What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected ফেরারী - সমরেশ মজুমদার 🎭 (2 Viewers)

নদীতে জল নেই, পুকুরগুলো খাঁ-খাঁ করছে। একটাও গাছ নেই, ঘাস বাগান ফুল সব ছাই হয়ে গেছে। বলতে বলতে থমকে দাঁড়ালো স্বপ্নেন্দু, না সব নয়। একটা ফুল আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে আছে, এখনও।

একটা ফুল? কোন ফুল, কোথায়?

স্বপ্নেন্দু হাসল, শব্দ হল, সেটা বলা যাবে না। একমাত্র আমিই তার হদিশ জানি।

আঃ আবার সাজানো কথা!

স্বপ্নেন্দু বুঝতে পারল। হেনা মনে করেছে স্বপ্নেন্দু তার কথা বলছে। যেন হেনাকে একটা ফুলের সঙ্গে তুলনা করেছে স্বপ্নেন্দু। সে আর ভুল ভাঙল না। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি সাজানো কথা বলি না।

হেনা সেন উঠল, আজ যে আমার কী হলো!

কী হল?

আপনি আসার আগে মনে হচ্ছিল, থাক, বাদ দিন।

দরজা বন্ধ করার আগে হেনা জিজ্ঞাসা করল, সত্যি কথা বলুন তো, আমি কি খুব কুৎসিত হয়ে যাইনি?

স্বপ্নেন্দু বলল, পরিবর্তিত পরিস্থিতি অনুযায়ী মোটেই না।

হেনার মাথাটা নিচু হল, আপনি আমার মনটাকে পাল্টে দিয়ে গেলেন। আবার কবে আসবেন?

কাল।

সত্যি?

হ্যাঁ। স্বপ্নেন্দু আর দাঁড়াল না। বাইরে বেরিয়ে স্বপ্নেন্দুর হাঁটার গতি বেড়ে গেল। জয় করায়ত্ত। এত সহজে যে সে হেনা সেনকে পেয়ে যাবে তা কল্পনায় ছিল না। একথা ঠিক যদি এই বৈপ্লবিক পরিবর্তন না ঘটত তাহলে ব্যাপারটা এত সহজ হত না। হেনা সেন তাকে নানাভাবে যাচাই করত এবং হয়ত শেষ পর্যন্ত ছুঁড়ে ফেলত।

স্বপ্নেন্দু ভাবল, এবার একটা দিন ঠিক করে ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের কাছে ওরা যাবে। হ্যাঁ, তার শরীর নেই। পুরুষ মানুষের কোনো চিহ্ন তার নেই। হেনার মধ্যে মহিলাত্ব পাওয়া যাবে না। কিন্তু ওগুলোই কি সব? পুরুষ এবং মহিলা কি দুজনের শরীরের মধ্যেই তৃপ্তি খুঁজবে শুধু? তাদের মনের আনন্দ বলেও তো একটা ব্যাপার আছে। হেনা সঙ্গে থাকলে সে ওই আনন্দ পাবেই। দুজনে মিলে গল্প করবে, ভালবাসবে, বেড়াতে যাবে। আসন্ন ভবিষ্যতের কথা ভেবে স্বপ্নেন্দু শিহরন বোধ করছিল।

বাস থেকে নেমে চোখের ওপর একটা ঘটনা ঘটতে দেখল সে। একজন মহিলা অলসভাবে হাঁটছিলেন। তাঁর হাতে একটা রেডিও সেট। বোধহয় সারাতে দিয়েছিলেন। বা ওইরকম কিছু। হঠাৎ একটা লোক তাঁর হাত থেকে সেটা ছিনিয়ে দৌড়তে শুরু করল। মহিলা চিৎকার করে পিছু ধাওয়া করতে কোত্থেকে আর একটা লোক উদয় হয়ে তার শাড়ির আঁচল টেনে ধরল। পত পত করে শাড়িটা খুলে গেল। মহিলা চেষ্টা করলেও সেটাকে আটকাতে পারলেন না। দ্বিতীয় লোকটা শাড়িটা হাতে নিয়ে উল্টোদিকে দৌড়ল। স্বপ্নেন্দু এতটা উত্তেজিত হয়েছিলো যে পিছু ধাওয়া করলো দ্বিতীয় লোকটার। কিন্তু দূরত্ব এত বেশি যে তার পক্ষে ধরা সম্ভব নয় বুঝে চিৎকার করতে লাগল যাতে অন্য লোক লোকটাকে ধরে। কিন্তু সে দেখল চারপাশের মানুষজন সে-চেষ্টাই করছে না। বরং হাসাহাসি শুরু হয়েছে। স্বপ্নেন্দু রাগত গলায় বললো, আপনারা হাসছেন? লজ্জা করছে না? একজন মহিলাকে বেইজ্জত করছে সবার সামনে। ছি ছি!

জনতার একজন বললো, কে মহিলা? উনি মহিলা তার প্রমাণ আছে?

থমকে গেলো স্বপ্নেন্দু, শাড়ি ব্লাউজ পরেছেন দেখছেন না?

আপনি শাড়ি ব্লাউজ পরলে মশাই একই রকম দেখাবে। শোনেননি কাল থেকে ইম-বাসে লেডিজ সিট উঠে যাচ্ছে।

লেডিস সিট উঠে যাচ্ছে? ততক্ষণে ছিনতাইকারী হাওয়া হয়ে গিয়েছে। স্বপ্নেন্দু মহিলার দিকে তাকাল। দুহাতে জামা ঢাকার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। স্বপ্নেন্দু বুঝল পুরনো সংস্কার এবং অভ্যেস ত্যাগ করতে পারেননি মহিলা।
 
সকালে শহরটা বেশ ছিমছাম ছিল। দুপুরে কী হয়েছিল স্বপ্নেন্দু জানে না। হেনা সেনের বাড়িতে যতক্ষণ ছিল বাইরের পৃথিবীর কথা খেয়াল ছিল না। কিন্তু বিকেলে মনে হলো কলকাতা যেন স্বচ্ছন্দ নয়। মানুষগুলোর ব্যবহার পাল্টে গিয়েছে।

অবনীদা বসেছিল দোকানে। স্বপ্নে দেখল দোকানটা ন্যাড়া। জিনিসপত্র কিছুই নেই। স্বপ্নেন্দু জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছেন অবনীদা? আমি স্বপ্নেন্দু।

দেখছ তো ভাই। এগুলো নিয়ে ওরা কী করবে জানি না তবু নিয়ে গেল।

কি নিয়ে গেল?

চায়ের কাপ-ডিশ-কেটলি জলের ড্রাম!

কারা নিল।

এখন তো চেনা মুশকিল। দল বেঁধে সাত আটজন এসেছিল। লুট করে নিয়ে চলে গেল। বললাম কোনো কাজে লাগবে না ভাই কিন্তু শুনল না। তুমি কিছু দ্যাখোনি?

মনে হলো কিছু একটা হয়েছে।

দোকানপাট লুট হচ্ছে, বড়ো রাস্তার কাপড়ের দোকানগুলো ভেঙে সবাই যে যার বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে। এমন কি মিষ্টির দোকান লুঠ করে সেগুলো চটকাচ্ছে মানুষগুলো। এসব কেন হচ্ছে জানো?

কেনো?

সবাই বুঝে গেছে তাদের আর পাওয়ার কিছু নেই। পুলিশ এসেছিল লরিতে চেপে। ধাওয়া করতে সবাই পালাল। কিন্তু এর মধ্যেই মানুষ জেনে গেছে পুলিশের পুরনো বন্দুকগুলো অকেজো হয়ে গিয়েছে। নতুন যে অস্ত্রের কথা শোনা যাচ্ছে তা কেউ চাক্ষুস করে নি। এখন তাই পুলিশ দেখলে কেউ ভয় পায় না।

অকেজো হয়ে গিয়েছে মানে?

ট্রিগার টিপলেও গুলি বের হচ্ছে না। বোধহয় গুলিগুলোর বারোটা বেজে গেছে। কি ভয়ঙ্কর কথা! চারিদিকে এখন অরাজকতা শুরু হয়ে যাবে। তুমি জানো আমার ছেলেটা আমাকে কী বলেছে?

কী?

বললো, একদম চোখ রাঙাবে না। তোমার খাই না পরি? আমি আমার মতো থাকব তুমি নাক গলাবে না। জীবনে যা কিছু সবই তো ভোগ করেছ। আমি কী পেলাম? বোঝো! আমার ভয় হচ্ছে আমাদের সংসারগুলো পর্যন্ত ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। নরক, নরক এসে গেল। এইসময় আর একটা কঙ্কাল এসে হাজির হল। তার দিকে তাকিয়ে চিনতে পারল না স্বপ্নেন্দু। লোকটা বললো, টিভি চালু হয়েছে? অবনীদা মাথা নাড়লো, জানি না। ওটা ছেলে বগলদাবা করে সরে পড়েছে। বাড়ির সব জিনিস সে হাওয়া করে দিচ্ছে।

কেন?

এখন পড়ে থাকা নাকি মূর্খামি। এমন কি সে তার মাকে বলছে, তুমি আর মা কোথায়, মা হতে হলে তো মেয়েমানুষ হতে হয়।

স্বপ্নেন্দু আর দাঁড়াল না। তার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। পাশের বাড়ির জানলায় একটি মুখ চিৎকার করে উঠল, কে কে?

আমি স্বপ্নেন্দু।

ও তুমি। আমি তোমার হরিজ্যাঠা। কিন্তু তুমি স্বপ্নেন্দু তার প্রমাণ কী? আজকাল তো কাউকে বোঝা যায় না। বাপের নাম বল?

আমার বাবা আপনার বন্ধু ছিলেন। ঈশ্বর তারকনাথ।

ও বুঝেছি। উই হ্যাভ লস্ট আওয়ার আইডেন্টিফিকেশন। সাম্যবাদ। সাম্যবাদ। ক্যুনিজম। তোমার মুখ্যমন্ত্রী যা বোঝাবেন তাই বুঝতে হবে? বাবা ছেলের দিকে তাকিয়ে চিনতে পারে না। মেয়েকে আর মেয়ে বলে মনে হয় না। হ্যাঁ, শোনো। সবসময় দরজা বন্ধ রাখবে বাবা। কোনো সিকিউরিটি নেই। যে কোনো মুহূর্তেই বাড়ি লুঠ হতে পারে। বড়ো রাস্তায় কী হয়েছে শুনেছ?

শুনেছি।

দাঙ্গার সময় এরকম হতো। তখন কারণটা বোঝা যেত। আমি তো দরজা খুলছি না। যা কথা বলার জানলা দিয়ে বলো।

স্বপ্নেন্দু সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এল। এই সিঁড়ির মুখে কোনো দরজা নেই। ওপরে উঠে পাশাপাশি দুটো ফ্ল্যাট। নিচে দরজা থাকলে কে বন্ধ করবে সেই ঝামেলায় ওটা খোলা রাখা রয়েছে।
 
ঘরের দরজা বন্ধ করে স্বপ্নেন্দু টেবিলের কাছে চলে এল। চাদর সরাতে ঝাপসা লাল রঙ চোখে পড়ল। সন্তর্পণে বড়ো জারটা খুলতেই ছোটো কাচের বাটির মধ্যে রক্তগোলাপটাকে স্পষ্ট দেখা গেলো। সেই একেই রকম সতেজ, ডাঁটো পাপড়ি। আর কি আশ্চর্য, সেই জলের ফোঁটাটাও অবিকল রয়ে গেছে। স্বপ্নেন্দু বুঝতে পারছিল একটু হাওয়ার স্পর্শ পেলে ফুলটা হয়তো ছাই হয়ে যাবে। সে কৃপণের মতো ফুলটার দিকে তাকাল। আঃ, হৃৎপিণ্ড ক্রমশ শান্তিতে ভরে যাচ্ছে। কি আরাম।

একটা তোয়ালে নিয়ে মুখ পরিষ্কার করল সে। ধুলো লেগেছিল করোটিতে। তোয়ালেতে বেশ ময়লা। নিজের জামাকাপড় খুলে সে খাটের ওপর চিত হয়ে শুয়ে পড়ল। জানলা দিয়ে হাওয়া ঢুকছে ঘরে। ঝিরঝিরে হাওয়া তার হাড়ের মধ্যে দিয়ে স্বচ্ছন্দে এপাশ ওপাশ করছে। শীতকালে কী হবে? তখন কি হাড় কনকন করবে?

স্বপ্নেন্দুর মনে হেনা সেনের মুখ ভেসে উঠল। নরম চিবুক, গলার স্বরে এখনও আগের মমতা। হেনা কি তাকে ভালোবেসেছে? স্বপ্নেন্দুর হৃৎপিণ্ড কেঁপে উঠল। আর কিছু চায় না সে। শুধু হেনা ভালোবেসে তার পাশে থাক। ওর সেই মায়া-চোখ, আদুরে গাল, মোহিনী হাসি, দম-বন্ধ করা বুক নাই থাকল কিন্তু হেনা তো আছে। আজ বিকেলে যা দেখল এবং শুনল তাতে কলকাতার পরিবেশটা কাল কি হবে অনুমান করা যাচ্ছে না। মানুষের চরিত্র খুব দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। যত তাড়াতড়ি সম্ভব হেনাকে বিয়ে করা দরকার। স্বপ্নেন্দু বিছানা ছেড়ে উঠল। তারপর টেলিফোন ডাইরেক্টরি দেখে ম্যারেজ রেজিস্ট্রারকে ফোন করল।

হ্যালো। ম্যারেজ রেজিস্ট্রার অফিস?

হ্যাঁ। কী চাই?

এখন বিয়ে করতে গেলে নোটিস দিতে হয়?

বিয়ে? কে বিয়ে করবে?

আমি। কথাটা বলতে একটু লজ্জা বোধ করলো স্বপ্নেন্দু।

আপনি কি পাগল হয়ে গিয়েছেন?

মানে? এটা কি ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিস নয়? এস কে রায়।

হ্যাঁ ঠিকই।

আপনার ওখান থেকে আমার এক বন্ধু মাস তিনেক আগে রেজিস্ট্রি করেছে। পাগল বলছেন কেন?

আপনি কাকে বিয়ে করবেন? তিনি ছেলে না মেয়ে?

কী আজেবাজে কথা বলছেন?

মাপ করবেন। এখন তো কেউ আর ছেলে কিংবা মেয়ে প্রমাণ করতে পারছেন না। ফলে বিয়ে হবে কী করে? পুরোন আইনে আছে পুরুষ এবং মহিলার মধ্যে বিয়ে হতে পারে। পুরুষে পুরুষে কিংবা মহিলায় মহিলায় অথবা নপুংসকদের মধ্যে বর্তমানে বিবাহের কোনো আইন নেই। বুঝলেন মশাই? হাসলেন রেজিস্ট্রার। শব্দ হলো।

সেকি? এখন তাহলে বিয়ে হবে না?

না। তাছাড়া আপনি তো তাজ্জব মানুষ। যেখানে এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানুষ উন্মাদ হয়ে উঠেছে, সম্পর্ক ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে সেখানে আপনি বিয়ের কথা ভাবছেন? ইটস এ নিউজ। খবরের কাগজে ছাপা হওয়া উচিত। হে হে করে হেসে উঠলেন রেজিস্ট্রার।

বিরক্ত এবং হতাশ স্বপ্নেন্দু বলল, জ্ঞান দেবেন না। তাহলে আপনি আছেন কী করতে? আপনার চাকরি তো গেল!

গেলো। দুহাতে এতকাল কামিয়েছি ভাই। সব গেল। তবে একটা সুখবর আছে। আপনি সরকারের কাছ থেকে সার্টিফিকেট নিতে পারেন।

সাটিফিকেট?

হ্যাঁ। আপনি অমুক চন্দ্র অমুক, এক্স শ্রীমতী অমুকের সঙ্গে এক সঙ্গে থাকতে চান। এ বিষয়ে এক্স শ্রীমতীর কোনো আপত্তি নেই। তাকেও সই করতে হবে। সরকার আপনাদের পাঁচ বছর একত্রে থাকার অনুমতি দেবেন।

পাঁচ বছর?

স্টেয়িং টুগেদার। তারপর ইচ্ছে করলে ছাড়াও যেতে পারে, আবার ওটা রিনিউ করাতেও পারে। আগে বিবাহিত জীবন কতদিন টিকত? পঞ্চাশ-ষাট বড়জোর সত্তর। তার বেশি নয় কিন্তু এখন অনন্ত জীবন। তাই এই ব্যবস্থা। আগে হলে এতো কথার জন্যে দক্ষিণা চাইতাম, এখন কী ঠিক করবেন জানাবেন। আমিই না হয় সার্টিফিকেটের ব্যবস্থা করে দেব।

সার্টিফিকেট যদি না চাই?

মিটে গেল গোল। ওপাশ থেকে লাইনটা কেটে দেওয়ার শব্দ হলো রিসিভার নামিয়ে রেখে স্বপ্নেন্দু কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। যাঃ শালা, এই কঙ্কালশরীরে বিয়েরও ব্যবস্থা নেই। ওর মনে হল মুখ্যমন্ত্রী এই পরিবর্তিত অবস্থার কথা এতটা না ভাবলেও পারতেন। হেনা সেনের মনে পুরনো সংস্কার জড়িয়ে আছে। বিয়ে ছাড়া একসঙ্গে থাকতে চাইলে হয়! যতই সুন্দরী হও, আধুনিকা হও, বিয়েটি চাই।
 
এই সময় বাইরে খুব হইচই শোনা গেল। স্বপ্নেন্দু জানলায় গিয়ে দাঁড়াতেই দেখতে পেল তিন-চারজন তোক একটা লোককে ঘিরে ধরেছে। লোকটা মোটরবাইকে বসে। লোকগুলো ওকে টানাটানি করছে। লোকটার কঙ্কাল বেশ রোগাপটকা। হঠাৎ মুখ তুলে সে স্বপ্নেন্দুকে দেখতে পেয়ে চিৎকার করে উঠলো, দেখুন, এরা আমার বাইক কেড়ে নিতে চাইছে। দিনদুপুরে ছিনতাই করছে! লোকগুলো হাসল। একজন বললো, এ বাইক তোর প্রমাণ কী?

আমার লাইসেন্স আছে। এই দেখুন!

হে হে হে। এ তো রক্তমাংসের মানুষের ছবি। তোর ছবি তার কী প্রমাণ?

লোকটা প্রতিবাদ করছিল কিন্তু ওরা ওকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে বাইকটাকে নিয়ে চলে গেল।

স্বপ্নেন্দু সরে এল জানলা থেকে। হঠাৎ সমস্ত শহরের পাগল হয়ে গেল নাকি! সে রেডিও খুলতেই মুখ্যমন্ত্রীর গলা ভেসে এল, বন্ধুগণ। আমরা যে পরিবর্তিত অবস্থায় পৌঁছেছি তাকে কাজে লাগানোর জন্যে আমি কলকাতাবাসীর কাছে আবেদন রাখছি। আপনারা এই পরিস্থিতির সুযোগ নিন। এখন অবস্থা অনেক উন্নত। দলে দলে মানুষ অফিস কাছারিতে যাচ্ছেন। ট্রাম-বাসে সহজে চলাফেরা করছেন। কলকাতায় আর কখনও খাদ্যাভাব জলাভাব অনুভূত হবে না। কিন্তু কোনো কোনো কু লোক এত সুন্দর ব্যবস্থাকে বানচাল করে দিতে চাইছেন। তারা সমস্ত কলকাতায় অরাজকতা সৃষ্টি করতে চাইছেন। আমি এই বলে তাদের সতর্ক করে দিতে চাই কোনোরকম অশান্তি সরকার সহ্য করবে না। জনসাধারণকে অনুরোধ করছি এর প্রতিবাদ করতে। আপনারা সবাইকে বন্ধুর মতো গ্রহণ করুন।

এইসময় দরজার শব্দ হলো। রেডিওটাকে বন্ধ করে স্বপ্নেন্দু মুখ ফেরাল। দ্বিতীয়বার শব্দটা হলো। কে এলো এই সময়ে? সন্ধে হয়ে আসছে। সতর্কবাণী মনে পড়ল। পরিচিত ব্যক্তি ছাড়া চট করে দরজা খোলা উচিত হবে না। স্বপ্নেন্দু জিজ্ঞাসা করল, কে ওখানে?

আমি। স্বরটি মহিলার।

আমি কে?

আহা, খোলোই না!

স্বপ্নেন্দুর হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠল। হেনা না? ওর মতো স্বর। হেনা এসেছে ভাবাই যায় না। সে দ্রুত দরজার পাল্লা খুলতেই দেখল মাথায় ঘোমটা দিয়ে হাতে ব্যাগ নিয়ে মহিলা ঘরে ঢুকে পড়ল। কিন্তু এ হেনা নয়, নিশ্চয়ই নয়।

কী ব্যাপার? মহিলা মুখ তুলতেই হোঁচট খেল। না, এ হেনা নয়। হেনার চিবুক বড় আদুরে, মসৃণ এবং গোলাকার।

আমাকে চিনতে পারছ না? হায় ভগবান। আমি আত্রেয়ী।

আত্রেয়ী?

আমি ভেবেছিলাম গলার স্বরে তুমি চিনবে। তোমাকে তো খুব সেনসিটিভ বলে আমি জানতাম। কি অন্য কোনো মেয়ের কথা ভেবেছিলে?

না না। স্বপ্নেন্দু বুঝতে পারছিল না আত্রেয়ী কেন এল, আসলে ব্যাপারটা এত চমকপ্রদ, বলো কি খবর। বোসো!

আমাকে কেমন দেখাচ্ছে স্বপ্নেন্দু–

মাথায় ঘোমটাটা সরিয়ে ফেললো আত্রেয়ী। সাদা করোটিটা ক্যাটক্যাট করছে। সেটার আকৃতি গোল। কপালটা উঁচু। চোখের ফুটো দুটো বেশ বড়ো, নাকের ডগা বসা, চিবুক চৌকো। হেনা সেনকে দেখে মনের যে আরাম হয়েছিল তার বিন্দুমাত্র হলো না আত্রেয়ীকে দেখে। কিন্তু কেমন। খসখসে শিরশিরানি বোধ করল হৃৎপিণ্ডে। স্বপ্নেন্দু জবাব দিলো,

ভালো।

কিন্তু ও নাকি সহ্য করতে পারছে না। আমিও না।

এটা তো মেনে নিতেই হবে।

সে কথা কে বোঝায় বল। দরজাটা বন্ধ করে দাও। বাইরে খুব গোলমাল।

এই অবস্থায় এলে কেন? স্বপ্নেন্দু দরজাটা বন্ধ করে দিল।

না এসে উপায় ছিল না। আমি একটা পাগলের সঙ্গে থাকতে পারি না।

পাগল?

হ্যাঁ।

সে কি? কেন?

কী বলব তোমাকে! ও পুরুষত্বহীন হয়ে পড়েছিল। অনেক চিকিৎসার পর ও বোধহয় সেরে আসছিল। এইসময় ঘটনাটা ঘটতে ও পাগল হয়ে গেল। এই হারানোটা ও স্ট্যান্ড করতে পারছে না। কাল আমাকে মেরেছে। এরপর আমি থাকি কী করে? না, আর একসঙ্গে থাকা সম্ভব নয়। এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে ঈষৎ হাঁপাতে লাগল সে।

স্বপ্নেন্দু বলল, বোস।

চেয়ারে বসে আত্রেয়ী জিজ্ঞাসা করল, তুমি অপছন্দ করছ?

না তো। আমি তোমাকে বসতে বললাম কেন?

কিন্তু আমি আর ফিরব না। আমি তোমার সঙ্গে থাকব।

আমার সঙ্গে থাকবে?এবার চমকে উঠল স্বপ্নেন্দু।

হ্যাঁ। আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। আমি জানি তুমিও আমাকে চেয়েছিলে।

সে তো ছাত্রাবস্থায়!

হ্যাঁ। তখন আমি ভুল করেছিলাম। গ্রেট মিসটেক। এখন সেটা সংশোধন করে নিতে চাই। আমরা তো অমর হয়ে গেছি, কোনো মৃত্যু ভয় নেই। আমরা চিরজীবন পরস্পরকে ভালবাসব। আত্রেয়ী এগিয়ে এল কয়েক পা, আমি প্রমাণ করে দেব ভালবাসা কাকে বলে!
 
স্বপ্নেন্দু চমকে উঠলো, কি আজেবাজে কথা বলছ? তোমার স্বামী জানতে পারলে কী হবে ভেবেছ? তাছাড়া

কিছুই হবে না। কারণ আমি তার স্ত্রী নই।

স্ত্রী নও মানে? তোমরা বিবাহিত।

ছিলাম। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমি আর মহিলা নই। মানে যেহেতু আমার ফিমেল অর্গানগুলো নেই তাই ও আমাকে স্ত্রী হিসেবে ক্লেইম করতে পারে না। তাছাড়া ও নিজেও তো পুরুষ নেই। শব্দ করে হাসল আত্রেয়ী, এখন পৃথিবীতে স্ত্রী পুরুষ আলাদা করে নেই। কোনোরকম পার্থক্য থাকছে না। এখন একটাই পরিচয় আমাদের আমরা মানুষ। ফঁপরে পড়ল স্বপ্নেন্দু। সে বলল, কিন্তু তুমি তোমার মা-বাবার কাছে চলে যেতে পারতে। যদি প্রয়োজন হয় আমি পৌঁছে দিচ্ছি।

তারা তো সব পাটনায়। শোনোনি, কলকাতার সঙ্গে বহির্বিশ্বের কোনো যোগাযোগ নেই। তাছাড়া তুমি কি আমাকে পছন্দ করছ না? তেজি ভঙ্গিতে কথা বললো আত্রেয়ী।

না না, সেকথা হচ্ছে না। তুমি হঠাৎ এখানে উঠলে লোকে বলবে কী?

লোকের আর কাজ নেই যে এ ব্যাপারে মাথা ঘামবে। তাছাড়া আমি যে মেয়ে তাই প্রমাণ করবে কে? স্বপ্নেন্দু!

বলো?

আত্রেয়ী এগিয়ে গেল স্বপ্নেন্দুর কাছে, আমি ভুল করেছিলাম। এতকাল একটুও শান্তি পাইনি। তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিও না।

কিন্তু তুমি বুঝতে পারছ না, এ হয় না।

কেন হয় না। পৃথিবীর যে কোনো মেয়ের তুলনায় আমি তোমাকে বেশি ভালবাসব। তুমি আমার সঙ্গে সাতদিন থাকো। তারপর যদি তোমার আমাকে খারাপ লাগে তাহলে আমি কথা দিচ্ছি আর বিরক্ত করব না। কান্নার শব্দ উঠলো এই ঘরে। জল নেই, শুধু শব্দে বোঝা যাচ্ছে আত্রেয়ী কাঁদছে।

স্বপ্নেন্দু খুব নার্ভাস বোধ করছিল। আত্রেয়ীকে ছাত্রাবস্থায় তার ভালো লাগতো ঠিকই কিন্তু কখনও প্রেম বলে যে ব্যাপার তা মনে আসেনি। অথচ এখন অত্রেয়ী সেইরকম চাপাতে চাইছে। বাইরে এখন বেশ অন্ধকার। তাছাড়া রাস্তার অবস্থা যা তাকে এই রাতটা কোথাও যেতে বলা উচিত হবে না। আজকের রাতটা কোনোরকমে কাটিয়ে দিয়ে কাল সকালে এর বিহিত করতে হবে।

স্বপ্নেন্দু একদম প্রস্তুত ছিল না। তার কথাটা শেষ হওয়া মাত্র আত্রেয়ী ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো। অদ্ভুত অনুভূতি হলো স্বপ্নেন্দুর। তার বুকের হৃৎপিণ্ডে মুখ রেখে আত্রেয়ী বলছে, তোমাকে ভালবাসি, ভালবাসি, ভালবাসি। আর তার হৃৎপিণ্ড কাঁপছে। হাড়ে হাড়ে ঘষা লাগায় শব্দ হচ্ছে। কোনো শারীরিক অনুভূতি নেই। কোনো চাঞ্চল্য নেই। বরং হাড়ের সঙ্গে হাড়ের স্পর্শে একটা অস্বস্তিকর শব্দ কানে আসছে। অনেক কষ্টে স্বপ্নেন্দু আত্রেয়ীকে ছাড়াতে পারল। স্বপ্নেন্দু ভেবে পাচ্ছিল না কী করবে! আত্রেয়ী তার বুকে মুখ রাখার সময় তার খারাপ লেগেছিল কি? একমাত্র ওই শব্দটি তাকে সচেতন করেছিল। এছাড়া সে যে নরম হয়ে পড়েছিল, বেশ আরাম হচ্ছিল তা কি মিথ্যে? যে কোনো মেয়ে বুকে মাথা রাখলেই কি এমন হয়? হেনা সেন যদি জানতে পারে। ছিঃ। হেনার কথা ভাবতেই দৃশ্যটা তেতো হয়ে গেল। সে আত্রেয়ীকে কথা ঘোরবার জন্যে জিজ্ঞাসা করলো, এলে কী করে? রাস্তায় তো গোলমাল হচ্ছে।
 
অনেক কষ্টে এসেছি! একটা বাসে উঠেছিলাম। ওরা লেডিজ সিটে বসতেই দিল না। বলল, এখন কেউ লেডিজ নয়। নেমেই দেখি একটা কাপড়ের দোকান লুট হচ্ছে। আমি তাড়াতাড়ি পা চালাতে তিনটে তোক আমার পেছন পেছন হাঁটতে লাগল। আত্রেয়ী দম নিল।

তোমার পেছন পেছন? আগে হলেও কথা ছিল।

না, শরীরের জন্যে নয়। এই শাড়ির জন্যে। ততক্ষণে আমি এই গলির মধ্যে ঢুকে পড়েছি। ওই চায়ের দোকানের লোকটা তখন না থাকলে।

চায়ের দোকান। অবনীদা! অবনীদা তোমায় দেখেছে?

ওর নাম বুঝি অবনীদা? উনি তেড়ে উঠতে লোকগুলো চলে গেল।

আমার কাছে আসছ সেটা ওকে বলেছ?

হ্যাঁ। আমি যে বাড়িটা গুলিয়ে ফেলেছিলাম।

কিছু বলেনি? হতাশ গলায় জিজ্ঞাসা করল স্বপ্নেন্দু।

কেন? অবনীদা কি তোমার গার্জেন?

তা কেন হবে?

উঃ স্বপ্ন, তুমি এখনও লোকনিন্দের ভয়ে মরছ! চলো, তোমার সংসার দেখি।

সংসার? আমার আবার সংসার কী। চাকরটা বোধহয় দেশে গিয়ে বেঁচে গেল। আর কখনও আসবে বলে মনে হয় না। এই তো দুটো ঘর। তুমি ওই ঘরটা ব্যবহার করতে পারো। পরিষ্কার আছে কিনা জানি না। কদিন তো ঝাঁট পড়েনি।

ওই ঘর ব্যবহার করবো মানে?

তুমি তো আজ রাত্রে এখানে থাকচ্ছ!

নিশ্চয়ই। কিন্তু তার জন্যে আলাদা ঘর ব্যবহার করতে হবে কেন? তুমি কি আমার সঙ্গে শোবে না? আত্রেয়ীর স্বরে বিস্ময়।

শোনো, আফটার অল তুমি মেয়ে, পরস্ত্রী।

চমৎকার। একটু আগে তোমাকে বললাম আমি আর কারো স্ত্রী নই। তোমাকে ভালবাসি বলে ছুটে এসেছি। তবু তোমার হুঁশ হল না। স্বপ্নেন্দু ভয় পেয়ো না, তোমার পাশে শুলে আমার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার কোনো চান্স নেই।

আত্রেয়ী?

হি হি করে হেসে উঠলো আত্রেয়ী, রাগ করো না। এসব কথা আগে উচ্চারণ করতে লজ্জা করত। এখন একটু আধটু না হয় করি। পাগলামি ছাড়ো, এখন আমরা একসঙ্গে থাকব। জানো স্বপ্ন, আমি চিরকাল ভাবতাম মানুষ কেন মানুষকে আত্মিক ভালাবাসবে না? কেন শরীর তার অবলম্বন হবে? একটা মেয়ের ঠোঁট, বুক, পাছা, যোনির আকর্ষণে আর একটা ছেলে কুকুরের মতো পেছনে ঘুরবে কেন? ওটাকে ভালবাসা বলে? ছি! শরীরের ওইসব ক্ষণিক জাদু শেষ হয়ে যাবে, মেয়েটা ছিবড়ে হয়ে যাবে তখন ছেলেটা সেই কুকুরের মতো লেজ গুটিয়ে আর একটা কুকুরীর সন্ধানে ফিরবে! ভাবতেই ঘেন্নায় শরীর গুলিয়ে উঠত। যাকে বিয়ে করেছিলাম সে তো নর্দমা ঘাঁটার মতো শরীরটা খুঁড়ত। কত মাথা ঠুকেছি কিছুতেই শোনেনি। কিন্তু ঈশ্বর শুনেছিলেন। নইলে হঠাৎ সে নপুংসক হয়ে যাবে কেন? অথচ আবার সেটা ফিরে পাওয়ার জন্যে কি চেষ্টা! না পেয়ে পাগল হয়ে গেল। কার্স, কার্স! পুরুষদের ওই পাশবিক অহঙ্কার আমি সহ্য করতে পারি না। ঈশ্বর আমার মনের কথা বুঝেছেন।

স্বপ্নেন্দু অবাক হয়ে শুনেছিল, তুমি পুরুষদের ভালবাসতে চাওনি?

হ্যাঁ চেয়েছি। কিন্তু তাতে শরীর থাকবে না। প্লেটোনিক লাভ হলো অমর। তাতে দেহের কদর্য-ভঙ্গি থাকে না। স্বর্গীয়। এসো স্বপ্ন, আমরা সেই স্বর্গীয় প্রেমে অনন্তকাল ডুবে থাকি। তুমি আর আমি। হাত বাড়াল আত্রেয়ী।

না, তুমি যে এই হাত বাড়াচ্ছ, সেটাতেও তো দেহের প্রয়োজন হচ্ছে!

না, এই কঙ্কালের হাড়ে রক্তমাংস নেই অতএব দেহ কেন হতে যাবে?

আত্রেয়ীর দিকে তাকাল স্বপ্নেন্দু। এই মেয়েটাও কি ওর স্বামীর মতো পাগল হয়ে গেল! হঠাৎ সে জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু আমি যদি অন্য কোনো মেয়েকে ভালবাসি? যদি সে আমাকে সমানভাবে চায়? হাসল আত্রেয়ী, এখন তো কেউ মেয়ে নয়। সত্যি কি কাউকে ভালবাস?

হ্যাঁ।

আমি বিশ্বাস করি না। আমি তাকে দেখতে চাই।

বেশ, দেখাব।

আত্রেয়ীর বসবার ভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছিল সে হতভম্ব হয়ে পড়েছে। শেষ পর্যন্ত সে মুখ তুললো, তুমি আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছ স্বপ্ন?

মোটেই না। আমি তোমাকে বন্ধু মনে করি।

আমিও তাই চাই। এখন দুজন মানুষের মধ্যে বন্ধুত্বের বেশি কিছু হতে পারে না। তাহলে এমন করে বলছ কেন?
 
এইসময় বাইরে খুব হইচই শোনা গেলো। স্বপ্নেন্দু দ্রুত জানলায় এসে দেখলো নিচের রাস্তায় উন্মত্ত কয়েকটা কঙ্কাল একটি কঙ্কালকে ধরেছে। তারপর তার শরীরে আগুন জ্বালিয়ে দিল লোকগুলো। জ্যান্ত পুড়িয়ে মারছে ওরা। স্বপ্নেন্দুর মাথা খারাপ হয়ে গেল। পাগলের মতো ছোটাছুটি করলো লোকটা। একটু আগুনের গোলা রাস্তাময় ছোটাছুটি করছে। তারপর আগুন আপনা আপনি নিভে গেলে লোকটা হো হো করে হাসল। তার হাড়ে শুধু সামান্য পোড়া দাগ ছাড়া একটুও ক্ষতি হয়নি। আক্রমণকারীরা হতভম্ব হয়ে পড়েছিল। এবার তারা পালিয়ে গেল যে যার মতো। আক্রান্ত লোকটি চেঁচিয়ে বলে উঠল, আমি অমর। হা হা হা মার তোরা, কত মারবি আমায় মার।

যেন কোনো চলচ্চিত্রের দৃশ্য চোখের সামনে দেখানো হলো। স্বপ্নেন্দুর মনে হলো একবার রাস্তায় গিয়ে দেখা দরকার। দূরে চেঁচামেচি চলছে এখন। সে রেডিও খুলতেই কোনো শব্দ পেল না। আকাশ বাণী কি মৃত? স্বপ্নেন্দু আত্রেয়ীকে বললো, তুমি বসো আমি একটু দেখে আসছি কি হচ্ছে বাইরে।

আমিও যাব।

না বলতে গিয়ে থমকে গেলো স্বপ্নেন্দু। এই ঘরে আত্রেয়ীকে একা রেখে যাওয়া উচিত হবে না। টেবিলে জারের তলায় ফুলটাকে দেখতে পাবে। সে কোনো ঝুঁকি নিতে চাইল না।

আত্রেয়ীকে নিয়ে বাইরে আসতেই দেখল লাঠি নিয়ে কিছু কঙ্কাল ছোটাছুটি করছে। মোড়ের কাছে আসতে সে অবাক হলো। অবনীদার দোকানে একটা কঙ্কাল বসে আছে মূর্তির মতো। তার অঙ্গে এক ফোঁটা সুতো নেই। স্বপ্নেন্দু বললো, আচ্ছা অবনীদা কোথায়?

আমিই অবনী। স্বপ্নেন্দু?

হ্যাঁ।

বাড়ি ফিরে যাও স্বপ্নেন্দু। দেখছ না মানুষ কেমন পাগল হয়ে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি চলে যাও। অবনী বললো।

কী ব্যাপার?

মানুষ জেনে গেছে এই পৃথিবী থেকে তাদের পাওয়ার কিছু নেই। অথচ তাদের অনন্তকাল অমর হয়ে থাকতে হবে। এমন কি আগুনও তাদের দগ্ধ করছে না। সবাই এই দশা থেকে মুক্তি চায় সবাই চিতায় শুতে চায় স্বপ্নেন্দু।

সবাই?

হ্যাঁ। আমি তো চাই। তুমি জানো না আমার স্ত্রী আজ বেরিয়ে গেছে। সে নাকি যে কোনো উপায়ে আত্মহত্যা করবেই। কত বললাম তবু গেল।

আপনি বাধা দিলেন না?

কী হবে দিয়ে! ওরা আমার লুঙ্গিটাকে খুলে নিয়ে গেল। এই যে উদোম হয়ে বসে আছি খারাপ লাগছে না কিন্তু। বেশ হাওয়া চলছে শরীরে। যাওয়ার সময় আমার ছোটো ছেলেটা বলল মায়ের সঙ্গে থাকবে। জানো, সে বলল মায়ের সঙ্গে? সব নষ্ট হয়ে গেছে, সব সম্পর্ক, কিন্তু স্বপ্নেন্দু শিশুরা এখন মাকে মা বলে জানে।

অবনীদা বললেন, আর দাঁড়িয়ে থেকো না। তোমার সঙ্গে মহিলা আছেন। ওঁর শাড়ি খুলে নেবে ওরা।

কিন্তু পুলিশ নেই?

না। এখন কিছুই নেই। সবাই লুঠ করতে নেমেছে। কারণ লুঠ করলে যদি খুন হয়ে যায় তাহলে বেঁচে যাবে। এই মৃত্যুর নাম জীবন।
 
স্বপ্নেন্দু ফিরে আসছিল। তাদের পাশের দরজায় তখন একটা অদ্ভুত দৃশ্য। সেই বৃদ্ধ ল্যাম্পপোস্টের গায়ে দড়ি ঝুলিয়ে গলায় ফাঁস ঢুকিয়ে লাফিয়ে পড়লেন। তাকে দেখতে ভিড় জমে গেছে। ঘাড়টা সামান্য বেঁকে গেল। কিন্তু লোকটা চেঁচাতে লাগল, আমি কি মরেছি? কি দেখছ তোমরা আমি কি মরেছি? উলঙ্গ সেই কঙ্কালটার দিকে তাকিয়ে একজন চেঁচাল, বললাম মরবেন না তবু শুনলেন না। এখন ঝুলুন ওখানে সারাজীবন। আমি অত ওপরে উঠে দড়ি কাটতে পারব না। আমি মরেছি, মরলে কেউ চেঁচায়? হাউ হাউ করে কাঁদছিলেন বুড়ো। দড়ি দিয়েও মরলাম না। তার শরীরটা হাওয়ায় দুলছিল একজন লাফিয়ে তার পা দুটো ঠেলে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, দোল দোল, নো হরিবোল।

স্বপ্নেন্দু আর দাঁড়াল না। তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে এল। ঘরে ঢুকে আত্রেয়ী বলল, ডিসগাস্টিং। মানুষ কোথায় স্বাভাবিকভাবে বাঁচার চেষ্টা করবে না মরার জন্যে হেদিয়ে মরছে। এই, আমি শাড়িটা খুলছি।

স্বপ্নেন্দু অবাক হয়ে দেখলো আত্রেয়ী তার শরীর থেকে শাড়ি খুলে ফেলল। জামাটাকে টান মেরে ছুঁড়ে ফেলে বলল, কেমন দেখাচ্ছে?

জাদুঘরে এই রকম মূর্তি দেখেছি।

এখন তো কলকাতা শহরটাই জাদুঘর হয়ে গেছে। লোকটা ঠিকই বলেছে, বেশ হাওয়া পাস করছে শরীরের ভেতর দিয়ে। হাড় জুড়োচ্ছ। এসে শুয়ে পড়ি। খুব টায়ার্ড লাগছে।

তুমি শোও। আমি—

স্বপ্নেন্দু জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। নিচে প্রচণ্ড উত্তেজক কিছু চলছে। ঝুঁকে পড়ল সে। সে বৃদ্ধ এখনও ল্যাম্পপোস্টে দোল খাচ্ছেন এবং সেই অবস্থায় চিৎকার করে উঠেছেন, মেরে ফ্যালো, খোকা তুই মেরে ফ্যাল আমাকে। আমি তোর পায়ে পড়ছি খোকা, এভাবে দোল খাওয়াস না।

নিচে দাঁড়ানো একটা কঙ্কাল খেঁকিয়ে উঠলো পই পই করে বলে ছিলাম এখন গলায় দড়ি দিলে কেউ মরে না। তখন শুনলে না কেন?

আমি বুঝতে পারি নি। যেমন করে তোক মেরে ফ্যাল আমাকে। আমি তোর বাপ তোকে হুকুম করছি মার আমাকে।

মার বললেই হলো! অত ওপরে ঝুলে তো বেশ মজাসে হাওয়া খাচ্ছ।

কঙ্কালটি আশেপাশে মজা দেখতে আসা মুখগুলির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, একটা উপায় বলুন তো? আমার মাথায় কিছু আসছে না।

জনতা সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজিতভাবে নানানরকম পরামর্শ দিতে লাগল। শেষ পর্যন্ত স্থির হলো নিচে আগুন জ্বালিয়ে বৃদ্ধকে পুড়িয়ে মারা হবে। সেই মতো প্রচুর কাঠ জোগাড় করল। তারপর সোৎসাহে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হলো বৃদ্ধের নিচে। দাউ দাউ করে সেই আগুন বৃদ্ধকে গ্রাস করে ফেলতে স্বপ্নেন্দু চোখ বন্ধ করতে চাইলেও পারল না। তার চোখের পাতা কিংবা মণি নেই তবু সে সব দেখতে পাচ্ছে। এবং দেখে যেতে হবে। আর তারপরেই অদ্ভুত কাণ্ডটা ঘটল। আগুনের শিখা বৃদ্ধের শরীরের খাঁচাকে লালচে করতে না করতে গলায় ফাঁস পরানো দড়িটা পুড়ে গিয়ে খসে পড়লো রাস্তায়। হই হই করে সবাই ছুটে গেলো বৃদ্ধের কাছে। বৃদ্ধ উঠে দাঁড়াতে পারছে না। কারণ পতনের পর তার পায়ের হাড় ভেঙেছে। কিন্তু তিনি সামনে চিৎকার করে যাচ্ছেন, মেরে ফ্যাল আমাকে, মেরে ফ্যাল।

সবাই মিলে ওকে ধরাধরি করে ভেতরে নিয়ে যেতে স্বপ্নেন্দু মুখ ফেরাল। আত্রেয়ী তার বালিশ জড়িয়ে শুয়ে আছে পাশ ফিরে। ওর হাড়গুলো বড্ড বেশি সাদা। বুকের খাঁচায় নিরেট হৃৎপিণ্ডটার দিকে তাকালো সে। ওটাকে ভাঙা যাবে না, কিছুতেই না। আত্রেয়ীর সঙ্গে রাত কাটিয়েছে শুনলে হেনা তাকে কি ভালোবাসবে? তার সঙ্গে সারাজীবন থাকতে চাইবে?

আত্রেয়ী ডাকলো, কী হলো? এসো কাছে এসো।

কী হবে কাছে এসে? স্বপ্নেন্দু সময় নিচ্ছিল।

তোমাকে জড়িয়ে ধরে সারারাত ঘুমিয়ে থাকব।

আমার ঘুম আসে না।

আমারও।

তাহলে?

তোমার বুকে মুখ রেখে রাতটা কাটিয়ে দেব।
 
স্বপ্নেন্দু টেবিলের দিকে তাকাল। গোলাপটাকে দেখতে তার খুব ইচ্ছে করছিল। কিন্তু আত্রেয়ীর সামনে কাপড় সরিয়ে ওটার দিকে তাকাতে সাহস হচ্ছিল না। ও নিশ্চয়ই লোভী হবে। ওরকম ডাঁটো গোলাপ দেখলে কেউ স্থির থাকতে পারে না। বরং ও ঘুমিয়ে পড়লে, দূর, এখন তো ঘুম চলে গেছে সাধারণ মানুষের চোখ থেকে। স্বপ্নেন্দু এক পা এগিয়ে এল। একটি নগ্নকঙ্কাল এবার চিত হলো। মেয়েদের শরীরে মাংস না থাকলে কিরকম বীভৎস হয়ে যায়। রাস্তাঘাটে যত কঙ্কাল চোখে পড়েছে তাদের দেখলেই এটা বোঝা যায়। পুরুষদের গঠন মেয়েদের চেয়ে অনেক সুন্দর। কিন্তু হেনার চিবুক? মাংস বা চামড়া না থাকা সত্ত্বেও কিরকম আদুরে। আর আত্রেয়ী? ওর দিকে তাকিয়ে কোনো অনুভূতিই হচ্ছে না।

আত্রেয়ী আবার ডাকল, এসো না!

স্বপ্নেন্দু বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়াল, শোনো আত্রেয়ী, আমি একটি মেয়েকে ভালবাসি। তার নাম হেনা। তার সঙ্গেই থাকতে চাই।

হেনা সে কে?

আমার বান্ধবী।

তুমি ভালবাস? কত বছর?

বছর নয়। তিনদিন।

সে কি? তিনদিনে একটা মেয়ের মন বোঝা যায়?

যায়। যে বুঝতে পারে সে একমুহূর্তেই পারে।

আমি বিশ্বাস করি না।

তোমার অবিশ্বাসে আমি কি করতে পারি।

তুমি আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্যে এসব বলছ।

আমি মিথ্যে বলছি না।

আত্রেয়ী ধীরে ধীরে উঠে বসলো, আমি সত্যি কিছু বুঝতে পারছি না। মাত্র তিনদিন দেখে তুমি একটি মেয়ের ওপর নির্ভর করতে চাইছ? সে তোমাকে কী দেবে? তারও তো শরীর নেই মেয়ে বলে তার কোনো আলাদা অস্তিত্বই নেই? আর আমি তোমাকে চেয়ে পাগলের মতো ছুটে এসেছি এই বিপদে–। আত্রেয়ীর গলা রুদ্ধ হলো। স্বপ্নেন্দুর মনে হলো ওর মুখটা খুব করুণ দেখাচ্ছে।

কিন্তু তুমি এতগুলো বছরে আসনি কেন?

আসতে পারি নি। কারণ ও আমাকে ডিভোর্স দিত না। তাছাড়া আমার ওই এঁটো শরীরটাকে আমি তোমায় দিতে পারতাম না স্বপ্নেন্দু। অনেক কষ্টে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলাম। কলেজ জীবনের ছবিটাকে জোর করে মুছে ফেলেছিলাম। কিন্তু সেদিন লিন্ডস স্ট্রিটে তোমায় দেখে বুঝলাম এতদিন শুধু নিজেকে ঠকিয়েছি। তাই যে মুহূর্তে এই শরীরটা পবিত্র হয়ে গেল অমনি তোমার কাছে ছুটে এলাম স্বপ্ন।

স্বপ্নেন্দুর মনে হলো আত্রেয়ী সত্যি কথা বলছে। কিন্তু সে এই সত্যিটাকে মেনে নেবে কি করে? সে বলল, আত্রেয়ী, আমি তোমার সঙ্গে হেনার আলাপ করিয়ে দেব।

বেশ, কিন্তু আমি তোমার কাছেই থাকব। এতে কি তোমার হেনা আপত্তি করবে?

জানি না। তবে শুনেছি মেয়েরা সতীন পছন্দ করে না।

সতীন? ও, তুমি ভুলে যাচ্ছ আমরা কেউ মেয়ে নই।

তাহলে তো চুকেই গেল। তুমি শুয়ে পড়, আমি—

আমার পাশে শুতে তোমার এখনও আপত্তি? বন্ধু কি বন্ধুর পাশে শোয় না?

অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে হাড়ে হাড়ে কোনো অনুভূতি না হলেও অভ্যেসে বসতে ইচ্ছে করে। স্বপ্নেন্দু খাটে বসে মাথাটা এলিয়ে দিতেই আত্রেয়ী ওর বুকের কাছে সরে এল। এসে বললো,

তোমার হৃৎপিণ্ডের শব্দ পাচ্ছি।

স্বপ্নে আড়ষ্ট গলায় জিজ্ঞাসা করলো, আচ্ছা আত্রেয়ী, এতসব ব্যাপার হয়ে গেল, মানুষের এমন অদ্ভুত পরিবর্ত ঘটল, সবাই হা-হুঁতাশ করছে কিন্তু তোমার কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি না?

না। আত্রেয়ী হাসলো যেন, কারণ আমি আমার শরীরটাকে ঘেন্না করতাম। ওটা আমার শত্রু ছিল। আর কথা বলল না, আমাকে তোমার হৃৎপিণ্ডের আওয়াজ শুনতে দাও। আত্রেয়ী স্বপ্নেন্দুর বুকের খাঁচায় কান চেপে ধরল আর ভেতরে সেই শক্ত স্বচ্ছ মোড়কের ভেতরে যে হৃৎপিণ্ড দপদপ করছিল সে ততক্ষণে অনেক সহজ। হেনাকে সে ভালোবাসে কিন্তু এই মুহূর্তে সে আত্রেয়ীকেও ভালোবাসে। শরীরের নির্দিষ্ট গণ্ডি যেহেতু আর চারপাশে নেই তার কোনো অপরাধবোধও আর কাজ করছে না। স্বপ্নেন্দু আর একবার টেবিলের দিকে তাকাল। ওই কাপড়ের ঢাকনা সরিয়ে জারের আড়ালটা তুললেই তার চোখে ঘুম কিংবা শান্তি নেমে আসত। কিন্তু ও ঝুঁকি সে কিছুতেই নিতে পারে না। তাকে সারারাত আত্রেয়ীকে পাহারা দিতে হবে।

ভোরবেলায় স্বপ্নেন্দু বলল, চলো, ঘুরে আসি।
 
মাঝরাত্রে একটি ঝগড়া হয়েছিল। স্বপ্নেন্দুর পক্ষে সারারাত একনাগাড়ে একই ভঙ্গিতে শুয়ে থাকা সম্ভব নয় অথচ আত্রেয়ীর কানে হৃৎপিণ্ডের শব্দ পৌঁছানো চাই। এই নিয়ে কথা কাটাকাটি। স্বপ্নেন্দু বলেছিলো, এটা উদ্ভট আবদার। বড্ড বেশি চাওয়া।

তারপর থেকে আত্রেয়ী চুপচাপ হয়ে গেছে। কোনো কথা বলেনি এতক্ষণ। স্বপ্নেন্দু প্রস্তাব করতেও উত্তর দিল না। স্বপ্নেন্দুর ইচ্ছে হলো একাই বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু ফুলটাকে এই ঘরে আত্রেয়ীর সঙ্গে একা রেখে যাওয়া অসম্ভব। সে কাছে এলো, আত্রেয়ী, আমার সঙ্গে কথা বলবে না!

আত্রেয়ী মুখ ফেরাল, আমি যে বড্ড বেশি চাই।

একটু কম চাও তাহলেই তো সব মিটে যায়।

বেশ, সেইটুকু হলো তুমি। আত্রেয়ী হাসল।

এখন সবে আঁধার সরেছে। কিন্তু রাস্তাঘাটে বেশ মানুষ। যেহেতু কারো চোখে ঘুম নেই তাই রাস্তা রাত্রেও ফাঁকা হয় না বের হবার সময় আত্রেয়ীর আর পোশাক পরেনি। স্বপ্নেন্দু আপত্তি জানালে বলেছিল, এখন আর লজ্জা কী? লোকে তো মেয়ে বলে বুঝবে না। বরং কাপড় থাকলে কেড়ে নিতে পারে।

স্বপ্নেন্দু তবু ইতস্তত করেছিল, কেমন ল্যাংটো ল্যাংটো দেখায়। তাছাড়া হাড়ের গঠন দেখেও ছেলে মেয়ের পার্থক্য বোঝা যায়। উড়িয়ে দিয়েছিলো আত্রেয়ী, ওটা যারা হাড় নিয়ে পড়াশুনো করেছে শুধু তারাই পারে। পাবলিক চিরকাল মুখ। এখন রেডিও থেকে বারংবার ঘোষণা করছে, শান্তি বজায় রাখুন। গুজবে কান দেবেন না। ভোর ছটায় মুখ্যমন্ত্রীর জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ শুনুন।

বের হবার সময় পকেট ট্রানজিস্টারটা সঙ্গে নিয়েছিল। তার পরনে পাজামা পাঞ্জামি। গলির মোড়ে আসতেই দুটো লোক এগিয়ে এলো, এই যে দাদা, জামাকাপড় ছাড়ুন।

ছাড়ব মানে? স্বপ্নেন্দুর গলায় বিস্ময়।

এখন এসব পরা চলবে না। পোশাক ব্যবধান সৃষ্টি করে। খুলে ফেলুন।

আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।

বোঝার কিছু নেই। আপনার সঙ্গে যে দাদা আছেন তিনি তো পোশাক পরেননি। আপনি ঊট মেরে পাঞ্জাবি চাপিয়েছেন। জানেন, কলকাতার লোকের গায়ে একটা সুতো পর্যন্ত নেই? এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সবাই এক হতে হবে। পোশাক মানুষ পরতো লজ্জা নিবারণের জন্যে। সেইটি যখন নেই তখন পোশাক খুলে সব মানুষ এক হয়ে যাক।

স্বপ্নেন্দু আত্রেয়ীর দিকে তাকাল। ওরা ওকে বললো চমৎকার। এর মধ্যে ভিড় জমে গেছে। সবাই নগ্ন। একজন বললো, অত কথায় কাজ কী? জোর করে খুলে নিলেই তো হয়।

প্রথমজন বললো না না। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন শান্তি বজায় রাখতে। উনি নিজেই খুলবেন। আমরা ওঁকে ঘেরাও করে রাখব যতক্ষণ না খোলেন। কোনো জোর জবরদস্তি কেউ করবেন না।

এই ঘেরাওটা জোর জবরদস্তি নয়? স্বপ্নেন্দু অসহায় হয়ে পড়েছিল। না। এটা একটা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের হাতিয়ার।

আত্রেয়ী মুখ খুলতে গিয়ে থেমে গেল। ওর মনে হলো কথা বললেই সে যে পুরুষ নয় তা বুঝে যাবে ওরা। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হলো স্বপ্নেন্দু। মুহূর্তেই জামাকাপড় উধাও হয়ে গেল। সমস্ত শরীরের হাড় ভোরের হাওয়ায় শীতল হলো। এমন কি ট্রানজিস্টারটাও হাতছাড়া হয়ে গেলো। শুধু ঘরের চাবিটা কোনোক্রমে বাঁচাতে পারল স্বপ্নেন্দু। প্রথম লোকটি বলল, এতক্ষণে আপনি জনতার সঙ্গে মিলে গেলেন ভাই। যে পোশাক পরবে তাকেই বাধা দেবেন। শান্তি বজায় রাখুন।

ভিড় ছাড়িয়ে কয়েক পা হেঁটে আত্রেয়ী কথা বললো, তোমাকে তখনই সাবধান করেছিলাম। কিন্তু শুনলে না। যা মন খারাপ করো না। তোমার শরীরের কাঠামো সত্যি চমৎকার।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top