What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected উত্তরাধিকার - সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

অনিমেষ অলসভাবে পায়চারি করতে লাগল। দূরে একটা চিতা প্রায় নিবে এসেছে। কাঠগুলো জ্বলে জ্বলে আগুন নিবুনিবু। প্রচণ্ড কান্নায় কেউ ভেঙে পড়েছে সেখানে, তাকে সামলাচ্ছে অন্যরা। হরিবোল ধ্বনি দিতে দিতে আর-একটি মৃতদেহ নিয়ে শানের দিকে কিছু লোক আসছে। অনিমেষের এখন রি ভয় করছিল না। দুধেলা জ্যোৎস্নায় এই শ্মশানের মাটি গাছ নদী ধবধব করচে। আকাশে এত নীল রঙ চেয়ে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। গোল আধুলির মতো রুপোলি চাঁদ চুপচাপ সরে সরে যাচ্ছে। আশ্চর্য, ঠিক এরকম সময় কিছু মানুষকে পৃথিবী থেকে চলে যাবার পর শ্মশানে আনা হয়েছে পুড়িয়ে শেষ করে দেবার জন্য। ওর খুব মন-খারাপ হয়ে গেল, কেন যে ছাই শোনে ও চাঁদের আলো পড়ে।

স্নান করিয়ে দাহ করার যে-নিয়মটা এখানে চালু আছে তা সকলে মানেন না, সামান্য জল ছিটিয়ে শুদ্ধ করে নেয় অনেকে-অনিমেষ শুনতে পেল। যে-ডোমটি তদারক করছিল তার দিকে তাকিয়ে অনিমেষ অবাক হয়ে গেল। এর মুখ দেখে মনে হয় না এইসব শোক দুঃখ একে স্পর্শ করে। কখনো কি ও মাথা তুলে আকাশ-ভাসানো চাঁদটাকে ভালো করে দেখেছে? মনে হয় না। সুনীলদার উলঙ্গ শরীরটাকে উপুড় করে শুইয়ে দিয়ে সে যেভাবে পা দুটো সোজা করে দিল তাতে পিসিমার উনুন ধরানোর ভঙ্গিটা মনে পড়ে গেল ওর। চিতার কাছাকাছি গোল হয়ে দাঁড়িয়েছিল সবাই সুনীলদার কোমরের পেছনদিকটায় বিরাট জরুলটায় আলো পড়ে চোখ টেনে নিচ্ছে। মানুষ মরে গেলে তার কত গোপন জিনিস সবাই সহজে জেনে যায়-সুনীলদার এখন কিছু করার নেই। হঠাৎ ও মাকে দেখতে পেল। মা শুয়েছিল সমস্ত চিতা আলো করে-ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছিল সেই চুলগুলো। সুনীলদাকে এই মুহূর্তে খুব দুর্বল, অসহায় বলে মনে হচ্ছিল অনিমেষের।

কে যেন বলল, মুখাগ্নি করবে কে?

সঙ্গে সঙ্গে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। সুনীলদার বাবা আসেননি, কোনো আত্মীয় এই শহরে থাকে। সমস্যাটা চট করে সমাধান করতে পারছিল না শুশানযাত্রীরা। এমন সময় অনিমেষ দেখল সেই ছেলেটি, যে আবৃত্তি করেছিল, যার সঙ্গে সুনীলদার খুব তর্ক হত, সে অলসভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে গেল, কই, কী করতে হবে বলুন।

একজন একটু দ্বিধা নিয়ে বলল, তুমি করবে?

নিশ্চয়ই! ছেলেটি জাবাব দিল, সংগ্রাম শুরু কর মুক্তির, দিন নেই তর্ক ও যুক্তির। আমার চেয়ে বড় আত্মীয় আর কে আছে! দিন। হাত নেড়ে নেড়ে কথাটা বলে সে পাটকাঠির আগুনটা তুলে নিয়ে সুনীলদার বুকে ছুঁইয়ে মুখের ওপর বুলিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো হাত আগুন ছুঁইয়ে চিতাটাকে জাগিয়ে দিল। কেউ কোনো কথা বলছে না, শুধু ফটফট করে কাঠ ফাটার শব্দ আর আগুনের শিখাগুলো যেন হামাগুড়ি দিয়ে সুনীলদার দিকে এগিয়ে আসছে।

হঠাৎ ডোমটা চেঁচিয়ে উঠল, বোল হরি হরিবোল। তার সেই একক কণ্ঠ শ্মশানের আকাশে একবার পাক খেয়ে ফিরে এল আচমকা। অবাক হয়ে সে শুশানযাত্রীদের দিকে তাকাল, তার অভিজ্ঞতায় এইরকম নৈঃশব্দ্য সে বোধহয় দেখেনি।

নীরবতা এতখানি বুকচাপা হয় এর আগে অনিমেষ এমন করে কখনো বোঝানি। সেই বাড়ি থেকে বের হবার পর যে-ধ্বনি দেওয়া চলছিল, যে-মানুষগুলো সুনীলদাকে কেন্দ্র করে জেহাদ জানাচ্ছিল, এখন এই সময় তারা ছবির মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কতখানি ভালোবাসা পেলে এরকমটা হয়-অনিমেষ আঁচ করতে পারছিল না। তবে সুনীলদা কিছু মানুষকে ভীষণরকম। আলোড়িত করেছিলেন, এখন অনিমেষ নিজেকে তার বাইরে ফেলতে পারল না। আগুন কাউকে ক্ষমা। করে না, সুনীলদার শরীরটা ক্রমশ গলে গলে পড়ছে। মারও এরকমটা হয়েছিল। হঠাৎ দুচোখে। দুহাতে চাপা দিল অনিমেষ। এ-দৃশ্য সে দেখতে পারছে না। কিন্তু চোখ বন্ধ করেও সে যে নিস্তার। পাচ্ছে না। অজস্র ছোট ছোট চিতা চোখের পাতায়-পাতায় জ্বলে যাচ্ছে। এটাকে নেভাতে গেলে অন্যটা জ্বলে উঠে।


চোখ খুলতে সাহস হচ্ছে না, অথচ। অনিমেষ এই অবস্থায় শুনতে পেল সেই ছেলেটা নিজের মনে কিছু আবৃত্তি করে যাচ্ছে। মনে হয় ঘোরের মধ্যে ছে সে। কতক্ষণ কেটে গেছে খেয়াল নেই, হঠাৎ সবাই কথা বলে উঠল। দুর্গাঠাকুর বিসর্জনের সময় সাতপাক ঘোরানো হয়ে গেলে জলে ফেলবার মুহূর্তটাতেই এইরকম ব্যস্ততা ভক্তদের মধ্যে হয়ে থাকে। অনিমেষ বন্ধু-চোখ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনল, কুব চাপা এবং রুদ্ধ গলায় ছেলেটি বলছে, কমরেড, তোমায় আমি ভুলছি না, ভুলব না। চোখ খুলল অনিমেষ, খুলে একটু একটু করে সাহস এনে চিতার দিকে তাকাল। না, সুনীলদা ওখানে নেই। একটা দল-পাকানো কালো কিছু পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এই পৃথিবীর কোথাও আর সুনীলদাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

একটু একটু করে মানুষজন ফিরে ফিরে যাচ্ছিল। সামান্য বাতাস দিচ্ছে। কোথা থেকে হালকা মেঘেরা এসে মাঝে-মাঝে চাঁদের মুখ আড়াল করে যাচ্ছে। সেই মুহূর্তে সমস্ত চরাচরে একটা ছায়া। দুলে দুলে যাচ্ছে। অনিমেষ দেখল সেই ছেলেটি আচ্ছন্নের মতো হেঁটে যাচ্ছে তার সামনে দিয়ে। যেতে-যেতে মুখ তুলে চাঁদকে দেখে চেঁচিয়ে উঠল, ঠিক ঠিক। কবিতা তোমায় আজকে দিলাম ছুটি ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়-পূর্ণিমা চাঁদ যেন জলসানো রুটি।

অনিমেষ আর দাঁড়াল না। ও দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ছেলেটির সঙ্গ নিল। ছেলেটি ওর দিকে তাকিয়ে হাসল, পথ অনেকটা, কিন্তু আমাকে একা হাঁটতে হচ্ছে না, তুমি আর আমি হাঁটলে পথ আর বেশি হবে না। কী বল

অনিমেষ কোনো কথা বলল না। হাঁটতে হাঁটতে ব্রিজের ওপর এসে ওর খেয়াল হল, যাঃ, মান করা হয়নি। পিসিমা বলেন, শ্মশানে এলে স্নান করে যেতে হয়। তাই গামছা নিয়ে এসেছে সে। কিন্তু এই মুহূর্তে স্নান করার কথা ভাবতে পারছে না ও। শরীর ননাংরা হলে লোকে স্নান করে। সুনীলদাকে দাহ করার পর স্নান করার কোনো মানে হয়। এই সময় ছেলেটি হঠাৎ আকাশের দিকে বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বলে উঠল, চাঁদটা আজ বড্ড জ্বালাচ্ছে, না?
 
এবার জলপাইগুড়ি শহরে প্রচণ্ড শীত পড়েছে। প্রবীণেরা এর মদ্যেই বলতে আরম্ভ করেছেন, সেই চল্লিশ সালের পর এত মারাত্মক শীত নাকি তারা দেখেননি। অনিমেষের এইসব কথা শুনলে বেশ মজা লাগে। লোকেরা যে কী করে সব কথা মনে রাখে! এই যেমন বর্ষকালে ঝমঝম করে তিনদিন ধরে আকাশ ফুটো হয়ে বৃষ্টি পড়ল, অথবা জ্যৈষ্ঠমাসে রাতদুপুরেও ঘেমে গিয়ে হাতপাখার। বাতাস খেয়ে হল, ব্যস, বৃদ্ধরা বলতে আরম্ভ করেন সেই অমুক সালের পর নাকি এবারের মতন বৃষ্টি বা গরম এর আগে দেখেননি।

তবে এবারের ঠান্ডাটা জব্বয় কনকনে। ভোরবেলা বিছানা থেকে উঠে মেঝেতে পা রাখতে একদম ইচ্ছে হয় না। সকাল হচ্ছে দেরিতে, সেই আটটা অবধি সামনের মাঠে কুয়াশার চুপচাপ বসে থাকে। আবার সাড়ে চারটে বাজতে-না বাজতেই অন্ধকার ডালপালা মেলে দেয়। এতদিন ওর কোনো সোয়েটার ছিল না। তুষের চাদর গায়ে দিয়ে শীতটা দিব্যি কাটিয়ে দিত। সেই কোন ছেলেবেলার ফুলহাতা পুলওভারটা এখনও সুটকেসে ভোলা আছে। ওর বন্ধুবান্ধবরা কত রকমারি সোয়েটার পরে বিকেলে বাঁধের ওপর বেড়াতে হয়-অনিমেষের এতিদন ছিল না, পরার প্রশ্নও ওঠেনি। এবার জয়াদি ওকে নীল-সাদা-হলুদ-মেশানো একটা সোয়েটার তৈরি করে দিয়েছেন, কথা ছিল টেস্টে অ্যালউড হলেই ও সেটা পাবে। অনিমেষ জানত টেস্টে সে কখনোই ফেল করবে না, তবু এর আগে তো কখনো টেস্ট দেয়নি, চিরকাল এ-সময় অ্যানুয়াল পরীক্ষাই দিয়ে এসেছে, এবার তাই উত্তেজনা ছিল আলাদারকম। কাল ফল বেরিয়েছে, জেলা স্কুল থেকে এই বছর সবাই টেস্টে পাশ করে ফাইনাল পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে। অনিমেষের স্থান চতুর্থ: অর্ক, অরূপ, মণ্টু এবং অনিমেষ। মণ্টুর অবশ্য এই প্লেস পাওয়াতে কিছু যায়-আসে না। তবে ইদানীং পড়াশুনায় মনোযোগী হয়ে পড়েছে যেন ও। এবার একটাও প্রশ্ন ইচ্ছে করে ছেড়ে আসেনি।

তিন মাস পর ফাইনাল পরীক্ষা। এবার ফি জমা দিতে হবে। কাল বিকেলে যখন বাড়িতে এসে ও খবরটা দিল তখন জয়াদি পিসিমার কাছে বসে ছিলেন। খবর শুনে পিসিমা তো চ্যাঁচামেচি করে দাদুকে ডাকাডাকি করতে আরম্ভ করলেন। জয়াদির সামনে পিসিমার কাণ্ড দেখে অনিমেষের লজ্জা-লজ্জা লাগছিল। কিন্তু জয়াদি চট করে পিসিমার দলে ভিড়ে গেলেন, ও বাবা, তুমি ফোর্থ হয়েছ। জেলা স্কুলের ফোর্থ বয় মানে তো ফার্স্ট ডিভিশন একদম বাধা-ইস, এটুখানি ছেলে কলেজে পড়তে চলল!

চটির শব্দ হতে জয়াদি দৌড়ে চলে গেলেন আচমকা। অনিমেষ দাদুকে দেখে সামনে গিয়ে দাঁড়াল। টেস্টে পাশ করলে কি প্রণাম করা উচিত?

সরিৎশেখর নাতির মুখের দিকে তাকিয় বললেন, আমাদের বংশে কেউ ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেনি। তোমার এবারের মার্কস কেমন?

অনিমেষ মাথা নিচু করে তিন নম্বর কিছুই না, একটু পড়াশুনা করলে ওটা পেতে অসুবিধে হবে। তুমি এখন বাইরের জগৎ থেকে মনটা সরিয়ে নাও। জীবনে বারবার ফাইনাল পরীক্ষা আসে না। কথাটা বলে চট করে ঘুরে ঘরের ভেতরে চলে গেলেন। অনিমেষ দাদুর এইরকম নিরাসক্ত কথাবার্তায় অভ্যস্ত, কিন্তু একটু পরেই চটির আওয়াজ ফিরে এল, এই নাও, রোজ খাওয়াদাওয়ার পর দুচামচ করে খাবে।

একটা বড় শিশিতে সিরাপমতন কিছু তিনি অনিমেষের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। হতভম্বের মতো সেটাকে হাতে নিয়ে অনিমেষ তার গায়ে কোনো লেবেল দেখতে পেল না, এটা কী?

সরিৎশেখর খুব নিশ্চিন্ত গলায় বললেন, ধীরেশ কবিরাজকে দিয়ে করিয়েছি, ব্রাহ্মীশাক থেকে তরি এই টনিকটা খেলে তোমার ব্রেন ভালো হবে, সব ব্যাপারে উৎসাহ আসবে। দেখবে তিন নম্বর পেতে কোনো অসুবিধে হবে না।
 
অনিমেষ বিহ্বল হয়ে পড়ল। কত আগে থেকে দাদু তার জন্য এত চিন্তা করেছেন! ও শিশিটাকে আঁকড়ে ধরল। সরিৎশেখর বললেন, তোমার ফাইনাল পরীক্ষার ফি কত, জান?

সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মাথা নাড়ল অনিমেষ, না। টাকাপয়সায় কথা উঠলেই আজকাল ওর খুব অস্বস্তি হয়।

সরিৎশেখর বললেন, ঠিক আছে, আমি জেনে নেব। তোমাকে ফার্স্ট ডিভিশন পেতেই হবে অনিমেষ। তোমার মাকে আমি কথা দিয়েছিলাম।

কথাটা শুনে দাদুর দিকে তাকাল অনিমেষ। সরিৎশে এখন অলসপায়ে ভেতরে চলে যাচ্ছেন। মাকে দাদু কবে কথা দিয়েছিলেন? এতদিন শোনেনি তো সে! স্বৰ্গছেঁড়া থেকে যখন এসেছিলেন, তখনই কেউ দশ বছর বাদে কাউকে ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করানোর কথা দিতে পারে না। ওর মনে হল দাদু গুলিয়ে ফেলছেন। স্মৃতিতে কোনকিছু গোলমাল হয়ে গেলে মৃত ব্যক্তির নাম করে নিজের ইচ্ছেটা স্বচ্ছন্দে চালিয়ে দেওয়া যায়। ধরা পড়ার ভয় থাকে না এবং সেটা জোরদারও হয়। অনিমেষ হেসে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে জয়াদির গলা পেল ও, এ মা, একা একা দাঁড়িয়ে হাসছ যে, পাগল হয়ে গেলে নাকি!

অনিমেষ ঘাড় ফিরিয়ে দেখল জয়াদি একটা প্যাকেট নিয়ে ফিরে এসেছেন, কী ওটা?

ফস করে নীল-সাদা-হলুদ-মেশানো সোয়েটারটা বের করে ওর সামনে ধরল, পরে ফ্যালো।

জয়াদি ওর জন্য সোয়েটার বানালে, মাঝে-মাঝে বুক-পিঠের মাপ নিয়ে যান, একথা সবাই জানে। কিন্তু এখন এই মুহূর্তে অনিমেষের ভীষণ আনন্দ হচ্ছিল। সে চিৎকার করে পিসিমাকে ডাকল, পিসিমা-তাড়াতাড়ি!

সরিৎশেখর যখন কথা বলছিলেন তখন হেমলতা রান্নাঘরে ফিরে গিয়েছিলেন। চিৎকার শুনে ছুটে এলেন, ও মা, হয়ে গেছে! বলিসনি তো! কী সুন্দর! আর-জন্মে জয়া তোর কেউ ছিল অনি।

জয়াদি হেসে বললেন,, ও মা, এ-জন্মে আমি বুঝি কেউ নই?

অনিমেষ হাত বাড়িয়ে সোয়েটারটা নিল। কী নরম উল! পিসিমা আর জয়াদিতে মিলে ওকে সোয়েটারটা পরালেন। পিসিমা সমানে জয়াদিল হাতের প্রশংসা করে যাচ্ছেন আর জয়াদি ওর চারপাশে ঘুরে ঘুরে সোয়েটারটা ঠিক করে দিচ্ছেন-অনিমেষের খুব লজ্জা করছিল। সুন্দর ফিট করেছে সোয়েটারটা, পিসিমা বললেন, তুই পাশ করে কলকাতায় গিয়েও এই সোয়েটারটা পরতে পারবি তিন-চার বছর।

জয়াদি বললেন, তখন দেখবেন এটা পছন্দই হবে না।

পিসিমা বললেন, আমি তো বাবা এত ভালো সোয়েটার কাউকে পরতে দেখিনি।

কলকাতায় পড়তে যাচ্ছে। কথাটা ইদানীং এ-বাড়িতে মাঝে-মাঝে শোনা যাচ্ছে। মহীতোষ নাকি সরিৎশেখরকে বলেছেন সেকথা। অনি যদি ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করে তা হলে কলকাতায় পাঠাবেন। এখানকার এ সি কলেজে পড়াশুনা খুব-একটা সুবিধে হবে না। কলকাতায় যাবার কথা শুনলেই দম বন্ধ হয়ে আসে আনন্দে। কলকাতা বাংলাদেশের প্রাণ। বেশি ভাবতে গেলেই অনেকরকম চিন্তা আসে। কলকাতার রাস্তায় সিনেমা-স্টাররা ঘুরে বেড়ায়, কবি-লেখকরা সেখানে। আড্ডা দেন। মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর কলকাতার রাস্তায় হেঁটেছেন। অদ্ভুত একটা রোমান্টিক জগৎ তৈরি হয়ে যায় মনেমনে। ফার্স্ট ডিভিশন পেতেই হবে-যেমন করেই হোক। হাতের শিশি আর বকের সোয়েটারটার দিকে তাকাল সে। সামান্য টেস্টে অ্যালাউড হয়ে যদি এতগুলো মানুষের ভালোবাসা পাওয়া যায়, তা হলে ফাইনাল পরীক্ষায় সে কেন ডিভিশন পাবে না? সোয়েটারের নরম ওমটা শরীরে জড়িয়ে অনিমেষ পিসিমা আর জয়াদির দিকে তাকিয়ে এই প্রথমবার আবিষ্কার করল, যারা খুব অল্পেই খুশি হয় তাদের জন্য সবকিছু করা যায়।

নতুন সোয়োটারটা পরে অনিমেষ বিকেলবেলায় বেরিয়েছিল। রাস্তা দিয়ে যে যাচ্ছে সে-ই একবার ওকে ঘুরে দেখছে। নতুন স্যার একবার খবর দিয়েছিলেন দেখা করার জন্য। নিশীথবাবুকে ও আজও মাঝে-মাঝে পুরনো নামে ভাবে। বোধহয় সংস্কারের মধ্যে যেটা একবার ঢুকে যায় তাকে চট করে ছাড়ানো যায় না। জলপাইগুড়ি শহরে এবার নির্বাচনী প্রচার এখনও শুরু হয়নি। মাঝে-মাঝে কংগ্রেসি অত্যাচারের প্রতিবাদ জানাতে কিছু পোস্টার দেখা যাচ্ছে। কংগ্রেস থেকে তেমন গা করছে এখন। জেলা থেকে যিনি মন্ত্রিত্ব পান তিনি হেরে যাবেন অতি বড় সমালোচকও আশা করতে পারেন না। তাকে কদিন আগে দেখেছে অনিমেষ, বেশ নধরকান্তি, দুধেআলতা রঙ, বয়স হয়েছে। এখন নড়েচড়ে বসতে অসুবিদে হয়। অথচ জেলার মানুষ, বিশেষ করে রাজবংশীরা ভদ্রলোককে ভীষণ সমর্থন করে। সেটাই ওঁর জোর। অবশ্য কংগ্রেসের জোড়া বলদ নিয়ে নামলেই হল-যে দাঁড়াবে সে-ই ভাববে আমাকেই সমর্থন করছে।
 
সুনীলদার সেই বন্ধু যার সঙ্গে শোনে আলাপ হয়েছিল, সে বলেছিল পার্টি অফিসে আসতেই হবে তার কোনো মানে নেই। আগে মনটা তৈরি করো। কথাটা ভালো লেগেছিল অনিমেষের। কমিউনিস্ট পার্টি, পি এস, পি ফলোয়ার্ড ব্লক-এই তিনটি বিরোধী দল এই শহরে বিক্ষোভ করে মাঝেমাঝে-কিন্তু কেমন যেন দানা বাঁধে না। খবরের কাগজে আজকাল কলকাতার খবর পড়ে অনিমেষ। সেখানে প্রায়ই মিছিল হয়-খাদ্য আন্দোলন হয়, তারপর সব চুপচাপ হয়ে যায়–যেন আগের দিন কিছুই গুরুতর ব্যাপার হয়নি। এখানেই কেমন খটকা লাগে অনিমেষের। নিশীথবাবুর সঙ্গে একদিন খোলাখুলি আলোচনা করেছিল অনিমেষ। নিশীথবাবু বলেছিলেন, কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের পরিবর্তে ধ্বংসাত্মক কাজকর্ম করছে। সত্যি কথা বলতে গেলে, ওরা জানেই না ওরা কী চায়। তারপর অনিমেষকে দমিয়ে দেবার জন্য বলেছেন, যারা কমিউনিস্ট পার্টির মাথায় বসে সর্বহারাদের প্রতি দরদ দেখিয়ে গরম-গরম কথা বলে, খোঁজ নিয়ে দ্যাখো, তারাই নিজস্ব প্রাসাদে বসে সেটা করে থাকে। যার পেটে খাবার নেই তাকে সহজেই উত্তেজিত করা যায়, কিন্তু তার খিদে মেটানোর রাস্তাটা বলে দেওয়া সহজ নয়। কমিউনিস্টরা সেটা জানে, তাই ও-পথে যায় না।

অনিমেষ বলেছিল, কিন্তু আমাদের দেশের মানুষ তো গরিব-গরিবের কথা কংগ্রেস ভাবে না কেন? গরিবদের জন্য কংগ্রেস কী করেছে।

বিরক্ত হয়েছিলেন নিশীথবাবু, আট বছরেই একটা দেশকে দেওয়া যায় না। সময় লাগবে অনিমেষ। কমিউনিস্টরা যখন কোনো কথা বলে, রাশিয়ার কথা আওড়ায়। বড় বড় বোলচাল ছাড়া কোনো কমিউনিস্টকে বক্তৃতা দিতে শুনবে না। তুমি কি ওদের দিকে ঝুঁকবে, অনিমেষ?

সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিতে পারেনি অনিমেষ। পরে বলেছিল, আমার যেন কেমন লাগে। কমিউনিস্টরা যা চায় সেটা ভালো লাগে, কিন্তু যেভাবে চায় সেটা একদম ভালো লাগে না।

নিশীথবাবু মুখ দেখে অনিমেষ স্পষ্ট বুঝতে পারলে, উত্তর ওঁর একদম পছন্দ হয়নি। গম্ভীরমুখে বলেছিলেন, অনিমেষ নিজের দেশকে নিজেদের মতো করেই সেবা করা উচিত। মাছনি কংগ্রেসের সবাই ত্রুটিমুক্ত নয়, অনেকেই স্বার্থ নিয়ে আসে, তবু এদের নিয়েই লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে। অভিজ্ঞতা যত বাড়ে কাজ করতে তত সুবিধা হয়।

টাকাপয়সা হাতে এলে সরিৎশেখর আবার আগের মতো হয়ে যান। বাড়িভাড়া নিয়ে যে গোলমাল হয়েছিল সিটা এখন আর নেই, নিয়মিত টাকা পাচ্ছেন। কিন্তু বাজারদর যেরকম বাড়ছে, তাতে পাল্লা দেওয়া মুশকিল। জালের দাম হুহু করে বেড়ে যাচ্ছে। প্রিয়তোষ মাঝে-মাঝে চিঠি দেয়। টাকাপয়সার দরকার হলেই যেন তাকে জানানো হয়-এই ইচ্ছে জানিয়ে সে ঠিকানাসহ চিঠি দিচ্ছে, সরিৎশেখরের মাঝে মাঝে লোভ হয় টাকা চাইতে, কিন্তু শেষ সময়ে সামলে নিয়ে উত্তর দিচ্ছেন না। তার সন্দেহ হেমলতার সঙ্গে প্রিয়তোষের যোগাযোগ আছে। তবে পরিবোষ একদম মাড়ায় না এদিকে। একটুও কষ্ট হয় না তার জন্য সরিৎশেখরের। মহীতোষ আসেন মাঝে-মাঝে-নিয়মিত ছেলের নাম করে টাকা পাঠান। মহীতোষের একটা অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটে গেছে এর মধ্যে। ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেছেন আর চেহারাটা হয়ে গিয়েছে বুড়োটে-বুড়োটে। এ-পক্ষে সন্তানাদি হল না তার। মহীতোষের স্ত্রী স্বৰ্গছেঁড়া থেকে একদম নড়তে চায় না। তাকে অনেকদিন দেখেননি তিনি। হেমলতা বলতে মহীতোষ বলছিলেন, সে ও-বাড়ি ছেড়ে নড়বে না।

বয়স তাকেও কবজা করেছে। শরীরের চামড়া ঝুলে পড়েছে। কিন্তু বড়সড় কোনো অসুখ তার হয়নি, সেই রিকশার ধাক্কায় পড়ে গিয়ে পাঙা ছাড়া। শীত সহ্য করতে আজকাল একটু কষ্ট হয়। লালইমলির সেই পুরনো গেঞ্জি, পাঞ্জাবি মোটা কাপড়ের কোট আর তুষের চাঁদরে লড়ে যান প্রাণপণে। বাঁচতে খুব ইচ্ছে হয় তার। 3 কী জিনিস হচ্ছে পৃথিবীতে, অন্যান্য মানুষের মতো চট করে মরে যাবার কোনো বাসনা হয় না। কন্তু মুশকিল হল, শীত পড়েছিল শানিয়ে-তা একরকম ছিল, সঙ্গে যে আজ রাত থেকে অসময়েরর বৃষ্টি নামল! একদম শ্রাবণমাসের বৃষ্টি।
 
শীতকালে জলপাইগুড়িতে হঠাৎ-হঠাৎ বৃষ্টি আসে। ঠান্ডাটা বাড়িয়ে দিয়ে যায়। যে সমস্ত মানুষ জরায় থিতোচ্ছিল তার টুপটাপ চলে যায় এ-সময়। তিস্তায় তখন টানের সময়। শীতের দাপটে ক্রমশ কুঁকড়ে যাচ্ছে নদীটা। তবু জল এখনও টলমলে। স্রোতের ধার নেই, যৌবন-ফুরিয়ে যাওয়া মহিলার মতো শুধু জাবর কটে যাওয়া। বাঁধ প্রায় সম্পূর্ণ। ওপাশে সেনপাড়া ছাড়িয়ে তিস্তার বুকের ওপর পুল বানাবার কথাবার্তা চলছে। কলকাতা থেকে সরাসরি ট্রেনে-বাসে আসাম যাওয়া যাবে। পক্ষিরাজ ঠ্যাকসিগুলো গা-গতর ঝেড়েমুছে এই কটা বছর কিছু কামিয়ে নেবার জন্য কিং সাহেবের ঘাটের দিকে, আসব-আসব করছে। এই সময় সন্ধে থেকেই আকাশ কাঁপিয়ে বৃষ্টি নামল।

ভোর হল, ঘড়ি দেখলে বোঝা যায়-আকাশ তেমনি গোমড়ামুখো। জল ধরবার চিহ্ন নেই। যেন বর্ষা চলে যাওয়ার সময় এই মেঘগুলোকে হিমালয়ের ভাঁজে-ভাঁজে ফেলে রেখে গিয়েছিল, নাহলে এই সময়ে এত বৃষ্টি পড়ে কখনো তিস্তার জল বাড়ছে। যেন কোনো গুপ্ত ওষুধে যৌবন ফিরে এল। তার-এরকমটা কখনো হয় না। লক্ষ্মীপুজোর পর এত জল তিস্তায় বয় না। কিন্তু শহরের মানুষ এবার নিশ্চিন্ত। সেই প্রলয়ঙ্কর বন্যাটাকে রুখে দেবে নতুন-তৈরি বাঁধ। তিস্তা সরাসারি শহরটাকে গ্রাস করতে পারল না এবার। কিন্তু করলার জল ছিটকে উঠে এল কিছু-কিছু নিচু জায়গায়। হাসপাতালপাড়াটা এই ঠাণ্ডায় তিনদিন জলের তলায় ড়ুবে রইল। আহাদী মেয়ের মতো করলা গিয়ে মুখ ঘষছে। কিং সাহেবের ঘাটের পাশে তিস্তার বুকে।

ঠিক তিনদিন তিনরাতের শেষে বৃষ্টি থেমে রোদ উঠল। হেমলতার অবস্থা খুব কাহিল। গরম বস্ত্র তার বেশি নেই। যতক্ষণ পেরেছেন উনুনের পাশে বসে থেকেছেন। চিরকাল এই কাঠকয়লার আগুনগুলো তাকে শীত থেকে বাঁচিয়ে রাখে। আপদমস্তক-মোড়া সরিৎশেখর রোদ উঠলে উঠোনে এসে বসলেন। দুজনে গল্প করছিলেন, আজ সন্ধে থেকে শীত ডবল হয়ে পড়বে। রোদ উঠলেই শীত বাড়ে। অনিমেষ বাজারে গিয়েছিল। শুধু আলু, পেঁকিশাক আর ঢ্যাঁড়শ নিয়ে ফিরে এসে বলল, শিকারপুর ফরেস্টের দিকে প্রচণ্ড বন্যা হয়েছে, ভোটপাটি ভেসে গেছে।

হেমলতা বাজার দেখে বললেন, ইস, তুই এতক্ষণ ধরে এই বাজার আনলি?

অনিমেষ বলল, কিছু থাকলে তো, আনব! সবাই মারামারি করে নিয়ে নিচ্ছে যা পাচ্ছে। অনেকদিন পরে বাজারে গিয়ে অনিমেষ অত্যন্ত বিরক্ত। ফেরত-টাকাটা সে দাদুর দিকে বাড়িয়ে দিল।

সরিৎশেখর টাকা নিয়ে বললেন, মাছ এনেছ?

অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, না।

সরিৎশেখর রাগ করলেন, কী আশ্চর্য তোমাকে আমি যা বলি শোন না কেন? এখন এই তিনমাস মাছ না খেলে তোমার শরীরে বল হবে কী করে? বেশি পড়াশুনা করতে গেলে শরীরে জোর দরকার হয়।

অনিমেষ হাসল, ত্রিশ টাকা সের কাটাপোনা খাওয়ার ইচ্ছে আমার নেই। অত দামের মাছ তাই সবাই কিনছে না। মাছ না খেলেও আমার চলবে।

নিশীথবাবু বললেন, আমাদের আরও দুর্গম জায়গায় যেতে হবে। এখান থেকে জল হয়তো আজ দুপুরেই নেমে যাবে, তা ছাড়া অন্য পার্টিও রিলিফ নিয়ে আসতে পারে।

ওরা যে চলে যাচ্ছে মানুষগুলো প্রথমে বুঝতে পারেনি। কিন্তু সেটা বোঝমাত্র কান-ফাটানো চিৎকার উঠল। কাকুতি-মিনতি থেকে শুরু করে কান্ন-অনিমেষের নামে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল। নিশীথবাবু এটা কী করে করলেন! অভুক্ত মানুষগুলোকে কিছু খাবার দিয়ে গেলে এমন কী মহাভারত অশুদ্ধ হত! তা ছাড়া কাগজের লেখাটা দেখার আগে পর্যন্ত ওর মুখ দেখে মনে হয়নি আরও দুর্গম জায়গার জন্য এই খাবারগুলোকে রাখতে হবে। ডিঙিনৌকো দূরে চলে যাচ্ছে দেখে এবার গালাগালি শুরু হল! পৃথিবীর শেষতম অশ্লীল ভাষায় গালাগালিগুলো শুনতে শুনতে অনিমেষ বলল, স্যার, না খেতে পেলে এরা মরে যাবে। কিছু দিলে ভালো হত।
 
অনিমেষের দিকে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলেন নিশীথবাবু। জবাব দেবার কোনো প্রয়োজন মনে করলেন না যেন। অনিমেষ দেখল কয়েকজন বোধহয় আর থাকতে না পেরে গাছ থেকে হলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপর প্রাণপণে সঁতার কেটে কাছে আসবার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু নৌকো তখন অনেক দূরে, ওদের নাগালের বাইরে। এর ভাঙা ঘর, ওর উঠোনের পাশ দিয়ে ওরা চলেছে। হঠাৎ অনিমেষের চোখে পড়ল একজন প্রায় পুটলি হয়ে-যাওয়া বুড়ি একটা ভাঙা ঘরের টলে-থাকা খড়ের চালে কোনোরকমে বসে আছে। কিন্তু-একটা আসছে বুঝতে পেরে চোখে হাতের আড়াল দিয়ে অদ্ভুত খনখনে গলায় বলে উঠল সে, কে যায়-অ মণি-আইলি নাকি? ওরা কেউ কোনো কথা বলল, না, নিঃশব্দে জায়গাটা পার হয়ে গেল। বুড়ি তখনও কেটে-যাওয়া রেকর্ডের মতো বলে যাচ্ছে, অ মণি-কথা ক, অ মণি-কথা ক।

নিশীথবাবু এবার অনিমেষের দিকে ফিরে তাকালেন। একটু অস্বস্তি হচ্ছে ওঁর মুখ দেখলে বোঝা যায়। যেন নিজের সঙ্গে কথা বললেন উনি, নিজেকে শক্ত করো অনিমেষ। আজকেই ওরা খাবার পেয়ে যাবে। কমিউনিস্টরা গতবার এদের ভোট পেয়েছিল, খাবার ওরাই পৌঁছে দেবে।

কেউ যেন লক্ষ কাঁটাওয়ালা চাবুক দিয়ে ওকে আচমকা আঘাত করেছে, অনিমেষ সোজা হয়ে বসল, আপনি এইজন্য ওদের খাবার দিলেন না?

পরগাছা দেখেছ যাদের খাবে তারই সর্বনাশ করবে। কংগ্রেস সরকার এদের আশ্রয় দিয়ে গ্রাম তৈরি করে দিয়েছিল, তার বিনিময়ে ওরা কমিউনিস্টদের ভোট দিচ্ছে। জেনেশুনে মানুষ দ্বিতীয়বার ভুল করে না। তা ছাড়া আমাকে হুকুমমতো কাজ করতে হচ্ছে।

অনিমেষ বলতে গেল, কিন্তু।

না, আর কথা নয়। রাশিয়াতে কোনো কমিউনিস্ট যদি এইরকম পরিস্থিতিতে তার দলনেতাকে প্রশ্ন করত তা হলে তার চরম শাস্তি হয়ে যেত। কিন্তু যেহেতু আমরা বাক্-স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি, তাই তুমি প্রশ্নটা করতে পারলে। তফাত বুঝতে চেষ্টা করো।

অনিমেষ পেছন ফিরে তাকাল। সেই গ্রামটা অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। অ মণি কথা ক বৃদ্ধার গলাটা ভুলতে পারছে না সে। হঠাৎ ওর মনে হল সুভাষ বোস, গান্ধীজি যদি এ-পরিস্থিতিতে পড়তেন তা হলে তারা কী করতেন। নিশ্চয়ই নিশীথবাবুর মতো কথা বলতেন না। মানুষের খাবার নিয়ে, একদম নিঃস্ব-হয়ে-যাওয়া মানুষের বাঁচবার অধিকার নিয়ে যে-রাজনীতি চলছে তা সমর্থন না করলে যদি রাজনীতি না করা যায় তবে দরকার নেই তার রাজনীতি করে। ওর মনে পড়ল নিশীথবাবু অনেকদিন আগে একবার বলেছিলেন, যারা বাস্তহারা, বন্দেমাতরাম মন্ত্র তাদের মুখে আসতেই পারে না। কথাটা আজ এতদিন বাদে তিনি নিজের আচরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন নতুন করে। আচ্ছ, কমিউনিস্টরাও কি কোনো কংগ্রেসি গ্রামে গেল রিলিফ দেবে না? কী জানি! অনিমেষ আর ভাবতে পারছিল না।

যত ওপরে উঠছে ওরা তত নদী ছোট হচ্ছে। সেইসঙ্গে স্রোতের দাপট বাড়ছে মূল নদী নৌকো বাওয়া অসম্ভব হত। অনিমেষ দেখল অজস্র গাছপালা নদী দিয়ে ভেসে যাচ্ছে, আজ তাদের ধরতে কোনো মানুষ নদীতে নামেনি। এত বেলা হল, সূর্য মাথার ওপর তার পা রাখল, কিন্তু খিদে পাচ্ছে না এতটুকু। খাওয়ার কথা বলছে না কেউ। এমন সময় মাঝি বলছে, বাবু, ওপারে যাওয়া হইব না।

নিশীথবাবু ঘাড় নাড়লেন, বুঝতে পেরেছি। তা হলে এদিকটাই সেরে যাই। আরও বাদিকে একটা গ্রাম আছে সেখানে চলো।
 
বাঁদিকটা বেশ জঙ্গল, জল বোধহয় উঠতে পারেনি সেখানে। কারণ নদী থেকে সেটা অনেকটা উঁচুতে। কিন্তু সেই জলে ডাঙাটির পাশ দিয়ে তিস্তার একটা স্রোত ওপাশ থেকে বেরিয়ে এসেছে। কিছুদূর যেতেই জঙ্গলের মধ্যে একটা মানুষ চিষ্কার করে কিছু বলল। নিশীথবাবু মাঝিকে ভালো জায়গা দেখে নৌকা ভেড়াতে বলতে সে বলল, বাবু, এডা তো কুষ্ঠরোগীদের গ্রাম!

নিশীথবাবু বললেন, হ্যাঁ, সেখানেই যাব। কুষ্ঠরোগীরা কি মানুষ নয়?

ডেঙ্গো জমিটায় জল ওঠেনি। চারপাশে জলের মধ্যে নৈবেদ্যর চুড়ার মতো মাথা উঁচু করে জেগে রয়েছে জায়গাটা। সূর্য এখন মাথার ওপর থেকে পশ্চিমে সামান্য হেলেছে, কিন্তু আকাশটার চেহারা আবার টসকেছে। বৃষ্টির মেঘ নয়, কিন্তু একটু একটু করে ঘোলাটে হয়ে উঠছে আকাশ, রোদের চটক ফট করে মরে গেল।

অনিমেষ ডাভার দিকে তাকাল। কুষ্ঠরোগীরা থাকে এখানে! একটা চিৎকার অবশ্য শুনেছিল সে, কিন্তু এখন কাউকে দেখা যাচ্ছে না। ঘন জঙ্গল ভেদ করে দৃষ্টি বেশি দূরে যায়ও না। সকাল থেকে এত রোদ হল তবু এখান থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে গাছের পাতায় ডালে এখনও স্যাঁতসেঁতে ভাবটা আছে। কতখানি এলাকা নিয়ে ভাঙাটা কে জানে! তবে বেশ উঁচুতে। কিন্তু এরকম ঘন জঙ্গলে মানুষ থাকে কী করে! বাইরে থেক তো কোনো ঘরবাড়ি চোখে পড়ছে না, কুষ্ঠরোগীরা তো মানুষ-অনিমেষ নিশীথবাবুর দিকে তাকাল।

পরিষ্কারমতো একটা জায়গা দেখে নৌকোটো ভেড়ানো হল। নিশীথবাবু নৌকো থেকে নেমে কয়েক পা হেঁটে ভেতরে গিয়ে বোধহয় কাউকে দেখতে না পেয়ে আবার ফিরে এলেন, আরে মালগুলো নৌকো থেকে নামাও, চুপচাপ বসে আছ কেন?

এক এক করে ব্যাগগুলো মাটিতে নামানো হলে মাঝি বলল, বাবু, কত সময় লাগব?

নিশীথবাবু বললেন, তোমার সঙ্গে তো সারাদিনের চুক্তি আছে, অপেক্ষা করো।

এতক্ষণ নৌকোয় বসে শুধু জল দেখতে-দেখতে অনিমেষের একঘেয়ে মনে হচ্ছিল, হাত-পা নাড়তে না পেরে খিল ধরে যাবার যোগাড়-এখন হাঁটতে পেরে স্বস্তি হল। বন্যার্তদের জন্য রিলিফ নিয়ে এসেছে অথচ এখানে তো বন্যার জল ওঠেইনি। কথাটা নিশীথবাবু শুনে খুব বিরক্ত হলেন, কী আশ্চর্য, এটুক তোমার মাথায় ঢুকল না যে যারা জলে আটক হয়ে থাকে তারা খাবারের অভাবে অভুক্ত থাকবেই। জলবন্দিরা যে বন্যার্ত নয় তা তোমায় কে বলল?

অনিমেষ উত্তর দিল না কিন্তু নিশীথবাবু কথাটা সে মানতে পারছিল না। অনেক ভিখিরি দুতিনদিন না-খেয়ে থাকে শহরের রাস্তায়, কই, তাদের তো রিলিফ দিতে যাওয়া হয় না! বন্যা এসে যাদের উৎখাত করেছে তারাই তো বন্যার্ত।

এমন সময় নিশীথবাবু বললেন, সবার যাবার দরকার নেই। তোমার তিনজন আমার সঙ্গে এসো। আঙুল দিয়ে তিনি অনিমেষ আর দুজনকে ডাকালেন। বাকিরা থেকে গেল সেখানেই। ওদের মুখ দেখে অনিমেষ বুঝতে পারছিল যেতে না হওয়ায় ওরা খুব সন্তুষ্ট হয়েছে। সত্যি কথা বলতে কী, নৌকো থেকে নামতেই সবাই দ্বিধা ছিল। যাওয়ার আগে একটা ব্যাগ খুলে নিশীথবাবু থেকেযাওয়া সঙ্গী এবং মাঝিদের কিছু খাবার দিলেন। চিড়ে গুড় আর লালচে পাউরুটি। এখন এই দুপুরপেরনো সময়টা এই সামান্য খাবার দেখেই অনিমেষের জিভে জল এসে গেল। ও যেন হঠাৎই টের পেল ওর প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। খিদে একদম সহ্য করতে পারে না ও। আজ অবধি অসময়ে খেতে হয়নি কখনো। কিন্তু আজ সকাল থেকে এই নৌকোয়-নৌকোয় ঘুরে আর সেই গলায় ফাঁস দিয়েঝুলেথাকা. লোকটাকে দেখার পর থেকে ওর খিদের অনুভূতিটা উধাও হয়ে গিয়েছিল। এখন হঠাৎ সেটা ফিরে এল।

কিন্তু নিশীথবাবু ব্যাগের মুখ বন্ধ করে প্রত্যেকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ওর সঙ্গে এগোতে লাগলেন। অনিমেষের সঙ্গী একটা মোটামতন লোক এমন সময় বলে ফেলল, বন্যার্তদের খাবার দিতে গিয়ে আমরাই ক্ষুধার্ত হয়ে গেলাম। একটু খেয়ে নিয়ে জোর করলে হত না?

নিশীথবাবু বললেন, না না, আমরা এখানে বসে খাওদাদাওয়া করলে যাদের জন্য খাবার এনেছি তারা কী ভাববে! ওদের দিয়ে তবে খাওয়া যাবে।

লোকটি মাথা নাড়ল, না, সেকথা ছিল না। তিনটে টাকা আর খিদের সময় খাবার এইরকম কথা পেয়ে কাজে এসেছি। এখন উলটোপলাটা বললে চলবে কেন?

কথাটা শুনে লোকটার দিকে অবাক হয়ে তাকাল অনিমেষ। সে কী। বন্যার্তদের সেবা করতে সত্যিকারের কংগ্রেসি নয়, শুধু নিশীতবাবুর মতো দুএকজন ছাড়া।
 
নিশীথবাবু খুব অস্বস্তিতে পড়েছেন বোঝা গেল, খিদে পেয়েছে তো এতক্ষণ নৌকোয় বসে খেলে না কেন? কাজের সময় যত ঝামেলা কর!

আমি তো মানুষ! আপনি লোকগুলোকে খেতে দিলেন না, আমি খাই কী করে? ঠিক আছে, চলুন, যা বলবেন করছি, দেখবেন টাকাটা যেন না মারা যায়।

লোকটা ব্যাগ নিয়ে হাঁটা শুরু করল। নিশীথবাবু চাপা গলায় অনিমেষকে শুনিয়ে বললেন, এইসব লোক নিয়ে দেশে বিপ্লব হবে, ভাবো!

জঙ্গলের মধ্যে ঢুকতেই একজন লোকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। লোকটা বোধহয় অনেকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে এদের দেখছিল, এখন কাছে আসতেই মুমুখি হল। বেঁটেমতন, গায়ে কাপড় জড়ানো এবং মুখচোখ ভীষণ ফোলা-ফোলা। ওদের দিকে গকিয়ে লোকটা বলে উঠল, কী আছে ব্যাগে, খাবার?

নিশীথবাবু ঘাড় নাড়লেন, কংগ্রেস থেকে রিলিফ নিয়ে এসেছি।

লোকটা ঘাড় নাড়ল, খুব বান এসেছিল, শহর ভেসে গেছে।

নিশীথবাবু বললেন, শহরে জল ঢোকেনি।

লোকটা বলল, আমাদের এখানেও না। তবে কাল থেকে কেউ কিছু খাইনি, না এলে নৌকো ডবিয়ে দিতাম। আসুন, মোড়ল আপনাদের নিয়ে যেতে বলেছে।

প্রথমদিকে লোকটার কথাবার্তা ছিল একধরনের, শেষ কথাটা বলার সময় ওকে খুব রাগী-রাগী রাগল। লোকটার পিছুপিছু ওরা হাঁটতে লাগল। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পায়ে-চলা-পথ বেশ পরিষ্কার। কিছুদুর যেতেই আর বাইরের জল চোখে পড়ল না। পথের ধারে ময়লা রক্তমাখা ফেটি পড়ে আছে। দেখেই গা ঘিনঘিন করে উঠল অনিমেষের। নিশীথবাবু নিঃশব্দে ঘাড় নেড়ে সেগুলোকে টপকে যেতে বললেন। কিছুটা যেতেই জঙ্গলটা যেন চট করে উধাও হয়ে গেল। সামেন বিরাট মাঠের মতো পরিষ্কার জমি, তার চারধারে ছোট ছোট খেলার ঘরের মতো ঘর। ঘরগুলোর চালে টিন দেওয়া, দেওয়াল যে যেরকম পেরেছে দিয়েছে। যে-কোনো ঘরেই মাথা নিচু করে ঢুকতে হয়। তবে ঠিক মধ্যিখানে বেশ শক্তমতন বিরাট চালাঘর। তার তলায় বেঞ্চি করে কাঠের খুঁটি পুঁতে রাখা হয়েছে। মাঠের এক কোণে অনেক মানুষ চুপচাপ বসে আছে। দূর থেকে তাদের ময়লা কাপড়ের স্তুপ বলে। মনে হচ্ছিল। ওরা খোলা জমিতে এসে পড়তেই লোকটা ওদের সেখানে দাঁড়াতে বলে দ্রুত সেদিকে চলে গেল। নিশীথবাবু চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, কীভাবে এরা বেঁচে আছে দ্যাখো। আর শোনো, এদের সামনে তোমরা-এমন-কিছু কোরো না যাতে এরা আঘাত পায়।

মোটা লোকটা বলল, একদম কুষ্ঠরোগীদের ডেরায় নিয়ে এলেন, এরকম কথা ছিল না।

নিশীথবাবু কথাটা শুনেও যেন শুনলেন না। অনিমেষ দেখল দুজন লোক সেই জটলা থেকে ওদের চিনিয়ে-নিয়ে-আসা লোকটির সঙ্গে উঠে এসে চালাঘরটার নিচে দাঁড়াল। পথপ্রদর্শকটি এগিয়ে এসে ওদের বলল, আসুন, মোড়ল আপনাদের সঙ্গে কথা বলবে।

নিশীথবাবুর পেছন পেছন ওরা চালাঘরটার দিকে এগিয়ে গেল। এখন রোদ নেই, একটু ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে। সমস্ত মাঠটা জুড়ে জুড়ে অদ্ভুত মায়াময় একটা ছায়া নেমেছে। হাঁটতে হাঁটতে অনিমেষ সেই বাতাসে একটা শুটকো গন্ধ পেল। গন্ধটা গা গুলিয়ে দেয়। মোটা লোকটি ফিসফিস করে বলল, কেউ শালা টেঁসেছে নির্ঘাত।
 
শহর থেকে এ জায়গাটা বেশি দূরে নয়, কিন্তু এ-অঞ্চলে অনিমেষরা কখনো আসেনি। তিস্তার তীর ধরে পায়ে হেঁটে নিশ্চয়ই এদিকের মানুষজন যাওয়া-আসা করে। শহরে যেসব কুষ্ঠরোগীকে ভিক্ষে করতে দেখা যায় তারাই যে এতটা দূর হেঁটে এই ডেরায় ফিরে আসে আগে জানত না অনিমেষ। ওর মনে পড়ল, কোনোদিন বিকেলবেলায় ও শহরের রাস্তায় একজন কুষ্ঠরোগীকেও ভিক্ষে করতে দেখেনি। এক-একজনকে দেখে মনে হত এ নিজে হাঁটতে পারবে না, অথচ কী করে যে সে আসে এবং উধাও হয়ে যায় কিছুতেই ধরতে পারত না সে।

ওদের এগিয়ে যেতে দেখে দূরের জটলার ভেতর থেকে একটা গুঞ্জন উঠল। ব্যাগগুলো যে খাবারের বুঝতে নিশ্চয়ই কারও অসুবিধে হচ্ছে না। চালাঘরের নিচে দাঁড়ানো একজন লোক হাত তুলে নিষেধ করতেই গুঞ্জনটা চট করে থেমে গেল।

চালাঘরের সামনে এসে অনিমেষ মাটিতে চোখ নামিয়ে ফেলল। একটা শীতল স্রোত যেন হঠাই নড়েচড়ে পা থেকে মাথায় উঠে এল। একপলক তাকিয়েই আর তাকাবার শক্তিটা খুঁজে পেল না সে। যে-লোকদুটি সামনে দাঁড়িয়ে আছে তাদের গায়ে পা-ঝুল-শার্ট, শার্টের ওপর ছেঁড়া কোট ঢাপানো। কোমর থেকে একটা ময়লা চিরকুট কাপড় লুঙ্গির মতো হাঁটুর নিচ অবধি জড়ানো। পায়ে কাপড়ের জুতো আছে। কিন্তু একটা লোকের বাম হাত কবজির পর শেষ হয়ে গিয়েছে, মুখের দিকে তাকালে চোখে এক লক্ষ সুচ ফোটে। কারণ তার নাক সেই, চলগুলোর জায়গায় লা চামড়া গদদশ করছে। অন্যজনের বিস্থা আরও বীভৎস। কার কানের লতি যেন ছিঁড়ে পড়েছে। ওপরের ঠোঁট না থাকায় দাঁতগুলো ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। কারোরই চোখে পাতা নেই, দ্বিতীয়জনের আঙুলগুলো ছোট হয়ে এসেছে, একটা আঙুল গোড়া থেকে খসে গিয়ে চামড়ায় লেগে ঝুলছে।

চালাঘরের ঠিক মাঝখানে বেঞ্চিগুলোর গায়ে ইটের গোল চৌহদ্দিতে আগুন জ্বলছে। কাঠের আগুন। ইঁটগুলো উঁচু বলে ওরা দূর থেকে এটাকে লক্ষ করেনি। আগুনটা এইভাবে জ্বলছে, কী কাজে লাগে কে জানে!

আপনারা কেন এসেছেন?

আমি তো মানুষ! আপনি লোকগুলোকে খেতে দিলেন না, আমি খাই কী করে? ঠিক আছে, চলুন, যা বলবেন করছি, দেখবেন টাকাটা যেন না মারা যায়।

লোকটা ব্যাগ নিয়ে হাঁটা শুরু করল। নিশীথবাবু চাপা গলায় অনিমেষকে শুনিয়ে বললেন, এইসব লোক নিয়ে দেশে বিপ্লব হবে, অবো! ·

জঙ্গলের মধ্যে ঢুকতেই একজন লোকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। লোকটা বোধহয় অনেকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে ওদের দেখছিল, এখন কাছে আসতেই মুখোমুখি হল। বেঁটেমতন, গায়ে কাপড় জড়ানো এবং মুখচোখ ভীষণ ফোলা-ফোলা। ওদের দিকে তাকিয়ে লোকটা বলে উঠল, কী আছে ব্যাগে, খাবার?

নিশীথবাবু ঘাড় নাড়লেন, কংগ্রেস থেকে রিলিফ নিয়ে এসেছি।

লোকটা ঘাড় নাড়ল, খুব বান এসেছিল, শহর ভেসে গেছে?

নিশীথবাবু বললেন, শহরে জল ঢোকেনি।

লোকটা বলল, আমাদের এখানেও না। তবে কাল থেকে কেউ কিছু খাইনি, না এলে নৌকো ডবিয়ে দিতাম। আসুন, মোড়ল আপনাদের নিয়ে যেতে বলেছে।
 
প্রথমদিকে লোকটার কথাবার্তা ছিল একধরনের, শেষ কথাটা বলার সময় ওকে খুব রাগী-রাগী রাগল। লোকটার পিছুপিছু ওরা হাঁটতে লাগল। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পায়ে-চলা-পথ বেশ পরিষ্কার। কিছুদুর যেতেই আর বাইরের জল চোখে পড়ল না। পথের ঋরে ময়লা রক্তমাখা ফেটি পড়ে আছে। দেখেই গা ঘিনঘিন করে উঠল অনিমেষের। নিশীথবাবু নিঃশব্দে ঘাড় নেড়ে সেগুলোকে টপকে যেতে বললেন। কিছুটা যেতেই জলটা যেন চট করে উধাও হয়ে গেল। সামেন বিরাট মাঠের মতো পরিষ্কার জমি, তার চারধারে ছোট ছোট খেলার ঘরের মতো ঘর। ঘরগুলোর চালে টিন, দেওয়া, দেওয়াল যে যেরকম পেরেছে দিয়েছে। যে-কোনো ঘরেই মাথা নিচু করে ঢুকতে হয়। তবে ঠিক মধ্যিখানে বেশ শক্তমতন বিরাট চালাঘর। তার তলায় বেঞ্চি করে কাঠের খুঁটি পুঁতে রাখা হয়েছে। মাঠের এক কোণে অনেক মানুষ চুপচাপ বসে আছে। দূর থেকে তাদের ময়লা কাপড়ের স্তুপ বলে মনে হচ্ছিল। ওরা ভোলা জমিতে এসে পড়তেই লোকটা.ওদের সেখানে দাঁড়াতে বলে দ্রুত সেদিকে চলে গেল। নিশীথবাবু চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, কীভাবে এরা বেঁচে আছে দ্যাখো। আর শোনো, এদের সামনে তোমরা এমন-কিছু কোরো না যাতে এরা আঘাত পায়।

মোটা লোকটা বলল, একদম কুষ্ঠরোগীদের ডেরায় নিয়ে এলেন, এরকম কথা ছিল না।

নিশীথবাবু কথাটা শুনেও যেন শুনলেন না। অনিমেষ দেখল দুজন লোক সেই জটলা থেকে ওদের চিনিয়ে-নিয়ে-আসা লোকটির সঙ্গে উঠে এসে চালাঘরটার নিচে দাঁড়াল। পথপ্রদর্শকটি এগিয়ে এসে ওদের বলল, আসুন, মোড়ল আপনাদের সঙ্গে কথা বলবে।

নিশীথবাবুর পেছন পেছন ওরা চালাঘরটার দিকে এগিয়ে গেল। এখন রোদ নেই, একটু ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে। সমস্ত মাঠটা জুড়ে জুড়ে অদ্ভুত মায়াময় একটা ছায়া নেমেছে। হাঁটতে হাঁটতে অনিমেষ সেই বাতাসে একটা শুটকো গন্ধ পেল। গন্ধটা গা গুলিয়ে দেয়। মোটা লোকটি ফিসফিস করে বলল, কেউ শালা টেঁসেছে নির্ঘাত।

শহর থেকে এ-জায়গাটা বেশি দূরে নয়, কিন্তু এ-অঞ্চলে অনিমেষরা কখনো আসেনি। তিস্তার তীর ধরে পায়ে হেঁটে নিশ্চয়ই এদিকের মানুষজন যাওয়া-আসা করে। শহরে যেসব কুষ্ঠরোগীকে ভিক্ষে করতে দেখা যায় তারাই যে এতটা দূর হেঁটে এই ডেরায় ফিরে আসে আগে জানত না অনিমেষ। ওর মনে পড়ল, কোনোদিন বিকেলবেলায় ও শহরের রাস্তায় একজন কুষ্ঠরোগীকেও ভিক্ষে করতে দেখেনি। এক-একজনকে দেখে মনে হত এ নিজে হাঁটতে পারবে না, অথচ কী করে যে সে আসে এবং উধাও হয়ে যায় কিছুতেই ধরতে পারত না সে।

ওদের এগিয়ে যেতে দেখে দূরের জুটলার ভেতর থেকে একটা গুঞ্জন উঠল। ব্যাগগুলো যে খাবারের বুঝতে নিশ্চয়ই কারও অসুবিধে হচ্ছে না। চালাঘরের নিচে দাঁড়ানো একজন লোক হাত তুলে নিষেধ করতেই গুঞ্জনটা চট করে থেমে গেল।

চালাঘরের সামনে এসে অনিমেষ মাটিতে চোখ নামিয়ে ফেলল। একটা শীতল স্রোত যেন হঠাৎই নড়েচড়ে পা থেকে মাথায় উঠে এল। একপলক তাকিয়েই আর তাকাবার শক্তিটা খুঁজে পেল না সে। যে-লোকদুটি সামনে দাঁড়িয়ে আছে তাদের গায়ে পা-কুল-শার্ট, শার্টের ওপর হেঁড়া কোট চাপানো। কোমর থেকে একটা ময়লা চিরকুট কাপড় লুঙ্গির মতো হাঁটুর নিচ অবধি জড়ান। পায়ে কাপড়ের জুতো আছে। কিন্তু একটা লোকের বাম হাত কবজির পর শেষ হয়ে গিয়েছে, মুখের দিকে তাকালে চোখে এক লক্ষ সুচ ফোটে। কারণ তার নাক সেই, চুলগুলোর জায়গায় লাল চামড়া গদদগ করছে। অন্যজনের বস্থা আরও বীভৎস। কার কানের লতি যেন ছিঁড়ে পড়েছে। ওপরের ঠোঁট না থাকায় দাঁতগুলো ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। কারোরই চোখে পাতা নেই, দ্বিতীয়জনের আঙুলগুলো ছোট হয়ে এসেছে, একটা আঙুল গোড়া থেকে খসে গিয়ে চামড়ায় লেগে ঝুলছে।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top