What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected তনু অতনু সংবাদ (1 Viewer)

বাঃ। আমি কিন্তু প্রশ্নটা না করতেই আপনি প্রশ্ন ভেবে নিয়েছেন। যাক গে। আপনি যখন ঔরঙ্গজেবের চার পূর্বপুরুষের নাম জানেন তখন নিশ্চয়ই আপনার চার পূর্বপুরুষের নাম জানা। বলুন তো! প্রতিমা তাকাল।

মাথা নামাল সত্যচরণ, তারপর বলল, বাবা, দাদু।

ওঁদের কোনও নাম নেই বুঝি–! প্রতিমা থামিয়ে দিল।

শ্ৰীযুক্ত সতীশ রায়, স্বর্গীয় সত্যসিন্ধু রায়–। চোখ বন্ধ করল সত্যচরণ। আর কোনও নাম মনে পড়ছিল না।

আপনি ওঁকে বলে দিন। প্রতিমা অনুরোধ করল সতীশ রায়কে।

ও জানলে তো বলবে। মোগল সম্রাটদের নাম মুখস্থ রেখেছে কিন্তু–। যাক গে। সাতকড়ি রায়, শুদ্ধানন্দ রায়।

দ্বিতীয় প্রশ্ন। আপনি আপনার বাবাকে ব্যবসায় সাহায্য করেন। তার মানে রোজগারের ব্যাপারে বাবার ওপর নির্ভরশীল। আচ্ছা ধরুন, বিয়ের পর আপনার বাবা আপনাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলেন। আমাকে তো আপনার সঙ্গে বেরিয়ে যেতে হবে। তখন আমরা কোথায় থাকব, কীভাবে খাওয়া দাওয়া করব?

বাবা আমাকে তাড়িয়ে দেবেন না। অন্যদিকে তাকিয়ে বলল সত্যচরণ।

–-আচ্ছা, যদি দেন–।

দিলে তো এতদিনে দিতেন। মুখ নামাল সত্যচরণ।

জবাব দাও। তোমাকে বেরিয়ে যেতে বলিনি বলে কোনদিন বলব না একথা ভাবার কোনও কারণ নেই। বলেই প্রতিমার দিকে তাকিয়ে হেসে মাথা নাড়লেন।

একটা কিছু করতে হবে।

ব্যাস। এটাই শুনতে চেয়েছিলাম। আপনার মনে হচ্ছে এখানে বসে থাকতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। যান, ভেতরে যান।

প্রতিমা কথা শেষ করতেই মহাদেব সেনকে নমস্কার করে ভেতরে চলে গেল সত্যচরণ। সতীশ রায় জিজ্ঞাসা করলেন, কী বুঝলে?

বেশ নিরীহ। বলেই হেসে ফেলল প্রতিমা।

হুম। কিন্তু তোমাকে শক্ত হাতে হাল ধরতে হবে। এমনটাইট দেরে যাতে চোখে সরষের ফুল দ্যাখে। সতীশ রায় হাসলেন।

না না। মহাদেব সেন বললেন, একে মা মনসা, আপনি তার ওপর–।

তুমি আমাকে মনসা বললে দাদু? মনসা তো ভগবান। প্রতিবাদ করল প্রতিমা।

হরিপদ ট্রে নিয়ে এল। তাতে নানান রকমের খাবার সাজানো মাছের বড়া, ফিশফ্রাই, সন্দেশ, রসগোল্লা।

মহাদেব সেন মাথা দোলালেন, এর সবকটাই আমার কাছে নিষিদ্ধ বস্তু।

কেন? সতীশ রায় জিজ্ঞাসা করলেন।

ভাজা খাওয়া বারণ হার্টের জন্যে। মিষ্টি নিষিদ্ধ ব্লাডসুগারের জন্যে।

ও। সতীশ রায় ভেবে পাচ্ছিলেন না কী করবেন।

হরিপদদা। দরজার বাইরে থেকে এলোকেশীর গলা ভেসে এল।

হরিপদ দ্রুত বাইরে চলে গেল। ফিরে এল আধ মিনিটের মধ্যেই। এসে বলল, আজ্ঞে, চিনিছাড়া সন্দেশ খেতে কি আপত্তি আছে?

চিনি ছাড়া সন্দেশ? সে তো কলকাতার বড় দোকানে পাওয়া যায়। মহাদেব সেন বললেন, মিষ্টি না থাকলে সন্দেশ কি সন্দেশ থাকে?

সতীশ রায় বললেন, এলোকেশী বলেছে যখন তখন নিয়ে এসো।

পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সন্দেশ চলে এল। গোটা চারেক।
 
ইতস্তত করে মুখে দিলেন মহাদেব সেন, চোখ বন্ধ করে চিবিয়ে বললেন, চমৎকার মিষ্টি যা আছে তা বোঝা যাচ্ছে না। কে বানাল?

আজ্ঞে এলোকেশী।

বাঃ। দুটো সন্দেশ খেয়ে নিলেন মহাদেব সেন।

হরিপদ এবার প্রতিমার দিকে তাকিয়ে বলল, মা, আপনি।

এম্মা! আমাকে আপনি বলছেন কেন? আমি কত ছোট। আপনি সত্যচরণবাবুকে কি আপনি বলেন?

না না। এইটুকু থেকে দেখে আসছি, তাই–।

আমাকে যদি এ বাড়িতে এসে থাকতে হয় তাহলে আপনি বলা চলবে না। হুঁ। আমি একটা ফ্রাই খাব। আর কিছু নয়। প্রতিমা বলল।

খাওয়া শেষ হলে সতীশ রায় হরিপদকে ডেকে বললেন, একবার এলোকেশীকে এখানে আসতে বলে।

মিনিট দুয়েক বাদে এলোকেশী এল। সতীশ রায় অবাক হয়ে দেখলেন শাড়ি-জামা এবং চুল বাঁধায় একটু সাজ সাজ ভাব এনেছে এলোকেশী। ঘরে ঢুকে নমস্কার করল হাতজোড় করে।

এই হল এলোকেশী।

খুব ভাল সন্দেশ খেলাম। মহাদেব সেন বললেন।

ফ্রাই-ও। প্রতিমা বলল।

সতীশ রায় বললেন, মা, তুমি তো আমাদের বাড়ি দেখতে এসেছ। যাও, এলোকেশীর সঙ্গে ঘুরে দ্যাখো বাড়িটা।

উঠে দাঁড়াল প্রতিমা। বলল, যাই।

ওরা বেরিয়ে যেতে মহাদেব সেন বললেন, নাতনির সব ভালো কিন্তু কবে যে ম্যাচিওরিটি আসবে কে জানে!

আপনি ভুল করছেন। আজকালকার ছেলেমেয়েরা এমন সহজভাবে জীবনকে গ্রহণ করতে জানেই না। ম্যাচিওরিটি মানে মুখ বন্ধ করে যদি প্যাঁচ ক্য হয় তাহলে আমি চাইব সেটা যেন ওর কখনই না আসে। সতীশ রায় বললেন।

.

এইটে বাবুর শোওয়ার ঘর। সতীশ রায়ের বেডরুমের সামনে দাঁড়িয়ে বলল এলোকেশী।

বাবু কে? প্রতিমা তাকাল।

তোমার ভাবী শ্বশুরমশাই। এলোকেশী হাসল।

ওমা। তাঁকে তুমি বাবু বলো নাকি?

এখানে, এই ডুডুয়াতে সবাই ওঁকে বড়বাবু বলে।

বড়বাবু শুনতে ভালো। বাবু বোলা না।

এইটেতে অতিথি এলে থাকে। হরিপদ বলল।

ও।

ওদিকে আরও দুটো খালি ঘর আছে।

ও।

এই যে উঠোন। উঠোনের ওপাশে রান্নাঘর, এদিকের ছোট ঘর দুটোর একটা মোতির মা আর আমি থাকি, অন্যটায় হরিপদদা।

মোতির মা কে?

মাতির মা খোকাবাবুর জন্ম থেকে আছে। ওর মা মারা যাওয়ার পর থেকেই খোকাবাবু যেমন মতির মা ছাড়া চলতে পারে না তেমনি মতির মা খোকাবাবুর কোনও দোষ দেখতে পায় না। খুব ভালোবাসে ওকে। কথা শেষ করে এলোকেশী ডাকল, মতির মা, ও মতির মা!

সলজ্জ ভঙ্গিতে বেরিয়ে এল মতির মা। পরিষ্কার থান পরনে, মাথায় ঘোমটা। এলোকেশী বলল, এই হল মতির মা।
 
প্রতিমা দ্রুত এগিয়ে নিচু হয়ে প্রণাম করতেই মতির মা হাউমাউ শব্দ করে লাফিয়ে সরে গিয়ে বলতে লাগল, পাপ হবে, মহা পাপ হবে।

তার মানে? কার পাপ হবে? প্রতিমা অবাক।

আমার! ঘোমটা টেনে দিল সামনে মতির মা।

কেন?

আমি এ বাড়িতে কাজ করি, বাড়ির বউ যে হতে যাচ্ছে সে কেন আমাকে প্রণাম করবে? আমারই প্রণাম করা উচিত। হাত নিচু করে এগোল মতির

আপনি কি পাগল? হেসে ফেলল প্রতিমা। আমার মায়ের চেয়ে কতবড় আপনি! ছি ছি ছি।

হঠাৎ দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলল মতির মা। এলোকেশী কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ওকি! কাঁদছ কেন? কী হল?

কান্না জড়ানো গলায় মতির মা বলল, দুশ্চিন্তায় ঘুমাতে পারতাম না। আজ যে কী ভালো লাগছে। এলো, আমার খোকাবাবু ভাগ্য করে এসেছিল, নইলে এমন মেয়ে এই ঘরে আসে!

যাচ্চলে! তুমি এখনও তোমার খোকাবাবুর কথা ভাবছ। এলোকেশী হেসে ফেলল, কার সঙ্গে বিয়ে হবে, সেই বউ কী রকম এই ভেবে খাওয়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল মতির মায়ের। তোমাকে দেখে শান্তি পেয়েছে।

খুব নরম মন গো, কবিতা লেখে তো। মতির মা বলল।

অ্যাঁ! কবিতা লেখে নাকি!

না না, আগে লিখত না। এই এক মাস হল শখ হয়েছে। বিয়ের পর যদি নিষেধ করা হয় তাহলে লিখবে না। মতির মা বলল।

প্রতিমার খুব মজা লাগছিলমতির মায়ের কথা শুনে।

এলোকেশী বলল, সেসব পরে হবে। আগে ওকে বাড়িটাকে দেখতে দাও। এই হল রান্নাঘর। এটা খাবারের জায়গা। আর ওপাশে খোকাবাবুর ঘর। মানে এখন পর্যন্ত ঘরটার ওই নাম, পরে তোমার ঘর হয়ে যাবে। ঘরটা দেখবে নাকি?

মতির মা বলল, তোর কি বুদ্ধি লোপ পেয়েছে! এখনও কোন সম্পর্ক তৈরি হয়নি, এই অবস্থায় কি ওর ওই ঘরে যাওয়া উচিত?

প্রতিমা হাসল; সম্পর্ক তৈরি না হলে কি যাওয়া যায় না?

তুমি তো এখনও কুমারী, আইবুড়ো ছেলের ঘরে যাওয়া ঠিক নয়! বেশ গম্ভীর মুখে কথাগুলো বলল মতির মা।

বেশ। তাহলে ওই ঘরে যাব না। তোমাদের বাড়িতে ঠাকুরঘর কোথায়?

ছিল। খোকার মা মারা যাওয়ার পর বড়বাবু বাড়িতে পুজো বন্ধ করে দিয়েছেন। ওই ঘর তালাবন্ধ। তুমি এসে যদি পারো তাহলে তালা খুলিয়ো।

ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে মনে পড়ে যাওয়াতে প্রতিমা মতির মাকে বলল, তোমার খোকাবাবু শুনলাম পরিশ্রম করে না। ওকে কি খাইয়ে দাও তুমি?

না না। প্রতিবাদ করল মতির মা, নিজের হাতে খায়। মা-মরা ছেলে তো, বেশি পরিশ্রম করলে যদি কিছু হয়ে যায়, তাই!…

একি কথা! ব্যাটাছেলে ন্যাকাচৈতন্য হয়ে থাকবে নাকি! এতদিন যা করেছে করেছে, এরপর ওসব চলবে না বলে দিয়ে।

সতীশ রায়ের গলা ভেসে এল, হরিপদকে ডাকছেন।

হরিপদ বলল, খোঁজ পড়েছে, এবার ও ঘরে যেতে হয়।

ঘরে ঢুকতেই সতীশ রায় জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন দেখলে?

ভালো।

হরিপদরা যেমন রেখেছে তেমন আছে।

মহাদেব সেন বললেন, আজ তাহলে চলি।

সতীশ রায় বললেন, আপনি আমার পিতৃতুল্য। এই বাড়িতে আপনার নাতনিকে পেলে আমি শুধু একটি মেয়ের অভাব থেকে বঞ্চিত হব না, আপনার মতো মানুষকে মাথার ওপর পেয়ে ধন্য হব।

গাড়িতে ওঠার আগে মহাদেব সেন বললেন, সবই ভালো কিন্তু মনে একটু খুত রয়ে গেল।

কীরকম? সতীশ রায় উদ্বিগ্ন হলেন।

একমাত্র পুত্রের বিয়ে দিচ্ছেন অথচ কোনও দাবিদাওয়া নেই–।

কে বলল নেই? এই যে, ঘটকবাবুকে জিজ্ঞাসা করুন, আমার দাবি মেটাতে কীরকম নাকানিচুবুনি খেয়েছেন–। সতীশ রায় এতক্ষণ চুপচাপ থাকা ঘটকমশাইকে দেখিয়ে দিলেন।
 
ওঁদের সঙ্গে ঘটকমশাইকেও চলে যেতে দেখে খেয়াল হল সতীশ রায়ের। ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকিয়ে মানিকজোড়কে দেখতে পেলেন।

কী ব্যাপার? তোমরা তো আমাকে অবাক করলে হে!

কেন বড়বাবু, কোন ত্রুটি হয়েছে কি? গোরক্ষ বলল।

না না। তোমরা এতক্ষণ মুখ বন্ধ করে বসেছিলে কী করে? এ তো তোমাদের স্বভাব নয়! হাসলেন সতীশ রায়।

কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বড়বাবু। নাগেশ্বর বলল।

কেন?

মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। আহা, চোখে মুখে কথা ঠিকরে উঠেছিল মায়ের। সুন্দরী তো বটেই কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর কথা বলার ভঙ্গি। নাগেশ্বর বলতে বলতে মাথা দোলাচ্ছিল।

একটুও জড়তা নেই, যেন নিজের বাড়িতে এসেছে। আপনার ভয়ে ডুডুয়ায় বাঘ আর গরু একসঙ্গে জল খায়– বলে থেমে গেল গোরক্ষ।

ওর সামনে আপনি, মানে আপনাকে, মায়ের পাশে ছেলের মতো দেখাচ্ছিল। নাগেশ্বর বলল, এ মেয়ে এলে সংসার সুখের হবে।

গোরক্ষ বলল, কথাই আছে, সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে।

হুম। সেটাই তো ভাবছি। আমাদের সন্ধ্যাহিক বন্ধ করে দিতে পারে এ বাড়িতে পা দিয়েই। ঝাড়ামোছা যখন শুরু করবে তখন কি আর আহ্নিককে রেহাই দেবে। বললেন সতীশ রায়।

সেকি! চিৎকার করে উঠল নাগেশ্বর।

একটা বাচ্চা মেয়ে এসে এতদিনকার অভ্যেস বন্ধ করে দেবে? একি মেনে নেওয়া যায়? না না, আপনি মহাদেব সেন মশাইকে জানিয়ে দিন। গোরক্ষ গম্ভীর গলায় বলল।

কী জানাব? পাত্রীর হবু শ্বশুর প্রতি সন্ধ্যায় দু-পেগ মদ্যপান করে স্যাঙাতদের সঙ্গে, বিয়ের পর সেটা মেনে নিতে হবে মেয়েকে? পাগল। ওই মেয়ের ওপর কিছু চাপিয়ে দিলে যে তা মানবে না। সতীশ রায় কথা বলার সময় দেখতে পেয়েছিলেন মঙ্গলরা অবনীবাবুকে নিয়ে এদিকে এগিয়ে আসছে। তিনি গেট খুলে বললেন, আসুন আসুন।

অবনীদা ভেতরে ঢুকে বললেন, এরা ফাঁকিবাজ নয়। সেদিন যা যা দেখিয়ে গিয়েছিলাম তা একেবারে ঠিকঠাক করতে পারছে। গুড। কিন্তু আমাকে এখনই শহরে ফিরে যেতে হবে।

সেকি! আপনার তো আজ রাত্রে ডুডুয়ায় থাকার কথা।

ঠিক। কিন্তু যাচ্ছি একজন কমপাউন্ডারকে ধরে নিয়ে আসতে। ফার্স্ট বাসে চলে আসব। তোমরা তার আগে শুরু করে দিয়ো। অবনীদা বললেন।

কম্পাউন্ডার কেন?

প্রেসার মাপাবে। প্রত্যেকের নামে আলাদা আলাদা কার্ড হবে। মেডিক্যাল কার্ডে প্রেসার, পালস-বিট কত লেখা থাকবে, ব্লাড গ্রুপও লিখে রাখতে হবে। ফুটবলে চোট পাওয়া তো রোজকার ব্যাপার, রক্তের গ্রুপ জানা না থাকলে অ্যাকসিডেন্টের সময় সমস্যা হয়। পালস-বিট যার ষাট পঁয়ষট্টি স্পোর্টসম্যান হিসেবে তার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। অবনীদা বললেন।

শুনেছিলাম পালসবিট বাহাত্তর থাকাটাই নর্মাল।

সাধারণ লোকের ক্ষেত্রে। যদি কোনও কারণে পালস-বিট আশি নব্বই হয়ে যায় তাহলে তাদের অসুস্থ বলা হয়। ওইসময় বেশি দৌড়াদৌড়ি ক্ষতিকর। কিন্তু যার পালস-বিট ষাট তার পক্ষে পনেরো বেশি হলেও কোন অসুবিধে হয় না। আচ্ছা, আমার ব্যাগটা–।

থাক না ওটা। আপনি তো কাল সকালেই আসছেন।

ও। তাহলে থাক। চলি। অবনীদা হাঁটতে লাগলেন বাস-রাস্তার দিকে। সঙ্গে ছেলেরা।

*
 
মঙ্গলরা চেয়েছিল ওরা যখন মাছ ধরবে তখন সতীশ রায় যেন উপস্থিত থাকেন। ইতিমধ্যে দুটো ডিঙ্গি নৌকো, টানা জাল, হাতজাল কিনে দিয়েছেন তিনি। সেই সঙ্গে ধরা মাছ নিয়ে যাওয়ার মজবুত ঝুড়িও।

মাথা নেড়ে বলেছিলেন, না, তোমরা এবার সাবালক হও। আমি সব ব্যবস্থা করে দিয়েছি। এবার হাতেকলমে কাজটা তোমাদের করতে হবে। আমি ওখানে গিয়ে দাঁড়ালে লোকে ভাববে আমার ব্যবসা। কাজে নামলে তোমরা নিজেরাই এগিয়ে যেতে পারবে। আরও কী করলে ভালো লাভ হতে পারে তা আবিষ্কার করবে।

বেলা নটা নাগাদ সতীশ রায় খবর পেলেন ছেলেরা বাইশ কেজি মাছ ধরেছে। সবই বড় বড় রুই অথবা কাতলা। স্থানীয় বাজারে যার দাম ষাট টাকা কেজি। কিন্তু, সেগুলো চালানি, অন্ধ্র প্রদেশ থেকে আসে। চারটে সাইকেলের পেছনে ব্যাগে ভরে ওরা কাছাকাছি হাটে গিয়ে বিক্রি করে দিল পঞ্চাশ টাকা কেজিতে। মাছওয়ালা ওই মাছ স্বচ্ছন্দে পঁয়ষট্টি টাকা কেজিতে বিক্রি করতে পারবে।

বেলা বারোটা নাগাদ মঙ্গলরা এল দেখা করতে। সতীশ রায় তখন স মিলে। কাঠচেরাই-এর একটা করাত তখন শব্দ করছে। মঙ্গল এগারোশ টাকা তার সামনে রাখতেই তিনি রেগে গেলেন, একি! এখানে টাকা রাখছ কেন?

আজকে এই দাম পেয়েছি–।

ভালো কথা। তোমাদের কী বলেছিলাম? অর্ধেক নিজেদের মধ্যে ভাগ, করে বাকিটা ব্যাঙ্কে জমা দাও! ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট তো খুলেছ!

হ্যাঁ।

ঠিক আছে।

আজ্ঞে নৌকা, জালের দাম–।

ছয়মাস পরে কত লাভ হল দেখি, তারপর হিসেব করব। ও হ্যাঁ, শুনলাম, তোমরা নাকি রুইকাতলা ছাড়া মাছ ধরোনি, ছোট মাছ ওঠেনি?

উঠেছিল। প্রথম দিন তাই–।

ছোট মাছেরও খদ্দের আছে এবং তাদের দাম বেশি বলে লাভও বেশি। আর টার্গেট করবে যাতে তিরিশ কেজি বড় আর দশ কেজি ছোট ধরতে পারো। যাও। আমাকে কাজ করতে দাও। ও হ্যাঁ, অবনীদা কবে আসবেন?

আজই।

তাহলে তোমরা তিনটের মধ্যে মাঠে তৈরি থাকবে। শহর থেকে যে লোকটা খেলা শেখাতে আসবে তাকে যেন হাত গুটিয়ে বসে থাকতে না হয়।

ছেলেরা চলে গেলে ম্যানেজারবাবু বললেন, সদর থেকে এক ভদ্রলোক দেখা করতে এসেছেন, বললেন, উনি অবনীবাবুর ভাই।

তাই নাকি। সে কোথায়? ব্যস্ত হয়ে উঠলেন সতীশ রায়।

স্বাস্থ্যবান এক প্রৌঢ়কে সঙ্গে নিয়ে ম্যানেজার ফিরে এলো। সতীশ রায় বললেন, নমস্কার। বসুন।

আমি নির্মল, আমার দাদা অবনী আপনার সঙ্গে দেখা করতে বলেছেন।

হ্যাঁ। খুব খুশি হয়েছি আপনি এসেছেন বলে। অবনীদার কাছে শুনেছি আপনি দীর্ঘদিন চা-বাগানের দায়িত্ব সামলে সম্প্রতি অবসর নিয়েছেন!

হ্যাঁ। এখন বেশির ভাগ চা-বাগানে কাজের পরিবেশ চলে গেছে। আমি আত্মসম্মান বিক্রি করতে রাজি নই বলে বাড়িতে ফিরে এসেছি। নির্মল বললেন।

এই কারণেই মনে হয়েছিল আপনার সঙ্গে কথা বলা যায়। দেখুন, চা বাগান সম্পর্কে আমার ধারণা ভাসা ভাসা। যেতে আসতে দেখি কিন্তু ব্যবসা সম্পর্কে কৌতূহলী হইনি। শুনেছি এখন কেউ কেউ ফ্যাক্টরি ছাড়া শুধু চায়ের বাগান তৈরি করে পাতা বিক্রি করছেন। আমার ম্যানেজারবাবু এ ব্যাপারে আগ্রহী। আপনি বলুন তো ব্যবসা হিসেবে এর সম্ভাবনা কতটুকু?
 
নির্মলবাবু হাসলেন, আমি কখনই ভাবিনি প্রপার অর্গানাইজেশন ছাড়া চা গাছ তৈরি, পাতা প্লাকিং, ফ্যাক্টরিতে প্রোসেসিং করা সম্ভব। প্রত্যেকটা ডিভিশন এ ওর ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এখন অন্য অনেক শিল্পের মতো চা-ও বিভক্ত হতে চলেছে। হ্যাঁ, আপনি সেরা জাতের পাতা উৎপাদন করে যাদের কারখানা আছে তাদের কাছে বিক্রি করতে পারেন। কিন্তু কোন্ জমিতে চা-গাছ লাগাচ্ছেন সেটা দেখতে হবে। আমি শুনেছি খড়গপুরের মতো গরম জায়গায় নাকি চা-চায় নিয়ে পরীক্ষা চলছে।

কীরকম জমি হলে ভালো হয়?

সামান্য ঢালু যাতে জল দাঁড়াবে না।

তারপর?

প্রথমে মাটি তৈরি করা, গাছ লাগানো, নার্সারি করা। প্রচুর কাজ। কতটা জমিতে চাষ করতে চান সেই বুঝে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রথমে সয়েল টেস্ট করা দরকার। মাটির ওপর গাছের প্রাণশক্তি নির্ভর করে। টেস্ট রিপোর্ট পেলে বলা যেতে পারে কী করা উচিত।

সাধারণত গাছ লাগাবার কতদিন পরে পাতা তোলা যায়?

চা গাছ দু-ভাবে করা যায়। বীজ থেকে অথবা বড় গাছের ডাল কেটে। দুটোই মাটিতে পুঁতে একবছর অপেক্ষা করতে হয়। এই অবস্থাটাকে বলে নার্সারি। একবছর পরে নার্সারি থেকে তুলে জমিতে পোঁতা হয়। বীজের গাছ পাতা তোলার জন্যে উপযুক্ত হয় চারবছর বাদে, কিন্তু কলমের গাছের পাতা বছর দুয়েক পরেই তোলা যায়। নির্মলবাবু জানালেন!

তার মানে অন্তত আড়াই বছর অপেক্ষা করতে হবে? সতীশ রায় জিজ্ঞাসা করলেন। তারপরে রিটার্ন পাব। দেখুন, এ ব্যাপারে আমি আগ্রহী কিন্তু যদি আপনি দায়িত্ব নেন তাহলেই। সতীশ রায় বললেন।

আপনি আমাকে জানেন না। আমার বায়োডাটা দ্যাখেননি। তবু আমার ওপর দায়িত্ব দিচ্ছেন কেন? নির্মলবাবু অবাক হলেন।

দেখুন ল্যাংড়া আমের গাছে আর যাই হোক ফজলি ফলবে না। আপনি অবনীদার ভাই, ইচ্ছে করলেও ততটা খারাপ করতে পারবেন না যতটা করলে আমার ক্ষতি হয়। আপনি একটা প্রজেক্ট রিপোর্ট তৈরি করুন। শুরুর সময় কী ধরনের কতটা জমি দরকার। আড়াই বছরে কী কী খরচ কোন্ কোন্ বাবদ করতে হবে? চায়ের পাতা বিক্রি শুরু হলে বাৎসরিক খরচের বিনিময়ে কত লাভ হতে পারে–এসব বিশদে তৈরি করে ফেলতে কতদিন সময় লাগবে?

বেশিদিন লাগার কথা নয় কিন্তু তার আগে জমি দেখা দরকার। এক এক জমিতে এক এক ধরনের পাতা হয়। জমি কী অবস্থায় আছে, সেটাকে বাগানে পরিণত করতে কত খরচ হবে তা না দেখলে বোঝা যাবে না। নির্মলবাবু বললেন।

সতীশ রায় একমুহূর্ত ভাবলেন। তারপর বললেন, চলুন।

ঘণ্টাদেড়েক ধরে গাড়ি নিয়ে চক্কর দিলেন ওঁরা। খাস জমি, ধানচাষের যোগ্য নয়, যেসব জমি অবহেলায় পড়ে আছে সেগুলো দেখে নির্মলবাবু ফিরে গেলেন। কথা দিলেন পনেরো দিনের মধ্যে প্রজেক্ট রিপোর্ট তৈরি করে দেবেন।

*
 
দিন ঠিক হয়ে গেল।

হাতে বেশি সময় নেই। ডুডুয়ার সতীশ রায়ের ছেলের বিয়ে বলে কথা। কাকে ছেড়ে কাকে বলবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না তিনি। নাগেশ্বর প্রস্তাব দিল, ডুডুয়ার প্রত্যেক বাড়ির একজনকে আসতে বললেও তো কয়েক হাজার হয়ে যাবে। অত লোক বউভাতের দিন কোথায় বসে খাবে? তার চেয়ে ঝাড়াই বাছাই করে পাঁচশো লোককে নেমন্তন্ন করাই ভালো।

সতীশ রায় সেই কর্মটি করতে গিয়ে দেখলেন কোনভাবেই হাজারের নিচে নামাতে পারছেন না। চিঠি ছাপা হল। সদরের বড়কর্তাদের নিজে গিয়ে নেমন্তন্ন করে এলেন। আত্মীয়স্বজনরা চলে এলেন দিন-দুই আগেই। বাড়িতে ভিয়েন বসল। নাগেশ্বর এবং গোরক্ষ চব্বিশঘণ্টাই পড়ে আছে এ বাড়িতে, তদারকি করতে। সদর থেকে নামকরা রান্নার ঠাকুর আনা হল। পরিবেশনের দায়িত্ব নিল তরুণ সংঘের ছেলেরা। ইতিমধ্যে মাছ বিক্রি করে তারা ভালো অবস্থায় পৌঁছে যাচ্ছে।

অবনীদার কোচিং-এ ভালো ফল হয়েছে। তরুণ সংঘ গত তিনটি ম্যাচের দুটো জিতেছে, একটি ড্র করেছে। অবনীদা জেলার সবচেয়ে বড় টুর্নামেন্টে নাম এনট্রি করিয়েছেন। সেখানে খেলার যোগ্যতা অর্জনের খেলায় জিতে গেছে তরুণ সংঘ। কিন্তু মঙ্গলরা বুঝতে পারছিল অবনীদা বেশি জোর দিচ্ছেন দশ থেকে তোর বাচ্চাদের ওপর। ওরা অন্ধের মতো অবনীদার কথা শুনছে এবং বেশ চটপট রপ্ত করছে খেলার কায়দা। অবনীদা বলে গেছেন বড়দের সঙ্গে ছোটদের একটা ম্যাচ তিনি খেলাবেন। যে গোল দেবে তাকে পঞ্চাশ টাকা পুরস্কার দেবেন তিনি।

বাড়ির পেছনে ডুডুয়ার ধারে বসে সত্যচরণ ভেবে পাচ্ছিল না তার কী করা উচিত। ঘন ঘন বুক নিংড়ে শ্বাস বেরিয়ে আসছে। যদি সে সাঁতার না জানতো তাহলে ডুডুয়ার এই কালো জলের তলায় চুপচাপ শুয়ে পড়ত।

হঠাৎ এলোকেশীর গলা কানে এল, ওমা! তুমি এখানে?

সত্যচরণ কোন কথা বলল না।

এলোকেশী বলল, ওদিকে দর্জি তোমার বিয়ের পাঞ্জাবি নিয়ে এসেছে। চল, পরে দেখবে ঠিক হয়েছে কিনা।

আমি কোথাও যাব না। গম্ভীর গলায় বলল সত্যচরণ।

অ্যাঁ? একি কথা! আজ বাদে কাল বিয়ে, জলের ধারে বসে থেকে অসুখ বাধাবে নাকি? ওঠ, চল।

সত্যচরণ এলোকেশীর দিকে তাকাল, এলাদি, তুমি আমাকে বাঁচাও।

বাঁচাব? কেন? কী হয়েছে তোমার?

আমি বিয়ে করতে পারব না।

সেকি? তোমার কি বউ পছন্দ হয়নি?

না। তা নয়। কিন্তু আমার পক্ষে কি বিয়ে করা উচিত? আমি তো আর, মানে, আমার মনের কৌমার্য তো নেই।

অ।

বিশ্বাস করো, পাখি ছাড়া আমি কিছুই ভাবতে পারছি না।

যাকে নিয়ে ভাবছ সে তো তার স্বামীর সঙ্গে বেশ মজায় আছে।

থাকুক। ওর শরীর নিয়ে আমি চিন্তা করি না। ওর মন তো আমার মন নিয়ে গিয়েছে। শ্বাস ফেলল সত্যচরণ।

একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, কতদূর এগিয়েছিলে?

মানে?

ওঃ। চুমুটুমু খেয়েছিলে? চোখ ছোট করল এলোকেশী।

এম্মা! নাঃ। রক্ত জমল সত্যচরণের গালে।

ও। হাত ধরেছিলে? মাথা নাড়ল সত্যচরণ, না। দূর থেকে দেখেছি। পাখিও দেখেছিল।

তার মানে কথাবার্তাও হয়নি?

মুখে হয়নি, মনে মনে হয়েছে।

আর কয়েকমাস পরে যখন তোমার পাখি বাপের বাড়িতে আসবে বাচ্চার জন্ম দিতে তখনও এসব কথা বলতে পারবে?

পারব। সারাজীবন পারব।

তাহলে ওই মেয়েটার কী হবে? বেচারা তোমাকে দেখতে এতদূরে এল। সমস্যাটা খুব শক্ত। একটু ভেবে দেখি। এখন চল, পাঞ্জাবিটা পরে দেখবে। নইলে বড়বাবুর কানে গেলে কুরুক্ষেত্র বাধবে। এলোকেশী সত্যচরণের হাত ধরে টেনে নিয়ে এল বাড়িতে।

সত্যচরণকে দেখে মতির মা দৌড়ে এল, উঃ। কোথায় গিয়েছিলে? এইসময় কেউ বাড়ির বাইরে যায়?

আমার জন্যে কাউকে ভাবতে হবে না। নিচু গলায় বলল সত্যচরণ।

আঃ! চুপ। এখন এসব কথা বলতে নেই। বাড়ি ভর্তি লোক। নাও, পাঞ্জাবি পরে দ্যাখো–। মতির মা অনুনয় করল।
 
কিছু কিছু আত্মীয়স্বজন এর মধ্যে এসে পড়েছেন। তাদের থাকাখাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তরুণ সংঘের ছেলেরা দুবেলা কাজ করছে এখানে। তারা তো বটেই,ডুডুয়ার কিছু লোক দু-বেলা পাত পাড়ছে এ বাড়িতে।

সমস্যা হল সন্ধেবেলায়। নাগেশ্বর গোরক্ষ ভেবে পাচ্ছিল না কী করে তার সমাধান করবে। বাড়িতে গিজগিজ করছে লোক, পরে আরও বাড়বে। এইসময়ে বাইরের ঘরে বসে পানাহার করা অসম্ভব ব্যাপার। গত পরশু যা হওয়ার শেষ বার হয়ে গিয়েছে। এরকম চললে সেই বউভাতের পর বাড়ি খালি না হওয়া পর্যন্ত আহ্নিকবিহীন হয়ে থাকতে হবে। ভাবলেই শরীর ঝিমঝিমিয়ে উঠছিল ওদের? তার পর যদি বউমা এসে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন তাহলে তো কথাই নেই।

বিকেল নাগাদ ওদের দুজনকে দেখে সতীশ রায় বললেন, এইমাত্র একটা খারাপ খবর পেলাম হে।

ওরা মুখ চাওয়াচায়ি করল। যে কোনও খবর তাদের ডিঙিয়ে কেউ বড়বাবুর কানে পৌঁছে দিচ্ছে। এ তো ভালো কথা নয়।

পোস্টমাস্টার মেয়ে নিয়ে ফিরে এসেছে। বিষঃ গলায় বললেন সতীশ রায়।

মেয়ে নিয়ে? মেয়ের তো বিয়ে হয়ে গিয়েছিল! গোরক্ষ বলল।

হা হয়েছিল। কিন্তু বাসরঘর থেকে জামাই জ্বরে পড়ে। নতুন বউ নিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরে গিয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়ে।

সর্বনাশ। কলকাতায় শুনেছি খুব ডেঙ্গু হচ্ছে এখন। নাগেশ্বর বলল।

তেরাত্তির না কাটতে ওই ডেঙ্গুতেই মারা গিয়েছে ছেলেটা। বউভাত হয়নি। বিধবা মেয়েকে নিয়ে ফিরে এসেছে পোস্টমাস্টার। চল, একবার দেখা করে আসি।

দূরত্ব এমন কিছু নয় তবু সতীশ রায় গাড়িতে উঠলেন। সামনে গোরক্ষ এবং নাগেশ্বর।

*

পোস্টমাস্টার কান্নায় ভেঙে পড়লেন। সতীশ রায় ওঁর কাঁধে হাত রাখলেন, কোনও কথা বললেন না। নাগেশ্বর বলল, ভগবানের যে কী ইচ্ছে কখন হয়, কেন হয় তা তিনিই জানেন।

গোরক্ষ বলল, কিন্তু মেয়েটা তো কোনও দোষ করেনি, ও কেন শাস্তি পেল?

সতীশ রায় মাথা নাড়লেন, শাস্তির কথা কেন বলছ? ও তো কোনও অন্যায় করেনি। আপনি ভেঙে পড়বেন না মাস্টারমশাই। নিজেকে শান্ত করুন।

পারছি না। সাধ্যের বাইরে গিয়ে খরচ করে মেয়ের বিয়ে দিলাম। বেচারা একটা দিনও স্বামীর ঘর করতে পারল না। উলটে অপয়া বদনাম নিয়ে ফিরে এল। এখন সারাজীবন পড়ে আছে সামনে, ওর যে কী হবে!

আবার বিয়ে দেবেন। আমি আপনার পাশে আছি। কয়েকটা মন্ত্র পড়লেই কেউ বিবাহিতা হয় না। ওর তো ফুলশয্যাই হয়নি। সতীশ রায় বললেন, বাড়ির সবাইকে আমার কথা বলবেন। আমি মনে করি সে এখনও কুমারী।

কিছুক্ষণ সান্ত্বনা দিয়ে আবার গাড়িতে উঠে বসলেন সতীশ রায়। এখন ধূপছায়া নেমেছে পৃথিবীতে। নাগেশ্বর আর গোরক্ষ ড্রাইভারের পাশে বসে পোস্টমাস্টারের মেয়ের দুভার্গ্য নিয়ে আলোচনা করছিল।

সতীশ রায় বললেন, ডুডুয়া ব্রিজ ছাড়িয়ে হাইওয়ে ধরে চল।

ড্রাইভার মাথা নাড়ল।

নাগেশ্বর জিজ্ঞাসা করল, কোথায় যাচ্ছি বড়বাবু?

ভ্রমণে। সতীশ রায় উত্তর দিলেন।

দু-পাশে পাতলা অন্ধকার। নির্দেশ পেয়ে গাড়ি হাইওয়ে থেকে নেমে জঙ্গলের রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াল। সতীশ রায় বললেন, ডিকি থেকে বাস্কেট বের করে আনো। আলো জ্বালার দরকার নেই।
 
ড্রাইভার আদেশ মান্য করতে দেখা গেল বাস্কেটের ভেতরে দুধরঙের পানীয়, গ্লাস, জল, কাজু এবং চিনেবাদাম সাজানো রয়েছে: গাড়ির দরজা খোলা থাকায় হালকা আলোয় এসব স্পষ্ট দেখতে পেয়ে নাগেশ্বর চেঁচিয়ে উঠল, একটু পায়ের ধুলো দিন বড়বাবু। ওঃ। হৃদয় একেবারে শীতল করে দিলেন। এ আপনি ছাড়া কেউ পারত না।

গোরক্ষ বলল, একেবারে চমকে দিয়েছেন বড়বাবু। খুব ভালো হল। এখন বাড়ি তো বাজার। তার চেয়ে এই নির্জনে, দ্যাখো নাগেশ্বর, জোনাকি জ্বলছে।

উল্লাস। বলে চুমুক দিলেন গ্লাসে সতীশ রায়, একটা কথা। তোমরা হাইওয়ে থেকে চূড়য়ায় ঢুকেই গাড়ি থেকে নেমে যাবে। আজ রাত্রে আমার বাড়ির লোকজন দু-দুটো মাতাল দেখুক তা আমি চাই না।

আপনি যা চান তাই হবে। নাগেশ্বর মাথা নেড়ে গোরক্ষর দিকে তাকাল, আহ্নিক যদি করতে চাও তাহলে রাত্রে বড়বাবুর বাড়িতে যাওয়া চলবে না।

গোরক্ষ বলল, মাথা খারাপ। নিজের সর্বনাশ করব কেন?

নাগেশ্বর বলল, তা যাই বল, বিয়ের মতো বিয়ে হচ্ছে এই ডুডুয়ায়। গর্বে বুক ভরে যাচ্ছে।

বরযাত্রীরা কটা বাস চেপে যাবে? প্রথম গ্লাস শেষ করে ফেলল গোরক্ষ। আজ পরিবেশ পালটে যাওয়ায় তার গতি বেড়েছে।

কটা বাস মানে? বরকে নিয়ে বাবোজন যাবে, তার জন্যে বাসের দরকার হবে কেন? একটা অ্যাম্বাসাডার আর একটা সুমোতেই চমৎকার ধরে যাবে।

সেকি? মাত্র বানোজন বরযাত্রী? হাঁ হয়ে গেল নাগেশ্বর?

আমরা কি খেতে পাই না যে পঞ্চাশ ষাটজন লোক নিয়ে মেয়ের বাড়িতে খেতে যাব? এগারোজনের টিম একজন দ্বাদশ ব্যক্তি। তোক দেখে বলবে এরা অত্যাচার করতে আসেনি। কে কে যাবে সেটা এখনও ঠিক করিনি। সতীশ রায় বললেন।

হঠাৎ পেছনের জঙ্গলে শব্দ হল। চমকে উঠল গোরক্ষ। গাড়ির দরজা বন্ধ করতেই আলো নিভে গেল। নাগেশ্বর বলল, শব্দ কিসের?

সতীশ রায় চিৎকার করলেন, ড্রাইভার।

গাড়ি পার্ক করে ড্রাইভার নেমে গিয়েছিল কিন্তু তার তো কাছেপিঠে থাকার কথা। এদিকে আওয়াজটা বেড়েই চলেছে।

বড়বাবু, মনে হয় কোনও বন্যজন্তু! কী হবে? গোরক্ষ বলল।

কেউ গাড়ি চালাতে জানো? সতীশ রায় পেছন থেকে বললেন।

না, না। দুজনেই একসঙ্গে বলে উঠল।

ওয়ার্থলেস। যাও, ড্রাইভারকে খুঁজে বের করে নিয়ে এসো৷ কড়া গলায় বললেন সতীশ রায়। অন্ধকারেই গ্লাস শেষ করল নাগেশ্বর।

সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি দুলে উঠল নৌকোর মতো। সতীশ রায় দেখলেন অন্ধকারে নড়ছে। চাপা গলায় বললেন, চুপ! হাতি।

হা-হা। নাগেশ্বরের দাঁত বাজনা বাজাতে লাগল।
 
একটু একটু করে এগিয়ে এল যে প্রাণীটি গাড়ির পাশে তার আয়তন আদৌ বেশি নয়। চোখ সয়ে যাওয়া অন্ধকারে সতীশ রায় দেখলেন একটা হাতির বাচ্চা শুড় তুলে কিছু শুঁকে গাড়ির জানলায় ধাক্কা মারছে। যত ছোট হোক ইচ্ছে করলে ঠেলে উলটে দিতে পারে বাচ্চাটা। আর ও নিশ্চয়ই একা নেই, দলে মা বাবাও আছে। তারা একটা পা তুলে দিলে দেখতে হবে না।

সতীশ রায় বললেন নিচু স্বরে, দরজা খুলে সোজা দৌড়াও। এখানে বসে থাকলে মারা পড়বে।

–দ-দ-দ। নাগেশ্বর তোতলাল।

যে পড়ে থাকবে সে মরবে। এই আমি দরজা খুলছি।

পরের কিছুটা সময় চিরটাকাল ভুলে থাকবেন সতীশ রায়। হাইওয়ের ওপর উঠে তাঁর বুক থেকে হৃৎপিণ্ড যেন ছিটকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। অনেকদিন দৌড়াননি, তার ওপর এভাবে দৌড়। বয়সটাও জানান দিচ্ছে। অনেকক্ষণ হাঁপানোর পর শুনতে পেলেন, মিনমিনে গলায়, হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ।

ওরা যে মানিকজোড় তাতে কোন সন্দেহ হল না। সতীশ রায় বললেন, চল, হেঁটেই ফিরতে হবে।

পিচের রাস্তায় বসে পড়ল ওরা। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াতেই পাশের গাছ থেকে ড্রাইভারের গলা শোনা গেল, বড়বাবু!

অন্ধকারেও যেটুকু দেখা যায়, ড্রাইভারকে নেমে আসতে দেখা গেল, আটটা হাতি, ভয়ে সাড়া দিতে পারিনি।

তা-তাই বলে আমাদের বিপদে ফেলে রেখে তুমি গাছে উঠে বসে থাকবে। বড়বাবু, এর চাকরি খতম করে দিন। নাগেশ্বর বলল।

তুমি হলে কী করতে? বিপদভঞ্জন হয়ে উদ্ধার করতে যেতে? সতীশ রায় খেঁকিয়ে উঠলেন, গাড়িটাকে বোধহয় মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে ওরা।

এখন কোনও আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না। গোরক্ষ বলল।

ঠিক কথা। ওরা বোধহয় ওখান থেকে চলে গেছে। নাগেশ্বর বলল।

সতীশ রায়ও কান পেতে কোনও শব্দ শুনতে পেলেন না। হাতিরা কখনও এক জায়গায় বেশিক্ষণ শান্ত হয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে না। এই অঞ্চলের জঙ্গলে হাতির দল ধান পাকলে আসে। সেসময় তাদের তাড়াবার জন্যে প্রস্তুত থাকে কৃষকেরা। এমন অসময়ে ওরা কেন এল? ওদিকের জঙ্গলে কী খাবার একদম নেই! সতীশ রায় বললেন; সাবধানে এগিয়ে গিয়ে দ্যাখো তো গাড়ির কি অবস্থা। মনে হচ্ছে হাতিরা ওখানে নেই। যদি দ্যাখো আছে, তাহলে কাছে যাওয়ার দরকার নেই।

. ইতস্তত করে শেষ পর্যন্ত এগোল ড্রাইভার। নাগেশ্বর বলল, ওকে দেখে আবার রেগে না যায় হাতিরা!

একটু একটু করে পাঁচ মিনিট কেটে যাওয়ার পর ইঞ্জিনের আওয়াজ কানে এল। তারপর হেডলাইট জ্বালিয়ে দ্রুত চলে এল গাড়িটা হাইওয়ের ওপর। ঝটপট গাড়িতে উঠে বসে সতীশ রায় বললেন, আশ্চর্য! গাড়ির ক্ষতি করেনি ওরা?

না। ড্রাইভার আবার গাড়ি চালু করল।.

ডুডুয়া ব্রিজের ওপর যখন চলে এল ওরা, তখন নাগেশ্বর চিৎকার করে উঠল, আরে! বোতলটা কোথায় গেল? দাঁড়াও, গাড়ি থামাও।

দরজা খুলতেই আলো জ্বলল। সিটের ওপর বা নিচে কোথাও ওদের বোতল নেই। গোরক্ষ চেঁচিয়ে উঠল, জানলার কাঁচ নেই। ভেঙে ফেলেছে।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top