What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected বাসভূমি -সমরেশ মজুমদার 🌎 (1 Viewer)

হাটের একপাশে টেনে নিয়ে গেল ওরা সিরিলকে। একজন সিরিলকে অভিনন্দন জানাল নিরিকে ঐভাবে তৈরি করার জন্যে। অত্যাচার করলে নিজের বাবাকেও যে ছেড়ে দেবে না এই সাহস এখন সমস্ত শ্রমিকের দরকার। ওরা ভাবছে নিরিকে নিয়ে একটা সভা করবে বড় মাঠে। নিরির সাহস যাতে অন্য মেয়েরা পায় সেই জন্যে এ রকম সভা হওয়া দরকার। কারণ সামনে খুব খারাপ সময় আসছে। মালিকের মতলব বোঝা যাচ্ছে না। বাগানে যে লাভ হয় তার সবই তো মালিকের ব্যাঙ্কে যায়। এবার বিশ পার্সেন্ট বোনাস চেয়েছে য়ুনিয়ন। যদি রফা না হয় তাহলে বাগান বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এজন্যে সমস্ত শ্রমিককে এক করা দরকার। সিরিল যেন আর গা এলিয়ে না থেকে য়ুনিয়নের সঙ্গে সক্রিয় সহযোগিতা করে। এ ব্যাপারে নিরিকে ও বুঝিয়ে সভায় আসতে রাজি করাক।

আগে হলে চটপট মনের কথা প্রকাশ করত সিরিল। আজকাল ভাববার সময় নেয় সব কিছুতেই। এতে অনেক সময় অপ্রিয় হবার দায় থেকে বাঁচা যায়। এর মধ্যে ওদের একজন বলল, তোরা শাদী করছিস কবে?

শাদী?

হুম। তোর মদৎ না থাকলে নিরি কখনো মাংরা সর্দারকে অপমান করতে পারে? তা আজ কী হল? একটু আগে দেখলাম মেয়েটা হিন্দুপাড়ায় রাস্তায় কাঁদতে কাঁদতে হেঁটে যাচ্ছে। আরে বাবা মেয়েটাকে ঘরে নিয়ে যা না বউ করে তাহলেই সব মিটে যায়। চাঁদ আকাশে ছাড়া থাকলে মেঘ তাকে ঢাকবেই!

ঠিকই তো! আর একজন টিপ্পনি কাটল, মাথার ওপর স্বামী নেই তাই এর ওর মাথা খাবেই তো মেয়েটা। তোর উচিত আর দেরি না করা।

ওদের কাছ থেকে সরে এসে সিরিল কিছুক্ষণ বুঝতে পারছিল না তার কী করা উচিত। নিরিকে ওর ভাল লাগে কিন্তু বিয়ে করার কথা চিন্তাও সে করেনি। তার ওপর মেয়েটার একটা স্বামী বেঁচে আছে বিনাগুড়িতে, সে শালা ঝামেলা পাকাতে পারে। কিন্তু মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে ওদিকে গিয়েছে কেন। ওই রাস্তায় মানুষজন এমনিতেই বেশি যেতে চায় না। একটু ইতস্তত করে সিরিল হাট ছেড়ে হিন্দুপাড়ার দিকে পা বাড়াল।

কিন্তু ব্যাপার স্যাপার ক্রমশ ঘোরালো হয়ে যাচ্ছে। বোনাসের দাবি নিয়ে এবার একটা জব্বর লড়াই হবে কোম্পানি আর শ্রমিকদের মধ্যে এসব অনেকদিন থেকেই শোনা যাচ্ছিল। কোম্পানি দিয়েছে সাড়ে আট পার্সেন্ট, য়ুনিয়ন চাইছে বিশ। দেড় গুণ। শালা, রক্ত দিয়ে চা তৈরি করি আমরা আর লাভের গুড় একলাই খাবে তোমরানা, এ হয় না। কিন্তু কাম বন্ধ হলে সেটা কতদিন চলবে। একটা শ্রমিক যদি তিনশ টাকা রোজগার করে তার দশ টাকাও মাসের শেষে ধার হয়। আর যদি এক মাস বন্ধ চলে তো হয়ে গেল। মালিকরা সেটা জানে বলেই এত জোর পায়। কিন্তু এবার কোন আপোস না, ইয়ে চা বাগান হামারা হ্যায়, আমাদেরও অংশ দিতে হবে এর লাভের। খুব জোর মালিক বাগান বিক্রি করে দিতে পারে। নতুন মালিককেও তো এটা মানতে হবে। দশটা বাঙালি বাবুকে রাতারাতি তাড়িয়ে নতুন বাবু বসাতে পারে কোম্পানি কিন্তু দেড় দু হাজার কুলি সরালে কাকে দিয়ে বাগান চালাবে? এর আগে একবার এ রকম হয়েছিল। কোম্পানির সঙ্গে গোলমাল লেগেছিল য়ুনিয়নের দার্জিলিং-এর কাছে এক বাগানে! বহুৎ ভারী ঝামেলা। কোম্পানি বাগান বন্ধ করল। সবাই বাগান থেকে পাতি তুলে এক জায়গায় জমা করে নিয়ে অন্য বাগানের কাছে সস্তায় বিক্রি করতে চাইল। অন্য বাগানের মালিক প্রথম প্রথম এ রকম পাতি দু হাতে কিনলেও পরে কি কারণে পিছিয়ে গেল। চায়ের পাতা তো আর মুখে ফেলে খাওয়া যায় না? অনেক মেশিনের কসরৎ ওকে দামি করে তোলে। সেই মেশিনটাই যদি তুলে নিয়ে যায় কোম্পানি তাহলে চা বাগান তো মাঠ হয়ে যাবে। হঠাৎ সিরিলের খেয়াল হল ওরা কেউ চাষবাস জানে না। সেই টেবুয়া থেকে চলে আসার পর, চাষবাসের আর প্রশ্নই ওঠেনি। এখন তার নিজের পক্ষেও চাষ করা অসম্ভব। বাপ তো প্রায় বুড়োই হয়ে গেল। এই চা-বাগান না থাকলে তার রোজগারের একমাত্র পথ হাটে বাজারে মাল বওয়া। না, এই চা-বাগানই তাদের প্রাণ, এটাকে মেরে ফেলে তারা বাঁচতে পারে না। দাদু যে টেবুয়াতে ফিরে যাওয়ার কথা সব সময় বলে, তা নিছক পাগলামি বলে মনে হয় সিরিলের। টেবুয়াতে ফিরে গেলে খাবটা কী! সেখানে তো চা-বাগান নেই।
 
চৌমাথা পার হতে গিয়ে মনে ঢেউ উঠল। অম্বিকার দোকানে আজ করনেশন রামটা আসার কথা। ভুটানের রাজার অভিষেকের সময় এই ব্র্যান্ডটা বাজারে ছেড়েছিল সামচির ডিস্টিলারি। প্রথম প্রথম খুব ডিম্যান্ড ছিল, চোখেই দেখা যেত না। এখন অম্বিকা মাঝে মাঝে আনায়। পানের দোকানের আড়ালে বারো টাকায় বোতল বিক্রি করে।

কোনো রকমে লোভ সামলাল সিরিল। সন্ধের পর দেখা যাবে। আগে নিরির ব্যাপারটা সামলানো যাক। পেট্রল পাম্প ছাড়িয়ে নির্জন পথটায় পড়ল সে। ছায়া ছায়া চার ধার। খুব চুপচাপ বলে পাখির গলা স্পষ্ট শোনায়। সিরিল ভেবেই পাচ্ছিল না এখানে নিরি কী জন্যে আসতে পারে। পিচের রাস্তাটা ছোট্ট বাঁক নিয়ে দু পাশে চা বাগান রেখে চলে গেছে বানারহাট বিনাগুড়ির দিকে। তবে কি ও বিনাগুড়িতে হেঁটে ফিরে যাচ্ছে? দূরত্ব এমন কিছু নয়। তিন ক্রোশ পথ হেঁটে অনেকেই যায়। কিন্তু সামান্য একটা রসিকতা শুনে ফেলে আসা স্বামীর ঘরে আবার ফিরে যাবে মেয়েটা? সিরিলের মনে হল তাই যদি যায় তো যাক। শান্তি না পাক স্বস্তিতে থাকুক। পরক্ষণেই খেয়াল হল যে স্বামীকে এত ঘেন্না করে ও চলে এল তার কাছে ফিরে যাওয়া মানে স্বেচ্ছায় নিজেকে মেরে ফেলা–কি একটা সিনেমায় এ রকম ঘটনা সে দেখেছে। ডায়লগটা ছিল, বিষ খেলে মানুষ জানার আগেই মরে যায়–আর এ মরণ তিলে তিলে প্রতি মুহূর্তের যন্ত্রণা নিয়ে। সিরিলের শরীরটা গরম হয়ে গেল। ও যদি যায় তো যেতে পারে কিন্তু যাবার আগেই সিরিল একবার প্রশ্ন করবে। যদি যাবেই তো এল কেন?

দু পাশে বড় বড় গাছ, কিছু জঙ্গল–মাঝে মাঝে হুম হাম গাড়ি ছুটে যাওয়া। বিকেল ফুরিয়ে আসছে। ডুয়ার্সে এখন বাঘ নেই। কিন্তু হাতির উপদ্রব বেশি। মাঝে মাঝে একলা হওয়া হাতি এসে জোর ঝামেলা করে। হিন্দুপাড়ার এই রাস্তায় মানুষ আসছে না ও রকম এক হাতির জ্বালায়। বুড়ো হওয়ায় দল ছাড়া হাতিটা শয়তানের চেয়ে বেশি বুদ্ধি ধরে। তিন তিনটে মানুষকে মেরেছে এক মাসে। হিন্দুপাড়ার এই জঙ্গলটা তার এলাকা। সাহেব শিকারি আনিয়েও ওকে মারতে পারেনি। জঙ্গলে খাবার না পেয়ে হাতির দল মাঝে মাঝে কুলি লাইন এমনকি এক রাতে বাজারের চৌমাথায় নেমে এসেছিল। তখন তাদের সামনে অতি মূর্খও দাঁড়াবে না। শিকারিরা আসার পরই সেই হাতিটা এমন গা ঢাকা দিয়েছিল যে কেউ আর তার সাড়াশব্দ পায়নি। কিন্তু সে আছে এখানেই। তাই সন্ধ্যে হয়ে আসা সময়ের নির্জন পথটায় নিরির দেখা যদি সে পায় তাহলে আর রক্ষে নেই এটা ভাবতেই সিরিলের বুকের রক্ত চলকে উঠল। বিনাগুড়ি নয়, নিরি কি ইচ্ছে করে এ রাস্তায় এসেছে? হাতিটা ওকে দেখতে পাক এটাই কি বাসনা?

পিচের রাস্তাটা এখন নাকবরাবর সিধে। অন্তত আধ মাইল স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। না, নিরি নেই। ওর হাট থেকে চলে আসা আর সিরিলের রওনা হওয়ার মধ্যেও সময়ে কি একটা মেয়ে আধ মাইল যেতে পারে? অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিল সে। নিরিকে যদি দেখতে না পায় আর। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় বিনাগুড়িতে পৌঁছে যাবে ও। সেখানে গিয়ে যদি শোনে নিরি চলে এসেছে তাহলে চুপচাপ ফিরে আসবে। ফিরে আসতে পারে যদি হাতিটার সঙ্গে দেখা না হয়।

একটু একটু করে কুয়াশা জমছে রাস্তায়। ফগ লাইট জ্বালাচ্ছে গাড়িগুলো! এখন অবশ্য গাড়ির সংখ্যা কম। শীত লাগছে সিরিলের। হাতের রেডিও আবার খুলতে গিয়ে মন পাল্টালো। গানের শব্দ শুনে হাতিটা যদি কাছাকাছি থাকে তবে আর দেখতে হবে না।
 
সিরিলের মনে হল রাস্তা না দেখে দু পাশের চা বাগানগুলো দেখলে হয়। কেউ যদি ইচ্ছে করে লুকোতে চায় তাকে ভগবানও খুঁজে বের করতে পারবে না। কিন্তু তবু–। চট করে বাঁদিকের। নীচু-ডাল একটা কাঁঠাল গাছে উঠে পড়ল সে। ট্রানজিস্টরকে বেলটের হুকে আটকে তর তর করে অনেকটা ওপরে উঠে চার পাশে চোখ বোলাতে লাগল। এদিকটা চা বাগান বেশি চওড়া নয়। শ দুয়েক গজ পরেই ফরেস্ট শুরু। সন্ধ্যে নামল বলে। হতাশ হয়ে নামবার আগে বিন্দুটা চোখে ঠেকল। ভাল করে ঠাওর করতে গিয়ে মেরুদণ্ডে কনকনানি টের পেল সিরিল। অন্তত পাঁচ মিনিটের পথ ছাড়িয়ে চা বাগানের ওপাশে জঙ্গলে যেটা স্থির কালো জমাট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেটা যে ওই একলা হাতিটাই এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ সে। অমন স্থির হয়ে আছে কেন হাতিটা? আরো কয়েক মিনিট সে লক্ষ্য করল। এত নিশ্চল যে চট করে মনে হবে জঙ্গলেরই একটা অংশ। তার সঙ্গে যে দূরত্ব তাতে বিপদের কোনো আশংকা নেই। তাছাড়া এত ওপরে হাতি নাগালও পাবে না। কিন্তু তেমন হলে সারা রাত সে আটক থাকলে পারে এখানে–সেটাই সমস্যা কিন্তু হাতিটা নড়ছে না কেন? কি দেখছে? হঠাৎ চিৎকার করে উঠল সিরিল। গাছের ডালে বসে দুটো হাতে মুখের দু পাশ ঢেকে উৎকট শব্দ বের করল। সেই সঙ্গে ট্রানজিসটার চালিয়ে দিল পুরো শক্তিতে। আর এটা করতেই সে চমকে উঠল। হাতিটা নড়ে উঠেছে। যেন কোনো কিছুতে একাগ্রতা ভাঙতেই তার চাঞ্চল্য। এক পা এগিয়েই মত পরিবর্তন করল। সিরিল বিস্ময়ে ওর পাহাড়ের মত আকৃতিটা স্পষ্ট দেখতে পেল এবার। হয়তো কোনো বিপদের গন্ধ পেয়েই ঘুরে গেল হাতিটা। তারপর জঙ্গল ভাঙতে ভাঙতে উল্টোদিকে দৌড় শুরু করল। কিছুক্ষণ পর তার চিহ্ন দেখা গেল না, শব্দও মিলিয়ে গেল। এবার সিরিলের চোখ যার দিকে সে কিন্তু তাকে দেখতে পাচ্ছে না। নিরির লম্বা শরীরটা এখন সোজা দাঁড়িয়ে হাতিটার কাছ থেকে ওর দূরত্ব পঞ্চাশ গজও ছিল না। এত কাছাকাছি গিয়েও বোধ হয় হাতিটাকে দ্যাখেনি নিরি। ওখানে নিশ্চয় একটা ছোট ঝরনা আছে যেগুলো চা বাগানের মধ্যে দিয়ে চুপচাপ বয়ে যায়। নিরিকে এতক্ষণ দেখা যায়নি কারণ সে ঝরনার পাশে বসেছিল। হাতিটা অবশ্যই তাকে দেখেছে। কিন্তু দেখেই খেপে গিয়ে আক্রমণ করেনি, তারিয়ে তারিয়ে দেখছিল। কিন্তু ওখানে গিয়ে বসা মানে মৃত্যু ফণায় চুমু খাওয়া নিরি কি তা জানত না?

নিরি ঘাড় ঘুরিয়ে সামনে পেছনে তাকাচ্ছে। ততক্ষণে সে বুঝতে পেরেছে তার যম কত কাছে ছিল! চিৎকার করেছে কিনা শুনতে পায়নি সিরিল কিন্তু হঠাৎ পাগলের মতো দৌড়তে দেখল শরীরটাকে। আতঙ্কিত হলে যেভাবে মানুষ দৌড়ায়। সিরিল গাছ থেকে নেমে চা বাগানের মধ্যে ঢুকে পড়ল। যদিও হাতিটা এখন দৃষ্টিসীমার মধ্যে নেই তবু এ রকম অবস্থায় যে কোনো রকম দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। রাস্তাটার আড়াআড়ি চা-বাগানের মধ্যে দৌড়ে যাচ্ছে নিরি। সিরিল চিৎকার করে তাকে ডাকল। হঠাৎ যেন পাথর হয়ে গেল মেয়েটা! দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখল। সিরিল বুঝতে পারল ভীষণ অবাক হয়ে গেছে মেয়েটা। দূরত্বটা অনেক হলেও সিরিলকে সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। সিরিল কাছাকাছি হতেই নিরি এক ঝটকায় নিজেকে সচেতন করে আবার পাগলের মত দৌড়তে লাগল। হঠাৎ এ রকম কাজের পেছনে কি যুক্তি থাকতে পারে বোধগম্য না হওয়ায় সিরিল আরো গতি বাড়িয়ে সামনে চিৎকার করে ওকে ডাকতে লাগল।

চা-বাগানের মধ্যে যে পায়ে চলার পথ সেগুলো গোলকধাঁধার মত। স্বচ্ছন্দে অনেকটা ঘুর ঘুর করা যায়। এই নির্জন সন্ধ্যা হওয়া সময়টা দুটো শরীর সেই গোলকধাঁধার পথে ছুটতে ছুটতে ক্রমশ কাছাকাছি হয়ে এল। মাথার ওপর ঘরে-ফেরা পাখির অজস্র চিৎকার, শরীরের ওপর দিয়ে ফিনফিনে কুয়াশারা গড়িয়ে যাচ্ছে। সিরিল এক সময় নিরির কাধ ধরে থামাতে চাইল। এতক্ষণে ওরও বেদম অবস্থা। আটক হওয়া মাত্রই নিরি প্রচণ্ড এক ঝটকায় নিজেকে সরিয়ে নিতে চাইল। সিরিলের হাত সরিয়ে দিয়ে সে যখন সরে যাচ্ছে তখন সিরিল আবার তাকে ধরল, কি হল তোমার–এমন করছ কেন?
 
মুখে কোনো উত্তর না দিয়ে সজোরে নিজেকে মুক্ত করল নিরি। প্রচণ্ড রাগ হয়ে গেল সিরিলের। আশ্চর্য বেয়াদপ মেয়ে তো! রাগ হলে সিরিল নিজেকে সামলাতে পারে না। সজোরে চড় মারল সে নিরিকে। মুখ সরিয়ে নেওয়ায় আঘাতটা জোরালো হল না। কিন্তু প্রতিক্রিয়া হল মারাত্মক। বাঘিনীর মত ঝাঁপিয়ে পড়ল নিরি। মেয়েটা বেশ শক্তি ধরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুটো শরীর ধস্তাধস্তি করে পরস্পরকে আঘাত করার চেষ্টায় নিয়োজিত হল। এর মধ্যে সিরিলের ট্রানজিসটারটা মাটিতে বেল্ট থেকে খুলে পড়ে গেছে। কাপড় খানিকটা ছিন্ন হয়ে অসংলগ্ন নিরি ক্রমশ হিংস্র হয়ে উঠেছে। পরস্পরের আঘাতগুলো নির্দ্বিধায় চলছিল। সিরিলের মাথায় এখন কোনো যুক্তি কিংবা আবেগ কাজ করছিল না। একটি অবাধ্য মেয়েকে শক্তির মাধ্যমে সমুচিত শিক্ষা দেওয়াই প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এর মধ্যে নিরি তাকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। সিরিলের আঘাতে ওর ঠোঁটের কোল রক্তাক্ত। হঠাৎ নিরি শক্ত হয়ে গেল। এ রকম নিশ্চল হয়ে যাওয়া মাত্র সিরিলের সমগ্র সত্তা চমক খেল। সে আবিষ্কার করল তার একটি হাত নিরির অর্ধ উন্মুক্ত স্তনের ওপর। এতক্ষণ যে রকম শারীরিক সংঘর্ষ চলছিল তা থেকে এই অনুভূতিটা আলাদা। সিরিলের সমস্ত শরীরে আঘাতের বেদনা ছাড়িয়ে এক অন্য রকম অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল। মেয়েদের স্তন। সম্পর্কে তার এই বয়সে অভিজ্ঞতা হয়েছে। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে মনে হল তার শরীরে অজস্র জোনাকি জ্বলছে আর নিভছে। এই যে নিরির নিথর হয়ে যাওয়া, একি আহ্বান? কারণ নিরির দুটো চোখ এখন বন্ধ। রক্তে ভেজা লাল ঠোঁটের কোণের অদ্ভুত সুখের ভাঁজ। হাতের মুঠোয় দুটো নরম স্বপ্ন পরম আবেগে লালন করতে করতে সিরিল আবিষ্কার করল তার পিঠের ওপর দুটো সাপের মত হাতের আঁটোসাঁটো বাঁধন আরো তীব্রতর হচ্ছে। যে দুটো হাত এতক্ষণ আক্রমণে ভয়ঙ্কর ছিল তাই এখন ফুলের ডালের মত থরথরিয়ে কাঁপছে। সিরিল একটু একটু করে ডুবতে লাগল। এই উন্মুক্ত নির্জন চরাচরে, পাখির চিৎকার আর কুয়াশার চাদর মোড়া চা-বাগানের সরু রাস্তায় সে নিরির ঝরনায় পাথরঠোকা মাছের মত ঘুরে বেড়াতে লাগল পরম বিস্ময়ে। তার প্রতিটি পদক্ষেপ যেন অতি যত্নে নিরি আগলে আগলে নিয়ে যাচ্ছে চরম লক্ষ্যের দিকে। কেউ কোনো কথা বলছে না। কথা যখন মরে যায় তখনই বোধহয় এই রকম আনন্দ জন্ম নেয়। নিরির শরীরে নিজেকে প্রবলভাবে আবিষ্কার করল সিরিল।

টিপিয়ে টিপিয়ে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় কুয়াশারা পালাচ্ছে। আকাশটা যেন অতি দ্রুত নীচে নেমে এসেছে। চারপাশে এখন দৃষ্টি যায় না। অন্ধকার গাছের মাথা থেকে বুঝুরু করে মাটিতে ঝরছে। চোখের দৃষ্টি সহজ হলে সিরিল দুহাতের অঞ্জলিতে নিরির মুখ ধরে পরমতৃপ্তিতে চুম্বন করল। নিরির গলায় একটা অস্ফুট আদুরে শব্দ যার মানে পৃথিবীর কোনো কথায় ব্যক্ত করা যায় না। সিরিল শব্দটাকে উপভোগ করে উঠে বসতে গেল। কিন্তু নিরির হাতের বাঁধন শিথিল হতে চাইছে না।

সিরিল বলল, এবার উঠব।

চোখ না খুলে নিরি পাখির মত নরম গলায় বলল, না।

কেন?

আরো একটু থাকো।

বৃষ্টি পড়ছে।

পড়ুক।

রাত হচ্ছে।

হোক।

সিরিলের মনের কোথাও যে চিন্তাটা ছিল না হঠাৎ সেটা উদয় হতে সে শক্ত হল। সেই একলা হাতিটা দুদ্দাড় করে ছুটে পালালেও যদি আবার চুপচাপ ফিরে আসে? ওর মতন ধূর্ত প্রাণী এ তল্লাটে কখনো আসেনি। এখন যদি সে এখানে উপস্থিত হয় তাহলে এ অবস্থায় ওদের কিছুই করার থাকবে না। স্বচ্ছন্দে একটা পা যদি ওদের শরীরে তুলে দেয় তাহলে ওকে আর নিরিকে হয়তো আলাদা করে চেনাও যাবে না। এভাবে শুয়ে থাকা মানে মৃত্যুকে ডেকে আনা। এতক্ষণের উত্তেজনায় যে চিন্তা একবারও মাথায় আসেনি, সেটা সিরিলকে অস্থির করল।

যেন খুব জেদী ছেলেকে ভোলাবার গলায় সে বলল, ওঠো।

ন্ না।

সেই হাতিটা এ অঞ্চলেই আছে। যদি আসে তাহলে মরে যেতে হবে।

যাব।

মানে?

আজ থেকে তো আমি মরেই গেলাম।

সেই বৃষ্টিঝরা সন্ধ্যায় চা-বাগানের মাটিতে নিরির দুহাতের বাঁধনে শুয়ে সিরিল বুক ভরে ভালবাসা নিতে লাগল। ওর হঠাৎ মনে হল দাদু একদম ভুল কথা বলে। এই চা বাগান, যার গন্ধ এখন নাক জুড়ে, নিরি থাকলে তা কখনো বিদেশ হয়?
 
কুলি লাইনে রটে গেল ছোট সাহেব চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন। ব্যাপারটা এতখানি অবিশ্বাস্য যে চট করে কেউ মানতে চাইল না। খবরটা শুকরা বুড়ো কানে গেলে সে হকচকিয়ে গেল। আজ সকাল থেকে কুলি লাইন অন্য একটা ব্যাপারে টগবগে ছিল। সন্ধ্যায় পঞ্চায়েতের মিটিং ডাকা হয়েছে বুকু সর্দারের অনুরোধে। লাইনের সব চেয়ে বুড়োর মানুষ হিসেবে শুকরাকে সে সময় থাকতে হবে। পঞ্চায়েত বসে এই গাছতলায় মাচাটাকে ঘিরে। বুকু সর্দারের সমস্যা ওর মেয়েকে নিয়ে। মেয়ে জামাই-এর ঘরে যাবে না আর জামাই মাঝে মাঝেই এখানে এসে ঝামেলা। করছে। মেয়ের বদলে এটা ওটা দাবি করছে। পঞ্চায়েতের মিটিং বলেই শুকরা একটু আগে গোটা দুয়েক নিটোল বিড়ি পেয়েছে বুকুর কাছে। খেতে মায়া হল বলে সে দুটো দুকানে খুঁজে রেখেছে সে। রেখে উবু হয়ে বসে ছিল মাচায়। আর মাঝে মাঝে চিৎকার করছিল, মালা– এ মালা! ত্রিসীমানায় মেয়েটার চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল না যদিও। ঘড়ির টিকটিকের মত এক নাগাড়ে ডাকাটা থামাল সে একটা ধমকে। ধমকটা নাতির সেটা বুঝতে পেরে কুঁকড়ে বসল সে।

সিরিল ধমকালো, নিজের গলা কানে যায় তোমার?

হারামি এক নম্বরের হারামি। বিড় বিড় করল শুকরা।

খামোকা গালাগালি করছ কেন?

বেশ করব একশবার করব! শালারা নিজেরাই খাবে আমাকে দেবে না। আরে আমি না থাকলে তোর বাপ জন্মাত? তুই জন্মাতিস? এখন যে তোর এত বোলচাল সে আমারই জন্যে এটা মনে রাখিস?

কী হল তোমার? শর্টকাট করো মাইরি।

মাংস এসেছিল না ঘরে?

মাংস?

শালা আকাশ থেকে পড়ল যেন। তোর বাপ যে সাপটাকে মেরেছিল তার মাংস এসেছিল? সেটা গেল কোথায়? এই বুড়োটার কথা না-হয় ছেড়েই দিলাম, ওই ছুঁড়িটাকেও দিলি না? আরে ও তো নিজের বোন। সব নিজেরাই সাঁটালি! হ্যাঁরে, সাপটার শরীরে চর্বি ছিল?

থুঃ থুঃ! শালা যত জংলী আদমীকো ঝামেলা! তুম আদমী হ্যায় না পাজামা? সাপের মাংস কি ভদ্রলোক খায়? সব ফেলে দিয়েছি আমি।

ফেলে দিয়েছিস? হায় কপাল! সাপের মাংস খেলে জীবন বাড়ে, যৌবন লম্বা হয়। তিন তিনটে মেয়েকে কাহিল করে দিতে পারতিস একা, ও ভগবান, কি গাধা!

একটা মেয়েকে পারি না তো তিনটে, সাপের মাংস দেখলেই ঘেন্না করে। যখন জংলী ছিলে তখন খেতে। এখন ভদ্রলোক হতে হলে ওসব খাওয়া চলবে না।

ভদ্ররলোক? কে ভদ্দরলোক?

কেন আমরা।

আমরা? তুই! খিলখিল করে ফোকলা মুখে হাসি উপচে এল। কিছুতেই বাগ মানে না, ভেঙেচুরে যাচ্ছে হাসির দমকে, শেষে সেটা কাশিতে গিয়ে শেষ হল। কাশতে কাশতে দম বন্ধ হবার জোগাড়। কোনোক্রমে সেটা থামলে বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে নিতে শুকরা বুড়ো বলল, মদেসিয়ারা ভদ্রলোক? তাহলে বাবুরা কী?

ওরা ভদ্রলোক!

ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাল শুকরা, আমরা আর ওরা এক?

আলবৎ এক।

আমি থাকব না এখানে। আমি চলে যাব। পাপ, পাপে ভরে গেছে জায়গাটা নইলে তুই একথা মুখে আনিস! হাত বাড়িয়ে লাঠিটা নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করল শুকরা বুড়ো। সিরিল হাসছিল, কোথায় যাবে? তোমার গ্রাম টেবুয়াতে?

হাঁ হাঁ জরুর। টেবুয়া আমার গ্রাম। আমার বাপ জন্মেছে তারও বাপ। এ চা বাগান আমাদের জায়গা নয়। এখানে নকরির জন্যে এসেছিলাম। এখানে তোরা ভদ্দরলোক হচ্ছিস, সাহেব চাকরি ছেড়ে দিয়ে মদেসিয়া হয়ে যাবে বোধহয়। ওরে নাতি, তুই আমাকে একটা ভিক্ষে দে। কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল শুকরা বুড়োর গলা।

কী?

আমাকে ইস্টিশানে নিয়ে গিয়ে রাঁচির রেলে তুলে দে।

তুলে দিলে যেতে পারবে?

সে পারব।

টিকিট?

চকিতে সামলে নিল শুকরা বুড়ো। মাটিতে পোঁতা টাকাটার কথা জিভে এসে গিয়েছিল প্রায়। মুখে বলল, রেলবাবুর পায়ে পড়ব।

ওখানে গিয়ে কী করবে? খাবে কী? দেখবে কে?

ওখানকার মাটি জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকব।

ব্যাস! তাতেই পেট ভরবে?

ভরবে রে ভরবে। সে মাটি কি তাই তুই জানিস না। যাবি আমার সঙ্গে?

ধ্যুৎ। আমি এখানে জন্মেছি, আমার বাপ জন্মেছে এখানে, এ জায়গাটাই আমার দেশ। চা পাতার গন্ধ নাকে না গেলে সে জায়গাটাকে বিদেশ ঠেকে। শোন বুড়ো, তোমার কোথাও যাওয়া চলবে না। অন্তত আজকের রাতে আগে নয়।

কেন? আজকের রাতে কী?

আঃ, ভুলে গেলে পঞ্চায়েত বসবে না?

তোর বাপের কী?

বাপের না আমার!

বুকু সর্দারের মেয়ে মরদের-ঘর করবে না তার মধ্যে তুই এলি কোত্থেকে?

হাসল সিরিল, রাত্তিরে ঢিবরি জ্বালা হয় কেন? ঘর আলো করতে তো! সেটা দিনের বেলা জ্বলে না কেন? না সূর্য উঠে গেছে তাই।

তার মানে? শুকরা বুড়ো রহস্য বুঝতে পারে না।

সিরিল এক হাতে বুড়োর মাথাটা জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, আমার রক্ত ওর শরীরে দিয়ে দিয়েছি। সূর্যটা আমি, বুঝলে।
 
প্রায় ঝটকা মেরে সোজা হয়ে দাঁড়াতে চেষ্ট করল শুকরা, দেবার আগে আমাকে একবার জিজ্ঞাসা করলি না কেন?

কেন? এসব কেউ কাউকে বলে নাকি?

আমি মেয়েটাকে একটু ভাল করে দেখতাম আগে।

হো হো করে হাসতে লাগল সিরিল, দেখো আজ রাত্রে, ওই যা, তুমি তো আবার রাত্রে দেখতেই পাও না। তবু–। আর হ্যাঁ, একথা কাউকে বলো না, যদি শুনি বলেছ তাহলে তুলব আর আংরাভাসায় ফেলে দেব।

আর যদি না বলি, তাহলে রেলে চড়িয়ে দিবি, বল, কথা দে।

বেশ দেব। অন্তত যে যেখানে গেল সুখী হয়, যার যেটা দেশ সে সেখানে যাক। কিন্তু আমি যাব না, এটা আমার দেশ।

না, এটা বাংলার দেশ। সাহেবদের আর বাবুদের জায়গা।

সাহেব, সাহেব কে? এই ছোট সাহেব, গাড়ি চালাত বাংলোয় থাকত হুকুম করত আগে হলে চাবুক মারত সে আজ থেকে সেসব আর কিছুই থাকবে না। একদম বাজারকা আদমি হো যায়ে গা।

কেন? লোকটা কি পাগল না বোকা? কক্ষনো শুনিনি এমন কথা। লোকটা কি গান্ধী মহারাজের চেলা?

সেটা আবার কে? মেয়েছেলে আবার মহারাজ হয় নাকি? গান্ধী তো মেয়ে-ছেলে, এই দেশের রানি। ওর পার্টির লোকদের তত শক্তি বেশি। না তার কেউ নয় ছোটাব। ঠিক আছে, এখন তো আর সাহেব থাকছে না ছোট সাহেব, আমি নিজের মুখে জিজ্ঞাসা করব কেন চাকরি ছাড়ল? আঁ! বিড়ি খাবে?

ঘাড় নাড়ল শুকরা বুড়ো,না। দুটো চোখের পাতা বন্ধ করে ভাবতে বসল সে। এটা কি কখনো সম্ভব? ম্যাকফার্স সাহেব, গেলি সাহেব, ওনিল সাহেব, কি কি ভারী ভারী চেহারা সব–কেউ কি কখনো বুড়ো হবার আগে চাকরি ছেড়ে চলে গেছে? কালে কালে কি হল! গান্ধীবাবার নাম শুনেছিল সে অনেক আগে। নাকি সাহেবদের তাড়াতে চায়। বাংলোয় বসে সাহেবরা নাকি এইসব বলে হাসিঠাট্টা করত। তার চেহারা দ্যাখেনি শুকরা। অথচ আজ নাতি বলল সে নাকি মেয়েছেলে, এই দেশের রানি। তাহলে তার বয়স কত? মেয়েছেলে বলেই কি এতদিন বেঁচে আছে! তা কি করে হয়! তাহলে তো ও মেয়েটাও এখন বেঁচে থাকত! অনেক দিন পরে পাঁজর ঝাঁপিয়ে নিঃশ্বাস ছিটকে বেরিয়ে এল। মৃত স্ত্রীর মুখটা মনে পড়ে না আজকাল। কিন্তু তার স্পর্শ গন্ধ সব যেন অনুভবে ছড়িয়ে। নাতি বলেছে রেলে তুলে দেবে। যীশু প্রভু যীশু, তোমার অসীম দয়া। চোখ খুললো বুড়ো, কেউ নেই সামনে। সিরিলটা কোন ফাঁকে উঠে গেছে। যাওয়ার সময় বলারও প্রয়োজন মনে করে না। মানুষ বলে ভাবে না তাকে। আবার ভদ্দরলোক হবার ইচ্ছে। চিৎকার শুরু করল শুকরা বুড়ো, মালা, এ মালা–আ। কয়েকটা মিনিট পার হয়ে গেল ডাকের তালে তালে, পায়ের শব্দ হল। নাতিনিটা ছুটে আসছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, খাও।

দুটো শুকনো রুটি হাতে নিয়ে নাতনির মুখের দিকে তাকালো বুড়ো। মালার দু কানের লতিতে হলুদ মাখা কাঠি বেঁধানো। কান ফুটিয়েছে ও।

চা বাগানের মাঝখানে বেশ কিছুটা জায়গা খাসমহলের দখলে। ওখান যারা বাস এবং ব্যবসা করে তারা চা বাগানের অধীনে নয়। যা কিছু হাট বাজার দোকানপাট সব এখানেই। সরকার নিয়মিত খাজনা আদায় করে থাকেন। পাকিস্তান হবার পর একটু একটু করে মানুষজন এখানে এসে বেশ জমজমাট করে তুলেছে। ন্যাশনাল হাইওয়ের দুপাশে এই ছোট্ট বসতিতেই ভাটিখানা। ছোটসাহেব সেখানেই একটা কারখানা খুলল। মোটরসারাই-এর কারখানা। লোকটাকে এখন আর চেনা যায় না। যখন খাটে তখন সারা শরীরে কালি মেখে মিস্ত্রি হয়ে যায়। এই কাজটা এত ভাল জানা ছিল, না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। একদিন সিরিল গেল তার সঙ্গে দেখা করতে।

অবশ্যই এই কদিন ছোটসাহেবকে কম হাঙ্গামা পোয়াতে হয়নি। দলে দলে বাগানের কুলিরা। এসে ভিড় করেছে কারখানার সামনে। অবাক হয়ে দেখেছে ছোটসাহেবের পরিবর্তন। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেননি অনেকে। এরকম হয়? যদিও আর চা বাগানে নেই তবু লোকে এমনকি বাবুরাও ওকে ছোটসাহেব বলেই ডাকছে। অন্য নাম ভাবা মুশকিল। কুলিরা দেখেছে ছোটসাহেবকে মোটেই অখুশি দেখাচ্ছে না। শিস দিয়ে কাজ করছে। মাঝে মাঝে ওদের সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছে। দশ-বারোটা লোককে কারখানায় কাজ দিয়েছে। বিস্ময় বেশিদিন জীবিত থাকে, শেষে এটাও গা সওয়া হয়ে গেল। কিন্তু ছোটসাহেব কেন চাকরি ছাড়ল এটা অনেকের কাছে স্পষ্ট হল না। নানান গল্প ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। চা-বাগানে আজকাল চুরি না করলে চাকরি যায় না। ছোট সাহেব কি চুরি করেছে? সাহেবরা চুরি করে এটা সর্দাররা জানে, কিন্তু ওটা এত বড় চুরি যে তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। এতো আর গুদাম থেকে পাতি কোঁচড়ে বেঁধে চুপচাপ সরে পড়া নয়। ছোটসাহেব কারখানা খোলার পর দেখা গেল অন্যান্য সাহেবরা সামনের বড় রাস্তা দিয়ে গাড়ি ছুটিয়ে চলে যান, এককালে যে চিনতেন তা ভাবগতিকে দেখে বোঝা যায় না। আর একটা মজার ব্যাপার দেখা গেল। এতকাল বাংলোয় ছোটসাহেব একা ছিল কিন্তু চাকরি ছেড়ে দেবার পর কারখানার ওপর যে ঘরখানা ভাড়া করে আছে সেখানে প্রতি শনিবার এক বুড়ি জলপাইগুড়ি থেকে এসে থাকে আবার রবিবার বিকেলে চলে যায়। সবাই জেনে গেল ওই বুড়ি নাকি ছোটসাহেবের মা।
 
সিরিল গিয়েছিল নেশা করে। পা টলছে মাথা ঠিক। ট্রানজিস্টার খারাপ হয়ে যাওয়ায় হাত খালি। খালি ছিল কারখানাও। কারণ সকাল থেকেই টুপুস টাপুস করে বৃষ্টি ঝরছে। তখন ঠিক বিকেল নয় কিন্তু মেঘগুলোর জন্যে সন্ধের চেহারা চারধারে। সিরিলকে দেখে ছোটসাহেব চিৎকার করে ডাকল, কতখানি খেয়েছিস?

পুরা বোতল! সিরিল দুটো হাতের মাপে বোতলটাকে বোঝাবার চেষ্টা করল।

ব্যস? তাতেই এই অবস্থা! হাসছিল ছোটসাহেব। দেখে রাগ হয়ে গেল সিরিলের। ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, এ হাঁড়িয়া না ভুটানকা ইংলিশ হুস্কি।

ও তাই বল, তাহলে তো নেশা হবেই। তারপর কী মনে করে?

তুই বাগানকা নোকরি ছেড়ে দিলি কেন?

সবাই সব কিছু পারে না, আমিও পারছিলাম না।

ঝুটা বাত। যে মিস্ত্রি হতে পারে সে রাজার চাকরি ছাড়ে না।

ছোটসাহেব একটু টুল টেনে বসে ওকে কিছুক্ষণ দেখে বলল, ঐ বাক্সটার ওপর বোস। কাঠের বাক্সটা পাশেই ছিল, সিরিল সেটায় বসতে গিয়েও বসল না। ছোটসাহেবের সামনে এভাবে বসাটা ঠিক হবে না। বাংলোয় গেলে ওরা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে পারে না পর্যন্ত আর এখন সমান হয়ে বসবে?

ছোটসাহেব ধমকে উঠল, কী হল বসতে বলছি না?

সিরিল বিড় বিড় করল, আমি তো কুলি–

ছোটসাহেব বলল, আমি কে? আমিও তো মিস্ত্রি। বসে পড়। নইলে যেকম পা টলছে তোর কখন আমার ঘাড়ে এসে পড়বি।

তাই তো! সিরিলের মাথায় কথাটা ঢুকল। এখন তোর আর এই লোকটা বাগানের সাহেব নয়। এর সামনে বসতে আপত্তি কী! ভাবা মাত্রই ধপাস করে বাক্সটায় বসে সে জিজ্ঞাসা করল,

তুই কি চুরি করেছিস?

চুরি? মানে? ছোটসাহেব হাঁ হয়ে গেল।

চুরি না করলে চাকরি ছাড়তে হল কেন?

বাজ পড়ল যেন। হো হো করে হাসতে লাগল ছোটসাহেব। কিছুতেই আর হাসি থামতে চায় না। কোনরকমে ঢোক গিলে বলল, তোকে যদি বলি এখানে হামাগুড়ি দিতে হবে। তুই তাই করতে গিয়ে যদি হাঁটু থেকে রক্ত বের হয় কী করবি?

আমি বলব পারব না।

আমিও তাই বলেছি। যা ভাগ, বৃষ্টি আসছে খুব, বাড়ি পৌঁছতে পারবি না।

কিছুই বুঝতে পারল না সিরিল। ছোটসাহেব চুরি না করে চাকরি ছেড়েছে। রক্ত পড়েছিল বলছে, কিন্তু সেটা কি রকম রক্ত। লোকটা যদ্দিন বাগানের সাহেব ছিল তদ্দিন অন্যরকম ছিল। কথা বলতে ভয় লাগত সেই সঙ্গে রাগও। এখন কিন্তু সেসব কিছু হচ্ছে না। আর এই সামনাসামনি বসে সিরিলের সাহসও বেড়ে যাচ্ছিল। সে বলল, বৃষ্টি তো পড়েই আর ভিজতে আমার খারাপ লাগে না। তুই চাকরি ছাড়লি কেন?
 
ছোটসাহেব ইতস্তত করল আরও কিছুক্ষণ। সিরিল পুরোপুরি মাতাল নয় কিন্তু এরকম নেশা হয়েছে যা মানুষকে নাছোড়বান্দা করে। চাকরি ছাড়ার পর তার এই বাগানের মধ্যেই থেকে যাওয়া বিশেষ জেদের জন্যেই। কোম্পানি কিন্তু তার চাকরি ছাড়ার কোনো কারণ কাউকে জানায়নি। অন্য ম্যানেজাররা তো বটেই বাবুরাও জেনে গেছে কিন্তু সবাই রহস্যজনকভাবে চুপচাপ। এই কদিন এসব কথা এড়িয়ে গেছে ছোটসাহেব, কিন্তু আজ এইরকম শীতল বিকেলে ওর মনে হল কুলিদের ব্যাপারটা জানানো দরকার। সিরিল দুটো হাত কোলের ওপর নিয়ে বড় বড় চোখে ছোটসাহেবকে দেখছিল। ছোটসাহেব সিগারেট ধরিয়ে বলল, শুনতে চাইছিস যখন তখন শোন। আমার বাড়ি শিলিগুড়িতে। খুব গরিব ছিলাম আমরা। বাবা নেই, দুই ভাই মায়ের কাছে থাকতাম। মা হাসপাতালের নার্স। ছোট ভাই আমার চেয়ে ছ বছরের ছোট। পড়াশুনায় ভাল ছিলাম আমি। স্কুলে পয়সা লাগত না। কিন্তু ফাইন্যাল পরীক্ষার ফি জোগাড় করতে পারল না মা। একজন বড়লোক আমাকে সেই টাকা দিলেন। তাঁরই পয়সায় আমি কলেজে পড়ি। তারই চেষ্টায় টোকলাইতে গিয়ে ট্রেনিং নিই। আর সাহেববাগানে চাকরিতে যখন সই করলাম তখন দেখলাম আমাকে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে আমি যেন আমার চেয়ে যারা নিচু ক্লাসের লোক তাদের সঙ্গে না মিশি, না আড্ডা মারি, আমার বাড়িতে আসতে না দিই। আমি মিশব আমার সমান বা উঁচু মানুষের সঙ্গে। নইলে তোরা আমাকে সাহেব বলে মানবি না। এসব মেনে নিতে হবেই চাকরি করতে গেলে। ব্রিটিশরা যে নিয়ম তৈরি করেছিল তা তো আর পাল্টায়নি। কিন্তু কোম্পানি বলল আমার মা যেন চাকরি ছেড়ে দেয় তা না হলে আমি যেন তার সঙ্গে যোগাযোগ না করি। মাকে লিখলাম আমার বাংলোয় এসে থাকতে চাকরি ছেড়ে দিয়ে। অনেকদিন তো হলো, আর কেন! মা লিখল, তা সম্ভব নয়। যে চাকরি করে এতদিন বেঁচে আছেন তা শেষ ছুটি হওয়ার আগে ছাড়বেন না। প্রতিদিন হাসপাতালে কত গরিব মানুষের সেবা করেন তিনি, তারাই তার ছেলেমেয়ে। আমার চাকরিতে অসুবিধে হলে তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখার দরকার নেই। খুব কষ্ট হল, মানতে পারছিলাম না কিন্তু কিছুই করার ছিল না। প্রতি শনিবার রাত্তিরে চুপচাপ গাড়ি চালিয়ে শিলিগুড়িতে চলে যেতাম। চোরের মত মায়ের সঙ্গে দেখা করতাম, আবার ভোরের আগেই ষাট মাইল রাস্তা পেরিয়ে বাংলোয় ফিরে আসতাম। এই ভাবেই চলছিল মাসের পর মাস। কিন্তু সময় তো পালটায়। আমার ছোট ভাই এখন বড় হয়েছে। পার্টি করে। সে একরাত্রে আমাকে বাড়ির বাইরে ধরে শাসাল, যদি আমি দিনের বেলায় মাথা উঁচু করে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে পারি, তাহলেই যেন ওখানে যাই, না হলে সে আমার আসা পছন্দ করে না। ধিক্কার হল খুব। এই ছেলেটা যা বোঝে তা আমি টাকার নেশায় ভুলে যেতে চাইছিলাম? টাকার জন্যে নিজের মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করতে চাইছিলাম? আর পারলাম না। এসব কথা খোলাখুলি লিখে চাকরি ছেড়ে চলে এলাম। কিন্তু আমার তো অন্য কোন বিদ্যে জানা নেই; চাকরি দেবে কে আমাকে? গাড়ি সারানোটা এককালে শিখেছিলাম। সেটাই কাজে লাগালাম। হয়তো অন্য জায়গায় গিয়ে এই কারখানাটা খুলতে পারতাম। কিন্তু ভীষণ জেদ ধরে গেল। আমি চা-কোম্পানির মুখের সামনেই কারখানা করব যাতে ওরা দুবেলা আমাকে দ্যাখে। আর এই ভাবে দেখতে দেখতে ওরা যদি মনে করে আইনকানুনগুলো সময়ের সঙ্গে পালটে ফেলা দরকার তাহলে আমার পরে যারা আসবে তারা উপকৃত হবে। হাসল ছোটসাহেব, শুনলি তো এই হল আমার গল্প। এখন আমি ভাল আছি, খুব ভাল আছি।
 
ছোটসাহেবের সব কথার মানে সিরিলের মাথায় ঢোকেনি। কিন্তু এটুকু সে বুঝতে পারছিল যে ছোটসাহেব মাকে ভালবাসে বলে ওই চাকরি ছেড়ে এসেছে। তার মানে লোকটা সত্যিকারের ভাল। আর এই যে ছোটসাহেব এত লোক থাকতে তাকেই এরকম দুঃখের কাহিনি শোনালো তার মানে হলো সে ছোটসাহেবের আপন লোক। তাহলে তো সেও কিছু প্রশ্ন ওকে করতে পারে। ঠোঁট শুকিয়ে আসছিল। জিভ নিয়ে সেটা চেটে নিয়ে সিরিল বলল, আচ্ছা, একটা কথা বল্ তো, আমাদের তোরা কী ভাবিস?

ভাবি মানে?

আমরা ভদ্রলোক কি না?

ভদ্রলোক কি চেহারায় বোঝা যায়? ওটা ব্যবহারে জানা যায়।

ঠিক হ্যায়। তাহলে বল, এই দেশটা আমাদের না তোদের?

মানে? ছোটসাহেব কথাটা বুঝতে পারছিল না।

এই সোজা কথাটা বুঝছিস না! ওই চা বাগানে আমরা মদেসিয়ারা দেড় হাজার লোক আছি আর তোরা বাঙালিরা হাতগুনতি। তাহলে জায়গাটা কার? দুদিকে মাথা দোলাতে দোলাতে প্রশ্ন করল সিরিল।

দুজনেরই। এসব কথা তোদের মাথায় কে ঢোকাচ্ছে?

কেন? ঢোকাবে কেন? বিশজন বাঙালিবাবু সব সময় অর্ডার করবে, বেগার খাটাবে, আমাদের ছোটলোক বলবে আর আমরা শুনব? আমার বাপ শোনে তার বাপ শুনেছে কিন্তু আমি শুনব কেন?

অন্যায় কথা শুনতে কে বলেছে? কিন্তু তার সঙ্গে দেশের প্রশ্ন আসছে কেন? আমরা সবাই ভারতবর্ষের নাগরিক। আমরা সবাই সব জায়গায় থাকতে পারি। সব জায়গাই আমাদের দেশ। একথা তোকে কে বলেছে।

কে আবার বলবে? আমার বড়বাপ বলে এটা আমাদের দেশ নয়। আমাদের দেশ হল টেবুয়াতে, রাঁচি হাজারীবাগ ছোটনাগপুরে। কিন্তু সে জায়গা তো আমি দেখিনি। আমি এখানে জন্মেছি; বড় হয়ে এই চা বাগান দেখছি। এটাই আমার দেশ, কি ঠিক কি না বল?

নিশ্চয়ই ঠিক। কিন্তু এ নিয়ে ভাববার কোনো কারণ আছে?

সিরিল ছোটসাহেবকে জরিপ করতে চেষ্টা করল। তারপর বলল, ফ্রান্সিসকে দেখেছিস? যেই শালা বাবু হয়ে গেল অমনি আমাদের কুলি ভাবতে লাগল। কোনো বাবু আমাদের মানুষ বলে মানে না। সাহেবরা তো সব সময় ভাবে আমরা ওদের কেনা গোলাম। তুইও ভাবতিস কদিন। আগে। আগে খড়ের ঘরে আমরা থাকতাম এখন দয়া করে পাকাবাড়ি খুপরি ঘর করে দিয়েছে। কিন্তু আমরা যা ছিলাম তাই আছি। পিক্‌ করে দাঁতের ফাঁক দিয়ে থুতু ফেলল সিরিল।

তোদের য়ুনিয়ন আছে, য়ুনিয়ন তো খুব জোরদার।

সব সমান। য়ুনিয়নের মাথায় কে আছে? না সেই শহরের বাঙালি বাবু। আজকাল গোলমাল কিছু হলে য়ুনিয়নের বাবুরা এসে সাহেবের বাংলোয় বসে একসঙ্গে মাল খায়, কথা বলে! আমরা গেলে বসতে পারা তো দূরের কথা, খাতিরও করবে না। সব শালা মালিকরা হাতের মধ্যে রেখে দিয়েছে। সিরিল উঠে দাঁড়াল, তুই লোকটা ভাল। এতদিন ভাল ছিলি না, এখন ভাল হয়েছিস।

ছোটসাহেব উঠল, তা না হয় হলো, কিন্তু সব সময় মনে রাখিস এই দেশ আমাদের সবার, কারো একার নয়।

পা বাড়াতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল সিরিল, আচ্ছা! তাহলে আমাদের য়ুনিয়ন যখন বলছে এবারের বোনাস বিশ পার্সেন্ট দিতে হবে বাবুরা সব চুপ কেন? কেন সাড়ে আট পার্সেন্ট মানব আমরা? বাবুরা কেন আমাদের সঙ্গে আসছে না? এটা বেইমানি নয়? কী করে সবাই এক দেশের হলাম?

ছোটসাহেব বলল, হাতের পাঁচটা আঙুল কি সমান হয়? কিন্তু মুঠোয় কিছু ধরতে গেলে সবাইকে একসঙ্গে নামতে হয়। তোকে আমি সোনার ভাত খেতে দেব বললেই যদি লাফিয়ে উঠিস আনন্দে তাহলে তোর মত গর্দভ আর কেউ নেই। বুঝেসুঝে কাজ কর, মাথা ঠাণ্ডা রাখ। সিরিলের মাথায় কিছু ঢুকছিল না আর। বাইরে বৃষ্টি নেমেছে। সে রাস্তায় পা বাড়াতে গিয়ে হঠাৎ থমকে গেল। তারপর নিঃশব্দে ফিরে এল ছোটসাহেবের কাছে। এখন ওর চোখ, আধবোজা, ঠোঁট কুঁচকে উঠছে। ছোটসাহেব বলল, কিরে কিছু বলবি?
 
ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলেও কিছুক্ষণ থম ধরে থাকল সিরিল। তারপর ফিসফিসিয়ে বলল, হাম শাদী করে গা।

একটু চমকে গেল ছোটসাহেব বলার ধরনে তারপরে অত্যন্ত খুশির গলায় চিৎকার করে উঠল, খুব ভাল, করে ফ্যাল।

কিন্তু আমি জানি না কি করে শাদী করতে হয়।

জানিস না? তা তোর বাপকে বল, তারাই ব্যবস্থা করবে।

না, ওরাও জানে না।

তোর বাপ মা শাদীর নিয়ম জানে না?

না। আমি সই করে শাদী করব। সাহেবরা যেমন করে। টলতে টলতে নিজেকে সামলে নিল সিরিল।

হকচকিয়ে গেল ছোটসাহেব। ব্যাপারটা বুঝে নিতে কয়েকটা মুহূর্ত ব্যয় হল। তারপর বলল, সই করতে পারিস?

ঘাড় কাত করল সিরিল, হুঁ। টিপসই ভি সই, ঠিক কিনা?

তা ঠিক। কিন্তু এই শখ হল কেন তোর?

আমার ইচ্ছে তাই করব। একশবার করব, আলবাত করব। আমার শাদী দেবে সরকার, সাহেবদের যেমন দেয়।

ঠিক আছে ঠিক আছে। ছোটসাহেব ওর কাঁধে হাত রাখল, পাত্রী ঠিক হয়েছে?

হুঁ। তুই আমাকে নিয়মটা বাতলে দে। কী করতে হবে আমি কিছু জানি না। তুই লোকটা ভাল আছিস। এখন তো আর বাগানের সাহেব নোস, তুই বল কী করতে হবে।

ঠিক আছে, আমি ভাল করে আইনটা জেনে নিয়ে তোকে বলব।

তুই খুশি তো ছোটাসাহেব।

হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই খুশি।

তোকে আমি মিঠাই খাওয়াবো, ভূটানকো রম্ খাওয়াবো।

বেশ বেশ।

তুই বড়া আদমি আছিস! সাহেবলোককা মুখমে লাথ মেরেছিস ওই নোকরি ছেড়ে দিয়ে। পড়তে পড়তে কোনো রকমে বেঁচে গেল সিরিল। তারপর দরজায় দাঁড়িয়ে সোজা হয়ে ছোটসাহেবকে কায়দা করে সেলাম জানাল কপালে হাত ছুঁইয়ে, ইনকিলাব জিন্দাবাদ, বন্ডেমাত্র।

এটা করতেই মন প্রফুল্ল হয়ে গেল ওর। খানিক পরে যখন অঝোর বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সে পথ হাঁটতে লাগল তখন আর কোনো কষ্ট নেই ওর। মাথায়, শরীরের সবখানে যে শীতল জলের ধারা নামছে সেটা খেয়াল নেই। রাস্তার দুপাশে ঝকড়া ঝাকড়া শিরীষ দেবদারু গাছগুলো এখন অন্ধকারকে আরো ঘন করেছে। বাজার ছাড়িয়ে বাবুদের কোয়ার্টারের সামনে দিয়ে ঘোরের মধ্যে হেঁটে সে কুলি লাইনের দিকে চলল। চোখ বন্ধ করেই হেঁটে যাওয়া এখন অসম্ভব নয়। সিরিল ভাবতে চাইল, এই চা বাগানের প্রতিটি ইঞ্চি সে জানে! এই অন্ধকার বৃষ্টির রাত আর

কি বাধা হতে পারে। অদ্ভুত একটা গুনগুনানি আনন্দ বুকের মধ্যে নাচছিল। চোখ বন্ধ করলেই এখন নিরির মুখ, চোখ খুললেই এখন নিরির হাসি। হায়, হায়, কি খেল দেখাল নিরি সেদিন পঞ্চায়েতের মিটিং-এ? ওই সেই লাফাঙ্গা স্বামীর মুখ শুকিয়ে ঘুঁটে হয়ে গেছিল। মার শালা লাথ, হাজারবার লাথ। ভাবতে ভাবতেই পরমানন্দে শুন্যে একটা লাথি ছুড়ল সিরিল। সঙ্গে সঙ্গে শরীরটা বেতাল হয়ে আছড়ে পড়ল রাস্তার একপাশে দেওদার গাছের গোড়ায়! উপুড় হয়ে জলকাদায় শুয়ে শুয়ে সে কিছুটা সামনে নিলে দুহাতের বাঁধনে একটা বড় পাথর পেয়ে। অজান্তেই অমিতাভ বচ্চনের গলায় বলে উঠল, নিরি মেরা পেয়ার, মেরা জিন্দেগি, ও মেরা ডার্লিং।

পঞ্চায়েতের মানুষগুলোর মুখ কেমন হয়েছিল? বুকু সর্দার ওর বাবা মাংরা সর্দার, অন্যান্য বুড়োগুলো হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ। শুধু শুকরা বুড়ো বসেছিল সেই পাথরের মত যাকে ঝরনার জল সারাদিন শব্দ করে ঠেলে যায় কিন্তু পাথরটা খেয়ালই করে না।

খুব লম্বা লম্বা বাত ঝাড়ছিল বুকু সর্দারের জামাই। যে মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে থাকতে চায়।, দুদিন পরেই পালিয়ে আসে সে মেয়ে নষ্ট, বদ, রান্ডী। যে মেয়ে পেটে বাচ্চা ধরতে পারে না সেই মেয়ে সংসার সামলাতে পারে না। তাই সে সমবেত বয়স্কজনকে অনুরোধ করছে এ ব্যাপারে একটা বিহিত করতে।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top