What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected তনু অতনু সংবাদ (3 Viewers)

সতীশ রায় সেটা দেখতে পেলেন। তিনি তার পাশে রাখা বাস্কেটটার দিকে তাকাতে দেখলেন সেটা উলটে পড়ে গেছে নিচে। দুটো সিটের মাঝখানে টাইট। হয়ে আটকে আছে সেটা।

শালা। বদমাস হাতি। আমাদের বোতল ডাকাতি করে নিয়ে গেছে। চেঁচিয়ে উঠল নাগেশ্বর।

গোরক্ষ বলল, বোতলের গন্ধেই এসেছিল। হাতিরা মদ খেতে খুব ভালোবাসে বড়বাবু, আপনারটাও নিয়ে গেছে?

সতীশ রায় বাস্কেটটাকোনমতে তুলতে দেখতে পেলেন তার বোতল নিচে পড়ে আছে। বললেন, চেষ্টা করেছিল, বাস্কেটের জন্যে নিতে পারেনি।

শত্রু শত্রু, সর্বত্র শত্রু। বিড়বিড় করল নাগেশ্বর, কী কাণ্ড! ব্যাটা গ্লাসদুটোও নিয়ে গেছে। ওইটুকুনি পুঁচকে হাতি, বড় হলে কী হবে!

বাড়ির কাছে এসে গাড়ি দাঁড় করাতে বললেন সতীশ রায়। তারপর নিজের বোতলটা ড্রাইভারের হাতে দিয়ে বললেন, কোনও নির্জন জায়গায় গিয়ে ওদের দু-দুবার গ্লাসে ঢেলে দেবে। তার বেশি নয়। তারপর বোতলটা বাস্কেটে রেখে দেবে। আমি যাচ্ছি!

আপনার জিনিস আমাদের দিলেন? নাগেশ্বর গদগদ।

বাড়িতে উৎসব, খাও একদিন। দরজা খুলে নেমে পড়লেন তিনি। কিন্তু গ্লাস? গ্লাস যে নেই?

জোগাড় করে নাও। ঠিক পেয়ে যাবে। হাঁটলেন সতীশ রায়। দুহাতে মাথা ঠুকল নাগেশ্বর, নমস্য মানুষ।

দয়ার শরীর। গোরক্ষ বলল।

চল ভাই ড্রাইভার। নাগেশ্বর বলল।

আমি ভাবছি, বউমা বাড়িতে এলে কী হবে আমাদের! গোরক্ষ বলল।

কালকের কথা কাল ভাবব। এখন চল, একটা নির্জন জায়গা বের করতে হবে যেখানে হাতি আসবে না। নাগেশ্বর সুর ধরল।

*

খারাপ খবর বাতাসের আগে ছোটে। তাকে মদত দেয় কিছু ঈর্ষাকাতর মানুষ। স্থানীয় মানুষেরা ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেয় এখানেই, যে যার মতো করে। পোস্টমাস্টার মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়েছিলেন কলকাতায়, সেটা অনেকেই ভালো চোখে দ্যাখেনি। অনেকে ভেবেছিলেন, এটা উঁট দেখানোর জন্যে, বেশিরভাগই হতাশ হয়েছিলেন বিয়ের খাওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়ায়। তাই পোস্টমাস্টারের মেয়ে বিয়ের পরেই বিধবা হয়েছে জানার পর সেটা পাঁচজনকে জানাবার তাগিদ অনুভব করেছিলেন অনেকেই। বাইরে দুঃখ দুঃখ ভাব থাকলেও একটা চোরা সুখও বুদবুদের মতো ছিল।
 
হরিপদ এসে খবরটা এলোকেশীকে দিল। আত্মীয়স্বজনের জন্যে চাররেলা খাবার তৈরি: থেকে মুক্তি পেয়েছে এলোকেশী ঠাকুর এসে যাওয়ায়। খবরটা শুনে চোখ বড় করে বলল, খবরদার কথাটা, ছোটবাবুকে বোলো না হরিপদদা।

এসময় খারাপ খবর শুনতে নেই।

কিন্তু বন্যার জল বাঁধ ভাঙলে আটকানো অসম্ভব। সত্যচরণের ঘরে ডাক পড়ল এলোকেশীর। এলোকেশী ঘরে ঢুকে দেখল খাটের মাঝখানে ফ্যাকাসে, মুখে

বসে আছে সত্যচরণ।

কী হল?

এলোদি–। গলা ধরে গেল সত্যচরণের।

–বলো।

যা শুনেছি তা ঠিক?

আ মরণ। তোমার কানে কে দিল?

মতির মা। বলল আমি নাকি গুরুবলে বেঁচে গিয়েছি। আমার সঙ্গে বিয়ে হলে নির্ঘাত মরে যেতাম। ওর কপালে বৈধব্য যোগ ছিল তো?

যত্ত বাজে কথা। রেগে গেল এলোকেশী, আমি তো প্রায় আধমরা লোককে বিয়ে করে বিধবা হয়েছি। সুস্থ লোককে বিয়ে করলে কী হতাম? কী জন্যে ডাকছিলে?

তুমি একটু ওদের বাড়িতে যাবে?

ওমা! আমি গিয়ে কী করব?

ওকে বলবে খবরটা শুনে আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। ওকে নিয়ে আমি প্রায় পঞ্চাশটা কবিতা লিখেছি, সেগুলো দিয়ে দেবে ওকে!

আশ্চর্য! কাঁচা ঘায়ে নুনের ছিটে দিয়ো না তো?

কেন? অবাক হল সত্যচরণ।

সে মরছে নিজের জ্বালায়! বিধবা হয়ে বাপের ঘাড়ে পড়ে থাকলে কি হয় তা আমাকে দেখে বুঝতে পারছ না? এলোকেশী ঠোঁট কামড়াল।

কিন্তু–! আমি যে ওর কথা ছাড়া কিছু ভাবতে পারছি না।

তাই? ঠিক আছে। আমি বড়বাবুকে গিয়ে বলছি।

কী বলবে?

বলব, মালবাজারের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে না দিয়ে ডুডুয়ার পোস্টমাস্টারের মেয়ের সঙ্গে ছোটখোকার বিয়ে দিন। এটা তার ইচ্ছে।

সর্বনাশ। মেরে হাড় ভেঙে দেবে বাবা। জানো, মাঝে মাঝে বাবাকে আমার কংস, রাবণ বলে মনে হয়। সত্যচরণ শ্বাস ফেলল।

তাহলে এক কাজ করো, পাখিকে নিয়ে কোথাও উড়ে যাও। ঠোঁট টিপে হাসল এলোকেশী।

হুঁঃ। তুমি কী মনে করেছ একথা আমি ভাবিনি? ভেবেছি। কিন্তু ও যদি আমার সঙ্গে যেতে না চায়। মানে, আমার মনে যে এত ব্যাপার আছে তা তো ও জানে না। তাছাড়া যদি বা যায় তাহলে ওকে নিয়ে কোথায় যাব? কোথায় থাকব? কী খেতে দেব? ব্যাস, আর সাহস পাই না। সত্যচরণ আবার শ্বাস ফেলল।

সাহস যখন নেই তখন বাপ যা বলছে তাই করো। এলোকেশী আর কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।

বিকেল তিনটে পর্যন্ত অপেক্ষা করে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না সত্যচরণ। বাড়ির পেছন দরজা দিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে এল সে। তারপর ঘুরপথে হেঁটে পোস্টঅফিসের সামনে চলে এল।
 
দুপুরের পর পোস্টঅফিস ফাঁকাই থাকে। ছোট্ট কাউন্টার। তার ভেতরে বসে একটা লোক খবরের কাগজ হাতে নিয়ে পেছন ফিরে কথা বলছে, আপনি ছাড়বেন না মাস্টারমশাই। বিয়ে যখন একবার হয়ে গিয়েছিল তখন স্বামীর সব সম্পত্তি আপনার মেয়ে পাবেই।

আঃ। চুপ করো। এখনই এসব কথা কেন? ভেতরে বসা একজন কিছু লিখতে লিখতে বললেন।

লোহা গরম থাকতে থাকতে ঘা দিতে হয়। প্রিয়জন মারা গেলে লোকে শোকে অন্ধ হয়ে পড়ে থাকে না তাকে দাহ করতে যায়? এও তেমনি। এখনই একটা ভালো উকিল দেখে কি চাই? লোকটা হঠাৎই সত্যচরণের উপস্থিতি টের পেয়ে জিজ্ঞাসা করল।

না, মনে। বাবা এসেছিলেন? আচমকা জিজ্ঞাসা করে ফেলল সত্যচরণ।

বাবা? কে তোমার বাবা? লোকটি সন্দিগ্ধ।

শ্ৰীযুক্ত সতীশ রায়।

অ্যাঁ! তু তুমি বড়বাবুর ছেলে। বেশিদিন এখানে কাজ করছি না তো তাই। তোমাকে দেখিনি। কিছু মনে কোরো না। না তো, উনি আজ আসেননি। মানে, এখানে ওঁর পায়ের ধুলো খুব কম পড়ে। লোকটি বলল।

ও।

দাঁড়াও। মাস্টারমশাই, দেখুন কে এসেছে? বড়বাবুর ছেলে। লোকটি হাসল।

সঙ্গে সঙ্গে উঠে গেলেন পোস্টমাস্টার, ও, তাই নাকি? তোমার শুনলাম বিয়ে?

মুখ নিচু করল সত্যচরণ।

লোকটি বলল, আমি এখনও নেমন্তন্ন পাইনি? আপনি পেয়েছেন মাস্টারমশাই?

আহ। চুপ করো। তা বাবা তোমার বাবা তো এখানে আসেননি।

ও।

উনি কাল সন্ধেবেলায় এসে আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে গেছেন।

ও। আপনার মেয়েকে বলবেন আমরা ডুডুয়ার সবাই ওর ভালো চাই। গড়গড় করে বলে গেল সত্যচরণ।

শুনে খুব খুশি হলাম।

লোকটি বলল, পাখি যদি ওর মুখ থেকে শোনে তাহলে মনে জোর পাবে।

সে তো বিছানা থেকে উঠতেই চাইছে না। পোস্টমাস্টার বললেন।

বড়বাবুর ছেলে এসেছে শুনলে হয়তো স্বাভাবিক হবে। ওকে নিয়ে গিয়ে একবার দেখুন না। লোকটি উপদেশ দিল।

পোস্টমাস্টারের বাড়ি অফিসের পেছনেই। লাগোয়া। সত্যচরণকে নিয়ে পোস্টামাস্টার বাড়ির ভেতরে এলেন। একটা উঠোনকে ঘিরে গোটা চারেক ঘর। তাদের দেখে পোস্টামাস্টারের স্ত্রী এগিয়ে এলেন।

পোস্টামাস্টার বললেন, ডুডুয়ার বড়বাবুর ছেলে। গতকাল ওর বাবা নিজে এসেছিলেন, আজ ও এসেছে।

ভদ্রমহিলা আঁচলের প্রান্ত দাঁতে কাটলেন।

তোমরা কথা বলো। আমি কাজ শেষ করি। পোস্টমাস্টার চলে গেলেন।

বারান্দায় চেয়ার দেখিয়ে ভদ্রমিহলা বললেন, বসুন।

আমাকে আপনি বলবেন না। আমি অনেক ছোট।

শব্দ করে শ্বাস ফেললেন ভদ্রমহিলা, কপাল পুড়িয়ে এল মেয়েটা। এত নরম এত শান্ত মেয়ের কপাল যে এভাবে পুড়বে স্বপ্নেও ভাবিনি।

আমরা–আমরা সবাই খুব কষ্ট পাচ্ছি। বিড় বিড় করে বলল সত্যচরণ।

এখন ওর কী হবে ভেবে পাচ্ছি না। ভদ্রমহিলা দরজার দিকে তাকালেন।

সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা তো আছি। ও কোথায়? সাহসী হল সত্যচরণ।

বিছানায় পড়ে আছে। আচ্ছা, দেখছি। ভদ্রমহিলা ভেতরে চলে যেতেই সত্যচরণ দু-হাতে মাথার চুল ঠিক করে নিল। তখন ভেতর থেকে অনুরোধ এবং প্রত্যাখ্যানেরসংলাপ ভেসে আসছে। শেষপর্যন্ত মায়ের সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে এল পাখি। সত্যচরণের মনে হল সে শোকের প্রতিমা দেখছে।

বড়বাবুর ছেলে, নিজে তোর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। ভদ্রমহিলা বললেন।

আপনি বসুন।

তুমি চা খাবে বাবা?

না না।

একটু শরবত করে দিই। ভদ্রমহিলা রান্নাঘরে চলে গেলেন।
 
সত্যচরণ কোনও কথা খুঁজে পাচ্ছিল না। পাখি দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। যেন সময় স্থির হয়ে আছে বলে মনে হল সত্যচরণের।

কিছু বলবেন? পাখি কথা বলল।

না, মানে, আমাকে কি কখনও দেখেছেন?

না।

কখনও না?

মাথা নেড়ে নীরবে না বলল পাখি।

মুখ নিচু করল সত্যচরণ। তারপর উদাস হয়ে উঠোনের একপাশের আমগাছের দিকে তাকাল সে। একটা ল্যাজঝোলা পাখি হুড়মুড়িয়ে উড়ে গেল গাছের ডাল ছেড়ে।

সত্যচরণ বলল, তাহলে যাই।

শরবত খাবেন না?

কী হবে খেয়ে! আচ্ছা, আপনি আমাকে আগে নাই বা দেখে থাকলেন, এখন তো দেখলেন! এর পরে তো না বলতে পারবেন না?

কপালে ভাঁজ পড়ল পাখির, তা তো পারবই না!

ব্যাস। তাহলেই হল। হাসল সত্যচরণ, আমি যাই। আপনার মাকে বলে (দেবেন।

দ্রুত সে বেরিয়ে গেল পাশের টিনের দরজা দিয়ে। পাখির মুখে না শুনে যে বিশাল পাথরটা বুকের ওপর চেপে বসেছিল শেষ কথায় তা সরে গেছে একেবারেই।

*

বেশ সকালবেলায় নির্মলবাবু এলেন সদর থেকে এসে হকচকিয়ে গেলেন।

সতীশ রায় তাকে দেখে একটু বিব্রত। ছেলের বিয়েতে তিনি অবনীদাকে নেমন্তন্ন করেছেন কিন্তু ওঁর ভাই নির্মলের কথা খেয়াল করেননি।

নির্মলবাবু বললেন, বুঝতেই পারছি আপনি খুব ব্যস্ত। আপনার ব্যস্ততা কেটে গেলে না হয় চা-বাগানের ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করা যাবে।

মাথা নাড়লেন সতীশবাবু, ছেলের বিয়ে, ব্যস্ততার কী আছে। আপনি বসুন। অবনীদা বোধহয় কিছু বলেননি বাড়িতে?

না। দাদাকে তো জানেনই। আত্মভোলা মানুষ। যখনই এখান থেকে ফিরে যান অল্পবয়সী ছেলেদের প্রশংসা করেন। উনি প্ল্যান করেছেন চার বছর ধরে ওদের তৈরি করবেন এবং তারপর ওই টিম নিয়ে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে খেলবেন। ওঁর বিশ্বাস পশ্চিমবাংলার সেরা দলগুলোকে জব্দ করতে পারবে এই ছেলেরা। নির্মলবাবু বললেন, দাদা স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন।

সাফল্য পেতে গেলে স্বপ্ন দেখতেই হয়। যাক গে, আপনার কী ধারণা হল? আমাদের এই এলাকায় চা গাছের চাষ করা যাবে?

নির্মলবাবু একটু থমকে গিয়ে হেসে ফেললেন, এতদিন আমি চা-বাগান তৈরির কথা শুনেছি, চা-গাছ চাষ করার কথা এই প্রথম শুনলাম। কথাটা ঠিকই। হ্যাঁ। যাবে। তবে সয়েল টেস্ট করাতে হবে।

বাজেট কিছু করেছেন?

আনুমানিক এক কোটি টাকার কাছাকাছি। নির্মলবাবু বললেন, জমি কিনে নিয়ে প্রজেক্ট রিপোর্ট দিলে ব্যাঙ্ক বা সরকার লোন দেবে।

সেটা আমি জানি। আপনি এগিয়ে যান। আমাকে আরও তিন সপ্তাহ সময় দিন। বাড়ির ঝামেলা চুকে গেলে আপনার সঙ্গে বসব। কিন্তু সতীশ রায় নির্মলবাবুর হাত ধরলেন, ত্রুটি মার্জনা করতে হবে।

সেকি? এসব কী বলছেন? হাত ছাড়িয়ে নিলেন নির্মলবাবু।

আমার পুত্রবধূর হাতে ভাত খেতে আপনাকে আসতে হবে। এবং সপরিবারে। দ্রুত পকেট থেকে নিমন্ত্রণ পত্র বের করে নাম লিখে সতীশ রায় নির্মলবাবুর হাতে দিলেন।

আপনার নিমন্ত্রণ আমি গ্রহণ করলাম। কিন্তু একটা অনুরোধ। বউভাতের দিন আমাকে আসতে বলবেন না। আমি না হয় সামনের রবিবারের দুপুরে এসে ভাত খেয়ে যাব। আচ্ছা চলি। নমস্কার জানিয়ে চলে গেলেন নির্মলবাবু।
 
কিছুক্ষণ ওঁর দিকে তাকিয়ে থাকলেন সতীশ রায়। তারপর হাসলেন। ভাই তো দাদার কিছু কিছু পাবেই। এই লোক চাটুকার নয়। এর হাতে এক কোটি টাকার প্রকল্পের দায়িত্ব স্বচ্ছন্দে দেওয়া যায়। যার আত্মসম্মানবোধ প্রবল সে কখনই নিজেকে ছোট করতে পারবে না।

ঘড়ির দিকে তাকালেন সতীশ রায়। নটা বেজে গেছে। চিৎকার করে ডাকলেন, হরিপদ, হরিপদ। নাগেশ্বর ছুটে এল ভেতর থেকে, কিছু বলছেন? সেই ভোর থেকেই ওরা চলে এসেছে এই বাড়িতে।

আঃ। তুমি কেন? গায়ে হলুদের তত্ত্ব নিয়ে তুমি যাবে নাকি? সকাল নটা বেজে গেল তবু কারও হুঁশ নেই। হরিপদ। চিৎকার করলেন তিনি।

হরিপদ ছুটে এল।

সতীশ রায় জিজ্ঞাসা করলেন, গায়ে হলুদের তত্ত্ব রেডি?

না-মানে–। মাথায় হাত দিল হরিপদ।

আশ্চর্য! ওই মেয়েটা হাঁ করে বসে আছে। এখান থেকে তত্ত্ব না গেলে সে স্নান করতে পারবে না আর তোমা ইয়ার্কি মারছ? ক্ষেপে গেলেন সতীশ রায়।

আসলে এখনও, এয়োরা এসে পড়েননি–। হরিপদ বলল।

এয়ো? ও। তাঁদের খবর দিয়েছিলে?

হ্যাঁ। মতির মা বলে এসেছিল।

সংসারের কাজ সামলে তারা আসবেন। কিন্তু এলোকেশী কী করছে?

বসে আছে। মতির মা বলেছিল এই গায়ে হলুদের ব্যাপারটা এয়োরাই করুক। হরিপদ নিচু গলায় জানাল।

কেন? এলোকেশী কী করছে? অ। এখনও সেই বিধবার অজুহাত চালাচ্ছে? উঃ। কী যন্ত্রণা! যাও, গিয়ে বলো, দশ মিনিটের মধ্যে এলোকেশী যেন যা করার তা শেষ করে। আর সে যদি না করতে চায় তাহলে এই বাড়িতে থাকার দরকার নেই। যাও। সতীশ রায়ের কথা শেষ হওয়ামাত্র হরিপদ অদৃশ্য হল।

চুপচাপ শুনছিল নাগেশ্বর, হঠাৎ হুংকার দিল, এতক্ষণে তোমার আসার সময় হল? গায়ে হলুদ দেওয়ার জন্যে আগে আসতে বলেছিলাম না?

সতীশ রায়কে দেখে গেট পেরিয়ে আসা স্থলাঙ্গিনী ঘোমটা টানলেন মাথায়, দিদির দেরি হয়ে গেল আসতে।

গোরক্ষ বেরিয়ে এল, দেরি তো হবেই। গায়ে হলুদে আসতেই এত সাজ, বউভাতের দিন যে কত দেরি হবে কে জানে।

সতীশ রায় দেখলেন স্থূলাঙ্গিনী ঘোমটা টেনে ভেতরে যাচ্ছেন এবং তখনই তার পেছনে ক্ষীণাঙ্গিনীকে দেখা গেল। প্রথম জন নাগেশ্বরের, দ্বিতীয় জন গোরক্ষক্ষার স্ত্রী। ঠিক তখনই শাঁখ বেজে উঠল। সঙ্গে উলুধ্বনি। মহিলারা ভেতরে যাওয়ার আগেই হরিপদ ছুটে এসে জানাল, গায়ে হলুদ হয়ে গিয়েছে।

বাঃ। গাড়িতে তোল তত্ত্বগুলো।

নাগেশ্বর গোরক্ষ তত্ত্ব নিয়ে গাড়িতে যেতে চেয়েছিল মেয়ের বাড়িতে। কিন্তু তোমাদের এখানে অনেক কাজ আছে বলে তাদের আটকালেন সতীশ রায়। হরিপদ সেজেগুজে গাড়িতে উঠল। তরুণ সংঘের ছেলেরা বাইরে দাঁড়িয়েছিল। তাদের দুজনকে সঙ্গে যেতে বললে তারা আনন্দিত হয়ে গাড়িতে উঠল।
 
দুটো গাড়ি ভাড়া করা হয়েছে। সতীশ রায়ের গাড়িতে বর যাবে। ওর সঙ্গে থাকবেমঙ্গল এবং আরও দুজন। বাকি দুটো গাড়িতে বরকর্তা এবং বরযাত্রী। বিয়ের লগ্ন সন্ধে সাড়ে সাতটায়। বিকেল পাঁচটায় বেরুতে হবে। পৌঁছে আশীর্বাদ-পর্ব আছে দু-পক্ষের। নাগেশ্বররা চেয়েছিল আগেই আশীর্বাদ হয়ে যাক। আশীর্বাদ উপলক্ষে খাওয়াদাওয়াটা বেশ জম্পেশ করে হত। কিন্তু সতীশ রায় বলেছিলেন, তাহলে তো ওদেরও আগে করতে হবে। মিছিমিছি ভদ্রলোকের খরচ বাড়িয়ে কী লাভ।

চারটে নাগাদ বরযাত্রীরা তৈরি হয়ে এল। নাগেশ্বর এবং গোরক্ষর সাজ দেখবার মতো। ধুতি পাঞ্জাবিতেই হয়নি। কাঁধে উড়নি নিয়েছে। নিজে তৈরি হয়ে নিয়ে সতীশ রায় হাঁকলেন, হরিপদ, খোকাকে তৈরি হয়ে নিতে বলল। কথার পরেই খেয়াল হল তাঁর, বাঙালির ছেলে বিয়ে করতে যাবে ধুতি পরে, সেটা পরতে পারবে কিনা জিজ্ঞাসা করো। নইলে নাগেশ্বর পরিয়ে দেবে ধুতি।

হরিপদ ভেতরে গেল। এখন গ্রামের অনেক বাড়ির মহিলা ভিড় করেছেন অন্দরমহলে। সত্যচরণের ঘরে উঁকি মারল হরিপদ। সে ঘরে নেই। বাইরে এসে। হরিপদ এলোকেশীকে জিজ্ঞাসা করল, খোকা কোথায়?

ঘরে নেই?

না।

ঘণ্টাখানেক আগে বাথরুমে যেতে দেখেছিলাম।

হরিপদ সেখানে গিয়ে দেখল বাথরুমের দরজা খোলা, সেখানে কেউ– নেই। কথাটা মতির মায়ের কানে যেতেই সে ব্যস্ত হয়ে খোঁজ নিতে লাগল। না। বাড়িতে না বাগানে, কোথাও সত্যচরণকে পাওয়া গেল না।

মতির মা দুহাতে মাথা ধরে বসে পড়ে ডুকরে কেঁদে উঠল, বলেছিলাম, বলেছিলাম। এখন কী হবে?

হরিপদ জিজ্ঞাসা করল, কী বলেছিলে?

এখনই বিয়ে না দিতে। কাঁদতে কাঁদতে বলল মতির মা।

চোপ। বড়বাবু শুনলে আস্ত রাখবে না। আমি যাই খুঁজে দেখি। হরিপদ বেরিয়ে গেল খিড়কি-দরজা দিয়ে।

ক্রমশ খবরটা অন্দরমহলে ছড়িয়ে গেল। সত্যচরণকে পাওয়া যাচ্ছে না। এলোকেশীর সন্দেহ হল। পোস্টমাস্টারের বাড়িতে যায়নি তো? সে খিড়কি দরজা দিয়ে দৌড়াল।

পোস্টমাস্টারের বাড়িতে ঢুকে হাঁপাতে হাঁপাতে এলোকেশী জিজ্ঞাসা করল, খোকা কি এখানে এসেছে?

বারান্দায় দাঁড়ানো পোস্টামাস্টারের বউ অবাক। কে খোকা?

বড়বাবু, মানে সতীশ রায়ের ছেলে। এলোকেশী বলন।

পাখি বেরিয়ে এসে মায়ের পাশে দাঁড়াল। পোস্টমাস্টারের বউ বলল, কদিন আগে এসেছিল। কেন?

ওকে পাওয়া যাচ্ছে না।

সেকি?

আজ ওর বিয়ে!

ও মাগো, ছেলেটার বোধহয় মাথা ঠিক নেই। পোস্টামাস্টারের বউ বলল।

মানে?

ও এসে পাখিকে বারংবার জিজ্ঞাসা করেছে ওকে কখনও দেখেছে কিনা। দেখলে ওর কী লাভ হবে কে জানে!
 
এলোকেশী আর দাঁড়াল না। বাড়ি ফিরে এল খিড়কি দরজা দিয়ে। এসে দেখল হরিপদ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ঘিরে মহিলাদের ভিড়। এইসময় নাগেশ্বর ভেতরে এল, খোকা রেডি? বড়বাবু তাড়া দিচ্ছেন। এখনই বেরুতে হবে আমাদের।

নাগেশ্বরের বউ মিনমিন করে বলল, তাকে পাওয়া যাচ্ছে না।

আঁঃ! সেকি? ও হরিপদ? চিৎকার করল নাগেশ্বর।

হরিপদ চুপচাপ মাথা নাড়ল।

নাগেশ্বর তৎক্ষণাৎ দৌড়াল। বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সতীশ রায় ঘটকের সঙ্গে হেসে কথা বলছিলেন। নাগেশ্বর তাকে ফিসফিসিয়ে বলল, সর্বনাশ হয়ে গেছে বড়বাবু।

সতীশ রায় চোখ ছোট করলেন, কী যা তা বকছ?

হ্যাঁ বড়বাবু। কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মাথা নাড়ল নাগেশ্বর।

সতীশ রায় দ্রুত অন্দরমহলে ঢুকলেন। বারান্দা এবং উঠোনের জমায়েত হওয়া মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারলেন নাগেশ্বর মিথ্যে কথা বলেনি। তাকে দেখতে পেয়ে মতির মায়ের কান্না বেড়ে গেল।

হরিপদ।

আজ্ঞে।

এসব কী শুনছি? সে কোথায়?

অনেক খুঁজে এসেছি, কোথাও পাইনি।

সতীশ রায় মতির মায়ের দিকে তাকালেন, তুমি নিশ্চয়ই জানো সে কোথায় গেছে?

মাথা নাড়ল মতির মা, আমাকে কিছুই বলেনি।

বিশ্বাস করি না। তুমিই আদর দিয়ে ওকে বাঁদর করেছ। উঃ। এখন কী করি! সাড়ে সাতটায় লগ্ন। মেয়েটার কাছে আমি মুখ দেখাব কী করে? তেমনি দ্রুতপায়ে বসার ঘরে চলে এলেন সতীশ রায়। সেখানে তখন বেশ কয়েকজন চিন্তিত মুখে বসে আছে। ঘটকমশাই বললেন, বড়বাবু, একবার মালবাজারে ফোন করলে ভালো হয়।

ফোন করে কী বলবে? সতীশ রায় মাথা নাড়লেন।

বললে হয়, আমাদের পৌঁছাতে একটু দেরি হবে। ঘটকমশাই বললেন।

পৌঁছাতে দেরি হবে। যখন পৌঁছাবে তখন কাকে নিয়ে পৌঁছাবে? সতীশ। রায় গজগজ করলেন, যত ইয়ার্কিমারা কথাবার্তা।

গোরক্ষ পাশে গিয়ে দাঁড়াল, বড়বাবু, একবার পোস্টমাস্টারের বাড়িতে খোঁজ নিলে হয় না? মানে, ওর মেয়ের জন্যে সত্যচরণ দেবদাস হতে চেয়েছিল

ও যদি সেখানে যায় তো সেখানেই থাকুক। এ বাড়িতে সে জীবনে ঢুকতে পারবে না। আমি ভেবে নেবো আমার কোনও ছেলে নেই। সতীশ রায় ঝপ

করে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন। হরিপদ দরজায় দাঁড়িয়ে শুনছিল। এগিয়ে এসে চুপিচুপি গোরক্ষকে বলল, সেখানে থোকা যায়নি।

তুমি জানলে কী করে? গোরক্ষ সন্দেহের চোখে তাকাল।

এলোকেশী গিয়েছিল খোঁজ করতে।

এলোকেশী সেখানে কেন গিয়েছিল? গোরক্ষর জেরা।

যদি খোকাকে ওখানে পাওয়া যায়। হরিপদ থতমত খেলো।

আমার বাড়িতে, নাগেশ্বরের বাড়িতে না গিয়ে ওখানে সত্যচরণকে পাওয়া যাবে বলে এলোকেশীর মনে হল? গোরক্ষ নাছোড়বান্দা।

আমি তা বলতে পারব না।
 
গোরক্ষ নিচু হয়ে সতীশ রায়কে বলল, মনে হচ্ছে এটা একটা চক্রান্ত। আর এই চক্রান্তে এলোকেশীও আছে। সে পোস্টমাস্টারের বাড়িতে খোঁজ করতে গিয়েছিল।

সেখানে দেখা পেয়েছে?

না। বলছে সেখানে যায়নি।

তাহলে তো চকেই গেল। এলোকেশী হরিপদরা আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করবে কেন? কী স্বার্থ ওদের। চক্রান্ত যদি করে থাকে তাহলে ওই বদমাশই করেছে। সে ভেবেছে এই করে পাঁচজনের সামনে আমার মুখ পোড়াবে। তুমি, থানায় চলে যাও। বড়বাবুকে আমার নাম বলে অনুরোধ করে যে করে হোক ওকে খুঁজে বের করতে।

নাগেশ্বর বলল, এখনই থানা পুলিশ করবেন বড়বাবু?

ঘটকমশাই বললেন, আর মাত্র দু-ঘণ্টা সময় আছে।

এইসময় টেলিফোন বেজে উঠল। দু-বার রিঙ হতে নাগেশ্বর গিয়ে রিসিভার তুলে বলল, হ্যালো! কে বলছেন? কান পেতে শুনে সে মাথা নাড়ল, না না, এই রওনা হব আমরা। হা হা জানি। বড়বাবু তৈরি হয়ে গেছেন। ঠিক আছে। রিসিভার রেখে নাগেশ্বর বলল, মিথ্যে বললাম।

সতীশ রায় তাকালেন।

নাগেশ্বর বলল, মেয়ের দাদু। বলল এখনই রওনা হতে। আমি মিথ্যে বললাম।

আঃ। ন্যাকামি কোরো না। যেন তুমি সত্যবাদী যুধিষ্ঠির। কী করি ঘটকবাবু? মাথায় কিছুই আসছে না। এমনভাবে বেইজ্জত করল ছেলেটা?

এইসময় মঙ্গল ঘরে এল। তাকে দেখে সতীশ রায় বললেন, শুনেছ?

মাথা নাড়ল মঙ্গল, একজন বলল ঘণ্টা আড়াই আগে সত্যচরণকে বাসে উঠতে দেখেছে।

বাসে উঠেছে? কোন বাসে?

শিলিগুড়ির বাসে।

শোনামাত্র সতীশ রায় যেন এলিয়ে পড়লেন।

গোরক্ষ ইশারায় ঘটকমশাই আর নাগেশ্বরকে ডেকে বাইরে চলে এল। ওরা কাছে এলে বলল, সে যখন শিলিগুড়ি চলে গিয়েছে তখন আজ রাত্রে তাকে আর পাওয়া যাবে না। কোথায় খুঁজব শিলিগুড়িতে?

তার মানে মেয়েটা লগ্নভ্রষ্টা হবে। ঘটকমশাই বললেন।

অত্যন্ত অন্যায়। নাগেশ্বর বলল।

এখন একটাই উপায় আছে। মাথা নাড়ল গোরক্ষ।

কী উপায়? ঘটকমশাই যেন ডোবার আগে খড়কুটো দেখতে পেলেন।

একদিন আপনি একটা গল্প বলেছিলেন, মনে আছে? অনেকটা এরকম?

গোরক্ষর কথায় নাগেশ্বরের মনে পড়ল। হ্যাঁ হ্যাঁ। বর পালিয়ে গিয়েছিল। সেই খবর বরের বাবা পাত্রীপক্ষকে দিতে গিয়েছিলেন। তারা জোর করে বরের বাবাকেই বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দিয়েছিল। মনে পড়েছে।

গোরক্ষ বলল, আমার মাথায় একটা রাস্তা এসেছে। ছেলে যখন বেপাত্তা হয়ে গেছে তখন মেয়েটার সর্বনাশ না করে বড়বাবু যদি বিয়েটা করে ফেলেন তাহলে সব দিক রক্ষা পায় কী বলেন ঘটকমশাই?

ঘটকমশাই-এর চোখ বড় হয়ে গেল, কিন্তু বয়সের পার্থক্যটা।

কী এমন পার্থক্য? তাছাড়া বড়বাবুর শরীর স্বাস্থ্য যে কোনও যুবকের চেয়ে মজবুত। খাওয়াদাওয়া ঘুমোনো সব নিয়ম করে। সন্ধেবেলায় যখন আহ্নিক করতে বসেন তখন দু-গ্লাস খাওয়া হলেই রাতের খাবার খেতে চলে যান। গোরক্ষ বলল।

তাছাড়া মেয়েকে পছন্দ হয়েছে বড়বাবুর। সত্যচরণের পছন্দ হয়নি বলে কেটে পড়েছে। বয়স নিয়ে ভাববেন না ঘটকবাবু। হিরের আংটি বেঁকে গেলেও সেটা হিরেরই থাকে। না, এছাড়া আর কোনও রাস্তা দেখতে পাচ্ছি না আমিও। বলল নাগেশ্বর, ছেলে বিবাগী হল, মানুষটা থাকবে কী নিয়ে?

ঘটকমশাই বললেন, পাত্রীপক্ষ রাজি হবে কিনা সন্দেহ।

আরে আগে বড়বাবুকে রাজি করান। তারপর তো পাত্রীপক্ষ। গোরক্ষ রেগে গেল, যান। আপনি বড়বাবুকে আড়ালে ডেকে প্রস্তাবটা দিন।

আমি? না না। এ আমি পারব না। একেবারে কঁচা খেয়ে নিতে পারেন। ঘটকমশাই বিভ্রান্ত।

নাগেশ্বর বলল, ঠিক আছে। তিনজনেই যাচ্ছি কিন্তু যা বলার আপনি বলবেন।

ওরা এগোল।

*
 
এখনও দিনের আলো চারপাশে। মহাদেব সেনের নাতনির বিয়েতে বাড়িটাকে চমৎকার সাজিয়েছে ডেকোরেটাররা। নহবত তৈরি হয়েছে। সন্ধে নামলেই সেখানে সানাই বাজবে, আলোয় ঝলমল করবে বিয়েবাড়ি।

মহাদেব সেন তার ঘরে শেষ মুহূর্তের সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত। তখনও অতিথিদের আসার সময় হয়নি। দুজন কাজের লোক বাড়ির সামনে টুকটাক কাজ করছিল। তারা দেখতে পেল একটি যুবক গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছে। যুবকের ভঙ্গিতে একটু সংকোচ থাকায় লোকদুটোর একজন জিজ্ঞাসা করল, কী চাই?

সত্যচরণ দু-পা এগোল, কথা বলতে চাই।

বলুন কী বলবেন? দ্বিতীয় লোকটি জানতে চাইল।

সেকথা আপনাদের বলা যাবে না। সত্যচরণ কোনওমতে বলতে পারল।

• • কী কথা যা আমাদের বলা যাবে না? আপনি কে ভাই? প্রথমজন বলল।

দ্বিতীয়জন জিজ্ঞাসা করল, কাকে বললেন চান?

ইয়ে, মানে, প্রতিমাকে।

প্রতিমাকে? কে আপনি? ওদের আত্মীয়?

না না।

আপনার মতলব কী বলুন তো? আজ-ওর বিয়ে আর আপনি হুট করে কোথা থেকে এসে কথা বলতে চাইছেন?

এইসময় টাকমাথা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা এক-প্রৌঢ় এগিয়ে এলেন, কী ব্যাপার সনাতন?

প্রথম লোকটি দ্রুত এগিয়ে গিয়ে প্রৌঢ়ের কানে কানে ব্যাপারটা বলতেই ভদ্রলোক বললেন, সর্বনাশ। এই যে, এদিকে এসো!

সত্যচরণ এগিয়ে গেল। প্রৌঢ় জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি প্রতিমাকে চেনো?

মাথা নেড়ে সত্যচরণ জানাল হ্যাঁ।

কী কথা বলতে চাইছ তাকে?

একান্তই ব্যক্তিগত।

শোন। মেয়েটার আজ বিয়ে। একটু পরেই বর এবং বরযাত্রী এসে যাবে? তারা যদি শোনে বাইরের একজন ব্যক্তিগত কথা বলতে পাত্রীর দেখা চাইছে তাহলে আমাদের কী ভাববে বল তো? তুমি নিশ্চয়ই প্রতিমার ক্ষতি করতে চাও না?

না।

বাঃ। তাহলে চুপচাপ চলে যাও।

আমি কথা বললে ওর কোনও ক্ষতি হবে না। সত্যচরণ জানাল।

কিন্তু তোমাকে ওর কাছে যেতে দেওয়া হবে না।

এরকম বলবেন না। আমি অনেক ঝুঁকি নিয়ে এসেছি। ওর সঙ্গে কথা না বললে ও খুব বিপদে পড়বে। আমাকে বাধা দেবেন না। কাঁদো কাদো হল সত্যচরণ।

ভদ্রলোক বুঝলেন মামলা বেশ জটিল। একে এখনই মেরে ধরে বের করে দেওয়া যায়। কিন্তু তাতে পাড়ার লোক কৌতূহলী হয়ে উঠবে। গুজব ছড়াবে। প্রৌঢ় বললেন, আমি মেয়ের কাকা। তুমি এখানে অপেক্ষা করো আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত।
 
প্রৌঢ় ভেতরে গেলেন। ভেতরের উঠোনে তখন ছাঁদনাতলায় আলপনা দেওয়া হচ্ছে। চারপাশে মেয়েদের ভিড়। প্রতিমার মা এবং দিদিমাকে ডেকে নিয়ে একটা ঘরে ঢুকে প্রৌঢ় জানালেন সমস্যার কথা।

দিদিমা বললেন, সর্বনাশ। ছেলেটা কে?

নাম বলছে না। জেদ ধরে আছে প্রতিমার সঙ্গে কথা বলবে বলে। প্রৌঢ় বললেন, তোমরা কেউ জানতে না বউদি?

প্রতিমার মা মাথা নাড়লেন, না।

তোমার মেয়ে নিশ্চয়ই এই ছেলেটার সঙ্গে ভাব করেছিল। বিয়ের খবর পেয়ে ছুটে এসেছে ছোকরা। প্রৌঢ় বললেন।

আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে ঠাকুরপো। কী হবে এখন?

মেরেধরে বের করে দিতে পারি-। প্রৌঢ় বললেন।

না না। মা, আপনি বাবাকে বলুন। প্রতিমার মা বললেন।

উনি কী করবেন। যেরকম নার্ভাস মানুষ। ডাকো প্রতিমাকে। আচ্ছা, আমিই ডেকে আনছি। বৃদ্ধা বেরিয়ে গেলেন।

প্রতিমার মা বললেন, ছেলেপক্ষ যদি জানতে পারে–!

বিয়ে ভেঙে দিয়ে চলে যাবে। একটু আগে তোমার শ্বশুরমশাই ওদের ফোন করেছিলেন। ওরা এখনও বের হয়নি। কী জানি, এই ছোকরা তাদের খবর দিল কিনা! দিয়েছে বলে হয়তো ভাবছে আসবে কিনা?

প্রতিমার মা মাথা নাড়লেন, ও যে এরকম কিছু করেছিল তা আমার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না।

আজকালকার মেয়ে, ওদের মুখ দেখে বোঝা যায় না পেটে কী আছে? প্রৌঢ় মাতব্বরের ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন।

দিদিমা প্রতিমাকে নিয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়লেন প্রতিমার মা, তোর পেটে পেটে এত? এইভাবে আমাদের সর্বনাশ করলি?

কী বাজে বকছু?

বাজে বকছি? মারার জন্যে হাত তুললেন প্রতিমার মা।

প্রৌঢ় বললেন, থাক থাক। বউদি এত মাথা গরম কোরো না। শোনো, সত্যি কথা বলে, তুমি কি কোনও ছেলের সঙ্গে ভাব করেছ?

আমার কি মাথা খারাপ?

তার মানে?

এখানকার সবকটা ছেলে মাকাল ফল। তাহলে যে এসেছে সে আসবে কেন?

কে এসেছে?

একটি ছেলে। রোগা, লম্বা, ভালো দেখতে।

দূর। সে কী বলেছে? খেঁকিয়ে উঠল প্রতিমা।

তোমাকে ব্যক্তিগত কথা বলতে চায়। প্রৌঢ় বললেন।

তার মানে এই বিয়ে ভাঙতে চায়। দিদিমা বললেন।

চলো তো দেখি, কে এসেছে।

খবরদার! একদম বাইরে যাবি না। প্রতিমার মা মেয়ের হাত ধরল।

আশ্চর্য। যাকে চিনি না জানি না সে ব্যক্তিগত কথা বলতে আসবে। কেন?

প্রৌঢ় বললেন, কিন্তু সে বলছে, তোকে চেনে। হয় সে মিথ্যে বলছে নয় তুই বলছিস। বাইরে গিয়ে ওর সঙ্গে কথা বললে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।

কী কেলেঙ্কারি হবে? কীরকম মিইয়ে গেল প্রতিমা।

যদি তোকে বিয়ে করতে নিষেধ করে, যদি কান্নাকাটি করে তাহলে লোকজন হাসাহাসি করবে। তোর দাদুর কথা ভাব। বিয়ে ভেঙে গেলে ওঁর হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে। প্রৌঢ় মাথা নাড়লেন, একটা ছেলে তো কোনও কারণ ছাড়াই এত সাহস দেখাতে পারে না।

দিদিমা বললেন, ছেলের বাপের কথা ভাব। তোকে কী পছন্দ করেছেন। তোর মুখে গালাগালি শুনতে চেয়েছিলেন বলে আমরা অবাক হয়েছিলাম। পরে বুঝতে পেরেছি মানুষটা আমুদে। তা গালাগাল শোনা এক কথা কিন্তু যাকে ছেলের বউ করে নিয়ে যাবেন তার চরিত্রে যদি কলঙ্ক থাকে তাহলে কিছুতেই মেনে নেবেন না।

তোমরা কী যা তা বলছ! আমি কী করেছি যে কলঙ্ক থাকবে? প্রায় চিৎকার করে উঠল প্রতিমা।

তুমি কিছুই করোনি। এখন দয়া করে নিজের ঘরে যাও। সেখানে কেউ যেন বুঝতে না পারে এসব ঘটনা ঘটেছে। এটুকু করো তাহলেই হবে। প্রতিমার মা বললেন।

বোঝা গেল অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রতিমা ফিরে গেল তার ঘরে যেখানে বান্ধবীরা তাকে সাজাচ্ছিল। দিদিমা জিজ্ঞাসা করলেন, কী হবে?

একটাই রাস্তা আছে। প্রৌঢ় চোখ বন্ধ করলেন।

কী? প্রতিমার মা শুকনো গলায় জিজ্ঞাসা করলেন। ..

আমি ওকে চিলেকোঠার ঘরে নিয়ে যাচ্ছি। তুমি খানিকটা দড়ি আর প্লাস্টার নিয়ে ওখানে চলে এসো তাড়াতাড়ি। প্রৌঢ় প্রতিমার মাকে কথাগুলো বলে দ্রুত পা বাড়ালেন।

*
 

Users who are viewing this thread

Back
Top