What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected স্বনামধন্য - সমরেশ মজুমদার (2 Viewers)

Kaptan Jacksparoow

Community Team
Elite Leader
Joined
Apr 6, 2019
Threads
325
Messages
5,984
Credits
44,713
T-Shirt
Profile Music
Recipe sushi
Rocket
Euro Banknote
Butterfly
images.jpeg
 
ভরত যখন পনেরো বছরের কিশোর তখন একটি ছবি দেখেছিল টিভিতে। তখন রবিবার বিকেলে বাড়ির সবাই একসঙ্গে বসে টিভি দেখত, গল্প করত, চা খেত। বড় সুখের সময় ছিল তখন। ছবিটা ছিল ইংরেজিতে, পটভূমিও ভারতবর্ষ নয়। ছিমছাম রাস্তা, গাড়িগুলো ট্রাফিক আইন মেনে চলছে, বাসে কেউ দাঁড়িয়ে নেই। বাড়িগুলোর দুপাশে বাগান, রাস্তার গায়ে সার দেওয়া গাছেরা দাঁড়িয়ে। ভোরবেলায় খবরের কাগজ আর দুধের প্যাকেট বাড়িগুলোর দরজায় রেখে দেওয়া হয়েছে গৃহস্বামী ঘুম ভেঙে তুলে নেন বলে। কোনো মতলববাজের দেখা পাওয়া গেল না যে সেগুলো চুরি করতে এসেছে। বাজারে হাঁকাহাঁকি চিৎকার নেই কিন্তু অনেকরকমের সবজি মাছ মাংস থরে থরে সাজানো রয়েছে যাদের গায়ে নির্দিষ্ট দামের লকেট ঝুলছে। তাই দেখে প্রয়োজনীয় ওজনের প্যাকেট তুলে নিয়ে গিয়ে লোকে কাউন্টারে দাম দিচ্ছে। ছবিটার আর কী কী ঘটনা ছিল, মানুষগুলো নিজেদের মধ্যে কী নাটক করেছিল তা ভরতের স্মরণে নেই কিন্তু ওইসব দৃশ্যগুলো দারুণভাবে মনে গেঁথে গিয়েছিল। ছবি দেখা শেষ হতেই সে প্রশ্ন করেছিল, আচ্ছা বাবা, আমাদের কলকাতা এ রকম হতে পারে না?

সঙ্গে সঙ্গে বড়রা বিশ্রীভাবে হেসে উঠেছিল। মা বলেছিল, চেষ্টা করলে হয় না কি!

বাবা বলেছিল, স্বপ্ন! স্বপ্ন দেখতে পারিস।

স্বপ্নটা দেখতে ভাল লাগত ভরতের। তার বয়স পনেরো হলেও বাবা এবং মা একটুও ভরসা করতে চাইতেন না। দামি স্কুলের বাস তাকে ফ্ল্যাটবাড়ির গেট থেকে তুলে নিয়ে যেত সকালে, ফিরিয়ে দিত ছুটি হলে। স্কুলের পাঁচিলঘেরা চৌহদ্দিতে যে জীবন তার সঙ্গে কলকাতা শহরের কোনো মিল ছিল না। যা কিছু সে দেখতে পেত তা আসা যাওয়ার পথে বাসের জানলা দিয়ে। তবে অনেক কিছু ঠিকঠাক বুঝে ওঠার আগে বাস জায়গাটায় দাঁড়িয়ে চলে যেত। স্কুলের সমবয়সী বন্ধুরা যে জীবনের গল্প বলত তার স্বাদ সে স্কুল ছাড়ার আগে পায়নি। স্বাধীনভাবে বাসে ট্রামে স্কুলে যাওয়ার জন্যে বাড়িতে আবেদন করলে উল্টে বকুনি শুনতে হয়েছে। বাবা বলত, স্কুলে যাওয়া আসা করছ, সেটা সহ্য হচ্ছে না? বৃষ্টি মিছিল এগুলো হলে বুঝতে পারবে স্কুলের বাস কি ভাল! আর মা বলত, কে তোকে এ সব বদ মতলব দিচ্ছে বল তো? একা যাবি, বন্ধু-বান্ধব জুটবে, সিগারেট বিড়ি ধরাবে তারপর ড্রাগ। সর্বনাশ হয়ে যাবে তোর!

অতএব বারো ক্লাশ পর্যন্ত জানলা দিয়ে যে কলকাতা সে দেখেছিল তার সঙ্গে স্বপ্নের ছবির কোনো মিল নেই। ওর স্কুলের নিকটতম বন্ধু পাভেল বলেছিল, তুই যেটা দেখছিস সেটা রঙিন ছবি।

তার মানে?

খুব বিশ্রী ভাঙাচোরা কোনো বাড়ির যদি রঙিন ছবি তোলা হয় দেখবি বেশ সুন্দর লাগে। একবার খবরের কাগজের প্রথম পাতায় পুজোর সময় ডাস্টবিনে জমে থাকা আবর্জনার রঙিন ছবি ছাপানো হয়েছিল, দেখে মনে হচ্ছিল ঠাকুরের ছবি ছাপা হয়েছে। বাস্তব ফোটে ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইটে। সেটা দেখতে পাবি রাস্তায় হাঁটলে মানুষের সঙ্গে মিশলে। কলেজে ওঠার আগে তুই জাল কেটে বের হতে পারবি না, ততদিন রঙিন ছবি দ্যাখ।

ভরতের মনে কলেজে যাওয়ার বাসনা তীব্র হয়েছিল বলে ও পড়াশুনায় খুব মন দিয়েছিল। ফল বের হলে দেখা গেল তার নাম তাবৎ পরীক্ষার্থীদের মধ্যে নবম স্থানে রয়েছে।

.
 
তার নাম কেন ভরত রাখা হয়েছিল তাই নিয়ে সে অনেকবার প্রশ্ন করেছিল অল্প বয়সে। রামায়ণে রামচন্দ্র নায়ক, তার পরে লক্ষ্মণ। শত্রুঘ্নর ভূমিকা খুব অল্প, নেই বলতে গেলে। ভরত সুবোধ বালক, দাদার পাদুকা মাথায় করে দেশ শাসন করেছিল বারো বছর। তার মায়ের কুকর্মের জন্যে সে মানুষের সহানুভূতি অত কাণ্ড করেও পায়নি। এমন কি মন্থরাকে শাসন করলেও নয়। পাভেল বলেছিল, মুখ্যমন্ত্রী যখন দেশের বাইরে যান তখন মন্ত্রিসভার এক নিরীহ প্রবীণ মন্ত্রীর ওপর দায়িত্ব দিয়ে যান যিনি তার অনুপস্থিতিতে অ্যাক্টিং মুখ্যমন্ত্রী হয়ে থাকেন। লোকটার কোনও সিদ্ধান্ত নেবার সাহস থাকে না এবং জনসাধারণও তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী বলে মনে করে না। ভরত ছিল সেইরকমের রাজা। তাই ভরতের ভূমিকা বকলম। বুঝলি?

ভরত এই রকম ব্যাখ্যা পছন্দ করেনি। সে কারও বকলম নয়। প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়ে তার মনে হয়েছিল এখন তাকে প্রমাণ করতে হবে সে একজন স্বাধীন মানুষ। তখন তার বয়স আঠারো।

ইদানীং বাবা এবং মা, আবার বাবার সঙ্গে তার, মায়ের সঙ্গে তার যে সম্পর্ক তাতে গোলমাল বাধছিল। বাবা চেয়েছিলেন সে জয়েন্ট দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুক। পাশ করে ম্যানেজমেন্ট শেষ করে সোজা পথে এগিয়ে যাক। মা চেয়েছিলেন সে ডাক্তারি পড়ুক। ডাক্তারদের চাকরি যাই হোক না কেন চেম্বার খুলে বসলে আয় হতে বাধ্য। বাবা এবং মায়ের দুটো প্রস্তাবই তার পছন্দ হয়নি। ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে সে বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করতে বেশী আগ্রহী। কিন্তু তার এই আগ্রহকে কোনও মূল্য দেয়নি ওরা। বলেছিল, এত বছর পড়াশুনার পরে বাকি জীবন অনিশ্চিত হয়ে যাবে। পাঁচ বা ছয় বছর পরে নিশ্চিত অর্থ সে রোজগার করতে পারবে না বলে ওদের বিশ্বাস। এবং এই একটা জায়গায় বাবা এবং মা একই ভাবনা ভেবেছিল। ভরত তর্ক করেছিল, সবাই যদি ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হয় তবে গবেষণা করবে কে? গবেষণা না করলে দেশের উন্নতি হবে কী করে? ভারতবর্ষে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার প্রচুর কিন্তু কোনও বিজ্ঞানী নেই, দেশের অবস্থা কী হবে ভাবতে পারো?

বাবা বলেছিল, সে সব ভাবার জন্যে নেতারা আছেন। তোমাকে ভাবতে হবে না। আমার সময়ে সাত আট হাজার মাইনে পেলে চলে যাচ্ছে কোনও মতে, তোমার সময়ে কুড়ি হাজার মাসে পেতে হবে। সেটা পেতে গেলে ও সব বিলাসিতা করা চলবে না।

মা বলেছিল, ঠিকই। তবে কুড়িতে হবে না। সাত আট হাজারে আমার দুর্দশা দেখতে পাচ্ছি। ইঞ্জিনিয়ার হলে মাস মাইনেতে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতে হবে। বরং ডাক্তারদের ফি আরও বাড়বে। এখনই কলকাতার অনেক ডাক্তার মাসে লাখ টাকা হেসে খেলে রোজগার করে।

কিন্তু জয়েন্ট দেয়নি ভরত। বলা যেতে পারে দিতে পারেনি। বাবা মা ফর্ম জমা দিয়েছিল। তার মত এত বিরূপ ছিল যে পরীক্ষার আগের দিন যখন চিকেন পক্সের আবির্ভাব বোঝা গেল তখন অত্যন্ত খুশি হয়েছিল। মনে হয়েছিল তাতে মুখে ফুটে ওঠা গুটিকাগুলো আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। পরীক্ষায় বসলে তাকে ঠিকঠাক উত্তর দিতে হত। ইচ্ছে করে জানা উত্তর না লেখা তার পক্ষে সম্ভব হত না। ভরত জানে জয়েন্ট দিলে তাকে হয় যাদবপুর নয় মেডিক্যাল কলেজে যেতে হত। পনেরো দিন বিছানায় পড়ে থেকে সে যখন বাইরে বের হল তখন প্রেসিডেন্সি কলেজ ছাড়া অন্য কোনও পথ খোলা নেই। রেগে মেগে বাবা বলেছিল, ও ইচ্ছে করে পক্স বাধিয়েছে। স্রেফ শয়তানি করার জন্যে। মা অবশ্য বলেছিল, ইচ্ছে করে জ্বর, পেটের অসুখ, সর্দি বাধানো যায়, পক্স কি করে কেউ বাধায় আমি জানি না। কি বুদ্ধি! বাবা চেঁচিয়ে বলেছিল, তোমার ছেলে সব পারে।
 
সেদিন প্রায় কুরুক্ষেত্র হয়ে গিয়েছিল তাদের বারোশো স্কোয়ার ফুটের ফ্ল্যাটটায়। প্রবল জ্বরে আক্রান্ত, ভরত সমস্ত শরীরে ব্যথা নিয়ে ওদের দুজনের সংলাপ শুনতে বাধ্য হয়েছিল। মা ছুটে গিয়েছিল বাবার সামনে, আমার ছেলে! আমার ছেলে বলতে তুমি কী বোঝাচ্ছ?

যা বোঝায় তাই। তুমি ওকে পেটে ধরেছিলে, অতএব তোমার ছেলে।

অদ্ভুত! যখন ও কিছু খারাপ করবে তখনই তুমি বলবে তোমার ছেলে! যখন পরীক্ষায় স্ট্যান্ড করল তখন পাঁচজনকে বলেছ আমার ছেলে? তোমার মতো সুবিধেবাদী পুরুষ পৃথিবীতে নেই।

আমি সুবিধেবাদী? চমৎকার! একটু ভেবে বলো কথাটা!

যথেষ্ট ভেবেছি। আমার জীবন নষ্ট করে দিয়েছ তুমি। মা কড়া গলায় বলেছিল।

কে কার জীবন নষ্ট করল তা পাবলিককে বিচার করতে বলবে? সুবিধেবাদী! তোমার জন্যে, তোমার মন রাখার জন্যে আমি মা-ভাইবোনদের ছেড়ে এই ফ্ল্যাটে চলে এসেছিলাম। ওরা প্রচণ্ড অর্থকষ্টে পড়বে জানা সত্ত্বেও মাসে দুশো টাকার বেশি দিইনি। আমি সুবিধেবাদী?

বাঃ। আমি তোমাকে নিষেধ করেছি দুশো টাকার বেশি দিতে! বলেছি তোমার মা ভাইবোনকে না খাইয়ে রেখে আমাদের কেক পোলাও খাওয়াও!

বলোনি? কিন্তু করতে বাধ্য করেছ। তোমার এই ফ্ল্যাট, স্ট্যাটাস মেইনটেন করে দুশো টাকার বেশি ওদের দেবার ক্ষমতা আমার ছিল না সেটা তুমি জানতে না?

এত কম ক্ষমতা নিয়ে বিয়ে করেছিলে কেন? মা ভাইবোনের জন্যে যখন এতটা কষ্ট পেয়েছ তখন ক্ষমতা বাড়াবার চেষ্টা করোনি কেন? তোমার কলিগদের যখন তরতর করে প্রমোশন হয়েছে, মাইনে বেড়েছে তখন তুমি আটকে ছিলে কেন? জবাব দাও।

আমি দুনম্বরি করতে পারিনি, পা চাটতে পারিনি।

ওহো, রামচন্দ্র। তোমার কেন প্রমোশন হয়নি আমি জানি না বলে ভেবেছ?

কেন? কী জানো তুমি?

তোমার বসের বউ, ওই পাঞ্জাবি মেয়েটার সঙ্গে প্রেম করতে গিয়েছিলে তুমি। মেয়েটা তোমাদের সঙ্গে ফ্লার্ট করত, সবাই সেটা বুঝত শুধু তুমি বোঝনি, মজে গিয়েছিলে। তোমাদের লুথার সাহেব সেটা জানতে পেরে তোমার বারোটা বাজিয়ে দিয়ে গেছেন।

তুমি জানলে কী করে এ সব কথা। কে বলেছে তোমাকে?

আমি জেনেছি।

ও বুঝেছি! মুখার্জি বলেছে। বলবেই তো! এই মুখার্জি সোয়াইনটার সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক তা আমি জানি না ভেবেছ! তোমাকে গিফট দেয়, পার্টিতে গিয়ে তোমার মাথা ধরলে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যায়, হোয়াই! আমাকে সুবিধেবাদী বলা হচ্ছে!

দীপক! খুব বাড়াবাড়ি করছ তুমি। মুখ সামলে কথা বলল।

ভয় দেখিও না। চেঁচিও না।

ওয়েল। আমাকে বিয়ে করতে তোমাকে কে বলেছিল। আমি কি তোমার পেছনে ঘুরেছিলাম। তুমি কেন তখন নেড়ি কুকুরের মতো আমার প্রেম আদায় করতে পাগল হয়েছিলে? মুখার্জি! ও রকম হাজারটা মুখার্জিকে আমি কখনও কেয়ার করিনি। তোমার লুথার সাহেব টেলিফোনে আমাকে প্রেম নিবেদন করতেন। লুথার সাহেব। তোমার মুখার্জির সারোগীর বস! তুমি জানো সে কথা! ইচ্ছে করলে লোকটাকে নাচিয়ে আমি অনেক কিছু আদায় করতে পারতাম। কেন? মিসেস লুথার, ওই পাঞ্জাবি উইচটা যখন দিল্লি গিয়েছিল আর লুথার অসুস্থ হলো তখন তুমি চাওনি আমি গিয়ে লোকটাকে দেখে আসি! গেলে তোমার প্রমোশন আর আটকে থাকত না! তুমি কি নিজের সুবিধের জন্যে আমাকে ব্যবহার করতে চাওনি?

অসম্ভব! তোমার সঙ্গে কথা বলা যায় না। আমি সরল মনে যা বলেছি তখন তুমি প্রতিবাদ করোনি আর এখন বিশ্রীভাবে ব্যাখ্যা করছ। বাবার পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। কথা বলতে বলতেই অন্য ঘরে চলে গেলেন। বিছানায় শুয়ে চোখের আড়ালে থাকা মায়ের মুখ কল্পনা করল ভরত। মা এখন হাঁপাচ্ছে। ঠোঁট কামড়াচ্ছে। এত তাড়াতাড়ি বাবা রণে ভঙ্গ দেবে ভাবতে পারেনি।
 
প্রেসিডেন্সি কলেজে যাতায়াতের জন্যে কলেজবাস থাকলে বাবা-মা খুশি হত। তখন ওর দিকে তারা এমন চোখে তাকাত যেন ক্যান্সার রুগি দেখছে। কোনো উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নেই, নিশ্চিত অর্থ রোজগারের প্রতিশ্রুতি নেই এমন জীবনে ছেলে প্রবেশ করেছে এবং সেটা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে তারা। ওইসময়ে ওদের কথাবার্তায় বেশ মিল থাকত, দেখে মনে হত মেড ফর ইচ আদার। প্রথমদিন কলেজে ভর্তির সময় বাবা গিয়েছিল। বাড়ি থেকে কোন বাস কতরকম রাস্তা হয়ে যায় তা পইপই করে বুঝিয়ে বলেছিল, যদি কোনও প্রব্লেম ফেস করো সঙ্গে সঙ্গে আমার অফিসে ফোন করবে। তোমার পকেটে যেন এক টাকার কয়েন সবসময় থাকে। পাবলিক বুথ থেকে ফোন করতে পারবে?

মা বলেছিল, শোনো, পড়াশুনায় ভাল রেজাল্ট করলেই সবার চরিত্র ভাল হয় না। তোমার কলেজে এমন অনেক মেয়ে বা ছেলে পাবে যারা সিগারেট খায়, ড্রাগ নেয়, আরও কত কী করে। তুমি তাদের সঙ্গ এড়িয়ে যাবে। কফি হাউসে আড্ডা মারতে যেও না। ওখানে ভদ্রলোক দুদণ্ড বসতে পারে না।

কিন্তু আমি ওদের চিনব কী করে? ভরতের খুব মজা লাগছিল।

মা ছেলের মুখের দিকে তাকাল, কে কী বলছে, কার সম্পর্কে কী শুনলে রোজ বাড়ি ফিরে আমাকে বলবে, আমি শুনে তোমাকে গাইড করব।

প্রথম কয়েকদিন আদেশ মান্য করেছিল। যে যা নয় তাকে তাই সাজিয়েছিল ভরত। এমন কি অধ্যাপকরাও বাদ যায়নি। আর তার ফলে মা তামাম কলেজকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বাবাকে বলেছিল ভরতকে অন্য কলেজে ভর্তি করতে। কারণটা শুনে বাবা হো হো করে হেসেছিল, লোকে তোমাকে পাগল বলবে।

একথা ঠিক প্রথম প্রথম বাসে ট্রামে একটু অস্বস্তি হত। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাদুড়ঝোলা ভিড় দেখতে দেখতে শরীর কিরকম করে উঠত। ঝুলন্ত মানুষের মুখগুলো কি ভয়ঙ্কর। নতুন কোনও যাত্রী পাদানিতে পা রাখতে চাইলে তারা স্বার্থপর এবং নৃশংস হতে দ্বিধা করছে না। এই মানুষরাই যখন মাটিতে হাঁটে, ঘরে বা অফিসে বসে থাকে তখন তাদের চেহারা বদলে যায়। বাসের ভেতরে ঢোকার জায়গা পেলে একটা তীব্র বোঁটকা গন্ধে নাক বন্ধ হয়ে আসে। দুঃসহ গরম, মানুষের ঘাম এবং শরীরের চাপ সহ্য করতে করতে কেবলই একটাই প্রার্থনা কত দ্রুত গন্তব্যস্থলে পৌঁছানো যায়। ভরত অবাক হয়ে দ্যাখে কেউ এই ব্যবস্থার প্রতিবাদ না করে নিজেদের মধ্যেই দাঁড়ানোর সুবিধে নিয়ে কামড়াকামড়ি করছে। পৃথিবীর একটি সভ্য দেশের নাগরিকদের যাতায়াতের পথে স্বস্তি পাওয়ার কোনও উপায় নেই এবং কেউ যে তাই নিয়ে চিন্তা করছে তাও ওর মনে হয় না। এই সময় স্কুলবাসকে স্বর্গ বলে মনে হত তার।
 
কলেজে অর্ণব বসুরায় নামের একটি ছেলের সঙ্গে ভরতের সখ্যতা হল। এই বয়সে অর্ণব যা পড়েছে ভরত তা পড়ার সুযোগ পায়নি। সে বঙ্কিমচন্দ্র পড়েছে, শরৎচন্দ্রের বাছাই করা বইগুলো এবং রবীন্দ্রনাথের কিছু কিছু। বিজ্ঞান পড়ার সঙ্গে সাহিত্যের কোনও যোগ নেই বলে তাকে বোঝানোনা হয়েছিল ওই সব পড়ে সময় নষ্ট করার কোনও মানে হয় না। কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের। সব লেখা সে পড়েছে। বাবা বলত, বিকেলে যখন পড়াশুনা করবে না তখন ফেলুদা শঙ্কু পড়বে, তোমার ব্রেন রেস্ট পাবে। প্রত্যেকটা মানুষের একটু আধটু রিলিফ দরকার।

অর্ণব বসুরায় যখন তাকে গোর্কি, মম অথবা ডিকেন্সের কথা বলে তখন সে অবাক হয়। ওর স্কুলের বন্ধু পাভেল এখন যাদবপুরে পড়ে। ওর নামটা গোর্কির উপন্যাস থেকে নেওয়া তা সে জানে। কিন্তু উপন্যাসের বিষয় তার অজানা। বলেছে সত্যজিৎ রায় রহস্যরোমাঞ্চ সিরিজ খুব ভাল লেখেন কিন্তু উপন্যাস পড়তে হলে বিভূতিভূষণ তারাশঙ্কর পড়তে হবে।

ভরত জিজ্ঞাসা করছিল, শুধু মজা পাওয়ার জন্যে এগুলো যে পড়ব তার সময় কোথায়?

অর্ণব বসুরায় অবাক হয়েছিল, কী বললে তুমি? সাহিত্য শুধু মজা পেতে পড়ে নাকি লোকে?

তা হলে কী জন্যে পড়ে? ফিজিক্স কেমিস্ট্রি ম্যাথস-এর সঙ্গে উপন্যাসের কী সম্পর্ক?

জীবনদর্শন তৈরি হয়। সাহিত্য সমাজের প্রতিবিম্ব। সামাজিক বিবর্তনের বিবরণ সাহিত্যে পাওয়া যায়। তুমি যে প্রফেশনই নাও মানুষকে জানতে গেলে এবং নিজের মূল্যায়ন করতে হলে সাহিত্য পড়তে হবে তোমাকে। তুমি আগে মানুষ তারপর অন্য কিছু। যত বড় বিজ্ঞানীই হও তোমার মন খারাপ হলে রবীন্দ্রনাথের গান অথবা জীবনানন্দের কবিতায় তুমি বন্ধু খুঁজে পাবে।

অর্ণব বসুরায় তাকে একটা লিস্ট বানিয়ে দিয়েছিল। হুতোম প্যাচার নকশা থেকে দেখি নাই ফিরে পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের যে সব বই অবশ্যই পড়া উচিত তা সেই লিস্টে ছিল। ভরতের মনে হয়েছিল বিকেলের কয়েকঘণ্টায় ও-গুলো পড়ে শেষ করা অসম্ভব। ফলে সে রাত জাগতে আরম্ভ করল।

বাল্যকালে মা তাকে গান শোনাত। সেইসব গান মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। সে লক্ষ্য করেছিল ওই গানগুলোর প্রতি বাবারও মমতা ছিল। মাঝে মাঝে দুজনে গলা মেলাত। এখনও মন ভাল থাকলে, সম্পর্ক কাছাকাছি এলে দুজনে গান গায়। অদ্ভুত ব্যাপার, গানগুলোর সবই দেশাত্মবোধক। আজ বিকেলে, ছুটির বিকেলে ওদের গাইতে শুনল ভরত। দেবদাস পড়ছিল সে। বই রেখে সে ওদের ঘরে গেল। বাবা শুয়ে শুয়ে গাইছে, মা পাশের চেয়ারে বসে খাটে পা তুলে দিয়ে গলা মেলাচ্ছে। ওকে দেখতে পেয়ে বাবা হাতের ইশারায় গাইতে বলল। সে মাথা নেড়ে আঙুল তুলতেই ওরা থেমে গেল। ভরত বলল, এই যে লাইনটা এত আবেগ দিয়ে গাইছ তার মানে কী? ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে!

ভারতবর্ষের আবার সুদিন ফিরে আসবে। জগতের শ্রেষ্ঠ দেশ হবে। খুব সরল কথা। মা আগ বাড়িয়ে জবাব দিল।

চমৎকার। আবার শব্দটার মানে আপাতত শ্রেষ্ঠত্বে নেই কিন্তু একদিন ছিল, তাই তো। বল তো, কবে ভারত জগতের শ্রেষ্ঠ দেশ ছিল?
 
মা বাবার দিকে তাকাল। বাবা উঠে বসল, ছিল। যখন ভারতীয় সংস্কৃতি সমস্ত বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সংস্কৃতি হিসেবে স্বীকৃত ছিল।

কখন?

আশ্চর্য। তুমি ইতিহাস পড়নি?

পড়েছি। মোগল সাম্রাজ্যের সময়, আলেকজান্ডার যখন এসেছিল তখনও নয়। আর তার আগে ভারতবর্ষ কনসেপ্টটাই ঠিক গ্রো করেনি। সব ছোট ছোট রাজ্য এবং তাদের মধ্যে সংঘাত

হত। ভারত যে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ হয়েছিল তার সদস্য কারা ছিল? আই মিন কমপিটিটার?

বাবা বলল, তুই কী বলছিস? মহেঞ্জোদাড়ো হরপ্পা?

মহেঞ্জোদড়ো হরপ্পা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা নয়। ওগুলোকেও আর ভারতবর্ষের বলা নিরর্থক। একসময় এইসব গান লেখা হয়েছে দেশাত্মবোধক আবেগে। তখন দেশকে মহান করার জন্যে যা মনে আসে তাই লিখেছেন কবি। কিন্তু এখন তোমরা গাইবার সময় যে ভুলভাল গাইছ তা মনে রাখবে না কেন?

বাবা বলল, আজকাল দেখছি খুঁত ধরতে শিখে গিয়েছ। আর কোনও গানে ভুল পেয়েছ?

ভুল নয় নয়, বাড়াবাড়ি। সেইসঙ্গে পরাধীন মনোভাব।

যেমন?

ওই যে, সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি!

মাই গড! এত ভাল গান নিয়েও তুমি ব্যঙ্গ করছ?

বাবা, তোমরা একটু ভাব। আমি আমার দেশকে সব চেয়ে ভালবাসব, দেশের সব কিছু আমার প্রিয় হবে এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না। নিজের ভাঙাবাড়িও অনেক আপন। কিন্তু যখন কবি বলেন সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি তখন অবশ্যই একজন রাজার অদৃশ্য অস্তিত্ব মনে করতে হয়। পৃথিবীতে একমাত্র ব্রিটেনের রানি ছাড়া সব রানীই রাজার অধীন। আমার দেশ রানি মানে আমরা একটি রাজার অধীন। হোয়াই? ব্রিটিশদের খুশি করতে কি ওই গান লেখা হয়েছিল? প্রশ্ন করে তাকিয়ে থাকল ভরত কিছুক্ষণ। জবাব না পেয়ে ধীরে ধীরে ফিরে গেল দরজার বাইরে এবং তখনই কানে এল মায়ের গলা, স্পয়েল হয়ে যাচ্ছে। কলেজে ঢোকার পর থেকেই ওর মধ্যে চেঞ্জ দেখতে পাচ্ছি আমি।

রাজনীতি করছে নাকি? বাবার গলায় আশঙ্কা।

বুঝতে পারছি না। বলেছি তো ইউনিয়ন থেকে দূরে থাকতে। কিন্তু ওর টেবিলে আমি গোর্কির মাদার পেয়েছি। আমার ভয় করছে।

বাবা বলল, মাদার আমরাও কলেজে পড়েছি। আমার কি, নিজের ক্যারিয়র ও যদি নিজে নষ্ট করতে চায় তা হলে ওই পস্তাবে।

আশ্চর্য! সুবিধেবাদীর মতো কথা বলবে না। আমাদের ছেলের ভবিষ্যৎ আমরা দেখব না?

কী ভাবে দেখবে? ও কি স্কুলবয়? দেখছ না কীভাবে যুক্তি দিয়ে কথা বলতে শিখে গেছে।

সেক্ষেত্রে পাল্টা যুক্তি দিতে হবে।

দ্যাটস ভেরি ডিফিকাল্ট। এই তো আমি এখনও ভেবে পেলাম না ভারত কবে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন নিয়েছিল। এই আবার শব্দটা লেখার কী দরকার পড়েছিল কবির!

তুমি অন্যদিকে চলে যাচ্ছ? মা ধমকে উঠল।

দ্যাখো, ও ড্রাগ খাচ্ছে না, কোনও মেয়ের সঙ্গে প্রেম করছে না। রেজাল্ট খারাপ না করা পর্যন্ত লক্ষ্য করে যাও।

খারাপ হলে কিছু করার থাকবে?

তুমি কী বলতে চাও? ওই ছেলেকে ডেকে আমি শাসন করব? কী বলব? কেন তুমি চিরাচরিত সত্য বলে যা জানি তাকে চ্যালেঞ্জ করছ? কেন উদ্ধত হচ্ছ? মুশকিল হল কি তোমার কোনও ব্যাপারেই ধৈর্য নেই। আমার ক্ষেত্রেও একই কাণ্ড করেছ। বাবার গলা ওপরে উঠল।

ও, তাই? তুমি অন্যায় করছ দেখেও আমি চুপ করে থাকলে তোমার শান্তি! পার্টিতে গিয়ে যখন বুড়িগুলো তোমার কোলের ওপর আঁচল ফেলে দেয় তখন আমাকে চোখ বন্ধ করে থাকতে হবে? তার নাম ধৈর্য? নো। আমার দ্বারা অসম্ভব। এই পঞ্চাশ বছর বয়সেও তোমার ছোঁকছোঁকানি গেল না। মা ছিটকে বাইরে বেরিয়ে এসে ওকে দেখতে পেয়ে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করল। ভরত হেসে ফেলল।

মা জিজ্ঞাসা করল, হাসছ কেন? হাসির কী আছে?

আমি ভেবে পাই না, তোমাদের মধ্যে প্রতি কথায় মতভেদ হয়, ঝগড়া বাধে তবু তেইশ বছর ধরে তোমরা পরস্পরকে টলারেট করে একসঙ্গে আছ কী করে?

তার মানে? মা আঁতকে উঠল।

রাগ কোরো না। পাশাপাশি দুটো দেশ থাকলে এরকম সম্পর্কে হলে বহুবার যুদ্ধ হয়ে যেত, প্রচুর লোক মারা যেত। কিন্তু তবু তোমরা একসঙ্গে গান গাও। আমি জানি না রহস্য কী!

তোমাকে এ সব কিছুই জানতে হবে না। কলেজে ঢুকে এই উন্নতি হয়েছে!
 
তাহলে প্লিজ আমার সামনে ঝগড়া করো না তোমরা। অ্যাট লিস্ট, আমি যখন থাকব না সে রকম সময় বেছে নিও অথবা আমি বাড়িতে থাকলে ঝগড়া করার আগে বলো আমি বেরিয়ে যাব। ভরত নিজের ঘরে ফিরে এল।

ব্যাপারটা একটু বেশি হয়ে গেল হয়তো কিন্তু না বলে পারেনি ভরত। আর বলার পর দেখতে পেল বাবা-মায়ের মধ্যে চমৎকার আঁতাত তৈরি হয়ে গেল। দুজনেই এখন একসঙ্গে তাকে প্রতিপক্ষ বলে ভাবছে। অবশ্য সে জানে এই আঁতাত বেশি দিন থাকবে না। ঝগড়া না করে ওদের পক্ষে জীবনযাপন অসম্ভব। কিন্তু তাকে উপলক্ষ করে যদি ওরা কিছুক্ষণ এক হয় তাই বা মন্দ কী! কলেজের বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কথা বলে সে ক্রমশ জানতে পারল সবারই কম-বিস্তর একই অভিজ্ঞতা। পঞ্চাশের কাছাকাছি শিক্ষিত বাবা-মা যারা অনেককাল আত্মীয়স্বজন বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা থাকে সম্পর্ক জটিল হয়ে যাচ্ছে। পরস্পরকে সহ্য করতে না পারলেও তাদের খুব কম সংখ্যকই বিবাহ বিচ্ছিন্ন করছে। এই সব মানুষের কথা গল্প-উপন্যাসে খুব একটা পাওয়া যাচ্ছে না। শরৎচন্দ্র থেকে আরম্ভ করে আজকের অনেক লেখকই এই সব সমস্যা তাদের উপন্যাসে তুলে ধরেননি। শরশ্চন্দ্রের সময়ে হয়তো এই সমস্যা ছিল না কিন্তু তারপরে? মানুষের জীবনের কথা না বলে তাদের নিয়ে নানান কল্পনা করা কি সামাজিক চিত্র চিত্ৰণ? আজ পর্যন্ত কোনও লেখায় বাবা কিংবা মাকে পাওয়া গেল না। অথচ এরা প্রায় প্রতিটি শিক্ষিত পরিবারের সদস্য। সেদিন তাদের হাউসিং কমপ্লেসে একজন বাউলের পোশাক পরা মানুষ গান গাইছিল। তার দুটো লাইন ভরতের খুব মনে ধরেছিল, আমার আসার গরজ কিছু নাহি ছিল/দুজনার ইচ্ছায় আমায় আসিতে হইল।

গানের লাইনদুটো অর্ণব বসুরায়কে বলেছিল ভরত। রোগা চশমা পরা ছেলেটা বলল, আবার বলো। ভরত দ্বিতীয় বার বলেছিল। অর্ণব বসুরায় বলেছিল, বাউল বৈরাগী দরবেশ ফকির যাঁদের আমরা অশিক্ষিত বলি তারা জীবনের কঠিন সত্যগুলো কি সহজে বলে দেন। জানো ভরত, আমি ঠিক করেছি খাওয়া পরা এবং পড়াশুনার খরচ ছাড়া বাবা-মায়ের কাছ থেকে বাড়তি কিছু নেব না। আমি একটা টিউশনি করছি তাতে যাতায়াতের খরচ ইত্যাদি দিব্যি কুলিয়ে যায়।

কেন? হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত কেন?

ওই গানটাতেই সেটা বলা আছে। আমার তো আসার গরজ ছিল না, বাবা-মা নিয়ে এসেছেন বলে এসেছি। যতদিন আমি সম্পূর্ণ স্বাবলম্বী না হচ্ছি ততদিন সেটা তৈরি করে দেওয়ার দায়িত্ব তাদের। কিন্তু যেহেতু এই পৃথিবীতে আসার পর ধীরে ধীরে আমার নিজস্ব সত্তা তৈরি হয়েছে তাই আমি সব ব্যাপারে তাদের ওপর নির্ভর করব না।

সব ব্যাপার বলতে?

এই যেমন সিগারেট খাওয়া, সিনেমা দেখা, কফিহাউসে কফির দাম দেওয়া। এই খরচগুলো করতে হলে টাকার দরকার হয়। বাবা-মায়ের কাছে হাত পেতে টাকা নিয়ে তা করতে আমার আপত্তি আছে। একটা মানুষ এগুলো ছাড়াই চমৎকার বেঁচে থাকতে পারে। যেসব প্রয়োজন এড়িয়ে যাওয়া যাবে না তার জন্যে আমি ওদের নির্ভর করব। আর যেদিন আমি নিজে রোজগার করে ওই সব খরচ অ্যাফোর্ড করতে পারব সেদিন করব।
 
অর্ণব বসুরায়ের এই সব কথায় চমক ছিল। কলেজে যাওয়া আসার জন্যে বাবা প্রতি মাসে দুশো টাকা দেন। তার বেশির ভাগই বেঁচে যায় যা কফিহাউসে খরচ করে ভরত। শুধু সে কেন কলেজের অনেক ছেলে মেয়ে এর চেয়ে অনেক বেশি হাতখরচ পায় বাড়ি থেকে, ফুরিয়ে গেলে জোর করে আদায় করে আবার। কণিষ্ক যে বিদেশি সিগারেট রোজ এক প্যাকেট করে খায় তার দাম চল্লিশ টাকার বেশি। অথচ অর্ণব বসুরায় নিজেকে কষ্ট দিতে চাইছে। ভরত আবিষ্কার করল এই কষ্ট করে অন্য এক সুখ পাওয়া যায়। সে হাউসিং কমপ্লেক্সেরই একটি ছেলেকে পড়ানোর দায়িত্ব নিল। প্রথম মাসের মাইনে পেয়ে বাবাকে বলে দিল তার আর হাত খরচের দরকার নেই। ছেলে ছাত্র পড়াচ্ছে এ খবর পাওয়ার পর মা অনেক নাটক করেছিল, মিসেস গুপ্তার কাছ থেকে তুই টাকা নিবি? ও কী ভাববে আমাদের?

তোমাদের ভাবতে যাবে কেন? নেব তো আমি।

আশ্চর্য! এখানে তোকে সবাই আমাদের ছেলে বলেই জানে।

ওঁর ছেলেকে পড়াচ্ছি বলে উনি টাকা দেবেন। ওঁর একজন প্রাইভেট টিউটারের দরকার ছিল আর আমার টাকাটার। চুকে গেল।

আমরা বেঁচে থাকতে তোর এত টাকার দরকার হলে?

তুমি ব্যাপারটা বুঝবে না মা। দয়া করে এমন সিন করো না যে মনে হবে গোটা মহাভারত আজ অশুদ্ধ হয়ে গেল। আমি ঠিক আছি। ভরত বলেছিল।

.

নিজেকে একটু আলাদা করে ভাবতে ভাল লাগে ভরতের। আজকাল মাথায় এমন সব প্রশ্ন উঁকি দেয় যার উত্তর সহজে পাওয়া যায় না। ওদের কলেজের অধ্যাপক পি কে জি রাজনীতি করা মানুষ। বাম মহলে যথেষ্ট যথেষ্ট শ্রদ্ধা পান ভদ্রলোক। মাথায় ঢোকা একটা সমস্যা তার কাছে পেশ করেছিল সে। শুনে ভদ্রলোক চোখ বন্ধ করলেন, হঠাৎ এমন ভাবনা?

গতকাল একটা বই পড়ছিলাম। তা থেকেই মনে এল। আপনার কাছে এটা সমস্যা বলে মনে হচ্ছে না?

হ্যাঁ নিশ্চয়ই। তবে যখন স্রোত উত্তাল হয় তখন কচুরিপানা ভেসে যায় তাতে। অধ্যাপক হেসেছিলেন, এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। সময় তাদের পরিবর্তিত করবে।

এটা ঠিক উত্তর হল না স্যার।

তুমি কী জানতে চাইছ?

আমি আবার বলছি। যখন কোন স্বৈরাচারী শাসক দেশ শাসন করে তখন তাকে সাহায্য করে নিজেদের আখের গোছাতে প্রচুর লোক এগিয়ে যায়। সৈন্যবাহিনীও লোকটির হাতে থাকে। এই শক্তির বিরুদ্ধে তিলতিল করে দেশের মানুষ যদি একত্রিত হয়ে বিপ্লব করে তখন স্বৈরাচারী পিছু হঠতে বাধ্য হয়। বিপ্লব হয়ে গেলে জনগণের সরকার যখন প্রতিষ্ঠিত হবে তখন দেখা যাবে দেশের নাগরিকদের কিছু অংশ, ধরা যাক দশ কি পনের অংশ স্বৈরাচারী শাসকের অনুগামী ছিল। এদের সংখ্যা হয়তো তিন লাখ। বেছে বেছে এদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের বিচার করে শাস্তি দেওয়া হলো আর বাকিরা নতুন শাসনব্যবস্থার সঙ্গে মিশে গেল নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে। দেখা গেছে পরে এরাই আবার জনসাধারণকে ভুল বুঝিয়ে উদ্বুদ্ধ করে গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে স্বৈরাচারীকে ফিরিয়ে আনার কাজে। আমাদের দেশেও যারা একসময় ব্রিটিশদের সাহায্য করত তারাই স্বাধীনতার পরে বড় বড় সরকারি পদে গিয়ে বলেছে ব্রিটিশ আমল ভাল ছিল। বিপ্লবের পর এদের বাঁচিয়ে রাখা মানে যাকে ছুরির ওপর শুয়ে থাকা বলে যারা মনে করেন তারা কি ভুল করেন? ভরত জিজ্ঞাসা করল।
 
মাই গড! তুমি কি চাইছ বিপ্লবের পর ওই তিনলক্ষ মানুষকে মেরে ফেলা হোক? তা হলে নাৎসিদের সঙ্গে পার্থক্য কোথায় থাকল? অধ্যাপক জিজ্ঞাসা করলেন।

ওদের বাঁচিয়ে রাখা মানে প্রতি মুহূর্তে কষ্টে পাওয়া শাসনব্যবস্থাকে বিপন্ন করার সম্ভাবনা জিইয়ে রাখা। বিশ্বাসঘাতকরা সবসময়ই বিশ্বাসঘাতক।

ঠিকই। কিন্তু জনগণের চাপে এরা পথ বদলাতে পারে। তুমি যা বলছ তা গণহত্যা, কোনও বিপ্লবী সরকার সেটা করতে পারে না। অধ্যাপক মাথা নাড়লেন, ধরা যাক তাদের ওই শাস্তি দেওয়া হল। তারপর ওই অত লক্ষ্য লোকের পরিবারের কী হবে? কে তাদের দায় বহন করবে? আগে বিপ্লব হোক তারপর এ সব ভাবনা ভেবো।

ভরত সন্তুষ্ট হয়নি। তার কেবলই মনে হতে লাগল কোথায় কঁক থেকে যাচ্ছে। দ্বিতীয় চিন্তাটা মাথায় আসামাত্র সে অধ্যাপককে ধরল, আমাদের দেশে প্রায় সতেরো বছর ধরে মার্ক্সবাদী মানুষেরা শাসনব্যবস্থায় আছেন। প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশ কম্যুনিস্টদের।

হ্যাঁ। জনসাধারণ সেই রায় দিয়েছে। কিন্তু এতগুলো বছরেও পশ্চিমবাংলায় কোনো এলাকার সমস্ত মানুষদের মার্ক্সবাদে দীক্ষিত করা গেল না কেন? কেন সরকারি সমস্ত ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও মার্কসীয় সমাজের ছবি এরা তুলে ধরতে পারলেন না কোনও পাড়ায়? সেই চেষ্টা কি করেছেন উঠতি থেকে প্রতিষ্ঠিত নেতারা? কোনও এলাকায় কর্মীরা কি বুর্জোয়া বদমায়েসী থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়েছেন?

অধ্যাপক চোখ ছোট করলেন, এই শাসনব্যবস্থায় সেটা সম্ভব নয়। কেন্দ্রীয় সরকার সেটা হতে দেবে না। আমরা যা করেছি তা সীমিত ক্ষমতার মধ্যে থেকে করেছি। মনে রেখে প্রায় আমাদের কাছাকাছি ভট প্রতিপক্ষ পেয়ে থাকে। এ দেশে বিপ্লব না হলে তুমি যা বলছ তা হওয়া অসম্ভব।

ব্যাপক আকারে না হলেও ক্ষুদ্র গণ্ডিতেও অসম্ভব?

হ্যাঁ। তাই।

এমনকি দলের কর্মীদের মধ্যেও বুর্জোয়া ভাইসেস থেকে যাবে?

যাদের মধ্যে ও সব আছে তারা দলের সদস্য নয়।

এসব কথা দায় এড়াবার জন্যে বলা তা বুঝে দিয়েছে ভরত। ক্রমশ তার মনে হতে লাগল এ দেশের কম্যুনিস্ট পার্টিগুলো সংঘবদ্ধ একটা যন্ত্র যা কোনও সমালোচনা সহ্য করতে পারে না। তারা যা মনে করে ঠিক তাই মানুষের উপর চাপিয়ে দিয়ে খুশি হয়। তার ফলে জনগণের উপকার যদি দশ শতাংশ হয় তা হলে ক্ষতি হয় নব্বই। কংগ্রেসিদের ওপর ভরসা করার কোনও মানেই নেই। একটি শিশুও জানে দুজন কংগ্রেসি একসঙ্গে থাকা মানে তাদের পেছনে দুটো উপদল আছে। একেবারে নগ্ন গুণ্ডাবাজি করা তাদের খুব স্বাভাবিক আচরণ। জনসাধারণের উপকার করার কথা এরা ভাবে কিন্তু বাস্তবে এঁদের কাজের জন্যে শতকরা একভাগও উপকৃত হয় না। তবু এই দুই দলের ওপর দেশের ভাগ্য নির্ণয় করে। এরাই হর্তাকর্তা। ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় দেশের ভালমন্দ কী হবে তা এরাই ঠিক করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর কৌশল এমনই, জনসাধারণ যাতে এদের বাইরে আর কারও কথা চিন্তা না করতে পার তার জন্যে এরা মরিয়া।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top