What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected বাসভূমি -সমরেশ মজুমদার 🌎 (2 Viewers)

গাছটার নির্দিষ্ট কোণে এসে শুকরা বুড়ো বসে পড়ল। হাত বাড়িয়ে মাটিটাকে স্পর্শ করল। আঃ কি আরাম। তারপর কোমর থেকে লোহার শিকটা বের করে গর্ত খুঁড়তে বসল সে। মালা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, মাটি খুঁড়ছ কেন?

শুকরা বুড়ো হাসল, খুঁড়ছি খুঁড়ছি, দেখতে পাবি কী আছে এতে?

কী আছে?

রেল দেখার মন্ত্র। কত্তো বছর জমিয়ে রেখেছি একে, আজকের জন্যে, এই দিনটার জন্যে। হাত লাগা না রে, আমি বুড়ো মানুষ, একা পারি?

শিরায় জড়ানো হাতের সঙ্গে কচি হাত যুক্ত হল। গর্ত বড় হচ্ছে তো হচ্ছেই। শুকরা বুড়োর মুখ এখন উদ্বেগে টান টান। আর তারপরেই সেই ভাঁড়টার মুখ দেখা গেল। হাসিতে মুখ ঢলো ঢলো এবার, সাবধান, সাবধানে তোল, ওইটার মধ্যে আমার সব আছে। নাতনির হাত সরিয়ে দিয়ে নিজেই ভাঁড়টাকে তুলল সে। নরম হয়ে গেছে কেন? কেন হাতের বাঁধনে শক্ত থাকছে না? স্পষ্ট মনে আছে একটা কাপড়ের পুটলির মধ্যে ভাঁড়টাকে রেখেছিল সে। কাপড়টাই বা নেই কেন? শুকরা বুড়োর মনে আছে ভাঁড়ের মধ্যে আর একটা ছোট্ট পুঁটলিতে ছিল সেগুলো। কিন্তু এখন ভাঁড় জমাট হয়ে আছে মাটিতে। এত মাটি কোত্থেকে এল? প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে যাচ্ছে আঙুলগুলো, কাঁপছে। বুকের মধ্যে পাহাড় ধসার টাল।

ওপরের স্তর সরিয়ে ফেলার পর মাটিটা যেন অন্যরকম দেখাতে লাগল। আর তারপরেই সেই নথটায় আলো লাগতেই চিকচিকিয়ে উঠল।

হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল শুকরা বুড়ো। খেয়ে নিয়েছে, মাটি সব টাকা খেয়ে নিয়েছে। মাথা ঠুকতে লাগল শুকরা বুড়ো গাছের তলায়। হেই বাপ যীশু, এই তোর মনে ছিল! এই মাটি আমার সব নিয়েছে, আমার বউকে, আমার যৌবন, জীবনকে। শেষতক আমার যাওয়ার টাকাকেও খেয়ে ফেলল গো। আমি কী করে জানব মাটির পেটে এত খিদে, সব খেয়ে নেবে সে?

নাতনির হাত পড়ল মাথায়। শুকরা বুড়ো জলমাটিতে নিকানো মুখ তুলে নাতনির দিকে তাকাতেই যেন স্ত্রীকে দেখতে পেল। তার চোখে জল দেখে সেই চোখও টলটলে। দু হাতে নাতনিকে বুকে জড়িয়ে ধরে আবার হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল শুকরা বুড়ো, আমার যাওয়ার টাকা সব মাটি হয়ে গেছে রে।

খানিক বাদে শুকরা বুড়ো আবার ভাঁড়টাকে পরম স্নেহে দু হাতে তুলে নিল। সেই টাকা আজ মাটি। এমন করে মায়ায় বাঁধে কেন মাটি? অথচ নথটার একটা কোণ এখনও চকচকে। সেটাকে জীর্ণ আঙুলে তুলে ধরল সে। খাঁজে খাঁজে মাটি জমে গেছে। এই নথ সেই মেয়ের নাকে ঝলসাত। বড় ইচ্ছে ছিল তার, শুকরা বুড়ো যখন টেবুয়ার মাটিতে গিয়ে শোবে তখন এই নথটাকেও যেন পাশে নেয়। তাহলেই তার ইচ্ছা পূর্ণ হবে। এখন তো আর টেবুয়াতে যাওয়ার কোনো উপায় থাকল না। কী করে এই নথটা সেই মাটিতে শোবে? কান্নাটা আবার বুক উপচে বেরিয়ে এল।

মালা বুঝতে পারছিল না। কিছু একটা ছিল বুড়া বাপের যা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এখন। যা না থাকায় রেল দেখা যাবে না। কিন্তু বুড়া বাপের হাতে ওটা কি? কী সুন্দর নথ! সে হাত বাড়াল। চমকে গিয়ে হাত সরিয়ে নিল শুকরা বুড়ো। মুখে বলল, না। কক্ষনো না। এটা তার নথ। আসল জায়গায় যাওয়ার জন্যে এতদিন বেঁচে আছে এটা। একদম হাত বাড়াবি না?

নিজের নাকের হলদে কাঠি গোঁজা ফুটোটা এখন খালি। নাক তার ফোঁটানো হয়েছে কিন্তু নাকছাবি কিনে দেয়নি কেউ। তার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল দাদুর হাত থেকে নথটাকে ছিনিয়ে নেয়। কিন্তু শুকরা বুড়োর হাতের আঙুলে যে এখন হাজার বাঘের শক্তি, কিছুতেই নথটাকে ছাড়ল না সে। চেষ্টা করেও যখন পারল না মালা তখন শুকরা বুড়ো উঠে দাঁড়াল। এক হাতে মাটি হয়ে যাওয়া টাকা অন্য হাতে নথ। বিড় বিড় করতে লাগল সে, রেলের বাবুকে গিয়ে বলব, আমার আর কিছু নেই রেলের বাবু; এই এমুঠো মাটি যা কিনা একদিন টাকা ছিল আর এই নথটা ছাড়া। নথটা তো দিতে পারব না, তোমার পায়ে পড়ি আমাকে টেবুয়াতে নিয়ে চল।

এখন আর তার হুঁশ নেই কিছু। লাঠিটা পিছনে পড়ে রইল। মালা দেখল বুড়া বাপ হাঁটছে একা একা। নিশ্চয়ই রেল দেখতে যাচ্ছে। সে ছুটে এসে বুড়োর কোমর ধরল। চমকে তাকাল শুকরা বুড়ো, সেই মুখ, অবিকল এক গড়ন। ফিসফিস করল সে, বউ, চল আমার সঙ্গে, নিয়ে চল এখান থেকে।

ওরা লাইন পেরিয়ে আসতেই রাস্তা দু ভাগ হয়ে গেল। একটা রাস্তা চলে গেছে গুদামের দিকে অন্যটা চা বাগান পেরিয়ে হাইওয়েতে। আর এখানে মাদলের শব্দটা তীব্র হল। গুদামের পথটা ছেড়ে শুকরা বুড়ো অন্য রাস্তায় পা বাড়াতেই পেছন থেকে ডাকটা ভেসে এল। মালা চিৎকার করে উঠে ছুটে গেল পেছনে। শুকরা বুড়ো দুটো মুঠো চোখের ওপর তুলে আলো আড়াল করে দেখল একজন ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে। মালার পাশাপাশি সে হেঁটে এল শুকরা বুড়োর সামনে। চিনতে পারল শুকরা বুড়ো, নিরি। দু হাতে বুকের ওপর ধরে রেখেছে যাকে তার শরীর দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু কপাল আর ঘুমন্ত চোখ নাক স্পষ্ট। কালো হীরের মত ঝকঝকে।
 
এই প্রথম নাতির বেটা পুতিকে দেখল শুকরা বুড়ো। এই কদিন কেউ তাকে নিয়ে যায়নি দেখাতে। তার ইচ্ছে হলেও এতদিন যে নিজেকে শাসন করছিল, আর মায়ায় জড়াস নে। এখন নাতবউ-এর মুখের দিকে তাকিয়ে সে দেখতে পেল যেন নতুন বৃষ্টি পেয়ে চা গাছের শরীর থেকে কুঁড়ি মুখ তুলছে। লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিরি বলল, আমিও যাব।

শুকরা বুড়ো জিজ্ঞাসা করল, খানিকটা অবাক হয়েই, কোথায়?

কোথায় আবার? সবাই যেখানে গেছে।

কেন যাচ্ছিস সেখানে?

বাঃ, আজ আমাদের জয়ের দিন আনন্দের দিন। এই প্রথম আমরা প্রমাণ করলাম আমরা পারি। এই জায়গা আমাদের, এখান থেকে আমাদের কেউ সরাতে পারবে না।

এই জায়গা আমাদের?

নিশ্চয়ই। জায়গাটাকে ভাল না বাসলে ওরকম কাজ কি কেউ করতে পারে? একেও নেয়ে যাচ্ছি তাই, বাপ কাকাদের কাজ দেখবে না ও?

শুকরা বুড়োর চোখ শূন্য। বুকের মধ্যে চৈত্রের আকাশ। মালা বলল, চল না, একবার দেখেই সেখানে যাব আমরা।

নিরি বলল, তুমি যাবে না নাতিদের দেখতে?

আর কোলের দশ দিনের বাচ্চাটা সেই সময় ট্যাঁ ট্যাঁ করে উঠতেই শুকরা বুড়ো চমকে গিয়ে হাত বাড়িয়ে তার গাল স্পর্শ করতে গেল। ঝুর ঝুর করে মুঠোর মাটি মাটিতে পড়ে গেলেও অদ্ভুত তুলতুলে গালের স্পর্শে বিদ্যুৎ বইল যেন ওর শরীরে।

দূর থেকে ওদের দেখতে পেয়ে কয়েকজন ছুটে গেল ভেতরে। আজ বাবুরা এসে গেছেন। তাঁরাও বিস্ময়ে তারিফ করছেন কুলিদের এই উদ্যোগকে। সিরিল তাই শুনছিল। খবরটা শুনতেই দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এল। এক হাতে বাচ্চা অন্য হাতের শুকরা বুড়োকে ধরেছে নিরি। শুকরা বুড়োর আর এক পাশে মালা। বুড়ো আসছে ফোকলা দাঁতে হাসতে হাসতে, এক পা এক পা করে। কথা বলতে বলতে। সিরিল বুঝল কথা হচ্ছে দশ দিনের শিশুর সঙ্গে। বাইরে জমজমাট। মেলার মানুষ অবাক হয়ে দৃশ্যটা দেখছিল। সিরিল আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। এক ছুটে দূরত্বটা অতিক্রম করে শুকরা বুড়োকে কাঁধে তুলে নিল। চমকে গিয়েছিল বুড়ো, নাতির গলা শুনে ধাতস্থ হল। মাথায় বুড়োকে নিয়ে এক পাক ঘুরে সিরিল চেঁচাল, তোমরা সবাই দ্যাখো। কে এসেছে, এই বুড়ো আশি সাল আগে এখানে এসেছিল। সঙ্গে সঙ্গে সবাই হইচই করে ওদের ঘিরে ধরল।

শুকরা বুড়ো ঘাবড়ে গেল খুব। কোনোদিন কেউ তার সঙ্গে কথা বলে না ডেকে, আজ এমন করছে কেন সবাই তাকে নিয়ে?

সিরিল বলল, বুঝতে পারছ না? তুমি এসে বীজ পুঁতেছিলে এখানে, আজ প্রথম সেই বীজের গাছে ফল ফলল।

শুকরা বুড়ো কাঁধের ওপর বসে জিজ্ঞাসা করল, তোরা সব নিজের হাতে করেছিস?

জরুর। শুধু সিরিল নয়, অনেকগুলো গলা থেকে শব্দটা বের হল। শুকরা বুড়ো শুধু বলতে পারল, আমি দেখব।

চারধারে টাটকা চায়ের গন্ধ ম ম করছে। একটাও মেসিন চলছে না এখন কিন্তু তবু বাতাসে কাজের স্পর্শ। শুকরা বুড়োর মনে হল অনেক দিন বাদে যেন নিজের ঘুরে চুল সে। কাঁধ থেকে তাকে মেঝের ওপর নামিয়ে দিতেই সে বিহ্বল চোখে চারপাশে তাকাল। চা-গুদামের কত পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। কত নতুন রকমের মেসিন, এমন কি জানলা দরজাগুলো পর্যন্ত অন্যরকম চেহারা নিয়েছে। এই গুদামে সে তিন কুড়ি বছর কাটিয়ে গেছে। হিসেবটা এখন অবশ্য মাঝেমাঝেই গোলমেলে হয়ে যায় তবু ওরকম একটা সময় তো বটেই। সে দেখল ছেলেরা তার দিকে মজার মুখ করে তাকিয়ে আছে। মুখ ঘোরালো বুড়ো, ওপাশে থাকে থাকে চায়ের বাক্স রয়েছে। সেদিকে দেখতে দেখতে তার মাথার ভেতর চিড়বিড় করে উঠল। কীভাবে প্যাকিং করেছে দ্যাখো, মুখ হাঁ করে আছে! বাতাস যদি ভেতরে ঢোকে তাহলে কি আর মুচমুচে চা থাকবে ঠিকঠাক! নড়বড়ে পায়ে এগিয়ে গেল সে। বাক্সটা হাত রেখে চিৎকার করে উঠল, কোন শালা হারামীর বাচ্চা এই কাজ করেছে? শুধু ফাঁকি দেবার মতলব, এটা কি প্যাকিং হয়েছে?

যেন আচমকা বোমা ফাটল। নিস্তব্ধ হয়ে গেল চারধার। কারো মুখ কথা সরছে না। সবাই বিস্ময়ে হতবাক। লাল চোখে ঘুরে দাঁড়াল শুকরা বুড়ো। সিরিল এগিয়ে গেল কাছে, কী হয়েছে?
 
হাড়িয়া খাওয়ার মত হাঁ হয়ে আছে বাক্সগুলো। ঠিক করো, জলদি জলদি ঠিকসে কাম করো। শুকরা বুড়ো ধমকাতেই ভুলটা চোখে পড়ল সবার। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন ছুটে গিয়ে বাক্স মেরামতের কাজে লেগে গেল। শুকরা বুড়ো এক একটা ভুল ধরিয়ে দিচ্ছে আর ছেলেরা খুশি মনে তাই সংশোধন করছে। একজন বুড়ো সর্দার পাশের মানুষকে বলল, সেকালের লোকের কাজের নমুনাই ছিল আলাদা, ফাঁকি পাবে না।

শুকরা বুড়ো মনে হল সে তার যৌবনে ফিরে গেছে। এমন আনন্দ সে গত কুড়ি বছরে পায়নি। যতই বদলাক, এই গুদামের গন্ধটা তো একই রকম আছে। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল সে। ঘুরতে ঘুরতে কোনার থামটার কাছে যেতেই সে থমকে দাঁড়াল। তখন তার বয়স কত? বড় জোর দেড়কুড়ি। গুলাং সাহেব ওই থামটার গায়ে বেঁধে বেত চালিয়েছিল তার ওপর। কারণ? দু মুঠো দামী চা হাতে নিয়ে সে বেরিয়েছিল গুদাম থেকে। বউটার বড় শখ ছিল সেই চা খাবার। চুরি করেনি। গুদামবাবুকে বলে কয়েই নিয়েছিল ওইটুকু চা। সাহেব সেসব কথা শুনতেই চাইল না। বেত চালিয়ে পুরো একটা দিন তাকে বেঁধে রাখা হয়েছিল থামটার গায়ে। রক্ত লেগেছিল থামটায়।

থামটার গায়ে হাত রাখল শুকরা বুড়ো। অবিকল একই চেহারায় আছে, শুধু রক্তের দাগটাই নেই। হঠাৎ কি মনে হল, থু থু ছিটোতে লাগল সে, বাঁ পা তুলে লাথি মারল মাটিতে। পেছনে ভিড় করে দাঁড়ানো মানুষরা অবাক হয়ে দেখল শুকরা বুড়ো থর থর করে কাঁপছে। সিরিল এগিয়ে গিয়ে তাকে ধরা আগেই শরীরটা বেঁকেচুরে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল।

হইহই করে উঠল সবাই। খবর পেয়ে মাংরা সর্দার ছুটে এসেছে। সিরিল গিয়ে সদ্য ফেরা ডাক্তারবাবুকে নিয়ে এসেছে এখানে। শুকরা বুড়ো অসাড় হয়ে পড়ে আছে, দুটো হাতের মুঠো বন্ধ। মালা তার বুকের পাশে। ইঞ্জেকসান দেবার পর চোখ খুলল শুকরা বুড়ো। তার শরীর এখন কাঁপছে, গলায় গোঁ গোঁ শব্দ।

কথা বলার আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও কথা বের হচ্ছে না। শুকরা বুড়ো অসহায় চোখে সামনের বিষণ্ণ মুখগুলোকে দেখল। এরা তাকে এত ভালবাসে? ওই যে সব নতুন নতুন লোকজন? সাহেবদের আমলে সবাই তাকে চাবুক মেরেছে, চাবুক মেরে কাজ করতে শিখিয়েছে। এমন করে কেউ ভালবাসা জানায়নি। শুধু একজন ছাড়া, যে মাটির তলায় শুয়ে আছে। কিন্তু সে ছটফট করছে না কেন মাটির তলায়? সারাজীবন যে তাকে খোঁচাতো টেবুয়াতে ফিরে যাওয়ার জন্যে, সে এখন শান্ত কেন? আজ এই মাটিতে শুয়ে তার ছোঁয়া পাচ্ছে বুঝি, তাই কি সে আজ এত শান্ত? এরও নাম কি ভালবাসা, এটাই কি আসল জায়গা?

চোখ খুলতেই চমকে গেল বুড়ো। দু চোখে জল কেন ওই শিশুর! নাকের পাটা ফুলছে। হলদে কাঠি বের করা ফুটোটায় কিছু নেই ওর। শুকরা বুড়ো সারাক্ষণের মুঠো করে রাখা হাতটা খুলল। কোনরকমে হাতের চেটোয় রাখা নথটা বাড়িয়ে দিল নাতনির দিকে। কচি হাতে মালা তুলে নিল নথটা। শুকরা বুড়ো বলল, পর, নাকে লাগা, আমি দেখি।

যতটুকু মাটি পরিষ্কার করা সম্ভব করে দু-একজন মালার নাকে নথটা পরিয়ে দিতেই বুক জুড়ে নীল আকাশ টলে উঠল শুকরা বুড়োর। চোখের সামনে তার বউ, যার নাকে এমনি করে নথটা ঝলসাত।

শুকরা বুড়োর মুখে কোনোরকম কুঞ্চন নেই। কারণ কেউ তার শিরায় শিরায় তখন ফিস ফিস করছিল, ঠিক জায়গায় গেছে গো নথটা। আমার বুক জুড়িয়ে গেল তাই। জানো বুড়ো, এই মাটি, এই চায়ের গন্ধ। এই ভালবাসা আরও ওই তোমার রক্ত নিয়ে গড়া কচি মুখের ওপর ঝকঝকে নথ-এর কাছে কোন টেবুয়া বড় হবে? এই আমাদের বাসভূমি গো, আমাদের স্বর্গ।

.

এই চা বাগানের ইতিহাসে এর চেয়ে বড় মিছিল আর কখনো হয়নি। সবাই, সাহেব বাবুরা থেকে ছোটসাহেব পর্যন্ত এসেছিল সেই মিছিলে। প্রবীণতম মানুষটি মাটির তলায় যাতে ভালভাবে ঘুমুতে পারে সেজন্যে ফ্যাক্টরির সামনে একটি বিশেষ জায়গা নির্দিষ্ট করা হল। তখন আকাশ জুড়ে একটি কালো শিশুর মুখ, যার চোখে জলের ধারা, নাকের পাটায় ভালবাসার হিরে জ্বলছে। সেই মুখের ভেতরে অস্পষ্ট সবুজ ঢেউ-খেলানো চায়ের বাগান। সেই মুখের একপাশ দিয়ে দীর্ঘ মিছিল এল মৃতদেহ নিয়ে। এসে সেই হিরের কাছে থমকে দাঁড়াল। এই দৃশ্য যারা দেখতে পেল তারা জানল, শেকড় নামিয়ে গাছ মাটির ভালবাসা নিল, নিয়ে বাঁচল।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top