What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected উত্তরাধিকার - সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

ভেতরে থেকে মহীতোষের গলা ভেসে গেল, অনিমেষকে ডাকছেন। অনিমেষ সাড়া দিয়ে দেখল, চা-বাগানের নুড়িবিছানো পথ দিয়ে সাইকেলগুলো দ্রুত মাঠের দিকে ছুটে আসছে। টাইপবাবু, ডাক্তারবাবু, পাতিবাবু, মশাবাবুরা জোরে জোরে প্যাডেল ঘুরিয়ে যে যার কোয়ার্টারের দিকে চলে যাচ্ছেন। মনোজ হালদারকে চিনতে পারল অনিমেষ, সেইরকম চেহারা আছে এখনও, নিজের কোয়ার্টারের দিকে যেতে-যেতে হঠাৎ সাইকেল ঘুরিয়ে সীতাদের কোয়ার্টারের সামনে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে কিছু বলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সীতার বাবাকে ওঁদের গেটে দেখতে পেল অনিমেষ। মাথা নেড়ে কিছু কিজ্ঞাসা করে চ্যাঁচামেচি করে বাড়ির লোকদের কিছু বলতে লাগলেন। এই সময় আরও কিছু লেবারকে পতাকা-হাতে লাইন থেকে ছুটে আসতে দেখল অনিমেষ। বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ হইহই করতে করতে চা-বাগানের নুড়িবিছানো পথটায় ঢুকে যাচ্ছে। এবং অনিমেষ অবাক হয়ে শুনল কেউ-একজন চিৎকার করে উঠতেই বাকিরা জানান দিল, জিন্দাবাদ। ইনকিলাব জিন্দাবাদ। বলার ধরনটা শহরে-শোনা ধ্বনির মতো নয়, এবং বেশ মজা পেয়ে গেছে ওরা–ভাবভঙ্গিতে তা-ই মনে হল। ওরা চলে যাওয়ার পর অনিমেষ দেখল আসাম রোডের ওপারে মাড়োয়ারি দোকানের ঝাঁপ শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেল।

অনিমেষ ব্যাপারটাকে কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছিল না। এই শান্ত সরল মানুষগুলো হঠাৎ একম খেপে গেল কেন? ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছে বাবুদের দেখলে এরা কেনোর মতো গুটিয়ে যায়, বাবুদের কোয়ার্টারের ছেলেকে কাজে লাগাতে পারলে ধন্য হয়, তারাই এখন খেপে গেল কেন? আর বাবুদের তো এমন ভয় পেতে দেখেনি ও! লোকগুলো কী চাইছে? টাকাপয়সা-খাবারদাবার? ওর মনে পড়ল সুনীলদা বলেছিল পৃথিবীতে দুটো জাত ছে, একদল হল সর্বহারা, অন্যদল বুর্জোয়া। বুর্জোয়া মানে যার সব আছে, কিন্তু সামান্য কিছু হারাবার ভয়ে যে অনেক বেশি সর্বহারাদের কাছে আদার করে। তা হলে এই লেবারগুলো সর্বহারা? কিন্তু ওর মনে হল বাবা এবং অন্য বাবুরা মিছিমিছি ভয় পাচ্ছেন। এরা আর যা-ই হোক, এই কোয়ার্টারগুলোতে এসে হামলা করবে না। কখনো কোনো মদেসিয়া ওঁরাওকে ও অভদ্র হতে দেখেনি, হাড়িয়া খেয়ে মাতাল হয়ে গেলেও না। অনিমেষ মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে কোয়ার্টারগুলোকে ভালো করে দেখল। সবকটার দরজা বন্ধ। আসাম রোড দিয়ে হুশহুশ করে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। হঠাৎ ওর মনে হল স্বৰ্গছেঁড়ার চেহারাটা যেন অনেকখানি পালটে গেছে। এই মাঠের মধ্যে দাঁড়ানো গাছ দুটো কেমন শীর্ণ, পাতাবাহার গাছগুলো শুকিয়ে মরে যাচ্ছে, বৈশাখমাসের শেষে প্রখর রোদে প্রখর রোদে স্বৰ্গছেঁড়া এখন পুড়ছে। অথচ চিরকাল এখানে একটা ঠাণ্ডা ভাব থাকত, এই সময় ভুটানের পাহাড় থেকে মেঘগুলো বৃষ্টি নিয়ে আসত।

কোয়ার্টারের বারান্দায় উঠে এল অনিমেষ। আর বাবা তাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন এবং এই প্রথম ওঁর মুখে সে খোকা ডাকটা শুনতে পেল। অন্য সময় হয়তো খোকা শুনলে তার হাসি পেত, কিন্তু সেই মুহূর্তে ওর ডাকটা ভালো লেগেছিল। এখান থেকে চাল যাওয়ার পর থেকে বাবার সম্পর্কে ওর মনে যে-দৃণা এবং তিক্ততা বাসা বেঁধেছিল, এই মুহূর্তে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। বাবা যেন আমূল পালটে গেছেন। শুধু তার সঙ্গেই নয়, ছোটমার সঙ্গেও বাবা কী ভালো ব্যবহার করছেন। মহীতোষের বুকের সঙ্গে লেপটে থাকার সময়কার অস্বস্তিটা ওর মনে আবার এল। বাল্যকাল থেকে এ-পর্যন্ত এরকম ঘটনা ঘটেছে কি না মনে পড়ে না। কীসব যে চটপট হয়ে যায়! যাকে দেখতে আজ খারাপ লাগল, কাল হয়তো সেটা অন্যরকম হতে পারে।

আশ্চর্য, বসার ঘরটা ঠিক সেইরকম আছে! এই যে এতগুলো বছর কেটে গেল, এই ঘরটার ওপর তার কোনো ছাপ পড়েনি। শুধু সোফার ওপর কভারগুলো এখন পালটে গেছে এবং-। অনিমেষ। পায়েপায়ে সোফার পাশে দেওয়ালের সামনে এসে দাঁড়াল। একটা বড় ফ্রেমে বাঁধানো ছবিতে তার চার-পাঁচ বছরের মুখটা হাসছে। কী ভীষণ দুই-দুই লাগছে চোখ দুটো। নিজের যে এরকম একটা। ছবি আছে একদল জানা ছিল না, অনিমেষ দেখল এই এত বছর হয়ে গেল, তার মুখ খুব সামান্যই পালটেছে। এই ছবি আগে এখানে ছিল না। বাবা নিশ্চয়ই নতুন করে বাঁধিয়ে এখানে টাঙিয়েছেন। কবে থেকে? অনিমেষের সবকিছু গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল।
 
মাঝের ঘরে পা দিতেই অনিমেষ দেখল বাবা দ্রুত জানলাগুলো বন্ধ করছেন, ছোটমা উবু হয়ে বসে সুটকেসে কীসব ভরছে। ওকে দেখে ছোটমা বলল, তুমি এতদিন পর এলে, আর কী হাঙ্গামায় পড়তে হল বলো তো?

অনিমেষ বলল, কিন্তু এখানে গোলমাল হবে কেন?

মহীতোষ বললেন, লেবাররা স্ট্রাইক কল করেছিল যখন তখন আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করেনি। আজ যেহেতু আমরা অফিসে গেছি, ওরা খেপে গেছে। স্ট্রাইকটো যে আমাদের নয় সেটা ওরা বুঝতে চাইছে না।

অনিমেষ বলল, আমাদের বাগানের কুলিরা এমন করবে কোনোদিন কেউ কল্পনা করতে পারিনি!

মহীতোষ বিরক্ত হয়ে বললেন, ওদের দাবিগুলো ঠিক আছে, কিন্তু এভাবে কোনো কাজ হয় না। জলপাইগুড়ি থেকে লোক এসে রাতদিন তাতিয়ে এই কাণ্ড করেছে, তারপর আমাদের জুলিয়েনবাবু আছেন-তিনিই তো এখন ওদের নেতা।

জুলিয়েন? প্রশ্নটা করেই অনিমেষ ভাবল, বাবা কি সুনীলদাকে চেনেন?

বকু সর্দারের ছেলে। তোর দাদুর পেছনে যে-বকু সর্দার দিনরাত ঘুরে বেড়াত। বকুটা,মরে গেছে, ওর ছেলে হল এদের পাণ্ডা। আবার মজা হল জুলিয়েন কিন্তু নিজে লেবার নয়, অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টোরকিপার-ছোট মালবাবু। কোম্পানি এখন মদেসিয়াদের বাবুদের চাকরিতে গেলেন।

কুলিদের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করতে ওঁরা এবং বোনাই যাচ্ছে, বাগানের সাই: কোয়ার্টার ছেড়ে বাজারে দিকে চলে যাবে। যেহেতু বাজার-এলাকাটা চা-বাগানের আওতায় পড়ে না, তাই সেখানে গেলে কুলিরা হামলা করতে পারবে না। এতদিন ধরে যে-মানুষগুলোকে দিনরাত চোখের ওপর দেখে আসছেন এই বাগানের বাবুরা, আজ যেন আর তাদের বিশ্বাস করতে পারছেন না অথচ মজার ব্যাপার, দুদলই এই বাগানে কী। বিলেতে বসে কলকাতার অফিসের মাধ্যমে কোম্পানি এই বাগানের ওপর কর্তৃত্ব করছে এবং তার সরাসরি দায়িত্ব ম্যানেজারের ওপর। কুলিরা দাবিদাওয়া মানেজারকে জানিয়েছে, ম্যানেজার সেটা কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। যতক্ষণ কোনো সিদ্ধান্ত না হবে ধর্মঘট চলবে! ম্যানেজার সকাল থেকে তার বাংলোর সামনে একগাদা সিকিউরিটির লোক বসিয়ে রেখেছেন-সবাই জানে সাহেবের কাছে দুটো বন্দুক আছে। ওখানে হামলা সহজে হবে না। কিন্তু কুলিরা বাবুদের কাজে যাওয়াটা মানতে পারছে না। জুলিয়েন নিজে আজ কুলিদের সঙ্গে আছে। যদিও বাবুদের ইউনিয়ন আলাদা, তবু কুলিদের রাগ ওঁদের ওপরই পড়েছে। এতদিন ধরে যা-কিছু হুকুম ওরা পেয়েছে তা বাবুদের কাছ থেকেই, ম্যানেজারের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ওদের হয় না। জলিয়েন ওদের পরিষ্কার করে না বললেও ওদের বুঝতে কষ্ট হয়নি, যা-কিছু অত্যাচার তা এই বাবুদের মাধ্যমেই সাহেব করেছেন। তাই আজ বাবুরা কাজে গিয়েছে খবর পেয়ে দলেদলে লোক ছুটছে ফ্যাক্টরির সামনে।

মহীতোষদের ডেকে ম্যানেজার আগাম খবরটা দিয়েছেন। সাদা-চামড়ার এই সাহেব উত্তরবঙ্গের চা-বাগানগুলোয় স্কটিশদের শেষ প্রতিনিধি। এখন ভালো হিন্দি বলতে পারেন ভ্রলোক। অত্যাচারী বলতে যা বোঝায় মহীতোষরা একে সেরকম মনে করেন না। অবশ্য সাহেবের একটা নিজস্ব গোয়েন্দাবাহিনী আছে, যারা ওঁকে এই চা-বাগানের সব খবর আগাম এনে দেয়। তাই সাহেব যখন মহীতোষের ডেকে কুলিদের সম্ভাব্য আক্রমণের কথা বলছিলেন তখন চট করে কেউ বিশ্বাস করতে গারিননি। এতদিনের পরিচিত মুখগুলো, যারা সাত চড়েও রা কাড়ে না, তারা আজ আক্রমণ করবে ভাবতে পারছিলেন না। যদিও বেশ কিছুদিন ধরে তারা খবর পাচ্ছিলেন, বিভিন্ন পার্টির লোক এসে লাইনে-লাইনে কুলিদের তাতাচ্ছে কিন্তু কেউ সেটায় তেমন গা করেননি। দীর্ঘকাল ধর্মঘট বা আন্দোলন চালাবার মতো মানসিক এবং আর্থিক ক্ষমতা এদের নেই-এটা সবাই জানে না। এই চা-বাগানে যে-সমস্ত কুলিকামিন কাজ করে তাদের বেশির ভাগ হপ্তায়-হপ্তায় টাকা পায়। যদিও একটা পরিবারের একদম শিশু ও বৃদ্ধ ছাড়া ছেলে মেয়ে বাবা সবাই কাজে আসে, কিন্তু হপ্তার টাকা পেলে সেটা ঘরে পৌঁছায় খুব সামান্য। স্বৰ্গছেঁড়ার চৌমাথায় বিরাট ভাটিখানা তো আছেই, শনিবার রাত্রে জুয়োর বোর্ড বসে যায় ডব্লিউ-এর শেষে। ডব্লিউ হল ছোট ছোট বাজার-কিন্তু তারপর জুয়াড়িয়া না এসে সেখানে ফাঁদ পাতে অনেক রাত পর্যন্ত পেট্রোম্যাক্স জ্বালিয়ে। কুলিরা যে-টাকা রোজ হিসাবে পায় কামিনরা পায় তার অর্ধেক। এই টাকা হাতে এলেই এদের মেজাজ হাড়িয়া না হলে শান্ত হয় না। ফলে দুদিন যেতে-না-যেতে ধারের মাত্রা বাড়তে থাকে।
 
এইরকম অর্থনৈতিক অবস্থা যাদের, যারা ম্যানেজার তো দূরের কথা–বাবুদের দেখলেই হাতজোড় করে অনুগ্রহের আশায় দাঁড়িয়ে পড়ে মাথা নিচু করে, তাদের কোনো পলিটিক্যার পার্টির লোক খ্যাপালেও কোনো কাজ হবে না এই বিশ্বাস সকলের ছিল। কিন্তু কদিন থেকে উত্তেজনা চরমে উঠে আজ সকালে যখন মহীতোষরা ফ্যাক্টরিতে এলেন তখন দেখলেন একটা লোক নেই ধারেকাছে, আংরাভাসার বুকে হুইলটা পর্যন্ত ঘুরছে না। নিঝুম হয়ে আছে স্বৰ্গছেঁড়া চা-বাগানের ফ্যাক্টরি এবং অফিস। দু-একজন যারা ভয়েভয়ে এসেছিল, গতিক সুবিধের নয় বলে গা-ঢাকা দিয়েছে। ফাঁকা ফ্যাক্টরিতে থাকতে ওদের অস্বস্তি হচ্ছিল, এমন সময় সাহেব তার কোয়ার্টারে বাবুদের ডেকে পাঠিয়ে আক্রমণের সংবাদ দিলেন। ডাক্তারবাবু কথাটাকে একদম নাকচ করে দিয়ে বলেছিলেন, কুলিরা তার কোনো ক্ষতি করতে পারে তিনি বিশ্বাস করতে পারেন না। আজ এত বছর তাকে দেবতার মতো মেনে এসেছে, এখন ওঁর গায়ে হাত তুলবে? অসম্ভব! কিন্তু সাহেব বললেন, যেহেতু দেশ এখন স্বাধীন। হয়েছে আর তার নিজস্ব ক্ষমতা নেই, তাই সেরকম কিছু হলে তিনি বাবুদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারবেন না। সেজন্য তিনি ওঁদের বিশ্বস্ত আনুগত্যের কথা স্মরণ রেখে আগাম খবরটা জানিয়ে দিচ্ছে এবং যদি সম্ভব হয় বাবুরা যেন এখনই কোনো নিরাপদ জায়গায় সাময়িকভাবে চলে যান। গোলমাল মিটে গেলে সাহেব আশা করেন যে তারা কাজে যোগ দেবেন এবং এই আনুগত্যের কথা সাহেব তার সুপরিশসহ কোম্পানিকে জানিয়ে দেবেন। একথা শোনার পরই ওঁরা যে যার কোয়ার্টারে ফিরে এসেছেন।

মহীতোষের অবশ্য মাথায় আর-একটা চিন্তা ছটফট করছিল। স্কুল ফাইনালের রেজাল্ট বেরিয়ে



গেছে। অনিমেষ হয়তো আজই স্বৰ্গছেঁড়ায় আসবে। ছেলে যদি পাশ না করতে পারে তার বলার কিছু নেই। কারণ মাধুরী চলে যাওয়ার পর তিনি একমাত্র টাকা পাঠানো ছাড়া ওর প্রতি কোনো কর্তব্য করেননি। তা ছাড়া কোনোকালেই তিনি ছেলেকে কাছে ডেকে নিজের করে নিতে পারেননি। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিবাহের পর থেকে তার মধ্যে ছেলের সম্পর্কে একটা অস্বস্তি এমন দানা বেঁধেছিল যে, ভালোভাবে কথা বলতে যেন কিসে বাধত। তারপর সেই বীভৎস দিনগুলো। সন্তানের জন্য তার দ্বিতীয় স্ত্রী তাকে কোনোদিন ব্ৰিত করেনি, বরং তিনিই এরকম কিছু হোক চেয়েছিলেন। এ-পক্ষের ছেলেমেয়ে এলে ব্যাপারটা সহজ হয়ে যাবে–সংসারে জড়েয়ে পড়লে অনেক অস্বস্তি কেটে যাবে, এইরকম একটা ধারণা মাথায় ঢুকে যাওয়ায় সেই অশান্তির সময়টা চলে এল। ওষুধপত্র, টোটকা, মাদুলি-কিছুতেই যখন স্ত্রী পুত্রবতী হল না, তখনই যোগাযোগ হল অধর তান্ত্রিকের সঙ্গে। তিনদিন তিনরাত সরুগার শ্মশানে ওঁর সঙ্গে বসে কারণ পান করার পর হঠাৎই তার মনে হল তিনি অত্যন্ত অন্যায় করেছেন। এই স্ত্রীকে বিবাহ এবং সন্তান কামনা করে তিনি মাধুরীর প্রতি চূড়ান্ত অসম্মান দেখিয়েছেন। ফলে সন্তান–ইচ্ছা চট করে মিলিয়ে গেল-তান্ত্রিক তাকে শেখালেন কী করে মৃত মাধুরীর আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। অদ্ভুত গোরের মধ্যে কেটে গেল দিনগুলো। এখনও সব ব্যাপার স্পষ্ট করে মনে পড়তে চায় না। তান্ত্রিক বাড়িতে এসে নিয়মিত দক্ষিণা নিয়ে যেত। সেই সময় মুখ গু৭জে কাজ করে গেছে এই স্ত্রী, ঝাড়িকে বাড়ি থেকে তিনি তাড়িয়ে দিয়েছেন। জলপাইগুড়িতে গেলে ছটফট করতেন কতক্ষণে স্বৰ্গছেঢ়ায় ফিরে আসেন। মাধুরীর দেখা তিনি পেতেন কি? কেমন অস্পস্ট ধোঁয়াটে একটা ধারণা তার এখনও আছে যে অধর তান্ত্রিক মাধুরীর মুখোমুখি ওঁকে করিয়ে দিয়েছিলেন একদিন। মাধুরীকে খুব দুখি-দুখি মনে হয়েছিল সেদিন। অধর তান্ত্রিক বলেছিল, তার সন্তানকামনাই মাধুরীকে দুঃখী করেছে।
 
তারপর সেই রাত এল। তিনি অনিমেষকে কী বলেছিলেন খেয়াল নেই, শুধু মনে আছে অনিমেষ ওঁকে ঠেলে দিয়েছিল। যখন জ্ঞান এল তিনি দেখলেন মাথায় ব্যান্ডেজ, সমস্ত শরীর দুর্বল তিনি কিছুই চিন্তা করতে পারছেন না। ছেলে জলপাইগুড়ি ফিরে যাওয়ায় সময় তিনি স্ত্রীকে বলেছিলেন তাকে বলে দিতে যে সরিৎশেখর যেন এসব ঘটনার কথা জানতে না পারেন। ছেলের কারণেই তিনি আঘাত পেয়েছেন মাথায় এই বোধ হতেই চট করে গুটিয়ে গেলেন মহীতোয। অনিমেষ কথা রেখেছিল, তার কারণ এর পর কতবার তিনি জলপাইগুড়ি গিয়েছেন, সরিৎশেখর এসব ব্যাপারে কোনোদিন কিছু জিজ্ঞাসা করেননি। অনিমেষ সম্পর্কে যেটুকু আড়ষ্টতা ছিল মনেমনে, সেটা যেন এই ঘটনার পর লজ্জায় রূপান্তরিত হয়ে গেল। নিজের তৈরি-করা বেড়াটা আর কখনো তার পক্ষে ডিঙানো সম্ভব হল না।

বিছনায় শুয়ে থাকার সময়ই বাড়ি এই বাড়িতে ফিরে এল। ওঁর অবস্থা দেখে সে চিৎকার কান্নাকাটি করে অধর তান্ত্রিককে গালাগালি করতে লাগল। তিনি দেখলেন ঝাড়ি যেন হঠাৎ অসমসাহসী হয়ে এ-বাড়ির ভালোমন্দ দেখাশুনা করছে। সুস্থ হয়ে শুনলেন অধর তান্ত্রিক আর সরুর্গার শ্মশানে নেই, কিছু লোক এক রাত্রের অন্ধকারে সেখানে গিয়ে মেরেধরে তাড়িয়ে দিয়েছে। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, এত ব্যাপার ঘটে গেল অথচ তার স্ত্রীর যেন কিছুতেই কোনো বিকার নেই। খুব স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে সে-তুলেও আর ওই সময়ের কথা উচ্চারণ করে না।

আজ বাড়ি ফিরেছিলেন একটা উত্তেজনা নিয়ে। ফিরে এসে পুত্রকে দেখে ওঁর অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করছিল। অথচ কিছুই বলতে পারলেন না। এমনকি ওকে বুকে জড়িয়ে ধরার সময় তার মনে হয়েছিল এ যেন তার সন্তান নয়। যৌবনে এসে-পড়া একটা প্রায় পূর্ণ শরীর, যার গোঁফের রেখা স্পষ্ট, গালে সামান্য ব্রন, মাথায় যে তার সমান-তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেও দীর্ঘ দূরত্নের বলে বোধ হচ্ছিল। একমাত্র বুকের ভেতর ছাড়া সন্তান কখনো চিরকাল পরিচিত থাকে না-অনিমেষ তো হবেই। কিন্তু কী খেয়ালে আজ ওকে তিনি খোকা বলে ডেকে উঠলেন। ওর যখন হামাগুড়ি দেবার বয়স, মাধুরীর নকল। করে মহীতোষ মাঝে-মাঝে খোকা বলে ডাকতেন। আধো-বুলি-ওঠা অনিমেষ তাকটা শুনলেই কা-কা করে উঠত। এটা ছিল একটা মজার খেলা ওদের কাছে। আজ সব কথা যা বলা যায়নি এই একটি ডাকের মাধ্যমে যেন বলে ফেলেছেন তিনি-ভেতরটা কেমন শান্তিতে ভরে যাচ্ছিল।



ভেতরের ঘরের দরজা বন্ধ করে মহীতোষ ছুটে যেতেই অনিমেষ ভ্রূ কুঁচকে এই ঘরটা দেখল। আশ্চর্য, মায়ের ছবিটা তো আর এখানে নেই। সেই অন্ধকারে ধোয়াটে পরিবেশে মাধুরীর বিষণ্ণ ছবিটা, যেটা দারুণ চাপ সৃষ্টি করত বুকের মধ্যে-অনিমেষ অবাক হয়ে দেখল, সেটা কোনোকালে এখানে ছিল কি না বোঝা যাচ্ছে না। বরং ঘরটা বেশ পরিষ্কার, দুটো সিঙ্গল খাটা জোড়া দিয়ে বিছানা পাতা আছে। বাবা এবং ছোটমা এখানে শোন-বোঝাই যাচ্ছে। অনিমেষ নিজের অজান্তেই মাধুরীর ছবিটা এখানে না দেখতে পেয়ে খুশি হল। ধীরপায়ে ও ভেতরের বারান্দায় আসতেই বাবার গলা শুনতে পেল, খোকা, ঝাড়িকে ডাক-আর দেরি করা ঠিক হচ্ছে না।

কথাটা শুনে কেমন হতভম্ব হয়ে গেল অনিমেষ। এখানে আসার পর চটপট এমন সময় ঘটনা ঘটে যাচ্ছে যে সে তাল রাখতে পারছে না। ঝাড়িকাকু এ-বাড়িতে আবার কী করে ফিরে এল। বাবা তো ওকে মেরে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। মাত্র ত্রিশ মাইল দূরত্বে থেকে ও এসব ঘটনা জানতে পারল! স্বৰ্গছেঁড়া থেকে চলে যাওয়ার পর থেকে ওর সঙ্গে সংযোগ রাখার দায়িত্ব যেন কারও নেই, সে যে এই বাড়ির একমাত্র ছেলে, এই জায়গার সঙ্গে তার নাড়ির সম্পর্ক-একথা সবাই যেন চট করে ভূলে গেছেন। অবশ্য সে একা নয়, যে-দাদু চিরকাল এখানে থেকে গেলেন, তাকেও কেউ কোনো কথা জানাবার প্রয়োজন বলে মনে করে না। অভমানটা বুকের মধ্যে জমতে শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওর খেয়াল হল এখান থেকে চলে যাওয়ার পর সে একটি চিঠি নিজে লেখেনি। চিঠি লিখলে ও নিশ্চয়ই সেব কথা জানতে পারত। চিঠির কথা মনে হলেই সীতার কথা মনে পড়ে যায়।
 
উঠোনে নেমে এল অনিমেষ। পেয়ারাগাছটায় একগাদা চড় ইপাখি হইচই করছে। উঠোনের ওপাশে সেই বুড়ো কাঁঠালগাছটাকে অ্যাদ্দিনে সত্যিই জরাগ্রস্ত বলে মনে হচ্ছে। গায়ে শ্যাওলা পড়ে জবুথবু হয়ে রয়েছে গাছটা। নিজের অজান্তেই বুকভরে নিশ্বাস নিল অনিমেষ–আঃ! ওর মনে হল এইসব রক্তের মতো পরিচিত গছিগাছিল গন্ধ যেন ও বাতাসে পাচ্ছে।

এই সময় ও ঝাড়িকাকুকে সেখানে দেখতে পেল। সেই খাকি রঙের হাফপ্যান্ট আর ছিটের ফতুয়া পরে ঝাকিকাকু একটা ঝুড়ি নিয়ে পেছনের বাগান থেকে বেরিয়ে আসছে। এই কবছরে অনেকটা বদলে গেছে ঝাকিকাকু। চুল পেকে গিয়ে শরীরটা একটু কুঁজো হয়েছে। ও এগিয়ে যেতেই ঝাকিকাকু থমকে দাঁড়াল। বোধহয় অনিকে এতখানি লম্বা সে আশা করেনি। বিস্ময়টা কাটিয়ে উঠে পিতলের সেই দাতটা বের করে হাসল, পাশ করেছিস?

ততক্ষণে ওর সামনে এসে পড়েছে, অনিমেষ, ঘাড় নেড়ে দুহাতে ঝাড়িকাকুর হাত দুটো ধরে বলল, কেমন আছ তুমি?

সঙ্গে সঙ্গে মুখটা আরও বুড়োটে হয়ে গেল, মাথা নেড়ে ঝাকিকাকু বলল, ভালো না রে, দুপায়ে যা বাতের ব্যথা-বেশিদিন বাঁচতে আর ভালোও লাগে না।

সেকথায় কান কান দিয়ে অনিমেষ বলল, ওঃ, তোমাকে এ-বাড়িতে দেখে কী ভালো লাগছে।

ঝাজিকাকু বলল, মহী যদি এখানে জায়গা না দিত, তা হরে না খেয়ে মরেই যেতাম। এই বুড়ো বয়সে ওসব কাজ পারি? তা কর্তাব কেমন আছেন? বগদি?

অনিমেষ বল, ভালো আছেন, তবে বয়স তো হচ্ছে।

ঝাড়িকাকু বলল, হ্যাঁ রে, বয়স না হলে কেউ বুঝতে পারে না সে-জিনিসটা কেমন। তা তুই তো এখন কলকাতায় যবি পড়তে, না? ফিরে এলে দেখবি তোদের ঝাড়ি আর নেই। তা না-ই থাকলাম, তুই বড় হ অনি। তারপর হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ায় খবরটা দিল, তোর সেই মাস্টারশাই-যার কাছে তোতে আমাতে গিয়েছিলাম রে-মরে গেছে।

চট করে সেই নস্যিমাখা ঘেমো মুখটা যেন সমস্ত আকাশ জুড়ে অনিমেষের চোখের সামনেটা ভরাট করে দিল। এইমাত্ৰ-বেলা ঝাড়িকাকুর কথাটায় একটা মুখ ভেসে উঠল-ওর সমস্ত কান জুড়ে যিনি বন্দেমাতরম শব্দটা শুনিয়েছিলেন। চুপচাপ দাঁড়িয়ে অনিমেষ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। সেটা দেখে ঝাকিকাকু অন্যদিক মুখ ফিরিয়ে বলল, কাদিল না অনি, ওভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো।

এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে মহীষে ভেতরের বারান্দায় এসে ওদের দেখতে পেলেন, কী করছিস তোরা এখনও, এর পরে অনিমেষের দিকে একবার তাকিয়ে খুব নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে।

মহীতোষই দ্রুত বলে গেলেন, বাগানের কুলিরা খেপে গেছে, বাড়িতে এসে হামলা করতে পারে। জিনিসপত্র যেখানে যা আছে পড়ে থাক, এখন বাজারে চলো।

ঝাড়িকাকু বলল, কুলিরা খামোকা হামলা করতে যাবে কেন?

রেগে গেলে কারও মাথা ঠিক থাকে। আমরা কাজে গিয়েছি বলে ওরা রেগে গেছে। চলো চলো। মহীতোষ তাড়া দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন।

কিন্তু ঝাড়িকাকুর ব্যস্ততার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না। ঘাড় নেড়ে বলল, তোরা যাবি যা, আমি যাব না।

মহীতোষ বললেন, যদি মারধোর করে?

আমাকে মারবে না। আমি ওদের সবাইকে চিনি। আমি গেল এই বাড়ি দেখবে কে?

ঝাড়িকাকু এগিয়ে গিয়ে রান্নাঘরের বারান্দায় ঝুড়িটাকে লমিয়ে রাখল। মহীতোষ কিছু বলতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত কাঁধ ঝাকিয়ে দ্রুত ভেতরে চলে গেলেন। সেদিকে তাকিয়ে ঝাড়িকাকু বলল, মানুষের রকম দেখেছিস, যাদের সঙ্গে এতদিন বাস করল এখন তাদেরই ভয় করছে। এই মদেসিয়াগুলোর মতো সরল মানুষ কখনো কাউকে মারতে পারে?
 
ঝাড়িকাকুর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ অনিমেষের মনে হল এত নির্লিপ্ত এবং ঠাণ্ডা মাথায় কথা বলতে বোধহয় খুব কম মানুষই পারে। বাবার অস্থিরতা ও ঝাড়িকাকুর স্থিরতা খুব স্পষ্ট হয়ে ওর চোখে পড়ছিল। হঠাৎ যেন মনে পড়ে গেছে এরকম ভঙ্গিতে ঝাড়িকাকু বলল, এই অনি, তুই দাঁড়িয়ে আছি কেন, যা, চলে যা তাড়াতাড়ি।

অনিমেষ বলল, সত্যি ওরা মারতে পারে? আমরা তো কোনো দোষ করিনি!

ঝাড়িকাকু বলল; তা হোক, তবু তোর যাওয়া ভালো।

কিন্তু তুমি যাচ্ছ না কেন? ঝাড়িকাকুর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর অনিমেষের এইভাবে চলে যেতে ইচ্ছে করছিল না।

এবার ঝাড়িকাকু হেসে ফেলল, যতই পাশ কর বাবা, তুই এখনও ছেলেমানুষ আছিস। ওরে, আমি যে বাঙালি নই তা এই বাগানের সব কুলি জানে। আমাকে কিছু বলবে না।

অনিমেষ স্তব্ধ হয়ে গেল। সময়ের সঙ্গে ও একদম ভুলে গিয়েছিল যে ঝাড়িকাকু বাঙালি নয়। অবশ্য একথা ওকে দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না। এখন ওর নিজেরই অবিশ্বাস হচ্ছিল, সেইসঙ্গে ওর মনে একটা বিষণ্ণতা কোথা থেকে চলে এল। নিজে বাঙালি নয় এই কথাটা কি ঝাড়িকাকু এতকাল সযত্নে লালন করে এসেছে মনেমনে? তা হলে এই বাড়ির মানুষ হয়ে যায় কী করে? কেন বাবার সমস্যা নিয়ে ঝাড়িকাকু কষ্ট পেয়েছিল। অনিমেষ বুঝতে পারল না। কিন্তু একথাটা ঠিক, বাঙালি নয় বলে ঝাড়িকাকু শক্ত হয়ে দাঁড়াতে পারছে আজকে। হয়তো এই কারণেই আজ বাড়িটা রক্ষা পেয়ে যাবে। কোনো-কোনো সময় দুর্বলতাই মানুষের রক্ষাকবচ হয়ে থাকে।

এতদিন বাদে স্বৰ্গছেঁড়ায় এক, অথচ এখনই এ-বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। কী যে সব ব্যাপার হয়ে যায়। অনিমেষ যেন অতিকষ্টে বারান্দায় উঠে এল। ততক্ষণে ছোটমা একটা বিরাট ব্যাগ নিয়ে এদিকে চলে এসেছে। না, বাইরের দরজায় তালা দিয়ে যাওয়া হবে না। সেটা ভেতর থেকে বন্ধ করে এদিকের দরজা দিয়ে যাওয়া হবে যাতে বাইরে থেকে কেউ চট করে বুঝতে না পারে কেউ বাড়িতে নেই। অনিমেষের সীতার ঠাকুমার কথা মনে হল। যদি সবাই চলে যায় কোয়ার্টার ছেড়ে কত বাচ্চাকাচ্চা এইসব কোয়ার্টারে নিশ্চয়ই আছে। ও ছোটমাকে হাত নেড়ে বিড় কিদরজা দিয়ে একছুটে বাইরে এল। আর আসতেই একটু অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেল। মাঠ পেরিয়ে বিভিন্ন কোয়ার্টার থেকে বাবুরা ছেলে মেয়ে বউদের সঙ্গে নিয়ে আসাম রোডের দিকে দৌড়ে যাচ্ছেন। অনেককেই ও চিনতে পারছিল-কেউ-কেউ নতুন। সীতার বাবা-মাকে দেখতে পেল না সে এই দলের মধ্যে। ওরা আসাম রোডের ওপর উঠে বাজারের পথে বাঁক ঘুরতেই অনিমেষ ফিরল। ছোটমা ততক্ষণে উঠোনে নেমে এসেছেন। পেছনে বাবা। বাবার হাতে সুটকেস। অনিমেষ এগিয়ে গিয়ে ছোটমার হাত থেকে ব্যাগটা নিতেই ছোটমা বলল, ঠাকুরকে ফেলে রেখে যাচ্ছি-জল-বাতাসাও পাবেন না।

মহীতোষ হাঁটতে হাঁটতে বললেন, রাখো তো তোমার ঠাকুর। বেঁচে থাকলে তোমরা অনেক জল-বাতাসা দেবার সুযোগ পাবে।

ছোটমা হঠাৎ সন্দিগ্ধ গলায় বলে উঠল, তোমরা সত্যি কী করেছ ওদের বলো তো যে এখন প্রাণের ভয় পাচ্ছ?

মহীতোষ বিরক্ত হলেন, আঃ, এখন বকবক না করে পা চাও তো।

খিড়কির দরজা দিয়ে বাইরে আসতে আসতে অনিমেষ বলল, অন্য বাবুর সবাই একটু আগে চলে গেছে, শুধু ঠাকুমাদের দেখলাম না।

ছোটমা বললেন, সে কী! কী হবে! ওঁর পক্ষে তো যাওয়াও অসম্ভব। একবার খোঁজ নিলে হয় না? বিয়েবাড়ির সব অগোছালো হয়ে পড়ে আছে।

মহীতোষ হতাশ ভঙ্গি করলেন। ঝাড়িকাকু পেছন পেছন আসছিল, কথাটা শুনে বলল, তোমরা যাও, আমি দেখছি।

বিয়েবাড়ি শব্দটা কানে যেতেই অনিমেষ কেমন আড়ষ্ট হয়ে গেল। আচ্ছা, যদি সীতারা যাবার আগই রাগী কুলিরা এসে পড়ত? তা হলে সীতা কি নতুন বেনারসি পরে বাবার সঙ্গে একটু-আগে-দেখা বাবুদের মতো দৌড়ে পালাত?
 
মহীতোষ আরেকটু এগিয়ে গিয়েছিলেন। ঝাড়িকাকুকে সীতাদের বাড়ির দিকে এগোতে দেখে অনিমেষ ছোটমার সঙ্গে বাবার পেছনে পেছনে হাঁটতে লাগল। ছোটমা বললেন, যা-ই বল বাপু, এই কুলিদের সঙ্গে নিশ্চয়ই বাবুরা ভালো ব্যবহার করত না, নাহলে পালাবার কথা মনে আসবেই-বা কেন? কথাটাকে মনেমনে সমর্থন করে অনিমেষ পেছন থেকে বাবার শরীরটাকে লক্ষ করল, এই মুহূর্তে অত বড় মানুষটাকে কেমন অসহায়-অসহায় দেখাচ্ছে।

মহীতোষ ঘাড় ফিরিয়ে কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে অনিমেষ চট করে ডানদিকে মাঠের শেষপ্রান্তে ফ্যাক্টরিতে যাবার রাস্তার দিকে তাকাল। হইহই শব্দটা জলস্রোতের মতো গড়িয়ে গড়িয়ে আসছে এখন। ক্রমশ কালো কালো মাথাগুলো দেখা গেল।

অসহায়ের মতো ওরা আসাম রোডের দিকে তাকাল, সেখানে পৌঁছানোর আগেই কুলিরা নিশ্চয়ই ওদের ফেলবে। কার। এখন ওরা ঠিক মাঠের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে।

চিৎকার ক্রমশ বাড়ছে, সামান্য যে-কজন রাস্তার মুখে গেটের সামনে পৌঁছেছে তার অনেক অনেক গুণ বেশি লোক যে এখনও আড়ালে রয়েছে এটা বুঝতে কোনো অসুবিধে হল না ওদের। মহীতোষ দৌড়ে স্ত্রী-পুত্রদের কাছে এসে হতাশ গলায় বললেন, তখন থেকে তাড়া দিচ্ছি তোমরা শুনলে না। এখন কপালে কী আছে কে বলতে পারে! সব বাবু চলে গেল সময়মতো-! কয়েক পা হেঁটে আসতেই ওদের বাড়ির সামনের ক্লাবঘরটা আড়াল হয়ে দাঁড়িয়ে গেল মধ্যিখানে। এই সময় মাদলের শব্দ শুনতে পেল। অনিমেষ দেখল ছোটমার মুখ একদম সাদা হয়ে গিয়েছে। এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে এখনই দ্রুত পা চালিয়ে আসাম রোডে উঠে যাওয়া উচিত। অবশ্য কুলিরা যদি আক্রমণ করার উদ্দেশ্য নিয়ে এসে থাকে তা হলে ওরা এই মুহূর্তে যত দূরত্বেই থাক ছোটমাকে নিয়ে। ওদের হাতের নাগালের বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু ওরা যে রীরিক আঘাত করবে এমন তো নাও হতে পারে। হয়তো চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে ক্রোধ প্রকাশ করবে। তারপর বুঝিয়ে বললে বুঝতেও পারে। ওদের বাড়িতে আসবার আগে সীতাদের বাড়ি কুলিদের সামনে পড়বে–সীতার মাবাবা-ঠাকুমা তো বাড়িতেই আছেন।

খুব দ্রুত এসব কথা চিন্তা করে অনিমেষ বাবাকে বলল, এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে চলো বাড়িতেই ফিরে যাই। মহীতোষও বোধহয় সেরকম চিন্তা করছিলেন, কথাটা শুনে দ্রুত খিড়কির দরজার দিকে হাঁটতে লাগলেন। অনিমেষ হাঁটতে গিয়ে দেখল ছোটমা তেমন জোরে পা ফেলতে পারছে না। ওকে সাহায্য করার জন্য অনিমেষ ছোটমার ডান হাতটা ধরল। ধরেই চমকে উঠল, এত শীতল হাত সে এর আগে কোনোদিন ধরেনি।

খিড়কিদরজা বন্ধ করতেই মনে হল একটা ব্রিট আড়াল হয়ে গেল-আপাতত কোনো ভয় নেই। এতটুকু হেঁটে আসতেই ছোটমা হাপাচ্ছে, অথচ যাবার সময় কোনো অসুবিধে ছিল না। হাটা ক্রমশ বাড়ছে, বোঝাই যাচ্ছে প্রচুর লোক এখন মাঠে জমায়েত হয়েছে। তাদের গলায় বিক্ষোভের আওয়াজটা হঠাৎ উল্লাসে রূপান্তরিত হয়ে গেল। ব্যাপারটা কী অনিমেষ বুঝতে পারল না। ওর মনে হল এখন ঝাড়িকাকু এখানে উপস্থিত থাকলে তবু যেন কিছুটা বল পাওয়া যেত। বাবা এই বাড়ির কর্তা-অথচ বাবাকে কী অসহায় লাগছে দেখতে!

মহীতোষ পকেটে হাত ঢুকিয়ে খোঁজার ভঙ্গি করে শেষ পর্যন্ত হতাশ গলায় বলে উঠলেন, যাচ্চলে, সিগারেটের প্যাকেটটা ঘরে ফেলে এসেছি।

ছোটমা এতক্ষণে কথা বললেন, এখানে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকব? দরজা খোলো, আমি ঘরের ভেতর বসব-যা হয় হোক।

মহীতোষ যেন অন্য কোনো উপায় চিন্তা করছিলেন, কথাটাকে আমল দিতে চাইলেন না, পাগল!

ছোটমা বলল, সীতার বাবা-মা যদি বাড়িতে থাকতে পারে তো আমরা পারব না কেন?

মহীতোষ বললেন, সীতার বাবা আজ অফিসে যায়নি, ছুটিতে আছে। তাই ওদের কোনো ভয় নেই, ওঁকে তাই কিছু বলবে না দেখো।
 
অনিমেষ কথাটা শুনে বাবার দিকে তাকাল। সীতার বাবা নিশ্চয়ই মেয়ের বিয়ের জন্য দুটি নিয়েছিলেন। সেটাই এখন তার কাজে লাগবে। কুলিদের তিনি বোঝাতে পারবেন যে তিনি কাজেইও যাননি এবং মনে কোনো পাপ নেই বলে কোয়ার্টার ছেড়ে কোথাও চলে যাননি। কুলিরা কি শুনবে সেকথা? অন্তত এখন পর্যন্ত সীতাদের বাড়ি থেকে যখন কোনো আর্তনাদ ভেসে আসছে না, তখন এর উলটোটা ভাবা যাচ্ছে না।

নিজের উঠোনে ফিরে ছোটমা ধাতস্থ হয়েছে। কুলিদের হল্লাটা ক্রমশ বাড়ছে। ওরা টের পেয়ে গেছে বাবুরা তাদের কোয়ার্টার ছেড়ে পালিয়ে গেছে। প্রথম কোয়ার্টারে কাউকে না পেয়ে বোধহয়। সেটার ওপর পাথর ছুড়ছে ওরা। অনিমেষরা এখান থেকেই টিনের ছাদে-পড়া পাথরের দুমদাম শব্দ শুনতে পেল। বোধহয় এই শব্দেই ছোটমার চেতনা অন্যরকম কাজ করল। গোয়ালঘরের দিকে কয়েক। পা এগিয়ে ছোটমা বলল, চলো পেছনদিকে চলে যাই।

মহীতোষ বললেন, তুমি নদী পার হতে পারবে? আর নদী পার হলেই তো কুলিলাইন। গিয়ে কী লাভ হবে?

ছোটমা বলল, এই লাইনের মেয়েদের আমি চিনি। দেখো ওরা আমাদের কিছু বলবে না। সামনে যারা এসেছে তারা অন্য লাইনের লোক।

মহীতোষ অগত্যা কী করবেন বুঝতে না পেরে ছেলের দিকে তাকালেন। অনিমেষ বলল, এখানে দাঁড়িয়ে তো কোনো লাভ হবে না। তার চেয়ে চলো।

ওরা এবার পেছনের দরজা দিয়ে বেশ জলদি হাঁটতে লাগল। অনিমেষ দেখল বুনো গাছে বাড়ির পেছনটা ছেয়ে গেছে। একটিমাত্র সরু পায়ে-চলা-রাস্তা গোয়ালঘরের পাশ দিয়ে নদীর দিকে চলে গেছে। গোয়ালঘরটা শূণ্য, শুধু একটা লালরঙা গোরু তার বাচ্চাকে নিয়ে খুঁটিতে বাঁধা হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের দেখে সেটা চট করে বাচ্চাটার গা চাটতে লাগল। গোয়ালঘরটা দেখে অনিমেষের কালীগাই-এর কথা মনে পড়ে গেল। ও বুঝতে পারল বেচারা মরে গেছে। এছত একটা ব্যথা ওর মনটাকে হঠাৎ ছুঁয়ে গেল। ও কোনো কথা না বলে চুপচাট হাঁটতে লাগল। এখান দিয়ে। চলাফেরা করলেই কালীগাই-এর সেই হাম্বা ডাকটা যেন কান বন্ধ করেও শোনা যায়।

নদীর সামনে এসে দাঁড়াল ওরা। অনিমেষ দেখল জলেরা এখনও চুপচাপ বয়ে চলে যায়। তবে এখানে নদীর গভীরুতা যেন আরও কমেছে। মাঝে-মাঝে শ্যাওলা বুকে নিয়ে ঘোট ঘোট চড়া মাথা তুলেছ। স্রোত আছে-কিন্তু ভীষণ বয়স্ক দেখাচ্ছে নদীটাকে।

অনিমেষ আগে জলে নামল। হাঁটুর নিচেই জল, ব্যাগ নিয়ে পার হতে কোনো অসুবিধা হল না। জলের তলায় এখনও সেইরকম নানা রঙের নুড়িপাথর পড়ে আছে। ওর পায়ের শব্দেই বোধহয় একটা লাল চিংড়ি লাফিয়ে অন্য ধারে চলে গেল। পার হয়ে অনিমেষ বলল, না, কোনো স্রোতই নেই, চলে এসো।

ছোটমা মহীতোষের হাত ধরে ধীরে ধীরে পার হয়ে এল। এপারে এসে মহীতোস হাঁফ ছেড়ে বললেন, ভাগ্যিস কোম্পানি আর নদীটার ওপর নজর দেয় না-নাহলে পার হওয়া যেত না।..

অনিমেষ ভাবল জিজ্ঞাসা করে যে নদী বন্ধ হয়ে গেলে ফ্যাক্টরির হুইলটা চলবে কী করে, কিন্তু ঠিক সে-সময় একটা উদোম বাচ্চাকেও ও অবাকচোখে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। বছর ছয়সাতের মদেসিয়া ছেলেটি দুপাশের বুনো গাছের মধ্যে দিয়ে যে-চলার পথটা কলিলাইনের দিকে চলে গেছে তার একপাশে একটা হোঁতকা কুকুরের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে জুলজুল করে ওদের দেখছে। মহীতোষও বাচ্চাটাকে দেখেছিলেন, নেহাতই গোবেচারা একটা কালো রোগা শিও। কিন্তু ওর মনে হল এটাই যদি এখনই ছুটে গিয়ে লাইনে ওঁদের উপস্থিতির কথা সবাইকে জানিয়ে দেয়, তা হলে আর কিছুই করার থাকবে না। কী করবেন বুঝতে না পেরে তিনি ছেলের দিকে তাকালেন। অনিমেষ কিছু বলতে হয় তাই জিজ্ঞাসা করল, এই, মরা ঘর কিধার।
 
ছেলেটা কোনো উত্তর দিল না, শুধু ওর দুটো হাত কুকুরছানাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল আর চোখ দুটো বড় বড় হয়ে উঠল। আর এই সময় পেছনে নদী পেরিয়ে জঙ্গলের প্রান্তে ওদের কোয়ার্টারের সামনে বোধহয় চিৎকারটা এসে পৌঁছেছে, কারণ এখানে দাঁড়িয়েও ওরা বুঝতে পারছিল দুরত্বটা বেশি নয়। সেইসঙ্গে মাদলে ড়ুম ড়ুম ড়ুম শব্দ যেন অদ্ভুত আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করে যাচ্ছিল। শব্দটা প্রকট হতেই ছেলেটার মুখচোখের ভাব বদলে গেল। খুব উত্তেজিত হয়ে সে একটা হাত শব্দটাকে লক্ষ্য করে উঁচিয়ে ধরে গোগোঁ করে আওয়াজ করতে লাগল। মুহূর্তে অনিমেষরা বুঝতে পারল বেচারা কথা বলতে পারে না। ওর চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে, হাতের কুকুরছানাটা ঝুলে পড়েছে। ছোটমা বোধহয় সামলাতে পারল না নিজেকে, চট করে একটা হাত বাচ্চাটার মাথায় রাখল। অনিমেষ দেখল সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাটা কেমন শান্ত হয়ে গেল, তারপর ছোটমার গা-ঘেঁষে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, কিন্তু ওর চোখ দুটো ভীষণ অবাক হয়ে ছোটমার মুখের ওপর সেঁটে রইল। মহীতোষ বোধহয় এ-দৃশ্য বেশিক্ষণ দেখতে চাইছিলেন না, সুটকেসটা তুলে বললেন, লাইনের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার দরকার নেই, বরং নদীর ধার দিয়ে একটু এগিয়ে গেলেই চা-বাগান পড়বে, একবার এতে ঢুকে পড়লে আর কোনো বয় নেই। বাগান দিয়ে সোজা এগিয়ে খুটিমারি ফরেস্টের কাছে বাজারের রাস্তা পেয়ে যাব, চলো।

ওরা এগোতেই বাচ্চাটা ছোটমার কাপড় ধরে টানাটানি শুরু করল। এক হাতে কুকুর অন্য হাতে কাপড় ধরে সে গোগোঁ শব্দ করে ছোটমাকে লাইনের দিকে নিয়ে যেতে চাইছে। ঠিক এই সময় দড়াম দড়াম শব্দ শুরু হয়ে গেল। ক্ষিপ্ত কুলিরা ওদের কোয়ার্টারের টিনের ছাদে পাথর ফেলছে। অনিমেষ নদীর ধারে দিয়ে সামান্য এগিয়ে গিয়েছিল, এবার ফিরে এসে বলল, না, কোনো রাস্তা নেই, কাটাগাছের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে মা যেতে পারবে না।

মহীতোষ নিজের পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যাওয়াটা পছন্দ কছিলেন না, একটু উষ্ণ গলায় বললেন, পারবে না বললে তো হবে না, এ ছাড়া কোনো উপায় নেই।

ছোটমা বলল, যা কপালে আছে হবে–লাইন দিয়েই চলল।

মহীতোষ বললেন, যা হলে মিছিমিছি বাড়ি ছেড়ে এলে কেন? কপাল ঠুকে বাড়িতে থেকে গেলেই তো হত!

ছোটমার জেদ এসে গেল চট করে, আমি তো তা-ই থাকতে চেয়েছিলাম, তোমরাই তো পেয়ে দৌড়ে মরছ। আমি এগোচ্ছি, এই লাইনের মেয়েরা আমাকে চেনে, কিছু বলবে না। তোমরা আমার পেছনে এসো।


মহীতোয় কিছু বলার আগেই ছোটমা সরু পায়ে-চলা-পথটা দিয়ে বাচ্চাটার সঙ্গে হাঁটতে আরম্ভ করল। মহীতোষ চুপচাপ ওদের চলে-যাওয়াটা দেখছিলেন। অনিমেষে কাছে এসে বলল, চলো?

কাঁধ ঝাঁকালেন মহীতোষ, জেনেশুনে এরকম রিস্ক নেবার কোনো মানে হয়? যেই বাচ্চাটা আঁচল ধরে টেনেছে অমনি মন নরম হয়ে গেল। অনিমেষ অনেক কষ্টে হাসি চাপল, বাবা এবং মায়ের এই ব্যাপারটা ওর কাছে নতুন–বাবাকে খুব অসহায় দেখাচ্ছে এখন। অগত্যা ছেলের সঙ্গে মহীতোষ স্ত্রীর অনুগাম হলেন। জঙ্গলটুকু পার হতেই কয়লার গুড়ো–বিছানো রাস্তাটা পড়ল। ডানদিকের চা-বাগান থেকে উঠে এসে সোজা ফ্যাক্টরির দিকে চলে গিয়েছে। ট্রাক্টরের ভারী চাকার দাগ রয়েছে এখানে। রাস্তার ওপাশে সার দিয়ে কুলিদের ঘরগুলো। বেশির ভাগই খড়ের ছাউনি, মাটির দেওয়াল, দুএকটা ইটের গাঁথুনি থাকলেও ওপরে খড় চাপানো হচ্ছে। অনিমেষ দেখল সমস্ত লাইনটা খাখা করছে। কোথাও কোনো মানুষের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। বেশির ভাগ বাড়ির দরজা বন্ধু, গরুগুলো খুঁটিতে বাধা, মুরগিগুলো মেজাজে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে। মহীতোষও বিস্ময়ে দেখছিলেন। এই অঞ্চলে তিনি অনেক বছর আগে এসেছিলেন। তাঁর কোয়ার্টার থেকে সামান্য দূরত্বের এই লাইনে আসবার কোনো প্রয়োজন তার পড়ে না। এখন এই নিঝুম পরিবেশ তাঁকে ভীষণরকম আশ্বস্ত করল। বোঝাই যাচ্ছে এই লাইনের ছেলে-বুড়ো-মেয়ে-মন্দ এই মুহূর্তে তার বাড়ির সামনে জমায়েত হয়েছে। বেশ উত্তেজিত গলায় তিনি বললেন, তাড়াতাড়ি এই বেলা লাইনটা পার হয়ে চলো।

অনিমেষরা কেউই এরকম আশা করেনি, এখন দ্রুত হাঁটা শুরু করে দিল। বাচ্চাটা সঙ্গে আসছিল, মহীতোষ তাকে ধমকালেন, এ ছোঁড়াটা, ঘর যা।

সে শুনল কি না বোঝা গেল না, কারণ তার মুখ খুব উজ্জ্বল হয়ে উঠল। পরম আনন্দে সে ছোটমার হাত ধরে একটা মাটির বাড়ির দাওয়ার দিকে নেটে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। ছোটমা বলল, অ গেল যা, এ ছোড়া যে ছাড়ে না। আর এর বাপ-মায়ের বুদ্ধি দ্যাখো–একে একা ফেলে পালিয়েছে সব। পালানো শব্দটা অনিমেষের কানে গাললেও সে কিছু বলল না। ছেলেটা ততক্ষনে গোগোঁ করে আঙুল তুলে কাউকে দেখবার চেষ্টা করছে। একটু এগোতেই ওদের নজরে পড়ল, ঘরটার দাওয়াতে রোদ্দুরে পা ছড়িয়ে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে কেউ বসে আছে, তার সামনে অনেকটা গম ওকুতে দেওয়া হয়েছে, বসে-থাকা মানুষটার হাতে একটা লাঠি-বোধহয় কাক চিল থেকে পাহারা দেবার জন্য। অনিমেষ দেখল ম্যানুষটা স্ত্রী কি পুরুষ চট করে বোঝা যাচ্ছে না, কারণ তার মাথার সাদা চুল গুড়িগুড়ি করে ছাঁটা। গায়ের চামড়া ঝুলে গুটিয়ে এসেছে। বেচারা চোখে দ্যাখে না বোধহয় কারণ ওরা এত কাছে এসেছে তবু তার কোনো ভাবান্তর নেই। বাচ্চাটা হঠাৎ ছুটে গিয়ে গোগো চিৎকার করতে সে একটু নড়েচড়ে বসে নিদাঁত মাড়ি বের করে কিছু বলল। মহীতোষ একটু সামনে গিয়ে ভালো করে লক্ষ করে বললেন, সেরা বলে মনে হচ্ছে।

ছোটমা বলল, সেরা? সেই যে তুমি যার গল্প বলেছিলো?

মহীতোষ মাথা নাড়লেন, তারপর কাছে গিয়ে ডাকলেন, এই তুমার নাম সেরা?

লোলচর্ম-মুখটা এবার যেন-হদিস পেল তার সামনে কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে। অনিমেষ এর আগে কোনোদিন সেরাকে দেখেনি অথবা এরা নামও শোনেনি। মদেসিয়া লাইনে এ-নামের কেউ থাকতে পারে ভাবা যায় না। যদিও বয়স হয়েছে বেশ তবে বোঝাই যায় রোগে ভুগে ভুগে এর অবস্থা এইরকম জীর্ণতায় এসে ঠেকেছে। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হল, এর গায়ে রঙ অন্য পাঁচটি মদেসিয়ার মতো সাদা হয় কখন কে জানে, বরং যে-কোনো বাঙালি মেয়ের সঙ্গে মিলে যায় চট করে। চোখের পাতা সাদা হয় কখন কে জানে, সাদা চোখের মণি যেন আতিপাতি করে খুঁজতে চাইল সামনে দাঁড়ানো মুখগুলোর দিকে চেয়ে, কৌন?
 
সেরাকে দেখে মহীতোষ পুরনো দিনের স্মৃতি নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন। এখন আত্মপরিচয় দিতে গিয়ে পরিস্থিতির কথা মনে পড়ে গিয়ে চট করে গুটিয়ে গেলেন। তারপর স্ত্রী-পুত্রের দিকে অকিয়ে বললেন, বেচারার বয়স হয়ে গেছে বলে চিনতে পারছে না-চলো যাওয়া যাক। ওই তো চা-বাগান দেখা যাচ্ছে।

কিন্তু ততক্ষণে সেরা উঠে দাঁড়িয়েছে লাঠিতে ভর করে, আর সেই বাচ্চাটা দৌড়ে গিয়ে কুকুরছানাসমেত ওর এক হাতের তলায় অবলম্বন হয়ে গিয়েছে। মহীতোষ যখন যাবার জন্য পা বাড়াচ্ছেন ঠিক তখনই সেরা বলে উঠল, বুড়াবাবাকে লেড়কা?

মহীতোষের পা দুটো যেন শক্ত হয়ে গেল। অনেকদিন বাদে কেউ তাকে এই নামে সম্বোধন করল। তিনি যখন প্রথম চাকরিতে ঢুকেছিলেন তখনই সেরার যৌবন ফুরিয়ে গেছে, কিন্তু ওর গল্পটা বেশ চালু ছিল। সে-সময় পাতি তোলার কাজ থেকে ছাড়িয়ে ওকে ফ্যাক্টরিতে, বাছাই-এর কাজে লাগানো হয়েছিল। মইতোষ দেখেছিলেন কাজের চেয়ে ও বেশি কথা বলত আর বলার ভঙ্গিতে এমন একটা কত ছিল যে যারা পছন্দ করত না তারাও চাষ করে শুনত। সেই সেরা এখন অথর্ব হয়ে তাকে পুরনো নামে ডেকে ফেলল-শহী, একটু রোমাঞ্চিত হলেও তার মনে হল পেছনে বিপদ নিয়ে। এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলার সময় এখন নয়। তবু যাবার সময় তিনি উত্তর দিলেন, হ্যাঁ।

ও কৌন, ব, বেটা–আরে কাহা ভাগতিস রে ও বুড়োবাবাকে লেড়কা?

মহীতোষরা দাঁড়িয়ে পড়লেন! সেরার গলা থেকে এরকম আওয়াজ বের হতে পারে কল্পনা করা যায় না। সেরার গলা শুনে যদি কেউ থেকে থাকে অশেপাশে, বেরিয়ে এলেই হয়ে গেল! মহীতোষ সেরার শোনার মতো গলায় বললেন, হ্যাঁ।

বুড়োবাবাকে লাতি ও ছোউয়া, ইধার আ, মো পানে আ, তুহার মুখ দেখি। জোরে জোরে অনিমেষকে ডাকতে লাগল সে।

মহীতোষের ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু ছোটমা বলল, যাও, তাড়াতাড়ি ঘুরে এসো।

অনিমেষ সামনে এগিয়ে যেতেই সেরা বাচ্চাটার মাথা থেকে বেরিয়ে যেতেই সেরা বাচ্চাটার মাথা থেকে সরিয়ে নিজের বুকে হাত রেখে বলল, মেরা নাম সেরা, ফা: কেলাস। বেস্ট। শেষের শব্দটা একটু মনে করে নিয়ে বলল। আর তার পরই ফোকলামুখে হেসে বলল, হাম নুডিড় হো গিয়া। বুড়বাবাকে লাতি? তুর জনম হল তো বুড়াবাবা মিঠাই খাওয়ালেক, আভি তু জোয়ান হো গিয়া বাপ, হাম বুড়ি হো গিয়া। কথাগুলো অসংলগ্ন কিন্তু অনিমেষ অনুভব করছিল আন্তরিকতা না থাকলে এভাবে কথা বলা যায় না। অথচ এই মুহূর্তে অন্য কুলিরা প্রতিশোধ নিতে তাদের কোয়ার্টারের সামনে হল্লা করছে। কেন যে এমন হয়! মৃদু হেসে ও চলে আসতে চাইছিল, কিন্তু সেরা ছাড়বার পাত্র নয়, সামান্য গলা নামিয়ে সেরা বলল, ও জেনানা কৌন হ্যায়? তুর দোসরা মা?

অনিমেষ বলল, হ্যাঁ। আমরা যাচ্ছি।

কাঁহা যাহাতিস রে?

বাজারে।

বা-জা-র! তুর ঘরকা সামনে রাস্তা ছোড়কে ইধারসে কাহে?

অনিমেষ কী জবাব দেবে বুঝতে না পেরে বাবার দিকে তাকাল। মহীতো ওকে ইশারা করে চলে আসতে বললেন। আর এই সময় নদীর ওপারে চিষ্কার চ্যাঁচামেচি বেড়ে গেল সহসা। এমন শব্দ করে মাদলগুলো বাজাতে লাগল যে অনিমেষের মনে পড়ল রহস্যময় আফ্রিকা বইতে এই ধরনের মাদল বাজিয়ে নরখাদকদের আসবার গল্প সে পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সে শুনল সেরা বলছ, শালা হারামি! হরতাল করবেক, কাম করবেক নাই, সাহেব পয়সা নেহি দেগা তো খায়গা ক্যা? সবকোই নিমকহারাম হো গিয়া! বিড়বিড় করে যাদের গলার শব্দ শোনা যাচ্ছে। অনিমেষ আর দাঁড়াল না, দৌড়ে মহীতোষদের সঙ্গ নিল। বাদিকে একটা টিউবওয়েল, সেটা ছাড়াতেই ঝুপড়ি-হয়ে-থাকা বিরাট অশ্বথগাছের গা-ঘেঁষে চা-বাগানের শুরু। ওরা যখন চা-বাগানের মধ্যে ঢুকে পড়েছে তখন পেছনে পায়ের শব্দ শুনতে পেল-খুব দ্রুত একটা লঘু আওয়াজ এগিয়ে আসছে। চা-গাছ ওদের বুজ–সমান উঁচু, মাঝে-মাঝে বড় শেডট্রি আর পাতি তোলার সুবিধেয় জন পায়ে-চলার রাস্তা চলে গেছে বাগানময়। মহীতোষ বললেন, বসে পড়ো, বসে পড়ো!
 

Users who are viewing this thread

Back
Top