What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected স্বনামধন্য - সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

কর্পোরেশনের খাতায় তোমার মেসোমশাই-এর নাম নেই। প্রণব পয়সা খরচ করে কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। তার জবাবে অনেকে কিনতে চাইছে কিন্তু তারা সবাই কাগজপত্র ঠিক আছে। কিনা জানতে চাইছে। মিউটেশন করা আছে কিনা জিজ্ঞাসা করছে সবাই।

সেটা করা নেই? ভরতের আগ্রহ হলো।

মাসিমা মাথা নাড়লেন। না বাবা, নেই। আমি তো এসব কিছু জানতাম না। গতকাল কর্পোরেশন অফিসে গিয়ে জানতে পারলাম। ওরা আজ বিকেলে দেখা করতে বলেছে।

আপনি একাই যাচ্ছেন?

আর কে যাবে বাবা? প্রণব চাকরিতে কামাই করলে মাইনে কাটে। দিন রাতের লোকের ভরসায় তোমার মেসোমশাইকে রেখে যেতে ভরসা হয় না, তবু তাই যাচ্ছি।

ঠিক আছে, আমার হাতে কোনো কাজ নেই এখন, আমি আপনার সঙ্গে যাচ্ছি।

তুমি যাবে? প্রণবের মা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তার ছেলে যখন স্কুলে পড়ত। তখন ভরত সহপাঠী ছিল। কিন্তু ভরতের বাবা-মায়ের চালচলন বুঝিয়ে দিত দুটো পরিবারের মধ্যে দূরত্ব রাখাই ভাল। সেকারণেই একই ফ্ল্যাট বাড়িতে থেকেও কোনো সম্পর্ক তৈরি হয়নি। এখন অর্থনৈতিক অবস্থা যেখানে নেমে এসেছে সেখানে ওটা আশা করাই যায় না।

চলুন। কিসে যাবেন?

ট্রাম যায়। একটু হাঁটতে হয় যদিও তবু অনেক আরামে যাওয়া যায়।

ধর্মতলামুখী ট্রামে লেডিস সিটে জায়গা পেয়ে গেলেন মাসিমা। ভিড় কম ছিল বলে ভেতরে দাঁড়াবার জায়গা পেয়ে গেল ভরত। সে মাসিমার কথা ভাবছিল। তার মায়ের চেয়ে বেশি বড় নন অথচ দুজনের কথা বলার ধরন আলাদা। বাংলা সিনেমায় যেসব মা-মাসিমাদের দেখা যায় ইনি সেই রকম। তার মা এখনও নায়িকাদের সঙ্গে মানিয়ে যাবে। মায়ের সঙ্গে পড়ত একজন বিখ্যাত মহিলা এখনও বাংলা ফিল্মের নায়িকা যখন, তখন মাকে বয়স্কা ভাবা যাচ্ছে না। আর মা যদি মাসিমাদের মতো কথাবার্তা বলত অথবা ওইভাবে শাড়ি পড়ত তাহলে বাবা আরও খেপে যেত। বাবা নিজেকে প্রৌঢ় বলেও ভাবতে চায় না। আজ ভরতের মনে হল বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃকোলে হয়তো ঠিক কিন্তু যেমন বয়স তেমন সাজো আর বোধহয় চলে না। কিন্তু ছেলে হিসেবে তার মায়ের চেয়ে মাসিমাকেই এখন বেশি পছন্দ হচ্ছে।
 
তখন প্রায় বিকেল কিন্তু ছুটি হতে ঘন্টাখানেক দেরি আছে। মাসিমার সঙ্গে কর্পোরেশন অফিসে ঢুকে ভরত দেখল অধিকাংশ চেয়ারই খালি। এতলোকে একসঙ্গে অফিসে আসেনি? মাসিমা এর আগের দিন যাঁর সঙ্গে কথা বলেছিলেন তিনি অবশ্য ঘরেই ছিলেন। পর্দা সরাতে দেখা গেল তার টেবিলের সামনে কয়েকজন বসে আছেন। ওদের দেখে হাত নেড়ে অপেক্ষা করতে বললেন। বাইরে বসারও জায়গা নেই। মাসিমা জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। হঠাৎ একটা শুটকো চেহারার লোক ওদের সামনে এগিয়ে এল, জমি-জমার ব্যাপার নাকি?

মাসিমা বললেন, হ্যাঁ। ওঁর সঙ্গে দেখা করব।

দেখা করলে কাজ হবে বলে ভেবেছেন? কিছু হবে না।

ভরত জিজ্ঞাসা করল, কী করে বুঝলেন কাজ হবে না?

থার্টি ইয়ার্স এক্সপেরিয়েন্স। প্রব্লেমটা কী?

কথা বলার ধরনের মেজাজটা খারাপ হল ভরতের, আপনাকে বললে কাজ হবে?

চান্স আছে। এটা সরকারি অফিস। সোজা কথায় কোনো কাজ হয় না। আপনারা তো ছার, মহামান্য মন্ত্রীমশাই এলেও দেখবেন ফাইল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই যে দেখছেন চেয়ারগুলো ফাঁকা, অফিস কিন্তু ছুটি হয়নি। যে যার কাজে চলে গেছে। পার্সোনাল কাজ। মন্ত্রীর বাবারও সাধ্য নেই ছুটি না হওয়া পর্যন্ত ওদের আটকে রাখতে। আর যাঁরা টেবিলে রয়েছেন তারা জনসেবায় ব্যস্ত। সকাল বেলায় বারোটার আগে কোনো কাজ পাবেন না।

আপনার কথা সত্যি হলে কর্পোরেশনের কাজ কী করে চলছে?

কোথায় থাকেন?

কেন?

নতুন ফ্ল্যাটবাড়িতে থাকলে বুঝবেন না। পুরনো কলকাতায় কিছু বাড়ি আছে যার অনেক শরিক। কেউ আগবাড়িয়ে সারাতে চায় না। ইট বেরিয়ে গেছে, দেওয়ালে ফাটল ধরেছে তবু তাতে মানুষ থাকছে। ওইভাবে আরও পঞ্চাশ বছর থাকবে। কর্পোরেশনও থাকবে। প্রব্লেম কী?

এই সময় অফিসারের ঘরের লোকগুলো বেরিয়ে এল বাইরে। লোকটাকে পাত্তা না দিয়ে মাসিমাকে ইশারা করে ভরত ভেতরে ঢুকল। অফিসার বয়সে প্রবীণ নন, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন বের হবেন বলে। ওদের দেখে কাঁধ ঝাঁকালেন, কী ব্যাপার?

ভরত বলল, ওঁকে আজ আসতে বলেছিলেন।

আপনারা এমন অসময়ে আসেন কেন? সকালের দিকে আসতে পারেন না?

ওঁকে তো এই সময় আসতে বলেছিলেন।

অ। বলুন। অফিসার আবার চেয়ারে বসলেন।

মাসিমাকে উল্টোদিকের চেয়ারে বসালো ভরত। মাসীমা বললেন, আমাদের জমির ব্যাপার কী করতে হবে সেটা জানতে এসেছি।

কোথাকার জমি?

আপনাকে আমি সব বলেছিলাম। আপনি রেকর্ড দেখে রাখবেন বলেছিলেন।

সরি। মাথায় সব রাখা সম্ভব নয়। তাছাড়া রেকর্ড তো আমি বের করব না। ওটা যাতে ঠিকঠাক আমার টেবিলে আসে তার ব্যবস্থা করুন।

কী ভাবে করব? মাসিমা জিজ্ঞাসা করলেন।

আপনি মহিলা। আপনাকে যেতে হবে না। আপনি গিয়ে পিওনদের সঙ্গে কথা বলুন।
 
ভরত লোকটাকে হাঁ করে দেখছিল। বলল, আপনার পিওনকে আমি বলব কেন? আপনার হুকুম শুনবে না? তার তো সেটাই চাকরি।

হুকুম? এখানে হুকুমে কিছু হয় না। বলেই যেন একটু অস্বস্তিতে পড়লেন ভদ্রলোক, আচ্ছা, আপনার সমস্যাটা কী আর একবার বলুন তো?

আমার স্বামী একটা জমি কিনেছিলেন।

কতটা?

পাঁচ কাঠা। আট হাজার টাকা কাঠা ছিল তখন। কোর্টে জমি রেজিস্ট্রি করা হয়েছে। সেসব কাগজ আমার কাছে আছে। কিন্তু কর্পোরেশন থেকে মিউটেশন করানো হয়নি।

খুব অন্যায় করেছেন। আপনারা স্বামী এখনও জীবিত?

হ্যাঁ। উনি শয্যাশায়ী। উনি কিন্তু আট বছর আগে মিউটেশনের জন্যে আবেদন করেছিলেন এখানে। তার কাগজও আছে। এখান থেকে কাজটা করা হয়নি।

কেন করা হয়নি?

উনি তো এখন ভাল করে কথা বলতে পারেন না। তবু যা শুনেছি তা বলা বোধহয় ঠিক হবে না।

বলে ফেলুন। ওটা শোনা দরকার।

বোধহয় পয়সাকড়ি চেয়েছিল কেউ। উনি রাজি হননি তাই কাজটাও হয়নি।

খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। এখন আপনারা মিউটেশন করাতে চাইছেন কেন?

আমাদের অবস্থা খুব খারাপ। টাকার দরকার।

ও, বিক্রি করবেন। আট হাজার কাঠার জমি এখন আশিহাজার হয়েছে তা নিশ্চয়ই জানেন।

হ্যাঁ। শুনেছি।

তার মানে চল্লিশ হাজারের বদলে চার লাখ পাবেন। কদ্দিন আগে কিনেছিলেন?

সাত বছর আগে।

সাত বছরে ব্যাঙ্কে ডাবল হয়। অথচ আপনি বিক্রি করতে পারবেন না যদি মিউটেশন করানো থাকে। যিনি কিনবেন তিনিও অবশ্য মিউটেশন থাকলে কিছুটা সুবিধে পাবেন ট্রানসফারের সময়, তবু তাকে ভুগতে হবে খানিকটা। অফিসার হাসলেন।

ভরত সোজা হয়ে বসল, এখন মিউটেশন করাতে হলে কী কী দরকার?

অফিসার বললেন, আবেদন। যিনি জমি কিনেছিলেন তিনি নথিপত্র সমেত আবেদন করবেন।

নথিপত্র বলতে?

জমির দলিলের কপি, আদালতে যে ডিড রেজেস্ত্রি হয়েছে তার কপি এবং যার কাছ থেকে জমি কেনা হয়েছে তার নামে মিউটেশন করা থাকলে তার কপি এবং আপটুডেট খাজনা দেবার রসিদ পেলেই চলবে।

মাসিমা বললেন, আমি শুনেছিলাম উনি যাঁর কাছ থেকে কিনেছিলেন তিনি ওসব কিছুই করেননি। দু-চার টাকা খাজনা ছিল বলে দেব দেব করে দেননি।

তাহলে বিশ বাঁও জলে পড়ে গেলেন। এখানে টাকাটা বড় কথা নয়, নিয়ম মেনে চলাই ধর্তব্য। আপনাকে আপটুডেট খাজনা ওর হয়ে দিতে হবে। সেটা ঠিক করব আমরা। আর এসব করে সার্টিফিকেট পেতে বছরখানেক লাগবে। ঠিক আছে, আপনারা আবেদন করুন, আমি দেখছি।

মাসিমা বললেন, মাসখানেকের মধ্যে ব্যাপারটা না হলে খুব মুশকিল পড়ব যে।

আই অ্যাম সরি। আপনার মতো আবেদন করেছেন এমন কয়েকশো কেস পেন্ডিং আছে। অফিসার উঠে দাঁড়ালেন।
 
ভরত সব শুনছিল চুপচাপ। এবার জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু কাজটা করতে কত দিন লাগে?

সেটা বড় কথা নয়। যিনি কাজটা করবেন তার ওপর বাড়তি চাপ আমি দিতে পারি না।

কিন্তু ওঁর টাকার দরকার। নিজের জমি বিক্রি করে টাকা পেতে চান।

আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু সরি বলা ছাড়া কোনো উপায় নেই। অফিসার হাসলেন, অবশ্য আপনাদের যদি বড় ক্যাচ থাকে, যেমন ধরুন মেয়র অথবা পুরমন্ত্রীকে দিয়ে যদি বলাতে পারেন তাহলে তাড়াতাড়ি হয়ে যেতে পারে।

আমার তো তেমন কেউ জানাশোনা নেই। মাসিমা বললেন।

অফিসার মাথা নেড়ে দরজার দিকে এগোচ্ছিলেন ভরত দ্রুত তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল, আপনি বুঝতেই পারছেন উনি বিপদে পড়েছেন। কোনো অন্যায় অনুরোধ করছেন না। আপনি কি হেল্প করতে পারেন না?

অফিসারের ঠোঁট বেঁকাল, আমি সাহায্য করতে চাইলে সবাই বলবে টাকা খেয়েছি। খামোকা বদনাম নেব কেন বলতে পারেন?

টাকা খেয়েছি মানে?

আশ্চর্য! টাকা খেয়েছি মানে জানেন না? সবাই জানে ওই জমির বর্তমান দাম কত। উনি লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগার করবেন জমি বিক্রি করে আর আমি বিনিপয়সায় ওঁকে সাহায্য করছি একথা কর্পোরেশনের একটা ইটও বিশ্বাস করবে না। ওঁর স্বামীকে আমি চিনতাম না। উনি সততা আঁকড়ে থেকে ওঁকে বিপদে ফেলে গেছেন।

ভরত লোকটার মুখের দিকে তাকাল, এই কাজটা সাতদিনের মধ্যে করাতে হলে কত টাকা দিতে হবে? টাকাটা আপনাকে দিলে আপনি নেবেন?

অফিসার ভরতের শক্ত হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলেন, আপনি সরকারি অফিসে এসে ঘুষের প্রস্তাব দিচ্ছেন?

আমি প্রস্তাব দিচ্ছি আপনার কথা শুনে!

আপনারা এবার আসতে পারেন।

ভরত শিথিল হল। মাসিমার সঙ্গে বাইরের করিডোরে বেরিয়ে এল সে। মাসিমা বললেন তুমি ওভাবে বললে কেন বাবা। আমাদের তো কাজটা হওয়া নিয়ে কথা।

কিন্তু লোকটা ওর ডিউটি করবে অথচ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে টাকার কথা বলছিল না? আমি চাইছিলাম ও টাকার কথা বলুক একবার–। ভরত চুপ করে গেল এই সেই দালাল চেহারার লোকটিকে আসতে দেখে। লোকটি বলল, ঝামেলা করলে এ বাড়িতে কোনো দিন কাজ করাতে পারবেন না। আমি ভাল কথা বলছি, মাল ছাড়ুন কাজ হয়ে যাবে।

ভরত কিছু বলার আগেই মাসিমা বললেন, উনি নতুন করে আবেদন করতে বললেন।

ওঁর কথা ছাড়ুন। রাঘব বোয়াল। আপনাদের মাথা খারাপ তাই সরাসরি ওঁরা কাছে গিয়েছিলেন। আমাকে বলুন ঠিক কী কী চাই আপনাদের।

মাসিমা লোকটিকে বিশদে বললেন। লোকটি হাসল, ম্যাক্সিমাম মাসখানেক। আজ দুশো টাকা দিয়ে যান। দিন সাতেক পরে এসে জেনে যাবেন কবে কাগজপত্র হাতে পাবেন। কাগজ পেলে বাকি আটশো দেবেন। খুব সস্তায় করে দিলাম, আমার কিছু থাকবে বলে মনে হয় না।

ভরত চিৎকার করে উঠল, কী বলছেন আপনি? কোনো অন্যায় আবদার করছেন না উনি তবু হাজার টাকা দিতে হবে? এটা কি মগের মুলুক?

এই মেরেছে! এসব কী হচ্ছে? লোকটি বিড়বিড় করল।

সামান্য কিছু লোক করিডোরে ঘোরাফেরা করছিল, চিৎকার শুনে তারাই ভিড় জমাল। একজন জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে ভাই?

ওঁর জমি উনি বিক্রি করবেন। সেই বাবদ কর্পোরেশন থেকে অনুমতি চাইতে এসেছেন। এরা বলছে বছর খানেক লাগবে নয়তো হাজার টাকা ঘুষ দিতে হবে। এর প্রতিবাদ করা উচিত। এখানে কি ঘুষ না দিলে কোনো কাজ হয় না?
 
এইসময় এক রাসভারী চেহারার মানুষ এগিয়ে এলেন, কে ঘুষ চেয়েছে?

ভরত লোকটিকে দেখাল, ইনি।

ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি কর্পোরেশনে চাকরি করেন?

আজ্ঞে না।

তাহলে ঘুষ চাইলেন কেন?

কই, চাইনি তো। লোকটি দুদিকে মাথা দোলালো।

আপনি চাননি? লায়ার!

আমি দালালি চেয়েছিলাম। আদালতে গেলে উকিলরা ফি নেয়, আমি দালালি নিয়ে কাজটা করে দিই। বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করলে খাব কী?

ভদ্রলোক বললেন, এর ঘুষ নেবার কোনো সুযোগ নেই কারণ এখানে চাকরি করে না। অথচ ভাই তুমি চেঁচিয়ে লোকজড়ো করে যা বললে তাতে কর্পোরেশনের মানহানি হয়েছে। তোমার বয়স কম নইলে তোমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে বিপদে ফেলতাম আমি। যান আপনারা, এখানে দাঁড়িয়ে কিছু দেখার নেই। যান। ধমকের সুরে জনতাকে বলা মাত্র ভিড় সরে গেল। ভদ্রলোক চলে গেলে লোকটি বলল, কালিদাস হয়ে গেলে ভাই?

মানে?

যে ডালে বসে আছ তারই গোড়া কাটছ?

মাসিমা এতক্ষণ উদ্বিগ্ন হয়ে শুনছিলেন, এবার বললেন, আপনি ব্যবস্থা করুন আমি ওই টাকা দিতে রাজি আছি। আমার কাজটা পাওয়া নিয়ে কথা।

ওই টাকায় তো আর হবে না মা! লোকটা হাসল।

আপনি তো হাজার টাকা বললেন?

বলেছিলাম। তখন তো দৃশ্যে নতুন অভিনেতার আগমন হয়নি। যিনি এইমাত্র এখানে অভিনয় করে গেলেন তাকে যে দক্ষিণা দিতে হবে এবার। অন্তত দুশো।

ভরত হতভম্ব হয়ে বলল, উনি আপনাকে চেনেন?

বিলক্ষণ। কতবার টাকা নিয়েছেন আমার কাছ থেকে। হ্যাঁ, বারো শো। দুশোই দিয়ে যান, বাকি হাজার কাগজ নেবার সময় দেবেন।

মাসিমা এমন চোখে ভরতের দিকে তাকালেন যে সে মাথা নিচু করতে বাধ্য হল। এই যে দুশো টাকা বেড়ে গেল তা ওর কারণে মাসিমা যেন বোঝাতে চাইলেন।

লোকটা ওদের সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে এল কাগজপত্র এবং দুশো টাকা নিয়ে নিল। ভরত জিজ্ঞাসা না করে পারল না, আপনি এখানে চাকরি করেন না। আর যদি আপনাকে খুঁজে না পাই?

ভয় হওয়াটা স্বাভাবিক। শুনুন। ওই বাড়িতে কত মেয়র এসে চলে গেল, কত অফিসার এসে দুদিনের জন্যে লাঠি ঘুরিয়ে বদলি হয়ে গেল, কত কেরানিবাবু ফেয়ারওয়েল নিয়ে বিদায় হলেন কিন্তু আমি ঠিক এক জায়গায় রয়ে গেছি। মৃত্যু অবধি থাকব। এলে সোনার ডিম পাই, টাকা মারা মানে মুরগির পেট কাটা। ওই চায়ের দোকানে গোবিন্দর খোঁজ করবেন, ওটা আমার নাম।

মাসিমা বললেন, আমি আপনাকে বিশ্বাস করলাম ভাই।

এ লাইনে বিশ্বাসই সব। কিন্তু মা, এই শেষ নয়। আপনি জমিটা তো বিক্রি করবেন?

হ্যাঁ।

তখন আবার আমাকে দরকার হবে।

কেন?

আপনি কাঠা প্রতি কত দাম পাচ্ছেন?

ধরুন এক লক্ষ টাকা।

বাঃ। চার লক্ষ টাকার জন্যে কত স্ট্যাম্প কিনতে হবে জানেন? যিনি কিনবেন তিনি নিশ্চয়ই সেটা দিতে চাইবেন না। তার মানে অন্তত দু লক্ষ হোয়াইট দু লক্ষ ব্ল্যাক করতে হবে। আপনি যদি পঞ্চাশ হাজার কাঠা দেখিয়ে স্ট্যাম্প কেনেন তাহলে অ্যাসেসার সেটা মানবে না। এই সব ঝামেলার সমাধান আমি করে দেব। নিশ্চিন্ত থাকুন। আপনি লাভ করলে আমায় একটু চিড়েগুড় দেবেন, তাতেই আমি খুশি। লোকটা হাসল।
 
ওরা বাইরে বেরিয়ে এল। ভরতের সমস্ত শরীর জ্বলছিল। সে বলল, মাসিমা, আপনাকে ট্রামে তুলে দিলে যেতে পারবেন একা?

তুমি কোথায় যাবে?

ভরত উত্তর না দিয়ে অন্যদিকে তাকাল।

মাসিমা বললেন, আমি তো একাই আসছিলাম, তুমি নিজেই সঙ্গে এলে।

আমি খুব দুঃখিত যে আমি সঙ্গে আসায় আপনার দুশো টাকা খরচ বেড়ে গেল।

মাসিমা গম্ভীর হতে গিয়ে হেসে ফেললেন, তাই তুমি আমাকে একা যেতে বলছ?

মাসিমা, আপনি বুঝতে পারছেন না, এটা প্রতারণা। সাধারণ মানুষকে তার ন্যায্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে চাপ দিয়ে প্রকাশ্যে এরা টাকা রোজগার করছে আর কেউ তার প্রতিবাদ করার কথা ভাবছে না। ঘুষ নেওয়ার মতো ঘুষ দেওয়াটাও এখানে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গেছে। আমি এটা সহ্য করতে পারছি না। ওই দালালটা কেমন দিয়ে দুশো টাকা বাড়িয়ে নিল। আর আপনি এই অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করলেন! ভরত উত্তেজিত গলায় কথাগুলো বলল।

মাসিমা বললেন, তুমি ঠিক বলেছ।

তাহলে আপনি টাকা দিলেন কেন?

না দিয়ে উপায় ছিল না।

কেন?

এক বছর অপেক্ষা করেও হয়তো কাজটা করাতে পারতাম না। কাজটা না হলে আমি টাকা পাব না। তোমার মেসোমশাই-এর চিকিৎসা ভালভাবে হবে না, ছেলেটাকে চাকরি ছাড়িয়ে দিনের

কলেজে ভর্তি করাতে পারব না। আর যদি এক বছর পরে হত তাহলে এই চার লক্ষ টাকার ব্যাঙ্কের সুদ নিশ্চয়ই হাজার টাকার অনেক বেশি হত। দ্যাখো বাবা, জীবন অনেক বেশি সত্য, আদর্শ এবং আবেগ যা আমাদের পূর্বপুরুষ স্থির করে গিয়েছিলেন তার সঙ্গে আজকের পরিস্থিতির কোনো মিল নেই তা আমি এখন হাড়ে হাড়ে বুঝছি। মাসিমা বললেন।

মাসিমার মুখে এমন কথা শুনবে আশা করেনি ভরত। মা বললে মানাতো। ভরতের মনে হল মানুষ এখন নিজের স্বার্থের জন্য যে কোন অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করতে পারে। মাসিমার মতো একজন বয়স্কার ঘরোয়া মহিলাও তার ব্যতিক্রম নয়? প্রায় মুখ বুজে ওরা ট্রাম স্টপে এল। মাসিমা উঠে লেডিস সিটে জায়গা পেয়ে গেলেন। ভরত ভিড় সামলাতে একপাশে দাঁড়িয়েছিল। ট্রাম যত এগোচ্ছে ভিড় তত বাড়ছে। কয়েকজন মহিলা খুব কষ্ট করে দাঁড়িয়ে আছেন সামনে! হঠাৎ তার চোখ পড়ল একটি হাত একজন মহিলার নিতম্বে অশ্লীলভাবে ঘুরছে। কার হাত অথবা কার নিতম্ব সে বুঝতে পারছে না ভিড়ের আড়াল থাকায়। ভরত চোখ সরিয়ে নিল। কিন্তু তার চোখ আবার ফিরে গেল অজান্তেই। দৃশ্যটা এখনও অব্যাহত আছে। বোঝা যাচ্ছে হাতের মালিক মহিলার পাশে দাঁড়িয়ে নেই। একটু দূর থেকেই লোকটা ওই অপকর্ম করছে। মাথায় খুন চেপে গেল ভরতের। সে হাত বাড়িয়ে লোকটার কবজি হ্যাঁচকা টান দিয়ে চিৎকার করল, এই কী হচ্ছে এসব?

ভিড় থাকা সত্ত্বেও ওই টানের ফলে একটি মাঝবয়সী মানুষের মুখ বেরিয়ে এল, আরে, হাত ধরে টানছেন কেন? কী অদ্ভুত!

অদ্ভুত? দেখাচ্ছি মজা! কী করছিলেন আপনি?

আমি? আমি আবার কী করব? ভিড় সামলে দাঁড়িয়েছিলাম! লোকটা হাত ছাড়াতে চাইল।দাঁড়িয়েছিলেন? আপনার হাত কী করছিল?

আমি দাঁড়িয়ে থাকলে হাত কী করতে পারে! অদ্ভুত!

আশেপাশের মানুষগুলো খানিকটা অবাক হয়ে জানতে চাইল, কী ব্যাপার ভাই? পকেটমার নাকি?

ভরত মাথা নাড়ল, না, তার চেয়েও খারাপ!

অ্যাঁ? তার চেয়ে খারাপ! কি করেছে?

উনি ওই ভদ্রমহিলার শরীরে হাত বোলাচ্ছিলেন অনেকক্ষণ ধরে।

সঙ্গে সঙ্গে জনতার নজর লোকটি এবং ভদ্রমহিলাকে আবিষ্কার করতে তৎপর হয়ে উঠল? লোকটি বলল, একদম মিথ্যে কথা বলছ ভাই। ভাল হবে না বলে দিচ্ছি।

তৎক্ষণাৎ একটা মিনি আদালত বসে গেল চলন্ত ট্রামে। দুজন যুবক উদ্যোগী হয়ে বলল, এটা বন্ধ করা দরকার। যদি উনি যা বলছেন সত্যি হয় তাহলে আপনার কপালে দুর্ভোগ আছে। ভিক্টিম কোন্ মহিলা?

তখন তখনও মহিলার মুখ দেখতে পাচ্ছিল না। শরীর দেখিয়ে বলল, ইনি।

ছেলেটি জিজ্ঞাসা করল, দিদিভাই, আপনার শরীরে কেউ কি হাত দিয়েছিল।

আমার শরীরে? ওমা, ওসব কী কথা? গলার স্বর শুনতে পেল ভরত।

উনি অভিযোগ করছেন, ওকে আপনার শরীরে হাত বোলাতে দেখেছেন।

আমার কি গণ্ডারের চামড়া যে কেউ হাত বোলালে টের পাব না। আর তেমন হলে জুতিয়ে মুখ ছিঁড়ে দিতাম না। ভদ্রমহিলা ঝাঁঝিয়ে উঠলেন।

সঙ্গে সঙ্গে তখনও কবজি ধরে থাকা লোকটি বীরবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ল, বদনাম, বদনাম দিচ্ছিস শালা। আমার প্রেস্টিজ-এর বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছিস!
 
ভরত-এমন হতভম্ব হয়ে পড়েছিল যে লোকটা তাকে কয়েক ঘা দেওয়া সত্ত্বেও সে কথা বলতে পারছিল না। সে ভুল দ্যাখেনি। তাহলে ওই ভদ্রমহিলা অস্বীকার করলেন কেন? ওই হাত বোলানো কি উনি উপভোগ করেছেন? কোনও মহিলা তা পারেন! এখন চলন্ত ট্রামে দু একজন তাকে লক্ষ্য করে টিপ্পনী কাটছে। ভিড় হালকা হচ্ছে। সেই লোকটাও সদর্পে নেমে গেল। ভরত মহিলার দিকে তাকাল। মাসিমার পাশে বসার জায়গা পেয়েছেন তিনি।

সে সোজাসুজি মাসিমার সামনে গিয়ে বলল, ওঁকে জিজ্ঞাসা করুন তো কেন মিথ্যে কথা বললেন!

এবার ভদ্রমহিলা ভরতকে দেখলেন। তারপর ট্রামের ভেতরটা নজর বোলালেন। মাসিমা তাকে নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ব্যাপারটা কি ঠিক?

লেডিস সিটে আর কেউ নেই, কাছাকাছি বলতে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা কন্ডাক্টর। ভদ্রমহিলা বললেন, আমি যদি অস্বীকার না করতাম তাহলে ট্রামে যাতায়াত করা অসুবিধে হয়ে যেত। বাসে যা ভিড় আমি উঠতেই পারি না। স্বীকার করলে আমি দ্রষ্টব্য বস্তু হয়ে যেতাম। এর আগে একটি মেয়ে প্রতিবাদ করেছিল, লোকটাকে গালাগাল দিয়েছিল। কিন্তু তারপর বেচারাকে অনেকবার শুনতে হয়েছে ছেলেদের উল্লাস, এই মেয়েটা এই মেয়েটা। গায়ে হাত সহ্য করার চেয়ে সেটা অনেক মর্মান্তিক।

ভরত শুনছিল। জিজ্ঞাসা করল, তাই বলে আপনি প্রতিবাদ করবেন না?

তখন তো আমি ভাল করে দাঁড়াতেই পারছিলাম না। কোন ফাঁক দিয়ে হাত বাড়িয়েছে, আমি না দেখে ধরব কাকে? ভদ্রমহিলা উঠে দাঁড়ালেন। ট্রাম দাঁড়ানো মাত্র নেমে গেলেন। এবং কন্ডাক্টর ওদের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন, ভাই, পঁচিশ বছর এই চাকরি করছি। লেডিজদের ব্যবহার একটু একটু করে কিরকম পাল্টে গেল। আগে সামান্য ধাক্কা লাগলে শুনতে পেতাম আপনাদের বাড়িতে মা বোন নেই? বদমাস ইতর এইসব গালাগাল। এখন ভিড় ট্রামে ওঁরা যখন উঠতে চান আর আমি নিষেধ করি তখন শুনতে পাই, আমি কি মোমের পুতুল যে গায়ে গা লাগলে ক্ষয়ে যাব? লেট মার্ক পড়ে গেলে আপনি বাঁচাবেন?

ভরত কথা বলল না। হঠাৎ তার অন্য কথা মনে এল। একটি মেয়ের হাত কনুই পিঠে ভিড়ের চাপ পড়লে কেউ কিছু মনে করে না, তিনিও এখন ব্যাপারটাকে অস্বাভাবিক ভাবে নেন না। কিন্তু বুক বা নিতম্বকে আলাদা করে দেখা হয় কেন? ওইসব জায়গাগুলো কি খুব সেন্সেটিভ বলে হাত-পা থেকে আলাদা? শরীরের যেসব জায়গা মেয়েরা ঢেকে রাখে তার মধ্যে তো পিঠও পড়ে। তাহলে পিঠে চাপ পড়লে কেউ কিছু মনে করে না কেন?

ট্রাম থেকে নেমে মাসিমা জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি সবসময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করো? এই আজ যেমন দেখলাম?

এতদিন করতাম না, কারণ এসব ব্যাপারে সামনে কখনও যাইনি।

কিন্তু কোনটা ন্যায় কোনটা অন্যায় তুমি বুঝবে কী করে?

আশ্চর্য! এ আপনি কী বলছেন?

ঠিকই বলছি বাবা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুর চেহারা বদলে যাচ্ছে। তুমি এমন হট করে মাথা গরম করে না। সস্নেহে কথাগুলো বললেন ভদ্রমহিলা।

ভরতের মনে হচ্ছিল চার লক্ষ টাকার জমি বিক্রি করার ইচ্ছায় মাসিমারও চরিত্র বদল হয়ে গেছে।

বাড়িতে ফিরে ভরত জিজ্ঞাসা করল, তুমি চাবি কোথায় রেখে গিয়েছিলে?

মা রান্নাঘরে ছিল, বলল, কেন?

তুমি দুপুরে বেরিয়েছিলে?

হ্যাঁ। রবীনবাবুদের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলাম। কেন, তুই এসেছিলি?

হঠাৎ ওখানে?

ইচ্ছে হল, গেলাম।

তোমাদের ব্যাপার-স্যাপার আমি বুঝতে পারি না।

তুমি নিজের কাজ করো, আমাদের ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। কিন্তু আজ তোর ক্লাস হয়নি? দুপুরে ফিরে এলি হঠাৎ?

এলাম। ভরত নিজের ঘরে চলে গেল। জামা ছেড়ে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। কিছু ভাল লাগছে না। আজকাল যেন কারো সঙ্গে কোনো কিছুর সঙ্গে তার মিল হচ্ছে না। তার মনে হচ্ছিল এখন কলকাতার বেশির ভাগ মানুষই মুখোশ পরে বেঁচে আছে।

শরীর খারাপ? মায়ের গলা পেল ভরত।

না। একটুও না নড়ে জবাব দিল সে।

তোর হয়েছেটা কী? আজকাল সব ব্যাপারে উল্টোপাল্টা কথা বলছিস, সবসময় মুখে বিরক্তির চিহ্ন। কলেজে ঢোকার পর এমন পাল্টে গেলি কি করে?

চিত হয়ে শুলো ভরত, এতকাল তোমরা আমার চোখে ঠুলি পরিয়ে রেখেছিলে বলে সত্যিকারের চেহারা দেখতে পাইনি। এখন দেখে থই পাচ্ছি না।

তার মানে?

তোমরা কি অদ্ভুতভাবে বেঁচে আছ মা!

আমরা? যেভাবে সাধারণ মানুষ বেঁচে থাকে সেইভাবেই আছি। তুই কি পাগল হয়ে গেছিস? কি উদ্ভট কথা বলছিস?

তাই? অন্ধের দেশে গেলে চোখ খুলে রাখলে অশান্তি হবেই, কথাটা সত্যি।

ভরত! তুই কী বলতে চাইছিস? মায়ের গলা চড়ল।
 
আমি যাদের দেখছি তাদের কেউ আর নিজেকেও বিশ্বাস করে না। সততা শব্দটা অভিধান থেকেও মুখে গেছে যেন। শুধু স্বার্থ, স্বার্থ নিয়ে বেঁচে থাকবে বলে প্রত্যেকে নিজেকেও নিজের অজান্তে ঠকিয়ে যাচ্ছে। এই যে তুমি, এত বছর ধরে বাবার সঙ্গে রয়েছ কিন্তু তোমাদের সম্পর্কটা কী? স্বামী-স্ত্রীর?

সে কী? তাহলে আমরা কী?

কী রকম স্বামী-স্ত্রী। প্রতিটি দিন যে কোনো ইস্যুতেই দুজনে দুজনকে চরম গালাগাল করছ। তখন দেখে মনে হয় কেউ আর কারও মুখ দেখবে না। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছ না। অথচ তার পরেই দুজনের কমন স্বার্থে ঘা পড়লে এমন এক হয়ে যাও দেখে কে বুঝবে একটু আগে খেয়োখেয়ি করছিলে। তোমরা নিজেদের কি করে এত বছর টলারেট করছ তা তোমরাই জানো! ভরত মুখের ওপর বলে ফেলল।

মা যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। ধীরে-ধীরে চেয়ারে বসে পড়ল। তার চোখ অদ্ভুতরকমের বড় দেখাচ্ছে। ভরত হাসল, তোমরা যে লোকটাকে সমালোচনা করো, ব্যঙ্গ করো নোংরা বললো সেই লোকটারই বন্ধুত্ব পাওয়ার জন্যে লালায়িত হও যখন জানতে পার তার হাতে ক্ষমতা আছে। তার ফ্ল্যাটে গিয়ে গল্প করে আসতে সম্মানে লাগে না তোমার। পাশের ফ্ল্যাটের মিসেস মুখার্জির সঙ্গে তোমার বোধহয় এখন খারাপ সম্পর্ক তাই তিনি ঠাট্টা করেন বলেন এখন তোমার মায়ের চাবি রাখার অনেক জায়গা হয়েছে। মা, আমি জানি না বাবা ঘুষ নেয় কি না, চুরি করে কি না! এখন মনে হচ্ছে নেয়। আগে কখনও ভাবিনি এখন চিন্তা করলে বুঝতে পারি মাইনের টাকায় রোজ স্কচ খাওয়া যায় না। ঘুষের ফ্লো বজায় রাখার জন্যই ম্যানেজিং ডিরেক্টরের মন পাওয়াটা জরুরি আর তাই ওই শ্রমিক নেতাকে তেল মাখাতে তার আপত্তি নেই। সব রকম বিবেক বিসর্জন দিয়ে। আরও শোনো, একজন শ্রমিক নেতা নয় লক্ষ টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কিনেছেন। পার্টিতে তাঁর ইনফ্লুয়েন্স খুব। অন্যের পয়সায় স্কচ খেতে তিনি অভ্যস্ত। সাধারণ মানুষের ছেলেমেয়েদের দেরিতে ইংরেজি শেখাতে বলে নিজের মেয়েকে ইংরেজিতে কইয়ে বলিয়ে করতে চান। আজকের কাগজে একটা খবর বেরিয়েছে। একজন শ্রমিক নেতার কাজই হল বড় বড় রেস্টুরেন্টের কর্মচারীদের খেপিয়ে মালিকদের বিরুদ্ধে ধর্মঘট করানো। ধর্মঘটী শ্রমিকরা যখন অভুক্ত অবস্থায় ইনক্লাব জিন্দাবাদ করছে তখন মালিক বেনামদারকে রেস্টুরেন্ট বিক্রি করে দিচ্ছেন নেতাকে তুষ্ট করে। নতুন মালিক যখন রেস্টুরেন্ট খুলছে তখন তার বিরুদ্ধে তো আন্দোলন করা যায় না এই অজুহাত দেখিয়ে আন্দোলন তুলে নিয়ে পুরনো কিছু কর্মীর বদলে নিজের লোক ঢোকাচ্ছেন নেতা। ওইসব কর্মীর অপরাধ তারা পেটের জন্যে বসে না থেকে সাময়িকভাবে অন্য কাজ খুঁজে নিয়েছিল। এই নেতার পক্ষে নয় লক্ষ টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কেনা সম্ভব এবং পার্টি কোনো আপত্তি করে না। তোমার কোনো কাজ সরকারি অফিসে থাকলে টাকা না দিলে সেটা হওয়া অসম্ভব। যে লোকগুলো টাকা নিচ্ছে তারা কারও বাবা কারও ছেলে। বাড়িতে ফিরে এসে তাদের বিবেকের কোথাও কোনো অস্বস্তি হয় না। ট্রামেবাসে মেয়েদের শরীর স্পর্শ করলে এখন তারা উপেক্ষা করেন কারণ প্রতিবাদ করলে আরও বড় লজ্জায় পড়তে হবে। নিচের তলায় প্রণবের মা ঘুষ দিলেন কর্পোরেশনকে কারণ তিনি জমি বিক্রি করে চার লক্ষ টাকা পাবেন। আমি এগুলো মানতে পারছি না, মানতে খারাপ লাগছে কিন্তু আমি একা তো কিছু করতে পারি না। একটানা কথাগুলো বলে থামল ভরত।

মা চুপচাপ বসেছিল। এবার জিজ্ঞাসা করল, তোর মাথায় এসব কে ঢোকাল?

তোমরা।

আমরা? মা অবাক।

হ্যাঁ। ছোটবেলা থেকে যদি বোঝাতে বড় হয়ে ঘুষ নিবি, স্বার্থের বাইরে এক পা হাঁটবি, যার সঙ্গে ঝগড়া করবি তার সঙ্গেই ভাব করবি, অসৎ না হলে তুই বড় হতে পারবি না তাহলে আজ সবাইকে স্বাভাবিক বলে মনে হত। কিন্তু তোমরা আমাকে বিবেকানন্দ রবীন্দ্রনাথের কথা বলতে। সতোর জয় সর্বত্র বলে গল্প শোনাতে। এই তুমি স্কুলের প্রথমদিকে কেউ আমার টিফিনে ভাগ বসালে ঝগড়া করতে নিষেধ করতে। মানুষ করেছ এক ভাবে আর নিজেরা বেঁচে আছ অন্যভাবে। ধাক্কাটা লেগেছে সেই কারণে।

তুই ঠিক কী চাইছিস?

আমি জানি না। তাহলে আগে সেটা ঠিক করে নে তারপর তোর সঙ্গে কথা বলব। মা উঠে গেল।
 
খারাপ লাগছিল। খুব খারাপ। অন্ধকার ঘরে একা শুয়ে ভরতের মনে হল তার এই খারাপ লাগাটা কি মিথ্যে? কলকাতার অন্য কোনো ছেলের কি এমন অনুভূতি হয় না। আর কেউ কি খোলা চোখে চারপাশের জীবন দ্যাখে না? দেখলে তারা কি করছে? অর্ণব বসু রায় একদিন বলেছিল, সত্তর দশকে কিছু মানুষ আমাদের দেশের রাজনৈতিক সামাজিক ব্যবস্থা পাল্টে ফেলার জন্যে আন্দোলন করেছিল। জনসাধারণ তাদের পাশে না দাঁড়ানোয় সেই সেই আন্দোলন বিপ্লব হতে পারেনি। জনসাধারণ কেন সমর্থন করেনি জিজ্ঞাসা করাতে অর্ণব বসু রায় বলেছিল, ওরা বিদেশি রাষ্ট্রের চেয়ারম্যানকে নিজেদের চেয়ারম্যান বলেছিল। পরের দিকে নিজেদের মধ্যে দলাদলি করে লক্ষ্য হারিয়েছিল।

এই ব্যাপারটাও ভরতের মাথায় ঢোকেনি। আমাদের দেশের দুর্নীতিগ্রস্ত পরিবেশকে বদলানোর জন্যে কেন বিদেশি রাষ্ট্রের চেয়ারম্যানকে মাথায় তুলতে হবে তা তিনি যতই আদর্শবান পুরুষ হোন না কেন? ঠিক একই ভাবে পশ্চিমবঙ্গ আর শক্তিমান রাজনৈতিক দলের নামে ব্রাকেটে এক শব্দটিকে তার অকারণ বলে মনে হয়। গোড়ার দিকে প্রয়োজন ছিল কি না সে জানে না। কিন্তু এখন ওই দল নিজস্ব নীতি অনুযায়ী পরিচালিত হয়। নামের পাশে লেজুড় রাখার কোনো যুক্তি এখন নেই।

আমি একা কিছুই করতে পারব না। একা কিছু করার চেষ্টা করলে উল্টে বোকা বনে যেতে হবে। আজ সকালে ট্রাফিক পুলিশটার অভিজ্ঞতা তাই বলে। বেল বাজল। ভরত অনুমান করল বাবা ফিরেছে। এখন মা বাবাকে তার কথা বলবে। বাবার মেজাজ ভাল থাকলে কথাগুলো উপেক্ষা করে। খারাপ থাকলে ওখান থেকেই চেঁচাবে।

সেই সকালে খেয়েছিল সে। বাড়ির ফেরার পর খাওয়ার কথা ওঠেনি। সারাদিন ধরে যেসব টেনসন গিয়েছে তাতে শরীর বেশ কাহিল। এখন জোর খিদে পাচ্ছে। অথচ এখান থেকে উঠে যাওয়ার পর মা একবারও তাকে খেতে ডাকেনি। অন্যদিনে বিকেলে জলখাবার না খেলে মা রাগারাগি করে আর আজ খাওয়ার কথাই বলেনি। বাংলা সাহিত্যে যেসব মায়ের কথা বলা হয়েছে। তারা কেউ এমন আচরণ করেনি। সেইসব মায়েরা বুক ভর্তি স্নেহ রাখত এবং সন্তানের মঙ্গ লের জন্যে অল আউট যেতে পারত। আমরা এখনও তাদের কথা উপন্যাসে পড়ি কিন্তু জীবন থেকে কখন যে তারা ঝরে গেছে সেই খবর রাখি না। এখনকার উপন্যাসের মা বিয়াল্লিশ বছরেও বন্ধু সঙ্গে সিনেমায় যায়, পঞ্চাশেও প্রেম করতে পারে। মা হওয়া মানে তার অন্যান্য সব শখ আহ্লাদের গায়ে পেরেক পোতা, এমনটা ভাবার দিন জীবনে চলে গেলেও সাহিত্যে যায়নি। মায়ের ভাবনায় আঘাত লেগেছে বলে ভরতকে খেতে ডাকা হয়নি। এখন ভরত নিজে খাবার নিয়ে খাবে কি না সেটা তার বিচার্যবিষয়।

ভরত ঠিক করল সে খাবে। বিছানায় উঠে বসতেই ঘরের আলো জ্বলল। বাবা এসে দাঁড়িয়েছে পোশাক পাল্টে, আয়। খাবি।

খুশি হল ভরত। যাক, নিজে গিয়ে নিতে হল না।

ধারে কাছে মা নেই, টেবিলে খাবার সাজানো রয়েছে। দামি হোটেলের ফিসফ্রাই বোঝা যাচ্ছে। বাবা এনেছে। চেয়ারে বসে খেতে শুরু করল ভরত। বাবা উল্টো দিকে বসে ফ্রাই ভেঙে জিজ্ঞাসা করল, টেস্ট কেমন?

ভরত মাথা নাড়ল, ঠিক আছে।

এটা কোনো উত্তর হলেও কোন টেস্টটা ঠিক তুই জানতিস? তার কোনো নির্দিষ্ট মান থাকে? বাবা হাসল, তোর ভাল লাগছে না খারাপ লাগছে সেইটে বল।

ভাল।

গুড। কলেজ কেমন লাগছে? বাবা খাওয়া শুরু করল।

হঠাৎ এই প্রশ্ন?

তুই কলেজে যাচ্ছিস, সড়গড় হয়ে গেছিস, এখন প্রশ্ন করাটা কি আচমকা হলো?

ঠিকই আছে।

তুই যে উদ্দেশ্যে কলেজে ঢুকলি সেটা পেতে গেলে একটু বেশি খাটতে হবে। এই সময় অন্য কোনো দিকে মন দেওয়া মানে আলটিমেটলি তোর নিজেরই ক্ষতি।
 
ভরত এক মুহূর্তের জন্যে খাওয়া থামাল, কিন্তু কিছুই বলল না। এতক্ষণে বাবা লাইনে নিয়ে আসছে আলোচনাটা তা সে বুঝতে পারল।

বাবা বলল, হাতের পাঁচটা আঙুল এক মাপের হয় না। একসঙ্গে থাকতে গেলে মতবিরোধ, ঝগড়াঝাটি হয়। কিন্তু আঙুলগুলো যেমন একটা হাতেরই অংশ তেমনি আমরা তিনজন একটি পরিবারের। এই কথাটা মনে রাখিস।

হঠাৎ এই কথা?

তোর মাথায় যেসব ভাবনাচিন্তা পাক খাচ্ছে তা তোর মাকে কষ্ট দিচ্ছে।

আমি অন্যায় বললে মা প্রতিবাদ করত।

জীবনে সবসময় ন্যায় অন্যায় এক খাতে বয় না। আজকে যেটাকে তোর অন্যায় বলে মনে হচ্ছে কাল সেটাকে তা নাও মনে হতে পারে। ধর, গাছ কাটা অন্যায়। একটা বড়সড় গাছ, যেমন ধর আম, কেটে ফেলা মানে অপরাধ করা। কিন্তু ওই আমগাছটা যদি বাড়ির গা ঘেঁষে বড় হয় তাহলে তার শেকড় বাড়িটার ক্ষতি করবে। নিজেদের নিরাপত্তার জন্যে গাছটাকে তখন কেটে ফেলতেই হবে। এটাকে আর অন্যায় বলা যাবে না।

হয় তো!

হয় তো নয়। এটা ঠিক। আজ আমরা যে যা করছি তা সবই নিজেদের নিরাপত্তার জন্যে। এই নিজেদের মানে আমি একা নই, আমি, তোর মা এবং তুই। তার চেয়ে বড় কথা আলটিমেটলি তুই হবি গেনার। আমরা যখন থাকব না তখন আমাদের যা কিছু তুই পাবি। তোকে ভালভাবে রেখে গেলে আমরা শান্তি পাব।

আমি ভালভাবে থাকব কিনা সেটা তোমরা জানো না।

তার মানে?

আমি মনে করি না প্রচুর টাকার মধ্যে বাস করলেই কেউ ভালভাবে থাকতে পারে। ভরত উঠে দাঁড়াল। বাবা চোখ কোঁচকালো। কিছু বলল না। ভরত টয়লেটে ঢুকে গেল।

ঘন্টা দুয়েক এই ফ্ল্যাট চুপচাপ ছিল। আজ মা টিভিও চালায়নি। টেবিলে বসে পড়ছিল ভরত। হঠাৎ মায়ের গলা কানে এল, না। যাবে না তুমি!

নো। আমাকে কথা বলতে হবে। হি ইজ মাই সন।

কাল সকালে কথা বলো। এখন নয়।

হোয়াই নট?

তুমি অনেকটা ড্রিঙ্ক করেছ। কী বলতে কী বলে ফেলবে।

শাট আপ। আমি ড্রাঙ্ক নই। আজ পর্যন্ত কখনও মাতাল হতে দেখেছ? আমার মনে হচ্ছে। কেউ ওর ব্রেন ওয়াশ করছে। আমি কথা বলবই।

যা ইচ্ছে তাই করো। আমার আর ভাল লাগছে না।

তারপরেই বাবার গলা কানে এল, ভরত!

ভরত তাকাল না। মুখে বলল, বলো।

তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল।

আমি এখন পড়ছি।

আমাকে তুমি পড়া দেখিও না। আমিও স্কুল ফাইনালে ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছিলাম। তখনকার পরীক্ষার সিস্টেম ছিল অনেক স্টিফ। এখনকার মতো টি দিয়েই নম্বর পাওয়া যেত না। ওয়েল। তোমার বন্ধুবান্ধব কারা? নাম বলো!

তোমার সে সব জেনে কী লাভ হবে?

সেটা আমি বুঝব!

আমার কোনো বন্ধু নেই।

মিথ্যে কথা?

আমি মিথ্যে কথা বলতে যাব কেন? তাহলে ওইসব আহাম্মকি কে তোমার ঢোকাচ্ছে? হাউ ডু ইউ নো যে টাকা থাকলেই ভাল থাকা যায় না? কী অভিজ্ঞতা আছে তোমার?

ভরত এবার ঘুরে বসল, তোমার টাকা আছে?

হ্যাঁ। ইয়েস। আছে। যা আছে তাতে ভালভাবে চলে যাবে।

তুমি কি ভাল আছ?

হোয়াট ডু ইউ মিন? আমি খারাপ আছি? আমার মতো ভাল কটা মানুষ আছে?
 

Users who are viewing this thread

Back
Top