এখন এই সকালে ওর মনে পড়ে গেল ভবানী মাস্টার বলে দিয়েছিলেন বন্দে মাতরম্ শব্দের মানে কী। এখন এই মুহূর্তে দাদুর সঙ্গে শহরে যেতে ওর একদম ইচ্ছে করছে না। স্বৰ্গছেঁড়ার এই বাড়ি, মায়ের গন্ধ, সামনের মাঠের চাপাগাছ আর পেছনে ঝিরঝিরে নদীটা ছেড়ে না গেলে যদি বড় না হওয়া যায় তাতে ওর বিন্দুমাত্র এসে যায় না।
তিনটে লরিতে মালপত্র বোঝাই হচ্ছে। পিসিমা সমস্ত বাড়ি ঘুরে এসে ঠাকুরঘরে ঢুকেছেন। মহীতোষ দাড়িয়ে থেকে দেখছেন কুলিরা লরিতে মালপত্র ঠিকঠাক রাখছে কি না। প্রিয়তোষ দাঁড়িয়ে ছিল বারান্দায়, তাকে লরির ওপর উঠে তদারকি করতে বলে মহীতোষ ঘরে এলেন। সরিৎশেখরের খাওয়াদাওয়া হয়ে গিয়েছিল আগেই, এখন যাবার জন্য জামাকাপড় পরে একদম প্রস্তুত। সকাল থেকে অনেকবার তাগাদা দিয়েছেন সবাইকে, বিকেল হয়ে গেলে তিস্তা পেরুতে জোড়া নৌকো পাওয়া যাবে না। সেই সাতসকালে খেয়েদেয়ে বসে আছেন। ঘরভরতি এখন লোক। স্বৰ্গছেঁড়া চা-বাগানের বুরা তো আছেনই, আশেপাশের বাস্ক টিম্বার-মার্চেন্টরাও এসেছেন। ঘরে ঢোকার আগে মহীতোষ দেখে এসেছেন সামনের মাঠটা মানুষের মাথায় ভরে গেছে। চা-বাগানের সমস্ত মদেসিয়া-মুণ্ডা-ওঁরাও শ্রমিকরা একদৃষ্টে এই বাড়ির দিকে চেয়ে আছে। ফুটবল মাঠেও এত ভিড় হয় না।
সরিৎশেখর ছেলেকে দেখে বললেন, হয়ে গেছে সব?
মহীতোষ বললেন, একটু বাকি আছে।
সরিৎশেখর বললেন, কী যে কর তোমরা, বারোটা পঞ্চাশের পর যাওয়া যাবে না, বারবেলা পড়ে যাবে। তাড়াতাড়ি করতে বলো সবাইকে।
মহীতোষ ভেতরে এসে দেখলেন মাধুরী একটা ছোট সুটকেসে অনির জামাকাপড় ভরে সেটাকে দরজার পাশে রাখছেন। মহীতোষ বললেন, অনি কোথায়?
মাধুরী বললেন, এই তো এখানেই ছিল। মোটেই যেতে চাইছে না।
যাবার জন্য লাফাচ্ছিল এতদিন, এখন যেতে চাইছে না বললে হবে! মহীতোষ কেমন বিষণ্ণ গলায় বললেন।
দ্যাখো, যা ভালো বোঝ করো। বলে মাধুরী ভেতরে চলে গেলেন।
মহীতোষ বাড়ির ভেতরে ছেলেকে পেলেন না। বাগানের দিকে উকি মেরে দেখলেন সেখানে কেউ নেই। যাবার সময় হয়ে গেল অথচ ছেলেটা গেল কোথায়। গোয়ালঘরের পেছনে এসে মহীতোষ থমকে দাঁড়ালেন। অনিকে দেখা যাচ্ছে। মাটিতে উবু হয়ে বসে আছে। ডাকতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত নাডেকে নিঃশব্দে পেছনে এসে দাঁড়ালেন তিনি। এখান থেকে অনির মুখ দেখা যাচ্ছে না বটে কিন্তু ফোপানির শব্দটা শোনা যাচ্ছে। এইভাবে নির্জনে বসে ছেলেটাকে কাঁদতে দেখে মহীতোষ কেমন হয়ে গেলেন। সাধারণ ছেলেমেয়ের মতো ও চটপটে নয়, কিন্তু ঐ বয়সের ছেলের চেয়ে ওর বুদ্ধিটা অনেক বড়, বেশিরকম বড়। কথা যখন বলে তখন ওর বয়েসের ছেলের মতো বলে না। সরিৎশেখর ওকে বেশি স্নেহ করেন, বোধহয় পৃথিবীতে একমাত্র অনিই সরিৎশেখরের মন নরম করতে পারে। এখন ছেলেকে কাঁদতে দেখে মহীতোষের বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল। এই একান্নবর্তী পরিবারে ছেলের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ আলাদা করে নয়। বলতে গেলে ঝাড়ির সঙ্গে যতটুকু কথা হয় অনির সঙ্গে সেইটুকুই হয়। অনি শহরে চলে যাবে বাবার সঙ্গে, লেখাপড়া শিখবে-এরকম কথা ছিল। কিন্তু এইমাত্র মহীতোষের মনে হল তার ছেলে এখন থেকে তার সঙ্গে থাকছে না।
দুহাত বাড়িয়ে অনিকে কোলে তুলে নিতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন মহীতোষ। উবু হয়ে বসে ফোপাতে ফোঁপাতে অনি মুঠোয় করে মাটি তুলছে। ওর সামনে একটা রুমাল পাতা। রুমালটার অনেকটা সেই মাটিতে ভরতি। ব্যাপারটা কী, ও রুমালে মাটি রাখছে কেন? শেষ পর্যন্ত অনি যখন রুমাল বাধতে শুরু করল মহীতোষ নিঃশব্দে পিছু ফিরলেন। ছেলের এই গোপন সংগ্রহ দেখে ফেলেছেন-এটা ওকে বুঝতে দেওয়া কোনোমতেই চলবে না। গোয়ালঘর পেরিয়ে এসে উকি মেরে দেখলেন অনি উঠে দাঁড়িয়েছে। এক হাতে চোখ মুছছে, অন্য হাতে রুমালের পুঁটলিটা ধরা। আড়াল থেকে মহীতোষ হাঁক দিলেন, অনি, অনি! ছেলের সাড়া না পেয়ে আবার ডাকলেন। এবার খুব আস্তে, ক্ষীণ গলায় অনি সাড়া দিতে মহীতোষ উঁচু গলায় বললেন, ওখানে কী করছ! দাদু যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়েছেন, তাড়াতাড়ি চলে এসো। খাটা বলে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালেন না মহীতোষ।
তিনটে লরিতে মালপত্র বোঝাই হচ্ছে। পিসিমা সমস্ত বাড়ি ঘুরে এসে ঠাকুরঘরে ঢুকেছেন। মহীতোষ দাড়িয়ে থেকে দেখছেন কুলিরা লরিতে মালপত্র ঠিকঠাক রাখছে কি না। প্রিয়তোষ দাঁড়িয়ে ছিল বারান্দায়, তাকে লরির ওপর উঠে তদারকি করতে বলে মহীতোষ ঘরে এলেন। সরিৎশেখরের খাওয়াদাওয়া হয়ে গিয়েছিল আগেই, এখন যাবার জন্য জামাকাপড় পরে একদম প্রস্তুত। সকাল থেকে অনেকবার তাগাদা দিয়েছেন সবাইকে, বিকেল হয়ে গেলে তিস্তা পেরুতে জোড়া নৌকো পাওয়া যাবে না। সেই সাতসকালে খেয়েদেয়ে বসে আছেন। ঘরভরতি এখন লোক। স্বৰ্গছেঁড়া চা-বাগানের বুরা তো আছেনই, আশেপাশের বাস্ক টিম্বার-মার্চেন্টরাও এসেছেন। ঘরে ঢোকার আগে মহীতোষ দেখে এসেছেন সামনের মাঠটা মানুষের মাথায় ভরে গেছে। চা-বাগানের সমস্ত মদেসিয়া-মুণ্ডা-ওঁরাও শ্রমিকরা একদৃষ্টে এই বাড়ির দিকে চেয়ে আছে। ফুটবল মাঠেও এত ভিড় হয় না।
সরিৎশেখর ছেলেকে দেখে বললেন, হয়ে গেছে সব?
মহীতোষ বললেন, একটু বাকি আছে।
সরিৎশেখর বললেন, কী যে কর তোমরা, বারোটা পঞ্চাশের পর যাওয়া যাবে না, বারবেলা পড়ে যাবে। তাড়াতাড়ি করতে বলো সবাইকে।
মহীতোষ ভেতরে এসে দেখলেন মাধুরী একটা ছোট সুটকেসে অনির জামাকাপড় ভরে সেটাকে দরজার পাশে রাখছেন। মহীতোষ বললেন, অনি কোথায়?
মাধুরী বললেন, এই তো এখানেই ছিল। মোটেই যেতে চাইছে না।
যাবার জন্য লাফাচ্ছিল এতদিন, এখন যেতে চাইছে না বললে হবে! মহীতোষ কেমন বিষণ্ণ গলায় বললেন।
দ্যাখো, যা ভালো বোঝ করো। বলে মাধুরী ভেতরে চলে গেলেন।
মহীতোষ বাড়ির ভেতরে ছেলেকে পেলেন না। বাগানের দিকে উকি মেরে দেখলেন সেখানে কেউ নেই। যাবার সময় হয়ে গেল অথচ ছেলেটা গেল কোথায়। গোয়ালঘরের পেছনে এসে মহীতোষ থমকে দাঁড়ালেন। অনিকে দেখা যাচ্ছে। মাটিতে উবু হয়ে বসে আছে। ডাকতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত নাডেকে নিঃশব্দে পেছনে এসে দাঁড়ালেন তিনি। এখান থেকে অনির মুখ দেখা যাচ্ছে না বটে কিন্তু ফোপানির শব্দটা শোনা যাচ্ছে। এইভাবে নির্জনে বসে ছেলেটাকে কাঁদতে দেখে মহীতোষ কেমন হয়ে গেলেন। সাধারণ ছেলেমেয়ের মতো ও চটপটে নয়, কিন্তু ঐ বয়সের ছেলের চেয়ে ওর বুদ্ধিটা অনেক বড়, বেশিরকম বড়। কথা যখন বলে তখন ওর বয়েসের ছেলের মতো বলে না। সরিৎশেখর ওকে বেশি স্নেহ করেন, বোধহয় পৃথিবীতে একমাত্র অনিই সরিৎশেখরের মন নরম করতে পারে। এখন ছেলেকে কাঁদতে দেখে মহীতোষের বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল। এই একান্নবর্তী পরিবারে ছেলের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ আলাদা করে নয়। বলতে গেলে ঝাড়ির সঙ্গে যতটুকু কথা হয় অনির সঙ্গে সেইটুকুই হয়। অনি শহরে চলে যাবে বাবার সঙ্গে, লেখাপড়া শিখবে-এরকম কথা ছিল। কিন্তু এইমাত্র মহীতোষের মনে হল তার ছেলে এখন থেকে তার সঙ্গে থাকছে না।
দুহাত বাড়িয়ে অনিকে কোলে তুলে নিতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন মহীতোষ। উবু হয়ে বসে ফোপাতে ফোঁপাতে অনি মুঠোয় করে মাটি তুলছে। ওর সামনে একটা রুমাল পাতা। রুমালটার অনেকটা সেই মাটিতে ভরতি। ব্যাপারটা কী, ও রুমালে মাটি রাখছে কেন? শেষ পর্যন্ত অনি যখন রুমাল বাধতে শুরু করল মহীতোষ নিঃশব্দে পিছু ফিরলেন। ছেলের এই গোপন সংগ্রহ দেখে ফেলেছেন-এটা ওকে বুঝতে দেওয়া কোনোমতেই চলবে না। গোয়ালঘর পেরিয়ে এসে উকি মেরে দেখলেন অনি উঠে দাঁড়িয়েছে। এক হাতে চোখ মুছছে, অন্য হাতে রুমালের পুঁটলিটা ধরা। আড়াল থেকে মহীতোষ হাঁক দিলেন, অনি, অনি! ছেলের সাড়া না পেয়ে আবার ডাকলেন। এবার খুব আস্তে, ক্ষীণ গলায় অনি সাড়া দিতে মহীতোষ উঁচু গলায় বললেন, ওখানে কী করছ! দাদু যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়েছেন, তাড়াতাড়ি চলে এসো। খাটা বলে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালেন না মহীতোষ।