What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected উত্তরাধিকার - সমরেশ মজুমদার (2 Viewers)

ওকে উঠতে দেখে মণ্টুরা উঠে দাঁড়াল। মুভিং ক্যাসেল চোখ বড় বড় করে বললেন, ওমা, তোমাদের অনেকক্ষণ আটকে রেখেছি, না? কথা বলার লোক পেলে একদম খেয়াল থাকে না আমার। কথা বলতে এত ভালোবাসি আমি! কোনোরকমে উঠে দাঁড়িয়ে উনি অনিমেষের কাঁধে হাত রেখে হাঁটতে লাগলেন গেটের দিকে। মণ্টুরা আগে-আগে যাচ্ছিল। না, অনিমেষ ফিরে আসার পর থেকে মণ্টু একটাও কথা বলেনি। মুভিং ক্যাসেলের ধীরে চলার জন্য মণ্টুদের সঙ্গে দূরত্বটা বেড়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ উনি ফিসফিস করে বললেন, তোমার ওই বন্ধুটা কিন্তু মোটেই ভালো নয়। ওর দাদা পি এস পি করে?

অনিমেষ বলল, জানি না। মুভিং ক্যাসেলের নরম হাতের চাপ ক্রমশ ওর কাঁধের কাছে অসহ্য হয়ে আসছিল। সেই মিষ্টি গন্ধটা ওকে এখন ঘিরে ধরেছে।

মুভিং ক্যাসেল বললেন, তোমার মতো ওর মন পরিষ্কার নয়। একটু সতর্ক হয়ে মিশো ওর। সঙ্গে। আর হ্যাঁ, আমাদের সে স্টুডেন্টস সংগঠন আছেন তাতে তোমার জয়েন করার দরকার নেই। তুমি,-তোমাকে দিয়ে অন্য কাজ করাবার প্ল্যান আছে।

অনিমেষ কিছু বলল না। ওরা গেটের কাছে এসে পড়তেই উনি দাঁড়িয়ে পড়ে অনিমেষের কাঁধ থেকে হাতটা নামাতে নামাতে ওর চিবুক ধরে নেড়ে দিলেন, ছেলের চিবুকটা এত সুন্দর যে কী বলব? তারপর গেটটা বন্ধ করে বললেন, কালকে এসো।

ওরা দেখল মুভিং ক্যাসেলের ফিরে যাওয়ার সময় সমস্ত শরীর নাচছে, শুধু কুকুরটা সঙ্গে নেই বলে যা মানাচ্ছে না। আচ্ছা, কুকুরটাকে সে সারা বাড়িতে দেখল না তো! মণ্টু মুভিং ক্যাসেলের দিকে তাকিয়ে বলল, বহুত খচ্চর মেয়েছেলে।

তপন সঙ্গে তাল দিল, হোলি মাদার গোয়িং ব্যাক।

অনিমেষ এখন আর কিছু বলতে পারল না। ওদের। মণ্টু যদি জানতে পারে রম্ভা ওকে চুমু খেয়েছে তা হলে কী করবে? এই পৃথিবীর কাউকে কখনো একথা বলা যাবে না।

তপন বলল, এতবড় মেয়েছেলে, এখনও কচি খুকি হয়ে আছে। মাসিমা বোলো না-বউদি বলো। পেয়াজি!

অনিমেষ ওদের এমন রাগের কারণ ঠিক বুঝতে পারছিল না।

মণ্টু বলল, আমাকে বলে কিনা তুমি ভুল পথে চলছ তোমার দাদার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। কংগ্রেসে এলে তুমি কত সুযোগ-সুবিধে পাবে-অনির মাথা চিবিয়েছে, এবার আমারটার দিকে লোভ।

হঠাৎ তপন বলল, গরু, এতক্ষণ কী খেলে এলে ভেতরে বুকে হাত দিয়ে জ্বল দেখলে?

অনিমেষ রাগতে গিয়েও পারল না, কোনোরকমে বলল, কী হচ্ছে কী!

তপন বলল, হোলি মাদারের একজিবিশন দেখলাম অমরা, এতক্ষণ হোলি ডটার কি তোমাকে গ্রামার পড়াল?

অনিমেষ কোনো উত্তর না দিয়ে হাঁটতে শুরু করতেই দেখল বাগান পেরিয়ে উর্বশীর ঘরের এদিকের জানালাটা দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল। তপন আর মণ্টু সেদিকে চেয়ে চাপা গলায় কী-একটা কথা বলে এগোতে গিয়ে আবার থমকে দাঁড়াল। অনিমেষ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে দেখল, মটু পকেট থেকে কালোমাতন কী একটা বের করে চটপট গেটের গায়ে বিরাম করের নামটার আগে বিরাট অ: লিখে গম্ভীরমুখে হাঁটতে লাগল।

আচমকা ঘটনাটা ঘটে যাওয়ায় অনিমেষ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে পড়ল। ও এগিয়ে-আসা মণ্টুর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল, একটু আগের সেই বিরক্তিটা আর একদম সেখানে নেই। অনিমেষ নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না।
 
ভাড়াটে আসার পর তেরাত্তিরও কাটেনি সরিৎশেখর অস্থির হয়ে উঠলেন। তিস্তা বাঁধ প্রকল্প অফিস বাড়ি ভাড়া নিচ্ছে, সইসাবুদ চুক্তি হয়েছে, উনি ভেবেছিলেন আর-পাঁচটা সরকারি অফিস যেমন হয় তেমনি দশটা-পাঁচটার ব্যাপার, সকাল সয়ে রাত নিশ্চিন্ত থাকা যাবে। অফিস হলেই গাড়ি আসবে ফলে সরিৎশেখর নিজে যা অনেক চেষ্টা করেও পরেননি সরকার নিজের প্রয়োজনেই বাড়ির দরজা অবধি রাস্তা বের করে নেবে। কিন্তু সেসব কিছুই হল না। প্রকল্পের দুজন ইঞ্জিনিয়ার তাঁদের ফ্যামিলি নিয়ে এসে উঠলেন এ-বাড়িতে। রেগেমেগে সরিৎশেখর চুক্তিপত্রটা খুলে দেখলেন তার হাত-পা বাঁধা। তিনি শুধু সরকারকে বাড়িভাড়াই দিয়েছেন, কিন্তু কোথাও বলেননি যে পরিবার নিয়ে কেউ বসবাস করতে ফ্যামিলি নিয়ে থাকবার জন্য ভাড়ার প্রস্তাব তিনি নাকচ করেছেন। দিনে-দিনেই বাড়ির মদ্যে কাঠের একটা পার্টিশন হয়ে গেল, দেওয়ালে পেরেকের শব্দ হতেই সরিৎশেখরের মনে হল ওঁর বুক ভেঙে যাচ্ছে। তড়িঘড়ি ছুটে গেলেন ঘটনাস্থলে, চিৎকারে চ্যাঁচামেচিতে কোনো কাজ হল না, মিস্ত্রিগুলো বধিরের মতো কাজ শেষ করে গেল। সেই বিকেলেই সাধুচরণের কাছে ছুটলেন সরিৎশেখর। সাধুচরণ এখন আর তেমন শক্ত নন। মেয়ে মারা যাবার পর স্ত্রী একদম উদ্যেম পাগল হয়ে গিয়েছিলেন, সম্প্রতি তিনিও গত হয়েছেন। দুই ছেলে বিয়ে করে আলাদা হয়ে গিয়েছে, পাগলের সংসারে তারা থাকতে চাননি। ফলে সাধুচরণের কী অবস্থা তা জানতে বাকি ছিল না সরিৎশেখরের। তবু ওঁরই কাছে ছুটলেন তিনি, বিষয়-সম্পত্তির ব্যাপারে লোকটার বুদ্ধি খেলে খুব। সাধুচরণ সব শুনে খানিকক্ষণ চিন্তা করে বললেন, আপনি এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন?

উত্তেজিত হব না? কী বলছ তুমি! আমার বুকে বসে ওরা পেরেক ঠুকবে, সহ্য করব? ও–বাড়ি আমার ছেলের চেয়েও আপন, বারো ভূতে লুটেপুটে খাবে, আমি দেখব?

আহা, আপনি বাড়ি ভাড়া দিয়েছেন, কে থাকল বা না-থাকল তাতে আপনার কী দরকার! শুধু যদি ওরা কিছু ড্যামেজ করে তা হলেই লিগ্যাল অ্যাকশন নেওয়া যেতে পারে।

তুমি বলছ আইন আমাকে সাহাযৗ করবে না?

ঠিক এই মুহূর্তে নয়। যারা আসছে তাদের সঙ্গে মানিয়ে গুছিয়ে যদি থাকা যায় তা হলে খারাপ কী। আপনারা একা একা থাকেন, বিপদে-আপদে কাজ দেবে। তা ছাড়া, আপনার মেয়ে তো একদম নিঃসঙ্গ, ভাড়াটে মেয়েদের সঙ্গে ভাব হয়ে গেলে দেখবেন ও খুশি হবে।

সরিৎশেখর তুব মেনে নিতে পারছিলেন না, দিনরাত চা-ভ্যা এই বয়সে সহ্য হবে না। দেওয়ালে থুতু ফেলবে, পেন্সিল দিয়ে লিখবে, আমার বিলিতি বেসিনগুলো ভাঙবে, ওঃ, কী দুর্মতি হয়েছিল। তখন রাজি হয়ে গেলাম!

বললেন সাধুচরণ, উঁহু, রাজি না হলে বাড়ি ওরা জোর করে নিয়ে নিত। সরকার তা পাবে। তৎ আঙুল কামড়াতে হত।

কথাটা খেয়াল ছিল না সরিৎশেখরের। সাধুচরণের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকালেন তিনি। হঠাৎ ওর মনে হল, ছেলেদের মতো এই বাড়িটাও বোধহয় তাকে শেষ বয়সে জ্বালাবে। সাধুচরণ হঠাৎ ওঁর দিকে মুখ তুলে মিটিমিটি হাসতে লাগলেন।

ভ্রূ কুঁচকালেন সরিৎশেখর, হাসছ কেন?

তেমনিভাবে সাধুচরণ বললেন, কথায় আছে রাজার মাও ভিখ মাঙে।

বুঝতে পারলেন না সরিৎশেখর, মানে?

বাঃ, আপনার ছোট ছেলে থাকতে কোনো চিন্তার মানে হয় না।

ছোট ছেলে! প্রিয়তোষ?

হ্যাঁ শুনেছি তার কথায় নাকি কংগ্রেসিরা উঠে বসে। মন্ত্রীর সঙ্গে খুব ভাব। ও আপনার বাড়িতে এসে থাকেনি?

সরিৎশেখর ঘাড় নাড়লেন, কমিউনিস্ট ছোঁড়ারা ওর খোঁজে এসেছিল।

তা-ই নাকি! আমি তো শুনে অবাক। কমিউনিস্ট ছিল বলে ঘর ছেড়ে পালাল যে-ছেলে তার এখন এত খাতির! জলন্ধরের পাঁজির বিজ্ঞাপনের মতো ব্যাপার, যাক, তাকে আপনি বলুন এইসব কথা, সঙ্গে সঙ্গে কাজ হয়ে যাবে।

ঘাড় নাড়লেন সরিৎশেখর, সে চলে গিয়েছে।

তাকে আসতে লিখুন।

এতক্ষণ পর সরিৎশেখরের খেয়াল হল প্রিয়তোষকে ওর ঠিকানার কথা জিজ্ঞাসা করা হয়নি। এমনকি সে কোথায় গেল তাও বলে যায়নি। হয়তো তাড়াহুড়োয় সময় পায়নি, হয়তো পরে চিঠি দেবে, কিন্তু সেকথা সাধুচরণকে বললে কাল সমস্ত শহর জেনে যাবে। হেমলতা হয়তো প্রায়ই বলে যে, বাবা, কিন্তু সেকথা সাধুচরণকে বললে কাল সমস্ত শহর জেনে যাবে। হেমলতা প্রায়ই বলে যে, বাবা, আপনার পেট আলগা তাঁকে ফিরিয়ে দেয় সরিৎশেখর এখন তাই ধীরে ধীরে ঘাড় নাড়লেন, যেন সাধুচরণের এই প্রস্তাবটা তার খুব মনঃপূত হয়েছে। কিন্তু রায়কতপাড়ার রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে কিছুতেই তিনি স্বস্তি পাচ্ছিলেন না।
 
অনিমেষ দাদুর ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছিল না। সরকার বাড়ির ভাড়া দেবে, কে থাকল বা–থাকল তাতে কী এসে যায়! ওর নিজের খুব মজা লাগছিল। ওদের বাড়িতে নতুন কিছু মানুষ এসে কছে, রেডিওতে হিন্দি গান বাজছে, এটা কল্পনায় ছিল না। সরিৎশেখর বাইরের বারান্দায় দাঁড়ানো একজন মহিলাকে দ্রভাবে বলতে গেলেন যে জোর হিন্দি গান বাজলে হেমলতার পুজোআচ্চার অসুবিধে হবে, বরং শ্যামাসঙ্গীত কীর্তন আর খবর শুনলে মন ভালো থাকে। কথাটা শুনে মহিলা হেসেই বাঁচেন না, বললেন, দাদু, আপনি কী কী পছন্দ করেন না তার একটা লিস্ট দিয়ে দেবেন। হিন্দি গান ভালো না, বুঝলাম। রবীন্দ্রসংগীত?

সরিৎশেখর সুরটা ধরতে পারেননি, রবি ঠাকুরের গান? না মা, ও বড় প্যানপেনে। ওই এখন যা হয়েছে আধুনিক না ফাধুনিক-ওসব একই ব্যাপার!

মহিলা এত জোরে হেসে উঠলেন যে, সরিৎশেখর আর দাঁড়ালেন না। কথাটা শুনে হেমলতা রাগ করতে লাগলেন, কী দরকার ছিল আপনার গায়ে পড়ে ওসব কথা বলার! নিজের সম্মান রাখতে পারেন না।

সরিৎশেখর বললেন, তোমার পূজোর অসুবিধে হবে বলেই-

ঝাঁঝিয়ে উঠলে হেমলতা, আমার জন্যে চিন্তা করে যেন আপনার ঘুম হচ্ছে না! আমি কি কিছু বুঝতে পারি না? হিন্দি গানস, রবীন্দ্রসংগীত, এসব তো আপনার চিরকালের কর্ণশূল। নি পর্যন্ত রেডিওতে হাত দেয় না তাই।

সরিৎশেখর শেষবার হুঙ্কার ছাড়ার চেষ্টা করলেন, আমার বাড়িতে মাইক বাজাবে আমি সেটা সহ্য করব!

আকাশ থেকে পড়লেন হেমলতা মাইক? বুড়ো বয়সে আপনার কথাবার্তার যা ছিরি হয়েছে না! মেয়েটা কী ভালো! বেচারাকে মামার বুড়ো ভরের কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছে, সাধ-আহ্লাদ করার সুযোগ পেল না।

কথাটা শুনে তাজ্জব হয়ে গেলেন সরিৎশেখর, তুমি জানলে কী করে?

বাঃ, আপনি যখন বাড়ি ছিলেন না তখন ও তো আলাপ করতে এসেছিল, আমার আমের আচার খেয়ে কী প্রশংসাটাই-না করল!

সরিৎশেখর মনেমনে বেশ দমে গেলেন। ওঁর আড়ালে বেশ একটা ষড়যন্ত্র চলছে এই বাড়িতে। অনেকদিন থেকেই তিনি হেমলতাকে সন্দেহ করেন। পরিতোষ বউকে নিয়ে এল এমন সময় যখন তিনি বাড়ি নেই। পরেও এসেছে কি না না কে জানে। তিনি তো আর সবসময় বাড়িতে থাকেন না। মহীতোষ যখনই আসে তার সঙ্গে দুএকটা কথা বলার পর রান্নাঘরে গিয়ে দিদির কাছে চুপচাপ বসে। থাকে। কী কথা বলে কে জানে! ইদানীং নাতিটাও তার কাছাকাছি ঘেঁষে না, নেহাত প্রয়োজনে। দুএকটা কথা হয় অথচ দিনরাত পিসির সঙ্গে ফুসফুস গুজগুজ চলছে। প্রিয়তোষ অ্যাদ্দিন পর বাড়ি ফিরল, তার সঙ্গে আর কটা কথাই-বা হল! হেমলতা অনেক রাত অবধি ছোট ভাই-এর সঙ্গে গল্প করছে এটা টের পেয়েছেন তিনি। সাধুচরণের কথাটা মনে পড়ে যাওয়ায় বেশ শক্ত গলায় এখন সরিৎশেখর জিজ্ঞাসা করলেন, প্রিয়তোষ ওর ঠিকানা তোমাকে দিয়ে গেছে, না?

চট করে প্রসঙ্গ পালটে বাবা একথা জিজ্ঞাসা করায় প্রথমে একটু অবাক হয়েছিলেন হেমলতা, তারপর বললেন, আমাকে দিয়েছে কে বলল?

সরিৎশেখর জেরা করার ভঙ্গিতে বললেন, দেয়নি?
 
আর সামলাতে পারলেন না হেমলতা বাবার কূটচালটা ধরে ফেলে চেঁচিয়ে উঠলেন, আপনি আপনার ছেলেদের চেনেন না? এ-বংশের ব্যাটাছেলেরা কোনোদিন মেয়েদের সঙ্গে খোলামনে কথা বলেছে। আমরা তো ঝিগিরি করতে এসেছি আপনাদের বাড়িতে। কথাটা বলে আর দাঁড়ালেন না হেমলতা, হনহন করে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। সরিৎশেখর আর কিছু বললেন না। এই মেয়েকে তিনি চটাতে সাহস পান না। আজ সাধুচরণের যে-দশা সেটা তার হলে তেরাত্তিরও কাটবে না। তার জন্য স্পেশাল ভাত তরকারি থেকে ওরু করে কফ ফেলার বাক্স পর্যন্ত ঠিক করে দেওয়া হেমলতা ছাড়া আর কেউ পারবে না। নিজের জন্যেই চুপচাপ সব হজম করে যেতে হবে। নিঃশব্দে লাঠি আর টর্চ নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন সরিৎশেখর। সন্ধেবেলায় কালীবাড়ির বাধানো চাতালে বসে আরতি দেখলে মনটা খানিকক্ষণ চিন্তামুক্ত থাকে, ইদানীং এই সত্যটা আবিষ্কার করেছেন তিনি। রাত হলেই বাড়িটা নিঝুম হয়ে যেত। এদিকটায় তিস্তার চর বেশি দূরে নয় বলেই সন্ধের পর। শেয়ালগুলো তারস্বরে ডাকাডাকি করে। নদী যখন টইটম্বুর হয়ে যায়, এপার-ওপার হাত মেলায়, তখন শেয়ালগুলো এসে এপারের কিছু ঝোপজঙ্গলে দিব্যি গর্ত খুঁড়ে লুকিয়ে থাকে। অনিমেষ দিনদুপুরে কয়েকটাকে বাগান থেকে তাড়িয়েছে, নেহাতই নেড়িকুত্তা-মার্ক নিরীহ চেহারা। পিসিমা তো সেই ভুলটাই করে ফেললেন। একদিন রাত্তিরে খাওয়াদাওয়ার পর বাসন ধুতে গিয়ে দেখলেন, একটা কুকুর ধুকতে ধুকতে ওঁর দিকে তাকিয়ে উঠোনে বসে আছে। কী মনে হল, এঁটোকাটা ছুড়ে দিতে সেটা ভয়েভয়ে গুড়ি মেরে এগিয়ে এসে খেয়ে গেল। পরদিনও একই ব্যাপার। আস্তে-আস্তে জীবটার ভয় কমে গেল। উঠোনে আলো কম, ভোল্টেজ এত অল্প যে একশো পাওয়া টিমটিম করে, তার ওপর। হেমলতা চোখে খুবই কম দেখছেন, ঠাওর করতে পারেনি। একদিন সরিৎশেখরকে বললেন কুকুরটার কথা, বাড়িতে রাত্রে আসে, যখন-তখন চোরটোর আসতে পারবে না। অনিমেষও শুনেছিল, সেদিন দেখল। খাওয়াদাওয়ার পর পিসিমা এটোর সঙ্গে একটা আস্ত রুটি নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ডাকতে লাগলেন, সিধু, ও সিধু, আয় বাবা, সিধু। পিসিমা কুকুরটার নাম রেখেছেন সিধু। নিজের ঘরের কাচের জানালায় মুখ রেখে কৌতূহলী হয়ে অনিমেষ দেখল কয়েকবার ডাকার পর বাগানের জঙ্গলটায় ঝটপট শব্দ হল। তারপর একটা শেয়াল প্রায় দৌড়ে পিসিমার সামনে এসে দাঁড়াল। পিসিমা খাবারগুলো মাটিতে রেখে দিতেই সে চেটেপুটে খেতে লাগল। বিস্ময়ে থ হয়ে গেল অনিমেষ। সত্যিই শেয়ালটার চেহারার সঙ্গে কুকুরের যথেষ্ট মিল আছে, তাই বলে অত কাছে দাঁড়িয়ে পিসিমা ভুল করবেন? অনিমেষ ভাবতে পারেনি শেয়ালের এত সাহস হবে। তবে কুকুরটার রাত্তিরবেলায় শুধু চুপচাপ আসাটা কেমন ঠেকছিল। পরদিন যখন ও পিসিমাকে বলল পিসিমা তো বুঝতে পারছি না। তুই আবার বাবাকে বলিস না। হাজার হোক কৃষ্ণের জীব তো, আর ডাকলেই কেমন আদুরে-আদুরে মুখ করে চলে আসে। পিসিমা নিজেই যেন স্বস্তি পাচ্ছিলেন না ওটা শেয়াল শোনার পর থেকে।

এইরকম একটা পরিবেশে নতুন মানুষজন এসে যাওয়ায় সন্ধের পর আর নির্জন থাকল না। তবে যা-কিছু আওয়াজ শোরগোল হচ্ছে তা বাড়ির ওদিকটায়। নতুন বাড়ির দুখানা ঘর সরিৎশেখর নিজেদের জন্য রেখে দিয়েছেন। তার আসা-যাওয়ার পথ আলাদা। ভাড়াটেরা দুটো ফ্লাট করে নিয়েছেন। একটাতে মহিলা আর তার স্বামী, অন্যটায় যিনি থাকেন তাঁর বোধহয় বেশিদিন চাকরি নেই, দেখতে বৃদ্ধ মনে হয়। তার ছেলে আর চাকর আছে। ছেলেটি অনিমেষদের চেয়ে কয়েক বছরের। বড়, সবসময় পাজামা তার গেরুয়া পাঞ্জাবি পরে। আনন্দচন্দ্র কলেজে পড়ে ও, মহিলা এসে পিসিমাকে বলে গিয়েছেন। পিসিমার সঙ্গে খুব ভাব হয়েছে গেছে ওঁর। আজ বিকেলে অনিমেষের সঙ্গে আলাপ হতে উনি জোর করে ওকে ওদের ঘরে নিয়ে গেলেন।
 
মহিলার নাম জয়া, ঘরে ঢুকেই তিনি বললেন, আমাকে তুমি জয়াদি বলে ডাকবে ভাই। আমার কর্তার দিকে তাকালে অবশ্য আমাকে মসিমা বলতে হয়, তোমার কী ইচ্ছে করছে।

অনিমেষ হেসে বলল, আমার কোনো দিদি নেই, আমি দিদি বলব।

বসবার ঘরে পা দিয়ে সত্যি মজা লাগছিল ওর। এই ঘরগুলো কদিনে জব্বর ভোল পালটেছে। সুন্দর বেতের চেয়ার, দেওয়ালে একটা বিরাট ঝরনার ক্যালেন্ডার আর মস্ত বড় একটা বুককেস-তাতে ঠাসা বই।

জয়াদি বললেন, তুমি কোন ক্লাসে পড়? অনিমেষ গর্বের সঙ্গে উত্তরটা দিল। ও বাবা, তা হলে তো তোমাকে খুব পড়তে হচ্ছে, আমি ডেকে আনলাম বলে পড়ার ক্ষতি হল না?

না না। আমি বিকেলবেলায় পড়তে পারি না তো!

তুমি কারও কাছে প্রাইভেট পড়?

আগে পড়তাম। টেস্টের পর কোচিং ক্লাসে ভর্তি হব।

তোমার বই পড়তে ভালো লাগে?

বই-পড়ার বই?

হুঁ পড়ার বই, গল্পের বই, কবিতার বই।

পড়ার বই-এর মধ্যে অঙ্কটা আমার একদম ভালো লাগে না। আমি চার রকমের অঙ্ক খুব। ভালোভাবে শিখেছি, যে-কোনো প্রশ্নই আসুক শুধু তা দিয়েই চল্লিশ নম্বর পেয়ে যাই।

তা-ই নাকি! যা! সত্যি! সরল, চলিত নিয়ম, ল, সা. গু., গ. সা. গু. আর সুদের অঙ্ক।

জয়াদি শুনে শব্দ করে হেসে উঠলেন। তারপর বললেন, আমি তোমার সব খবর জেনে নিচ্ছি বলে কিছু মনে করছ না তো?

না।

আচ্ছা, এবার বলো গল্পের বই কী কী পড়েছ।

অনিমেষ একপলক চিন্ত করে নিল, বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ, বিবক্ষ, কপালকুণ্ডলা, সীতারাম। নীহারঞ্জন গুপ্তের কালো ভ্রমর-

সঙ্গে সঙ্গে আবার হাসি জয়াদির। হাসতে হাসতে বললেন, তুমি কালো ভ্রমর পড়েছ। ওঃ, দারুণ না? দস্যু মোহন ও বাবা, তাও পড়েছ! কিন্তু শোনো, তোমাকে একটা কথা বলি, প্রায় একশো বছর আগে বঙ্কিমচন্দ্র যেসব বই লিখেছেন সেগুলোকে আমরা বলি অমর সাহিত্য। অমর মানে যা কোনোদিন পুরনো হয় না। আর কালো ভ্রমর হচ্ছে আইসক্রীম খাওয়ার মতো, ফুরিয়ে গেলেই শেষ। তাই কখনো আনন্দমঠের সঙ্গে কালো ভ্রমরের নাম একসঙ্গে কোরো না। তা হলে বঙ্কিমচন্দ্রকে অশ্রদ্ধা করা হয়।

এভাবে কেউ তাকে লেখকদের চিনিয়ে দেয়নি, অনিমেষ জয়াদিকে আরও পছন্দ করে ফেলল, আমাকে এখান থেকে বই পড়তে দেবেন? আঙুল দিয়ে ও বুককেসটাকে দেখাল।

নিশ্চয়ই, কিন্তু আর-কাউকে দেবে না। বই অন্যের হাতে গেলে তার পা গজিয়ে যায়। ঠিক আছে, আমি তোমাকে বই বেছে দেব। প্রথমে বঙ্কিচন্দ্রের সব বই তুমি পড়বে, তারপর শরৎচন্দ্র–।

আমি শরৎচন্দ্রের রামের সুমতি পড়েছি। অনিমেষ মনে করে বলল।

আচ্ছা। তারপর রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ পড়া হয়ে গেলে তোমার সব পড়া হয়ে যাবে।

রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতা আমার মুখস্থ। ভীষণ ভালো, না?

যত বড় হবে তত ভালো লাগবে। কিন্তু তুমি পড়বে কখন, তোমার তো স্কুরে পড়ার চাপ এখন?

একটুও দেরি করল না অনিমেষ, বিকেলবেলায় পড়ব। এখন থেকে আর বিকেলে খেলতে যাব না, খেললে রাত্রে পড়ার সময় ঘুম আসে। .

বেশ তা হলে বিকেলে এখানে বসে আরাম করে পড়বে, রোজ বাড়িতে নিয়ে গেলে পড়ার বই-এর তলায় গল্পের বই লুকিয়ে রাখবে, পড়া হবে না।

অনিমেষ হেসে ফেলল, আমি কাল একটা বই কিছুতেই ছাড়তে পারছিলাম না বলে ওরকম করে পড়েছি। দাদু অল্পের জন্য ধরতে পারেননি।

কী বই সেটা?

পথের পাঁচালী। এখন যে-সিনেমাটা হচ্ছে রূপশ্রীতে, সেই বইটা। ক্লাসের একটা ছেলের কাছ থেকে এনেছি। তুমি পড়েছ?

হঠাৎ যে ও তুমি বলে ফেলেছে অনিমেষ নিজেই খেয়াল করেনি। জয়াদি আস্তে-আস্তে বলল, দুর্গাকে তোমার কেমন লাগে?

মুহূর্তে বুক ভার হয়ে গেল অনিমেষের, দুর্গার জন্য আমি কেঁদে ফেলছিলাম, ওঃ, কী ভালো। আর জান, পড়তে-পড়তে নিজেকে অপু বলে মনে হয়।
 
জয়াদির সঙ্গে রিকশায় যেতে-যেতে অনিমেষ বইটা যে পথের পাঁচালী তা জানতে পারল। আজ শেষ শো, কাল রবিবার থেকে অন্য বই। শুক্রবার থেকে এখানে নতুন ছবি দেখানো হয়, কিন্তু এবার। কিছু গোলমাল হয়ে যাওয়ায় পুরনো ছবিটা থেকে গেছে। হলের সামনে এসে দাঁড়াতেই তপপিসি আর ছোটকাকার কথা মনে পড়ে গেল ওর। তপূপিসির সঙ্গে জয়াদির অনেক মিল আছে। জয়াদিও যেটুকু নইলে নয় তার বেশি সাজে না। অনিমেষ দেখছে যাকে ভালো লেগে যায় তার সঙ্গে সবসময় ভালোলাগা মানুষগুলোর অদ্ভুত একটা মিল পাওয়া যায়।

জয়াদি এবং অনিমেষ পাশাপাশি বসে ছবিটা দেখল। হরে আজকে একদম দর্শক নেই। অনেকদিন বাদে সিনেমা দেখতে এল অনিমেষ। মূল ছবির আগে গর্ভমেন্টের ঝবি দেখাল, তাতে জওহরলাল নেহরু, বিধানচন্দ্র রায়কে দেখতে পেল ও। একবার গান্ধীজিকে এক হয়ে গেল তার অজান্তে। তারপর দুর্গা মারা যেতে সেই বৃষ্টির রাত্রে ছাদের ঘরে শুয়ে-থাকা মাধুরীর মুখটাকে দেখতে পেল ও। সঙ্গে সঙ্গে ড়ুকরে কেঁদে উঠল অনিমেষ। ওর সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল। জয়াদির একটা হাত ওর পিঠে এসে নামল, এই, কেঁদো না, এটা তো সিনেমা, সত্যি নয়।

অনিমেষ বুঝতে পারল কথা বলার সময় জয়াদির গলার স্বর জড়িয়ে যাচ্ছে, জয়াদি কোনোরকমে কান্নাটাকে চেপে যাচ্ছেন।

ছবি শেষ হবার পর গম্ভীর হয়ে গেল অনিমেষ। ওর মনে হল ও যেন নিজের কখন অপু হয়ে গিয়েছে। জয়াদিও আর কোনো কথা বলছেন না। সন্ধে হবার অনেক আগেই ওরা রিকশায় চেপে বাড়িতে পৌঁছে গেল। পথের পাচালী সদ্য-সদ্য পড়া ছিল অনিমেষের, তার ওপর এই ছবি দেখা, দুই-এ মিলে অদুত একটা প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে গেল ওর মদ্যে। যা বঙ্কিমচন্দ্র শরৎ এমনকি রবীন্দ্রনাথ পারেননি, বিভূতিভূষণ সেটা সহজে যেন পেরে গেলেন। অনিমেষের খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, ও যদি কখনো কলকাতায় যেতে পারে তা হরে বিভূতিভূষণের কাছে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকবে।ত

দ্বিতীয় ভাড়াটের ছেলেটিকে অনিমেষ কয়েকবার দেখেছে, খুব ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে অথবা ঢুকছে, কিন্তু আলাপ হয়নি। জয়াদির সঙ্গে ওদের আলাপ নেই এটা বুঝতে পেরেছে অনিমেষ, ওদের বাড়িতে মহিলা নেই বলেই বোধহয়। জয়াদির স্বামী খুব গভীর। ওকে দেখলে কেমন আছ, বসো, এর বেশি কোনো কথা বলেন না। না বলে দিলে উনি যে জয়াদির স্বামী বোঝা মুশকিল। মাথার চুল সব পাকা, চোখে খুব পাওয়ারওয়ালা কালো ফ্রেমের চশমা। বরং অন্য ভাড়াটে, যিনি ওই ছেলেটির বাবা, তাকে খুব ভালোমানুষ মনে হয়। দাদু যখন এন্তার অভিযোগ করে যান তখন চুপচাপ মাথা নেড়ে শোনেন। রিটায়ার করার সময় হয়ে গেছে ওঁর, মাথায় একটাও চুল নেই।

তা ছেলেটার সঙ্গে অদ্ভুতভাবে আলাপ হয়ে গেল ওর। একদিন বিকেলে ও স্কুল থেকে ফিরেছে এমন সময় দেখল গেটে পিয়ন দাঁড়িয়ে, হাতে একটা পার্সেল। ওকে দেখতে পেয়ে পিয়ন জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, সুনীল রায় বলে কেউ থাকে এখানে?

সুনীল আশ্চর্য অনিমেষ এরকম নামের কাউকে চিনতে পারল না, না তো!

কী আশ্চর্য। দুদিন ধরে ঘুরছি, হামিপাড়া নিয়ার টাউন ক্লাব। একটু আগে একটা ছেলে বলল, এই বাড়িতে হবে। অচেনা লোকের নামের আগের কেয়ার অফ দেয় না কেন? যেন সবাই বিধান রায়। হয়ে গেছে! বিরক্ত হয়ে পিয়ন চলে যাচ্ছিল।

খুব হতাশ হল সুনীল, কী আশ্চর্য! আচ্ছা, তুমি এখানে বসো। হাত দিয়ে বিছানার একটা দিক দেখিয়ে দিল ও। অনিমেষ বসতে এই তিনটে ওর সামনে রেখে বলল, সুকান্ত হল কবি, নবজাগরণের কবি। ওর কবিতা পড়লে রক্ত টগবগ করে ওঠে। আমাদের এই ভাঙাচোরা সমাজ, বুর্জোয় শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কবিতা লিখেছে। সুনীল বলল, শুনবে শেষ চারটে লাইন?

অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, ওর খুব কৌতূহল হচ্ছিল। সুনীল কেমন অন্যরকম গলায় কবিতা পড়ল,

এবার লোকের ঘরে ঘরে যাবে
সোনালি নয়কো, রক্তে রঙিন ধান,
দেখবে সকালে সেখানে জ্বলছে
দাউ দাউ করে বাংলা দেশের প্রাণ।

তারপর চোখ বন্ধ করে বলল,

কবিতা তোমায় দিলাম ছুটি
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়।
পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।

এরকম কবিতা এর আগে শুনেছ? কবিতা বলতে তো বোঝ প্যানপেনে চাঁদফুল আর প্রেমের ন্যাকামি। প্রেম সম্পর্কে সুকান্ত কী লিখেছে শুনবে?

হে রাজকন্যে
তোমার জন্যে
এ জনারণ্যে
নেইকো ঠাঁই–
জানাই তাই।

অনিমেষ ক্রমশ চমকৃত হচ্ছিল। এ-ধরনের কবিতা ও আগে শোনেনি। খুব সাহস করে সে বলল, উনি কি কমিউনিস্ট

হঠাৎ মুখের চেহারা পালটে গেল সুনীলের। খুব শক্ত গলায় সে বলল, শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে যদি কমিউনিস্ট হতে হয় তিনি কমিউনিস্ট। একদল মানুষ ফুলেফেঁপে ঢোল হবে আর কোটি কোটি মানুষ না খেয়ে শুকিয়ে মরবে-এরকম সমাজ্যবঘা চিরদিন চলতে পারে না। সুকান্ত তাই বলেছে, জন্মেই দেখি, ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি। কথাটা এই স্বাধীনতার পওে সত্যি।

অনিমেষের একথাগুলো শুনে চট করে সদ্যপড়া রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা মনে পড়ে গেল, রাজার হস্ত করে সমস্ত সোৎসাহে যে-বইটা ওকে দিল তার নাম ছাড়পত্র।
 
সুনীলের সঙ্গে ভাব হয়ে গেল অনিমেষের। বয়সে বড় বলে সে ওকে সুনীলদা বলে ডাকে। জয়াদি ব্যাপারটা ভালো করে শুনে বলল, বাঃ, বেশ ছেলে তো! আমাদের সঙ্গে কথা বলে না তো, তাই জানতাম না। কিন্তু এর চেয়ে বেশি কৌতূহল প্রকাশ করল না।

জয়াদির কথা সুনীলদাকে বলতেই সুনীলদা বলল, হ্যাঁ, ওঁকে দেখেছি। মহিলাকে সঙ্গে মপ্রয়োজনে কথা বলি না।

অনিমেষ সুকান্তের পর গোর্কির মা পড়ে ফেলল। সুনীলদা ওকে বুঝিয়েছে, পৃথিবীতে মানুষের মাত্র দুটো শ্রেণী আছে। একদল শোষক অন্যদল শোষিত। শোষকের হাতে আছে সরকার, মিলিটারি, পুলিশ। শোষিতের সম্বল ক্ষুধা, বঞ্চনা, তাই আজকের স্লোগান দুনিয়ার শ্রমিক এক হও। ভিয়েতনাম, কিউবা, আফ্রিকার দেশগুলো আজ মানুষের অধিকার আদায় করতে লড়ে যাচ্ছে। ভারতবর্ষকে ওদের সংগ্রামের শামিল হতে হবে। ইংরেজ চলে যাবার পর তাদের স্নেহে পুষ্ট কিছু কংগ্রেসি সরকা হাতে পেয়েছে। সাধারণ মানুষ এখনও এদেশে কুতুপুজো করে, তারা জওহরলালের ভণ্ডামিতে ভুলবেই। কংগ্রেসের একটা নকল ইতিহাস আছে যার ফলে জেলায় সাধারণ মানুষ এমন মুগ্ধ যে এতদিন কংগ্রেস যা ইচ্ছে তা-ই করতে পেরেছে। কিন্তু কংগ্রেস তো দালালমাত্র। আসলে এই দেশ শাসন করে কয়েকটা ফ্যামিলি। তারাই দেশের টোটাল ইকনমিতে কবজা করে বসে কংগ্রেসকে শিখণ্ডী করে যা ইচ্ছে করছে।

অনিমেষ লক্ষ করেছে সুনীলদা যে-কথা বলে ছোটকাকা ঠিক সে-ধরনের কথা বলত না। ছোটকাকা সেই সময় যেরকম ছন্নছাড়া ছিল সুনীলদা তা নয়। ছোটকাকার কথাবার্তার মধ্যে একটা বিক্ষোভ ছিল ঠিকই, কিন্তু সুনীলদার মতো এত পরিষ্কার ধারনা ছিল না। সুনীলদাকে ওর অনেক সমঝদার মনে হয়। অবশ্য সে-সময়কার ছোটকাকাকে ও স্পষ্ট মনে করতে পারে না, শুধু ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায় ছাড়া। মুখে যেসব কথা বলেছেন নিশীথবাব, কাজের সময় তার কোনোটার কথা মনে রাখেননি। সুনীলদা ওকে সবচেয়ে বড় ধাক্কা দিয়েছে, সেটা জন্মভূমি নিয়ে। নিশীথবাবু বলেছেন, জন্মভূমিই হল মায়ের বিকল্প। জন্মভূমিকে ভালো না বাসলে মাকে ভালোবাসা যায় না।

সুনীলদা বলল, স্বাধীনতার পর যে লক্ষ লক্ষ মানুষ পাকিস্তান থেকে এদেশে চলে এল তাদের জন্মভূমি ওপারেই পড়ে রইল। এদেশে এসে তারা দেশপ্রেম দেখাতে পারে না নিশ্চয়ই। পশ্চিমবাংলা তাদের জন্মভূমি নয়, যে-মানুষগুলো নিজের জন্মভূমিতে লড়াই করে না থেকে পালিয়ে এল বাচার তাদিগে তুমি কি তাদের শ্রদ্ধা করবে?

অনিমেষ বলর, কিন্তু ওরা তো সবাই বাংলাদেশের লোক। তা হলে এটাও ওদের জন্মভূমি।

সুনীলদা বলল, ঠিক তাই। আমরা আরও বড় করে ভাবি। আমাদের জন্মভূমি গোটা পৃথিবীটা। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুমি যে-কথা বলছ তা স্বাধীনতার অনেক আগে বলা হত। বঙ্কিমচন্দ্রের সে-যুগে প্রয়োজন ছিল হয়তো, এখন তিনি ব্যাকডেটেড হয়ে গেছেন। এখন এত সংকীর্ণ। হলে হলে না। তখন ছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই, এখন নিজেদের সঙ্গে নিজেদের সগ্রাম।

জলপাইগুড়ি শহরে বামপন্থি আন্দোলনের পুরোধ হিসেবে জাতীয় কমিউনিস্ট পার্টি এবং পি এস পির মধ্যে বেশ একটা রেষারেষি আছে। সুনীলদা এই দুটো দলের সঙ্গেই পরিচিত, তবে অনিমেষের মনে হয়, ও কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে বেশি যুক্ত। খোলাখুলি কথা বলে না কখনো। মাঝে-মাঝে বেশ কদিনের জন্য উধাও হয়ে যায়। এবার ফিরে এসে বলল, তোমাদের চা-বাগানের নাম স্বৰ্গছেঁড়া?

অনিমেষ বলল, হ্যাঁ।

সুনীলদা হেসে বলল, ওখানেই ছিলাম এই কয়দিন।

বেশ অবাক হল অনিমেষ। স্বৰ্গছেঁড়ায় ওর কেউ থাকে সেটা বলেনি তো কখনো!

কার বাড়িতে ছিলে?

একজন শ্রমিকনেতার।

আরও অবাক হয়ে গেল অনিমেষ, স্বৰ্গছেঁড়ায় কখনো কোনো শ্রমিকনেতা ছিল না! ও জিজ্ঞাসা করল, ওঁর নাম কী?

জুলিয়েন। বেশ শিক্ষিত ছেলে। চা-বাগানের কর্তৃপক্ষ ওকে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বাবুদের চাকরি দেয়নি। সেই মুলকরাজ আনন্দের যুগ এখনও চলে আসছে দেখলাম।

মুলকরাজ আনন্দের নাম এর আগে শোনেনি অনিমেষ। কিন্তু বুকু সর্দারের ছেলে মাংরা যে এখন শ্রমিকনেতা কল্পনা করতে ওর কষ্ট হচ্ছে।

সুনীলদা বলল, যাহোক, শ্রমিকরা খুব উত্তপ্ত। আন্দোলনের প্রস্তুতি চলছে। কিছু কিছু দারিদাওয়া নিয়ে ম্যানেজারের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। এদের ঠিকমতো গাইড করলে চা-বাগানের চেহারা পালটে যাবে।

অনিমেষ চেহারা পালটে যাবে।

সুনীলদা বলল, কী আশ্চর্য, তুমি বাগানে ছিল আর দেখনি? বাগানের কুলিদের মানুষের মর্যাদা দেওয়া হয়? গরু-ছাগলের মতো বাড়িতে কাজ করানো হয় না? কী বেতন পয়া ওরা? থাকার জায়গা ধোয়াড়ের চেয়ে অধম!,
 
কথাগুলো শুনতে শুনতে অনিমেষ আজ এতদিন পরে চোখে দেখে সয়ে-যাওয়া সত্যটার অর্থ আবিষ্কার করল। সুনীলদা যা বলেছে তা মিথ্যে নয়, অথচ এতদিন ওখানে থেকে ওর কাছে এটা একটুও অন্যায় বলে মনে হয়নি।

অনিমেষ বলল, আন্দোলন হবে?

নিশ্চয়ই। সুনীলদা বলল। তারপর একটু বিষ গলায় জুড়ে দিল, কিন্তু আমাদের এই বামপন্থি পাটিগুলো যেরকম শম্বুকগতিতে চলছে তাতে কোনো কাজ হবে না। এদেশে এভাবে কোনোদিন বিপ্লব আসবে না। ভিক্ষে করে অধিকার পাওয়া যায় না।

অনিমেষের এতদিন বাদে খুব ইচ্ছে করছিল স্বৰ্গহেঁড়ায় গিয়ে ব্যাপারটা দেখতে। খুব দ্রুত একটা পরিবর্তন নিশ্চয়ই হয়ে গেছে ওখানে। একটা মজার ব্যাপার মনে পড়ে গেছে এরকম ভঙ্গিতে সুনীলদা বলল, জান, আসবার সময় দেখলাম কিছু কংগ্রেসি ধ্বনি দিচ্ছে, বন্দে মাতরম্ মাতরম্। ঠিক ইনকিলাব জিন্দাবাদের নকল করে। ওদের আর নিজস্ব বলে কিছু থাকল না।

জলপাইগুড়ি শহরের শরীরটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধবার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। ওধারে চাঁদমারি থেকে এধারে রায়কতপাড়া ছাড়িয়ে তিস্তার গা-ঘেঁষে দিনরাত কাজ চলছে। প্রত্যেক বছর নিয়মিত বন্যার হাত থেকে শহর বাঁচবে, দল বেঁধে মানুষেরা আসত বাঁধ গড়া দেখতে। প্রচুর বোন্ডার পড়ছে, বড় বড় কাঠের বিমকে বালির ভেতরে ঠুকে ঢুকিয়ে দেওয়ার কাজ চলছে সারাদিন। মানুষেরা একটু নিশ্চিন্ত, যদিও গত দশ বছরের মধ্যে একবারই শুধু বড়সড় বন্যা হয়েছিল তবু তিস্তাকে কেউ বিশ্বাস করে না।

বাঁধের কাজ শুরু হবার পর জলপাইগুড়ির ছেলেমেয়েদের একটা বেড়াবার জায়গা জুটে গেল। এমনিতে কোনো পার্ক নেইবা শহরের মধ্যে যে-খেলার মাঠগুলো সেখানে অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা সাহস করে বসতে পারে না। কারণ এই শহরের মানুষ পরস্পরকে এত চেনে যে, শোভনতার বেড়া ডিঙানো অসম্ভব। তবু রায়কতপাড়ার ছেলে সাহস করে বাবুপাড়ার মেয়ের সঙ্গে মাষকলাইবাড়ির। রাস্তায় পাঁচ মিনিট হেঁটে আসে কখনো-সখনো। কিন্তু তাই নিয়ে ধুন্ধুমার কাণ্ড শুরু হয়ে যায়। দেখা। যায় মোটামুটি একটি সুন্দরী বালিকার প্রতি শহরের একাধিক কিশোর আকৃষ্ট। এবং তারা। প্রয়োজনমতো দুটো শিবিরে বিভক্ত। এই দুটো শিবির পরিচালনা করে থাকে শহরের দুই মাস্তান, রায়কতপাড়ার অনিল দত্ত আর পাণ্ডাপাড়ার সাধন। এরা অবশ্য কদাচিত্র মুখোমুখি হয়, কিন্তু যখন হয় তখন শহরের পুলিশবাহিনীর হৃৎকল্প শুরু হয়ে যায়। বিরাট দুটো বাহিনী হাতে হান্টার, গুপ্তি এবং লাঠি নিয়ে বীরদর্পে রাস্তা দিয়ে প্রায় মিছিল করে এগিয়ে যায়। আগ্নেয়াস্ত্র বা বোমার ব্যবহার হয় না। তবে এটা খুব আশ্চর্যের ব্যাপার, এই দুই মাস্তান এবং তাদের প্রথম সারির শিষ্যরা রাজনৈতিক সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকে। তাদের এখন অবধি কোনো রাজনৈতিক দলের হয়ে মারামারি করতে দেখা যায়নি। বাধ তৈরি হওয়ার পর থেকে এরা প্রায়ই তিস্তার পাড়-ঘেঁষে টহল দিচ্ছে সনোগাদ। কারণ যেহেতু এই অঞ্চলটা শহরের বাইরে অপেক্ষাকৃত নির্জন জায়গায় এবং অজস্র কাঠ ও বোন্ডারে বোঝায় হয়ে থাকে, পরস্পরের সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য প্রেমিক-প্রেমিকরা নদীর শীতল বাতাস পাথরের আড়ালে নিজেদের লুকিয়ে রেখে উপভোগ করতে পছন্দ করছে।

কংগ্রেস অফিসে এই নিয়ে কথাবার্তা হয়েছে। নাগরিকরা স্বচ্ছন্দে পছন্দমতো জায়গায় যোরাফেরা করতে পারছে না-এটা চলতে দেওয়া যায় না। অবশ্য সাধন এবং অনিল কখনো ঘটনাস্থলে যায়নি। এরা কয়েকবার জেলে কাটিয়ে এসেছে এবং এখন বেশি ঝামেলা পছন্দও করছে না। থানার বড়বাবু তিস্তার পাড়ে সেপাই মোতায়েন করেছেন, কিন্তু সন্ধ্যার পর সেই বিস্তীর্ণ এলাকায় তাদের খোঁজ পাওয়া মুশকিল। ফলে নিত্যনতুন হাঙ্গামা লেগেই আছে। শহর প্রতিদিন নতুন কেচ্ছার খবর পেয়ে জমজমাট হয়ে থাকে।
 
বাঁধ তৈরি আরম্ভ হওয়ায় সবচেয়ে অসুবিধে হচ্ছে সরিৎশেখরের। সেই কাকভোরে লাঠি দুলিয়ে তিস্তার নির্মল বাতাসে তিনি হনহন করে হেঁটে যেতে পারছেন না। প্রাতঃভ্রমণ বন্ধ হলে আয়ু সংক্ষিপ্ত হবে, এরকম একটা ধারণা থাকায় তিনি এলোপাতাড়ি শহরের পথে ঘুরে আসেন। ইদানীং অর্থচিন্তা বেড়েছে তাঁর। বাড়ি ভাড়া দিয়েছেন দুই মাস হয়ে গেল অথচ পয়সা পাচ্ছে না। সরকারের হাজাররকম নিয়মকানুনের জট ছাড়িয়ে তার কাছে পয়সা হয়ে গেল অথচ পয়সা পাচ্ছেন না। সরকারের হাজাররকম নিয়মকানুনের জট ছাড়িয়ে তার কাছে পয়সা আসতে দেরি হচ্ছে। হেমলতার নামে জমানো টাকা প্রায় শেষ। এদিকে মিউনিসিপ্যালিটি জলের প্রেশার কমিয়ে দেওয়ায় ওপরের ট্যাঙ্কে জল উঠছে না। ফলে হেমলতা তো বটেই, ভাড়াটেরাও অনুযোগ করছে। জয়ার স্বামী তো সেদিন বলে দিলেন, একটা-কিছু ব্যবস্থা করুন।

হেমলতা অনিকে স্কুলের ভাত দিচ্ছিলেন, হন্তদন্ত হয়ে বারান্দায় এসে বললেন, কে টাকা পাঠিয়েছে, প্রিয়? আপনি নিলেন?

সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়লেন সরিৎশেখর, মাথা-খারাপ! আমি কি ভিখিরি!

হেমলতা বললেন, ঠিক করেছেন। বাবা, আপনার ছেলেরা কোনোদিন আপনাকে শান্তি.দেবে। সরিৎশেখর আর দাঁড়াতে পারছিলেন না, বারান্দায় বেতের চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লেন। হঠাৎ তার সবকিছু ফাঁকা বলে মনে হতে লাগল। শুধ আলোচাল খেয়ে হেমলতা অম্বল থেকে পেটের যাবতীয় রোগ পেয়েছে বলে তিনি জানতেন, কিন্তু এরকম মনের জোর পায় কী করে! হেমলতা এই মুখভঙ্গি দেখে তিনি ঠিক স্বস্তি পাচ্ছিলেন না।

বিকেলের দিকে আজকাল আর খেলার মাঠে যায় না অনিমেষরা। উঁচু ক্লাসে ওঠার পর থেকেই খেলাধুলা কমে এসেছিল। ইদানীং বিরাম করের বাড়িতেও যাওয়া কমে গেছে। রম্ভার সঙ্গে সেই ঘটনাটা ঘটে যাবার পর থেকে ওর ওখানে যেতে সঙ্কোচ হচ্ছিল। অবশ্য মুভিং ক্যাসেল.কয়েকবার ধরে নিয়ে গিয়েছেন ওকে, আদর করে বসিয়েছেন, কিন্তু উর্বশীর দেখা পায়নি। মেনকাদি কলকাতায় চলে গিয়েছে। এখানকার কলেজে পড়ানা ভালো হচ্ছে না, হোস্টেলের থেকে কলকাতার কলেজে ভরতি হয়েছে মেনকাদি। মণ্টু বলে, নিশীথবাবু নাকি জব্বর ল্যাং খেয়েছেন। তবে ভেঙে পড়েননি, কারণ এখনও উর্বশী রম্ভা রয়েছে। সেদিনের ঘটনার পর থেকে আশ্চর্যভাবে বদলে গেছে:মণ্টু। আর : একবারও.ও মুভিং ক্যাসেলের বাড়িতে যায়নি এবং তপন রম্ভাকে নিয়ে দু একবার ঠাট্টা করার চেষ্টা করলেও ও চুপচাপ থেকেছে। রম্ভার প্রতি মণ্টুর যেন আকর্ষণ নেই। বিকেলে সেনপাড়া ছাড়িয়ে বাঁধের বেল্ডারের ওপর বসে থাকে ওরা। ক্লাসে যে নতুন ছেলেটি টাকি থেকে এসেছে সে খুব মেধাবী এবং দাবখেলায় হারে না সহজে। এসে অরূপকে ডিঙিয়ে ফার্স্ট হয়েছে এবার। ছেলেটির নামটাও অদ্ভু, অর্ক। অর্ককে দেখে অবাক হয়ে যায় অনিমেষ। ওদের সঙ্গে বিকেলবেলায় তিস্তার পাড়ে বসে যখন সে কথা বলে তখন অনর্গল মুখ খারাপ করে যায়। নিজেই বলে, খিস্তিতে কোনো শালা আমার সঙ্গে পারবে না। এমনকি মণ্টুকেও নিষ্প্রভ দেখাচ্ছে আর্ক আসার পর থেকে। যে-ছেলে প্রত্যেকটা সাবজেক্টে লেটার মার্ক পায়ে সে কী করে খিস্তি করে বলে, এটা একটা রেয়ার কলেকশন। আরকারও কাছে শুনবি না। এই সময় অনিমেষ না-শোনার ভান করে নির্লিপ্ত মুখে তিস্তার দিকে চেয়ে থাকে। অর্কর ইংরেজি খাতা দেখে হেডমাস্টারমশাই নাকি এত মুগ্ধ হয়েছেন যে নিজে গিয়ে ওর বাবার সঙ্গে আলাপ করে এসেছেন। ও যে এবার স্কুল ফাইনালে স্ট্যান্ড করবে তা সবাই জানে। সেই অর্ক আজ বিকেলে এসে গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল, বল তো, আমরা জন্মেছি কেন?

উত্তরটা দেবে কি না অনিমেষ বুঝতে পারছিল না। মণ্টু বলল, শহীদ হতে।

তপন বলল, হাফসোল খেতে।

খুব বিরক্ত হয়েছে এমন ভঙ্গিতে অর্ক বলল, তোদের সঙ্গে সিরিয়স আলোচনা করে সুখ পাওয়া যায় না। উত্তরবঙ্গের মানুষগুলোর মাথা মোটা হয়। তো একবার মনেও হয় না কেন জন্মেছি জানতে?

প্রশ্নটা ওর দিকে তাকিয়ে, তাই অনিমেষ বলল, আমি উত্তরটা জানি এবং তা খুব সোজা। আগের জন্মের কর্মফল অনুযায়ী আমরা জন্মগ্রহণ করি।

অর্ক বলল, বুকিশ! জন্মগ্রহণ করি, যেন তুই চাইলেই জন্মাতে পারবি! জন্মগ্রহণ পানিগ্রহণ করার মতো ব্যাপার, না? কোনো প্র্যাকটিক্যাল নলেজ নেই!

মণ্টু বলল, কীরকম?

পকেট থেকে একটা গোটা সিগারেট বের করে অর্ক ধরাল। আগে ও দেশলাই রাখত না, আজ এনেছে। অর্ক আসার পর মণ্টুদের এই নতুন অভ্যাসটা হয়েছে। একটা সিগারেট ঘুরে ঘুরে দুএকটান দিয়ে শেষ করে। শহরের বাইরে এরকম নির্জন জায়গায় ধরা পড়ার কোনো ভয় নেই। চাপে পড়ে অনিমেষ একদিন একটা টান দিয়েছিল, দম বন্ধ হবার যোগাড়! বিশ্রী টেস্ট, কেন যে লোকে সিগারেট খায় কে জানে!

, গলগল করে দুই নাক দিয়ে ধোঁয়া বের করে অর্ক,বলল, জন্মাবার পেছনে আমাদের কোনো কৃতিত্ব নেই।

অনিমেষ সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল! মণ্টু বলল, উঠলি যে!

অনিমেষ বলল, এইসব কথা শুনতে আমার ঘেন্না করে।

বেশ রাগের মাথায় ও দপদপিয়ে এগিয়ে গেল সামনে। অর্ক চেঁচিয়ে বলল, সত্য খুব ন্যাংটো রে! তা সিগারেটে টান দিবি না, শেষ হয়ে গেল যে!
 
অনিমেষ কোনো কথা বলল না। সত্যি, ওদের আড্ডাটা ইদানীং খুব খারাপ হয়ে গিয়েছে। চারপাঁচজন এক হলেই মেয়েদের শরীর নিয়ে বিশ্রী আলোচনাটা আসবেই। তার চেয়ে কংগ্রেস অফিসে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকলেও এত খারাপ লাগে না। জয়াদি মামার বাড়ি গিয়েছেন প্রায় দিন-দশেক বিকেলে বইপড়া বন্ধ। সুনীলদাও কোনোদিন মুখ-খারাপ করেনি। ওর সঙ্গে থাকতে খুব ভালো লাগে অনিমেষের। চা-বাগান অঞ্চলে কীসব সংগঠনের কাজে সুনীলদা ড়ুব দিয়েছে। সুনীলদার সঙ্গে ওর যেসব কথাবার্তা হয়েছে তা একদিন কংগ্রেস অফিসে বসে নিশীথবাবুকে বলেছিল ও। নিশীথবাবু। নির্দেশ দিয়েছেন, সুনীলের সঙ্গে একদম মেলামেশা নয়। কথাটা একদম সমর্থন করতে পারছে না অনিমেষ। একধম তিস্তার বাধে মেয়েসংক্রান্ত ঘটনা ঘটলে মণ্টু কেস বলে তাকে চিহ্নিত করে।

বিরাট একটা পাথরের স্কুপের আড়াল থেকে চিৎকারটা আসছিল। একটা গলা খুব ধমকাচ্ছে আর মেয়েটি না না, পায়ে পাড়ি আপানার বলে মিনতি কছে। অনিমেষ নিঃশব্দে পাথরগুলোর আড়াল রেখে কাছে যেতেই কী করবে বুঝতে পারল না চট করে। চারটে ওদের বয়সি ছেলে এই সন্ধে হয়ে আসা অন্ধকারে গুণ্ডার মতো মুখ করে হাসছিল। ওদের সামনে যে ছেলেটি শুধুমাত্র জাঙ্গিয়া পড়ে দাঁড়িয়ে আছে তাকে অনেক কষ্টে চিনতে পারল ও। তার জামাপ্যান্ট মাটিতে পড়ে রয়েছে। চারজানের যে নেতা সে বলছিল, ওটুকু আবার কার জন্য রাখলে চাঁদ, খুলে ফ্যালো। তোমাকে মারব না, কিছু বলব না। তিস্তার পাড়ে লুকিয়ে প্রেম করতে এসেছ যখন তখন তুমি তো হিরো, একদম ন্যাংটো হয়ে বাড়ি চলে যাও। খোলো! শেষ কথাটা ধমকের মতো শোনাল।

ছেলেটি, যাকে একদিন মণ্টু মেরেছিল, কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, প্লিজ, আমি এটা পরেই যাই, আর কোনোদিন করব না, আপনারা যা চান তা-ই দেব।

অনিমেষ রম্ভার মতো মুখটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল। ওদের দিকে পেছন ফিরে রম্ভা দুহাতে চোখ ঢেকে অনিমেষ যেদিকে দাঁড়িয়ে সেদিকে ফিরে রয়েছে। ওর শরীরটা ফোঁপানির তালে কাঁপছে। এই সময় চারজনের একজন রম্ভার দিকে এগিয়ে গেল, তোমার নাম কী?

রম্ভা কোনো জবাব দিল না, তেমনি ফোপাতে লাগল।

বাড়ি কোথায়? তাও জবাব নেই। ছেলেটি বোধহয় একটু রেগে গেল, আবার ফ্যাঁচফ্যাঁচ হচ্ছে! শালা লুকিয়ে এখানে এসে হামু খাবার বেলায় মনে ছিল না। আমরা যে সামনে এসেছি তা খেয়াল হচ্ছিল না! যাক, জামাটামা খুলে ন্যাংটো হয়ে বাড়ি যাও খুকি।

রম্ভা সজোরে ঘাড় নাড়ল। ওদের মধ্যে একজন ছেলেটির চিবুক নেড়ে দিয়ে বলল, জম্পেস মাল পটিয়েছ বাবা! একা খাওয়া কি ভালো!

প্রথম ছেলেটি এবার চট করে রম্ভার পিঠে জামার ওপরটা খপ করে ধরে বলল, অ্যাই খোল, নইলে বাপের নাম ভুলিয়ে দেব।

সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষের মাথা গরম হয়ে গেল। একছুটে সে দলটার মধ্যে গিয়ে পড়ল এবং কেউ কিছু বোঝার আগেই ছেলেটার হাত মুচড়ে ধরল, কী আরম্ভ করেছ তোমরা, এটা কি গুণ্ডামির জায়গা?

ব্যাপারটা এত দ্রুত হয়ে গিয়েছিল যে ছেলেটি ভীষণ ঘাবড়ে গেল। র ঘুরে অনিমেষকে দেখতে পেয়ে কী করবে বুঝতে না পেরে শেষ পর্যন্ত দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল, অনিমেষ, দ্যাখো ওরা আমার ওপর অত্যাচার করছে। আমি এমনি কথা বলতে এসেছিলাম-আর আমাকে অপমান করছে।

বোধহয় রম্ভার গলার স্বরেই বাকি তিনজনের সংবিৎ ফিরে এসেছিল। ওরা এক লাফে সামনে তো আন্তি এগিয়ে এলন হতাশার এরকরেছে, জঙ্গি এসে প্রথম ছেলেটিকে ছাড়িয়ে নিল। রম্ভার হাতের বাঁধন শরীরে থাকায় অনিমেষ নড়তে পারছে না। প্রথম ছেলেটি এবার খেপে গিয়ে বলল, এ-শালা আবার কে? দুজনের সঙ্গে এসেছিল নাকি?
 

Users who are viewing this thread

Back
Top