What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected স্বনামধন্য - সমরেশ মজুমদার (4 Viewers)

চা শেষ করে সে যখন উঠে দাঁড়াচ্ছে তখন মা বলল, একবার ডাক্তারকে ফোন করে দেখি, উনি যদি আপত্তি না করেন তাহলে আমার দিতে আপত্তি কি।

বাবা বলল, আপত্তি করবেন। তোমারও বয়স হয়েছে।

ভরত বলল, যদি অপারেশনটা আমার হত আর তোমাদের অন্য উপায় না থাকত তাহলেও কি এইসব কথা বলতে?

বাবা বলল, এরকম তুলনা করা বোকামি। যাকে চিনি না তার সম্পর্কে দায়িত্ববোধ থাকে না। সে আমাদের সন্তান নয়।

ঘরে চলে এল সে। অদ্ভুত অসহায় লাগছিল। অভিজিতের সঙ্গে কি আবার যোগাযোগ করবে? কিন্তু ও যা করার করেছে, বারংবার করবে কেন? সুদেষ্ণার কথা মনে এল। সুদেষ্ণার সঙ্গে

অনেককাল যোগাযোগ নেই।

বেরিয়ে এসে ও দেখল বাবা-মা এখনও খাওয়ার টেবিলে বসে আছে। তার মানে আবার ওদের মধ্যে আপাত যুদ্ধবিরতি হয়েছে। সে রিসিভার তুলে ডায়াল করল। ওপাশে এক ভদ্রলোকের গলা পাওয়া গেল। ভরত জানতে চাইল সুদেষ্ণা আছে কিনা! ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কে বলছ?

বলুন ভরত কথা বলছি।

ভরত? তুমি সুদেষ্ণার সঙ্গে পড়তে না?

হ্যাঁ।

আরে কী খবর বল? আমি ওর বাবা বলছি। তুমি তো সেই একবার আসবার পর এলেই না। কী করছ এখন? সুদেষ্ণার বাবা উজ্জ্বল হলেন। ভরতের মনে পড়ল মানুষটাকে। বই পত্তর নিয়ে থাকেন সবসময়।

কিছু না? কাজকর্মের চেষ্টা করছি।

পড়াশুনা?

ও আমার দ্বারা হবে না। সুদেষ্ণা কোথায়?

ও নিচে আছে। বাড়িতেই নাচের স্কুল করেছে। সামনের মাসে রবীন্দ্রসদনে ওদের প্রোগ্রাম। ও তো স্কুল থেকেই শিখত, পাশটাস করেছিল, এখন বিদ্যেটা কাজে লাগাচ্ছে। বেশ জমে গেছে ওর স্কুল। দাঁড়াও, আমি কানেকশনটা নিচে দিয়ে দিচ্ছি। ভরত শুনল ওপাশে বেল বাজছে তারপরই সুদেষ্ণার গলা, বাবা, আবার লাইন দিলে কেন? আমাদের রিহার্সাল চলছে এখন।

সুদেষ্ণার বাবার গলা শোনা গেল, ভরত ফোন করেছে অনেকদিন বাদে তাই—ভরত কথা বলো। ভদ্রলোক রিসিভার নামিয়ে রাখলেন, আওয়াজ বোঝা গেল। ভরত বলল, আমি খুব দুঃখিত এসময়ে বিরক্ত করার জন্যে।

সুদেষ্ণা হাসল, ঠিক আছে। কেমন আছ?

আছি। আমি তোমার সাহায্য চাই।

বল।

তোমার শ্রাবণীকে মনে আছে? আমাদের কলেজে পড়ত!

বাঃ, মনে থাকবে না কেন? তোমার কাছ থেকে খবর নিয়ে আমি একবার হসপিটালে গিয়েছিলাম। কী হয়েছে ওর?

আগামীকাল ওর অপারেশন। লিউকেমিয়ায় ভুগছে তা জানো। ফ্রেশ ব্লাড দরকার। ওর এমন কেউ নেই যে সাহায্য করতে পারে।

কখন দরকার?

কাল সকাল নটার মধ্যে।

অ্যাসেমব্লি অফ গর্ড চার্চে?

হ্যাঁ।

ওর ব্লাড গ্রুপটা যেন কী?

ও।

ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।

তুমি দেবে?

তোমাকে চিন্তা করতে মানা করছি। গুড নাইট।

রিসিভার নামিয়ে রাখতে রাখতে হঠাৎ গায়ে কাঁটা ছড়ালো ভরতের। এ যে কী আনন্দ তা সে কী করে বোঝাবে? মা জিজ্ঞাসা করল, কী হলো?

আপাতত আর সমস্যা নেই। পরম বিশ্বাসে বলে ফেলল ভরত।

.
 
সকাল সাড়ে আটটায় হসপিটালে পৌঁছে ভরত দেখতে পেল সুদেষ্ণা বেশ কয়েকজন মেয়েকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখে এগিয়ে এল সে, আমার স্কুলের মেয়ে এরা। প্রত্যেকের ব্লাড গ্রুপ ও।

অবাক হয়ে ভরত জিজ্ঞাসা করল, এরা সবাই নিজের ব্লাড গ্রুপ জানে?

যে কোনও শিক্ষিত মানুষের সেটা জানা উচিত। তাছাড়া স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় অ্যাডমিশন ফর্মে সেটা লিখতে হয়।

মনে মনে মাথা গুনল ভরত। সুদেষ্ণাকে নিয়ে ছয়জন। হঠাৎ যেন মনে হল শূন্য হাতে যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে থাকার সময় আচমকা বিপুল অস্ত্র পেয়ে গেল। সে ওদের নিয়ে সোজা ব্লাডব্যাঙ্কে চলে এল। দুজন ডাক্তার পালা করে তদারক করেন। এঁদের সঙ্গে ভালই পরিচয় হয়ে গেছে ভরতের। রক্ত দেবার ব্যবস্থা করে ভরত ছুটল ডক্টর দত্তর কাছে। গিয়ে দেখল মাসিমা সেখানে বসে আছেন। দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদছেন তিনি। ডক্টর দত্ত বলছেন, আপনি শক্ত হন মা। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করছি। আপনার মেয়ের কথা ভাবুন, ও নিজে কি লড়াই করছে! এই যে ভরত, এসে গেছ। রক্তের কী হলো?

পাঁচজন এসেছে যাদের রক্তের গ্রুপের সঙ্গে শ্রাবণীর মিলে গেছে। আর একজন–। ভরত বলতে গিয়ে ফাঁপরে পড়ল, সুদেষ্ণা নিজের কথা তাকে বলেনি।

সেটুকু শোনার মতো ধৈর্য ডক্টর দত্তর ছিল না, তিনি সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, দারুণ। গুড। আমি যে কি চিন্তায় ছিলাম। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হতাম ব্লাডব্যাঙ্ক থেকে আনাতে। এখন আমরা স্বচ্ছন্দে কাজ শুরু করে দিতে পারি। রিসিভার তুলে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে তিনি বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, ভরত পেছন পেছন আসতেই দরজার বাইরে পা রেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন, কিছু বলবে?

শ্রাবণীর সঙ্গে দেখা করা যায় না?

ডক্টর দত্ত বড় চোখে দেখে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলেন, বিকেলে দেখা কোরো। ততক্ষণে ওর সেন্স এসে যাবে।

ডক্টর দত্ত চলে গেলেন। ভরত মাসিমাকে নিয়ে বাইরের বেঞ্চিতে বসল। হঠাৎ মাসিমা তার হাত ধরলেন, বাবা, তুমি না থাকলে–। ওঁর গলা বুজে এল।

ভরত প্রতিবাদ করল। ভদ্রমহিলা সেকথায় কান না দিয়ে আঁচলে চোখ বন্ধ করলেন। কিছুক্ষণ বসে থেকে সে উঠে পড়ল নিঃশব্দে। শ্রাবণীকে বাঁচাতেই হবে। আজকের অপারেশন ঠিকঠাক হলে ডক্টর দত্ত লড়াই করার জোর পাবেন। এই মুহূর্তে সে ভাবতেই পারছে না শ্রাবণী তার কেউ হয় না। ওর সঙ্গে এই হসপিটালের বাইরে কোনও সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু এসব সত্ত্বেও মনে হচ্ছে শ্রাবণী না বাঁচলে তার সব কিছু শূন্য হয়ে যাবে।

ওরা আসছিল। সুদেষ্ণা জিজ্ঞাসা করল অপারেশন শুরু হয়ে গিয়েছে?

মাথা নাড়ল ভরত।

সুদেষ্ণা জিজ্ঞাসা করল, তাহলে তো শ্রাবণীকে দেখা যাবে না, না?

বোধহয় না।

সুদেষ্ণা সঙ্গিনীদের বলল, তোমরা আর অপেক্ষা করে কি করবে? কারও শরীর খারাপ লাগছে না তো?

মেয়েগুলো হেসে উঠল। প্রত্যেকে যে যেমন দেখতে তোক ভরতের সুন্দর লাগল। একটি মেয়ে বলল, আমি তো কিছু বুঝতেই পারলাম না। আমার রক্ত ওকে দেওয়া হবে এটা ভাবতেই নিজেকে কিরকম ইম্পর্ট্যান্ট মনে হচ্ছে।

সুদেষ্ণা বলল, রক্ত শ্রাবণীর শরীরে গিয়ে যেন ওকে বাঁচতে সাহায্য করে সেই প্রার্থনা করো। তোমরা একা যেতে পারবে?

অন্য একটি মেয়ে শব্দ করে হাসল, আমরা পাঁচজন আছি, একা কোথায়।

ওরা চলে গেলে ভরত বলল তুমি একটা দারুণ কাজ করলে!

সুদেষ্ণা তাকাল, কিছু বলল না।

ভরত আবার বলল, তুমি বাড়ি ফিরবে না?
 
যে কোনও মুহূর্তেই যেতে পারি। তবে এখন হাতে কোনও কাজ নেই। চলো, অপারেশন থিয়েটারের সামনে যাই।

জিজ্ঞাসা করে ওরা চলে এল ও. টি.-র সামনে। দরজায় লাল আলো জ্বলছে। হঠাৎ সুদেষ্ণা জিজ্ঞাসা করল সেবার বাড়ি ফেরার পর শ্রাবণী এতদিন ভাল ছিল, না?

আমি ঠিক জানি না।

জানো না মানে? তোমার সঙ্গে দেখা হত না?

না।

হতো না? চমকে তাকাল সুদেষ্ণা।

ভরত মাথা নাড়ল, সেবার হসপিটাল থেকে নিয়ে যাওয়ার পর আমি আর কোনও যোগাযোগ করিনি। এতদিন পরে খেয়াল হতে ওর বাড়িতে গিয়ে জানতে পারলাম ও আবার হসপিটালে ভর্তি হয়েছে।

তাহলে তুমি এত কনসার্নড হয়ে গেলে কী করে?

সুদেষ্ণার চোখে বিস্ময়।

মনে হল ওর পাশে দাঁড়ানো দরকার।

শুধু তাই?

ভরত এবার বুঝতে পারল। সে সুদেষ্ণার দিকে তাকিয়ে বলল, ব্যাপারটা শুধু তাই ছিল। এখন কী আমি জানি না।

সুদেষ্ণা এবার অন্যদিকে তাকাল। ওরা আর কথা বলল না।

প্রায় আধঘণ্টা বাদে ডক্টর দত্ত বের হলেন। ওদের ওখানে দাঁড়াতে দেখে মাথা নাড়লেন। ভরত এগিয়ে গেল, কিন্তু কী প্রশ্ন করবে বুঝতে পারল না।

ডক্টর দত্ত বললেন, মানুষের হাড়ের মধ্যে স্পঞ্জের মতো যে জিনিসটা থাক তার নাম ম্যারো। লাল আর হলদে দু ধরনের ম্যারো। হলদেটা তৈরি করে ফ্যাট আর লাল ম্যারোর কাজ হল লোহিত রক্তকণিকা বানানো। মানুষের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লাল ম্যারো দুর্বল হয়ে যায় আর হলুদটা সক্রিয় হয় বেশি। তখন বুকের প্রধান হাড়ে, কোমরের, খুলির, শিরদাঁড়া, হাত পায়ের হাড়ে ওই লাল মজ্জা থাকে বাকি সব হাড়ে তাদের অস্তিত্ব পাওয়া যাবে না। লাল মজ্জা থেকে তৈরি হয় স্টেম সেলস্, স্টেম সেলস থেকে রেড সেল, হোয়াইট সেল আর প্লেটলে। কোনও কারণে যদি লাল মজ্জা ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে শরীরে রক্তের জোগান কমে যাবে। শ্রাবণীর তাই হয়েছে। দেখি এই অপারেশনের রেজাল্ট কী হয়। আমরা ওর ম্যারো পরীক্ষা করব যাতে কোনো রাস্তা খুঁজে পাওয়া যায়।

এখন কেমন আছে?

আমি অবাক হয়ে গিয়েছি। ব্যাপারটা খুব পেইনফুল কিন্তু মেয়েটা চমৎকার সহযোগিতা করেছে। ডক্টর দত্ত চলে গেলেন।

মাসিমাকে খবরটা দিল ভরত। উনি বললেন সকালবেলায় স্নান করে এসেছেন। আর বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। মেয়েকে বেড়ে দেওয়ার পর জ্ঞান হয়েছে দেখে তারপর যাবেন। ভরত জিজ্ঞাসা করল, আপনার জন্যে কিছু খাবার এনে দেব?

না বাবা। আমি কিছু খেতে পারব না।

ভরতের কষ্ট হচ্ছিল। এই মহিলার মেয়ে ছাড়া জীবনে আর কেউ নেই। সেই মেয়ে—

ভরত বলল, বিকেলে আপনাকে আসতে হবে না। আমি আসব।

মাসিমা ম্লান তাকালেন, কোনও কথা বললেন না।

সুদেষ্ণার সঙ্গে বেরিয়ে এল ভরত। সুদেষ্ণা জিজ্ঞাসা করল, কোথায় যাবে?

আমার বাড়িতে চলো।

না, থাক।

তুমি আমাকে বন্ধু বলে ভাবতে পার না।

বাঃ। আজ যা করেছ তারপর না ভেবে কি পারি?

ও, আজ এটা না করলে বুঝি ভাবতে না?

তাহলে কাল রাত্রে তোমায় ফোন করলাম কেন?

একটু চুপ করে থেকে সুদেষ্ণা বলল, ভরত, তুমি একসময় আমাকে বলেছিলে, আই লাভ ইউ সুদেষ্ণা। আমি বলেছিলাম তোমার অনুভূতি আমার এলে ভেবে বলব। তুমি জিজ্ঞাসা করেছিলে কবে? আমি বলেছিলাম জ্যোতিষী নই। মনে পড়ে?

এসব কথা আবার কেন তুলছ?

কারণ তোমাকে উত্তরটা দেবার দায় আমার থেকেই গিয়েছিল।

না। কোনও দায় তোমার নেই।

ধন্যবাদ। তবে আজ মনে হচ্ছে উত্তরটা দিতে পারি।

জানা উত্তর শোনার কোন দরকার আছে কি?

সুদেষ্ণা হাসল, কি জান? বলব আমি তোমার ভালবাসা নিতে পারছি না।

ভরত সুদেষ্ণার দিকে তাকাল। তারপর হেসে ফেলল, সুদেষ্ণা, তুমি খুব সুন্দরী, সচ্ছল, গুণবতী মেয়ে। তুমি আমারই বয়সী। যেসময় তোমাকে আমি প্রস্তাবটা দিয়েছিলাম, তখন জীবন কী আমি জানতাম না। সময় একটু একটু করে সেই প্রস্তাবটাকে কুরে কুরে খেয়ে নিয়েছে। এখন আমি আর তোমাকে সেই প্রস্তাব করতে পারি না। আমি জানি কতটা যোগ্যতা থাকলে তোমাকে এমন প্রস্তাব দেওয়া যায়। আমি তোমার বন্ধুত্ব চাই সুদেষ্ণা, শুধু ওইটুকুই।
 
বিকেলবেলায় হসপিটালে গিয়ে ভরত দেখল শ্রাবণীর বিছানার পাশে মাসিমার সঙ্গে সুদেষ্ণাও বসে আছে। শ্রাবণীর রক্ত এবং স্যালাইন চলছে। মেয়েটাকে এখন কাগজের মতো সাদা দেখাচ্ছে। ভরতকে দেখামাত্র সুদেষ্ণা উঠে দাঁড়াল, সেন্স এসেছে।

ভরত মাথা নাড়ল। শ্রাবণীর চোখ বন্ধ। হয়তো ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় ঘুমাচ্ছে। সে নার্সকে জিজ্ঞাসা করল, ডাক্তারবাবু কিছু বলে গেছেন?

আপনাদের জানানোর জন্যে কিছু বলেননি।

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সে মাসিমাকে বলল, আপনি এবার বাড়ি চলুন।

সুদেষ্ণা বলল, আমি ওঁকে পৌঁছে দেব।

ভরত বলল, তাহলে আমি যাই।

তুমি বাড়ির দিকে যাবে না?

না।

সুদেষ্ণার গাড়ি আছে। সকালেও লিফট দিতে চেয়েছিল, ভরত নেয়নি। ও আসায় মাসিমার সুবিধে হল। ও যে আসবে ভাবেনি ভরত।

বাইরে বেরিয়ে একটা সাধারণ দোকানে বসে চা খেল ভরত। দোকানটা খুব খেলো টাইপের, তার খদ্দেররাও তথৈবচ। ভেতরের বেঞ্চিতে বসে গ্লাসে চা খেতে খেতে ভরত শুনল দুটো লোক হিন্দিতে কথা বলছে। কোন একটা জিনিস লুকিয়ে বিক্রি করা হবে কিন্তু যে কিনবে সে দামটা কম দিতে চাইছে। তাকে বাদ দিয়ে অন্য আর একজনকে বিক্রি করার প্ল্যান করছে ওরা। কিন্তু সেটা করতে গেলে আগের লোকটাকে যে ক্ষতি করতে চাইবে সে ব্যাপারেও সন্দেহ নেই। এক্ষেত্রে আগের লোকটাকে এখনই টাইট দেওয়া দরকার। কথাবার্তা বলে ওরা একমত হয়ে চায়ের দাম মিটিয়ে উঠে গেল। ভরত চুপচাপ দেখল। লোকগুলোর রাগ তার বাবার মতো। কি সহজে ওরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। ওর মনে হল কাজ হাসিল করার পর ওই দুজনের মধ্যে একই কাণ্ড হওয়া অসম্ভব নয়। এ ওকে সরিয়ে দিতে চাইবে পুরো টাকাটা কজা করতে। এইভাবেই বেশিরভাগ মানুষ বেঁচে থাকে।

বাড়িতে এসে মায়ের মুখে শুনল তার ফোন এসেছিল। স্বপন নামে একজন চিত্রপরিচালক ফোনে বলেছেন আগামিকাল সকাল নটার মধ্যে স্টুডিওতে গিয়ে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে। রাজেশবাবুর সঙ্গে তার কথা হয়ে গেছে।

ভেতরে ভেতরে খুব খুশি হলেও মুখে কিছু প্রকাশ করল না ভরত। খবরটা দিয়ে মা তাকে লক্ষ্য করে বললেন, কী ব্যাপার রে?

এবার সত্যি কথাটা বলতে হয়। তবু সে কিছুই নয় এমন ভঙ্গিতে বলল, ওই একটা টিভি সিরিয়ালের ব্যাপারে কথা বলতে চায়।

সে নিজের ঘরে ঢুকছিল, মা পেছন থেকে জিজ্ঞাসা করল টিভি সিরিয়াল তো তোর কী? তোর সঙ্গে কী কথা বলবে?

আমাকে সিরিয়ালে অভিনয় করার অফার দিয়েছে। সে ঘুরে জানিয়ে দিল।

তুই অভিনয় করবি? মায়ের মুখে বিস্ময়।

চেষ্টা করতে দোষ কী! ভরত হাসল।

তুই কি পাগল হয়ে গিয়েছিস? ওই লাইনটায় যাওয়া মানে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে যাওয়া সেটা জানিস। তো? ওখানকার মানুষের কি দুর্নাম!

ভরত নিচু গলায় কথা বলল, মা, এখন কোন্ লাইনের সুনাম আছে তুমি বল! বাবা যে চাকরি করছে তাতে কি ফেয়ার কমপিটিশন আছে? একজন সরকারি ডাক্তার হাসপাতাল ম্যানেজ করে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে যাচ্ছেন, সেটা কি ফেয়ার? একসময় এইসব দেখে আমার মাথা গরম হয়ে যেত। তখন প্রতিবাদ করেছি বোকার মতো। আমার কথা শুনে চললে নিচতলার প্রণবের মা এখনও কর্পোরেশন থেকে সার্টিফিকেট বের করতে পারতেন না। কালো টাকা নিয়ে জমি বিক্রি করতে তাঁকে ঘুষ দিতে হয়েছে। এটাও কি ফেয়ার? তুমি যে গ্যাসের সিলিন্ডার ঠিক সময়ে পাবে বলে এক্সট্রা টাকা দাও, তোমার কি মনে হয় সেটা ফেয়ার? চারপাশের মানুষ যা মেনে নিয়েছে, অন্যায় বলে মনে করার মনটা যখন মরে গিয়েছে তখন আর এসব প্রশ্ন তুলে লাভ কী! আর আমি তোমার মত ফিল্ম সম্পর্কে জেনেই যাচ্ছি, আমার আফসোস করার কিছু থাকবে না।

সে ঘরে ঢুকে গেল। ঢুকতেই আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পেল। হঠাৎ মনে হল সে সামনা-সামনি যা দেখতে তার চেয়ে অনেক ভাল টিভির পর্দায় দেখায়। অত খুঁত সত্ত্বেও তাকে চমৎকার দেখাচ্ছিল। কিন্ত কাল সকাল নটার মধ্যে স্টুডিও যেতে হলে হসপিটালে যাবে কী করে? দোটানায় পড়ল ভরত।

.
 
মোটামুটি ভাল পোশাক পরে ঠিক পৌনে নটায় স্টুডিওতে ঢুকতেই স্বপনকে দেখতে পেল ভরত। মাঝখানের লনে দাঁড়িয়ে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলছে, ওকে দেখে হাত নাড়ল, ভরত দাঁড়িয়েছিল, কথা শেষ করে স্বপন কাছে এল, রাজেশদার সঙ্গে কথা হয়েছে। স্ক্রিন টেস্টের রিপোর্ট পেয়ে খুব খুশি। ওঁর শুটিং আরম্ভ হবে সামনের বৃহস্পতিবার। উনি তোমাকে আজ বিকেলে শুটিং হয়ে যাওয়ার পর দেখা করে যেতে বলেছেন। আমার কাছে কাজ করলে ওঁর কোন আপত্তি নেই।

ভরত জিজ্ঞাসা করল, শুটিং হয়ে যাওয়ার পর মানে?

ওহো, কাল ভাই তুমি চলে যাওয়ার পর শিডিউল বদলেছি। আমার হিরোইনের ডেট নিয়ে প্রব্লেম হচ্ছিল। তুমি যে চরিত্রে কাজ করবে সেটা পরের দিকে ছিল। হিরোইনের সঙ্গেই। তখন ওঁর ডেট পাওয়া যাবে না বলে আজ থেকেই করছি। ওঁর সঙ্গে বুধবারের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। স্বপন এমন ভঙ্গিতে বলছিল তাতে মনে হল ও যা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটাই শেষ কথা, ভরতের সঙ্গে আলোচনার দরকার নেই।

ভরতের রাগ হয়ে গেল। এরা তার সঙ্গে কথা বলার দরকার আছে বলে মনে করল না? তার কোনও অসুবিধা আছে কিনা জানতে চাইল না? অদ্ভুত জগৎ।

সে বলল, কিন্তু আজ আমার পক্ষে তো এখানে থাকা সম্ভব নয়।

স্বপন চমকে তাকাল, সেকি? কেন?

আমার অসুবিধে আছে।

মাইগড! আমি যে সেট তৈরি করতে বলেছি কালকেই। সব আর্টিস্টদের বলে দেওয়া হয়েছে। এখন অসুবিধের কথা বললে চলবে কেন?

কাল যখন আমাকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন তখন যদি জানতাম আজই কাজ করতে হবে তাহলে তখনই বলে দিতাম। আমি দুঃখিত।

তোমার অসুবিধে কী ধরনের?

আমার এক আত্মীয়ের অপারেশন হয়েছে। সিরিয়াস কেস। আমাকে সকালে হাসপাতালে যেতেই হবে। আর কোনো মেল মেম্বার নেই।

কখন?

এগারোটার মধ্যে।

স্বপন একটু ভাবল। তারপর বলল ওকে! দশটা-ছটা শিডিউল ছিল। আমি অন্য শটগুলো নেব, তুমি বারোটার মধ্যে চলে এসো। গাড়ি দরকার?

ট্যাক্সিতে আসতে হবে।

তাই এসো। এরা পেমেন্টে করে দেবে।

তাহলে আমি যাই?

স্বপন ঘড়ি দেখল যাও। দ্যাখো ভাই, আমাদের সব কিছু প্ল্যান মাফিক চলে না। অবস্থা অনুযায়ী অলটারেশন করতেই হয়। এটা সবসময় মাথায় রাখবে। এসো।

.

দশটার মধ্যে হাসপাতালে পৌঁছাতে পারল ভারত। গেটের বাইরে ফুটপাতের দিকে চোখ পড়তেই সে দাঁড়িয়ে গেল। ঝুড়িতে একরাশ পেয়ারা নিয়ে বসে আছে একটা লোক। বেছে বেছে গোটা চারেক কিনে একটা মাঝখান থেকে কাটিয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, নুনঝাল আছে?

লোকটা মাথা নেড়ে কাগজে পুরিয়া করে সেটাও দিল।

কাগজের প্যাকট নিয়ে ভেতরে ঢুকতেই ও দেখল আজ প্রচুর ভিড় হয়েছে। বাঁ দিকের আউটডোরে এত লোক কখনও সে দ্যাখেনি। সিঁড়ি বেয়ে ঘরে উঠে এল ভরত। হলঘরের দরজায় পৌঁছে সে অবাক হয়ে গেল। শ্রাবণীর বিছানা খালি। সাদা চাদর বড্ড বেশি সাদা। হঠাৎ ভরতের সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল। সে অসহায় চোখে চারপাশে তাকাল। সমস্ত শরীরে অদ্ভুত একটা কাঁপুনি ছড়িয়ে পড়ছে।

এইসময় নার্স এগিয়ে এল, আপনি তো শ্রাবণীকে খুঁজছেন?

শূন্য চোখে তাকাল ভরত। ওর গলা শুকিয়ে গিয়েছিল।

ওকে ওপাশের ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অবস্থা খুব খারাপ। ব্লাড নিতে পারছে না ভালভাবে ভোর থেকে। ওখানে সমস্ত ডাক্তারবাবুরা রয়েছেন।

কোথায়? ফ্যাসফেসে গলায় জিজ্ঞাসা করল ভরত।

নার্স বলল, আসুন।

করিডোরে খানিকটা হেঁটে নার্স তাকে দেখিয়ে দিল।

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই সে দেখল সামনের ঘরের দরজায় আলো জ্বলছে। আর এইঘরের একপাশের বেঞ্চিতে সুদেষ্ণাকে জড়িয়ে ধরে মাসিমা কেঁদে চলেছেন। ভরতের খেয়াল হল তার হাতে পেয়ারার প্যাকেট রয়েছে। সে চুপচাপ বেঞ্চির একপাশে গিয়ে বসল। মাসিমার চাপা কান্না মাঝে মাঝে স্পষ্ট হচ্ছে। সুদেষ্ণা বলল, আপনি শান্ত হল। যা হবে তা তো মেনে নিতেই হবে। ডক্টর দত্ত এখনও চেষ্টা করছেন।
 
দরজা খুলল। ডক্টর দত্ত বেরিয়ে এলেন। ঝড়ো কাকের মত দেখাচ্ছে বৃদ্ধ মানুষটিকে। মাসিমার দিকে তাকালেন। ভরত উঠে সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ডক্টর দত্ত বললেন, স্টিল ফাইটিং। আমাদের বিদ্যে শেষ হয়ে গেছে। ঈশ্বরের যা ইচ্ছে তাই হবে। ডক্টর দত্ত বেরিয়ে গেলেন। তার পেছনে আর একজন ডাক্তার। ভরত দরজাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সামান্য ফাঁক হয়ে আছে পাল্লা। তার ফাঁক দিয়ে বিছানাটা দেখা যাচ্ছিল। শ্রাবণীর মাথার একটা অংশ দেখা যাচ্ছে। সে দরজাটা সামান্য ঠেলল। একজন নার্স মনিটার পরীক্ষা করছে। নানান নল এসে শ্রাবণীর শরীরে শক্তি যোগাতে সাহায্য করছে। শ্ৰবণী চিত হয়ে শুয়ে আছে। ওর মুখ খুব শান্ত। এই যে এত কাণ্ড হচ্ছে তাকে নিয়ে সে ব্যাপারে তার কোনও আগ্রহ নেই। এইসময় ভরত দেখল নার্স তাকে ইশারা করছে দরজা বন্ধ করার জন্যে। ভরত ধীরে ধীরে দরজা বন্ধ করল।

সুদেষ্ণা কাছে এল কী হবে?

জানি না।

মাসিমাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া উচিত।

উনি কি যাবেন?

সুদেষ্ণা একটু ইতস্তত করল, আমি, মানে, খুব জরুরি একটা কাজ আছে, কী করি বলো তো! মাসিমাকে এখানে একা রেখে যেতে ইচ্ছে করছে না।

তোমার কাজ কখন শেষ হবে?

দুটো নাগাদ।

ওঁকে বললেও উনি বাড়ি যাবেন বলে মনে হয় না। তুমি যাও।

তুমি থাকবে?

দেখি।

সুদেষ্ণা অদ্ভুত চোখে তাকাল, এরকম করে বলছ?

আমি থেকে তো কিছু করতে পারব না।

সুদেষ্ণা মাসিমার কাছে চলে গেল। নিচু গলায় কিছু বলল। মাসিমা মাথা নাড়লেন। সুদেষ্ণা আবার ভরতকে দেখল। তারপর মাসিমার পাশে সে কথা বলতে লাগল। ভরত বেরিয়ে এল। তার হাতে প্যাকেটটা তেমনি করে ধরা ছিল।

ডক্টর দত্তের চেম্বারে তেমনি ভিড়। এই এত মানুষের কারও না কারও শরীরে রক্তের গোলমাল শুরু হয়ে গেছে। ডক্টর দত্ত তাদের আশ্বাস দিচ্ছেন। লড়াই করার প্রেরণা পাচ্ছে তারা। ভরতকে দেখে তিনি বললেন, একটা ফঁড়া আজ সকালে কেটেছে। বিকেল নাগাদ যদি এরকম চলে তাহলে খানিকটা স্বস্তি পাব। বলেই তিনি সামনে বসা মানুষটিকে প্রশ্ন শুরু করলেন।

ঘড়িতে এখন এগারোটা বেজে গেছে। এখন শ্রাবণী লড়ছে তা ওর নিজের লড়াই। তারা তো দূরের কথা, ডাক্তারের ক্ষমতার শেষ সীমাও আর তাকে সুনিশ্চিত করতে পারছে না। কিছুই করার নেই।

হসপিটালের বাইরে এসে ছেঁড়া জামাকাপড়পরা একটা বাচ্চার হাতে প্যাকেটটা ধরিয়ে দিল ভরত। তারপর হাত বাড়িয়ে ট্যাক্সি ডাকল।

.

মুখে হালকা মেকআপ, চুল চমৎকার আঁচড়ানো ভরতকে সেটে নিয়ে এল একজন সহকারী পরিচালক। স্বপন তার কাছে এল, দৃশ্যটি হল, তুমি নায়িকার বাবার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলে। ভদ্রলোকের দুনম্বরী ব্যবসা আছে যা মেয়ে জানে না। তুমি বেশ নামকরা মস্তান। দুনম্বরীতে তোমার কোনও জুড়ি নেই। লোকটা তোমাকে ঠকাচ্ছে আর সমাজে ভদ্রলোকের মুখোশ পরে আছে। আজ বাড়িতে নেই। ওর মেয়ে তোমাকে জিজ্ঞাসা করছে বাবার সঙ্গে তোমার কি দরকার! সিচ্যুয়েশনটা এই।

আমাকে কীভাবে কথা বলতে হবে?

মস্তানের মত।

সেটা আগে নিশ্চয়ই বলা হয়নি।

না। এই প্রথম ছবিতে ইন করছে।

আমি যদি স্বাভাবিক গলায় বলি। মানে, দর্শকরা তো জানবেই লোকটা মস্তান।

তাতে কি নাটকীয় হবে? স্বপন বলল, ওহো বুঝেছি। দ্যাটস ইনটারেস্টিং। এসো, একটা রিহার্সাল দেখি।
 
স্বপন তাকে নিয়ে গেল নায়িকার সামনে। নায়িকার মাথা নিয়ে হেয়ারড্রেসার তখন খুব ব্যস্ত। স্বপন বলল, ম্যাডাম, একটু রিহার্স করতে হবে। কো-অ্যাক্টর নতুন।

এত বড় রোলে নতুন নিচ্ছেন? বেশি সময় যাবে। নায়িকার মুখ অন্যদিকে ঘোরানো, তার চুল ঠিক করা হচ্ছে, সেই অবস্থায় বললেন।

স্বপন বলল, কেন নিতে হল তা তো জানেন। হ্যাঁ, দরজা খুলে আপনি জিজ্ঞাসা করবেন, কাকে চান? লোকটা জবাব দেবে না। আপনি রিপিট করবেন, কী হল? তখন লোকটা বলবে, রায় সাহেবকে বলুন ওঁকে একটু দর্শন দিতে হবে। আমি একটা কম্বাইন শটে এটা নিয়ে প্রেফারেন্সে যাব।

নায়িকার চুল ঠিক হয়ে গিয়েছিল। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, দর্শন শব্দটা কানে লাগছে।

হ্যাঁ। আগে ছিল না। চরিত্রটাকে একটু অন্যরকম করব বলে এখন অ্যাড করলাম। স্বপন হাসল, নিন।

নায়িকা বললেন, কাকে চান?

ভরত গম্ভীর মুখে দেখে সামান্য হাসল।

কী হল?

রায়সাহেবকে বলুন, ওঁকে একটু দর্শন দিতে হবে। গলার স্বর খুব শীতল রাখার চেষ্টা করলেও ওর একটা হাত কথা বলার সময়ে উঠে এল। সে মাথা নেড়ে বলল, সরি! হাত উঠবে না।

স্বপন বলল, ঠিক আছে। ক্যামেরায় ওটা আসবে না।

নায়িকার কপালে ভাঁজ, অত ঠাণ্ডা গলায় বলবেন নাকি?

স্বপন বলল, মেইনটেইন করতে পারলে খারাপ লাগবে না।

সোজা নাকি! তাছাড়া ওইভাবে বললে আমার ওপর কর্তৃত্ব করা হয়। নায়িকা মাথা নাড়লেন,, না, যেভাবে মস্তানরা কথা বলে সেইভাবে অ্যাক্টিং করতে বলুন।

স্বপন বলল, ম্যাডাম, এটা আমার ভাল লাগছে। যাকে ভেবে প্রথমে সংলাপ লেখা হয়েছিল তিনি মস্তানদের মত বলতে অভ্যস্ত। কিন্তু এটা অন্য একটা ডায়মেনশন আনছে। সিনটা টেক করি, দেখে তারপর বলুন।

ভরত চুপচাপ শুনছিল। তার রাগ হচ্ছিল। হঠাৎ আবিষ্কার করল নিজেই জিভ দিয়ে গালের দেওয়ালে ঠেলছে। সে নতুন, কোন মন্তব্য করা উচিত নয় কিন্তু তবু স্বপনকে ভাল লাগল ওই বক্তব্য মেনে না নেওয়ায়।

ক্যামেরার সামনে আলো জ্বেলে যে রিহার্সাল তাকে মনিটার বলে। সেটা করতে গিয়ে বারবার বাধা পড়তে লাগল। লাইটের লোকজন সময় নিচ্ছে। মাল্টি কাটার ইত্যাদি শব্দগুলো শুনতে পাচ্ছিল সে। নায়িকা বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ভদ্রমহিলা তার সঙ্গে পরিচিত হতে চাননি। সে মহিলাকে দেখল। মেকআপ নেওয়া সত্ত্বেও সুদেষ্ণা ওর থেকে অনেক সুন্দর।

কী দেখছেন? নায়িকা জিজ্ঞাসা করলো।

আপনাকে। বলে ফেলল ভরত।

আপনি খুব ভাগ্যবান।

আপনাকে দেখছি বলে?

না পেলে আপনাকে দেখতে পারতাম না।

এরকম কথা শুনবেন যেন ভাবতে পারেননি নায়িকা, কিছু বলতে যাচ্ছিলেন রাগতভাবে। স্বপনের গলা শোনা গেল, রেডি! ক্যামেরা!

অন। আর একটি গলা ভেসে এল।

সাউন্ড?

ওকে!

অ্যাকশন।

কাকে চাই? নায়িকা স্বাভাবিক হতে পারেননি তখনও।

ভরত চেয়ে দেখল। এবং নিজের গালের দেওয়ালে জিভ ঠেকালো।

সেদিকে তাকিয়ে নায়িকা সংলাপ বলতে গিয়ে মাথা নেড়ে চোখ বন্ধ করলেন। স্বপনের গলা ভেসে এল, কাট। কাট। ওকে। ওয়ান্স মোর।

এবার ঠিকঠাক হল সব।

স্বপন বলল, ফাইন। মনিটার অন কর। সেট লাইট দাও।

বড় আলো নিভে গিয়ে অন্য আলো ছড়িয়ে পড়ল। সবাই মনিটারের সামনে জড়ো হয়েছে। ভরত এগোল না। একেই কি অভিনয় বলে? যে যত ভাল অভিনয় করবে তত সে নামি হবে? মিথ্যেটাকে সত্যি করতে হবে বিশ্বাসযোগ্য করে। ওপাশে নিজের গলা বাজছে কানে এল। শ্রাবণী লড়াই করছে জীবনের জন্যে। সুদেষ্ণা এখন অনেক নরম। সে যা করছে তাতে কৃতজ্ঞতা ভাব ছাড়া আর কোনও অনুভব নেই। কিন্তু কার জন্য। আমি যা নই তা হয়ে সবাইকে মোহিত করলে আমার পায়ে তলার জমি শক্ত হবে। এই চেষ্টাটা চারপাশের মানুষজন প্রতিদিন করে যাচ্ছে যা সে একসময় সহ্য করতে পারেনি।

হাততালি উঠল। নায়িকা এবং স্বপন এগিয়ে এল। নায়িকা বলেন, দারুণ, দারুণ হয়েছে। আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি। আপনি কি গ্রুপ থিয়েটারে করেন?

গ্রুপ থিয়েটার? ভরত হাসল। স্বপন চেঁচাল, নেক্সট শট।

আমি পাস করে গেলাম। ভরত মনে মনে বলল। অ্যাসেমব্লি অফ গড চার্চ হসপিটালের বিছানায় শুয়ে যে হারতে বসেছে, সে এটা জেনে যাবে না এটুকুই স্বস্তির।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top