What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected স্বনামধন্য - সমরেশ মজুমদার (2 Viewers)

অভিজিৎ জিজ্ঞাসা করল, অপারেশন করে ওটা সরানো যাবে না!

যাবে। কিন্তু ওই বাচ্চাকে অপারেট করা অসম্ভব ব্যাপার। ওই শরীর সেটা সহ্য করতে পারবে না। শরীরে কোনও শক্তি নেই রক্তাল্পতার জন্যে। কিন্তু এ অবস্থা চললে ও কালকের মধ্যেই মারা যাবে জেনে আজ রাত্রে ডক্টর দত্ত মরিয়া হয়ে অপারেশন করবেন। যদি সহ্য করতে পারে তাহলে বেঁচে যেতে পারে। তার সম্ভাবনা খুবই কম।

ওর মা ব্যাপারটা জনেন?

হ্যাঁ। ওর বাবা শোনার পর ওপরে উঠছেন না।

মন খুব খারাপ হয়ে গেল ওদের। নিচে নামতেই একজন এসে বলল ডক্টর দত্ত ডাকছেন। অভিজিতরা সঙ্গে এল। ডক্টর দত্ত তাদের বসতে বললেন। ওঁকে খুব বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। অভিজিতরা সঙ্গে এল। প্রথমে জানতে চাইলেন। শ্রাবণী পড়াশুনায় কীরকম?

ভরত মাথা নাড়ল, আমি ঠিক জানি না। তবে ভাল রেজাল্ট না হলে প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হওয়া যায় না। একথা জিজ্ঞাসা করছেন কেন?

ডক্টর দত্ত শব্দ করলেন ঠোঁট দিয়ে। খুব আফসোসে মানুষের মুখে এমন শব্দ বের হয়। তারপর বললেন, আমার সন্দেহটা ভুল হলে সবচেয়ে খুশি আমিই হতাম। কিন্তু আমাকে খুশি করার কোনো ইচ্ছে ভগবানের নেই। ওর রিপোর্ট পেয়েছি। তবে হাল ছেড়ে দেবার মতো। লিউকোমিয়া নয়। আমরা লড়তে পারব। তারপর তোমরা তো আছ। সহজে হার মানার কথাই ওঠে না।

অভিজিৎ ঝুঁকে পড়ল, ডাক্তারবাবু, আপনি যত রক্ত চান আমি এনে দেব। দরকার হলে অন্য কলেজের ছেলেমেয়েদের কাছে অ্যাপিল করব। একটু আগে আমরা একটা বাচ্চার মুখে মৃত্যুর ছায়া এসেছি। ওকে কি বাঁচানো যায় না?

কার কথা বলছ?

ওপরে রয়েছে বাচ্চাটা। হেমারেজ হওয়ার যার পায়খানা হচ্ছে না।

হঠাৎ ডক্টর দত্ত উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, দে কিলড হার। আমি পই পই করে বলে দিয়েছিলাম কীভাবে রক্ত দিতে হবে। ওরা সেটা গ্রাহ্য করেনি। এম বি বি এস করলেই ডাক্তার হওয়া যায় না। অভিজ্ঞতা না থাকলে সিনিয়ারদের কথা শুনতে হয়। এত কষ্ট করে বাচ্চাটাকে দাঁড় করিয়েছিলাম, ওরা অবহেলায় সেটা নষ্ট করল। হ্যাঁ, রাত নটায় আমি অপারেশন করব বলে। ঠিক করেছি। কিন্তু ওর যা অবস্থা পেট কাটামাত্র প্রাণ বেরিয়ে যেতে পারে। যদি সেটা নিশ্চিত বুঝতে পারি তাহলে আমি সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করব। হয়তো তার মধ্যেই ও চলে যাবে। যাওয়ার আগে খামোকা শরীর কাটাছেঁড়া করি কেন। ডক্টর দত্ত বললেন।

ভরত বলল, কিন্তু যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ কি আশা করা উচিত না। শুনেছি ডাক্তাররা রোগীর মৃত্যুর পরও অপেক্ষা করেন খানিকক্ষণ যদি প্রাণ ফিরে আসে।

ইয়েস মাই বয়। তাই করা উচিত। কিন্তু এক্ষেত্রে!–ডক্টর দত্ত উঠে দাঁড়ালেন। তাকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছিল, যা হোক শ্রাবণীকে এখন কতগুলো প্রসেসের মধ্যে যেতে হবে। ইটস রিয়েলি পেইনফুল। ওর শরীর কতটা রক্ত নিতে পারছে সেটা আগে দেখা যাক।

ওরা বেরিয়ে এল। নিচে ছেলেমেয়েরা অপেক্ষা করছিল। তখন সন্ধে হয়ে এসেছে। প্রত্যেকেরই বাড়ি ফেরার তাড়া। ভরত আবিষ্কার করল তার দিকে যাওয়ার কেউ নেই। এবং তখনই খেয়াল হল পকেটের কথা। একটা টাকাও নেই তার কাছে। টাকার কথা মনে পড়তেই প্রচণ্ড খিদে পেয়ে গেল। সেই সাতসকালে বাড়ি থেকে বের হবার আগে খেয়েছিল, গোটা দিনে খাওয়ার সুযোগ হয়নি, মনেও আসেনি। এলেও ট্যাক্সি ভাড়া দিয়ে দেবার পর খাবার কোনও উপায় ছিল না। পকেটে টাকা থাকলে খিদে পেলে সেটাকে উপেক্ষা করে কিছুক্ষণ সময় কাটানো যায় কিন্তু এখন টাকা নেই বলেই মনে হচ্ছে, না খেলে আর হাঁটতে পারবে না। জিভ শুকিয়ে আসছে। মাথা ঘুরছে অথচ ওইসব উপসর্গ খানিক আগে বিন্দুমাত্র ছিল না।
 
সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে সে ছুটন্ত গাড়ি দেখছিল। এখন পার্ক স্ট্রিট ধরে শুধুই গাড়ির মিছিল। এখন তাকে হেঁটে বাড়ি ফিরতে হবে। অন্তত পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা। বাড়িতে ফেরার পর খাওয়া। নিজের ওপর খুব রাগ হচ্ছিল। এখন। আজ সারাটা দিন তার কী ভাবে কাটল? শ্রাবণী যদি না পড়ে যেত, সে যদি ওকে হাসপাতাল এবং বাড়িতে না নিয়ে যেত তাহলে এখন এই সমস্যা হত না। কে শ্রাবণী? আজকের আগে তো সে মেয়েটাকে চিনতই না, সেই মেয়ের লিউকোমিয়া হয়েছে। বলে সারাদিন ধরে এত ছুটোছুটি করার কী দরকার ছিল? এইসব ভাবনা মাথায় আসায় যখন নিজের ওপর রাগটা বাড়ছিল, তখন ডক্টর দত্তর মুখ মনে এল। আর সেটা আসামাত্র কিরকম মিইয়ে গেল ভরত। মাথা নেড়ে সে রাস্তাটা পার হয়ে থানার সামনে চলে এল। খারাপ লাগা বোধটাকে ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করছিল সে। তখনই রবীনবাবুকে দেখতে পেল। থানা থেকে বেরিয়ে একটা অ্যাম্বাসাডারে উঠতে যেতেই ভরতের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল তার।

আরে, তুমি এখানে।

প্রথমে লোকটাকে দেখে বিরক্ত হয়েছিল ভরত কিন্তু দ্রুত সেটাকে কাটিয়ে উঠল সে, আপনি কি বাড়িতে যাচ্ছেন?

না। কেন? রবীনবাবু যেন বেশ অস্বস্তিতে পড়েছেন।

আমি একটু প্রব্লেমে পড়েছি।

তাই নাকি? পকেটমার হয়ে গেছে বোধহয়?

ভরত বেঁচে গেল। ভদ্রলোক কী করে বুঝলেন তার পকেটে টাকা নেই। সে অন্য ব্যাখ্যায় না গিয়ে নীরবে মাথা নাড়ল।

ভদ্রলোক পকেটে হাত দিয়ে একটু ভাবলেন, ঠিক আছে এসো। আমরা একটু চা খেয়ে বাড়ি ফিরব। কিংবা ড্রাইভারকে বলতে পারি তোমাকে ড্রপ করে দিয়ে আসতে। ওঠো।

ভদ্রলোক পেছনের সিটে উঠে পড়লেন। ভরত যেন বেঁচে গেল। ড্রাইভারের পাশের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে সে লক্ষ্য করল মধ্যবয়সিনী এক সুন্দরী মহিলা রবীনবাবুর পাশে বসে আছেন। রবীনবাবুকে বলতে শুনল, এর নাম ভরত। আমার মেয়ের টিচার। আমাদের বিল্ডিং-এই থাকে। ও হ্যাঁ, ওসি বললেন, তোমার কোনও চিন্তার কারণ নেই। আর ঝামেলা হবে না।

ওসিকে ইনভাইট করেছ?

দূর! চুনোপুঁটিকে খাইয়ে কী হবে। রাঘব বোয়ালদের একদিন বলতে হবে। তা পকেটমার কোথায় হল? ট্রামে না বাসে?

প্রশ্নটা যে তাকেই করছেন বুঝতে সামান্য দেরি হল। সঙ্গে সঙ্গে একটু ঝুঁকে রবীনবাবু বললেন, আরে, কী ভাবছ বলো তো! কত গেছে?

বেশি নয়। ভরত সামলে নিল।

সাবধানে চলাফেরা করবে তো! টাকা হাতাবার জন্যে পাঁচ পাবলিক মুখিয়ে আছে। এই দ্যাখো, সারাদিন শ্রমিকদের নিয়ে কারবার আমার, কম সাবধানে থাকতে হয়। রক্ত জল করে টাকা রোজগার করতে হয় হে। ড্রাইভার, বাঁদিকে ঢাক। হ্যাঁ, আর একটু।

একটা বার কাম রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়িটা দাঁড়াল। ওঁরা নামছিলেন, ভরত মুখ ঘুরিয়ে বলল, আমি না হয় চলে যাই।

আরে যাবে তো বটেই। একটু চা খেয়ে যাও। সেদিন তোমার সঙ্গে একটু ঝামেলা হয়ে গিয়েছিল। এসো। ওরা এগিয়ে যেতে বাধ্য হতে নামল ভরত।
 
স্বপ্নলোকের এই স্বপ্নপুরীতে রবীনবাবু যে বেশ পরিচিত তা আপ্যায়নে বোঝা গেল। ভর সন্ধেবেলায় টেবিলে মদ্যপান শুরু হয়ে গিয়েছে। আরামদায়ক চেয়ারে বসে রবীনবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, চায়ের সঙ্গে কী খাবে বলো?

আমার কোনো পছন্দ নেই। ভরতের বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল। এই ভদ্রলোক তাকে বলেছিলেন ব্রোকেন ফ্যামিলির ছেলে জানলে তাকে বাড়িতে ঢোকাতেন না।

একটা চা আর দুটো চিকেন স্যান্ডউইচের অর্ডার দিলেন রবীনবাবু। তারপর বললেন, আজ থানায় গিয়েছিলাম এঁর জন্যে। ক্যামাক স্ট্রিটে ওঁর কারখানায় ঝামেলা হচ্ছে। ঠিক শ্রমিক বিক্ষোভ বলা যাবে না, যাবে? প্রশ্নটি মহিলাকে।

মহিলা হেসে উঠলেন, কিন্তু কোনো কথা বললেন না।

খাবার এল। ভরত দেখল চা এসেছে তা তার একার জন্যেই। অর্থাৎ ওঁরা এসব খাবেন না। যত চটপট পারে সে খাবার শেষ করল। এবং ওই মুহূর্তে মনে হল খিদের সময় স্যান্ডউইচ ট্যান্ডউইচকে খাবার হিসেবে ধরা উচিত নয়। হঠাৎ রবীনবাবু পার্স বের করে তিনটে দশ টাকার। নোট তুলে ধরলেন, এগুলো রাখো। ট্যাক্সি নিয়ে চলে যাও।

ভরত একটু ইতস্তত করে টাকাগুলো নিয়ে বলল, আমি আজই ফেরত দিয়ে দেব।

নো। কখনই না। আমি তোমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। আমি চাই তুমি আমার মেয়েকে পড়াও এমনি নিতে সম্মানে বাধলে এটাকে অ্যাডভান্স হিসেবে নিতে পার।

আপনি আবার আমাকে বাড়িতে ঢুকিয়ে বিপদ ডাকবেন?

অ্যাঁ? ওহো। তোমার স্মরণশক্তি দেখছি জব্বর। যাক গে। তুমি আমার একটা উপকার করো। যাওয়ার সময় বাড়িতে বলে যেও ওদের খাওয়া-দাওয়া করে নিতে। মিটিং সেরে ফিরতে একটু দেরি হয়ে যাবে আজ। বলে দাও। ভরতের দিকে এমনভাবে হাত নাড়ালেন রবীনবাবু তাকে বোঝা গেল চলে যেতে বলছেন এবং একই সঙ্গে বেয়ারাকে ইশারা করলেন অর্ডার নিয়ে যেতে।

অন্যদিন হলে বাসে বাড়ি ফিরে ভরত। আজ ইচ্ছে করে ট্যাক্সি নিল। যতক্ষণ মিটারে কুড়িটাকা আটআনা না উঠল ততক্ষণ সে এ রাস্তা সে রাস্তায় ঘুরল। পুরো তিরিশ টাকা ড্রাইভারের হাতে তুলে দিয়ে ভরতের বেশ আনন্দ হল।

লিফটে ঢুকে প্রথমে নিজেদের ফ্লোরের বোতাম টিপেছিল সে তারপর মনে পড়তে দ্বিতীয় বোতাম টিপল। লিফট থেকে নেমে হঠাৎ তার মনে হল পারমিতার যদি শ্রাবণীর মতো লিউকোমিয়া হয় তাহলে সে কি ওর ওপর রাগ করতে পারবে? এতদিন ওর কথা ভাবতেই মনে হত নিতম্বপক্ক মেয়ে কিন্তু লিউকোমিয়া শব্দটি মনে আসার পর আর সেটা মনে এল না। কিরকম দুঃখ দুঃখ ভাব এল। ভরত বোতাম টিপল।
 
দ্বিতীয়বারের পর পারমিতা দরজা খুলল। খুব অবাক হয়ে বলল, তুমি? ভরত অবাক হল। এই মেয়েটা তাকে শেষ বার বলেছিল, আমি আপনাকে আই লাভ ইউ বলতে পারি? আর আজ স্বচ্ছন্দে তুমি বলছে।

কী করছ? ভরত ইচ্ছে করেই জিজ্ঞাসা করল।

আমি? কিচ্ছু না।

ভেতরে যেতে বলবে না?

বাবা কিন্তু এখনই আসবে।

আসুক না। ভরত মেয়েটির পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকল।

বাবা এলে খুব রাগ করবে।

করবেন না। ওঁর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। ভরত হাসল, আমার খুব খিদে পেয়েছে। তুমি কিছু খাওয়াতে পার?

এখানে বসো। আমি মাকে বলি। পারমিতা ভেতরে চলে গেল।

ভরত বসল না। সে এপাশ ওপাশ দেখতে দেখতে পারমিতার ঘরের দরজায় আসতেই একটি ছেলেকে দেখতে পেল। বছর বাইশের রোগা জিনস্ পরা ছোকরা, মাথায় অমিতাভ বচ্চনের মত চুল, তার দিকে বোকা বোকা চোখে তাকাচ্ছে।

তুমি কে ভাই? ভরত হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করল।

ছেলেটিই উঠে দাঁড়াল, আমি, আমি, এখানেই থাকি৷

এ বাড়িতেই?

না, না। সামনের ফ্ল্যাটবাড়িতে। আমি আসছি।

আরে! যাচ্ছ কেন? আমি তো তোমাকে চলে যেতে বলিনি। তুমি নিশ্চয়ই পারমিতার বন্ধু?

না মানে, ওই রকমই।

চুমু-টুমু খেয়েছ?

না, বিশ্বাস করুন, আমি আজ প্রথম এলাম, কিছুই করিনি। আমি এলাম। ছেলেটা প্রায় ঊর্ধ্বশ্বাসে বেরিয়ে গেল। বাইরের দরজায় শব্দ হলো। ভরত দেখল পারমিতা এসে দাঁড়িয়ে আছে। ওর মুখ খুব শক্ত, চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক নয়।

ভরত হেসে ফেলল, অসময়ে এসে তোমার খুব অসুবিধে করলাম?

পারমিতা কোনো জবাব দিল না, একই ভাবে দাঁড়িয়ে রইল।

চেয়ারে বসল ভরত, তোমার বাবা আমাকে খুব ভাল চা আর স্যান্ডইউচ খাইয়ে বলেছেন তোমাকে আবার পড়াতে। অতএব আমার ওপর রাগ করে লাভ নেই।

আমি তোমার কাছে পড়ব না।

কেন?

আমার ইচ্ছে নয়, তাই।

ঠিক আছে, আমি তোমাকে আর বকব না, অসময়ে এসে তোমাকে এমন জব্দ করব না। তুমি তোমার বয়ফ্রেন্ডদের সঙ্গে দিব্যি আড্ডা মারতে পারবে। ঠিক আছে?

ও আমার বয়ফ্রেন্ড নয়।

তাহলে কী? তুমি সম্পর্ক নেই এমন ছেলেকে এই নির্জন ঘরে ডেকে নিয়ে এসেছ জানলে তোমার বাবা খুশি হবেন?

বাবা জানতে পারত না।

কিন্তু একটু আগে তুমি বললে তোমার বাবার আসার কথা ছিল।

বাবা এলেই এঘরে আসে না। বাথরুমে গেলে ও চলে যেত।

তার মানে তুমি চাও না তোমার বাবা ওকে দেখুক। সম্পর্কটা কী?

কোনও সম্পর্ক নেই। ইশারা করত, আসতে বললাম। আমার খুব একা লাগে তাই। ও আমার হাত ধরেছিল, ওই অবধি, কাল থেকে আর পাত্তা দিতাম না।

ছেলেটার তাতে খুব কষ্ট হতে পারে, ওভাবে তুমি ওকে বিট্রে করেছ।

আমার তাকে কী! আমি তো আগ বাড়িয়ে ওকে ডাকিনি, পারমিতা ঠোঁট টিপল, আশা করি বাবাকে এসব বলা হবে না। বলেই বেরিয়ে গেল।
 
ভরত টেবিলের একপাশে রাখা বইগুলো দেখতে লাগল। সবই প্রেমের উপন্যাস। খুব নামকরা কোনও লেখকের নয়, হঠাৎ হঠাৎ বেস্ট সেলার হওয়া এক একটা উপন্যাস যার পাতায় পাতায় দাগ দেওয়া। পারমিতা ফিরে এল টোস্ট আর ওমলেট নিয়ে। টেবিলে রেখে জিজ্ঞাসা করল, চা না কফি?

ওসব কিছু লাগবে না।

খাওয়া শেষ করে ভরত জিজ্ঞাসা করল, তোমার মা কোথায়?

নিজের ঘরে বসে টি ভি দেখছে।

তোমার সম্পর্কে কোনও খবর রাখে না।

টাইফয়েডের পর থেকে মা আর কিছু পারে না।

শোনো, তোমার বাবার ফিরতে দেরি হবে। উনি একজন মহিলার সঙ্গে মিটিং করছেন। আমি এখন যাচ্ছি। ভরত পা বাড়াল।

পারমিতা চট করে সামনে এসে দাঁড়াল, রাগ করেছ?

কেন?

বিশ্বাস করো, ওই ছেলেটার সঙ্গে আমি কিছু করিনি।

বিশ্বাস করলাম।

তাহলে চলে যাচ্ছ কেন? আমি না তোমাকে বুঝতে পারি না। তুমি অন্য সব ছেলেদের মতো নও। আই লাভ ইউ। পারমিতা দুহাত বাড়িয়ে হিন্দি সিনেমার নায়িকার মতো ভরতের কাঁধ ধরে হাসল

আমি তো চাকরি করি না, রোজগার নেই, তোমাকে বিয়ে করতে পারব না।

ধ্যুৎ। বিয়ের কথা কে বলেছে। জাস্ট বলো, আই লাভ ইউ!

সঙ্গে সঙ্গে পারমিতা তাকে চুমু খেল। ছোঁ মেরে নিয়ে যাওয়া চিলের তৎপরতার কাছে হার স্বীকার করতে হল ভরতকে, মুখ সরাতে পারল না। কিন্তু ঠোঁটের স্পর্শ পাওয়া মাত্র ভরতের শরীর গুলিয়ে উঠল। কি রকম একটা কষা স্বাদ, গন্ধটাও সুবিধের নয়। চুমু খেলে যদি এরকম অনুভূতি হয় তাহলে লোকে চুমু খায় কেন? পারমিতা তখন হাসছিল, কি রকম চোর চোর দেখাচ্ছে প্রথম? তুমি এর আগে কখনও কারও কাছে চুমু পাওনি?

না। এই প্রথম আর এই শেষ।

তার মানে? পারমিতা হতভম্ব।

তুমি আর কখনও আমার সঙ্গে এসব করবে না।

সে কি প্রেম করলে এসব না করে থাকা যায় না।

তাহলে প্রেম করবে না। ভরত রুমাল বের করে ঠোঁট মুছল।

তুমি ইয়ার্কি মারছ!

আমি সিরিয়াসলি বলছি। চললাম।

ভরত যখন দরজার কাছে তখন পেছন থেকে পারমিতা ডাকল, শোনো, তুমি আর কখনও এবাড়িতে আসবে না আর আমি কার সঙ্গে কি করছি তা নিয়ে ভাববেও না। যাও।

মা দরজা খুলে জিজ্ঞাসা করল, লাইব্রেরিতে ছিলি?

না। পাশ কাটিয়ে ভেতরে চলে এল ভরত। সোজা বাথরুমে গিয়ে পেস্টব্রাশে নিয়ে দাঁত মাজতে লাগল। মা এগিয়ে এসে অবাক গলায় জানতে চাইল, একি রে! এখন ব্রাশ করছিস?

একটু বেশি খাওয়া হয়ে গেছে।

কোথায়?

জবাব না দিয়ে মুখ ধুয়ে নিল ভরত। পেস্টের গন্ধে সেই অনুভূতিটা উধাও হয়ে গেছে। তোয়ালেতে মুখ মুখ মুছে বেরিয়ে এল ভরত, তুমি এত তাড়াতাড়ি?

তাড়াতাড়ি কোথায়? এই সময় তো রোজ আসি। তোর জন্যে পেস্ট্রি এনেছিলাম তুলে রাখি, মনে হচ্ছে খাবি না। মা কিচেনের দিকে চলে গেলেন। তারপরই মনে পড়ে যেতে বললে, সুদেষ্ণা ফোন করেছিল একটু আগে।

কী বলল?

তুই নেই জেনে ফোন রেখে দিল।

অ।

ওইভাবে বললি কেন?

কী ভাবে বললাম? ওর সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই, খামোকা কেন যে ফোন করে। ভরত নিজের ঘরে চলে এল।
 
পোশাক পাল্টে পরিষ্কার হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল সে। খুব টায়ার্ড লাগছে এখন। সকাল থেকে খুব টেনশন এবং ছোটাছুটি করতে হয়েছে। শ্রাবণী বাঁচবে কি না তা একমাত্র ঈশ্বরই বলতে পারেন। ওই অসুখ হলে মানুষ এখনও কোনও আশা করতে পারে না অথচ ডক্টর দত্ত করছেন। ডক্টর দত্তের মুখ মনে আসতেই অদ্ভুত আরাম এল। এমন মানুষ পৃথিবীতে আছেন তা সে জানত না। প্রতিদিন খবরের কাগজে ডাক্তারদের অবহেলার কাহিনি পড়ে পড়ে যে ধারণা তৈরি হয়েছিল, শুধু তাই কেন, প্রতিষ্ঠত নামী ডাক্তারদের যে প্রফেশনাল আচারণ আজ স্বাভাবিক তার বিপরীত মেরুতে এখনও আছেন ডক্টর দত্ত। ওঁকে দেখে ভাল হতে, ভাল থাকতে ইচ্ছে করে। চারপাশের অবিরত অসাধুতা ওঁকে কি স্পর্শ করে না? নাকি ওঁরও অন্য রূপ আছে? মাদার টেরেসার যে ভাবমূতির ভারতীয়দের কাছে আছে তা ঈশ্বরের বিকল্প। কিন্তু বি বি সি ওঁর সম্পর্কে যে নোংরা ছুঁড়েছে তার বিরুদ্ধে পৃথিবীব্যাপী প্রতিবাদ হচ্ছে না কেন? মাদার নিজে করবেন না, সেটাই স্বাভাবিক, এখনও কলকাতায় প্রতিবাদ জানিয়ে একটাও মিছিল বের হলো না। তখনই অস্বস্তি আসে।

ভরতের মনে হলো শ্রাবণীকে বাঁচাতেই হবে। যে মেয়েকে আজ সকালের আগে সে দ্যাখেনি তার জন্যে মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগল। শ্রাবণী সুদেষ্ণা বা পারমিতা নয়, রোগা শ্যামলা বাংলাদেশের একটা সাধারণ মেয়ে। কিন্তু ভরত ক্রমশ ওর জন্যে টান অনুভব করতে লাগল। সে চোখ বন্ধ করে ভাবল হঠাৎ তার নিজের রক্তে যদি লোহিতকণিকা কমে যেতে থাকে, যদি শ্বেতকণিকারা দেহ-অধিকার তৎপর হয় তাহলে? এসব হওয়ার আগে সে কিছুই জানতে পারবে না, হওয়া শুরু হলে কিছুই করার থাকবে না। নিজের শরীর অথচ নিজেরই অজানা।

ঘুমিয়ে পড়েছিল ভরত, বেল বাজাতে চোখ খুলল কিন্তু বিছানা ছাড়ল না।

একটু বাদেই মা দরজা খুলল, বাবার গলা পাওয়া গেল, খাব না।

তখনও দরজা বন্ধ হয়নি, মা জানতে চাইল, ফোনে বলোনি কেন?

বাবার গলা স্বাভাবিক নয়, একদিন না খেলে খাবার নষ্ট হবে না, ফ্রিজ আছে। আর যদি হয়েও যায় তাহলে এমন কিছু অপরাধ হবে না।

তুমি এত ড্রিঙ্ক করে এসেছ কেন?

করলাম। গুডনাইট। তু

মি এভাবে আমার সঙ্গে কথা বলতে পার না।

উঃ। আবার আরম্ভ হলো। এ বাড়িতে একটুও শান্তি নেই।

আরম্ভ আমি করলাম? আমি জানি তোমার পক্ষে এই অভিনয় বেশিদিন চালানো মুশকিল। আমি এইদিনটার অপেক্ষায় ছিলাম। পায়ের শব্দে মনে হল মা নিজের ঘরে দৌড়ে চলে গেল। বাবার কোনও আওয়াজ পাচ্ছিল না ভরত। সে বিছানা থেকে উঠল না। ঘড়িতে এখন দশটা বাজতে সাত। ফেরার পক্ষে এমন কিছু রাত হয়নি। তবে ইদানীং তারা তিনজন সাড়ে নটায় ডিনারটেবিলে বসছিল। আজ বাবার দেরি হচ্ছে দেখে মা নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছিল বলে তাকে ডাকেনি। কিন্তু আজকের ঘটনাটা কী ঘটল? বাবা রাত দশটার মধ্যে ড্রিঙ্ক করে বাড়িতে এসে জানিয়েছে যে ডিনার খাবে না। শোনামাত্র মা খুব অপমানিত বোধ করে একেবারে সম্পর্কের যেসব ক্ষত এতদিন চাপা ছিল তার গায়ে হাত রাখল। এভাবে দেখলে বাবার দোষটা কিছুতেই খুব মারাত্মক নয়। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে বাবা একদিন একটু বেশি খেতেই পারে এবং খাওয়ার পর ডিনারে ইচ্ছে নাও থাকতে পারে। অতএব দোষের পাল্লাটা মায়ের দিকেই ভারী হচ্ছে। আবার আজকের ঘটনাটা যদি এভাবে দেখা যায়, মা ভালমন্দ বেঁধে বাবার জন্যে অপেক্ষা করছিল। বেশ কয়েক মাস বাবা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরে। ড্রিঙ্ক করে বাড়িতেই এবং সাড়ে নটায় হাসিমুখে খেতে বসে। মায়ের মন সেভাবেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ কোনো নোটিস না দিয়ে নিয়ম। ভেঙে বাড়ি ফেরার কারণ মা জানতে চাইতেই পারে। দুঃখ প্রকাশ না করে নিজের কাজের সাফাই গেয়েছে বাবা। মায়ের প্রশ্ন শুনে ধৈর্য হারিয়ে মূল জায়গায় ধাক্কা দিয়েছে, এ বাড়িতে শান্তি নেই। এবং এই শব্দগুলো মাকে অপমান করার পক্ষে যথেষ্ট। এই ব্যাখায় দোষের পাল্লা বাবার দিকেই ভারী, সমর্থন মা-ই পাবে।

অর্থাৎ একই ঘটনা যে যেমন ভাবে ব্যাখ্যা করবে সে তেমনভাবে সাজাতে পারে। কিন্তু তারপর কী হবে? মা বাবা কি আবার সেই আগের সম্পর্কহীনতায় ফিরে যাবে? ভরত উঠল। ঘর থেকে বেরিয়ে দেখল ডাইনিং কাম ড্রাইং রুমে কেউ নেই, আলো জ্বলছে। সে মায়ের দরজায় গিয়ে বলল, খাবার দেবে না?
 
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মা বেরিয়ে এল। মুখ থমথমে, বুঝতে অসুবিধে হয় না যে চোখের জল ঘর থেকে বেরুবার আগে মুছে নিয়েছে। চেয়ার টেনে ভরত বসতেই খাবার এগিয়ে দিতে লাগল মা। ভরত জিজ্ঞাসা করল, তুমি খাবে না?

মা জবাব দিল না।

কি হল? বসো। বাবা না হয় খেয়ে এসেছে, তুমি তো খাওনি। বসো।

মা ওর মুখের দিকে তাকাল। তারপর প্রতিবাদ করবে না বলেই চেয়ার টেনে বসে পড়ল।

ভরতের ইচ্ছে করছিল অনেক কথা বলতে। কিন্তু কোনও কথাই বলতে পারল না। যে দুটি মানুষ তাকে জন্ম দিয়েছে, তিলতিল করে বড় করেছে তাদের নিজস্ব সম্পর্ক নিয়ে কথা বলতে গেলে যেসব বাঁধ ভেঙে যাবে তা কখনই তার পক্ষে শোভনীয় নয়। সে দেখল যতটুকু না খেলে নয় ঠিক ততটুকুই মা খেল।

খাওয়া শেষ হতেই টেলিফোন বাজল। ভরত উঠে রিসিভার তুলল, হ্যালো।

ওপাশে সুদেষ্ণার গলা, সরি, একটু অসময়ে ফোন করছি। আমি সন্ধের সময় ফোন করেছিলাম, তখন তুমি বাড়িতে ছিলে না।

কী ব্যাপার? ভরত দেখল মা তাকিয়ে আছে। সে রিসিভারে হাত চাপা না দিয়েই বলল, সুদেষ্ণা!

কেউ আছে? সুদেষ্ণা জানতে চাইল।

মা। বলো।

আজ কী হয়েছিল কলেজে? আমি যেতে পারিনি নাচের প্রোগ্রাম ছিল, পরে শুনলাম।

তাহলে তো শুনেছই।

ডিটেলস শুনতে পাইনি। মেয়েটিকে তুমি চেন?

আগে চিনতাম না। কলেজে খুব আটপৌরে চেহারার অনেক মেয়ে পড়ে, তারা সচরাচর চেনার মতো কোনো কাজ করে না।

তুমি কি আমাকে ইঙ্গিত করছ?

না। মেয়েটি অসুস্থ হয়ে পড়ায় আমরা হাসপাতালে নিয়ে গেছি। শুনলাম রক্ত দিয়েছে অনেকে!

হ্যাঁ। ওর রক্ত দরকার।

কী অসুখ?

লিউকোমিয়া।

সর্বনাশ।

হ্যাঁ। এটা ওই মেয়েটির না হয়ে কারো হতে পারত। আমার খুব ভাল লেগেছে শোনামাত্র ছেলেমেয়েরা এগিয়ে এসেছে রক্ত দিয়ে ওকে বাঁচাতে।

কিন্তু লিউকোমিয়া হলে মানুষ কি বাঁচে?

যে ডাক্তার দেখছেন তিনি চেষ্টা করবেন বলেছেন। আর কেউ নাও বাঁচতে পারে ভেবে কি আমরা সাহায্য করব না। ধরো, তোমার যদি লিউকোমিয়া হত তাহলে কি সবাই হাত গুটিয়ে বসে থাকত?

আমি কি এক্ষেত্রে কিছু করতে পারি?

কাল অ্যাসেমব্লি অফ গড চার্চ হসপিটালে গিয়ে ডক্টর দত্তর সঙ্গে দেখা করে বলল যে শ্রাবণীকে সাহায্য করতে চাও, উনি কী করতে হবে বলে দেবেন। গুড নাইট। রিসিভার নামিয়ে রাখল ভরত।

মা শুনছিল কথাগুলো। জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে রে?

ভরত অল্প কথায় ঘটনাগুলো বলল। শুনতে শুনতে মায়ের মুখে কালো ছায়া নামল। বাবার সঙ্গে ঘটনাটা ঘটার পর যে অন্ধকার ছিল মায়ের মুখে এখনকার অভিব্যক্তি তার থেকে আলাদা। অদ্ভুত গলায় জিজ্ঞাসা করল, ওর বাবা নেই?

না। বিধবা মা-ই সব।

তাহলে চিকিৎসা হবে কী করে?

রক্তের জন্যে আমরা আছি আর ওষুধপত্রের দায়িত্ব ডক্টর দত্ত নিয়েছেন।

ভদ্রলোককে আমার দেখতে ইচ্ছে করছে। কি মানুষ! মা বলল, দেখিস, এই মেয়ে ঠিক বেঁচে যাবে। তোরা এতজন রক্ত দিতে গিয়েছিলি, বৃথা যাবে না।

হঠাৎই ভরতের মনে হল মায়ের মনটা এখন অন্যরকম হয়ে গিয়েছে। বাবার সঙ্গে ঘটনাটা ঘটার পর যে পাথর চেপেছিল ওখানে, তা শ্রাবণীর কাহিনি শোনার পর যেন আপাতত অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। শ্রাবণীর অসুখ মায়ের ওপর এই মুহূর্তে যে কাজ করল তা মা নিজেই কখনও জানবে না।
 
তিনদিন ধরে ক্রমাগত দলবেঁধে ছেলেমেয়েরা রক্ত দিয়ে এল। শ্রাবণীর ব্লিডিং বন্ধ হয়েছে। ডক্টর দত্ত বলছেন যতদিন ওর হিমোগ্লোবিন একটা স্টেডি জায়গায় না আসছে ততদিন উনি ওকে ছাড়বেন না। বিছানায় শুয়ে শ্রাবণী একটু-আধটু কথা বলতে পারছে। ওর মা দুবেলা আসেন মেয়ের কাছে। তৃতীয় দিনের বিকেলে ভরত ঢুকতেই বেডের পাশে বসা শ্রাবণীর মা বললেন, এই হল ভরত।

শ্রাবণী মুখ ফিরিয়ে তাকাল। শীর্ণমুখ, কোটরে বসা বড় বড় চোখ, চুল দুই বিনুনিতে বাঁধা। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল।

ভরত হাসল, এখন কেমন আছ?

শ্রাবণী জবাব দিল না। ওর ঠোঁটে একটা হাসি আলতো এল। এত বিবর্ণ হাসি ভরত কখনও দ্যখেনি। শ্রাবণীর মা বললেন, ওকে সব কথা বলেছি। তুমি যা করেছ তার ঋণ শোধ করার ক্ষমতা আমার নেই।

আমি কিছুই করিনি মাসিমা। শ্রাবণী আমাদের কলেজে পড়ে। আলাপ থাকলে বন্ধুই হতো। এখন তো তাই হয়ে গিয়েছে। এখন আর ব্লাড দিচ্ছে না?

নার্স বলল রাত্রে দেবে। ডাক্তারবাবু এসে দেখে যাবেন একটু পরে। বসোনা। মাসিমার কথায় ভরত বসল দ্বিতীয় টুলে।

শ্রাবণী জিজ্ঞাসা করল, আপনি কোন ইয়ারে পড়েন?

ভরত মাথা নাড়াল, আপনি-টাপনি না। তুমি বলবে। আমরা এক কলেজে পড়ি সেটাই শেষ কথা। ইয়ার-টিয়ারের কথা বলে ভাগাভাগির কী দরকার। আর সবাই এসেছিল তোমার কাছে?

সকালে এসেছিল। তখন ও ঘুমোচ্ছিল বলে নার্স দেখা করতে দেয়নি। শ্রাবণীর মা বললেন, এখন মনে হচ্ছে এই ডাক্তারবাবুর কাছে আমাদের অনেক আগে আসা উচিত ছিল। উনি তোমাকে

কী বলেছিলেন?

কোনো বিপদ নেই, শ্রাবণী ভাল হয়ে যাবে। ভরত জানাল।

শ্রাবণী আবার সেই হাসি হাসল।

তুমি হাসলে কেন? ভরত জিজ্ঞাসা করল।

লিউকোমিয়া কখনও ভাল হয়? শ্রাবণী বিষণ্ণ গলায় জিজ্ঞাসা করল।

খুব অবাক হয়ে গেল ভরত। শ্রাবণী রোগের নামটা জানল কী করে? ওর মা এত বড় ভুলটা করলেন? মেয়েকে না জানালে হত না?

তোমার লিউকোমিয়া হয়েছে কে বলল?

আমি জানি।

ভুল জানতে পারো তো?

আমি ডক্টর দত্তকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। উনি স্বীকার করেছেন। অবশ্য বলেছেন যে ধরনের লিউকোমিয়া ফ্যাটাল তা নাকি আমার হয়নি। উনি নিশ্চিত যে আমি যদি ওঁর কথা শুনি তাহলে আবার পড়াশুনা করতে পারব।

তাহলে? তুমি ওঁর কথা শুনবে তো?

হাসল শ্রাবণী, বাঁচতে আমার খুব ইচ্ছে যে।

শ্রাবণীর মা ওর কপালে হাত বোলাতে লাগলেন। ভরত একটু ঝুঁকে বিছানার পাশে নেতিয়ে পড়ে থাকা শ্রাবণীর প্রায় সাদা আঙুলগুলো ধরল, তুমি আবার কলেজে যাবে। আমরা তোমার বন্ধু, তোমার পাশে আছি।

শ্রাবণীর আঙুলগুলো সামান্য নড়ে ভরতকে ছুঁলো। ভরত একটু অপেক্ষা করে যখন বুঝল মেয়েটার শরীরে কোনও শক্তি নেই তখন হাত সরিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল, মাসিমা, আপনি কি এখনই ফিরবেন?

ছটা বেজে গেলে ডাক্তারবাবু আসবেন, তারপর।

একা যেতে অসুবিধা হয় না?

আমি মল্লিকবাজার থেকে ট্রামে উঠি।

ভরত বলল, যাই শ্রাবণী। তারপর হাঁটতে যেতেই কানে এল, আসবে। ঘাড় নাড়ল। করিডোর পেরিয়ে নিচে নেমে জানতে পারল ডক্টর দত্ত তখনও আসেননি। হঠাৎ ওর খেয়াল হল সেই বাচ্চাটার কথা যার অপারেশন অনিবার্য ছিল। সে চটপট ওপরে উঠতে সিঁড়িতেই সেই নার্সের মুখোমুখি হল যাঁর কাছে ঘটনাটা শুনেছিল। ভরতকে মহিলা প্রথম চিনতে পারেননি। ভরত তাকে মনে করিয়ে দিতে মাথা নাড়লেন মহিলা, অপারেশন করা যায়নি, টেবিলে নিয়ে যাওয়ার আগেই–।
 
ভরত চোখবন্ধ করল। তারপর দ্রুত নেমে এল নিচে। পার্কস্ট্রিটে দাঁড়িয়ে ওর মনে হল দুর্বল মানুষেরা কার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে? ধান্দাবাজ অর্থলোভী কিছু মানুষ না ঈশ্বরের বিরুদ্ধে? কেন ভদ্রলোক এত খামখেয়ালি? মানুষ যদি ভগবানের স্রষ্টা হয়ে থাকে তাহলে সেই মানুষদের ওপর ভগবানের বিন্দুমাত্র কৃতজ্ঞতা নেই কেন? ঠিক তখনই সে ডক্টর দত্তকে দেখতে পেল। পার্কস্ট্রিট থেকে হসপিটালের গলিতে তার গাড়ি ঢুকছে। পেছনের সিটে মাথা এলিয়ে চুপচাপ বসে আছেন। তার মনে হল এইসব মানুষ আছেন বলেই ভগবান মাঝে মাঝে জব্দ হন।

প্রায় আড়াই মাস পরে ডক্টর দত্ত শ্রাবণীকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। সেই সঙ্গে পই পই করে তাকে কি করতে হবে বা না হবে সেই নির্দেশগুলো মনে রাখতে বললেন। একমাস পরে শ্রাবণীকে আবার আসতে হবে হাসপাতালে। ওর শরীর এর মধ্যে সামান্য গোলমাল করলেই যেন ডক্টর দত্তকে টেলিফোন করা হয়। রিলিজ হবার আগের বিকেলে শ্রাবণীর মা ভরতকে আলাদা ডেকে বললেন, আমি ডাক্তারবাবুকে শ্রাবণীর সামনে ছাড়া পাচ্ছি না, উনি। এত ব্যস্ত, কয়েকটা কথা যে জিজ্ঞাসা করা দরকার।

আপনি কি আমাকে বলছেন ওঁকে জিজ্ঞাসা করতে?

তুমি জিজ্ঞাসা করলে কি ভাল দেখাবে?

তাহলে চলুন, যত ভিড় থাকুক আমি ওঁকে বলব।

ছটা বেজে গেলে সে মাসিমাকে নিয়ে নিচে নামল। আজ শ্রাবণী বেশ ভাল। হেঁটে করিডোরে পর্যন্ত এল। সামান্য মোটা হয়েছে ফ্যাকাশে ভাবটাও নেই। হেসে বলেছিল, তোমাদের রক্ত আমার শরীরে। আমার নিজস্ব বলে কিছু রইল না।

ভরত বলেছিল, নিজস্ব নিয়ে খুব ভুগলে, এখন তা নিয়ে আফসোস কেন?

শ্রাবণী বলেছিল আফসোস কোথায়? এ তো আনন্দ।

ডক্টর দত্তের চেম্বারে বেজায় ভিড়। বাইরেও লোক দাঁড়িয়ে আছে। সাধারণত এমন ভিড় সকালেই হয়। মানুষজনকে কাটিয়ে ঢুকতে ঢুকতে ভরত শুনল, আগামীকাল একটি বেড খালি হবার কথা অথচ দুজন পেশেন্টকে ভর্তি না করলেই নয়। কি যে করি। বলতে বলতে মুখ ফিরিয়ে ভরতকে দেখে বললেন, কী ব্যাপার?

শ্রাবণীর মা আপনার কাছে কিছু জানতে চাইছেন।

আনো।

মাসিমাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল আবার ভরত। সে প্রথম দিন থেকেই লক্ষ্য করছে অন্য ডাক্তারদের মত ডক্টর দত্তের চেম্বারের বাইরে বেয়ারা জাতীয় কোনও পাহারাদার নেই। যে কেউ সহজেই ঢুকে যেতে পারে। এটা ঠিক না বেঠিক তা সে বুঝতে পারেনি। আজ মনে হলো এতে তাদের সুবিধে হয়েছে। ডক্টর দত্ত বললেন, বলুন মা!

মাসিমা অন্য মানুষদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আর কোনও ভয় নেই তো?

ডক্টর দত্ত মাথা নাড়লেন, কোনো গ্যারান্টি নেই। তবে যদি আমার কথা শুনে চলে তাহলে খারাপ হবার সম্ভাবনা কম। একবার কারও হার্ট জখম হয়ে গেলে কেউ বলতে পারে কখনও আর সেটা হবে না? এও সেরকম।

মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু ভাবব না?

ভাববেন না কেন? ও পড়াশুনা করুক, নিজের পায়ে দাঁড়াক। তবে এখনই যেন কোনও চাপের মধ্যে না যায়। বলতে বলতে ডক্টর দত্তের চোখ ছোট হয়ে এল, আপনি কি ওর বিয়ে থার কথা ভাবছেন?

মাসীমা বললেন, ও ছাড়া আমার কেউ নেই। আমার বয়স হয়েছে। চিন্তা হয়।

নো। নেভার। এখনই ওসব নিয়ে ভাববেন না। তাছাড়া একটা মেয়ে পড়াশুনা করবে, নিজের পায়ে দাঁড়াবে, এটা না চেয়ে তাকে বিয়ে দিয়ে সংসারের জাঁতাকলে জুড়ে দেওয়ার অভ্যেস বাঙালি বাবা-মায়ের কবে যাবে বলতে পারেন? আমি তো বলি যেসব বাপ-মা মেয়েকে অল্প বয়সে বিয়ে দিতে চায় তাকে দাঁড়াবার সুযোগ না দিয়ে তারা এসকেপিস্ট, স্বার্থপর। মেয়ে তাদের দায়, বিয়ে দিয়ে কাঁধ থেকে সেই দায় নামাতে চায়। তাছাড়া বিয়ে দেবেন কার সঙ্গে? আপনার মেয়ের লিউকোমিয়া হয়েছিল জানলে কোনো বঙ্গসন্তান ওকে বিয়ে করতে আসবে? আছে কারও সেই হৃদয়? ইতিহাস বলে এইসব পেশেন্টদের দশ বারো বছর বাদে আবার আক্রমণ হয়। যদ্দিন ও বাঁচবে সুস্থ হয়ে বাঁচুক। পড়াশুনা শেষ করুক, চাকরি করুক, কারও গলগ্রহ হয়ে শ্রাবণী থাকতে যাবে কেন? ও খুব ইনট্রোভার্ট এবং ইনটেলিজেন্ট মেয়ে। ওর জীবনটা ওকেই যাপন করতে দিন। তবে কেউ যদি ওর প্রেমে পড়ে সব জেনেশুনে তাহলে আমরা ওয়েলকাম করব। কিন্তু জানিয়ে দেব সন্তান যেন না হয়। ঠিক আছে? আর কিছু জিজ্ঞাস্য আছে?

মাসিমা মাথা নাড়লে, না।

ডক্টর দত্ত ভরতের দিকে তাকালেন, কিহে ইয়ংম্যান, তুমি আমার সঙ্গে কি একমত?

ভরত জবাব দিল, নিশ্চয়ই। আমার বিশ্বাস শ্রাবণীও আপনাকে সমর্থন করবে।
 
ডক্টর দত্ত হাসলেন, একটা মজার কথা শোনো। শ্রাবণীকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম ও কাউকে ভালবাসে কিনা। মানে বয়ফ্রেণ্ড আছে কিনা? সে চটপট মাথা নেড়ে জবাব দিল, এখানে আসার আগে তেমন কেউ ছিল না।

শ্রাবণীর মা অবাক হয়ে বললেন, সেকি!

আর বলবেন না, ডক্টর দত্ত মাথা নাড়লেন, আমি তার নাম জানতে চাইলাম। সে বলল, বলতে অসুবিধে আছে। ব্যাপারটা নাকি তার তরফ থেকেই।

শ্রাবণীর মা হঠাৎ অত লোকের মধ্যে ভরতের দিকে এমন ভাবে তাকালেন যে ভরতের খুব অস্বস্তি হতে লাগল। ভরত কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। ডক্টর দত্ত চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে মিটমিট হাসছিলেন। তারপরেই বেশ গম্ভীর হয়ে তিনি বললেন, বুঝলে ইয়ংম্যান, তোমরা আমাকে ঈর্ষা করতে পার।

কেন? ভরতের মুখ থেকে প্রশ্ন বেরিয়ে এল।

সেই ভাগ্যবানের নাম ডক্টর দত্ত। বলেই হো হো করে হাসতে লাগলেন তিনি। ভরত দেখল শ্রাবণীর মায়েরও মুখের চেহারায় প্রশান্তি এসেছে। বৃদ্ধ ডাক্তারের হাসি মাসিমার সমস্ত উদ্বেগ মুছিয়ে দিয়েছে। বাইরে বেরিয়ে এসে তার খুব অবাক লাগছিল। যে কোনো মা মেয়ের প্রেমিকের খবর পেলে স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন হবেন কিন্তু মৃত্যুর নিঃশ্বাস যে মেয়ের গায়ে পড়ছে তার। মা কোন্ যুক্তিতে একই ভাবে উদ্বিগ্ন হন? ভরত ঠিক করল যে শ্রাবণীর বাড়িতে যাবে না যদি না শ্রাবণী তাকে ডেকে পাঠায়।

.

কফিহাউসে সেদিন জোর তর্ক চলছে। পূর্ব ইউরোপের বেশিরভাগ দেশ থেকে কমিউনিজম উধাও হয়ে গিয়েছে। ভারতবর্ষের অন্য রাজ্যগুলোর ও ব্যাপারে যে আগ্রহ নেই তা ইতিমধ্যে প্রমাণিত। মুশকিল হলো, মানুষের কথা বলতে হলে, নিপীড়িত মানুষের পক্ষে কথা বললেই এতদিন ধরে শোনানো শ্লোগানগুলোর দৌলতে তা কমিউনিজম ঘেঁষা বলে মনে হয়। একজন পাঁড় কংগ্রেসি। নেতা যখন মানুষের সপক্ষে গল্প লেখেন তখন সন্দেহ হয় ভেক ধরে কমিউনিজমের দলে তিনি ঢুকতে চাইছেন কিনা। আসলে পুরনো অভ্যেস থেকেই মানুষের কথা বলতে গেলে চট করে কমিউনিজমের কথা মনে আসে। তর্ক চলছিল, এই ভাবনার পরিবর্তন হওয়া উচিত। এই সময় একটি ছেলে এসে খবর দিল শ্রাবণী ক্লাসে এসেছে।

ভরত অবাক হল। তাদের পার্ট ওয়ান পরীক্ষার সময় হয়ে গিয়েছে। এতদিন অনুপস্থিত থেকে শ্রাবণী কী করে পরীক্ষা দেবে। তার মনে পড়ল, শ্রাবণী বাড়ি ফেরার পর ওর সঙ্গে দেখা করতেও কখনও যায়নি এবং একই সঙ্গে ডক্টর দত্তর খবর নেওয়া হয়নি। আড্ডার সবাই খবরটা পেয়ে খুব খুশি হল। ওদের মধ্যে যারা রক্ত দিয়েছিল তাদের একজন বলেই ফেলল, যাক, আমাদের রক্তটা দেখছি কাজে লেগেছে। কিন্তু আমার মনে হয় ওর খুব খারাপ ধরনের অ্যানেমিয়া হয়েছিল তাই বেঁচে গেছে। লিউকোমিয়া নয়। হলে আবার ক্লাসে আসত না।

কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে ভরত উঠে পড়ল। কফিহাউস থেকে বেরিয়ে গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ছুটি হবার বেশি দেরি নেই। কোন ক্লাসে শ্রাবণী আছে সে জানে না তাই এখানে দাঁড়ানোই ভাল, দেখা হয়ে যাবে। এই সময় অভিজিৎ সামনে এল, খবর পেয়েছ? শ্রাবণী আবার ক্লাসে এসেছে। একই সঙ্গে প্রশ্ন করেই উত্তরটা দিয়ে দিল অভিজিৎ।

একটু আগে শুনলাম।

মাসিমা আপত্তি করছিলেন কিন্তু আমি জোর করলাম। বাড়িতে বসে থাকলে ও আরও ভীতু হয়ে যাবে। জ্ঞর দত্তের আপত্তি নেই যদি শ্রাবণী সহ্য করতে পারে। আজ বেরুবার সময় একটু নার্ভাস ছিল প্রথম, পরে ঠিক এসেছে। অভিজিৎ জানাল।

তুমি ওদের বাড়িতে যাও নাকি?

হ্যাঁ। ওর মায়ের পক্ষে তো ডক্টর দত্তের সঙ্গে যোগাযোগ করা সব সময় সম্ভব নয়। আমার সঙ্গেই চেক আপে যেত শ্রাবণী। কিন্তু মুশকিল হল ওর পার্সেন্টেজ নিয়ে কলেজ খুব প্রব্লেম করছে। বলছে পরীক্ষা দিতে দেবে না। কিন্তু শ্রাবণীর ইচ্ছে ও দেয়। আমি ওকে এই কমাসের নোটস দিয়েছি বলে ওর সম্ভবত অসুবিধে হবে না। কাল প্রিন্সিপালের সঙ্গে কথা বলব। না হলে ইউনিয়ন লেবেলে মুভ করতে হবে। শ্রাবণী ইচ্ছে করে অ্যাবসেন্ট হয়নি। এত বড় অসুখের পরও ও যে কলেজে এসেছে তাকে এনকারেজ না করে আইন দেখালে চলবে কেন? তুমি কী বলো?

ঠিকই তো।

মাসিমাকে বলেছি কদিন ওকে নিয়ে আসা নিয়ে যাওয়া আমি করব। যাই। অভিজিৎ চলে গেল। হঠাৎ মেজাজটা খিঁচড়ে গেল ভরতের। তার মনে হল শ্রাবণীর জন্যে এখানে দাঁড়িয়ে থাকার কোনও মানে হয় না। সে হনহনিয়ে হাঁটা শুরু করল।

.
 

Users who are viewing this thread

Back
Top