What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected স্বনামধন্য - সমরেশ মজুমদার (3 Viewers)

আমাকে নিয়ে আর কোনও সমস্যা রইল না! ভরত বাকিটা বলে দিল।

হ্যাঁ। কথাটা সত্যি। যতদিন তুই আমাদের ওপর নির্ভর করেছিলি ততদিন আমাদের দায় ছিল। অসহ্য হলেও আমরা সেটা মানিয়ে নিতে চাইতাম।

তুমি যা বলছ বাবারও একই সিদ্ধান্ত?

আপত্তি থাকলে ও প্রতিবাদ করত।

তোমরা কী করবে?

আমরা আলাদা হয়ে যাব। সুখ পাইনি কিন্তু স্বস্তি পেতে দোষ কী।

এই ফ্ল্যাটে–?

আমি থাকব। তোর বাবা আর একটা প্রমোশন পাচ্ছে। কোম্পানি ওকে সানি পার্কে ভাল ফ্ল্যাট দেবে। কোনও অসুবিধে হবে না।

তুমি তো হাউসওয়াইফ। তোমার চলবে কী করে?

কাল যেখানে গিয়েছিলাম সেখানে একটা ব্যবস্থা হয়েছে। একটা নামী ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরি নিচ্ছি আমি। তোর বাবার কোনও দায় নেই।

এসব কথা তোমরা খুব ঠাণ্ডা মাথায় ভেবেছ?

মা হাসল, হ্যাঁ রে।

এবার বাবা কথা বলল, তোর মা যা বলল এটা আমাদের সিদ্ধান্ত। কিন্তু আমরা চাই তুই যতদিন পড়াশুনা করতে চাইবি ততদিন আমরা তোর পাশে থাকব। তুই কার কাছে থাকবি, আমার কাছে না তোর মায়ের কাছে সেটা তুই ঠিক করবি।

আমি থাকলে কার অসুবিধে হবে না?

মা বলল, আমার অসুবিধে হবে কেন?

বাবা বলল, অসুবিধে হবার কোনও কারণ নেই।

আমি যদি তোমাদের দুজনের কারও কাছে না থাকি?

তুই কি হোস্টেলে থাকতে চাইছিস? বাবা জিজ্ঞাসা করল।

আমি এখনও কিছু ভাবিনি।

দ্যাখ ভেবে দ্যাখ। আমরা সামনের মাস থেকে আলাদা হব।

তোমরা কি ডিভোর্স চাইছ?

সেটা চাইতে গেলে অনেকটা সময় আলাদা থাকতে হয়। এটা সেই প্রথম স্টেপ। বাবা উঠে গেল। বেসিনে হাতমুখ ধুয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেল। ভরত মায়ের দিকে তাকাল, এতদিনের সম্পর্ক ছিঁড়ে ফেলতে তোমার কষ্ট হচ্ছে না?

মা নিষ্পলক তাকাল, হচ্ছে নিশ্চয়ই কিন্তু আমি টের পাচ্ছি না।

বুঝতে পারলাম না।

যে সমস্ত মোষ গাড়ি টানে তাদের কাঁধে দেখবি মস্ত কড়া পড়ে যায়। ঘাটা পড়া বলে। সেখানে কোনও অনুভূতি থাকে না। ওটা শক্ত হয় যাওয়ার পর গাড়ি টানার সময় মোষের একটুও ব্যথা লাগে না। আমারও তাই অবস্থা। সংঘাত হতে হতে মনের সব নরম ব্যাপারগুলো উধাও হয়ে গিয়েছে। এখন সমস্ত মন জুড়ে ওই ঘাটা পড়ে গেছে। তাই ব্যথা লাগলেও টের পাচ্ছি না। মা বলল।

ভরত উঠল। হাতমুখ ধুয়ে নিজের ঘরে ফিরল। বিছানায় শুয়ে সে অপলক তাকিয়ে থাকল ছাদের দিকে। একসময় সে ভাবত এই খেয়োখেয়ি করে ওরা একসঙ্গে আছে কী করে? কেন আলাদা হয়ে যায় না? রাত্রে যুদ্ধ করে আবার সকালে বন্ধুত্ব করে কী করে? কিন্তু এখন ওরা আলাদা হবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শোনার পর তার একটুও ভাল লাগছে না। এটা কি তার মধ্যবিত্ত মানসিকতার কারণে? মধ্যবিত্তরা ভাল বা মন্দ কোনোকিছুকেই চূড়ান্ত অবস্থায় মেনে নিতে পারে না।
 
বাবা-মা আলাদা হয়ে যাচ্ছে। তারপর ওদের ডিভোর্স হয়ে যাবে। বাবা আবার বিয়ে করতে পারে। এখনও চেহারা শরীর অটুট আছে বাবার। মাকে কিন্তু একটুও প্রৌঢ়া বলে মনে হয় না তবু মা আবার কাউকে বিয়ে করছে এটা ভাবতে অস্বস্তি হয়। কী আশা নিয়ে দ্বিতীয়বার বিয়ে করবে? সারাজীবন একজন পুরুষের সঙ্গে যখন মিল হলো না তখন পরিণত বয়সে অচেনা আর একজনের সঙ্গে সেটা হবে এমন আশা করার কোনও কারণ আছে! ফুটন্ত কড়াই থেকে গনগনে আগুনে ঝাঁপ দেওয়া হতে পারে সেটা।

হঠাৎ সমস্ত শরীর কাঁপিয়ে কান্না এল ভরতের। এমনভাবে কান্না আসবে সে নিজেই জানত না। তার কোনো প্রস্তুতি ছিল না। দ্রুত উপুড় হয়ে শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে নিজেকে সামাল দেবার চেষ্টা করতে লাগল প্রাণপণে। একান্না কার জন্যে সে নিজেই জানে না। কিন্তু আর কেউ তাকে কাঁদতে দেখুক তা সে চাইছিল না। কান্না যখন থামল তখন সব কিছু ফাঁকা হয়ে যাওয়ার বদলে ভরতের মনে কিরকম আক্রোশ দানা বাঁধতে লাগল। এই আক্রোশ কার বিরুদ্ধে কী কারণে তা ভাবার কোনো অবকাশ নেই। কেবল মনে হচ্ছিল তার সামনে একটার পর একটা কালো দেওয়াল এবং বেঁচে থাকতে হলে ওইসব দেওয়াল ভেঙে চুরমার করে দিতে হবে। কাউকে কোনও কৈফিয়ত দেবার দায় তার নেই।

.

পরের দিনও এ বাড়ির আবহাওয়া স্বাভাবিক। কেউ দেখলে বিশ্বাস করতে চাইবে না। আর কয়েকদিন পরে একটা বড় ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। দুটি নারীপুরুষ দীর্ঘসময় একত্রে বাস করে চিরদিনের জন্য আলাদা হয়ে যাচ্ছে এবং তার জন্যে কোনো তিক্ততা নেই। দুজনের মধ্যে এখন ভাল বন্ধুর সম্পর্ক। গতরাত্রে বাবা মদ খেয়েছে একাই পরিমিত। মা সময় পেলে গল্প করে গিয়েছে। যে কোনও স্বাভাবিক দম্পতির ছবি।

ওরা যদি ঝগড়া করত, কথা বন্ধ রাখত তাহলে অনেক ভাল লাগত ভরতের। উত্তেজনার মাথায় মানুষ যা করে তা সহ্য করা যায় কিন্তু ঠাণ্ডা মাথায় ধীরে সুস্থে যদি সেই জিনিস করে তাহলে মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ওরা বলেছে সে কার সঙ্গে থাকবে তা যেন ঠিক করে নেয়। কার সঙ্গে? বাবা না মা? যদি এই দুজনের সঙ্গেই না থাকে তাহলে তার থাকার জায়গা কোথায়? ভরতের মনে আত্মীয়স্বজনের ছবি এল। বাবার এক ভাই থাকেন দুর্গাপুরে। কালে ভদ্রে আসেন। এলে এ বাড়িতে ওঠেন না, কিছুক্ষণের জন্যে থেকে বেরিয়ে যান তিনি। বাবার বোন থাকে জামশেদপুরে। ছেলেবেলায় তাকে কয়েকবার দেখেছে সে। পিসি বলত। একদিন মা বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিল তোমার বোন আর কতদিন থাকবে কিছু বলেছে? বাবা জবাব দিতে পারেনি। তার মনে হয়েছিল মায়ের প্রশ্নের জবাবটা সে-ই জেনে নেবে। সোজা পিসিকে গিয়ে প্রশ্নটা করেছিল। পিসি অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, কেন রে?

সে বলেছিল, মা জানতে চাইছে। পরদিনই পিসি ফিরে গিয়েছিল জামশেদপুরে। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত এই বাড়িতে আসেনি। মা-ও কখনও ওবাড়িতে যায় না। দার্জিলিং, পুরীতে যাওয়া যেতে পারে দুর্গাপুর জামশেদপুরে না। শুধু সে নয়, তার স্কুলের বন্ধুরাও পিসিদের চেনে না, মাসিদের চেনে। ভরতের দুর্ভাগ্য তার কোনও মাসি নেই। থাকলে না হয় আজ সেখানে যেতে পারত।

কোনও হস্টেলে অথবা মেসে গিয়ে উঠলে কেমন হয়? হোস্টেলে থাকলে ছুটির সময়। সমস্যা হবে। তখন সবাইকে বাড়িতে যেতে হয়, সে কোথায় যাবে? অতএব মেস-ই ভাল। মেসে থাকতে কত খরচ পড়ে তা সে জানে না। ওর সঙ্গে একটি মেদিনীপুরের ছেলে পড়ে যে হোস্টেলে জায়গা না পেয়ে মীর্জাপুরের মেসে উঠেছে। জায়গাটা সে চেনে। তার হাতে আপাতত নয়শো টাকা আসছে। পারমিতার বাবা দিলে বারো তেরোশ হবে। একটা মেসে নিশ্চয়ই তার চেয়ে বেশি দিতে হবে না।


একটু হালকা হয়ে সে কলেজে চলে এল। থার্ড পিরিয়ড অফ ছিল। ভরত সেই ছেলেটাকে খুঁজে বের করল। ছেলেটা ভাল রেজাল্ট করলেও কথাবার্তায় গ্রাম্যতা কলকাতায় এসেও ঝেড়ে ফেলতে পারেনি। ভরতের প্রশ্ন শুনে বলল, অনেক টাকা লাগে।

কত?

হাজার টাকা খাওয়া আর দুশো টাকা সিট রেন্ট।

ভরত ঢোঁক গিলল। তার হাতে বড়জোর একশ টাকা অতিরিক্ত থাকবে। যাই থাক সে দুবেলা খাওয়া আর একটা শোওয়ার জায়গা তো পাবে। ভরত বলল, আজ তোমার সঙ্গে গেলে মেসের মালিকের সঙ্গে কথা বলতে পারব?

কেন?

আমি তোমার মেসে থাকতে চাই।

ওখানে তো জায়গা নেই। সব সিট ফুল।

যাচ্চলে!

তাছাড়া মেসের খাবার খুব খারাপ। খেতে পারবে না ভাল করে। তোমার তো এই শহরেই বাড়ি। বাড়ি ছেড়ে শখ করে কেউ মেসে গিয়ে থাকে? ছেলেটা বিজ্ঞের হাসি হাসল।

কেন থাকতে চাই সেটা আমি বুঝব। জ্ঞান দিচ্ছ কেন?

না না। আমি এমনি বললাম। আমাদের পাশের মেসে জায়গা খালি আছে।

আজ বিকেলে আমাকে নিয়ে যাবে।

বিকেলে? আমি যে তখন পড়ব।

পরে পড়ো। জোর গলায় বলতেই ছেলেটা মিইয়ে গেল। বিকেলে যখন ছেলেটির সঙ্গে বের হচ্ছে তখন সুদেষ্ণার সঙ্গে দেখা। সুদেষ্ণাকে এগিয়ে আসতে দেখে ছেলেটি কুঁকড়ে একপাশে সরে গেল।

সুদেষ্ণা জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছ?

ভাল নেই।

কেন, কী হয়েছে?

এক কথায় বলা যাবে না। আর অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।

যেন একটা বাচ্চা ছেলের সঙ্গে কথা বলছে এমন ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল সুদেষ্ণা, কাল তোমার কী হয়েছিল?

আই অ্যাম সরি। তোমাকে ওভাবে বিব্রত করার জন্যে ক্ষমা কর। আচ্ছা, চলি। সুদেষ্ণাকে দাঁড় করিয়ে রেখে সে মেদিনীপুরের ছেলেটাকে সঙ্গে আসতে ইশারা করল।
 
একটা জরাজীর্ণ বাড়ি, কোনও সাইনবোর্ড নেই। ছেলেটির সঙ্গে ভেতরে ঢুকতেই নাকে অদ্ভুত বোঁটকা গন্ধ এল। এই বিকেলেই এখানে আলো প্রায় নেই বললেই চলে। মাঝখানে একটা চাতাল, চাতালের পাশে কল। সম্ভবত সেটাই স্নানের জায়গা কারণ একজন বৃদ্ধ সেখানে স্নান করতে করতে জিজ্ঞাসা করলেন, কাকে চাই?

ছেলেটি বলল, আপনাকে।

বিশাল শরীর প্রায় অর্ধনগ্ন। মাথায় বালতির জল ঢেলে চিৎকার করে কোনো সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারণ করে লোকটি বললেন, কেন ভাই?

আমাদের কলেজে পড়ে। মেসে থাকতে চায়।

ভাল। খুব ভাল। পনের কলা পূর্ণ হয়েছে, ইনি এলে সোল কলা হয়। দুনম্বর ঘরের চার নম্বর সিট খালি আছে। দেখে এসো, ততক্ষণে নেয়ে নিই। বলেই হাঁক দিলেন, জগু, অ্যাই। জগু, বাবুদের দুনম্বরের চার নম্বর দেখা।

জগু নামক লোকটির উদয় হল এবং সে তাদের যে ঘরে নিয়ে গেল সেখানে আলো নেই। ভরত বলল, আলো জ্বালুন।

গরমকালে ছটা আর শীতকালে পাঁচটার আগে আলো জ্বালার আইন নেই।

তাহলে আমি দেখব কী করে? বিরক্ত হল ভরত।

জগু মুখ বাড়িয়ে বলল, অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছে না, আলো জ্বালতে বলছে।

আচ্ছা জ্বাল। গলা ভেসে এল।

অতএব আলো জ্বালা হল। তিনটে তক্তাপোশ বিছানা রয়েছে, একটি খালি। তিনটের গায়ে ছোট টেবিল, কারও চেয়ার নেই। নোনা ধরা দেওয়ালেই পেরেকে হ্যাঁঙার টানিয়ে জামা প্যান্ট ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এই তিনটি মানুষ কে কিরকম তা জানা নেই। জিনিসপত্রের অবস্থা দেখে কারও সঙ্গতি তেমন নয় বলে অনুমান হল।

জগু বলল, উনি একটু বেশি নাক ডাকেন। তবে শনি রবিবার দেশে যান। আর এই দুইবাবু ফেরেন রাত দশটায়। কারও সঙ্গে কথা বলেন না।

ভরত জিজ্ঞাসা করল, কেন?

কথা বলার অবস্থা থাকে না মা কালীর কৃপায়। বলে হাতের মুদ্রায় খাওয়া দেখাল। ভরতের খুব খারাপ লাগছিল। এমন একটা ঘরে থাকার কথা সে কখনও চিন্তা করেনি। কিন্তু কোনো উপায় নেই।

স্নান সেরে লোকটি একটা ছোট ঘরে ওদের বসিয়ে মাথা আঁচড়াতে আঁচড়াতে কথা বলছিল, এই বাজারে আমি যে সস্তায় মেস চালাচ্ছি তা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। আপনি তো পাশের মেসে থাকেন। কত দিতে হয়?

অঙ্কটা বলল ছেলেটি। ভদ্রলোক বললেন, আমার এখানে পঞ্চাশ টাকা কম। সকালে নো চা। নটা থেকে বারোটা ভাত ডাল ঘ্যাঁট আর মাছের ঝোল। বিকেলে চায়ের ব্যবস্থা নেই। রাত্রে রুটি এবং তরকারি। সপ্তাহে একদিন মাছ। রান্না অপূর্ব। পোস্ত পাবেন দুদিন। টাকা এনেছেন?

আজ আনিনি।
 
দ্রুত নিয়ে আসুন। সিট ধরে রাখতে পারব না। হ্যাঁ, আমার এখানে কোনও ছাত্র নেই। ছাত্র থাকলেই গোলমাল পাকায়। রাত দশটার পর গেট বন্ধ হয়ে যায়। তখন এলে খাওয়া পাওয়া যাবে না। মদ খাওয়া যাবে না। মিল অফ করলে ফেরত পাবেন না কিছু। আর ওই যাকে বলে বান্ধবী, তাকে ঘরে আনা চলবে না। একজনের যদি আসে তাহলে বাকি সবার চরিত্র খারাপ হয়ে যাবে।

আমি তো ছাত্র, আমাকে নিচ্ছেন কেন?

মুখ থেকে বেরিয়ে গেছে। একবার মুখ থেকে কথা বের হলে ফিরিয়ে নেওয়ার বান্দা আমি নই। বাড়ি কোথায়? ভদ্রলোক একটা খাতা খুললেন।

কলকাতায়।

অ্যাঁ। কলকাতায় বাড়ি অথচ মেসে থাকবেন?

হ্যাঁ। কোনও পুলিশ টুলিশের ব্যাপার নেই তো?

না।

বাবা টাকা দেবেন? ছাত্র বলে জিজ্ঞাসা করছি।

না। আমিই দেব।

ও বাবা! তা সেটা আসবে কোত্থেকে?

আমি টিউশনি করি।

মেরেছে। যে মাসে টিউশনির টাকা পাবেন না অথবা অভিভাবক যদি আপনাকে ছাড়িয়ে দেয় তাহলে তো–। কথা শেষ না করে মাথা নাড়লেন ভদ্রলোক।

যেভাবেই হোক আপনি টাকা পেলেই তো হলো।

হলো। একমাসের অ্যাডভান্স দিতে হবে। যে মাসেরটা দিতে পারবেন না সেই মাসের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করব। আর হ্যাঁ, এখানে কোনওরকম আন্দোলন চলবে না।

আন্দোলন মানে?

ওই যে চলবে না চলবে না। খাবার খারাপ, চালে গন্ধ বাবুদের তো বায়নাক্কার শেষ নেই। আরে অত নাক উঁচু তো বাপের কাছে গিয়ে থাকুক।

হঠাৎ ভরত বলল, আপনি দেখছি খুব বদ লোক।

ভদ্রলোক হতভম্ব, তার মানে?

আপনি ডিক্টেটার হয়ে মেস চালাচ্ছেন। হিটলার মুসোলিনী।

সঙ্গে সঙ্গে মাথার ওপর দুটো হাত তুলে নমস্কার করলেন ভদ্রলোক, কি যে বলেন। ওইসব মহাত্মাদের সঙ্গে আমার তুলনা। আসুন।

আসুন মানে?

আপনাকে আমার চাই না।

কারণ?

প্রথমেই বদলোক বলেছেন। ঢোকার আগেই। পরে ভিটেমাটি ছাড়া করবেন।

আপনি চাই না বললেই হবে না। আমি থাকব। কাল টাকা দেব। আরে।

ইয়ার্কি নাকি। আমি মেস-মালিক, আমি বলছি আপনাকে চাই না।

আপনি বদলোক তাই বদ বলেছি। এটা কোনও অপরাধ নয়। আপনি লজিক দিয়ে বোঝন কেন আমাকে থাকতে দেবেন না।

আমি কিছু বোঝাতে পারব না। যান এখান থেকে।

যাওয়ার জন্যে আসিনি আমি।

কি মুশকিল। এই যে, তুমি তোমার বন্ধুকে বোঝাও! নইলে মেসে থাকা মুশকিল হবে। তোমাদের মালিক আমার পিসতুতো ভাই।

ওকি বোঝাবে? টেবিল থেকে একটা পেপার ওয়েট তুলে নিয়ে ঠুকঠুক করে টেবিলে শব্দ করতে লাগল ভরত, আমার পকেটে পঞ্চাশ টাকা আছে। অ্যাডভান্স নিন।
 
শব্দ অসহ্য লাগায় ভদ্রলোক পেপার ওয়েট কেড়ে নিতে চাইলেন কিন্তু পারলেন না। চিৎকার করে ডাকলেন, জগু, অ্যাই জগা। উত্তেজনায় ওঁর শরীর কাঁপছিল।

দৌড়ে এল আগের লোকটা, আজ্ঞে?

এদের তাড়া। বের করে দে। ভদ্রলোক চিৎকার করলেন।

আজ্ঞে আপনারা তাহলে আসুন। লোকটি ঘাড় নাড়ল।

পঞ্চাশ টাকা নিয়ে রসিদ দিন। একই গলায় বলল ভরত।

না। দেব না। তোমার মতো কাঁটা আমার গলায় বিঁধতে দেব না। আমার মুখের ওপর বলে কিনা আমি বদ লোক! বের হও।

আমি চলে গেলে আপনার বিপদ আছে।

তার মানে?

এটা একটা মেস? একটা গোয়ালঘর এর চেয়ে ভাল। কলেজের ছেলেরা এসে সব ভেঙে দিয়ে যাবে। মেস চালিয়ে পকেট ভারী করা বেরিয়ে যাবে। চাইকি, এক-আধজন ওই ভুড়িটাকে ফাঁসিয়েও দিতে পারে। তারপরে পুলিশ আসবে, হেলথ ডিপার্টমেন্টের লোক আসবে। তাদের সন্তুষ্ট করতে মোটা মাল ছাড়তে হবে। সেসব চুকে যাওয়ার পর আবার ছেলেরা আসবে। গুণ্ডা বদমাস নয়, কলেজ স্টুডেন্ট। ওরা যা ইচ্ছে করতে পারে পুলিশ কোনো কেস করবে না, এটা তো নিশ্চয়ই জানেন। ভরত পেপার ওয়েট ঠুকতে ঠুকতে বলে যাচ্ছিল। তার কথা শেষ হওয়ামাত্র জগু হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। প্রচণ্ড রেগে যাওয়া চেহারা নিয়ে ভদ্রলোক বসেছিলেন চেয়ারে। কিন্তু তার মুখ থেকে কোনও কথা বের হচ্ছিল না। ভরত দেখল তার সঙ্গী একটু একটু করে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। সে তাকে আটকাল, মিছিমিছি ভয় পাচ্ছিস? তোকে কিছু করলে আমরা এসে ছাল ছাড়িয়ে নেব। ছাল ছাড়ানো চর্বিওয়ালা মানুষের বডির এখন হেভি ডিম্যান্ড। তারপর ঘুরে তাকাল, কী সিদ্ধান্ত নিলেন?

জগু তখন চলে গেছে ভদ্রলোকের পাশে, বাবু মেনে নিন। দাদাকে নিজের দলে টেনে নিন তা হলে বাকি পনেরো বাবু আর মুখ খুলতে পারবে না।

না জগা, না। আমি চরিত্র খুইয়ে ব্যবসা করতে পারব না। এই করে এতদিনে দুটো ফ্ল্যাট করেছি, দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছি, সারাজীবন নিজেকে বঞ্চিত করে এই মেসে পড়ে থেকেছি, এখন চরিত্র নষ্ট করতে পারব না। গলার স্বর করুণ হয়ে আসছিল। মুখ ছোট দেখাচ্ছিল। ভরত উঠে দাঁড়ল, তা হলে অপেক্ষা করুন।

না, না, তা বলিনি। আমি বলি কি, অন্য মেসে গেলে হয় না?

না। ঠিক আছে। তবে একটা কথা আছে।

বলুন।

কোনো অসুবিধে হলে সবার সামনে আমাকে যেন কিছু না বলা হয়। একটু আড়ালে-আবডালে বললেই হবে। কেমন?

না।

না মানে?

এই মেসে যাতে মানুষ বাস করতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে।

মানুষই তো থাকে এখানে?

গরু-ভেড়ার মতো থাকে। দেওয়ালগুলোয় নতুন করে হোয়াইট ওয়াশ করান। ঘরে যাতে আলো আসে তার ব্যবস্থা করুন।

অসম্ভব। অনেক খরচ। পুরনো বাড়ি, একবার হাত দিলে আর দেখতে হবে না। আমি মরে যাব।

গেলে যাবেন। সকালে চা টোস্ট দেবেন। দুপুরে ঘাটের বদলে একটা ভাল তরকারি, বিকেলে টিফিন আর রাত্রে ডিম অথবা মাংস।

ওই টাকায়? পাগল। আমার হাতে কিছুই থাকবে না।

অনেক তো নিয়েছেন, একটু না হয় কম নিলেন। দরকার হলে একটু চার্জ বাড়ান। কিন্তু বেশি নয়। চলি। বেরিয়ে এল ভরত।

বাইরে বেরিয়ে ছেলেটি বলল, তোমার তো খুব জোর আছে!

তার মানে?

এসব কথা আমাদের কথা। কিন্তু আমরা কেউ বলতে সাহস পাইনি। ছেলেটি হাসল, তুমি কি ওই মেসে এসে থাকবে?

দেখি।

ছেলেটির সঙ্গে ওর মেসে গেল ভরত। যে অবস্থায় ওরা বাস করে দেখে শরীর গুলিয়ে উঠল তার। তখন মেসের বাসিন্দারা কেউ নেই। কিন্তু ঘরে পা ফেলার জায়গা পাওয়া মুশকিল। এই ঘরের অবস্থা আরও করুণ। উপায় নেই বলে মানুষ এমন পরিবেশে থাকতে বাধ্য হয়। ছেলেটি তাকে চা খাওয়াতে চাইল। মেসের চাকর বাইরে থেকে এনে দিল। ভরত হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের জেলায় তো অনেক ভাল কলেজ আছে। তুমি এত কষ্ট করে এখানে থেকে পড়তে এলে কেন?

ছেলেটি হাসল, প্রেসিডেন্সি কলেজে তো পড়তে পারতাম না।

এখানে তোমার কষ্ট হয় না?

প্রথম প্রথম হত, এখন হয় না।

ভরত কিছু বলল না। যে-কোনো কষ্টই প্রথম অসহ্য হয়। সুদেষ্ণা যখন তার প্রস্তাবে অবাক হয়ে গিয়েছিল তখন তার যে কষ্ট হয়েছিল এখন আর ততটা নেই।
 
বাড়িতে ফেরার সময় ভরত ঠিক করে ফেলল সে মেসে থাকবে না। ওখানে থাকতে পারবে না সে। বাবা এবং মা আলাদা হয়ে যাচ্ছে বলে সে অত কষ্ট করতে পারবে না। বাড়িতে ফিরে সে সোজা পারমিতাদের ফ্ল্যাটে গেল। এই সময় তার ওকে পড়াতে যাওয়ার কথা। পারমিতার বদলে তার মা দরজা খুললেন। খুলে তাকে দেখে একপাশে মাথা নিচু করে দাঁড়ালেন।

ভরত জিজ্ঞাসা করল, পারমিতা আছে?

ভদ্রমহিলা নীরবে মাথা নেড়ে না বললেন।

একটু বিরক্ত হল ভরত, আশ্চর্য! এইসময় পড়াতে আসব বলে গিয়েছিলাম।

আপনি বসুন। ভদ্রমহিলা দরজা আর একটু ফাঁক করলেন। সে ভেতরে ঢুকলে দরজাটা বন্ধ করে চলে গেলেন তিনি। ভরত বসবার ঘরে বসল। পারমিতার এতক্ষণে স্কুল থেকে ফিরে আসা উচিত। সে ভেতরদিকে তাকাল। ভদ্রমহিলার আচরণ বেশ অদ্ভুত। এত আধুনিকা মেয়ে যাঁর তার পক্ষে অমন চালচলন বেমানান।

দশ মিনিট বাদে বেল বাজল। ভরত উঠে দরজা খুলতে দেখল পারমিতা দাঁড়িয়ে আছে, সঙ্গে ওর বাবা। ভরত জিজ্ঞাসা করা, এত দেরি হলো?

শ্রমিক নেতা বললেন, আমরা একটু মার্কেটিং-এ বেরিয়েছিলাম। বসো।

পারমিতা চুপচাপ ভেতরে চলে গেল ওর বাবা চেয়ারে বসে বললেন, শুনলাম ওকে পড়াবে বলে তুমি টাকা চেয়েছ?

আমি টিউশনি করি।

অ। তোমার বাবার যা আর্থিক অবস্থা তাতে টিউশনি করার কথা নয় তোমার।

আমি স্বাবলম্বী হতে চাই।

বেশ। কিন্তু তোমার বাবা-মায়ের সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল ওকে একটু ইংরেজিতে কইয়ে বলিয়ে করে দেবার জন্যে তোমাকে পাঠাবেন। চারশো টাকা মাসে খরচ করে ইংরেজিতে কথা বলা শেখানোর সামর্থ্য আমার নেই। ওঁদের সঙ্গে আমার সেই কথাও হয়নি। ওঁরা জানেন, তুমি আমার কাছে টাকা চেয়েছ?

কাজটা আমি করব ওরা জানবে কেন?

কারণ তুমি ওঁদের ছেলে। তোমার বাবাকে আমি ফেবার করছি বলে তুমি এই কাজটুকু করবে। শোন, ইংরেজিতে কথা বলতে পারে না জাপানিরা, তাই বলে ওদের কোন কাজটা আটকে থাকছে? পৃথিবীর অর্থনীতি ওরাই কন্ট্রোল করছে। হ্যাঁ, আমাদের দেশে ইংরেজি বলতে পারলে লোকে সমীহ করে, তাই। কিন্তু ভাই, আমি এটা এক্সপেক্ট করিনি। ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন।

আপনার মেয়ের ইংরেজির ভিত খুব কাঁচা। কথা বলতে গিয়ে দেখলাম ওর ক্লাসের পড়াটাও ঠিক হচ্ছে না। তাছাড়া ওই নিজে আমাকে বলল ওর ক্লাসের ইংরেজি পড়াতে। শুধু ইংরেজিতে কথা বলা শেখানোর জন্যে আমি চারশো টাকা চাইনি। ওর প্রেজেন্ট মাস্টারকে আপনি নিশ্চয়ই টাকা দিতেন?

না। তার ভাইকে চাকরি দিয়েছি। সে পড়াক বা না পড়াক আমার কিছু যায় আসে না।

কী বলছেন আপনি? অবাক হয়ে বলল ভরত।

ঠিকই বলছি। তুমি হাজার পড়িয়ে আমার মেয়েকে পণ্ডিত করে গ্যারান্টি দিতে পারবে যে ও স্কুল ফাইনালে ফার্স্ট ডিভিসন পাবে?

ও যদি সিরিয়াসলি পড়ে, তাছাড়া অন্য সাবজেক্টগুলোও আছে।

কিন্তু এই মাস্টার থাকলে ও ফার্স্ট ডিভিশন পাবেই।

না পড়িয়েও?

হ্যাঁ। পরীক্ষার মাসখানেক আগে প্রশ্নগুলো পেলে কিছু তো লিখতে পারবে। আর সেটা পারলে নাম্বার দিতে ওদের কোনও অসুবিধে হবে না। কত ছেলে স্কুল লাইফে ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করেও ফাইনালে গিয়ে ঢ্যাড়ায় কেন? তখন অভিযোগ ওঠে খাতা ভাল করে দেখাই হয়নি। আরে পার খাতা পাঁচসিকে করে পেলে কোন মাস্টারের ধৈর্য থাকে সব কটা উত্তর ঠিক সময়ে পড়ার? বুঝলে? তাই বলছিলাম, তোমাকে ইংরেজি পড়াতে হবে না। আমার সব ঠিক করা আছে। ও বারো ক্লাস দিয়ে জয়েন্ট এন্ট্রান্স দেবে। মেডিকেলে ভর্তি হবে। আমি চাই ও ডাক্তার হোক।

জয়েন্ট দিয়ে ও মেডিকেলে চান্স পাবে?

আলবৎ পাবে। ডাইরেক্ট না পেলে সি এমের কোটায় পাবে?

আপনি কি ডাক্তারিটাও পাশ করাবার ব্যবস্থা করে রেখেছেন?

হাতে তো অনেক সময় আছে, দেখা যাক।

আপনি মানুষ খুন করতে পারেন।

তার মানে? হকচকিয়ে গেলেন পারমিতার বাবা।

আমি চললাম।

না, দাঁড়াও। তুমি আমাকে টন্ট করলে?

আপনি সেটা বুঝতে পারছেন?

শোনও হে, কার সঙ্গে এভাবে কথা বলছ তুমি জানো না? যাও, বাবাকে জিজ্ঞেস কর। ওঁর প্রমোশন হয়েছে আমার জন্যে। আমি বিনিপয়সায় কারও জন্যে কোন উপকার করিনি কখনও কিন্তু তোমার মা আমাকে এমনভাবে তেল মারল যে না করে পারিনি। আমার সঙ্গে ঠাট্টা? দেব তোমার বাবাকে টাইট?
 
তাতে আমার কিছু এসে যাবে না। বাবা-মা আলাদা হয়ে যাচ্ছে। এরপর মা নিশ্চয়ই বাবার জন্যে আপনাকে বলতে আসবে না।

এ্যাঁ? আলাদা হচ্ছে? সেকি? দেখে তো বুঝিনি। তা অত মাল খেলে আলাদা হবে না? তা হলে তো ভালই করেছি তোমাকে ছাড়িয়ে দিয়ে। এইসব ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তানকে বাড়িতে ঢুকিয়ে নিজের বিপদ ডাকতাম।

আপনি এসব না করে মেয়ের বিয়ে দিন। আঠারো হয়নি যদিও তবু আপনি তো সব পারেন। তাতে বেঁচে যাবেন। ভরত দরজার দিকে এগোল।

তার মানে?

ও দ্বিতীয় দিনেই আমাকে একটা ইংরেজি বাক্য বলতে পেরেছে।

কী বাক্য?

আই লাভ ইউ। বুঝতেই পারছেন। নমস্কার। সজোরে দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে এল সে। রাগে মাথার শিরা দপদপ করছিল। প্রতি বছর কাগজে মুখ্যমন্ত্রীর সুপারিশে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়া ছেলেমেয়েদের সম্পর্কে সমালোচনা বের হয়। কিন্তু তাতে কোনও কাজ হয় না। এই ভদ্রলোকেরও তাই কোনও অসুবিধে হবে না। এর বিরুদ্ধে তার কিছুই করার নেই। বেনিয়মগুলো মানতে প্রথম প্রথম মানুষের অসুবিধে হত, এখন চারধারে তার এমন প্রাবল্য যে সেটা সহ্য হয়ে গেছে। কষ্টের মতো।

.

সন্ধেটা নিজের ঘরে ছিল ভরত। আটটা নাগাদ বসার ঘরে এসে দেখল বাবা টি ভি দেখছে আর মা কিচেনে। সে গলা তুলে বলল, তোমাদের সঙ্গে আমার কথা আছে।

বলার ভঙ্গি দেখে বাবা একটু অবাক, কী কথা?

মা, এদিকে এসো।

অতএব মা এল। চোখে বিস্ময়।

তুমি সামনের মাসে আলাদা হয়ে যাচ্ছ? বাবাকে জিজ্ঞেসা করল সে।

সবই তো জানিস।

তা হলে তো মায়েরও এই ফ্ল্যাটে থাকা উচিত নয়।

তার মানে? বাবা জিজ্ঞাসা করল, তোর মা কোথায় থাকবে?

সেটা মা ঠিক করবে। এই ফ্ল্যাট তোমরা কিনেছিলে যখন তখন তিনজনের থাকার কথা ছিল। তোমরা আলাদা হচ্ছ। তুমি অফিসের ফ্ল্যাটে উঠে যাচ্ছ, মায়েরও একটা ব্যবস্থা করা উচিত। মা চাকরি নিচ্ছে। যেহেতু আমি বেকার তাই এখানে থাকব।

আশ্চর্য! আমি কোথায় ব্যবস্থা করব? মা এগিয়ে এল, কলকাতায় থাকার জায়গা চাইলে চট করে পাওয়া যায়? আর কত মাইনে পাব আমি যে আলাদা ফ্ল্যাট ভাড়া করব?

সেটা তোমার সমস্যা। বাবার কেনা ফ্ল্যাটে তোমার থাকতে খারাপ লাগা উচিত। ভরত এইভাবে কথা বলতে বেশ মজা পাচ্ছিল।

খারাপ কেন লাগবে? আমি ক্ষতিপূরণ হিসেবে এই ফ্ল্যাটটা নিচ্ছি।

ও। আমার ক্ষতিপূরণ কীভাবে করবে তোমরা?

তোর ক্ষতিপূরণ?

নিশ্চয়ই। তোমাকে বিয়ে করে এখন আলাদা হচ্ছে বলে বাবা ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে। তোমরা দুজনে আমাকে পৃথিবীতে এনে আলাদা হচ্ছ যখন তখন তো আমার দুজনের কাছেই ক্ষতিপূরণ পাওনা।

বাবা বলল, তোকে তো বলেছি, তোর যার কাছে ইচ্ছে তার কাছেই থাকতে পারবি। তুই বল কার কাছে থাকবি?

কারো কাছে নয়। একা থাকব। আমি যদ্দিন রোজগার না করব তদ্দিন ভালভাবে থাকতে চাই এবং তোমরা তার ব্যবস্থা করে দাও।

কীভাবে?

হয় এই ফ্ল্যাটটা ছেড়ে দাও নয় অন্য কোনো ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করে দাও।
 
বাবা মায়ের দিকে তাকাল। মা সুর পাল্টালো, তোর হঠাৎ মতি বদলে গেল? আমাকে বলেছিলি টিউশনি করে স্বাবলম্বী হবি। তার কী হল? হঠাৎ এইসব কথা মাথায় কী করে এল?

ভেবেছিলাম। পরে মনে হল তোমাদের জন্যে আত্মত্যাগ করার কোনও মানে হয় না। আজ পারমিতার বাবা বলল তুমি তাকে এত তেল দিয়েছ যে বাবার প্রমোশনের ব্যবস্থা তাকে বিনা পয়সায় করে দিতে হয়েছে। ওর মেয়েকে পড়াতে হবে অথচ টাকা নিতে পারব না এমন শর্ত আমি মানিনি। শুনলাম তুমি ওকে কথা দিয়েছ বিনা পয়সায় পড়াব। তুমি যদি আমাকে বা মাকে এক্সপ্লয়েট করতে পার তাহলে চোরের ওপর রাগ করে আমি মাটিতে ভাত খেতে যাব কেন? আমার ব্যবস্থা না করে তোমাদের আলাদা হওয়া চলবে না। ভরত সোজা দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল।

এসব কথা বছরখানেক আগেও বাবা-মাকে বলার কথা ও স্বপ্নেও ভাবতে পারত না। কলেজে ওঠার পর কিরকমভাবে সব পাল্টে গেল। কোথায় যাচ্ছে কেন যাচ্ছে না ভেবে ভরত হাঁটছিল। একটা লোক আলো জ্বালিয়ে ঠেলাগাড়িতে করে কুলপি মালাই বিক্রি করছিল। তাতে দেখে তেষ্টা পেয়ে গেল তার। লোকটার সামনে দুটো ছেলে দাঁড়িয়েছিল। ওকে আসতে দেখে দ্রুত সরে গেল তারা। তাদের দিকে ভাল করে লক্ষ্য না করে ভরত লোকটাকে জিজ্ঞাসা করল, স্পেশ্যাল আছে?

ছোটবেলায় মা তার সামনে স্পেশ্যাল কুলপি খেত। ঠাণ্ডা খেলে গলায় ব্যথা হয়ে জ্বর আসবে বলে তাকে দু-একবার চাটতে দিত। আজ মনে হল আসুক জ্বর সে তবু খাবে। লোকটা চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল।

ভরত ধমক দিয়ে বলল, কী হল? কানে কালা নাকি?

আপনাকে তো আগে কখনও নিতে দেখিনি।

দ্যাখোনি বলে বিক্রি করবে না নাকি?

একটু বেশি দাম পড়বে। পুলিশ খুব নজর রাখছে।

পুলিশ! ভরত হকচকিয়ে গেল। কুলপি মালাই-এর জন্যে পুলিশ কিছু বলে বলে সে জানে না। মা বলত মাঝে মাঝে ভাঙ মিশিয়ে দেয় এরা। ও কি তাই ভাবছে? ভরত জিজ্ঞাসা করল, কত?

চল্লিশ টাকা। মালের বড় টানাটানি যাচ্ছে এখন।

কোয়ালিটি আইসক্রিম এর চেয়ে অনেক সস্তায় পাওয়া যায়। লোকটা বলে কী? কিন্তু ভরতের জেদ চেপে গেল। ও চল্লিশটা টাকা বের করে লোকটার হাতে দিতেই চারপাশে নজর বুলিয়ে নিয়ে ঝুড়ির নিচ থেকে একটা কাগজে মোড়া বস্তু চট করে বের করল। এক টুকরো কুলপি শালপাতায় দিয়ে এগিয়ে ধরল লোকটা, নিন। দুটো ট্যাবলেট আছে। নতুন হলে একসঙ্গে খাবেন না।

শালপাতায় কুলপি নিতে গিয়ে আঙুলে মোড়কটা টের পেল ভরত। হঠাৎ তার শরীর শিরশির করে উঠল। কুলপির টুকরোটা মুখে তুলতে গিয়েও তুলতে পারল না সে।

এটা তা হলে ড্রাগ। কাগজে টিভি-তে ড্রাগের বিরুদ্ধে কত কি লেখা হয়েছে, প্রচার চলেছে। শিল্পী সাহিত্যিকরা ড্রাগবিরোধী মিছিলে হেঁটেছেন কত। ড্রাগের নেশা সর্বনাশা, একটা পরিবার একটা জাতিকে শেষ করে দেয়। অথচ শহরের পথে একটু আড়াল রেখে এখনও সমানে তা বিক্রি হয়ে চলেছে। লোকটা কি তাকে ড্রাগশোর ভেবেছে! একটু আগে চলে যাওয়া লোকদুটো তা হলে ড্রাগ কিনতে এসেছিল! ভরতের মনে হল এই সময় পুলিশ যদি তাকে ধরে তা হলে চূড়ান্ত বিপদে পড়বে। মারাদোনার ড্রাগ খাওয়ার অপরাধে শাস্তি হয়েছিল। কাপ্রিয়েতির বিচার। চলছে। পানামার এক্স-প্রেসিডেন্ট তো এখনও জেলে পচছে। কোনো কোনো দেশে ড্রাগ সমেত কাউকে ধরলে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়। কিন্তু এসব সত্ত্বেও ভরতের ইচ্ছে হচ্ছিল বস্তুটাকে চাক্ষুষ করতে। টি ভি-তে দেখেছে রাঙতার মধ্যে পুড়িয়ে হাতে ডলে সিগারেটের তামাক সঙ্গে মিশিয়ে টানতে। কিন্তু এই বস্তুটি কি রকম?

সে যখন বাড়ির গেটের সামনে পৌঁছে গেছে তখন হঠাৎ দুটো লোক উদয় হল, এক মিনিট!

ভরত হকচকিয়ে গেল। প্রথমে লোকদুটোকে সে চিনতেই পারল না।

আপনি যে আমাদের লাইনের তা জানতাম না তো।

লাইনের? গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল ভরতের।

নেশার কথা বলছি। কত নিল? চল্লিশ?

হ্যাঁ।

শালা রোজ দাম বাড়াচ্ছে। আমাদের মাল কম পড়ে গেছে। কুড়িটা টাকা ধার দেবেন? কাল ওর কাছে দিয়ে দেব!

আপনাদের আমি চিনি না, টাকা ধার দিতে যাব কেন?

এই তো চেনাচেনি হল। এ বাড়িতেই থাকেন? বাঃ। আমরা এখন একই লাইনের লোক। আপনার অভাব হলে আমরা দেখব, আমাদের প্রয়োজনে আপনি। দিনই ভাই, ছাতি ফেটে যাচ্ছে।

আমার কাছে আর টাকা নেই।

নেই? আপনি দেখছি বিশ্বাস করতে পারছেন না। আরে মশাই একবার যখন নেশা ধরেছে। তখন দেখা হবেই। আপনি ড্রাগ খান শুনলে পাবলিক ঘেন্না করবে, আমরা করব না। দিন।

বিশ্বাস করুন, সঙ্গে নেই।

দ্বিতীয় লোকটি বলল, তা হলে বাড়ি থেকে এনে দিন না। এত টানাটানি যাচ্ছে যে রোজ টাকার জোগাড় করতে পারি না।
 
ভরত খুব নার্ভাস হয়ে গেল। এই লোকদুটো ড্রাগ খায়। তার উচিত এদের পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেওয়া। তা হলে ওই কুলপিওয়ালাও ধরা পড়বে। কিন্তু সেটা করতে গেলে ওরা তাকে জড়িয়ে দেবে। মোড়টাকে সে পকেটে রেখেছিল। বের করে এদের দিয়ে দিলে কি নিষ্কৃতি পাবে? সে কাতরগলায় বলল, দেখুন, আমি কোনওদিন এই নেশা করিনি। আজ হঠাৎ লোকটা আমায় দিতে নিয়ে ফেলেছি।

চাঁদু! নিজের লোকের কাছে মিথ্যে বলে না। আগে খাওনি কিন্তু খেয়ে দ্যাখ সব ভুলে যাবে। যেদিকে তাকাও দেখবে দু নম্বরী চলছে। ভাল কাজ করে তুমি এই পৃথিবীতে বাঁচতে পারবে না। এই যে আমি বারো বছর আগে গ্র্যাজুয়েট হয়েছি আজও চাকরি পাইনি। শালার এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ থেকে একটা চিঠি পাইনি। সবাই শালা লাথি ঝাটা মারছে। এই যে ও, চাকরি নেই বলে ওর প্রেমিকা সটকে পড়েছে একজন মালদারের সঙ্গে। ওর বোন আটটা প্রেম করে আটজনের কাছ থেকেই সোনার হার আর দামী ঘড়ি বাগিয়ে নয় নম্বর খুঁজছে। এসব থেকে ভুলে থাকার বেস্ট রাস্তা হচ্ছে ড্রাগ খাওয়া। যান, নিয়ে আসুন, যাব আপনার সঙ্গে? লোকটা ব্যস্ত হলো।

না। আমি আসছি। ভরত দেখল দারোয়ান তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। লোকটার দিকে মাথা নেড়ে সে ভেতরে ঢুকল। ওদের চোখের আড়ালে আসতেই ওর পা থামল। এখন কী করা যায়? ওদের টাকা দেবে? সে যদি আর ফিরে না আসে তা হলে এই বিশাল হাউজিং থেকে তাকে খুঁজে নিশ্চয়ই বের করতে পারবে না ওরা। তারপরেই মনে হল দারোয়ানই তো হদিশ বলে দেবে। ওরা যদি বাড়িতে এসে ঝামেলা করে, বলে সে ট্যাবলেট কিনেছে?

ভরত ফিরে এল গেটের সামনে। তার সঙ্গেই টাকা ছিল। তা থেকে কুড়িটা টাকা দিয়ে আর দাঁড়াল না সে। হনহনিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।

দরজা খুলল মা। কোনো কথা না বলে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিল সে। মা বলল, খোকা!

এই ডাকটা অনেকদিন পরে শুনল। ফিরে দাঁড়াতেই মা বলল, তোর বাবা বলছিল ইচ্ছে হলে তুই হোস্টেলে থাকতে পারিস।

কথা না বলে নিজের ঘরে চলে এল সে। হোস্টেলে থাকতে পারিস! যে যার নিজের ব্যবস্থা করে নেবে আর তাকে থাকতে হবে হোস্টেলে! যেন হোস্টেলে গেলে সে খুব সুখে থাকবে! তার কেউ নেই, কেউ না। সুদেষ্ণা নেই, পারমিতা তাকে আই লাভ ইউ! বলা সত্ত্বেও আজ একবারও সামনে আসেনি। বাবা-মায়ের কথা ছেড়ে দিতে হবে। সে কী নিয়ে থাকবে? কাকে নিয়ে? যদি তার কোনও ভাই অথবা বোন থাকত তা হলে এই বিরাট পৃথিবীতে সে একা হয়ে যেত না। ওরা এত স্বার্থপর যে দ্বিতীয় সন্তানকে পৃথিবীতে আনতে চায়নি।

তোর কী হয়েছে? মায়ের গলা পেল সে।

কিছু হয়নি।

তুই আমাকে বুঝতে পারছিস না কেন?

তোমাকে?

হ্যাঁ, আমাকে। তোর বাবা ছেলে। যে কোন অডস-এর সঙ্গে ছেলেদের মানিয়ে নেওয়া অস্বাভাবিক নয় কিন্তু এখনও মেয়েদের পক্ষে সেটা সম্ভব হয়নি।

তোমরা স্বার্থপর।

তুই না বুঝে কথা বলছিস।

না। তোমরা দুজন নিজেদের ইগো নিয়ে রইলে, একবারও আমার কথা ভাবলে না। তোমরা এতদিন ধরে আমার জন্যে যা করেছ তা সবই নিজের স্বার্থে। আজ আমি স্বাবলম্বী হবার চেষ্টা করছি বলে আমার সম্পর্কে কোনও কথা শেষ না করে চিৎকার করে উঠল ভরত, গো অ্যাহেড। যা ইচ্ছে কর। আমি তোমাদের দয়ার ওপর নির্ভর করে থাকব না।

খোকা। আর পাঁচ কি ছয় বছর পরে তুই চাকরি করবি, তারপর বিয়ে করে সংসারী হবি। তখন আমার কাছ থেকে তোর কিছু চাওয়ার থাকবে না। তুই তোর নিজের জগৎ নিয়ে থাকবি। তখন আমি কী করব তা একবার ভেবেছিস? তোর বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কোনোকালেই আর ভাল হবে না। কেন হবে না তার ব্যাখ্যা তোকে দেব না আমি। তোর জন্যে এতকাল অপেক্ষা করেছি। এখন আমার শেষ সময়। আরও ছয় বছর অপেক্ষা যদি করতে হয় তোকে সংসারী দেখার জন্যে তা হলে আমার চারপাশে অন্ধকার থাকবে তখন। তুই কি সেইটে চাইছিস?

তুমি, তুমি কি আবার বিয়ে করবে?

জানি না। জানি না একা হয়ে গেলে আমি কী করব। তবে জীবন যেভাবে আমাকে চলতে বাধ্য করবে সেইভাবে চলব।

আই কান্ট আন্ডারস্ট্যান্ড মা। বাবার সঙ্গে তোমার যে ঘটনা ঘটেছে তা দ্বিতীয়বার বিয়ে করলেও ঘটতে পারে। পারে না?
 
আমি কিছু ভাবিনি। আমি শুধু মুক্তি চাই। আমার নিজের আইডেন্টিটি নিয়ে বাঁচতে চাই। তুই তোর স্বার্থ দেখে আমাকে নিঃশেষ করে দিলে আমি কী নিয়ে বাঁচব? তোর বাবার সঙ্গে আমার রক্তের সম্পর্ক নেই, ওই অর্জিত সম্পর্ক ইচ্ছে করলে ভেঙে ফেলা যায়। কিন্তু তোর সঙ্গে আমার সম্পর্ক রক্তের। একে ভাঙা যায় না, মোছা যায় না। তোর মুখ চেয়ে আমাকে যদি সব হজম করতে হয় তা হলে সন্তানরাই যে বাঙালি মায়েদের প্রধান শত্রু তা আর একবার প্রমাণিত হবে।

সন্তানরা শত্রু?

কথাটা নিষ্ঠুর হলেও সত্যি। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে মায়েরা সব কিছু মুখ বুজে মেনে নেয় শুধু সন্তানের জন্যে। যাকে পেটে ধরে একটু একটু করে বড় করেছে তার ভাল চেয়ে নিজের স্বার্থ বিসর্জন দেয়। কিন্তু বড় হয়ে সন্তান আর মায়ের কথা ভাবে না। তার নিজস্ব জগতে কোথাও মায়ের জায়গা নেই। এ সেই কাকড়ার বাচ্চাদের মতো যারা ডিম ফুটে বেরিয়ে এসে মায়ের শরীরের রক্তমাংস খেয়ে বড় হয়। একসময় মা কাঁকড়া কঙ্কাল হয়ে গেলে বাচ্চাগুলো বাইরের পৃথিবীর দিকে পা বাড়ায়। মায়ের গলায় কান্না ছিটকে এসেছিল। দ্রুত চলে গেল মা চোখের আড়াল থেকে।

কিছুক্ষণ বসে রইল ভরত। তারপর ধীরে ধীরে বাবার ঘরে এল সে। বাবা চুপচাপ শুয়েছিল খাটে, চোখে হাত চাপা দিয়ে। ভরত ডাকল, বাবা!

বাবা হাত সরিয়ে তাকে দেখল।

তোমার এসব ভাল লাগছে?

কারও লাগার কথা নয়।

কিছু করতে পার না তুমি?

আমি হেল্পলেস।

আশ্চর্য! হেল্পলেস! তোমার এত ক্ষমতা, একদিন গর্ব করে বলেছিলে বাঘের দুধও এনে দিতে পার, বলেছিলে টাকা থাকলে কলকাতায় সব করা যায় আর এখন বলছ হেল্পলেস? ফোঁস করে উঠল ভরত।

ভরত!

মা নিজেকে কেন বঞ্চিত মনে করে? কেন তোমাদের সম্পর্ক খারাপ? এত বছর ধরে কেন তোমাদের মধ্যে একটুও বোঝাপড়া হয়নি? এ সবকিছুর কারণ তুমি জানো। সেগুলোকে সংশোধন করতে পারনি?

বাবা উঠল। কাচের গ্লাসে জল ঢাকা দেওয়া ছিল। কলম খুলে তার ভেতরে কয়েকফোঁটা কালি ছড়িয়ে দিয়ে গ্লাসটা আলোর সামনে ধরল। ভরত দেখল কালির ফোঁটাগুলো জলের ভেতর ঢুকে আস্তে আস্তে মিশে যাচ্ছে। শেষপর্যন্ত জলের রঙ পাল্টে গেল। বাবা গ্লাসটা ধরে রেখে বলল, এখন ওই কালিটাকে জল থেকে আলাদা করা কি সম্ভব? সম্ভব নয়। জলটাকে ফুটিয়ে বাষ্প করে আবার নতুন জল পেতে পারিস কিন্তু কালিটাকে পাবি না। তখনও মনে হবে ওই জলে কালি মিশেছিল, হয়তো এখনও চরিত্র বদলে আছে।

তা হলে দুজন মানুষ সারাজীবন একসঙ্গে থাকে কী করে?

আমি জানি না। বেশিরভাগ মানুষ সহ্য করতে করতে সমস্ত বোধ মেরে ফেলে অসাড় হয়ে থাকে। কারও প্রবল ইচ্ছে সত্ত্বেও উপায় থাকে না বলে থাকে।

অতীতে যা হবার হয়েছে কিন্তু তুমি কি পার না ভবিষ্যতে অন্যজীবন তৈরি করতে?

ভবিষ্যৎ তো অতীতের ভিতেই দাঁড়িয়ে থাকবে।

তা হলে তোমার বন্ধুরা যখন আসত, মা তাদের ফ্রাই ভেজে দিত, হাসিঠাট্টা করত, সেটা কি শুধুই অভিনয় ছিল?

হ্যাঁ। তাই এজন্যে আমি ওর কাছে কৃতজ্ঞ।

তা হলে তোমার প্রমোশনের জন্যে মা ওই শ্রমিক নেতাকে তেল দিতে গেল কেন?

প্রমোশন না পেলে আলাদা ফ্ল্যাট অফিস থেকে দিত না। ওই ফ্ল্যাট পাওয়া খুব জরুরি ছিল। আমার ভাল লাগেনি কিন্তু মেনে নিতে হয়েছে।

আমার তো অনেক কিছু ভাল লাগছে না। রাস্তায় পুলিশ প্রকাশ্যে ঘুষ নিচ্ছে, সি.এমের কোটায় বাজে ছেলেমেয়ে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পাচ্ছে, পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র পেয়ে যাচ্ছে। ইনফ্লুয়েন্সিয়াল নেতার ছেলেমেয়ে, নাম্বারটা তাদের ইচ্ছেমতো দেওয়া হচ্ছে, প্রকাশ্যে একজন মহিলাকে নগ্ন করার অপরাধে অপরাধীও বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, মন্ত্রীর বাড়িতে অপরাধীকে ধরতে গিয়ে পুলিশ অফিসার সাসপেন্ড হচ্ছে, এসব মেনে থাকতে পারি তা হলে তোমরা পরস্পরকে মেনে নিতে পার না কেন? ভরত ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

.
 

Users who are viewing this thread

Back
Top