What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected উত্তরাধিকার - সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

এখন এই সকালে ওর মনে পড়ে গেল ভবানী মাস্টার বলে দিয়েছিলেন বন্দে মাতরম্ শব্দের মানে কী। এখন এই মুহূর্তে দাদুর সঙ্গে শহরে যেতে ওর একদম ইচ্ছে করছে না। স্বৰ্গছেঁড়ার এই বাড়ি, মায়ের গন্ধ, সামনের মাঠের চাপাগাছ আর পেছনে ঝিরঝিরে নদীটা ছেড়ে না গেলে যদি বড় না হওয়া যায় তাতে ওর বিন্দুমাত্র এসে যায় না।

তিনটে লরিতে মালপত্র বোঝাই হচ্ছে। পিসিমা সমস্ত বাড়ি ঘুরে এসে ঠাকুরঘরে ঢুকেছেন। মহীতোষ দাড়িয়ে থেকে দেখছেন কুলিরা লরিতে মালপত্র ঠিকঠাক রাখছে কি না। প্রিয়তোষ দাঁড়িয়ে ছিল বারান্দায়, তাকে লরির ওপর উঠে তদারকি করতে বলে মহীতোষ ঘরে এলেন। সরিৎশেখরের খাওয়াদাওয়া হয়ে গিয়েছিল আগেই, এখন যাবার জন্য জামাকাপড় পরে একদম প্রস্তুত। সকাল থেকে অনেকবার তাগাদা দিয়েছেন সবাইকে, বিকেল হয়ে গেলে তিস্তা পেরুতে জোড়া নৌকো পাওয়া যাবে না। সেই সাতসকালে খেয়েদেয়ে বসে আছেন। ঘরভরতি এখন লোক। স্বৰ্গছেঁড়া চা-বাগানের বুরা তো আছেনই, আশেপাশের বাস্ক টিম্বার-মার্চেন্টরাও এসেছেন। ঘরে ঢোকার আগে মহীতোষ দেখে এসেছেন সামনের মাঠটা মানুষের মাথায় ভরে গেছে। চা-বাগানের সমস্ত মদেসিয়া-মুণ্ডা-ওঁরাও শ্রমিকরা একদৃষ্টে এই বাড়ির দিকে চেয়ে আছে। ফুটবল মাঠেও এত ভিড় হয় না।

সরিৎশেখর ছেলেকে দেখে বললেন, হয়ে গেছে সব?

মহীতোষ বললেন, একটু বাকি আছে।

সরিৎশেখর বললেন, কী যে কর তোমরা, বারোটা পঞ্চাশের পর যাওয়া যাবে না, বারবেলা পড়ে যাবে। তাড়াতাড়ি করতে বলো সবাইকে।

মহীতোষ ভেতরে এসে দেখলেন মাধুরী একটা ছোট সুটকেসে অনির জামাকাপড় ভরে সেটাকে দরজার পাশে রাখছেন। মহীতোষ বললেন, অনি কোথায়?

মাধুরী বললেন, এই তো এখানেই ছিল। মোটেই যেতে চাইছে না।

যাবার জন্য লাফাচ্ছিল এতদিন, এখন যেতে চাইছে না বললে হবে! মহীতোষ কেমন বিষণ্ণ গলায় বললেন।

দ্যাখো, যা ভালো বোঝ করো। বলে মাধুরী ভেতরে চলে গেলেন।

মহীতোষ বাড়ির ভেতরে ছেলেকে পেলেন না। বাগানের দিকে উকি মেরে দেখলেন সেখানে কেউ নেই। যাবার সময় হয়ে গেল অথচ ছেলেটা গেল কোথায়। গোয়ালঘরের পেছনে এসে মহীতোষ থমকে দাঁড়ালেন। অনিকে দেখা যাচ্ছে। মাটিতে উবু হয়ে বসে আছে। ডাকতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত নাডেকে নিঃশব্দে পেছনে এসে দাঁড়ালেন তিনি। এখান থেকে অনির মুখ দেখা যাচ্ছে না বটে কিন্তু ফোপানির শব্দটা শোনা যাচ্ছে। এইভাবে নির্জনে বসে ছেলেটাকে কাঁদতে দেখে মহীতোষ কেমন হয়ে গেলেন। সাধারণ ছেলেমেয়ের মতো ও চটপটে নয়, কিন্তু ঐ বয়সের ছেলের চেয়ে ওর বুদ্ধিটা অনেক বড়, বেশিরকম বড়। কথা যখন বলে তখন ওর বয়েসের ছেলের মতো বলে না। সরিৎশেখর ওকে বেশি স্নেহ করেন, বোধহয় পৃথিবীতে একমাত্র অনিই সরিৎশেখরের মন নরম করতে পারে। এখন ছেলেকে কাঁদতে দেখে মহীতোষের বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল। এই একান্নবর্তী পরিবারে ছেলের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ আলাদা করে নয়। বলতে গেলে ঝাড়ির সঙ্গে যতটুকু কথা হয় অনির সঙ্গে সেইটুকুই হয়। অনি শহরে চলে যাবে বাবার সঙ্গে, লেখাপড়া শিখবে-এরকম কথা ছিল। কিন্তু এইমাত্র মহীতোষের মনে হল তার ছেলে এখন থেকে তার সঙ্গে থাকছে না।

দুহাত বাড়িয়ে অনিকে কোলে তুলে নিতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন মহীতোষ। উবু হয়ে বসে ফোপাতে ফোঁপাতে অনি মুঠোয় করে মাটি তুলছে। ওর সামনে একটা রুমাল পাতা। রুমালটার অনেকটা সেই মাটিতে ভরতি। ব্যাপারটা কী, ও রুমালে মাটি রাখছে কেন? শেষ পর্যন্ত অনি যখন রুমাল বাধতে শুরু করল মহীতোষ নিঃশব্দে পিছু ফিরলেন। ছেলের এই গোপন সংগ্রহ দেখে ফেলেছেন-এটা ওকে বুঝতে দেওয়া কোনোমতেই চলবে না। গোয়ালঘর পেরিয়ে এসে উকি মেরে দেখলেন অনি উঠে দাঁড়িয়েছে। এক হাতে চোখ মুছছে, অন্য হাতে রুমালের পুঁটলিটা ধরা। আড়াল থেকে মহীতোষ হাঁক দিলেন, অনি, অনি! ছেলের সাড়া না পেয়ে আবার ডাকলেন। এবার খুব আস্তে, ক্ষীণ গলায় অনি সাড়া দিতে মহীতোষ উঁচু গলায় বললেন, ওখানে কী করছ! দাদু যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়েছেন, তাড়াতাড়ি চলে এসো। খাটা বলে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালেন না মহীতোষ।
 
ঘর থেকে সবাই বারান্দায় নেমে দাড়িয়েছে। বাড়ির সামনে দাঁড়ানো লরিগুলোর গা-ঘেঁষে মানুষের জটলা। মালপত্র বাধা শেষ, প্রিয়তোষ ঘরে ঢুকে সরিৎশেখরকে বলল, আর দেরি করবেন না, বেলা হল।

কথাটা শোনার জন্যই বসে ছিলেন সরিৎশেখর, তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে বললেন, চলি তা হলে।

ডাক্তার ঘোষাল বললেন, একদম ভুলে যাবেন না আমাদের।

সরিৎশেখর বললেন, সে কী! তোমাকে ভুলব কী করে হে, তুমি যে আমার-কথাটি বলতে গিয়ে থমকে গেলেন উনি।

এখন এই পরিবেশে ওঁদের সেই চিরকেলে ঠাটাটা একদম মানায় না। সরিৎশেখর থেমে গেলেও ডাজার ঘোষাল বাকিটুকু মনেমনে জুড়ে নিলেন, বউটাকে মেরেছ!

কথাটা তো নেহাত ইয়ার্কি করে বলা, সবাই জানে। ডাক্তার ঘোষালের হাত চট করে সরিৎশেখর জড়িয়ে ধরলেন, কিছু মনে কোরো না ডাক্তার। ডাক্তার মাথা নাড়লেন।

এবার মহীতোষকে সরিৎশেখর বললেন, তোমার দিদি কোথায়?

মহীতোষ বললেন, সবাই রেডি।

সরিৎশেখর বললেন, নি!

গম্ভীর গলার ডাকটা ভেতরে যেতেই অনির বুকটা কেঁপে উঠল। ভিতরের ঘরে খাটের ওপর মা এবং পিসিমার মধ্যে অনি বসে ছিল। বাগানের অন্য বাবুদের স্ত্রী ও মেয়েরা ভিড় করেছে সেখানে। পিসিমা চলে যাচ্ছে বলে সবাই দেখতে এসেছে। খাটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে বিশু, বাপী। ওদের দিকে তাকাচ্ছে না অনি। ওর চোখ জলে অন্ধ। দ্বিতীয়বার ডাকটা আসতে মাধুরী আঁচল দিয়ে ছেলের চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললেন, যা।

কাঁপতে কাঁপতে অনি বাইরের ঘরে এসে দাড়াতে সরিৎশেখর নাতিকে আপাদমস্তক দেখলেন, দেখে হাসলেন, কী হয়েছে তোমার?

ডাক্তার ঘোষাল বললেন, বোধহয় মন-খারাপ।

সরিৎশেখর কী ভাবরেন খানিক, তা হলে ও থাক।

কথাটা শুনেই অনির সমস্ত শরীরে হইচই পড়ে গেল। দাদুর দিকে তাকাতে গিয়ে বাবার গলা শুনল ও, না, এখন যাওয়াই ভালো। এখানে তো পড়ানা হবে না।

মুহূর্তে বেলুনটা ফুটো হয়ে সব হাওয়া হল করে বেরিয়ে গেল যেন। সরিৎশেখর ডাকলেন, হেম!

অনি অবাক হয়ে দেখল পিসিমা ঠাকুরের মূর্তিটা পুঁটলিতে নিয়ে দরজায় এসে দাঁড়ালেন। পিসিমাকে এখন অদ্ভুত দেখাচ্ছে। মাথায় ঘোমটা, গরদের কাপড়ের ওপর সাদা চাদর। মহীতোষও দিদিকে দেখছিলেন। দিদির ভালো নাম যে হেমলতা তা যেন খেয়ালই ছিল না। সরিৎশেখর অনেকদিন পর দিদির নাম ধরে ডাকলেন। এই স্বৰ্গছেঁড়ায় সবার কাছে উনি দিদি বা বউদি। হেম বলে ডাকার লোক খুব বেশি নেই।

সরিৎশেখর বললেন, হেম, এই ছেলেটিকে আমরা নিয়ে যাচ্ছি, আজ থেকে এর সব ভার তোমার ওপর, যদ্দিন ও কলেজে না ওঠে। মনে থাকবে তো?

পিসিমাকে ঘোমটার মধ্যে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতে দেখল অনি, আপনি যা বলবেন। . সরিৎশেখর এবার মাধুরীকে ডাকলেন। ঘরে আর কেউ কোনো কথা বলছে না। মাধুরী এসে হেমলতার পাশে দাড়াতে সরিৎশখর বললেন বউমা, আমি চললাম। এখানে আর আমার পিছুটান নেই। তোমাকে আমি পছন্দ করে আমাদের সংসারে এনেছিলাম, এই সংসারের ভার তোমার ওপর দিয়ে যাচ্ছি। আর মা, তোমার পুত্রটিকে আমার হাতে দিতে তোমার আপত্তি নেই তো?

মাধুরী ঘাড় নাড়লেন। সরিৎশেখর বললেন, ঠিক আছে, তুমি দেখো, এই কাঁচা সোনাকে কীভাবে পাকা সোনা করে ফিরিয়ে দিই। কথাটা বলে অনিকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন সরিৎশেখর। অনি দেখল মা একহাতে ঘোমটা ঠিক করতে গিয়ে শাড়ির পাড় চোখের তলায় চেপে রাখল।

হে সাহেব চেয়েছিলেন যে, সরিৎশেখর প্রাইভেট কারে শহরে যান। কিন্তু সরিৎশেখর রাজি হননি। লরির সামনে.ড্রাইভারের পাশে তো অনেক জায়গা আছে, আলাদা করে গাড়ির দরকার নেই। মহীতোষ বারান্দায় এসে দেখলেন কুলি-সর্দাররা, সব সামনে দাঁড়িয়ে, পেছনে অনেক মুখ।

মহীতোষের পেছনে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে সরিৎশেখর এসে দাঁড়াতেই একটা গুঞ্জন উঠল। সরিৎশেখর কিছুটা বিব্রত হয়ে সামনে তাকালেন। একজন সর্দার এগিয়ে এল, এসে সরিৎশেখরের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে চিৎকার করে উঠল, কাহা যাতিস রে মো সব ছোড়কে?

সরিৎশেখর বললেন, কেন?

লোকটা তেমনি চিৎকার করে বলল, কিনোর এখানে থাক, আমাদের বাবা হয়ে থাক, তোকে আমরা যেতে দেব না। সঙ্গে সঙ্গে আর-একজন সর্দার চিৎকার করে উঠল, বাবা যাবেক নাই। আর সেই একটা গলার সঙ্গে সমস্ত মাঠ গলা মেলাল। সরিৎশেখর দেখলেন বহু সর্দার ওদের মধ্যে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আছে সেরাও। এদের প্রায় প্রত্যেককে কয়েকটা ছেলেছোকরা বাদে তিনি চেনেন। চিৎকার সমানে বাড়ছিল। মহীতোষ সরিৎশেখরকে বললেন, কী ব্যাপার কিছুই বুঝতে পারছি না, কী করবেন?

ডাক্তারবাবু বললেন, আমি দেখছি। তারপর সামনে এগিয়ে তিনি হাত উঁচু করে সবাইকে থামতে বললেন, চিক্কারটা কমে এল। ডাক্তারবাবু বললেন, তারা বাবাকে যেতে দিবি না বলছিস কিন্তু বাবার যে চাকরি নেই-তা জানিস?

একজন সর্দার বলল, এই চা-বাগান বাবা তৈরি করেছে, বাবা যতদিন জীবিত থাকবে তাকে চাকরি করতে দিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে তার সমর্থনে আওয়াজ উঠল।
 
এবার সরিৎশেখর বারান্দা থেকে নেমে সর্দারদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে সবাই তাঁকে ঘিরে ধরল । সরিৎশেখর সামনের কালো কালো বিচলিত মুখগুলোর দিকে তাকালেন, আমাকে তোরা যেতে দে। সারাজীবন তো চাকরি করলাম, একটু বিশ্রাম চাই রে।

একজন সর্দার বলল, আমাদের কে দেখবে? কার কাছে যাব?

সরিংশেখর বললেন, আরে বোকা, এখন তোরা স্বাধীন, এখন ভয় কী? তোদের চার-পাঁচজন মিলে একটা দল কর। সবাই সেই দলকে সুবিধে-অসুবিধে জানাবো ঐ দলই সাহেবের সঙ্গে কথা বলে দাবি আদায় করবে, ব্যস।

সর্দাররা সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। হঠাৎ বকু সর্দার এগিয়ে সরিৎশেখরের পায়ে ঝাপিয়ে পড়ল। কোনো কথা নয়, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে সেটা সংক্রামক রোগের মতো ছড়িয়ে পড়ল অন্য মুখগুলোতে। সরিৎশেখর এইসব সরল মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে শেষ পর্যন্ত আবিষ্কার করলেন যে তার নিজের চোখের আগল কখন খুলে গেছে, বয়স্ক শুকনো গালের চামড়ার ওপর ফোঁটা ফোঁটা জলবিন্দু পড়ায় অদ্ভুত শান্তি লাগছে। অথচ কোনো শোক তকে কাঁদতে পারেনি এতদিন।

হয়তো কান্নার জন্যেই প্রতিবোধ নরম হয়ে সরে গেল। অনি দেখল পিসিমা মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। ঝাড়িকাকু এবং প্রিয়তোষ লরির ওপর উঠল। মহীতোষ প্রথমে লরির সামনে ড্রাইভারের পাশে অনিকে তুলে দিলে হেমলতা তার পাশে উঠে বসলেন। সরিৎশেখর ঐসব বোবা মুখের দিকে তাকিয়ে লরিতে উঠতে গিয়ে থমকে দাড়ালেন। ভিড় কাটিয়ে বিলাস ছুটে আসছে। সরিৎশেখরের হাতে একটা বিরাট মিষ্টির হাঁড়ি ধরিয়ে দিয়ে ভ্যা করে কেঁদে ফেলল সে। সরিৎশেখর । হাঁড়িটা অনির হাতে দিতেই একটা অদ্ভুত ব্যাপার হয়ে গেল। দুজন সর্দার ফিসফিস করে কী বলে মাথার পাগড়ি সরিৎশেখরের পায়ের সামনে টানটান করে ধরে থাকল। আর কয়েকশো মানুষ এগিয়ে এসে একআনা, দুআনা, লাল পয়সা, ফুটো পয়সা ফেলতে লাগল তাতে। ডাক্তার ঘোষাল মালবাবু, মনোজ হালদার সব দাড়িয়ে এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখছে। ক্রমশ কাপড়টার মাঝখানে পয়সা উঁচু হচ্ছিল।

সরিৎশেখর অদ্ভুত গলায় বললেন, ডাক্তার, তোমরা ফেয়ারওয়ালের কথা বলেছিলে না, পৃথিবীতে কেউ এর চেয়ে বড় ফেয়ারওয়েল পেয়েছে?

মহীতোষ সঙ্গে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু মাধুরী একা থাকবেন বলে সরিৎশেখর নিষেধ করেছেন। সঙ্গে তো প্রিয়তোষ যাচ্ছেই, কোনো অসুবিধে হবে না। তাছাড়া দুদিন আগে লোক পাঠিয়ে জলপাইগুড়ির বাড়ি ধুয়েমুছে পরিষ্কার করিয়ে নিয়েছেন। ঘড়ি দেখলেন তিনি, আর একদম সময় নেই। ড্রাইভার উঠে বসল, তার পাশে অনি। অনির পাশে হেমলতা, তার গায়ে দরজার ধারে সরিৎশেখর কোলে খুচরা পয়সার পুঁটলিটা নিয়ে বসে আছেন। ড্রাইভারকে স্টার্ট নেবার ইঙ্গিত করতে যেতেই সরিৎশেখর টের পেলেন গাড়িটা দুলছে। তারপর গাড়িটা একটু একটু করে চলতে শুরু করল। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার উঠল, বাবা যায়-ধেউসি রে, আউড় ঘোড়া-দেউসি রে। ড্রাইভার অসহায়ের মতো বসে রইল স্টিয়ারিং ধরে, গাড়ি ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে ও। দুজন সর্দার পাদানির ওপর লাফিয়ে উঠে অন্যান্যকে নির্দেশ দিতে লাগল ঠেলার জন্য। ক্রমশ মাঠ পেরিয়ে লরি আসাম রোডে পড়ল। পিছনের গাড়িটাকে কেউ ঠেলছে না, কিন্তু সেটাও স্পীড নিতে পারছে না এই লরির জন্য।

অনি দেখছিল সামনের কাচের ওপর একটা হনুমানের ছবি, এক হাতে পাহাড় বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, বুকে রাম-সীতার ছবি। কাচের ওপাশে আকাশ। আলো করে দেখার জন্য উঠে দাঁড়াতেই ওর নজরে পড়ল ওদের সরির সঙ্গে বাগানের কুলিরা হেঁটে যাচ্ছে রাস্তা জুড়ে। সামনের দিক থেকে আসা গাড়িগুলো রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে গেছে পরপর। সবাই হন দিচ্ছে কিন্তু কেউ তাতে কান দিচ্ছে না। হঠাৎ অনির নজরে পড়লে রাস্তাটা যেখানে বাঁক নিয়েছে সেই বিরাট বটগাছের তলায় মুখ উঁচু করে রেতিয়া দাড়িয়ে আছে। কাছাকাছি হতে অনি চিৎকার করে উঠল, রেতিয়া! সঙ্গে সঙ্গে সরিৎশেখর আর হেমলতা ওর দিকে অবাক হয়ে তাকালেন। কিন্তু অনির সেদিকে নজর নেই। ও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে রেতিয়ার অন্ধ চোখ দুটোর পাতা কেঁপে উঠল। ঠোঁট দুটো গোল হয়ে যেন কিছু বলল। কী বলল সেটা সম্মিলিত চিৎকারে শোনা গেল না। ক্রমশ সামনের কাচের মধ্যে থেকে রেতিয়ার মুখ মুছে গেলে অনির বুকের মধ্যে অনেকক্ষণের জমা কান্নাটা ছিটকে বেরিয়ে এল। হেমলতা এক হাতে ঠাকুরের পুঁটুলি সামলে অন্য হাতে অনিকে বুকে টেনে নিলেন।

সরিৎশেখর ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠছিলেন। এভাবে লরি ঠেলে ওরা কদুর যাবে? যেভাবে ওরা যাচ্ছে তাতে উৎসাহে ভাটা পড়ার কোনো চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। পাশে পাদানিতে দাঁড়ানো সর্দারকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কদুরে যাবি তোরা? খুব যেন উৎসাহ হচ্ছে এইরকম মেজাজে সে জবাব দিল, তোর ঘর তক্‌।


বলে কী। জলপাইগুড়ি অবধি পায়ে হেঁটে ওরা হয়তো যেতে পারে, কিন্তু তাতে তো মাঝরাত হয়ে যাবে! সরিৎশেখর ড্রাইভারকে স্টার্ট নিতে ইঙ্গিত করলেন। সঙ্গে সঙ্গে ভটভট করে ইঞ্জিনটা হুঙ্কার ছাড়ল। সরিৎশেখর দেখরেন শব্দ শুনে সামনের লোকজন লাফ দিয়ে একপাশে সরে দাঁড়াল। সেই সুযোগে ড্রাইভার স্পীড বাড়িয়ে দিল চটপট, মুহুর্তে জনতা চিষ্কার করে উঠল, কিন্তু ততক্ষণে ওঁরা অনেক দূরে চলে এসেছেন। পিছনের গাড়িটাও বোধহয় সেই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল, সরিৎশেখর দেখলেন সেটাও পিছন পিছন আসছে। ডুডুয়া নদীর পুলের কাছে এসে সরিৎশেখরের খেয়াল হল সর্দার দুজন এখনও পাদানিতে দাড়িয়ে আছে। আর আশ্চর্য এই যে, গাড়ি ছুটে যাচ্ছে ওদের নিয়ে-এতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই যেন, হাসিহাসি মুখ করে ছুটন্ত হাড়িটা হাওয়া মুখচোখে মাখছে দুজন।

গাড়ি থামাতে বলরেন সরিৎশেখর। তারপর নিচে নেমে সর্দার দুটোকে ডাকলেন। ওরা মাথা নিচু করে কাছে আসতে বললেন, এবার তোরা যা, আর এই টাকাগুলো রাখ। লাইনের লোকজনকে আজ রাত্রে আচ্ছাসে ভোজ দিবি। পকেট থেকে কয়েকটা দশটাকার নোট বের করে ওদের হাতে খুঁজে দিলেন তিনি। সর্দার দুটো চকচকে নতুন নোট হাতে নিয়ে কী করবে বুঝতে পারছিল না। সরিৎশেখর আর সুযোগ দিলেন না ওদের, গাড়িতে উঠে দরজা বন্ধ করে দিলেন।

তার সারাজীবনের স্মৃতি বুকে নিয়ে স্বৰ্গছেঁড়া ক্রমশ পেছনে চলে যেতে লাগল।
 
অবসর-জীবন কীভাবে কাটাবেন সরিৎশেখর কোনোদিন চিন্তা করেননি। সেই কোন ছেলেবেলায় চা-বাগানে ঢুকে পড়ার পর এতটা কাল হুহু করে কেটে গেল, নিশ্বাস ফেলার সময় পাননি। চাকুরির মেয়াদ ফুরিয়ে আসার মুখে ভেবেছিলেন কর্মহীন অবস্থায় এই তল্লাটে আর থাকবেনই না। আজ ডুয়ার্সের সব লোক তাতে একডাকে চেনে যেজন্যে সেটা ক্ষয়ে যাবে বেকার ক্ষমতাহীন হয়ে বসে থাকলে। তারচেয়ে কলকাতার কাছে গঙ্গার ধারে বাড়ি নিলে বেশ হয়, এরকমটা ভাবতে শুরু করেছিলেন। হেমলতা বলেছিলেন, যদি এদেশ ছেড়ে যেতেই হয় তো দেশে চলুন। দেশ বলতে সরিৎশেখর অবাক হয়েছিলেন, আজ প্রায় কুড়ি বছর তিনি নদীয়ার সেই গগ্রামে পা বাড়াননি, পিতা ষষ্ঠীচরণ দেহ রাখার পর সে-ভিটেতে খুড়তুতো ভাইলা ধুকছে। নিজের একটা দেশ আছে এই বেটা কবেই চলে গেছে। বোধহয় বড়বউ চলে যাবার পর থেকেই দেশ সম্পর্কে মায়ামমতা তার নেই। তা ছাড়া এতটা কাল সাহেবসুবোদের সঙ্গে কাটিয়ে ঐ গ্রামের জীবন তার পোষাবে না। দেশ শব্দটা তাই তার মনে পড়ে না। অথচ হেমলতা কী সহজে দেশ বলল আবেগ-আবেগ গলায়। বেচারা তো কখনো সেগ্রাম চোখেই দেখেননি। বাবার ইচ্ছের কথা শুনে মহীতোষ বেঁকে বসল, আমাদের ছেড়ে আপনি অত দূরে চলে যাবেন-এ হয় না। আপনি যখন রিটয়ার করে আমার সঙ্গে থাকবেনই না, তা হলে অন্তত কাছাকাছি থাকুন। সাপ্লয়ারদের বললে জলপাইগুড়িতে একটা জমির ব্যবস্থা হয়ে যাবে। বিপদে-আপদে আমরা যেতে পারব। কিন্তু কলকাতায় আপনি তিষ্ঠোতে পারবেন না, আর কিছু-একটা হয়ে গেলে আমরা আফসোসে মরে যাব। কথাগুলোকে খুব একটা পাত্তা দিচ্ছিলেন না সরিৎশেখর। শেষ পর্যন্ত বউমা বললেন, বাবা, আপনি চলে গেলে অনির কী হবে? ও কার কাছে পড়াশুনা করবে?

ব্যস হয়ে গেল। সরিৎশেখর জলপাইগুড়ি শহরে জমি কিনলেন। মাত্র দু-হাজার টাকায় শহরের ওপরে জমিসমেত দুটো কাঁঠালগাছ, একটা আম আর অজস্র সুপুরি। এ ছাড়া একটা টিনের চালওয়ালা দু-ঘরের মাথা গোঁজার আস্তানা, যেটায় দিব্যি থাকা যায় কিছুদিন।

জমিটা রেজিস্ট্রি হয়ে গেলেই তিনি বড় ছেলে পরিতোষকে পাঠিয়ে দিলেন। এই ছেলে তার রাতের ঘুম দিনের স্বস্তি কেড়ে নিতে যথেষ্ট। অনেক ঘাট ঘুরে সরিৎশেখরের অনেক পয়সা আজেবাজে ব্যবসায় নষ্ট করে একজন কাঠের কন্ট্রাক্টরের কাছে পড়ে ছিল। সরিৎশেখর তাকে কাজে লাগাতে চাইলেন। মিউনিসিপ্যালিটি থেকে প্ল্যান মঞ্জুর হয়ে গিয়েছিল বাড়ির। দোতলার ভিত হবে, পাঁচটা শোবার ঘর, একটা হল, বসার ঘর, কিচেন, দুটো বাথরুম, একটু ডাইনিং স্পেস, মেয়েদের গল্প করার জন্য বেশ বড় ঠাকুরঘর। মাকফার্সন সাহেবের সঙ্গে বসে বাড়ির প্ল্যান করা হল। ঘুপচিঘর নয়, দক্ষিণের বাতাস যেন চিরুনির মতো সমস্ত বাড়িটার মধ্যে দিয়ে বয়ে যেতে পারে এরকমভাবে। জানলা-দরজা বানানো হবে। পরিতোষ শহরে এসে বাড়ির তদারকি করবে দাঁড়িয়ে থেকে। কন্ট্রাক্টরকে বিশ্বাস নেই সরিৎশেখরের। ওদের কাজকর্ম তো বাগানের বিভিন্ন ব্যাপারে অষ্টপ্রহর দেখছেন। কাজ যদি সঠিক হত তা হলে পুজো বা ক্রিসমাসে এত ভেট দিতে হত না। সরিৎশেখর নিজের বাড়ি তৈরি করতে গিয়ে কন্ট্রাক্টরের ভেট চান না।

বাড়ি করার আগে সরিৎশেখর পরিতোষকে নিয়ে এক সকালে শহরে এলেন। পরিতোষের ইচ্ছা সে নিজেই মিস্ত্রি যোগাড় করে প্যানমাফিক বাড়ি বানাবে-সরিৎশেখরের একেবারে গৃহপ্রবেশ করবেন। কিন্তু ছেলের কথায় তার আজকাল খুব ভরসা নেই। শহরে সরিৎশেখরের দেশের গায়ের একজন আছেন যাকে তিনি বন্ধুর মতো বিশ্বাস করেন-সেই সাধুচরণ হালদারের বাড়িতে পরিতোষ প্রথমটা আসতে চায়নি। কিন্তু সরিৎশেখর যখন যেখানে যাবেনই পরিতোষকে বাধ্য হয়ে সঙ্গী হতে হল।
 
রায়কতপাড়ায় ঢুকতেই সাধুচরণের কাঠ-সিমেন্ট-মেশানো দোতলা বাড়ি। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় নদীয়া জেলার যেসব মানুষ পাকাপাকি বাস করছেন তাঁদের নাড়িনক্ষত্র সাধুচরণের জনা। দেশের খবরাখবর এবং ছেলেমেয়েদের বিয়ের সম্বন্ধের জন্য তারা সাধুচরণের শরণাপন্ন হন। কদমতলায় ওঁর বিরাট স্টেশনারি দোকান এককালে রমরম করত। স্যার আশুতোষের মতো গোঁফ তখনও কুচকুচে কালো, সরিৎশেখর শহরে এলেই দোকানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে যেতেন। তা এখন বয়স হয়েছে সাধুচরণের, দুই ছেলে দোকানে বসে। বাড়ি বসে বন্ধকি কারবার করেন তিনি। সরিৎশেখর জিজ্ঞাসা করায় বলেছিলেন, কিছু-একটা নিয়ে থাকতে হবে, তো!

পরিতোষের এ-বাড়িতে আসতেগ না চাওয়ার পেছনে যে-কারণটা সেটা সরিৎশেখর জানেন। সাধুচরণের শুশ্রী এবং কন্যা উন্মাদ। স্ত্রী যতটা কন্যা তার দ্বিগুণ। বিবস্ত্র হয়ে যাতে না থাকে সেজন্যে পা অবধি স্কুল এবং তলায় বোম আঁটা একধরনের অর্ডারি সেমিজ মেয়েকে পরিয়ে রাখেন সাধুচরণ। মেয়েটি চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে না, কামড়ায় না। শুধু অঙ্গভঙ্গি করে এবং শব্দ না করে হাসে। পরিতোষ এর আগে দেছেছে সাধুচরণ মেয়েটাকে বারান্দার এক কোণে চেয়ারে বসিয়ে তার খানিক তফাতে নিজে বসে অতিথির সঙ্গে কথা বলেন। সাধুকাকার সঙ্গে কথা বলতে বলতে তার চোখ মেয়েটার দিকে যেতে সে শিউরে উঠেছিল। অত কুৎসিত করে কোনো মেয়ে নিঃশব্দে হাসতে পারে সে জানত না। আর তার ঐ প্রতিক্রিয়া দেখে সাধুচরণ খুব মজা পাচ্ছেন-সেটা পরিতোষ বেশ টের পাচ্ছিল। বোধহয় মেয়েকে সামনে অতিথিদের নার্ভের ওপর একটা প্রেশার সৃষ্টি করে ভদ্রলোক তাকে নিয়ে খেলা করেন। সেদিন সাধুচরণের স্ত্রী এসে তাকে চা দিয়েছিলেন। নিশ্চিত ভদ্রমহিলা সেদিন কিছু সুস্থ ছিলেন। তবে তার চোখমুখ অসম্ভব লাল দেখ চ্ছিল। পরিতোষ গুনেছে ভদ্রমহিলা মাঝে-মাঝে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যান, তখন তাকে ঘরবন্দি করে। খা হয়-আবার টপ করে সুস্থও হয়ে যান। পরিতোষ এও শুনেছে এক জ্যোতিষী হাত দেখে বলেছে বিয়ে দিলে মেয়ের এই পাগলামি সেরে যাবে। কিন্তু সাধুচরণ নদীয়া জেলায় সে ধরনের পাত্রের সন্ধান পাচ্ছেন না।

তবু, সরিৎশেখরের সঙ্গে পরিতোষকে আসতেই হল। রিকশায় চড়া সরিৎশেখর একদম পছন্দ করেন না। লাঠি-হাতে লম্বা শরীরটা নিয়ে যখন হনহন করে হেঁটে যান, তখন তাঁর সঙ্গে পাল্লা দেওয়া মুশকিল। তা ছাড়া বাবার সঙ্গে হাঁটতে পরিতোষের ভীষণ অস্বস্তি হয়-ইচ্ছে করে পিছিয়ে পড়ে এমনভাবে সে হাঁটে যেন সরিৎশেখর তার কেউ না।

সাধুচরণ হালদার বাড়িতেই ছিলেন। সরিৎশেখরের গলা শুনে হাত জোড় করে হাসতে হাসতে অভ্যর্থনা জানালেন। চেয়ারে বসতে বসতে সরিৎশেখরের প্রথম কথা হল, বসো হে সাধু, তোমার সঙ্গে কথা আছে। আর হ্যাঁ, মেয়েটাকে আজ বাইরে আনার দরকার নেই।

সাধুচরণ ঘাড় নাড়লেন, না না, আপনারা নিশ্চিন্তে বসুন, তাকে বাইরে আনার দরকার নেই।

পরিতোষ বারান্দার একপাশে দাঁড়িয়ে ভ্রূ কুঁচকালো। সরিৎশেখর খানিক অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কেন, আনতে হবে না কেন?

আজ্ঞে, ডাক্তার বলেছে ও আর বেশিদিন বাঁচবে না। আজন্ম শুনে এলাম পাগলরা দীর্ঘজীবি হয়-কিন্তু এ-মেয়ে নাকি বড়জোর মাসখানেক। কথা তো কোনোকালেই বলে না-এখন মুখে গ্যাজলা উঠছে, বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না। যাক বাবা, যত শীঘ্র যায় ততই মঙ্গল। কী বলেন?

সরিৎশেখর অন্যমনস্ক গলায় বললেন, তবু তো তোমার মেয়ে হে।

মাথা নাড়লেন সাধুচরণ, না, না। বাপ তো মেয়েকে সৎপাত্রে দান করতে পারলে বেঁচে যায়তাই না? তা ওর ক্ষেত্রে মৃত্যু হল সৎপাত্রে দান। এব্যাপারে আপনি বিন্দুমাত্র চিন্তিত হবেন না। এখন বলুন আগমনের উদ্দেশ্যটা কী?

সরিৎশেখর বাড়ি বানাবার কথা বললেন। যেহেতু তিনি শহরে থাকতে পারছেন না তাই সাধুবাবুর সাহায্য নিতে চান। ভালো রাজমিস্ত্রি যোগাড় করে দেওয়া তো সাধুবাবুর কাছে কোনো সমস্যা নয়। ইট-ভাটায় খবর দিলে গরুর গাড়ি করে ইট আসবে-সিমেন্টের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আর ঐ এলাহি কাজকর্ম ঠিক হচ্ছে কি না দেখার জন্য পরিতোষ থাকল। সাধুকাকাকে দেখতে হবে পরিতোষ ঠিকমতো কাজকর্ম দেখাশোনা করছে কি-না। সরিৎশেখর মাঝে-মাঝে এসে দেখে যাবেন।
 
সাধুচরণ চুপচাপ শুনলেন, তারপর বললেন, আপনি এসে আমাদের সঙ্গে থাকবেন, দুবেলা দেখা পাব-এ তো আমাদের সৌভাগ্য। সব ব্যবস্থা করে দেব। রহমত মিয়া আছে-খুব গুণী মিস্ত্রি-ওর ওপর ভার দিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকতে পারেন। সেসব কিছুতেই আটকাবে না। আমি ভাবছি আপনার পুত্র আহারাদি করবে কোথায়?

পরিতোষ চমকে উঠে কিছু বলতে চাইলে সরিৎশেখর হাত নেড়ে তাকে থামিয়ে দিলেন, কোনো হোটেলের সঙ্গে বন্দোবস্ত করে নিলেই হবে। কিং সাহেবের ঘাটে এখন তো অনেক পাইস-হোটেল হয়েছে।

সাধুচরণ বললেন, দুদিনেই পেটের বারোটা বেজে যাবে। তারচেয়ে ও আমার এখানেই থাকাখাওয়া করে কাজকর্ম দেখতে পারে। আমার সঙ্গে নিত্য যোগাযোগ হবে।

কিন্তু পরিতোষ বাইরে বেরিয়ে এসে প্রায় বিদ্রোহ করে বসল। সাধুচরণের বাড়িতে সে মরে গেলেও থাকবে না। দু-দুটো পাগলকে দিনরাত দেখার মতো নার্ভ তার নাকি নেই। সাধুচরণের বউকে যদিও সহ্য করা যায়, কিন্তু মেয়েকে অসম্ভব। তারচেয়ে সে নিজে হাত পুড়ি ভাতে ভাত বেঁধে খাবে। বাবার দিক থেকে উলটো-মুখো হয়ে সে বলল, আপনি এ-ব্যাপারে একা চিন্তা করবেন না বাবা।

সরিৎশেখরেরও সাধুচরণের কথাটা ভালো লাগেনি। হয়তো সে খোলামনেই বলেছে। তবু একটা সোথ মেয়ে রয়েছে বাড়িতে, হোক-না পাগল, সোমথ তো, সেখানে পরিতোষের মতো দুর্নামযুক্ত একটা ছেলেকে বাড়িতে রাখার প্রস্তাব-কেন যেন মনে সন্দেহ এনে দেয়। ঠিক হ, পরিতোষ নিজেই খাবার ব্যবস্থা করবে, টিনের ঘরটাকে বসবাসের উপযুক্ত করে দিয়ে গেলেন সরিৎশেখর। রহমত মিঞা কাজ করবে লোকজন নিয়ে সরিৎশেখর সপ্তাহে একদিন এসে টাকাপয়সা দিয়ে যাবেন পুত্রকে। কোনো সমস্যা দেখা দিলে পরিতোষ সাধুচরণের পরামর্শ নেবে। খুব ঠেকায় না পড়লে যেন টাকাপয়সা না নেয়।

ভিত খোঁড়া হল। প্ল্যানমাফিক কাজ এগোতে লাগল। ভিত-পুজোটুজোর ব্যাপার করেন না সরিৎশেখর। প্রথম দিকে তরতর করে কাজ চলতে লাগল। সরিৎশেখর সন্তুষ্ট, ছেলের পরিবর্তন হয়েছে দেখে খুশি হলেন। সাধুচরণও পরিতোষের প্রশংসা করেন। সারাদিন রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে থেকে। মজুরদের কাজ করায়। ক্রমশ সরিৎশেখর ছেলেকে বিশ্বাস করতে লাগলেন। লোক মারফত টাকা পাঠান, চা-বাগানের কাজ ফাকি দিয়ে ঘনঘন শহরে আসা সম্ভব হয় নাএযভাবে কাজ চলছে পুরো বাড়ি শেষ হতে মাস দুয়েক লাগার কথা নয়। এখনও রিটায়ার করতে দেরি আছে। তবে সরিৎশেখর ঠিক করলেন ভাড়াটাড়া দেবেন না।

এমন সময় সাধুচরণের একটা চিঠি পেলেন সরিৎশেখর। শনিবার সন্ধেনাগাদ চলে আসুন, দিনমানে অবশ্যই নয়। আমার গৃহে তো থাকবেন না তাই রুবি বোর্ডিং-এ আপনার ব্যবস্থা করতে পারি। আসার আপনার প্রয়োজন, কারণ আপনার পুত্রের সঙ্গে আপনার ভবিষ্যৎ এক্ষেত্রে জড়িত হয়ে পড়েছে।

মাথায় রক্ত উঠে গেল সরিৎশেখরের। অতীতের অনেক অপকর্মের নায়ক নিজের ছেলেকে তিনি জানেন। শনিবার পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন না। বিকেলের ডাকে চিঠি পেয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সাহেবকে বলে একটা গাড়ি যোগাড় করে শহরে রওনা হলেন। যাবার সময় মহীতোষকেও কিছু বললেন না। শহরে এসে প্রথমে ভাবলেন সাধুচরণের কাছে যাবেন কি না। তারপর ঠিক করলেন নিজেই ব্যাপারটা দেখবেন আগে। সাধুচরণের চিঠির ভাষা খুবই সন্দেহজনক-সরিৎশেখর একটা বিশ্রী গন্ধ পাচ্ছেন তাতে-আর তাই সাক্ষী রাখা বাঞ্ছনীয় নয়।
 
সন্ধে হয়ে গিয়েছিল অনেকক্ষণ। তিস্তা নদীর গায়ে যে মাটির রাস্তা সেনপাড়ার দিকে চলে গিয়েছে, সেখানে গাড়ি রেখে ড্রাইভারকে চুপচাপ বসে থাকতে বললেন। গাড়ি থেকে নেমে ওঁর খেয়াল হল উত্তেজনায় আসবার সময় কাশ্মীরি লাঠিটা সঙ্গে আনতে ভুলে গেছেন। সামনে অনেকটা খোলা মাঠ অন্ধকারে ঢাকা-অনেক দূরে টিনের ঘরের সামনে হারিকেন জ্বলছে মিটমিট করে। কী মনে করে সরিৎশেখর গাড়ির হ্যান্ডেলটা লাঠির মতো বাগিয়ে মাঠ ভাঙতে লাগলেন।

জালতারের বেড়া দিয়ে সমস্ত জমিটা ঘিরে রাখা হয়েছিল। এদিকটা দিয়ে বাড়ির মালমশলা আনবার জন্য একটা ছোট টিনে গেট করা আছে। সরিৎশখর গেট খুলে ভেতরে ঢুকলেন।

ঢুকতেই তিনি বড় ছেলের গলা শুনতে পেলেন। এলোমেলো গলায় সায়গলের গান গাইছে। গানের গলাটা তো বেশ ভালো! ছেলের গান কোনোদিন শোনেননি তিনি। হঠাৎ মনে হল ওকে যদি গান শেখানো যেত, তা হলে নাম করতে পারত। কিন্তু গলাটা স্থির থাকছে না কেন। কয়েক পা। এগোতেই নতুন বাধাই কুয়োটার পাশে এসে দাঁড়ালেন। ভিত খোঁড়ার পর এই কুয়োটা হয়েছে। খাবার জল নয়-বাড়ির কাজে জল দরকার বলে এটা খোঁড়া। অগভীর। অন্ধকার হালকা করে অনেক তারা উঠে এল আকাশটায়। সরিৎশেখর কুয়োর দিকে তাকাতে অবাক হলেন। বেশ কিছুটা নিচে অন্ধকারেও যেন কিছু চিকচিক করছে। জল নয় অবশ্যই। হাতেই লোহার হ্যান্ডেলটা নিচে নামিয়ে দিতেই ঠক্ করে শব্দ হল। জোরে চাপ দিতে মচ করে ভেঙে গেল। সরিৎশেখর বুঝলেন ওটা কাচ। এত কাচে কুয়ো ভরতি হবে কেন? নাকি এ-কুয়োর জল পায় না বলে ওরা অন্য কুয়ো খুঁড়েছে? বোধহয় এটাতে আবর্জনা ফেলে আজকাল। কিন্তু এগুলো কিসের বোতল?

কিছুক্ষণ বাদেই গান শেষ হল। আর সঙ্গে সঙ্গে আড়ষ্ট হয়ে সরিৎশেখর শুনলেন দুটি স্ত্রী-কষ্ঠে ধবল উল্লাসের ঝড় উঠল। একটি কণ্ঠ মাতাল গলায় তুমি মাইরি ভালোই গাও, এসে তোমার গলায় একটা চুমু খাই বলে খিলখিল করে উঠল।

সরিৎশেখর আর স্থির থাকতে পারলেন না। দ্রুতপায়ে নিচু বারান্দায় উঠে এসে লোহার হ্যালেটা দিয়ে দরজায় ঠেলা দিলেন। ভেজানো ছিল দরজাটা, হাট করে খুলে গেল। দুটো ঘরের মধ্যে এটাই একটু বড়। ঘরের মধ্যিখানে একটা জলচৌকির ওপর দুটো বড় মোটা মোমবাতি জ্বলছে। দরজাটা খুলল বলে মোমবাতির শিখা দুটো থরথর করে কাঁপছে এখন। সরিৎশেখর দেখলেন পরিতোষ একটা বালিশ পেটের নিচে নিয়ে একটা কদাকার মেয়ের কোলে মুখ রেখে শুয়ে আছে। মেয়েটি হাতের গেলাস থেকে মাঝে-মাঝে নিজে নিচ্ছে আবার পরিতোষকে মদ খাওয়াচ্ছে। আর-একটা বয়স্কা মোটা মেয়েছেলে পরিতোষের পায়ের কাছে বসে ওর গোড়ালি টিপছে।

দরজাটা খুলে যেতেই বয়স্কা মেয়েছেলেটি প্রথম ওঁকে দেখতে পেল, তারপর গলা দুলিয়ে বলল, কে এলে গো, লনুন নাগর?

সরিৎশেখর প্রথমে উত্তেজনায় কথা বলতে পারছিলেন না। থরথর করে ওঁর দেহ কাঁপছিল। কোনোরকমে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গর্জে উঠলেন, পরিতোষ! বাবার গলা শুনে নেশাগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও পরিতোষ তড়াক করে উঠে বসল। অন্ধকারে মোমবাতির আলোয় পুরোটা দেখা যায় না, তাই দরজায় দাঁড়ানো সরিৎশেকরকে মোমবাতির মাথা ডিঙিয়ে অশষ্ট ছায়া-ছায়া দেখল সে।

সরিৎশেখর তখন এক পা এগিয়েছেন, হারামজাদা, বদমাশ, কুলাঙ্গার-কথা বলতে বলতে হাতের হ্যাণ্ডেলটা শূন্যে অস্ফালন করে সজোরে পুত্রের দিকে ঘোরালেন তিনি। পলকে মোমবাতি দুটো শূন্যে উঠে নিবে গেল। পরিতোষ যন্ত্রণায় চিষ্কার করে উঠে দাঁড়াল। মেয়ে দুটো তাদের বাবু বিপদে পড়েছে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে প্রায় বিবস্ত্র অবস্থায় এসে সরিৎশেখরের দুই পা জড়িয়ে ধরল। সরিৎশেখর একটাকে লাথি মেরে সরিয়ে দিলেও মোটা মেয়েছেলেটিকে পারলেন না। সে সামনে তাকিয়ে যাচ্ছে, বাবুসাহেব আর আসব না, মাইরি বলছি, টাকা দিলেও রাজি হব না ভদ্দপরপাড়ায় আসতে আমাদের বেগুনটুলিই ভালো ছিলো গো-ও-ও।

আর এই সুযোগে এক হাতে মাথার একটা পাশ ধরে তীরের মতো দরজা দিয়ে পরিতোষ ছুটে বেরিয়ে গেল। পা আটক থাকায় সরিৎশেখর পুত্রকে আর-একবার চেষ্টা করেও বিফল হলেন।
 
মেয়েছেলে দুটোকে দুর করে দেবার সময় আবার ঝামেলায় পড়তে হল। টাকা ছাড়া তারা যাবে। জানতে পারলেন পরিতোষ প্রায়ই তাদের নিয়ে আসে, ফুর্তি করে, যাবার সময় টাকা দেয়। চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে ওরা সরিৎশেখরের কাছ থেকে টাকা আদায় করল। ভাগ্যিস এখনও এদিক তেমন লোকবসতি হয়নি এবং সময়টা সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে তাই কেউ জানল না। সরিৎশেখর সবকটা দরজায় তালা লাগিয়ে পেছনে আসতে হ হয়ে গেলেন। এতদিনে তার বাড়ির অর্ধেকটা কাজ হয়ে যাবার কথা। জানলা-দরজায় ফ্রেম লেগে যাবে শুনেছিলেন। কিন্তু এই অশষ্ট অন্ধকারে উনি দেখতে পেলেন ভিত-এর গাঁথুনির পর আর এক ইঞ্চি দেওয়ালও ওঠেনি।

নিজের সারাজীবনের সঞ্চয়ের একটা অংশের এই পরিণতি দেখতে দেখতে সরিৎশেখর শক্ত হয়ে দাঁড়ালেন। তারপর মাথা উঁচু করে অন্ধকারে মাঠ ভেঙে গাড়িতে ফিরে এলেন। একবার ভাবলেন। এখনই রায়কতপাড়ায় গিয়ে সাধুচরণের সঙ্গে দেখা করবেন। কেন তাকে এতদিন পর তিনি জানালেন। পুত্রের কথা? কেন সময় থাকতে সাবধান করে খবর দেননি? বন্ধু হিসেবে সরিৎশেখর তো সাধুচরণের। ওপর নির্ভর করতে চেয়েছিলেন। হঠাৎ তার একটা কথা মনে পড়ে গেল। সাধুচরণ অনেকদিন আগে তাকে একবার বলেছিলেন, আপনার এই পুত্রটিকে নিয়ে দুশ্চিন্তার দেখছি অবধি নেই। আমাদের জাতের কেউ জেনেশুনে ওকে কন্যা দেবে না। আমারও কন্যাটিকে নিয়ে ভাবনার শেষ হয় না। এই দুটিকে একসঙ্গে জুটিয়ে দিলে কেমন হয়?

সরিৎশেখর অবাক হয়ে বলেছিলেন, কী যা-তা বলছ!

সাধুচরণ বলেছিলেন, তা অবশ্য। আপনার পুত্র আগে খুব আসত, এখন আসতে চায় না।

গাড়ি আর ঘোরালেন না তিনি। সোজা কিং সাহেবের ঘাটে চলে এলেন। তিস্তার এই ঘাটটা এখন জমজমাট। অজস্র খড়ের চালের দোকান হয়েছে চা-খাবারের। সন্ধের পর ঘাট বন্ধ হয়ে গেছে, অনেকক্ষণ, অনেক কষ্টে বেশি বকশিশের লোভ দেখিয়ে সরিৎশেখর একটা জোড়া-নৌকো যোগাড় করে গাড়ি তুললেন তাতে।

সেদিন গভীর রাত্রে বাড়ি ফিরে তিনি কিছুক্ষণ নিজের খাটের ওপর গুম হয়ে বসে রইলেন সবাই আন্দাজ করছে কিছু-একটা হয়েছে, কিন্তু কেউ আগবাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করতে সাহস পাচ্ছে না শেষ পর্যন্ত নিজেই ডাকলেন তিনি হেম, মহীতোষ আর প্রিয়তোষকে। ওরা শুনলেন ওদের বাবা ওঁদে বড়দাদাকে আজ থেকে ত্যজ্যপুত্র বলে ঘোষণা করলেন। খাটোর একপাশে দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে ঘাপটি মেরে শুয়ে-থাকা অনিমেষ কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে পেল। দাদু আসার পরই ওর ধু ভেঙে গিয়েছিল, কিন্তু ও বুঝতে পেরেছিল সেটা টের পেতে দেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কিন্তু ত্যজ্যপুত্র শব্দটার মানে কী?

রহমত মিঞার হাতে বাড়ি হাতের তরতর করে উঠতে লাগল। ছাতি-মাথায় সরিৎশেখ সারাদিন মিস্ত্রিদের পেছনে লেগে রইলেন। ট্রাকে করে ইট-বালি আসছে। তারা বেঁধে মিস্ত্রিরা কাভ করছে। বাউন্ডারির মধ্যে একটা করে মজুররা সেখানে আস্তানা করে নিয়েছে। সন্ধের সময় ইটের উনুন জ্বালিয়ে রুটি সেঁকতে সেঁকতে রামলীলা গায় ওরা তারস্বরে। অনি ঘুরে ঘুরে দেখে সারাদিন সরিৎশেখর ঠিক করেছেন সামনের বছর ওকে জিলা স্কুলে ভরতি করে দেন। যেহেতু এটা প্রায় বছরের শেষ, ভরতি হওয়া চলবে না। ফলে অনির আর বই নিয়ে বসতে হয় ছোট ছেলেমেয়েরা লাইন করে জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে গান গাইতে যাচ্ছে। জিলা স্কুলে ভরতি হতে অনিকে যে আরও কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে! সরিৎশেখর ওকে খবরের কাগজ পড়া শেখাচ্ছেন। রোজ বিকেলে যখন। কাগজওয়ালা কাগজ দিয়ে যায়, তখন প্রথম পাতা জুড়ে মহাত্মা গান্ধী আর জওহরলাল নেহরুর ছবি দেখতে পায় অনি।
 
এখানে শোওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে এইরকম-বড় ঘরটায় সরিৎশেখরের বিরাট খাটটা পাতা আছে। দামি মেহগনি কাঠের খাট। খাটের গায়ে চীনে-লণ্ঠন রাখার একটা স্ট্যান্ড। অনি দাদুর সঙ্গে ঐ খাটে শোয়। সারাদিন মিস্ত্রিদের পিছনে খেটে সরিৎশেখর সন্ধে পেরুলেই খাওয়াদাওয়া সেরে অনিকে নিয়ে শুয়ে পড়েন। অন্ধকার ঘরে দাদুর নাকডাকা শুনতে শুনতে অনির কিছুতেই ঘুম আসে না। রাত হয়ে গেলে মজুররা আর গান গায় না, শুধু একলা একটা ঢোলক তালে তালে বেজে যায়। সেই বাজনা শুনতে শুনতে অনির মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। আর তখনই বুক কেমন করে ওর কান্না আসে। এখানে ওর একটাও বন্ধু নেই, সমবয়সি কোনো ছেলের সঙ্গে ওর আলাপ নেই। পাশের ঘরে শোন। হেমলতা। ঘরের এক কোণে রান্নার জিনিসপত্র, অন্য কোণে ঠাকুরের আসন। এইভাবে থাকা ওঁর কোনোদিন অভ্যেস নেই। প্রথম দিন ব্যবস্থা দেখে বলেছিলেন, ওমা, এইরকমভাবে থাকব কী করে? সরিৎশেখর কোনো জবাব দেননি। তবে বাড়ি তৈরি না হওয়া অবধি কষ্ট করতে হবেই-উপায় কী-এইরকম একটা ভঙ্গি তার আচরণে ছিল। কিন্তু হেমলতা চমৎকার মানিয়ে নিলেন। এখানকার সংসার, তা যত কষ্ট হোক তার নিজের। চিরকাল ভাই ভাই-বউদের সঙ্গে থেকে এরকম একটা মজা তিনি পাননি কোনোদিন। নিজের সংসার তো কোনোকালে করা হল না, বাবা আর ভাইপোকে নিয়ে নতুন সংসারে অভূতভাবে মজে গেলেন হেমলতা।

খুব ভোরে সরিৎশেখর অনিকে ঘুম থেকে তোলেন। এই সময় প্রায়ই ভোরের দিকে বৃষ্টি হয়। সরিৎশেখর তা গ্রাহ্য করেন না। বৃষ্টি হলে গামবুট বা ছাতা নিয়ে দাদুর সঙ্গে অনিকে বেরুতে হয়। দাদুরও একই পোশাক। ঘুমে চোখের পাতা এটে থাকে, জল ছিটিয়ে চোখ ধুয়ে বেরুতে হয়। বেরুবার সময় সরিৎশেখর হেমলতার ঘুম ভাঙিয়ে যান নইলে দরজার খোলা থাকবে যে! মাঠ পেরিয়ে। নাতির হাত ধরে হনহন করে তিনি তিস্তার পারে চলে আসেন। এখন তিস্তা পোয়াতি মেয়ের লাবণ্যে টলটলে। বৃষ্টি না হলে অন্ধকার পাতলা সরের মতো পৃথিবীময় জুড়ে থাকে। টুপটাপ তারাগুলো। নিভছে। কখনো সাদা হাড়ের মতো চাঁদ আকাশের এক কোণে ঝুলে থাকে। সারারাত বিশ্রাম পেয়ে পৃথিবীর বুকের ভিতর থেকে উঠে আসা নিশ্বাসের মতো একরাশ ঠাণ্ডা বাতাস নদীর জলে খেলা করতে করতে অনিদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলে যায় মণ্ডলঘাটের দিকে। নদীর বুকে অদ্ভুত এক অন্ধকার লুকোচুরি খেলা করে জলের সঙ্গে। হাঁটতে শুরু করেন সরিৎশেখর কাঁচা রাস্তা ধরে। এক পাশে নদী, অন্য পাশে ঘুমন্ত শহর। দাদুর দ্রুত পদক্ষেপের সঙ্গে তাল রাখতে অনিকে হাঁপাতে হয়। চলার সময় কোনো কথা বলেন না সরিৎশেখর। কিং সাহেবের ঘাট ছাড়াবার পর হঠাৎ পুবের আকাশটা রং বদলায়। অনি দেখেছে যে-মুহূর্তে ওরা কিং সাহেবের ঘাট পেরিয়ে পিলখানার রাস্তায় পা বাড়ায়, ঠিক। তখনই অন্ধকার মাটি থেকে হুশ করে উঠে গিয়ে গাছের মাথায়-মাথায় জমে। আর সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত চারাচর ঠাকুরঘরের মতো পবিত্র হয়ে যায়। এমনকি মাটির ওপর ধুলোগুলো কেমন শান্ত হয়ে এলিয়ে থাকে শিশির মেখে। অনি দ্যাখে নদীর গায়ে কোথাও অন্ধকার নেই। অদ্ভুত সারল্য নিয়ে জলেরা বয়ে যায়। দু-একটা তারা ড়ুবে যাবার আগে, যেন কেউ তাদের কথা দিয়ে নিয়ে যায়নি এইরকম আফসোস-মুখে চেয়ে থাকে তখনও। পুবের আকাশটায় হোলি খেলা শুরু হয়ে যায় হঠাৎ। তখনই দাদু দাঁড়িয়ে পড়েন সেদিকে হাতজোড় করে। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় ভোলা গলায় সূর্যপ্রণাম-ও জবাকুসুমসঙ্কাশং ক্যাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম। ধ্বান্তারিং সর্বপাপঘ্নং প্রণতোহস্মি দিবাকরম। কবিতার সুরে সুরে অদ্ভুত এক মায়াময় জগৎ তৈরি হয়ে যায় তখন, প্রতিটি শব্দ যেন সামনের আকাশে অঞ্জলির মতো রঙ হয়ে জড়িয়ে যায়। একসময় দিগন্তরেখায় যেখানে তিস্তার বুকে অসম্ভব লালচে রঙের আকাশ মুখ ড়ুবিয়েছে সেখানটা কাঁপতে থাকে থরথর করে। সেই কাঁপুনি গায়ে মেখে টুক করে সূর্যটা উঠে সুন্দর সোনার টিপটা থেকে ঝলক ঝলক আগুন বেরোতে থাকে তখন সরিৎশেখর বাড়ির পথ ধরেন। অনির তখন মনটা কেমন করে ওঠে। যে-কোনো ভালো জিনিস দেখলেই মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। এই মুহূর্তে ওর দাদুকে খুব ভালো লাগে-ঘুম ভাঙিয়ে তোলার জন্য কোনো আফসোস থাকে না।
 
বাড়ি ফিরে জল খেয়ে বাড়ির কাজে লেগে যান সরিৎশেখর। সারাদিনের প্রতিটি মুহূর্তে মিস্ত্রিদের চিৎকার আর বিভিন্ন রকমের শব্দে বাড়িটা ভরে থাকে। হেমলতা নিজের মনে সংসারের কাজ করে যান। এখানে এসে প্রথমে চাকরবাকর পাওয়া যায়নি। এখন চাকর রাখলেই যেন হেমলতার অসুবিধে হবে বেশি। কোনো কাজ নিজের হাতে না করলে তার স্বস্তি হয় না। বাবার খাওয়াদাওয়ার দিকে তার কড়া নজর। ঠিক সময়ে শরবত পাঠিয়ে দেন অনির হাত দিয়ে পাথরের গ্লাসে করে। একদিন অন্তর সকালে বাজারে যান সরিৎশেখর। অনি তখন সঙ্গী হয়। দাদুর সঙ্গে যেতে-যেতে রাস্তা কতরকমের লোকের সঙ্গে দেখা হয়, তাদের বেশির ভাগই দাদুকে নমস্কার করে কথা বলে, নানা সমস্যা নিয়ে। আলোচনা করে। অনি বুঝতে পারে ইংরেজরা চলে যাওয়ায় আমাদের অনেক দায়িত্ব বেড়ে গেছে। দাদুর বন্ধুদের কেউ বলেন, যারা ইংরেজদের চাকর ছিল সেই অফিসাররা কী করে দেশ শাসন করবে? আবার একজন বুড়ো বললেন, জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে, এর চেয়ে ইংরেজ-আমল বরং ভালো ছিল। লোকটা কথা বলার সময় চারপাশে চোরের মতো তাকাচ্ছিল। অনির ওকে ভালো লাগছিল না। এসব কথাবার্তার সবটা অনি বুঝতে পারছিল না। কিন্তু ওর মনে হতে লাগল ও বড় হচ্ছে, একটু একটু করে বড় হচ্ছে।

বাড়ির একদিকে চুড়ো করে বালি রাখা ছিল। খাওয়াদাওয়ার পর অনি একা একা সেখানটায় সুড়ঙ্গ-তৈরির খেলা খেলত। অনেকটা দূর ওপরের বালি না ভেঙে গর্ত করে চুপচাপ ভেতরে ঢুকে বসে থাকা যায়। এদিকটায় নতুন-তৈরি বাড়ির ছায়া পড়ে থাকায় বেশ ঠাণ্ডা। দরজা-জানালার ফ্রেম বসে গেছে। কয়েকদিন আগেই ঢালাই শেষ হয়ে গিয়েছে। ছাদ-পেটানোর কাজ চলছে। রহমত মিঞা। কম পয়সায় বেশি কাজ পাওয়া যায়. বলে একগাদা কামিন নিয়ে এসেছে। তারা সকালে দল বেঁধে আসে, সন্ধের সময় দল বেঁধে চলে যায়। সরিৎশেখর মজুরদের বাড়ির ভিতরের খোলা জায়গায় অজস্র গাছপালা লাগিয়ে নিয়েছেন। তারা শিকড়ে জোর পেয়ে গেছে। অনি ভালোবাসে বলে তিনটে পেয়ারা এবং বাউণ্ডারির ধার ঘেঁষে সার দিয়ে কলাগাছ লাগানো হয়েছে।

সেদিন দুপুরে অনি বালির পাহাড়ের তলায় সুড়ঙ্গ করে একদম ওপাশে প্রায় চলে এল। সারা গায়ে বালি মেখে অনি বেরুতে যাচ্ছে হঠাৎ চাপা গলা শুনতে পেল। ওর মনে হল কোনো কারণে দাদ আজ, এদিকটায় চলে এসেছেন। আজ এই বালিমাখা অবস্থায় তিনি যদি অনিকে দেখেন, তাহলে নির্ঘাত শাস্তি পেতে হবে। এর আগে বালি নষ্ট করার জন্যে ওকে ধমক খেতে হয়েছে। চোরের মতো উলটোদিকে হামাগুড়ি দিয়ে ফিরতে যেতে অনি আবার গলাটা শুনতে পেল। না, এ-গলা তো দাদুর নয়। হিন্দিতে কথা বলছে। ছেলেটা কী যেন বলছে খুব চাপা গলায়, আর মেয়েটা না না বলছে সমানে। অনি ফিরল না আর। ওরা কারো দেখার কৌতূহলে ও এগিয়ে গেল হামাগুড়ি দিয়ে। একদম শেষপ্রান্তে গুহার মুখটা বড় হয়নি, একটা বড় ছিদ্র হয়ে রয়েছে, অনি সেখানে চোখ রাখল। ও দেখতে পেল একটা মাঝবয়সী মজুর, যার দাড়ি আছে অনেকটা আর রাত্রে রামলীলা গায়, নতুন-আসা একটা লম্বা কামিনের হাত ধরে কথা বলছে। কামিনটা বারবার ঘাড় নাড়ছে আর ভয়-ভয় চোখে চারপাশে তাকিয়ে দেখছে কেউ দেখে ফেলল কি না। কিন্তু মজুরটা যেন কোনো কথা শুনতে রাজি নয়। হঠাৎ সে দুহাতে কামিনটাকে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকে চাপতে লাগল। কামিনটা প্রাণপণে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করে দুমদাম মজুরটাকে বুকে ঘুষি মারতে লাগল। মজুরটা ভীষণ অন্যায় করছে এটা বুঝতে পারছিল অনি। ওর মনে হল কামিনটাকে বাঁচানো দরকার। চিষ্কার করবে কি না অনি যখন ভাবছে, ঠিক তখনই মজুরটা কামিনটাকে টপ করে চুম খেয়ে ফেলল। অনি অবাক হয়ে দেখল চুমু খেতেই কামিনটা কেমন হয়ে গেল। হাত-পা ছুড়ছে না, প্রতিবাদ করছে না, বরং দুহাতে মজুরটাকে জড়িয়ে ধরেছে ও। আর মজুরটা ওর সমস্ত শরীরে আদর করার মতো করে হাত বোলাতে লাগল। এখন চিৎকার করার কোনো মানে হয় না, কারণ মেয়েটা তো সাহায্য চাইছে না-এটুকু অনি বুঝতে পারল। একসময় লোকটা কামিনের ওপরের কালো জামাটা খুলে ফেলল। অনি কামিনটার পিঠ দেখতে পাচ্ছে। কালো শরীরের ওপর একটা ফ্যাকাশে সাদা দাগ। অনেকদিন চাপা-পড়ে-থাকা ঘাসের রঙ। মজুরটার এখন সব আগ্রহ কামিনের বুকের ওপরে-যেটা অনির দিক থেকে আড়াল করা। হঠাৎ কার। গলা ভেসে সাড়া দিতে দৌড়ে চলে গেল কামিনটাকে কী যেন বলে। মাটিতে পড়ে থাকা জামাটা দ্রুত তুলে নিয়ে এপাশে ফিরে হাঁটু গেড়ে বসে সে পরতে লাগল। অনি দেখল মেয়েটির তামাটে রঙের বড় বড় বুকের ওপর লালচে লালচে দাঁতের দাগ। এভাবে কোনোদিন এইরকম বুক দেখেনি অনি। মেয়েটি জামা পরতে পরতে কী মমতায় একবার দাগগুলোর ওপর হাত বুলিয়ে নিল। তারপর অনির পাশে বালির ওপর পিচ করে পুতু ফেলে হেলতে দুলতে চলে গেল।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top