What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected উত্তরাধিকার - সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

রাস্তার পাশে গাছগুলোতের, দেওয়ালে হরতালের পোস্টার পড়েছে। ধরা আর করলা নদীর মুখে যে-ব্রিজটা নিচু হয়ে কচুরিপানার ডগা ছয়ে আছে, সেখানে দাঁড়াল সে। ধরার আসল নাম কি ধরলা? করলায় মিশছে যকন তখন এরকম নাম হওয়াই উচিত। কিন্তু ছেলেবেলা থেকে সে ধরধরা নাম শুনে আসছে। করলা যেরকম গভীর এবং গম্ভীর ধরধরা তেমন না। এই ধরধরার থমকে-চলা জল কোনোরকমে গিয়ে পড়ছে করলায়, করলা সেই জলে স্রোতের টান দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তিস্তায়। তিস্তা তার বিরাট ঢেউ-এ সেই জলকে মিশিয়ে ছুটে যাচ্ছে ব্ৰহ্মপত্র কিংবা সমুদ্রের দিকে। ধরার এলিয়ে-থাকা জলের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ শরীরে কেমন কাঁটা দিয়ে উঠল। মানুষের জীবন ঠিক এইরকম, এই নদীর মতন। সে যখন স্বৰ্গছেঁড়ায় ছিল তখন সেই ইউক্যালিপটাস গাছ, চায়ের বাগান, মাঠ, ভবানী মাস্টার আর নতুন-শেখা বন্দেমাতরম ছাড়া কিছুই জানত না। তখন মাতার ওপর ওদের। সমস্ত পরিবারটা ছিল, চারধারে যেন স্বপ্নের, আদরের দেওয়াল তাকে আড়াল করে রেখেছিল। তারপর এই ধরধরার করলায় মিশে যাওয়ার মতো সে এল জলপাইগুড়িতে। এখানে নতুন স্যার, কংগ্রেস, বিরাম কর, রম্ভা আর সুনীললদা তার চারপাশের দেওয়ালটাকে যেন আস্তে-আস্তে সরিয়ে নিল। ইনকিলাব জিন্দাবাদ, এবং সুনীলদা-ছোটমা আর এই বাবা-অনিমেষে মাথা নাড়ল, আর আগামীকাল সে ট্রেনে উঠবে, কলকাতায় যেতে হবে তাকে। ঠিক নদীর সমুদ্রে পড়ার মতন। কলকাতার মানুষ নাকি দয়ামায়াহীন, কেউ কারও বন্ধু নয়। সেখানে চোর বদমাশ আর পণ্ডিতেরা। পাশাপাশি বাস করে, কিন্তু কে যে কী তা চিনে নেওয়া সহজ নয়। কলকাতার মানুষ শিক্ষিত হয় এবং উচ্ছন্নে যাবার জন্য সাহায্য পায়। অদ্ভুত রহস্য নিয়ে এখন কলকাতা তার সামনে দুলছে, নদীর সামনে সমুদ্রের ঢেউ-এর মতন। কলকাতা-বিষয়ক অনেক বই পড়েছে সে, না গিয়েও অনেক রাস্তার নাম সে জানে। কলকাতা এখন তাকে টানছে, কিন্তু যে-স্বৰ্গছেঁড়াকে সে ছেড়ে এল, যে-জলপাইগুড়ি থেকে চলে যেতে হচ্ছে, তাকে আর এমনভাবে কখনো ফিরে পাবে না এই বোধ ক্রমশ আচ্ছন্ন করে ফেলছিল অনিমেষকে। এবার স্বৰ্গছেঁড়ায় গিয়ে সে একটা নগ্ন সত্যের মুখোমুখি হয়ে গেল। দীর্ঘকাল মাটির সঙ্গে বসবাস না করলে শিকড় আলগা হয়ে যায়। ওখানকার নতুন ছেলেদের কাছে সে যেন বাইরের লোক বলে মনে হচ্ছিল। এই জলপাইগুড়িতেও তার একদিন এমন অনুভব হবে–অনিমেষ স্পষ্ট বুঝতে পারছিল।

ধর্‌ধরা-করলার সঙ্গমের পাশ ঘেঁষে তপুপিসিদের স্কুল। অনেকদিন তপুপিসিকে দেখেনি সে; তপুসিসি এখন কেমন আছে? তপুপিসিকে নিজের পাশের খবর দিয়ে আসার ইচ্ছেটা কোনোরকমে সামাল দিল সে। তার মুখোমুখি হতে হঠাৎ খুব সঙ্কোচ হচ্ছিল ওর, অথচ সে তো আর অন্যায় করেনি। ছোটকাকার ব্যবহারের জন্য সে তো দায়ী নয়। তবু-। অনিমেষ হাসপাতাল-পাড়ার রাস্তায় পা বাড়ান্ডানদিকে ফার্মেসি ট্রেনিং সেন্টারের সামনে মৃতুদেহ রেখে একা একা সে চিৎকার করে কাঁদছে। অনিমেষ মুখ ফিরিয়ে নিল। কান্না বড় সঙক্রামক–নিজেকে স্থির রাখতে দেয় না।
 
দিনবাজারের পোস্টঅফিসের সামনে এসে রাস্তা থেকে সরে দাঁড়াল সে। বিরাট একটা মিছিল আসছে কংগ্রেসের। সামনে চরকার ছবিওয়ালা পতাকা-হাতে একটি বালক, পেছনে জলপাইগুড়ির সমস্ত বয়স্ক কংগেসিরা। হরতালের বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছেন তারা। অনেকের হাতেই পোস্টার। অনিমেষ পড়ল, নেতাজিকে দালাল বলে কারা-হরতাল ডেকেছে যারা, গড়ার আগেই ভঙতে চায় কারা-হরতালের শরিক যারা, দেশকে বাঁচান-কমিউনিস্ট দালালদের থেকে দূরে থাকুন, রক্ত দিয়ে পাওয়া স্বাধীনতা-হঠকারীদের খেয়ারমতো হারাব না, হারাব না।

মিছিলের দিকে তাকিয়ে অনিমেষের পা শক্ত হয়ে গেল। হরবিলাসবাবু। সম্পূর্ণ অশক্ত চেহারা নিয়ে সেই বৃদ্ধ অন্য একজনকে অবলম্বন করে মাথা নিচু করে কোনোরকমে হেঁটে যাচ্ছেন। স্পষ্ট, যেন চোখ কান বন্ধ করলেও নিজের রক্তে সেই কথাগুলোকে অনিমেষ শুনতে পায়, আমাদের সশ্রাম শান্তির জন্য, ভালোবাসার জন্য। আপনারা সবাই প্রস্তুত হোন। এখন সেই ব্রাহ্মমুহূর্তে, আমাদের জাতীয় পতাকা স্বাধীন ভারতের আকাশে মাথা উঁচু করে উড়বে। তাকে তুলে ধরছে আগামীকালের ভারতবর্ষের অন্যতম নাগরিক শ্রীমান অনিমেষ। মুহূর্তেই অনিমেষ সেইসব ফুলের পাপড়ি যা পতাকা থেকে খুলে পড়েছিল তার স্পর্শ সমস্ত শরীরে অনুভব করল। বুকের ভেতরে কে যেন সারাক্ষণ চুপচাপ বসে বলে ঘুমোয়, আর হঠাৎ-হঠাৎ ঘুম বেঙে এমন এক বায়না করতে থাকে যে তাকে সামলানো দায় হয়ে ওঠে। অনিমেষ দ্রুত পা ফেলে মিছিলের ভেতর ঢুকে পড়ল, তারপর হরবিলাসবাবুর পাশে গিয়ে তার অন্য হাত আঁকড়ে ধরল। বৃদ্ধের চোখে প্রায় সাদা-হয়ে-আসা কাচের চশমা, তার শরীর থেকে অনেক কিছু খুবলে খুবলে নিয়ে গিয়েছে, সোজা হয়ে হাটতে তিনি পারেন না। হঠাৎ একজনকেউ তার হাত ধরেছে বুঝতে পেরে তিনি শরীর বেঁকিয়ে মুখ কাত করে তাকে দেখতে চেষ্টা করলেন। চলতে চলতে অনিমেষ একবার অস্বস্তিতে পড়ল। হরবিলাসবাবুকে সে চেনে কিন্তু তিনি তো তাকে মনে নাও রাখতে পারেন! মিছিলটা পোস্টঅফিসের সামনে দিয়ে রায়কতপাড়ার দিকে যাচ্ছে। হরবিলাসবাবুর সঙ্গী একজন তরুণ, অনিমেষকে হাত ধরতে দেখে হেসে বলল, দাদু ছাড়ছিল না, তাই নিয়ে এলাম।

চলতে চলতে হরবিলাসবাবু কথা বললেন, ফ্যাসফেসে গলার শব্দ স্পষ্ট উচ্চারণ হয় না, তুমি কে বাবা? কী নাম?

শুকনো কাঠির মতো হাত ধরে অনিমেষ বলল, আমার নাম অনিমেষ। আপনার এইরকম, চেহারা হল কী করে?

রোগ বাবা, কালব্যাধি। এই মরি কি সেই মরি, তবু মরি না। তা শুনলাম:কংগ্রেস একটা ভালো কাজ করছে-দেশগড়ার কাজে সবাইকে ডাকছে, তাই চলে এলাম। হরতাল কার বিরুদ্ধে করছিস? ভাই হয়ে ভাইকে ছুরি মারবি? অবিশ্যি কংগ্রেসও আমাকে আর ডাকে না, ঘাটের মড়াকে কে পছন্দ করে?

কথা বলতে বলতে হাঁফ ধরে যাচ্ছিল এবং নিজের শরীরটাকে ঠিক বুঝতে পারেননি, হরবিলাসবাবু সহসা দাঁড়িয়ে পড়লেন। অনিমেষ দেখল তার বুক জোরে ওঠানামা করছে, চোখ দুটো বড় হয়ে উঠছে। ও খুব ঘাবড়ে গিয়ে হরবিলাসাবাবুর সঙ্গীকে বলল, উনি বোধহয় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, চলুন ওই বারান্দায় ওঁকে একটু বসিয়ে দিই।

মিছিলের লোকজন ওদের মধ্যে রেখে এগিয়ে যাচ্ছিল। কেউ-কেউ কৌতূহলী চোখে, কেউ শুধুমাত্র জিভ দিয়ে একটা সমব্যথার শব্দ বাজিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। একজন বলল, এই শরীর নিয়ে ঝামেলা বাড়াবার জন্য আসার কী বাজিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। একজন বলল, এই শরীর নিয়ে ঝামেলা বাড়াবার জন্য আসার কী দরকার ছিল! হরবিলাসবাবুর সঙ্গীও খুব বিরক্ত হয়ে পড়ল, বললাম পারবেন না-হল তো! কবে কী করেছেন এখনও সেইসব জাবর কাটা!
 
ওরা দুজনে সন্তপর্ণে ওঁকে রাস্তার পাশে এক বারান্দায় নিয়ে গিয়ে বসাল। মিছিলের আর-কোনো মানুষ ওদের সঙ্গে এল না। জেলখানার পাশ দিয়ে মিছিল এবার এগোচ্ছে উমাগতি বিদ্যামন্দিরের দিকে। অনিমেষ দেখল মিছিলের শেষাশেষি নিশীথবাবু শ্লোগান দিতে দিতে হেঁটে যাচ্ছেন। ওঁর মুখ সামনের দিকে, অনিমেষদের লক্ষ করলেন না। হঠাৎ অনিমেষের মনে হল, নিশীথবাবুকে খুব বয়স্ক মনে হচ্ছে। খদ্দরের পাঞ্জাবি এবং ধুতিপরা নিশীথবাবুর শরীরটা কেমন যেন বুড়িয়ে গিয়েছে। হরবিলাসবাবুর পক্ষে শুয়ে পড়লেই ভালো হত, তবু খানিকক্ষণ বসে হাঁপের টানটা কমল। এক হাতে চশমাটা খুলে অন্য হাতের আঙুলে চোখের কোল মুছলেন তিনি। অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, এমন বোধ করছেন আপনি?

মাথা নাড়লেন হরবিলাসবাবু, ভালো।

কিছু বলা উচিত তাই অনিমেষ বলল, এই শরীর নিয়ে আপনার আসা ঠিক হয়নি।

কেমন বিহ্বল মুখ তুলে হরবিলাসবাবু তাকে দেখলেন, এখন আর ঠিক-বেঠিক জ্ঞান থাকে না। এই খাই, পরমুহূর্তে মনে হয় খাইনি। এই আমি ইংরেদের সঙ্গে লড়েছি, মাঝে-মাকে বিশ্বাসই হয় না। শরীর পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মরে যাওয়া উচিত।

অনিমেষ বলল, আপনি আর কথা বলবেন না। বরং একটা রিকশা নিয়ে বাড়ি ফিরে যান।

হরবিলাসবাবুর সঙ্গী বোধহয় এইরকম কিছু ভাবছিল, সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, আপনারা বসুন, আমি একটা রিকশা ডেকে আনি। বোধহয় হাত নেড়ে বারণ করতে যাচ্ছিলেন হরবিলাসবার, কিন্তু সে তা না শুনে পোল্টঅফিসের দিকে এগিয়ে গেল।

এবার যেন হরবিলাসবাবুর খেয়াল হল, তোমাকে তো আগে দেখিনি বাবা, কী নামঃ অনিমেষ খুব অবাক হয়ে গেল। এই খানিক আগে সে ওঁকে নিজের নাম বলেছে, অথচ এই মুহূর্তে তিনি সেটা ভুলে গিয়েছেন। ও আবার নাম বলল। তুমি আমাকে চেন? খেয়াল করতে না পেরে হরবিলাসবাবু বললেন।

হ্যাঁ, আপনি একসময় এই জেলার অন্যতম কংগ্রেসকর্মী ছিলেন, কতবার জেল খেটেছেন। সাতচল্লিশ সালের পনেরোই আগস্টের কথা আপনার মনে আছে অনিমেষের গায়ে হঠাৎ কাঁটা ফুটে উঠল। ও উদগ্রীব হয়ে বৃদ্ধের মুখের দিকে তাকাল।

হরবিলাসবাবু যেন তারিখটা নিয়ে কয়েকবার ভাবলেন, ঘাড় নেড়ে বললেন, ও-দিনটায় তো আমরা স্বাধীন হলাম।

সেদিন আপনি কোথায় গিয়েছিলেন? খুব ভোরবেলায়?

আবার খানিক চিন্তা করে ঘাড় নাড়লেন হরবিলাসবাবু, মনে পড়ছে না ভাই। আজকাল সব কেমন গুলিয়ে যায়। অথচ এই তো সেদিনের কথা। আচ্ছা, সেবার সোদপুরে।

ওঁকে থামিয়ে দিল অনিমেষ, না। আপনি স্বৰ্গছেঁড়ায় গিয়েছিলেন। সেখানে আপনার উপস্থিতিতে প্রথম জাতীয় পতাকা তোলা হয়েছিল।

আচমকা যেন মনে পড়ে গেল বৃদ্ধের, ইহঁ। সেই প্রথম পতাকা উঠল মাথা উঁচু করে। ওরা ফুল বেঁধে দিয়েছিল। কত ফুল পড়ল আকাশ থেকে, শখ বাজাল মেয়েরা। মনে পড়ছে, মনে পড়ছে। তুমি সেখানে ছিলে?

অনিমেষ খুব আস্তে বলল, আপনি আমাকে পতাকা তুলতে ডেকেছিলেন, আমি প্রথম সেই পতাকা তুলেছিলাম।

ওর দিকে উদ্‌গ্রীব-চোখে কিছুক্ষণ তাকয়ে থেকে হরবিলাসরু হঠাৎ দুটো শুকনো হাত বাড়িয়ে ওর মুখ চেপে ধরলেন অঞ্জলির মতো। তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, মনে রাখা বড় শক্ত। আমি মনে রাখতে পারি না, আমি মরে গেছি, তুমি মনে রেখেছ-তোমার দায়িত্ব অনেক। দাদু, তোকে বড় হিংসে হচ্ছে রে!

ঠিক এই সময়ে রিকশা নিয়ে ছেলেটি ফিরে এল, আসুন।

দুজনে ধরাধরি করে হরবিলাসবাবুকে রিকশায় তুলে দিল। অনিমেষ লক্ষ করছিল যে তিনি ওর মুখ থেকে চোখ সরাচ্ছিলেন না। অনিমেষের মনে হল, তিনি ওর বুকের ভেতরটর দেখতে পাচ্ছেন। ও ঝুঁকে পড়ে তাকে প্রণাম করল। হরবিলাসবাবু জড়সড় হয়ে রিকশায় বসেছিলেন, বোধহয় ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও শরীর নাড়তে পারলেন না। সঙ্গী ছেলেটি নিচে দাঁড়িয়েছিল, বলল, আপনি একা যেতে পারবেন?

অনিমেষ বলল, ওঁকে একা ছাড়া কি ঠিক হবে?
 
ছেলেটি বেজারমুখে বলল আমার কাছে পয়সা নেই, রিকশাভাড়া আপনার কাছে আছে? ভীষণ বিরক্ত হয়ে পড়লেন হরবিলাসবাবু, আড়চোখে অনিমেষ সেটা দেখতে পেল। ও চট করে পকেটে হাত দিয়ে দুটো আধুলি খুঁজে পেল। স্বর্ণছেঁড়া থেকে ফিরে ওর কাছে কিছু পয়সা এসেছে। অনিমেষ চট করে সেটা ছেলেটির হাতে খুঁজে দিতে সে দ্বিরুক্তি না করে নিয়ে নিল।

রিকশাটা চলে গেলে অনিমেষ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। কোথাও যেন একটা খুশির ঝরনা মুখ বুজে বসে ছিল, হঠাৎ সামান্য ফাঁক পেয়ে সেটা তিরতির করে ওর সমস্ত বুঝ ভাসিয়ে দিচ্ছে। হরবিলাসবাবুর জন্য সামান্য কিছু করতে পারায় ওর নিজেকে খুব মূল্যবান বলে মনে হতে লাগল।

মিছিলটা তখন হারিয়ে গিয়েছে। অন্যমনস্ক হয়ে সে মণ্টুদের বাড়ির দিকে হাঁটাছিল। মণ্টুদের বাড়ি উমাগতি বিদ্যামন্দিরের পাশে। মন্টর মাকে অনিমেষের খুব ভালো লাগে। মণ্টুর বাবা অসুস্থ হয়ে আছেন অনেক দিন, তাই সংসারের হাল ধরে আছেন মাসিমা। এখানকার একটা বাচ্চাদের স্কুলে তিনি পড়ান, পুর খাটতে পারেন এবং যখনই দেখা হয় এমন মিষ্টি করে হাসেন ভালো না লেগে পারা যায় না। মণ্টুদের বাড়ির সামনে এসে অনিমেষ বুঝতে পারল মিছিল ভেঙে গেছে স্কুলের মাঠে পেীছে। কারণ কন্দরপরা মানুষগুলো গল্প করতে করতে ফিরে যাচ্ছেন। রিকশাওয়ালারা যেন মেলা বসেছে এমন ভঙ্গিতে হর্ন বাজাচ্ছে। টিনের দরজা ঠেলে উঠোনে ঢুকে পড়ল অনিমেষ। বিরাট কাঠালগাছের সামনে মণ্টুদের টিনের চালওয়ালা বাড়ি। অনিমেষ দেখল মাসিমা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। ওকে দেখে মিষ্টি মুখ হাসিতে ভরে গেল, পাশ করে তোর পিঠে ডানা গজিয়েছে শুনলাম, আমাকে প্রণাম করার সময় পাচ্ছিস না!

কথার ধরন এমন যে না হেসে পারা যায় না। অনিমেষ প্রায় দৌড়ে গিয়ে ওকে প্রণাম করল। মাসিমা চিবুকে হাত দিয়ে চুমু খেলেন, তারপর, এখন তো তোরা সব কলকাতার বাবু হতে চললি! আমাদের কথা মনে থাকবে তো?

কেন মনে থাকবে না, বাঃ! অনিমেষ প্রতিবাদ করল।

বোস গিয়ে ঘরে, আমি সন্ধেটা দিয়ে আসি। মাসিমা বললেন।

মণ্টু কোথায় মাসিমা। অনিমেষ চারধারে নজর বোলাল। তার গলা শুনলে মণ্টু নিশ্চয়ই বাইরে বেরিয়ে আসত।

মাসিমা বললেন, ও আজ সকালে শিলিগুড়ি গেল আমার হোটদার কাছে। তোর সঙ্গে রেজাল্ট বের হবার পর আর দেখা হয়নি?

মণ্টু বাড়িতে নেই শুনে অনিমেষ হতাশ হল, না। ও কবে যাবে কলকাতায়।

ওই তো হয়েছে মুশকিল। আমার ছোটদার শালার বাড়ি বেহালায়। বউদির ইচ্ছে ও সেখানে থেকে পড়াশুনা করুক। তা এত আগে থেকে গিয়ে কী হবে! মণ্টু তাই বউদিকে মার্কশিট দিতে গিয়েছে, ভরতি-টরতি হয়ে গেলেও যাবে। তা তুই কবে যাচ্ছিস রে? মাসিমা যেতে-যেতে ঘুরে দাঁড়ালেন।

আগামীকাল। অনিমেষ বলল।

ওমা, তাই নাকি। কোথায় উঠবি? কার সঙ্গে যাবি? মাসিমা আবার এগিয়ে এলেন। যেন এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়াটা ওঁর ধারণায় ছিল না।

কার সঙ্গে আবার, একাই যাব! আমি কি ছোট আছি নাকি? ওখানে বাবার এক বন্ধু আছেন, তার বাড়িতে উঠে হোস্টেল ঠিক হলে চলে যাব। খুব গম্ভীর গলায় অনিমেষ জবাব দিল।

সে কী! তোকে বাড়ি থেকে একা ছাড়বে আর তা ছাড়া কাল হরতাল, কলকাতায় যদি কোনো বিপদ-আপদ হয়? আমার কিন্তু ভালো লাগছে না। মাসিমাকে সত্যি সত্যি খুব চিন্তিত দেখাল।
 
অনিমেষ জোর করে হাসল, কিছু হবে না। কিন্তু মনেমনে ও হঠাৎ দুর্বল হয়ে পড়ল। কলকাতায় যাবার সময় যত এগিয়ে আসছে তত যেন একটা অনিশ্চিত এবং অজান্ম জগতে পা বাড়াবার উত্তেজনা বুকের মধ্যে ড্রাম বাজাচ্ছে। ও লক্ষ করল এখন ওর হাতের চেটো ঘামছে। কিন্তু খুব গম্ভীর হয়ে সে এই দুর্বলতাকে ঢেকে রাখতে চাইল।

মাসিমা আর সন্ধে দিতে গেলেন না। যদিও এখনও শেষ বিকেলের আলো কোনোরকমে নেতিতে পড়ে আছে আকাশটায়, তবু সন্ধে বলা যায় না। তবে যে-কোনো মুহূর্তেই রাত নেমে আসতে পড়ে আছে আকাশটায়, তবু সন্ধে বলা যায় না। তবে যে-কোনো মুহূর্তেই রাত নেমে আসতে পারে। আজ অবশ্য ছটার মধ্যে বাড়ি ফেরার তাড়া নেই। কাল যখন কলকাতায় যাবার জন্য জলপাইগুড়ি ছাড়তেই হবে তখন আজ নিশ্চয়ই দেরি করে গেলে দাদু কিছু মনে করবেন না। এর মধ্যেই ওর নিজেকে বেশ বড় বড় বলে মনে হচ্ছে। এখন ঠোঁটের ওপর নরম সিল্কি চুল বেরিয়ে গোঁফের আকৃতি নিয়ে নিয়েছে। সে-তুলনায় গালে দাড়ি কম, চিবুকে অবশ্য বেশকিছু বড় হয়েছে।

এখন পর্যন্ত নিয়মিত দাড়ি কামানো অভ্যাস করেনি। একবার পেন্সিলে ব্লেড ঢুকিয়ে টেনেছিল, কেমন অস্বস্তি হয়। কলেজে না ভরতি হলে দাড়ি কামাবে না ঠিক করেছিল অনিমেষ। একটা প্লেটে কিছু পাটিসাপটা নিয়ে মাসিমা বেরিয়ে এলেন, বন্ধু নেই বলে পালাবার মতলব করছিস বুঝতে পাচ্ছি, এটা খেয়ে যা।

এখন পাটিসাপটা? অনিমেষের খুব ভালো লাগল।

সারাদিন বসে ছিলাম, করে ফেললাম। বড় ছেলেটা খুব ভালোবাসে। মাসিমা ওকে সামনে বসিয়ে ওগুলো খাওয়ালেন।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। টিনের দরজা খুলে বাইরে বেরুতে বেরুতে ও মাসিমার শাখ বাজানোর আওয়াজ পেল। তিনবারের আওয়াজটা শেষ হতে ও হাঁটা শুরু করল। উমাগতি বিদ্যামন্দিরের মাটে এখনও কিছু জটলা আছে। মিছিলের কিছু লোক এখনও গল্প করছে ওখানে। দূর থেকে আর-একটা ছোট দল ইনকিলাব জিন্দাবাদ ধ্বনি দিতে দিতে এগিয়ে আসছে। আমাগীকালের হরতালের সপক্ষে ওদের স্লোগান কংগ্রেসিদের দেশে জোরদার হল। অনিমেষ খুর আশঙ্কা করছিল এবার হয়তো মুখোমুখি একটা সংঘর্ষ বেধে যাবে। কিন্তু কংগ্রেসিরা চুপাচাপ ওদের চলে-যাওয়া দেখল। ওরাও খুব দ্রুত এবং এদের অবজ্ঞা করেই হেঁটে গেল। অনিমেষ ফেরার জন্য পা বাড়াতে যাচ্ছে এমন সময় পেছন থেকে ওর নাম ধরে কেউ ওকে ডেকে উঠল। পেছনের মাঠের অন্ধকার থেকে একজন মানুষকে এগিয়ে আসতে দেখল সে। রাস্তার আলো মুখে পড়তেই ও নিশীথবাবুকে চিনতে পারল। ওকে দেখে অনিমেষ খুব অস্বস্তিতে পড়ল। ইদানীং নিশীথবাবুর সঙ্গে ওর তেমন যোগযোগ নেই। ওর হোস্টেলের ঘরে আগের মতো নিয়মিত যাওয়া ও বন্ধ করেছে সেই বন্যার পর থেকেই। স্কুলে যতদিন ছিল ততদিন মুখোমুখি হলে কথা বলেছে, কিন্তু আগের মতো আগ্রহ দেখায়নি। ফাইনাল ইয়ার, পড়ানোর চাপ কুব এরকম ভান দেখিয়ে ও সরে থেকেছে। কিন্তু নিশীথবার ওর মনের কথা বুঝতে পেরেছেন-এই ধরনের একটা কথা একদিন বলেও ছিলেন।

কী ব্যাপার ভালো রেজাল্ট করেছ অথচ দেখা করতে আসনি যে নিশীথবাবু ওর পাশে এসে দাঁড়ালেন।

অনিমেষ পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল, আমি এখানে ছিলাম না, স্বৰ্গছেঁড়ায় গিয়েছিলাম।

তা কী ঠিক হল, এখানে পড়বে, না কলকাতায় যাবে?

নিশীথবাবুর মুখের একটা পাশ দেখতে পাচ্ছিল সে, খুব স্বাভাবিক গলায় কথা বলছিলেন তিনি। অনিমেষ বলল, কলকাতায় যাব, কাল যাওয়া ঠিক হয়েছে।

খুব ভালো। ওখানে না গেলে এই সময়কে, এই দেশকে জানা যায় না। কী নিচ্ছ, সায়েন্স না আর্টস?
 
নিশীথবাবুর প্রশ্নটা শুনে অনিমেষের আচমকা বাবার মুখ মনে পড়ে গেল। ইস, একদম ভুলে গিয়েছিল সে। বাবার প্রস্তাব সে যে মেনে নিতে পারছে না এবং দাদুকে ওর সপক্ষে বাজি করাতে হবে একথাটা একদম খেয়াল ছিল না। ভাগ্যিস নিশীথবার জিজ্ঞাসা করলেন, না হলে পরে মুশকিলে পড়তে হত। দাদুর সঙ্গে যাবার আগে কথা বলতে হবে। নিশীথবাবুকে ও জবাব দিল, আর্টস নেব।

মাথা নাড়লেন তিনি, আমি এরকমটাই ভেবেছিলাম। তা ওখানে কোথায় থাকবে তোমার কাকা বোধহয় এখন কলকাতায় আছেন?

অনিমেষ বলল, না, আমি হোস্টেলে থাকব। প্রেসিডেন্সি কলেজে তো হোস্টেল আছে।

হ্যাঁ, ইডেন হোস্টেল। তারপর দুজনে অনেকক্ষণ চুপচাপ হেঁটে এল। জেলখানা পেরিয়ে পোস্টঅফিসের সামনে হঠাৎ নিশীথবাবু যেন নিজের মনেই বলে উঠলেন, কাল হরতাল।

অনিমেষ বলল, যা, সন্ধে ছটা পর্যন্ত।

নিশীথবাবু বললেন, সেটা বড় কথা নয়। কথা হল হরতাল আদৌ হবে কি না। কলকাতায় কথা জানি না, ওখানকার মানুষ হুজুগে, এখানে ইলেকশনের যা রেজাল্ট তাতে তো এখানে ওদের ডাকে কেউ সাড়া দেবে না। তুমি কী বল?

অনিমেষ সহসা জবাব দিল না। হরতাল হবে না বললে নিশীথবাবু নিশ্চয়ই খুশি হবেন। কিন্তু ও কি সত্যি জানে যে হরতাল হবে না? নিশীথবাবু আবার জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কথা বলছ না যে?

মানে ঠিক বলা যায় না। কমিউনিস্টরা যেকথা বলছে তা তো একদম মিথ্যে নয়। সব মানুষ তো সমান খেতে পায় না, জামাকাপড় পায় না। আর জিনিসপত্রে দাম যা বেড়ে গেছে, সবাই তো কিনতেও পারে না। সরকার থেকে তেমন কোনো ব্যবস্থা

অনিমেষকে থামিয়ে দিলেন নিশীথবাবু, বেশ, বেশ! আমাদের এই রাষ্ট্রের বয়স কত? এখনও আমরা বালক। এই কয় বছরে রাতাতি ইংরেজদের ছিবড়ে-করে-যাওয়া দেশটাকে বড়লোক করে দেওয়া যায়? এটা ম্যাজিক নাকি? তার জন্য সময় লাগবে না? নিঃস্ব অবস্থা থেকে তিল তিল করে গড়তে হবে না? কমিউনিস্টদের পক্ষে নেই নেই করে মানুষকে খেপিয়ে তোলা সহজ, তাতে কোনো দায়িত্ব নেই। সাহায্য নয়-শত্রুতাই ওদের একমাত্র বেঁচে থাকার অবলম্বন।

অনিমেষ এ-ধরনের কথা এর আগেও শুনেছে, তাই বলল, কিন্তু গরিবদের কিছু লাভ না হলেও বড়লোকরা আরও বড়লোক হচ্ছে। কংগ্রেসি নেতাদের নাকি প্রচুর টাকা হচ্ছে। ও বিরাম করের নামটা বলতে গিয়েও চেপে গেল।

হতে পারে। তবে ব্যতিক্রম কি নিয়ম? এই আমি, কলকাতা ছেড়ে চলে এলাম এখানে, কংগ্রেসকে ভালোবেসে ওর জন্য কাজ করছি, কে আমাকে টাকা দিয়েছে? কতটা বড়লোক কংগ্রেসকে বুর্জোয়াদের পার্টি বলে ওরা? দেশের জন্য কাজ করছি এটাই আমার আনন্দ-ওরা যদি সন্দেহ করে। করুক। নিন্দে করে বা সন্দেহ করে কেউ সিদ্ধিলাভ করতে পারে না।

কিন্তু কমিউনিস্টরা যে সমান অধিকারের কথা বলে–, অনিমেষ হঠাৎ থেমে গেল। ও বুঝতে পারছিল শুধু শোনা কথার ওপর একটা দলের যুক্তিগুলো বলা যায় না।

নিশীথবাবু হঠাৎ গলা খুলে হাসলেন, তারপর কোনোরকমে সেটাকে সামলে বললেন, অনিমেষ, তোমাকে একটা কথা বলি। আমাদের তেত্রিশ কোটি দেবতার দেশে কখনো কোনো ইজম চলতে পারে না। কমিউনিস্ট এখন যেসব বড় বড় কথা বলছে সেগুলো বলার জন্যই। যদি ওরা ক্ষমতা পায় তা হলে আমরা যা করছি ঠিক তা-ই করবে। তখন যদি কেউ হরতাল ডাকে, জোর করে তা ভাঙতে চাইবে। ক্ষমতায় বসলে সব মাথায় উঠে যাবে-একথা আমি তোমায় লিখে দিতে পারি-তখন আমার কথা বেরুবে না।

অনিমেষ চট করে জবাব দিতে পারল না। কী হবে না-হবে তা সে বলবে কী করে? নিশীথবাবুর নিশ্চিয়ই তার থেকে অভিজ্ঞতা বেশি। অবশ্য এটা ঠিক যে ও নিশীথবাবুকে চিরকাল এরকমই দেখে এসেছে, বড়লোক হলে অবশ্যই ওরা টের পেত। কিন্তু শুধু বিরামবাবুর বাড়িতে যাওয়া-আসা ছাড়া, সেরকম কিছু চোখে পড়েনি ওর।

তুমি বিরামদার ঠিকানা জান? হঠাৎ নিশীথবাবু জিজ্ঞাসা করলেন।

না। অনিমেষ বলল। তোমার যদি দরকার হয় আমার কাছ থেকে চিঠি নিয়ে যেও। বিরামদার মতো ইনফ্লুয়েন্সিয়াল লোককে কলকাতায় থাকলে দরকার হবেই। ওখানে তুমি কাজ করার অনেক সুবিধে পাবে। আমাদের ইউনিয়ন সে সব কলেজেই আছে। আর যদি সিনসিয়ারলি কাজ করা যায় তবে দেশের নেতাদের চোখে সহজেই পড়া যায়, কলকাতায় থাকার এটাই হল সুবিধে। তুমি তো ইডেনে থাকবে বলেছিলে, সেখানে অবশ্য বামপন্থি দলগুলো-ছাত্র ফেডারেশনের জোর বেশি।

অনিমেষ অনেক্ষণ কোনো কথা বলছিল না। ওরা দুজন সমস্ত রাস্তাটা চুপচাপ হেঁটে এল। যত সময় যাচ্ছে অনিমেষের বোধ হচ্ছিল নিশীথবাবু যেন গুটিয়ে যাচ্ছেন। নৈঃশব্দ্য যে কখনো-কখনো গোপনে-গোপনে কথা তৈরি করে নেয় এই প্রথম বুঝতে পারল অনিমেষ। এই যে অনিমেষ খুব জোরের সঙ্গে কথা বলেনি, তিনি একাই অনেকক্ষণ বলে গেলেন-এটা চুপচাপ হাঁটতে গিয়ে যেন নিশীথবাবু আবিষ্কার করে ফেলেছেন। তাই হাকিমপাড়ায় পৌঁছে দুজনের আলাদা পথের মোড়ে দাঁড়িয়ে নিশীথবাবু একটু থমকে দাঁড়ালেন। অনিমেষ যাবার সময় তাঁকে প্রণাম করতেই ভীষণ ধরাগলায় বললেন, অনিমেষ, অবিশ্বাস করে ঠকার চেয়ে বিশ্বাস করে হারানো অনেক ভালো।
 
আটটার মধ্যেই খাওয়াদাওয়া চুকে গেল। সরিৎশেখরই তাড়া দিচ্ছিলেন। আজ বিকেলে ইলেকট্রিক বিল এসেছে, দেখে মাথায় হাত। প্রথম ঝাঝ মিটিয়েছিলেন তিনি হেমলতার ওপরে। এত আলো জ্বাললে তিনি আর কী করে পেরে উঠবেন! হেমলতা তখন রান্নাঘরে বসে পায়েসের শেষ ব্যবস্থা করছিলেন, অনেক কষ্টে বাবার সঙ্গে তর্ক করার ঝোকটাকে সামলালেন। তর্ক মানেই ঝগড়া, অশান্তি। অন্যদিনে হলে ছেড়ে দিতেন না, কিন্তু কাল অনি কলকাতায় চলে যাবে, আজ তাঁর মন ভীষণ অশান্ত, কিছুতেই কিছু ভালো লাগছে না। সেই ছোট্টবেলা-ছোট্টবেলা জন্মাল তো ও তাঁরই হাতে। তারপর চোখের সামনে তিলতিল করে ওকে বড় হতে দেখলেন, এই দেখে যে কতটা কষ্টের এখন এই মুহূর্তে তিনি উপলব্ধি করছেন। নিজের সন্তান নেই, সন্তান-স্নেহ কথাটা লোকমুখে শোনা, কিন্তু হঠাৎ আজ সকাল থেকে তার মনে হচ্ছে তাঁর শরীরের একটা অংশ কাল বিযুক্ত হতে যাচ্ছে। বাবার চিৎকার শুনেও তিনি এখন কিছু বলতে পারলেন না, তার বদলে দুচোখ উপচে জল এসে গেল। অথচ অনি তাঁর ছেলে নয়, সেই কোকিল এসে যেন ডিম পেড়ে রেখে গেছে-তবু কেন যে ছাই এমন হয়। মৃতা ভ্রাতৃবধূকে মনেমনে ঠেসতে লাগলেন তিনি, বেঁচে থাকলে নাজ দেখতাম তুই কী কতিস! মরে গিয়ে সব দায় চাপিয়ে গেলি। বা হাতে চোখ মুছলেন তিনি। আজকাল যে কী হয় তার, মাঝে-মাঝে বড়মা, ছোটমা আর মাধুরীর মুখ এক হয়ে তালগোল পাকিয়ে যায়। মৃতা এই তিন মহিলাকে বড় কাছাকাছি মনে হয়।

ভাড়াটে বসাবার পর থেকেই বাড়ির ট্যাক্স বেড়েছিল, কিছুদিন আগে আবার বেড়েছে। সরিৎশেখর, তার বিরুদ্ধে আপিল করেছিলেন, বেশ কয়েকবার তিনি মিউনিসিপ্যালিটি অফিসে যোরাঘুরি করেছেন, কিন্তু সেই আবেদন শোনার সময় বাবুদের এখনও হয়নি। ফলে বাড়ির ট্যাক্স দেওয়া বন্ধ করেছেন তিনি। এদিকে জলের সাপ্লাই শহরে কমে গেছে, যেটুকু আসে তাতে চাপ নেই, ফলে অত সাধের ওয়াটার-ট্যাঙ্কটা শুকনো থাকে। পুচপুচ করে কয়েক দফায় যে-জ আসে তাতে মেহলতার কিছুই হয় আজকাল, চারধারে অভাবের তীরগুলো উচিয়ে বসে আছে, নড়াচড়া করলেই খেচা লাগছে। আজ শুতে যাবার সময় তার বুকে সামান্য ব্যথা বোধ হচ্ছে। প্রেশারট্রেশার কখনো চেক করাননি। শরীর মাঝে-মাঝেই অকেজো হয়ে যাচ্ছে, তখন হোমিওপ্যাথি গুরি তাকে সাহায্য করে।

একটু আগে হেমলতা মশারি টাঙিয়ে দিয়ে গেছেন, মাথার কাছে খাটের নিচে খবরের কাগজের ওপর বালির বাক্যে কফ ফেলার জায়গা ঠিক রাখতে ভোলেননি। একটা দিন এই মেয়ে না থাকলে তার শরীরটা বিকল হয়ে যাবে একথা তার চেয়ে আর-কেউ ভালো করে জানে না। তবু কোনো সমস্যায় পড়লেই মেয়ের ওপর হম্বিতম্বি করেন, কারণ এটাই সবচেয়ে নিশ্চিন্ত জায়গা। এখন রাগ করতে পারেন এমন মানুষ তার ধারেকাছে নেই। বুকের ব্যথার কোনো ওষুধ তার কাছে নেই, এটা নতুন উপসর্গ। ডান হাত বুকে রাখলেন তিনি। শরীর ক্রমশ শুকিয়ে দড়ি পাকিয়ে যাচ্ছে। সেইসর মাগুলো কোথায় চলে গেল, চামড়াগুলো গুটিয়ে যাচ্ছে আস্তে-আস্তে। নিজের শরীরের দিকে তাকালে বড় কষ্ট হয় এখন।
 
পঁচাত্তর বছর অল্প সময়-দেখতে-দেখতে চলে গেল। কিন্তু মৃত্যু অনেক দূরে-আরও পঁচিশটি বছর তার বেঁচে থাকার বড় সাধ। পৃথিবীতে রোজ কত কী খবর হয়-মরে গেলে সেসব থেকে সোজা ব্যাগ-হাতে দ্রুত হেঁটে বাড়ি ফেলেন। বেঁচে থাকার অধিকার তার আছে, এরকমটা ভেবে মনটা প্রফুল্ল হল সরিৎশেখরের। কিন্তু সে সামান্যক্ষণের জন্য। বুকের মধ্যে হাপ লাগছে। এই যে বেঁচে থাকতে ভালো লাগে, এই বাড়িটাকে রোজ ভোরে উঠে দেখতে ইচ্ছে করে, সেটা কী জন্যে এত বছর বেঁচে থেকে তিনি কী দেখলেন? দুই স্ত্রী-তারা তো অনেকদিন আগেই ঢ্যাং ঢ্যাং করে চলে গেল। বড় ছেলের মুখদর্শন এ-জীবনে তিনি করবেন না, ছোট ছেলে-হ্যাঁ, তাকেও তিনি বাতিল করেছেন। এক মেয়ে চোখের সামনে মরে গেল, আর-একজন বিধবা হয়ে সারাজীবন থান পরে তার সংসারে পড়ে রইল। একমাত্র মহীতোষ যে কিনা কোনোদিন তার মুখের ওপর তর্ক করেনি, তাকে আঘাত দেয়নি, কিন্তু ওর কাছেও তিনি আপন হতে পারেননি কোনোদিন। মহীর বউ তো জোয়ান বসেই চলে গেল। অর্থাৎ এই এত বছর বয়স তাকে শুধু দুঃখই দিয়ে গেছে-বেঁচে থেকে হেয় সুখ পাওয়া যায় না। এই যদি নীট ফল হয়, তা হলে মনে হয়, এও তো একটু একটু করে সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ভাড়াটের অনাদর, ট্যাক্সের বোঝা তো আছেই, এতদিনে একবারও তিনি হোয়াইটওয়াশ করাতে পারলেন না। যত্ন না পেলে সবকিছুই নষ্ট হয়ে যায়, যাচ্ছেও।

এইসব সমস্যার মধ্যে বাস করেও তনি একটি জায়গায় অত্যন্ত কর্তব্যপরায়ণ ছিলেন, সেখানে তার কোনোরকম গাফিলতি ছিলন না-তা হলে অনিমেষকে মানুষ করা। লোকে যে কেন মানুষ করার কথা বলে, মানুষ কেউ কাউকে করতে পারে না। তিনি তার পুত্রদের পারেননি। শরীর বড় হওয়া আর আর মানুষ হওয়া যখন এক ব্যাপার নয় তখন এই চলতি কথাটা মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু অনিমেষের বেলায় তার আওতায় থেকে একটু একটু করে লক্ষ্যের দিকে এগিয়েছে, কখনো হোঁচট খায়নি। এই ছেলে প্রথম ডিভিশনে পাশ করবে এ অন্ধ বিশ্বাস তার ছিল এবং সেটা মিথ্যে হয়নি। আজ অবধি যখন যা খেতে বা পরতে দিয়েছেন ও কখনো সে নিয়ে অভিযোগ করেনি–এটাই মানুষ হবার প্রথম পদক্ষেপ। একমাত্র যে-জিনিসটা সরিৎশেখরকে ভাবাত, মাঝে-মাঝে ছোট ছেলের পরিণতির কথা মনে করিয়ে দিত, তা হল অনিমেষের দেশের কাজে আকৃষ্ট হওয়ার প্রবণতা। সেই ছেলেবেলা থেকে ওর কংগ্রেসের প্রতি যে-আকর্ষণ তা কি এখনও আছে। ইদানীং ওর সঙ্গে এ-বিষয়ে আলোচনা হয় না। অনিমেষের সঙ্গেওর সেই নতুন স্যারের সম্পর্ক কী তা তিনি জানেন না। তবে রাজনীতির প্রতি আকর্ষণ সত্ত্বেও যদি এ-ছেলে এমন ভালো ফল করে পাশ করতে পারে, তবে তিনি কখনোই আপত্তি করবেন না। আজ রাত্রে সরিৎশেখর বিছানায় শুয়ে এইসব চিন্তা করতে করতে আসল জায়গায় শেষ পর্যন্ত এলেন–অনিমেষ কাল কলকাতায় চলে যাচ্ছে।

বুকের ব্যথার জায়গায় এখন যেন কোনো স্পর্শ লাগল-কারণ উপলব্ধি করতে পারলেন সরিৎশেখর। এবং এই প্রথম তিনি ভীষণ অবাক হয়ে গেলেন। তার শরীর মনের হুকুমে চলে? এবং কোন মন, না, যে-মনকে তিনি নিজেই জানতেন না। এমনিতে তাঁর সম্পর্কে নির্দয় কঠোর পাষাণ এইসব বিশেষণ ব্যবহৃত হয়, সত্যি বলতে কী, অন্যায়ের সঙ্গে তিনি কোনোদিন আপস করেননি বলেই তার সম্পর্কে সবাই একথা বলে। কিন্তু অনিমেষকে তিনি বড় করেছেন, পড়াশুনা শিখিয়েছেন আরও বড় হবার জন্য-কলকাতায় না গেলে তা সব নয়-এসব তো অনেক দিনের জানা কথা। তা হলে? তা ছাড়া তার বংশে আজ অবধি কেউ কলকাতায় পড়তে যায়নি-সেদিক দিয়ে তার গৌরবের ব্যাপার।
 
আজ খেতে বসে অনিমেষ মহীতোষের ইচ্ছার কথা জানিয়েছিল। ওর বাবা ওকে ডাক্তার হতে বলেছে-সায়েন্স পড়াতে চায়। অথচ নাতির ইচ্ছে সে আর্টস পড়ে। তাঁকে সালিশি করেছে সে। অনিমেষ ইংরেজিতে এম এ পাশ করে অধ্যাপক হোক এই চিন্তা তাকে খুশি করে। মহীতোষ কদিন দেখেছে তার ছেলেকে সে কী করে জানবে ওর মনের গঠন কেমন? ফট করে কিছু চাপিয়ে দিলে ফল ভালো পাওয়া যাবে? তিনি নাতিকে বলেছেন, সায়েন্স পড়তে যদি ভালো না লাগে তো পড়ার দরকার নেই। সেকথা শুনে অনিমেষের মুখ কীরকম উজ্জ্বল হয়েছিল এখন চোখ বন্ধ করেও তিনি দেখতে পেলেন। আজকাল কোনো সিদ্ধান্ত নেবার জন্য কেউ বড়-একটা তার শরণাপন্ন হয় না-সরিৎশেখরের তাই আজ নিজেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে বোধ হচ্ছিল। মহীতোষের সঙ্গে পরে তিনি এব্যাপারে কথা বলবেন। অতএব কাল যে-ছেলেটা কলকাতায় যচ্ছে তাতে তার চেয়ে সুখী আর কে পারে। তবু যে কেন এমটা হয়? কেন মনে হচ্ছে সেখানে ওর কিছু হলে তিনি দেখতে পাবেন না! একটা অজানা শহরে ছেলেটা একা একা কীভাবে বাস করবে? সেইসঙ্গে এতক্ষণ যে-ব্যাপারটা তিনি মনের আড়ালে-আবডালে রাখছিলেন সেটা চট করে সামনে এসে দাঁড়াল-কাল থেকে তিনি সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়বেন। কাল থেকে বাড়িটা ফাঁক হয়ে পড়বে। তিনি কী করে বাঁচবেন? যৌবনে যেকোনো সমস্যার মুখোমুখি তিনি যেভাবে হতে পারতেন, এই পঁচাত্তর বছরে এসে তা আর সম্ভব নয়-এই সত্যটা যেন বুকের ব্যথাকেআগলে রাখছিল। এখন তিনি বুঝতে পারেন যে হেলতা ক্রমশ অশক্ত হয়ে পড়ছে-শারীরিক ক্ষমতায় সে আর বেশিদিন এভাবে কাজ করে যেতে পারবে না। যদি তার আগে হেমলতা চলে যায়, তা হলে তিনি কী করবেন? এই বাড়িতে সম্পূর্ণ একা একা তিনি কীভাবে থাকবেন? এখন এই বয়সে আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। মহীতোষের কাছে গিয়ে দুদিন তিষ্ঠোতে পারবেন না তিনি।

কেউ জানে না, কাউকে জানাননি তিনি, বেশ কিছুদিন আগে গোপনে একটা উইল করেছেন এই বাড়ির ব্যাপারে। তাঁর অবর্তমানে এই বাড়ির সম্পূর্ণ মালিকানা হেমলতার, কিন্তু তিনি এই সম্পত্তি ভোগ করতে পারবেন, বিক্রি করতে পারবেন না। হেমলতার এ অনিমেষ এই বাড়ির মালিক হবে। আর কেউ নয়-আর কারও কথা তিনি চিন্তা করতে পারেন না। উইল করার সময় মনে হয়েছিল, মানুষ যখন বোঝে মৃত্যু খুব কাছে, চলে যাওয়ার সময় আর সুযোগ পাওয়া যাবে না, তখনই উইল করে। কিন্তু তিনি কখনোই খুব শিগগির যাচ্ছেন না, তা হলে উইল করা কেন? কি করে ফেলে আর পালটানো বা বাতিল করা হয়নি। এবং যেহেতু এটা একটা দুর্বলতা, তাই কাউকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করেননি, এমনকি হেমলতাকেও নয়। অনিমেষ কাল চলে যাবে। সে যদি কৃতিত্বের সঙ্গে এম এ পাশ করে অধ্যাপনা করে তা হলে কি জলপাইগুড়িতে ফিরবে না, কখনোই নয়। এই কথাটা এই মুহূর্তে অন্তত বিশ্বাস করতে আরম্ভ করলে। কলকাতায় গিয়ে শিখড় গাড়লে কেউ আর ফিরে আসে না। ওঁর মনে হতে লাগল, অনিমেষের এই চলে যাওয়াটা শেষ যাওয়া। এর পর ও আসবে ক্ষণিকের জন্য-সাময়িকভাবে। এই অনিমেষকে আর তিনি কখনো ফিরে পাবেন না। অতএব এই বাড়ির মালিকানা গেলে সে কোনোদিনই তার দখল চাইবে না। তখন এত যত্নের বাড়িটার কী অবস্থা হবে।

ভীষণ অস্বস্তি হতে লাগল তার। চট করে অনেক বছর আগে শোনা শনিবাবার কথা মনে পড়ল। এর কোনো কাজে বাধা দিও না-এই সংসারে সে আটকে থাকবে না। কথাটাকে এই মুহূর্তে তিনি ভীষণ সত্যি বলে মনে করতে লাগলেন। এবং এই প্রথম সরিৎশেখর ব্যথার কারণটা পুরোপুরি আবিষ্কার করলেন। তার বুকের ভেতর থেকে কী-একটা জিনিস.আস্তে-আস্তে খসে যাচ্ছে। তার ভীষণ ইচ্ছা হচ্ছে সেটাকে দুহাতে আঁকড়ে ধরে রাখেন, অথচ ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তিনি বাধা দিতে পারলেন না। তাকে তার নিজের দৃষ্টির পূর্ণ রূপ দেখে যেতে হবে। ভীষণ অস্বস্তি নিয়ে এক বিছানায় এপাশওপাশ করতে করতে গভীর রাতে সহসা উঠে বসলেন সরিৎশেখর।
 
জিনিসপত্র মোটামুটি গোছগাছ হয়ে গেছে। একটা সুটকেস আর ছোট হোন্ডল নিয়ে সে যাবে। কাল সন্ধ্যেবেলায় ট্রেন। শিলিগুড়ি থেকে যে নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেস ছাড়ে তাতে হলদিবাড়ি থেকে আসা একটা কম্পার্টমেন্ট জুড়ে দেওয়া হয়। অনিমেষ জলপাইগুড়ি স্টেশনে সেই লোকাল ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে উঠবে। সাধারণত জলপাইগুড়ির মানুষ আগেভাগেই লোক পাঠিয়ে হলদিবাড়ি থেকে জায়গা দখল করিয়ে আনে কিন্তু একজনের পক্ষে তেমন কোনো অসুবিধে হবে না। আজ সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরতেই ও জয়াদির গলা পেয়েছিল, নিশ্চয়ই জয়াদি বিকেলে বাড়ি ফিরেছেন। যাওয়ার আগে ওর সঙ্গে দেখা হবে ভেবে খুশি হয়েছিল অনিমেষ। সত্যি বলতে, জয়াদিই প্রথম তাঁকে কলকাতার সঙ্গে পরিচিত করিয়েছিলেন। জয়াদি না থাকলে সে জানতেই পারত না জীবনানন্দ দাশ নামে সেই বিখ্যাত কবি ট্রামের তলায় চাপা পড়েছিলেন। জমাদির সঙ্গে দেখা করার জন্য সে ওদের বারান্দায় উঠে আসতেই থমকে দাঁড়িয়েছিল। খুব চাপা গলায় জয়াদি কথা বলছিলেন, এতে যার সআের পক্ষে বিয়ে করা উচিত হয়নি।

জয়াদির স্বীমীর গলা কিন্তু চড়া ছিল, ওসব নাটুকে কথা ছেড়ে দাও, নবেল পড়ে মাথা বিগড়ে গিয়েছে তোমার। এত ঘনঘন বাপের বাড়ি যাওয়া পছন্দ করি না আমি।

খুব নির্লিপ্তর মতো জয়াদি বললেন, বেশ, যাব না।

অ্যাঁ। কী বললে? এককথায় রাজি? তা সেইসব কচি কচি ভাইগুলোর মাথা চিবোতে পারবে না বলে মন-খারাপ লাগছে না? তোমার যে পুরুষ-ধরা রোগ ছিল তা যদি জানতাম কোন শালা বিয়ে করতে!

দ্রুত নেমে এসেছিল অনিমেষ। ওর মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। কী ভীষণ নোংরা গলায় জয়াদির স্বামী কথা বলছেন! জয়াদির এই সমস্যায় জয়াদিকে এতখানি নোংরার মধ্যে থাকতে হয় কোনোদিন সে টের পায়নি! ওঁর সঙ্গে কথা বলেও আভাস পায়নি কখনো। ওঁদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মিল নেই এটা টের পেয়েছে, কিন্তু তাই বলে এতটা! কচি কচি ভাই বলতে উনি কী বোঝাচ্ছিলেন। সে-অর্থে ও নিজেও তো জয়াদির ভাই। ভীষণ অসহায় লাগল অনিমেষের। একবার মনে হয়েছিল পিসিমাকে ব্যাপারটা বরবে, কিন্তু চলে যাওয়ার সমস্যা নিয়ে বাড়ির সবাই এত চিন্তিত যে একথাটা বলার অবকাশ পায়নি।

এখন রাত দশটা হবে। এই সময় জলপাইগুড়ি শহর ক্রমশ নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে। ওদের পাড়াটায় দোকানপাট নেই, বড় ছাড়া-ছাড়া বাড়ি, তাই গভীর রাতটা খুব তাড়াতাড়ি নেমে আসে। একদম ঘুম পাচ্ছে না আজ অনিমেষের। কাল চলে যেতে হবে-এই বোধটা মাঝে-মাঝে সেই একাকিত্বের ভয়টাকে উসকে দিচ্ছে। অন্যমনস্ক হয়ে ও সামনের দেওয়ালের দিকে তাকাল। সেখানে সেই ঘোট কুকুরটা এখনও চুপচাপ বসে আছে। আজ থেকে অনেক বছর আগে এটাকে আবিষ্কার করেছিল সে। দেওয়ালের চুনের আস্তরণ সরে গিয়ে যে-ফাটল হয়েছে সেটাই একটা কুকুরের আকৃতি নিয়ে নিয়েছে। খুব মজা লাগত ছেলেবেলায়। চট করে দেখলে মনে হয় খুব আদুরে ভঙ্গি নিয়ে কুকুরটা চেয়ে আছে। আজ এত রাত্রে ওর কুকুরটার জন্য ভীষণ কষ্ট হল, কাল থেকে সে আর এটাকে দেখতে পাবে না!
 

Users who are viewing this thread

Back
Top