What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected বাসভূমি -সমরেশ মজুমদার 🌎 (2 Viewers)

গাছের জলে শরীর ভিজিয়ে পাতিবাবুর কাছে এসে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল ব্যাপারটা। বুকু সর্দারের মেয়েটা সাতসকালে শেড়টির পাতায় নিজের খোঁপা সাজাচ্ছে। নিরি নাম মেয়েছেলেটার। বিনাগুড়িতে বিয়ে হয়েছিল কিন্তু স্বামীর ঘর করে না। হুটহাট চলে আসতে আসতে শেষপর্যন্ত আর গেলই না। এখন নাকি ওই লাইনের ছোঁড়াগুলোর মাথা চিবোয়। বুকু সর্দারের কথায় ওকে কাজে নিয়েছে মাংরা অথচ ওরই জন্যে পাতিবাবুর কাছে বেইজ্জত। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে নিরির টুকরিটা মাটি থেকে তুলে ধরল সে। কয়েকটা কচি পাতা রয়েছে ওখানে। অথচ এতক্ষণে অন্তত চার ইঞ্চি ভরে যাওয়ার কথা। একটা চাপা গুজব শুনত মাংরা দলের দুটো জোয়ান ছেলে নাকি ওর ঝুড়ি ভরে দিতে সাহায্য করে। ধরা যায়নি বলে কিছু বলার নেই। গাইবাছুরে ভাব থাকলে কে আটকাবে? পাতিবাবু ওকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে গেলেন সামনে। যেন আর কিছু করার নেই। মাংরা যখন এসে পড়েছে যা করবার সেই করবে। তার ওপর কর্তৃপক্ষের এই আস্থা বা বিশ্বাস মাঝে মাঝে মাথা গরম করে দেয় মাংরার। তখন নিজেকে খুব ক্ষমতাবান বলে মনে হয়। কয়েক পা এগিয়ে খপ করে চুলের মুঠি ধরল সে নিরির। চিৎকার করে উঠল মেয়েটা। গলার ক্যানক্যানানিতে কানের দফা রফা হবার জোগাড়। হাতের চাপে খোঁপায় গোঁজা পাতা আর ফুল দুমড়ে গেছে। আগের দিন হলে এতক্ষণে সপাং সপাং লাঠি চালাত শরীরে। কিন্তু এখন সেটা অসম্ভব। গায়ে হাত দিলেই কাম বন্ধ হয়ে যাবে। কুলিদের য়ুনিয়ন হয়েছে। অন্যায় করলে শাস্তি দাও কিন্তু সেটা যেন বে-আইনি না হয়। তাই লাঠি হাতে নিয়ে ঘুরলেও ওটা কোনো কাজে লাগে না। এরকম অবস্থায় বাপের আমলে সাহেবরা পিঠের চামড়া ছাড়িয়ে নিত। ওদের অল্পবয়সে সারা শরীরে কালসিটে পড়ে যেত। আর এখন সব কুলি সাহেব হয়ে গেছে– গায়ে হাত তোলা যাবে না! আরে মারধর করলেই তো ভাল কাজ হবে। মুখে যতই তুমি গালাগাল দাও সেকথা কানে কখনও ঢোকে? আর এইসব বদমাস চিড়িয়াদের। নিজের মাথাকে একটা ঝটকায় ছিনিয়ে নিয়ে নিরি ফুঁসে উঠল, কেনে গায়ে হাত দিচ্ছিস। বুড়া মরা লজ্জা করে না।

এটা তোর রঙ করার জায়গায়? পাঁচটা পাতাও টুকরিতে পড়েনি আর তুই এখানে সাজগোজ করছিস! কোম্পানি মুখ দেখে পয়সা দেবে? চোখ পাকাল মাংরা।

যা শালা দালাল কোথাকার। আমি কাম করি আর সাজ করি তোর কী? তোর পাতি ঠিক পেলেই তো হোল। খবরদার বলছি, এই শেষবার, এরপর গায়ে হাত তুললে তোর নোকরি আমি খতম করব।

আমার নোকরি তুই খতম করবি? হাঁ হয়ে গেল মাংরা। বলে কি মেয়েটা। এই সেদিন জন্মাতে দেখল, বুকু সর্দারের অনুরোধে একে কাজ দিল নিজের দলে আর ওই এখন তাকে শাসাচ্ছে। ইচ্ছে হল বেধড়ক প্যাদায় কিন্তু সেটা উচিত হবে না এটা বুঝেছে। অনেক কষ্টে আজকাল নিজেকে সামলাতে হয়। আগের দিন হলে মেয়েটা বেয়াদপির জন্য এতক্ষণে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকত! দাঁত বের করে হাসবার চেষ্টা করল মাংরা, আরে শালি, তুই বাগানকা মালিক নাকি?

জরুর। শরীর দোলালো নিরি। সাহেবকে বলব তুই আমার ইজ্জত নিয়েছিস, ব্যস। একটা হাত শূন্যে তুলে চাকু চালাবার ভঙ্গি করে পাছা দুলিয়ে টুকরি তুলে ফিরে গেল মেয়েটা। একদম জমে গেল মাংরা। বলে কি রে মেয়েটা! মাথা গরম হয়ে গেল ওর। এর একটা বিহিত করতেই হবে। দুদ্দাড় চায়ের গাছ সরিয়ে দৌড়তে লাগল মাংরা। পাতিবাবুকে খুঁজে বের করে সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। মাথায় শোলার টুপি, হাফ প্যান্ট আর হাতে ছাতি নিয়ে পাতিবাবু তখন সাইকেলের প্যাডেলে পা রাখছিলেন, প্লাকিং চলছে কতগুলো ব্লকে একসঙ্গে। পাতিবাবুকে সবটাই ঘুরে ঘুরে দেখতে হয়। রোদ জল ঝড়–এই ঘোরা থেকে নিষ্কৃতি নেই। বুড়ো সর্দারকে ছুটে আসতে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে?

মাংরা ঘটনাটা এক টানে বলল। মেয়েটাকে অবিলম্বে ছাড়িয়ে দেওয়া দরকার। নইলে কখন কার নামে এমন মিথ্যে রটিয়ে দেবে যে বেইজ্জত হতে হবে। কথাটা শুনে পাতিবাবুর মুখ গম্ভীর হল। বড্ড বাড় বেড়েছে আজকাল ছোঁড়া ছুঁড়িদের। এক-একসময় এমন করে তাকায় অথবা কথা বলে যেন ওরা মালিকের বাবা। পাতিবাবু বললেন, সাহেব আধ ঘণ্টার মধ্যেই আসবে। তখন তোকে ডাকব, সব খুলে বলবি।
 
পাতিবাবু অন্য ব্লকে চলে যাওয়া মাত্র হঠাৎ বৃষ্টি জোরে নামল। একদম মুষলধারে না নামলে প্লাকিং থামে না। মাংরা দৌড়ে একটা শেডট্রির গা ঘেষে দাঁড়াল। বুকু সর্দারের সঙ্গে কথা না বলেই সাহেবকে রিপোর্ট করা ঠিক হবে? বুকু বলবে, মাংরা তুই একি করলি, এতদিনের বন্ধু লোক। কিন্তু মেয়েটার হাবভাব বুকে জ্বলুনি ছড়ায়। ওর ছেনালি দেখে এই বুড়ো বয়সেই শরীর নাচে তো ছোঁড়াগুলো দিশেহারা হবেই। কিন্তু মেয়েছেলে যদি পুরুষের নামে বদনাম দেয় তো সবাই সেটা বিশ্বাস করার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। আগের দিন হলে এসবে কেউ ভাবত? শরীর নিয়েছে? বেশ প্রমাণ কর। নেই প্রমাণ? কেউ দ্যাখেনি? তো চুকে গেল। কিংবা বড় জোর হাঁড়িয়া পিয়াও সবাইকে। মেয়েটার যদি স্বামী থাকে তো অবশ্য ঝামেলা হত। মারপিট থেকে জান নেওয়া সবই সম্ভব ছিল। কিন্তু এখন অন্য ব্যবস্থা। য়ুনিয়ন হয়েছে। ছোঁড়াগুলো সেই নেশায় বড় বড় কথা বলে। পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করে। সব চেয়ে মুশকিল হল সাহেবরাও ওদের ঘাঁটাতে সাহস করে না। বাগানে কোনো গোলমাল হলে য়ুনিয়নবাবুদের সঙ্গে দুএকটা মদেসিয়া ছোকরা সাহেবের বাংলোয় ফয়সালা করতে গিয়ে নাকি একসঙ্গে বসে বিলিতি খায়। ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারে না। মদেসিয়া গিয়ে সাহেবের সঙ্গে এক চেয়ারে বসে মদ খাবে? বাপের জন্মে শুনেছে কেউ? তা দিনগুলো এত জলদি পালটে যাচ্ছে। সেই সাহেবরাও আজ নেই সেই শাসনও গেছে। আগে সাদা চামড়া ছাড়া সাহেব হতো? এখন কালেভদ্রে ওরকম সাদা দেখা যায়। সব কালো চামড়ার মানুষ এখন সাহেব বনে এসেছে। আসল সাহেবি গুণ এদের থাকবে কী করে। নেড়ি কুত্তাকে বাংলোয় বাঁধলে কি অ্যালসেশিয়ানের মত আওয়াজ করবে? ফলে সব মাথায় উঠেছে। কাজ করতে চায় না কেউ। কেমন ফাঁকি দিয়ে পয়সা হাতিয়ে নেবার ধান্দায় থাকে। আর এসব যদি কারো সহ্য না হয় যদি কেউ মনে করে বাগানটা তাকে অন্ন দিচ্ছে অতএব ফাঁকি দেওয়া উচিত নয় তাহলে এরা এখন তাকে দালাল বলে মস্করা করে।

বাপের মত অন্ধ নয় মাংরা। বাপ বলে এ জায়গাটা আমাদের নয়। এখানে কাজে এসেছি, পয়সা পাচ্ছি তাই মন দিয়ে কাজ করব। সে পয়সা দিচ্ছে সে দেবতা, তার কথা অমান্য করার কথা করার স্বপ্নেও ভাবব না।

মাংরা কিন্তু এরকম ভাবে না। এ জায়গাটা বাঙালিদের। মদেসিয়ারা এখানে এসেছিল, থেকে গেছে এইমাত্র। এখন যদি আবার টেবুয়াতে ফিরে যায় তাহলে ওখানে কী করে মানাবে? যেখান থেকে খাবার অভাবে একদিন চলে আসতে হয়েছিল সেখানে ফিরে গেলে খাবেই বা কী! তাই ফেরার প্রশ্ন ওঠে না। বাপের কাছ থেকে সেই মাতৃভূমির জন্যে একটা মমতা পেয়েছে সে এইমাত্র। কিন্তু এই চা বাগানটা আমাদের রুটি দেয়। একে যত্ন করা, সেবা করা আমাদের কর্তব্য। পয়সা পাচ্ছি তাই কাজে ফাঁকি দেব না। সাহেবের মুখের ওপর কথা বলা ঠিক নয়। হয়তো অনেক অন্যায় আদেশ হয়–ওভারটাইম বলে খাটিয়ে পয়সা না দিয়ে তিনটে খাসি লাইনে পাঠিয়ে দেয়, কিন্তু এসব নিয়ে ঝামেলা পাকালে আখেরে নিজেরই ক্ষতি। কারণ মানুষ একবার উদ্ধত হলে আর থামতে জানে না। আবার সাহেবরা এখন যে ভাবে প্রশ্রয় দেয় তাতে যদি শাসন করার প্রয়োজন হবে যখন, তখন হাত শক্ত হবে না আর।

নিরিকে নিয়ে ঠিক কি করা উচিত বুঝতে পারছিল না মাংরা। এই হয়েছে তার অবস্থা, কোনো ব্যাপারে চটজলদি মন স্থির করতে পারে না। বুড়ো শুকরা যেমন পুরনো ধারণা নিয়ে গোঁ ধরে থাকে সেটা সে সব সময় মানতে পারে না। আবার ছেলে সিরিল যখন সব ব্যাপারে ডোন্টকেয়ার ভাব করে তখন তার ভয় লাগে। এরকম ঔদ্ধত্য সে কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারে না। ফলে নিজেকে কেমন অসহায় বলে মনে হয় আজকাল। অথচ সে সর্দার। যুবক বয়সে কেউ সর্দার হলে তাকে সে স্বপ্নের নায়ক হিসেবে দেখত। সর্দারদের কি প্রতিপত্তি তখন। একজন লেবার সাহেবের কাছে কেন বাবুদের সামনে গিয়ে কথা বলবে এমন বুকের পাটা কারো ছিল? তাকে যা বলার সর্দারকে জানাতে হতো। সর্দার সেটা বাবুদের মাধ্যমে সাহেবের কাছে পৌঁছে দিত। আর এখন? নিজেকে এক এক সময় ওই শেডট্রির সঙ্গে তুলনা করে সে। রোদ আটকায় না জল আড়াল হয় না তবু চা গাছগুলোর মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে শেডট্রি নাম দিয়ে। ওর সঙ্গী অন্য সর্দাররা বলে এসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ কী! যে কদিন চাকরি আছে কাজ করে যাও চুপচাপ। তারপর ছুটি হয়ে গেলে মরে যাও। সেটা যতক্ষণ না হচ্ছে ততক্ষণ অন্ধ হয়ে থাক আর রাতভর শরাব পিও ব্যস।

.
 
সারাটা দিন মেজাজ খিঁচড়ে থাকল মাংরার! মাঝে মাঝে বাগানের হালচাল দেখে তার মরে যেতে ইচ্ছে করে। নইলে পাতিবাবু যখন তাকে ডেকে পাঠালেন সকালে তখন এমন হয়? সাহেব জিপ চা বাগানের গা ঘেঁষে দাঁড় করিয়ে এক হাতে পাইপ ধরিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কুছ গোলমাল হুয়া?

মাংরা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলেছিল। যদিও তখনও সে দোনামনা করছিল বুকুর সঙ্গে কথা না বলে নালিশটা করবে কিনা। পাতিবাবু তখন উস্কে দিলেন, সাহেব এসেছে, তুই সব খুলে বল সাহেবকে।

মাংরা তখন আর কী করবে! ঘটনাটা যেমন হয়েছিল তেমনি বলে গেল। ওর মনে একটু ভয় ছিল। আগে হলে ওই নিরিটাকে সাহেবের হুকুমে বাংলোয় যেতে হতো এই নালিশ শুনলে। সাতদিন পর যখন মেয়েটা ছাড়া পেত তখন তাকে দেখে চেনা কষ্টকর হত। কখানা হাড় ছাড়া সাহেব তার সব শুষে নিয়েছে। এর পর কোনো মেয়ে আর বেআদবির কথা চিন্তা করবে না। আর এখন কি হল? ঘটনা শুনে সাহেবের গলা থেকে এমন আওয়াজ বের হল সামনের গাছ থেকে একদল টিয়া চমকে উঠে টা টা করে উড়ে গেল। প্রায় দুলে দুলে হাসিতে ফেটে পড়লেন সাহেব। তারপর কোনো রকমে নিজেকে সামলে বললেন, হাউ ফানি। ভেরি ইন্টরেস্টিং। নো নো বুড্ডা; আমাদের চাই কাজ। দিনের শেষে প্রোডাকশন ঠিক থাকলে কিছু বলার নেই। পাতি মেয়েটা তুলুক বা অন্য কেউ ওকে হেল্প করুক তা নিয়ে আমাদের চিন্তা করার কী আছে। ওর ব্যাপারে নাক গলাচ্ছ কেন? একটু সাজগোজ না করলে ছেলেরা উৎসাহ পাবে কেন? আমার মনে হচ্ছে এরকম মেয়ে যদি আরো বেশি থাকে তো প্রোডাকশন বেড়ে যেতে পারে, কী বলেন আপনি?

পাতিবাবু ঘাড় নাড়লেন, ইয়েস স্যার। ইউ আর রাইট স্যার। ইউ আর রাইট স্যার। তবে কিনা স্যার বাপের বয়সী লোকটাকে অমন কথা বলল।

কী কথা? ও বাপের বয়সী হলেও তো সর্দার মানুষ। সাহেব চোখ ছোট করে হাসলেন।

মাংরা বলল, সাব আমি ওর বাবার বন্ধু, বুড়ো হয়ে গেছি।

সাহেব বললে, সেটাই তো তোমার সুবিধে। ও যদি অভিযোগ করে তাহলে আমরা কেউ বিশ্বাস করব না। তুমি বুড়ো, অক্ষম। হো হো করে হেসে উঠলেন সাহেব নিজের রসিকতায়, আই মাস্ট সি হার। কোথায় সে?

পাতিবাবু সঙ্গে সঙ্গে একজনকে ডেকে নিরির খোঁজে পাঠাল। মাংরার বিমর্ষ মুখের দিকে তাকিয়ে সাহেব বললেন, দিন পালটে যাচ্ছে সর্দার। ভাল কথা বলে গায়ে হাতে হাত বুলিয়ে কাজ আদায় করো। এ বাগান নাকি সব চেয়ে পিসফুল ছিল। শুনছি এবার নাকি স্ট্রাইক হতে পারে। তাহলে?

এইসময় নিরি এল। ওর সাহেবের কাছে আসার কারণ অন্যান্য লেবাররা জেনে গেছে এর মধ্যে। তারা সবাই চা-গাছগুলোর সামনে হাত গুটিয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে। নিরি আসছে বুক ফুলিয়ে, হাঁটার ভঙ্গিতে থোড়াই পরোয়া করি ভাব। ওকে তো বটেই, পাতিবাবুকে পর্যন্ত উপেক্ষা করে সে সাহেবের সামনে গিয়ে দাঁড়াল, আমাকে ডেকেছেন সাব? সাহেব তখন ওর পা থেকে মাথা পর্যন্ত জরিপ করছিলেন। চোখ তুলে মাংরা সাহেবের চোখে কৌতুক দেখেছিল। সাহেব বললেন, নাম কী তোমার?

নিরি।

মরদের নাম কী?

ওকে আমি ছেড়ে দিয়েছি।

বিয়ে ভেঙে গেছে?

আমি ওকে ছেড়েই দিয়েছি।

এখানে কার কাছে আছ?

এখন বাপের কাছে। কদিন পর নতুন ঘরে যাব।

অ। সাহেব থতমত হয়ে গেলেন। চা বাগানে এসেছেন অল্পদিন। কিন্তু এরকম অভিজ্ঞতা ওঁর হয়নি কখনও। এমন স্মার্ট কথাবার্তা শোনে নি বোঝা যাচ্ছিল।

ওকে এসব কথা বলেছ কেন? মাংরাকে দেখালেন সাহেব।

আমি সাজি কি না সাজি তাকে ওর কী। পাতিবাবু চেঁচালো আর ও ছুটে এসে মাথায় হাত দিল। মাথায় হাত দেবার ও কে? ওর ছেলে সাহস পায় না তো ও! আমি পাতি তুলি কি না সেটাই আসল কথা। ঠিক কিনা?

সাহেব ঘাড় নাড়লেন, কিন্তু ও তো তোমার বাবার বন্ধু।

হাসল নিরি, ছোঃ, কত বাপের বন্ধু দেখলাম! তাছাড়া ওর ছেলেই আমাকে বলেছে কেউ ফালতু ঝামেলা করলে প্রতিবাদ করতে!

কথাটা শুনে মাংরা হকচকিয়ে গেল। সিরিল এই কথা মেয়েটাকে বলেছে? কখন সে এর সঙ্গে কথাবার্তা বলে? কেউ তো তাকে কিছু বলেনি। ছেলে বড্ড বেআদব, আজকাল লিডার হয়েছে তরুণদের। য়ুনিয়ন বাবুরাও ওকে খাতির করে বলে শুনেছে। কিন্তু এই মেয়েটার সঙ্গে কীসের সম্পর্ক! এই স্বামী তাড়ানো বদ মেয়েছেলেটার খপ্পরে পড়ল নাকি?

সাহেবও একটু অবাক হয়েছিলেন কথা শুনে, ওর ছেলে তোমাকে কী বলেছে? সাহেব একই সঙ্গে মাংরাকে দেখলেন।

দিনকাল পাল্টে গেছে, কেউ অন্যায় করলে ছেড়ে দেবে না।

তুমি ওর ছেলের কথা শোনো কেন?

ইস্! হঠাৎ মেয়েটার চেহারা পাল্টে গেল, সেকথা আপনাকে আমি বলব কেন? এটা আমার ব্যাপার।

মেয়েটার কণ্ঠস্বর এমন নিচে ছিল না যা কাছে-পিঠের লেবারা শুনতে পাবে না। তাই ওর কথা শেষ হতেই একটা হাসির হররা উঠল। সাহেব একটু গম্ভীর হবার চেষ্টা করে বললেন, তাহলে তো তুমি আরো অন্যায় করেছ ওকে ওই কথা বলে। যাকে তুমি মানো তার বাবাকে বদনাম দিতে লজ্জা করা উচিত।




মেয়েটা একটুও লজ্জিত হল না, কাজের জায়গায় সবাই এক। যে আমার মাথায় হাত দেয় তাকে আমি ছাড়ব কেন? আর আমি বলছি যদি আবার করে তবে নালিশ করব। আমি এখনি বদনাম দিইনি তো।

মাথায় হাত দিয়ে সে অন্যায় করেছে। কিন্তু হাজার হোক বুড়ো মানুষ, তোমার এসব কথা বলা উচিত হয়নি। সাহেব পাতিবাবুর দিকে ফিরে দাঁড়ালেন। যেন এই প্রসঙ্গে নিয়ে আর কথা বাড়াতে চান না তিনি।

নিরি এবার মাংরাকে দেখল। রাগে ঘেন্নায় এবং লজ্জায় কাঁপছিল মাংরা। এটা বিচার হল? আর মেয়েটা যে কথা শোনাল তার পরে এখানে দাঁড়িয়ে থাকা যায়? ইচ্ছে হচ্ছে এখনই ছুটে গিয়ে বউকে বেধড়ক মারে। গুদামে কাজ করছে বউ, ছেলেও সেখানে। বউএর প্রশ্রয়েই ছেলেটা এমন সাপের পাঁচ পা দেখেছে। মাংরা চোখ তুলে দেখল সাহেব পাতিবাবুকে নিয়ে অন্যদিকে হেঁটে যাচ্ছে। লেবারদের হাত আবার চালু হয়েছে। হঠাৎ নিরি ওর কাছে এগিয়ে এল। তারপর ওর হাত ধরে বলল, আমার মাথায় হাত দিয়েছিল বলে আমি স্বামীর ঘর করিনি। মাথায় হাত দিলে আমার শরীরে আগুন জ্বলে। বলেছি তাই বলে সাহেবের কাছে এসে চুকলি কাটার কী আছে! হাতটা ঝটকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করে বিফল হল মাংরা! চা-গাছের মধ্যে হাঁটতে আরম্ভ করলেও মেয়েটা সঙ্গ নিল, আজকাল যে এসব করে সবাই তাকে কী বলে জানো?

কী? অন্যমনস্ক হয়ে বলল মাংরা।

মেয়েটার শরীর থেকে কেমন যেন ভদ্রলোক ভদ্রলোক মার্কা গন্ধ বের হচ্ছে, মদেসিয়াদের মতন নয়।

দালাল! বলেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠল নিরি।

আর সেই সময় ব্লকের শেষপ্রান্তে কানফাটানো চিৎকার উঠল। সবাই উত্তেজিত হয়ে জায়গাটা থেকে সরে আসছে। নিরির কথাটা কানে নিয়েও স্থির হতে পারল না মাংরা। প্রাণপণে দৌড়ে জায়গাটায় পৌঁছে গেল। গিয়ে শুনল একটা চা-গাছের গুঁড়িতে পাক দিয়ে পড়ে রয়েছে বিরাট সাপ। পাতি তুলতে তুলতে প্রায় তার গায়ে পড়ে গিয়েছিল একজন। এখন সাপটা গাছ ছেড়ে বেরিয়ে আসছে। এই ঘন চা বাগানে মাটি ঘেঁষে এসে যদি ওটা কাউকে আক্রমণ করে তাহলে আত্মরক্ষার কোনো উপায় থাকবে না। চিৎকার শুনে সাহেবও ছুটে এলেন। বোঝা গেল সাপটা ছোটখাটো নয়। বর্ণনায় বুঝে গেল মাংরা এটা নির্ঘাৎ রাজসাপ। অজগর না পাইথন কি যেন বলে সাহেবরা। সাহেব তখনই বাংলোয় একজনকে পাঠালেন বন্দুক আনতে।

কিন্তু মাংরার তখন শরীর জ্বলছে। নিঃশব্দে পা টিপে টিপে সে এগিয়ে যাচ্ছে। এক হাতে লাঠিটাকে উঁচিয়ে রেখেছে। এই চা-বাগানে সে জন্মেছে। একটু একটু করে বুড়ো হল। সে যেমন করে এখানকার প্রকৃতিকে জানে এই লেবারগুলো তার এক কণাও জানে না। আতা-বাগানে কাজ করতে এলেই সাপ তো জলভাত, বাঘের মুখেও পড়তে হতো। কত হরিণের বাচ্চা সে নিজের হাতে ধরে সাহেবকে ভেট দিয়েছে। মৃত্যুর সঙ্গে এক কালে লড়াই করতে হতো পাতি তুলতে এলে। এসব কথা এরা কেউ জানে? এখন সব বাবু হচ্ছে, মুখে লম্বা লম্বা বাত। সে যে সর্দার এদের সবার চেয়ে বড় এটা বুঝিয়ে দেওয়া দরকার। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে কাকে তোরা দালাল বলছিস দ্যাখ।
 
সবার নজরে পড়ে গেল মাংরা সর্দার সন্তর্পণে এগোচ্ছে। একটা লাঠি সম্বল করে সাপটার মোকাবিলা মানে মৃত্যুকে ডেকে আনা। কুলিরা সব নিরাপদ জায়গায় সরে দাঁড়িয়েছে। এইসময় নারীকণ্ঠে চিৎকার উঠল, মাংরাকে ফিরে আসতে বলছে। গলাটা কার বুঝতে পারল না মাংরা, এখন তার নজর গাছগুলোর তলায়। উবু হয়ে হাঁটছে সে। অজগর হলে যে কোনো সময় এক ঝটকায় শুইয়ে দেবে তাকে। সেইটে হতে দিলে চলবে না। সাহেবের গলা শুনতে পাচ্ছে সে, হুকুম করছেন ফিরে যেতে। কান দিল না সে। না, এই মুহূর্তে কোনো আদেশ শুনবে না মাংরা।

এ ব্লকে চা গাছের তলাটায় যথেষ্ট আগাছা জমে গেছে। বাজপাখীর মত মাটি হাতড়াচ্ছিল সে চোখ দিয়ে। আর একটু এগোতেই সে স্থির হল। সাপটা তাকে দেখছে! একটা গাছের গুঁড়ি শুধু লেজে পাকিয়ে ধরে অনেকটা এগিয়ে এসেছে শরীরটা। আচমকা ঘাম জমতে লাগল শরীরে। এরকম মোটা আর লম্বা সাপ সে জীবনে দেখেনি। নির্ঘাৎ কিছু একটা খেয়েছে সাপটা। কারণ পেটের কাছটায় বেঢপ ফুলে আছে ওর। চোখাচোখি হতেই আস্তে আস্তে হাঁ করল সাপটা। মুখের গহ্বর এবং জিভ দেখে চকিতে সতর্ক হয়ে গেল মাংরা। ওই মুখ তার মত মানুষকে সহজেই অর্ধেকটা গিলে নিতে পারে। এই সাপ ফণা তোলে না কিন্তু নিজের পরিধির মধ্যে অত্যন্ত দ্রুত ঝাঁপিয়ে গিলে নিতে পারে। কিংবা বিদ্যুতের মত লেজ ছুঁড়ে শিকারকে পাকে পাকে জড়িয়ে চাপ দিতে পারে যতক্ষণ তার হাড়গোড় না ভেঙে যায়। বেশ কিছুক্ষণ চোখে চোখ রাখল ওরা। পেছনে কুলিদের গলায় কোনো শব্দ নেই। হঠাৎ সাপটার কী হল বুঝল না মাংরা, মুখটা সরিয়ে নিচ্ছে। একটু একটু করে শরীরটাকে আড়ালে নিয়ে যাওয়ার মতলব। পিছু হটছে ওটা, এই সময় ঝট করে একমুঠো মাটি তুলে ছুঁড়ে দিল মাংরা। ভেজা মাটির দলা থপাস করে সাপটার চোখের ওপর পড়ে ঘুঁটের মত বসে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মরিয়া হয়ে সাপটা শন শন করে অনেকটা দূর মাথা সোজা করে এগিয়ে এল। কিন্তু চোখে দেখতে পাচ্ছে না ওটা। দুহাতে লাঠিটা ধরে ঝাঁপিয়ে পড়ল মাংরা। মাথা সরাবার আগেই ঠিক গলার কাছটাতে লাঠিটাকে আড়াআড়ি ফেলে ওটার দুই প্রান্তে দুই পা দিয়ে উঠে দাঁড়াল। আচমকা আক্রমণে সাপটা যে কয় পলক ঘাবড়েছিল সেইটে কাজে লাগাল মাংরা। প্রাণপণে লেজ ব্যবহার করবে জানে মাংরা। মাথা অকেজো হয়ে গেলে ওর বড় অস্ত্র। এক ঝটকায় তাকে ফেলে দিতে পারে লেজের আঘাতে। শরশর করে লেজটা খুলে আসছে গুঁড়ি থেকে। প্রচণ্ড গতিতে লেজটাকে ওপরে তুলতে গিয়ে বাধা পেল সাপটা। একটা চা-গাছের ডালে লেজটা আটকে গেল আঘাত করতে গিয়ে। মাংরা দেখল ডালটা পাটকাঠির মত ভেঙে গেল একবারই। এবার লেজটাকে সে গুটিয়ে আনছে। আক্রমণের ধারা পালটাচ্ছে ঠিক ওই জন্যেই তৈরি ছিল মাংরা। লেজের ডগাটা নাগালে আসামাত্র খপ করে ধরে সোজা হয়ে দাঁড়াল সে। পায়ে তলায় মাথা লাঠিতে আটকানো আর দুহাতের মুঠোয় লেজ, সাপটা প্রাণপণে শরীর দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরতে চেষ্টা করছে। প্রচণ্ড সেই শক্তির সঙ্গে যুঝতে পারছিল না মাংরা। একটু শিথিল হলেই মৃত্যু, মাংরা কোনরকমে শরীরটাকে সাপের পেটের নাগালের বাইরে রাখছিল।

এসময় হইহই বেড়ে গেল। দৃশ্যটা দূর থেকে সবাই দেখেছে। সাপটা এখন কব্জায় বুঝে ছুটে এল অনেকে। মুহূর্তেই দড়িতে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা হয়ে গেল সাপটা। কয়েকজন মাংরাকে ধরে ধরে খোলা জায়গায় নিয়ে এল। সমস্ত শক্তি নিঃসাড় হয়ে গেছে তার। শরীর ঝিম ঝিম করছে, চোখ ঝাপসা। ম্যানেজার এগিয়ে এল, ইয়েস সর্দার, তুমি খুব সাহসী। তোমার জন্যে আমি গর্ব বোধ করছি। এর জন্যে তুমি বকশিশ পাবে।

দুটো হাত জড়ো করে মাংরা কৃতজ্ঞতা জানালো কোনরকমে। কিন্তু মনে মনে বলল, এ তোমার কি রকম বিচার। আমি সর্দার আর আমার সম্মান নেই? পারত ওই ছোঁড়ারা এরকম একটা কাজ করতে?
 
ভিড় জমেছে সাপটাকে নিয়ে। দড়ি বাঁধা সাপটা সত্যি প্রকান্ড। হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠল মাংরা। তারপর চিৎকার করে বলল, কামমে লাগ যাও সব, জলদি। মাংরার মুখ চোখ এখন একজন সর্দারের যেমন হওয়া উচিত তাই। যথেষ্ট সময় নষ্ট হয়েছে আর নয়। লেবাররা তো বটেই ছোটসাহেব পর্যন্ত লোকটার এই রকম পরিবর্তন দেখে অবাক হয়ে গেলেন। পাতিবাবুকে বললেন, হি ইজ আওয়ার অ্যাসেট। ওকে অফিসে পাঠিয়ে দেবেন বিকেলে। তারপর দড়িতে বাঁধা বিশাল সাপটাকে নিজের গাড়ির পেছনে ঝুলিয়ে বীরবিক্রমে ফিরে গেলেন।

না। সাপটাকে ধরেও মেজাজ ঠিক হল না মাংরার। বিকেলে গুদামের পাশে সাহেবের অফিসে যাওয়ার সময় ভেবেছিল সিরিলকে ডেকে জিজ্ঞাসা করবে ওই মরদ-ছাড়া বেশরম মেয়েছেলেটা যা বলল তা সত্যি কিনা! সিরিল যদি স্বীকার করে তাহলে এই মুহূর্তেই সম্পর্ক ত্যাগ করবে। ওরকম ছেলের কোনো প্রয়োজন নেই তার। হপ্তায় যে টাকা পায় তা তো জামাকাপড় আর ভুটানের মদ খেতেই চলে যায়। এইসব মেয়ের পেছনে ঢালছে কিনা কে জানে! ওর কাছ থেকে তো একটা পয়সাও নেয় না মাংরা! তার সংসারের অবস্থা এককুড়ি সাল আগে যেমন ছিল এখনও তাই। ছেলেকে তাড়িয়ে দিলে কোনো সমস্যা নেই শুধু একটি ছাড়া। বাগান থেকে ছুটি হয়ে গেলে মাথা গোঁজার জায়গা থাকবে না। নইলে ছেলে যদ্দিন চাকরি করবে তদ্দিন তাকে কোয়ার্টার ছাড়তে কেউ বলবে না। তা এরকম ছেলের আশ্রয়ে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া ভাল। সে নিজে কোনোদিন শুকরাবুড়োকে অপমান করেনি, ভাবতেও পারে না। আর এ হারামি ছেলের কান্ড দ্যাখো, ওই মেয়েটাকে নিজের বাপের পেছনে লেলিয়ে দিচ্ছে। আজ না হয় কোয়ার্টার হয়েছে ইটের দেওয়াল টালির ছাদ। আরে এককুড়ি সাল আগেও তো মাটির ঘরে খড়ের ছাদের তলায় থাকত ওরা। তাই থাকবে না হয়। বাগানের বাইরের জঙ্গলের মধ্যে একটা ঘর তুলে নেবে। কিংবা এখানে থাকবেই না। বুড়ো বাপকে নিয়ে সেই টেবুয়াতে চলে যাবে। বাপের কথা যদি ঠিক হয় তাহলে সেটাই তো তাদের দেশ। নিশ্চয়ই দু-একজন আত্মীয়কে খুঁজে বের করে নেওয়া যাবে। শেষের সিদ্ধান্তটা রাগের মাথায় মনে এলেও ব্যাপারটা নিয়ে বেশি ভাবতে যুৎ পায় না মাংরা। গুদামের সামনে দাঁড়িয়ে সে একটু আড়ষ্ট হল। যদি সত্যি হয় ব্যাপারটা! হাতের লাঠিটা বগলে নিয়ে এক পা এক পা এগোতে অন্তত তিনটে লোকের প্রশংসা শুনতে হল। ওরকম বড় সাপ সে একা ধরল কী করে! কত বড় হিম্মত থাকলে এরকম সাহস দেখানো যায় এই সব কথাবার্তা। সারা বাগান আজ তার হিম্মতের কথা জেনে গেছে। অত বড় সাপটাকে যে ধরেছে তাকে এখন সবাই সম্মান করবে। এই সময় যদি সে ছেলের কাছে অপমানিত হয় তাহলে– মাংরা ফিরে এল। যা হবার ঘরে গিয়েই হবে।

একটা কড়কড়ে পাঁচ টাকার নোট বকশিশ পেল সে ছোটসাহেবের কাছ থেকে। মাংরা জানে ওই সাপটার চামড়া এতক্ষণ ছাড়ানো হয়ে গিয়েছে। বাজারে ওই চামড়ার দাম অনেক। অন্তত দুই-তিনজোড়া জুতো হয়ে যাবে। তিন সাহেবের পায়ে শোভা পাবে সেগুলো। এর আগের সাহেবরা হরিণ বা বাঘ পেলে চামড়া খুলে নিয়ে কত কি করত। মাংরা শুনল ছাল ছাড়িয়ে মাংসটা পাঠিয়ে দিয়েছে। পাঁচ টাকা হাতে নিয়ে খুশি হতে পারল না মাংরা। সিরিল হলে ছুঁড়ে ফেলে দিত। বলত, একটা আদমির জীবনের দামে জুতো বানাচ্ছ আর তার জন্যে মোটে পাঁচটা টাকা। আর বাপ হলে আনন্দে মাথা নাড়ত। সাহেব যে খুশি হয়ে দিয়েছে এই তো কত। না দিলে কিছু বলার ছিল? সাপটা যেহেতু বাগানে ছিল তাই তার মালিক তো সাহেবই। কিন্তু মাংরা চুপচাপ নিয়ে নিল। তারপর সেলাম করে খোয়া ছড়ানো পথ দিয়ে হেঁটে এল বাজারে। কামিনগুলো এখন খালি ঝুড়ি নিয়ে ফিরে যাচ্ছে যে যার বাড়িতে। গুদামের শিট বদল হচ্ছে। মাথার ওপর পাখিদের চিৎকার। পিচের রাস্তার দুপাশে লম্বা লম্বা গাছের সারি। চা বাগানের মধ্যে যখন সে হাঁটে তখন একধরনের গন্ধ পায়। সে গন্ধটা নাকে এলেই বুক জুড়িয়ে যায়। আর এখন পিচের রাস্তায় হাঁটার সময় গাড়ির হুসহাস শব্দে নিজেকে গুটিয়ে গুটিয়ে পা ফেলতে হয়। রামচন্দ্রের দোকানটা এত দূরে যে ফুরোতেই চায় না পথটা।
 
সব জিনিসের দাম বাড়ছে, মালের দাম তো বাড়বেই। তবে ঠিক যারা পুরনো খদ্দের তাদের সঙ্গে এরা জালিয়াতি করে না। এক নম্বরটা দেবেই। আগে পাঁচ টাকা হলে সাঁতার কাটা যেত, এখন নেশাটা জমব জমব হয় মাত্র। কিন্তু আজকে অন্য রকম ব্যাপার হল। সবাই সাপটার গল্পটা শুনতে চায়। যেচে অনেকেই খাওয়াতে লাগল তাকে। নিজেকে খুব বিরাট মানুষ বলে মনে হতে লাগল তার। গল্পটা বারংবার বলতে বলতে একটু একটু করে অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে কিন্তু কী করবে মাংরা। সেই সময় কে একজন মেয়েটার কথা তুলল। শুধু সাপ ধরা নয়, নিরি যে তাকে অমন হুমকি দিয়েছিল সেটাও রাষ্ট্র হয়ে গেছে। কথাটা ভুলেই গিয়েছিল মাংরা। সাপের গল্প আর পেটে মাল পড়ায় অন্য রকম মেজাজে ছিল। এখন কেউ একজন বলতেই আর একটা গলা খ্যানখেনিয়ে বলল, আমি হলে শালা সাপ না ধরে আগে ওই মেয়েটাকেই ধরতাম। মেয়েছেলে হল মেঘের মত। বৃষ্টি হবার আগেই যত হম্বিতিম্বি করে। কথাটা শোনা মাত্র মাংরা চোখ ঘুরিয়ে বুকু সর্দারকে খুঁজল। ভাটিখানার সামনে বিরাট উঠোনটায় ওরা সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে খাচ্ছো। মাঝে মাঝে কুপি জ্বালিয়ে ছোলাভাজা বিক্রি হচ্ছে। তারই আলোয় মানুষ দেখা এবং চেনা বেশ কষ্টকর। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে পা নড়বড়ে হয়ে গেল। জব্বর খাওয়া হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মাথায় আবার আগুন জ্বলল যে। শালা বুকুকেই খতম করবে সে। মেয়ে যখন ওর, দায়িত্ব ওকেই নিতে হবে। টলতে টলতে পুরো উঠোনটা পাক দিল সে। না বুকু সর্দারকে সে চিনতে পারছে না। বুকু শালা আসেনি। রোজ আসে আর আজই বাদ। হঠাৎ ওর মনে পড়ল, পকেটে এখনও পাঁচটা টাকা ঠিকঠাক আছে। এটাও তো লজ্জার টাকা। এটাকেও খতম করা দরকার। যে কটা বোতল পেল সব নিয়ে বসল মাংরা।

রামচন্দ্রের খদ্দের বাগানের কুলি কামিন। অনেক অনেক বছর হয়ে গেল এই দোকান। একটা গোপন চুক্তি থাকায় সাহেবদের কাছে লীজের অংশ চলে যায়। নইলে আজ তাকে দ্যাখে কে। এই কুলিদের পয়সায় তার পেট্রোল পাম্প, লরি, বাস, জমিজমা। আগে ছোঁড়ারা লাইনে হাঁড়িয়া খেত। এখন ভুটানের মাল খায়। সেটার বিক্রি রামচন্দ্রের হাত দিয়ে। তবে সরাসরি এই আস্তানা থেকে নয়। সবাই জানে পুলিসও খবর রাখে কিন্তু মুখ খুলবে কোন্ শালা! তবে কুলিদের মধ্যে একটু অন্য রকম ভাব দেখা যাচ্ছে। ব্যাপারটা ভাল নয়। জোয়ান যুবক-যুবতীরা আর আসছে উঠোনে বসতে। এখন ভিড় শুধু প্রৌঢ় আর বৃদ্ধদের। মেয়েছেলেরা লজ্জার বয়স পেরিয়ে তবে আসে। এই করলে ব্যবসা উঠে যাবে। দু-একটা মেয়ে যারা শরীর বেচে তাদের এখানে আনলে কেমন হয় এই চিন্তা রামচন্দ্রের হয়েছে। সাহেব হ্যাঁ বললেই ব্যাস, কেল্লা ফতে। তখন যুবকগুলো আসবেই, ফুল এবং মধু–একজোড়া আকর্ষণ।

খেতে খেতে এক সময় শুয়ে পড়ল মাংরা। মাথার ভেতর পরিষ্কার হয়ে গেছে। ঠিক সেইসময় মেয়েছেলেটা এসে দাঁড়াল। মাংরা দেখল কোথায় সাপ ধরেছে বলে সোহাগ করবে না চোখ জ্বলছে হিলহিলিয়ে। হাত নেড়ে পাশে বসতে বলল সে। সিরিলের মা ধূপ করে পাশে বসে কান্নার গলায় বলল, তোমাকে ছুঁড়িটা ওই কথা বলল আর তুমি শুনে গেলে? কী রকম মরদ তুমি?

মাংরা গায়ে না মাখার গলায় বলল, হাম বুড্ডা হো গ্যায়া।

সিরিলের মা থুতু ফেলল এক দলা, থু থু। তারপর ব্যবহৃত বোতলগুলোর দিকে হাত বাড়াল।

বেহেড মাতাল হয়ে দুজনে যখন ভাটিখানা থেকে বের হল তখন চাঁদ মাথার ওপরে, দোকানের আলো নিভে গেছে। সারাদিনের পর এখন আকাশ নির্মল। হাঁটুর তলায় পা দুটো নেই, দড়াম করে পড়ে গেল মাংরা। পড়ে বলল, নিরিকো হাম শাদী করেগা। সিরিলের মা চিৎকার করল কথাটা শুনে। তার নেশা হলেও এখনও শক্ত আছে। এ বুড়োটা নেশার ঝোঁকে বলেটা কি! ওই ছুঁড়িকে বিয়ে করবে। ইচ্ছে হল বেধড়ক পেটায় লোকটাকে। কিন্তু এই অবস্থায় সেটা কী করে সম্ভব! লোকটার যে হুঁশই নেই। খানিকক্ষণ চিৎকার চেঁচামেচি করে সে হাত ধরে টানতে লাগল মাংরাকে। টেনে হিঁচড়ে পথ চলতে লাগল। মাঝে মাঝে মাটিতে গড়িয়ে কখনও হামা দিয়ে মাংরা বউয়ের সঙ্গে চলতে লাগল। কখনও হুঁশ এলে সোজা হয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করে আর তখনই মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে, হাম উসকো শাদী করেগা। এ বুড্ডি ভাগো! আচমকা বউ-এর শরীরে একটা লাথি বসিয়ে মাটিতে পড়ে যায় মাংরা। পুরোটা রাস্তা এইভাবে মার খেয়ে স্বামীকে টেনে নিয়ে আসে সিরিলের মা। নিজের ঘরের দরজায় যখন পৌঁছয় তখনও সিরিলের ট্রানজিস্টর বাজছে। বিদেশি সুরের সঙ্গে শুয়ে শুয়ে পা নাচাচ্ছে সিরিল। এত রাতেও তার পরনে প্যান্ট, নেশা হলেও কিন্তু হুঁশ আছে। গোলমাল শুনে হাতে যন্ত্রটা ঝুলিয়ে বাইরে আসে বেরিয়ে। আর তখনই উঠে দাঁড়ায় মাংরা। টেনে টেনে বলে হাম উসকো শাদী করেগা। বাপের অবস্থা দেখে সিরিল বিরক্ত হয়েছিল, এখন সংলাপ শুনে সে হো হো করে হেসে উঠল। আর এতক্ষণ সহ্য করার পর মাংরার বউ-এর ধৈৰ্য্যচ্যুতি হল। ঘরের ভেতর থেকে ঝাঁটা এনে বেধড়ক মারতে লাগল স্বামীকে। পথে আসতে আসতে যত মার খেয়েছে সব ঝেঁটিয়ে উসুল করে নিচ্ছিল সে। তাই দেখে সিরিল ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, শালা, সব থার্ড কেলাস আদমি।
 
বিনাগুড়ি ক্যান্টনমেন্টের পাশে নতুন গজিয়ে ওঠা বাজারে ফরেন জিনিস পাওয়া যায়। ইন্ডিয়ার মালের চেয়ে বেশ সস্তা। টাকা থাকলে সব কিনে ফেলত সিরিল। রেডিও টেপ-রেকর্ডার জামা প্যান্ট দাড়ি কামাবার মেসিন আরো কত কি। দেখে শুনে ও একটা স্ট্রেচের প্যান্ট আর ব্যানলনের গেঞ্জি কিনেছে। ঠিক অমিতাভ বচ্চনের মত লাল কালো মেশানো। বাজারের পানের দোকানের আয়নায় দেখেছে জব্বর লাগে। প্রায় পঞ্চাশ টাকা বেরিয়ে গেল অবশ্য–জিন্দেগি মে এইসাই তো যাতা হ্যায়–ফিন আতা ভি হ্যায়। এখন ওই সবের ওপর চওড়া বেলট কোমরে এঁটে হাতে রেডিও ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে সে যখন হাঁটে তখন মনে হয় হিন্দি ছবির হিরো যাচ্ছে। জীবনে দুটো শখ সিরিলের। বিনাগুড়ি বাজারহাটে যত হিন্দি ছবি আসে সেগুলো দেখা আর ভুটানের রামের বোতল খাওয়া। গুদামে কাজ করে যে টাকা পায় সেগুলো পকেটে বেশিদিন থাকতে চায় না তার। এতদিন দুনম্বর টাকার ধান্ধা ছিল না, কিন্তু মনে হচ্ছে এখন দরকার। বাপকে পয়সা দিতে হয় না, দিলে সব হাফিস হয়ে যেত। শোলের ডায়ালগ মুখস্থ সিরিলের। যখনই সুযোগ পায় পা ফাঁক করে আমজাদের গলা নকল করে সে আওড়ায়। তখন মদেসিয়া মেয়েপুরুষগুলো তার দিকে ভগবান দেখার চোখ করে তাকিয়ে থাকে। বাগানের মেয়েগুলোর কাছে সিরিল এক নম্বর হিরো।

আজ রবিবার। হাটবার। আশেপাশের চা-বাগানের মেয়েপুরুষ ভিড় জমিয়েছে বাজারে খোলা মাঠে৷ মাইকে গান, বিজ্ঞাপন বাজছে। মেলা মেলা ব্যাপার। সিরিল ট্রানজিস্টার হাতে হাঁটছিল। কিশোরকুমারের গানে অজান্তেই লিপ দিয়ে যাচ্ছে সে। ফ্রান্সিস ওরাওঁ-এর কোয়ার্টারে যেতে হবে। কাল গুদামে একটা ঝামেলা হয়ে গেছে। ফ্রান্সিস কী বলে দেখা দরকার।

পড়াশুনা করেনি বলে এখন মাঝে মাঝে আফসোস হয় সিরিলের। বুড়া বাপ না হয় একদম গেঁয়ো ছিল বাপটাও যে হাফ-গেঁয়ো। নইলে তাকে জোর করে মিশনারিদের কাছে পাঠাতে পারত? যেমন ফ্রান্সিস গিয়েছে। তাহলে সিরিল আজ ফ্রান্সিসের মত বাবু বনে যেতে পারত।

মাত্র দুবছর আগে হল ব্যাপারটা। আগে বাবুদের চাকরি করত বাঙালিরা। কোনো বাবুর ছুটি হয়ে গেলে তার ছেলে কাজে লাগত। কোনোরকমে ম্যাট্রিক পাস করে নিলেই হল। এটাই নিয়ম ছিল। কিন্তু নতুন য়ুনিয়ন বলতে আরম্ভ করল বাবুর কাজে কুলিদেরও নিতে হবে। সিরিল নতুন যুনিয়নে তখন একজন মাতব্বর হয়ে গেছে। নেতা ফেতা নয় কারণ চা বাগানের য়ুনিয়নের নেতা হয় শহরের লোক। যা হোক, কুলির ছেলেরা ম্যাট্রিক পাস করলে তাকেও ওই বাবুর চাকরিতে নিতে হবে এই দাবীতে সাহেবের সঙ্গে দেখা করল ওরা। দুতিন দিন খুব ঝামেলা হল। শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেল সাহেব। সেই সুবাদে ফ্রান্সিস কাজ পেয়ে গেল, বাবুর চাকরি। চা বাগানের ইতিহাসে এমনটি হয়নি। বিনাগুড়ির মিশনারিদের স্কুলে কোনো রকমে ম্যাট্রিক পাস করে বসেছিল ফ্রান্সিস। বেচারা কুলির কাজেও যেতে পারছিল না আবার অন্য চাকরিও পাচ্ছিল না। যেদিন ফ্রান্সিস কাজ পেল সেদিন তাদের কি বিজয়োল্লাস। বাবুরা সব গম্ভীর মুখে রয়েছে। মদেসিয়া ওরাঁও-এর ছেলেরা যাদের এতদিন ওরা মানুষই মনে করত না তারা আজ সমান সমান, চেয়ারে বসবে, পাশাপাশি বাবুদের কোয়ার্টারে থাকবে এটা মেনে নিতে মন চাইছিল না। তখন থেকেই সিরিলরা ঠিক করেছিল যদি কেউ কটুক্তি করে তাহলে তাকে ছেড়ে দেবে না। এ চাবাগান কার? যারা রক্ত দিয়ে চা তৈরি করছে বছরের পর বছর, যাদের ওপর শুধু হুকুমের চাবুক চলেছে তারাই আজ সংখ্যায় ভারী। এই বাগানের বাবু যদি পনেরো জন হয় তবে কুলি হবে কমসে কম পনেরশ। এক ফুঁয়ে উড়ে যাবে ওরা। যাক্, মনে যাই হোক মুখে কিছু বলেননি বাবুরা। ফ্রান্সিস ছোট গুদামবাবুর কাজে লেগে গেল। লাইন থেকে উঠে বাবুদের পাশাপাশি কোয়াটারে চলে গেল। কুলিদের ভরসা বাড়ল। এই করে একদিন সাহেবের চাকরিতেও হয়তো মদেসিয়াদের দেখা যাবে। সিরিলের হাঁটার অভ্যেস দুলে দুলে এবং যেন খানিকটা উড়ে উড়েই। পিচের রাস্তায় কিছুটা হাঁটলে বাঁয়ে ডাইনে বাবুদের কোয়ার্টার। সেদিকে তাকিয়ে হাঁটতে গিয়ে পেছনে হর্ন বাজল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল সে ছোটা সাহেব। সেলাম করবে না ভেবেও হাতটাকে ঠেকাতে পারল না সে। ছোটসাহেব চলেই যাচ্ছিলেন কিছুদূর গিয়ে গাড়ি থামালেন। সিরিল একটু অবাক হল। বাগানের সাহেবদের ধারে কাছে ঘেঁষতে চায় না সে। সব শালা যেন এক একটা আমজাদ খান। সিরিল বাঁ দিক দিয়ে সরে যাবে বলে পা বাড়াতেই গাড়িটা ব্যাক করে পাশে এসে দাঁড়াল। ছোটসাহেব মুখ বেরে করে বললেন, তোর নাম কিরে? –

সিরিল।

মাংরা সর্দারের ছেলে না তুই? জি।

সবাইকে যেসব জ্ঞান দিচ্ছিস নিজে তা বুঝিস?

মানে?

কাল একটা মেয়ে তোর বাবাকে অপমান করেছিল। সে বলল তুই নাকি ওভাবে কথা বলতে শিখিয়েছিস। নিরি না কি যেন নাম–।

নিরি! সিরিল আস্তে আস্তে উচ্চারণ করল নামটা।
 
ছোটসাহেব বললেন, এই বাগান তোর মায়ের মত। এমন কিছু করিস না যাতে এর অপমান হয়। যে খাবার দেয় তাকে সম্মান জানানো উচিত। কথা শেষ করেই হুস করে চলে গেল গাড়িটা। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল সিরিল। কী বলতে চাইলেন ছোটসাহেব? কোনো সাহেব যে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে এসব কথা বলতে পারে তাইতো বিশ্বাসযোগ্য না। বড়সাহেব হলে? ভাবাই যায় না।

এই ছোটসাহেব নোকটা অদ্ভুত। লোকটা নাকি গরিব ঘরের ছেলে। ভাল পড়াশুনা করে ট্রেনিং ফ্রেনিং নিয়ে সাহেব হয়েছে। অন্য সাহেবরা ওকে তাই ভাল নজরে দেখে না। এই চা বাগানে আগে একটাই য়ুনিয়ন ছিল। এখন তিনটে, এখন যারা মন্ত্রী তাদের য়ুনিয়নই বেশি জোরদার। প্রতিবারই এরকম হয়। কিন্তু একটা ব্যাপার নিয়ে কুলিদের মধ্যে ফিসফাস হচ্ছে। প্রথম থেকে কুলি য়ুনিয়নের মাথায় বসে আছে শহরের পলিটিক্যাল বাবুরা। গোলমাল হলে তারা যেন দয়া করে আসেন, সাহেবের বাংলোয় বসে কথা বলেন, একটা মিটমাট করে দিয়ে চলে যান। এই ব্যাপারটা পাল্টাতে হবে। সিরিল এবং তার বন্ধুরা এখন মাল কামায়। ভোটের আগে পার্টির কাছ থেকে পয়সা নেয় আর মনে মনে গালাগালি দেয়। মন্ত্রীত্ব যে দলের কব্জায় আসে তাদের য়ুনিয়নে ঢুকে যেতে ওদের সময় লাগে না। কিন্তু এসব করে মাঝে মাঝে পকেট ভারী হলেও মন কেমন করে। ওই যে ছোটসাহেব কথাটা বলে গেল, যে খাবার দেয় তার ইজ্জত বাঁচাতে হবে। সিরিলদের ধারণা, পলিটিক্যাল বাবুরা এসবের ধার ধারে না।

ট্রানজিস্টারটা হাতে বেজেই যাচ্ছিল। সিরিল গেটটা খুলল। বিরাট কোয়ার্টার। চারপাশ তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। ফ্রান্সিস বাবু হবার পর এখানে এসেছে। মনে পড়ে, প্রথম দিন সে যখন এই কোয়ার্টারের দখল নিয়েছিল সেদিন কয়েকশ কুলি মিছিল করে এসেছিল ওর সঙ্গে। সিরিল ট্রানজিস্টারটা বন্ধ করে বারান্দায় উঠে চিৎকার করে ফ্রান্সিসকে ডাকল।

একটা বছর পাঁচেকের হাফ প্যান্ট পরা ছেলে দরজায় উঁকি মেরে ভেতরে ছুটে গেল। তারপর একটা বছর পনেরোর ছুকরি এসে জিজ্ঞাসা করল, কী চাস?

ফ্রান্সিসকে ডাক।

বাবু নাম জিজ্ঞাসা করল।

বাবু! সিরিলের খেয়াল হল এ মেয়েটাকে সে কখনো দ্যাখেনি। এ ফ্রান্সিসকে বাবু বলছে কেন? সিরিল জিজ্ঞাসা করল, তোর ঘর কোথায়?

হাসিমারা।

এখানে কী করিস?

কী আর করব। খানা পাকাই, ঘরের কাম করি।

ও, ফ্রান্সিসকে বল সিরিল এসেছে।

মেয়েটি ভেতরে চলে যেতেও সিরিল মাথা পরিষ্কার করতে পারছিল না। ফ্রান্সিস বাড়িতে কাজের লোক রেখেছে অন্য বাবুদের মতন। আর এনেছে একদম হাসিমারা থেকে যেখানে কেউ তাকে চেনে না। এসব ভাবতে ভাবতেই ফ্রান্সিস এল। পাজামা আর সার্ট পরেছে। ওকে দেখে অবাক হল যেন, বলল, কী খবর? গুদামে কিছু গোলমাল হয়েছে?

সিরিল দেখল এই সময়ে মধ্যেই ফ্রান্সিসের চেহারার বেশ পরিবর্তন হয়েছে। মদেসিয়াদের কালো চামড়ার ওপর একটা চকচকে পালিশ লেগেছে। এমন কি সে যে এই প্রথম বাড়িতে এল সেটা না ভেবে অন্য বাবুদের মত কাজের কথা বলছে।

সিরিল বলল, তোমার সঙ্গে কথা আছে।

কী কথা?

সেদিন গুদামে তুমি বুধুয়ার সঙ্গে ওরকম কথা বলেছ এটা সবাই ভালভাবে নেয়নি। তুমি কি তোমার জাতভাইকে স্বীকার করছ না আজকাল?

এসব কথা কেন?

কারণ সবাই তোমাকে বাবু বলে ভাবতে শুরু করেছে।

হাসল ফ্রান্সিস, আমি তো বাবুই। ছোট গুদাম বাবু।

কিন্তু সেটা তোমাকে করল কে? আমরা যদি সাহেবকে গিয়ে না ধরতাম তাহলে তুমি এই চাকরি পেতে?

তুই কী চাস?

আমি চাই তুমি আমাদের লোকের মত কাজ করবে।

বাঃ, বহুৎ আচ্ছা! তোমরা ফাঁকি দেবে, কাম করবে না, আর আমি তাই দেখে চোখ বুঁজে থাকব? আমাকে তাই মাইনে দেওয়া হয়? আমি যখন বাবুর চাকরি করছি তখন একজন বাবু যে ভাবে কাজ করে আমি তাই করব। আর এ কথা তুই বলতে এসেছিস কেন? আমার সঙ্গে য়ুনিয়নের এ ব্যাপারে পরিষ্কার কথাবার্তা হয়ে গেছে।

কোন্ য়ুনিয়ন?

আমাদের য়ুনিয়ন। বাবু য়ুনিয়ন।

সিরিল আর দাঁড়াল না। ফ্রান্সিস সম্পর্কে ওর বাবাই এখন বলে–দাঁড় কাক ময়ূরের পেখম পাছায় গুঁজে ময়ূর সেজেছে। সিরিলের মনে হল, সাজাসাজি নয়, ফ্রান্সিস সত্যিকারের ময়ূর হয়ে গেছে। এখন ওর কোনো জাত নেই। শালা অতক্ষণ তার সঙ্গে কথা বলল কিন্তু একবারও বসতে বলল না। কুলি লাইনের অনেকেই মনে করে ফ্রান্সিস তাদের লোক–এই ভুলটা ধরিয়ে দেওয়া দরকার।
 
নদী পেরোলেই হাট শুরু। আগে ছোট ছিল এখন বাড়তে বাড়তে নদী অবধি চলে এসেছে। দুপুর অবধি শাকসবজি আর সাপ্তাহিক প্রয়োজনে সবাই ঘোরাফেরা করে। দুপুরের পর থেকেই হাটের চেহারা যায় পালটে। তখন চারপাশে মেলার আমেজ। মেয়েরা আসে সেজেগুজে। নানান শখের জিনিস বিক্রি শুরু হয়ে যায়। মাইকে হিন্দি গান বাজে। যেন রমরমে ব্যাপার।

এ সিরিল! চিৎকারটা শুনে সিরিল চারপাশে চোখ বোলালো। চেনাশোনা প্রায় সবাই, কিন্তু যে ডাকছে তাকে দেখতে পেল না সে। আরো কয়েক পা যাওয়া মাত্র সেই চিৎকার। সিরিল গলাটা চেনে, রসিকতা ও তরফই শুধু করবে এরকা হতে দেওয়া যায় না। সে চটপট বাঁ দিকে পাঁপড়ের দোকানে দাঁড়ানো মেয়েটার কাঁধে হাত রেখে বলল, তোকে আজ খুব সুন্দর দেখাচ্ছে রে!

মেয়েটা এমন অবাক হয়ে গেল যে ঘাড় ঘুরিয়ে ওকে দেখতেই লাগল কিছুক্ষণ। হাতে পাঁপর আধখাওয়া অবস্থায় রয়েছে, ঠোঁটের চারদিকে তার তেল চকচক করছে। অন্য লাইনের মেয়ে, এর আগে কয়েকবার দেখেছে কিন্তু এভাবে কথা বলার মত সম্পর্ক নয়। মেয়েটি নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, নেশা করেছিস না?

সিরিল হাতটা সরাল না, সুন্দর জিনিস কি নেশা করে দেখতে হয়? ওটা দেখেই তো মানুষের নেশা হয়। কয়েকদিন আগে অমিতাভ বচ্চনের মুখ থেকে শোনা এই ডায়লগটা। তেমনি কায়দা করে আবৃত্তি করল সে। মেয়েটা এতে আরো ঘাবড়ে গেল। কোনরকমে পাঁপরটা দু টুকরো করে বড়টা সিরিলের দিকে এগিয়ে ধরে বলল, নে, খা।

সিরিল বাঁ হাতের দুই আঙুলে কায়দা করে সেটা তুলে নিয়ে বলল, আবার যখন দেখা হবে তখন যা খাওয়াব তুমি খাবে তো? এটাও অমিতাভ বচ্চনের সংলাপ। কথাটা শেষ করে উত্তরের জন্যে না দাঁড়িয়ে ও ভিড় বাঁচিয়ে হাঁটতে লাগল। মেয়েটি ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজের মনে বলে উঠল, শালে বদমাস, অমিতাভ বন্ গেলেক!

সামনে তাকাতেই সিরিল হেসে ফেলল। কোমরে হাত রেখে নিরি দাঁড়িয়ে আছে। মুখ থমথমে, চোখে আগুন। বড় জোর মাস ছয়েক জানা-শোনা হয়েছে কিন্তু নিরি এমন ভঙ্গি করে যে মনে হয় সারাজীবন একসঙ্গে আছে। মেয়েটা সুন্দর। ওকে যদি জিনত আমন কিংবা হেমা মালিনীর মত পোশাক পরানো যেত তো চোখ জ্বলে যেত সবায়ের। এখনও সেই আদ্যিকালের প্যাঁচ দেওয়া শাড়ি আর তার ওপর আংরা পরে। তা শাড়িটা যদি বাঙালি মেয়েদের মত পরত তাহলেও কথা ছিল। সিরিল মানসনেত্রে নিরিকে জিনত আমনের পোশাকে দেখে শিহরিত হল। শালা ওর মরদটা নিশ্চয়ই তিন নম্বরের হারামি, নইলে এই রকম বউকে সামলাতে পারে না। বড় কষ্ট মেয়েটার–একে দেখার পর থেকেই সিরিলের মনে হচ্ছে এই চা-বাগানের সব কিছু বেশ ভাল।

আমি ডাকছি শুনতে পাচ্ছ না? নিরি ফুঁসে উঠল।

ডাকলেই শুনতে হবে?

সব পুরুষ সমান। ওই মেয়েটার মধ্যে কী আছে এমন যে আমার ডাক শুনবে না!

ওকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে আসব? ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়েটাকে খুঁজল সিরিল।

সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত এগিয়ে এসে সিরিলের হাতে প্রচণ্ড চিমটি কাটল নিরি। ওর মুখ থেকে চিৎকারটা বেরুনো মাত্র সবাই এ দিকে তাকাল। হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, এরকম চিমটি যে বিনাগুড়িতে গেলে শেখা যায় তা জানতাম না, উঃ!

অ্যাই! নিরি আর একবার আক্রমণ করতে উদ্যত দেখে সিরিল দ্রুত সরে দাঁড়াল। তারপর হাত বাড়িয়ে বলে উঠল, দাঁড়াও দাঁড়াও, জব্বর খবর আছে। কাল রাত্রে মাংরা সর্দার সবাইকে ডেকে বলেছে তোমাকে শাদী করবে হা-হা হা। তাহলে তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা কী দাঁড়াল যেন।
 
কথাটা এমন মজা করে বলা যে হাটের মানুষগুলো হো হো করে হেসে উঠল শুনে। কেউ কেউ আবার সম্পর্কটা চেঁচিয়েও বলে দিল। শোনামাত্রই নিরি বড় বড় পা ফেলে হিন্দুপাড়ার রাস্তায় হাঁটতে শুরু করল। দ্রুত যে চোখের জলের বন্যা ওর দিকে ধেয়ে আসছে তাকে সামলাবার জন্যে ওকে কষ্ট করে লড়তে হচ্ছিল। হাটের মানুষজন, দোকানের তাবু টাঙানো দড়ি–কিছুই আর চোখের সামনে নেই। ওর শুধু এটুকুই মনে হচ্ছিল এ রকম অপমানিত সে কখনও হয়নি। এই একহাট মানুষের সামনে সিরিল যে ঠাট্টাটা ওর সঙ্গে করল তা বিনাগুড়ির স্বামীর ঘর থেকে চলে আসার সময় যা ঘটেছিল তার থেকে অনেক জ্বালাকর। অথচ আজ সকাল থেকে ও ভাবছে কখন হাটে সিরিল আসবে! সে ঠিক করেছিল সিরিলকে বলবে কাল রাগের মাথায় মাংরা সর্দারকে যেকথা সে বলেছে সেটা বলা ঠিক হয়নি। আজ সিরিলের সঙ্গে মাংরা সর্দারের কাছে গিয়ে সে ক্ষমা চাইবে বলে ঠিক করেছিল। বুড়ো মানুষ, তার ওপর লোকটা সিরিলের বাবা, ক্ষমা চাইতে কোনো লজ্জা নেই। কিন্তু দেখা হওয়া মাত্রই সিরিল ও কথা বলল কেন? নিজের বাপকে নিয়ে ওর সঙ্গে রসিকতা! হন হন করে হাঁটতে লাগল নিরি।

এই পরিবর্তন, নিরির অমন চলে যাওয়ামাত্র সিরিল বুঝেছিল যে কথাটা বলা ঠিক হয়নি। কেন যে সবাই অত অল্পে মন ভার করে কে জানে। কাল রাত্রে বাপ নেশার ঘোরে কথাটা বলছিল বার বার, মা যখন ধোলাই দিচ্ছিল তখনও সেই বাক্যিটা মুখ থেকে সরছিল না–এই নিয়ে খুব হাসি-তামাসা হয়েছিল। নেশার ঘোরে মানুষ নাকি সত্যি কথা বলে। তাহলে মাংরা সর্দারের নিরির ওপর মনে মনে লোভ ছিল। কথাটা কেউ জানাতে মায়ের রাগ আরো বেড়ে গিয়েছিল। সিরিলের কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই বেশ মজাদার বলে মনে হয়েছিল। লোকমুখে বাগানের ভেতর বাবা আর নিরির গোলমালটা সে শুনেছিল। প্রতি মুহূর্তে সে সতর্ক হয়েছিল বাবা ওকে আচ্ছাসে ঝাড়বে। খামোকা একটা মেয়ের ঝুঁটি ধরার কোনো অধিকার বাবার নেই। সেটা করলে ও রকম ব্যবহার তো পাবেই। নিরি যে ফোঁস করে উঠছে তাতে সে খুশি। দাদু বলে আগে নাকি যে-কোনো মেয়েকে যখন তখন সাহেবরা তুলে নিয়ে গিয়ে মা বানিয়ে ছেড়ে দিত। কারো কিছু বলার ক্ষমতা ছিল না। দাদুর কথা শুনলে মনে হয় এটাই সেকালে স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। বাবা অতটা মনে করে না কিন্তু সাহেবদের কাছ থেকে শিখেছে যে কাজ আদায় করতে গায়ের জোর ফলাতে হবে। সে ছেলে কিংবা মেয়ে হোক তাতে কিছু এসে যায় না। বাড়িতে দুদণ্ড থাকতে ইচ্ছে করে না সিরিলের। সব্বাই যেন ধুঁকছে। হাঁড়িয়া খাওয়া পানসে চোখে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কেউ কিছু জানে না। শুধু তার বাড়িই নয়, লাইনের অন্যান্য ঘরগুলোরও ওই এক দশা। আজ সকালে মাংরা সর্দার তাকে কিছু বলল না। উলটে মা ঘ্যানর ঘ্যানর শুরু করল। নিরি নাকি একটা বাজে ধরনের মেয়ে। স্বামীর ঘর করতে তো পারেইনি উলটে এর ওর তার সঙ্গে ঘুরছে কিন্তু কাউকে শাদী করছে না। সিরিলের মত ছেলে ইচ্ছে করলে কত ভাল ভাল মেয়েকে বিয়ে করতে পারে। এই তো তেলিপাড়ায় একটা মেয়ে আছে। বাঙালি বাবুদের স্কুলে দুই তিন ক্লাস পড়েছে। শাড়িটাড়ি পরে বাঙালিদের মতন। তাকে বিয়ে করে সুখে থাকতে পারে। কিন্তু ওই বেশরম মেয়েটার পাল্লায় পড়লে তার সব যাবে। এসব কথা তাকে শুনিয়ে বলা, সামনাসামনি নয়। আর সেটা শোনার পর নিরি সম্পর্কে অন্যরকম ভাবতে শুরু করল। মেয়েটার সঙ্গে তার আলাপ আছে, ঘনিষ্ঠতাও একটু কিন্তু ঠিক প্রেমট্রেম হয়নি। এর একটা অন্যতম কারণ নিরি হিন্দি সিনেমা দ্যাখে না। যে মেয়ে হেমা মালিনীকে দ্যাখেনি তার সঙ্গে ডায়লগ বলে সুখ নেই। বরং চুনাভাটি বাগানের নেপালি দারোয়ানের মেয়ে প্রেমকে তার পছন্দ খুব। জামাকাপড় কথাবার্তা দেখলে মনে হয় একদম ফিল্ম থেকে মাটিতে নেমে এসেছে। হাসে যেন হেমা মালিনী, হাঁটে যেন জিনত আর কথা বলে রেখার মতন। কিন্তু মুশকিল হল বাজার-হাট বিনাগুড়ি যেখানেই ও সিনেমা দেখতে যাক মৌমাছির মত একগাদা মালদার ঘিরে থাকে। তাই প্রেম আর ফিলিমস্টার ওর কাছে একই রকম।

নিরির চলে যাওয়া নিয়ে প্রথমে মাথা ঘামায়নি সিরিল। এইসাই তো হোতা হ্যায়। কিন্তু কয়েক পা হাঁটতেই যাদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল তারা বেশ উত্তেজিত। এই চা বাগানের সবচেয়ে শক্তিশালী য়ুনিয়নের ওরা সক্রিয় কর্মী। এরা সিরিলকে অনেকবার দলে টানতে চেয়েছে কিন্তু ততদিনে সিরিল শাঁসটা বুঝে গিয়েছে! যতক্ষণ না তোমার দল মন্ত্রিত্ব পাচ্ছে আমি তার মধ্যে নেই।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top