What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected স্বনামধন্য - সমরেশ মজুমদার (3 Viewers)

প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে একটু একটু করে জড়িত হচ্ছিল ভরত। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর শাখা হওয়ায় ছাত্রদের ভাবনা নিয়ে ভাবার চাইতে আন্তর্জাতিক সমস্যা নিয়ে লাফালাফি করে নিজেদের জাহির করতে ওদের আগ্রহ দেখে সে উৎসাহ হারিয়ে ফেলল। অভিজিত সরকার নামে একটি ছাত্রনেতার সঙ্গে ভরতের সামান্য ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। স্কুল থেকে ভাল ফল করে অভিজিত প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হয়েছে। শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের সে সক্রিয় সদস্য। ওর বাবা হাইকোর্টের সফল ব্যারিস্টার। অর্থের অভাব নেই। অভিজিতের জীবনের লক্ষ্য পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে পৌঁছানো, মন্ত্রিসভায় যাওয়া। এ বিষয়ে তার ভাবনা পরিষ্কার। আমার সময়ের অন্য ছাত্রনেতার থেকে আমি একটু এগিয়ে আছি কারণ প্রেসিডেন্সি কলেজের লেবেলটা আর কারও নেই। ছাত্র হিসেবে আমি মেধাবী তা প্রমাণিত। পার্টি সংক্রান্ত পড়াশুনা আমি যে ভাবে চালাচ্ছি তা আমার ভিত শক্ত করবে। আমি নিজে নিম্নবিত্ত বা বিত্তহীন পরিবার থেকে আসিনি, আমার বাবার প্রচুর টাকা আছে, এটা বেশ গুরুত্ব পায়। পার্টির ওপরের তলায় দু চারজন বাদে বেশির ভাগই উচ্চবিত্ত শ্রেণির মানুষ। তাছাড়া কেউ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, গবেষক অথবা অধ্যাপক হবার লক্ষ্যে নিজেকে তৈরি করে আর আমি রাজনৈতিক নেতা হিসেবে নিজেকে তৈরি করার চেষ্টা করছি। কারণ একজন মন্ত্রী ডাক্তার থেকে অধ্যাপকদের নিয়ন্ত্রণ করে। আমার বাবা আমাকে সমর্থন করেন।

কফিহাউসে বসে এমন সাবলীল ভঙ্গিতে কথাগুলো বলেছিল অভিজিত যে অবাক হয়ে গিয়েছিল ভরত। ক্ষমতাবান রাজনৈতিক নেতা হিসেবে নিজেকে তৈরি করার জন্যে প্রেসিডেন্সি কলেজের একজন ছাত্র পরিশ্রম করছে, এ কথা বাবা-মা কখনও বিশ্বাস করবে? ভরতকে ছাত্র রাজনীতিতে না জড়িয়ে পড়ার জন্যে ওরা বারবার নিষেধ করেছে। কলেজে ও-সব করে কত ছেলের ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়েছে তার ফিরিস্তি দিয়েছে। বাবা বলেছে নকশাল আন্দোলনের সময় প্রেসিডেন্সি কলেজের উজ্জ্বল ছেলের ওই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছে চিরদিনের জন্যে। তার মানে, তখন যারা ছাত্র রাজনীতি করত তারা অভিজিতের মতো বুদ্ধিমান ছিল না। তারা একটা আদর্শে বিশ্বাস করত, আখেরে নয়। অভিজিত তাকে বলেছিল কয়েকজন নেতার কথা। যারা ছাত্র এবং যুব রাজনীতি করে আজ নেতা হয়েছে। কোনওদিন চাকরিবাকরি অথবা ব্যবসা করেনি। কিন্তু দিল্লি বোম্বে যেতে গেলে তাদের বাড়িতে এক ডজন প্লেনের ওপেন টিকিট এসে যায়। এরা শুধু শাসক দলেই নয়, কংগ্রেসেও আছেন। যেহেতু এঁদের বয়স প্রায় পঞ্চাশ তাই তিরিশ বছর আগে ছাত্র রাজনীতি করার সময় তারা বুদ্ধি খরচ করেছিলেন।
 
অনেককাল অন্ধকারে বাস করার পর যদি আচমকা আলোয় আসা যায় তা হলে চোখ ঝলসে যেতে বাধ্য। প্রথম প্রথম ভরতের তাই হয়েছিল। শুধু রাজনীতি নয়, জীবনের অন্যক্ষেত্রেও সে হিসেব মেলাতে পারছিল না। সুদেষ্ণা নামের মেয়েটি কলেজে খুব নামকরা। সুদেষ্ণা সুন্দরী, মেধাবী। গল্প উপন্যাস বা সিনেমায় এমন মেয়েকেই নায়িকা হিসেবে ভাবা হয়। সুদেষ্ণাকে দেখে ওর মাথায় অন্য এক চিন্তা এসেছিল। মেয়ে মানেই নায়িকা নয়। ক্লাশের কুড়িটি মেয়ের মধ্যে বড় জোর দুজনকে নায়িকা বলে ভাবা যেতে পারে। বাকি আঠারোজন সারাজীবন পার্শ্বচরিত্র থেকে যাবে। একমাত্র বিয়ের রাত্রে তারা নায়িকার মর্যাদা পেতে পারে। অথচ সেই সব মেয়ে যখন একা থাকে তখন তাদের কল্পনা আচার-আচরণ এবং পুরুষের কোনও কথার প্রতিক্রিয়াতে ঠিক নায়িকাসুলভ অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে। সে যে নায়িকা নয় তা এককভাবে হজম করা বেশ কষ্টকর তার পক্ষে।

সুদেষ্ণা সম্পর্কে এ সব তথ্য খাটে না। কোনোদিন কলেজে এক পোশাকে সে আসে না। তার সঙ্গে কথা বলতে পেরে অধ্যাপকরাও খুশি হয়। গল্প উপন্যাসে ভরত আবিষ্কার করেছে নায়িকা একজন পুরুষবন্ধুর জন্যেই জীবন দিয়ে দিতে পারে। তাকেই বলে প্রেম। সে সুন্দরীর একাধিক প্রেমিক থাকে, যে অবলীলায় কয়েকজন ছেলের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে তাকে ভ্যাম্প বলা হয়। লেখক এবং পাঠকের তার ওপর কোনও সহানুভূতি থাকে না। বদ চরিত্র বলে তাকে চিহ্নিত করা হয়েছে সাবেকী উপন্যাসগুলোতে। যে মেয়ে তাও করে না অথচ কোনও অল্পবয়সী চরিত্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয় তাকেও চরিত্রহীনা বলা হয়েছে। এই সব সংজ্ঞা বাতিল হয়ে গেল সুদেষ্ণাকে দেখার পর। সুদেষ্ণার ছেলে বন্ধুর সংখ্যা কত তাই নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। সবাই নিজেকে ওর একমাত্র বন্ধু হিসেবে দাবি করে করে এখন প্রথম বন্ধুতে সীমিত হয়েছে। সুদেষ্ণা নাকি সবার সঙ্গেই প্রেমের কথা বলে। কলেজের ছাত্র অথবা অধ্যাপকদের সে মিষ্টি কথা বলতে ইতস্তত করে না। যে ছেলে তাকে এড়িয়ে দূরে সরে থাকতে চায় তার সঙ্গে সে যেচে গিয়ে কথা বলে আসে। আর এ সব করা সত্ত্বেও তার রেজাল্ট ঈর্ষণীয় ভাবে ভাল। সুদেষ্ণা যেন নদীর মতো দুপাশের চরাচর ঘর বাড়ি গাছপালা ছুঁয়ে ছুঁয়ে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ওকে বদ মেয়ে বা চরিত্রহীনা বলার সাহস কারও নেই অথবা সেরকম কিছু ভাবতেও ইচ্ছে করে না। পুরনো ভাবটাকে তাই বাতিল করতে হয় ওকে দেখে।

একদিন মা তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, তোদের কলেজের মেয়েরা কেমন?

ভরত জবাব দিয়েছিল, মেয়েরা যেমন হয়।

ও বাবা। মেয়েরা কেমন হয় তা তুই জেনে বসে আছিস?

বইতে পড়েছি, টিভিতে দেখেছি, তার ওপর তোমাকে তো দেখছিস।

ওরা তোদের সঙ্গে কথা বলে?

প্রয়োজন হলে বলে। সবাই অবশ্য নয়। বলেই সুদেষ্ণার কথা মনে পড়েছিল। ওকে যেটুকু সে দেখেছে তাই অকপটে বলেছিল। শুনে মায়ের মুখ গম্ভীর, কী রকম বাড়ির মেয়ে?

কেন?

কলেজে গিয়ে এত ছেলের সঙ্গে ভাব করছে, বাড়ির লোক কিছু বলে না?

ভাব করছে মানে?

তুমি এখন বড় হয়েছ, তোমার জেনে রাখা উচিত এই সব মেয়ে ছেলেদের মুণ্ডু চিবিয়ে আনন্দ পায়। বোকা ছেলেদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যায়।
 
আমি তোমার কথা বুঝতে পারলাম না। সোজা হয়ে বসেছিল ভরত।

বুঝতে হবে না। শুধু ওই সুদেষ্ণার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করো। মা উঠে গিয়েছিল। যখন মেজাজ গরম হয় তখনই মা তুই থেকে তুমিতে উঠে যায়। হয়তো তুমি বলে দূরত্ব বাড়াতে চায়। বাবার ক্ষেত্রে এ রকমটা অবশ্য করে না। তুমি থেকে আপনিতে চলে যেতে মাকে কখনও শোনেনি সে। ভরত ভেবে দেখেছিল মা যতই আধুনিকা হোক সুদেষ্ণকে গ্রহণ করতে পারছে না। শুধু মা-ই কেন, কলেজের সমবয়সী অনেক ছেলে-মেয়ে সুদেষ্ণার চরিত্র নিয়ে সন্দেহ করে। মানুষ কেন যে যার নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত থাকে না, অন্যের জীবনের খুঁটিনাটি জেনে মন্তব্য করতে উদগ্রীব হয় সেটা ভরত কিছুতেই বুঝতে পারেনি। সুদেষ্ণার সঙ্গে তার কথা হয়েছে দু-একবার। ওর স্বাভাবিক ব্যবহারে সে কোনও অস্বাভাবিকতা খুঁজে পায়নি। খোঁজার চেষ্টাও অবশ্য করেনি।

এইভাবে জীবন চলছিল ভরতের যেমন আর পাঁচজন তরুণের শুরু হয়। এতকাল বন্ধ এলাকায়। বাস করে বাইরের পৃথিবীতে পা দিয়ে সে অনেক কিছু মেলাতে মারছিল না। রাত্রে প্রায়ই স্বপ্ন দেখত সেই ছবিটার। সেই নিটোল রাস্তা, ছবির মত বাড়ি, হাসিখুশি স্বাস্থ্যবান মানুষ, শান্তির জীবন। এই ছবির সঙ্গে ভরতের দেখা পৃথিবীর কোনও মিল নেই। এই ব্যবধান ঘোচাবার জন্যে কোনও দায় বোধ করে না। তার কেবলই মনে হয় এখন বাবা মা শিশুদের শেখায়, কী করে স্বার্থপর হয়ে বেঁচে থাকতে হয়। যা তোমাকে উপকৃত করবে না তার দিকে ভুলেও তাকিও না। এই পৃথিবীতে তুমি এবং তোমার নিকটজন ছাড়া আর কারও কথা চিন্তা করা বোকামি। এবং ভুল করেও ওই নিকটজনের সংখ্যা বাড়িও না। দেশ, সমাজ ইত্যাদির জন্যে ভাবনা ভাবা মানে আত্মহত্যা করা। তোমাকে যে করেই হোক প্রচুর টাকা রোজগার করতে হবে যাতে ভারতবর্ষে যে সব সুখ সুবিধে কিনতে পারা যায় তা কেনার উপযুক্ত হতে পার। সোজা পথে যে টাকা আসে তা তোমাকে চিরকাল অসুখী রাখবে কারণ পরিমাণে বেশি হতে পারে না। অতএব নিজেকে বাঁচিয়ে তুমি অর্থ আনো এবং একবার আনার পরে সেই অর্থের গায়ে কালো দাগ যখন অবলীলায় মুছে যায় তখন নিজের প্রতিপত্তি বাড়াও। এই না হলে বেঁচে থাকা অর্থহীন।

.

ক্রমশ ভরত তার চারপাশে দুই তিন এবং তার বেশি মুখওয়ালা মানুষ দেখতে শুরু করল। তার বাবার তিনটি মুখ আছে। একটি মুখ দেখলে মনে হয় ভদ্রলোক অত্যন্ত সহৃদয় প্রকৃতির, দেশের জন্যে ভাবেন, গুনগুনিয়ে বঙ্গ আমার জননী আমার গাইতে ভালবাসেন, ছেলেকে ডেকে বলেন পথের পাঁচালি ইংরেজিতে লেখা হলে নোবেল প্রাইজ পেত, বুঝলে! দ্বিতীয় মুখ বেরিয়ে আসে বিশেষ বিশেষ টেলিফোন এলে। তখন গলার স্বর নেমে যায়। সত্যিকারের ষড়যন্ত্রীর মতো দেখায় মুখটা। টাকা-পয়সার লেনদেন নিয়ে, ফিসফিসিয়ে কথা বলেন। হয় তো নিজের কানকেও ঠিক বিশ্বাস করেন না। মায়ের সঙ্গে হেসে এমন ভাবে কথা বলেন যে মনে হয় মা মিস ইউনিভার্স। বেড়াল বেড়াল ভাব এসে যায় তখন। বিশেষ করে মায়ের কোনও বান্ধবী বা বাবার বন্ধু বাড়িতে এলে ভাল প্রেমিক প্রেমিক মুখটি স্পষ্ট দেখা যায়। ফিসফিসিয়ে টাকার কথা বলে যে মুখ তার সঙ্গে এই মুখটির কোনও পার্থক্য আজকাল ভরত দেখতে পায় না। তৃতীয় মুখটি বেরিয়ে পড়ে যখন বাবার আঁতে ঘা লাগে। মায়ের সঙ্গে ঝগড়ার সময় মুখে নেকড়ের ছাপ ফুটে ওঠে। একই ব্যাপার মায়ের ক্ষেত্রেও হতে দেখছে সে। বাইরের লোকের সামনে এক মুখ, বাবার সঙ্গে ঝগড়ার সময় দ্বিতীয় মুখ আর সুখী সুখী চেহারা করে ফেললেই তৃতীয় মুখটি বেরিয়ে আসে।

ভরতদের নিচের ফ্ল্যাটে থাকেন রবীনবাবু। মাত্র দু বছর আগে হাজার স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট কিনেছেন নয় লক্ষ টাকা দিয়ে। রবীনবাবু শ্রমিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। প্রায়ই খবরের কাগজে নাম বের হয়। সকালবেলায় লিফটে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে আসা মানুষের ভিড় থাকে খুব। কিন্তু নামকরা শ্রমিক নেতা বলে কেউ আপত্তি থাকলেও জানাতে পারে না। লিফট ছেড়ে হেঁটে নিচে নামে অন্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা। বাবা বলেছিল, শ্রমিক আন্দোলন করে নয় লক্ষ টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কিনেছে, ভেবে দ্যাখো।

মা বলেছিল, আগে বোধহয় কোনো বস্তিতে থাকত। বউটার চেহারা তাই বলে।

বাবা বলল, কিছু বলা যাবে না। এখন তো ওদেরই যুগ। মা বলল, ওর মেয়েটাকে দেখেছ? কি অশ্লীলভাবে জামা পরে, বুকের দিকে তাকানো যায় না। এর মধ্যেই অন্য ফ্ল্যাটের ছেলেরা গায়ে পড়ছে। আমাদের এখানে আগে কখনও এমন কাণ্ড হয়নি। কালচারের ছিটেফোঁটা নেই তা বোঝা যায়।

তোমার ছেলে তাকায় না তো!

শুধু আমার ছেলে হলে তাকাত না, মুশকিল হল ও তোমারও ছেলে।

কথাগুলো দরজার ওপাশে থেকেও কানে ঢুকেছিল। মেয়েটাকে সে দেখেছে কয়েকবার। যে ছেলেই সিঁড়ি দিয়ে নামে তার দিকেই অদ্ভুত চোখে তাকায়।
 
সেদিনরাত্রে ঘটনাটা ঘটল। মা টিভি দেখছিল। ভরত নিজের ঘরে। বাবা হুইস্কির গ্লাস নিয়েই বই পড়ছিল এমন সময় বেল বাজল। মা দরজা খুলল, ও আপনি! আপনি।

একটু বিরক্ত করছি বোধহয়।

না না বিরক্ত কেন? আসুন। এই শুনছ? মা বাবাকে ডাকল।

সাধারণত মায়ের প্রথম ডাকে বাবা সাড়া দেয় না। হুইস্কি খাওয়ার সময় তো নয়ই।

ভরত আগন্তুকের গলা পেল, আসলে আমার টেলিফোনটা আউট অফ অর্ডার হয়ে আছে। আমি রবীন, আপনাদের নিচের ফ্ল্যাটে আছি।

ওমা একি কথা! আপনাকে চিনব না কেন? অ্যাই শুনছ! এবারে ডাকটা একটু উঁচুতে।

বাবা গ্লাস রেখে যেতে বাধ্য হলো। মা বলল, চিনতে পারছ? রবীনবাবু।

বাবা বলল, নিশ্চয়! আসুন, কি সৌভাগ্য।

একটা টেলিফোন করতে পারি?

একশবার। বাবা টেলিফোনটা এনে দিল। ভরত দরজায় এসে দেখল লোকটা বোতাম টিপে চোখ বন্ধ করেছে, হ্যালো। রবীন বলছি। কী ভেবেছেন বলুন তো? শ্রমমন্ত্রীকে বলে ব্যাপারটা ম্যানেজ করলাম অথচ আপনার হুঁশ নেই। শ্রমিকরা খেপে লাল হয়ে আছে। তা আপনি যদি এই চালে চলেন তা হলে ওদের লেলিয়ে দিই, কী বলেন? একটু চুপ করলেন রবীনবাবু, ঠিক আছে, শেষবার চান্স দিলাম, কাল সকাল দশটা পর্যন্ত। টেলিফোনের লাইন কেটে দিয়ে রবীনবাবু বললেন, কারও উপকার করা এ যুগে অন্যায়।

বাবা বলল, কোনও প্রব্লেম?

আর প্রব্লেম। আমার লাইনে এক মিনিট শান্তি নেই মশাই। শ্রমিকদের প্রভিডেন্ড ফান্ড কেটেছে অথচ সরকারের ঘরে জমা দেয়নি। এক্সাইজ ডিউটি অর্ধেক দিয়ে পুরো মাল বাজারে ছাড়ছে। অথচ শ্রমিকদের হকের পাওনা দেবার বেলায় নানা অজুহাত। হ্যাঁ, আমি জানি আজকাল যা খরচ বেড়েছে তাতে সৎপথে ব্যবসা করলে সব কিছু মেটানোর পর মালিকের পকেটে কিছু যাবে না। আমি চাই না ইন্ডাস্ট্রি বন্ধ হোক। শুধু ধর্মঘট আর আন্দোলন করলে তো কারখানাগুলোর উন্নতি হবে না। কিন্তু লোকগুলো এমন অকৃতজ্ঞ যে যতক্ষণ না শাসিয়ে কথা বলছি ততক্ষণ। রবীনবাবু হাসলেন, আপনারা আবার আমাকে ভুল বুঝবেন না।

মা বলল, সে কি! আপনাকে ভুল বুঝব কেন? চা না কফি?

না না, এত রাত্রে ও সব। মাথা ঝাঁকাতে লাগলেন রবীনবাবু।

মা বলল, তা কি হয়! এই প্রথম আপনি এলেন আমাদের বাড়িতে।

কী দরকার। আসলে আমি এখন চা কফি খাই না। সারাদিন ধরে এত চা খেতে হয় যে, বুঝতেই পারছেন, শ্রমিকদের নিয়ে কারবার।

বাবা বলল, আপনাকে বলতে সঙ্কোচ হচ্ছে।

না না। সঙ্কোচ কীসের, বলে ফেলুন।

আমি একটু হুইস্কি খাচ্ছিলাম। আপনার আপত্তি না থাকলে–।

সেটা একটু চলতে পারে। প্রিমিয়াম তো?

হ্যাঁ। তা তো নিশ্চয়ই।

মা বলল, তুমি সার্ভ করো, আমি তোমাদের খাবারের ব্যবস্থা করছি।
 
ভরত দেখল বাবা হুইস্কির বোতল, ঠাণ্ডা জল এবং গ্লাস নিয়ে শ্রমিক নেতার পাশে বসল। মা চটপট খাবার বানিয়ে টেবিলে রাখল। ভরতের এক পিসি রাত আটটায় এ বাড়িতে এসে চা চেয়েছিল বলে মা বিরক্ত হয়েছিল। আর যে লোকটার নিন্দে করেছে দুজনেই তাকে সেবা করতে এখন বিন্দুমাত্র কুণ্ঠা দেখাচ্ছে না ওরা।

রবীনবাবু বললেন, আপনি যেন কোথায় আছেন?

বাবা জবাব দিলেন। গ্লাসে চুমুক দিয়ে রবীনবাবু হাসলেন, আপনাদের এম ডি লুথার সাহেব যাকে বলে দুনম্বরি লোক, ঠিক তাই ছিলেন।

আপনি চিনতেন? বাবা অবাক।

বাঃ। চিনব না কেন? আমার ইউনিয়ন তো ওখানে পাওয়ারে।

লুথার সাহেব!

লোকটা আমাকে টাকা দিত, একটু বেশিই দিত আবার নিজের জন্যে রাখত। অবশ্য সেটা আমাকে জানিয়েই রাখত। এমন কি পার্টি ফান্ডে চাঁদা দিতে বললেও ও ওই একই কারবার করত। হে হে করে হাসলেন রবীনবাবু।

বাবা বলল, এখনকার এম ডি?

আজই কথা হচ্ছিল। দিল্লি যাওয়া আসার ওপেন টিকিট ফেরত পাঠালাম। লোকটা ভাবে কী? প্লেনে যেন আমি উঠতে পারি না? আরে আমি একটা কাজ নিয়ে দিল্লি যাই না রে। দশজনের দশটা কাজ করে দেব আর দশজনই দশটা ওপেন টিকিট দেবে। যাব তো একটায়। আমাকে টিকিট দেখাচ্ছে। দেব অ্যাইসা টাইট যে বাছাধন বুঝবে ঠ্যালা।

সত্যি নাকি?

আমি মিথ্যে বলি না মশাই।

তা হলে আমি যে বিপদে পড়

কী রকম?

কোম্পানির কিছু হলে?

দুর! দেখছেন না সি এম চাইছেন না শ্রমিক অশান্তির জন্যে কারখানার প্রোডাকশন যেন বন্ধ না হয়। এই যে এত এন আর আইদের লোভ দেখিয়ে টেনে আনা হচ্ছে সব হাওয়া হয়ে যাবে। তাই আমি রামকৃষ্ণর পলিসি নিয়েছি, ফোঁস করব কিন্তু ছোবল মারব না। হুইস্কিতে চুমুক দিলেন রবীনবাবু, বিপদে পড়বেন কেন? এই মওকায় কিছু কামিয়ে নিন।

কী রকম? বাবা উৎসুক।

কোনওমতে এম ডির কানে তুলে দিন আমি আপনার প্রতিবেশী। ব্যস, তারপরে দেখবেন মাল আপনা আপনি আপনার পকেটে এসে যাবে। হো হো করে হাসলেন রবীনবাবু, আপনার ছেলেমেয়ে কটি? প্রশ্নটা আচমকাই মায়ের দিকে তাকিয়ে ছুড়লেন তিনি।

একটি! প্রেসিডেন্সিতে পড়ে।

আচ্ছা! তা হলে ব্রিলিয়ান্ট ছেলে। কই ডাকুন ওকে।

মা উঠে এল। দরজা পেরিয়েই ভরতকে দেখতে পেয়ে হকচকিয়ে গেল। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে একটু বুঝতে চেষ্টা করতেই নিঃশব্দে মাথা নেড়ে না বলল ভরত।

মা ফিসফিস করে বলল, দু মিনিটের জন্যে গেলে জাত যাবে না, এসো। তারপরেই ফিরে গিয়ে মা হাসল, পড়াশুনা করছিল, আসছে।
 
অগত্যা যেতেই হল। তাকে দেখতে পেয়ে রবীনবাবু বললেন, ও, তুমি। প্রেসিডেন্সিতে পড়? ওখানে আমাদের প্রচুর ছেলে আছে।

অভিজিতের মুখ মনে এলেও কিছু বলল না ভরত।

রবীনবাবু বললেন, কোন পার্টি কর?

এখনও ভেবে পাচ্ছি না। তা ছাড়া মা-বাবা বলেছেন ইউনিয়ন না করতে।

রবীনবাবু একটু কুঁকড়ে যাওয়া মায়ের দিকে তাকালেন, না না। এই তো ইউনিয়ন করার বয়স। এখন থেকে না নামলে বেশ শক্ত হবে কী করে। বাধা দেওয়া ঠিক নয়।

মা মিন মিন করল, পড়াশুনায় ব্যাঘাত হবে বলে। হ্যাঁ। ওদিকটাও নজরে রেখো। পড়াশুনা যেন নষ্ট না হয়। আমার মেয়েকে তো আমি বলি পড়াশুনা হচ্ছে সবচেয়ে প্রথম কর্তব্য। তুমি কি ইংলিশ মিডিয়ামে পড়েছ?

জবাব দিল মা, হ্যাঁ। আগাগোড়া!

বাঃ। খুব ভাল। আমার মেয়েটার সব ভাল শুধু স্পোকেন ইংলিশটা খারাপ। তুমি একটা কাজ করতে পারবে? ওকে ইংরেজি বলাটা শিখিয়ে দাও।

মা বলল, দিস না। সপ্তাহে দু-একদিন শেখালেই শিখে নেবে।

হ্যাঁ। তার বেশি লাগবে না। যাও, পড়াশুনা করো। রবীনবাবু বলল হাই তুলে।

চার পেগ মদ্যপান করে ভদ্রলোক চলে গেলে বাবা আর রাতের খাবার খাব না বলে শুয়ে পড়ল। মা গুনগুন করে সুর ভাঁজতে ভাঁজতে প্লেট গ্লাস গোছাচ্ছিল। ভরত এসে দাঁড়াল সামনে, তোমরা এটা কী করলে?

কোনটা?

ওই বাজে লোকটাকে এন্টারটেইন করলে?

বাজে লোক মানে?

চমৎকার! তোমরা বলোনি লোকটা বাজে? শ্রমিক নেতা হয়ে নয় লক্ষ টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কেনে কী করে বলে সমালোচনা করোনি? অথচ ওর সঙ্গে যে ভাবে কথা বললে তাতে মনে হল কৃপা পাওয়ার জন্যে গলে যাচ্ছ। বেশ জোরে জোরে কথাগুলো বলল ভরত।

কৃপা? ওর কাছে আমরা কোনও কৃপা চেয়েছি বলে তোর মনে হল? প্রতিবেশী বাড়িতে এসেছে, পছন্দ করি বা না করি ভদ্র ব্যবহার করাটাই নিয়ম। তা ছাড়া আমরা কী করছি না করছি তার কৈফিয়ত তোকে দেব না। মা কড়াগলায় বলল।

বাঃ, এ ব্যাপারে তোমাদের বেশ মিল দেখছি।

ভরত! বাড়াবাড়ি করো না। মা চিৎকার করল।

এই সময় বাবা বেরিয়ে এল, কী হয়েছে? কী বলছে ও?

রবীনবাবুকে ড্রিঙ্ক অফার করেছ বলে আমাদের সমালোচনা করছে। বলছে ওঁর কাছে কৃপা চাওয়ার জন্যে আমরা খাতির করেছি। এমন বিশ্রী ভাবে কথা বলে আজকাল! মা বলল।

বেশ করেছি। আমার কোম্পানির এম ডি যাকে তোয়াজ করে তাকে খাতির করলে যদি উপায় হয় তা হলে নিশ্চয়ই করব। এনি মোর কোশ্চেন? বাবা যে ভাবে ঘুরে দাঁড়াল প্রশ্ন মনে এলেও ভরতের আর কথা বলতে ইচ্ছে করল না।

.
 
সেই রাত্রে ভরত কিছু খেল না। মা মাত্র একবার খাওয়ার কথা বলেছিল, দ্বিতীয়বার আসেনি। প্রচণ্ড ক্রোধ ভরতকে আপ্লুত করেছিল। তার মনে হচ্ছিল এই পৃথিবীটার সব কিছু বানানো, মানুষগুলোর আচরণে ভণ্ডামি ছাড়া কিছু নেই। তার হাতে যদি ক্ষমতা থাকত তা হলে এই সবকিছু চুরমার করে ফেলত। ভারতবর্ষে, কলকাতায় বাস করে কোনও মানুষ সুস্থ থাকতে পারে না। তাকে প্রতিপদে ভণ্ডামি করে যেতে হবেই। অথচ কেউ এর প্রতিবাদ করে না, কেউ না। যে সব সন্ন্যাসীরা বিবেকানন্দের বাণী আওড়ান তারাও অনুদান না পেলে স্কুলে ছাত্র ভর্তি করেন না। এদের মধ্যে বাঁচতে হলে হয় তাকে ভণ্ড হতে হবে নয় প্রতিপদে প্রতিবাদ করতে হবে। ওই রাত্রে প্রচণ্ড রাগ এবং খিদে একাকার হয়ে যাওয়ায় ভরত ঠিক করল সে প্রতিবাদ করবে। এ ব্যাপারে সে কারও সাহায্য নেবে না। যে সব রাজনৈতিক দল আদর্শের কথা বলে তাদের ভণ্ডামিও আজ স্পষ্ট। ফলে রাজনৈতিক দলের সদস্য হলে তাকে এই ভণ্ডামির পথেই যেতে হবে। সে ঠিক করল মানুষ হিসাবে সে স্পষ্টবাদী হবে।

পরদিন সকালে কলেজে যাচ্ছিল ভরত। হ্যারিসন রোড আর কলেজ স্ট্রিটের মোড় যখন সে পার হচ্ছে তখন চারধারে প্রচুর মানুষ। সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। বাস ট্রাম এবং রিকশায়। মোড়টা প্রায় ভরাট। ভরত দেখল একস্টা লরি বেআইনি ভাবে নো এন্ট্রি লাগানো পথে ঢুকছিল। তাকে দাঁড় করিয়ে ট্রাফিক পুলিশ খুব ধমকাচ্ছে। লরির ড্রাইভার কয়েক শো লোকের সামনে হাত বাড়িয়ে দুটো টাকা এগিয়ে ধরতেই পুলিশটা ছোঁ মেরে নিয়ে নিল। তারপর হাত নেড়ে ড্রাইভারের ইচ্ছে অনুযায়ী পথে যেতে বলল। ভরত দৃশ্যটা দেখল অবাক চোখে। লরিটা বাঁক নেবার চেষ্টা করতেই সে দৌড়ে গেল সামনে। ব্রেক চাপতে বাধ্য হল ড্রাইভার। পুলিশটা বিরক্ত হয়ে তাকে দেখছে। ভরত নোকটাকে কাছে ডাকল। এগিয়ে এল লোকটা, কী করছেন? জ্যাম হয়ে যাচ্ছে দেখতে পাচ্ছেন না?

খপ করে লোকটার বাঁ হাত ধরে ফেলল ভরত, আপনি ঘুষ নিলেন কেন?

ঘুষ? হকচকিয়ে গেল পুলিশ।

আপনি প্রকাশ্যে এত লোকের সামনে ওর কাছে ঘুষ নিয়েছেন।

কী যা-তা বলছেন? কে আপনি?

তাতে আপনার কোনও দরকার নেই। আপনি ঘুষ নিয়ে লরিটাকে বেআইনি পথে যেতে দিয়েছেন। আপনি পুলিশ, আইনের রক্ষক। তবু এত নির্লজ্জ আপনি যে পাবলিকের চোখের সামনে অন্যায় কাজ করতে দ্বিধা করছেন না। ভরতের কথার মধ্যে আশেপাশের গাড়ি থেকে হর্ন বাজা শুরু হল। দুচারজন মানুষ এগিয়ে এসেছিল কাছে। তাদের একজন বলল, ছেড়ে দাও ভাই, পুলিশ তো ঘুষ নেবেই।

আশ্চর্য! আপনারা এই অন্যায়কে সমর্থন করছেন?

একজন বলল, এটাই তো নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মারুতি গাড়ির কঁচ নামিয়ে এক সুবেশ ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে?

ভরত তাকে ব্যাপারটা বলল। ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন, কেন আমাদের দেরি করিয়ে দিচ্ছেন ভাই। দুটো টাকার মামলা। ওর ওপরওয়ালারা দুশো দুহাজার থেকে দু লাখ নিচ্ছে। আপনি কলকাতায় নতুন নাকি?

ভরত মাথা নাড়ল, নো। আমি ওকে ছাড়ব না। ওকে টাকা সমেত ধরেছি। একজনকে শাস্তি দিলে হয়তো দুজন ব্যাপারটা করার আগে ভাববে।
 
ভিড় বাড়ছিল। পাবলিক ভরত এবং পুলিশটিকে ফুটপাতে তুলে দিল। তারাই ট্রাফিক কন্ট্রোল করতে আরম্ভ করল। ভরত পুলিশটির হাত শক্ত করে ধরেছিল। হঠাৎ লোকটা যেন খেপে উঠল, সততা মারাচ্ছেন না? সততা। রোদ জল ঝড়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি রাস্তায়, ক পয়সা। মাইনে পাই জানেন? পারবেন আপনি টানা চারঘণ্টা গ্রীষ্মকালের দুপুরে ওখানে দাঁড়াতে? আর দু চারটাকা যা আসে তা কি আমি একা ঘরে নিয়ে যাই ভেবেছেন? ক ভাগ করতে হয়, আমি কত পাই তার হিসেব জানেন?

আমি কিছু জানতে চাই না। আপনি থানায় চলুন।

থানায়? লোকটা অনেকক্ষণ পরে হাসল, আমায় থানায় নিয়ে গেলে আপনি বিপদে পড়বেন। বড়বাবু আপনাকে পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দেবেন।

লোকটার কথা সত্যি হলেও হতে পারে। ভরত বলল, চলুন আমার সঙ্গে?

কোথায়? আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেল!

আমাদের কলেজে আসুন। প্রায় টানতে টানতে লোকটাকে কলেজে নিয়ে এল ভরত। ওদের পেছনে পেছন মজা দেখতে চাওয়া জনতা আসছিল। কেউ কেউ ভরতকে সমর্থন করছিল। পুলিশের ওপর যাদের সহজাত রাগ আছে তারা সেটা প্রকাশও করছিল।

অভিজিত এগিয়ে এল, কী হয়েছে?

ভরত বলল ব্যাপারটা। শেষ করল, ইনি বলছেন থানায় গেলে বড়বাবু উল্টে আমাকে পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দেবেন।

অভিজিত পুলিশটিকে জিজ্ঞাসা করল, তাই নাকি?

এবার লোকটির গলার স্বর পাল্টে গেল। মিনমিনে গলায় বলল, আমি বুঝতে পারিনি স্যার ইনি ছাত্র। আমাকে মাপ করে দিন, আর হবে না।

এই মোড়ে ডিউটি করলে আর ঘুষ নেবেন না? অভিজিত প্রশ্ন করল।

কক্ষনো না। মাইরি বলছি।

এই মোটরবাইকের আওয়াজ পাওয়া গেল। বিশালদেহী এক সার্জেন্ট ভিড় সরিয়ে এগিয়ে এল, কী হয়েছে? একে ধরে এনেছেন কেন? কে এনেছে?

ভরত জবাব দিল, আমি। ও ঘুষ নিচ্ছিল। প্রতিবাদ করলে ভয় দেখিয়েছে।

কত টাকা ঘুষ নিয়েছে?

দু টাকা।

তুমি ঘুষ নিয়েছ? সার্জেন্ট পুলিশটিকে জিজ্ঞেস করল।

না স্যার। লোকটার কাছে আমি টাকাটা পেতাম, দেখা হতে শোধ করে দিল। অবলীলায় মিথ্যে কথা বলে ফেলল পুলিশটি। হাঁ হয়ে গেল ভরত।

সার্জেন্ট ভরতকে বলল, একজন সরকারি কর্মীকে জোর করে কর্তব্যস্থল থেকে নিয়ে আসার জন্য আপনাকে অ্যারেস্ট করা যেতে পারে, আপনি জানেন? ও যে এই কথাটা মিথ্যে বলল তা আপনি প্রমাণ করতে পারবেন?

ভরত প্রতিবাদ করল, ও মিথ্যে বলছে। একটু আগে ঘুষ নেবার জন্য ক্ষমা চাইছিল।

আপনি প্রমাণ করতে পারবেন?

ওই লরিওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করুন। নো এন্ট্রিতে ঢুকছিল বলে টাকা দিয়েছে।

কোন লরিওয়ালা?

মোড়ে দাঁড়িয়েছিল।

ছিল হয়তো, এখন নেই। নাম্বার নিয়েছেন?

না

নিলেও সে কি এসে স্বীকার করবে ওকে ঘুষ দিয়েছে নো-এন্ট্রিতে ঢোকার জন্যে? কী মনে হয় আপনার? সবাই যুধিষ্ঠির হয়ে গেছে?

অভিজিত চুপচাপ শুনছিল। এবার ভরতকে বলল, তুমি একটা সাধারণ ব্যাপারে বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়েছ। লেটস ফরগেট ইট।
 
সার্জেন্ট বলল, আমি ভেবে অবাক হচ্ছি যে এখনকার ছেলে হয়েও ট্রাফিক পুলিশের দু টাকা ঘুষ নেওয়াটা আপনার কাছে অসহ্য হয়েছে কী করে? লাল সবুজ আলোর মত এটাও এত স্বাভাবিক তা আপনার বোঝা উচিত। যাকগে, আমি কোনো কেস দিচ্ছি না। যাও, ডিউটিতে যাও। আদেশ পাওয়ামাত্র পুলিশটি ছুটে গেল।

ভিড় ফাঁকা হয়ে গেলে অভিজিত ওর কাঁধে হাত রাখল, ব্যাপারটা কি?

ভরত বলল, নিজেকে একটা গর্দভ বলে মনে হচ্ছে।

হঠাৎ তোমার অ্যাডভেঞ্চার করার বাসনা হল কেন?

অ্যাডভেঞ্চার?

নয় তো কি? এত সামান্য ব্যাপার নিয়ে মাথা গরম করলে। বুর্জোয়ারা যেখানে সক্রিয় সেখানে এ সব ঘটনা অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। তুমি কজন পুলিশকে সংশোধন করবে? এরা তো নিচের তলার ক্ষমতাহীন প্রাণী। রাঘব বোয়ালদের যদি শায়েস্তা না করা যায় তা হলে এরা তো অভ্যেস ত্যাগ করবে না। অভিজিত থামল। হেসে বলল, তা ছাড়া, ওরা সবাই আমাদের সরকারি প্রশাসনের অঙ্গ। সামান্য ব্যাপার নিয়ে এদের কলঙ্কিত করলে তার দায় সরকারের ওপর পড়বে। মাঝে মাঝে পি এমকে তাই বলতে হচ্ছে পুলিশ কোনও অন্যায় করেনি। বুঝলে?

তুমি বুঝতে চাইছ না। এই রোমান্টিক অ্যাডভেঞ্চার করার ইচ্ছা তোমাকে ছাড়তে হবে। অভিজিত আর দাঁড়াল না। ক্ষোভে বিরক্তিতে নিজেকে প্রতারিত বলে মনে হচ্ছিল ভরতের। এইসময় দেখতে পেল সুদেষ্ণা তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, অভিনন্দন।

মানে?

এতকাল শুনেছি পুলিশ সাধারণ মানুষকে ধরে ভোগাচ্ছে। আজ নাকি আপনি পুলিশকে নাজেহাল করেছেন? কী ব্যাপার? সুদেষ্ণা হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করল।

রাগ হয়ে গেল ভরতের, অভিনন্দন জানাতে এসেছেন অথচ জানেন না ব্যাপারটা কি? যারা গল্প করেছে তারা ওটাই বাদ দিল?

সুদেষ্ণার মুখ নরম হয়ে গেল, কি হয়েছে আপনার?

ভরত মাথা নাড়ল, চলি।

দাঁড়ান। আমি কিন্তু আপনার শত্রু নই।

হ্যাঁ। জানি। সবাই আপনার বন্ধু। এই কলেজের সব ছেলেকে তাই বলে উন্মাদ করে দিতে পারলে খুশি হন।

তাই নাকি? আমার এত ক্ষমতা?

ক্ষমতা যে আছে তা নিজে জানেন না?

বাঃ। এতগুলো উন্মাদের সঙ্গে মিশে আমার কি লাভ হবে?

আনন্দ। স্রেফ মজা দেখবেন।

তাই। আর কে কত উন্মাদ তা আমি জানি না। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে সত্যিকারের এক উন্মাদের সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি। এবং একটুও মজা পাচ্ছি না। সুদেষ্ণা চলে গেল।

ভরতের এ বার খারাপ লাগল। পুলিশের ব্যাপারটা নিয়ে বিরক্ত এবং হতাশ হয়ে সে সুদেষ্ণাকে উল্টোপাল্টা কথা বলে ফেলল। এ সব তার চিন্তায় ছিল না। মা-এর কাছাকাছি কথা বলায় সে নিজে প্রতিবাদ করেছে। অথচ এখন অজান্তেই তাই আউড়ে গেল।

সুদেষ্ণা তাকে বলে গেল সত্যিকারের উন্মাদ। ভরত ক্লাসে ঢুকে শেষ বেঞ্চিতে বসল। অধ্যাপক কী পড়াচ্ছেন তা শোনার চেষ্টা করল। হঠাৎ তার মনে হল লোকটা বানানো কথা বলছে। তার আগে বছরের পর বছর এই একই কথা অজস্র ছাত্রছাত্রী শুনেছে। শুনে তাদের কার কি লাভ হয়েছে কেউ হিসেব দেয়নি। বি.এস সি পাশ করে, এই সব বক্তৃতা শুনেও মুদির দোকান করেছে। এমন মানুষের সন্ধান পাওয়া শক্ত নয়। ইচ্ছে হল কথাটা অধ্যাপককে বলে। ঠিক সেই সময়ই অধ্যাপক পড়া থামিয়ে তার দিকে তাকালেন, উঠে দাঁড়াও।

ভরত উঠল। অধ্যাপক বললেন, মনে হচ্ছে আমার ক্লাস তোমার ভাল লাগছে না। তাই তোমাকে সাজেস্ট করছি যেখানে ভাল লাগবে সেখানে যেতে পার।

আমার যদি ভাল না লাগে তা হলে কেন ভাল লাগছে না জানতে চাইবেন না?

নো। আই ডোন্ট কেয়ার। তুমি যেতে পার।
 
ভরত বেরিয়ে এল। একেবারে কলেজ স্ট্রিটে এসে সে আবিষ্কার করল কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। চুপচাপ সে হাঁটতে লাগল। কলুটোলার মোড়ে এসে সে একজন প্রৌঢ়কে ধমক দিতে শুনল। লোকটার আগে আগে একটা দশ বারো বছরের ছেলে মাথায় বিরাট বোঝা নিয়ে ছোটার চেষ্টা করছে। প্রৌঢ় ধমকাচ্ছে ছেলেটা ভালভাবে ছুটতে পারছে না বলে। ভরতের মাথা গরম হয়ে গেল। সে ছেলেটার সামনে গিয়ে ওকে থামাল। তারপর প্রৌঢ়কে বলল, এটা কী করছেন? ওইটুকু বাচ্চার মাথায় অত মাল চাপিয়ে ছোটাচ্ছেন?

আঃ। আমাকে ট্রেন ধরতে হবে। পথ ছাড়ো।

না ছাড়ব না। আপনার লজ্জা করছে না ওকে এক্সপ্লয়েট করতে?

এক্সপ্লয়েট? ও টাকা নিচ্ছে না? মাগনা খাটছে? সারা পৃথিবীতে কে কোথায় এক্সপ্লয়েট করছে বলতে পার? ও যেচে দর করে কাজটা নিয়েছে হে। কেটে পড়। চল, চ।

প্রৌঢ় ছেলেটিকে নিয়ে ছুটলেন। ভরত চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল।

.

বিকেলবেলা বাড়িতে ফিরে এসে ভরত দেখল দরজা বন্ধ। এই ফ্ল্যাটের দুটো চাবি আছে। একটা বাবার পার্সে থাকে, দ্বিতীয়টা দেওয়ালে ঝোলানো। কোনো কারণে মাকে যদি বেরুতে হয় তাহলে চাবি পাশের ফ্ল্যাটের মিসেস মুখার্জির কাছে রেখে যান। এই মিসেস মুখার্জির সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক অদ্ভুত রকমের। মাঝে মাঝে গলাগলি ভাব, মাঝে মাঝে কথা বন্ধ। কি বিষয়ে মত-পার্থক্য হয় ভরত জানে না। মিস্টার মুখার্জির মাথা ভর্তি টাক, বয়স হয়েছে, খুবই নিরীহ চেহারার মানুষ। ওঁদের কোনো ছেলেমেয়ে নেই বলে মিসেস মুখার্জি প্রায়ই বাপের বাড়িতে গিয়ে সময় কাটান।

ভরত মিসেস মুখার্জির দরজার পাশের বোতাম টিপল। বাইরে থেকে বোঝা যায় না ভেতরে বেল বাজছে কি না! দ্বিতীয়বার বেল বাজতেই দরজা খুলল, তার আগে কি-হোলের ওপাশে যে চোখ এসেছিল তা বুঝতে পারল ভরত। মিসেস মুখার্জি একটা আলখাল্লা জাতীয় পোশাক পরে আছেন, মাথার চুলে ভোয়ালে জড়ানো। ভরতকে দেখে বিরক্ত হলেন তিনি, কী ব্যাপার?

মা কি আপনার কাছে চাবি রেখে গেছেন?

কই, আমি জানি না তো! চোখ ঘোরালেন মহিলা।

না দরজা বন্ধ, ভেতরে কেউ নেই বলে ভাবলাম আপনার কাছে চাবি রেখে মা বেরিয়েছে।

এখন তোমার মায়ের চাবি রাখার কত জায়গা হয়েছে, দ্যাখো কোথায় রেখে গেছে?

ভরত ঠোঁট কামড়াল। মিসেস মুখার্জি হাসলেন, তোমার মা যতক্ষণ না ফিরছে ততক্ষণ কি তুমি এখানে বসবে? বসতে পার।

ভরত মাথা নাড়ল, না, ঠিক আছে। সে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল। হ্যাঁ, রোজ যে সময়ে সে বাড়ি ফেরে তার অনেক আগে আজ ফিরেছে। মা যদি কোথাও বেরিয়ে থাকে তাহলে ওই সময়ের মধ্যেই ফিরে আসবে। চাবি যখন মিসেস মুখার্জির কাছে রাখা নেই তখন বোঝাই যাচ্ছে মায়ের সঙ্গে ওঁর সম্পর্ক আবার খারাপ হয়েছে।

নিচে নামতেই ভরত দেখল ওদের সঙ্গে পড়ত প্রণব নামের একটি ছেলের মা ফ্ল্যাট থেকে বের হচ্ছেন। প্রণবের বাবার সম্প্রতি সেরিব্রাল হওয়ায় শয্যাশায়ী। প্রণব রাত্রে কলেজে পড়ে এবং এই বয়সেই দিনের বেলায় কোথায় চাকরি করছে। প্রণবের মা একেবারেই হাউসওয়াইফ এবং পুরনো আমলের চালচলন। ভরত জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছেন মাসিমা?

ভাল না বাবা। তোমার মেসোমশাই তো এখনও ওই অবস্থায় রয়েছেন। ছেলেটার পড়াশুনায় ব্যাঘাত হচ্ছে খুব। টাকা-পয়সারও খুব টানাটানি যাচ্ছে। ভদ্রমহিলা অকপটে বললেন, এই দ্যাখো না, আজ থেকে সাত বছর আগে তোমার মেসোমশাই পাঁচকাঠা জমি কিনেছিলেন। আট হাজার করে কাঠা ছিল তখন। ইচ্ছে ছিল জায়গাটায় বাস চলাচল ভাল করে শুরু হলে একটা ছোট বাগানওয়ালা বাড়ি করবেন। ভগবান আর সেই ইচ্ছে পূর্ণ হতে দিলেন না। এখন যখন টাকারই টানাটানি তখন ওই জমি বিক্রি করে দিতে চাই। কিন্তু পারছি না।

পারছেন না কেন? জমি তো আপনাদেরই।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top