন্দমঠ, অ্যাঁ? ধান্দাটা কী?

আমার বইটি দিন। অনিমেষ কোনোরকমে বলল।

অ্যাই চোপ। যা পালা এখান থেকে। লোকটা তেড়ে উঠতে পেছন থেকে আর-একটা গলা শোনা গেল, কী হয়েছে শ্যামসুন্দর? চেঁচাচ্ছে কেন?

আরে এই ছোকরা তখন থেকে ঘুরঘুর করছে, এ-পাড়ায় কোনোদিন দেখিনি। লোকটা মুখ ফিরিয়ে বলল।

খুব সাবধান। আজকাল চোর-ডাকাতের দল এইসব বাচ্চা ছেলেকে পাঠিয়ে খবরাখবর নেয়। অনিমেষ দেখল একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক ওদের দিকে এগিয়ে আসছেন।

হঠাৎ মাথা-গরম হয়ে গেল ওর। শ্যামাসুন্দর নামে লোকটা কিছু বোঝার আগেই ও ঝাঁপিয়ে পড়ে হাত থেকে আনন্দমঠটা ছিনিয়ে নিল। এত জোরে লাফিয়ে উঠেছিল অনিমেষ ও শ্যামসুন্দর ব্যালেন্স রাখতে না পেরে ঘুরে মাটিতে পড়ে গিয়ে ওরে বাপরে বাপ বলে চিৎকার করে অনিমেষকে জড়িয়ে ধরতে গেল। বেটাল হয়ে অনিমেষ মাটিতে পড়তে পড়তে কোনোরকমে শ্যামসুন্দরের মুখে একটা পেনালটি শট কষিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। অনিমেষকে ছেড়ে দিয়ে নিজের মুখ দুহাতে চেপে ডাকাত ডাকাত বলে শ্যামসুন্দর চাঁচাচ্ছে আর সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক হঠাৎ গলা ফাটিয়ে একটা বিকট শব্দ তুলতে লাগলেন। সঙ্গে সঙ্গে গলির ভিতরে অনেকগুলো গলায় হইহই আওয়াজ উঠল। অনিমেষ দেখল পিলপিল করে লোকজন বেরিয়ে আসছে গলি দিয়ে। আর দাঁড়াল না অনিমেষ, এক হাতে বইটা সামলে প্রাণপণে ছুটতে লাগল সামনের রাস্তা ধরে। কেউ পালিয়ে গেছে এটা বুঝতে না পেরে একটা অজানা অন্ধকার গলির ভেতর ঢুকে পড়ল। এতদূর দৌড়ে এসে ওর হাঁপ ধরে যাচ্ছিল, মুখ দিয়ে নিশ্বাস নিতে নিতে ও বুঝতে পারছিল আর পালাতে পারবে না। সামনে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ কিছু–একটায় পা জড়িয়ে ও ছিটকে রাস্তায় পড়ে গেল। ওর মনে হল ডান পায়ের বুড়ো আঙুলটা। ফেটে চৌচির হয়ে গেছে, একটা অসহ্য যন্ত্রণা পাক খেয়ে উঠেছে পা বেয়ে। চুপচাপ শুয়ে থাকতে থাকতে ও টের পেল পেছনে কোনো পায়ের শব্দ নেই। কোনো গলা ভেসে আসছে না। তা হলে কি ওরা আর পেছন পেছন আসছিল না? ও কি বোকার মতো ভয়ের চোটে দৌড়ে যাচ্ছিল। একটু একটু করে সাহস ফিরে আসতে শরীর ঠাণ্ডা হল, বুকের ভিতর ধুকধুকুনিটা কমে এল। অনিমেষ উঠে বসে নিজের বুড়ো আঙুলে হাত দিতেই আঙুলগুলো চটচটে হয়ে গেল। গরম ঘন বস্তুটি যে রক্ত তা বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল না। আঙুলের চটচটে অনুভূতিটা হঠাৎ ওকে কেমন আচ্ছন্ন করে ফেলল। একা এই অন্ধকারে মাটিতে বসে মাধুরীর মুখটা দেখতে পেয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল অনিমেষ।
 
পায়ের গোড়ালির উপর ভর করে কয়েক পা হেঁটে আসতে ও একসঙ্গে অনেকগুলো আলো দেখতে পেল। আললাগুলো খুব উজ্জ্বল নয়, পরপর লাইন কিছুটা দূরে চলে গেছে। কাছাকাছি অনেকগুলো গলা শুনতে পেল সে। বেশির ভাগ গলাই মেয়েলি, কেউ হাসছে, কেউ গান গাইছে। এইরকম গলায় কোনো মেয়েকে ও হাসতে শোনেনি কোনোদিন। ওকে দেখে মেয়েগুলো মুখের কাছে আলো তুলে ধরল। অবাক চোখে অনিমেষ দেখল পরপর অনেকগুলো মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে সার দিয়ে। কেমন সব সাদা-সাদা মুখ আর তাতে পড়েছে লণ্ঠন, কুপির আলো। যেন নিজেদের মুখ অনিকে দেখানোর জন্য ওরা আলোগুলো তুলেছে। একটা মেয়েলি গলায় চিৎকার উঠল, এ যে দেখি, কেষ্টঠাকুর, নাড় গোপাল, ননী খাবার ইচ্ছে হয়েছে বুঝি?

সঙ্গে সঙ্গে আলোগুলো নিচে নেমে এল, ওমা, এ যে দেখছি পুঁচকে ছেলে! আমি ভাবলাম নাগর এল বুঝি।

খিলখিল করে হেসে উঠল একজন, এগুলো হল ক্ষুদে শয়তান, বুঝলে দিদি! একটু সুড়সুড়ি উঠেছে কি এসে হাজির।

ঝ্যাঁটা মার, ঝ্যাঁটা মার।

আঃ থামো তো, রাম না বলতেই রামায়ণ গাইছ। অনিমেষ দেখলে একটা লম্বামতন মেয়ে লণ্ঠন-হাতে ওর দিকে এগিয়ে এল, এই ছোঁড়া, এখানে এসেছিস কেন?

আমি আর আসব না। অনিমেষ তাড়াতাড়ি বলে উঠল।

সঙ্গে সঙ্গে হাসির রোল ছড়িয়ে পড়ল, কান ধরে বলতে বল রে!

মেয়েটি এক হাত কোমরে রেখে অন্য হাতে হারিকেন ধরে আবার বলল, কিন্তু এসেছিস কেন? জানিস না এ-মহল্লার নাম বেগুনটুনি, এখানে আসতে নেই! নাকি জেনেশুনে এসেছিস?

ঘাড় নাড়ল অনিমেষ, তারপর বলল, আসতে নেই কেন?

মেয়েটি কী বরতে গিয়ে থেমে গেল, তারপর একটু নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, তুমি কোন স্কুলে পড়?

হঠাৎ তুই থেকে তুমিতে উঠে গেলে অনিমেষের কেমন অস্বস্তি হতে লাগল, জেলা স্কুলে।

বলতে বলতে ও যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত করে ফেলল। মেয়েটি বলল, কী হয়েছে, অ্যায়সা করছ কেন?

অনিমেষ পা-টা তুলে ধরতেই মেয়েটি মুখে হাতচাপা দিয়ে প্রায় চিৎকার করে উঠল, ওমা, এ যে দেখছি রক্তগঙ্গা ছুটছে, ক্যায়সা হল?

অনিমেষ দেখল আরও কয়েকজন এগিয়ে এসে মুখ বাড়িয়ে ওর পা দেখছে। একজন বলল, ছেড়ে দে, এই সন্ধেবেলায় আর ঝামেলা বাড়াস না।

কে-একজন জড়ানো গলায় গান গাইতে গাইতে এদিকে আসছে দেখে সবাই হৈ হৈ করে আবার বাতি নিয়ে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। প্রথম মেয়েটি সেদিকে একবার দেখে একটু ইতস্তত করে এক হাত অনিমেষের পিঠের ওপর রেখে বলল, তুমি আস্তে-আস্তে আমার কামরায় উঠে এসো তো!


একটু এগোলেই সার-দেওয়া মাটির ঘর দেখতে পেল অনিমেষ। তারই একটায় মেয়েটি ওকে নিয়ে ঢুকল। ঘরের মধ্যে লণ্ঠনটা রেখে মেয়েটি ওকে বসতে বলল। আসবার বলতে একটা তক্তাপোশ, আর ওপর বিছানা করা। দুটো বালিশ, কোনো পাশবালিশ নেই। দেওয়ালে একটা ভাঙা আয়না ঝোলানো, একদিকে দড়িতে কিছু জামাকাপড় এলোমেলোভাবে টাঙানো। ওকে বসতে বলে মেয়েটি তক্তাপোশের তলা থেকে একটা টিনের সুটকেস টেনে বের করে তা থেকে অনেকটা পাড় ছিঁড়ে নিয়ে এসে বলল, দেখি, গোড় বাড়াও! ওর খুব সঙ্কোচ হচ্ছিল মেয়েটি পা ধরায়, কিন্তু হঠাৎ ওর মনে হল মেয়েটি খুব ভালো। এত ভালো যে তার কাছে আসতে নেই কেন? তপুপিসির চেয়ে বেশি বড় হবে না মেয়েটি, কিন্তু সাজগোজ একদম অন্যরকম। এরা কারা? এই যে এত মেয়ে একসঙ্গে রয়েছে, সন্ধেবেলায় আলো নিয়ে ঘুরছে কী জন্যে? এটা কি কোনো হোস্টেল? ওদের স্কুলে যেমন ছেলেদের বোর্ডিং আছে তেমন কিছু কিন্তু মেয়েরা এত চেঁচিয়ে হাসবে কেন? ওর মনে পড়ে গেল হেমলতা ওকে যে অপ্সরাদের গল্প বলেছিলেন তারাও তো এইরকম হাসি গান নিয়ে থাকে, দরকার হলে ভগবানদের সভায় গিয়ে নেচে আসে। এরা কি নাচ জানে? দ্যুৎ অপ্সরারা দারুণ সুন্দরী হয়, এরা তো কেমন কালোকালো। হঠাৎ ডান পায়ের বুড়ো আঙুলে চাপ লাগাতেই অনিমেষের নজর পায়ের দিকে চলে এল। ও দেখল ওর পায়ের ওপর ইয়া লম্বা একটা ব্যান্ডেজ বাঁধা হয়ে গেছে। ওদের ডিল স্যার খুব সুন্দর করে ব্যান্ডেজ বাঁধার যে-কায়দাটা ওদের শিখিয়ে দিয়েছেন এই মেয়েটা নিশ্চয়ই সেটা জানে না।

কি, আর দরদ লাগছে। মেয়েটি গিট বেঁধে ওর পা কোল থেকে নামিয়ে দিল। ঘাড় নেড়ে না বলে অনিমেষ উঠে দাঁড়াতেই ওর মনে হল কী-একটা যেন ওর কাছে নেই। কী নেই বুঝতে না পেরে ও নিজের হাতের দিকে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠল অনিমেষ। ও যখন দৌড়ে এই গলির মুখে আসে তখনও বইটা তার হাতে ধরা ছিল হাতজোড়া হয়েছিল বলে একটুও লকোতে পারেনি। তা হলে নিশ্চয়ই অন্ধকারে হোঁচট খেয়ে ও যখন আছড়ে পড়েছিল তখন বইটা ছিটকে গিয়েছে। গোড়ালির ওপর ভর করে ও প্রায় দৌড়ে বাইরে আসছিল কিছু না বলে। মেয়েটি চট করে ওর হাত ধরে বলল, চলতে পারবে তো?

দ্রুত ঘাড় নাড়ল অনিমেষ, হ্যাঁ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে এল। মেয়েটি খুব অবাক হচ্ছিল ওর এইরকম পরিবর্তনে, লণ্ঠন-হাতে পেছন পেছন খানিকটা এসে চেঁচিয়ে বলল, আরে শোনো, সামালকে যাও। ততক্ষণে অনিমেষ অনেকটা দূর চলে গেছে। কিন্তু গলিটার মধ্যে এত অন্ধকার কেন যে-জায়গাটায় ও আছাড় খেয়ে পড়েছিল সে-জায়গাট যে ছাই বোঝা যাচ্ছে না। কোথায়। পা দিয়ে রাস্তাটা হাঁটকে দেখতে লাগল ও অন্ধের মতন। নতুন স্যার বলেছেন, এই বই না পড়লে দেশকে জানা যাবে না, আমাদের ইতিহাস জানা যাবে না। এই অন্ধকারে অনিমেষ কোথাও বইটার অস্তিত্ব খুঁজে পেল না একা একা। ঠিক এই সময় অন্ধকার কুঁড়ে একটা চিৎকার উড়ে এল, গলাটা ক্যানকেনে, কে রে এখানে ঘুরঘুর করে, ট্যাকখালির জমিদারের পো নাকি, বাপের বাসিবিয়ে দেখার বড় সাদ, না রে, যা বোরো এখান হতে। চারপাশে তাকিয়ে অনিমেষ কাউকে দেখতে পেল না। এই অন্ধকার গলিতে কাউকে দেখা অসম্ভব। অথচ ওর মনে হচ্ছে এই কথাগুলো যে বলল সে যেন স্পষ্ট তাকে দেখতে পাচ্ছে। কেমন শিরশির করতে লাগল ওর। এখান থেকে একদৌড়ে ও বড় রাস্তায় চলে যেতে পারে। কিন্তু বইটা? ধীরে ধীরে ও পেছনদিকে তাকাল। একটা আলো পেলে হত, কেউ যদি একটা আলো দিত ওকে!
 
গোড়ালিতে ভর করে ও আবার ফিরে এল। ওকে দেখে একজন শিস দিয়ে উঠল, আ গিয়া মেরা জান-খিলাও দো খিলি পান। আর-একজন বলে উঠল, হায় কপাল, এ-ছেঁড়ার দেখছি জোয়ার এসেছে, তুই যত ওকে ঘরে ফেরত পাঠাবি, কবুতরী, ও তত এখানে ঘুরঘুর করবে দ্যাখ।

অনিমেষ দেখল সেই মেয়েটি লণ্ঠন-হাতে দ্রুত ওর দিকে এগিয়ে এল। তা হলে এর নাম কবুতরী? বেশ সুন্দর নাম তো। ওর কাছে এসে কবুতরী বলল, ফিন চলে এলে, ঘর যাও। এখন ওর কথার মধ্যে বেশ একটা ব্যাজ টের পেল অনিমেষ। সেই নরম ভাবটা নেই। মুখ ঘুরিয়ে ও আবার গলিটার দিকে তাকাল-একদম ঘুটঘুট করছে। ওর কাছে আলো চাইলে কি খুব রেগে যাবে? কবুতরী সেটা লক্ষ করে বলল, ডর লাগছে নাকি? আসতে ডর নেই, যেতে ডর! চল, আমি যাচ্ছি। ফির কভি এখানে আসবি না। লণ্ঠনটা এক হাতে ধরে অন্য হাতে অনিমেষকে টানতে টানতে কবুতরী হাঁটতে লাগল। কয়েক পা এগোতেই বাঁদিকের রকে চোখ যেতে চমকে উঠল অনিমেষ। একটা বুড়ি শুকনো মুখ ফোকলা দাঁতে হাসছে। তার চোখ দুটো খুব বড়, সমস্ত চামড়া ঝুলছে। দুটো শুকনো পায়ের ফাঁকে মুণ্ডুটা ঝোলানো যেন, উবু হয়ে বসে আছে। বোধহয় কেউ সরিয়ে না দিলে নড়তে পারে না। হারিকেনের আলো ওর মুখ তেকে সরে যাবার আগেই ক্যানকেনে গলায় বেড়িয়ে এল মুখ থেকে, ক্যারে, বিয়ে দেখলি? অ্যাঁ?

বুকের ভিতর হিম হয়ে যায় আচমকা। হাঁটতে হাঁটতে কতরী বলল, ডরো মৎ। ও বহুৎ ভালো বুড়ি আছে, আমাদের দেখ ভাল করে। হোঁচট খাওয়ার জা; টায় এসে অনিমেষ দাঁড়িয়ে পড়ল। লণ্ঠনের আলো গলির ভিতর নাচতে নাচতে যাচ্ছে, ব্যাকুল চোখে ও চারধারে খুঁজতে লাগল। সব জায়গায় আলো যাচ্ছে না, বইটা কত দূরে যেতে পারে? কিছুদূর এগিয়ে থমকে দাঁড়াল কবুতরী, কী হল, খাড়া হয়ে গেলে কেন? আর ঠিক তখনই ও. দেখতে পেল রাস্তার পাশে নর্দমার গায়ে নরম পাকের ভিতর বর্শার মতো গেঁথে আছে বইটা। একছুটে অনিমেষ বইটাকে তুলে নিল। টপটপ করে কয়েক ফোঁটা কাদা-মাখা জল গড়িয়ে পড়ল নিচে, তলার দিকটা কাদায় ভিজে কালো হয়ে গিয়েছে। নতুন স্যার কী বলবেন ওকে হাত দিয়ে মলাটের কাদা মুছতে গিয়ে কাগজটা আরও কালো-কালো হয়ে গেল। আলোটা বেড়ে গেলে ও দেখল কবুতর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, কী টুড়ছ? কার কিতাব?

অনিমেষ বলল, আমার। পড়ে গিয়েছিল এখানে। কাদা লেগে গেছে।

লণ্ঠনটা নামিয়ে রেখে কবুতরী হঠাৎ বইটা টেনে নিল। উবু হয়ে বসে মলাটের ওপর পাগড়ি মাথায় বঙ্কিমচন্দ্রের ছবিটা খানিকক্ষণ দেখে জিজ্ঞাসা করল, নাম কী এই কিতাবের?

অনিমেষ বলল, আনন্দমঠ। বইটা খুলে পাতাগুলো ওলটাতে ওলটাতে কবুতরী বলল, জাদা নষ্ট হয়নি। শেষ পাতায় কিছুটা কাদা ছিল, আঙুল দিয়ে সেটাকে মুছতে খানিকটা দাগ হয়ে গেল। বইটা ফেরত দিয়ে কবুতরী জিজ্ঞাসা করল, এখন সাফ করলে আরও খারাপ পড়ে ফেলল-বিসর্জন আসিয়া প্রতিষ্ঠাকে লইয়া গেল।

লাইনটার মানে ও কিছুতেই বুঝতে পারল না।

দাদুর সঙ্গে চলে আসার পর আর স্বৰ্গছেঁড়ায় যায়নি অনিমেষ। মহীতোষ এর মধ্যে অনেকবার এসেছেন জলপাইগুড়িতে। প্রত্যেকবারই স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন, রাত্রে থাকেননি কখনো, বেলায়বেলায় চলে গিয়েছেন।

হেমলতা বলেছিলেন, মা না বলতে পারিস তুই, নতুন মা বলে ডাকিস, অনি। আমিও তা-ই বলতাম। হাজার হোক মা তো! ওরা এলো ধারেকাছে থাকত না অনি। প্রথমদিকে কেমন একটা অস্বস্তি, পরে লজ্জা-লজ্জা করত। অথচ ওরা আসবেন ছুটির দিন দেখে যখন অনিকে বাড়িতে থাকতেই হয়। মহীতোষ বাড়ি এসে বেশির ভাগ সময় তার বাবার সঙ্গেই গল্প করেন, চা-বাগানের বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ নেন। সেই সময় তার স্ত্রী রান্নাঘরে হেমলতার পাশে গিয়ে বসে থাকে। মেয়েটির বয়স অল্প এবং হেমলতা প্রথম আলাপেই বুঝে গিয়েছিলেন, মেয়েটির স্বভাবের সঙ্গে মাধুরীর যথেষ্ট মিল আছে। চিবুকের আদলটায় তো মাধুরী বসানো, সেইরকমই হাবভাব। তবে মাধুরী একটু ফরসা ছিল এই যা। প্রথম কদিন তো একদম কথাই বলেনি। হেমলতা তিনরার জিজ্ঞাসা করলে একবার উত্তর পান। সে-সময় কী কারণে মহীতোষ এদিকে এসেছিলেন, হেমলতা তাকে ডেকে বললেন, ও মহী, তোর বউ-এর বোধহয় আমাকে পছন্দ হয়নি, আমার সঙ্গে একদম কথা বলে না।
 
মহীতোষ উত্তর দেননি কিছু, চুপচাপ চলে গিয়েছিলেন ঘর থেকে। তার চলে যাওয়া বুঝতে পেরে খুব আস্তে অথচ দ্রুত নতুন বউ বলে উঠেছিল, আমার ভয় করে।

ভয়! ভয় কেন? অবাক হয়েছিলেন হেমলতা।

মাথা নিচু করে নতুন বউ বলেছিল, আমি যদি দিদির মতো না হই!

ব্যস। সঙ্গে সঙ্গে জল হয়ে গেলেন হেমলতা। মহীতোষের বিয়ে করাটা উনি একদম পছন্দ করেননি সেটা সবাই জানে। নতুন বউ এলে একটা দূরত্ব রেখে গেছেন এই কয়দিন, কখনো অনিকে বলেননি কাছে আসতে। এক সেই প্রথমদিন ওঁরা যখন জোড়ে এলেন, বউ এসে তাঁকে প্রণাম করল, কানে দুল দিয়ে আশীবাদ করলেন যখন তখন সরিৎশেখর অনিকে ধরে দাঁড়িয়েছিলেন। ছেলেটা। আগাগোড়া মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে থেকে ওঁদের প্রণাম করে চলে গেল। শ্বশুর সামনে তখন নতুন বউ একমাথা ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে। এখন এই মেয়েটার কথা শুনে বুকটা কেমন করে উঠল হেমলতার। মাধুরী মুখটা ভাবতে গিয়ে কাঁপুনি এল শরীরে। কোনোরকমে নিজেকে সামলে ললেন, তোমার নামটা আমার একদম ভালো লাগে না বাপু, আমি তোমাকে কিন্তু মাধুরী বলে ডাকব।

সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠে ওঁর দিকে তাকিয়েছিল নতুন বউ। হেমলতা দেখেছিলেন দুটো বড় বড় চোখ ওঁর দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে হেমলতা দেখলেন একটু একটু করে জল গড়িয়ে এসে চোখের কোনায় জমা হচ্ছে। খুব বড় একটা অন্যায় করে ফেলেছেন বুঝতে পেরে গেছেন ততক্ষণে। সরিৎশেখর চিরকাল তাকে বকাবকি করেছেন পেট-আলগা বলে, মনে যা আসে মুখে তা না বললে স্বস্তি পান না হেমলতা। এই মেয়েটাকে মাধুরী বলে ডাকলে মনটা শান্ত হবে। ভেবেই কথাটা বলেছিলেন।

খপ করে নতুন বউ-এর হাতটা ধরলেন হেমলতা, রাগ করলি ভাই, আমি তোকে সত্যি বলছি, দুঃখ দিতে চাইনি।

নতুন বউ-এর তখন গলা ধরে গেছে, আপনি আমাকে যা-খুশি ডাকুন।

হেমলতা বললেন, দেখি তোর একটা পরীক্ষা নিই। কাল রাত্রে পায়েস করেছিলাম। অনির জন্য একবাটি সরপাতা হয়ে আছে। ওটা নিয়ে ছেলেটাকে খাইয়ে আয় দেখি। বেলা হয়ে গেল।

কথার নেশায় হেমলতা কখন টপ করে যে তুইতে নেমে এসেছেন নিজেই বুঝতে পারেননি। বয়সে ছোট কাউকে যদি ভালো লেগে যায় তাহলে তাকে তুই না বললে একদম সুখ হয় না তার।

ঘরের কোনায় মিটসেফের ভিতর পায়েসের বাটিগুলো চাপা দেওয়া আছে। আগের সন্ধেবেলায় রাধা পায়েস এক-একটা বাটিতে ঢেলে রেখে দেন হেমলতা। নাড়াচাড়া না হওয়ায় বাটিগুলোতে পায়ে জমে গিয়ে পুরু সর পড়ে যায়। সরিৎশেখরের ভালোবাসার জিনিসের মধ্যে এখন এই একটা জিনিস টিমটিম করে বেঁচে রয়েছে। ভালো দুধ পাওয়া যায় না এখানে, স্বৰ্গছেঁড়ায় যখন পায়েস রান্না হত সাত বাড়ির লোক টের পেত। কালানোনিয়া চালের গন্ধে চারধার ম-ম করত। সরিৎশেখর নিজেই এক জামবাটি পায়েস দুবেলা খেতেন! দাদুর এই শখটা পেয়েছে নাতি, পায়েস খেতে বড় ভালোবাসে ছেলেটা।

আজ মহীতোষরা আসবেন বলে প্রত্যেকের জন্য আলাদা বাটিতে পায়েস বেঁধে রেখেছেন হেমলতা। সকালে দেখেছেন সেগুলো জমে গিয়েছে বেশ। বিভিন্ন সাইজের বাটি আছে মিটসেফে। নতুন বউ উঠে দাঁড়ালে তিনি মিটসেফটা ওকে দেখিয়ে দিলেন। বুক-সমান মিটসেফের দরজা খুলে নতুন বউ সেদিকে তাকাতেই হেমলতা আড়চোখে দেখতে লাগলেন। অনির মন অল্পে ভরে না, ছোট বাটিতে পায়েস দিলে ঠ্যাচামেচি করবেই। নতুন বউ কোনো বাটিটা তোলে দেখছিলেন তিনি, মন বোঝা যাবে। দেওয়ার হাতটা টের পাওয়া যাবে। মেয়েটার বুদ্ধি আছে, মনে মনে খুশি হলেন হেমলতা। বড় তিনটে বাটির একটাকে বের করে আনল নতুন বউ, ছোট দুটোতে হাত ছোঁয়াল না। যাক, অনিটার কখনো কষ্ট হবে না। চামচটাও মনে করে নিল!

হেমলতা বললেন, বড় বাড়িতে রয়েছে ও, তুই গিয়ে ভালো করে আলাপ করে পায়েস খাইয়ে আয়। এক পা হেঁটে আবার দাঁড়িয়ে পড়ল নতুন বউ। কিছু-একটা বলব-বলব করে যেন বলতে পারছিল না। সেটা বুঝতে পেরেই যেন হেমলতা বললেন, কী হল, আরে বাবা নিজের ছেলের কাছে যাচ্ছিস, লজ্জা কিসের! অনি বড় ভালো ছেলে, মনটা খুব নরম। নে যা, আমি আর বকবক করতে পারছি না, উনুন কামাই যাচ্ছে।
 
ভেতরের বারান্দায় সরিৎশেখর মহীতোষের সঙ্গে বসেছিলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে নতুন বউকে দেখলেন সরিৎশেখর। একমাথা ঘোমটা, আঁচলের তলায় কিছু-একটা ঢেকে নিয়ে উঠোন পেরিয়ে আসছে। ওকে দেখলেই চট করে মাধুরীর কথা মনে পড়ে যায়। মাধুরীও ঘোমটা দিত তবে এতটা নয়। সে-মেয়েকে পছন্দ করে এনেছিলেন তিনি, তার পছন্দের জিনিস বেশিদিন টেকে না। ছেলের দিকে তাকালেন, মহীতোষও বউকে দেখছে। একটুও গলা ঝেড়ে নিয়ে বললেন, মেয়েটাকে ওর বাপের কাছে নিয়ে যাও না কেন? প্রত্যেকবারেই দেখতে পাই এখানে এসেই ফিরে যাচ্ছ।

হঠাৎ-এ ধরনের কথার জন্য তৈরি ছিলেন না মহীতোষ। কিছু-একটা নিয়ে স্ত্রীকে ওদিকে যেতে দেখে অবাক হয়েছিলেন তিনি। এই প্রথম এ-বাড়িতে ওকে দিয়ে কোনো কাজ করাচ্ছে দিদি। কিন্তু কার যাচ্ছে। ওখানে তো অনি থাকে। ছেলের সঙ্গে এখ ভালো করে কথা হয় না তার, কেমন অস্বস্তি হয়। স্ত্রীকে অনির কাছে যেতে দেখে হঠাৎ খুব আরাম বোধ হচ্ছিল। এই সময় বাবার প্রশ্নটা কানে কী বলবেন বুঝতে না পেরে কান চুলকে বললেন, যেতে চায় না ও।

ভ্রূ কুঁচকালেন সরিৎশেখর, সে কী! না না, এ ঠিক কথা নয়। তোমারই উদ্যোগী হওয়া উচিত, এক শহরে বাড়ি, তার মা-বাবা কী ভাবছেন বলো তো!

সরিৎশেখর নিজে কখনো ছেলের শ্বশুবাড়িতে যান না, অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও যেতে পারেন না। মহীর বিয়ের রাত্রে বাড়ি ফিরে তার যে-অভিজ্ঞতা হয়েছিল সে-কথা কাউকে বলা হয়নি, এমনকি হেমলতাকেও নয়। নাতির মুখের দিকে চেয়ে সেদিন তিনি অবাক হয়ে গিয়েছিলেন।

নতুন বউ এদিকটায় কখনো আসেনি। বিরাট বারান্দা পেরিয়ে সার-দেওয়া ঘরগুলোর কোনটায় অনিমেষ আছে বুঝে উঠতে সময় লাগল তার। দরজাটা ভেজানো ছিল। হঠাৎ তার মনের হল শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে, হাতে কোনো সাড় নেই। এ-বাড়িতে যেদিন প্রথম এসেছিল সেদিনও এরকম মনে হয়নি। এতবড় একটা ছেলে যার তাকে বিয়ে করতে কখনোই ইচ্ছে হয়নি তার, তবু বিয়েটা হলে গেল। আর বিয়ের পর ইস্তক অহরহ যার নাম শুনছে ও, সে হল এই ছেলে। মহীতোষের কথাবার্তায় বুঝতে পেরেছে ছেলের মন জয় করতে মহীতোষ স্ত্রীকে যেন পরোক্ষভাবে নির্দেশ দিচ্ছেন। কিন্তু সেটা কী করে হয়! আজ অবধি জেনেশুনে কোনো মন জয় করার চেষ্টা ওকে করতে হয়নি। সেটা কী করে করতে হবে মহীতোষ তাকে শিখিয়ে দেননি কিন্তু। ভেজানো দরজাটা ঠেলল নতুন বউ।

বাবা এবং নতুন মা এসেছেন জানতে পেরে অনি চুপচাপ করে বসে ছিল। পিসিমার নির্দেশমতো ও মনে মনে নতুন মা শব্দটাকে অনেকখানি রপ্ত করে নিয়েছে, কিন্তু ব্যবহার করেনি। দূর থেকে কয়েকবার নতুন মাকে ও দেখেছে। এর আগে ওরা যখন এসেছেন তখন দুপুরের খাওয়ার সময় বাবা আর দাদুর পাশে বসে খেতে খেতে মাথা নিচু করে আড়চোখে দেখেছে, একটা রঙিন শাড়ি রান্নাঘরের দরজার অনেকটা আড়ালে দাঁড়িয়ে রয়েছে। খাওয়ার সময় বসে খাতাটা অত্যন্ত খারাপ লাগে অনির। বাবা যেন না বললে নয় এরকম দুএকটা প্রশ্ন করেন। কত তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করতে পারবে সেই চেষ্টা চালিয়ে যায় অনি। পিসিমা পরিবেশন করে বলে স্বস্তি পায় ও। এতদিন যা মনে হয়নি আজ ওঁরা যখন রিকশা থেকে নামলেন তখন অনি খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল। বাথরুমে টিনের বালতিতে ওর জামাকাপড় জলে ভিজিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে আসছিল পড়তে, এমন সময় রিকশা বাড়ির সামনে এসে। থামে। মহীতোষ রিকশাগুলোকে পয়সা দিচ্ছিলেন যখন তখন নতুন মা রিকশা থেকে নেমে ঘোমটা ঠিক করে বাড়ির দিকে তাকাল। তার তাকানোর ভঙ্গিটা অনিকে কেমন চমকে দিল। ওর মনে যেটুকু আছে, মাধুরী এইরকমভাবে তাকাতেন। একছুটে নিজের ঘরে চলে গিয়েছিল অনি, কেউ ওকে লক্ষ করেনি।

কালকের পড়া হয়ে গিয়েছিল। খুব একটা আটকে না গেলে ও পড়া বুঝতে সরিৎশেখরের কাছে যায় না। এমনিতে দাদু খুব ভালো কিন্তু পড়াতে গেলেই চট করে এমন রেগে যান যে অনিকে অবশ্যই চড়-চাপড় খেতে হয়। সে-সময় ওঁর চেহারাই অন্যরকম হয়ে যায়। একটা সাধারণ ইংরেজি শব্দ অনি কেন বুঝতে পারছে না এই সমস্যাট এত প্রবল হয়ে ওঠে যে সেটা সমাধান করতে প্রহার ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সামনের বছর থেকে মাস্টার রাখবেন মহীতোষ, সরিৎশেখরকে এরকম বলতে শুনেছে ও। পিসিমাকে অনি বলেছে যদি মাস্টার রাখতেই হয় তা হলে নতুন স্যারকে যেন রাখা হয়।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top