What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected স্বনামধন্য - সমরেশ মজুমদার (2 Viewers)

বাস থেকে নেমে ওরা হাঁটছিল। জায়গাটায় ভাল ভিড়। স্কুলের বাচ্চারা যাচ্ছে। হঠাৎ একটা অ্যাম্বাসাডার গাড়িকে দ্রুতগতিতে আসতে দেখল সে। গাড়ির শরীর থেকে গলগল করে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে। বাচ্চাগুলো নাকমুখ চেপে কুঁকড়ে গেল সেই ধোঁয়ায়। এই দৃশ্য কলকাতার রাস্তায় অত্যন্ত স্বাভাবিক। ট্যাক্সি, মিনিবাস এবং বাসের ড্রাইভাররা এইভাবে কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে যাচ্ছে শহরে কিন্তু কেউ কিছু বলে না। হঠাৎ মাথার ভেতর সেই আগুনটা জ্বলে উঠতেই ভরত তাকিয়ে রাস্তায় নেমে দুহাত ছড়িয়ে গাড়িটাকে থামতে বলল। গাড়ি গতিতে ছিল, ফলে ড্রাইভারকে আচমকা ব্রেক কষতে হলো। গাড়ি থামিয়ে লোকটা গালগাল দিল।

ভরত ছুটে গেল পাশে, কী বললেন আপনি?

এইভাবে লাফিয়ে পড়লেন কেন? অ্যাকসিডেন্ট হলে তো লোকে আমাকে ছাড়ত না।

আপনি গাড়ি থেকে নামুন।

কেন? নামব কেন?

আপনার গাড়ি থেকে যে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে তা ওই বাচ্চাদের ফুসফুস নষ্ট করছে, শহরটারও বারোটা বাজাচ্ছে। একথা আপনি জানেন?

ও এই কথা! ডিজেল গাড়ি থেকে ধোঁয়া বের হবেই।

তার মানে? সব ডিজেল গাড়ি থেকে এইরকম ধোঁয়া বের হয়?

নতুন ইঞ্জিন, ভাল ইঞ্জিন হলে বের হয় না। পুরনো হয়ে গেলে হবে।

তাহলে ইঞ্জিন সারান না কেন?

মালিককে গিয়ে বলুন সেকথা। আমি ড্রাইভার!

বাঃ, আপনি গাড়ি চালাচ্ছেন, আপনি বলবেন না?

মালিক অন্ধ নন। তিনি জানেন। আরে মশাই, সমস্ত কলকাতার লোক ডিজেলের ধোঁয়া মেনে নিয়েছে আর আপনি এসে নাটক করছেন!

ঠিক আছে। ব্যাপারটার ফয়সালা থানায় গিয়ে হবে। থানায় চলুন।

ইয়ার্কি! থানায় যাব কেন?

ভিড় জমে গিয়েছিল। ভরত খুশি হল জনতা তাকে সমর্থন করছে দেখে। কলকাতার আবহাওয়া বিষাক্ত করার জন্য মোটরওয়ালাদের বড় অংশ দায়ী একথা অনেকেই বলতে লাগল ড্রাইভার বেশ ঘাবড়ে গেল কথাবার্তা শুনে। বলল, দাদা, আমার কোনও দোষ নেই। আমি মাইনে নিয়ে গাড়ি চালাই। মালিক যদি গাড়ি না সারায় তাহলে আমি কী করব?

আপনি থানায় চলুন। ভদ্রভাবে বলছি।

এইসময় একটা পুলিশ ভ্যান হাজির হলো। একজন সাবইন্সপেক্ট এগিয়ে এলেন, কী হয়েছে এখানে, ভীড় কেন?

ভরত উৎসাহিত হলো, এই লোকটির গাড়ি থেকে অবিরত কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে। দূষণ করার অপরাধে আপনি এর বিরুদ্ধে স্টেপ নিন।

ড্রাইভার বলল, সার, আমার কোনও দোষ নেই।

কার গাড়ি? অফিসার জানতে চাইলেন।

হরিরাম মেহতা।

চলুন থানায়। গাড়ি রেখে মালিককে ডেকে পাঠাবেন।

স্যার!

কথা বাড়াবেন না। এঁরা যখন বলছেন তখন থানায় যেতে হবেই। পশন ফ্রি সার্টিফিকেট আছে? কবে চেক-আপ করেছেন?
 
গত সপ্তাহে। ড্রাইভারের খেয়াল হতে দ্রুত গাড়ির ড্রয়ার থেকে একটা কাগজ বের করে অফিসারের হাতে তুলে দিল। অফিসার সেটাকে পরীক্ষা করে মাথা নাড়লেন, নো৷

ভরত জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে?

অফিসার বললেন, এই সার্টিফিকেট অনুযায়ী ওই গাড়ির বিরুদ্ধে অমি কোনও ব্যবস্থা নিতে পারি না। ওকে বলতে পারি আর একবার গ্যারেজে নিয়ে যেতে। কিন্তু এই সার্টিফিকেট এখনও অনেকদিন গাড়িটাকে নির্দোষ বলছে। বুঝতেই পারছেন সাত দিন আগে যদি পরীক্ষা করা হত তাহলে এই সার্টিফিকেট কেউ দিত না। অথচ এরা সাত দিন আগেই সার্টিফিকেট পেয়েছে। সম্ভবত গাড়ি পরীক্ষা না করিয়েই পেয়েছে। কলকাতায় এখন এটা হচ্ছে।

ভরত বলল, আপনি ওকে স্টার্ট নিতে বলুন দেখবেন গলগল করে ধোঁয়া বের হচ্ছে।

আমার কিছু করার নেই ভাই। সার্টিফিকেট ফিরিয়ে দিয়ে ভ্যানে উঠে বসলেন অফিসার। ভ্যান চলতে শুরু করতেই ড্রাইভার চেঁচিয়ে উঠল, ওই দেখুন, পুলিশের ভ্যান থেকেই ধোঁয়া বের হচ্ছে। ধরতে হলে ওদেরও ধরুন।

পুলিশ ভ্যান থেকেও ধোঁয়া বের হচ্ছিল কিন্তু অল্প বেরিয়েই বন্ধ হয়ে গেল। ওই দিকে সবার মনোযোগ থাকায় ড্রাইভার গাড়ি চালু করে এগোতেই বলব বলব করেও কেউ কিছু বলতে পারল না। আবার ধোঁয়ায় কলুষিত হল কলকাতা।

এই গাড়িকে যারা দূষণমুক্ত সার্টিফিকেট দিয়েছে তারা কলকাতার হত্যাকারী। ভরত ভেবে পাচ্ছিল না টাকা দিয়ে যদি সার্টিফিকেট কেনা যায় তাহলে ওই নিয়মটা রাখার কী দরকার? সে মাথা নিচু করে ফিরে এল সুদেষ্ণার কাছে।

সুদেষ্ণা এতক্ষণ চুপচাপ দেখে যাচ্ছিল। ভরত বলল, দেখলে?

ওর গলায় এমন কিছু ছিল যে সুদেষ্ণার খারাপ লাগল, আমি তোমার আগে কাউকে এভাবে প্রতিবাদ করতে দেখিনি।

কী লাভ হল। সবাই একটা না একটা অজুহাত পকেটে পুরে রাস্তায় বের হয়। যদি গভর্নমেন্ট কিছু না করে তাহলে সাধারণ মানুষ এইভাবে খতম হয়ে যাবে। ভরত বলল, দেখেশুনে আমার মাথায় রক্ত চড়ে যায়।

হাঁটতে হাঁটতে সুদেষ্ণা বলল, এই যে তুমি প্রতিবাদ করলে এর নিশ্চয়ই দাম আছে।

দাম আছে? লোকটা আবার ধোঁয়া ছড়াল?

হ্যাঁ। কিন্তু অতগুলো লোক জানল এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা যায়। এরপর এদের কেউ কেউ নিশ্চয়ই সেটা করবে। পাড়ায় গিয়ে গল্প করবে আজকের ঘটনা নিয়ে। আর ওই ড্রাইভার তার মালিককে নিশ্চয়ই রিপোর্ট করবে। লোকটা ভাববে গাড়িটাকে সারাবার কথা।

এসব আশাবাদের কথা।

আমি এখনও আশাবাদী।

.

গেটওয়ালা বাড়ির ভেতরে বাঁধানো চাতাল। ভরত দেখল এবং বুঝল সুদেষ্ণারা বেশ অবস্থাপন্ন। দোতলায় যে হলঘরটিতে তাকে বসানো হলো সেটি মূল্যবান আসবাবে সাজানো। এই ঘরের সঙ্গে ফ্ল্যাটবাড়ির বড়লোকি ড্রইংরুমের তফাত অনেক। এই ঘরের আসবাবের কিউরিও ভ্যালু প্রচুর। অভিজাত বাড়ির আবহাওয়া সর্বত্র।

সুদেষ্ণা বলল, আগে বাবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই এসো।

আমি যাব?

হ্যাঁ। বাবা এখন তার স্টাডিতে। খুব কুঁড়ে, এখানে আসবে না। সুদেষ্ণা বলল, নাকি চা খেয়ে তারপর যাবে?

ভরত গম্ভীর মুখে বলল, আমার বাবাদের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে না।

ওমা, কেন?

আমার দেখা বাবাশ্রেণির মানুষগুলো হিপোক্রিট হয়।

অর্থাৎ।

নিজেরা যা করেনি, নিজে যা বিশ্বাস করে না তাই করতে জ্ঞান দেয় ওরা।

বেশ তো! এই নিয়েই কথা বলা যেতে পারে। এসো।
 
সুদেষ্ণা যে ঘরে নিয়ে গেল সেই ঘরে প্রচুর বই। আলমারির বাইরে মেঝের ওপরও তারা স্কুপ হয়ে পড়ে আছে। একজন প্রৌঢ় মোটাসোটা ফরসা মানুষ, চোখে চশমা, পরনে গেঞ্জি আর পাজামা, বাবু হয়ে বসে একটা বই-এর পাতা ওল্টাচ্ছিলেন। সুদেষ্ণা ডাকতেই মুখ না ফিরিয়ে বললেন, আজকের মতো অভিযান শেষ?

হ্যাঁ।

গাড়ি নিয়ে যাওনি?

না।

গুড। তোমার মাতৃদেবী কোর্ট মার্শাল করবেন। তৈরি থেকো।

বাবা, এর নাম ভরত।

ভদ্রলোক মুখ ফেরালেন, ইন্টারেস্টিং। হাঁটু মুড়ে বসতে পারবে? তাহলে ওখানে বসে পড়। পড়। ভরত। বঙ্গসন্তান?

হ্যাঁ ভরত বসে পড়েছিল।

এই নামটি বাঙালিদের পছন্দ নয়। ইন ফ্যাক্ট রামায়ণের পুরুষ চরিত্রের নামগুলো বাঙালি কোনওকালে গ্রহণ করেনি। এককালে রামচন্দ্রকে সামান্য নিয়েছিল কিন্তু দশরথ, লক্ষণ, শত্রুঘ্ন বা বিশ্বামিত্র তো নয়ই। গত তিরিশ বছরে রামচন্দ্রকেও বাতিল করেছে। তাদের ঝোঁক মহাভারতের পুরুষচরিত্রের প্রতি। মেয়েদের বেলাতে অতটা নয়, যেমন সরমা ঊর্মিলা তো আছেই, একসময় সীতা খুব চালু ছিল। কিন্তু মহাভারতের মেয়েরা বাঙালি পরিবারে ছড়িয়ে আছে। ভদ্রলোক বললেন, রামায়ণের পুরুষের নামগুলো ইউ পি বিহারে খুব চালু তাই তুমি বঙ্গসন্তান কি না। প্রশ্ন করেছিলাম। নিজেকে ভরত ভাবতে তোমার কেমন লাগে?

ভাল। কারণ আমার নাম ভরত।

আমি রামায়ণের ভরতের কথা বলছি!

তার কথা আমোক ভাবতে যাব কেন? জ্ঞান হবার পর শুনে আসছি আমার নাম ভরত। অন্য কিছু শুনলে সেটাকে মেনে নিতাম, ভাল লাগাতাম।

তার মানে তোমার নিজস্ব কোনো ভাবনা নেই?

ভরত প্রৌঢ়ের দিকে তাকাল, আপনি শুনতে চান বলতে পারি।

নিশ্চয়ই।

দেখুন আমি নিজের ইচ্ছেতে পৃথিবীতে আসিনি, বাবা-মাকে পছন্দ করার কোনও সুযোগ আমি পাইনি। কোনও মানুষই পায় না। এটা মেনে নিতে হয়। শৈশব এবং বাল্যকালে স্কুলে এবং বাড়িতে আমাকে যা পড়তে বলা হয়েছিল আমি পড়েছি, মেনে নিয়েই পড়েছি। করার পর বাবা-মা চেয়েছিলেন আমি ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হই, ওই প্রথম আমি মেনে নিইনি। কিন্তু বাইরে বেরিয়ে দেখলাম আমি এক দারুণ সুবিধেবাদী স্বার্থপর মানবসমাজে বাস করছি যা চারপাশে মানুষেরা চুপচাপ মেনে নিয়েছে। এই ধান্দাবাজ জীবনযাপনের বিরুদ্ধে একা লড়াই করতে গেলে প্রতি পায়ে ঠোকর খেতে হবে। কিছু কিছু জায়গায় প্রতিবাদ করতে গিয়ে আমি হাস্যাস্পদ হয়েছি। আমার নিজস্ব ভাবনা এক্ষেত্রে শুধু দুঃখ বাড়াচ্ছে।

যেমন?

কোনটে বাদ দিয়ে কোনটে বলব? ধরুন, একটি রাজনৈতিক দল তাদের আদর্শের কথা বলে কংগ্রেস বিরোধিতা করে দেশের মানুষের কাছে ভোট চাইল। মানুষ তাদের সমর্থন করল। সেই দলের কাছে কংগ্রেস থেকে সরে আসা এক সুবিধেবাদী সমর্থন চাইল রাজ্যসভায় যাবে বলে। অবাক হয়ে দেখলাম গণতান্ত্রিক দলটি লোকটাকে সমর্থন করল। নির্বাচিত হবার কিছুদিন পরে ওই সুবিধেবাদী আবার কংগ্রেসে ঢুকে গেল। দেশের মানুষের প্রশ্ন করার কোনো অধিকার নেই কেন তোমরা ওই সুবিধেবাদীর চরিত্র জেনেও সমর্থন করলে। তোমাদের সমর্থন কি আমাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা নয়?

তুমি কি রাজনীতি কর?

না। ধান্দাবাজ ছাড়া এদেশে কেউ রাজনীতি করতে পারে না।

তাহলে দেশের দায়িত্ব ধান্দাবাজদের হাতে ছেড়ে দিতে চাও তুমি?

আমি চাই বা না চাই সেটাই হচ্ছে।

তোমার কথার উত্তরে বলছি, সত্যিকারের ভাল ছেলে, যারা দেশের মঙ্গল চায় তারা যদি রাজনীতি করে তাহলে ধান্দাবাজরা সরে যেতে বাধ্য হবে।
 
ভরত ভদ্রলোকের দিকে তাকাল। সুদেষ্ণার বাবা হাসলেন, বিধানচন্দ্র রায়কে কেউ ধান্দাবাজ বলতে পারত না। এমন কি জ্যোতি বসুর বিরুদ্ধে যে অভিযোগই থাকুক না কেন তাকে ধান্দাবাজ বলা চলবে না। তুমি পরের সারির অথবা নিচের দিকের কিছু নেতা সম্পর্কে ওই কথা বলতে পার। কংগ্রেসিদের যে চেহারা আমরা কাগজে দেখতে পাই তা যদি সত্যি হয় তাহলে ওই গালাগাল তাদের প্রাপ্য। কিন্তু কিছু ভাল মানুষ কংগ্রেসেও আছেন। বলতে পার সংখ্যায় কম।

ভরত বলল, তারা কিছুই করতে পারবেন না। দল তাদের জগন্নাথ করে রেখে দিয়েছে। এদেশে গণতন্ত্র বলে কিছু নেই। যার হাতে টাকা আছে সে সব কিছু দখল করে বসে আছে। একজন কৃষকের জমি কেড়ে নিলে সে আদালতে যেতে পারবে না টাকার অভাবে। শাসক দলের সদস্য না হলে পার্টি অফিস তাকে সমর্থন করবে না। এই গণতান্ত্রিক দেশের ভোটার ওই কৃষক।

তাহলে তোমার সমস্ত ক্রোধ শাসক রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে?

না। মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ রাজনৈতিক দলগুলো। যদি আজ পশ্চিমবাংলার সবকটা বিধানসভার আসনে প্রকৃত দেশপ্রেমিক প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়ে কোনও নতুন দল সুস্থ পরিবেশ তৈরি করতে চায় তাহলে জনসাধারণ তাদের সমর্থন করবে না। কারণ তারাও জেনে গিয়েছে ভালমানুষির স্থান রাজনীতিতে নেই। আদর্শবাদী দল ক্ষমতায় এলে তাদের নিজেদেরই অসুবিধে হবে।

যেমন?

ধরুন, কলকাতার একটি লোকের রেশন কার্ড আছে। কিন্তু সে চাল নেবে না কিন্তু রেশন থেকে চিনি নেবে। কারণ রেশনের চাল খেতে তার ভাল লাগে না তাই বেশি দামে বাজার থেকে ভাল চাল কিনবে। কিন্তু বাজার থেকে চিনি কিনবে না কারণ রেশনে একই চিনি সস্তায় পাওয়া যায়। ওই যে সুবিধেবাদী চরিত্র সর্বত্র। কোন সরকার যদি বলে কার্ডে যা যা পাওয়া যায় তাই নিতে হবে নইলে চিনি দেওয়া হবে না তাহলে সেই সরকারকে অত্যন্ত অপছন্দ করবে মানুষ।

তুমি এসব নিয়ে খুব ভাবো?

খুব ভাবি না। তবে চোখ খুললেই যা দেখি তাতে এসব ভাবনা আপনা-আপনি আসে। আমাদের সঙ্গে একটি ছেলে পড়ে। সে মাঝারি ছাত্র ছিল। পঞ্চাশ বাহান্ন পেত। পরীক্ষার সময় একটি রাজনৈতিক দলের সৌজন্যে ওদের পরীক্ষাকেন্দ্রে গণটোকাটুকি হল। ছেলেটি আশি নম্বর পেয়ে গেছে অনায়াসে। সারাবছর খেটে ওর চেয়ে ভাল ছাত্র ওই নম্বর পায়নি। একে সবাই মেনে নিচ্ছে। আমার মানতে কষ্ট হয় কিন্তু কিছুই করার উপায় নেই।

এসবের জন্যে দায়ী কে?

ভরত ভদ্রলোককে দেখল, আপনারা।

কী রকম? একটুও অবাক হলেন না সুদেষ্ণার বাবা।

আপনাদের মেরুদণ্ডহীনতায় স্বাধীনতা সম্পর্কে উদাসীনতাই দেশটাকে এরকম ধান্দাবাজ করে তুলেছে। আপনারাই বাধ্য করেছেন আমাদের বেঁচে থাকতে হলে ধান্দাবাজ হতে। নিজের স্বার্থ ছাড়া আপনারা কোন চিন্তাই করেননি। তারই পরিণতিতে আজ এই অবস্থা। মুশকিল হলো, আশেপাশের কাউকেই আমরা এখন শ্রদ্ধা করতে পারি না। কেউ ভাল কিছু করছে দেখলে ভাবি এর পেছনে মতলব আছে।
 
তুমি ঠিকই বলেছ। আমরাই দায়ী। তোমাদের সামনে আমরা কোনও ভাল ছবি রাখতে পারিনি। আমরা ছেলেবেলায় অনেক বড়বড় কথা বইতে পড়তাম। গুরুজনরা বলতেন আদর্শবান হতে। অন্যায়কে অন্যায় বলতে। রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে ঈশ্বর। বাপ ঠাকুর্দা যখন বলতেন বাঙালির ঐতিহ্য আছে, সংস্কৃতি আছে তখন সেটাকে বিশ্বাস করতাম। বয়স্করা অন্যায় কিছু বললে তার মুখের ওপর প্রতিবাদ করতাম না কারণ তাতে তাকে অপমান করা হত। আমরা কুষ্ঠি বিচার করে ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিতাম, তাদের কোয়ালিটি বিচার করতাম না। আমার ছেলের হাঁপানি থাকলেও বিয়ে দেবার সময় সুস্থ সুলক্ষণা মেয়ে খুঁজতাম যার ভাগ্য আমার ছেলের অসুখ সারাবে। তার পরিণতিতে যা হবার তাই হয়েছে। কিন্তু, এই দেশ আমাদের দেশ। এখানেই আমাদের বাস করতে হবে। আমি তুমি যা করতে পারব না সময় তা পারবে। অন্যায়ের ছুরির কোনও বাঁট থাকে না, যাকে মারে সে যেমন আহত হয় যে মারে তার হাতও রক্তাক্ত হয়। এই ব্যবস্থা তাই চিরদিন চলতে পারে না।

আপনি আশার কথা বলছেন।

হ্যাঁ। কারণ আশা ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। সুদেষ্ণার বাবা হাসলেন, তোমার সঙ্গে কথা বলে আমার ভাল লাগল। তোমাকে কি মাঝে মাঝে আশা করতে পারি?

ভরতের খেয়াল হলো, এই প্রথম কোন বয়স্ক লোক তার সান্নিধ্য চাইছেন, এই প্রথম কোনও অভিভাবক তার ক্রোধের কথাগুলো মন দিয়ে শুনলেন।

সে বলল, আসব। আচ্ছা, সুদেষ্ণাকে আপনার কী রকম মনে হয়?

সুদেষ্ণা এতক্ষণ চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল, চমকে উঠে বলল, আরে। আবার আমাকে কেন?

তোমার কীরকম মনে হয়? সুদেষ্ণার বাবা জিজ্ঞাসা করলেন।

ওর সম্পর্কে আমার ভাল ধারণা ছিল না। বড়লোকের মেয়ে, গাড়িতে করে যাতায়াত করে, একগাদা ছেলে বন্ধু, জীবন সম্পর্কে উদাসীন বলেই মনে হত।

মনে হত? এখন হচ্ছে না?

পুরোটা নয়।

ভদ্রলোক হাসলেন, বড়লোকের মেয়ে হওয়া কারও ইচ্ছের ওপর নির্ভর করে না। আমার পারিবারিক সূত্রে প্রচুর সম্পত্তি আছে। কিন্তু একটাই খরচ আমার, সেটা এই বইপত্তর কেনা। ফলে টাকা রয়েই যাচ্ছে। ওর মা অবশ্য ওসব দ্যাখেন। সুদেষ্ণা আমাদের মেয়ে এটা ওর অপরাধ নয়। আমাদের দুটো গাড়ি আছে। তার একটা নিয়ে সে যেতেই পারে। বাড়িতে গাড়ি থাকতে ভিড় বাসে কলেজে যাওয়ার মধ্যে বৈপ্লবিক কিছু দেখানোর চেষ্টা থাকতে পারে কিন্তু সেটা নিছকই বোকামি। আর ছেলে বন্ধু? কলেজে পড়ছে ও। একগাদা মেয়ের সঙ্গে যেমন বন্ধুত্ব হতে পারে তেমনি এক রাশ ছেলের সঙ্গেও। তাদের কথা আমি ওর মুখে শুনেছি কিন্তু কাউকেই চোখে দেখিনি। একমাত্র তোমাকেই ও প্রথম আমার কাছে নিয়ে এল।

সুদেষ্ণা বলল, তুমি এতক্ষণ যেসব প্রতিবাদের কথা বললে তার সঙ্গে এই মন্তব্যটা মিলছে না।

কোনটা? ভরত জিজ্ঞাসা করল।

তোমার মতো ছেলে ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব খারাপ চোখে দেখবে কেন?

আমি দেখিনি। তোমার কথা মাকে বলেছিলাম, তিনি বিরূপ মন্তব্য করেছেন। ছেলেদের সঙ্গে তোমার মেলামেশা নিয়ে কলেজে অনেকেই বাজে কথা বলে।

সুদেষ্ণা বলল, এদেশে বঞ্চিতরাই চিরকাল নিন্দুক হয়।

বঞ্চিত?

হ্যাঁ। যেসব ছেলের সঙ্গে আমি কথা বলি না তারা যেমন আমাকে অপছন্দ করে তেমনি যেসব মেয়ে ছেলেদের সঙ্গে মিশতে পারে না তারাও ওই একই গোত্রের। তুমি কি ওদের দলে?

না। আমি প্রচলিত ধারণার কথা বলেছি এবং এ জন্যে ক্ষমাপ্রার্থী।

তুমি আর একদিন আমাকে অপমান করেছিলে!

সেদিন আমার মেজাজ ঠিক ছিল না। পরে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ হয়নি।

এখন চাও।

বেশ। ক্ষমা চাইছি।

সুদেষ্ণা এবং তার বাবা একইসঙ্গে হেসে উঠলেন।
 
সুদেষ্ণার বাবা বললেন, দ্যাখো ভরত, এইসব যা তুমি বললে তা তোমার মনে থাক, সেইমত নিজের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করো কিন্তু এর কারণে হতাশায় ভেঙে পড়ো না। খোঁজ নিলে দেখবে তোমার মতো ভাবছে এমন অনেক মানুষ দেশে আছে। সংখ্যা বাড়লে দেশেরই মঙ্গল। হ্যাঁরে, ওকে চা দিয়েছিস?

না। আসামাত্রই এখানে এসেছি। চলো। সুদেষ্ণা ইশারা করল।

ওরা বাইরের ঘরে ফিরে এল।

সুদেষ্ণা জিজ্ঞাসা করল, আমার বাবাকে কি তোমার হিপোক্রিট বলে মনে হলো?

বুঝতে পারলাম না। এককথায় হ্যাঁ বা না বলতে পারছি না।

খারাপ দেখে দেখে তুমি আর সহজ নেই।

কি জানি। হয়তো। মাঝে মাঝে নিজেকে নিয়ে তাই ফাঁপরে পড়ি খুব।

চেষ্টা করো, দেখবে সহজ হয়ে যাবে।

চেষ্টা করে সহজ হওয়া যায়?

সুদেষ্ণা মাথা নেড়ে ভেতরে চলে গেল। সম্ভবত খাবার আনতে গেল। ভরত ওর বাবার কথা ভাবল। একটা মানুষ শুধু বইপত্র নিয়ে গোটাজীবন পড়ে আছেন। আশ্চর্য! নিজের বাবার সঙ্গে ওই মানুষটার পার্থক্যগুলো সে চিন্তা করছিল।

আপনি?

মহিলা কণ্ঠ শুনে সে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। একজন সুন্দরী মধ্যবয়সিনী সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। বিদেশি সুগন্ধে ছেয়ে আছেন তিনি। পরনের পোশাক অত্যন্ত রুচিসম্মত। কিন্তু তাতে বয়সের ছাপ বিন্দুমাত্র নেই।

আমি সুদেষ্ণার সঙ্গে পড়ি।

আচ্ছা! ওর সঙ্গে এসেছেন?

হ্যাঁ।

কই, কেউ বলেনি তো আমাকে! ভদ্রমহিলা চারপাশে এমন ভঙ্গিতে তাকালেন যেন চারপাশে দাঁড়ানো অনুগতদের অনুযোগ জানাচ্ছেন। যদিও এঘরে কেউ নেই।

একথার কী জবাব হয় না বুঝে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতো ভরত।

বসুন। সুদেষ্ণা আমার মেয়ে।

ও। নমস্কার। হাতজোড় করল ভরত।

মাথা নাড়লেন ভদ্রমহিলা। ভরত বসলে উল্টোদিকের সোফায় বসলেন।

কতক্ষণ এসেছেন?

এই আপনি সম্বোধন কানে লাগছিল কিন্তু প্রতিবাদ করল না ভরত, অনেকক্ষণ। ওর বাবার সঙ্গে কথা বলছিলাম।

উনি এখানে এসেছিলেন?

না। ওঁর স্টাডিরুমে গিয়েছিলাম।

তাই? ভদ্রমহিলাকে একটু আনমনা দেখাল, কোথায় থাকো?

ভরত জবাব দিল।

বাবা কী করেন?

চাকরি।

মা?

বাড়িতেই আছেন।

নিজের বাড়ি?

না। ফ্ল্যাট।

এইসময় সুদেষ্ণা এল ঘরে, তোমাদের আলাপ হয়ে গেছে দেখছি। মা, ভরত একটু অন্য ধরনের ছেলে। টিউশনি করে নিজের খরচ চালায়। বাড়ি থেকে টাকা নেয় না।

সেকি? কেন? ভদ্রমহিলা আঁতকে উঠলেন।

ভরত হাসল, কোনও জবাব দিল না। কথা বলতে গেলে তো অনেক কথা বলতে হয়!

তোমার বাবা নিশ্চয়ই ভাল অবস্থায় আছেন?

অবশ্যই।

তিনি আপত্তি করেন না?

করেছিলেন। আমি বুঝিয়ে বলতে মেনে নিয়েছেন।

টাকা না নেবার পক্ষে কী যুক্তি দিয়েছিলে?

যেহেতু ওঁর কাজকর্ম আমি সমর্থন করি না তাই ওঁর টাকা আমি নিতে পারি না।

কী কাজকর্ম?

এইসময় সুদেষ্ণা বলে উঠল, ওমা! তুমি ভরতের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা বলছ। লিভ ইট! তুমি কি কোথাও বেরুচ্ছ?
 
ভদ্রমহিলা একদৃষ্টিতে ভরতের দিকে তাকিয়েছিলেন। যেন অদ্ভুত কিছু দেখতে পেয়েছে। নীরবে মাথা নেড়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি নিশ্চয়ই রাজনীতি কর?

আজ্ঞে না।

ভদ্রমহিলা উঠে দাঁড়ালেন, আমি তোমাকে বুঝতে পারছি না। হয়তো সুদেষ্ণার বাবা ভাল বুঝবেন। মেয়ের দিকে তাকালেন, মিসেস বোসের বাড়িতে যাচ্ছি। নটার মধ্যে ফিরব।

ভরতকে তোমার পছন্দ হয়নি, না?

পছন্দ? কী ব্যাপারে পছন্দ?

আমার বন্ধু হিসেবে।

তুমি কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে সেটা এখন তুমিই ঠিক করবে। তবে এই বয়সে বাপমাপের অবাধ্য হওয়া আমি সহ্য করতে পারি না। ভদ্রমহিলা বেরিয়ে গেলেন। সুদেষ্ণা বলে ফেলল, মায়ের ধারণা তুমি এখনও বালক।

তোমারও কি একই ধারণা?

এখনও পর্যন্ত তোমার সম্পর্কে কোনও ধারণাই তৈরি হয়নি।

খাবার এল। সঙ্গে চা। খিদে পেয়েছিল বেশ। ভরত মুখ চালালো, তুমি খাবে না?

না।

কেন?

আমি এসময় খাই না। মোটা হয়ে যাচ্ছিলাম বলে কতগুলো নিয়ম মানতে হচ্ছে।

তুমি মোটা? হাঁ হয়ে গেল ভরত। সুদেষ্ণার শরীরের গড়ন চোখে পড়ার মতো।

কোমরে সামান্য ফ্যাট জমছিল। তুমি বুঝবে না। বলেই হেসে ফেলল, দয়া করে আবার লেকচার শুরু করো না, এদেশের নব্বই ভাগ মানুষ দুবেলা খেতে পায় না আর আমি বিলাসিতা করে খাই না! ওটা খুব বাড়াবাড়ি হবে।

ভরত তাকাল কিন্তু কিছু বলল না। তার মনে হল সে যে মনের কথাগুলোকে সুযোগ পেলেই বলে ফেলে সেটা সুদেষ্ণার কাছেও লেকচার বলেই মনে হয়। আসলে আমরা চারপাশে এত সাজানো দেখানো প্রতিবাদের কথা শুনি যে প্রতিবাদ ব্যাপারটাই ক্রমশ খেলো হয়ে এসেছে।

চায়ে চুমুক দিয়ে ভরত জিজ্ঞাসা করল, সুদেষ্ণা, তোমার বাবা-মায়ের সম্পর্ক কী রকম?

হঠাৎ এই প্রশ্ন?

দুজনকে আমার দুরকম মনে হল।

মা মায়ের মতন থাকে, বাবা বাবার মতন। তবে মা-ই এই সংসারের বিষয় সম্পত্তি দেখাশোনা করে থাকে। মা-ই সব। সুদেষ্ণা বলল।

কে তোমার বেশি প্রিয়।

দুজন দুরকমভাবে আমার প্রিয়। কম-বেশি মাপিনি। সুদেষ্ণা হাসল, ভরত, তোমাকে একটা কথা বলব। কিছু মনে করবে না তো?

স্বচ্ছন্দে বলে ফেল।

চারপাশের পৃথিবীর নিয়ে এই যে ভাবনাচিন্তা করে মন খারাপ করছ এতে তোমারই ক্ষতি হচ্ছে। তুমি একা কিছুই বদলাতে পারবে না।

আমি জানি।

বাবা যা বললেন, পৃথিবীতে তুমি খুব ভাল বন্ধু পেতে পার।

হুঁ। ভরত উঠে দাঁড়াল, আমি চললাম।

সুদেষ্ণা তাকে এগিয়ে দিল গেট পর্যন্ত, কাল দেখা হবে।

কাল ছুটি। বলেই তার খেয়াল হল, জানো এটাও একটা অদ্ভুত ব্যাপার।

কোনটা?

সেদিন একটা কাগজে পড়ছিলাম। এদেশে সরকারি ছুটি থাকে বছরে ষোলো দিন। একজন কর্মচারী তার সঙ্গে বারো দিন ক্যাজুয়াল এবং তিরিশ দিন আর্ন লিভ নিতে পারেন। অর্থাৎ ষোল বারো তিরিশ মিলে আটান্ন দিন ছুটি। প্রতি দিন এবং রবিবার ছুটির দিন মানে বছরে একশ চার তার সঙ্গে যোগ করলে দাঁড়াচ্ছে একশ বাষট্টি দিন। অর্থাৎ আউট অফ তিনশ পঁয়ষট্টি দিনের একশ বাষট্টি দিন ছুটি। তার মানে বারো মাসের পাঁচ মাস এদেশে কাজ করতে হয় না কর্মচারীদের। তার ওপর বন্ধ আছে। নেতাদের মৃত্যু হলে ছুটি আছে। মাথা নাড়ল ভরত, জাপান, চিন, আমেরিকা অথবা রাশিয়ায় এ ব্যাপারটা কেউ চিন্তাও করতে পারে না। আমাদের দেশে যেখানে বেশি কাজ করা দরকার সেখানেই এই আলস্য।

সত্যি তো। তুমি এসব নিয়ে ভাবো?

ভাবি না। চোখের সামনের এলে তোমরা যে উদাসীনতায় উপেক্ষা কর আমি তা পারি না। কোন লাভ নেই তবু–।

আবার এসো।

হ্যাঁ।

রাস্তায় পা দিয়ে ভরতের মনে হলো অনেক দিন পরে সন্ধেটা ভাল কাটাল। সুদেষ্ণার মা যা বললেন সেটা ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু ওর বাবা একেবারে আলাদা মানুষ। তারপরেই সুদেষ্ণার কথা মনে হল। কলেজে দেখা সুদেষ্ণার সঙ্গে এই সুদেষ্ণার অনেক পার্থক্য। কলেজে ওকে অন্য গ্রহের মানুষ বলে মনে হয়, বাড়িতে এসে বন্ধু বলে ভাবতে ইচ্ছে করল।
 
হাউসিং কমপ্লেক্সে ঢুকতেই শ্রমিক নেতাকে দেখতে পেল ভরত। ভদ্রলোক চারজন লোককে কিছু বোঝাচ্ছিলেন এবং তারা যেন ঈশ্বরের বাণী শুনছে এমন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। পাশ কাটিয়ে সে লিফটের দিকে এগোচ্ছিল, এইসময় ভদ্রলোক বলে উঠলেন, এই যে, শোনো!

ভরত দাঁড়াল নিস্পৃহ মুখে।

তোমার নামটা কী যেন?

ভরত।

ও। বাবা-মা ভাল আছে?

ভরত নীরবে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

দাঁড়াও। ভদ্রলোক অন্যদিকে তাকালেন, ওই কথা রইল। কাল সকাল আটটায়। বলে ভরতের পাশে চলে এলেন, আমাকে আবার রাত নটায় বেরুতে হবে। বিদেশি ডেলিগটদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। ও হ্যাঁ, তোমাদের কলেজের অভিজিতকে চেন তো?

চিনি।

ওকে তোমার কথা বলছিলাম। তুমি নাকি একটা ট্রাফিক কনস্টেবলকে ঘুষ নিতে দেখে উত্তেজিত হয়ে কলেজে ধরে নিয়ে গিয়েছিলে?

ঠিকই শুনেছেন।

কোরাপশন। চারদিকে কোরাপশন। যেখানেই হাত দাও একই ব্যাপার। পুলিশ ফোর্সটা তো শেষ হয়ে গেল। লিফটে ঢুকলেন ভদ্রলোক।

পুলিশকে কাজ করতে দেওয়া হয় না।

কে বলেছে? ফালতু কথা।

মন্ত্রীর বাড়িতে দুবৃত্ত আছে বলে পুলিশ অ্যারেস্ট করতে গেলে তাদেরই পরে সাসপেন্ড করা হয়। এরপর জেনেশুনে তারা ওই কাজ করবে কেন?

দুটো ব্যাপার। প্রথমত, ওই বাড়িতে ক্রিমিন্যাল ছিল কি না তা প্রমাণিত হয়নি। দ্বিতীয়ত, ওই মন্ত্রী আমাদের দলের নয়। আমাদের দলের কারো বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ কেউ আজ পর্যন্ত শোনেনি। তাই না?

উনি আপনাদের সরকারে আছেন!

ঐক্য বজায় রাখতে কিছু বলতে পারছি না আমরা। এস, আমার ফ্ল্যাটে এসো। লিফটের দরজা খুলে গেল।

আজ থাক।

আহা। থাকবে কেন? তোমার সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগছে। এসোই না।

অতএব অনিচ্ছা সত্ত্বেও পা বাড়াল ভরত। ভদ্রলোক বেল বাজালেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটি মেয়ে এসে দরজা খুলল। ভদ্রলোক বললেন, দ্যাখো কে এসেছে।

আমি চিনি। ওপরে থাকে। মেয়েটা চোখ ঘোরালো।

ভদ্রলোক বললেন, আমার মেয়ে। পারমিতা। এসো বসো। পারমিতা, মা কী করছে? ভরতকে কিছু খাওয়াতে বল। আর আমি বাইরে ডিনার করব।

ভরত তাড়াতাড়ি বলে উঠল, না না, আমি কিছু খাব না। আমার পেট ভর্তি।

চা?

না।

ঠিক আছে। জোর করব না। বসো। এই হল আমার ফ্ল্যাট। কোনও বিদেশি জিনিস দেখতে পাচ্ছ? থাকলে তো দেখবে। একেবারে সিম্পল। যা না থাকলে নয়। অথচ শুনেছি আমার বিরুদ্ধে কানাকানি চলছে শ্রমিক নেতা হয়েও এত টাকা দিয়ে কি করে ফ্ল্যাট কিনি। ফ্ল্যাটের দাম তো চার লাখ টাকা। তা আমার বাপঠাকুর্দা তো ছিলেন, তাদের কাছ থেকেও তো পেতে পারি। এইটে বাঙালিদের স্বভাব। মহারাষ্ট্রে যাও, কেউ নেতাদের নিয়ে মাথা ঘামায় না।
 
ভরত জানে চার লাখ টাকা কাগজে কলমে হলেও নয় লাখ দিয়ে ভদ্রলোক ফ্ল্যাটটা কিনেছেন। তবে হ্যাঁ, তাদের ফ্ল্যাট যেভাবে সাজানো এই ফ্ল্যাট তার ধারে কাছেও যায় না। কিন্তু ভদ্রলোক আগ বাড়িয়ে এসব বলছেন কেন?

মেয়েটা দাঁড়িয়েছিল বাবার পেছনে। ঢুলুঢুলু চোখে তাকাচ্ছে তার দিকে। ভদ্রলোক সেটা দেখতে পাচ্ছেন না। মেয়েটার শরীরের ওপর দিকটা বড্ড দৃষ্টিকটু। তার ওপর টাইট স্কার্টজামা পরায় তা আরও উগ্র হয়ে গেছে। এবাড়িতে কেউ ওর পোশাক নিয়ে কথা বলে না।

ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, অভিজিত বলছিল তুমি আমাদের পার্টিকে সমর্থন করো না?

আমার এইসব রাজনীতি ভাল লাগে না।

কোন রাজনীতি ভাল লাগে? বিপ্লবের? পুলিশ ধরে খুন কর, জোতদার মারো, মূর্তি ভাঙো– এইসব? যার পেছনে কোনও প্র্যাকটিক্যাল সেন্স নেই?

না। আমি নকশাল নই।

গুড। দ্যাখো একটা পুলিশ ঘুষ নিচ্ছে দেখে মাথা গরম করে কোনও লাভ নেই। তাকে ধরে তুমি দেশে সমাজতন্ত্র আনতে পারবে না। মা পারমিতা, তোমাকে বলেছিলাম ইংরেজি শিখতে হবে। এখন ইংরেজিতে কথা বলা খুব জরুরি। ভরত ইংলিশ মিডিয়ামে পড়েছে। তোমার মাকে ডাকো।

সঙ্গে সঙ্গে পারমিতা চিৎকার করল, মা। মা! তারপর বলল, লজ্জা পাচ্ছে।

পাক। ডেকে আনো।

এবার দরজায় জড়সড় হয়ে এক ভদ্রমহিলা দাঁড়ালেন। রোগা, ভীতু ভীতু চেহারা। শ্রমিক নেতা বললেন, এই হল ভরত। পারমিতাকে ইংরেজি শেখাবে। বুঝলে?

ভদ্রমহিলা ঘাড় নাড়লেন।

শ্রমিক নেতা জিজ্ঞাসা করলেন, কবে থেকে আরম্ভ করবে?

আমি তো এখনও মনস্থির করিনি। গম্ভীর গলা ভরত বলল।

না না। তোমার বাবার সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে। তুমি বরং আজ দেখে নাও ওর স্ট্যান্ডার্ড কেমন। সেই বুঝে ওকে কোচ করবে। আমাকে এখন তৈরি হয়ে নিতে হবে। পারমিতা, তুমি ভরতকে তোমার পড়ার ঘরে নিয়ে যাও। ভদ্রলোক উঠে গেলেন ভেতরে। সমস্ত ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটে গেল যে তাজ্জব হয়ে গেল ভরত। পারমিতা ডাকল, আসুন। আমার ঘর ওইটে।

ভরত ভেতরের দরজায় তখনও দাঁড়ানো মহিলার দিকে তাকাল। সে বুঝতে পারল এই বাড়িতে ওঁর কোনও ভূমিকা নেই। পারমিতা বলল, মা। ওখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? বাবার কী লাগবে দ্যাখো। ভদ্রমহিলা দ্রুত চোখের আড়ালে চলে গেলেন।

ভরত বুঝতে পারছিল না সে কী করবে? এখনই ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যাওয়া যায়। যদিও তার জন্যে বাবা বিপাকে পড়বে তাতে সে কি করতে পারে। তার পরেই মনে হলো সে তো এখন টিউশনি করছেই। একটা টিউশনি ছাড়ার পর নতুন ছাত্র পায়নি। শ্রমিক নেতা যদি তাকে টাকা দেয় তাহলে পড়াতে দোষ কি! অবশ্য শ্রমিক নেতার টাকা দুনম্বরি কিনা এখনও সে জানে না কিন্তু অনুমান করতে পারে মাত্র। যে কারণে আগের টিউশনি সে ছেড়েছে সেই একই কারণ তো এখানেও রয়েছে। এইসময় পারমিতা জিজ্ঞাসা করল, কী ভাবছেন?

ভরত সিদ্ধান্ত নিল, আপাতত দেখা যাক। হয়তো টাকা চাইলে ভদ্রলোক আর পড়াতে বলবেন না। সে পারমিতাকে অনুসরণ করল।
 
ছোট ঘর। ঘরের দেওয়াল জুড়ে আমীর খান, শাহরুখ খানের ছবি। একদিকে জুহি চাওলা অনেকটা শরীর দেখিয়ে শুয়ে আছে। ভেতর স্টিরিও এবং তার স্পিকার কায়দা করে সাজানো। চেয়ার এগিয়ে দিয়ে পারমিতা বলল, বসুন।

ভরত বসল। টেবিলে কিছু পড়ার বই।

কোন ক্লাসে পড়।

টেন।

এখন তো পড়ার চাপ খুব।

হুঁ।

এইসময় আলাদা করে ইংরেজি শিখতে পারবে?

আপনি শেখালে পারব।

শেখানোর আগে তোমার বাবার সঙ্গে কথা বলতে হবে।

কেন?

আমি টিউশনি করলে টাকা নিই।

কত?

চারশো।

মাত্র। বাবার কাছে কিছু না। পারমিতা হেসে উঠল।

এসময় শ্রমিক নেতার গলা শোনা গেল, পারমিতা, আমি বেরুচ্ছি।

আচ্ছা। চেঁচিয়ে সাড়া দিল পারমিতা। ওপাশে দরজা বন্ধ হবার আওয়াজ হলো। পারমিতা বলল, আজ কিন্তু পড়ব না।

কী করবে?

আজ গল্প করব। আপনার আমীর খানকে ভাল লাগে?

আমি সিনেমা দেখি না।

শানুর গান শুনেছেন? এক লেড়কি কো দেখা তো এ্যায়সা লাগা।

না। আমি শুনিনি।

শুনবেন? আমার কাছে ক্যাসেট আছে।

তুমি হিন্দি ছবি খুব দ্যাখো বুঝি?

খুব। ভি সি আরে দেখি। হাসল পারমিতা, নাইনটিন ফরটি টু দেখবেন?

এখন?

কী আছে। বাবার ফিরে আসতে অনেক দেরি আছে। আর আমি যা বলব মা তাই শুনবে।

বাঃ। শোনো, আমি এখন যাচ্ছি।

যাচ্ছি মানে, আপনি তো আমাকে পরীক্ষাই করলেন না।

পরীক্ষা?

ওই যে বাবা বলে গেল আমার স্ট্যান্ডার্ড দেখতে।

বেশ। তুমি আমার সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলো।

মেয়েটা এবার লজ্জা পেল। মাথা নিচু করল। ভরত বলল, সঙ্কোচ করলে কোনদিন শিখতে পারবে না। যা জানো তাই বলো। হোয়াট ইজ ইওর নেম?

পারমিতা মিনমিনে গলায় জবাব এল।

না। পুরো বাক্যটা বলো।

মাই নেম পারমিতা।

লেখো তো যা বললে।

পারমিতা লিখল। তারপর জিভ বের করে বলল, ইজ হবে।

বুঝতে পেরেছি। তোমার বাবাকে বলবে আমি পরে দেখা করব।

একটা ইজ বলিনি বলে আমার ওপর রাগ করবেন?

রাগ করেছি কে বলল! হেসে ফেলল ভরত।

সে উঠে দাঁড়াতেই পারমিতা এগিয়ে এল সামনে, না। আপনি এখন যাবেন না।

না। আমি সেই সকালে বেরিয়েছি, এবার বাড়িতে ফেরা দরকার।

একটা ফোন করে দিন না।

না। আজ চলি।

আপনি আমাকে শেখাবেন না? প্লিজ।

ঠিক আছে। আসব।

তাহলে কাল আসবেন?

কাল? তুমি কখন স্কুল থেকে ফেরো?

চারটে। কাল তো ছুটি।

হ্যাঁ। তাহলে সকালবেলায় আসব। এই ধরো দশটা।

থ্যাঙ্ক ইউ। আপনি খুব ভাল।



ভরত বেরিয়ে এল। লিফটে না উঠে সিঁড়ি ভেঙে নিজেদের ফ্ল্যাটের সামনে পৌঁছে দেখল দরজা বন্ধ। বেল বাজাতেই একটা অপরিচিত মুখ তাকে জিজ্ঞাসা করল, কাকে চাই?

কাউকে নয়। আমি এখানেই থাকি।

ভদ্রলোক অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে সরে দাঁড়াতে ও ভেতরে ঢুকল। ছড়িয়ে ছিটিয়ে জনা পাঁচেক মানুষ বসে আছেন। বাবাও ওদের মধ্যে। প্রত্যেকের হাতে হুইস্কির গ্লাস। ঘরে নেই।

কিরে! এত দেরি করলি? বাবা এমনভাবে জিজ্ঞাসা করল যে বেরুবার সময় কখন ফিরবে তা নিয়ে দুজনের মধ্যে কথা হয়েছিল যেন।

আমি তো রোজ এই সময়েই টিউশনি সেরে ফিরি।

ওঃ, ঠিক আছে যাও। বাবার উৎসাহে হঠাৎ যেন জল পড়ল।

ভরত কথা না বাড়িয়ে ভেতরে যাচ্ছিল। একজন প্রশ্ন করল, হু ইজ হি!

পুত্র। প্রেসিডেন্সিতে পড়ে। স্বাবলম্বী হবে বলে টিউশনি করছে।

মাই গড! নকশাল নাকি?

আমার তো মনে হয় না। আমাদের বংশে কেউ কখনও রাজনীতি করেনি।

এই বয়সের ছেলেদের নিয়ে বড় বিপদ। আমার ভাগনে সেন্ট জেভিয়ার্সে পড়ে, ভাল ছাত্র ছিল, নরেন্দ্রপুর থেকে পাশ করেছিল, ড্রাগ খাচ্ছে। কিছুতেই কারো কথা শুনছে না।

সর্বনাশ। কী করে হল?

আমি জানি না। কাগজে পড়ি হতাশা থেকে ওই নেশায় আক্রান্ত হয় এরা।

না না। আমার ছেলে ওই লাইনে নেই। আসলে বাবা-মায়ের উচিত ছেলের সঙ্গে একটা সময় এলে বন্ধুর মত ব্যবহার করা। বাঙালিরা সেটা পারে না বলেই। বাবা কথা শেষ করল না।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top