অনিমেষ অলসভাবে পায়চারি করতে লাগল। দূরে একটা চিতা প্রায় নিবে এসেছে। কাঠগুলো জ্বলে জ্বলে আগুন নিবুনিবু। প্রচণ্ড কান্নায় কেউ ভেঙে পড়েছে সেখানে, তাকে সামলাচ্ছে অন্যরা। হরিবোল ধ্বনি দিতে দিতে আর-একটি মৃতদেহ নিয়ে শানের দিকে কিছু লোক আসছে। অনিমেষের এখন রি ভয় করছিল না। দুধেলা জ্যোৎস্নায় এই শ্মশানের মাটি গাছ নদী ধবধব করচে। আকাশে এত নীল রঙ চেয়ে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। গোল আধুলির মতো রুপোলি চাঁদ চুপচাপ সরে সরে যাচ্ছে। আশ্চর্য, ঠিক এরকম সময় কিছু মানুষকে পৃথিবী থেকে চলে যাবার পর শ্মশানে আনা হয়েছে পুড়িয়ে শেষ করে দেবার জন্য। ওর খুব মন-খারাপ হয়ে গেল, কেন যে ছাই শোনে ও চাঁদের আলো পড়ে।
স্নান করিয়ে দাহ করার যে-নিয়মটা এখানে চালু আছে তা সকলে মানেন না, সামান্য জল ছিটিয়ে শুদ্ধ করে নেয় অনেকে-অনিমেষ শুনতে পেল। যে-ডোমটি তদারক করছিল তার দিকে তাকিয়ে অনিমেষ অবাক হয়ে গেল। এর মুখ দেখে মনে হয় না এইসব শোক দুঃখ একে স্পর্শ করে। কখনো কি ও মাথা তুলে আকাশ-ভাসানো চাঁদটাকে ভালো করে দেখেছে? মনে হয় না। সুনীলদার উলঙ্গ শরীরটাকে উপুড় করে শুইয়ে দিয়ে সে যেভাবে পা দুটো সোজা করে দিল তাতে পিসিমার উনুন ধরানোর ভঙ্গিটা মনে পড়ে গেল ওর। চিতার কাছাকাছি গোল হয়ে দাঁড়িয়েছিল সবাই সুনীলদার কোমরের পেছনদিকটায় বিরাট জরুলটায় আলো পড়ে চোখ টেনে নিচ্ছে। মানুষ মরে গেলে তার কত গোপন জিনিস সবাই সহজে জেনে যায়-সুনীলদার এখন কিছু করার নেই। হঠাৎ ও মাকে দেখতে পেল। মা শুয়েছিল সমস্ত চিতা আলো করে-ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছিল সেই চুলগুলো। সুনীলদাকে এই মুহূর্তে খুব দুর্বল, অসহায় বলে মনে হচ্ছিল অনিমেষের।
কে যেন বলল, মুখাগ্নি করবে কে?
সঙ্গে সঙ্গে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। সুনীলদার বাবা আসেননি, কোনো আত্মীয় এই শহরে থাকে। সমস্যাটা চট করে সমাধান করতে পারছিল না শুশানযাত্রীরা। এমন সময় অনিমেষ দেখল সেই ছেলেটি, যে আবৃত্তি করেছিল, যার সঙ্গে সুনীলদার খুব তর্ক হত, সে অলসভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে গেল, কই, কী করতে হবে বলুন।
একজন একটু দ্বিধা নিয়ে বলল, তুমি করবে?
নিশ্চয়ই! ছেলেটি জাবাব দিল, সংগ্রাম শুরু কর মুক্তির, দিন নেই তর্ক ও যুক্তির। আমার চেয়ে বড় আত্মীয় আর কে আছে! দিন। হাত নেড়ে নেড়ে কথাটা বলে সে পাটকাঠির আগুনটা তুলে নিয়ে সুনীলদার বুকে ছুঁইয়ে মুখের ওপর বুলিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো হাত আগুন ছুঁইয়ে চিতাটাকে জাগিয়ে দিল। কেউ কোনো কথা বলছে না, শুধু ফটফট করে কাঠ ফাটার শব্দ আর আগুনের শিখাগুলো যেন হামাগুড়ি দিয়ে সুনীলদার দিকে এগিয়ে আসছে।
হঠাৎ ডোমটা চেঁচিয়ে উঠল, বোল হরি হরিবোল। তার সেই একক কণ্ঠ শ্মশানের আকাশে একবার পাক খেয়ে ফিরে এল আচমকা। অবাক হয়ে সে শুশানযাত্রীদের দিকে তাকাল, তার অভিজ্ঞতায় এইরকম নৈঃশব্দ্য সে বোধহয় দেখেনি।
নীরবতা এতখানি বুকচাপা হয় এর আগে অনিমেষ এমন করে কখনো বোঝানি। সেই বাড়ি থেকে বের হবার পর যে-ধ্বনি দেওয়া চলছিল, যে-মানুষগুলো সুনীলদাকে কেন্দ্র করে জেহাদ জানাচ্ছিল, এখন এই সময় তারা ছবির মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কতখানি ভালোবাসা পেলে এরকমটা হয়-অনিমেষ আঁচ করতে পারছিল না। তবে সুনীলদা কিছু মানুষকে ভীষণরকম। আলোড়িত করেছিলেন, এখন অনিমেষ নিজেকে তার বাইরে ফেলতে পারল না। আগুন কাউকে ক্ষমা। করে না, সুনীলদার শরীরটা ক্রমশ গলে গলে পড়ছে। মারও এরকমটা হয়েছিল। হঠাৎ দুচোখে। দুহাতে চাপা দিল অনিমেষ। এ-দৃশ্য সে দেখতে পারছে না। কিন্তু চোখ বন্ধ করেও সে যে নিস্তার। পাচ্ছে না। অজস্র ছোট ছোট চিতা চোখের পাতায়-পাতায় জ্বলে যাচ্ছে। এটাকে নেভাতে গেলে অন্যটা জ্বলে উঠে।
চোখ খুলতে সাহস হচ্ছে না, অথচ। অনিমেষ এই অবস্থায় শুনতে পেল সেই ছেলেটা নিজের মনে কিছু আবৃত্তি করে যাচ্ছে। মনে হয় ঘোরের মধ্যে ছে সে। কতক্ষণ কেটে গেছে খেয়াল নেই, হঠাৎ সবাই কথা বলে উঠল। দুর্গাঠাকুর বিসর্জনের সময় সাতপাক ঘোরানো হয়ে গেলে জলে ফেলবার মুহূর্তটাতেই এইরকম ব্যস্ততা ভক্তদের মধ্যে হয়ে থাকে। অনিমেষ বন্ধু-চোখ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনল, কুব চাপা এবং রুদ্ধ গলায় ছেলেটি বলছে, কমরেড, তোমায় আমি ভুলছি না, ভুলব না। চোখ খুলল অনিমেষ, খুলে একটু একটু করে সাহস এনে চিতার দিকে তাকাল। না, সুনীলদা ওখানে নেই। একটা দল-পাকানো কালো কিছু পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এই পৃথিবীর কোথাও আর সুনীলদাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
একটু একটু করে মানুষজন ফিরে ফিরে যাচ্ছিল। সামান্য বাতাস দিচ্ছে। কোথা থেকে হালকা মেঘেরা এসে মাঝে-মাঝে চাঁদের মুখ আড়াল করে যাচ্ছে। সেই মুহূর্তে সমস্ত চরাচরে একটা ছায়া। দুলে দুলে যাচ্ছে। অনিমেষ দেখল সেই ছেলেটি আচ্ছন্নের মতো হেঁটে যাচ্ছে তার সামনে দিয়ে। যেতে-যেতে মুখ তুলে চাঁদকে দেখে চেঁচিয়ে উঠল, ঠিক ঠিক। কবিতা তোমায় আজকে দিলাম ছুটি ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়-পূর্ণিমা চাঁদ যেন জলসানো রুটি।
অনিমেষ আর দাঁড়াল না। ও দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ছেলেটির সঙ্গ নিল। ছেলেটি ওর দিকে তাকিয়ে হাসল, পথ অনেকটা, কিন্তু আমাকে একা হাঁটতে হচ্ছে না, তুমি আর আমি হাঁটলে পথ আর বেশি হবে না। কী বল
অনিমেষ কোনো কথা বলল না। হাঁটতে হাঁটতে ব্রিজের ওপর এসে ওর খেয়াল হল, যাঃ, মান করা হয়নি। পিসিমা বলেন, শ্মশানে এলে স্নান করে যেতে হয়। তাই গামছা নিয়ে এসেছে সে। কিন্তু এই মুহূর্তে স্নান করার কথা ভাবতে পারছে না ও। শরীর ননাংরা হলে লোকে স্নান করে। সুনীলদাকে দাহ করার পর স্নান করার কোনো মানে হয়। এই সময় ছেলেটি হঠাৎ আকাশের দিকে বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বলে উঠল, চাঁদটা আজ বড্ড জ্বালাচ্ছে, না?
স্নান করিয়ে দাহ করার যে-নিয়মটা এখানে চালু আছে তা সকলে মানেন না, সামান্য জল ছিটিয়ে শুদ্ধ করে নেয় অনেকে-অনিমেষ শুনতে পেল। যে-ডোমটি তদারক করছিল তার দিকে তাকিয়ে অনিমেষ অবাক হয়ে গেল। এর মুখ দেখে মনে হয় না এইসব শোক দুঃখ একে স্পর্শ করে। কখনো কি ও মাথা তুলে আকাশ-ভাসানো চাঁদটাকে ভালো করে দেখেছে? মনে হয় না। সুনীলদার উলঙ্গ শরীরটাকে উপুড় করে শুইয়ে দিয়ে সে যেভাবে পা দুটো সোজা করে দিল তাতে পিসিমার উনুন ধরানোর ভঙ্গিটা মনে পড়ে গেল ওর। চিতার কাছাকাছি গোল হয়ে দাঁড়িয়েছিল সবাই সুনীলদার কোমরের পেছনদিকটায় বিরাট জরুলটায় আলো পড়ে চোখ টেনে নিচ্ছে। মানুষ মরে গেলে তার কত গোপন জিনিস সবাই সহজে জেনে যায়-সুনীলদার এখন কিছু করার নেই। হঠাৎ ও মাকে দেখতে পেল। মা শুয়েছিল সমস্ত চিতা আলো করে-ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছিল সেই চুলগুলো। সুনীলদাকে এই মুহূর্তে খুব দুর্বল, অসহায় বলে মনে হচ্ছিল অনিমেষের।
কে যেন বলল, মুখাগ্নি করবে কে?
সঙ্গে সঙ্গে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। সুনীলদার বাবা আসেননি, কোনো আত্মীয় এই শহরে থাকে। সমস্যাটা চট করে সমাধান করতে পারছিল না শুশানযাত্রীরা। এমন সময় অনিমেষ দেখল সেই ছেলেটি, যে আবৃত্তি করেছিল, যার সঙ্গে সুনীলদার খুব তর্ক হত, সে অলসভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে গেল, কই, কী করতে হবে বলুন।
একজন একটু দ্বিধা নিয়ে বলল, তুমি করবে?
নিশ্চয়ই! ছেলেটি জাবাব দিল, সংগ্রাম শুরু কর মুক্তির, দিন নেই তর্ক ও যুক্তির। আমার চেয়ে বড় আত্মীয় আর কে আছে! দিন। হাত নেড়ে নেড়ে কথাটা বলে সে পাটকাঠির আগুনটা তুলে নিয়ে সুনীলদার বুকে ছুঁইয়ে মুখের ওপর বুলিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো হাত আগুন ছুঁইয়ে চিতাটাকে জাগিয়ে দিল। কেউ কোনো কথা বলছে না, শুধু ফটফট করে কাঠ ফাটার শব্দ আর আগুনের শিখাগুলো যেন হামাগুড়ি দিয়ে সুনীলদার দিকে এগিয়ে আসছে।
হঠাৎ ডোমটা চেঁচিয়ে উঠল, বোল হরি হরিবোল। তার সেই একক কণ্ঠ শ্মশানের আকাশে একবার পাক খেয়ে ফিরে এল আচমকা। অবাক হয়ে সে শুশানযাত্রীদের দিকে তাকাল, তার অভিজ্ঞতায় এইরকম নৈঃশব্দ্য সে বোধহয় দেখেনি।
নীরবতা এতখানি বুকচাপা হয় এর আগে অনিমেষ এমন করে কখনো বোঝানি। সেই বাড়ি থেকে বের হবার পর যে-ধ্বনি দেওয়া চলছিল, যে-মানুষগুলো সুনীলদাকে কেন্দ্র করে জেহাদ জানাচ্ছিল, এখন এই সময় তারা ছবির মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কতখানি ভালোবাসা পেলে এরকমটা হয়-অনিমেষ আঁচ করতে পারছিল না। তবে সুনীলদা কিছু মানুষকে ভীষণরকম। আলোড়িত করেছিলেন, এখন অনিমেষ নিজেকে তার বাইরে ফেলতে পারল না। আগুন কাউকে ক্ষমা। করে না, সুনীলদার শরীরটা ক্রমশ গলে গলে পড়ছে। মারও এরকমটা হয়েছিল। হঠাৎ দুচোখে। দুহাতে চাপা দিল অনিমেষ। এ-দৃশ্য সে দেখতে পারছে না। কিন্তু চোখ বন্ধ করেও সে যে নিস্তার। পাচ্ছে না। অজস্র ছোট ছোট চিতা চোখের পাতায়-পাতায় জ্বলে যাচ্ছে। এটাকে নেভাতে গেলে অন্যটা জ্বলে উঠে।
চোখ খুলতে সাহস হচ্ছে না, অথচ। অনিমেষ এই অবস্থায় শুনতে পেল সেই ছেলেটা নিজের মনে কিছু আবৃত্তি করে যাচ্ছে। মনে হয় ঘোরের মধ্যে ছে সে। কতক্ষণ কেটে গেছে খেয়াল নেই, হঠাৎ সবাই কথা বলে উঠল। দুর্গাঠাকুর বিসর্জনের সময় সাতপাক ঘোরানো হয়ে গেলে জলে ফেলবার মুহূর্তটাতেই এইরকম ব্যস্ততা ভক্তদের মধ্যে হয়ে থাকে। অনিমেষ বন্ধু-চোখ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনল, কুব চাপা এবং রুদ্ধ গলায় ছেলেটি বলছে, কমরেড, তোমায় আমি ভুলছি না, ভুলব না। চোখ খুলল অনিমেষ, খুলে একটু একটু করে সাহস এনে চিতার দিকে তাকাল। না, সুনীলদা ওখানে নেই। একটা দল-পাকানো কালো কিছু পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এই পৃথিবীর কোথাও আর সুনীলদাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
একটু একটু করে মানুষজন ফিরে ফিরে যাচ্ছিল। সামান্য বাতাস দিচ্ছে। কোথা থেকে হালকা মেঘেরা এসে মাঝে-মাঝে চাঁদের মুখ আড়াল করে যাচ্ছে। সেই মুহূর্তে সমস্ত চরাচরে একটা ছায়া। দুলে দুলে যাচ্ছে। অনিমেষ দেখল সেই ছেলেটি আচ্ছন্নের মতো হেঁটে যাচ্ছে তার সামনে দিয়ে। যেতে-যেতে মুখ তুলে চাঁদকে দেখে চেঁচিয়ে উঠল, ঠিক ঠিক। কবিতা তোমায় আজকে দিলাম ছুটি ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়-পূর্ণিমা চাঁদ যেন জলসানো রুটি।
অনিমেষ আর দাঁড়াল না। ও দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ছেলেটির সঙ্গ নিল। ছেলেটি ওর দিকে তাকিয়ে হাসল, পথ অনেকটা, কিন্তু আমাকে একা হাঁটতে হচ্ছে না, তুমি আর আমি হাঁটলে পথ আর বেশি হবে না। কী বল
অনিমেষ কোনো কথা বলল না। হাঁটতে হাঁটতে ব্রিজের ওপর এসে ওর খেয়াল হল, যাঃ, মান করা হয়নি। পিসিমা বলেন, শ্মশানে এলে স্নান করে যেতে হয়। তাই গামছা নিয়ে এসেছে সে। কিন্তু এই মুহূর্তে স্নান করার কথা ভাবতে পারছে না ও। শরীর ননাংরা হলে লোকে স্নান করে। সুনীলদাকে দাহ করার পর স্নান করার কোনো মানে হয়। এই সময় ছেলেটি হঠাৎ আকাশের দিকে বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বলে উঠল, চাঁদটা আজ বড্ড জ্বালাচ্ছে, না?