What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected উত্তরাধিকার - সমরেশ মজুমদার (2 Viewers)

এখন সরিৎশেখর একা একমনে দাবা খেলছেন। সম্প্রতি দাত বাধিয়েছেন তিনি। বাঁদিকের টেবিলে একটা পেয়ালার জলে ডুবে ওঁর খোলা দাঁত হাসছে। তোবড়ানো গাল দেখতে দেখতে অনির মনের হল ছোটবাবুর সঙ্গে দাদুর মুখের এখন কী ভীষণ মিল! হঠাৎ কী হল, অনি দৌড়ে ভিতরে চলে এল। আর ঠিক তখন দূরে ফ্যাক্টরিতে আটটার ভো বেজে উঠল। ঝাড়িকাকু খবর এনেছিল আটটায় নদী বন্ধ হবে।

রান্নাঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে মা বললেন, অনি, হাওয়া দিচ্ছে খুব, চটি পরে গলায় মাফলার জড়িয়ে যাও।

তর সইছিল না অনির!একটু একটু ঠাণ্ডা বাতাস বইছে বটে তবে তার জন্যে মাফলার পরার দরকার হয় না। মায়ের সবতাতেই বাড়াবাড়ি। অবশ্য ওর টনসিলের ধাত আছে একটু, ডাক্তারবাবু ঠাণ্ডা কিছু খেতে নিষেধ করেছেন। তাই বলে এই হাওয়ায় আর কী হবে! এপাশের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ও মায়ের দিকে তাকাল। বারান্দার সিলিং থেকে ঝোলানো শিকে রাখা হারিকেনের আলোয় মাকে কেমন দেখাচ্ছে। লাল শাড়ি পরেছে মা। কাপড়টা যেন সব আলো শুয়ে নিচ্ছে এখন। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে অনির বুকের ভিতর কেমন করে উঠল। আস্তে আস্তে ও ভিতরের ঘরে ঢুকে আলনা থেকে মাফলারটা টেনে গলায় জড়িয়ে নিন।

ঝাড়িকাকু একটা খালুই-হাতে উঠোনে দাড়িয়ে ছিল। শীত-ফিত বেশি লাগে না ওর। পূজোর পর থেকে একটা মালোয়নি ফতুয়ার ওপর জড়িয়ে নেয়। এখন যে-কে সেই। তাড়াতাড়ি চল। ঝাড়িকাকু ডাকল।

উঠোনে নেমে এল অনি। পিসিমার গলা পেল ও। নিজের ছোট ঘরে বসে এতক্ষণ পুজো করছিলেন, এইবার গুরুদেব দয়া করে দীনজনে বলে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর অনিকে দেখতে পেয়ে বলে উঠলেন, তাড়াতাড়ি চলে আসিস বাবা, যা পচা শরীর তোর! ঝাড়িটারও খেয়েদের কাজ নেই, ছেলেটাকে নাচাল।

ঝাড়িকাকু কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই অনি নেমে গেছে উঠোনে। ঝাড়িকাকু কী বিড়বিড় করে টর্চের আলো জ্বালাল। ছোট্ট টর্চ। প্রায়ই বিগড়োয়। ফ্যাকাশে আলো পড়েছে মাটিতে। আকাশ মেঘলা বলেই অন্ধকার বেশি লাগছে। এমনকি সামনের গোয়ালঘর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। ওরা হাঁটতে লাগল। একটু ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। অনিকাড়িকাকুর পিছনে যেতে-যেতে হঠাৎ হাত বাড়িয়ে ওর ফতুয়ার কোণটা চেপে ধরল। এরকম অন্ধকারে এর আগে কোনোদিন হাঁটেনি ও।

গোয়ালঘরের পেছনে লম্বা গাছগুলোর তলা দিয়ে যেতে-যেতে ওরা চিৎকার শুনতে পেল। দ্রুত পা চালাচ্ছিল ঝাড়িকাকু। প্রায় ছুটতে ছুটতে ওরা আঙরাসার পাড়ে এসে দাঁড়াল। আর দাঁড়াতেই একটা লুত দৃশ্য চোখে পড়ল অনির। পুরো নদীটা জুড়ে যতদূর দেখা যায়, সেই ধোপার ঘাট পর্যন্ত, অস্ত্র হারিকেন আর টর্চের আলো জোনাকির মতো নাচছে। আচমকা দেখলে মনে হয় যেন দেওয়ালির রাতটাকে কে উপুড় করে দিয়েছে নদীতে। সমস্ত কুলিলাইন ভেঙে পড়েছে এখানে। আঙরাভাসার দিকে তাকিয়ে কেমন বিশ্রী লাগল অনির। জল এখন পায়ের তলায়। কাপড়কাচা পাথরটা ভেজা মুড়ির ওপর পড়ে আছে। জল মাঝখানে। তাও কমে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। লাফ দিয়ে নেমে পড়ল ঝাড়িকাকু। একটি বিরাট লম্বা বানমাছ ঠিক সামনেটায় খলবল করছিল। একটা মদেসিয়া মেয়ে মাছটার দিকে এগোবার আগেই ঝাড়িকাকু বা হাতে সেটাকে তুলে খাইতে ঢুকিয়ে নিল। মেয়েটা চিৎকার করে গাল দিয়ে উঠল। হাত বাড়িয়ে ওকে ডাকল ঝাড়িকাকু। অনি ভেজা নুড়ির ওপর সাবধানে হেঁটে এল। পায়ের কাছে একটা পাথরঠোকা মাছ জল না পেয়ে লাফাচ্ছে। দুই-তিনবারের চেষ্টায় ওটাকে ধরে অনি ঝড়িকাকুর খালুইতে ফেলে দিল।
 
তোর তো রবারের চটি জল লাগলে কিছু হবে না তুই টর্চটা ধর। যেখানে ফেলতে বলব সোজা করে আলো ফেলবি। হাত বাড়িয়ে টর্চটা দিল ঝাড়িকাকু। জল এখন নেমে গেছে পুরোপুরি। শ্যাওলা আর ভাঙা ডালপালা নদীর বুকে ছড়িয়ে আছে এখন। মাঝে-মাঝে কাদা জমেছে। স্রোতের সময় কাদা দেখা যায় না। অজস্র পোকামাকড় উঠছে এখন। এরা সব কোথায় ছিল কে জানে! তিনটি মেয়ে দল । বেঁধে হাতে কুপি জ্বেলে মাছ খুঁজছে। অনি দেখল ওরা খুব হিহি করে হাসছে। আলো পড়ে ওদের কালো শরীর চকচক করছে। কাড়িকাকুকে খেপাচ্ছে ওরা। একটা গর্তের মুখে টর্চ ফেলতে বলল ঝাড়িকাকু। নদীর কিনারে চ্যাপটা পাথরের গা-ঘেঁষে গর্তের মুখে। আলো ফেলে অনি দেবল তিনচারটে মোটা মোটা পা গর্তের মুখে বেরিয়ে আছে। পকেট থেকে একটা শক্ত সুতো বের করে তার ডগায় একটু শ্যাওলা বাঁধলো ঝাড়িকাকু। তারপর টানটান করে সুতো ধরে শ্যাওলাটাকে গর্তের মুখে নাচিয়ে নাচিয়ে ভিতরে ঢোকাবার চেষ্টা করতে লাগল। অনি দেখল চট করে পাগুলো ভিতরে ঢুকে গেল! গর্তের মধ্যে জমা জলে একটু বুদ্বুদ উঠল। আলোটা নিবিয়ে দিল অনি। যাঃ, চলে গেল। কিন্তু ঝাড়িকাকু চাপাগলায় বলল, আঃ, নেলি কেন? আবার আলো জ্বালাল অনি। চাপা নিশ্বাসের শব্দ কানে যেতে অনি দেখল মেয়ে তিনটে পেছনে এসে দাঁড়িয়ে কৌতূহলী চোখে ব্যাপারটা দেখছে। ঝাড়িকাকুও ওদের দেখেছে, কিন্তু এখন তার মনোযোগ গর্তের দিকে। গর্তের মুখটাতে শ্যাওলাটাকে নাচাচ্ছে একমনে। হাত টনটন করতে লাগল অনির। মুখ ঘুরিয়ে ও নদীর চারপাশে তাকাল। আজ রাতে আর নদীতে কোনো মাছ পড়ে থাকবে না। লণ্ঠন কুপি আর টর্চের আলোয় নদীটা পরিস্কার। হঠাৎ তিনটে মেয়ে একসঙ্গে হাততালি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠতেই অনি চট করে মুখ ফেরাল। ঝাড়িকাকু একগাল হেসে হাতটা মাথার ওপরে তুলে ধরেছে। আর সুতোর শেষে মাটি থেকে ওপরে একটা বিরাট কাঁকড়া খলবল করে ঝুলছে। শেষ পর্যন্ত সেটা সুতো ছেড়ে পাথরের নুড়ির ওপর পড়তেই ঝাড়িকাকু খাইটা ওর ওপর চেপে ধরল। তারপর অতি সন্তর্পণে খালুই-এর তলা দিয়ে বেরিয়ে আসা মোটা দাড় দুটো ধরে কাঁকড়াটাকে বের করে আনল। টর্চের আলোয় কুচকুচে কালো কাঁকড়াটাকে মুদৃষ্টিতে দেখল অনি। অত বড় কাঁকড়া এর আগে কখনো দেখেনি সে। দুটো গোল গোল চোখ ঘুরিয়ে অনিকে দেখছে ওটা। খালুই-এর ভিতরে টপ করে ফেলে দিল ঝাড়িকাকু। কাঁকড়াটাকে ফেলে দিয়ে সেই হাতে পাশে দাঁড়ানো তিনটে মেয়ের একটার চিবুকে টোকা দিয়ে দিল। টর্চের আলোটা সম্মোহিতের মতো ঘুরিয়েছিল অনি। ফ্যাকাশে আলোটা মেয়েটির মুখে পড়তেই ও দেখল কেমন থতমত হয়ে গেল মেয়েটি। সঙ্গীরা খিলখিল করে হেসে উঠতেই ও লাজুক লাজুক মুখ করে মাথা নামাল।



আধঘন্টার মধ্যেই খাই ভরতি হয়ে গেল। বান, কাঁকড়া, পাথরঠোকা, চিংড়ি আর পেটমোটা পুঁটি এরকম কত মাছ। ঝাড়িকাকু বলল, তুই এখানে দাঁড়া, আমি মাছগুলো বাড়িতে রেখে আসি। হঠাৎ অনির কেমন ভয়-ভয় করতে লাগল। এই অন্ধকারে যদিও নদীতে প্রচুর মদেসিয়া আলো জ্বেলে ঘুরছে, তবু ওর শরীর শিরশির করতে লাগল। আবছা আলো-অন্ধকারে মানুষগুলোর মুখ স্পষ্ট করে চেনা যাচ্ছে না, কেমন রহস্যময় দেখাচ্ছে চারপাশ। ওরা ওদের ঘাটে কাপড়কাচা পাথরটার ওপর ফিরে এল। অনির পায়ের গোড়ালি অবধি কাধা মাখা, রবারের চটি চপচপ কমছে। ঝাড়িকাকুর ফতুয়া ধরে ও পাড়ের দিকে তাকাল। ফুলগাছ ডুমুরগাছ আর বুনো ফুলের গাছগুলোর মধ্যে চুপচাপ যেঅন্ধকার জমে আছে সেদিকে চেয়ে ওর বুকের মধ্যে তিরতির করে উঠল। হঠাৎ একটা লম্বা মর্তি সেই অন্ধকার জমে আছে সেদিকে চেয়ে ওর বুকের মধ্যে তিরতির করে উঠল। হঠাৎ একটা সশ্ব মৃতি সেই অন্ধকারে চলে গেল, পেছন পেছন আর-একজন শাড়ি-পরা। মুখ দেখতে পেল না ও। মূর্তি সেই অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। কারা ওরা? এটা তো ওদের দিকের পাড়। মদেসিয়ারা এখন নিশ্চয়ই এদিকে আসবে না। ফিসফিস করে ও বলল-কাড়িকাকু মুখ ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকাল ঝাড়িকাকু। কাঁচাপাকা সাতদিন না-কমানো দাড়ি, হাফপ্যান্ট আর ফতুয়া পরা বেঁটেখাটো এই মানুষটাকে অনির এখন খুব আপন মনে হচ্ছিল। এক হাতে ওকে জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে ঝাড়িকাকু বলল, কী হয়েছে?

ওরা কারা? ফিসফিস করে বলল অনি। ভালো করে অন্ধকারে চোখ বুলিয়েও কিছু ঠাওর করতে পারল না ঝাড়িকাকু। অনির হাত থেকে টর্চ নিয়ে অন্ধকারে আলো ফেলল ও। ফ্যাকাশে আলো দূরে গেল না।

কী দেখছিস? ঝাড়িকাকু জিজ্ঞাসা করল।

একজন, তারপর আর-একজন। কারো মাথা নেই। অনি প্রায় কেঁদে ফেলে আর কি।

ও কিছু না, কাড়িকাকু মাথা নাড়ল, রামনাম বল। ওরা হলে চলে যাবেন। মাছ বড় ভালোবাসেন তো।.বলতে বলতে খালুইসুদ্ধ হাত জোড়া করে নমস্কার করল। অনি মনে মনে রাম রাম বলতে শুরু করে দিল এবার। এখানে এই নদীতে এত লোক, তবু সাহস হচ্ছে না কেন?
 
ঠাণ্ডা বাতাস যা এতক্ষণ বইছিল এলোমেলো, হঠাৎ গাছের পাতা নাচিয়ে দিল এবার।–ঘুমুতে-পারা পাখিগুলো নির্জন নদীতীরে হঠাৎ-আসা একদল মানুষের চিৎকারে কিচিমিচির করছিল এতক্ষণ, ডালপালা নড়ে উঠতেই ডানা ঝাপটাতে লাগল। হিমবাতাস নদীর মধ্যে নেমে একটা শোশে শব্দ তুলে চিরুনির মতো গাছপালার ফাক গলে কোথায় উধাও হয়ে যাচ্ছিল। পুলওভার থাকা সত্ত্বেও অনির শীতবোধ হল।

ঝাড়িকাকু বলল, ডাক্তারবাবুর ছেলে হরিশ বড় মাছ খেতে ভালোবাসত। ঝাড়িকাকুর মুখর দিকে তাকাল অনি। অন্ধকার কালির মতো লেপটে আছে। ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না। ডাক্তারবাবুকে অনি ভালো করেই চেনে। ডাক্তারবাবু আর দিদিমা, ওদের বাড়িতে কোনো ছেলেমেয়ে নেই। তা হলে কার কথা বলছে ঝাড়িকাকু! কে হরিশ! এই নামের কাউকে চেনে না তো ও!

হরিশ কে আমি দেখিনি তো! অনি বলল।

তুই দেখবি কী করে? হাসল ঝাড়িকাকু, তুই তো এই সেদিন হলি। তোর বাবার চেয়ে বছর তিনের ছোট ছিল হরিশ। সেই যেবার ডুডুয়া নদীতে যখন খুব জল বেড়ে গেল, রাস্তার ওপর জল উঠে বাস বন্ধ হল, সেবার এই কুলগাছের মাথা থেকে ধুপ করে পড়ে গেল ছোঁড়াটা। খুব ডানৰ্পিটে ছিল তো! আমি তখন এই ঘাটে বসে বাসন মাজছি। কাজ শেষ করে বাসন মাজতে তিনটে চারটে বেজে যেত। ভরদুপুরবেলা বাসন মাজছি বসে, হঠাৎ হরিশ এল। গাছটায় কুল হত তখন, পাতা যেখা। যেত না। তা হরিশ তলার ডালের ফুলগুলো শেষ করে দিয়েছিল পাকার আগেই। হরিশ লাফ দিয়ে তরতর করে মগডালে চলে গিয়ে হাত বাড়িয়ে ল ছিড়ে অর্ধেক খেয়ে আমাকে ঢিল মারছিল। ডাক্তারবাবুর ছেলে আমি কী বলব বল। ঐ মগডালে বসে বসে ও আমাকে বলল, ভুডুয়াতে জল কমে গেলে বানমাছ মারতে গেলে কেমন হয়? বানমাছ ধরার বঁড়শি আমার কাছে ছিল হরিশ জানত। কর্তাবাবু কত রকমের সুতো আর বঁড়শি শহর থেকে পোষ্ট অফিস দিয়ে আনাতেন। আমি দুটো বঁড়শি চেয়ে নিয়েছিলাম। মুশকিল হত বানমাছ বড়দি রান্না করতে চাইত না কিছুতেই। ধরলে খাব কী করে? হরিশের মা রান্না করে ভালো। বড়দি বলত, ঢাকার মেয়ে তো, তাই পারে। আমি একদনি খেয়েছিলাম, বড় ঝাল! তা আমি বললাম, বউদি যদি যেতে দেয় যাব। কথাটা বলে ফোস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে অন্ধকারে দাঁড়ানো কুলগাছটার দিকে তাকাল ঝাড়িকাকু।

পিসিমাকে বড়দি ঝাড়িকাকু। বাবা ছোটকাকরাও বড়দি বলে। এই সেদিন আগে পর্যন্ত শুনে শুনে অনিও বলত বড়দিপিসি। তখন কি ছোট ঠাকুমা ছিল না? না সেই কুমড়ো নিয়ে দেশের বাড়িতে গিয়েছিল বলে মরে গিয়েছিল। মা তখন ছিল না এটা বুঝতে পারছে অনি। পিসিমা বলেন, বিশ বছর বয়সে বাবার বিয়ে হয়েছিল। বাবা যখন কুল খেত তখন নিশ্চয় ছোট ছিল। অনি বলল, তারপর?

কথা বলার সময় ঝাড়িকাকুর একটা পিতনে বাধানো দাত দেখতে পাওয়া যায়। রোজ ই দিয়ে দাঁত মাজে বলে চকচক করে। বাড়িকাকু বলল, বাসন মাজতে মাজতে হঠাৎ শুনতে পেলাম বুকফাটা চিল্কার। চমকে উঠে দাড়িয়ে দেখি হরিশ পড়ে যাচ্ছে। অত উঁচু ডাল ভেঙে পড়ে যাচ্ছে হরিশ, আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম। পড়ে গিয়ে কেমন দলা পাকিয়ে গেল ও। আমি চিৎকার করে সবাইকে ডেকে আনলাম। ডাভারবার দুপুরে খেতে এসেছিলেন। চিৎকার শুনে ছুটে এলেন। সাহেবের গাড়ি করে, জলপাইগুড়ি নিয়ে গেল যদি বাঁচানো যায়, পাগলের মতো সবাই ছুটল ওকে নিয়ে। ভুডুয়ার জল বেড়েছে সকাল থেকে রাস্তার ওপরে জল, এত জল আগে কখনো হয়নি। সন্ধেবেলা মড়া নিয়ে ফিরে এল ওরা, যেতে পারেনি। তা হরিশ চলে যাবার তিনদিন পরই ঘটে গেল ব্যাপারটা। তখন কর্তাবাবু লোক দিয়ে এই ঘাটে খড়ের ছাউনি করে দিয়েছিলেন। বৃষ্টিবাদলায় ভিজতে হবে না বলে। সেদিন রাত্তিরে খাওয়াদাওয়া হয়ে গেলে বাসনগুলো নিয়ে এসেছিলাম মেজে ফেলতে। চাঁদের রাত হলে রাত্রেই বাসন মাজতাম। রাত হয়ে গেলে নদীতে কেউ আসে না। কিন্তু আমার ভয়টয় করত না। বাসন মাজা হয়ে গেলে উঠে দাঁড়িয়েছি, হঠাৎ শুনি মাথার উপর খড়ের চালে মচমচ শব্দ হচ্ছে। এঘাটের ওপর তো কোনো গাছপালা নেই, ব্যাপারটা কী দেখবার জন্য মুখ বাড়িয়েছে তো আমার শরীর ঠাণ্ডা। হরিশ বাঁশের চালায় পা ঝুলিয়ে বসে হাসছে। আমায় দেখে বলল, কী মাছের কাঁটা ফেললি রে নদীতে, কালবোস? আমায় দিবি? কেমন খোনা-খোনা শব্দ। কিন্তু একদম হরিশ। আমি একছুটে বাড়ি এসে বড়দিকে বললাম। বাসন-টাসন সব রইল নদীর পাড়ে। বড়দি তক্ষুনি এক প্লেট ভাজা মাছ আমাকে দিয়ে বলল ঘাটে রেখে আসতে। আমি রাম রাম বলতে বলতে মাছ নিয়ে আবার এসে এখানে রেখে দৌড়ে ফিলে গেলাম। বাসন নেবার কথা মনে নেই। আর চালার দিকেও তাকাইনি। পরদিন সকালে দেখি বাসনগুলো তেমনই আছে, প্লেটটাও, শুধু মাছগুলো নেই। তারপর থেকে যদ্দিন ডাক্তারবাবু পিণ্ডি দেননি ততদিন ওর মা ওর জন্যে এক প্লেট মাছ নদীর ধারে রেখে যেত। আমি অবশ্য আর সন্ধের পর এখানে আসিনি। অনেকে জড়িয়ে ধরে টর্চ জ্বেলে হাঁটতে লাগল ঝাড়িকাকু, নে চল।।
 
এতক্ষণ হাওয়া দিচ্ছিল, এখন টুপটুপ করে কয়েক ফোঁটা পড়ল। তাড়াতাড়ি পা চালা। ঝাড়িকাকু বেশ দ্রুত হাঁটছিল। দুপাশে অন্ধকার রেখে ফ্যাকাশে আলোর বৃত্তে পা ফেলে ওরা এগিয়ে আসছিল। এখন চারপাশে শুধু বাতাসের শব্দ ছাড়া কিছু নেই। অবশ্য ঝাড়িকাকুর হাতে খাইতে বড় কাঁকড়াটা ভীষণ শব্দ করছে। ওরা গোয়ালঘরের পাশ দিয়ে আসতে হঠাৎ কালীগাই-এর গম্ভীর গলার ডাক নতে পেল। যেন পরিচিত কেউ যাচ্ছে বুঝতে পেরেছে ও। জিভ দিয়ে একটা শব্দ করে সাড়া দিল কাড়িকাকু। অনির মনে হচ্ছিল, এখন যে-কোনো মুহূর্তেই হরিশ ওদের সামনে এসে হাত বাড়িয়ে মাছ চাইতে পারে। আর ঠিক তখনি অন্ধকারে একটা আকন্দগাছের পাশে দুটো মূর্তিকে নড়ে উঠতে দেখে অনি দুহাতে শাড়িকাকুকে জড়িয়ে ধরল। ঝাড়িকাকুও দেখতে পেয়েছিল ওদের। খানিকক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে থেকে মাথা দোলাল একবার। তারপর অনির হাত ধরে সোজা হেঁটে খিড়কিদরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে বলল, তোর যা ভয়, ও তো প্রিয়। চমকে গেল অনি। প্রিয়? মানে কাক কাকু এত রাত্রে ঐ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কী করছে? সঙ্গে শাড়ি-পরা মেয়েটা কে? চট করে নদীর পাড়ে দেখা দুটো মূর্তির কথা মনে পড়ে গেল ওর। অন্ধকারে মনে হয়েছিল যাদের মাথা নেই। তাহলে ঝাড়িকাকু আর একটা মেয়ে নদীর পাড়ে গিয়েছিল মাছধরা দেখতে মেয়েটা কে জানতে খুব ইচ্ছে হচ্ছিল অনির।

উঠোনে ওদের দেকেই মা আর পিসিমা একসঙ্গে বকাঝকা শুরু করলেন। পিসিমা বকছিলেন ঝাড়িকাকুকে, কেন এতক্ষণ ও অনিকে নিয়ে নদীতে ছিল, আর মা অনিকে। অনি যখন টিউবওয়েলের জলে পা ধুচ্ছে ঠিক তখন নদীর মধ্যে প্রচণ্ড শোরগোল হচ্ছে শুনতে পেল। কারা ভয় পেয়ে উত্তেজনায় চিৎকার করছে। একবার ফিরে তাকিয়ে ঝাড়িকাকু আবার ছুটে গেল অন্ধকারে টর্চ জ্বেলে। কী হয়েছে জানতে ওরা উঠোনে এসে দাঁড়াল। উঠোনের এখানটায় অন্ধকার তেন নেই। শিকে টাঙানো হারিকেনের আলো অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। ঝাড়িকাকু চলে যেতে ওরা দেখল তিনচারটে লণ্ঠন গোয়ালঘরের পিছনদিকে ছুটে ডাক্তারবাবুরকোয়ার্টারের দিকে চলে গেল।

এমন সময় প্রিয়তোষ খিড়িকিদরজা খুলে ভিতরে এল। পিসিমা জিজ্ঞাসা করলেন, কি হয়েছে রে?

কী জানি! প্রিয়তোষ হাঁটতে হাঁটতে বলল।

তুই কোথায় ছিলি? পিসিমা আবার জিজ্ঞাসা করলেন।

চটপট পা চালিয়ে কাকু ততক্ষণে ভিতরে চলে গিয়েছে। অনি দেখল থমথমে-মুখে পিসিমা মায়ের দিকে তাকালেন। মা চোখাচোখি হতেই মুখ নামিয়ে নিলেন। পিসিমা মনে মনে বিড় বিড় করে বললেন, বড় বেড়ে যাচ্ছে, বাবা ওনলে রক্তে রাখবে না।

একটু বাদেই ঝাড়িকাকু ফিরে এল হাঁপাতে হাঁপাতে। ওর কাছে শোনা গেল ব্যাপারটা। মাছ ধরার নেশায় সবাই নেমে পড়েছে নদীতে। তা ঐ লাইনের বংশী, বয়স হয়েছে বলে চোখে ভালো করে দেখে না, পা দিয়ে দিয়ে কাদা সরিয়ে পাকাল মাছ খুঁজছিল। কয়েকটা মাছ ধরে নেশাটা বেশ জমে গিয়েছিল ওর। হাড়িয়া খেয়েছে আজ সন্ধে থেকে। হঠাৎ একটা লম্বা মোটা জিনিসকে চলতে দেকে মাছ ভেবে কোমরে হাত দিতেই ঘুরে দাঁড়িয়ে সেটা ছোবল মেরেছে হাতে। নেশার ঘোরে ওর কোমর ছাড়েনি বংশী। সাপটা দু-তিনটে ছোবল মারার পর খেয়াল হতেই চিৎকার করে কেঁদে উঠছে। ততক্ষণে সাপটা অন্ধকারে লুকিয়ে পড়েছে ছাড়া পেয়ে। এখন কেউ বলছে সাপটা নিশ্চয়ই জলটোড়া, বিষফিষ নেই। কেউ বলছে, ছোবল মেরেছে যখন তখন নিশ্চয়ই গোখরো। বংশী বলছে, সাপটার রঙ ছিল কুচকুচে কালো। তা নেশার চোখ বলে কথাটা কেউ ধরছে না। হাতে দু-তিনটে দড়ি বাধা হয়ে গেছে। হাঁটতে পারছে না বংশী। ডাক্তারবাবুকে আনতে লোক গেছে কোয়ার্টারে।

ব্যাপারটা শুনে পিসিমা বললেন, জয়গুরু। বলে অনির চিবুকে হাত দিয়ে চুমু খেয়ে নিলেন, তখন বলেছিলেন নদীতে নিয়ে যাস না ঝাড়ি, যদি এই ছেলের কিছু হত-তুমি কালই সোয়া পাঁচআনার পুজো দিয়ে দিও মাধুরী।
 
এমন সময় জুতোর আওয়াজ উঠল ভিতরের ঘরে। ঝাড়িকাকু সুড় করে রান্নাঘরে চলে গেল। মা হাত বাড়িয়ে মাথার ঘোমটা টেনে দিলেন। সরিৎশেখর এসে বারান্দায় দাঁড়ালেন। বাড়িতে বিদ্যাসাগরি চটি পরেন, আওয়াজ হয়। অনিকে বললেন, হ্যা রে, ভবানী মাস্টার এসেছিল একটু আগে, কাল তোর স্কুলে পরীক্ষা?

পিসিমা বললেন, ও তো আর ওই স্কুলে পড়ছে না, পরীক্ষা দিয়ে কী হবে?

সরিৎশেখর বললেন, তা হোক, কাল পরীক্ষা দিতে যাবে ও। বলে আর দাঁড়ালেন না।

এই সময় কান্নার রোল উঠল নদীর ধারে। অনিকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে পিসিমা বললেন, কালই পাঁচসিকের পুজো দিও মাধুরী।।

শেষ পর্যন্ত রাত্রিবেলায় বৃষ্টি নামল।

খানিক আগেই ওদের খাওয়াদাওয়া হয়ে গিয়েছে। দাদুর সঙ্গে বসে খাওয়া অনির অভ্যেস। খেতে খেতে দাদু বলেছিলেন, আজ ঢালবে, তোমরা তাড়াতাড়ি কাজকর্ম চুকিয়ে নাও। দাদুর খাওয়ার সময় হাতপাখা নিয়ে পিসিমা সামনে বসে থাকেন। গরমকালে তো বটেই, শীতকালেও এরকমটা দেখেছে অনি। হাতপাখা ছাড়া দাদুর খাওয়ার সময় পিসিমার বসা মানায় না। কাজ-করা উঁচু চওড়া পিড়িতে বসে সরিৎশেখর খান, পাশেই ছোট মাপের পিড়িতে অনি। আজ বাইরের হাওয়ার জন্য জানালা-দরজা বন্ধ। কাচের জানালা দিয়ে হঠাৎ চমকানো গিতের আলো ঘরে এল। মা মাথায় ঘোমটা দিয়ে খাবার দিচ্ছিলেন।

পিসিমা বললেন, বংশীটা মরে গেল।

আমসত্ত্ব দুধে মাখতে মাখতে সরিৎশেখর বলরেন, দুধটা আজ ঠাণ্ডা হয়ে গেছে-কতবার বলেছি ঠাণ্ডা দুধ দেবে না।

মা তাড়াতাড়ি একবাটি গরম দুধ নিয়ে এসে বললেন, একটু ঢেলে দেব বউদি?

পিসিমা বললেন, দাও।

সরিৎশেখর বিরাট জামবাটিটা এগিয়ে দিয়ে খানিকটা দুধ নিলেন, নিয়ে বললেন, কে বংশী?

লাইনের বংশী। আগে জল এনে দিত আমাদের।

কি হয়েছিল?

মাছ ধরতে গিয়ে লতায় কেটেছে।

কথাটা শুনে সরিৎশেখর চট করে অনির দিকে তাকালেন, তারপর জানালা দিয়ে বাইরের দিকে। বাইরে তখন ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আলোয় আলোয় ঝলসে যাচ্ছে গাছপালা। সেইদকে চোখ রেখে সরিৎশেখর বললেন, বড় ভালো মাংস কাটত লোকটা, এক কোপে মাথা নামিয়ে দিত।

কথাটা শুনে চট করে একটা কথা মনে পড়ে গেল অনির। সরিৎশেখর আজকাল আর মাংস খান । বাড়িতে মাংস এলে আলাদা রান্না হয়। একদিন পিসিমা দাদুর মাংস খাওয়ার গল্প করছিলেন। যৌবনে তিন সের মাংস একাই খেতেন উনি। মা বলেছিলেন, তিন সের?

পিসিমা হাত নেড়ে বলেছেন, হবে না কেন? নদীর ধারে গাছে ঝুলিয়ে বংশী পাঁঠা কাটাত। তারপর সেই মাংসের অর্ধেক বাড়িতে রেখে বাকিটা অন্য বাবুদের বাড়ি বাবা দিয়ে দিতেন। আমাদের বাড়িতে খাওয়ার লোক তেমন ছিল না। মহী ছুটিতে বাড়ি এলে ওকে ধরলে চার পাঁচজন। বাবাই অর্ধেক খেতেন।

মা হেসে বললেন, একটা অর্ধেক পাঁঠার মাংস কী করে তিন সের হয় বউদি?

অনিও হেসে বলল । পিসিমা নাকি হিসেব পারে না-দাদু বলেন। সেই বাবা মাংস ছেড়ে দিলেন একদিন, পিসিমা বললেন, ভীষণ পাষাণ লোক ছিলেন বাবা। এখন কী দেখছিস, একদিন এমন জোরে বকেছিলেন যে ঝাড়ি প্যান্টে হিসি করে ফেলেছিল। গমগম করত গলা। তখন শাকবার ক্ষেতে অন্য লোকের গরু-ছাগল ঢুকলে বাবা রেগে কাই হয়ে যেতেন। পাঠা নিয়ে বাবা সেটার কানের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতেন। যন্ত্রণায় মরে যেত জীবটা। তখন যার পাঠা তাকে বলা হত দোষ করেছে তাই শাস্তি দিয়েছি। বাবাকে ভয় পেত সবাই, কিছু বলত না। বংশী এসে সেই পঁঠার মাংস কেটে বাড়ি-বাড়ি দিয়ে আসত। যার পাঠা তার বাড়িও বাদ যেত না। শেষ পর্যন্ত আমি আর সরষে দিতাম না, পাপের ভাগী হবে কে? এর মধ্যে হয়েছে কী, বাগানে কে এক সন্ন্যাসী এসেছে, বাবা দেখতে গিয়ে নমস্কার করলেন। সন্ন্যাসী মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, তোর তো বহুদিন প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে দেখছি!

বাবা বললেন, কেন, কী জন্যে?

সন্ন্যাসী হাত নেড়ে বলেছিলেন, তোর গায়ে খুনির গন্ধ।

চুপ করে ফিরে এসেছিলেন বাবা। আর ছাগল ধরতেন না, মাংস খাওয়া ছেড়ে দিলেন শেষ পর্যন্ত। তাও ছাড়া কী-একদিন খেতে বসেছেন, মাংস দেওয়া হয়েছে। একটু মুখে দিয়েই টান দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিলেন। চিৎকার করে বললেন, মাংস বেঁধেছে না বোষ্টমি করেছে! না হয়েছে নুন না ঝাল। আর আমাকে মাংস দেবার কষ্ট তোদের করতে হবে না। আমি তো ভয়েভয়ে মহীকে বললাম, খেয়ে দ্যাখ তো! মহী বলল, কই, খারাপ হয়নি তো। আসলে একটা বাহানা দরকার তো, সন্ন্যাসীর কথায় ছেড়ে দিলে লোকে বলবে কী।
 
এখন দাদুর শরীরের দিকে তাকালে অনির মনেই হই না এসব হতে পারে। একমাথা পাকা চুল, ঠোটের দুপাশে ঝুলে-থাকা সাদা গোঁফ, বিরাট বুকে মেদ কিছুটা ঝুলে পড়েছে, বাঁ হাতে সোনার তাগা আর হাঁটু অবধি ধুতিপরা এই লম্বাচওড়া মানুষটাকে অনির বড় ভালো লাগে। দাদুর সঙ্গে রোজ শোয় ও। ছেলেবেলা থেকেই। আর শুয়ে শুয়ে যত গল্প। পিসিমা বলেন, শুয়ে শুয়ে ও পুটুস পুটুস করে বাবাকে সব লাগায়। আসলে দাদু যখন রোজ জিজ্ঞাসা করেন, আজ কী < বল তখন কোন কথাটা বাদ দেবে বুঝতে না পেরে সব বলে ফেলে অনি।

আজ রাত্রে দাদুর ঘর থেকে নিজের বালিশ নিয়ে এল ও, তারপর সোজা মায়ের বিছানায় শুয়ে পড়ল। মহীতোষ খানিক আগে ক্লাব বন্ধ করে ফিরেছেন। রোজ দশটা অবধি ক্লাব চলে, আজ বৃষ্টির জন্য একটু আগেই ভেঙে গেছে ; শুয়ে শুয়ে অনি দাদুর গলা শুনতে পেল, ওকেই ডাকছেন। উঠে এল ও, দরজায় দাড়িয়ে আস্তে আস্তে বলল, আমি মায়ের কাছে শোব। বিছানায় বাবু হয়ে বসে সরিৎশেখর ওকে দেখলেন, তারপর হেসে ঘাড় নাড়লেন। আর এই সময় ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমে গেল। বাড়ির টিনের ছাদে যেন অজস্র পাথর পড়ছে, কানে তালা লেগে যাবার যোগাড়। অনি একছুটে মায়ের ঘরে ফিরে এল। বিছানায় শুয়ে বালিশে মুখ চেপে ও বৃষ্টির শব্দ শুনতে লাগল। মাঝে-মাঝে শব্দ করে বাজ পড়ছে। মাথার পাশে কাচের জানলা দিয়ে বিদ্যুতের হঠাৎ-জাগা আলোয় পাশের সবজিক্ষেত সাদা হয়ে যাচ্ছে, সেই এক পলকের আলোয় বৃষ্টির ধারাগুলো কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছিল। সবজিক্ষেতের মধ্যে বড় পেঁপেগাছটা হিড়িম্ব রাক্ষসীর মতো হাত-পা নাড়ছে হাওয়ার ঝাপটে। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল অনি। তারপর তখন কেমন করে জলের শব্দ শুনতে শুনতে ও ঘুমিয়ে পড়েছিল বুঝতে পারেনি।

মহীতোষ গলা শুনতে পেয়ে ও থতমত খেয়ে গিয়েছিল। মাধুরী ওকে ভালো করে শুইয়ে দিচ্ছিলেন বলে ঘুমটা ভেঙে গেল। ওর মনে পড়লও আজ মায়ের ঘরে শুয়ে আছে। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে সমান তালে। চোখ একটু খুলে অনি দেখল ঘরের কোণায় রাখা হারিকেনের আলো কমিয়ে দেওয়া, হয়েছে। পাশে-শোয়া মায়ের শরীর থেকে কী মিষ্টি গন্ধ আসছে, অনির খুব ইচ্ছে হচ্ছিল মাকে জড়িয়ে ধরে। ঠিক এমন সময় মহীতোষ হঠাৎ বললেন, ও আজ এখানে শুয়েছে যে!

মাধুরী হাসলেন, কিছু বললেন না।

কী ব্যাপার? মহীতোষ আবার জিজ্ঞাসা করলেন।

বোধহয় মন-কেমন করছে! মাধুরী বললেন।

অনির বুক দুরুদুরু করতে লাগল। এখন যদি মহীতোষ ওকে তুলে দাদুর ঘরে পাঠিয়ে দেন, তা হলে–বাবাকে বিচ্ছিরি লোক বলে মনে হতে লাগল অনির। ওর ইচ্ছে হল মাকে আঁকড়ে ধরে।

ঘুমিয়েছে। মহীতোষের চাপা গলা শুনতে পেল অনি। সঙ্গে সঙ্গে ও চোখ বন্ধ করে ফেলল। মড়ার মতো পড়ে থাকল অনি। ও অনুভব করল বুকের ওপর মায়ের একটা হাত এসে পড়ল। তারপর হাতটা ক্রমশ ওর চিবুক, গাল, চোখের ওপর দিয়ে আলতো করে বুলিয়ে গেল। মা বললেন, হুঁ।

বউদি চলে গেলে তোমার অসুবিধে হবে? মহীতোষ বললেন।

হুঁ, এতদিনের অভ্যেস। বাড়িটা ফাঁকা হয়ে যাবে। অনি না গেলে কী আর হত। পরে গেলেও পারত। একটু বিষণ্ণ গলা মাধুরীর।

না, এখনই যাক। জলপাইগুড়িতে ভালো স্কুল আছে, নিচু ক্লাস থেকে ভরতি হলে ভিতটা ভালো হবে। আমি ভাবছি, অনি হবার সময় বড়দিই তো সব করেছিল, এবার কী হবে! একটু চিন্তিত গলা মহীতোষের, তুমি কি বড়দিকে বলেছ?

দেরি আছে তো। এই শোননা, তোমার ছোট ভাই-এর বোধহয় কিছু গোলমাল হচ্ছে। মাধুরী বেশ মজা-করে বললেন।

কী হল আবার একটু নিস্পৃহ গলা মহীতোষের।

তুমি বাবাকে বলবে না তো?

ব্যাপারটা কী?

বড়দি আজ খুব রেগে গিয়েছিল। ঝাড়িকে জিজ্ঞাসা করেছিল বড়দি। প্রিয় নদীর ঘাটে যায়নি জল বন্ধ হবার পর। অথচ ও অন্ধকারে জঙ্গলে ছিল। ঝাড়ি বলেছে, ওর সঙ্গে একটা শাড়ি পরা মেয়ে ছিল। বোঝো!

শাড়ি-পরা মেয়ে? কী যা-তা বলছ! মহীতোষ প্রায় উঠে বসলেন।

আঃ, আস্তে কথা বলো। গুদামবাবুর মেয়ে তপু।

ও কুচবিহারে চলে যায়নি?

না।

এইভাবে ছেলেদের মাথা খাবে নাকি?

তা তোমার ভাইটি যদি মাথা বাড়িয়ে দেয়, ওর দোষ কী?

বাবা শুনলে বাড়ি থেকে দূর করে দেবেন ওকে।

তুমি কিছু বোললা না। যার যা ইচ্ছে করুক, আমাদের কী দরকার? গুদামবাবু শুনেছি মেয়ের বিয়ের চেষ্টা করছে, হলে ভালো।

তুমি তো বলে খালাস, বাবা চলে গেলে প্রিয় এখানেই থাকবে, তখন সামলাবে কে? আমার এসব ভালো লাগে না। আসলে মেয়েটাই খারাপ, মালবাবু বলছিল কুচবিহারে ও নাকি কী গোলমাল করেছে একটা ছোড়ার সঙ্গে। মালবাবুর বড় শালী কুচবিহারে থাকে-তা সে-ই বলেছে। আমি প্রিয়কে বুলব সাবধান হতে।

না, তুমি কিছু বলবে না। যা করার বড়দিই করবে।
 
কিছুক্ষণ অনি আর কিছু শুনতে পেল না। ও তপুপিসির মুখটা মনে করল। খুব সুন্দর দেখতে তপুপিসি, গায়ের রঙ কী ফরসা! আজ নদীর ধারে আকন্দগাছের পাশে তা হলে তপূপিসিই ছিল? ও বুঝতে পারছিল কাকু আর তপুপিসি নিশ্চয়ই খারাপ কিছু করছে, যেটা মহীতোষ পছন্দ করছেন না, দাদু শুনলে রেগে যাবেন। কী সেটা? কাকুকে ভালো লাগে না ওর। টানতে টানতে ওর কান কাকু লম্বা করে দিয়েছে। বাঁ কানটা। আয়নায় ছোট-বড় দেখায় দুটো।

আমি তা হলে ঘুমোলাম। মহীতোষের গলা পেল অনি।

হুঁ। বলে মাধুরী অনির দিকে ফিরে শুলেন। শুয়ে এক হাতে অনির গলা জড়িয়ে ধরলেন। একটু বাদেই মহীতোষের নাম ডাকতে শুরু করল। অনির গলার কাছে মায়ের হাতের বালার মুখটা একটু চেপে বসেছিল। ধার আছে মুখটায়। ওর চিনচিন করছিল গলার কাছটা। কিন্তু তবু সিটিয়ে শুয়ে থাকল অনি। চোখ বন্ধ করে ও মাথার ওপর টিনের ছাদে পড়া বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে মায়ের শরীর থেকে আসা মা-মা গন্ধটার মধ্যে সাঁতার কাটতে লাগল চোরের মতো। গলার ব্যথাটা কখন হারিয়ে গেল একসময় টের পেল না অনি।

পাতাবাহার গাছগুলো সার দিয়ে রাস্তার দুপাশে লাগানো, রাস্তাটা ওদের বাড়ি থেকে সোজা উঠে এসে আসাম রোডে পড়েছে। অনি দেখল বাপী আর বিশু বইপত্তর-হাতে ওর জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। ওদের স্কুলে কোনো ইউনিফর্ম নেই। তবু মহীতোষ ওর জন্য সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট করে দিয়েছেন, অনি তা-ই পরে স্কুলে যায়। ওর স্কুলের অন্য ছেলেমেয়েরা যে যেমন খুশি পরে আসে। জুতো পরার চল ওদের মধ্যে নেই, অন্তত স্কুলে জুতো পরে কেউ আসে না। অনি চটি পরে যায়। মা আর পিসিমা বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন। সরিৎশেখর আর মহীতোষ অফিসে চলে গেছেন সকালে। একটু বাদেই জলখাবার খেতে আসার সময়। সরিৎশেখর আসেন না, বকু সর্দার এসে ওঁর খাবার নিয়ে যায়। বাড়ি থেকে বেরুবার আগে পিসিমা ঠাকুরঘরে ওকে নিয়ে গিয়ে প্রণাম করিয়েছেন। তারপর পুজোর বেলপাতা ওর বুকপকেটে ভালো করে রেখে দিয়েছেন। অনি আজ জীবনের প্রথম পরীক্ষা দেবে। সকালে কাকু পরীক্ষার কথা শুনে বলেছে, যত বুজরুকি ভবানী মাস্টারের!

আজ সকাল থেকেই কেমন পরিষ্কার সোনালি রোদ উঠেছে। গাছের পাতা এমনকি ঘাসগুলো অবধি নতুন নতুন দেখাচ্ছে। ওরা আসাম রোড দিয়ে হাঁটতে লাগল। পি. ডর. ডি.-র পিচের রাস্তার দুধারে লম্বা লম্বা গাছ, যার ডালগুলো এখনও ভেজা, মাথার ওপর বেঁকে আছে। দুবেলায় ছায়ায় ভরে থাকে এই রাস্তা। বাদরলাঠি ফ, এখানে-ওখানে ছড়িয়ে আছে।

চা-বাগানের সীমানা ছাড়ালেই হাট। দুপাশে ফাকা মাঠের মধ্যে মাঝে-মাঝে চালাঘর করা। বাঁদিকে মাছমাংসের হাট, চালও বসে, ডানদিকে ওয়োরাটার মাঠ। আজ অবশ্য সব ফাকা। রবিবার সকাল থেকে গিজগিজ করতে থাকে লোক। বানারহাট ধূপগুড়ি থেকে হাট-বাস বোঝাই ব্যাপারিরা এসে হাজির হয় বড় বড় ঝুড়ি নিয়ে। একটু বেলায় আসে খদ্দেররা। তখন চোঙায় করে কলের গান বাজায় অনেকে। কী জমজমাট লাগে চারধার। ফাকা হাট দুপাশে রেখে ওরা ছোট্ট পুলের ওপর এল। দুপাশে রেলিং দেওয়া, নিচে প্রচণ্ড শব্দ করে আঙরাভাসা নদী বয়ে যাচ্ছে ফ্যাক্টরির দিকে। পুলের ওপর দাঁড়িয়েই লকগেটটা দেখতে পাওয়া যায়। ওপাশে পুকুরের মতো থইথই জল দাঁড়িয়ে। গেটের তলা দিয়ে অজস্র ফেনা তুলে ছিটকে বেরিয়ে আসছে এধারের ধারা। বিশু বলল, একদিন স্নান করার সময় এখানে এসে নামব আর আমাদের ঘাটে গিয়ে উঠব।

বাপী বলল, যাঃ, মরে যাবি একদম-কী স্রোত!

বিশু কিছু বলল না, কিন্তু অনি ওর মুখ দেখে বুঝল বিশু নিশ্চয়ই এইরকম একদিন করবে। যা ডানপিটে ছেলে ও! তালগাছে উঠে বাবুইপাখির বাচ্চা ধরতে চেয়েছিল একদিন। মা ভীষণ রাগ করবে বলে অনি কোনোরকমে ওকে বারণ করেছে। আজ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে অনির চট করে হরিশের কথা মনে পড়ে গেল। গায়ের মধ্যে শিরশির করে উঠল অনির।
 
পলু ছাড়ালেই ভরত হাজামের দোকান। ত্রিপলের ছাউনি দেওয়া, নিচে একটা টুল পাতা। ভরত খদ্দেরকে টুলে বসিয়ে চুল ছাঁটে। ওদের বাড়িতে মাসে দুবার যায় ভরত। দাদু দুবারই চুল ছাঁটান। কাঠালতলায় পিড়ি পেতে এক এক করে বসতে হয় ওদের। একটা কাপড় আছে ভরতের যার রঙ কোনোকালে হয়তো সাদা ছিল, দাদু বলেন ওটাতে ছারপোকা আর উকুন গিজগিজ করছে। খালিগায়ে বসে ওরা। মহীতোষ বলেন, ব্যাটা বাটিছাট ছাড়া আর কিছু জানে না। বুড়ো ভরত অনিকে চুল ছাঁটার সময় মজার-মজার গল্প বলে। সবসময় মাথা নিচে করে বসে থাকতে পারে না। নড়লেই চাটি মারে ভরত। সঙ্গে সঙ্গে ছাড়াও কাটে, ‘নাচ বুড়িয়া নাচ, কান্ধে পর নাচ’ হেসে ফেলে অনি। ছেলেবেলায় ছোটকাকাকেও চুল কেটে দিত ভরত। এখন তেমাথার মোড়ে যে নতুন মডার্ন আর্ট সেলুন হয়েছে, ছোটকাকা সেখানে গিয়ে চুল ছটিয়ে আনে। কিন্তু চোখে কম দেখলেও সরিৎশেখরের ভরতকে ছাড়া চলে না। ছোট ঠাকুমার বিয়ের সময় নাকি ভরত হাজাম ছিল।

এখন সেলুনটা ফাঁকা। ভরতের তিনপায়া কুকুরটা টুলের ওপর উঠে বসে আছে। দোকানে ভরত নেই। আর একটু এগোলেই ছোট ছোট কয়েকটা স্টেশনারি দোকান, বিলাসের মিষ্টির দোকানে বিরাট কড়াই-এ দুধ ফুটছে। এর পরেই রাস্তাটা গুলতির বাঁটের মতো দুভাগ হয়ে গিয়েছে। ঠিক মধ্যেখানে একটা বিরাট পাথরে সম্প্রতি লেখা হয়েছে গৌহাটি, নিচে বাঁদিকে একটা ভীর, ডানদিকে লেখা নাথুয়া। বাঁদিকের রাস্তাটায় আর একটু গেলে জমজমাট তিনমাথার মোড়। কতরকমের দোকানপাট, রেস্টুরেন্ট, পেট্রল পাম্প, সবসময় লোক গিজগিজ করছে। ডানদিকের রাস্তাটা ধরে এগোলেই বড় বড় কাঠোর গোলা চোখে পড়ে। কাছেই একটা স-মিলে কাজ হচ্ছে। করাত-টানার শব্দ হচ্ছে একটানা। ফরেস্ট অফিস এদিকটাতেই। রেজার সাহেবের অফিসের সামনে একটা জিপ দাড়িয়ে আছে। ডানদিকে মিশনারিদের একটা বাগানওয়ালা বাড়ি। ওখানে মদেসিয়া ছেলেমেয়েদের অক্ষর-পরিচয় হয়। রাস্তটা বাক নিতেই ঘোট মাঠ আর মাঠের গায়ে ওদের স্কুল।

ভবানী মাস্টার স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। একঘরের স্কুল। বারান্দায় মাঝে-মাঝে ক্লাস নেন উনি। ওদের নতুন-আসা দিদিমণি ভেতরের ঘরে ক্লাস ওয়ানদের পড়ান, ঘরের আর-এক পাশে বা বারান্দায় ক্লাস টু-কে পড়ান ভবানী মাস্টার। নতুন দিদিমণি পি. ডব্লু. ডি. অফিসের বড়বাবুর বোন। কদিন আগে ভবানী মাস্টারের অসুখের সময় হতে উনি এসে স্কুল দেখাশুনা করছেন। ভীষণ গম্ভীর।

স্বৰ্গছেঁড়ার তালেবর মানুষজন সম্প্রতি নতুন একটা স্কুলবাড়ি তৈরি করছেন হিন্দুপাড়ার মাঠে। বেশ বড়সড় স্কুল। এই কদিন ওদের এই একচালাতেই ক্লাস হচ্ছে। মাইনেপত্তর কোনো ছাত্রকে দিতে হয় না। ক্লাব থেকে চাঁদা তুলে ভবানী মাস্টারের মাইনে দেওয়া হয়। নতুন দিদিমণি এখনও মাইনে নেন না।

আসলে এই ঘরটা বারোয়ারি পুজোর জন্যে বানানো হয়েছিল। দরজাটা তাই বেশ বড়। দুর্গাপুজোর খ্যাতি আছে স্বৰ্গছেঁড়ার। পুজোর একপক্ষ আগে থেকে স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। বুড়ো হারান ঘোষ তাঁর দুই ছেলেকে নিয়ে এসে যান ঠাকুর গড়তে। সেই থেকে উৎসব লেগে যায় স্বৰ্গছেঁড়ায়। ভবানী মাস্টার তখন চলে যান দেশে। বাংলাদেশে। মাঝে-মাঝে ওর কথা বুঝতে পারে না অনি। কথা না শুনলে চুল ধরে মাথা নামিয়ে পিঠের ওপর শব্দ করে যখন কিল মারেন ভবানী মাস্টার তখন বিড়বিড় করে নিজের ভাষায় কী বলেন কিছুতেই বুঝতে পারে না অনি। তবে অনি কোনোদিন মারটার খায়নি। দাদু বলেন উনি ময়মনসিংহ না কী জেলার লোক। ভীষণ রাগী লোক।

ভবানী মাস্টার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওদের দেখলেন। তারপর ওরা কাছে যেতে বিশুর দিকে তাকিয়ে বললেন, বেড়াতে যাও বুঝি, বেশ বেশ, তা এবার ভিতরে গিয়ে আমাকে উদ্ধার করো বাবা সব। ঘরে ঢুকে অনির মনে হল আজ সবাই কেমন যেন আলাদা, অনেকের কপালে দই-এর টিপ। ভবানী মাস্টার আজ ক্লাস ওয়ান টু-দের পাশাপাশি বসতে বললেন। লম্বা লম্বা ডেস্কের সঙ্গে বেঞ্চি। সামনে একটা ব্ল্যাকবোর্ড। ব্ল্যাকবোর্ডে এক দুই করে প্রশ্ন লেখা। বাঁদিকে ক্লাস ওয়ানের জন্য, ডানদিকে ক্লাস ট। আজকে ভবানী মাস্টারের গলা ভীষণ ভারী এবং রাগী লাগছিল। সবাইকে বলে দিলেন, যে একটা কথা বলবে তাকে ইট মাথায় করে তেমাথা অবধি দৌড়ে ঘুরে আসতে হবে।

এমন সময় নতুন দিদিমণি স্কুলে এলেন। সাদা শাড়ি জামা, নাকের ডগায় তিল থাকায় সবসময় মনে হয় কিছু উড়ে এসে ওখানে বসেছে। দিদিমণি এসে প্রথমে রোলকল করলেন। তারপর বানী মাস্টারের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে কী বললেন। ভবানী মাস্টারের মুখটা কেমন মজার মজার হয়ে গেল। ঘাড় নেড়ে কী যেন বলে ওদের দিকে তাকালেন, এখন তোমরা দিদিমণির কাছে গান করবে। একটার পর পরীক্ষা। বলে বাইরের বারান্দায় চলে গেলেন।
 
গানের কথা শুনে সবাই গুনগুন করে উঠল। গোপামাসি বসেছিল অনির পাশে। অনেক বড় গোপামাসি। স্কুলে শাড়ি পরে আসতে পারে না বলে ফ্রক পরে। অনিকে গোপমাসি বলল, গান গাইতে আমার খুব ভালো লাগে। দেখিস গানের পরীক্ষা নেবে। তুই পারবি?

ঘাড় নাড়ল অনি, না।

এমন কী আর, শুধু জোরে জোরে সুর করে বলবি, সে হয়ে যাবেখন। আমি তো হাটের দিনে গান শুনে শুনে শিখে গিয়েছি। কথা বলতে বলতে চুপ করে গেল গোপমাসি। দিদিমণি ওর দিক তাকিয়ে আছেন একদৃষ্টে। তারপর একটু গলাখাকারি দিয়ে বললেন উনি, আর কদিন বাদেই, তোমরা হয়তো জান, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা দিবস। জান তো?

হ্যাঁ দিদিমণি। পুরো ঘরটা একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল।

স্বাধীনতা মানে আমরা আর পরাধীন থাকব না। ইংরেজদের হুকুম আমাদের মানতে হবে না। আমরাই আমাদের রাজা। দিদিমণি হাত নেড়ে বললেন, এখন সেই দিনটি হল পনেরোই আগস্ট। এই পনেরোই আগষ্ট হবে উৎসবের দিন। আমরা স্কুলের সামনে আমাদের জাতীয় পতাকা তুলব। শহর থেকে একজন গণ্যমান্য লোক আসবেন তোমাদের কিছু বলতে। তখন তোমরা সবাই মিলে একটা গান গাইবে। আমাদের হাতে সময় আছে মাত্র পাঁচ দিন।এর মধ্যে তোমরা গানটা মুখস্থ করে নেবে। প্রথম আমি গাইছি তোমরা শোননা। দিদিমণি এবার সবার দিকে তাকিয়ে নিলেন। একসঙ্গে অনেক কথা বলায় ওঁর নাকের ডগায় তিলের ওপর একটু ঘাম জমতে দেখল অনি। আঁচল দিয়ে সেটা মুছে নিলেন উনি। তারপর একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে হাতের বইটা সামনে খুলে ধরে খুব নরম গলায় গাইতে লাগলেন, ধন্যধান্য পুষ্পভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা…।

সমস্ত ঘর চুপচাপ, গান গাইছেন গম্ভীর-দিদিমণি। এত সুন্দর যে উনি গাইতে পারেন অনি তা জানত না। সকলে কেমন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে, এমনকি গোপামাসিও। এক-একটা লাইন ঘুরেফিরে গাইছেন উনি, কী সুন্দর লাগছে। একসময় অনি গানের মধ্যে ঢুকে পড়ল। তারপর যেই দিদিমণি কেমন করুণ করে গাইলেন-ও মা তোমার চরণ দুটি বৃক্ষে আমার ধরি, তখন হঠাৎ অনির শরীরটা থরথর করে কেঁপে উঠল, ওর হাতের লোমকূপগুলো কাটা হয়ে উঠল, এই মুহূর্তে মা কাছে থাকলে অনি তাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ রাখত।

দিদি তখনও গেয়ে যাচ্ছেন, অনির শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছিল। ও জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। স্কুলের পেছনের রাস্তাটা চলে গেছে খুঁটিমারীর জঙ্গলের ভিতর দিয়ে নাথুয়ার দিকে। বেশ চনমুনে রোদ উঠেছে। রাস্তাটা তাই ফাঁকা। সামনের বকুলগাছটায় একটা লেজঝোলা পাখি ঘাড় ঘুরিয়ে ডাকছে। তার লেজের হলদে নীল লম্বা পালকে রোদ পড়ে চকচক করছে। পাশেই একটা লম্বা ইউক্যালিপটাস গাছ। ওরা বলে সাহেবগাছ। সাহেবগাছের একদম ওপরডালে মৌচাক বেঁধেছে মৌমাছিরা। গাছের তলায় গেলেই শব্দ শোনা যায়। ওরা কি ফুলের ওপর ঘুমিয়ে পড়ে ফুলের মধু খেয়ে শিশু বলে, মৌচাকের মধ্যে মধু জমা আছে। গুলতি দিয়ে একদিন ভাঙবে ও মৌচাকটাকে। দিনের বেলা বলে ও পারছে না, চাক ভেঙে দিলে মৌমাছিরা নাকি ছেড়ে দেবে না। ভীষণ হুল। অনির কোনো ভাই নেই, গানটায় ভাই-এ ভাই-এ এত স্নেহ বলেছেন দিদিমণি। আচ্ছা ওর ভাই নেই কেন? পিসিমা গল্প করার সময় বলেন, তুই যেমন মায়েরর পেটে এসেছিলি-তেমনি একটা ভাই তো মায়ের পেটে আসতে পারে! অনি দেখল রেতিয়া সামনের রাস্তাটা দিয়ে যাচ্ছে ওদের চেয়ে বয়সে বড়, এক নম্বর লাইনের মদেসিয়া ছেলে। ও চোখে দেখতে পায় না। অথচ পা দিয়ে রাস্তা বুঝে রোজ বাজারে চলে আসে। বাজারে গিয়ে মতি সিংয়ের চায়ের দোকানের সামনে পাতা বেঞ্চিতে চুপ করে বসে থাকে। মতি সিং ওকে রোজ চা খাওয়ায়। সারা মুখে বসন্তের দাগ, ছেলেটা খোঁড়াতে খোড়াতে যাচ্ছে। হঠাৎ অনির খুব দুঃখ হল ওর জন্য। দিদিমণি যে এমন মন-কেমন-করা গান গাইছে বেচারা শুনতে পেল না। অথচ ওর খুব বুদ্ধি। এখন যদি অনি ছুটে ওর কাছে যায়, গিয়ে জিজ্ঞাসা করে, এই বল তো আমি ওকে, সঙ্গে সঙ্গে রেতিয়া মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকাবে, ওর বসন্তের দাগওয়ালা কপালে ভাজ পড়বে, দুটো সাদা চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইবে, তারপর হঠাৎসব সহজ হয়ে গিয়ে ওর হলদে ছাতা-লাগা দাঁতগুলোয় শিউলি ফুলের বোঁটার মতো হাসি ঝিলিক দিয়ে উঠবে, ও মুখ নিচু করে বলবে, অনি।
 
একসময় গান শেষ হয়ে গেল। এত সুন্দর গান এমন কথা অনি শোনেনি আগে। ও দেখল, ভবানী মাস্টার দরজায় এসে দাড়িয়েছেন। বোঝাই যাচ্ছে উনি গান শুনছিলেন, তাই ওঁর মুখটা অন্যরকম দেখাচ্ছিল। এরপর দিদিমণি ওদের গানটা শেখাতে আরম্ভ কররেন। গোপামাসির গলা সবার ওপরে। এমনিতে অনি কোনোদিন সবার সামনে গান গায়নি। কিন্তু আস্তে আস্তে ওর গলা খুলতে লাগল। গানের লাইনগুলোর সব মানে বুঝতে পারছিল না, এই যা।

কেমন ঘোরের মধ্যে সময়টা কেটে গেল। একসময় দিদিমণি থাকলেন। এখন টিফিন। অনি টিফিনের সময় কিছু খায় না। কেউই খায় না। দুটোয় ছুটি । বাড়ি ফিরে পিসিমার আলোচালের ভাত সুন্দর নিরামিষ তরকারি দিয়ে একসঙ্গে বসে খায়। এতক্ষণে ওর নজর পড়ল সামনের ঘর ফাকা। সবাই বাইরের মাঠে রোদুরে হইহই করছে। স-মিলের করাতের শব্দ এখানে আসছে। একটা কাঠঠোকরা পাখি সামনের সাহেবগাছে বসে একটানা শব্দ করে যাচ্ছে।

অনি দেখল গোপমাসি বাইরে থেকে ফিরে এল। এসে। ওর পাশে বসল, কেমন গাইলাম রে?

অনি হাসল। সবাই মিলে একসঙ্গে গান করেছে, অথচ পামাসি এমন ভাব করছে যেন একাই গেয়েছে।

আমি বড় হলে খুব গাযিকা হব, জানিস, কাননবালা।

কথাটা বলে চোখ বন্ধ করল গোপামাসি। গোপামাসি তত বড়ই হয়ে গিয়েছি, শুধু শাড়ি পরে–এই যা।

তুই নাকি চলে যাবি এখান থেকে হঠাৎ গোপামাসি বলল।

হুঁ।

আর আসবি না?

আসব তো! ছুটি হলেই আসব।

আমার সঙ্গে দেখা করবি তো?

বাঃ, কেন করব না! ঘাড় নিচু করে গোপামাসি বলল, তোরা ছেলেরা কেমন টুকটুক করে চলে যাস। আমি দ্যাখ এই এক ক্লাসে সারাজীবন পড়ে থাকলাম। পাশ করলেও কী হবে, আমার তো পড়া হবে না আর।

নতুন স্কুল হচ্ছে, সেখানে পড়বে। অনি বলল।

ঠোঁট ওলটালে গোপামাসি, মা পড়তে দেবে না। ছোঁড়া ছোড়া মাস্টার আসবে যে সব! অথচ দেখ ক্লাস ওয়ানের পরীক্ষা একেবারে আমি পাশ করে গেছি। হঠাৎ ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে গোপামাসি বলর, দাঁড়া, তোর খাতাটা দে দেখি।

কিছু বুঝতে না পেরে অনি নতুন পাতাটা এগিয়ে দিল। গোপামাসি বলল, আমি তো ফল করবই। পাশ করলে তো মা বাড়ি থেকে বেরুতে দেবে না। আমি তোর পরীক্ষার উত্তর লিখে দিচ্ছি।। তুই চুপ করে বসে থাক।

অনির খুব মজা লাগল। বোর্ডের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নগুলো দেখে গোপামাসি র খাতায় উত্তর লিখছে। এইসব প্রশ্নের উত্তর ও জানে, কিন্তু সেগুলো লেখার হাত থেকে বেঁচে যাচ্ছে বলে ওর সাইকেলে আনন্দ হচ্ছিল। গোপামাসি লিখছে-ও জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল আবার। ওভারসিয়ারবাবু সাইকেল চেপে আসছেন ঠাঠা রোদুরে খুঁটিমারীর দিক থেকে। মাথায় সোলার হ্যাট। খাকি হাফপ্যান্টের নিচে ইয়া মোটা মোটা পা। পাছা দুটো সিটের পাশে ঝুলে পড়েছে। দুহাতে সামনের হ্যান্ডেলে শরীরের ভর রেখে চোখ বন্ধ করেই বুঝি চালাচ্ছেন। চোখ এত ছোট আর মুখটা এত ফোলা যে বোঝা যায় না তাকিয়ে আছেন না ঘুমোচ্ছন। হঠাৎ একটা প্রচন্ড শব্দ হতেই চমকে উঠল অনি। একটা মোটা পা আকাশে তুলে অন্যটায় নিজেকে কোনোরকমে সামলাচ্ছেন ওভারসিয়ারবাবু মাটিতে ভর দিয়ে। পেছনের চাকা চুপসে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে হইহই শব্দ উঠল। মাঠে যারা খেলছিল তারা ব্যাপারটা দেখেছে। ভবানী মাস্টারের গলা শোনা গেল, অবোধ্য ভাষায় গালাগাল দিনে বোধহয়, সবাই হুড়মুড় করে ঘরে ফিরে এল। বিশু ছড়া কাটছিল, ওভারবাবুর চাকা, চলতে গেলেই বেঁকা।

চোরের মতন খাতটা দিয়ে দিল গোপামাসি, নে, শুধু একটা পারলাম না। যা শক্ত! এতেই পাশ করে যাবি।

খাতাটা খুলে দেখল অনি। খুব সুন্দর হাতের লেখা গোপামাসির। খাতার ওপরে ওর নাম লিখে দিয়েছে।

পরীক্ষা আরম্ভ হয়ে গেল। গোপামাসি কী সব লিখছে নিজের খাতায়। লে র ভঙ্গিতে অনি বুঝল, মন নেই। ভবানী মাস্টার একটা লম্বা বেত হাতে নিয়ে মাঝখানে বসে। সবাই মুখ নিচু করে লিখছে। ভবানী মাস্টার অনিকে দেখলেন, কী অনিমেষ, লিখ লিখ।

পাশ থেকে গোপামাসির চাপা গলা শুনতে পেল অনি, আরে বোকা, ছবি আঁক না পেছন পাতায়। চুপ করে বসে থাকলে ধরা পড়ে যাবি না!
 

Users who are viewing this thread

Back
Top