গাছটার নির্দিষ্ট কোণে এসে শুকরা বুড়ো বসে পড়ল। হাত বাড়িয়ে মাটিটাকে স্পর্শ করল। আঃ কি আরাম। তারপর কোমর থেকে লোহার শিকটা বের করে গর্ত খুঁড়তে বসল সে। মালা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, মাটি খুঁড়ছ কেন?
শুকরা বুড়ো হাসল, খুঁড়ছি খুঁড়ছি, দেখতে পাবি কী আছে এতে?
কী আছে?
রেল দেখার মন্ত্র। কত্তো বছর জমিয়ে রেখেছি একে, আজকের জন্যে, এই দিনটার জন্যে। হাত লাগা না রে, আমি বুড়ো মানুষ, একা পারি?
শিরায় জড়ানো হাতের সঙ্গে কচি হাত যুক্ত হল। গর্ত বড় হচ্ছে তো হচ্ছেই। শুকরা বুড়োর মুখ এখন উদ্বেগে টান টান। আর তারপরেই সেই ভাঁড়টার মুখ দেখা গেল। হাসিতে মুখ ঢলো ঢলো এবার, সাবধান, সাবধানে তোল, ওইটার মধ্যে আমার সব আছে। নাতনির হাত সরিয়ে দিয়ে নিজেই ভাঁড়টাকে তুলল সে। নরম হয়ে গেছে কেন? কেন হাতের বাঁধনে শক্ত থাকছে না? স্পষ্ট মনে আছে একটা কাপড়ের পুটলির মধ্যে ভাঁড়টাকে রেখেছিল সে। কাপড়টাই বা নেই কেন? শুকরা বুড়োর মনে আছে ভাঁড়ের মধ্যে আর একটা ছোট্ট পুঁটলিতে ছিল সেগুলো। কিন্তু এখন ভাঁড় জমাট হয়ে আছে মাটিতে। এত মাটি কোত্থেকে এল? প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে যাচ্ছে আঙুলগুলো, কাঁপছে। বুকের মধ্যে পাহাড় ধসার টাল।
ওপরের স্তর সরিয়ে ফেলার পর মাটিটা যেন অন্যরকম দেখাতে লাগল। আর তারপরেই সেই নথটায় আলো লাগতেই চিকচিকিয়ে উঠল।
হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল শুকরা বুড়ো। খেয়ে নিয়েছে, মাটি সব টাকা খেয়ে নিয়েছে। মাথা ঠুকতে লাগল শুকরা বুড়ো গাছের তলায়। হেই বাপ যীশু, এই তোর মনে ছিল! এই মাটি আমার সব নিয়েছে, আমার বউকে, আমার যৌবন, জীবনকে। শেষতক আমার যাওয়ার টাকাকেও খেয়ে ফেলল গো। আমি কী করে জানব মাটির পেটে এত খিদে, সব খেয়ে নেবে সে?
নাতনির হাত পড়ল মাথায়। শুকরা বুড়ো জলমাটিতে নিকানো মুখ তুলে নাতনির দিকে তাকাতেই যেন স্ত্রীকে দেখতে পেল। তার চোখে জল দেখে সেই চোখও টলটলে। দু হাতে নাতনিকে বুকে জড়িয়ে ধরে আবার হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল শুকরা বুড়ো, আমার যাওয়ার টাকা সব মাটি হয়ে গেছে রে।
খানিক বাদে শুকরা বুড়ো আবার ভাঁড়টাকে পরম স্নেহে দু হাতে তুলে নিল। সেই টাকা আজ মাটি। এমন করে মায়ায় বাঁধে কেন মাটি? অথচ নথটার একটা কোণ এখনও চকচকে। সেটাকে জীর্ণ আঙুলে তুলে ধরল সে। খাঁজে খাঁজে মাটি জমে গেছে। এই নথ সেই মেয়ের নাকে ঝলসাত। বড় ইচ্ছে ছিল তার, শুকরা বুড়ো যখন টেবুয়ার মাটিতে গিয়ে শোবে তখন এই নথটাকেও যেন পাশে নেয়। তাহলেই তার ইচ্ছা পূর্ণ হবে। এখন তো আর টেবুয়াতে যাওয়ার কোনো উপায় থাকল না। কী করে এই নথটা সেই মাটিতে শোবে? কান্নাটা আবার বুক উপচে বেরিয়ে এল।
মালা বুঝতে পারছিল না। কিছু একটা ছিল বুড়া বাপের যা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এখন। যা না থাকায় রেল দেখা যাবে না। কিন্তু বুড়া বাপের হাতে ওটা কি? কী সুন্দর নথ! সে হাত বাড়াল। চমকে গিয়ে হাত সরিয়ে নিল শুকরা বুড়ো। মুখে বলল, না। কক্ষনো না। এটা তার নথ। আসল জায়গায় যাওয়ার জন্যে এতদিন বেঁচে আছে এটা। একদম হাত বাড়াবি না?
নিজের নাকের হলদে কাঠি গোঁজা ফুটোটা এখন খালি। নাক তার ফোঁটানো হয়েছে কিন্তু নাকছাবি কিনে দেয়নি কেউ। তার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল দাদুর হাত থেকে নথটাকে ছিনিয়ে নেয়। কিন্তু শুকরা বুড়োর হাতের আঙুলে যে এখন হাজার বাঘের শক্তি, কিছুতেই নথটাকে ছাড়ল না সে। চেষ্টা করেও যখন পারল না মালা তখন শুকরা বুড়ো উঠে দাঁড়াল। এক হাতে মাটি হয়ে যাওয়া টাকা অন্য হাতে নথ। বিড় বিড় করতে লাগল সে, রেলের বাবুকে গিয়ে বলব, আমার আর কিছু নেই রেলের বাবু; এই এমুঠো মাটি যা কিনা একদিন টাকা ছিল আর এই নথটা ছাড়া। নথটা তো দিতে পারব না, তোমার পায়ে পড়ি আমাকে টেবুয়াতে নিয়ে চল।
এখন আর তার হুঁশ নেই কিছু। লাঠিটা পিছনে পড়ে রইল। মালা দেখল বুড়া বাপ হাঁটছে একা একা। নিশ্চয়ই রেল দেখতে যাচ্ছে। সে ছুটে এসে বুড়োর কোমর ধরল। চমকে তাকাল শুকরা বুড়ো, সেই মুখ, অবিকল এক গড়ন। ফিসফিস করল সে, বউ, চল আমার সঙ্গে, নিয়ে চল এখান থেকে।
ওরা লাইন পেরিয়ে আসতেই রাস্তা দু ভাগ হয়ে গেল। একটা রাস্তা চলে গেছে গুদামের দিকে অন্যটা চা বাগান পেরিয়ে হাইওয়েতে। আর এখানে মাদলের শব্দটা তীব্র হল। গুদামের পথটা ছেড়ে শুকরা বুড়ো অন্য রাস্তায় পা বাড়াতেই পেছন থেকে ডাকটা ভেসে এল। মালা চিৎকার করে উঠে ছুটে গেল পেছনে। শুকরা বুড়ো দুটো মুঠো চোখের ওপর তুলে আলো আড়াল করে দেখল একজন ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে। মালার পাশাপাশি সে হেঁটে এল শুকরা বুড়োর সামনে। চিনতে পারল শুকরা বুড়ো, নিরি। দু হাতে বুকের ওপর ধরে রেখেছে যাকে তার শরীর দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু কপাল আর ঘুমন্ত চোখ নাক স্পষ্ট। কালো হীরের মত ঝকঝকে।
শুকরা বুড়ো হাসল, খুঁড়ছি খুঁড়ছি, দেখতে পাবি কী আছে এতে?
কী আছে?
রেল দেখার মন্ত্র। কত্তো বছর জমিয়ে রেখেছি একে, আজকের জন্যে, এই দিনটার জন্যে। হাত লাগা না রে, আমি বুড়ো মানুষ, একা পারি?
শিরায় জড়ানো হাতের সঙ্গে কচি হাত যুক্ত হল। গর্ত বড় হচ্ছে তো হচ্ছেই। শুকরা বুড়োর মুখ এখন উদ্বেগে টান টান। আর তারপরেই সেই ভাঁড়টার মুখ দেখা গেল। হাসিতে মুখ ঢলো ঢলো এবার, সাবধান, সাবধানে তোল, ওইটার মধ্যে আমার সব আছে। নাতনির হাত সরিয়ে দিয়ে নিজেই ভাঁড়টাকে তুলল সে। নরম হয়ে গেছে কেন? কেন হাতের বাঁধনে শক্ত থাকছে না? স্পষ্ট মনে আছে একটা কাপড়ের পুটলির মধ্যে ভাঁড়টাকে রেখেছিল সে। কাপড়টাই বা নেই কেন? শুকরা বুড়োর মনে আছে ভাঁড়ের মধ্যে আর একটা ছোট্ট পুঁটলিতে ছিল সেগুলো। কিন্তু এখন ভাঁড় জমাট হয়ে আছে মাটিতে। এত মাটি কোত্থেকে এল? প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে যাচ্ছে আঙুলগুলো, কাঁপছে। বুকের মধ্যে পাহাড় ধসার টাল।
ওপরের স্তর সরিয়ে ফেলার পর মাটিটা যেন অন্যরকম দেখাতে লাগল। আর তারপরেই সেই নথটায় আলো লাগতেই চিকচিকিয়ে উঠল।
হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল শুকরা বুড়ো। খেয়ে নিয়েছে, মাটি সব টাকা খেয়ে নিয়েছে। মাথা ঠুকতে লাগল শুকরা বুড়ো গাছের তলায়। হেই বাপ যীশু, এই তোর মনে ছিল! এই মাটি আমার সব নিয়েছে, আমার বউকে, আমার যৌবন, জীবনকে। শেষতক আমার যাওয়ার টাকাকেও খেয়ে ফেলল গো। আমি কী করে জানব মাটির পেটে এত খিদে, সব খেয়ে নেবে সে?
নাতনির হাত পড়ল মাথায়। শুকরা বুড়ো জলমাটিতে নিকানো মুখ তুলে নাতনির দিকে তাকাতেই যেন স্ত্রীকে দেখতে পেল। তার চোখে জল দেখে সেই চোখও টলটলে। দু হাতে নাতনিকে বুকে জড়িয়ে ধরে আবার হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল শুকরা বুড়ো, আমার যাওয়ার টাকা সব মাটি হয়ে গেছে রে।
খানিক বাদে শুকরা বুড়ো আবার ভাঁড়টাকে পরম স্নেহে দু হাতে তুলে নিল। সেই টাকা আজ মাটি। এমন করে মায়ায় বাঁধে কেন মাটি? অথচ নথটার একটা কোণ এখনও চকচকে। সেটাকে জীর্ণ আঙুলে তুলে ধরল সে। খাঁজে খাঁজে মাটি জমে গেছে। এই নথ সেই মেয়ের নাকে ঝলসাত। বড় ইচ্ছে ছিল তার, শুকরা বুড়ো যখন টেবুয়ার মাটিতে গিয়ে শোবে তখন এই নথটাকেও যেন পাশে নেয়। তাহলেই তার ইচ্ছা পূর্ণ হবে। এখন তো আর টেবুয়াতে যাওয়ার কোনো উপায় থাকল না। কী করে এই নথটা সেই মাটিতে শোবে? কান্নাটা আবার বুক উপচে বেরিয়ে এল।
মালা বুঝতে পারছিল না। কিছু একটা ছিল বুড়া বাপের যা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এখন। যা না থাকায় রেল দেখা যাবে না। কিন্তু বুড়া বাপের হাতে ওটা কি? কী সুন্দর নথ! সে হাত বাড়াল। চমকে গিয়ে হাত সরিয়ে নিল শুকরা বুড়ো। মুখে বলল, না। কক্ষনো না। এটা তার নথ। আসল জায়গায় যাওয়ার জন্যে এতদিন বেঁচে আছে এটা। একদম হাত বাড়াবি না?
নিজের নাকের হলদে কাঠি গোঁজা ফুটোটা এখন খালি। নাক তার ফোঁটানো হয়েছে কিন্তু নাকছাবি কিনে দেয়নি কেউ। তার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল দাদুর হাত থেকে নথটাকে ছিনিয়ে নেয়। কিন্তু শুকরা বুড়োর হাতের আঙুলে যে এখন হাজার বাঘের শক্তি, কিছুতেই নথটাকে ছাড়ল না সে। চেষ্টা করেও যখন পারল না মালা তখন শুকরা বুড়ো উঠে দাঁড়াল। এক হাতে মাটি হয়ে যাওয়া টাকা অন্য হাতে নথ। বিড় বিড় করতে লাগল সে, রেলের বাবুকে গিয়ে বলব, আমার আর কিছু নেই রেলের বাবু; এই এমুঠো মাটি যা কিনা একদিন টাকা ছিল আর এই নথটা ছাড়া। নথটা তো দিতে পারব না, তোমার পায়ে পড়ি আমাকে টেবুয়াতে নিয়ে চল।
এখন আর তার হুঁশ নেই কিছু। লাঠিটা পিছনে পড়ে রইল। মালা দেখল বুড়া বাপ হাঁটছে একা একা। নিশ্চয়ই রেল দেখতে যাচ্ছে। সে ছুটে এসে বুড়োর কোমর ধরল। চমকে তাকাল শুকরা বুড়ো, সেই মুখ, অবিকল এক গড়ন। ফিসফিস করল সে, বউ, চল আমার সঙ্গে, নিয়ে চল এখান থেকে।
ওরা লাইন পেরিয়ে আসতেই রাস্তা দু ভাগ হয়ে গেল। একটা রাস্তা চলে গেছে গুদামের দিকে অন্যটা চা বাগান পেরিয়ে হাইওয়েতে। আর এখানে মাদলের শব্দটা তীব্র হল। গুদামের পথটা ছেড়ে শুকরা বুড়ো অন্য রাস্তায় পা বাড়াতেই পেছন থেকে ডাকটা ভেসে এল। মালা চিৎকার করে উঠে ছুটে গেল পেছনে। শুকরা বুড়ো দুটো মুঠো চোখের ওপর তুলে আলো আড়াল করে দেখল একজন ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে। মালার পাশাপাশি সে হেঁটে এল শুকরা বুড়োর সামনে। চিনতে পারল শুকরা বুড়ো, নিরি। দু হাতে বুকের ওপর ধরে রেখেছে যাকে তার শরীর দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু কপাল আর ঘুমন্ত চোখ নাক স্পষ্ট। কালো হীরের মত ঝকঝকে।