রাস্তার পাশে গাছগুলোতের, দেওয়ালে হরতালের পোস্টার পড়েছে। ধরা আর করলা নদীর মুখে যে-ব্রিজটা নিচু হয়ে কচুরিপানার ডগা ছয়ে আছে, সেখানে দাঁড়াল সে। ধরার আসল নাম কি ধরলা? করলায় মিশছে যকন তখন এরকম নাম হওয়াই উচিত। কিন্তু ছেলেবেলা থেকে সে ধরধরা নাম শুনে আসছে। করলা যেরকম গভীর এবং গম্ভীর ধরধরা তেমন না। এই ধরধরার থমকে-চলা জল কোনোরকমে গিয়ে পড়ছে করলায়, করলা সেই জলে স্রোতের টান দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তিস্তায়। তিস্তা তার বিরাট ঢেউ-এ সেই জলকে মিশিয়ে ছুটে যাচ্ছে ব্ৰহ্মপত্র কিংবা সমুদ্রের দিকে। ধরার এলিয়ে-থাকা জলের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ শরীরে কেমন কাঁটা দিয়ে উঠল। মানুষের জীবন ঠিক এইরকম, এই নদীর মতন। সে যখন স্বৰ্গছেঁড়ায় ছিল তখন সেই ইউক্যালিপটাস গাছ, চায়ের বাগান, মাঠ, ভবানী মাস্টার আর নতুন-শেখা বন্দেমাতরম ছাড়া কিছুই জানত না। তখন মাতার ওপর ওদের। সমস্ত পরিবারটা ছিল, চারধারে যেন স্বপ্নের, আদরের দেওয়াল তাকে আড়াল করে রেখেছিল। তারপর এই ধরধরার করলায় মিশে যাওয়ার মতো সে এল জলপাইগুড়িতে। এখানে নতুন স্যার, কংগ্রেস, বিরাম কর, রম্ভা আর সুনীললদা তার চারপাশের দেওয়ালটাকে যেন আস্তে-আস্তে সরিয়ে নিল। ইনকিলাব জিন্দাবাদ, এবং সুনীলদা-ছোটমা আর এই বাবা-অনিমেষে মাথা নাড়ল, আর আগামীকাল সে ট্রেনে উঠবে, কলকাতায় যেতে হবে তাকে। ঠিক নদীর সমুদ্রে পড়ার মতন। কলকাতার মানুষ নাকি দয়ামায়াহীন, কেউ কারও বন্ধু নয়। সেখানে চোর বদমাশ আর পণ্ডিতেরা। পাশাপাশি বাস করে, কিন্তু কে যে কী তা চিনে নেওয়া সহজ নয়। কলকাতার মানুষ শিক্ষিত হয় এবং উচ্ছন্নে যাবার জন্য সাহায্য পায়। অদ্ভুত রহস্য নিয়ে এখন কলকাতা তার সামনে দুলছে, নদীর সামনে সমুদ্রের ঢেউ-এর মতন। কলকাতা-বিষয়ক অনেক বই পড়েছে সে, না গিয়েও অনেক রাস্তার নাম সে জানে। কলকাতা এখন তাকে টানছে, কিন্তু যে-স্বৰ্গছেঁড়াকে সে ছেড়ে এল, যে-জলপাইগুড়ি থেকে চলে যেতে হচ্ছে, তাকে আর এমনভাবে কখনো ফিরে পাবে না এই বোধ ক্রমশ আচ্ছন্ন করে ফেলছিল অনিমেষকে। এবার স্বৰ্গছেঁড়ায় গিয়ে সে একটা নগ্ন সত্যের মুখোমুখি হয়ে গেল। দীর্ঘকাল মাটির সঙ্গে বসবাস না করলে শিকড় আলগা হয়ে যায়। ওখানকার নতুন ছেলেদের কাছে সে যেন বাইরের লোক বলে মনে হচ্ছিল। এই জলপাইগুড়িতেও তার একদিন এমন অনুভব হবে–অনিমেষ স্পষ্ট বুঝতে পারছিল।
ধর্ধরা-করলার সঙ্গমের পাশ ঘেঁষে তপুপিসিদের স্কুল। অনেকদিন তপুপিসিকে দেখেনি সে; তপুসিসি এখন কেমন আছে? তপুপিসিকে নিজের পাশের খবর দিয়ে আসার ইচ্ছেটা কোনোরকমে সামাল দিল সে। তার মুখোমুখি হতে হঠাৎ খুব সঙ্কোচ হচ্ছিল ওর, অথচ সে তো আর অন্যায় করেনি। ছোটকাকার ব্যবহারের জন্য সে তো দায়ী নয়। তবু-। অনিমেষ হাসপাতাল-পাড়ার রাস্তায় পা বাড়ান্ডানদিকে ফার্মেসি ট্রেনিং সেন্টারের সামনে মৃতুদেহ রেখে একা একা সে চিৎকার করে কাঁদছে। অনিমেষ মুখ ফিরিয়ে নিল। কান্না বড় সঙক্রামক–নিজেকে স্থির রাখতে দেয় না।
ধর্ধরা-করলার সঙ্গমের পাশ ঘেঁষে তপুপিসিদের স্কুল। অনেকদিন তপুপিসিকে দেখেনি সে; তপুসিসি এখন কেমন আছে? তপুপিসিকে নিজের পাশের খবর দিয়ে আসার ইচ্ছেটা কোনোরকমে সামাল দিল সে। তার মুখোমুখি হতে হঠাৎ খুব সঙ্কোচ হচ্ছিল ওর, অথচ সে তো আর অন্যায় করেনি। ছোটকাকার ব্যবহারের জন্য সে তো দায়ী নয়। তবু-। অনিমেষ হাসপাতাল-পাড়ার রাস্তায় পা বাড়ান্ডানদিকে ফার্মেসি ট্রেনিং সেন্টারের সামনে মৃতুদেহ রেখে একা একা সে চিৎকার করে কাঁদছে। অনিমেষ মুখ ফিরিয়ে নিল। কান্না বড় সঙক্রামক–নিজেকে স্থির রাখতে দেয় না।