ভেতরে থেকে মহীতোষের গলা ভেসে গেল, অনিমেষকে ডাকছেন। অনিমেষ সাড়া দিয়ে দেখল, চা-বাগানের নুড়িবিছানো পথ দিয়ে সাইকেলগুলো দ্রুত মাঠের দিকে ছুটে আসছে। টাইপবাবু, ডাক্তারবাবু, পাতিবাবু, মশাবাবুরা জোরে জোরে প্যাডেল ঘুরিয়ে যে যার কোয়ার্টারের দিকে চলে যাচ্ছেন। মনোজ হালদারকে চিনতে পারল অনিমেষ, সেইরকম চেহারা আছে এখনও, নিজের কোয়ার্টারের দিকে যেতে-যেতে হঠাৎ সাইকেল ঘুরিয়ে সীতাদের কোয়ার্টারের সামনে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে কিছু বলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সীতার বাবাকে ওঁদের গেটে দেখতে পেল অনিমেষ। মাথা নেড়ে কিছু কিজ্ঞাসা করে চ্যাঁচামেচি করে বাড়ির লোকদের কিছু বলতে লাগলেন। এই সময় আরও কিছু লেবারকে পতাকা-হাতে লাইন থেকে ছুটে আসতে দেখল অনিমেষ। বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ হইহই করতে করতে চা-বাগানের নুড়িবিছানো পথটায় ঢুকে যাচ্ছে। এবং অনিমেষ অবাক হয়ে শুনল কেউ-একজন চিৎকার করে উঠতেই বাকিরা জানান দিল, জিন্দাবাদ। ইনকিলাব জিন্দাবাদ। বলার ধরনটা শহরে-শোনা ধ্বনির মতো নয়, এবং বেশ মজা পেয়ে গেছে ওরা–ভাবভঙ্গিতে তা-ই মনে হল। ওরা চলে যাওয়ার পর অনিমেষ দেখল আসাম রোডের ওপারে মাড়োয়ারি দোকানের ঝাঁপ শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেল।
অনিমেষ ব্যাপারটাকে কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছিল না। এই শান্ত সরল মানুষগুলো হঠাৎ একম খেপে গেল কেন? ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছে বাবুদের দেখলে এরা কেনোর মতো গুটিয়ে যায়, বাবুদের কোয়ার্টারের ছেলেকে কাজে লাগাতে পারলে ধন্য হয়, তারাই এখন খেপে গেল কেন? আর বাবুদের তো এমন ভয় পেতে দেখেনি ও! লোকগুলো কী চাইছে? টাকাপয়সা-খাবারদাবার? ওর মনে পড়ল সুনীলদা বলেছিল পৃথিবীতে দুটো জাত ছে, একদল হল সর্বহারা, অন্যদল বুর্জোয়া। বুর্জোয়া মানে যার সব আছে, কিন্তু সামান্য কিছু হারাবার ভয়ে যে অনেক বেশি সর্বহারাদের কাছে আদার করে। তা হলে এই লেবারগুলো সর্বহারা? কিন্তু ওর মনে হল বাবা এবং অন্য বাবুরা মিছিমিছি ভয় পাচ্ছেন। এরা আর যা-ই হোক, এই কোয়ার্টারগুলোতে এসে হামলা করবে না। কখনো কোনো মদেসিয়া ওঁরাওকে ও অভদ্র হতে দেখেনি, হাড়িয়া খেয়ে মাতাল হয়ে গেলেও না। অনিমেষ মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে কোয়ার্টারগুলোকে ভালো করে দেখল। সবকটার দরজা বন্ধ। আসাম রোড দিয়ে হুশহুশ করে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। হঠাৎ ওর মনে হল স্বৰ্গছেঁড়ার চেহারাটা যেন অনেকখানি পালটে গেছে। এই মাঠের মধ্যে দাঁড়ানো গাছ দুটো কেমন শীর্ণ, পাতাবাহার গাছগুলো শুকিয়ে মরে যাচ্ছে, বৈশাখমাসের শেষে প্রখর রোদে প্রখর রোদে স্বৰ্গছেঁড়া এখন পুড়ছে। অথচ চিরকাল এখানে একটা ঠাণ্ডা ভাব থাকত, এই সময় ভুটানের পাহাড় থেকে মেঘগুলো বৃষ্টি নিয়ে আসত।
কোয়ার্টারের বারান্দায় উঠে এল অনিমেষ। আর বাবা তাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন এবং এই প্রথম ওঁর মুখে সে খোকা ডাকটা শুনতে পেল। অন্য সময় হয়তো খোকা শুনলে তার হাসি পেত, কিন্তু সেই মুহূর্তে ওর ডাকটা ভালো লেগেছিল। এখান থেকে চাল যাওয়ার পর থেকে বাবার সম্পর্কে ওর মনে যে-দৃণা এবং তিক্ততা বাসা বেঁধেছিল, এই মুহূর্তে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। বাবা যেন আমূল পালটে গেছেন। শুধু তার সঙ্গেই নয়, ছোটমার সঙ্গেও বাবা কী ভালো ব্যবহার করছেন। মহীতোষের বুকের সঙ্গে লেপটে থাকার সময়কার অস্বস্তিটা ওর মনে আবার এল। বাল্যকাল থেকে এ-পর্যন্ত এরকম ঘটনা ঘটেছে কি না মনে পড়ে না। কীসব যে চটপট হয়ে যায়! যাকে দেখতে আজ খারাপ লাগল, কাল হয়তো সেটা অন্যরকম হতে পারে।
আশ্চর্য, বসার ঘরটা ঠিক সেইরকম আছে! এই যে এতগুলো বছর কেটে গেল, এই ঘরটার ওপর তার কোনো ছাপ পড়েনি। শুধু সোফার ওপর কভারগুলো এখন পালটে গেছে এবং-। অনিমেষ। পায়েপায়ে সোফার পাশে দেওয়ালের সামনে এসে দাঁড়াল। একটা বড় ফ্রেমে বাঁধানো ছবিতে তার চার-পাঁচ বছরের মুখটা হাসছে। কী ভীষণ দুই-দুই লাগছে চোখ দুটো। নিজের যে এরকম একটা। ছবি আছে একদল জানা ছিল না, অনিমেষ দেখল এই এত বছর হয়ে গেল, তার মুখ খুব সামান্যই পালটেছে। এই ছবি আগে এখানে ছিল না। বাবা নিশ্চয়ই নতুন করে বাঁধিয়ে এখানে টাঙিয়েছেন। কবে থেকে? অনিমেষের সবকিছু গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল।
অনিমেষ ব্যাপারটাকে কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছিল না। এই শান্ত সরল মানুষগুলো হঠাৎ একম খেপে গেল কেন? ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছে বাবুদের দেখলে এরা কেনোর মতো গুটিয়ে যায়, বাবুদের কোয়ার্টারের ছেলেকে কাজে লাগাতে পারলে ধন্য হয়, তারাই এখন খেপে গেল কেন? আর বাবুদের তো এমন ভয় পেতে দেখেনি ও! লোকগুলো কী চাইছে? টাকাপয়সা-খাবারদাবার? ওর মনে পড়ল সুনীলদা বলেছিল পৃথিবীতে দুটো জাত ছে, একদল হল সর্বহারা, অন্যদল বুর্জোয়া। বুর্জোয়া মানে যার সব আছে, কিন্তু সামান্য কিছু হারাবার ভয়ে যে অনেক বেশি সর্বহারাদের কাছে আদার করে। তা হলে এই লেবারগুলো সর্বহারা? কিন্তু ওর মনে হল বাবা এবং অন্য বাবুরা মিছিমিছি ভয় পাচ্ছেন। এরা আর যা-ই হোক, এই কোয়ার্টারগুলোতে এসে হামলা করবে না। কখনো কোনো মদেসিয়া ওঁরাওকে ও অভদ্র হতে দেখেনি, হাড়িয়া খেয়ে মাতাল হয়ে গেলেও না। অনিমেষ মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে কোয়ার্টারগুলোকে ভালো করে দেখল। সবকটার দরজা বন্ধ। আসাম রোড দিয়ে হুশহুশ করে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। হঠাৎ ওর মনে হল স্বৰ্গছেঁড়ার চেহারাটা যেন অনেকখানি পালটে গেছে। এই মাঠের মধ্যে দাঁড়ানো গাছ দুটো কেমন শীর্ণ, পাতাবাহার গাছগুলো শুকিয়ে মরে যাচ্ছে, বৈশাখমাসের শেষে প্রখর রোদে প্রখর রোদে স্বৰ্গছেঁড়া এখন পুড়ছে। অথচ চিরকাল এখানে একটা ঠাণ্ডা ভাব থাকত, এই সময় ভুটানের পাহাড় থেকে মেঘগুলো বৃষ্টি নিয়ে আসত।
কোয়ার্টারের বারান্দায় উঠে এল অনিমেষ। আর বাবা তাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন এবং এই প্রথম ওঁর মুখে সে খোকা ডাকটা শুনতে পেল। অন্য সময় হয়তো খোকা শুনলে তার হাসি পেত, কিন্তু সেই মুহূর্তে ওর ডাকটা ভালো লেগেছিল। এখান থেকে চাল যাওয়ার পর থেকে বাবার সম্পর্কে ওর মনে যে-দৃণা এবং তিক্ততা বাসা বেঁধেছিল, এই মুহূর্তে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। বাবা যেন আমূল পালটে গেছেন। শুধু তার সঙ্গেই নয়, ছোটমার সঙ্গেও বাবা কী ভালো ব্যবহার করছেন। মহীতোষের বুকের সঙ্গে লেপটে থাকার সময়কার অস্বস্তিটা ওর মনে আবার এল। বাল্যকাল থেকে এ-পর্যন্ত এরকম ঘটনা ঘটেছে কি না মনে পড়ে না। কীসব যে চটপট হয়ে যায়! যাকে দেখতে আজ খারাপ লাগল, কাল হয়তো সেটা অন্যরকম হতে পারে।
আশ্চর্য, বসার ঘরটা ঠিক সেইরকম আছে! এই যে এতগুলো বছর কেটে গেল, এই ঘরটার ওপর তার কোনো ছাপ পড়েনি। শুধু সোফার ওপর কভারগুলো এখন পালটে গেছে এবং-। অনিমেষ। পায়েপায়ে সোফার পাশে দেওয়ালের সামনে এসে দাঁড়াল। একটা বড় ফ্রেমে বাঁধানো ছবিতে তার চার-পাঁচ বছরের মুখটা হাসছে। কী ভীষণ দুই-দুই লাগছে চোখ দুটো। নিজের যে এরকম একটা। ছবি আছে একদল জানা ছিল না, অনিমেষ দেখল এই এত বছর হয়ে গেল, তার মুখ খুব সামান্যই পালটেছে। এই ছবি আগে এখানে ছিল না। বাবা নিশ্চয়ই নতুন করে বাঁধিয়ে এখানে টাঙিয়েছেন। কবে থেকে? অনিমেষের সবকিছু গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল।