What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected ফেরারী - সমরেশ মজুমদার 🎭 (1 Viewer)

স্বপ্নেন্দু আর দাঁড়াল না। ট্রাম রাস্তায় এসে সে হতভম্ব হয়ে গেল। না, কোনো গাড়ি ঘোড়ার চিহ্ন নেই। সন্ধে হয়ে গেছে। রাস্তায় আলোগুলো এদিকে জ্বলছে না। কেমন যেন গা ছমছমে ভাব। তাকে যেতে হবে অনেক দূর। আগে হলে কেয়ার করত না। কিন্তু এখন এতটা পথ হেঁটে যাওয়া অসম্ভব। এমনিতে তার পায়ের হাড় কনকন করছে। সন্ধে হচ্ছে বলে লোকজন রাস্তা থেকে কমে যাচ্ছে। স্বপ্নেন্দু ভেবে পাচ্ছিল না সে কি করবে। একটু একটু করে হেঁটে সে ওয়েলিংটনের মোড়ে চলে এল। জায়গাটা শ্মশানের মতো ফাঁকা। কলকাতা শহরে দাঁড়িয়ে এমন অসহায় সে আর কখনও হয়নি। এই সময় একটা শিস শুনতে পেল সে। কেউ যেন মনের আনন্দে শিস দিয়ে যাচ্ছে। মেরা জুতা হ্যায় জাপানি। চারপাশে চোখ বোলাতে সে ফুটপাথের ধার ঘেঁষে ভিখিরিটাকে দেখতে পেল। দুটো ছেঁড়া চট গায়ে চাপিয়ে রাজার মতো হেলান দিয়ে বসে বসে শিস্ দিচ্ছে। তার ঊধ্বাঙ্গে কোনো বস্ত্র নেই। হঠাৎ তাকালে আনন্দমঠের মম্বন্তর গ্রামের ছবিটি মনে পড়ে যায়। চোখাচোখি হতে লোকটা খুকখুক করে হাসল, এই যে বাবু, দুটো পয়সা হবে!

স্বপ্নেন্দু অবাক হল। ভিখিরিটা এখনও পয়সা চাইছে! কিন্তু হাসল কেন? সে কোনো কথা বলার আগেই ভিখিরিটা চেঁচিয়ে উঠলো, লাথি মারি টাকার মুখে। আর আমাকে কারো কাছে পয়সা চাইতে হবে না। কি আনন্দ! আর শালা মানুষের গালাগালি শুনব না। মেরা জুতা হ্যায়। জাপানি। এই যে দাদা, দুটো পয়সা হবে। নিজের গলাটাকেই বিকৃত করে শোনাল লোকটা।

ঠিক তখন একটা প্রাইভেট গাড়িকে আসতে দেখল স্বপ্নেন্দু। ফিয়াট। গাড়িটা যাচ্ছে তার গন্তব্যস্থলের দিকে। স্বপ্নেন্দু। হাত তুলল। সেটা পর্যাপ্ত নয় ভেবে রাস্তায় মাঝখানে নেমে গিয়ে ইশারা করতে লাগল থামাবার জন্যে। ড্রাইভার যেন খানিকটা ইতস্তত করে শেষ পর্যন্ত এগিয়ে থামাল গাড়িটা। স্বপ্নেন্দু ছুটে গেলো জানলায়,

কোথায় যাচ্ছেন আপনি?

শ্যামবাজার।

আমিও যাব। কোনো কিছু পাচ্ছি না। যদি—

উঠে বসুন।

গাড়িতে উঠে স্বপ্নেন্দু বললো, ধন্যবাদ।

কোনো দরকার নেই। আগে আমি কাউকে লিফ্ট দিতাম না। এখন তো কোনো ভয় নেই এই যে হৃৎপিণ্ড দেখছেন ওটা এমন একটা প্রটেকশনে আছে আণবিক বোমা মারলেও ভাঙবে না। ডু য়ু নো, এটা কী?

না।

আমাদের পাপ। সারাজীবন আমি যে পাপ করেছি এটা তাই দিয়ে তৈরি।

হেসে ফেলল স্বপ্নেন্দু, তাহলে একটি এক বছরে শিশুর বেলায় কী বলবেন?

সে তার বাপ মায়ের কাছ থেকে রক্তের সূত্রে ওটা পেয়েছে।

স্বপ্নে দেখলো গাড়ির কাচে রেডক্রশ চিহ্ন রয়েছে। সে জিজ্ঞাসা করল, আপনি ডাক্তার?

আই ওয়াজ। আমার একটা মরণাপন্ন পেশেন্ট ছিলো নার্সিংহোমে। আজ গিয়ে দেখি সে নাকি হেঁটে বাড়ি চলে গেছে। নার্সিংহোমের সবাই বেকার। সুতরাং আমিও। আমি এখন কী করব? মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন আমাদের মৃত্যু নেই। শরীর নেই যখন তখন অসুখ বিসুখ করবে না কারো। আমি বেকার হয়ে গেলাম। মুখ্যমন্ত্রী বললেন যারা খাদ্য ব্যবসায় আছে তাদের দেখবেন। বাট হোয়াট অ্যাবাউট আস? তাছাড়া কেমন যেন অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। সারাদিন রোগী দেখে। বেড়াচ্ছি, চেম্বারে পেশেন্ট গিজ গিজ করছে। সবসময় টেনশন। সারা জীবনে তো কম আর্ন করিনি। সেগুলো নিয়ে আমি কি করব এখন? ডাক্তার স্বপ্নেন্দুর দিকে তাকালেন, আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু লিভ। জানেন, আমার কাছে কিছু সায়েনায়েড ছিল। এক ফোঁটা জিভে লাগলে চোখ বন্ধ হয়ে যাবে। মুঠোয় করে মুখে ঢালোম, হৃদপিণ্ডে মাখালাম। নো রেসপন্স। হাতুড়ি দিয়ে ভাঙবার চেষ্টা করলাম বুকের বাক্সটা। একটুও টসকাল না।

ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললেন ডাক্তার।

স্বপ্নেন্দু নিচু গলায় বলল, মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন এই পরিবর্তিত অবস্থাকে সহজ মনে মেনে নিতে। অ্যাকচুয়ালি, আপনি আপনার সঞ্চিত টাকা এখন মানুষের উপকারে খরচ করতে পারেন। খাওয়া পরা অথবা অসুখ বিসুখ ছাড়াও তো মানুষের অনেক প্রয়োজন আছে। যেগুলো এতকাল আমরা পারতাম না।

বাধা দিলেন ডাক্তার, আপনি কমুনিস্ট?

না। মোটেই না।

তাহলে রাবিশ কথাবার্তা বলবেন না। আমি সারাজীবন এত কষ্ট করে যা উপার্জন করেছি তা পাঁচজনের জন্যে বিলিয়ে দেব? তার চেয়ে নিজের হাতে পুড়িয়ে ফেললে বেশি আরাম লাগবে।
 
স্বপ্নেন্দু কথা বলল না। গাড়ি ততক্ষণ কলেজ স্ট্রিট ছাড়িয়ে গেছে। পথঘাট নির্জন। এবার ডাক্তারের গলায় হাহাকার শোনা গেলো, আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ আনন্দটাকে চিরকালের জন্য হারালাম।

কী সেটা।

ডাক্তারের করোটিটা দুললো, ইঞ্জেকশন। যখন আমি কারো শরীরের কাছে সিরিঞ্জ নিয়ে যেতাম অদ্ভুত প্লেজার হতো। দিনে অন্তত গোটা পাঁচেক ইঞ্জেকশন না দিলে আমার রাত্রে ঘুম আসতো না।

সেকি?

আমি অ্যাদ্দিন কাউকে বলি নি। এখন অবশ্য বাধা নেই। কাউকে বলিনি ঠিক নয়, আমার এক মনস্তাত্ত্বিক বন্ধুকে বলেছিলাম। সে জিজ্ঞাসা করেছিল, আমি কি ইমপোটেন্ট? স্বীকার করিনি তখন। এখন কলকাতার মানুষ আর সেসবের কথা ভাববে না। তাই বলছি, হি ওয়াজ রাইট।

স্বপ্নেন্দু নড়ে চড়ে বসল। লোকটা পাগল নাকি? দু মিনিটের আলাপে যে সব কথা বলছে তা কোনো সুস্থ মানুষ বলে? হয় পাগল, নয় স্বপ্নেন্দু মাথা নাড়ল, এসব পরিবর্তিত পরিস্থিতির ফল। এখন মানুষের কিছুই হারাবার ভয়ডর নেই। অতএব নিজের গোপন তথ্য খুলে বললেও ক্ষতি নেই।

শ্যামবাজার কোথায়?

স্বপ্নেন্দু রাস্তাটার নাম বলল। ডাক্তার বললেন, অয়েল ইন্ডিকেটারের দিকে তাকিয়ে দেখুন। ওটা শূন্যে আটকে আছে। অথচ গাড়িটা সুন্দর চলছে। জল নেই এক ফোঁটা তবু ইঞ্জিন বন্ধ হচ্ছে না। আগে শুনলে পাগল বলতাম। তাই না?

সেকি পেট্রোল নেই তবু গাড়ি চলছে।

দেখছেন তো।

হয়তো আপনার ইন্ডিকেটারটা ঠিক কাজ করছে না।

নো। ওটা ঠিক আছে।

তাহলে?

এটাও বোধহয় পরিবর্তিত পরিস্থিতির রেজাল্ট। আরে মশাই, গাড়িতে যে এক ফোঁটা জল নেই সেটা বিশ্বাস করেন তো। ওই দেখুন হেদোর কি অবস্থা!

স্বপ্নেন্দু হতভম্ব হয়ে গেল। এখন থেকে গাড়ির জন্য আর পেট্রোলের দরকার হবে না? কি আশ্চর্য! স্বপ্নেন্দুর মোড়ে এসে গাড়িটা থামালেন। ধন্যবাদ জানিয়ে নেমে যাচ্ছিল সে। ডাক্তার বললেন, শুনুন মশাই, আপনার নাম জানি না। কোনোদিন দেখা হবে কি না তারও ঠিক নেই। তবে আমাকে পাগল ভাবার কোনো কারণ নেই। যে যে কারণে আগে পাগল ভাবা হতো, এখন সেইসব কারণগুলো বাতিল হয়ে গিয়েছে। বরং আপনার যদি কোনো পাপ টাপ থাকে তাহলে বলাবলি করতে শুরু করুন, দেখবেন বেশ হালকা লাগবে।

গাড়িটা চোখের সামনে থেকে চলে গেলেও স্বপ্নেন্দু দাঁড়িয়েছিল। অদ্ভুত লোক তো! তার পরেই খেয়াল হলো, তার নিজের কোনো পাপ আছে কি না। স্বপ্নেন্দু অনেক চিন্তা করেও তেমন কোনো পাপের কথা মনে করতে পারল না। ছেলেবেলায় একবার একটা বেড়ালকে ঢিল ছুঁড়ে খোঁড়া করে দিয়েছিলো। খুব চুরি করত বেড়ালটা। সে এমন পাপ, আদৌ পাপ কি না বলা মুশকিল, কিন্তু ও কথা কাউকে বলা যাবে না।

ঘরে ঢুকে বিছানায় চিৎপাত হতে গিয়েই স্বপেন্দুর মনে পড়ল। টেবিলের দিকে তাকাতেই কাচের আড়ালে সেই লাল গোলাপটাকে দেখতে পেল সে। গোলাপটাকে আরও টাটকা আরও বেশি লাল দেখাচ্ছে। সে দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে স্বপ্নেন্দুর মন শান্ত হয়ে গেল।

পরের দিন রেডিও খুলে স্বপ্নেন্দু বুঝল কলকাতার অবস্থা বেশ স্বাভাবিক। চমৎকার গানবাজনা হচ্ছে। খবরে বলা হলো, প্রচুর ট্রাম বাস চলছে সকাল থেকে। গত দুদিনে কলকাতায় খুনজখম দূরের কথা সামান্য ছিনতাই-এর ঘটনা পর্যন্ত ঘটেনি। তবে ধুতি এবং লুঙ্গির চাহিদা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। নাগরিকদের কাছে আবেদন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী, অবিলম্বে যে যার কাজে যোগ দিন। আজ স্বপ্নেন্দু চাদরটাকে বাতিল করল। কারণ ওতে মনের জড়তা ধরা পড়ে। যা হয়েছে তা ওর একার ক্ষেত্রে নয় যখন, তখন প্রকাশ্যে মেনে নেওয়াই ভাল। ঘর থেকে বের হবার আগে সে আবার ফুলটার দিকে তাকাল। চমৎকার তাজা। কলকাতা শহরে একমাত্র তার কাছেই ফুল আছে, খাঁটি ফুল। ওটাকে ছোঁওয়া যাবে না, টেবিল থেকে নড়ানো যাবে না। অথচ এই ঘরে ফুলটা একা পড়ে থাকবে সেটাও ভালো লাগছিল না। স্বপ্নেন্দু একটা চাদর দিয়ে বড় জারটাকে ঢেকে দিল।
 
আজ ট্রামে বাসে খুব ভিড়। ট্রামে বাসে যত লোক ধরত এখন তার ডবল ধরবে।

কথাটা শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠল। একজন বলল, মুখ্যমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন। বিপ্লব এলেও ট্রান্সপোর্ট প্রব্লেম সলভ করতে পারত না।

প্রথম জন স্বপ্নেন্দু দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনাদের বাথরুমটাকে কী করবেন ভাবছেন?

বাথরুম? স্বপ্নেন্দু হতভম্ব।

দুর মশাই। এখন তো আর বাথরুমের প্রয়োজন নেই। খামোকা কিছু ঘর খালি পড়ে থাকবে বাড়িতে বাড়িতে। আমি ভাবছি ওটা ভাড়া দিয়ে দোব। আমাদের বাথরুমটা বেশ বড়।

দ্বিতীয়জন বলল, ভাড়ার টাকা দিয়ে কী করবেন দাদু?

কেন? শখের জিনিস কিনব। এই ধরো কালার টিভি।

টি ভি? স্টেশন তো চালু হয়নি।

হয়নি, কিন্তু হবে।

ওঃ টিভির মেয়েগুলোকে কী রকম দেখাবে ভাবুন তো! আমার বড় মেয়েটি দেখতে ভালো নয় বলে অ্যানাউন্সারের চাকরি পায় নি। এখন আবার অ্যাপ্লাই করতে বলি, কি বলেন?

স্বপ্নেন্দু দেখল কলকাতার মানুষ বেশ সহজেই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। হয়তো মুখ্যমন্ত্রীর অনুরোধে কাজ হয়েছে। তার বেশ ভালো লাগছিল। লিফটের সামনে বিরাট লাইন। কিন্তু আজ অনেক বেশি লোক করছে বলে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে লাইনটা। স্বপ্নে দেখল লাইনে তিনটে শাড়ি আছে। তার মানে মেয়েরাও অফিসে এসেছে। তার হৃৎপিণ্ড কাঁপতে লাগল, হেনা সেন আছে নাকি লাইনে? কী করে হেনাকে চিনবে সে? আজ সকালে রেডিওতে বলেছিল, প্রত্যেক নাগরিক আইডেন্টিটি কার্ড সঙ্গে নিয়ে অফিসে যাবেন। কিন্তু সে কার্ড তো ব্যাগের ভেতরে থাকবে।

স্বপ্নেন্দু ছটফট করছিল। লিফটে উঠে সে শাড়ির দিকে তাকাল। সেদিন হেনা সেন যে শাড়ি পরেছিল সেটার সঙ্গে এই তিনটির রঙ মিলছে না। হেনা যদি তাকে দ্যাখে তাহলে নিশ্চয়ই হাসবে। সঙ্গে সঙ্গে খেয়াল হলো, তার চেহারাও তো হেনার চেনার কথা নয়।

নিজের ফ্লোরে এসে স্বপ্নেন্দু অবাক হলো। দেওয়ালে পোস্টার পড়েছে কর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছাচারিতা চলবে না। ঘুষখোর অফিসারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। নিজের ঘরে যাওয়ার সময় সে। দেখলো অফিসে বিরাট জটলা হচ্ছে। বেশ উত্তেজনা। ঘরে ঢুকে সে দেখল তার চেয়ারে কেউ বসে আছে। তাকে দেখে লোকটা উঠে দাঁড়াতে স্বপ্নেন্দু চিনতে পারল। লোকটা নির্জীব গলায় জিজ্ঞাসা করল,

আপনি কি সাহেব?

এক গ্লাস জল দাও হরিমাধব। বলতে বলতে খেয়াল হলো আর জলের দরকার নেই, জল পাওয়াও যাবে না। হরিমাধব ততক্ষণে তিন হাত দূরে ছিটকে গেছে, মাপ করুন স্যার। আমি ভাবিনি আপনি আসবেন।

ভাবনি?

না স্যার। বিশ্বাস করুন এর আগে আমি কখনও ওই চেয়ারে বসিনি। আজ বড় ইচ্ছে হলো শরীরটা যখন পাল্টে গেল, নিজেকে ভূতের মতো দেখাচ্ছে তখন ভাবলাম চেয়ারটায় বসে দেখি কেমন লাগে।

ঠিক আছে। স্বপ্নেন্দু চেয়ারটায় বসলো। অনেক কষ্টে প্যান্টটাকে কোমরে শক্ত করে বেঁধেছে। কিন্তু কেবলই মনে হয় এই বুঝি পড়ে গেল।

হরিমাধব এগিয়ে এলো, স্যার, অফিসের সবাই খুব ক্ষেপে গেছে।

কোন?

ওই ট্রান্সফার হবে। আজ কেউ কাজ করবে না বলেছে।

এখনও ওইসব ওদের মাথায় আছে নাকি?

হ্যাঁ স্যার। আপনি সাবধানে থাকবেন। হরিমাধব দরজার দিকে তাকাল, আর হ্যাঁ, ম্যাডাম আপনাকে ফোন করেছিলেন দুবার। সঙ্গে সঙ্গে মিসেস বক্সীর শরীরটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। মরলেও বোধহয় স্বভাব পাল্টাবে না। তার পরেই ওর হাসি পেল। আর এখন তো হাসি পেতেই তা খুকখুক করে বেরিয়ে পড়ে। কঙ্কালশরীর বোধহয় নিঃশব্দে হাসতে পারে না। স্বপ্নেন্দু টেলিফোনটার দিকে তাকাল। অপারেটর এসেছে তাহলে।
 
সে আবার হরিমাধবকে জিজ্ঞাসা করল, তোমার কেমন লাগছে হরিমাধব? ভালো না স্যার। এই ভূতের চেহারা নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালেই শিউরে উঠি। আমার পরিবারকে আবার ঠিক শাঁকচুন্নির মতো দেখায়। নরক, নরকে এসে গেছি। স্যার, শাস্ত্রে লেখা ছিল কলিযুগের পর নাকি এইরকম সাক্ষাৎ নরকবাস ঘটবে। ফুঁপিয়ে উঠল হরিমাধব। স্বপ্নেন্দু তাকালো হরিমাধবের বুকের দিকে। অদৃশ্য গোলকের গর্তে থাকা হৃৎপিণ্ডটা থরথরিয়ে কাঁপছে। তার মানে লোকটার কান্না জেনুইন। মাথাটা পরিষ্কার হয়ে গেল স্বপ্নেন্দুর। এখন কেউ ভান করলে তার বুকের দিকে তাকালেই ধরা পড়ে যাবে। বাঃ ফার্স্ট ক্লাশ।

এই সময় টেলিফোনটা বেজে উঠলো। হ্যাল, বলতেই মিসেস বক্সীর গলা ভেসে এল, কখন এসেছেন? কেউ বলেনি আমি ডেকেছি?

বলেছে। স্বপ্নেন্দু নিস্পৃহ স্বরে বলল।

বলেছে? তবু আপনি আমার সঙ্গে দেখা করছেন না?

যাচ্ছি। আমি একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। রিসিভার নামিয়ে রেখে স্বপ্নেন্দু হরিমাধবকে জিজ্ঞাসা করল, আজ অফিসে সবাই এসেছে? হরিমাধবের করোটিটা নড়ল, না স্যার, অনেকেই আসেনি। পেটের ধান্ধা যখন আর করতে হবে না তখন মিছিমিছি কেন আসতে যাবে?

স্বপ্নেন্দুর মনটা খারাপ হয়ে গেল। সবাই আসেনি? তার মানে হেনা সেনও না আসতে পারে। প্রশ্নটা করতে গিয়েও পারল না, কেমন সংকোচ বোধ হলো। হরিমাধব আবার এই নিয়ে গপ্পো করবে। যা করতে হবে তাতে অফিসিয়াল ব্যাপার যোগ না করলে হরিমাধবরা অন্যভাবে দ্যাখে।

ঘর থেকে বেরিয়ে আসামাত্র করিডোরে চিৎকার শুনতে পেলো সে। দশবারো জন কংকাল বিভিন্ন পোশাকে দাঁড়িয়ে হাত তুলে স্লোগান দিচ্ছে। সমস্ত কাজকর্ম বন্ধ করে দেবার হুমকি দিচ্ছে। ওরা। স্বপ্নেন্দুকে দেখেও দেখল না যেন। বোধহয় চিনতে পারেনি। স্বপ্নেন্দু সুড়ুৎ করে মিসেস বক্সীর দরজার কাছে চলে এল। সেখানে একটা কঙ্কাল উর্দি পরে দাঁড়িয়ে আছে।

কাকে চাই? লোকটা জিজ্ঞাসা করল।

এই প্রথম মিসেস বক্সীর ঘরে ঢুকতে বাধা পেল স্বপ্নেন্দু। বিরক্ত স্বরে সে জিজ্ঞাসা করলো, তুমি কে?

আমি ওর বেয়ারা। ম্যাডাম কাউকে ঘরে ঢুকতে দেবেন না।

কি আশ্চর্য! তুমি আমাকে চিনতে পারছ না? আমি স্বপ্নেন্দু!

সঙ্গে সঙ্গে লোকটা কপালে হাত ঠেকাল ক্ষমা করবেন স্যার। আমার একবার সেরকম মনে হয়েছিল কিন্তু সব মুখগুলো দেখতে যে একরকম। যান স্যার, ম্যাডাম আপনাকে যেতে বলেছেন।

এরকম পাহারা তো আগে দাওনি।

ওই যে, অফিসের লোকরা চেঁচাচ্ছে তাই ম্যাডাম বললেন।
 
স্বপ্নেন্দু দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। বিশাল ঘরে কেউ নেই। টেবিলের ওপাশে ঘুরন্ত চেয়ারটা ফাঁকা। স্বপ্নেন্দু একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বলল। ঘরের কোণায়, একটা পর্দা ঘেরা জায়গা আছে। সেখানে ইজিচেয়ারে শুয়ে মিসেস বক্সী বিশ্রাম করেন। কিন্তু লাগোয়া বাথরুমের দরজাটা খোলা। ঘরে যিনি ঢুকলেন তাকে দেখে চমকে উঠল স্বপ্নেন্দু। অসম্ভব বেঁটে এবং রোগা একটা কঙ্কালের গায়ে আলখাল্লা টাইপের ম্যাক্সি জড়ানো। করোটির ওপরে বড় রুমাল বাঁধা। ঘরে ঢুকেই ম্যাডাম স্থির হলেন, কে?

আই ম্যাডাম, স্বপ্নেন্দু।

আমি সি। গুড়গুড় করে উনি চলে এলেন নিজের চেয়ারে। তারপর শরীরটা সিধে রেখে বললেন, আমি ভাবছি প্রত্যেকের বুকের ওপরে একটা নেমপ্লেট রাখতে বলব। নইলে চিনতে অসুবিধে হচ্ছে।

এত দেরি হল কেন?

অফিসে আসব না ভেবেছিলাম।

সে কি? কেন? এখন তো শরীর খারাপের অজুহাত টিকবে না।

না। চাকরি করব না ভাবছি।

হোয়াট ডু য়ু মিন? আপনি শোনেননি চিফমিনিস্টার কি বলেছেন? প্রত্যেক নাগরিক এতকাল যা যা করেছেন এখনও তাই করতে হবে। অন্তত সরকারি বেসরকারি চাকরিতে যারা ছিলেন তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে সেই চাকরি করতে হবে। একটা স্পেশ্যাল পুলিশ ফোর্স এই ব্যাপারটা দেখবে। খুক খুক করে হাসলেন মিসেস বক্সী, চাকরি করব না বললেই মিটে গেল?

সে কি? পুলিশরাও এখনও অ্যাকটিভ আছে নাকি?

মোর অ্যাকটিভ। আপনি ভাবছেন গুলি করেও যখন কিছু হবে না তখন যা ইচ্ছে করবেন? এর মধ্যে বিজ্ঞানীরা এমন একটা অস্ত্র বের করেছেন যার রিঅ্যাকশনে হৃৎপিণ্ড আধঘন্টা অসাড় হয়ে যাবে। সেই সময় আপনি নড়তে চড়তেও পারবেন না। আপনাকে অ্যারেস্ট করে টিউব রেলে ফেলে রাখা হবে।

টিউব রেলে?

ইয়েস, টিউব রেল তো ইনকমপ্লিট। তাছাড়া এখন আর টিউবের কোনো প্রয়োজনও হবে। ট্রান্সপোর্ট প্রবেলম সলজ্ঞ। তাই টিউবটাকে অন্ধকূপ হিসেবে ব্যবহার করা হবে। পানিশমেন্ট সেল।

তারপরে অন্য স্বরে মিসেস বক্সী বললেন, ওসব চিন্তা ছাড়ন। ইউ আর ইয়ং হ্যান্ডসাম। কত ব্রাইট প্রসপেক্ট সামনে পড়ে আছে। আজকের অ্যাটেন্ডেন্স অবশ্য সেভেন্টি। নট ব্যাড।

স্বপ্নেন্দু ঠিক ঠাওর করতে পারছিল না মিসেস বক্সী দেখাচ্ছে কি না। তবু সে জিজ্ঞাসা করলো, ডেকেছিলেন কেন?

মিসেস বক্সী বললেন, স্লোগান শুনেছেন? মানুষের অভ্যেস কোথায় যাবে? এই চেঞ্জড শরীরেও ওরা চেঁচাচ্ছে। এটা বন্ধ করতে হবে।

বলুন কী করব?

আঃ, সেটা আপনি ঠিক করুন।

ওই ট্রান্সফার অর্ডারটা বাতিল করে দিন।

সে কী?

ঠিকই বলছি। এখন আর পার্টিরা ঘুষ দিতে আসবে না। কারণ মানুষের অনেক প্রয়োজন আর ঠিক আগের মতো নেই। তাছাড়া ঘুষ নিয়ে ওরা কি করবে? টাকারও মূল্য কমে গেছে!

ইউ আর রাইট। আমি অনেকবার ভেবেছি। সত্যি কথা। এখন আর ঘুষ দেবে কে? আর ঘুষ নিয়ে কিই বা করবে। কিন্তু এটা প্রেস্টিজের ব্যাপার। চট করে আমরা এই সিদ্ধান্ত ওদের জানাব না। মিসেস বক্সী চেয়ার ছাড়লেন। মহিলার চেহারা এখন আমূল পাল্টে গেছে। সেই থপথপে মাংসের তালটা চলে যাওয়ায় বেশ ছিমছাম দেখাচ্ছে। কিন্তু ম্যাক্সিটা নিশ্চয়ই ওঁর নয়। মিসেস বক্সী হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ালেন, আমাকে খুব কুৎসিত দেখাচ্ছে?

না না। বিউটিফুল।

ওঃ বাটারিং করবেন না। ওটা আমি একদম পছন্দ করি না। আমি তো প্রথমে এমন শকড ছিলাম যে বিছানা থেকে উঠতেই পারি নি। নাউ আই ফিল ইটস বেটার। অ্যাট লিস্ট উই আর সেফ ফ্রম ইওর হাঙ্গরি আইস। তার পরেই হেসে ফেললেন মিসেস বক্সী, রাগ করবেন না। আমি আপনাকে মিন করি নি। ইউ আর গুড। আসুন না আজকে সন্ধেবেলায় আমার বাড়িতে। আমার মেয়ে খুশি হবে।

আপনার মেয়ে? স্বপ্নেন্দু এতটা তরল হতে ম্যাডামকে কখনও দ্যাখে নি।

হ্যাঁ। এবার লরেটো থেকে পাশ করেছে। ম্যাক্সিটা তো ওরই।

ও, ঠিক আছে যাওয়া যাবে। স্বপ্নেন্দু উঠে দাঁড়ল।

কিন্তু বিনা শর্তে নয়।

মানে?

ওদের ক্ষমা চাইতে হবে বিক্ষোভ করার জন্যে। তারপর আমরা ট্রান্সফার অর্ডারটা ক্যানসেল করব। ও কে?

যাঃ বাবা। কোন্ কথা থেকে কোথায় চলে এলেন মহিলা। স্বপ্নেন্দু করোটি নেড়ে বেরিয়ে এল বাইরে।
 
দুপুরে খবর পাওয়া গেল ওদের গেট মিটিং-এ একদম লোক হয়নি। নেতারা অনেক অনুরোধ করা সত্ত্বেও কর্মচারীরা নাকি সেখানে উপস্থিত হয়নি। তারা বলছে এখন যেহেতু অফিসে আসা বাধ্যতামূলক তাই আসতে হয়। ট্রান্সফার নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কোনো লাভ নেই।

নেতারা নাকি খুব ভেঙে পড়েছে কর্মচারীদের এই ব্যবহারে। টিফিনের পর নেতারা এল তার ঘরে। স্বপ্নেন্দু ওদের বসতে বলল,

বলুন, কী চাই আপনাদের।

ওটা, করবেন না।

কর্মচারীরা তাই চাইছেন?

এখন তো অনেকেই সরে যাচ্ছে। কিন্তু এটা আমাদের প্রেস্টিজের প্রশ্ন।

মিসেস বক্সীর সঙ্গে কথা বলুন।

না। উনি খুব একরোখা। তাছাড়া আমরা আপনাকে মধ্যস্থতা করতে বলছি।

মেনে নিন। অফিস অর্ডার বলে কথা।

মেনে নিলে আমাদের আন্দোলনের মেরুদণ্ড ভেঙে যাবে।

আপনারা আর কি নিয়ে আন্দোলন করবেন?

চাকরি যখন করছি তখন সমস্যা তো আসবেই। তাছাড়া এখন থেকে আর আটান্ন বছর বয়সে রিটায়ারমেন্ট নেই। অতএব সমস্যা থাকবেই।

রিটায়ারমেন্ট নেই?

না স্যার।

এক মিনিট ভাবল স্বপ্নেন্দু। এই চাকরি চিরকাল করে যেতে হবে? কোনো প্রমোশন নেই? তারপর লোকগুলোর মুখের দিকে তাকাল সে। করোটি দেখে মনের প্রতিক্রিয়া বোঝা যায় না। আর এরা শার্ট পরে আছে বলে মনের প্রতিক্রিয়া ওদের হৃৎপিণ্ডে দেখা যাচ্ছে না। হরিমাধবের শার্টের বোতাম একটাও নেই। তাই ওরটা বুঝতে অনেক সুবিধে।

হঠাৎ হেনা সেনের কথা মনে পড়ল। সে জিজ্ঞাসা করল, শুক্রবার যে মহিলা তর্ক করছিলেন। তিনি কোথায়? তিনি কি এখন আপনাদের সঙ্গে আছেন?

নেতারা মুখ চাওয়াচায়ি করল। শেষ পর্যন্ত একজন বলল, উনি আসেননি আজ।

ও। স্বপ্নেন্দুর মন খারাপ হয়ে গেলেও সে মুখে বলল, ভদ্রমহিলা বিচক্ষণ কথাবার্তা বলেছিলেন। অলরাইট। আপনারা যান, আমি দেখছি কী করা যায়। বুঝতেই পারছেন এসব আমার হাতে নেই।

আমরা জানি স্যার। আপনি মধ্যস্থতা করুন। ততক্ষণ আমরা একটু আধটু আন্দোলন চালাব।

আন্দোলন চালাবেন মানে?

না চালালে ইমেজ নষ্ট হয়ে যাবে।

নেতারা চলে গেলে স্বপ্নেন্দু উঠে দাঁড়াল। যাক প্রব্লেম সলভড। তবে এ কথা এখনই মিসেস বক্সীকে বলা চলবে না। ওঁকেও দুদিন ঝুলিয়ে রাখলে অন্য কাজ নিয়ে টিকটিক করবেন না। শালা, প্রমোশনই যখন কোনোকালে হবে না তখন কাজ দেখিয়ে লাভ কী? টেলিফোনটা শব্দ করতেই বিরক্ত হল স্বপ্নেন্দু। মিসেস বক্সী নির্ঘাৎ। দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে আবার ফিরে এলো সে। সে যে বেরিয়ে যাচ্ছে একথা বলে দেওয়া ভালো।

আমি মুখার্জি বলছি।

যাঃ শালা। থার্ড অ্যাসেসমেন্ট অফিসার মুখার্জির ফাইলটা তো মিসেস বক্সীর কাছে আটকে আছে। সে জবাব দিলো, বলুন।

শোনো। তোমাকে শুক্রবারে যে রিকোয়েস্ট করেছিলাম সেটা করতে হবে না। ম্যাডামের অ্যাভালের কোনো দরকার নেই।

কেন?

দিগম্বর হয়ে বসে আছি এখন। আমি আর ইন্টারেস্টেড নই।

টেলিফোন নামিয়ে হেসে ফেলল স্বপ্নেন্দু। বিপ্লবও এতটা কার্যকরী হতো না। মুখ্যমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন। জাঁদরেল ঘুষখোর অফিসার আর ঘুষের জন্যে অনুরোধ করছে না। চমৎকার।

মিসেস বক্সীকে জানাল না স্বপ্নেন্দু। হরিমাধবকে বলে গেল কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলবে শরীর খারাপ বলে, তাড়াতাড়ি চলে গেছেন। হরিমাধবের বিস্ময় বাড়ল, স্যার, আপনার শরীর খারাপ?

তৎক্ষণাৎ খেয়াল হলো। শরীর কোথায় যে খারাপ হবে? এই অজুহাতটা চিরকালের মতো বাতিল হয়ে গেল। স্বপ্নেন্দু গম্ভীর গলায় বলল, ঠিক আছে। কেউ খুঁজলে বলে দিও জরুরি কাজে বেরিয়েছি।

এখন দুপুর শেষ হয়নি। রোদের তাপ বড্ড বেশি। কিন্তু ঘাম হচ্ছে না বা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা না থাকায় তেমন কষ্ট হচ্ছে না। বাস থেকে নেমে স্বপ্নেন্দু হেসে ফেলল। কন্ডাকটার চুপচাপ বসে আছে। কোনো যাত্রীকেই টিকিট কাটতে হচ্ছে না। এটা কদ্দিন চলবে কে জানে।
 
রাস্তাটা নির্জন। হঠাৎ স্বপ্নেন্দুর বুকের ভেতরটায় থম ধরল। তার হৃৎপিণ্ড কাঁপতে শুরু করল। খুব নার্ভাস লাগছে এখন। এইভাবে চট করে চলে না এলেই ভালো ছিল। তারপর মরিয়া হলো সে। লাল ব্লাউজ লাল শাড়ির আগুন তাকে চুম্বকের মতো টানছিল।

কলিংবেলের বোতামে আঙুল রাখতেই ভেতরে যেন ঝড় বয়ে গেল। নির্জন দুপুরে বোধহয় আওয়াজ বেশি হয়। কেউ দরজা খুলছে না। মিনিট দুয়েক অপেক্ষা করার পর স্বপ্নেন্দু আবার বেল টিপল। এরপর ধীরে ধীরে দরজা খুলে দাঁড়ালেন এক মহিলা। মহিলা কারণ তার পরনে সাদা শাড়ি, মাথাটা বিরাট ঘোমটার আড়াল ঢাকা। সেই পরশুরামের গল্পের চরিত্র যেন।

কী চাই?

হেনা সেন আছেন? স্বপ্নেন্দুর স্বর কাঁপছিল।

আপনি কে?

আমি ওঁর অফিসে কাজ করি। আমার নাম স্বপ্নেন্দু।

ও তুমি। এসো ভেতরে এসো। মহিলা দরজা ফাঁক করতে স্বপ্নেন্দু ঢুকে পড়ল। দরজা বন্ধ করে মহিলা কাতর গলায় বললেন, একি হল বাবা, আমরা কি এমন পাপ করেছি যে এই শাস্তি পেতে হচ্ছে।

স্বপ্নেন্দু বুঝল ইনি হেনার মা। মনে পড়লো না সেদিন ইনি তাকে তুমি বলেছিলেন কিনা। সে বললো, কী আর করা যাবে বলুন। মহিলা বললেন, এইভাবে বাঁচতে চাই না বাবা। তিনি স্বর্গে বসে রইলেন আর আমি চিরকাল এই নরকে পড়ে থাকব। আমার তো বাঁচবার কোনো আকাঙ্ক্ষাই ছিলো না। শুধু ওই মেয়েটার একটা হিল্লে করতে পারলে! কলকাতার সব মানুষের কি এই দশা?

হ্যাঁ মাসীমা।

কলকাতার বাইরের?

তাদের কথা জানি না।

পরশু থেকে মেয়ে আমার বিছানা ছাড়েনি। শুধু পড়ে পড়ে কেঁদে যাচ্ছে। তুমিই প্রথম আমাদের বাড়িতে এলে।

ওর সঙ্গে একটু কথা বলা যাবে? স্বপ্নেন্দু যেন অনুনয় করল।

কথা? ও তো কথাই বলতে চাইছে না। কতবার ওকে বললাম সহজ হতে তা মেয়ে আমাকে খেঁকিয়ে উঠছে। সরে যাও সরে যাও আমি কাউকে সহ্য করতে পারছি না। ওকি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইবে?

মহিলা মাথার পড়ে যাওয়া ঘোমটা চট করে টেনে নিলেন। স্বপ্নেন্দু লক্ষ্য করল এঁর করোটির গায়ে সামান্য হলদে দাগ রয়েছে।

তাহলে থাক। ওকে বলবেন আমি এসেছিলাম। নিশ্বাস ফেললো স্বপ্নেন্দু। মহিলা বললেন, দাঁড়াও। তুমি বড়ো ভালো ছেলে বাবা।

অবাক হয়ে স্বপ্নেন্দু জিজ্ঞাসা করলো, একথা বলছেন কেন?

নিশ্চয়ই কারণ আছে। আমি ভাবছি তুমি যদি নিজে গিয়ে ওকে সহজ হতে বল তাহলে যদি কাজ হয়। আগে থেকে বললেও আপনি করবে।

আপনি যদি বলেন। স্বপ্নেন্দুর হৃৎপিণ্ড কাঁপতে লাগল।

আগে হলে হয়তো বলতাম না। কিন্তু এখন আমার মাথা ঠিক নেই। দ্যাখো, যদি পারো ওকে সহজ করতে। ওই দরজা দিয়ে যাও।

স্বপ্নেন্দুর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। তারপর ধীরে ধীরে সে বাঁ দিকের ছোট্ট প্যাসেজটা ধরে হেঁটে একটা ভেজানো দরজার সামনে দাঁড়াল। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল মহিলা নেই। নিজের জামা ঠিক করে নিলো স্বপ্নেন্দু, ভেতরে ঢুকতেই খাটটাকে দেখতে পেল। খাটের ওপর হেনা সেন উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। হলদে ফুল তোলা ম্যাক্সি ওর গায়ে। বড়ো হাতায় কবজি পর্যন্ত ঢাকা। পায়ের হাড় এবং সাদা করোটি এবার দেখতে পেলো স্বপ্নেন্দু। উপুড় হয়ে শুয়ে থাকায় হেনা সেন তার উপস্থিতি টের পায় নি। স্বপ্নেন্দুর হৃৎপিণ্ড স্থির হয়ে গেল। হেনা সেন ছাড়া নিশ্চয়ই এই ঘরে অন্য কেউ থাকবে না। সে চোখ বন্ধ করতে গিয়েও পারল না। কারণ তার চোখের পাতাই নেই। হৃৎপিণ্ড অনুভবে দৃষ্টিশক্তি যোগাচ্ছে।

সেই হেনা সেন? স্বপ্নেন্দুর মনে হচ্ছিল এখানে না এলেই ভালো হতো। যে মাখনের মতো নরম শরীর তাকে চুম্বকের মতো টেনেছিল সেটাকে স্মৃতিতে বাঁচিয়ে রাখাই ছিল। এখন তো হেনা সেন তারই মতো বীভৎস। অথচ এই ঘরে ঢোকবার আগে বুকের ভেতর ভূমিকম্প হচ্ছিল তার। তার অনুরণন তো এখনও মেলায় নি। স্বপ্নেন্দু নিচু স্বরে ডাকলো, শুনুন।

হেনা সেনের কোনো প্রতিক্রিয়া হলো কিনা বুঝতে পারলো না সে। এক পা এগিয়ে সে আবার ডাকলো, মিস সেন!..
 
এবার চকিতে করোটি ঘুরে গেল। আর তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বসে হেনা সেন চিৎকার করে উঠলেন, কে? কে? ও মাগো! তার একটা হাত মুখে চাপা দিল।

সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে ধিক্কার দিলো স্বপ্নেন্দু। একি দেখছে সে। কিন্তু ততক্ষণে সেই চামড়া মাংস-রক্তহীন কঙ্কালের মুখটা চাদরে ঢেকে ফেলেছে হেনা সেন। এখনও যেন ঘরের মধ্যে আর্তনাদটা পাক খাচ্ছে। স্বপ্নেন্দু ঘোর কাটিয়ে বলে উঠলো, নার্ভাস হবেন না মিস সেন। আমি স্বপ্নেন্দু।

স্বপ্ন? সঙ্গে সঙ্গে হেনা সেনের মাথাটা আলোড়িত হলো, আমি চিনি না আপনাকে। কেন এলেন এখানে? বেরিয়ে যান, বেরিয়ে যান বলছি। ওমা, মাগো।

আর্তনাদ শুনে স্বপ্নেন্দু এতটা অবাক হয়ে গিয়েছিলো যে কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে পারে নি প্রথমটায়। যেন সত্যি কোনো মহিলার ঘরে সে আচম্বিত ঢুকেছে এবং তিনি চিৎকার করছেন আত্মরক্ষার জন্যে। স্বপ্নেন্দু নামটা শুনেও ওর কোনো প্রতিক্রিয়া হয় নি দেখে সে আরও তাজ্জব হলো। এখনই সেই মহিলা ছুটে আসবেন এবং তাকে বেরিয়ে যেতে হবে এই আশংকায় স্বপ্নেন্দু দরজার দিকে তাকাল। কিন্তু মহিলার আসার কোনো লক্ষণ দেখা না যাওয়ায় সাহস বাড়ল তার। হেনা সেন এখন দুহাতে চাদরটাকে আঁকড়ে ধরে কাঁপছেন।

স্বপ্নেন্দু আর এক পা এগোল, মিস সেন। আমি আপনার অফিসে কাজ করি। এই দুদিন আমি আসতে পারিনি। আজ না এসে পারলাম না। আপনি সত্যি আমাকে চিনতে পারছেন না?

না, আমি কাউকে চিনি না। উত্তেজনা আছে কিন্তু এবার তার ঝাঁঝ কম।

তা কি হতে পারে? আমি শুক্রবারে এখানে এসেছিলাম।

আজ কেন এসেছেন? মজা দেখতে?

মোটেই নয়। স্বপ্নেন্দু আবার দরজাটার দিকে তাকাল। মহিলা ওর ওপাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব শুনছেন কিনা কে জানে! তবু সে মরিয়া হয়ে বলল, এই কদিন আমি আপনার কথা ভেবেছি।

কি মিথ্যে বলতে এসেছেন!

মিথ্যে নয়। আমার বলা শোভন নয়। স্বপ্নেন্দুকে থামিয়ে দিয়ে হেনা সেন বললো, কী জন্যে এসেছিলেন আমি জানি। এখন তো আর সেসব নেই। আমার শরীর, আমার শরীরটার দিকে তাকালে পুরুষজাতটার চোখ লোভে চকচক করে উঠত। ওই ঘেন্নায় আমি! তা আর এখন কেন? এখন তো আমি একটা কঙ্কাল। এখন আমাকে একটু নিশ্চিন্তে থাকতে দিন।

আপনি ভুল বলছেন।

একটুও না। সেদিন যখন আপনি আমাকে ঘরে ডেকেছিলেন তখনই আমি বুঝতে পেরেছিলাম। সেই চোখ। লালসা থিক থিক করছে। আজ আমার কিছু নেই। আপনাদের কাছে আমার কোনো মূল্য নেই। উঃ।

আমি আবার বলছি আপনি ভুল বলছেন।

নাঃ। চিৎকারটা বাড়ল। তারপর এক টানে চাদর খুলে হিসহিসে গলায় হেনা সেন বলল, দেখুন চেয়ে দেখুন। এই হলাম আমি।

স্বপ্নেন্দু একবার ভালো করে দেখল, তার বুক মুচড়ে যাচ্ছিল। সেই ঠোঁটের জাদুকরী হাসি, চোখের কাজ গালের টোল আর মুখের মায়া কোথায় মিলিয়ে গেল। একটা ছোট্ট কঙ্কালের জেদী মুখ তার দিকে ফেরানো। কিন্তু সেই সঙ্গে তার মনে হলো রাস্তাঘাটে এই কদিনে সে অনেক কঙ্কালের মুখ দেখেছে। তাদের চোয়াল, কপাল, নাকের তুলনায় হেনা সেনের মুখ অনেক সুন্দর। অন্তত ওর চিবুকে একটা আলতো আদুরে ভাব মাখানো আছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মুগ্ধ হলো স্বপ্নেন্দু। তারপর বললো, আমার মুখের দিকে দেখুন। আমিও আপনার মতো। তবে একটা কথা বলি, সব হারিয়েও আপনি অনেকের চেয়ে সুন্দর, বেশি সুন্দর।
 
আবার সেই মিথ্যে কথা! সারাজীবন ধরে স্তুতি শুনেছি। আর না। কি আশায় আপনি এসেছেন আমার কাছে? আমার শরীর? তবে দেখুন। নিজের চোখে দেখুন। হঠাৎ দুহাতে পাগলের মতো ম্যাক্সিটা খুলে ফেললো হেনা সেন, দেখুন, ভালো করে দেখুন। আমার শরীরে এখন কটা হাড় ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। আপনারা, পুরুষজাত চিবিয়ে সব নরম সুন্দর গিলেছেন। বাট নাউ আই অ্যাম ফিনিশড। গেট আউট প্লিজ। হেনা সেন থরথর করে কাঁপছিল। স্বপ্নেন্দুর মনে হলো অসম্ভব সুন্দর একটা দৃশ্য দেখেছ। হেনা সেনের দুটো পা ঈষৎ ভাঁজ করা, কোমর বাঁকানো, বুকের খাঁচার ভেতরে তার হৃৎপিণ্ড ধড়ফড় করছে। যেন কুমোরটুলিতে মূর্তি গড়ার প্রাথমিক কাজ শেষ হয়েছে, এবার মাটির প্রলেপ লাগিয়ে দিলেই হলো। সে একটু ঝুঁকে বিছানা থেকে চাদর তুলে নিয়ে হেনা সেনের শরীরে ছড়িয়ে দিল, তারপর বলল, উত্তেজিত হবেন না। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে।

কে বলেছেন? হেনা সেনের স্বরে বিস্ময়।

মুখ্যমন্ত্রী।

আঃ আপনি অদ্ভুত লোক তো।

উনি তো অন্যায় কিছু বলেননি। আমাদের যা গিয়েছে তা নিয়ে চিন্তা করে কী লাভ! আমরা তো অমরত্ব পেলাম, তাই না?

কীসের বিনিময়ে অমরত্ব পেলাম? কে চায় এমন অমরত্ব? অন্তত আমি চাই না। আমার ওই শরীরটাকে কৃপণের মতো লোভী হাতগুলোর আওতা থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম। কেন, কীসের জন্যে? আমি তো তার ব্যবহারই জানলাম না, তার স্বাদ আমার অচেনা রয়ে গেল চিরজীবনের জন্যে। কে চায় এই অমরত্ব?

উত্তেজিত হবেন না। আপনি বিশ্বাস করুন আমি কোনো অভিসন্ধি নিয়ে আসিনি।

তাহলে কেন এসেছেন?

বলব। আগে জামাটা পরে নিন।

আমি আর শাড়ি পরতে পারব না। আঃ।

কেন পারবেন না? অফিসে আজ তিনজন মহিলাকে শাড়ি পরে যেতে দেখেছি।

অফিসে? অফিসে লোক গিয়েছিল? মেয়েরা গিয়েছিল?

হ্যাঁ। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন সবাইকে স্বাভাবিকভাবেই চলতে। যাঁরা অফিসে যাবেন না তাদের পাতাল-নরকে ঠেলে দেওয়া হবে।

পাতাল-নরকে? হেনা সেনের স্বরে আবার বিস্ময়।

হ্যাঁ। ওই যে টিউব রেল হচ্ছিল। ওটা কমপ্লিট হতে সময় লাগবে। কিন্তু এখন আর তেমন ট্রান্সপোর্ট প্রব্লেম নেই তাই টিউবের মুখ বন্ধ করে পুলিশ অপরাধীদের ওখানে ফেলে দেবে।

আমি অফিসে যাব না। এই মুখ, শরীর নিয়ে যেতে পারব না।

তাহলে পাতাল-নরকে যেতে হবে। ঠিক আছে, ব্যাপারটা আমি দেখব। আপনার জামা পরুন আগে। আমি কি ঘর থেকে বেরিয়ে যাব?

হেনা সেনের মুখ নিচু হলো। স্বপ্নেন্দু মনে হলো হেনা লজ্জা পেয়েছে। সে দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়াতে হেনা সেনকে দেখতে পেল। ছবির বাঁধানো ফ্রেমে হেনা সুন্দর হাসছে। সেই মোহিন শরীর আর মুখের হাসিতে ঘর যেন আলো হয়ে গেছে। এই ছবিটাকে খুলে ফেলা উচিত। স্বপ্নেন্দু মনে মনে বলল।

ঠিক তখন হেনা সেন বিছানা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে, বসুন।

স্বপ্নেন্দু ফিরে তাকাল! হাতওয়ালা ম্যাক্সি পায়ের গোড়ালি ছুঁয়েছে।

মাথায় একটা কালো রুমাল বাঁধা। স্বপ্নেন্দু বলল, সুন্দর।

হেনার মাথা সামান্য নড়ল, আবার বানানো কথা!

বিশ্বাস করুন। স্বপ্নেন্দুর স্বর ভারী হলো।

আপনি কি পাগল?

তাই মনে হচ্ছে? জানলাগুলো খুলে দিই?

আলো আসবে যে।

আসুক। এখন থেকে খোলা হাওয়ায় বের হবেন।

আমি পারব না, লজ্জা লাগছে, কেমন-ভাবতে পারছি না।

উঁহু। বরং দেখবেন পাঁচজনে আপনার দিকে তাকাবে।

আবার? হেনা একটা চেয়ারে বসল। পাশে স্বপ্নেন্দু।

আপনি আমার কাছে কী চান বলুন তো?

আপনার কী মনে হয়?
 
আমি বুঝতে পারছি না। আমার তো দেওয়ার মতো কিছুই নেই। সত্যি বলতে কি এই কণ্ঠস্বর ছাড়া আমি আর মেয়েও নই।

ভুল হল। কণ্ঠে আমাদের স্বর নেই। ওট বক্ষস্বর হবে। আর তাই যদি বলেন তাহলে আমিও তো পুরুষ নেই। একমাত্র স্বর সেটা বোঝা যায় আর হয়তো হাড়ের গঠনে। তাই না?

তাহলে? কী চান আপনি?

আপনাকে।

ওঃ, আমি এই কথাটাই তো বুঝতে পারছি না।

বুঝতে হবে না। কাল থেকে অফিসে যাচ্ছেন?

কাল থেকে? না না।

বেশ যেদিন যাবেন বলবেন। আমি একটা ছুটির দরখাস্তে আপনার সই করিয়ে নিয়ে যাব। বাড়িতে বইপত্র আছে?

আপনি এমনভাবে কথা বলছেন যেন কিছুই হয়নি।

মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন যে এসব নিয়ে একদম মাথা ঘামাবেন না।

কি নিয়ে মাথা ঘামাব?

বলব?

বলুন।

আপনার মায়ের সঙ্গে আলোচনা করুন একটা সমস্যা নিয়ে।

কী সমস্যা?

আপনার বিয়ে হয়ে গেলে উনি কোথায় থাকবেন? আপনার সঙ্গে থাকতে ওঁর আপত্তি আছে কিনা? নাকি এখানেই থাকতে চান!

বিয়ে? আপনি কি সুস্থ?

অবশ্যই।

আমাকে কে বিয়ে করবে? আমি তো আর মেয়েই নই।

এইসময় দরজায় হেনার মা এসে দাঁড়ালেন। স্বপ্নেন্দু তাকে আগে লক্ষ্য করেছিল। সে উঠে দাঁড়ালো, আসুন। আপনার মেয়ে সমানে ঝগড়া করে যাচ্ছে।

মোটেই না। হেনা মৃদু আপত্তি করল।

সে কি? একটু আগে আপনি চেঁচাচ্ছিলেন না! আমাকে চিনতে পর্যন্ত চাইছিলেন না। বসুন মাসীমা।

না বসব না। তুই ভালো আছিস?

জবাব দিল না হেনা। একটু চুপ করে বলল, তুমি একটা কাপড় বাঁধো তো মাথায়, বিশ্রী দেখাচ্ছে।

মহিলা ক্লান্ত গলায় বললেন, আমাকে আর কী দেখাবে! ভাগ্যিস তুমি এলে বাবা। নইলে ওকে নিয়ে যে কি করতাম আমি! কোনো কথা শুনতে চাইছিল না। শরীর নিয়ে ওর চিরকালই–।

আঃ চুপ করো তো। মাকে থামিয়ে দিল হেনা সেন।

স্বপ্নেন্দু বললো, আপনারা এক কাজ করুন। বাইরের পৃথিবীতে কি হচ্ছে তা জানতেই পারছেন না। চলুন আপনারা আমার সঙ্গে। বাইরে হেঁটে আসি। নইলে একা একা ঘরে বসে থাকলে আরও মন খারাপ হবে।

হেনার মা বললেন, না বাবা। আমার বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে না। তোর ইচ্ছে হলে ঘুরে আয়। স্বপ্নেন্দু যখন বলছে। হেনার মা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

হেনা কোনো জবাব দিল না। স্বপ্নেন্দু কিছুক্ষণ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করলো, কি হলো?

আজকে একদম ইচ্ছে করছে না।

ঠিক আছে। কাল তৈরি থাকবেন। এলেই বেরিয়ে পড়তে হবে।

কাল আপনি আসবেন?

হ্যাঁ। বললাম তো লোকলজ্জার কোনো কারণ নেই।

আপনি আমাকে ঠকাচ্ছেন না তো?

ঠকিয়ে আমার কী লাভ?

আমার খুব ভয় করে।

কীসের ভয়।

পুরুষজাতটাকে। ওরা মেয়েদের শুধু শরীরের জন্যেই চায় সেটা মিটে গেলে আর তাকিয়েও দ্যাখে না। তাই–

এখন তো আর সেসব প্রশ্ন ওঠে না।

হেনা সেন যেন চেতনায় ফিরল, তা বটে। সেজন্যে আরও গোলমাল লাগছে। আপনি যা বলছেন সব কি সত্যি?

সব। আর এইসব পুরোনো ভাবনাগুলোকে এখন বাতিল করুন। মনটাকে পরিষ্কার করুন দেখবেন সব কিছু হালকা লাগবে। কলকাতা শহরটার চেহারা একদম পাল্টে গেছে। আপনি কেন স্মৃতি আঁকড়ে থাকবেন?

পাল্টে গেছে মানে?
 

Users who are viewing this thread

Back
Top