আমার মাথায় ঢুকছিল না কিছু। দশ হাজার টাকা দেবার ক্ষমতা নেই। অথচ ওই টাকা দিলে ভদ্রলোকের স্ত্রীকে বাঁচানো মুশকিল হবে। আমি এম. এ. পাশ করা এক আদর্শবান মানুষ অথচ দশ হাজার টাকা সঞ্চয়ে নেই, জোগাড় করে দেবার ক্ষমতা নেই।
বিপ্লব।
ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম। কী বলি? নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিল। যদি মানুষের উপকারে আসতে না পারি তাহলে বেঁচে থাকার মানে কী?
তোমার ওপর খুব ভরসা করে আছি। একটু দ্যাখো ভাই।
দেখছি।
উনি নিজের জায়গায় চলে যেতেই কয়েকটা ভাবনা ভেবে ফেললাম। বাপকে বললে হয়তো টাকা পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু কী কারণে নিচ্ছি জানলে তিনি দেবেন না। যে টাকা ফেরত পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না, সেই টাকা উনি বের করবেন না। আর যদি বা দেন অনেক শর্ত আরোপ করবেন। ভদ্রলোকের স্ত্রীকে বাঁচাবার জন্যে না হয় আমার সব আদর্শ এক্ষেত্রে ভুলে থাকলাম। দ্বিতীয় ব্যক্তির কথা মনে করতে চাইলাম যে ধার দিতে পারে। অবশ্য ধার নিয়ে কবে শোধ করব সেটা আমিই জানি না। সঙ্গে সঙ্গে হেনার মুখ মনে পড়ল। হেনা ইচ্ছে করলে দিতে পারে। কখনও ওর কাছে অমি একটা টাকাও চাইনি। হেনা কি আমাকে শর্ত দেবে? একটু ভাবলাম। তারপর সোজা প্রকাশকের ঘলে চলে গেলাম। ভদ্রলোক কিছু লিখছিলেন, অবাক হয়ে তাকালেন।
ঠিক আছে, কাজটা আমি করব।
গুড। সুমতি হয়েছে বলে ধন্যবাদ।
কিন্তু তার জন্যে আমাকে অ্যাডভান্স দিতে হবে।
অ্যাডভান্স? কাজটা কেমন হল না দেখে কি টাকা দেওয়া যায়?
সেটা আপনার সমস্যা। কিন্তু আমার অ্যাডভান্স চাই।
হুম। কত?
দশ হাজার।
পাগল নাকি। চল্লিশ টাকা দামের বই একটা এডিশন হলে লেখকই অত টাকা পাবে না। কী বলছ ভেবে বলো। তোমাকে একটা কমিশন দেব ঠিকই সেটা কি দাঁড়াবে তা বিক্রির ওপর নির্ভর করছে। প্রকাশক সরাসরি বলে দিলেন।
কিন্তু ওঁর বই তো বছরে অন্তত পাঁচটা এডিশন হয়।
ভদ্রলোক আমার দিকে তাকালেন, হঠাৎ টাকার দরকার পড়ল কেন।
কারণটা বলতে গিয়ে সামলে নিলাম। ওটা বললে নিজের দর বাড়ানো হবে। আমি যে কত মহৎ, মানুষের উপকার করি, এটা বলতে ভাল লাগবে না। তাছাড়া ওই ম্যানেজারবাবুকেও জড়ানো হবে। আমি যা করি না, সেই মিথ্যে কথাই বললাম, আমার দরকার আছে।
ঠিক আছে। দিচ্ছি। কিন্তু দশ দিনের মধ্যে পুরো পাণ্ডুলিপি চাই। প্রকাশক চেক বই লিখতে লাগলেন। বললাম, অ্যাকাউন্ট পেয়ি করবেন না।
মামার বাড়ি নাকি? অডিটার কি আমার মামা?
টাকাটা আজই দরকার।
উঃ। ভদ্রলোক চেকটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। না, আমার কথা রেখেছেন উনি। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সোজা ম্যানেজারবাবুর সামনে গিয়ে চেকটা রাখলাম, এটা ক্যাশ করে নেবেন। আপনাকে তো ব্যাঙ্কে যেতেই হয়।
চেক দেখে ওঁর চোখ বড় হল, সে কী? স্যারের চেক? উনি–উনি!
ওঁকে আপনার কথা আমি কিছুই বলিনি। টাকা যে আপনার দরকার তা ওঁকে কেন বলতে যাব? এখন চেষ্টা করুন, যাতে আপনার স্ত্রী সুস্থ হয়ে ওঠেন। আমি সরে এলাম। টেবিলে বসেও দেখলাম ভদ্রলোক এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি বের করলাম। এখন আমি কাজটা করতে বাধ্য। যে কাজের জন্যে টাকা নিয়েছি সেটা নেবার আগে মনে হয়েছিল খুব সহজসাধ্য। এখন কি রকম ভয় করতে লাগল। যদি খারাপ হয়। যদি আমার কলম ছোঁয়ানোর কারণে এই বই তেমন বিক্রি না হয়?
প্রথম পাতাটা আবার পড়লাম। এবার মনে হল ভুলটুল যাই থাকুক না কেন প্রত্যেক লেখকের যেমন নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে স্বজনবাবুরও কিছু আছে। মাঝে মাঝেই আবেগের টোকা দিতে তিনি খুবই পটু। প্রথমবার লিখতে গিয়ে বুঝতে পারলাম কোনো লেখা পড়ে সমালোচনা করা অথবা সহজেই লেখা যায় বলে মনে হওয়া এক জিনিস আর সেটা কাগজে কলমে লেখা আর এক জিনিস। দেখে দেখে লিখছি। শুধু মাঝে মাঝে বাক্য পাল্টাচ্ছি কিন্তু তাতেই প্রচুর সময় বেরিয়ে যাচ্ছে। এইভাবে চললে দশ দিন কেন দশ মাসেও কাজটা করা যাবে না।
বিকেলবেলায় বের হলাম। সারাদিন বুঝে গিয়েছি একমাত্র বানান ঠিক করা আর ছোটখাটো শব্দ জোড়া ছাড়া আমার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। প্রত্যেকটা জিনিসের সাফল্যের পেছনে অনুশীলন করা প্রয়োজন, যে কখনও সাইকেল চালায়নি তাকে সাইকেল দিয়ে চালাতে বললে সে কিছুতেই সক্ষম হবে না। লেখার ক্ষেত্রে আরও কিছু বাড়তি ক্ষমতা দরকার। স্বজন মুখার্জি যত খারাপই লিখুন না কেন সেটার পেছনে তার দীর্ঘদিনের অধ্যবসায় রয়েছে, যা অস্বীকার করার উপায় নেই।
অতএব হার স্বীকার করতেই হবে। আর তা করলে দশ হাজার টাকা ফেরত দিতে হবে। কিন্তু আমি দশ হাজার টাকা কোথায় পাব? বাবার কাছে যাওয়ার বদলে হেনার ফ্ল্যাটের সামনে এসে যখন দাঁড়ালাম তখন সাতটা বেজে গিয়েছে। বেল টিপলাম। দরজা খুলল না। হেনা কি তাহলে এখন ফেরেনি? দ্বিতীয়বার একটু ধরে রাখলাম বোতামটা।
ঝট করে দরজা খুলে গেল। মাথায় তোয়ালে মোড়া, পরনে হাউসকোট, মুখে পৃথিবীর সমস্ত বিরক্তি নিয়ে হেনা দাঁড়িয়ে আছে।
কী ব্যাপার? আবার?
প্রশ্ন দুটো এমনভাবে করল সে যে আমার মনে হল ফিরে যাওয়া উচিত।
প্রয়োজন আছে।
কী প্রয়োজন? কেন তুমি এভাবে আমাকে বিরক্ত করতে আসো?
আমি আর বিরক্ত করব না।
কিসে মানুষ বিরক্ত হয় সে জ্ঞান তোমার আছে? সরে দাঁড়াল সে, যা বলবার তাড়াতাড়ি বলো। আমাকে আবার বেরুতে হবে।
ঘরে ঢুকলাম। দরজা বন্ধ করে সে তোয়ালে খুলে চুল মুছতে লাগল। বুঝতে পারলাম এতক্ষণ বাথরুমে ছিল। ওর কানের পাশের চুলে এখনও জল লেগে আছে। জলের ফোঁটা মুক্তোর মতো ঝুলছে। আলো পড়ায় সেটাকে আরও রহস্যময় মনে হচ্ছিল। হঠাৎ আমি তীব্র আকর্ষণ বোধ করতে লাগলাম। ওই জলের ফোঁটাকে স্পর্শ করতে খুব ইচ্ছে হলো। হেনাকে এখন কী দারুণ টাটকা লাগছে, এই রাগ বা বিরক্তি ওই শরীরের সঙ্গে মানাচ্ছে না।
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো হেনার দিকে এগোলাম।
হেনা খুব অবাক হয়ে শুধু বলতে পারল, আরে!
কিন্তু আমি ততক্ষণে সেই মুক্তোর ফোঁটা ছুঁয়ে ফেলেছি। ছোঁয়ামাত্র আমার আঙুল ভিজে গেল। মুক্তো নেই? হেনা চট করে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে চাইল আমি কী করছি। ওর গালে আঙুল লাগতেই শরীরে বিদ্যুৎ বয়ে গেল। আমি দুহাতে ওকে জড়িয়ে ধরে কাছে টানলাম। হেনার শরীর প্রতিবাদ করতেই ওর ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরলাম।
চুম্বনের স্বাদ কীরকম হয় আমার জানা ছিল না। ওই মুহূর্তে স্বাদের কথা চিন্তাও করতে পারলাম না। আসলে কোনো চিন্তা করার মত মাথার অবস্থা আমার ছিল না। হেনার ঠোঁটে ঠোঁট চেপে আমি পৃথিবীটাই ভুলে গেলাম। আমি তখন অসাড়। আর সেই মুহূর্তে সাড়া দিল হেনা। ওর জিভের ডগায় এক নতুন পৃথিবীর দরজা খুলে গেল। হেনার হাতের বাঁধন আরও শক্ত হলো। শেষপর্যন্ত ও মুখ নামিয়ে আমার বুকে মাথা রাখল। আমরা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ।
হঠাৎ এক পা সরে দাঁড়িয়ে এক রাশ বিস্ময় মুখে নিয়ে হেনা জিজ্ঞাসা করল, একী হল? আমি কি স্বপ্ন দেখছি? তুমি বিপ্লব তো?
আমি নিঃশ্বাস ফেললাম। হাসবার চেষ্টা করলাম।
তোমার মাথা ঠিক আছে তো? ঘাড় কাত করল হেনা।
তোমাকে এখন দারুণ দেখাচ্ছে। কোনো রকমে বলতে পারলাম আমি।
কিন্তু এ তুমি কী করলে?
আমি–আমি। কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
এতদিন আসছ, মনে হত ভাল হয়তো বাসো, কিন্তু কখনও সীমা ছাড়াওনি। মনে মনে তোমাকে আমি আর পাঁচটা মানুষের থেকে আলাদা বলে ভাবতাম। কিন্ত একী করলে?
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়েছিলাম। তখনও আমার নিঃশ্বাস স্বাভাবিক নয়, সমস্ত মনে এক লক্ষ অশ্বারোহীর দৌড়ে যাওয়ার চাপ।
তুমি কি জানো আজ পর্যন্ত কেউ আমাকে চুমু খায়নি?
জানি।
জানো? কী করে?
ব্যাখ্যা করতে পারব না।
আচ্ছা! নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা ছিল যে আমার স্বামী হবে শুধু তাকেই এই অধিকার দেব। কিন্তু তুমি শেষ পর্যন্ত জোর করে প্রতিজ্ঞা ভাঙলে?
প্রতিজ্ঞা ভাঙতে হবে কেন?
কেন? কী ভেবেছ তুমি। আজ সাত-আট বছর ধরে তুমি যাওয়া আসা করেছ। আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছ, কিন্তু কখনও স্পর্শ করোনি। ক্রমশ আমার মনে হয়েছিল তুমি সাধারণ সহজ নও। কিন্তু আমি তো মেয়ে। আমি সব সময় চাইব যে আমার প্রেমিক হবে আমার স্বামী হবে সে সহজ থাকবে। তার ওপর ওই আদর্শের বাসি ভূত যা আজকের যুগে অচল, তা তোমার ঘাড়ে এমন ভাবে জেঁকে বসেছে যে আমার পক্ষে মানিয়ে নেওয়া অসম্ভব। আমার অপছন্দ তুমি জানো। তা সত্ত্বেও তুমি আজ জোর করে এই কাণ্ড করলে। তারপরও বলছ, প্রতিজ্ঞা ভাঙতে হবে কেন?
আমাকে বিয়ে করতে তোমার আপত্তি আছে?
অবশ্যই। এই তোমাকে বিয়ে আমি কখনই করতে পারি না। আত্মহত্যা করার শখ আমার নেই।
আত্মহত্যা?
নয়তো কী? স্বামীর দায়িত্ব তুমি নিতে পারবে?
চেষ্টা করব!
কীভাবে? কটা টাকা রোজগার কর তুমি? তোমার ওই আদর্শ বাধ্য করবে তোমাকে আধপেটা খেয়ে থাকতে। ঝুপড়িতে থাকা মানুষের শান্তিটুকুও আমি পাব না। অথচ তুমি শিক্ষিত, রবীন্দ্রনাথ থেকে শেক্সপীয়র পড়া মানুষ। কিন্তু কতটুকু তোমার দাম?
কিন্তু আমি যদি বাবার প্রস্তাব অ্যাকসেপ্ট করি?
তার মানে?
ওই এন. আর. আই-দের সঙ্গে ব্যবসায় নামি?
তুমি কি আমার সঙ্গে রসিকতা করছ?
একদম না। আমি সিরিয়াস।
তোমার বাবার সুপারিশ নিতে লজ্জা করবে না?
করবে। কিন্তু আজ আমার অন্য উপলব্ধি হয়েছে।
কী রকম?
একজন পরিচিত মানুষ তার স্ত্রীকে বাঁচাবার জন্যে আমার কাছে দশ হাজার টাকা চেয়েছিলেন। আমি প্রথমে ভেবেই পাইনি কি করে দেব? সামান্য দশ হাজার টাকা, শেষে যে প্রকাশনা সংস্থায় প্রুফ দেখি তার মালিকের কাছে টাকাটা চাইলাম। তিনি আগে আমাকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন একটি পাণ্ডুলিপিকে রিরাইট করে দিলে কিছু কমিশন দেবেন। বইটার কোথাও আমার নাম ছাপা হবে না। আমি প্রথমে রাজি হইনি। পুরো ব্যাপারটা শুধু বেআইনি নয়, অনৈতিক। কিন্তু দশ হাজার টাকা আগাম নিয়ে শেষপর্যন্ত সম্মতি দিতে বাধ্য হলাম। অথচ কাজটা করতে গিয়ে দেখলাম আমি পারছি না। আদর্শের দোহাই দিয়ে সরে দাঁড়ানো এক কথা আর কাজে নেমে নিজের অক্ষমতা আবিষ্কার করা অন্য কথা। শেষেরটা বেশি যন্ত্রণাদায়ক। আর কাজটা না করতে পারলে দশ হাজার টাকা শোধ করব কী করে তাও বুঝতে পারছি না। আমি আর কিছুর সঙ্গেই তাল রাখতে পারছি না হেনা।
অদ্ভুত তো। একজন পরিচিত লোক দশ হাজার চাইল আর তুমি ধার করে সেটা দিয়ে দিলে? ভদ্রলোক ফেরত দেবেন কবে?
আমি জানি না। জিজ্ঞাসা করিনি। কারণে উনি উত্তরটা দিতে পারতেন না।
চমৎকার। কিন্তু লিখতে গিয়ে যেমন আবিষ্কার করলে লেখাটা তোমার পক্ষে সহজ ব্যাপার নয় তেমনি ঘটনাটা তো ব্যবসার ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে!
তার মানে?
তুমি জীবনে কখনও ব্যবসা করোনি। এন. আর. আই-রা যে ব্যবসা করতে চাইছেন তার সম্পর্কে কোনো ধারণাই তোমার নেই। তুমি কি করে ভাবছ দুম করে সেই ব্যবসায় নেমে রাতারাতি সফল হবে? কোনো ট্রেনিং বা অভিজ্ঞতা ছাড়াই সাফল্য আসবে? একি ছেলের হাতের মোয়া? আমি কী বলছি বুঝতে পারছ?
হেনা কাছে চলে এল।
পারছি। কিন্তু তা হলে কোনোদিনই কিছু করা সম্ভব নয়। হেনা আমি তোমার সাহায্য চাই।
কীরকম?
আমাকে মানসিক শক্তি দাও।
ওটা কেউ কাউকে দিতে পারে না। নিজেকে অর্জন করতে হয়! হেনা ঘুরে দেওয়াল-ঘড়ি দেখল, ইস। কী দেরি হয়ে গেল। আমি যে–!
হেনার মুখের চেহারা বদলে গেল। এরকম লাজুক মুখ কখনও দেখিনি আমি। আমি ওর হাত স্পর্শ করলাম। হেনা মুখ ফেরাল, বসো। আমি কিছু খাবার তৈরি করি। নিশ্চয়ই অনেকক্ষণ খাওনি তুমি। সে হাত ছাড়িয়ে ছুটে গেল ভেতরে।
কীরকম সহজ হয় গেল পৃথিবীটা। আমার চারপাশের ঘনিষ্ঠ মানুষজন চাইছে তাদের কাছে যেটা স্বাভাবিক সেই ব্যাপারটা আমি করি। আমি যদি কেরানিগিরি করি তাহলে ঘুম থেকে উঠে কেরাসিনের লাইনে না দাঁড়িয়ে দুনম্বরি করে কেরোসিন নিয়ে আসি বাড়তি ক্যানে। বাজারে গিয়ে চোটপাট করে দাম কমাই বাড়ি ফিরে এসে ছেলেমেয়েকে পড়াতে বসে বিদ্যাসাগর নেতাজির আদর্শের কথা বলি। ট্রামে, বাসে এর ওর পা মাড়িয়ে সম্ভব হলে কন্ডাক্টারকে ফাঁকি দিয়ে অফিসে যাই এগারোটা নাগাদ। লেট কেন হলো এই প্রশ্নের জবাবে চিৎকার করে বড়বাবুর পিলে চমকে দিই, আগে ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা ঠিক করতে বলুন সরকারকে তারপর ঠিক সময়ে অ্যাটেনডেন্স চাইবেন। তারপর খবরের কাগজ বা পার্টির মুখপত্র খুলে বসি টেবিলে। সেকশনের অন্যদের কাজকর্ম সম্পর্কে খোঁজ নিই। টিফিনের সময় দলের সঙ্গে ঘরে-ঘরে ইউনিয়নের ইস্যুগুলো প্রচার করি। বিকেলে মিছিলে যাওয়ার আগে সেকশন থেকে দিনের প্রাপ্য উপরির অংশটুকু নিতে যেন না ভুলি। কালো হাত গুঁড়িয়ে দাও বলতে বলতে একসময় মিছিল থেকে সটকে পড়ে বাড়ি ফিরে বউ-এর শাড়ির ভাঁজে উপরির টাকা গুঁজে রাখি। তারপর ছেলেমেয়েদের গল্প শোনাই কীভাবে হাসতে হাসতে ক্ষুদিরাম দেশের জন্যে ফাঁসিতে ঝুলেছিলেন। কিন্তু সেইসঙ্গে এও বলতে হবে আগে পড়াশুনা শেষ করে ভাল চাকরি যাতে পাও, সেই চেষ্টা করো।
আর যদি কেরানি না হয়ে ওপরতলার চাকুরে অথবা বড় ব্যবসায়ী হই তাহলে জীবন অন্য খাতে বইয়ে দেবার নামই স্বাভাবিক হওয়া। সকালে উঠে চা খেয়ে টয়লেটে ঢোকা। স্নান শেষ করে ব্রেকফার্স্ট খেয়ে স্ত্রীকে আদর করে গাড়িতে উঠে বসতে হবে, যেটা আমাকে অফিসে পৌঁছে দেবে নটার মধ্যে। সেখানে সারাদিন নানার সমস্যার সমাধান করে এম. ডি-কে তুষ্ট করা আমার কর্তব্য হবে। এর মধ্যে কনফারেন্স আর মিটিং, লাঞ্চের সময় ধান্দাবাজি এসব তো আছেই। অফিসের পর বাড়ি ফিরেই বউকে নিয়ে পার্টিতে যেতে হবে নিজের বউকে অন্য লোকের সঙ্গে গল্প করার সুযোগ দিয়ে অন্যের বউ-এর সঙ্গে ফস্টিনস্টি করতে করতে মদ গিলতে হবে পাঁচ-সাত পেগ। তারপর বাড়ি ফিরে বিছানায় লুটিয়ে পড়ার নাম জীবনযাপন, সহজ এবং স্বাভাবিক।
হ্যাঁ। আমাকেও স্রোতে ভাসতে হবে। স্রোতের উল্টোদিকে সাঁতার কাটলে বেশিক্ষণ ভেসে থাকা যে যায় না, তা এতদিনে টের পেয়েছি। আমি যেমন হেনাকে হারাতে চাই না, তেমনি নিজের কাছেও হারতে চাই না। রাত দশটা নাগাদ হেনার ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এসে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে এইসব কথা ভাবছিলাম। একটু আগে হেনা বাপকে ফোন করেছিল। বাপ না বলে এখন আমার বাবা বলা উচিত। সব শুনে তিনি খুব খুশি হয়েছে। হেনাকে নাকি বাড়িতে যেতে বলেছেন। বলেছেন, তোমার জন্যে মা আমি বুড়ো বয়সে শান্তি পেলাম। হেনা আপ্লুত।
ঠিক সেইসময় মারুতি ভ্যানটা পাশে এসে দাঁড়াল। গাড়ির সামনের দরজা খুলে লোকটি নামল, এই যে স্যার! চেনা যাচ্ছে?
চিনলাম। মাথা নাড়লাম, হ্যাঁ। সেইসঙ্গে ভয় ভয় করতে লাগল।
কাল দুনম্বরি করলেন কেন? আমাদের ফাঁসাতে চেয়েছিলেন?
দুর। আমি হেসে উঠলাম, ওটা ভড়কি! মহিম গুপ্ত কিছু বলেনি? আমি তো তোমাদের বিরুদ্ধে পুলিশকে একটা কথাও বলিনি। গাড়ির নাম্বার দিইনি। দিয়েছি?
তা দেননি। কিন্তু থানায় ঢুকেছিলেন কেন?
তার আগে বলো এখানে আমি আছি সেটা কী করে জানলে?
আমার লোক আপনার পেছনে ছিল। শুনুন মহিম গুপ্ত বা আপনার বাবা আছেন বলে আপনাকে কিছু করিনি। কিন্তু খবর পেলাম বাইপাসের পাশে বিদেশিদের সঙ্গে কারখানা করবেন। আমার দশটা লোককে চাকরি দিতে হবে।
চাকরি?
হ্যাঁ।
এখনও কোনো কথাই ফাইন্যাল হয়নি।
হবে। হয়ে যাবে। মহিমা মিথ্যে খবর দেয় না।
তার চেয়ে এক কাজ করো। আমি হাসলাম। ছেলেটি তাকাল।
গাড়ির ডিকিতে কেউ আছে না কি হাত-পা বাঁধা অবস্থায়? ময়দানে নিয়ে চলো, কাল যা পারিনি, আজ সেটা করে দিচ্ছি।
রসিকতা করছেন?
না। চাকরি দেওয়ার চেয়ে কাউকে গুলি করে মারা অনেক সহজ।
আচ্ছা দুনম্বরি লোক তো আপনি। সে গাড়িতে ফিরে যেতেই ওটা হুস করে বেরিয়ে গেল। এত সহজে ছাড়া পাব ভাবতে পারিনি। আজ সকালেও এই কথাগুলো বলতে পারতাম না। বেঁচে থাকার জন্যে যে বর্মের দরকার হয় তা আমার হাতে এসে গেছে।
একটা ট্যাক্সি ডাকলাম। পেছনের সিটে বসে গন্তব্য বলে দিলাম। অনেক অনেক বছর পরে নিজের পয়সায় ট্যাক্সিতে চড়লাম। আধঘণ্টার মধ্যে বাড়িতে পৌঁছে জিজ্ঞাসা করলাম, কত হয়েছে?
তিরিশ টাকা দিন স্যার, ঊনত্রিশ হয়েছে।
আপনার মিটার খারাপ।
না স্যার।
আমি বলছি খারাপ। চলুন, থানায় চলুন।
থানায় নিয়ে যাবেন কেন স্যার। আমি এই গাড়ি তো চালাই না, আজ সন্ধেবেলায় বের করেছি। মিটার খারাপ থাকলে মাপ করে দেবেন।
কিন্তু সন্ধে থেকেই আপনি লোক ঠকাচ্ছেন। তাছাড়া একথাটাও মিথ্যে হতে পারে। পুলিশ ঠিক বের করবে কবে থেকে ট্যাক্সিটা চালাচ্ছেন।
আপনার কাছে হাতজোড় করছি স্যার, অন্যায় হয়ে গেছে। আর হবে না।
তাহলে কত দিতে হবে?
কিছু না। কিছু দিতে হবে না স্যার। আমি নেমে দাঁড়াতেই দ্রুত বেরিয়ে গেল ট্যাক্সিটা। কয়েক মুহূর্তে হতভম্ব ছিলাম। তারপরই মনে হল, বাঃ। কী সুন্দর ব্যবস্থা। আন্দাজে ঢিল ছুঁড়তেই ভাড়া দিতে হল না। এইটে আগে কখনও মাথায় আসতো না।
দরজার সামনে দুজন দাঁড়িয়ে আমাকে দেখে ফিসফিস করছিল। একজন এগিয়ে এল, দাদা, আপনার বাবার সঙ্গে দরকার ছিল। জরুরি।
হবে না। বাবা এখন আহ্নিক করছেন। কাল সকালে আসুন।
কাল। তখন তো খুব ভিড় হয়। পার্টির লোকজন দেখা করতে দেয় না।
আমার সঙ্গে দেখা করবেন। ব্যবস্থা করে দেব।
ঠিক আছে। আপনি যা বলবেন তাই হবে।
ও কে কাল দেখা হবে।
অনেক দিন পরে, বোধহয় জ্ঞান হবার পর এই প্রথম মধ্যরাত্রে বাড়ির সদর দরজার কলিং বেলের বোতাম টিপলাম আমি। এখন যে কোনো চরিত্রে চমৎকার অভিনয় করতে পারব, বাজি রেখে দেখুন।