What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected উত্তরাধিকার - সমরেশ মজুমদার (2 Viewers)

এতক্ষণে আনির ভয়-ভয় করতে লাগল। ও বুঝতে পারল ব্যাপারটা অন্যায় হয়ে গিয়েছে। আস্তে-আস্তে খাতা খুলে ও পেছনের পাতায় চলে এল। তারপর মাথা ঝুকিয়ে পেন্সিল একটা গোল দাগ আঁকল। তার মধ্যে আর দুটো গোল, গোলের মধ্যে গোল। তারপর হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়াতে গোপামাসি যে-উত্তরটা শক্ত বলেছিল সেটা চট করে লিখে ফেলল।

একসময় সময়টা শেষ হয়ে গেল। পরীক্ষা শেষ। সকলে এক এক করে খাতা জমা দিয়ে গেল। অনি কাছে দাঁড়াতেই ওর হাত থেকে খাতা নিলেন ভবানী মাস্টার, সব উত্তর দিয়েছ।

ঘাড় নাড়তে গিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল অনি। ওর কেমন শিরশির করতে লাগল। ভবানী মাস্টারের ভাঙাচোরা মুখের দিকে তাকিয়ে ওর মনে দাদুর মুখটা ভেসে উঠল। ঘাড় নাড়ল ও, না।

কোনটা পার নাই।

হঠাৎ অনির ঠোঁট কাঁপতে লাগল। ভবানী মাস্টার একদৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে আছেন। ঘর প্রায় ফাঁকা। সবাই চলে যাচ্ছে। দরজায় বিশু আর বাপী দাঁড়িয়ে, ওরা অনির জন্যে অপেক্ষা করছে। গোপামাসি নেই। মাটির দিকে মুখ নামাল অনি। ওর চিবুক থরথর করছিল। দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল শেষ পর্যন্ত।

কী হল-আরে কাঁদ কেন? ব্যস্ত হয়ে উঠলেন ভবানী মাস্টার।

আমি লিখিনি কান্না-জড়ানোর গলায় বলল অনি।

এক হাতে ওকে জড়িয়ে কাছে আনলেন ভবানী মাস্টার, কী লিখ নাই?

গোপমাসি নিজে থেকে লিখে দিয়েছে। আমি লিখতে বলিনি। জোরে কেঁদে উঠল ও।

ডান হাতে খাতাটা খুললেন ভবানী মাস্টার। উত্তরগুলো দেখলেন। মুহূর্তে ওঁর কপালের রগ দুটো নাচতে লাগল। তারপর অনির দিকে তাকালেন, তুমি এগুলান দেখছ।

ঘাড় নাড়ল অনি, না।

বাঃ, ভালো। এখন চোখ থিকা জল মোছে। গোপটার মাথায় গোবর থাকলে সার হত, তাও নাই। ও যা ভুল করছে তুমি তা শুদ্ধ করো। বসো। কথাটা বলে অনির হাত ধরে সামনে বসিয়ে দিলেন উনি। তারপর দরজার দিকে তাকিয়ে বিওদের দেখতে পেয়ে ধমক দিলেন, এই তোরা বাগানে থাকিস না। আয় বস, ঐ দেখল একটা যোগ একদম বুল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ও সেটা ঠিক করল।

শেষ পর্যন্ত ভুল ঠিক করা হয়ে গেলে ও খাতটা মাস্টারের হাতে দিল। চটপট দেখে নিলেন উনি। দেখে চেঁচিয়ে উঠলেন, বাঃ, ফাস্ট ক্লাস।

তারপর অনির দিকে ফিরে ওকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন উনি। অনি বুঝতে পারছিল না ও কী করবে। ওঁর শরীর থেকে আসা ঘামের গন্ধে, নস্যির গন্ধে অনির কষ্ট হচ্ছিল। ভবানী মাস্টার ওর মাথায় হাত বুলিয়ে ফিসফিস করে বললেন, একটা কথা মনে রাখবা বাবা, নিজের কাছে সৎ থাকলে জীবনে কোনো দুঃখই দুঃখ হয় না। তুমি অনেক বড় হবা একদিন, কিন্তু সৎ থাকবা, আমাকে কথা দাও।

কথাগুলো শুনতে শুনতে অনি আবার কেঁদে ফেলল। তারপর ঐ নস্যির গন্ধ, ঘামের গন্ধ মাথা বুকে মাথা রেখে ও কান্না-জড়াননা গলায় কী বলে থরথর করে কাঁপতে লাগল।

স্কুলের মাঠে বিকেলে ফুটবল খেলা হয়, কিন্তু অনিদের সেখানে যাওয়া হয় না। ওদের কোয়ার্টার থেকে স্কুলের ফুটবল মাঠ অনেক দূর। তাছাড়া গেলেই যে খেলতে যাবে এমন নয়। একদিন অনিরা গিয়ে দেখেছিল তাদের বয়সি কেউ খেলছে না। হাফপ্যান্ট বা ধুতি গুটিয়ে পরে বড় বড় মানুষ হইহই করে ফুটবল খেলছে ওখানে। তাদের বিশাল বিশাল লোমশ পা দেখে ওরা ভয়ে ফিরে এসেছিল। বাগানের কোয়ার্টারের সামনে অঢেল খোলা জমি। মাঝে-মাঝে উঁচুনিচু অবশ্য, তাছাড়া দুটো কাঁঠালচাপার গাছ শক্ত হয়ে বসে আছে মধ্যিখানে-তাও খেলাটেলা যেত, কিন্তু মুশকিল হল ওদের বয়সি ছেলে এই কোয়ার্টারগুলোতে বেশি নেই। অনিদের বাতাবিলেবু গাছ থেকে গোলগাল একটা লেবু নিয়ে ওরা মাঝে মাঝে খেলে, কিন্তু সেটা ঠিক জমে না।

অনিরা বাড়ির সামনের মাঠে গোল হয়ে বসে ধনধান্য পুষ্পভরা গাইছিল। মোটামুটি কথাগুলো এখন মুখস্থ হয়ে গেছে। গান করে গাইলে যে-কোনো কবিতা চট করে মুখস্থ হয়ে যায়। হঠাৎ ওরা শুনলো গোঁ গোঁ করে শব্দঠছে সামনের রাস্তায়। সাধারণত যেসব লরি বা বাস এই রাস্তায় রোজ চলাচল করে এ শব্দ তার থেকে আলাদা। কি গম্ভীর, যেন সমস্ত পৃথিবী কঁপিয়ে শব্দটা গড়াতে গড়াতে আসছে। খানিকবাদেই ওরা দেখতে পেল ত্রিপলে মোড়া ভারী ভারী মিলিটারি ট্রাক একের পর এক ছুটে আসছে। মুখ-থ্যাবড়া গাড়িগুলো দেখতে বীভৎস, অনেকটা খেপে-যাওয়া বুলডগের মতো। প্রত্যেকটি গাড়ির নাকের ডগায় সরু লোহার শিক লিকলিক করছে। ট্রাকগুলো থেকে বেখাপ্লামতো কিছু বাইরে বেরিয়ে আছে, তবে সেগুলোর ওপর ভালো করে ত্রিপল ঢাকা। তার পরই ওরা দেখতে লরিভরতি কালো কালো বিকট চেহারার মিলিটারির দল। ট্রাকে বসে হইহই করে চিৎকার করছে। এই ধরনের চেহারার মানুষ ওরা কখনো দেখেনি। এত দূর থেকেও ওদের সাদা দাঁত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
 
হঠাৎ বিশু ওরে বাবা গো বলে চোচো দৌড় দিল নিজের বাড়ির দিকে। ওর দেখাদেখি বাপীও ছুটল। মিলিটারি ট্রাক দেখলে কেউ বাড়ির বাইরে যাবে না-এরকম একটা আদেশ ছোটদের জন্যে দেওয়া আছে। কিন্তু কী করে অনিরা বুঝবে কখন ওরা আসবে! দৌড়তে গিয়ে নি টের পেল ওর, দুটো পা যেন জমে গেছে। পা-ঝিনঝিন শুরু হয়ে গেল হঠাৎ। গলার কাছটায়, টনসিলের ব্যথাটাই বোধহয়, কেমন করে উঠল ঘুমন্ত গাড়িগুলো দেখতে দেখতে ও নিজের অজান্তে ধনধান্য পুষ্পরা ফিসফিস করে গাইতে লাগল। আর গাইতে গাইতে ওর শরীরের শিরশিরানিটার কমে যাওয়া টের পেল। অনিক অবাক হয়ে দেখল একটা গাড়ি ঠিক ওদের বাড়ির সামনে ব্রেক কষে থেমে গেছে। গাড়িটা থামতেই একটা লোক লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে এল। এত লম্বা লোক অনি কোনোদিন দেখেনি, দুনম্বর লাইনের ভেটুয়া সর্দারের চেয়েও লম্বা। আর তেমনি মোট। এদিক ওদিকে মুখ ঘুরিয়ে জায়গাটা দেখে নিল লোকটা, তারপর অনিকে লক্ষ করে হনহন করে এগিয়ে আসতে লাগল। অনি দেখল লোকটার হাতে দোল খাচ্ছে হাঁটার তালে। জয়ে সিটকে গিড়য়ে অনি প্রায় কান্নার সুরে ধন্যধান্য পুষ্পভরা বিড়বিড় করে যেতে লাগল বারংবার।

ওয়াতার, ওয়াতার; পানি!

অনি চোখ খুলে দেখল সামনে একটা ওয়াটার টু ঝুলছে আর তার পেছনে পাহাড়ের মতো উঁচু একটা লোক যার গায়ের রঙ মিশমিশে কালো। লোকটা হাসছে, কী সাদা দাঁতগুলো। লোকটা ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আবার বলল, ওয়াতার, প্লিজ। জল চাইছে লোকটা, অনি পা দুটোয় ক্রমশ সাড় ফিরে পেল। ও তাকিয়ে দেখল পেছনের সব কোয়াটারের জানালা-দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু ওদের বাড়ির জানালায় অনেকগুলো মুখ কী ভীষণ ভয় নিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।

এগিয়ে-দেওয়া ওয়াটার বটটা হাতে নিয়ে অনি নিজের বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে ও টের পেল এখন আর একদম ভয় করছে না, বুকের মধ্যে একটুও শিরশিরানি নেই। বরং নিজেকে খুব কাজের বলে মনে হচ্ছে, বেশ বড় বড় লাগছে নিজেকে।

বারান্দায় উঠতেই দরজা খুলে গেল আর সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো হাত অনিকে জড়িয়ে ধরে ভেতরে টেনে নিল। সবাই মিলে বলতে লাগল, কী ছেলে রে বাবা, একটুও ভয় নেই, যদি ধরে নিয়ে যেত, আসুক আজ বাবা, হবে তোমার ইত্যাদি। বেঁকেচুরে নিজেকে ছাড়িয়ে অনি ঝাড়িকাকুর দিকে ওয়াটার বটুটা এগিয়ে দিয়ে গম্ভীর মুখে বলল, জল নিয়ে এস শিগগির, লোকটা দাড়িয়ে আছে।

অনির গলার স্বরে এমন একটা কিছু ছিল যে, মাধুরী অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকালেন। অনি যে এই গলায় কথা বলতে পারে মাধুরীর জানা ছিল না। ওয়াটার বটটা নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন উনি।

পিসিমা বললেন, হ্যারে, তোকে কী বলল রে?

অনি বলল, কী আর বলবে, জল চাইল!

পিসিমা আবার বললেন, তোকে কি ভয় দেখাল?

বিরক্ত হয়ে অনি বলল, ভয় দেখাবে কেন? জল চাইতে হলে কি তুমি ভূঢ় দেখাও?

এমন সময় মাধুরী ওয়াটার বটলটা নিয়ে ফিরে এলেন। কম্বলে মোড়া বটলটা এখন বেশ ভারী। মাধুরী জলের সঙ্গে একটা প্লেটে বেশকিছু বাতাসা দিলেন। বাতাসাটা নিয়ে অনি মায়ের দিকে তাকাতে মাধুরী হাসলেন, শুধু জল দিতে নেই রে, যা। এক হাতে জল অন্য হাতে বাতাসা নিয়ে অনি গটগট করে বাইরে বেরিয়ে এল। এইজন্যে মাকে ওর এত ভালো লাগে।
 
মাঠের মধ্যে গাছের মতো লোকটা একা দাড়িয়ে ছিল। অনিকে আসতে দেখে একগাল হাসল। হাসি দেখে অনির সাহস আরও বেড়ে গেল। কাছাকাছি হতে লোকটা হাত বাড়িয়ে ওয়াটার বলটা নিয়ে বলল, থ্যা। কথাটা অনি ঠিক বুঝল না, কিন্তু ভঙ্গিতে বেশ মজা লাগল। ও বাতাসার প্লেটটা এগিয়ে ধরতে লোকটা চোখ কুঁচকে সেটাকে দেখে বলল, হোয়াতিজ দ্যাটা মানেটা ধরতে না পারলেও অনি বুঝতে পারল লোকটা কী বলতে চাইছে। এখনও ওদের স্কুলে ইংরেজি শুরু হয়নি। সরিৎশেখর অবশ্য ওকে মাঝে-মাঝে ইংরেজি শব্দ শেখান, কিন্তু বাতাসার ইংরেজি কোনোদিন গুনেছে বলে মনে করতে পারল না। বরং বাতাসা খেতে মিষ্টি, আর মিষ্টির ইংরেজি সুইট-এটা বলে দিলেই তো হয়! শব্দটা শুনে লোকটা ঠোঁট দুটো গোল করে অবাক হবার ভান করে বলল, শো গুড় ইংলিশ? আই টু। ওকে, ওকে। বলে এক থাবায় বাতাসাগুলো নিয়ে মুখে পুরে চিবোতে লাগল। স্বাদ জিভে যেতে লোকটার মাথা দুলতে লাগল চিবোনার তালে তালে। তারপর ঢকঢক করে কয়েকটা ঢোক জল খেয়ে নিতেই পেছন থেকে ট্রাকের লোকগুলো হইহই করে ডাকতে শুরু করল। অনি দেখল পেছনের লোকগুলোকে ইংরেজি নয়, অন্য কোনো ভাষায় জবাব দিয়ে একহাতে অনিকে শূন্যে তুলে নিয়ে ট্রাকের দিকে হাঁটতে লাগল। লোকটার গায়ের ঘেমো বেটিকা গন্ধ আর ট্রাকের একদল নিগ্রোর হইহই, পেছনের বারান্দায় বেরিয়ে আসার পিসিমার আর্তচিৎকারে অনির শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল, ওর হাত থেকে প্লেটটা টুপ করে পড়ে গেল। ওর মনে হল ও ছেলেধরার কবলে পড়েছে, এখন ঐ ট্রাকে চাপিয়ে পৃথিবীর কোনো দূরান্তে ওকে নিয়ে যাবে ওরা। বাবা মা দাদু কাউকে কোনোদিন দেখতে পাবে না ও। প্রচণ্ড আক্রোশে লোকটার চোখদুটো দুই আঙুলে টিপে অন্ধ করে দিতে গিয়ে অনি শুনল ওকে মাথায় তুলে হাটতে হাটতে লোকটা অদ্ভুত ভাষায় ভীষণ চেনা সুরে গান গাইছে। গাইবার ধরন দেখে বোঝা যায়, খুব মগ্ন হয়ে গাইছে ও। ওর ভাষা বোঝা অসম্ভব, কিন্তু সুর শুনে অনির মনে হল পুজো করার সময় পিসিমা এইরকম সুরে গুনগুন করেন। অনির হাত লোকটার শিংএর মতো চুলের ওপর এসে থেমে গেল। ট্রাকের কাছে এসে লোকটা কিছু বলতে ট্রাকের ওপর দাড়ানো লোকগুলো হইহই করে উঠে হাত বাড়িয়ে অনির দিকে চার-পাঁচটা প্যাকেট এগিয়ে দিল। লোকটার কাঁধের ওপর থাকায় অনি ট্রাকের সবটাই দেখতে পাচ্ছে। একগাদা কম্বল পাতা, বন্দুক, কাচের বোতল ছড়ানো। প্যাকেটগুলো ওর হাতে গুছিয়ে দেওয়া হয়ে গেলে লোকটা ওকে মাটিতে নামিয়ে দিল। তারপর বিরাট থাবার মধ্যে ওর মুখটা ধরে কেমন গলায় বলল, থাঙ্ক ইউ মাই সন। বলে লাফ দিয়ে ট্রাকে উঠে গেল। ওয়াটার বলটা তখন ট্রাকের ভেতর হাতে-হাতে ঘুরছে।

ট্রাকটা চলে যেতে রাস্তাটা ফাঁকা হয়ে গেল। বিরাট আসাম রোড চুপচাপ-শব্দ নেই কোথাও। অনি ওর বুকের কাছে ধরা প্যাকেটগুলোর দিকে তাকাল। গন্ধ এবং ছবিতে বোঝা যাচ্ছে, এগলো বিস্কুট এবং টফির প্যাকেট। ওরা ওকে এগুলো ভালোবেসে দিয়ে গেল। অথচ ও কী ভয় পেয়ে গিয়েছিল! লোকগুলোকে ছেলেধরা বলে ভেবেছিল। হঠাৎ অনি অনুভব করল ওর প্যান্টের সামানেটা কেমন ভেজা-ভেজা। এক হাতে প্যাকেটগুলো সামলে অন্য হাতে জায়গাটা কত ভালো! নিজের বাড়ির দিকে তাকিয়ে ও দেখল পিসিমা মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে, পাশে ঝাড়িকাকু, অনেক পেছনে মা। হঠাৎ ওর পিসিমার ওপর রাগ হল, পিসিমাই শুধুশুধু মিলিটারিদের ছেলেধরা বলে ভয় দেখায়। অনি আর দাঁড়াল না। একছুটে মাঠটা পেরিয়ে পিসিমার বাড়ানো হাতের ফাঁক গলে মায়ের শরীর জড়িয়ে ধরল।

মাধুরী বললেন, কী হয়েছে?

মাকে জড়িয়ে ধরতে মুঠো আলগা হওয়ায় আনির হাত থেকে প্যাকেটগুলো টুপটুপ করে মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল। সেই অবস্থায় মায়ের বুকে মুখ গুজে অনি বলল, লোকটা খুব ভালো, কিন্তু মা, কিন্তু বোকার মতো হিসি করে ফেলেছি। ভরত হাজাম সরিৎশেখরের চুল কাটছিল। কাঁঠালতলার রোদুরে কাঠোর পিড়ি পেতে উনি বসেছিলেন। চুল কাটার সব সরঞ্জাম বাড়িতে রেখেছেন উনি। বারো ভূতের চুল-কাটা কাচি ক্ষুরে ওঁর বড় ঘেন্না, কার কী রোগ আছে বলা যায় না। ভরত তাই খালি হাতে এবাড়িতে আসে। এমনকি কাটা চুল থেকে গাঁ-বাঁচানোর জন্যে ত্রিশ বছরের পুরনো লং ক্লথ যেটা এই মুহূর্তে সরিৎশেখর জড়িয়ে বসে আছেন সেটাও আনতে হয় না।
 
কিচকিচ শব্দ করে উঠছিল ভারতের দুই আঙুলের চাপে। বেশিক্ষণ মাথা নিচু করতে পারেন না বাবু, তাই মাঝে-মাঝে হাত সরিয়ে নিচ্ছিল অত। আজ ত্রিশ বছর এই বাড়ির চুল কাটছে ও, অনেককেই জন্মাতে দেখেছে, মরতেও। বিয়ে দিয়ে এনেছে কয়েকজনকে। কিন্তু এখন আর তেমন জোর নেই ওর। কেমন যে ও পুরনো হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারে না। এই বাড়ির সেজোবাবু ওর কাছে চুল কাটে না। একদিন বলতেই হেসে উঠেছিল, কেন বাবা, আমাকে আর দয়া না-ই-বা করলে, তোমার বাটিছাট নেবার পার্টি এ-বাড়িতে অনেক আছে। বাবা টু অনি। অল ফাউন্ড দুটাকা! মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল ভরতের হ্যাঁ, দুটাকায় ও সবাইয়ের এমনকি ঝাড়ির চুলটাও কেটে দেয়। প্রথম ছিল আট আনা, বছর পাঁচেক আগে বেড়ে গিয়ে দুটাকা হল।

সরিৎশেখর মাথা তুলতেই হাত সরিয়ে নিল ভরত হাজাম, তোর কাছে এই শেষ চুল কাটা, না? ভরত কোনো উত্তর দিল না। বাবুর চাকরি, শেষ, এই বাগান থেকে শহরে বাড়ি করে বাবু চলে যাচ্ছেন। এই মাথার কালো চুলগুলো চোখের সামনে ফুলের মতো সাদা হয়ে গেল-আজ ত্রিশ বছর ধরে এই মাথার চুল কেটেছে ও, আর কোনোদিন কাটতে পারবে না। লোকমুখে শুনেছে ও, বাবু নাকি এই বাগানে আর কোনোদিন পা দেবেন না। কথাটা ভাবতেই বুকের মধ্যে কেমন করে উঠল। পানসে চোখে জল আসতে লাগল।

হঠাৎ সরিৎশেখর বললেন, ভরত, যাবার সময় এই খুরচিগুলো নিয়ে যাস। খুব চাইতিস তো এককালে?

সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড চিৎকার করে কেঁদে উঠল ভরত। দুহাতে মুখ গুঁজে ফেঁপাতে লাগল বাচ্চা ছেলের মতো।

কান্নার শব্দ শুনে সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে এল। রান্নাঘরে অনিকে খেতে দিচ্ছিলেন মাধুরী, শব্দ শুনে এঁটোহাতে একছুটে বেরিয়ে এল অনি, পিছনে পিছনে মাধুরী। ঝাড়িকাকু ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে হাসছে। মহীতোষকে দেখে মাথায় ঘোমটা তুলে দিরেন মাধুরী। শ্বশুরমশাই পিছন ফিরে বসে, সামনে ভরত হাজাম মাটিতে বসে কাঁদছে। একটু আগে স্নান হয়ে গেছে মহীতোষের। এই বাড়িতে লুঙ্গি পরা নিষেধ ছিল এককালে। মহীতোষ নিয়ম ভেঙ্গেছেন। শীতকাল নয় তবু ঠাণ্ডা আছে, তাই লুঙ্গির ওপর পুরোহাতের গেঞ্জি চাপাননা। অনি দেখল পিসিমা দাদুর কাছে এগিয়ে গেলেন। মহীতোষ বারান্দায় দাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে। সরিৎশেখর মুখ ঘুরিয়ে সবাইকে দেখলেন। অনি দেখল দাদুর মুখ কেমন করে কাঁদছে কেন? চুল কাটার সময় ব্ৰত এমন করে ওর ঘাড় ধরে থাকে যেন অনিরই কান্না পেয়ে যায়। একটু নড়াচড়া করলে মাথায় গাঁট্টা মারে। আবার মন ভালো থাকলে গানও শোনায় কাঁচি চালাতে চালাতে। একটা গান তো অনিরই মুখস্থ হয়ে গেছে-বুড়া কাঁদে বুড্ডি নাচে, বুড়া বোলে ভাগো। মা অবশ্য খুব বারণ করে দিয়েছে গানটা গাইতে। কিন্তু বাবা দাদু বাড়িতে না থাকলে ছোটকাকু গলা ছেড়ে ঠাট্টা করে গানটা মাঝে-মাঝে গায়।

সরিৎশেখর গম্ভীর গলায় বললেন, মহী, আমি যখন এখানে থাকব না তখন যেন ভরতের এবাড়িতে আসা বন্ধ না হয়।

মহীতোষ বললেন, কী আশ্চর্য, বন্ধ হবে কেন?

সরিৎশেখর বললেন, আর ও তো বুড়ো হয়ে গেছে, যখন চুল কাটা ছেড়ে দেবে তখনও যেন প্রতি মাসে টাকা দেওয়া হয়।

মহীতোষ হাসলেন, আচ্ছা।

পিসিমা জিজ্ঞাসা করলেন, ও বাবা, এইজন্যে ভরত কাঁদছে?

সরিৎশেখর মাথা নাড়লেন, না। তারপর ঘাড় ফিরিয়ে হেঁকে উঠলেন, আয় বাবা ভরত, বাকি চুলটা কেটে দে, আমি সারাদিন বসে থাকতে পারব না।

বাঁধাছ্যাঁদা শেষ। টুকিটাকি যাবতীয় জিনিসপত্র পিসিমা জড়ো করেছেন। চিরকালের জন্য যেন স্বৰ্গছেঁড়া ছেড়ে চলে যাওয়া-এই যে মাধুরী মহীতোষরা এখনে থাকছেন একথাটা আর মনে নেই। শহরে গিয়ে অসুবিধে হতে পারে বলে পুরো সংসারটা তুলে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছেন পিসিমা। অনির জামাকপড় বাক্সে তোলা হয়ে গিয়েছে। সময়টা যত গড়িয়ে যাচ্ছে অনির বুকের ভেতর তত কী খারাপ লাগছে! অথচ দাদুর মুখ দেখে মোটেই মনে হচ্ছে না, এখান থেকে যেতে একটুও খারাপ লাগছে। এই চা-বাগান নাকি দাদু নিজের হাতে তৈরি করেছেন। দাদুর তো বেশি মন-কেমন করা উচিত। বরং দাদু চলে যাচ্ছেন শুনে এত যে লোকজন দেখা করতে আসছে, তাদের সঙ্গে বেশ হেসে হেসে দাদু কথা বলছেন। মাঝে আর একটা দিন। পনেরোই আগষ্ট। তার পরদিনই চলে যেতে হবে এখান থেকে। বাগান থেকে দুটো লরি দেবে মালপত্র নিয়ে যেতে-আজ অবধি অনি শহরে যায়নি কখনো।
 
অন্ধকারে অনি চারপাশে চোখ বোলাল। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এখন রাত কটা? ভোর পাঁচটার সময় বিশু আর বাপী ওদের বাড়ির সামনে আসবে। রাত্রে শোওয়ার সময় মাধুরী অনির জন্য সাদা শার্ট কালো প্যান্ট ইস্ত্রি করিয়ে রেখে দিয়েছেন। পাঁচটা বাজতে আর কত দেরি! অনির মোটেই ঘুম আসছিল না। ওর বুকের ওপর মাধুরীর একটা হাত নেতিয়ে পড়েছে। ওপাশে মহীতোষের নাক ডাকছে। কান খাড়া করে অনি কিছুক্ষণ শুনতে চেষ্টা করল বৃষ্টির শব্দ হচ্ছে কি না। যাক বাবা, বৃষ্টি হচ্ছে না। কাল সারাটা দিন যদিও রোদের দিন গেছে, তবু সন্ধেনাগাদ মেঘ-মেঘ করছিল। হঠাৎ মাধুরীর হাতটা একটু নড়ে উঠতে অনি চমকে উঠল। মাধুরীর শরীর থেকে অদ্ভুত মিন্ধি গন্ধটা বেরুচ্ছে। আর একদিন একটা রাত – মায়ের বুকে মুখ গুঁজে দিতে মাধুরীর ঘুম ভেঙে গেল! জড়ানো গলায় বললেন, আঃ, ঠেসছিস কেন? আর সঙ্গে সঙ্গে অনি শুনতে পেল কে যেন তার নাম ধরে বাইরে ডাকছে। তড়াক করে উঠে পড়ল ও। মাধুরী জিজ্ঞাসা করলেন, কী হল? অনি বলল, ওরা এসে গেছে। অনি দেখল, ওর গলা শুনে মহীতোষের নাক ডাকা থেমে গেল। বাবার ঘুমটা অদ্ভুত, অনি ঠিক বুঝতে পারে না।

পাটভাঙা জামাপ্যান্ট, বুকে কাগজের গান্ধীর ছবি পিন দিয়ে এঁটে, হাতে জাতীয় পতাকা নিয়ে বীরের মতো পা ফেলে অনি বাইরের ঘরে এসে দাঁড়াল। বাইরের ঘরের জানালা খুলে দেওয়া হয়েছে। দরজাও খোলা। বাইরে এখনও আলো ফোটেনি। অন্ধকারটা ফ্যাকাশে হয়ে এসেছে। সেই ফ্যাকাশে অন্ধকারটা ঘরময় জুড়ে রয়েছে। ঘরের একপাশে ইজিচেয়ারে সরিৎশেখর চুপচাপ বসে আছেন। আনির পায়ের শব্দে উনি মুখ ফিরিয়ে ওকে দেখলেন। দাদু এভাবে বসে আছেন কেন? দাদু কি কাল রাত্রে ঘুমোননি? দাদুর মুখটা অমন দেখাচ্ছে কেন? হাত বাড়িয়ে সরিৎশেখর অনিকে ডাকলেন, কোথায় চললে?

স্কুলে। আজ আমাদের স্বাধীনতা দিবস। অনি বলল।

স্বাধীনতা মানে জান? সরিৎশেখর বললেন।

হ্যাঁ, আমরা নিজেরাই নিজেদের রাজা এখন। অনি শোনা কথাটা বলল।

গুড। গো অ্যাহেড। এগিয়ে যাও। পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেন সরিৎশেখর।

ওকে দেখে বিশু বলল, তাড়াতাড়ি চল, আরম্ভ হয়ে গেল বলে।

বাপী বলল, কাল রাত্রে তোদের রেডিওটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল, না?

অনি বলল, জানি না তো!

বাপী বলল, কাল বারোটার সময় সবাই রেডিও শুনতে গিয়ে দেখে খারাপ হয়ে গিয়েছে। বাবা বাড়ি ফিরে বলল। অনি ব্যাপারটা জানে না, ও শুনেছিল রাতে রেডিওতে নাকি কিসব বলবে, কিন্তু ওদের রেডিওটাই খারাপ হয়ে গেল, যাঃ!

দেরি হয়ে গেছে বলে ওরা দৌড় শুরু করল। আসাম রোডের দুপাশে সার দিয়ে দাঁড়াননা পাইনদেওদার গাছের শরীরে অন্ধকার ঝুপসি হয়ে বসে আছে। রাস্তাটা এখন স্পষ্ট দেকা যাচ্ছে। পুব দিকটায় একটি লালচে আভা এসেছে। ওরা তিনজন পাশাপাশি তিনটে পতাকা সামনে ধরে দৌড়াচ্ছিল। হাওয়ায় পতাকা তিনটে পতপত করে উড়ছে; একটু শীতের ভাব থাকলেও বেশ আরাম লাগছে ছুটতে। অনির ভারি ভালো লাগছিল। আর আমরা নিজের রাজা নিজে। দৌড়তে দৌড়তে বাপী চিল্কার করল, পনেরোই আগস্ট, ওরা চিৎকার করে জবাব দিল, স্বাধীনতা দিবস। এখন এই রাস্তার চারপাশে কেউ জেগে নেই। নির্জন আসাম রোডের ওপর ছুটে-চলা তিনটে বালকের চিৎকার শুনে একরাশ পাখি দুদিকের গাছের মাথায় বসে কলরব করে জানান দিল। ভারতবর্ষের কোন এক কোণে এই নিঝুম প্রান্তরে সাতচল্লিশ সালের পনেরোই আগস্টের এই ভোর-হতে-যাওয়া সময়টায় তিনটে বালক কী বিরাট দায়িত্ব নিয়ে পতাকা উঁচু রেখে দৌড়তে দৌড়তে গান ধরল, ওদের একটিমাত্র শেখা গান, ধন্যধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা। দৌড়বার তালে অনভ্যস্ত গলার সুর ভেঙেচুরে যাচ্ছে, তবু দুপাশের প্রকৃতি যেন তা অঞ্জলির মতো গ্রহণ করছিল।
 
স্কুলবাড়ির কাছাকাছি এসে ওরা দাঁড়িয়ে পড়ল। এখনও আলো ফোটেনি, কিন্তু কষ্ট করে অন্ধকার খুঁজতে হয় । ওরা দেখল একটি মূর্তি খুব সতর্ক পায়ে রাস্তার একপাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। বিশু বলল, রেতিয়া না রে

ওরা তিনজন তিন পাশে গিয়ে দাঁড়াতে রেতিয়া চমকে সোজা হয়ে দাড়াল, মুখটা ছুঁচলো করে, শংকর চোখ দুটো বন্ধ করে কিছু টের পেতে চেষ্টা করর। গলা ভারী করে অনি জিজ্ঞাসা করল, কাঁহা যাহাতিস রে?

চট করে উত্তর এল, স্কুল। ওরা-মুখ চাওয়াচাওয়ি করল, তারপর আবার দৌড় শুরু করল। অনি ঠিক বুঝতে পারছিল না রেতিয়ার কাছে কী করে খবর গেল যে আজ স্বাধীনতা দিবস। স্বাধীনতা মানে আমি নিজেই নিজের রাজা। রাজার ইংরেজি কিং। বাবারা তাস খেলার সময় কিংকে সাহেব বলে। আমরা আজ থেকে সব সাহেব হয়ে গেলাম। রেতিয়া পর্যন্ত।

স্কুলের মাঠটা এই সাতসকালে প্রায় ভরে গেছে। ওদের বাগান থেকে মাত্র ওরা তিনজন কিন্তু ওপাশের বাজার, হিন্দুপাড়া কলিন পার্ক থেকে ছেলেমেয়ের দল এসে মাঠটা ভরিয়ে দিয়েছে। স্কুলের সামনে একটা লম্বা বাঁশ পোঁতা হয়েছে যার ডগা থেকে একটা দড়ি নিচে নামানো। পাশে টেবিলের ওপর মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর ছবি। এই নামটা অনি সবে শিখেছে। এত বড় নাম মনে না থাকলে গান্ধীজি বলা যেতে পারে, নতুন দিদিমণি বলেছেন। ভবনী মাস্টারকে দেখে অবাক হয়ে গেল ও। ধোপভাঙা ধুতি-পাঞ্জাবি পরলেও অনেককে ভালো দেখায় না, ভবানী মাস্টারকেও কেমন দেখাচ্ছে। তার ওপর মাথায় সাদা নৌকো-টুপি। সুভাষচন্দ্র বসুর ছবিতে দেখেছে ও। নতুন দিদিমণি গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন পাশে। টেবিলের ওপাশে দুটো চেয়ার, একটাতে ব্যানার্জি স-মিলের বড় কর্তা, অন্যটাতে মোটামতন একটা লোক নৌকো-টুপি পরে বসে ঘড়ি দেখছেন মাঝে-মাঝে।

অনিরা ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে গেল। স্বৰ্গছেঁড়ার বেশ বড় বড় কয়েকজন ছেলে যারা স্কুলে পড়ে না তারা ভিড় ম্যানেজ করছিল। পূর্বদিকটা ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। ব্যানার্জি স-মিলের বড়কর্তা ভবানী মাস্টারকে ডেকে ফিসফিস করে কী বলতে ভবানী মাস্টার হাত তুলে সবাইকে শান্ত হতে বললেন। গোলমাল থেমে যেতেই নতুন দিদিমণি চিল্কার করে উঠলেন, বন্দে-এ মারতম্। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকশো শিশুর গলায় উঠল, বলে-এ মাতরম্। তিনবার এই ধ্বনিটা উচ্চারণ করে অনির মলে হল ওদের চারপাশে অদ্ভুত একটা ফুলের দেওয়াল তৈরি হয়ে গেছে। ভবানী মাস্টার চিৎকার করে উঠলেন, তোমরা জান, আজ ইংরেজদের দাসত্বমোচন করে আমরা স্বাধীন হয়েছি। দুশো বছর পরাধীনতার পরে আমাদের ক্ষুদিরাম, বাঘা যতীন, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, গান্ধীজির জন্যে আজ এই দেশে স্বাধীনতা এসেছে। নতুন দিদিমণি ফিসফিস করে কিছু বলতেই ভবানী মাস্টার বললেন, হ্যাঁ, এইসঙ্গে সুভাষ বোসের নাম ভুলে গেলে চলবে না।। স্বাধীনতা এই পুণ্যদিনে আমরা সমবেত হয়েছি। তোমরা যা এখনও নাবালক তারা শশানো, এই দেশটাকে ছিড়ে শুষে নষ্ট করে দিতে চেয়েছে ইংরেজরা। এই দেশটাকে নিজের মায়ের মতো ভেবে নিয়ে তোমাদের নতুন করে গড়তে হবে। বলল সবাই বন্দে মাতরম্। অনিরা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করল, বন্দে মাতরম্। অনি দেখল ভবানী মাস্টারের চোখ থেকে জল নেমে এসেছে, তিনি মোছর চেষ্টা করছেন না। সেই অবস্থায় ভবানী মাস্টার বললেন, তাকিয়ে দ্যাখো পূর্ব দিগন্তে সূর্যদের উঠেছেন। এই মহালগ্নে আমাদের স্বর্গছেড়ার আকাশে প্রথম জাতীয় পতাকা উড়বে। শহর থেকে বিশিষ্ট জননেতা শ্রীযুক্ত হরবিলাস রায় মহাশয় আজ আমাদের এখানে এসেছেন। স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর অবদানের কথা আমরা সবাই জানি। আমি তাঁকে অনুরোধ করছি এই পবিত্র দায়িত্ব গ্রহণ করতে। সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে। কোথাও কোনো শব্দ নেই। স্বৰ্গছেঁড়ার মানুষের জীবনে এমন একটা ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে যার গুরুত্ব সম্পর্কে কেউ হয়তো কোনোদিন সচেতন ছিল না। এখন এই মুহূর্তে সবাই উন্মুখ হয়ে দাড়িয়ে।
 
হরবিলাসবাবু দাড়ালেন, সামনের জনতার ওপর ওঁর বৃদ্ধ চোখ দুটো রাখলেন খানিক, তারপর খুব পরিচ্ছন্ন গলায় বললেন, আজ সেই মুহূর্ত এসেছে যার জন্য আমরা সারাজীবন সগ্রাম করেছি। গান্ধীজির অনুগামী আমি, আমাদের সগ্রাম শান্তির জন্য, ভালোবাসার জন্য। কিন্তু আমার তো বয়স হয়েছে। এই পতাকা আমার যৌবনের স্বপ্ন ছিল, একে আমি আমার রক্তের চেয়ে বেশি ভালোবাসি। আজ এই পতাকা মাথা উঁচু করে আকাশে উড়বে-এই দৃশ্য দেখার জন্যই আমি বেঁচে আছি। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, এই পতাকা আকাশে তোলার যোগ্যতা আমার নেই। এই পতাকা তুলবে আগামীকালের ভারতবর্ষের দায়িত্ব যাদের ওপর তারাই যোগ্যতা আমার নেই। এই পতাকা তুলবে আগামীকালের ভারতবর্ষের দায়িত্ব যাদের ওপর তারাই। সাতচল্লিশ সালের পনেরোই আগস্টের এই সকাল তাদের সারাজীবন দেশগড়ার কাজে শক্তি যোগাবে। তাই আমি আগামীকালের নাগরিকদের মধ্যে একজনকে এই পতাকা তোলার জন্য আহ্বান করছি। সবাই অবাক হয়ে কথাগুলো শুনল। হরবিলাসবাবু কয়েক পা এগিয়ে এসে সামনের দিকে তাকালেন। তার চোখ ছোট ছোট ছেলেদের মুখের ওপর, কাকে ডাকবেন তিনি ভাবছেন। হঠাৎ অনি দেখল হরবিলাসবাবু তার দিকে তাকিয়ে আছেন । খানিকক্ষণ দেখে তিনি আঙুল তুলে অনিকে কাছে ডাকলেন। অনি প্রথমে বুঝতে পারেমি যে তাকেই ডাকা হচ্ছে। বোঝমাত্রই ওর বুকের মধ্যে দুদুক শুরু হয়ে গেল। হাঁটুর তলায় পা দুটোর অস্তিত্ব যেন হঠাৎই নেই। বাপী ফিসফিস করে বলল, তোকে ডাকছে, যা।

হরবিলাসবাবু ডাকলেন, তুমি এসো ভাই।

কী করবে ভেবে না পেয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল অনি। স্বর্গহেঁড়ার ছেলেমেয়ের দল অনির দিকে তাকিয়ে আছে। হরবিলাসবাবু এক হাতে অনিকে জড়িয়ে ধরে পতাকার কাছে নিয়ে গেলেন। ভবানী মাস্টার বাশের গায়ে জড়ানো দড়িটা খুলে অনিকে ফিসফিস করে বললেন, এইদিকের রশিটা টানবা, পুঁটলিটা একদম ডগায় গেলে রশিটা জোরে নাচাবা।

অনি সম্মোহিতের মতো মাথা নাড়ল। হরবিলাসবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী ভাই?

অনি, অনিমেষে।

হরবিলাসবাবু সোজা হয়ে সামনের দিকে তাকালেন, আপনারা সবাই প্রস্তুত হোন। এখন সেই ব্রাহ্মণমুহুর্ত, আমাদের জাতীয় পতাকা স্বাধীন ভারতের আকাশে মাথা উঁচু করে উড়বে। তাকে তুলে ধরছে আগামীকালে ভারতবর্ষে অন্যতম নাগরিক শ্রীমান অনিমেষ। কথাটা শেষ হতেই ভবানী মাস্টার ইঙ্গিত করে অনিমেষকে দড়িটা টানতে বললেন।

দুহাতে হঠাৎ যেন শক্তি ফিরে পেল অনি, সমস্ত শরীরে কাঁটা দিচ্ছে, মা কোথায়-মা যদি দেখত, অনি দড়িটা ধরে টানতে লাগল। এপাশের দড়ি বেয়ে একটা রঙিন পুঁটলি উঠে যাচ্ছে, ওদিকে দড়ি নেমে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে হরবিলাসবাবু চিৎকার করে উঠলেন, বন্দে মাতরম। সঙ্গে সঙ্গে স্বৰ্গছেঁড়া কাঁপিয়ে চিক্কার উঠল, বন্দে মাতরম্। চিক্কারটা থামছে না, একের পর এক ডাকের নেশায় সবাই পাগল সেইসঙ্গে শখ বাজতে লাগল। নতুন দিদিমণি ব্যাগ থেকে শখ বের করে গাল ফুলিয়ে সেই ডাকে সঙ্গে মিলিয়ে সেই শখধনি করতে করতে লাগলেন। অনি তাকিয়ে দেখল পুঁটলিটা ওপরে . উঠে গেছে। দড়িটা ধরে ঝাকুনি দিতেই চট করে সেটা খুলে গিয়ে ঝুরঝুর করে কিসব আকাশ থেকে অনির মাথার ওপর ঝরে পড়তে লাগল। অনি দেখল একরাশ ফুলের পাপড়ি ওর সমস্ত শরীর ছুঁয়ে নিচে পড়ছে আর সকালের বাতাস মেখে প্রথম সূর্যের আলো বুকে নিয়ে তিনরঙা পতাকা কী দরুণ গর্বে দোল খাচ্ছে। চারধারে হইহই চিৎকার, এ ওকে জড়িয়ে ধরছে আনন্দে, কারও কোনো কথা শোনা যাচ্ছে না। ওপরের ঐ গর্বিত পতাকার দিকে তাকিয়ে অনির মনে হল ও এখনও ছোট, পতাকাটা ওর নাগালের অনেক বাইরে।
 
সরিৎশেখর ফেয়ারওয়েল নিতে রাজি হলেন না। পনেরোই আগষ্টের দুপুরে হে সাহেব নিজে গাড়ি চালিয়ে সরিৎশেখরের কাছে এলেন। সরিৎশেখর তখন বারান্দায় বেতের চেয়ারে অনিকে নিয়ে। বসে ছিলেন। আর স্বৰ্গছেঁড়ায় অনি একটা খবর হয়ে গিয়েছে। হরবিলাসবাবু অনিকে দিয়ে প্রথম জাতীয় পতাকা তুলিয়েছেন, এই কথাটা সবার মুখে-মুখে ঘুরছে। পতাকা তোলার পর ছবি তোলা হয়েছে অনিকে সামনে রেখে। ভবানী মাস্টার বলেছেন ছবিটা বাঁধিয়ে স্কুলের বারান্দায় টাঙিয়ে রাখবেন। খবরটা শুনে সরিৎশেখর সেই যে অনিকে সঙ্গে রেখেছেন আর ছাড়তেই চাইতেন না।

হে সাহেবের বাড়ি স্কটল্যাণ্ডে। চা-বাগানের ম্যানোজারি করে গায়ের রঙটা সামান্য নষ্ট হলেও আচার-আচরণে পুরো সাহেব। গাড়ি থেকে নামতেই সরিৎশেখর উঠে দাঁড়ালেন। এই দীর্ঘ তাঁদের মধ্যে কেউ তার বিরুদ্ধে অসৌজন্যের অভিযোগ করতে পারেননি। ম্যাকফার্সন সাহেব একসময় অভিযোগ করতেন সরিৎশেখর কংগ্রেসিদের সঙ্গে বেশি মেশামেশি করছেন, হিন্দু-মুসলমান গননার সময় তিনি কংগ্রেসকে সাহায্য করেছেন, কিন্তু সেটা ছিল তাদের অন্তরঙ্গ ব্যাপার। এ নিয়ে ম্যাকফার্সন সাহেব ওপরতলায় কোনোদিন রিপোর্ট করেননি।

হ্যালো বড়বাবু! হে সাহেব হাসলেন, হেসে হাত বাড়িয়ে দিলেন। সরিৎশেখর করমর্দন করে সাহেবকে চেয়ারে বসালেন। হঠাৎ অনির ভবানী মাস্টারের কথা মনে পড়ে গেল। ইংরেজ সাহেবরা আমাদের দেশটাকে ছিড়ে শুষে নিয়ে চলে গেছে। সবাই তো যায়নি, এই হে সাহেব তো এখনও দাদুর সামনের চেয়ারে বসে হাসছেন। দাদু ওঁর সঙ্গে অমন ভালোভাবে কথা বলছে কেন? আজ তো আমরা নিজেরাই নিজেদের রাজা। বড় খারাপ লাগছিল অনির।

হে সাহেব বললেন, আমি খবর পেলাম তুমি নাকি ফেয়ারওয়েল নিতে রাজি হচ্ছ না! বাংলা বরেন সাহেব, ভাঙা-ভাঙা, তবে বেশ স্পষ্ট বোঝা যায়। কথাটা বলার সময় সাহেবের মুখ-চোখ খুব গম্ভীর দেখাল।

সরিৎশেখর হাসলেন, আমাকে তোমরা তাড়িয়ে দিতে চাইছ?

সাহেব বললেন, সে কী, একথা কেন বলছ? এই টি-এস্টেট তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। ফেয়ারওয়েল মানে কি তাড়িয়ে দেওয়া

সরিৎশেখর হাসলেন, দ্যাখো সাহেব, আমি জানি এই বাগানের সবাই আমাকে ভালোবাসে। আজ সবাই আমাকে ভালো কথা বলে উপহার দেবে এবং আমি সেগুলো নিয়ে চুপচাপ চলে যাব, ব্যাপারটা ভাবতে অস্বস্তি লাগছে।

সাহেব বললেন, কিন্তু এটাই তো প্র্যাকটিস।

খুব ধীরে ধীরে সরিৎশেখর বললেন, আজ আমাদের ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে। দুশো বছর পর তোমাদের হাত থেকে ক্ষমতা ফিরে পেয়েছি। এমন দিনে আমাকে ফেয়ারওয়েল দিও না, নিজেকে বড় অক্ষম মনে হবে। আমাকে তো বেঁচে থাকতে হবে!

হে সাহেব সরিৎশেখরের দিকে কিছুক্ষণ স্থিরচোখে তাকালেন, তারপর মাথা নিচু করলেন, আই আন্ডারস্ট্যাণ্ড। তবে আমরা তো কমন পিপল। ওয়েল, তোমার ফেয়ারওয়েলে যদি আমি না থাকি তা হলে তোমার আপত্তি আছে।

চট করে উঠে দাঁড়ালেন সরিৎশেখর, উঠে এসে হে সাহেবের হাত জড়িয়ে ধরলেন, কী বলছ সাহেব। আমি তোমাকে হেয় করতে চাইনি। তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কের মধ্যে আমি বিশ্বাস করি কোনো তিক্ততা নেই। তোমার পুর্বপুরুষ আমার পূর্বপুরুষের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল, তার জন্যে তুমি দায়ী হবে কেন? তুমি তো জান আমি অ্যাকটিভ পলিটিক্স কোনোকালে করিনি। আর আমি জানি এখন ভারতবর্ষের যাঁরা নেতা হবেন তাদের সঙ্গে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কোনো যোগাযোগ থাকবে না। তবু আজ আমাদের স্বাধীনতা দিবস-এটা একটা আলাদা ফিলিংস-আমার মনে হচ্ছে আমি যৌবনে ফিরে গিয়েছি-তুমি ফেয়ারওয়েল দিয়ে আমাকে বুড়ো করে দিও না।

হে সাহেব উঠে দাদুর একটা হাত ধরে গাড়ির দিকে হাঁটতে লাগরেন, পেছনে অনি। হে সাহেব বললেন, বাবু, এবার বোধহয় আমাকে দেশে ফিরে যেতে হবে। কোম্পানি ইণ্ডিপেণ্ডেন্ট ইন্ডিয়ায় হয়তো বিজনেস করতে চাইবে না। সো, আমাদের হয়তো আর কোনোদিন দেখা হবে না। বাট, আমি চিরকাল এই দিনগুলো মনে রাখব, আমি জানি তুমিও ভুলবে না।

দাদু কিছু বললেন না। সাহেব গাড়িতে উঠে অনির দিকে তাকালেন, তারপর হাত নেড়ে ললেন, কনগ্রাচুলেশন, আওয়ার ইয়ং হিরো!
 
গাড়িটা চলে যেতে অনি দাদুর পাশে গিয়ে দাঁড়াল। দাদুর পাশে দাঁড়ালে ওর নিজেকে ভীষণ ছোট লাগে। সরিৎশেখর নাতির কাঁধে হাত রেখে হাঁটতে লাগলেন হঠাৎ। পায়চারি করে বেড়াবার মতো ওঁরা আসাম রোডে এসে পড়লেন। অনি দেখছিল, দাদু কোনো কথা বলছেন না, মুখটা গভীর। বাড়ির সবাই ওকে খুব ভয় করে, কিন্তু অনির সঙ্গে উনি এরকম মুখ করে থাকেন না। অনেকক্ষণ থেকে সাহেব সম্পর্কে একগাদা জিজ্ঞাসা অনির মনে ছটফট করছিল। হাঁটতে হাঁটতে সে বলল, দাদু, সাহেবকে তুমি কিছু বললে না কেন?

সরিৎশেখর আনমনে বললেন, কেন, কী বলব?

অনি অবাক হল, কেন? ওরা আমাদের দেশটাকে ছিড়ে শুষে নষ্ট করে দেয়নি।

সরিৎশেখর চমকে নাতির দিকে তাকালেন, ও বাবা, তুমি এসব কথা কোথেকে শিখলে? নিশ্চয় ভবানী মাস্টার বলেছে?

ঘাড় নাড়ল অনি, হ্যাঁ, বলো না মিথ্যে কথা না সত্যি কথা?

দুদিকে মাথা দোলালেন সরিৎশেখর, মিথ্যে নয় আবার সবটা সত্যি নয়। শোননা ভাই, কেউ কাউকে নষ্ট করতে পারে না। সাহেবরা যখন এসেছিল আমরা ওদের হাতে দেশটাকে তুলে দিয়েছিলাম; ওরা নিজেদের স্বার্থে দেশটাকে ব্যবহার করবেই। কিন্তু হাতের পাঁচ আঙুল কি সমান? কেউ-কেউ তো অত্যাচারী–ও হতে পারে। যেমন ধরো এই হে সাহেব, ওরা যে আমাদের প্রভু, আমরা যে পরাধীন তা কোনোদিন ওঁর ব্যবহারে টের পাইনি। যেই আমরা স্বাধীন হলাম সব সাহেব খারাপ হয়ে গেল তা বলি কী করে?

দুপাশে বড় বড় দেওদার, শাল তাদের ডালপালা দিয়ে আকাশ ঢেকে রেখেছে, ছায়া-ছায়া পথটায় ওঁরা হাঁটছিলেন । হাঁটতে হাঁটতে সরিৎশেখর বললেন, আজ যদি তুমি কলকাতায় থাকতে তা হলে কত কী দেখতে পেতে। কত উৎসব হচ্ছে সেখানে আমরা তো এখানে কিছুই বুঝতে পারি না, আজ অবধি এই স্বৰ্গছেঁড়ায় একদিনও আন্দোলন হয়নি। এখানকার বাগানের কুলিকামিনরা স্বাধীনতা মানেই জানে না। বরং আজ যদি সাহেব চলে যায় ওরা কাঁদবে। কিন্তু কলকাতা হল এই দেশের প্রাণকেন্দ্র, আমাদের ফুসফুসের মতো। কত আন্দোলন হয়েছে সেখানে, কত মানুষ মরেছে পুলিশের গুলিতে।

কেন, মরেছে কেন? পুলিশ কেন গুলি করবে? অনি বলল।

হাসলেন সরিৎশেখর, তুমি যে-জামাটা পরে আছ, কেউ যদি সেটা চায় তুমি দিয়ে দেবে?

কেন দেব? আমার জামা আমি পরব।

কিন্তু ধরো জামাটা একদিন তার ছিল, তুমি পেয়ে গেছ বলে পরছ, তা হলে? তুমি ভাবছ এখন এটা তোমার সম্পত্তি, কিন্তু সে ফিরিয়ে নেবে বলে ঝামেলা করছে, ব্যস, লেগে যাবে লড়াই।

অনি বলল, জামাটা যদি আমার না হয় তা হলে আমি ফিরিয়ে দেব।

মাথা নাড়লেন সরিৎশেখর, সেটাই উচিত, কিন্তু বড়রা এই কথাটা বোঝে না।

অনেকক্ষণ চুপচাপ হেঁটে যাওয়ার পর অনি বলল, আমাকে কলকাতায় নিয়ে যাবে দাদু

নাতির দিকে তাকালেন সরিৎশেখর, কলকাতায় তুমি একদিন যাবেই দাদু। তবে যেদিন যাবে নিজে যাবে, কারোর সঙ্গে যেও না।

অনি বলল, কেন?

সরিৎশেখর বললেন, এখন তো তুমি ছোট, আরও বড় হও তখন বুঝবে। শুধু মনে রেখো, কলকাতায় যখন তুমি যাবে তখন যোগ্যতা নিয়ে যাবে। তোমাকে তার জন্য সাধনা করতে হবে, মন দিয়ে পড়াশুনা করতে হবে। অনেক বড় নেতা হবে তুমি-স্বাধীন দেশের মাথা-উঁচু করা নেতা।

দাদুর কথাগুলো ঠিক ঠিক বুঝতে পারছিল না অনি। তবে ভেতরে ভেতরে অদ্ভুত একটা শিহরন বোধ করছিল ও। আজ ভোরবেলায় ছুটে যেতে যেতে বন্দে মাতরম্ বলে চিৎকার করার সময় যে-ধরনের গায়ে-কাঁটা-ওঠা কাপুনি এসেছিল ওর হঠাৎ সেইরকম হল। এই নির্জন রাস্তায় দাদুর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে অনি মনেমনে চিৎকার করে যেতে লাগল, বন্দে মাতরম্।…

কখন যেন ভোর হয়ে গেল, ঝকমকে রোদ উঠল, কিন্তু স্বৰ্গছেঁড়া চা-বাগানের ফ্যাক্টরিতে আজ ভে বাজল না। কিন্তু একটি টি করে মদেসিয়া ওঁরাও মানুষের দল ঘর ছেড়ে বেরুতে লাগল। সরিৎশেখরের কোয়ার্টারের সামনে যে বিরাট মাঠটা চাপাগাছ বুকে নিয়ে রয়েছে তার এক কোণে এসে চুপচাপ বসে থাকল।

কখন যেন ভোর হয়ে গেল, : রিশেখর নিজেই টের পাননি। কদিন থেকেই রাতের বেলা এলে তার ঘুম চলে যায়। একা একা এই ঘরে জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকারে চোখ রেখে তিনি অদ্ভুত সব ছবি দেখতে পান। খোলা চোখ কখন দৃষ্টিহীন হয়ে মনের মতো করে কিছু চেহারা তৈরি করে দেখতে শুরু করে দেয়। যাবার সময় যত এগিয়ে আসছে তত এটা বাড়ছে, চোখ তত সাদা হয়ে থাকছে। চূড়ান্তা হয়ে গেল আজ রাতটায়। কাল যে খাওয়াদাওয়া চুকে গেলে শুয়েছেন বিছানায়, এই নোদওঠা সময় অবধি ঘুমই এল না।
 
কান্নাকাটির ধাত সরিৎশেখরের কোনোকালেই ছিল না। বরং খুব কঠোর বা নিষ্ঠুর বলে একটা কুখ্যাতি ছিল ওঁর সম্বন্ধে। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে স্বৰ্গছেড়ছেড়ে চলে যাবার সময় এরকম কে হচ্ছে। সারাটা জীবন এখানে কাটিয়ে নতুন জায়গায় যাহার অস্বস্তিতে নতুন জায়গায় যে তিনি নিজেই চেয়েছিলেন, কর্মহীন হয়ে এই স্বৰ্গছেঁড়ায় থাকতে কিছুতেই চান না তিনি। তা হলো কাল রাত্রে এটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখলেন উনি। উঠোনের লিচুগাছটার মাথায় অন্ধকার জমে গিয়ে ঠিক বড়বউ এর পেছন ফিরে চুল খুলে দাঁড়াবার মূর্তি হয়ে গিয়েছে। চমকে গিয়েছিলেন তিনি। সে কত বছর আগের কথা। বড়বউ-এর মুখটা এখন আর মনে পড়ে না। চোখ ভাবতে গেলে চিবুকের ডোলাটা হারিয়ে যায়, নাকটা খুব টিকলো ছিল না মনে আছে, কিন্তু সব মিলিয়ে পুরো মুখটা যে কিছুতেই মনে পড়ে না। অনির মুখের দিকে তাকালে হঠাৎ-হঠাৎ বড়বউ-এর মুখটা চলকে ওঠে। মহীতোষ বড়বউ-এর ছেলে, কিন্তু মায়ের কোনো ছায়া ওর মধ্যে নেই। আবার মহীতোষের ছেলেকে দেখে সরিৎশেখরের কেন যে বড়বউ-এর কথা মনে আসে কে জানে! তা সেই অস্পষ্ট হয়ে-যা বড়বউকে কাল রাত্রে অন্ধকারমাখা লিচুগাছটা ঠিক আস্ত ফিরিয়ে এনে দিল। রাত্রে শোবার আগে হারিকেনের দিকে তাকিয়ে চুল আঁচড়াত বড়বউ। পিছন থেকে সরিৎশেখর তার মুখ দেখতে পেতেন না, চুঁইয়ে-আসা আলো খোলা চুলের ধারগুলোয় গুটিসুটি মেরে থাকত। ঠিক সেইরকম হয়েছিল কাল রাতে লিচুগাছটার।

কিন্তু বড়বউকে নিয়ে কিছু ভাবতে গেলেই যা হয় তা-ই হয়েছিল। হুড়মুড় করে ছোটবউ এসে যায়। ছোটবউ একদম স্পষ্ট। কুড়ি বছর আগের সেই ছটফটে চেহারা বড়বউ-এর ঠাণ্ডা এবং অস্পষ্ট চেহারাকে লহমায় মুছে দেয়। বড় বউ-এর সময় ছবি তোলা সম্ভব হয়নি। স্বৰ্গছোড়ায় ফটোর দোকান ছিল না। ছোটবউ-এর সময় সরিৎশেখর নিজে বইপত্তর পড়ে ছবি তোলা এবং তার ওয়াশপ্রিন্টিং শিখে নিয়েছিলেন। এখন এই কোয়ার্টারের দেওয়ালে ছোটবউ-এর মুখ ফ্রেমে বাধানো হয়ে অন্তত তিন জায়গায় রয়েছে। ছোটবউ দপদপিয়ে চলাফেরা করত, তাই যখন সে চলে গেল সরিৎশেখর বুকের গভীরে দগদগে ঘা তৈরি হয়ে গেল। বড়বউ কখন এল কখন গেল, কোনো অনুভূতি তৈরি হল না। কিন্তু কাল সারারাত ধরে এই দুটি বিপরীত চরিত্রের মেয়ে বারবার নিজেদের স্বভাব নিয়ে সরিৎশেখরের কাছে ফিরে ফিরে এসেছে। স্বৰ্গছেঁড়ার এই বাড়ির চৌহদ্দিতে যাদের অস্তিত্ব সীমায়িত তারা সরিৎশেখরকে এই যাবার আগে রাতে শেষবারের জন্য ঘুমোতে দিল না।।

কখন যেন ভোর হয়ে গেল, বাতাবিলেবু গাছটায় বসে একটা দাঁড়কাক কেমন করুণ গলায় ডাক শুরু করে দিল, জানলার তার গলে বিছানায় সকালে রোদ আলোছায়ায় নকশা কাটা শুরু করে দিল অনি টের পায়নি। কাল রাত্রে মায়ের কাছে শুয়ে অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখেছিল ও। আজ এই সকালে স্বপ্নটা যেন তাকে ছেড়ে যেতে চাইছে না। স্বপ্নটার কথা মনে হতেই ও আর-একবার ঝালিশে মুখ খুঁজে কেঁদে নিল। কাল রাতে মায়ের পাশে শুয়ে শুয়ে সেই মিষ্টি গন্ধটা পেতেই বুকটা কেমন করে উঠেছিল। আজ শেষ রাত, কাল থেকে আর মাকে এমন করে পাব না, এই বোধটা যত বাড়তে লাগল তত চোখ ভারী হয়ে উঠছিল। শেষে ছেলের কান্না শুনে মাধুরী ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কী হল? অনি অনেকক্ষণ কোনো জবাব দেয়নি। মাধুরী, অনেক বুঝিয়েছিলেন, কী হল? অনি অনেকক্ষণ কোনো জবাব দেয়নি। মাধুরী অনেক বুঝিয়েছিলেন। অনিকে অনেক বড় হতে হবে, লেখাপড়া শিখতে হবে। এখানে স্বৰ্গছেঁড়ায় তো ভালো স্কুল নেই। প্রত্যেক ছুটিতে অনি যখন এখানে আসবে তখন নুতন নতুন গল্প শুনবেন মাধুরী ওর কাছে। অনি যখন বলল, তোমাকে ছেড়ে আমি কী করে থাকব মা, তখন মাধুরীর গলাটা একদম পালটে গেল, আমি তো সবসময় তার সঙ্গে আছি রে বোকা! অনি হঠাৎ টের পেল ওর বুকের কান্নাটা মায়ের বুকের ভেতর চলে গেছে। আর একটু হলেই মা অনির মতো কেঁদে ফেলবে। খুব শক্ত হয়ে গেল অনির শরীর। টানটান করে সিটিয়ে শুয়ে রইল। মাকে কষ্ট দিলে মহাপাপ হয়, পিসিমা বলছে। তারপর সেইভাবে শুয়ে থেকে কখন যে ঘুম এসে গেল ও জানে না। কে যেন তার হাত ধরে হাঁটতে লাগল, তার মুখ সে দেখতে পাচ্ছে না। ক্রমশ তার শরীর বড় হয়ে যেতে লাগল। সে দেখল অনেকেই তার মতো হাঁটছে, অজস্র লোক। যে-লোকটার সঙ্গে ও যাচ্ছিল সে বলল আগে যেতে হবে, সবার আগে যেতে হবে। অনির মনে হল সবাই এক কথাই ভাবছে। অনি দৌড়াতে লাগল। অনেকে পড়ে যাচ্ছে, আবার উঠছে। হঠাৎ অনি দেখল ওর সামনে কেউ নেই, পেছনে হাজার হাজার লোক। কে যেন ফিসফিসিয়ে বলল, গলা খুলে চ্যাঁচাও। ও দেখল ভবনী মাস্টার ওর পেছনে। অনি সমস্ত শরীর নেড়ে ডাক দিল, বন্দে মাতরম্। কানের পর্দা ফেটে যাবার উপক্রম হল সেই ডাকের সাড়ায়। এইভাবে এগোতে এগোতে অনি থমকে দাঁড়াল। সামনেই একটা খাদ, তার তলা দেখা যাচ্ছে না। খাদের কাছে বুকে অনি বলল, বন্দে মাতরম্। সঙ্গে সঙ্গে নিচ থেকে একটা গমগমে গলা বলে উঠল, মানে কি অনি মানেটা খুঁজতে গিয়ে শুনল নিচ থেকে যে যেন বলছে, বোকা ছেলে, আমার কাছে আয়। অনি অবাক হয়ে দেখল অনেক নিচে মায়ের মুখ, ওর দিকে তাকিয়ে হাসছেন। অনির ঘুম ভেঙে গেল।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top