What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected উত্তরাধিকার - সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

এটা অবশ্যই কংগ্রেসিদের পোশাক। এই তো মন্ত্রীকে সে এইরকমই দেখল, তবু সবাই তো এরকম নয়। নিশীথবাবু, নবীনবাবু শশধরবাবু, তো একদম অন্যরকম। আবার মুভিং ক্যাসেল-তিনিও তো কংগ্রেস করেন।

ওর দিকে তাকিয়ে প্রিয়তোষ বলল, তা আমার পোশাক দেখে নিশ্চয়ই কমিস্ট মনে হচ্ছে না, কিন্তু কংগ্রেসিও মনে হচ্ছে না তো? তা হলে আমি কী? হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে প্রিয়তোষ ড্রাইভারকে বলল, একটু বাজারের দকিটায় যাব ভাই, দিনবাজারের পুলটা দিয়ে না হয় ঘুরে যাবেন।

তারপর জানলার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি আর কোনো পার্টি করি না।

একথাটাই এতক্ষণ মনে হচ্ছিল অনিমেষের, সে অবাক-গলায় জিজ্ঞাস করল, তুমি বুঝি অফিসার?

মাথা নাড়ল প্রিয়তোষ, না রে! আমি চাকরি করি, কিন্তু ঠিক সেরকম চাকরি নয়। তগুই এখন এসব কথা বুঝবি না। বাঃ, শহরটার তো অনেক উন্নতি হয়েছে। ওটা কী সিনেমা হল, আলোছায়া? দীপ্তি টকিজ আছে না?

প্রসঙ্গটা এমন সহজে ঘুরে গেল যে অনিমেষ ধরতে পারল না, হ্যাঁ। আর-একটা সিনেমা হল হয়েছে। ও মুখ বের করে দেখল আলোছায়াতে দস্যু মোহন হচ্ছে। এই সিনেমাটার কথা মণ্টু খুব বলছিল। ও চট করে পকেটে পড়ে-থাকা আধুলিকে স্পর্শ করে নিল।

তুই সিগারেট খাস?

প্রশ্নটা শুনে চমকে ছোটকাকার দিকে তাকিয়ে দ্রুত মাথা নাড়ল অনিমেষ। এরকম প্রশ্ন বড়রা কেউ করবে ও ভাবেনি। ছোটকাকা নির্বিকার-ওদের ক্লাসের অনেকেই এখন সিগারেট খায়। মণ্টু ওকে একবার জোর করে সিগারেট টানিয়েছিল, কী বিচ্ছিরি তেতো-তোতো! কি আরাম যে লোকে পায়।

তুই পার্টি করিস?

এই প্রশ্নটার অর্থ এখন অনিমেষের জানা হয়ে গেছে। পার্টি করা বলতে এখন সবাই কমিউনিস্ট পার্টি করার কথাই বোঝায়। যেন কংগ্রেসি পার্টি করে না। নিশীথবাবু ওকে নিয়ে কংগ্রেস অফিসে কয়েকবার গিয়েছিলেন। সামনের নির্বাচনে ওকে কংসের হয়ে যে কাজ করতে হবে সেটা নিশ্চিত। সেদিন একটা মজার বক্তৃতা শুনেছিল ও। জেলা থেকে নির্বাচিত একজন কংগ্রেসি বলছিলেন, ওরা বলে আমরা চোর, ভালো কথা। কিন্তু গদিতে যে-ই যাবে সে সাধু থাকতে পারে না। এখন কথা হল আমরা খেয়ে-খেয়ে এমন অবস্থায় এসেছি যে আর খাওয়ার ক্ষমতা নেই। এখন ইচ্ছে না থাকলেও আমরা সাধারণ মানুষের জন্য দুএকটা কাজ করব। কিন্তু ওরা তো উপোসী ছারপোকা হয়ে আছে, গদিতে গেলে তো দশ বছর লুটেপুটে খাবে! তার বেলা? কথাটা অনিমেষের ঠিক মনঃপুত না হলেও বিকল্প কোনো চিন্তা মাথায় আসেনি। তাই ঘাড় নেড়ে এখন সে বলল, আমি কংগ্রেসকে সার্পোট করি।

একটু অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে প্রিয়তোষ মনে করতে পারল, ও, তুই সেই বন্দেমাতরম্ বলতিস, না? স্বাধীনতা দিবসে ফ্ল্যাগ তুলেছিলি, না?

ঘাড় নাড়ল অনিমেষ। এটা ওর গর্ব!

হঠাৎ অনিমেষের জ্যাঠামশাই-এর কথা মনে পড়ে গেল, জান, জ্যাঠামশাই একদিন জেঠিমা আর ছেলেকে নিয়ে বাড়িতে এসেছিল। দাদু ছিল না তখন।

তাই নাকি? তারপর?

খাওয়াদাওয়া করে দাদু আসার আগেই চলে গেল। এ-খবর তুমি জান?

অনিমেষ সন্দেহের চোখে ছোটকাকার দিকে তাকাল। প্রিয়তোষ হেসে ঘাড় নাড়ল, না।

জ্যাঠামশাই তোমাকে কমিউনিস্ট পার্টি কর বলে বোকা বলছিল। আখের গোছাতে হলে নাকি কংগ্রেসি হতে হয়। আমার খুব রাগ হয়েছিল। বলে কথাটা কি ঠিক? হাতের সব আঙুল কি সমান? অনিমেষ বেশ উত্তেজিত গলায় বলল।
 
প্রিয়তোষ দিনবাজারের সামনে গাড়িটা দাঁড় করাতে বলে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করল, কেন, তুই একটু আগে বললি না চেহারা দেখে বোঝা যায় কে কমিউনিস্ট আর কে কংগ্রেসি। তা সুখে থাকতে গেলে তো কংগ্রেসি হতে হবে। ভালো করেছিস।

ব্যাগ থেকে একটা একশো টাকার নোট বের করে অনিমেষের সামনে ধরল প্রিয়তোষ, যা, চট করে এক সের ভালো কাটা পোনা এক সের রাবড়ি আর কিছু মিষ্টি কিনে আন। আমি আবার মাছ ছাড়া খেতে পারি না। তা ছাড়া বাবার এসব অনেকদিন পর খেতে ভালো লাগবে।

অনিমেষ দেখল ছোটকাকার ব্যাগটা একশো টাকা নোটে ফুলে ঢাউস হয়ে আছে। কত টাকা! বাড়ানো হাতে নিয়ে ওর খেয়াল হল পিসিমা আজকাল একদম মাছ হোন না, ও একটু ইতস্তত করে বলল, কিন্তু পিসিমা যে মাছ রান্না করেন না!

সে কী! প্রিয়তোষ যেন কথাটা বিশ্বাস করল না, ঠিক আছে, সে আমি দেখব। হ্যাঁ, এক কাজ কর, আসার সময় এক পোয়া ছানার জিলিপি আনবি। দিদি ছানার জিলিপি পেলে কোনোকিছুতেই না বলবে না।

প্রিয়তোষ যেন বাড়িতে একটা উৎসবের মেজাজ নিয়ে এল। এতদিন ধরে সরিৎশেখরের এই সংসার যে-জলার মধ্যে পাক খাচ্ছিল তার যেন অনেক মুখ খুলে গেল আচম্বিতে। হেমলতা প্রিয়তোষকে জড়িয়ে ধরে খানিকক্ষণ মন খুলে কেঁদে নিয়ে মাছ কুটতে বসে গেলেন। কান্নার সময়। অনিমেষ দূরে দাঁড়িয়ে অনেকগুলো নাম শুনতে পেল, যাঁদের মধ্যে সেই অদেখা শচীন পিসেমশাইও ছিলেন। হেমলতা কান্নায় আপেক্ষটাই বড় হয়ে উঠেছিল, প্রিয়তোষ অ্যাদ্দিন কোথায় ছিল—এদিকে যে সংসার ভেসে যায়-আর কতদিন এই পোড়া বোঝা বইতে হবে ইত্যাদি। কান্নার মাঝখানে একবার সরিৎশেখরের বিরুদ্ধেও কিছু বলা হল। তারপর কান্না থামলে প্রিয়তোষের আনি মিষ্টি তাকে খেতে দিয়ে গল্প করতে করতে মাছ কুটতে বসে গেলেন। যেন যন্ত্রের মতো ব্যাপার হচ্ছে, অনিমেষ অবাক হয়ে দেখছিল। খুব শোক বা খুব আনন্দ মানুষকে তার সংস্কার ভুলিয়ে দিতে পারে সহজেই।

একটু বেলা বাড়লে একমাথা রোদ ভেঙে সরিশখর বাড়ি ফিরলেন। এই দৃশ্যটা দেখার জন্য আড়লে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল অনিমেষ। সরিৎশেখর আসছেন, এক হাতে বিবর্ণ ছাতি অন্য হাতে লাঠি। কোরা ধুতি হাঁটুর নিচ অবধি, পাঞ্জাবি লালচে। বেশ দ্রুত হাঁটছিলেন প্রথমটায়, গেটের কাছাকাছি এসে মুখ তুলে ঠাওর করতে চাইলেন বাড়িতে নতুন কোনো ঘটনা ঘটেছে কি না। অনিমেষ দেখছিল দাদু ঠিক বুঝতে পারছেন না, তাই গেটটা বন্ধ করার সময় শব্দ করলেন খুব জোরে। তারপর যেন হাঁটতে পারছেন না আর, এইরকম ভঙ্গিতে লাঠিতে শরীরের ত্র দিয়ে এগোতে লাগলেন। কয়েক পা হেঁটে থমকে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলেন কোনো আওয়াজ পান কি না। দাদুর এইরকম ব্যাপারস্যাপার কোনোদিন দেখেনি অনিমেষ। গেটের আওয়াজ ভেতরে হেমলতার কানে গিয়েছিল। পিসিমাকে হুড়মুড় করে বাইরে বেরিয়ে আসতে দেখল ও। দাদুকে দেখে পিসিমা চিৎকার করে উঠলেন, ও বাবা, দেখুন কে এসেছে-প্রিয়-প্রিয়তোষ, একদম সাহেব হয়ে এসেছে-আপনার জন্য মাছ মিষ্টি এনেছে। অনি দেখল দাদু যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব করে হাঁটছেন। তার শরীরের কষ্ট যেন ছোটকাকার ফিরে আসার চেয়ে অনেক জরুরি।

বারান্দায় উঠে চেয়ারে গা এলিয়ে দিতে দিতে সরিৎশেখর বললেন, এক গেলাস জল দাও।

হেমলতা চেঁচিয়ে উঠলেন, এই রোদে পুড়ে এলেন, এখনই জল খাবেন কী!

অনিমেষ দেখল ছোটকাকা ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে গম্ভীরমুখে দাদুকে প্রণাম করল। ছোটকাকার পরনে এখন ধোপভাঙা পায়জামা আর গেঞ্জি। দাদু একটা হাত উঁচু করে কী যেন বললেন, তারপর ছোটকাকা উঠে দাঁড়ালে জিজ্ঞাসা করলেন, কখন এলে?।

একদম হাঁ হয়ে গেল অনিমেষ। এত বছর পর এভাবে বাড়ি ফিরল যে, তাকে দাদু এমনভাবে প্রশ্ন করলেন যেন কদিন বেরিয়ে কেউ বাড়ি ফিলেছে! ছোটকাকাও বলল, এই তো খানিক আগে আপনি কেমন আছেন?
 
ততক্ষণে পিসিমা ভেতর থেকে একটা তালপাতার পাখা এনে জোরে জোরে দাদুকে বাতাস করতে আরম্ভ করে দিয়েছিলেন। সে-বাতাস খানিকক্ষণ নিয়ে দাদু বললেন, বড় অর্থকষ্ট, এ ছাড়া ভালোই আছি। আজ বাড়িটা ভাড়া দিয়ে এলাম।

পিসিমা জিজ্ঞাসা করলেন, কত টাকায় ঠিক হল?

আড়াইশো। তাতে আমার চলে যাবে। কথাটা বলে দাদু ছোটকাকাকে আর-একবার দেখলেন, তোমার শরীর আগের থেকে ভালো হয়েছে। বিয়ে-থা করেছ।

না, কী আশ্চর্য, আপনাকে না বলে বিয়ে করব কেন? কেমন বোকার মতো মুখ করল ছোটকাকা।

পিসিমা বললেন, মন্ত্রী আবার বিয়ে করেছে, জানিস? আর পরি একটা কোত্থেকে মেয়ে ধরে বিয়ে করেছে, একটা বাচ্চাও হয়েছে।

হঠাৎ খুব জোরে ধমকে উঠলেন দাদু, থামো তো, তখন থেকে ভড়ভড় করছ।

পিসিমা চুপ করতেই খুব আস্তে বলে ফেললেন, তুমি অ্যাদ্দিন কোথায় ছিলে জানতে চাই না, মনে হচ্ছে সুখেই আছ। চাকরিবাকরি কর।

হ্যাঁ। খুব সংক্ষিপ্ত জবাব দিল ছোটকাকা।

পিসিমা আবার বলে উঠলেন, হ্যাঁ বাবা, প্রিয় যখন এল আমি তো অবাক। কী দামি কোটপ্যান্ট, আবার সাহেবদের মতো টাই! খুব বড় অফিসার আমাদের প্রিয়। আপনার আর কোনো কষ্ট হবে না।

হঠাৎ দাদু জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি আজকাল কমিউনিস্ট পার্টি কর না?

মাথা নাড়ল ছোটকাকা, না, আমি কোনো দলে নেই।

সে কী! যে-পার্টির জন্য বাড়ি ছাড়লে সেই পার্টি ছেড়ে বড়লোক হয়ে গেলো আমার আজকাল প্রায়ই মনে হয় তোমার বন্ধুরা ঠিক কথাই বলে। আমি অবশ্য তোমার বন্ধুদের বেশি চিনি না। সরিৎশেখর মেয়ের দিকে তাকালেন, হেম, প্রিয়তোষ মিষ্টি এনেছে বলছিলে না, দাও খাই, অনেকদিন মিষ্টি খাই না!

সরিৎশেখরের এই মিষ্টি খেতে চাওয়াটা থেকেই বাড়িতে বেশ উৎসব-উৎসব আমেজ শুরু হয়ে গেল। কিন্তু অনিমেষ দেখছিল দাদু যখন ছোটকাকাকে বন্ধুদের নাম করে কীসব শোনার কথাটা বললেন এবং বলে কথাটা ঘুরিয়ে নিলেন তখন ছোটকাকা ভ্রূ কুঁচকে দাদুকে এমন ভঙ্গিতে দেখল যেটা মোটেই ভালো নয়। তার পর থেকে এ-বাড়িটা একদম পালটে গেল। এত বয়স হয়ে গেলেও এখনও কী শক্ত উনি, একই দিনবাজার থেকে বাজারের বোঝা এক হাতে বয়ে আনেন। সেই দাদু একন যেন হঠাৎই অথর্ব হয়ে যাচ্ছেন। কথা বলছেন আস্তে-আস্তে। খেয়েদেয়ে দুপুরে ছোটকাকা ঘুমুলে পিসিমা শব্দ করে বাসন মাজছিলেন বলে চাপা গলায় ধমকে উঠলেন, যেমন তোমার গলার শব্দ তেমনি হাতের আওয়াজ! ছেলেটাকে ঘুমাতে দেবে না?

বিকেলে চা খেয়ে বেরুবার সময় ছোটকাকা দাদুকে দশটা একশো টাকার নোট দিল। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে অনিমেষ দেখল টাকাটা নেবার সময় দাদু একটুও উত্তেজিত হলেন না। যেন গচ্ছিত টাকা ফেরত নিচ্ছেন এমন ভাব। বাড়ি থেকে বের হবার আগে ছোটকাকা অনিমেষকে ডাকল, কী করছিস তুই?

এখন ভর–বিকেল। তিস্তার পাড়ে মণ্টুরা এসে গেছে। অনিমেষ ওদের কাছে আজকের এয়ারপোর্টের অভিজ্ঞতাটা বলবার জন্য ছটফট করছিল। মুখে বলল, কিছু না।

তা হলে চল, আমার সঙ্গে ঘুরে আসবি। তারপর পিসিমাকে ডেকে বলল, তোমরা কখন শুয়ে পড়?

পিসিমার সময়ের হিসেব ঠিক থাকে না, নটা-দশটা হবে, বাংলা খবর শেষ হলেই বাবা শুয়ে পড়েন।

ছোটকাকা বললেন, আমাদের ফিরতে দেরি হবে।

ছোটকাকার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে টাউন ক্লাবের রাস্তায় আসতে-আসতে অনিমেষের মনে হল আজ অবধি ও কাউকে এভাবে কুম করে বাড়ি থেকে বের হতে দেখেনি। ক্রমশ ও বুঝতে পারছিল ছোটকাকা ওদের থেকে একদম আলাদা। এই যে সিল্কের শাটপ্যান্ট পরা শরীরটা ওর পাশে-পাশে হেঁটে যাচ্ছে তাকে ও ঠিক চেনে না। এই শরীরটা থেকে যে বুক-ভরে-যাওয়া সুগন্ধ বেরুচ্ছে সেটাই যেন একটা আড়াল তৈরি করে ফেলেছে। এত সুন্দর গন্ধ মুভিং ক্যাসেলের শরীর থেকেও বের হয় না। বিলিতি সেন্ট বোধহয়।
 
মোড়ের মাথায় এসে একটা রিকশা নিল ছোটকাকা। কোনো দর-কষাকষি করল না, বলল, ঘণ্টা চারেক থাকতে হবে, দশ টাকা পাবে।

রিকশাওয়ালাটা বোধহয় এরকম খদ্দের আগে পায়নি, অবক হয়ে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি ঘাড় নাড়ল। ছোটকাকার পাশে রিকশায় বসতে অনিমেষের মনে হল ওর জামাকাপড়ও গন্ধে ভুরভুর করছে এখন। হাওয়া কেটে ছুটছে রিকশাটা টাউন ক্লাবের পাশ দিয়ে। ছোটকাকা বলল, আগে পোস্টঅফিসের দিকে চলো। ঘাড় নেড়ে রিকশাওয়ালা পি ডব্লু ডি অফিস ছাড়িয়ে করলা নদীর পুলের ওপর উঠল। করলা নদীর একদিকটায় কচুরিপানা কম। আরও একটু বাঁদিকে তাকালে তিস্তা দেখা যায়-করলা-তিস্তার সঙ্গমটায় কিং সাহেবের ঘাট।

করলা নদীর দিকে তাকাতেই চট করে অনির সেই ব্যাপারটা মনে পড়ে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে ও সোজা হয়ে বসল। অলসভাবে শরীরটা রেখে প্রিয়তোষ শহর দেখছিল। এই কয় বছরে একটুও বদলায়নি জলপাইগুড়ি, শুধু নতুন নতুন কিছু বাড়ি তৈরি হয়েছে এদিকটায়। করলার পারে বিরাট জায়গা জুড়ে হলঘরমতন কিছু হচ্ছে। হঠাৎ ও লক্ষ করল অনিমেষ কেমন সিঁটিয়ে বসে আছে।

কী হল তোর? প্রিয়তোষ পকেট থেকে সিগারেট বের করতে করতে জিজ্ঞাসা করল। মনে পড়ে যাওয়া থেকে অনিমেষ চুপচাপ ভাবছিল কথাটা বলবে কি না। ও ঠিক বুঝে উঠছিল না যে ছোটকাকা ব্যাপারটা কীভাবে নেবে। ও নিজে অবশ্য আর গার্লস স্কুলে যায়নি, কিন্তু তপুপিসি যে এখনও এখানে আছে এ-খবর সে জানে। আর আশ্চর্য, এতদিন জলপাইগুড়ি শহরে থেকে তপপিসি একদিনের জন্যও ওদে বাড়িতে আসেনি! তপুপিসির কথা ছোটকাকুকে কীভাবে বলবে মনেমনে গোছাচ্ছিল সে। প্রিয়তোষ অবাক হচ্ছিল ওর মুখ দেখে। নরম গলায় বলল, কিছু বলবি?

ঘাড় নাড়ল অনিমেষ। তারপর উলটোদিকে কারখানার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার একটা চিঠি আমি পুলিশকে নিতে দিইনি। চিঠিটা দাদুর বড় আলমারিতে আছে।

প্রিয়তোষ ব্যাপারটা ধরতে পারল না একবিন্দু, আমার চিঠি? কী বলছিস, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

হঠাৎ খুব রাগ হয়ে গেল অনিমেষের। এত বড় গুরুত্বপূর্ণ একটা চিঠি সুটকেসে রেখে গেল ছোটাকাক, অথচ এখন কিছুই মনে পড়ছে না। চিঠির সমস্ত লাইনগুলো অবশ্য অনিমেষের নিজের মনে নেই, কিন্তু সব মিলিয়ে এই বোধটা ওর মনে আছে যে তপুলিসি খুব দুঃখ পেয়েছিল আর চিঠিটা পেলে পুলিশ নিশ্চয়ই তপুপিসির ওপর অত্যাচার করত। অথচ ছোটকাকা কিছু বুঝতে পারছে না!

তপুপিসির লেখা একটা চিঠি তোমার সুটকেসে পেয়েছিলাম আমি। তোমাকে খুঁজতে আসার আগেই লুকিয়ে ফেলেছিলাম। চিঠিটা দাদুর কাছে আছে। অনিমেষ আস্তে-আস্তে কথাগুলো বলল।

ব্যাপারটা বুঝতে যেন একটু সময় লাগল ছোটকাকার। তারপর নিজের মনেই যেন বলল, ও, আচ্ছা! আমার একদম খেয়াল ছিল না চিঠিটার কথা। তারপর অনিমেষের দিকে ফিরে বলল, তুই পড়েছিস?

মাথা নাড়ল অনিমেষ, আমি জানতাম না ওটা কার চিঠি। কথা বলেই ও বুঝতে পারল যে ঠিক বলা হল না। কারণ ছোটকাকুর সুটকেসে অন্য কার চিঠি থাকতে যাবে! আর চিঠিটা খুলেই ও তপুপিসির নাম দেখতে পেয়েছিল। কিন্তু চিঠিটা তখন না-পড়ে উপায় ছিল না-এটা মনে পড়ছে।

রিকশাওয়ালা পোস্টঅফিসের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। ছোটকাকা এফ ডি আই স্কুলের দিকে তাকিয়ে বলল, কদমতলা দিয়ে মাষকলাইবাড়ি চলো।…বাবা কী বলল?

শেষ প্রশ্নটা ওকে করছে বুঝতে পেরে অনিমেষ বলল, দাদু কিছু বলেননি, শুধু আলমারিতে তুলে রেখে দিলেন।

রাহুতবাড়ির তলাটা জমজমাট। এখনও সন্ধে হয়নি, আশেপাশে প্রচুর সাইকেলরিকশা ছুটে যাচ্ছে। প্রিয়তোষ চুপচাপ সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে। অনিমেষ বুঝতে পারছিল না ছোটকাকা তাকে ছোটকাকা একবারও কিন্তু তপুপিসির কথা জিজ্ঞাসা করল না। নাকি এখানকার সব খবর যেমন ছোটকাকা জানে তপূপিসির কথাও অজানা নয়! তপুপিসি ওকে খবরটা দিয়ে নিজে থেকেই বলেছিল, তাই হোটকাকাকে বলা ওর কর্তব্য।

ছোটকাকা, তপুপিসি তোমাকে দেখা করতে বলেছে।

তপু তোকে বলেছে?

হ্যাঁ।

তোর সঙ্গে কেথায় দেখা হল? স্বৰ্গছেঁড়ায়?

না। তপুপিসি স্বৰ্গছেঁড়ায় নেই এখন। এখানে গার্লস স্কুলে কাজ করে তপুপিসি। তোমার খবর নিতে আমি একদিন ওর সঙ্গে দেখা করেছিলাম।

আমার খবর নিতে? আমার খবর ওর কাছে পাবি কী করে মনে হল।

অনেক কষ্টে অনিমেষ বলতে পারল, তোমার চিঠিটা পড়ে আমার মনে হয়েছিল।
 
প্রিয়তোষ কোনো কথা বলল না। থানার পাশ দিয়ে রুবি বোর্ডিং ছাড়িয়ে কদমতলার রাস্তায় যাচ্ছিল রিকশাটা। অনিমেষ দেখল রূপশ্রী সিনেমার সামনেটা একদম ফাঁকা, সামান্য কয়েকটা রিকশা দাঁড়িয়ে। আর ওপরে বিরাট সাইনবোর্ডে একটা ছোট ছেলে তার চেয়ে বড় একটা মেয়ের সঙ্গে দৌড়ে যাচ্ছে। সামনে একটা গাড়ি রাস্তা জুড়ে থাকায় ওদের রিকশাটা দাঁড়িয়ে গেল। অনিমেষ সিনেমার হোডিং-এ ছবির নামটা পড়ল, পথের পাঁচালী। কীরকম ছবি এটা একদম ভিড় নেই কেন? ওর মনে পড়ল আলোছায়াতে দস্যু মোন হচ্ছে, মণ্টু বলছিল ভীষণ ভিড় হচ্ছে। আর তখনই অনিমেষ সিনেমা হলের গেটের দিকে তাকিয়ে প্রায় উঠে দাঁড়াল। প্রিয়তোষ চমকে গিয়ে ওকে জিজ্ঞাসা করল, কী হল?

চেঁচিয়ে উঠল অনিমেষ, তপুপিসি!

প্রিয়তোষের কপালে সঙ্গে সঙ্গে তিন-চারটে ভজ আঁকা হয়ে গেল! মুখ ঘুরিয়ে অনিমেষের দৃষ্টি অনুসরণ করে ও সিনেমা হলের সামনেটা ভালো করে দেখল। আট-দশজন স্কুলের মেয়ে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের সামনে নীলপাড় সাদা শাড়ি পরে তপু টিকিট গুনছে। কিছু বলার আগেই অনিমেষ লাফ দিয়ে নেমে দ্রুত হেঁটে তপপিসির কাছে গিয়ে হাজির হল।

ওকে দেখতে পায়নি তপুপিসি, অনিমেষ কাছে গিয়ে ডাকল। ঘুরে দাঁড়িয়ে অনিমেষকে দেখতে পেয়ে তলুপিসি ীষণ অবাক হল, ওমা অনি, তুই কোথা থেকে এলি? সিনেমা দেখছিস?

চটপট ঘাড় নাড়ল অনিমেষ, না। তুমি দেখছ।

খুশি-খুশি মুখে পিসি বলল, হ্যাঁ। হোস্টেলের ওপর-ক্লাসের মেয়েদের নিয়ে এসেছি। এত ভালো ছবি বাংলাভাষায় এর আগে হয়নি। তুই অবশ্যই দেখবি কিন্তু।

এসব কথা এখন কানে যাচ্ছিল না অনিমেষের। ও একটু অসহিষ্ণু গলায় বলল, জান তপুপিসি, ছোটকাকা এসেছে!

ছোটকাকা? তপুপিসি যেন কথাটা মনের মধ্যে দুএকবার আওড়ে নিলেন, কবে এসেছে।

এই তো, আজ সকালে। অনিমেষ রিকশার দিকে তাকিয়ে বলল, ওই তো রিকশায় বসে আছে। একটু আগে আমরা তোমার কথা বলছিলাম, তুমি অনেকদিন বাঁচবে, দেখো।

রিকশায় বসে প্রিয়তোষ দেখল তপু মুখ তুলে ওকে দেখছে। ও ধীরেসুস্থে রিকশা থেকে নেমে দূরত্বটা হেঁটে এর। তুপ চশমা নিয়েছে মোটা কালো ফ্রেমের। খুব ভারিক্কি দেখাচ্ছে। স্কুলের মেয়েগুলো বড় বড় চোখ করে ব্যাপারটা দেখছিল। অনিমেষের দিকে কেউ-কেউ চোরা-চাহনি দিচ্ছে, কেউ মুখ টিপে হাসছে। বোঝা যায় তপুপিসিকে এরা ভয় করে, কারণ কেউ কোনো শব্দ করছে না। অনিমেষ ছোটকাকাকে বলতে শুনল, কেমন আছ তপু?

তপুপিসি বারবার ছোটকাকাকে দেখছিল। যেন সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না, প্রশ্নটা শুনতেই একটু নড়ে উঠল শরীরটা, তারপর বলল, ভালো। তুমি কেমন আছ?

হাসল ছোটকাকা, কেমন দেখছ?

বেশ আছ মনে হচ্ছে। কবে এলে?

আজ সকালে।

কদিন থাকবে?

কালই চলে যাব।

উত্তরটা শুনে অনিমেষ অবাক হয়ে গেল। ছোটকাকা যে কালই চলে যাবে একথা তো আগে একবারও বলেনি! এমনকি দাদু-পিসিমাও জানেন না।

কেন এলে?

এলাম। অনেকদিন এদিকে আসিনি, ভাবলাম দেখে যাই। তাছাড়া এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজছে সেটা সারতে হবে। এখন সেখানেই যাচ্ছি।

ও। ঠিক আছে, তোমাকে আর আটকাব না, কাজ সারো গিয়ে। আমাদেরও সিনেমা শুরু হল বলেঃ তপুপিসি আস্তে-আস্তে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল।

অনিমেষ ফ্যালফ্যাল করে এদের দেখছিল। এতদিন পরে দেখা হল অথচ ওরা কীভাবে কথা বলছে! তপুপিসির সঙ্গে ওর যেদিন শেষ কথা হয়েছিল সেদিন তপুপিসি কত ব্যাকুলভাবে ছোটকাকার কথা জিজ্ঞাসা করেছিল। অথচ আজ সেই মানুষটাকে সামনে পেয়ে কেমন দায়সারা কথা বলছে। আবার ছোটকাকা যেভাবে কথা বলছে তার উত্তর আর কীভাবেই-বা দেওয়া যায়। না, তপুপিসিকে সে কোনো দোষ দিতে পারছে না।

হঠাৎ যেন প্রিয়তোষের গলাটা অন্যরকম শোনাল, ঠিক আছে, তোমরা সিনেমা দ্যাখো, আমরা চলি।

আচ্ছা! শোনো, এই সিনেমা দেখাটা আমার যতটা আনন্দ করার জন্য, তার চেয়ে কর্তব্য করা কিন্তু একবিন্দু কম নয়। তপুপিসি মেয়েদের এগোতে নির্দেশ দিল হাত নেড়ে। সঙ্গে সঙ্গে লাইনটা সাপের মতো নড়ে এগোতে লাগল।
 
আরও খানিক বাদে যখন রিকশাটা কদমতলার মোড় ঘুরে শিল্প-সমিতিপাড়া হয়ে মাষকলাইবাড়ির দিকে যাচ্ছিল, যখন শহটার বুকজুড়ে ছুড়ে-দেওয়া হাতজালের মতো অন্ধকার আকাশ থেকে নেমে আসছিল তখন অনিমেষের মনে হচ্ছিল ও একদম বড় হতে পারেনি। এখনও অনেক অজানা ইংরেজি শব্দের মতো এই পৃথিবীর চেনা চৌহদ্দিতে অনেক কিছু অজানা হয়ে আছে। তপূপিসি আর ছোটকাকু যে-কথা সহজ গলায় বলে গেল ও কিছুতেই তা পারত না। কিন্তু ওর কাছে। এই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে আসছে যে তপপিসি আজ খুব দুঃখ পেল, সেই কতদিন আগে-লেখা চিঠিতে যে-দুঃখটা ছিল আজ একদম কিছু না বলে তার চেয়ে অনেক বড় দুখ নিয়ে তপুপিসি সিনেমা হলের। ভেতর চলে গেল। ওর মনে একটুও সংশয় নেই, এখন এই মুহূর্তে তপপিসি একটুও সিনেমা দেখছে না। অনিমেষের ইচ্ছে হচ্ছিল এখন চুপচাপ হেঁটে বাড়ি ফিরে যেতে। ছোটকাকার বিলিতি সেন্টের গন্ধ নাকে নিয়ে রিকশায় যেতে একদম ভালো লাগছে না।

মাষকলাইবাড়িতে পৌঁছতে সন্ধেটা গাঢ় হয়ে গেল। বড় রাস্তা ছেড়ে বাঁদিকের মাটির পথটায় রিকশাওয়ালাকে যেতে বলল ছোটকাকা। অনিমেষ এর আগে এইসব জায়গায় কখনো আসেনি। বাড়িঘরদোর দেখলেই বোঝা যায় সদ্য-গজিয়ে-ওঠা একটা কলোনি এটা। প্রিয়তোষ একটু অসুবিধেতে পড়েছিল প্রথমটা। খুব তড়িঘড়ি জায়গাটার চেহারা বদলেছে। কিন্তু একটা টিনের চালওয়ালা একতলা বাড়িটাকে খুঁজে বের করল শেষ অবধি। কাঁচা রাস্তটায় মিউনিসিপ্যালিটির আলো আসেনি। কেমন অন্ধকার হয়ে আছে চারধার। দুপাশের বাড়িগুলো থেকে চুইয়ে-আসা হারিকেনের আলোটুকুই এতক্ষণ রিকশাওয়ালার সম্বল ছিল। বাড়িটার সামনে এসে রিকশা থেকে নেমে পড়ল প্রিয়তোষ, তারপর অনিমেষের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে কী ভেবে নিয়ে বলল, নেমে আয়। আমি ইশারা করলে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে আসবি।

ব্যাপারটা খুব রহস্যময় লাগছিল অনিমেষের কাছে। এই অন্ধকারে এমন অপরিচিত পরিবেশ আসা, বোধহয় সেই গুরুত্বপূর্ণ কাজটা যার জন্য ছোটকাকা এসেছে তা এখানেই এবং ইশারা করলেই বেরিয়ে আসতে হবে-ও কী করবে ঠাওর করতে পারছিল না। ও বলতে গেল যে সে রিকশাতেই বসে আছে, ছোটকাকা কাজ শেষ করে আসুক। কিন্তু ততক্ষণে ছোটকাকা রাস্তা ছেড়ে সেই বাড়িটার বারান্দায় উঠে পড়েছে। অগত্যা অনিমেষ রিকশা থেকে নেমে অন্ধকারে কোনোরকমে বারান্দায় চলে এলে। প্রথমবার কড়া নাড়ার সময় ভেতর থেকে কোনো শব্দ হয়নি, এবার কেউ খুব গীর গলায় কে বলে উঠল। অনিমেষ অস্পষ্ট দেখল প্রিয়তোষ গলাটা শুনেই পকেট থেকে রুমাল বের করে চট করে মুখ মুছে নিয়ে জবাব দিল, আমি প্রিয়তোষ।

দরজা খুলতে একটুও দেরি হল না এবার। প্রিয়তোষ এগিয়ে যেতে অনিমেষ পিছু নিল। খোলা দরজার ওপাশে যিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন তার মাথায় ঘোমটা, বাঁ হাতে শাখা-নোয়া নেই। দেখলেই বোঝা যায় বিয়ে-থা হয়নি। মুখে এবং কাপড় পরার ধরনে এমন একটা ব্যাপার আছে যে তাকে পরিচিত। বিবাহিত বা অবিবাহিত মেয়েদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করা যায়। ঘরে আসবার বলতে একটা তড়পোশ আর দুটো কাঠের চেয়ার। তক্তপোশের ওপর বাবু হয়ে একজন মাঝবয়েসি মানুষ বসে আছেন। বোঝাই যায় এককালে স্বাস্থ্য খুব ভালো ছিল। মাথায় চুল আছে যথেষ্ট, কিন্তু সেগুলো অগোছালো আর ঘরের ভেতর যেটুকু হারিকেন দিচ্ছিল তাতেই চুলগুলোর অর্ধেক যে পাকা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না। একটা ফতুয়া আর লুঙ্গি পরেছেন ভদ্রলোক, নাকটা ভীষণ টিকলো। অনিমেষ দেখল ভদ্রলোকের ডান হাতটা ফুতয়ার হাত থেকে বেরোয়নি। লতপত করছে সেটা। এই প্রথম ও আবিষ্কার করল মানুষটার একটা হাত নেই।

প্রিয়তোষ ঘরে ঢুকে থমকে দাঁড়িয়েছিল। অনিমেষ দেখল ওঁরা দুজন একদৃষ্টে ছোটকাকার দিকে তাকিয়ে আছেন। ভদ্রমহিলার চোখের বিস্ময় মুখেও ছড়িয়ে পড়েছে।

ছোটকাকা বলল, তেজেনদা, আমার চিঠি পেয়েছেন?

সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রমহিলা কাঠ-কাঠ গলায় বলে উঠলেন, ঠিকানা যখন ঠিক লেখা হয়েছে তখন না পাওয়ার কোনো কারণ নেই।

ছোটকাকা বলল, এভাবে কথা বলছ কেন রমলাদি?

ভদ্রমহিলা বললেন, তোমার সঙ্গে আর কীভাবে কথা বলা যায়!

ছোটকাকা কিছু বলতে যাচ্ছিল এমন সময় ভদ্রলোক কথা বললেন। অনিমেষ শুনল ওঁর গলার স্বর বেশ গম্ভীর, এই ছেলেটি কে?

ছোটকাকা বলল, আমার ভাইপো।

একে সঙ্গে এনেছ কেন?

ছোটকাকা একটু সময় নিল উত্তরটা দিতে, ওকে নিয়ে শহরটা দেখতে বেরিয়েছিলাম, সেই থেকে সঙ্গে আছে।

তুমি কি পলিটিক্যাল আলোচনা অ্যাড করতে চাও?

এবার ছোটকাকা ঘুরে দাঁড়াল, অনি, তুই বাইরে গিয়ে অপেক্ষা কর।
 
দরজা ভেজানো ছিল। অনিমেষ আস্তে-আস্তে সেটা খুলে বাইরে এল। ওর মনে হচ্ছিল এই ঘরে একটা দারুণ কোনো ব্যাপার হবে-চলে গেলে সেটা দেখতে পাবে না ও। অথচ এর পর চলে না যাওয়া অসম্ভব। দরজাটা ভেজিয়ে ও বারান্দায় দাঁড়াল। বাইরে ঘুটেঘুটে অন্ধকার। রিকশাওয়ালাকে দেখা যাচ্ছে না। শুধু রাস্তার একপাশে রিকশার তলায় ছোট একটা লাল আলো একচক্ষু রাক্ষসের মতো ঘাপটি মেরে বসে আছে। বারান্দা দিয়ে কয়েক পা হেঁটে অনিমেষ একটা বন্ধ জানলার পাশে এসে দাঁড়াল। আশ্চর্য, ঘর থেকে কোনো শব্দ বাইরে আসছে না! ওরা কি খুব চাপাগলায় কথা বলছে কী কথা? হঠাৎ অনিমেষের মনে হল ছোটকাকার হঠাৎ করে চলে যাওয়া, এতদিন উধাও হয়ে থেকে এভাবে বড়লোক হয়ে ফিরে আসা-এতসব রহস্যের কথা এই বন্ধ ঘরের আলোচনা থেকে জানা যাবে। ওই হাতকাটা ভদ্রলোক তো বললেন পলিটিক্যাল আলোচনা হবে। অনিমেষ শুনবার কৌতূহল ওকে এমন পেয়ে বসল যে ও নিঃশব্দে বারান্দা থেকে নেমে বাড়ির এপাশটায় চলে এল। এধারের মাটি কোপানো, বোধহয় শাকসবজির গাছ লাগানো হয়েছে। অন্ধকারে পায়ে হাতড়ে ও ঘরটার একপাশে চলে এল। এদিকের জানলাটা আধা-ভেজানো, একটা পর্দা ঝুলছে। ও চুপটি করে জানলার নিচে গিয়ে দাঁড়াল। পাশেই একটা ঝাঁপড় গাছে বসে একটা পাখি ডানা ঝাঁপটে উঠল। অনিমেষ শুনল ছোটকাকা বলছে, এভাবে কথাবার্তা বলার জন্য আমি নিশ্চয়ই এতদিন পর আপনাকে চিঠি দিইনি তেজেনদা।

সঙ্গে সঙ্গে সেই মহিলা, যাকে ছোটকাকা রমলাদি বলেছেন, হিসহিস করে বলে উঠলেন, একজন বিশ্বাসঘাতক দালালের সঙ্গে এর চেয়ে দ্রভাবে কথা বলা যায় না।

ছোটকাকা উত্তেজিত গলায় বাল, তেজেনদা, আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি, এই ভদ্রমহিলাকে আপনি চুপ করতে বলুন।

তেজেনদার গলা পেল অনিমেষ, প্রিয়তোষ, তুমি হঠাৎ এলে কেন? আমি তো তোমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করিনি।

আপনি কি জানতেন আমি কোথায় আছি?

গত তিন বছর ধরে তোমার সব খবর আমি পেয়েছি। দিল্লিতে–

গলাটা হঠাৎ থেমে গেল। তার পরেই ছোটকাকার গলা ভেসে এল, বুঝতে পারছি। ঠিক আছে, আমি যা বলব আপনাকেই বলব, এই মহিলাকে এই ঘর থেকে যেতে বলুন।

কেন আমাকে কেন প্রিয়তোষ?

আশ্চর্য, আপনি আমাকে এই প্রশ্নটা করলেন!

হ্যাঁ।

আপনি আমাকে কমিউনিস্টজমে দীক্ষা দিয়েছিলেন, আপনাকে আমি গরু বলে মেনেছি।

সে তো এতকালে। সেই কোন কালে। এখন তো তুমি কমিউনিস্ট নও। আমার সঙ্গে তোমার তো কোনো সম্পর্ক নেই, তুমিই রাখনি। তা হলে এসব কথা কেন?

ছোটকাকার গলাটা কেমন শোনাল, মাঝে-মাঝে তেজেনদা আমি ভাবি। ইদানীং প্রায়ই মনে হচ্ছে আপনার সঙ্গে একটু আলোচনা কররে মনটা পরিষ্কার হবে। কোনো মানে নেই জানি, কিন্তু এককালে আমি আর আপনি দিনরাত একসঙ্গে কীভাবে কাটিয়েছি-সেগুলো আমাকে হষ্ট করে। এ-ফিলিংস শুধু আপনার আমার ব্যক্তিগত রিলেশন নিয়ে, তেজেনদা। তাই কথাগুলো শুধু আপনাকে চলতে চাই।

হুঁ। কিন্তু প্রিয়তোষ, তোমার চিঠি পাওয়ার পর আমরা পার্টি থেকে ডিভিশন নিয়েছি যে, কোনো ব্যক্তিগত আলোচনা তোমার সঙ্গে অসম্ভব। ইন ফ্যাক্ট, তোমাকে অভিযুক্ত করার জন্য রমলাকে পার্টি থেকে এখানে থাকতে বলেছে। তুমি কাল মিনিস্টারের সঙ্গে প্লেন থেকে নামার পরই আমরা মিটিং করি।

কয়েক সেকেন্ড সব চুপচাপ, তারপর ছোটকাকা বলে উঠল, আমি কোনো পার্টির কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নই। তেজেনদা, ব্যক্তিগত ব্যাপার পার্টির লেভেলে নিয়ে যাওয়ার যে প্রবণতা আপনার কাছে সেটাকে আমি ঘৃণা করি। বেশ, আমি উঠছি।

সঙ্গে সঙ্গে রমলাদি বললেন, না। উঠি বসলেই এখন ওঠা সম্ভব নয়। সত্যি কথা বলতে কি, তেজেনদার একটা অস্বস্তি থাকায় আমরা কিছু করিনি এতদিন। কিন্তু তোমার সাহস যখন এতটা বেড়ে গেছে তখন আর শেয়ার করা যায় না। তুমি জলপাইগুড়ি ঢোকার পর থেকে আমাদের ছেলেরা তোমাকে ওয়াচ করছে এবং এই মুহূর্তেও।

প্রিয়তোষের কী প্রতিক্রিয়া হল অনিমেষ দেখতে পেল না, কিন্তু ওর নিজের শরীরে কেমন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছিল এবার। ও চকিতে মুখ ঘুরিয়ে চারপাশে তাকাল। আশেপাশের বাড়িগুলো থেকে যে-আলো আসছে তাতে কোনোকিছুই ভালো করে দেখা যায় না। এই বাড়িতে কেউ কি আছে যে। ওদের ওয়াচ করছে। ছোটকাকা যদি এই শহরে আসা অবধি কেউ বা কারা ফলো করে থাকে, তবে তারা এখানেও আছে। অনিমেষের খুব অস্বস্তি হচ্ছিল, ও অন্ধকারে ঠাহর করেও কিছু দেখতে পেল না। এই যে ও এখানে দাঁড়িয়ে আছে, তাও নিশ্চয়ই ওদের নজরে পড়েছে। নাকি পড়েনি?
 
হঠাৎ রমলাদির গলা শুনতে পেল অনিমেষ, প্রিয়তোষ, তোমার বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ, পার্টির বিপর্যয়ের সময় তুমি যখন অন্যাদের মতো গা-ঢাকা দিয়েছিলে তখন তোমার হদিস কোনো কমরেড জানত না।

ছোটকাকার গলা পাওয়া গেল না। রমলা বললেন, চুপ করে থেকে সময় নষ্ট করছ। আমরা এখানে আড্ডা মারতে আসিনি। তবু কোনো উত্তর এল না ছোটকাকার কাছ থেকে। রমলাদি আবার বললেন, যাবার আগে তুমি পার্টি ফান্ড ডিল করতে, আমরা পরে হিসাব মেলাতে পারিনি। কেন?

এবারে ছোটকাকা বলে উঠল, চমক্কার। যেহেতু আমি আর পার্টির সদস্য নই, তাই এইসব আজেবাজে প্রশ্নের জবাব দিতে বাধ্য নই। তবু যখন শুনতে চাইছ তখন বলছি, আমি যা-কিছু করেছি সবই তেজেনদার আদেশে করেছি। লোকাল কমিটির ফাভে লাখ লাখ টাকা থাকে না। যা গরমিল হচ্ছে তা তেজেনদার আদেশেই হয়েছে। ব্যস!

সঙ্গে সঙ্গে তেজেনদার চিৎকার কানে এল ওর, কী, কী বললি প্রিয়? আমি তোকে বলেছি চুরি করতে? তুই পারলি বলতে এসব কথা? তোকে আমি হাতে করে গড়েছিলাম এইজন্যে?

রমলাদি বললেন, তুমি যে-কথা বলছ তা কি দায়িত্ব নিয়ে বলছ?

হঠাৎ প্রিয়তোষ চেঁচিয়ে উঠল, আমার কী দরকার দায়িত্ব নেবার! তোমরা যা অভিযোগ করছ তা কি প্রমাণ করতে পারবে কখনোই না। অতএব আমি যদি বলি তেজেনদাই সবকিছু করেছেন তোমাদের সেটা শুনতে হবে। কী করেছ তোমরা? ফিফটি টুর ইলেকশনের পর কোথায় দাঁড়িয়েছ এসে! সাধারণ মানুষকে তোমরা কখনোই কাছে আনতে পারনি, তাদের আস্থা পাওয়া তো দূরের কথা। কংগ্রেস সুইপ করে বেরিয়ে গেছে এটা তাদের ক্রেডিট, তোমাদের সজ্জা। পার্টির যখন এই হাল করেছ তখন তোমাদের কোনো কথা বলার অধিকার নেই। আমি চললাম।

তেজেনদা বললেন, তোর মতো কিছু বিশ্বাসঘাতকের জন্য আজ আমাদের এই অবস্থা। আমরা যতদিন তোদের ঝেড়ে না ফেলতে পারি ততদিন এক পা-ও এগোতে পারব না। কিন্তু মনে রাখিস, কমিউনিস্ট পার্টি চিরকাল এইভাবে পড়ে-পড়ে মার খাবে না। তুই বলতিস এককালে, তেজেনদা, আপনার একটা হাত ইংরেজদের দিয়েও আপনি এত অ্যাকটিভ? হ্যাঁ, এই পার্টি যখন মিলিট্যান্ট হবে, যখন কোনো আপস করবে না, তখন এই দেশের মানুষ আমাদের পাশে আসবেই। হয়তো আমি তখন থাকব না, কিন্তু পার্টি ক্ষমতায় আসবেই।

রমলাদির তীক্ষ্ম গলা ভেসে এল, তেজেনদা, আপনি সেন্টিমেন্টাল হয়ে যাচ্ছেন!

এবার ছোটকাকার গলার স্বর পালটে গেল আচমকো, তেজেনদা, ঝগড়া করে কোনো লাভ নেই। আমি কাদের হয়ে কাজ করছি সেটা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়, কিন্তু যেজন্য আমি আপনার কাছে এলাম তা আলোচনা করার সুযোগ দিলে ভালো করতেন।

রমলাদি বললেন, কী জন্যে তুমি এসেছ।

আস্তে-আস্তে ছোটকাকা বলল, আমরা চাই উত্তরবঙ্গের এই অঞ্চলে অ্যান্টিকংগ্রেস মুভমেন্ট শুরু হোক, টাকার জন্য তোমরা চিন্তা করো না। তেজেনদা, আন্দোলন না করলে কোনো পার্টি জনতার আস্থা অর্জন করতে পারে না।

আমাদের টাকা দেবে কে? তোরা মানে কারা? কী লাভ তোদের? তেজেনদার গলাটা কাঁপছিল।

ছোটকাকা বলল, মাপ করো, এর উত্তর আমি দিতে অক্ষম। তবে তোমাদের সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্ব আমার ওপর দেওয়া হয়েছে।

সঙ্গে সঙ্গে রমলাদি শক্ত গলায় বলে উঠলেন, তুমি কাদের হয়ে টোপ ফেলছ প্রিয়তোষ? আমাদের পার্টি ঘুষ খেয়ে কাজ করে না। তোমার সম্পর্কে যা শুনেছিলাম সেটা সত্যি তা হলে। ছি ছি, ছি!

দরজা খোলা শব্দ পেল অনিমেষ, রমলাদি, তোমাদের পার্টির নিয়ম হল কোনো প্রশ্ন না করা। ওপরতলা থেকে যখন আদেশ আসবে তখন দেখব তুমি কী করে অস্বীকার কর।

হঠাৎ রমলা বললেন, তুমি এখান তেকে বেরিয়ে যেতে পারবে না, প্রিয়তোষ।

হাসল ছোটকাকা, ভুলে যাচ্ছ কেন, এটা রাশিয়া নয়। আর এটা দেখছ, তোমার সঙ্গীদের কেউ সাহস দেখাতে এলে আমাকে এটা ব্যবহার করতে হবে।

খুব ফ্যাসফেসে গলায় তেজেনদা বললেন, প্রিয়তোষ!

ছোটকাকা বলল, আমি কাল সকাল অবধি আছি। আমার প্রস্তাব যদি ভালো লাগে খবর দিও। এবং খবরটা, রমলাদি, তুমি নিজে গিয়ে দিও। আনঅফিসিয়ালি একটা কথা বলি ফালতু গোঁড়ামি বাদ দিলে যদি আখেরে কাজ হয় তা-ই করাটাই বুদ্ধিমানের লক্ষণ।

দরজা খুলে গেল। তেজেনদা বললেন, ওর হাতে রিভিলভার আছে, বোকামি কোরো না রমলা। ছেলেদের নির্দেশ দেবার দরকার নেই। ও যেমন এসেছিল তেমনি যাক।

ঠিক এই সময় অনিমেষ ছোটকাকাকে ওর নাম ধরে ডাকতে শুনল। দুবার ডাকবার পর ছোটকাকা রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করল ওর কথা। অনিমেষের এখন একটুও ইচ্ছে করছিল না? ছোটকাকার সঙ্গে যেতে। ছোটকাকা কী? কংগ্রেসের মিনিস্টারের সঙ্গে ভাব আছে, কিন্তু কংগ্রেসি নয়। আবার কমিউনিস্ট না হয়েও কমিউন্টিদের বলে গেল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে আন্দোলন নয়। আবার কমিউনিস্ট না হয়েও কমিউনিস্টদের বলে গেল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে। ছোটকাকার সঙ্গে রিভলভার আছে ও জানতই না!


বন্দেমাতরম্ বা ইনকিলাব জিন্দাবাদের বাইরে কি কোনো দল আছে। তারা কারা? তাদের কি অনেক টাকা আছে? অনিমেষের মনে হল তারা যে-ই হোক এই দেশকে একফোঁটাও ভালোবাসে না। তারা শুধু পক্ষের মধ্যে লড়াই বাধিয়ে দিতে চায়। দাদুকে দেওয়া ছোটকাকার টাকাগুলো মনে করে ও যেন কিছু হদিস খুঁজে পাচ্ছিল না। ছোটকাকা আবার ওর নাম ধরে ডেকে উঠতে অনিমেষ নিজের অজান্তেই একটা ঘৃণা মনে লালন করতে করতে রিকশার দিকে এগিয়ে গেল।
 
আজ দুপুরে প্লেনে প্রিয়তোষ চলে যাবে। অনিমেষ ভেবেছিল এতদিন পর বাড়ি এসেএইভাবে হঠাৎ চলে যাওয়ায় দাদু নিশ্চয়ই অসন্তুষ্ট হবেন। কিন্তু কার্যত দেখা গেল হেমলতাই একটু চ্যাঁচামেচি করলেন, ভাইকে অভিমানে দুকথা শুনিয়ে দিলেন এবং খবরটা সরিৎশেখরের কাছে পৌঁছে দিয়ে অনুযোগ করতে লাগলেন। সরিৎশেখরের তখন সবে বাজার থেকে ফিরে হাতপাখা নিয়ে বসেছেন, শুনে বললেন, ও, তা-ই নাকি নাকি! কোনো তাপ-উত্তাপ নেই, আবহনও নেই, বিসর্জন নেই বড় হবার পর দাদুকে যত দেখছে তানিমেষ তত অবাক হচ্ছে। কোনো শোক-দুঃখই যেন দাদুকে তেমনভাবে স্পর্শ করে না। ছোটকাকাকে প্রথম দেখে দাদু কী নির্লিপ্তের মতো প্রশ্ন করেছিলেন, কখন এল? এখন খবরটা পাওয়ার পর মুখোমুখি হতে সেইরকম গলায় শুধোলেন, প্লেন কটায়?

প্রিয়তোষ বোধহয় এরকম আশা করেনি। ভেবেছিল দিদির মতো বাবাও রাগারাগি করবেন।

একটা পঁয়তাল্লিশ। প্রিয়তোষ নিজের ঘড়ি দেখল, আটটা বাজে।

একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যেও। তোমার দিদিকে বলে দিচ্ছি তাড়াতাড়ি রান্না শেষ করতে।

ব্যস্ত হবার কিছু নেই। অনেক দেরি আছে। প্রিয়তোষ অবাক হয়ে বাবাকে দেখছিল।

হঠাৎ সরিৎশেখর বললেন, তুমি ওই চেয়ারটায় বসো, তোমার সঙ্গে কথা আছে। বেতের চেয়ারের ওপর পাতা গদিগুলো দীর্ঘকাল না পালটানোয় কালো হয়ে গিয়েছে ময়লা জমে, প্রিয়তোষ সাবধানে বসল।

সরিৎশেখর উঠোনের পাশে বাতাসে দোল-খাওয়া বকফুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি জানি না তুমি এখন কী কর। আজ বাজারে এলাম তুমি নাকি খুবই ইনমেনশিয়াল লোক। আমার বাড়িতে এসে উঠেছ অনেকে বিশ্বাস করে না।

খুব লজ্জিত হয়ে পড়ল প্রিয়তোষ, কে বলেছে এসব কথা?

ঘাড় নাড়লেন সরিৎশেখর, যেন ছেলের প্রশ্নটাকে ঝেড়ে ফেললেন, তুমি আমার একটা উপকার করবে?

বলুন।

আমার বাড়ির চারপাশে কী দ্রুত বাড়িঘর গজিয়ে উঠেছে। একটা বড় গাড়ি ঢোকার পথ নেই। অথচ মিউনিসিপ্যালিটির প্ল্যানে আমার জন্যে রাস্তা দেখানো আছে। আমি ডি সি, মিউনিসিপ্যালিটিসবাইকে চিঠি দিয়েছি, কোনো কাজ হয়নি। এরকম চললে ক্রমশ আমার বাড়িটা বন্দি হয়ে যাবে।

প্রিয়তোষের দিকে মুখ ফেরালেন সরিৎশেখর। প্রিয়তোষ সমস্যাটা অনুধাবন করার চেষ্টা করছিল, কিন্তু আপনার রাস্তা অন্য লোক দখল করবে কী করে?

অসহায় ভঙ্গিতে সরিৎশেখর বললেন, সবই তো হয় এ-যুগে। স্বাধীতার পর আমরা যে-জিনিসটা খুব দ্রুত শিখেছি সেটা হল টাকা দিয়ে আইন কেনা যায়। এখন এ-যুগে উচিত বলে কোনো শব্দ সরকারি কর্মচারীদের কাছে আশা করা বোকামি। আমাকে ওরা বলে এই বাড়ি নিয়ে যখন এতন সমস্যা তখন ওটাকে বিক্রি করে দিন, নিস্তার পাবেন। যেন আমি নিস্তার পাবার জন্য এই বাড়ি বানিয়েছি।

প্রিয়তোষ বলল, আপনার বাড়ি তো এবার গভর্মেন্ট ভাড়া নিচ্ছে, ওদের প্রয়োজনেই রাস্তা বেরিয়ে যাবে। সরকারি গাড়ি আনার জন্য রাস্তা দরকার হবেই।

সরিৎশেখর খানিকক্ষণ ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তা হলে তোমাকে বলছি কেন?

প্রিয়তোষ বোঝাতে চাইল, না, এ তো গভর্মেন্ট নিজের গরজেই করবে, মাঝখান থেকে আপনার বাড়ির জন্যে একটা রাস্তা তৈরি হয়ে যাবে।

সরিৎশেখর আস্তে-আস্তে বললেন, কাল হয়ে যাওয়ার পর আমি জানতে পারলাম এই বাড়িতে ওরা অফিস করছে না, রেসিডেন্সিয়াল পারপাসে নিচ্ছে। আগে জানলে আমি ভাড়া দিতাম না।

কিন্তু বাড়ি ভাড়া দেওয়াটা তো আপনার বিশেষ প্রয়োজন ছিল। প্রিয়তোষ বলল।

হ্যাঁ ছিল, কারণ মানুষ শেষ বয়সে এসে কারও ওপর বাঁচার জন্য নির্ভর করে। আমার পুত্রদের কাছে থেকে সেটা আশা করা বোকামি। আমার বাড়ির কাছ থেকে আমি তা পাব, এ এখন আমাকে দেখবে। তুমি প্রায়ই বলছ, আপনার বাড়ি। যেন এই বাড়িটা শুধু একা আমারই, তোমাদের কিছু যায়-আসে না!

প্রিয়তোষ বলল, কিন্তু আমার পক্ষে তো জলপাইগুড়িতে এসে সেটলড করার কোনো প্রশ্ন ওঠে। দাদারা আছেন!

দাদারা বোলো না, দাদ-তোমার বড়দার অস্তিত্ব আমার কাছে নেই। চট করে ছেলেকে থামিয়ে দিলেন সরিৎশেখর, কি, আজেবাজে কথা বলে লাভ নেই। দেশের কত বড় বড় কাজে তোমাদের সময় ব্যয় হচ্ছে, আমার এই সামান্য উপকার যদি তোমার দ্বারা সম্ভব হয় তা হলে খুশি হব।

প্রিয়তোষ উঠল, দেখি কী করা যায়।

সরিৎশেখর বললেন, শুনলাম সেন্ট্রালের মিনিস্টারের সঙ্গে তোমার খাতির আছে। তাকে বললে তো এই মুহূর্তেই কাজ হয়ে যায়।

প্রিয়তোষ বলল, এত সাধারণ ব্যাপার তাঁকে বলা ঠিক মানায় না।

সরিৎশেখর মনেমনে বিড়বিড় করলেন, আমার কাছে তো মোটেই সাধারণ নয়! তারপর হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ায় তিনি উঠে দাঁড়ালেন, তুমি কি এখন বাইরে যাচ্ছ?

হ্যাঁ। প্রিয়তোষ ঘাড় নাড়ল।
 
দাঁড়াও। সরিৎশেখর দ্রুত ঘরের ভেতর চলে গেলেন। অনিমেষ ওর পড়ার ঘর থেকে বাইরের বারান্দাটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল। প্রিয়তোষ কাল রাত্রের পোশকটাই পরেছে এখন। দাদু ভেতরে গলে একা দাঁড়িয়ে এপাশ-ওপাশ তাকাচ্ছে। এই লোকটাকে ওর একবিন্দু পছন্দ হচ্ছে না এখন। কাল রাত্রে বাড়িতে ফেরার পর অনিমেষ ভেবেছিল কেউ হয়তো এসে ছোটকাকার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। এমনকি আজ সকালে দুবার ঘোটকাকা অনিকে বলেছে কেউ এলে যেন ডেকে দেয়। কিন্তু কেউ আসেনি। অনিমেষের মনে হল তেজেনদাদের কেউ নিশ্চয়ই আসবে না। আজ একটু আগে ছোটকাকা অনিমেষকে একটু ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, কাল রাত্রের কোনেকিছু সে শুনেছে কি না। এখন চট করে সত্যি কথা না বলতে কোন অসুবিধে হয় না। বিশেষ করে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণের উপদশটা পড়ার পর থেকে। ছোটকাকা আশ্বস্ত হয়ে ওকে হঠাৎ বিরাম করের বাড়ির পজিশনটা জানাতে বলল। অনিমেষ ভাবছিল ছোটকাকা নিশ্চয়ই তাকে সঙ্গে যেতে বলবে। কিন্তু প্রিয়তোষ ঠিকানা জেনে নিয়ে এ-বিষয়ে কোনো কথা বলল না। অবশ্য কাল স্কুল-কামাই হয়েছে, আজ না গেলে দাদু খুশি হবে না। কিন্তু মুভিং ক্যাসেলের বাড়িতে ছোটকাকা কী জন্য যাচ্ছে জানবার জন্য ওর ভীষণ কৌতূহল হচ্ছিল। অথচ কোনো উপায় নেই। ওর মনে হল একটু পরেই উর্বশীরা রিকশা করে স্কুলে চলে যাবে। ছোটকাকার সঙ্গে কি ওদের দেখা হবে?

সরিৎশেখর বাইরে এলেন হাতে একটা কাগজ নিয়ে, এটা তোমার জিনিস, নিয়ে যাও।

অনিমেষ দেখল ছোটকাকা খুব অবাক হয়ে দাদুর হাত থেকে কাগজটা তুলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী এটা?

দাদু কোনো উত্তর দিলেন না, একটা হাত শূন্যে কীভাবে নেড়ে আবার ঘরে ঢুকে গেলেন। ছোটকাকা কাগজটা টানটান করে দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে মুঠোয় পুরে মুচড়ে ফেলল। তারপর তাকে কয়েক টুকরো করে ছিঁড়ে টান দিয়ে উঠোনের একপাশে ফেলে দিল।

ছোটকাকা বেরিয়ে গেলে অনিমেষ উঠোনে নেমে এল। দাদু ঘরের মধ্যে বসে হাতপাখা চালাচ্ছেন, পিসিমা রান্নাঘরে। ও প্রায় পা টিপে টিপে ছোটকাকার ছুড়ে-ফেলা কাগজের মোড়কটা তুলে নিল। টুকরোগুলো দেখেই ওর পা-দুটো কেমন ভারী হয়ে গেল। এক টুকরোয় অনিমেষ পড়ল, কী বোকা আমি। দায় তুলে নিলাম। তপু। আর-একটা টুকরোর প্রথমেই, পৃথিবীতে চিরকাল মেয়েরাই ঠকবে, এটাই নিয়ম।

তপুপিসির সেই চিঠিটা যেটাকে সে পুলিশের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল, যেটাকে দাদু এতদিন যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন সেটার এই অবস্থা হওয়ায় অনিমেষের বুকটা কেমন করে উঠল। গতকাল সন্ধ্যায়-দেখা পাথরের মতো মুখটা মনে পড়তেই অনিমেষ বুঝতে পারল, তপুপিসি অনেক বুদ্ধিমতী। ও হঠাৎ দ্রুতহাতে কাগজগুলো কুটিকুটি করে ছিড়তে লাগল। এর একটা শব্দও যেন কেউ পড়তে না পরতে। তপুপিসির এই চিঠির প্রতিটি অক্ষরে যে-দুঃখটা ছিল সেটা যেন এখন ওর লজ্জা হয়ে পড়েছে। অনিমেষ তপুপিসিকে সেই লজ্জার হাত থেকে বাঁচাবার জন্য অক্ষরগুলো নষ্ট করে ফেলেছিল।

সেদিন স্কুলে নিশীথবাবু এলেন না। প্রথম পিরিয়ডেই ওঁর ক্লাস ছিল। প্রেয়ারের পর ক্লাসরুমে গিয়ে ওরা গল্পগুজব করছিল। গতকাল এয়ারপোর্টে যা যা ঘটেছিল অনিমেষ যখন সবিস্তারে ঘটনা ঘটে না। হোস্টেলের ছাত্রদের কারও গার্জেন এলে হেডস্যার দারোয়ান দিয়ে ডাকান, অনিমেষের বেলায় আজ অবধি এরকম হয়নি।

দারোয়ানের পিছুপিছু হেডস্যারের ঘরে গেল অনিমেষ। হেডস্যারের ঘরের সামনেই অফিস-ক্লার্ক বসেন। তিনি অনিমেষকে দেখে বললেন, তোমার বাড়ি থেকে দিয়েছে, এখনই বাড়ি চলে যাও।

অবাক হয়ে অনিমেষ বলল, কেন?

নিশ্চয়ই কোনো বিপদ-আপদ হয়েছে।

আমি কি বই-এর ব্যাগ নিয়ে যাব?

ভদ্রলোক একটু দ্বিধা করে বললেন, না, তুমি যাও। আমি দারোয়ানকে দিয়ে ক্লাস থেকে ব্যাগ আনিয়ে রাখছি, কাজ শেষ হলেই চলে এসো।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top