What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected নিকট কথা - সমরেশ মজুমদার 📞 (3 Viewers)

অফিস ঘরের ভেতর একটা কাচের ঘর। প্রকাশক মশাই সেখানে বসেন। রোগা ফর্সা প্রৌঢ় ভদ্রলোকটি শিক্ষিত এবং সুদর্শন। মাস কয়েক আগে ওঁর ঘরে ঢুকে বলেছিলাম, ভাল বাংলা বানান জানি, কাজ দেবেন? তিনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, লেখার নেশা আছে নাকি?

না।

তাহলে বসো। কী নাম?

কাজটা হয়ে গিয়েছিল। দরজায় টোকা দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। উনি কিছু হিসেব করেছিলেন। বিরক্ত হয়ে তাকালেন। বললাম, কিছু যদি মনে করেন তাহলে একটা কথা বলব।

বল।

আপনি বাংলা সাহিত্যের ক্ষতি করছেন।

আমি? চমকে উঠলেন ভদ্রলোক, কী রকম?

স্বজন মুখোপাধ্যায়ের যে উপন্যাসটা ছাপা হচ্ছে সেটা আপনি পড়েছেন?

না।

সেকি? আপনি না পড়ে বই ছাপছেন?

উনি সোজা হয়ে বসলেন। কলম বন্ধ করলেন, পড়া উচিত বলে মনে করিনি। স্বজনবাবুর বই-এর স্টেডি সেল আছে।

ও। তাহলে কিছু বলার নেই। আপনার তো আরও অনেক প্রুফ রিডার আছে তাদের কাউকে ওর প্রুফ দিলে আমার ভাল লাগবে।

কেন?

উনি লিখতে জানেন না। বাক্য অসংলগ্ন, অজস্র বানান ভুল। ভেতরে তথ্যের অসংলগ্নতা মাথা খারাপ করে দিচ্ছে।

নিয়ে এসো।

বেরিয়ে এসে প্রুফ নিয়ে গেলাম। তিনি দেখলেন। তারপর বললেন, মানুষ করে দাও।

মানে?

রিরাইট করে দাও।

অসম্ভব।

বাজে কথা বোলো না। এ বই ছাপা হলে যখন বাংলা সাহিত্যের ক্ষতি হবে তখন তোমার উচিত সেই ক্ষতিটা যাতে না হয় তা দেখা।

আপনি অদ্ভুত কথা বলছেন। রিরাইট হলে সমস্ত লেখাটাই নতুন করে লিখতে হবে। অথচ সেটা ওঁর নামে ছাপা হবে, টাকা উনিই পাবেন।

ও ব্যাপারে কথা বলছি। টেলিফোন তুলে ডায়াল করলেন প্রকাশক, হ্যালো, স্বজনবাবু ভাল আছেন? হ্যাঁ, আগেরটা আবার এডিশন হয়েছে। কিন্তু স্বজনবাবু আমি যে মুশকিলে পড়েছি। কী করি বলুন তো? হ্যাঁ। একজন সাংবাদিক এসেছেন আপনার পাণ্ডুলিপি দেখতে। উনি ফটোকপি ছাপবেন কাগজে, মানে আপনার ওপর কভারেজ করবেন। হ্যাঁ, ভাল কথা, কিন্তু মুশকিলটা এখানেই। কেন? আপনার হয়তো সময় কম ছিল তাই প্রতি পাতায় অন্তত কুড়িটা বানান ভুল, সেন্টেন্সে গোলমাল। এগুলোর ছবি ছাপা হলে কী হবে ভেবেছেন? আমি বলি কি আপনি যদি নতুন করে! হ্যাঁ, সময় কম, তা আমি জানি। আচ্ছা, এককাজ করলে হয়। আমার পরিচিত একটি ছেলেকে দিয়ে কাজটা করিয়ে নিই? হ্যাঁ, খুব ভাল বানান জানে। না না কেউ জানবে na। তবে বিনা পয়সায় তো করবে না। ধরুন আপনার প্রাপ্য থেকে তিন-চার পার্সেন্ট ওকে দিয়ে দিলে সম্মানটাও থাকে আপনার নামও বেড়ে যাবে। না দু-চারশো দিলে ও রাজি হবে না, তাছাড়া খবরটা তো চেপে রাখার ব্যাপার আছে, এটা বুঝছেন না কেন? ঠিক আছে তো? ও কে!

রিসিভার নামিয়ে রেখে বললেন, যাও।

উনি রাজি হলেন?

হয়েছেন। তুমি প্রুফেই কারকেশন করতে করতে যাও।

আমি অন্যের হয়ে লিখব?

আপত্তি কেন? তুমি সন্তোষকুমার ঘোষের নাম শুনেছ?

হ্যাঁ। শ্রীচরণেষু মাকে-র লেখক।

উনি একজন বিখ্যাত সাংবাদিক নামে রবীন্দ্রনাথের জীবনী লিখেছিলেন। সেই বইতে কোথাও ওঁর নাম ছাপা ছিল না। তুমি ভেবে নাও, বাংলা সাহিত্যকে বাঁচিয়ে দিচ্ছ। আরে, আমি না ছাপি আর একজন কৃতার্থ হয়ে ওই বই ছাপবে। বুঝেছ?

টেবিলে ফিরে এসে নিজের সঙ্গে লড়াই করতে আরম্ভ করলাম। কী করব বুঝতে পারছি না। একটা মন বলছিল, এটা অন্যায়, খুব অন্যায়। আর এক মন বলছিল, এটা শ্রাদ্ধের মতো কাজ। করা উচিত। এই বই ছাপা হলে অন্তত ষাট টাকা দাম হবে। যারা খেয়ে না খেয়ে বই কেনে তাদের উপকার করা হবে।
 
প্রথমে পুরো উপন্যাসটি পড়ে ফেললাম। সেই ত্রিকোণ প্রেমের গল্প। কোন সময়ের গল্প, নায়ক নায়িকা কী করে এসব নিয়ে লেখক মাথা ঘামাননি। কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম। এই লেখক গপ্পো বলতে জানেন। যত খারাপ লাগুক আমাকে শেষ পর্যন্ত পড়িয়ে তো ছাড়ল। প্রচণ্ড গতি। বাবার আলমারিতে একটা উটকো বই পেয়েছিলাম। ওই রাজনৈতিক মতবাদ বোঝাই বইগুলোর পেছনে সেটা পড়েছিল। মোহন সিরিজের বই। মোহন সিরিজের নাম আমি কলেজে পড়তে শুনেছি। বাংলা ডিটেকটিভ উপন্যাসের ইতিহাস বলতে হলে ওই মোহন সিরিজের কথা সমালোচকরা একটু আধটু বলে থাকেন। তা আগ্রহী হয়ে বইটি পড়লাম। ওই সিরিজ নাকি একসময় খুব জনপ্রিয় ছিল। ওই লেখকের লেখায় গতি ছিল। যখনই কোনো সমস্যার সামনে নায়ক দিশেহারা তখন লেখক সমাধান করলে এই বলে, কোথা হইতে কি করিয়া কি হইয়া গেল মোহন জানে না কিন্তু বাঙালি পাঠককুল পড়ার সময় এই গোঁজামিল মেনে নিয়েছিলেন। ঠিক একইভাবে স্বজনবাবু বাজারে করে খাচ্ছেন।

একবার মনে হল অত ঝামেলার দরকার কী? আমার কাজ প্রুফ দেখা। বানান ঠিক করে দেওয়া প্যারাগ্রাফ সাজিয়ে দেওয়া আর কোনো বাক্যে গোলমাল থাকলে সেটা ঠিক করা। তাই করি। আমি শুরু করলাম। দুপুরে আলুরদম দিয়ে রুটি সবে শেষ করেছি এমন সময় স্বজনবাবু হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন। কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা প্রকাশকের কাচের ঘরে চলে গেলেন তিনি। ভদ্রলোকের পরনে শু, ধুতি আর সিল্কের পাঞ্জাবি। এই রকম পোশাকে লেখক আজকাল বড় একটা দেখা যায় না।

আমি আবার কাজ শুরু করতেই উনি বেরিয়ে এসে আমাদের ম্যানেজারকে কিছু জিজ্ঞাসা করলেন। ম্যানেজার আমাকে দেখিয়ে দিতে একটা চেয়ার টেনে আমার পাশে বসলেন, কী নাম ভাই?

নিজের নাম বলতে খারাপ লাগল। বললাম, বলুন।

ইয়ে, হয়েছে কি, এই লেখাটা খুব তাড়াহুড়োর মধ্যে লিখেছি। যদি ভুলভাল কিছু হয়ে থাকে তাহলে ঠিকঠাক করে দেবেন ভাই, স্বজনবাবু বললেন।

আপনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা ভুল কোট করেছেন।

অ! ওটা অবশ্য অনেকেই করে। মানে, দেখবেন, কিছু লোক আবৃত্তি করার সময় রবীন্দ্রনাথের কবিতা বলল কিন্তু সব শব্দ ঠিক বলল না। আমি ওই বাস্তবচিত্রটা ধরতে চেয়েছি। ঠিকঠাক করে দিন। কিন্তু ভাই কথাটা পাঁচ কান করবেন না।

লোকটার গলার স্বর এমন যে আমার মজা করতে ইচ্ছে করল। প্রকাশকের ঘর দেখিয়ে বললাম, কিন্তু উনি আমাকে বলেছেন পুরো উপন্যাসটাকে রিরাইট করতে।

বলেছেন?

হ্যাঁ।

বেশ করুন। গল্পটা ঠিক রাখবেন। আর স্পিড। স্পিডটা নষ্ট করবেন না। আমার অ্যাসেট হল ওটা। ওটা যেন নষ্ট না নয়।

দেখছি।

আপনি গপ্পো লেখেন?

না।

বাঁচা গেল। যারা গপ্পো লেখে তারা তাদের মতো লিখবে। তাদের নিজেদের লেখা যখন পাবলিক পড়ে না তখন আমার হয়ে লিখলে তার হালও ওই একই রকম হবে। তা আপনি যখন লেখালেখি করেন না তখন ভরসা পাওয়া গেল। আজ সন্ধেবেলায় কী করছেন?

কেন?

আসুন না। একটু খাওয়াদাওয়া করা যাবে।

কোথায় যেতে হবে?

একটা কাগজ টেনে ফসফস করে ঠিকানা লিখলেন স্বজনবাবু। সেটা আমার সামনে এগিয়ে দিয়ে বললেন, চলে আসুন। ওখানে গল্প পাব। আপনি আমাকে সাহায্য করলে আর দেখতে হবে না। একটা চোখ কুঁচকে উঠে গেলেন ভদ্রলোক।

আমার মাথায় কিছু ঢুকছিল না। সাহিত্য কি সহকারীকে সঙ্গে নিয়ে করা যায়? বঙ্কিম বা রবীন্দ্রনাথ অথবা শরৎচন্দ্র মাথায় থাকুন, বিভূতিভূষণ তারাশংকর এমন প্রস্তাব শুনলে কি আত্মহত্যা করতেন না? নাকি যুগ পাল্টেছে, অ্যাপ্রোচও। এখন কম্পুটারের যুগ। পাঠক চান তাই লেখক উগরে যদি না দেন তাহলে বাজার শেষ হয়ে যাবে। এমন কত লেখক তো লেখেন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা দূরে থাক, দেশ পত্রিকার প্রতি সংখ্যায় কত নতুন লেখকের গল্প, সদ্য পরিচিত লেখকের ধারাবাহিক উপন্যাস। অথচ সেগুলো সম্পর্কে পাঠক মোটেই উৎসাহী নয়। অথচ স্বজনবাবুদের উপন্যাস বাজারে বেরুলেই এডিসন হয়ে যায়। বইমেলায় লোকে অটোগ্রাফ নেবে বলে কেনে। এইসব লোক তো বুদ্ধু নয়। স্বজনবাবুর উপন্যাস না কিনে ছয়শো গ্রাম মাংস কিনলে রবিবারের দুপুরে ভাতের স্বাদ আরও চমৎকার হত। কিন্তু তা তো করছে না। আমার কাছে ধন্দ এখানেই।
 
কয়েকদিন আগে একটি ছেলে ভুল করে অফিসে ঢুকে পড়েছিল। আমার সামনে এসে জিজ্ঞাসা করেছিল, আচ্ছা স্বজন মুখোপাধ্যায়ের দুপুর ঠাকুরপো বইটা আছে? আমি কিনতে চাই। অবাক হয়ে তাকালাম। বড়জোর কুড়ি বছর বয়স। দুপুর ঠাকুরপো, যে কোনো উপন্যাসের নাম হয় তা আমি ভাবতে পারি না।

ম্যানেজার শুনছিলেন, বললেন, আমাদের সেলস কাউন্টারে যান ভাই।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কত দাম?

আশি টাকা। ম্যানেজার বলার আগেই ছেলেটি জানাল।

আপনি বুঝি খুব উপন্যাস পড়েন?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

শ্রীমতী কাফে পড়েছেন?

স্বজন মুখার্জির লেখা?

না। সমরেশ বসুর উপন্যাস।

নাঃ। ওসব পুরনো লেখা পড়া হয়নি। আচ্ছা চলি।

কথাটা মনে পড়তেই আমার খুব রাগ হল। যে লোকটা সমরেশ বসুর পায়ের যোগ্য নয় তার বই আমাকে রিরাইট করতে হবে কেন? শুধু টাকার জন্যে? কোনো দরকার নেই। ঠিক করলাম, প্রুফ দেখে দায় শেষ করব। রিরাইট করা আমার দ্বারা হবে না। প্রকাশক যাই মনে করুন, আমি নাচার।

পাঁচটা নাগাদ আমি বের হলাম। অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছি এখন কোথায় যাওয়া যায়? কফি হাউসে অবশ্য যাওয়া যেতে পারে। কিন্তু কী লাভ? সেই টেবিলে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা পরনিন্দা পরচর্চা করা কাঁহাতক ভাল লগে। কফি হাউসে এক আজব জায়গা। যদি কেউ বলে গত দশ কি কুড়ি বছরে ধরে নিয়মিত কফি হাউসে আসছে তাহলে চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায় লোকটির জীবন চোরাবালিতে আটকে গিয়েছে। সাফল্য পেলে কেউ আর অনর্থক সময় নষ্ট করার জন্যে কফি হাউসে আসে না।

তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছ?

পেছনে ফিরে তাকালাম। প্রকাশক বেরিয়ে এসেছেন।

ভাবছি কোথায় যাওয়া যায়!

যাওয়ার কোনো জায়গা নেই বুঝি?

তা না!

আমার সঙ্গে চলো।

কোথায়?

রবীন্দ্রসদনে। রবীন্দ্রনাথের গানের প্রোগ্রাম আছে।

রবীন্দ্রনাথের গান?

ওহো, জানো না। আমরা যাকে রবীন্দ্রসঙ্গীত বলতাম এখনকার ছেলেমেয়েরা তাকেই রবীন্দ্রনাথের গান বলে। চলো।

ভদ্রলোক হঠাৎ আমার ওপর এমন সদয় হচ্ছেন কেন বুঝতে পারছি না। এই কয় মাসে তিনি প্রয়োজন ছাড়া একটাও কথা বলেননি। মাঝে মাঝে মনে হত উনি আমাকে চেনেনই না।

রবীন্দ্রসদনের পেছনে গাড়ি পার্ক করতেই কানে এল কেউ গান গাইছে। সুন্দর, উদাত্ত গলা। মাইকে ভেসে আসছে না। উদাসী হাওয়ায় পথে পথে–। গাড়ি থেকে নামতেই লোকটিকে দেখতে পেলাম। মুখে দাড়ি, হাতে ব্যাগ। গান গাইতে গাইতে হনহন করে হাঁটছে। একবার গেটের কাছে চলে যাচ্ছে, আর একবার পার্কিং লটের কাছে ফিরে আসছে। কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। গানটা শেষ হতেই আর একটা ধরল। প্রকাশক বললেন, বাঃ গাইছে বেশ ভাল কিন্তু পাগল নাকি?

সদনের সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু লোকটি আমাকে আচ্ছন্ন করল। যে ভঙ্গিতে ও গাইছে তা একমাত্র নিজের জন্যেই গাওয়া যায়। পৃথিবীর অন্য কেউ সেটা শুনছে কিনা তা নিয়ে ওর বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। এই মুহূর্তে ও নিজেই নিজের রাজা। এমন সুখ কজন মানুষ পেতে পারে। নিজের কাছে ছাড়া আর কারও কাছে ওর কোনো দায় নেই।
 
রবীন্দ্রসদনের চাতালে মোটামুটি ভিড়। মেয়েরা সব সেজেগুজে এসেছে। আমি লক্ষ্য করেছি, রবীন্দ্রনাথ হলেই কলকাতার কিছু মহিলা অফ হোয়াইট শাড়ি পরেন, চুলে সাদা ফুল। তখন তাদের তাকানো হাঁটাচলা সম্পূর্ণ বদলে যায়। ঠিক আশ্রমবালিকা যাকে বলে তা নয় কিন্তু নিজেকে শুদ্ধ দেখাবার চেষ্টা প্রকট থাকে। প্রকাশকের আসন প্রথম সারিতে। তার পাশে আমাকে বসালেন। কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, বুঝলে হে, আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে আসছি সায়গলের আমল থেকে। হ্যাঁ।

সায়গল? যদ্দুর জানি পঞ্চাশ সালের অনেক আগেই ভদ্রলোক গত হয়েছেন। আমার এই প্রকাশকের বয়স কিছুতেই পঞ্চান্নর বেশি নয়। পঞ্চাশ সালে ওঁর বয়স ছিল বড় জোর উনিশ। ওই বয়সে কেউ–। তাই বা বলি কেন? শুনেছি উনি ওপার বাংলার লোক। কুড়ি বছর বয়সে ভাগ্যান্বেষণে কলকাতায় এসেছিলেন। তাহলে সায়গলের গান শুনলেন কখন? আমি চাপা গলায় বললাম, আপনি গুল মারছেন!

কী? কী বললে?

আপনি শুনতে পেয়েছেন। গুল যারা মারে তাদের কান খুব শার্প হয়।

অ। আমি গুল মারছি?

এই তো শুনেছেন!

তুমি তোমার বস-এর সঙ্গে ওই ভাবে কথা বলবে?

দেখুন, আমি যদি বলতাম আপনি মিথ্যে কথা বলছেন তাহলে আপনি খুব রাগ করতেন। কিন্তু গুল মারছেন বললে আপনার একটু কাটল কিন্তু রক্ত পড়ল না।

বাঃ তুমি দেখছি বেশ বুদ্ধিমান। গুড।

আমার বাবা এটা মনে করেন না, আপনি করলেন।

উনি তাহলে তোমার সঙ্গে মেশেননি। যাকগে, স্বজনের উপন্যাসটায় হাত দিয়েছ?

হাত! ওটা ঠিক করতে গেলে দশটা হাত লাগবে। মা দুর্গাকে ডেকে আনুন।

ওসব বললে তো চলবে না। পাবলিক যা খায় তাই লিখছে স্বজন।

আমি বানান আর সেনটেন্স দেখে দিচ্ছি।

কী? রিরাইট করছ না? প্রকাশক হতভম্ব।

না। বিবেকে লাগছে।

এই কথা বলার জন্যে আমি তোমাকে স্যাক করতে পারি, তা জানো?

করে দিন। আমি তাহলে বেঁচে যাই।

অ্যাঁ। তার মানে?

একটা কুৎসিত পরিশ্রম করতে হয় না তাহলে।

প্রেক্ষাগৃহ তখন প্রায় ভরে গেছে। অনুষ্ঠান আরম্ভ হতে মিনিট দশেক দেরি আছে। আমি ভাবছিলাম, এখনই আমাকে ওখান থেকে উঠে যেতে হবে। কিন্তু প্রকাশক মুখ খোলার আগেই একজন সুন্দরী মহিলা এগিয়ে এলেন। অফ হোয়াইট সিল্কের শাড়ি, মিলিয়ে ব্লাউজ, কপালে চন্দনের টিপ। মহিলা প্রকাশককে বললেন, ও মা, কখন এসেছ! আমি ভাবতে পারছি না। কি ভাল লাগছে!

প্রকাশক জোর করেই বোধহয় হাসলেন, তোরা কেমন আছিস?

আমি ভাল। শুধু মায়ের বাতের ব্যথা আবার বেড়েছে। শোনো মামা, আমি তোমার অফিসে যাব। আমার কয়েকটা রেফারেন্স বই-এর দরকার আছে। তোমাকে হেল্প করতে হবে।

এম. এ. করেছিস অনেকদিন! এখন ওসব বই-এর কী দরকার।

ওটা তুমি বুঝবে না।

হঠাৎ মহিলা আমার দিকে তাকালেন, কিছু মনে করবেন না, আপনাকে খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে। আপনি কি কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে পড়তেন?

হ্যাঁ।

কী সাবজেক্ট ছিল?

বাংলা।

এই, তুমি বিপ্লব। না?

হ্যাঁ।

আমায় চিনতে পারছ না? আমি সুভদ্রা।

সুভদ্রা? আমি মনে করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু মন বিশ্বাসঘাতকতা করল। সুভদ্রা নামের কোনো মেয়ের কথা মনে পড়ল না।

কি, মনে পড়ছে না?

না। আমি কিছু মনে করতে পারছি না।

আমরা তিনবন্ধু সবসময় একসঙ্গে ঘুরতাম, একই শাড়ি পরে ক্লাসে যেতাম। তাই ছেলেরা আমাদের নাম দিয়েছিল ত্রিধারা। মনে পড়ছে?


এবার আবছা মনে এল। তিন বন্ধু, খুব হাসত। অন্য মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা মারলে ওই তিনজন কখনই ছেলেদের সঙ্গে কথা বলত না। কিন্তু তিনজনকে একসঙ্গে মনে পড়ছে, আলাদা করে একে নয়। আমি মাথা নাড়ালাম, হ্যাঁ, বাকি দুজনের সঙ্গে যোগাযোগ আছে তো?

চিঠিতে। মঞ্জুলা এখন আমেরিকায়। ওর স্বামী ওখানে ডাক্তারি করে। রত্ন দিল্লিতে। দুজনেরই বিয়ে হয়ে গিয়েছে। কী করছ তুমি? সুভদ্রা জিজ্ঞাসা করল।

আপাতত তোমার মামার পাবলিকেশনে গিয়ে প্রুফ দেখি।

সেকি? অন্য কিছু–!

প্রকাশক এবার কথা বললেন, তোরা এবার মুখ বন্ধ করবি? এখনই পর্দা উঠবে। এই, তুই তোর সিটে চলে যা। ইনটারভ্যালে আসিস।

সুভদ্রা গম্ভীর মুখে চলে গেল। আমার অত সামান্য কাজ করা বোধহয় ওকে খুব বিভ্রান্ত করেছে। হ্যাঁ, এম. এ. পাশ করে একজন মাত্র আটশো টাকার বিনিময়ে বানান ঠিক করে দেয়, কোনো অ্যাম্বিশন নেই, এটা কারও ভাল লাগার কথা নয়।

পর্দা ওঠার আগে প্রকাশক বললেন, তুমি এম এ পাশ করে পড়ানোর দিকে গেলে না কেন?

আমরা জন্যে চাকরি নিয়ে কেউ বসে নেই, তাই।

তুমি বড্ড বাঁকা বাঁকা কথা বলো তো হে!

আপনার কান এসব শুনতে অভ্যস্ত নয়, তাই বাঁকা বলে মনে হচ্ছে।
 
পর্দা উঠল। ঘোষক খুব ইনিয়ে বিনিয়ে সাধ এবং সাধ্যের গল্প শোনালেন। একেবারে প্রথম একজন মধ্যবয়সী মহিলা এলেন উদ্বোধনী সঙ্গীত গাইতে। আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে–! ইনিয়ে বিনিয়ে দুলে দুলে গান লোকে চুপচাপ শুনছিল। তারপর রবীন্দ্রসঙ্গীত সহযোগে নৃত্য। রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে নাচ, একথা ঘোষক বললেন না। আমার হৃদয় তোমার আপন হাতে দোলে, মঞ্চের ওপাশ থেকে গান ভেসে এল আর বছর তিরিশের এক মহিলা চকচকে শাড়ি পেঁচিয়ে পরে ছুটে এলেন মঞ্চে। গানের কথার রূপ দিলেন হাত পা চোখের ভঙ্গিমায়। দোলাও-এর সঙ্গে যেভাবে হাত নাড়লেন তা শিশুকে ঘুম পাড়াবার সময় মায়েরা ওইভাবে হাতে তুলে দোলায়। কিছুক্ষণ দেখার পর অসহ্য মনে হল আমার কাছে। এইসব বুড়োধাড়ি মেয়েকে ধমকে থামিয়ে দিয়ে বলা উচিত, তোমার বয়স কত মা? পাঁচ বছরের বাচ্চা যা করে তা মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু তোমাকে কি মানায়?

আমি উঠে দাঁড়ালাম। প্রকাশক চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, একি? কোথায় যাচ্ছ?

এসব দেখলে আমার শরীর খারাপ হয়ে যাবে। ওঁকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হনহন করে বেরিয়ে এলাম। হলের বাইরে এসে মনে হল, আহা, কী আরাম।

আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথ যদি বাংলায় না জন্মাতেন, বাংলাভাষায় না লিখতেন তাহলে বাঙালি কি নিয়ে থাকত। এইসব ধ্যাস্টামো কীভাবে করত? নজরুল যা লিখেছেন তা নিয়ে এইসব ইয়ার্কি করা যায় না। মধুসুদন বড্ড সিরিয়াস এবং এই লাইনে তাঁকে ফেলা যায় না। রবীন্দ্রনাথ বাঙালিকে অনেক দিয়েছেন, একটা আধশোওয়া জাতিকে টেনে তুলে ছুটতে সাহায্য করেছেন, কিন্তু কী দরকার ছিল ওঁর নৃত্যনাট্য লেখার? রোগা রোগা বাবরি চুল রাখা ধেড়ে ধেড়ে ছেলেগুলো ওইসব নৃত্যনাট্যে শরীর দোলায়, পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে-র সময় আঙুলের মুদ্রায় কাকে তারা ডাকে তারা নিজেরাই জানে না। যে আবেগ কবির কলমে ছিল তা এইসব নাচিয়েদের কল্যাণে উধাও।

বাসস্টপে দাঁড়ালাম। রবীন্দ্রসদনের সামনে বাসস্টপটায় এই সময়েও বেশ ভিড়। হঠাৎ নজরে এল একটি অল্পবয়সী মেয়ে বিরক্ত হয়ে সরে আসছে আমার দিকে। তার ঠিক পাশেই মধ্যবয়সী একটি লোক যার হাতে গাড়ির চাবি। লোকটা চাবিটা দেখানোর ভঙ্গি করে নাড়ছে। মাথাটা গরম হয়ে গেল। সোজা মেয়েটির পাশে গিয়ে বললাম, দাঁড়ান ভাই। এবার লোকটাকে ডাকলাম, এই যে এদিকে আসুন।

লোকটা একটু হকচকিয়ে গেল। দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল আমার মতলব কী!

বললাম, আপনার গাড়িটা কোথায়? এখানে নিয়ে আসুন। আপনার বাড়িতে আমরা যাব।

মেয়েটি আঁতকে উঠল, আমি কেন যাব? আমি কোথাও যাব না।

বললাম, আপনি ভয় পাবেন না। ওর গাড়িতে চড়ে আমরা ওর বাড়িতে গিয়ে আত্মীয়স্বজনদের বলে আসব উনি বাসস্টপে মেয়ে দেখলেই গাড়ির চাবি দেখান। যান, নিয়ে আসুন গাড়ি।

হঠাৎ লোকটা উদাসী হয়ে গেল। যেন পৃথিবীতে কোনো সমস্যা নেই এমন ভঙ্গি করে হেঁটে যেতে লাগল আকাদেমির দিকে। একবারও ফিরে তাকাল না।

বললাম, এবার যান। আর ও আপনাকে বিরক্ত করবে না। মেয়েটি সেই যাওয়া দেখে বলল, আমার খুব ভয় করছে।

কেন? কী বলেছে ও আপনাকে?

কিছু বলেনি। শুধু গাড়ির চাবি দেখিয়ে বলছিল, সঙ্গে গাড়ি আছে।

ঠিক আছে। বাসে উঠুন।

তখনই একটা প্রাইভেট বাস এসে দাঁড়াল। মেয়েটি ভীতচোখে বলল, এই বাস।

বেশ। উঠুন। আমি না হয় একটু এগিয়ে দিচ্ছি।

মেয়েটি ভিড়ের সঙ্গে মিশে গেল। আমি পাদানিতে। এইভাবেই যাওয়া আসা করতে হবে তা কলকাতার মানুষ মেনে নিয়েছে অনেককাল। গোটা পাঁচেক স্টপ চলে যাওয়ার পর মনে হলো এখন তো মেয়েটার কোনো ভয় নেই। ভাড়া দিয়ে টিকিট নিয়ে নেমে পড়লাম।
 
নামবার পর দেখলাম আমি এখন ভবানীপুরে। আমাকে ফিরতে হবে উল্টোদিকে। সময় নিয়ে ভাবি না, কিছু বাড়তি পয়সা খরচ হল। কয়েক পা হাঁটতেই আমার পা স্থির হলো। উল্টো দিকের গলিতে ঢুকে তিন নম্বর বাড়িটা আমাকে টানতে লাগল। এটা কী রকম হলো? এখানে আসার কোনো কথা ছিল না। একেই কি কাকতালীয় ব্যাপার বলে। বছরখানেক আগে শেষবার আমি ওই বাড়িতে গিয়েছি। সেদিন হেনা বলেছিল, বিপ্লব, তুমি আর এখানে এসো না। আমি তোমাকে টলারেট করতে পারছি না। তোমার সঙ্গ আর পেলে আমি পাগল হয়ে যাব।

সেই শেষ। এই একবছর কোনো যোগাযোগ নেই, না দেখা, ফোন।

আজ টানটাকে এড়াতে পারলাম না। গলিতে ঢুকলাম। তিন নম্বর বাড়িটা পাঁচতলা। লিফট আছে। হেনা থাকে তিনতলায়। লিফট থেকে নেমে বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছলাম। এক বছরে মানুষ কি একই রকম থাকে? হেনা কি একটুও পাল্টায়নি। তারপরেই মনে হল, আমি কি পাল্টেছি?

উত্তরটা স্পষ্ট। না, পাল্টাইনি, একবছর আগে যা ভাবতাম তা বাতিল করার কোনো কারণ ঘটেনি যখন তখন পাল্টাবো কেন? আমি যদি না পাল্টাই তাহলে হেনারও তো একই অবস্থা হওয়া স্বাভাবিক। অতএব আমার উচিত নয় ওকে বিরক্ত করা। আমি ফিরলাম। লিফটের বোতাম টিপলাম নেবে যাওয়ার জন্যে। একটু পরেই লিফট উঠে আসার আওয়াজ হল। লিফট উঠে আসছে। হেনা বা তার মা দেখতে পাওয়ার আগেই আমি নিচে নেমে যেতে চাই।

লিফট থামল। দরজা খুলে বেরিয়ে এল হেনা এবং তার পেছনে এক ছিমছাম যুবক। আমি চমকে গিয়েছিলাম। মুখ ফিরিয়ে নিতেই শুনলাম প্রচণ্ড উচ্ছ্বাস নিয়ে হেনা বলছে; আরে তুমি? কখন এলে? চলে যাচ্ছ যে। এসো এসো। প্রায় দৌড়ে এসে হেনা আমার হাত ধরল। এক সেকেন্ডের জন্যে হলেও আমি আরও ঘাবড়ে গেলাম। এই গলায় হেনা কখনও আমার সঙ্গে কথা বলেনি। আর এখন, শেষ কথা হয়ে যাওয়ার পর, এভাবে বলছে ভাবা যায় না।

আমি বললাম, না, থাক, মনে হচ্ছে তুমি এখন ব্যস্ত থাকবে!

ব্যস্ত? তুমি কী বলছ? এসো, কাম অরিত্র। হেনা এগিয়ে গিয়ে বেল টিপল। তারপরে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, অরিত্র, মিট মাই ফ্রেন্ড, বিপ্লব, আমার অনেক দিনের বন্ধু।

অরিত্র মাথা নাড়ল, নমস্কার।

লোকটা নমস্কার বলল, কিন্তু হাত তুলল না। এখন মনে হলো, তুলতে যে হবেই তার কোনো মানে নেই। মুখে বললেই তো মানে বোঝানো হলো। দরজা খুলল যে কাজের মেয়েটি তাকে আমি চিনি না। অন্তত গত এক বছরে প্রথম পরিবর্তন নজরে এল। প্রথম বলা ঠিক হল না, দ্বিতীয়, প্রথম পরিবর্তন তো হেনার বলা একটু আগের কথাগুলো। যে ভঙ্গিতে ও কখনও কথা বলেনি তা আজ বলল।

তোমরা একটু বসো প্লিজ। হেনা সোফা দেখিয়ে ভেতরে চলে গেল।
 
আমরা বসলাম। বসা মাত্র অরিত্রকে দেখলাম একটা ম্যাগাজিন তুলে নিয়ে পাতা খুলতে। অর্থাৎ ও এখন আমার সঙ্গে কথা বলতে চায় না। আচ্ছা, এই লোকটা কে? হেনার সঙ্গে ওর কী ধরনের সম্পর্ক! যে ভঙ্গি নিয়ে ঘরে ঢুকল তাতে খুব অন্তরঙ্গ বলে মনে হচ্ছে না। এ কি অন্তরঙ্গ হবার চেষ্টা করছে? হঠাৎ বুকের ভেতর অস্বস্তি এল। সেটা মুহূর্তের জন্যে। তারপরেই ভাবলাম, এ নিয়ে আমি ভাবছি কেন? হেনা এখন স্বাধীন। কারও কাছে কোনো অবলিগেশন নেই। যা ইচ্ছে তাই ও করতে পারে।

হেনা ফিরে এল, কী খাবে বলো? চা, কফি না ঠাণ্ডা?

অরিত্র কাঁধ নাচাল। আমি বললাম, কিছু না।

এখনও রাগ পড়েনি?

মানে?

তুমি না একটা যাচ্ছেতাই। হাসল হেনা, জানো অরিত্র, বিপ্লব বড় অভিমানী। কদিন আগে ওর সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফেল করেছি, বাবুর রাগ হয়ে গেল।

অরিত্র ম্যাগাজিন রেখে আমায় দেখল তারপর হেনাকে।

হেনা হাসল, আমরা খুব পুরনো বন্ধু। আমরা পরস্পরকে খুব ভাল বুঝতে পারি।

ও।

বিপ্লব, অরিত্র খুব আপ রাইজিং। আমার সঙ্গে সম্প্রতি আলাপ হয়েছে। আমার এক অফিস কলিগ ওর বন্ধু, সেই সুবাদে।

হঠাৎ অরিত্র ঘড়ি দেখল, মাই গড। সে উঠে দাঁড়াল।

হেনা জিজ্ঞাসা করল, কী হল?

একদম ভুলে গিয়েছিলাম। আমার জন্যে ক্যালকাটা ক্লাবে একজন অপেক্ষা করছে। আমি খুবই দুঃখিত, আমাকে এখনই চলে যেতে হচ্ছে। সে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল।

হেনা বলল, কিন্তু–!

অরিত্র কাধ নাচিয়ে দরজার দিকে এগোলো। হেনা চটপট ওর পেছনে ছুটল। অরিত্রকে দরজা খুলে দিয়ে সে বলল, আমার খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু কাজ থাকলে তো কিছু করার নেই!

অরিত্র মাথা নেড়ে বেরিয়ে যেতেই সে দরজাটা বন্ধ করল।

ফিরে যখন এল তখন আমি অন্য হেনাকে দেখলাম, মুখের একটা উপশিরাও নড়ছে না। স্থির পায়ে আমার উল্টোদিকের সোফার পাশে এসে জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার?

আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তোমার সঙ্গে একবছর দেখা হয়নি অথচ তুমি ভদ্রলোককে বললে কদিন আগে আমার সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফেল করেছ। কী ব্যাপার?

ওটা না বললে অরিত্র এখান থেকে এখন চলে যেত না। ও যখন আজ আমার কাঁধে চেপেছিল তখন ভেবে পাচ্ছিলাম না কি করে ওকে কাটাব। আজকের সন্ধেটা ওর প্রেম প্রস্তাব শুনে নষ্ট করতে হবে বলে খারাপ লাগছিল। তা হঠাৎ তোমাকে দেখে মনে হলো বেঁচে গেলাম। আমার কথা শুনে তুমি প্রতিবাদ করোনি সেটা ইনডাইরেক্টলি আমাকে হেল্প করেছে, তাই তোমাকে ধন্যবাদ। কিন্তু তুমি কি বিশেষ কোনো কারণে এখানে এসেছিলে? হেনা তখনও বসছিল না।

না।

তাহলে?

হঠাৎ এ পাড়ায় চলে আসি। আসার পর মনে হল অনেকদিন দেখা হয়নি।

হঠাৎ এ পাড়ায় চলে আসি মানে? প্ল্যান না করে কেউ আসে নাকি? এরকম সিলি যুক্তি দেবার বয়স তুমি দশ বছর আগে পেরিয়ে এসেছ বিপ্লব। তাছাড়া অনেককাল দেখা হয়নি মানে এই নয় দেখা করার জন্যে ছটফট করতে হবে। তোমার সঙ্গে আমার শেষবার যে কথা হয়েছিল তা নিশ্চয়ই মনে আছে। যাকগে, আজকে তুমি আমাকে ইনডাইরেক্টলি সাহায্য করেছ। চা খাবে?

না।

তাহলে–!

আমি হেনার দিকে তাকালাম, তুমি আমাকে চলে যেতে বলছ?

আমি খুব টায়ার্ড!

টায়ার্ড। একটু আগে অরিত্র যখন এসেছিল তখন তোমাকে দেখে বা কথা শুনে একটুও মনে হয়নি ওকথা। আমি না থাকলে নিশ্চয়ই অরিত্র এখনই উঠে যেত না!

হঠাৎ হেনা শরীরটাকে দ্রুত সোফায় নিয়ে গেল, কী করতে চাও তুমি? বসতে চাও, বসো কতক্ষণ বসবে দয়া করে বলে দাও সেইমত তৈরি হই।

হেনা? আমি চমকে উঠলাম।

হেনা মুখ ফেরাল অন্য পাশে।

বেশ। আমি যাচ্ছি।

এক মিনিট! বসো। আমি খুব অবাক হয়ে গেছি তোমার ব্যাপার দেখে।

মানে?

যে তুমি আমার সঙ্গে কোনরকম অ্যাডজাস্ট করতে চাইতে না সেই তুমি আজ এলে কেন?
 
এককালে তো সম্পর্ক ছিল, সে সময়টা তো মিথ্যে ছিল না। যদি সেটাকে বন্ধুত্ব বলো তাহলে তার সুবাদে তো আসা যায়, এরকম মনে হয়েছিল আমার। ভুল মনে হয়েছিল। এখন তুমি প্রতিদিন হয়তো নতুননতুন প্রেমপ্রস্তাব শুনতে অভ্যস্ত। পুরনোকে ভাল লাগার কথা নয়।

বাঃ। চমৎকার! তুমি দেখছি বাংলা সিনেমার সংলাপ ভাল লিখতে পারবে। এখনও নিশ্চয়ই কোনো কোম্পানির চাকর হওনি। হয়েছ? তা দ্যাখো না, চেষ্টা করে ফিল্মলাইনে! হেনা মাথা ঝাঁকাতেই ওর চকচকে পালিশ করা কাঁধ ছুঁয়ে থাকা চুলগুলো চোখ গাল স্পর্শ করে গেল, হ্যাঁ। প্রেমপ্রস্তাবের কথা বলছিলে না? আমি স্বীকার করতে বাধ্য আজ পর্যন্ত তুমি ছাড়া আর সমস্ত পুরুষ আমাকে প্রস্তাব দেবার সময় প্রায় একই ভাষা বা শব্দ ব্যবহার করেছে অথবা একই ভঙ্গিতে কথা বলেছে। ব্যাপারটা ক্রমশ এমন একঘেঁয়ে হয়ে গিয়েছে যে আর শোনার মত ধৈর্য আমার নেই।

তবু তো আজ শুনতে যাচ্ছিলে?

হ্যাঁ। কারণ কাজের সুবাদে অরিত্রর সঙ্গে আমার আলাপ। আমি আজ যে কোম্পানিতে আছি কাল সেখানে নাও থাকতে পারি। খামোকা কাউকে চটিয়ে দিয়ে আমার কোনো লাভ হবে না। তাছাড়া লোকটা ভদ্রলোক, লম্পট নয়।

আচ্ছা! তা আমাকে হঠাৎ আলাদা করলে কেন?

ওটা আমার বোকামি।

বোকামি?

তখন বয়স কম ছিল। তুমি যেসব কথা বলতে সেগুলোকে সত্যি বলে মনে হত, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করত। জীবন সম্পর্কে তোমার অ্যাপ্রোচ ছিল নেগেটিভ। এই বয়সে বাঁকা বাঁকা কথা শুনতে বেশ আরাম লাগত। কিন্তু সেটা বয়স বাড়ার পর নেহাৎ বোকামো বলেই মনে হয়েছে। তোমার মনের বয়স বাড়েনি বলে তুমি একই জায়গায় পড়ে আছ। তোমাকে সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

তাই যারা বানানো ক্লিশে হয়ে যাওয়া শব্দ-উচ্চারণ করে, জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে দুনম্বরি হাসে, তাদের সহ্য করতে তোমার আপত্তি নেই।

না, নেই। তোমাকে আমি আগেও অনেকবার বলেছি কোটি কোটি মানুষ যা মেনে নিয়েছে। তুমি তার ব্যতিক্রম হতে পারো না। এই যে তুমি এম. এ. পাস করেও চাকরি করনি, ব্যবসা করনি, কীভাবে টাকা রোজগার করছ, আদৌ করছ কি না তা জানি না, তোমার ওপর কেউ নির্ভর করতে পারে? তুমি নিজে নিজের ওপর নির্ভর করতে পারো?

আমার তো চলে যাচ্ছে।

হ্যাঁ। বাবার হোটেলে দুবেলা খাওয়া আর পৈতৃক বাড়ির ছাদ মাথার ওপর থাকলে বুলির বিপ্লব করা যায়। কিন্তু তাও কদিন? তেইশ কি চব্বিশ। তোমার বয়স তো তাও অনেককাল পার হয়ে গিয়েছে। এবার তাকিয়ে দ্যাখো না। দুটো পা মাটিতে রাখো!

যার দশে হয়নি তার একশতেও হবে না হেনা।

তার মানে চিরকাল তুমি একটি অকর্মণ্য মানুষ হয়ে বেঁচে থাকবে?

অকর্মণ্য? আমি হাঁ হয়ে গেলাম।

নিশ্চয়ই। শুধু কথাসর্বস্ব মানুষকে কেউ বিশ্বাস করতে পারে? আর যে কথা আজকের যুগে অচল! তোমার ওপর কোনো মানুষ আস্থা রাখতে পারবে? তুমি কারও দায়িত্ব নিতে পারবে?

তোমার এসব কথায় যুক্তি আছে, ছিল। আমি তাই একবছর আগে মেনে নিয়েছি।

তবু তুমি নিজেকে শোধরাওনি?

না। আজকাল আমার বমি পায়।

বমি পায়?

কেউ দুনম্বরি কথা বললে বা জ্ঞান দিলে শরীর গুলিয়ে ওঠে। হেনা, অনেকক্ষণ থেকে আমার এইরকম হচ্ছে। তোমার টয়লেটে যেতে পারি?

নোঃ। চিৎকার করে উঠল হেনা, তোমার শরীরের কোনো কিছু এ বাড়িতে রেখে যাবে না তুমি।

বমিও করতে পারব না?

এনি ড্যাম থিং।

কিন্তু আমি পারলাম না। তিরের মতো দৌড়ে গেলাম টয়লেটের দিকে। যেহেতু আমার জানা ছিল তাই দরজাটা খুলে বেসিনে পৌঁছাতে পারলাম শেষমুহূর্তে। ভেতর থেকে যাবতীয় আবর্জনা বেরিয়ে আসার কথা, কিন্তু কয়েক চামচ তেতো জল ছাড়া কিছু বের হল না। মুখে ঘাড়ে জল দিলাম, একটু কুলকুচি করলাম হাঁপাতে হাঁপাতে।

তুমি কি অসুস্থ? টয়লেটের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে হেনা।

না। মাথা নাড়লাম। তখনও শরীরে কাঁপুনি হচ্ছিল।

তাহলে?

এরকম হয়।

ডাক্তার দেখিয়েছ?

আমি উত্তর দিলাম না। পৃথিবীর কোনো ডাক্তার এর চিকিৎসা করতে পারবে না। একথা বলে কী লাভ। চলে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াতেই হেনা বলল, শোনো। একটু বসে যাও।

কেন?

আমি অনুরোধ করছি।

এই গলায় হেনা অনেককাল কথা বলেনি। আমি বসলাম। হেনা ভেতরে চলে গেল। মানুষের নিজস্ব কিছু চরিত্র আছে। এই চরিত্র এক একজনের এক একরকম। তার নিজের মতন। আবার কিছু চরিত্রে অনেকের পার্থক্য নেই। এই যেমন, সম্পর্ক যখন সহজ থাকে, মন ভাল থাকে তখন মানুষ যে গলায় কথা বলে, একবার সম্পর্ক তিক্ত হয়ে গেলে নিজের অজান্তে আর সেই গলা ব্যবহার করতে পারে না। তখন হয়তো ঝগড়া হচ্ছে না, সেদিন কোনো অশান্তি হয়নি কিন্তু মন টোল খেয়ে গেলে কণ্ঠস্বর সেই যে পাল্টে যায় তা আর আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারে না। যদি যায় তাহলে বলতে হবে অসাধ্যসাধন করা হলো। আজ হেনার ক্ষেত্রে তাই হয়েছে, এমন ভাবার তো কোনো কারণ নেই।

এক গ্লাস জল নিয়ে এল হেনা, খেয়ে নাও।

বিনা বাক্যব্যয়ে জল খেলাম। খুব প্রয়োজন ছিল জলের।
 
আমার হাত থেকে গ্লাস ফিরিয়ে নিয়ে হেনা সোফায় বসল। ও এখন কথা খুঁজছে বুঝতে পারছি। কীভাবে আমাকে বুঝবে, সেটা ভেবে পাচ্ছে না। চিরকালই ওর জ্ঞান দেবার একটু ঝোঁক আছে। ওকে সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকে চিনি। তখন স্কার্ট পরে কলেজে যেত, দুটো বেণী পিঠে নাচত। আমি বাংলা, ও ইকনমিক্স। আমি যখন এম. এ. ক্লাশে সময় নষ্ট করছি তখন কিসব পরীক্ষা দিয়ে হেনা চাকরিতে ঢুকে পড়েছে। ওর নিজের বাড়ি ব্যারাকপুরে। এই ফ্ল্যাটটা ওর বাবা ওকে ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। একজন খুব পুরনো মহিলা হেনার সঙ্গে একবছর আগেও থাকত। হেনাকে ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছে। সে মহিলা কি এখন নেই?

এই সময় হেনা বলল, আমার খিদে পেয়েছে। তুমি একটু বসবে, দেখি কী বানাতে পারি।

কেন? তোমার সেই মহিলা নেই?

না। নাতনির বিয়েতে গেছে। হেনা উঠে গেল।

খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম বমিটা করার পর। সোফায় শরীর এলিয়ে দিলাম। এবং তার ফলে যে কখন ঘুম এসে গেল তা বুঝতে পারিনি। যখন ঘুম ভাঙল তখন ঘড়িতে সাড়ে দশটা বেজে গেছে। ঘর অন্ধকার। হেনা এ-ঘরে নেই। হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলাম। তারপর ডাকলাম, হেনা।

কোনো সাড়া এল না। আমি দ্বিতীয়বার ডাকলাম, এবার একটু জোরে। কিন্তু তবু সাড়া এল না।

হেনা কি আমার মতো ঘুমিয়ে পড়েছে? আমি পাশের ঘরে ঢুকলাম। এটা তিন ঘরের ফ্ল্যাট। এর পাশেরটা হেনার বেডরুম, বেডরুমের দরজা বন্ধ। কয়েকবার নক করা সত্ত্বেও সাড়া এল না। ঠিক তখনই টেলিফোনটা আওয়াজ করে উঠল। শব্দটা এমন আকস্মিক যে আমি ছিটকে উঠেছিলাম। আমি আবার বন্ধ দরজায় আঘাত করলাম, তোমার টেলিফোন, প্লিজ দরজা খোলো।

তবু দরজা খুলে বেরিয়ে এল না হেনা। এটা রসিকতা হলে মোটা দাগের রসিকতা। আর নিজের নিরাপত্তা সম্পর্কে সন্দেহ আছে বলে হেনা দরজা দিয়েছে, এমন ধরে নিলে আর দরজায় আঘাত করে ওর চৈতন্য জাগানোর কোনো মানে হয় না। তার চেয়ে রিসিভারটা তুলে বলে দিই আজ রাত্রে ফোন করে কোনো লাভ নেই।

রিসিভার তুলতেই মনে হল, কী শাস্তি। ছোট ফ্ল্যাটে রাত বাড়লে শব্দ ভয়ঙ্কর হয়ে যায়।

হ্যালো! গম্ভীর হয়ে বললাম।

যাক। তোমার ঘুম শেষপর্যন্ত ভেঙেছে। হেনার গলা।

আরে তুমি? তুমি কোত্থেকে বলছ? আমি হতভম্ব হয়ে বন্ধ দরজাটা দেখলাম।

তখন তোমাকে বলার সুযোগই হল না। আমি সাড়ে নটা নাগাদ ডিনারে বেরিয়েছি। খুব ভাল বড় পার্টি হচ্ছে এক বান্ধবীর বাড়িতে। তুমি এমন মড়ার মতো ঘুমাচ্ছিলে যে তোমাকে আর ডিস্টার্ব করিনি আসার সময়। এখন তো রাত হয়ে গেছে। তুমি নিশ্চয়ই চলে যাবে। যাওয়ার সময় দরজাটা টেনে দিয়ে যেও। প্লিজ! রাখছি।

ওপাশে রিসিভার রাখার আওয়াজ হল। ফোন নামিয়ে ধাতস্থ হতে সময় লাগল আমার। বন্ধ দরজাটার দিকে তাকালাম। ওর ভেতরে কেউ নেই অথচ কত আজেবাজে ভাবনা মাথায় আসছিল বন্ধ দরজা দেখে। এমন তো হতেই পারে, হেনার আগে থেকেই নেমন্তন্ন ছিল। আমাকে ওভাবে ঘুমোতে দেখে ও কেন নেমন্তন্ন বাতিল করবে?

কিন্তু খিদে পাচ্ছে খুব। আমি শেষ কখন খেয়েছি? দুপুরে। রুটি আর আলুর দম। আমার কাছে পয়সা ছিল, বিকেলে যাহোক কিছু খেয়ে নিতে পারতাম। কিন্তু সঙ্গে লোক থাকলে ওই হয় মুশকিল। প্রকাশকের গাড়ি করে রবীন্দ্রসদনে গিয়েছিলাম। ওঁর উচিত ছিল আমাকে খাওয়ার কথা বলা। বলেননি। আমি যা খাব তা উনি খাবেন না বলেই আমি কিছু বলিনি।

কিচেনে ঢুকলাম। ফ্রিজ ভর্তি খাবার। মাংস-মাছ সব রান্না করা রয়েছে। এমনকি ভাতও। কিন্তু গরম না করে খাওয়া যাবে না। হেনা কি তিন চার দিনের রান্না একসঙ্গে রেঁধে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখে? মিষ্টির বাক্সটা দেখলাম। নাঃ। চলবে না। ফ্রিজ বন্ধ করে হটবক্সটা দেখলাম। কিছুই নেই ভেতরে। কিন্তু হেনা বলেছিল কিছু বানাতে কিচেনে যাচ্ছে। কী বানিয়েছে তখন?

পেলাম শেষ পর্যন্ত। একটা সসপ্যানের মধ্যে চাপা দেওয়া ছিল। মোটা সোটা ওমলেট আর চার পিস টোস্ট। ওমলেট একটাই। তার মানে হেনার নিজেরটা খেয়ে গেছে। স্বাভাবিক। অফিস থেকে ফিরে এসে অভুক্ত অবস্থায় কেউ পার্টিতে যায় না।

ঠাণ্ডা ওমলেট এবং শীতল টোস্ট ক্ষুধার্তের জিভে কোনো বিস্বাদ আনে না। খাওয়া হয়ে গেলে শরীরে বল পেলাম। এবার ফেরা যাক। রাত ঢের হয়েছে। এরপরে বাস পাব না। ট্যাক্সিতে চেপে বাড়ি ফেরার বিলাসিতা আমি অ্যাফোর্ড করতে পারি না। কিন্তু বাইরের দরজা খুলতে যাওয়ার সময় মনে হল হেনার সঙ্গে আমার কোনো কথাই হল না। একবছর ধরে না আসার কারণে যে ব্যবধান ছিল তা আর কখনই না এলে নিশ্চয়ই আরও বেড়ে যেত। কথা বলার কোনো প্রয়োজনই হত না। কিন্তু আজ সন্ধেবেলায় কথাগুলো নতুন করে উঠেছিল। সেটা শেষ করতে হলে আমাকে আবার এই ফ্ল্যাটে আসতে হয়। ওই আবার আসা হেনা পছন্দ করবে না। তাই সাপ ব্যাঙ যা হোক আজই শেষ করে যাওয়া ভাল। যতই রাত হোক, কলকাতার রাস্তায় কেউ পড়ে থাকে না।
 
তবে বাড়িতে যে খাবার আমার জন্যে বরাদ্দ সেটা নষ্ট করার অধিকার আমার নেই। আমার জন্যে খাবার না রাখার জন্যে বলে দেব বলে ফোনের দিকে এগোলাম। ডায়াল করতে গিয়ে থমকে গেলাম। যাচ্চলে! আমার বাড়ির নাম্বারটা যেন কত? ঝাপসা ঝাপসা লাগছে কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছি না। অদ্ভুত যন্ত্রণা শুরু হল। তারপরেই মনে হল ওটা আমার বাড়ি ভাবলাম কেন? যে বাড়িতে আমি থাকি, মানে রাত্রিবাস করি, সেটা আমার বাড়ি হবে কেন? ওটা আমার পিতার বাড়ি। পিতা? ধ্যাৎ! পিতা বললেই কিরকম মুনিঋষি সাধুসন্ত সেইন্টদের ছবি মনে আসে। বাবা শব্দটার মধ্যে ওগুলো অতটা না হলেও কিছুট তো থাকছেই। বাপ শব্দটা বরং অনেক বেশি সহজ। কোনো স্ট্যাম্প নেই। মেয়েরা যদি বাপের বাড়ি বলতে পারে তাহলে ছেলেরাই বা বলবে না কেন? এইটুকু ভাবতেই নাম্বারটা মনে এসে গেল।

ওপাশে ফোন বাজছে। আমার বাপ বাড়িতে থাকলে এখন তার আহ্নিকের সময়। নিশ্চয়ই ভাই ফোনটা তুলবে। কিন্তু কেউ সাড়া দিল না। ফোনটা বেজে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। লাইনটা কেটে আবার ডায়াল করলাম। একই অবস্থা। এমন হতেই পারে না। নিশ্চয়ই ফোন খারাপ হয়েছে। বাড়ি খালি করে সবাই অন্য কোথাও কিছুতেই চলে যেতে পারে না। ওয়ান নাইন নাইনে ফোন করলাম। মিনিট তিনেক বাজল কিন্তু দিদিমণিরা সাড়া দিলেন না।

শেষপর্যন্ত হাল ছেড়ে দিলাম। ঘড়ি বলছে এগারোটা বেজে গিয়েছে। এবার বেরুতে হয়। আলো নিভিয়ে দিতেই দরজায় শব্দ হল। বাইরে থেকে চাবি ঘুরিয়ে কেউ দরজা খুলছে। চোর নাকি? দ্রুত সরে এলাম এক কোণে! চোর হলে হেনার উপকার করে যাওয়া উচিত। আলমারির আড়ালে দাঁড়ালাম।

কিন্তু হেনারই গলা বাজল, তোমাদের অনেক ধন্যবাদ পৌঁছে দেবার জন্যে।

টুক করে আলো জ্বলল। হেনা এত তাড়াতাড়ি ফিরে এল। আমি ঘড়ি দেখলাম। যাচ্চলে। আমি এতক্ষণ কী দেখছিলাম? এগারোটা নয়, বারোটা বেজে গেছে।

একটি মহিলা কণ্ঠ বলল, টয়লেট কোথায় হেনা?

ওইতো, ওইদিকে। যাও। হেনার গলা। তারপরেই টয়লেটের দরজা বন্ধ হবার শব্দ হল।

সঙ্গে সঙ্গে একটি পুরুষ কণ্ঠ শুনলাম। চাপা গলায় বলছে, হেনা! আমি আর পারছি না।

কেন? শরীর খারাপ? হেনা খুব সিরিয়াস।

ওঃ। ঠাট্টা কোরো না। আই নিড ইউ হেনা, আই লাভ ইউ।

প্লিজ সুমিত! তোমার বউ শুনলে দুঃখ পাবে।

আই ডোন্ট কেয়ার! আমি আর ওর সঙ্গে থাকতে পারছি না। আই নিড ইউ।

রিয়েলি?

জাস্ট টেল মি ইয়েস।

তোমার বউ-এর সামনে বলতে পারবে?

তুমি আমাকে পরীক্ষা করছ?

না। কিন্তু মুশকিল হল, তুমি একবারও জানতে চাইছ না আমি ফ্রি আছি কি না!

তার মানে?

আমি তো অন্য কারো সঙ্গে এনগেজড হয়ে থাকতে পারি?

মাই গড!

কেন? পারি না?

সেই ভাগ্যবানটি কে?

তুমি চিনবে না। আমরা একসঙ্গে কলেজে পড়তাম।

হেনা, তুমি আমাকে ব্লাফ দিচ্ছ না তো?
 

Users who are viewing this thread

Back
Top