What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected তনু অতনু সংবাদ (2 Viewers)

গাড়ি চলছিল নির্জন পথ দিয়ে। হঠাৎ সাইকেলটা চোখে পড়ল। লোকটা সাইকেল রাস্তার একপাশে দাঁড় করিয়ে মাথার ওপর হাত নিয়ে যেতেই ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললেন সতীশ রায়। একেবারে লোকটার মুখোমুখি গাড়ির জানলাটা নিয়ে এল ড্রাইভার।

নমস্কার বড়বাবু। লোকটির নাম হরেকৃষ্ণ।

নমস্কার। তাহলে সাইকেল পেয়ে গেছেন? জিজ্ঞাসা করলেন সতীশ রায়।

হ্যাঁ। হাসি ফুটল হরেকৃষ্ণের মুখে, পেয়ে গেছি। আর ভয় নেই।

ঠিক বললেন না। ভয় আছে।

হ্যাঁ। যদি শুনি কোনও বেকার লোক অথবা অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেকে চোলাই বিক্রি করছেন তাহলে আপনার ভাটিখানা ভেঙে দেওয়া হবে।

ছি ছি ছি! অমন কাজ করব কেন?

না করলেই মঙ্গল। পাবলিক কাজটা করলে পুলিশ আসবে না আপনাকে সাহায্য করতে তা যতই লাইসেন্স পান। মনে রাখবেন কথাটা।

নিশ্চয়ই মনে রাখব। কিন্তু বড়বাবু, একটা কথা–কে বেকার কে বেকার নয়, কার আঠারো হয়েছে কার সতেরো তা বুঝব কী করে?

প্রথম কাউকে চাকরি দিন যে সবাইকে চেনে। চলো।

ড্রাইভার ইঞ্জিন চালু করল। মদ্যপান তিনি নিজেও করেন। কিন্তু কখনই শোভনসীমার বাইরে যান না। তাছাড়া নিজের বাড়ির বাইরে গিয়ে কখনই পান করেননি তিনি। ভাটিখানা যখন চালু করল হরেকৃষ্ণ তখন অনেকেই তার কাছে আপত্তি জানিয়েছিল। যদিও ভাটিখানাটা বসতির বাইরে, জঙ্গলের কোল ঘেঁষে কিন্তু অভাবী মানুষগুলো সেখানে ছুটে যাবেই। যারা যাবে তারা চোলাই খেয়ে নিজেকে সামলাতে পারবে না। তার প্রতিক্রিয়া ডুডুয়ার সংসারগুলোতে পড়বেই। এদিকে নিজে যতই বিলিতি দামি জিনিস খান, সেটা তো মদই, অন্যকে নিষেধ করেন কী করে? তাহলে পান করা ছেড়ে দিতে হয়। কিন্তু গোরক্ষ তাকে যুক্তি দিল, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের অধিকার আছে নিজের পছন্দমতো পানীয় খাওয়ার। সেটা খেয়ে সে যদি অন্যের অপকার না করে তাহলে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়।

হরেকৃষ্ণর বাড়ি মেখলিগঞ্জে। বাইরের লোক। তবু তাকে ডেকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন সতীশ রায়। তখনও সে হাতে লাইসেন্স পায়নি। এদিকের গ্রামগুলোতে বাড়িতেই তৈরি চোলাই প্রকাশ্যে বিক্রি হয়। হরেকৃষ্ণ কাগজপত্র দেখিয়েছিল। সে লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছে।

এই একটা বিষফোঁড়া। কিন্তু মেনে না নিয়ে কী করবেন।

পোস্ট-অফিসের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় চিৎকার শুনতে পেয়ে গাড়ি থামাতে বললেন। গোরক্ষ আর নাগেশ্বর ছুটতে ছুটতে আসছে। কাছে এসে নাগেশ্বর হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, টাইট করে দিয়েছি।

কী টাইট করলে? সতীশ রায় অবাক।

পোস্ট-অফিসের দুই কর্মচারীকে। আপনার নাম বলতেই একেবারে কেঁচো। এখন থেকে ঠিক সময়ে পোস্ট-অফিস খুলবে, বন্ধ করবে। খুলে চরতে বেরুবে না। তবে একটু সুখের কথা, পোস্টমাস্টারও আগামী পরশু ফিরে আসছে। নাগেশ্বর যেন বিশ্বজয় করে এসেছে এমন হাসি হাসল।

সতীশ রায় বুঝলেন। এদের ধরে আনতে বললে বেঁবে আনে। পোস্ট অফিসের কর্মচারীদের ওপর নিশ্চয়ই রোলার চালিয়ে এসেছে।

ঠিক আছে। চলি।

আজ্ঞে বড়বাবু, কোথায়, মানে, কোন্ দিকে যাচ্ছেন? গোরক্ষ জিজ্ঞাসা করল।

সদরে।

উঃ কতকাল সদরে যাইনি। নাগেশ্বর বলল।

কোর্টের চত্বরে ভাতের হোটেলে পাবদার ঝাল যা করে না। গোরক্ষ মাথা নাড়ল।

দ্যাখো, আমি কাজে যাচ্ছি। তোমরা গিয়ে কী করবে?

কিছু না। চুপচাপ গাড়িতে বসে থাকব। দিনের বেলায় তো আপনার সঙ্গ পাই না! কথায় বলে সাধুসঙ্গে স্বর্গবাস। বলেই দূরে দাঁড়ানো এক কিশোরকে ডেকে নাগেশ্বর বলল, আই রতন, আমাদের দুজনের বাড়িতে গিয়ে খবর দিবি, আমরা বড়বাবুর সঙ্গে সদরে যাচ্ছি।

ছেলেটি ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলতেই ওরা দরজা খুলে ড্রাইভারের পাশে উঠে। বসল। ড্রাইভার বিরক্ত হয়ে বলল, সরে বসুন।

সরেই তো আছি বাবা। বেশি সরলে তো বাইরে বেড়িয়ে যাব। বেশ নরম গলায় বলল গোরক্ষ।

এই দুজন দিব্যি আছে। জমিতে দুটো চাষ লোক দিয়ে করায়। তাতেই সম্বৎসরের খাওয়া পরা চলে যায়। এতেই যথেষ্ট। তবে দু-জনের দুই ছেলে কুচবিহারের বাসে কন্ডাক্টরি করে। কাঁচা পয়সা, কিছু পাঠায় তাদের বাড়িতে।
 
গাড়ি চলছিল ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে। শুনশান রাস্তা। দুপাশে চাষের মাঠ। সতীশ রায় ভেবে নিলেন। প্রথমে ডিসি অফিসে যেতে হবে। সেখান থেকে কোঅপারেটিভ অফিসে। তারপর অবনীদার খোঁজ নিতে হবে।

ধূপগুড়ি পেরিয়ে গেল। সতীশ রায় দেখলেন মানিকজোড় চুপচাপ ঢুলছে। জলঢাকা নদী আসতেই ওরা সোজা হল। নাগেশ্বর ঝুঁকে নদী দেখল, দ্যাখ মাছ। ধরছে। কী মাছ?

পুঁটি? গোরক্ষ জবাব দিল গম্ভীর মুখে।

কী করে বোঝা গেল?

গিয়ে দেখলেই হয়।

এদের কখনই মিল হয় না অথচ দুজন দুজনাকে ছেড়ে চলবে না। সতীশ রায় হাসলেন। নাগেশ্বর বলল, বাবা, কষা মাংস।

গোরক্ষ বলল, উঁহু। মাটন তরকা, জবাব নেই।

নাগেশর পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখল সতীশ রায় চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। নিঃশব্দে হাত ঘুরিয়ে সে গোরক্ষকে জানিয়ে দিল, কোনও লাভ হবে না। গোরক্ষ বলল, তবে স্ট্যান্ডার্ড খুব পড়ে গেছে। আগের মতো নেই।

*

ডিসি অফিসের কাজ শেষ করতে দুটো বেজে গেল। গাড়ির কাছে এসে সতীশ রায় দেখলেন মানিকজোড় ধারে কাছে নেই। ড্রাইভার বলল, ওঁরা। কোর্টের দিকে গেছেন।

এখনও এই এলাকাকে লোকে কোর্ট বলে কারণ বহু বছর এখানেই সদরের আদালতগুলো ছিল। এখন আদালত চলে গিয়েছে নবাববাড়িতে কিন্তু নামটা জড়িয়ে আছে এলাকার সঙ্গে।

গাড়ি নিয়ে কোর্টের চত্বরে ঢুকতেই ওদের দেখতে পেলেন তিনি। একটা গাছের তলায় বেঞ্চিতে বসে আছে বিমর্ষ মুখে। গাড়ি দেখে চলে এল কাছে, হয়ে গেছে?

হ্যাঁ। তোমরা পাবদার ঝাল খেয়েছ?

নাঃ। খদ্দের হয় না বলে দোকান উঠে গেছে।

তাহলে গাড়িতে উঠে বসো।

সেখান থেকে কো-অপারেটিভের অফিসে। গাড়ি থেকে নামার সময় সতীশ রায় বললেন, গোরক্ষ, তুমি আমার সঙ্গে এসো।

আমি? নাগেশ্বর তাকাল।

তুমি গাড়িতেই অপেক্ষা করো।

অফিসে ঢোকার আগে সতীশ রায় বললেন, এখানে কখনও আসিনি। এরা আমাকে চেনে না। তুমি একটু পরিচয়টা দিয়ো।

অবশ্যই।

অফিসে ঢুকে একজন করণিককে সতীশ রায় বললেন, বড়সাহেব আছেন?

কেন? কী দরকার। আমাকে বলুন। লোকটি সোজা হয়ে বসল।

গোরক্ষ বলল, আপনাকে আমি বলতে পারি, কিন্তু উনি পারেন না।

কেন? উনি কে?

ডুডুয়া বলে একটা জায়গার নাম শুনেছেন?

ডুডুয়া? হ্যাঁ।

সেই জায়গাটা ওঁর কথায় চলে। আপনার কথায় কতজন চলে?

লোকটা সতীশ রায়ের দিকে তাকাল। সতীশ রায় নির্বিকার।

দাঁড়ান; দেখছি।

দু মিনিটের মধ্যে লোকটা ফিরে এল, আসুন।

পরদা ঠেলে ভেতরে ঢুকল লোকটা, পেছনে ওঁরা।

টেকো মাথার অফিসার বললেন, ডুডুয়ার কি যেন বলছিলে–।

আমার নাম সতীশ রায়। লোকে বলে ডুডুয়ার সতীশ রায়।

অ। বলুন, বসুন।

আমার ওখানে তরুণ সংঘ নামে একটা ফুটবল ক্লাব আছে। তার ছেলেরা একটা কো-অপারেটিভ খুলতে চায়। আমার উকিলবাবু যা যা করার সব করবেন। কিন্তু আমি এসেছি উদ্বোধনের দিন আপনি বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত যেন থাকেন সেই অনুরোধ নিয়ে। সতীশ রায় বেশ বিনয়ের সঙ্গে বললেন, বলে বসলেন।

কবে উদ্বোধন? ক্যালেন্ডার দেখলেন ভদ্রলোক।

যেদিন আপনি কাগজপত্র দেবেন।

অ্যাঁ। অ্যাপ্লাই করেছেন?

না। কালই করব।

আপনি অ্যাপ্লাই করেই উদ্বোধনের কথা ভাবছেন?

নাহলে তো আপনার তারিখ পাওয়া যাবে না।

কী মুশকিল। অ্যাপ্লাই করলেই যে অনুমতি পেয়ে যাবেন তা কী করে ভাবছেন? আর এর জন্যে সময় লাগে! খিঁচিয়ে উঠলেন অফিসার।
 
আগে থেকে উদ্বোধনের দিন ঠিক করে নিলে সুবিধে এই যে কোন তারিখের মধ্যে অনুমতি দিতে হবে সেটা আপনার জানা থাকবে। তা ধরুন, সামনের মাসের পনেরো তারিখ। ডি.এম. সাহেব ওই দিনটাই ঠিক করেছেন।

ডি.এম.?

উনিই তোত প্রধান অতিথি হয়ে যাবেন। সত্যি বলতে কি ওঁর সাজেসশনেই। আমরা আপনাকে বিশেষ অতিথি হিসেবে স্বাগত জানাতে এসেছি।

ডি.এম, আমার কথা বলেছেন? সোজা হয়ে বসলেন অফিসার, তাহলে, ঠিক আছে, পনেরো তারিখ রবিবার। আপনারা বারো তারিখ অনুমতি পেয়ে যাবেন। কালই সব কাগজপত্র পাঠিয়ে দিন। আমার হাতে দিয়ে যেতে বলবেন।

অফিসার একটা কাগজে লিখলেন, ডুডুয়ার সতীশ রায়।

আপনি মাছ খান?

হে হে হে। বাঙালির তো ওটাই প্রিয় খাবার।

ডুডুয়া নদীতে দেড়কেজি রুই ঘাই মারছে। ডি.এম. সাহেব দুটো নেবেন। আপনি কটা? সতীশ রায় উঠে দাঁড়ালেন।

একটা। দুজন তো লোক, ডি.এম. দুটো নিলে একটার বেশি নেওয়া ভালো দেখায় না। বুঝলেন না। অফিসার ভালোমানুষের মতো মুখ করে বললেন।

*

গাড়িতে বসে সতীশ রায় বুঝলেন নাগেশ্বর নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কাল তোমার স্ত্রীর মঙ্গলচণ্ডীর উপোস ছিল। আজ কী?

আজ? তিনরকমের তরকারি আর হাঁসের ডিমের ঝোল গলা অবধি খেয়ে এখন নাক ডাকছেন। নাগেশ্বর করুণ গলায় বলল।

আহা! একথা আগে বলবে তো! আমি ভাবলাম আজও তার উপোস।

হুঁঃ। নাকে শব্দ করল নাগেশ্বর।

আজ তোমার মেয়েকে অনেককাল বাদে দেখলাম। সতীশ রায় বললেন, একটু ব্যায়াম করা দরকার ওর।

ব্যায়াম? কোনও লাভ হবে না বড়বাবু। হাতির পেট থেকে যে বের হয় তাকে হাজার ব্যায়াম করিয়ে কেউ হরিণ করতে পারবে না, হাতিই হবে।

গোরক্ষ চুপচাপ শুনছিল, এবার জোরে শ্বাস ফেলল।

তোমার কি হল?

তার উপোস করার অভ্যেস নেই। ভালোই খান। সব হাড়ে ঢুকে যায়। সরু সরু হাড়। জোরে বাতাস বইলে ঘরের বাইরে বের হন না।

সেকি? কেন?

পড়ে যাবেন। ছেলের আবদার ছিল, মা তুমি সালোয়ার কামিজ পরো। শহরে বুড়িরাও পড়ছে। আমি এনে দেব। শুনে আমি বললাম, বাবা, তুমি তো চলে যাবে আর আমি সারাক্ষণ দেখব একটা হ্যাঁঙারে ওই সালোয়ার কামিজ ঝুলছে। সেটা কি ভালো লাগবে। গোরক্ষ বলল।

– অবনীদাকে বাড়িতেই পাওয়া গেল। খবরের কাগজ পড়ছেন। দেখামাত্র বললেন, আরে সতীশবাবু যে! ডুড়ুয়া ছেড়ে আমার এখানে?

সতীশ রায় বললেন, কেমন আছেন দাদা?

ষাট কমপ্লিট করলাম তবে এখনও টাউন ক্লাব মাঠটা চারবার দৌড়াই। যেদিন পারব না সেদিন মারা যাব। অবনীদা হাসলেন।

একটা অনুরোধ নিয়ে এসেছি। সতীশ রায় বললেন।

আপনার মতো লোক আমাকে অনুরোধ করছেন, কী ব্যাপার?

ডুডুয়াতে তরুণ সংঘ নামে একটা ক্লাব করেছে ছেলেরা। ফুটবল খেলে। বানারহাট বীরপাড়াতে গিয়ে ম্যাচ খেলে। কখনও হারে কখনও জেতে। কিন্তু শেখাবার কেউ নেই। নিজেরাই যা পারে তাই খেলে। আমার ইচ্ছে আপনি যদি ওদের একটু খেলাটা শেখান। সতীশ রায় বললেন।

ওদের বয়স কত?

আঠারো থেকে চব্বিশ।

কোনও লাভ নেই। দড়কচা মেরে গেছে। এখন শেখালে কোনও লাভ হবে না। আমি যা বলব তা ওরা করতে পারবে না। শেখার বয়স আট থেকে চোদ্দ। দেখুন যে অক্ষর চেনে না সে বুড়ো বয়সে অক্ষর চিনতে পারে কিন্তু চিনে লেখক হতে পারে না। অবনীদা বললেন।

কয়েক সেকেন্ড ভাবলেন সতীশ রায়, বেশ। ওই বয়সের ছেলেরাও আছে। আপনি তাদের শেখান।

কিন্তু এখান থেকে বোজ ডুডুয়াতে যাব কী করে?

শুক্রবার যাবেন। শনি রবি থেকে সোমবার ফিরে আসবেন। অথবা। সপ্তাহে চারদিন। ওখান থেকে একটা বাস সাড়ে সাতটায় আসে।

কথা দিচ্ছি না। একবার ওদের দেখি–।

আর একটা অনুরোধ। যাতায়াতের ভাড়া বাদ দিয়ে আপনার সম্মান দক্ষিণা কত দিতে হবে?
 
হো হো করে হাসলেন অবনীদা। তারপর বললেন, গত পঁচিশ বছর ধরে শহরে কোচিং করছি। কত ছেলে আমার কাছে খেলা শিখে কলকাতার ফার্স্ট ডিভিসনে ফুটবল খেলছে। দুজন তো ইন্ডিয়া টিমে খেলে এসেছে। কেউ আমাকে একটা টাকা দিয়েছে না আমি কারও কাছে চাইতে পেরেছি। হ্যাঁ, আমার খেলা দেখে রায়মশাই চাকরি দিয়েছিলেন। তাতেই খুশি আমি। যাব, যাব। এই ধরুন সামনের শনিবারে। বেলা দুটোয় পৌঁছাবো।

না অবনীদা! পারিশ্রমিক না নিলে আপনাকে দরকার নেই।

অবনীদা সতীশ রায়ের দিকে তাকালেন, আমাকে পেশাদার কোচ হতে বলছেন? তাহলে অন্য লোকের কাছে যান।

নমস্কার জানিয়ে বেরিয়ে এলেন সতীশ রায়। একটা মানুষ এখান থেকে অতদূরে যাবে, খাটবে কিন্তু পয়সা নেবে না, এটা ঠিক কথা নয়। যতই ফুটবল পাগল মানুষ হন, পেশাদার না হলে দায়িত্ব বাড়ে না। তাছাড়া ওঁকে টাকা দিলে তাদের মনে হবে না কারও দয়ার ওপর আছেন।

গাড়িতে উঠে কিছুক্ষণ গুম হয়ে রইলেন সতীশ রায়। ড্রাইভারের পাশে বসে মানিকজোড় ঢুলছে। তিস্তা ব্রিজ পেরিয়ে গাড়ি ময়নাগুড়ি বাইপাসের কাছে আসাতে ড্রাইভারকে থামতে বললেন তিনি।

গাড়ি থামতেই ঘুম ভাঙল ওদের। সতীশ রায় বললেন, এবার নামো। তুমি কষা মাংস রুটি কিংবা ভাত আর তুমি মাটন তরকা রুটি খেয়ে এসো। ওই যে তোমাদের ধাবা।

লোক দুটো নিঃশব্দে নেমে এগিয়ে গেল ধাবার দিকে। ড্রাইভারের হাতে টাকা দিয়ে সতীশ বললেন, তুমি কিছু খেয়ে নাও। আর ওঁদের খাবারের দাম মিটিয়ে দিয়ে। চোখ বন্ধ করলেন তিনি।

*

ডুডুয়া সতীশ রায়ের কাঠের কল কিছুদিন আগে পর্যন্ত প্রায় চব্বিশ ঘণ্টাই আওয়াজ করত। ইলেকট্রিক সার আগে জেনারেটার মেশিন চলত। তখন নিলামে গাছ কাটার অধিকার পেয়ে কাঠের ব্যবসায়ীরা ট্রাকে চাপিয়ে বড় বড় গাছ এনে ফেলতেন সমিলের সামনে। যে যেমন চায় তেমন সাইজের তক্তা। বানিয়ে দেওয়া হত গাছ কেটে। অনেকে আবার সেইসব গাছ সরাসরি বিক্রি করে দিতেন সতীশ রায়ের কাছে। সেগুলো সতীশ রায়ের কাছ থেকে তক্তা। হিসেবে কিনে নিয়ে যেত কন্ট্রাক্টররা।

কয়েক বছর হল সরকার জঙ্গলে কাঠ কাটার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। যে গাছগুলো নষ্ট হয়ে গেছে বা ঝড়ে পড়ে গেছে অথবা সরকারি প্রয়োজনে যে গাছ কাটা দরকার সেগুলোকে নিলামে তোলা হয়। ফলে অনেক কাঠের ব্যবসায়ী হাত গুটিয়ে বসে আছেন। সতীশ রায়ের কাঠের কলে আট দশ ঘণ্টার বেশি শব্দ হয় না। তবে প্রায়ই প্রস্তাব আসে, বেআইনি ভাবে কাটা গাছকে তত্তায় রূপান্তরিত করে দিতে। তার জন্য দ্বিগুণ টাকা দিতেও তারা রাজি। কিন্তু সতীশ রায় রাজি নন। তার কড়া নির্দেশ আছে কর্মচারীদের কাছে, সরকারি কাগজ ছাড়া কেউ যেন ওই ধরনের গাছের গুঁড়ি কারখানাতে না ঢোকাতে পারে। আর এই কথাটা জেলার কর্তারা জানেন। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট বা পুলিশ মাঝে মাঝে অন্য কারখানাগুলোতে হানা দিলেও সতীশ রায়ের এখানে আসেন না।
 
আজ সকাল থেকেই কারখানার ম্যানেজারের সঙ্গে হিসেব নিয়ে বসেছিলেন সতীশ রায়। সারা মাসের আয়-ব্যয়ের অঙ্ক কষে সতীশ রায় ম্যানেজারের দিকে তাকালেন। লোকটি সৎ। প্রায় ত্রিশ বছর ধরে কাজ করছেন।

সতীশ রায় বললেন, গতমাসে যা রোজগার করেছেন তাতে আপনাদের মাইনে, ইলেকট্রিকের বিল মিটিয়েই শেষ হয়ে যাচ্ছে। কী করা যায়?

ম্যানেজার বললেন, গত চারমাসে একই অবস্থা গিয়েছে। আরও মাস দুয়েক দেখে কারখানা বন্ধ করে দিন।

কারখানা বন্ধ করলে বারোটা লোক যাবে কোথায়? খাবে কী?

কিন্তু বড়বাবু, সরকার যদি পলিসি না বদলায় তাহলে ঘর থেকে টাকা বের করে কারখানা চালাতে হবে। সেটা অন্যায়। ম্যানেজার বললেন।

আপনি তো অদ্ভুত লোক। নিজের সর্বাশি নিজেই চাইছেন?

কেউ কি তা চায় বড়বাবু! কিন্তু আমি তো আশার আলো দেখতে পাচ্ছি, না। সরকার যদি জঙ্গলে কাঠ কাটতে না দেয় তাহলে কাঠ চেরাই-এর কলগুলো বাঁচবে কী করে? ম্যানেজার বিমর্ষমুখে বললেন।

আচ্ছা, আরও কয়েকমাস দেখুন। সামনের মাস থেকে সত্য এসে বসবে

এখানে। কাজ না থাকলে এখানেই তার সুবিধে, কবিতা লিখতে পারবে। উঠে দাঁড়ালেন সতীশ রায়।

ম্যানেজার বললেন, ঠিক বুঝলাম না।

আমারও একই অবস্থা। সতীশ রায় ঘড়ি দেখলেন। বেলা হয়েছে।

ম্যানেজারবাবু একটু ইতস্তত করে বললেন, বড়বাবু, একটা কথা বলব?

সতীশ রায় তাকালেন।

শুনতে পাচ্ছি কিছু খাস জমি সরকার বিক্রি করবেন।

আমিও শুনেছি। ওগুলো উঁচু নিচু জমি। জল দাঁড়ায় না। চাষ হবে না। বিক্রি করতে চাইলে খদ্দের পাবে কোথায়?

আপনি যদি কিনে নেন?

তার চেয়ে পকেটের টাকা ডুডুয়ায় ফেলে দিতে বলুন। কম পরিশ্রম।

আমার কথা একটু শুনুন। যদি তিন চার একর জমি পাওয়া যায় তাহলে একটা চাষ হতে পারে। আমরা ওখানে চা-গাছ লাগাতে পারি।

হাঁ হয়ে গেলেন সতীশ রায়, চা গাছ?

হ্যাঁ বড়বাবু। এদিকের চা বাগানগুলোতে লেবার ট্রাবল লেগেই আছে। তার ওপরে ঠিকঠাক যত্ন না নেওয়ায় চায়ের পাতার মানও কমে গেছে। আমরা যদি যত্ন করে চা গাছ তৈরি করি তাহলে দেখতে হবে না। ম্যানেজার বলল।

গাছ লাগালেন, পাতাও হল। তা সেগুলো থেকে চা তৈরি করতে কত টাকার কারখানা বানাতে হয় তা জানেন? সতীশ রায় এবার বিরক্ত হলেন।

আমরা কারখানা করব কেন? যাদের কারখানা আছে তারা আমাদের কাছ থেকে পাতা কিনবে। ম্যানেজার বোঝাল।

কেন কিনবে? তাদের নিজেদের বাগানেই তো পাতা হচ্ছে।

যে পাতা হয় তাতে তো সারাবছর মেশিন চলে না। কয়েকশ লোকের মাইনে, সার, অন্য সব খরচ মিটিয়ে পাতার যা দাম পড়ে তার চেয়ে সস্তায় যদি .. আমাদের কাছ থেকে পায় তাহলে নেবে না কেন? মানেজার উৎসাহের সঙ্গে বললেন।
 
একটু ভাবলেন সতীশ রায়। তারপর বললেন, দেখি, ভেবে দেখি। চা-গাছ তো একদিনে বড় হয় না। তিনবছরে কত ইনভেস্টমেন্ট সেটাই আগে হিসেব করে দেখতে হবে। তাছাড়া এ ব্যাপারে সরকারের অনুমতি নেওয়া দরকার কিনা তাও জানতে হবে। দেখি।

কিন্তু বাড়ির পথে আসার সময় সতীশ রায়ের মনে হল এই ম্যানেজার লোকটা কাঠচেরাই করে শেষ হয়ে যায়নি। এই যে খাস জমিতে চা-বাগান তৈরি করার কথা ভাবা, এর মধ্যেও একটা স্বপ্ন দেখার চেষ্টা আছে। যারা স্বপ্ন দেখতে চায় তারা সহজে মরে না। তার সত্যচরণ কবিতা লেখে, কবিরা কি স্বপ্ন দ্যাখে না?

*

আজ দুপুরের খাওয়া বেশ জমিয়ে খেলেন সতীশ রায়। প্রতিটি রামাই সুস্বাদু। খেয়েদেয়ে ঘরে এসে পান আর সিগারেট নিয়ে ডাকলেন, মতির মা। কেউ ওকে ডেকে দাও। সেদিন একটু কড়া গলায় ধমক দিয়েছিলেন, দেওয়ায় কাজ হয়েছে।

মতির মা এসে দাঁড়াল দরজায়, ঘোমটা মাথায়।

হঠাৎ তোমার রান্নার হাত খুলে গেল কী করে? এ বাড়িতে তো অনেক বছর আছ এরকম রান্না কখনওরাঁধেনি। সতীশ রায় বললেন, ভালো, বেশ ভালো।

আমি তো রাঁধিনি। মতির মা নিচু গলায় বলল।

ও। কে বেঁধেছে?

আপনি বলেছিলেন রান্নার জন্যে কাউকে আনতে–?

হ্যাঁ, এ কে?

গুরুচরণ হালদারের মেয়ে। বিয়ে হয়েছিল। এখন বিধবা হয়ে বাপের বাড়িতে ফিরে এসেছে। বাপের অবস্থা খারাপ।

কে গুরুচরণ হালদার মনে করতে পারলেন না সতীশ রায়। জিজ্ঞাসা করলেন, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, তো?

ওকে ডাকব? ·

ডাকো।

সিগারেট খাচ্ছিলেন তিনি। এসময় তার চোখ স্ত্রীর ছবির দিকে যাবেই। আজও গেল। মৃত মানুষের ছবির চোখ কি মাঝে মাঝে বদলে যায়? চোখ সরাতেই শুনতে পেলেন, ডেকেছেন?

মুখ ঘুরিয়ে মেয়েটিকে দেখালেন। বছর তিরিশের, বেশ লম্বা চেহারা।

তুমি রান্না করেছ?

হ্যাঁ। খারাপ হয়নি তো?

না। কি নাম?

এলোকেশী।

তোমাদের কোন্ বাড়ি?

ব্লক অফিসের কোয়ার্টার। বাবা দুবছর হল বদলি হয়ে এসেছেন।

তাই বলো। পুরোনো লোক হলে চিনতে পারতাম। তা তুমি এ বাড়িতে এসে রান্না করছ, তোমার বাবা আপত্তি করেননি?

না। বিধবা মেয়ে বাচ্চা সমেত অভাবের সংসারে এলে কোন বাবাই খুশি হয় না। এতে স্বস্তি পেয়েছে। বলেছে, কোনও কাজই ছোট না।

কথাটা ঠিক। মাইনে ঠিক হয়েছে?

কার সঙ্গে কথা বলে ঠিক হবে?

কেন? মতির মা কিছু বলেনি?

বলতে এসেছিল। আমি শুনিনি।

কেন?

মাইনে ঠিক করবে মালিক। ও কি আমার মালিক?

থতমত খেয়ে গেলেন সতীশ রায়। তার মুখের ওপর এরকম কথা আজ পর্যন্ত কোন কর্মচারী বলেনি। অবশ্য এই মেয়েটিকে ওই অর্থে কর্মচারী বলা যায় না।

সতীশ রায় বললেন, তুমি কত টাকা চাও?

আমি কিছু চাই না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে একটা কাজের মধ্যে আছি তাতেই আমার শান্তি। আপনার বিবেচনায় যা হয় দেবেন।

এসো।

যাচ্ছি। একটা কথা বলব?

সতীশ রায় তাকালেন।

খোকা নাকি ঝাল খেতে ভালবাসে না। কিন্তু আমার রান্না চেটেপুটে খেয়েছে। সেই থেকে মতির মায়ের মুখ গোমড়া হয়ে আছে। আমি কি খোকার জন্যে রাঁধব না?

মতির মা যা বলে তাই করবে।

আপনি মাংস খান না শুনলাম।

হ্যাঁ।

আমি একদিন রাঁধি, একটু চেখে দেখুন।

হেসে ফেললেন সতীশ রায়, দেখা যাবে।

যাকগে। এখানে এসে শুনেছিলাম আপনি নাকি ভীষণ রাগী। কেউ মুখ তুলে আপনার সঙ্গে কথা বলে না। ভুলটা ভাঙল। এলোকেশী চলে গেল।

কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন সতীশ রায়। এ মেয়ে কথা বলে না খই ফোঁটায়। বিধবা, এক বাচ্চার মা বলে মনেই হয় না। নাঃ। একে আর বাড়তে দেওয়া ঠিক হবে না। মাইনে যখন নেবে তখন কর্মচারীর মতো ওকে থাকতে হবে এই বাড়িতে।

*
 
আজ বিকেল থেকে আকাশে মেঘ। দুপুরের পরে আলিপুর দুয়ারের জেলেপাড়ায় গিয়েছিলেন সতীশ রায়। সেখান গিয়ে জেনেছেন জালে মাছ ধরতে হলে কী কী উপকরণ লাগে। জাল দুরকমের। হাত জাল আর টানা জাল। হাত জাল নদীতে ছুঁড়ে ফেলতে একটু কসরত লাগে। মাছও বেশি পাওয়া যায় না। টানাজাল ঘণ্টা তিনেক ফেললে ভালো মাছ ওঠে। তবে তার জন্য অন্তত দুটো ছোট নৌকো দরকার। দুজন খুব দক্ষ মাছ ধরিয়েকে ভাড়া করেছেন সতীশ রায়। তারা এসে ছেলেদের দুদিন ধরে মাছ ধরা শেখাবে। আসবে আগামীকাল।

বানারহাটের সঙ্গে খেলে তিন এক গোলে হেরে ছেলেগুলো মনমরা হয়ে ছিল। এই খবরে উৎসাহিত হল। ট্রেনার দুজন থাকবে ক্লাব ঘরে। তাদের খাওয়া দাওয়া বিভিন্ন বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া হবে।

আজ ঘরেই আসর বসেছিল। মেঘ আছে বলে দিনের আলো বেশ আগেই ফুরিয়েছিল। ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে।

নাগেশ্বর বলল, বড়বাবু। একটা কথা বলব?

সতীশ রায় ওদের উলটোদিকে ইজিচেয়ারে বসেছিলেন। চুরুটের ধোঁয়া ছাড়লেন, কথা বললেন না।

নাগেশ্বর বলল, পাঁচ বছর ধরে এক ব্র্যান্ড খাচ্ছি, অরুচি ধরেছে।

ওই দামের মধ্যে অন্য কি পছন্দ, কিনতে পারো।

দশ বিশ টাকা বেশি দিলে—।

অভ্যেস খারাপ কোরো না নাগেশ্বর। সতীশ রায় বললেন।

হক কথা। গোরক্ষ বলল, খারাপ অভ্যেস মানেই সর্বনাশ।

হরিপদ এল, ঘটকবাবু এসেছেন।

এই অসময়ে! সাড়ে সাতটা বাজতে না বাজতেই তো ছুটবে। ডাকো তাকে। সতীশ রায় বললেন। হরিপদ চলে গেল।

নাগেশ্বর বলল, লোকটা খুব লোভী।

কী করে বোঝা হল? গোরক্ষ বলল।

বড়বাবু মুখের ওপর নাকচ করে দিলেন তবু আশা ছাড়েনি।

ঘটকমশাই ঘরে এলেন, ও, আজ আপনারা এখানেই।

বসে পড়। সতীশ রায় বললেন।

ঘটকমশাই বসলেন। মানিকজোড়ের দিকে তাকিয়ে হাসলেন।

কী মনে করে?

বড়বাবু, সুখবর আছে। ঘটকমশাই মাথা নাড়লেন।

কীরকম কী রকম?

মনে হচ্ছে আপনি যেরকম চেয়েছিলেন সেরকম পাত্রীর সন্ধান পেয়েছি। একেবারে একশতে একশ বলছি না, আমি তো চোখে দেখিনি।

কানে শুনেছ? সতীশ রায় জিজ্ঞাসা করলেন।

আজ্ঞে হ্যাঁ।

বৃত্তান্ত বল।

আজ একটা দরকারে মালবাজারে গিয়েছিলাম। বেলা এগারোটা নাগাদ পেট্রোল পাম্পের পাশে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি এমন সময় ওঁরা এলেন। ঘটকমশাই গল্প বলছেন।

কারা? সতীশ রায় জিজ্ঞাসা করলেন।

দেখেই বুঝলাম বাইরের লোক। বাস ধরবে ফিরে যাবে বলে। কাছে। এসেই তাঁরা নিবন্ধ শুরু করলেন। কথাবার্তায় বুঝলাম মেয়ে দেখতে এসেছিলেন। হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। ওঁদের দলে ঘটক ছিল। সে বেচারা খুব বকুনি খাচ্ছিল। সুযোগ বুঝে লোকটাকে একটু আলাদা ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম, কি ব্যাপার? লোকটা বলল, মুখ পুড়িয়ে দিল মেয়েটা। ও মেয়ের বিয়ে হবে না।

কার মেয়ে?

মহাদেব সেনের নাতনি। আমার পার্টি না হাতছাড়া হয়ে যায়। বলেই লোকটা দলে মিলে গেল। ঘটকমশাই থামলেন।

আচ্ছা বেকুব ত! অন্য পার্টি যে মেয়েকে ছি ছি ছি করছে তার খবর এনেছেন এখানে? ডুডুয়া কি আবর্জনা ফেলার জায়গা? গোরক্ষ জিজ্ঞাসা করল।
 
আহা, পুরোটা শুনুন আগে। ঘটকমশাই বললেন, একে ওকে জিজ্ঞাসা করলাম কে মহাদেব সেন? খবর মিলল। বাজারের কাছে বড় স্টেশনারি দোকান আছে। নিকামের রাস্তায় বেশ বড় বাগানওয়ালা বাড়ি। গেলাম দোকানে। বুঝলাম খুব ভালো বিক্রি। একজন কর্মচারী তখন সবে বাড়ি থেকে দোকানে ঢুকেছে। মুখ গম্ভীর। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, মহাদেববাবু কোথায়? লোকটা বলল, বাড়িতে। তবে আজ যাবেন না। খুব মন খারাপ।

কেন? কী হয়েছে?

পাত্রপক্ষ এসেছিল নাতনিকে দেখতে। পছন্দও করেছিল। কিন্তু নাতনি। শেষে এমন একটা প্রশ্ন করল যে তারা বিগড়ে গিয়ে বেরিয়ে গেছে বাড়ি থেকে।

নাতনি মানে? ছেলের মেয়ে?

না। কোনও ছেলে নেই। একমাত্র মেয়ে বিধবা। তার মেয়ে। হঠাৎ লোকটার খেয়াল হল, আপনার কি দরকার?

আমি একজন ঘটক। ভালো পাত্র আছে সন্ধানে।

অন্য জায়গায় দেখুন। এখানে লাভ হবে না।

কেন? দেখতে খারাপ?

দূর! বেশ সুন্দর দেখতে। ডানা কাটা পরী নয় কিন্তু সুন্দর। তবে মুখ খুললে চোখ কপালে উঠবে। মা-দিদারা মেরেধরেও শেখাতে পারছে না।

কীরকম?

এই তো, আজ। পাত্রপক্ষ অনেক প্রশ্ন করেছিল। সব কটার উত্তর ঠিকঠাক দিয়েছে। শেষে বলে কিনা আমি একটা প্রশ্ন করতে পারি? পাত্রের বাবা বললেন, নিশ্চয়ই। বল। মেয়ে বলল, আপনার ছেলে এত ম্যাদামারা কেন? বোবা হয়ে বসে আছে।

হো হো করে হেসে উঠলেন সতীশ রায়। হাসি থামতেই চাইছিল না তার। তাকে হাসতে দেখে নাগেশ্বর আর গোরক্ষ হাসতে লাগল। শেষপর্যন্ত উরে ব্বাবা বলে হাসি থামালেন সতীশ রায়।

ঘটকমশাই বললেন, মেয়ের কথা শুনে এক সেকেন্ডও দাঁড়াননি পাত্রপক্ষ। হন হন করে বেরিয়ে গেছেন বাড়ি থেকে। ওঁদেরই আমি দেখেছিলাম বাসস্ট্যান্ডে। একবার ভাবলাম সেনবাড়ি থেকে ঘুরে আসি। তারপর ঠিক করলাম আপনার মতামতটা নেওয়া দরকার। তাই চলে এলাম।

হরিপদ। হাঁকলেন সতীশ রায়।

হরিপদ অবাক হয়ে হাসি শুনছিল। ছুটে এল ভেতরে।

ঘটকবাবুকে আমার থেকে এক পাত্র দে। সতীশ রায় দরাজ হলেন।

আপনার থেকে? নাগেশ্বর বিমর্ষ হল।

আমার থেকে দিলে তোমাদের কম পড়বে না।

কিন্তু বড়বাবু, আমি যে পান করি না। ঘটকমশাই কুঁকড়ে গেলেন।

এরকম পাত্রী তোমার অভিজ্ঞতায় কটা আছে?

একটাও না।

তাহলে ব্যতিক্রমও হয়। তুমি পান করলেও তাই হবে। নাও, গ্লাস তোল। বলো, চিয়ার্স! উঃ কি শব্দ। ম্যাদামারা!

ঘটকমশাই বাধ্য হয়ে গ্লাসে চুমুক দিলেন। দিয়ে মুখ বিকৃত করলেন।

গোরক্ষ জিজ্ঞাসা করল, বড়বাবু। ম্যাদামারা মানে কি?

খুব ভালো কথা। নইলে বড়বাবু খুশি হবেন কেন? নাগেশ্বর বলল।

সতীশ রায় গ্লাস শেষ করলেন, কবে যাব?

ঘটকমশায় বুঝতে পারলেন না, কোথায়?

তোমার সঙ্গে আমি তীর্থ করতে যাব নাকি? মালবাজারের মহাদেব সেনের নাতনিকে দেখতে কবে যাব? সতীশ রায় আবার জিজ্ঞাসা করলেন।

আপনি-আপনি যাবেন? ঢক করে অনেকটা খেয়ে ফেললেন ঘটকমশাই।

আমার মন বলছিল, ঠিক বলছিল?

আরে এই মেয়েকে দেখব না তো কাকে দেখব? সতীশ রায় বললেন, যে মেয়ে মুখের ওপর বলতে পারে ম্যাদামারা, সে ফালতু না।

ছবি এনেছেন? দেখি? নাগেশ্বর হাত বাড়াল।

আমি তো সেনমশাই-এর বাড়িতে যাইনি। ছবি কি করে পাব?

গিয়ে যদি দেখি মেয়ে ট্যারা তাহলে? নাগেশ্বর বলল।

না না। কর্মচারী বলেছে সে সুন্দরী।

গোরক্ষ বলল, কেউ নিজেদের জিনিস খারাপ বলে? কানা পটল বিক্রি করার সময় বলে রাজার পটল।

উহুঁ। যে মেয়ে ট্যারা অন্য কোনও খুঁত আছে সে কখনও এমন কথা পাত্রপক্ষকে বলবে না। সে চাইবে যেন তেন প্রকারে সিঁদুর পরতে! আমি হলফ করে বলতে পারি এই মেয়ে শুধু সুশ্রী নয়, সুন্দরীও। ঘটকবাবু, তুমি ওঁদের সঙ্গে কথা বলে দিন ঠিক করো। আমি এই মেয়েকে দেখতে যাব। সতীশ রায় ঘোষণা করলেন।
 
ঘটকমশাই-এর এত আনন্দ হল যে তিনি চোখ বন্ধ করে হাসতে লাগলেন।

গোরক্ষ বলল, আপনার শেষ বাস চলে গেল।

অ্যাঁ। চমকে উঠলেন, কটা বাজে।

সাড়ে সাতটা।

কী হবে? কী করে ফিরব এখন?

সতীশ রায় বললেন, ফিরতে হবে না। হরিপদ।

হরিপদ এল। সতীশ রায় বললেন, ঘটকবাবুকে আর এক পাত্র দে। এমন সুখবর নিয়ে এসেছেন আজ, আনন্দ করা যাক।

কিন্তু বড়বাবু, আমার স্ত্রী!

ফোন আছে বাড়িতে? আশেপাশে?

আজ্ঞে আছে। পাশের বাড়িতেই আছে।

নাম্বার বলুন।

নাম্বার! উঃ। নাম্বার মনে পড়ছে না! গুলিয়ে যাচ্ছে। ঘটকমশাই মাথায় হাত দিলেন।

যাক। আপনার কোন চিন্তা নেই। এখানেই দুটি খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়বেন? আরে মশাই রাস্তায় তো পড়ে যাননি।

অগত্যা দ্বিতীয় গ্লাস নিলেন ঘটকমশাই। প্রথমটি শেষ করার পর তার মনে বেশ ফুর্তি এল। গোরক্ষ জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, আপনার তো অনেক অভিজ্ঞতা?

তা আপনাদের বাপ-মায়ের আশীর্বাদে প্রায় চল্লিশ বছরের।

সবচেয়ে যেটা সেরা সেটা শোনান। গোরক্ষ বলল।

শুনবেন! গ্লাসে চুমুক দিলেন ঘটক মশাই। এখন আর মুখ বিকৃত করছেন না তিনি। বললেন, বছর দশেক আগের কথা। ছেলের বয়স বাইশ। সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছে। বাপের বয়স ছেচল্লিশ। বিপত্নীক। ছেলের জন্যে মেয়ে দেখতে বলেছিলেন আমাকে। দেখলাম। রামসাই-এর জমিদারবাবুর মেয়ে। বছর উনিশ বয়স। রূপের দেমাক আছে। তা থাক। বাপ গেলেন পাত্রী দেখতে। পছন্দ হয়ে গেল। দেনাপাওনার কথাও চুকে গেল। কিন্তু ছেলে বসল বেঁকে। সে বিয়ে করবে না। অনেক অনুরোধ, চোখরাঙানি বৃথা গেল। সে নাকি আরও পড়াশুনা করবে। বাপ বেশি চাপ দিতে পালিয়ে গেল কলকাতায় মাসির বাড়িতে। কর্তা ফঁপরে পড়লেন। বিয়ের কাজ অনেক এগিয়ে গেছে। কেনাকাটাও হয়ে গেছে। আমায় বললেন, খবরটা রামসাই গিয়ে দিয়ে আসতে। কাঁপতে কাঁপতে গেলাম। গিয়ে দেখলাম ম্যারাপ বাঁধা হচ্ছে। কিছু আত্মীয়স্বজন বাইরে থেকে এসে গিয়েছে। মেয়ের বাপ চুপচাপ শুনলেন। বললেন, কী করা যাবে। তবে বিয়ে হবে। ওই দিন ওই লগ্নেই হবে। হাতে অন্য পাত্র আছে। একটাই অনুরোধ পাত্রের বাবাকে বলবেন আমি নিমন্ত্রণ করছি, উনি যেন বিনা সংকোচে আমার মেয়ের বিয়েতে আসেন। তাহলে আমার রাগ থাকবে না।

বাঃ। খুব বড় মন তো। গোরক্ষ বলল।

কথাটা বললাম। পাত্রের বাবা বললেন, আমার কি যাওয়া ঠিক হবে! ছেলেটা মুখ পুড়িয়ে চলে গেছে, এই মুখ দেখাব?

বললাম, অত করে বলেছেন, গেলে যদি খুশি হন, যাওয়াই ভালো।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top