What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected তনু অতনু সংবাদ (2 Viewers)

লোকটা যে হাতে লাইসেন্স পেয়ে গেছে। আর দোকানও করেছে গ্রামের বাইরে জঙ্গল ঘেঁষে। দেখছি, কী করা যায়।

আরও কিছুটা এগিয়ে ঘড়ি দেখলেন তিনি। বারোটা বেজে দশ। বললেন, লোকটার নাম হরেকৃষ্ণ।

ওই ভাটিখানার মালিক তো, জানি। নাগেশ্বর বলল।

জানো। গিয়েছ নাকি সেখানে?

ছি ছি বড়বাবু। আপনার অনুমতি ছাড়া কোথাও গিয়েছি?

শোনো, তোমরা দুজন একবার সেখানে যাও। হরেকৃষ্ণকে আমি শর্ত দিয়েছিলাম বেকার লোক এবং অপ্রাপ্তবয়স্কদের মদ বিক্রি করতে পারবে না। সেটা মানছে কিনা দেখবে। বলবে তার বিক্রি করা মদ খেয়ে একজন এমন অসুস্থ হয়ে পড়েছে যে ডাক্তার বলেছে শহরে নিয়ে যেতে। এরকম যেন আর না হয়। পারবে তো তোমরা? সতীশ রায় বললেন।

গোরক্ষ বলল, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।

তাহলে তোমরা যাও। ঠিক তিনটের সময় সেজেগুজে এসো।

সে আর বলতে– নাগেশ্বর হাসল।

*

আজ দুপুরের খাবার মতির মা পরিবেশন করল। জানা গেল এলোকেশী গিয়েছে বাপের বাড়ি থেকে জিনিসপত্র আনতে। কিন্তু তার চেয়ে অন্য খবর জানতে উৎসাহ বেশি মতির মায়ের, ছোটখোকা আজও মাছ ধরা দেখতে গেছে।

কখন?

এই তো, আপনি বাড়ি ফিরে চানে গেলেন, তখন—।

কথা বাড়ালেন না সতীশ রায়।

খাওয়া-দাওয়া সিগারেট শেষ পর্ব চুকলে গুরুচরণ হালদার দেখা করতে এল, মেয়ে নিশ্চয়ই বলেছে আমি বদলি হয়ে গেছি।

হ্যাঁ। বদলির চাকরির তো এই বিপদ।

মাত্র দুবছর হল এসেছি, আসরফ এক জায়গায় আট দশ বছর মাটি আঁকড়ে পড়ে আছে অথচ আমার ঘাড়েই কোপ পড়ল। গিয়েছিলাম বি. ডি. ও. র অফিসে। উনি কিছুই জানেন না। গুরুচরণ ফুঁসছিল।

আমার কাছে কেন এসেছেন সেটা বলুন।

আজ্ঞে, আচমকা বদলি করল কিন্তু জিনিসপত্র নিয়ে নতুন জায়গায় যাওয়ার খরচ পরে বিল করে আদায় করতে হবে। এখন এই খরচ আমি কীভাবে করি? যদি কিছু ধার দেন।

কত?

এই ধরুন, হাজার পাঁচেক। গাড়ি ভাড়া করে মালপত্র নিয়ে যাওয়ার খরচ তো কম নয়। নতুন জায়গায় সংসার পাততেও তো খরচ হবে।

কতদিনে শোধ করবেন?

বেশিদিন না। দশ মাসে। মাসে পাঁচশো করে। গুরুচরণ বলল।

কথার খেলাপ হবে না তো?

একদম না। কারণ প্রত্যেক মাসে এলোর মাইনে বাবদ যে টাকা আপনি আমার হাতে দিতেন সেটা দশমাস দিতে হবে না। ঘরের টাকা ঘরেই রইল। সেই সঙ্গে যে ধার নিচ্ছি তা শোধ হয়ে গেল। গুরুচরণ হাসল।

তাহলে তো হল না।

মানে? হকচকিয়ে গেল গুরুচরণ।

আপনার মেয়ে বলেছে যে তার রোজগার করা টাকা কাউকে দেবে না।

একথা হারামজাদি বলেছে?

গালাগাল দিয়ো না। আমি দ্বিতীয়বার বরদাস্ত করব না।

হায় কপাল। দুধকলা দিয়ে এ কোন্ কালসাপ পুষলাম? আমার ওয়াইফ ঠিক কথা বলে! পাঁচ হাজার টাকা পথখরচা নিয়ে ওকে জোর করে শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়াই উচিত ছিল। আমি ভাবলাম মাসে পাঁচশো পেলে বছরে তার চেয়ে বেশি পাওয়া যাবে। যে মুরগি ডিম দেবে তাকে কেন কাটব? আপনি ওর কথা কানে তুলবেন না বাবু। গুরুচরণ ভেঙে পড়ল।

সতীশ রায় ডাকলেন, হরিপদ।

হরিপদ এল। সতীশ রায় বললেন, দুলালকে বল শুরুচরণবাবুর মালপত্র আজই নাথুয়াতে পৌঁছে দিতে। যা ভাড়া হবে তা যেন আমার কাছ থেকে নেয়। যান আপনি ওর সঙ্গে। এর বেশি কিছু আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়।

হরিপদ গম্ভীর গলায় বলল চলুন।

*

ঘটকমশাই এসে গিয়েছেন ঠিক সময়ে। আজ বেশ প্রফুল্ল দেখাচ্ছে তাকে। খেতে বললে রাজি হলেন না। বললেন, গিন্নিকে বলে এসেছি যদি বাবুমশাই-এর পাত্রী পছন্দ হয় তাহলে রাত্রে ওঁর বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করে থেকে যাব। আজ কোন চিন্তা নেই।
 
সতীশ রায় আজ একটু সাজলেন। শ্বশুর হওয়ার এই সুযোগটা কাজে লাগাতে চাইলেন। ভালো পাঞ্জাবি, ধুতি, পাম্প স্যু বের করলেন। অনেককাল ব্যবহার না করা পারফিউম দুই বগলে ছড়ালেন। চুল আঁচড়ালেন পরিপাটি করে।

বড়বাবু। দরজায় এলোকেশী।

কী ব্যাপার? মুখ ফেরালেন বা সতীশ রায়।

সম্পর্ক শেষ করে এলাম। জিনিসপত্র যা ছিল নিয়ে এসেছি।

ভালো।

আপনার কাছে টাকা চাইতে এসেছিল, দেননি তো?

যাও স্নান-খাওয়া করে নাও।

যাই। পরে তো, মানে যাওয়ার সময় বলতে পারতাম না, তাই তড়িঘড়ি বলতে এলাম।

পরে পারতে না কেন?

কনে দেখতে যাবেন। শুভ কাজ। সেইসময় বিধবার মুখ দেখতে নেই। এলোকেশী চলে গেল। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। তারপর স্ত্রীর ছবির দিকে তাকালেন। স্ত্রী নেই, তিনি তো বিপত্নীক। বিধবাদের যদি অত নিয়ম মেনে চলতে হয়, তাহলে বিপত্নীকদের এত স্বাধীনতা কেন?

*

সাড়ে তিনটে বাজতে চলল তবু মানিকজোড়ের দেখা নেই। ঘটকমশাই অধৈর্য হচ্ছেন। পাঁজিতে বলেছে সাড়ে তিনটের আগেই বেরুতে হবে।

তিনটে আঠাশে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠলেন তারা। ঘটকমশাই বসলেন ড্রাইভারের পাশে। তিনি বললেন, ওঁরা কেন এলেন না, সময়টা জানতেন তো? আপনাকে এত মান্যি করেন।

এরকম ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি। সতীশ রায় বললেন।

ও হ্যাঁ। বানারহাট থেকে রসগোল্লা নেবেন নাকি?

রসগোল্লা? অন্যমনস্ক ছিলেন সতীশ রায়।

প্রথমবার যাচ্ছেন, খালি হাতে যাবেন?

ও। কিন্তু ধরো, মেয়ে দেখলাম, পছন্দ হল না, তখন ওই রসগোল্লা ওরা খুশি হয়ে খেতে পারবে? আমারও মনে হবে অনর্থক নিয়ে গেলাম।

তা অবশ্য। ঘটকমশাই বললেন, তবে রেওয়াজ আছে বলেই–।

ঠিক আছে। মেয়ে পছন্দ হলে মালবাজারের মিষ্টির দোকানে অর্ডার দেব চার রকমের মিষ্টি সেন বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে। সতীশ রায় বললেন।

ডুডুয়া থেকে ন্যাশনাল হাইওয়েতে ওঠার মুখে ওদের দেখতে পেয়ে ড্রাইভার গাড়ির গতি কমিয়ে বলল, ওই যে ওখানে।

গাড়ি থামাও। সতীশ রায় বললেন।

ড্রাইভার ওদের পাশে গাড়ি থামাতেই ওরা সামনের দরজা খুলে উঠে পড়ল। ঘটকমশাই চেঁচালেন, আরে কী করছেন! এতখানি সরে গেলে ড্রাইভার গাড়ি চালাবে কী করে?

গোরক্ষ দরজা বন্ধ করে মুখ নিচু করল।

সতীশ রায় জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় গিয়েছিলে?

দুজনে দুজনের দিকে তাকাল, জবাব দিল না।

সেই একই পোশাকে আছ, বাড়িতে স্নান খাওয়া করে আসনি?

দুজনে মাথা নিচু করল। ঘটকমশাই চাপে পড়ে উসখুস করছিলেন, এবার ওদের দিকে তাকাতেই বলে উঠলেন, ইস। কী দুর্গন্ধ।

সঙ্গে সঙ্গে দুজনের হাত দুই পকেটে ঢুকে গেল। রুমাল বের করে দুজনেই মুখ চাপা দিলেন।

সেকি! তোমরা এই ভরদুপুরে মদ গিলে এসেছ? সতীশ রায় রেগে গেলেন, নামো, নেমে যাও গাড়ি থেকে। তোমাদের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই আমার।

গোরক্ষ মিনমিন করল, দোষ আমাদের না, বিশ্বাস করুন।

নাগেশ্বর বলল, আমরা ফাঁদে পড়ে গিয়েছিলাম।
 
গাড়ি থেমে গিয়েছিল। গোরক্ষ বলল, একটু শুনুন, প্লিজ। আমরা হরেকৃষ্ণের ভাটিখানায় গিয়ে কোনও বেকার বা অপ্রাপ্তবয়স্ককে দেখতে পাইনি।

পেলে ঝাড়ব কী করে ওকে। তখন নাগেশ্বর বলল, ওখানকার চোলাই খেয়ে মানুষ অসুস্থ হচ্ছে। শোনামাত্ৰ ক্ষেপে গেল্ল হরেকৃষ্ণ। সে চিৎকার করল, সে হয়তো অন্য দোষ করে কিন্তু কখনই ভেজাল চোলাই বিক্রি করে না। এই বদনাম সে সহ্য করতে পারবে না। আমাদের প্রমাণ দিতে হবে সে খারাপ চোলাই বিক্রি করেছে। আমি অসুস্থ লোকটার কথা বললাম। শুনে সে উড়িয়ে দিল। তিনটুকরো ইলিশ সবাই খায়। কিন্তু দু-টুকরো খেলেই কারও কারও অম্বল হয়। তাই বলে কি ইলিশটা খারাপ? সে বলল, আপনারা নিজেরা খেয়ে দেখুন, খেয়ে মন্দ বলুন। আমি মেনে নেব। এই দোকান বন্ধ করে চলে যাব।

নাগেশ্বর বলল, আমি ভাবলাম দারুণ মোকা পাওয়া গেল। খেয়ে খারাপ বললে ভাটিখানা উঠে উঠে যাবে। আমি তো কখনও চোলাই খাইনি। ঠিক বুঝতে না পেরে গোরক্ষকে বললাম খেতে। ও ঠিক ধরতে পারল না ভালো না খারাপ।

তারপর একের পর এক গ্লাস গিলে গেছ?

আজ্ঞে তখন আর খেয়াল ছিল না।

দাম দিয়েছ?

গোরক্ষ বলল, দিতে চেয়েছিলাম কিছুতেই নিতে চাইল না।

নিতে চাইল না বলে খুব খুশি হলে?

না বড়বাবু। আপনার কাছে প্রসাদ পাই তাই বলে অন্য লোক, ছিঃ।

কাল সকালে গিয়ে দাম মিটিয়ে আসবে। না নিলে ফেলে দেবে ওর সামনে। যাও, নামো। সতীশ রায় বিরক্ত।

বড়বাবু। গোরক্ষ বলল।

পরিবারের কাছে তো বটেই। নিজের কাছেও মুখ দেখাতে পারব না। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল নাগেশ্বর, আমাদের নামাবেন না।

কী চাও?

পাত্রী দেখতে যাব। গোরক্ষ বলল, মাথা নাড়ল নাগেশ্বর।

চমৎকার। দু-দুটো মাতালকে সঙ্গে নিয়ে পাত্রী দেখতে যাব আমি। কী ভেবেছ তোমরা। চিৎকার করলেন সতীশ রায়।

বেশ। আমরা গাড়িতেই বসে থাকব, নামব না। তবু তো বলতে পারব বড়ার সঙ্গে পাত্রী দেখতে গিয়েছিলাম। গোরক্ষ বলল।

কথাটা মনে থাকে যেন। গাড়ি চালাও।

মিনিট তিনেকের মধ্যে ঠাণ্ডা বাতাস ওদের ঘুম পাড়িয়ে দিল, ঘটকমশাইকে খোঁচা মারতে হচ্ছিল ওদের সরাতে।

মালবাজারে পৌঁছাতে পাঁচটা বাজতে দশ। পেট্রল পাম্পের কাছে গাড়ি থামিয়ে ওদের নামতে বললেন সতীশ রায়।

তখন চোখে ঘুম ওদের। সতীশ রায় বললেন, ওপাশের ওই মাঠে শুয়ে ঘুমাও। ফেরার সময় ডেকে নিয়ে যাব।

সারাদিন খাইনি–। গোরক্ষ বলল।

ওসব খাওয়ার পর শরীরে খাবার খাওয়া উচিত। নাগেশ্বর বলল।

এই অবেলায় ভাত খেতে হবে না। পুরি তরকারি খেয়ে এখানে এসে দাঁড়িয়ে থেকো। ধরো। কুড়িটা টাকার নোট নাগেশ্বরের হাতে ধরিয়ে দিয়ে সতীশ রায় বললেন, ঘটকবাবু, কোন পথে যেতে হবে?

ঘটকমশাই পথ চিনিয়ে নিয়ে এলেন।

বাগান এবং বাড়ির চেহারা দেখে সতীশ রায় অনুমান করতে পারলেন এদের অবস্থা বেশ ভালো। গাড়ির শব্দে একজন বৃদ্ধ হাতজোড় করে বেরিয়ে এলেন বারান্দা থেকে। ঘটকমশাই ফিসফিস করে বললেন, মহাদেব সেন।
 
মহাদেব সেনের বয়স সত্তরের ওপাশে। বোঝাই যাচ্ছিল, উনি সতীশ রায়ের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বাগানের গেট খুলে আপ্যায়ন করলেন, নমস্কার। আসুন।

গাড়ি থেকে নেমে সতীশ রায় হাত জোড় করলেন, বাঃ, আপনার বাড়িটি বেশ সুন্দর।

ওই আর কী! আসতে অসুবিধে হয়নি তো? মহাদেব জিজ্ঞাসা করলেন।

বিন্দুমাত্র না। ঘটকবাবু পথ চিনিয়ে আনলেন। সতীশ রায় জবাব দিলেন।

মহাদেব সেন ঘটক মশাইয়ের দিকে তাকালেন, আপনি বলেছিলেন ওঁর সঙ্গে আরও দুজন আসতে পারেন–!

সতীশ রায় বললেন, আমি একাই এলাম। আসলে আমার বাড়ির বউ করে যাকে নিয়ে যাব তাকে আমিই দেখতে চাই প্রথমবার।

কথা বলতে বলতে ওঁরা বারান্দা পেরিয়ে ভেতরের ঘরে ঢুকলেন। মহাদেব সেন বললেন, বসুন।

ওঁরা বসতেই ভেতর থেকে একটি কাজের মেয়ে ট্রে-তে জলের গ্লাস রেখে সামনে এল। ঘটকমশাই জল খেলেন, সতীশ রায় বললেন, না।

মেয়েটি চলে গেলে সতীশ রায়ের দিকে তাকিয়ে মহাদেব সেন বললেন, অনেকটা পথ এসেছেন, একটু চা।

হবে। ব্যস্ত হবেন না। আমি যাকে দেখতে এসেছি সে আপনার নাতনি?

হ্যাঁ। আমার একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলাম শিলিগুড়িতে। পাত্র ইঞ্জিনিয়ার। বিয়ের দুবছরের মাথায় মেয়ে হল। সেই মেয়ের পাঁচ বছর বয়সে দুর্ঘটনা ঘটল! সেবকের রাস্তায় জিপ দুর্ঘটনায় মারা গেল জামাই। তখন থেকে ওরা এখানে। নাতনি এখানকার স্কুলে পড়েছে। হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করার পর ওর দিদিমা চাইছে বিয়ে দিয়ে দিতে। পড়াশুনোয় তেমন মেধাবী নয় যে কলেজে পড়ে উন্নতি করতে পারবে। বুঝতেই পারছেন ওই মেয়েই আমাদের সবকিছু। মহাদেব সেন বললেন।

কি নাম?

প্রতিমা।

বাঃ।

আপনার ছেলে শুনলাম আপনাকে ব্যবসায় সাহায্য করে?

প্রশ্নটা শুনে ঘটকমশাই-এর দিকে তাকালেন সতীশ রায়। তারপর নীরবে মাথা নাড়লেন।

ভালো। আপনার কথা আমরা মালবাজারে বসেও শুনেছি। ডুডুয়ার সতীশ রায় আমার বাড়িতে আসছেন শুনলে অনেকেই দেখতে আসতে চাইত।

আপনি আমাকে লজ্জায় ফেলে দিচ্ছেন। আমি সামান্য ব্যক্তি। কিছু জমিজমা আর কাঠের কারখানা ছিল, আমি আরও কিছু বাড়িয়েছি। স্ত্রী চলে গেছেন পনেরো বছর আগে। সব কিছু দেখে ছেলেকে মানুষ করা যে কী সমস্যা তা আমিই জানি। তবে হ্যাঁ, ছেলে এখনকার মতো অবাধ্য, বারমুখো নয়। আবার এত ঘরমুখী যে সেটাই সমস্যা হয়েছে। এক ছেলে, তাকে ভালভাবে সংসারী করে যেতে না পারলে চুপ করলেন সতীশ রায়।

একি! এত তাড়াতাড়ি যাওয়ার কথা বলছেন কেন? আপনার বয়স আমার চেয়ে অনেক কম। মহাদেব সেন কথাটা বলতেই ভেতরের দরজায় টোকা পড়ল। এক মিনিট, বলে মহাদেব সেন ভেতরের দরজার পর্দা সরিয়ে চোখের আড়ালে চলে গেলেন। ঘটকমশাই জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন বুঝছেন?

বোঝার মত কিছু কি ঘটেছে? চাপা গলায় বললেন সতীশ রায়।

মহাদেব- সেন ফিরে এসে বললেন, এবার নাতনিকে এঘরে আসতে বলি?

অবশ্যই। সতীশ রায় মাথা নাড়লেন।

সঙ্গে সঙ্গে পর্দা সরিয়ে যে এঘরে ঢুকল তার পরনে দামী শাড়ি যেটা সামলাতে অনেকগুলো সেফটিপিন ব্যবহার করা হয়েছে। মুখে পাউডারের প্রলেপ, চিবুক বুকের দিকে। চুল পাতা করে বাঁধা।

মহাদেব সেন বললেন, ওই চেয়ারে বসে দিদি।

জানি। চিবুক উঠল না, মুখ থেকে শব্দ বেরুল। বেরুতেই ভেতরের দরজায় দুবার টোকা পড়ল।

তুমি প্রতিমা?

মাথাটা একবার ঈষৎ ওপর-নিচ হল।

তুমি আমার দিকে তাকাচ্ছ না কেন?

ধীরে ধীরে মুখ উঠল। সতীশ রায় দেখলেন মুখটি নিখুঁত। এতটা নিখুঁত তিনি আশা করেননি। দুবার কেন দশবার দেখেও হতচ্ছাড়াটার আশ মিটবে না।

আচ্ছা মা, তুমি কি বাড়িতে এরকম শাড়ি পরে থাকো?

মাথা নেড়ে না বলল প্রতিমা।

তাহলে এক কাজ কর। ভেতরে গিয়ে খুব চটপট বাড়িতে যা পর তাই পরে এসো। আর আসার আগে মুখ ধুয়ে ফেলবে, চুলও খুলে যেমন থাকো তেমন হয়ে আসবে।

বলমাত্র তড়াক করে উঠে প্রতিমা যেভাবে ভেতরে চলে গেল তাতে ঘটকমশাই-ও হেসে ফেললেন। ভেতরে তখন শাসানি চলছে আর প্রতিমা চাপা গলায় বলছে, আমি কী করব?

সতীশ রায় মহাদেব সেনকে বললেন, আমি ওকে ওর মতো দেখতে চাই, এই কথাটা যদি ভেতরে বলে দেন–।

ঠিক আছে, ঠিক আছে। মহাদেব সেন বললেন, সাধারণত যারা দেখতে আসেন তারা সাজাগোজা অবস্থাতেই দেখতে চান।
 
কাজের মেয়েটি চা নিয়ে এল। ঘটকমশাই হাত বাড়ালেন কিন্তু সতীশ রায় নিলেন না। যতটা সময় লাগতে পারে বলে সতীশ রায় ভেবেছিলেন তার অনেক আগেই প্রতিমা ফিরে এল। তার দিকে তাকিয়ে সতীশ রায় বলে উঠলেন, বাঃ। এই তো। এখন তোমাকে অনেক সহজ লাগছে।

আটপৌরে শাড়ি, মুখে রঙ নেই, চুল হাত খোঁপায় আটকানো, প্রতিমা বাইরের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপল।

আচ্ছা, তুমি নিশ্চয়ই জানো, আমি কে?

মাথা নাড়ল প্রতিমা।

কে বল তো?

তাকাল প্রতিমা, ডুডুয়ার সতীশ রায়।

শব্দ করে হাসলেন সতীশ রায়। তারপর বললেন, আমার ছেলের নাম। সত্যচরণ রায়। তোমার যেমন বাবা নেই, ওরও তেমন মা নেই। তবে ওর একটা অভ্যেস আছে। বেশির ভাগ সময় ঘরে বসে লেখালেখি করে।

কী লেখে?

কী জানি! আমাকে দেখায় না। চুপ করে প্রতিমাকে দেখলেন কিছুক্ষণ। তারপর রুমাল বের করে মুখ মুছলেন।

আমি কি হাঁটব? প্রতিমা জিজ্ঞাসা করল।

অ্যাঁ? শুধু শুধু হাঁটবে কেন?*সতীশ রায় বুঝতে পারলেন না।

যারা দেখতে আসে তারা তো হাঁটতে বলে। একজন আবার ভেজা পায়ে হাঁটতে বলেছিল। মেঝেতে পায়ের ছাপ পরীক্ষা করেছিল। প্রতিমা বলল।

কেন?

ওমা, আপনি এসব জানেন না? প্রতিমা প্রশ্ন করা মাত্রই ভেতরের দরজায় শব্দ হল। সঙ্গে সঙ্গে মুখ নামাল সে, না। আমি কিছু বলব না।

তোমাকে হাঁটতে হবে না, খোঁপা খুলে দেখাতে হবে না কত চুল!

তাহলে সেলাই আনব?

এনে কী করবে? আমাদের বাড়ির সেলাই দর্জি করে।

ও।

আমি কি রাঁধতে পারি–।

সেটা জেনেও কোনও উপকারে আসবে না। কারণ রান্না করে মতির মা আর এলোকেশী। তোমাকে তারা রান্নাঘরে ঢুকতেই দেবে না।

তাহলে এখন কি আমাকে গান গাইতে হবে?

গান–! সতীশ রায় তাকালেন।

আমি গান গাইলে সবাই চুপ করতে বলে।

তাহলে গাইতে হবে না। সতীশ রায় বললেন, আমি তোমাকে মাত্র একটি প্রশ্ন করব। বুঝতে পারছ?

না। মাত্র একটা প্রশ্ন? এর আগেরবার যারা এসেছিল তারা চৌদ্দটা প্রশ্ন করেছিল। আপনি মাত্র একটা করবেন?

হ্যাঁ।

কোনও অথবা দেবেন না?

না।

প্রতিমা অসহায় চোখে মহাদেব সেনের দিকে তাকাল। মহাদেব সেন বললেন, প্রশ্নটা শোন, উত্তর জানা থাকলে জবাব দিবি।

আর না জানা থাকলে ফেল করব! বলে সতীশ রায়ের দিকে তাকাল প্রতিমা, জানেন, গতবার প্রশ্ন করেছিল, অসুরকে মেরে দুর্গাঠাকুর কি দশ হাত নিয়ে কৈলাসে ফিরে গিয়েছিল না আট হাত খুলে ফেলেছিল?

সর্বনাশ, এর উত্তর তো আমারও জানা নেই। কি ঘটকবাবু, তুমি জানো?

ঘটকমশাই মাথা নেড়ে না বললেন।

সতীশ রায় বললেন, তারপর?

আমি বললাম, সিংহ তো দুর্গার সঙ্গে কৈলাসে যেতে পারে না। ও হিমালয়ের জঙ্গলে থাকে। দুর্গা নেমে এসে ওর পিঠে ওঠেন প্রত্যেক বছর, তার আটটা হাত দুর্গা সিংহের কাছে জমা রেখে যান। সিংহ পাহারা দেয়। প্রতিমা হাসল।

সতীশ রায় বললেন, চমৎকার, চমৎকার উত্তর।

ঠিক আছে। আপনি প্রশ্ন করুন।
 
আমার একটাই প্রশ্ন। তোমাকে ওই প্রশ্নের পাঁচটা উত্তর দিতে হবে। যেমন, যদি জিজ্ঞাসা করি তোমার জানা পাঁচটা ফলের নাম বলো। তুমি কী বলবে?

আম, লিচু, আপেল, ন্যাসপাতি, কাঁঠাল। উত্তর দিল প্রতিমা।

গুড। আমার প্রশ্নটারও পাঁচটা উত্তর চাই। তুমি এতদিন ধরে যত গালাগাল শুনেছ তার সেরা পাঁচটা আমাকে বলো।

গালাগাল? চোখ গোল হয়ে গেল প্রতিমার। মহাদেব সেন উঠে বাইরের বারান্দায় চলে গেলেন। ভেতরের দরজায় শব্দ হলো না।

হ্যাঁ। তুমি কি গালাগাল জানো না?

হুঁ।

পাঁচটা বেস্ট গালাগাল বলল।

অসভ্য। নিচু গলায় বলল প্রতিমা।

এ তত তোমরা সাত আট বছরেই বলতে। সবার সামনে বলতে। তবু এটাকে এক বলে ধরলাম।

বদমাশ? গলা একটু উঠল।

হ্যাঁ। দুই। তবে খুব নিরীহ গালাগাল।

মুখপোড়া? গলা আরও উঠল।

তিন। চলবে।

মাকাল? এবার গলা ছাড়ল।

বাঃ। এবার পাঁচ নম্বর। এটাই আসল। যেগুলো বলেছ তাদের থেকে কড়া একটা কিছু বল। সতীশ রায় উত্তেজিত।

প্রতিমা ভাবছিল কিন্তু কোনও শব্দ খুঁজে পাচ্ছিল না। তার মুখে অনেক

অভিব্যক্তি কিন্তু কোনও শব্দ নেই।

সেটা লক্ষ্য করে সতীশ রায় বললেন, আমি তোমাকে সাহায্য করছি। কিন্তু যেহেতু তুমি বললে না তাই এটা পাঁচ নম্বর হবে না। বলে একটু থেমে হেসে বললেন, ম্যাদামারা।

হ্যাঁ। চোখ বড় করল প্রতিমা।

আগের বার যারা দেখতে এসেছিলেন তাঁদের ছেলের সম্পর্কে তুমি একথা বলেছিলে, ঘটকবাবুর মুখে শুনেছি।

হ্যাঁ। কিরকম কেঁচোর মত বসেছিল।

অতএব পাঁচ নম্বরটা। সতীশ রায় বললেন।

মনে আসছে না।

এক মিনিট সময় দিচ্ছি।

চোখ বন্ধ করে বসে থাকল প্রতিমা। পঞ্চাশ সেকেন্ড যখন পার হয়েছে ৩খন চেঁচিয়ে উঠল, পাঁচ নম্বর হল, ঢ্যামনা।

সতীশ রায় প্রাণখুলে হেসে উঠলেন, পারবে, মা তুমিই পারবে। ঘটকবাবু, ডাকুন ওর দাদুকে।

ডাকতে হল না। তার আগেই মহাদেব সেন ঘরে ফিরে এলেন। সতীশ রায় এগিয়ে গিয়ে তার পায়ে হাত দিতে চাইলে তিনি চমকে সরে গেলেন, একি করছেন আপনি? ছি ছি। আপনার মতন মানুষ আমাকে–।

আপনি বয়সে বড়। সম্পর্কে আমার বেয়াই-এর বাবা। আমার পিতৃসমই।

বেয়াই?

আপনার ছেলে থাকলে তাকে ওই সম্বোধনই তো করতাম। সতীশ রায় বললেন, আপনার নাতনিকে আমি পুত্রবধূ হিসেবে দেখতে চাই।

এ তো খুব আনন্দের কথা–।

প্রথমে এক কাপ চা খাব। সতীশ রায় বললেন।

প্রতিমা দৌড়ে গেল ভেতরে।

ঘটকমশাই বললেন, এবার বলুন, আপনি যেমনটি চেয়েছিলেন তেমনটি পেয়েছেন তো?

একশতে একশ। কী বলে তোমাকে ধন্যবাদ দেব আমি জানি না। হাসলেন সতীশ রায়।
 
মুখোমুখি বসে মহাদেব সেন ইতস্তত করেও শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করলেন, কিছু মনে করবেন না, এর আগে যারা মেয়ে দেখতে এসেছে তাদের মতো কোনও প্রশ্ন করলেন না কেন? মানে, যাকে বলে যাচাই করে নেওয়া!

অর্থ হয় না। ওর মাথার চুল গোড়ালি ছুঁয়েছে কি কোমর পর্যন্ত নেমেছে তা জেনে আমার সংসারের কী লাভ হবে? ও তো স্কুলে পড়াতে যাচ্ছে না যে সাধারণ জ্ঞান কেমন সেইসব প্রশ্ন করে জানব মেধা কী রকম? একটা সুস্থ মেয়ে যার মানসিক বিকার নেই, দেখলে মন্দ লাগে না, ব্যবহার ভালল, এই তো যথেষ্ট। আজকাল বাড়িতে রাঁধুনি থাকায় রান্না কীরকম জানে এই প্রশ্নের দরকার পড়ে না। প্রয়োজন হলে বিয়ের পর রান্না শিখে নেবে। সতীশ রায় বললেন।

কিন্তু।

বলুন।

আপনি ওর কাছে গালাগালি শুনতে চাইলেন কেন?

ওটা আমার গোপন ব্যাপার।

কিন্তু গতবার ওর একটা কথা শুনেই পাত্রপক্ষ রেগেমেগে চলে যায়।

ভাগ্যিস গিয়েছিল নইলে আমি সুযোগ পেতাম না।

আমি কিন্তু এরকম কখনও শুনিনি। মেয়ে দেখতে এসে কেউ কি কখনও জানতে চেয়েছে পাত্রী কীরকম গালাগাল জানে? আচ্ছা, যদি ও না জানত?

তাহলে বলতাম না চা খাব।

তার মানে আপনার সংসারে যে পুত্রবধূ যাবে তার গালাগাল জানা জরুরি।

বলেছি তো ওটা আমার গোপন ব্যাপার।

প্রতিমা এল ট্রেতে মিষ্টি আর চা নিয়ে। সঙ্গে যিনি এলেন তাঁকে দেখে বোঝা যায় উনি মহাদেববাবুর স্ত্রী।

মাথা নাড়লেন সতীশ রায়, না মা মিষ্টি নয়, আমি চা খাব।

এখানকার মিষ্টি খুব ভালো। প্রৌঢ়া বললেন।

মহাদেব সেন বললেন, আমার স্ত্রী।

ওহো! নমস্কার। হ্যাঁ, আজ নয়, মিষ্টি খাব বিয়ের দিনে। ঘটকবাবু, তুমি আমার প্লেট সাবাড় করে দাও।

অসম্ভব, একসঙ্গে খেতে পারব না।

তাহলে পরে খাবেন। প্যাক করে দেব। প্রৌঢ়া বললেন।

সতীশ রায় হাসলেন, তুমি দেখছি পুজোরি বামুন হয়ে গেলে। চায়ের কাপপ্লেট তুলে নিলেন তিনি।

প্রৌঢ়া বললেন, আমার নাতনিকে পছন্দ হয়েছে শুনে মন ভরে গেল। আপনার বাড়িতে ও গেলে কোনও দুশ্চিন্তা থাকবে না।

চায়ে চুমুক দিয়ে সতীশ রায় জিজ্ঞাসা করলেন, কী করে বুঝলেন?

আপনার কথাবার্তা শুনে।

কিন্তু ওকে অনেক দায়িত্ব নিতে হবে। আমার স্ত্রী গত হয়েছেন পনেরো বছর আগে। অন্দরমহল কাজের মেয়েদের হাতে। ওর মাথার ওপর শাশুড়ি বা ননদ থাকছে না। ও হ্যাঁ, আমি তো মেয়ে দেখলাম, ভালো লাগল। কিন্তু আপনারা কবে আসছেন ডুডুয়াতে?

প্রতিমা বলে উঠল, দিদা মাকে নিয়ে ডুডুয়াতে গিয়েছিল।

তাই নাকি? প্রৌঢ়ার দিকে তাকালেন সতীশ রায়।

অনেক বছর আগে। প্রৌঢ়া বললেন।

মহাদেব সেন বললেন, তিরিশ বছর তো বটেই। আমার মামাতো ভাই এখানেই মানুষ হয়েছিল। সে চাকরি পায় পোস্টাল ডিপার্টমেন্টে। প্রথমেই পোস্টমাস্টার হয়ে ডুডুয়াতে পোস্টিং পায়। তার আবদারে উনি মেয়েকে নিয়ে দিন দশেক সেখানে থেকে সংসার গুছিয়ে আসেন। এখন সেই ছেলে প্রমোশন পেয়ে পেয়ে অনেক বড় পোস্টে চলে গেছে।

তিরিশ বছর আগে? কি নাম ওঁর?

শিবশংকর রায়।

মাথা নাড়লেন সতীশ রায়, খুব ঝাপসা মনে পড়ছে। বেশিদিন থাকেননি ডুডুয়াতে। আপনারা মাত্র দশদিন ছিলেন?

হ্যাঁ। তখন ওখানে খুব অসুবিধে হত। এখন শুনেছি শহরে যা পাওয়া যায় তা ওখানেও পাওয়া যাচ্ছে। প্রৌঢ়া বললেন।

দিদা, ওই ঘটনাটা বলো। প্রতিমা প্রৌঢ়াকে ইশারা করল।

কী ঘটনা? সতীশ রায় তাকালেন।

ও কিছু না। প্রৌঢ়া মাথা নাড়লেন।

মা তো খুব সুন্দরী ছিল তাই ওই দশদিন বাড়িতেই বসে থাকত দিদা মাকে নিয়ে। রাস্তায় বেরুলেই লোকে নাকি হাঁ করে তাকিয়ে থাকত। একটা সম্বন্ধও নাকি এসেছিল। প্রতিমা জানিয়ে দিল।

তাহলে আপনারা কবে যাচ্ছেন?

আপনি বলছেন যখন তখন নিশ্চয়ই যাব। ঘটকমশাই-এর মুখে যা শুনেছি তাতে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি। আপনাকে জানিয়ে দেব।
 
তাহলে উঠি। হ্যাঁ, তোমাকে ভালো লাগল, একেবারে খালি হাতে এসে ফিরে যাই কী করে! পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা গয়নার বাক্স বের করে সেটা খুললেন সতীশ রায়। তারপর একটা একভরি চেন তুলে বললেন, এটি আমার মায়ের ছিল। মা আমার স্ত্রীকে দিয়েছিলেন। তিনি নেই, তার হয়ে আমি তোমাকে দিলাম। এটিকে কখনও হারিয়ো না। বাক্সে চেন রেখে এগিয়ে ধরলেন সতীশ রায়।

প্রৌঢ়া বললেন, একি করছেন? এমন মূল্যবান জিনিস ওকে এখনই দিচ্ছেন কেন? বিয়ের পর দিলে ভালো হত।

কেন? আমার মন ওকে স্বীকার করে নিয়েছে সেটাই তো শেষ কথা। বিয়ে তো সমাজের স্বীকৃতির জন্যে। ওকে পরিয়ে দিন।

প্রৌঢ়া সোনার চেন পরিয়ে দিতেই প্রতিমা সতীশ রায়কে প্রণাম করল। তারপর দাদু দিদাকে প্রণাম সেরে ঘটকমশাই-এর দিকে এগোলে তিনি না না বলে সরে গেলেন।

সতীশ রায় বললেন, বিয়ের দিন আপনার সুবিধে মতো ঠিক করুন। যখন ছেলেকে দেখতে যাবেন তখন জানিয়ে দেবেন।

দরজার কাছে গিয়ে মহাদেব সেন বললেন, দাবিদাওয়ার ব্যাপারটা।

মিটে গেছে। যা চেয়েছিলাম তা পেয়ে গেছি। আচ্ছা নমস্কার। চল হে ঘটকবাবু। অনেকটা পথ যেতে হবে। সতীশ রায় গাড়ির দিকে এগোলেন।

পেছনে সতীশ রায় সামনে ড্রাইভারের পাশে ঘটকমশাই। গাড়ি ছাড়ার আগে সেই কাজের মেয়েটি দৌড়ে এসে একটা বড় বাক্স ঘটকবাবুর হাতে তুলে দিল। ঘটকবাবু লজ্জা লজ্জা মুখে সেটি ড্যাশবোর্ডের ওপর রেখে দিলেন।

গাড়ি চলতে শুরু করলে ঘটকমশাই বললেন, আপনি চমকে দিয়েছেন বড়বাবু।

কীরকম?

খালি হাতে না গিয়ে মিষ্টি নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলাম। আপনি যে পকেটে সোনার গয়না নিয়ে যাচ্ছেন তা ভাবতেই পারিনি। ঘটকমশাই বললেন, তখন বলেছিলেন পছন্দ হলে এখানকার দোকানে অর্ডার দিয়ে চাররকমের মিষ্টি ওবাড়িতে পাঠিয়ে দেবেন। ভাল মিষ্টির দোকানে।

না। আর দরকার নেই।

ও। আমার কথাটা মনে রাখবেন বড়বাবু।

কী কথাটা?

এই যে, আপনার মনের মতো পাত্রী জোগাড় করে দিলাম।

ও! নিশ্চয়ই।

পেট্রল পাম্পের মোড়ে ওরা দাঁড়িয়েছিল। সঙ্গে আর একজন লোক। তফাতে ছোটখাটো ভিড়। গাড়ি থামতেই ভিড়টা বলে উঠল, সত্যি বলেছে, এসেছে, এসেছে।

সতীশ রায় গাড়িতে বসেই জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে?

তৃতীয় লোকটি বলল, পঞ্চাশ টাকার খাবার খেয়েছে এরা। কুড়িটা টাকা দিয়ে বলেছে অপেক্ষা করতে, লোক এলে তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে শোধ করবে। আপনি কি সেই লোক?

তিরিশ টাকা পকেট থেকে বের করে লোকটির হাতে দিতেই মানিকজোড় দৌড়ে সামনের আসনে উঠে বসল। গোরক্ষ বলল, আজকাল মানুষ অবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে।

নাগেশ্বর বলল, ঠিক হল না, বিশ্বাস করতে কেউ শেখেইনি।

ঘটকমশাই বললেন, বড়বাবু আপনাদের কুড়িটাকার পুরি তরকারি খেতে বলেছিলেন, পঞ্চাশ খেতে গেলেন কেন যখন পকেটে টাকা নেই?

ওই তো দোষ। হিসেব করে খেতে পারি না। বড়বাবু এটা জানেন। নাগেশ্বর বলল।

গাড়ি চলছিল। গোরক্ষ বলল, আমার ডানচোখ নাচছে। তার মানে শুভ খবর। বড়বাবু, পাত্রী পছন্দ হয়েছে?

হুঁ। সতীশ রায় বললেন চোখ বন্ধ করে।

গোরক্ষ চেঁচাল, দারুণ খবর!

দারুণ! চেঁচাল নাগেশ্বর।

আঃ! সরে বসুন। চেঁচালেন ঘটকমশাই।

নাগেশ্বর জিজ্ঞাসা করল, দেখলেন?

কী? চোখ খুললেন সতীশ রায়।

ওই যে, যেটা চেয়েছিলেন। নাগেশ্বর বলল, নষ্টামির–।

ঝোঁক। গোরক্ষ জুড়ে দিল।

ঘটকমশাই বললেন, বড়বাবুর মনের মতো হয়েছে।

বাঃ। কী আনন্দ। এটা কী? ড্যাশবোর্ডের ওপর রাখা প্যাকেটের ওপর নজর পড়তেই সেটা তুলে নিয়ে খুলে ফেলল নাগেশ্বর। ঘটকমশাই বাধা। দেওয়ার সুযোগ পেলেন না। নাগেশ্বর বলল, গোরক্ষ! ভগবান আছেন। পঞ্চাশ টাকা খাওয়া হয়ে গিয়েছে, সন্দেশ খেতে পারিনি। ভগবান সন্দেশ পাঠিয়ে দিয়েছেন। নাও, শুরু করো।

*
 
ঘটকমশাই আজ রাত্রে ফিরে যাবেন না। সতীশ রায় পাত্রী পছন্দ করলে আজকের রাতটা এখানেই আনন্দ করে যাবেন। একথা আগেই ঠিক ছিল। হরিপদ তাঁকে যে ঘরে থাকতে দিয়েছিল সেই ঘরে হাতমুখ ধুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। মানিকজোড় গিয়েছে যে যার বাড়িতে। বলে গেছে, এই যাব আর এই আসব। ঘটক মশাই আজ একটা কথাও বলতে পারেননি। তাঁর চোখের সামনে অন্তত কুড়িখানা বড় বড় মিষ্টি ওরা পেটের ভেতর ফেলে দিল? ভেবেছিলেন, গিন্নির জন্যে নিয়ে যাবেন মিষ্টির প্যাকেটটা কিন্তু ওই হাঘরেদের জন্যে হল না।

ঘরের দরজায় একজন এসে দাঁড়াল। পুরোপুরি সামনে নয়, দরজার পাল্লার আড়ালে শরীর রেখে এলোকেশী জিজ্ঞাসা করল, চা এনে দেব?

চা? মাথা নাড়লেন ঘটকমশাই। না। সন্ধে পেরিয়ে গেছে, থাক। বরং পাখাটা কমিয়ে দিলে ভালো হয়।

অতএব এলোকেশী ঘরে ঢুকে পাখার রেগুলেটার ঘোরাল। ঘুরিয়ে চলে গেল। তাকে দেখলেন ঘটকমশাই। এরকম সুন্দর স্বাস্থ্যের উজ্জ্বল শ্যামা রমণী যে সতীশ রায়ের বাড়িতে আছে তা তার জানা ছিল না। সতীশ রায় বিপত্নীক। এই রমণী কি এবাড়ির কাজের লোক? বিশ্বাস হয় না। দিনহাটার হরিশ মণ্ডল চল্লিশ বছর বয়সে বিপত্নীক হওয়ার পর এই বয়সের পাত্রী খুঁজছে। বলেছে, বিধবা হলে ভালো হয়।

এই সময় হরিপদ ঢুকল, বড়বাবু ডাকছেন।

ওহো! উঠে দাঁড়ালেন ঘটকমশাই।

আচ্ছা ঘটকমশাই, বাড়ির সবাই জানতে চাইছে পাত্রী যখন পছন্দ হয়েছে। তখন তাকে দেখতে নিশ্চয়ই খুব সুন্দরী? হরিপদ জিজ্ঞাসা করল।

অবশ্যই।

মতির মা জানতে চাইছিল, স্বভাব খুব নরম তো?

মিত্রর রক্ষক শত্রুর যম। ও হ্যাঁ, একটি মহিলা চা খাব কিনা জানতে এই ঘরে এসেছিল, বড়বাবুর আত্মীয় কেউ?

না না। ও হল এলোকেশী। ওর বাবা ব্লক অফিসে কাজ করত। খুব ভালো রান্না করে। বিধবা বলে বাড়িতে বোঝা হয়ে ছিল। মতির মা বড়বাবুকে বলে এ-বাড়িতে চাকরি দিয়েছে। এর আগে কখনও এমন কাজ করেনি, ভদ্রলোকের মেয়ে।

*

ওরা এসে গিয়েছিল। গ্লাসে পানীয় ঢালা হয়েছে। সঙ্গে কাজু এবং চিনে বাদাম। নাগেশ্বর জিজ্ঞাসা করল, আজ এমন আনন্দের দিন, এদিনেও দুরকম বোতল টেবিলে থাকা কি ঠিক হবে বড়বাবু?

তাহলে তোমাদেরটা টেবিল থেকে নামিয়ে রাখ। হাঁটু সব সময় শরীরের নিচের দিকেই থাকে, ও-দুটোকে তো কাঁধে তুললে এক পা-ও হাঁটা যাবে না।

সতীশ রায় বললেন, ঘটকবাবু কোথায়? ঘুমাচ্ছে নাকি?

ঘটকমশাই ঘরে ঢুকলেন। তাকে দেখে সতীশ রায় বললেন, এসো হে, খাও, যত পারো। কিন্তু দেখো, বমি না হয়।

ঘটকমশাই লজ্জা পেলেন, নো না। ওদিন প্রথমবার ছিল তো-। তবে গলার স্বর জড়িয়ে গেলে খাওয়া বন্ধ করে দেব।

গোরক্ষ বলল, তাহলে শুরু হোক। চীয়ার্স।

সবাই চীয়ার্স বললে গোরক্ষ জিজ্ঞাসা করল, একটা কথা জানতে বড় ইচ্ছে হচ্ছে। আপনি ঘটকবাবুকে বলেছিলেন এমন মেয়ে চাই যার মধ্যে একটু নষ্টামির ঝোঁক আছে। ছেলের জন্যে এই প্রথমবার মেয়ে দেখতে গেলেন। গিয়েই পছন্দ করলেন। তার মানে ওর মধ্যে নষ্টামির ঝোঁক দেখেছেন আপনি। সেটা কী?
 
সতীশ রায় মাথা নাড়লেন, এসব তোমাদের না জানলেও চলবে। শুধু জেনে রেখো এ-মেয়ে সাধারণ নয়। সাদাসাপটা ভালো মেয়ে যারা তারা সেবা করতে পারে, স্নেহ ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতে পারে কিন্তু যাকে দিচ্ছে সে যদি নিতে না জানে তাহলে বেনো বনে মুক্তো ছড়ানো ছাড়া কিছু হবে না। বুনো ওলের জন্যে কী দরকার?

নাগেশ্বর বলল, বাঘা তেঁতুল।

হ্যাঁ। এ বাড়িতে যে বউ হয়ে আসবে সে যদি লবঙ্গ লতিকা কিংবা সাতচড়ে রা না কাড়া মেয়ে হয় তাহলে আমি চোখ বোজার পর এই ঘরে শেয়াল ডাকবে। তাই চেয়েছিলাম নষ্ট নয় কিন্তু সেদিকে একটু ঝোঁক আছে এমন মেয়েকে ঘরে আনব। ঘটকবাবুর দৌলতে আজ পেয়েও গেলাম। সতীশ রায় বললেন।

কিন্তু কীভাবে পেলেন? কী করে যাচাই করলেন? নাগেশ্বর অস্থির।

অ্যাই! চুপ করো। বড়বাবু সেটা জানাবেন না বলেছেন শুনিসনি? গোরক্ষ চাপা গলায় ধমক দিল।

হরিপদ এল, বড়বাবু।

তাকালেন সতীশ রায়। হরিপদ বলল, মাছের বড়া ভাজা হচ্ছে, এনে দেব?

মাছের বড়া? বাঃ। সতীশ রায় বললেন, মুখ বদলানো যাক। মতির মা তাহলে নতুন নতুন রান্না শিখছে। আনন।

আজ্ঞে মতির মা নয়, এলোকেশী। চলে গেল হরিপদ।

সঙ্গে সঙ্গে নাগেশ্বর বলে ফেলল, এই নামটা আগেও একদিন শুনেছিলাম। বড়বাবু, এলোকেশী কে?

একজন বিধবা। শ্বশুরবাড়িতে অত্যাচারিতা, আবার বাবা মা এখন মনে করে গলগ্রহ। রাঁধে ভালো বলে মতির মা কাজে নিয়েছে। সন্তানও নেই।

গোরক্ষ জিজ্ঞাসা করল, বয়স কেমন?

আমি জানতে চাইনি। সতীশ রায় বিরক্ত হলেন।

আমি দেখেছি একটু আগে। সাতাশ-আঠাশ হবে। বড়বাবু, একটা কথা বলছিলাম। যদি অনুমতি দেন।

আজ তুমি যা খুশি বলতে পারো।

দিনহাটায় আমার এক মক্কেল আছে। নাম হরিশ মণ্ডল। জমিজমা দু-দুটো মুদির দোকান, অবস্থা খুব ভালো। স্ত্রী গত হয়েছেন কয়েক বছর। বয়স চল্লিশ পার হলেও স্বাস্থ্য ভালো। বিয়ের ইচ্ছে হয়েছে আবার। শর্ত এক, পাত্রীকে বিধবা এবং নিঃসন্তান হতে হবে। এলোকেশীকে যেটুকু দেখলাম মণ্ডল মশাই।

ঘটকমশাইকে কথা থামিয়ে দিলেন সতীশ রায়, তুমি কি এরপর হরিপদ অথবা মতির মায়ের বিয়ের সম্বন্ধ করবে? এলোকেশী-বিয়ে করবে কি করবে না সেটা ঠিক করবে সে আর তার বাবা। আমাকে জিজ্ঞাসা করছ কেন?

গোরক্ষ বলল, হক কথা। আপনি মশাই যেখানে ঢোকেন সেখানেই পাত্রপাত্রী খোঁজেন নাকি? ভয়ঙ্কর লোক।

এইসময় তিনটি প্লেটে মাছের বড়া নিয়ে এল হরিপদ আলাদা করে। এক একটি প্লেটে দুটো করে।

সতীশ রায় জিজ্ঞাসা করলেন, একটা প্লেট কম কেন?

হরিপদ মুখ নিচু করল। বিরক্ত সতীশ রায় জিজ্ঞাসা করলেন, কী হল?

কথাটা এলোকেশীর কানে যাওয়ায় সে খুব রেগে গেছে। হরিপদ বলল।

কোন্ কথাটা?

আজ্ঞে, ঘটকমশাই কোন্ দোজবরের সঙ্গে সম্বন্ধ করতে চাইছেন–।

সে তো নিশ্চয়ই রান্নাঘরে বসে ভাজাভাজি করছে। শুনতে পেল কী করে?

আজ্ঞে, মতির মা দরজার কাছে এসেছিল। শুনে সে গিয়ে বলেছে।

হো হ করে হাসতে লাগলেন সতীশ রায়। তারপর বললেন, ঘটকবান, এবাড়িতে একজন শত্রু তৈরি করলে হে। তুমি চিনেবাদাম খাও।

অন্যায় হয়ে গেছে। আর ওকথা বলব না।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top