What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected মৌষলকাল - সমরেশ মজুমদার (2 Viewers)

অনিমেষ কী বলবে বুঝতে পারছিল না। খরচ এমন কিছু বেশি নয়। অষ্টধাতুর মূর্তি। একটু বড় না হলে তো চোখে পড়বে না। মায়ের পায়ের মল আর রুপোর খাড়া। লাখ পাঁচেক আমাকে দিলে আমি কিনে নেব। আরে মশাই, আপনি যা পাচ্ছেন তার টোয়েন্টি পার্সেন্টে জনগণের সেবা করবেন। ঠিক আছে? আপনার স্ত্রী এসেছেন তো? তার সঙ্গে কথা বলে জানাবেন। আমি সব ব্যবস্থা করে খদ্দের নিয়ে আসব। আচ্ছা, আমাকে একটু পার্টি অফিসে যেতে হবে। উঠে দাঁড়ালেন ভোম্বলবাবু।

অনিমেষ উঠে দাঁড়াল, আপনি যে এসব করছেন, তা আপনার পার্টি জানে?

দেখুন মশাই, আমি কি চুরি করছি যে লুকিয়ে করব? নৃপেনদাকে মনে আছে? ছেলেবেলা থেকে সিপিআই করতেন, পরে সিপিএমে। জেলা সম্পাদক হয়ে আছেন বহু বছর। তাঁকে নিয়ে এসে মন্দিরের জমিটাকে দেখিয়েছি। পার্টি থেকে কোনও সাহায্য নেব না বলেই তো আপনাদের কাছে হাত পাতছি। মন্দিরের গায়ে শ্বেতপাথরের ফলকে মাসিমার নাম লিখে জানিয়ে দিতে পারি তিনিই দান করেছেন। চলুন। বাইরে বেরিয়ে রিকশাটাকে দেখলেন ভোম্বলবাবু। চেঁচিয়ে বললেন, অ্যাই, দাঁড়িয়ে আছিস বলে ওয়েটিং চার্জ নিবি না। আমার লোক।

লছমন সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়ল। অনিমেষ রিকশায় না ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা না করে মোটরবাইকে চেপে বেরিয়ে গেলেন ভোম্বলবাবু।

রিকশা চালাতে চালাতে লছমন বলল, উনি বাইক চালান, গাড়িতে ওঠেন না। গাড়ি চড়েন ওঁর ছেলে, বউ।

অনিমেষ গম্ভীর হয়ে বসে ছিল।

.

বাড়িতে ঢুকে অনিমেষ দেখল ছোটমা বারান্দায় বসে একটি বালকের সঙ্গে বেশ হাসিমুখে গল্প করছেন। অনিমেষকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হল? মুখ গম্ভীর কেন?

অনিমেষ মাথা নাড়ল। পেছন পেছন আসছিল লছমন। চেঁচিয়ে বলল, বাবা, বাবুকে প্রণাম কর।

বালক এগিয়ে এসে প্রণাম করতে চাইলে অনিমেষ তাকে বাধা দিল, না না। প্রণাম করতে হবে না। তুমি কে?

লছমন পাশে এসে বলল, আমার ছেলে। মাসিমা ওকে খুব ভালবাসেন।

ছোটমা বললেন, লক্ষ্মী ছেলে। আমার কথা খুব শোনে। আয় বাবা।

তোমার নাম কী?

অর্জুন। ডাকনাম, বাবা। বালক বলল।

বাঃ। এরকম ডাকনাম তো কখনও শুনিনি।

জন্মাবার পরে ওকে বাবা বলে ডাকা শুরু হয়। সেটাই ওর ডাকনাম হয়ে গেছে। লছমন বলল। আঁচলের খুঁট থেকে এক টাকার কয়েন বের করে বাবার হাতে দিয়ে ছোটমা বললেন, লজেন্স কিনে খাস।

আপত্তি করল লছমন, না না দেবেন না। অভ্যেস খারাপ হবে।

তুমি চুপ করো। ধমক দিলেন ছোটমা, যা বাবা। সন্ধে হয়ে আসছে। বাড়ি গিয়ে পড়তে বস। লছমন, অন্ধকার হয়ে আসছে, তুমি ওর সঙ্গে যাও।

লছমন ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেলে মাধবীলতা ঘর থেকে বেরিয়ে এল, কী হল?

সংক্ষেপে ভোম্বলবাবুর বক্তব্য জানাল অনিমেষ।

মাধবীলতা বলল, সেকী? পার্টির অবস্থা এখানে এইরকম হয়েছে?

এখানে? রেগে গেল অনিমেষ, কোথায় নয়? কলকাতায় দেখোনি? আমাদের পাড়ায় ভোম্বলবাবু নেই?

কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে যিনি ভোটে লড়াই করেন তিনি কালীবাড়ির জন্যে চাপ দিয়ে টাকা তুলবেন? এক পয়সা দেবে না ওঁকে। বেশ জোরে কথাগুলো বলল মাধবীলতা।

আমি কি দিতে চাইছি? কিন্তু এমনভাবে জাল বিছিয়ে রেখেছে যে তা কেটে বাড়ি বিক্রি করা কতটা সম্ভব হবে তা জানি না। অনিমেষ বলল।

এই যে পার্টির জেলা সম্পাদক, একে তুমি চেনো?

এককালে চিনতাম। বারীনদার স্টুডিয়োতে আসতেন।

ওঁর সঙ্গে কথা বলবে?

দেখি, ওঁর মদত না পেলে ভোম্বলবাবু এত সাহস পাবে?

তোমার সঙ্গে কথা বললে ভদ্রলোকের মন বদলাতে পারে।

কী জানি! ছোটমা এতক্ষণ শুনছিলেন, বললেন, থাক। এত ঝামেলা হচ্ছে যখন তখন বাড়ি আর বিক্রি করতে হবে না। আমি এখানেই মরব। ওই লছমন আছে, বাবাও আসে, ওরা নিশ্চয়ই আমাকে শ্মশানে নিয়ে যাবে।
 
মাধবীলতা ধমক দিল, পাগলের মতো কী যা তা বলছেন?

মা, তুমি এখানে আমার মতো মাস দুয়েক থেকে দেখো, তুমিও পাগল হয়ে যাবে। ছোটমা আঁচলে মুখ মুছলেন।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, এই বাড়ির মিউনিসিপ্যাল ট্যাক্স দেওয়া হয় না?

হত। তোমার বাবা বেঁচে থাকতে নতুন করে ট্যাক্স চাইল। তোমার বাবা প্রতিবাদ করলেন, অন্যায়ভাবে বেশি ট্যাক্স চাওয়া হয়েছে। না কমালে ট্যাক্স দেবেন না। সেই যে বন্ধ হল, আর দেওয়া হয়নি। ছোটমা বললেন।

আগের রশিদগুলো আছে?

সব একটা ফাইলে তোমার বাবা রেখে গেছেন। প্রতিবাদের চিঠিও ওখানে আছে।

আমাকে দেখতে হবে।

মাধবীলতার মনে পড়ে গেল, ওহো! অর্ক ফোন করেছিল।

কী বলল?

আমরা এখানে কতদিন আছি জানতে চাইল।

কতদিন থাকব তা বলা সম্ভব নয়। আমি এর শেষ দেখতে চাই।

আমিও আন্দাজে বললাম, এখনই ফিরছি না। শুনে বলল, ও ছুটি নিয়ে কয়েকদিনের জন্যে এখানে আসতে পারে। মাধবীলতা বলল।

ছোটমা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, ওকে আসতে বলেছ তো?

মাধবীলতা হেসে উঠল, হ্যাঁ।

অনিমেষ ভিতরের ঘরে চলে গেলে ছোটমা বললেন, একটু বসো। মাধবীলতা একটা মোড়া টেনে বসল, কিছু বলবেন? হ্যাঁ। তোমরা তো বিয়ে করোনি, না সই করে, না মন্ত্র পড়ে। তাই তো?

হ্যাঁ। মাধবীলতা বলল।

ছেলে তো জানে।

জানে। কিন্তু মেনে নিয়েছে।

আমিও এর মধ্যে অন্যায় দেখিনি। তুমি অনির জন্যে যা করেছ তা কটা মন্ত্র পড়া, সই করা বউ স্বামীর জন্যে করে থাকে। কিন্তু! ছোটমা থামলেন।

কিন্তু কী?

তোমার শ্বশুরমশাই মানতে পারেননি। আমি তাকে অনেক বুঝিয়েছিলাম কিন্তু তিনি গোঁ ছাড়েননি। আর সেইজন্যে একটা অন্যায় করে গেছেন।

কী অন্যায়?

ছোটমা উঠে মাধবীলতার হাত ধরে বললেন, এসো। নিজের ঘরে ঢুকে আলমারি খুললেন ছোটমা। তারপর লকার থেকে একটা বড় খাম টেনে এনে স্ট্যাম্প পেপার সমেত তিনটি কাগজ বের করলেন। বললেন, যক্ষের মতো পাহারা দিয়ে যাচ্ছি। আজ মুক্তি চাই। এই উইলে তোমার শ্বশুর তার যাবতীয় সম্পত্তি আমাকে দিয়ে গেছেন। শর্ত দিয়েছেন, অনিকে কিছু দিতে পারব না। দেখো।

মাধবীলতা পড়ল। পড়ে হেসে ফেরত দিতেই ছোটমা দ্রুত উইলটাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করতে লাগলেন। মাধবীলতা চেঁচিয়ে উঠল, একী! কী করছেন আপনি?

.
 
উইলের ছোঁড়া টুকরোর কয়েকটা মেঝেতে পড়ে গিয়েছিল, মাধবীলতা সেগুলো তুলে ছোটমায়ের সামনে ধরতে তিনি সবগুলোই তার হাতে দিয়ে দিলেন।

মাধবীলতা বললেন, কাজটা আপনি ঠিক করলেন না।

এটা করতে চাই বলেই তোমাদের আসতে বলেছিলাম। আমি ঠিকই করেছি। করেননি তোমার শ্বশুরমশাই। আমি কে? ওঁর দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রী হিসেবে এই বাড়িতে এসেছিলাম। তারপর থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসে

আছি। একটুও ভাল লাগত না। ছোটমা বললেন।

এখন এগুলো নিয়ে কী করব?

পুড়িয়ে ফেলো, ছাই হয়ে যাক। বলেই তার মনে পড়ল, আর একটা কাজ করতে হবে। তিনি তো শুধু উইল করেই চুপ করে যাননি। উকিলকে দিয়ে কী সব করিয়েছেন। আমাকে কপি দিয়েছেন। আসলটা আছে উকিলের কাছে। অনিকে ডাকো তো! ছোটমা ঘরের বাইরে এসে বারান্দার আলো জ্বেলে মোড়ায় বসলেন।

মাধবীলতা শঙ্কিত হল, আমার মনে হয় উইল ছেঁড়ার কথা ওকে না বলাই ভালো।

কেন? ছোটমা তাকালেন।

ও মানতে পারবে বলে মনে হয় না।

আমি যা ভাল মনে করেছি তাই করেছি। বেশ জোরে কথাগুলো বললেন।

ডাকতে হল না মাধবীলতাকে, অনিমেষ বেরিয়ে এল ঘর থেকে। জিজ্ঞাসা করল, নেলকাটার আনোনি?

মাধবীলতা কিছু বলার আগেই ছোটমা বললেন, সন্ধের পর নখ কাটতে হবে না। কাল সকালে কেটো। তুমি একটু এখানে এসো, কথা আছে।

কাছে এসে অনিমেষ মাধবীলতার দিকে তাকাতেই লক্ষ করল তার দুটো হাত একত্রিত, সেখানে কিছু কাগজের টুকরো রয়েছে। সে ইশারায় জিজ্ঞাসা করল, ওসব কী? মাধবীলতা মাথা নাড়ল, ঠিক কী বোঝাতে চাইল তা বোঝা গেল না।

অনি। তুমি কি রায়বাবুকে চিনতে? ছোটমা জিজ্ঞাসা করলেন।

কোন রায়বাবু?

ওকালতি করেন। বাবুপাড়ায় থাকেন। তার বাবাও ওকালতি করতেন।

অনিমেষ মনে করার চেষ্টা করল। ঝাপসা মনে পড়ল যাঁর কথা, তার মুখ অস্পষ্ট। সে জিজ্ঞাসা করল, ঠিক কোথায় থাকেন?

আমি জানি না। তোমার বাবা যেতেন। তিনি যখন বেঁচে ছিলেন তখন ভদ্রলোক একবার এই বাড়িতে এসেছিলেন। ছোটমা বললেন।

কোনও দরকার আছে তার সঙ্গে?

হ্যাঁ, ছোটমা বললেন, তোমার বাবার করা উইলের কপিটা তার কাছ থেকে নিয়ে আসবে। বাবুপাড়ার সবাই রায় উকিলকে চেনে।

অনিমেষ হাসল, তিনি আমাকে দেবেন কেন?

আমি একটা চিঠি লিখে দেব। সেটা তাকে দিলে না দেওয়ার তো কোনও কারণ নেই। তোমার বাবা বলতেন ওঁর কাছে সকাল আটটায় যেতে হয়। তারপর নাকি কোর্টের জন্যে তৈরি হন। তুমি ওই সময়েই যেয়ো।

.

কথা শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন ছোটমা।

কিন্তু উইলটা কী জন্যে দরকার?

আমার দরকার আছে। তুমি যেতে না পারলে আমাকেই যেতে হবে। ছোটমা নিজের ঘরে চলে গেলে মাধবীলতা বলল, ঘরে চলো।

ঘরে ঢুকে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার বলো তো?

মাধবীলতা উইলের টুকরো কাগজগুলো টেবিলের ওপর রাখল।

ওগুলো কী?

এখন বাতিল কাগজ।

আঃ, হেঁয়ালি করছ কেন? মাধবীলতা ঘুরে দাঁড়াল, তোমার বাবা নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী একটা উইল করে গিয়েছেন। তাতে তিনি যাঁকে তার সম্পত্তি দিতে চান তাঁকেই দিয়ে গেছেন। কিন্তু যাঁকে দিয়েছিলেন তিনি ওটা মেনে নিতে পারেননি। তিনি সেই উইলটা ছিঁড়ে ফেলেছেন, এগুলো তার টুকরো।

ছোটমা তোমার সামনে কাজটা করলেন?

হ্যাঁ। মাধবীলতা মাথা নাড়ল।

আর তুমি সেটা চেয়ে চেয়ে দেখলে?
 
আমি আপত্তি করেছিলাম, উনি শোনেননি। ওঁর মনে হয়েছে এই সম্পত্তির অধিকার পাওয়ার যোগ্যতা ওঁর নেই। আমি অবাক হয়ে গিয়েছি। গোটা পৃথিবী জুড়ে যখন মানুষ কিছু পাওয়ার জন্যে লালায়িত হয়ে আছে তখন এই অসহায় মহিলা কী অবলীলায় অন্তত কুড়ি লাখ টাকার সম্পত্তি প্রত্যাখ্যান করলেন। ওঁর সম্পর্কে আমার শ্রদ্ধা অনেক বেড়ে গেল। মাধবীলতা খাটের ওপর বসল।

বাবা যদি আমাকে কিছু দিতে না চেয়ে থাকেন তো ঠিক মনে করেই করেছেন।

হ্যাঁ। কিন্তু তার কারণ তুমি নও, আমি।

তুমি?

আমাকে তোমার স্ত্রী হিসেবে তিনি গ্রহণ করতে পারেননি।

তাতে আমাদের তো কিছু এসে যায়নি!

যায়নি। কিন্তু ছোটমার মন মানেনি। উনি আমাদের এখানে আসার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। মাধবীলতা বলল।

এখন কী চাইছেন ছোটমা?

আমাকে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি।

আমি কিন্তু এসবের মধ্যে নেই। অনিমেষ মাথা নাড়ল।

আমার কিছু বলার নেই। তোমার যেটা করতে ইচ্ছে হবে সেটাই করবে। কিন্তু কাল মিস্টার রায়ের বাড়িতে যেয়ো। মাধবীলতা বলল।

আমার যেতে ইচ্ছে করছে না লতা।

ভেবে দেখো। ওঁর যা শরীরের অবস্থা–!

বেশ। যাব। উইলটা যদি ভদ্রলোক দেন, এনে দেব। কিন্তু আমি যে এসবের মধ্যে নেই তা ওঁকে জানিয়ে দেব। অনিমেষ বলল।

.

লছমনের দেখা পাওয়া গেল না। টাউন ক্লাবের মোড় থেকে অন্য একজনের রিকশা নিল অনিমেষ। এখন সকাল পৌনে আটটা। আজ বাজারে যাওয়ার ঝামেলা নেই।

আগে করলা নদীর ওপর ঝুলনা ব্রিজ ছিল। সেটা ভেঙে অনেকদিন আগেই কংক্রিটের সেতু তৈরি হয়েছে। সেই সেতুর ওপর রিকশা উঠতেই মন খারাপ হয়ে গেল অনিমেষের। এখন করলাকে আর নদী বলা যাবে না। এমনকী খালও নয়। মজে গিয়ে জল না থাকলে নয় এমন অবস্থায় স্থির হয়ে আছে। আগে মানুষ জাল ফেলে মাছ ধরত, করলার বুকে নৌকো চলত, বিজয়াদশমীর রাত্রে তো প্রতিমা নিয়ে প্রচুর নৌকো উৎসবটাকে আরও সুন্দর করে তুলত। এখন সেসব উধাও। দেখলেই মন খারাপ হয়ে যায়। করলার পাশ ধরে থানাকে ডানদিকে রেখে অনিমেষ বাঁদিকে ঘুরতেই লম্বা লোকটিকে দেখতে পেল। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।



এই মানুষটির চেহারার পরিবর্তন তেমন হয়নি। শুধু বয়সের ছাপ পড়েছে। অনিমেষ চিনতে পারল। সে যখন স্কুলের শেষ ধাপে এবং তারপরে কলেজের ছাত্র তখন এই মানুষটি টাউন ক্লাব দলের গোলকিপার ছিলেন। দারুণ খেলতেন তখন।

রিকশাওয়ালাকে একটু থামতে বলে অর্জুন গলা তুলল, কেমন আছেন সন্তুদা?

ভদ্রলোক তাকালেন। বোঝাই যাচ্ছিল, চিনতে পারছেন না। বললেন, ঠিক–!

আপনার সঙ্গে বহু বছর আগে কয়েকবার কথা হয়েছিল। আপনার খেলা দেখতে খুব ভাল লাগত তখন। আমি অনিমেষ, অনিমেষ মিত্র, একসময় হাকিমপাড়ায় থাকতাম। অনেকদিন ধরে কলকাতায় আছি। অনিমেষ বলল।

অনিমেষ! দাঁড়ান দাঁড়ান, আপনি কি রাজনীতি করতেন? নকশাল রাজনীতি? সন্তুবাবু মনে পড়ার ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করলেন।

কিছুদিন ওই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। তারপর পুলিশ। হেসে নিজের পা দেখিয়ে দিল অনিমেষ।

আমি আপনার কথা শুনেছি। কোথায় কার কাছে শুনেছি জানেন? চৌধুরী মেডিক্যাল স্টোর্সের রামবাবুর কাছ থেকে। উনি আপনাকে খুব স্নেহ করেন।

ঠিকই।

কবে এসেছেন?

এই তো সবে।

আপনাদের বাড়ি তো হাকিমপাড়ায়-?

হ্যাঁ।

আচ্ছা, শুনেছি এখন যাঁরা সিপিএমের মন্ত্রী, নেতা তারা একসময় আপনার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। আপনিও তখন সিপিএম করতেন। এখন আপশোস হয় না?

কীসের আপশোস? কোনও আপশোস নেই। আচ্ছা, আপনাদের পাড়ায় মিস্টার রায়, যিনি ওকালতি করেন, কোথায় থাকেন? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

বলাইদা। সোজা যান। এস পি রায়ের বাড়ির আগে ডান দিকের গলিতে ঢুকে দেখবেন গেটে ওঁর নাম লেখা আছে। সন্তুবাবু বললেন।

থ্যাঙ্ক ইউ। মাথা নেড়ে অনিমেষ রিকশাওয়ালাকে চলতে বলল।
 
বাড়িটাকে খুঁজে পেতে এবার আর অসুবিধে হল না। রিকশাওয়ালার সাহায্য নিয়ে অনিমেষ রিকশা থেকে নেমে গেট খুলে এগিয়ে গেল ক্রাচ নিয়ে। বাইরের ঘরে অন্তত জনা আটেক মানুষ অপেক্ষা করছেন। পাশের ঘরের দরজায় পরদা রয়েছে। অতএব অনিমেষকে বসতে হল। সাড়ে আটটার মধ্যে যাঁরা ভেতরে যেতে পেলেন তার সমান সংখ্যার মানুষ বাইরে বসে থাকলেন। সাড়ে আটটায় বেরিয়ে এলেন শ্রীযুক্ত বলাই রায়। মাথায় টাক, আশির আশেপাশে বয়স। সামনে দাঁড়িয়ে বলাইবাবু বললেন, জরুরি দরকার মনে করলে কোর্টে আসুন। আজ একটা থেকে দেড়টা ফাঁকা আছি। এখন আর কথা বলতে পারছি না।

বাকিরা মাথা নেড়ে মেনে নিলেও অনিমেষ বলল, একটা কথা বলতে পারি?

নিশ্চয়ই, বলুন।

অনিমেষ ছোটমায়ের লেখা চিঠি এগিয়ে দিল। ভদ্রলোক সেটা খুলে পড়লেন, আপনি অনিমেষবাবু, মহীতোষবাবুর ছেলে?

হ্যাঁ।

এই চিঠি মহীতোষবাবুর স্ত্রী লিখেছেন?

হ্যাঁ, চিঠিতে তিনি সেটা জানিয়েছেন।

কিছু মনে করবেন না। মহীতোষবাবুর স্ত্রীর হাতের লেখা আমি চিনি না। এই চিঠি যে তিনিই লিখেছেন তা বুঝব কী করে? বলাইবাবু হাসলেন।

মুশকিল হল, ওঁর পক্ষে আসা বেশ কষ্টকর ব্যাপার।

বুঝলাম। কিন্তু উইল নিয়ে তিনি কী করতে চান?

আমার জানা নেই।

দেখুন ভাই, মহীতোষবাবুর মৃত্যুর পরে আমি তার কাছে খবর পাঠিয়েছিলাম যাতে তিনি উইলের প্রবেট নিয়ে নেন। কিন্তু তখন তিনি রেসপন্ড করেননি।

আমি এসব কিছুই জানি না।

ঘড়ি দেখলেন বলাইবাবু, যদি ধরে নিই, চিঠিটা তিনিই লিখেছেন, তা হলে আপনাকে আমার কাছে পাঠানোটা বিস্ময়কর। কেন তা আপনাকে বলছি না। সেই জন্যে আমার মনে চিঠির জেনুইনিটি নিয়ে সন্দেহ জাগছে। মহীতোষবাবুর সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক ছিল। তাই আজ কোর্ট থেকে ফেরার সময় আমি নিজে ওঁর সঙ্গে দেখা করে কথা বলব। আচ্ছা, নমস্কার। একটানা কথাগুলো বলে বলাইবাবু ভেতরে চলে গেলেন। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকল অনিমেষ। তবে মনে হচ্ছিল বলাইবাবু যা বলেছেন তাতে একটুও অন্যায় নেই। যাকে উইলে কিছু দিতে নিষেধ করে যাওয়া হয়েছে তাকেই কেন উইলের অরিজিন্যাল কপি নিতে পাঠাবেন ছোটমা? বিশ্বাস করাটা তো সত্যি স্বাভাবিক নয়। রিকশাওয়ালাকে সিপিএমের জেলা সম্পাদক নৃপেনবাবুর কথা বলতেই সে মাথা নাড়ল, হ্যাঁ চিনি, চলুন। তবে ওখানে পৌঁছে ছেড়ে দেবেন।

কেন?

আপনি কখন ওঁর সঙ্গে কথা বলতে পারবেন তা ভগবানও জানেন না। আমি যদি ওয়েটিং চার্জ চাই তা হলে আপনি আর কত দেবেন। রিকশাওয়ালা বলল।

কদমতলা হয়ে শিল্পসমিতি পাড়ায় পৌঁছে একটি তিনতলা বাড়ির সামনে রিকশা পঁড় করিয়ে লোকটা বলল, আসুন বাবু, নামিয়ে দিচ্ছি।

ভাড়া নিয়ে রিকশাওয়ালা চলে গেলে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে বেশ অবাক হল। অন্তত জনা পঁচিশেক মানুষ বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এরা যে সবাই নৃপেনবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সে এগিয়ে কাছে যেতেই একটি ছেলে সামনে এসে বলল, এই নিন, আপনার নম্বর।

একটা কাগজ হাতে ধরিয়ে দিল ছেলেটা, তাতে লেখা সাতাশ।

আমার নম্বর সাতাশ? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

হ্যাঁ, আপনি হ্যাঁন্ডিক্যাপড লোক, তাই বলি, আজ চলে যান, দাদা ঘণ্টাখানেক পরে শিলিগুড়িতে চলে যাবেন, কলকাতা থেকে মন্ত্রী আসছেন।

তা হলে?

বুঝতেই পারছেন, এক ঘণ্টার মধ্যে আপনি চান্স পাবেন না।

ও। অনিমেষ ইতস্তত করল।

ছেলেটা বলল, এক কাজ করুন। কাল ভোর পাঁচটায় এসে লাইন দিন। তা হলে প্রথম দশজনের মধ্যে থাকতে পারবেন।
 
অনিমেষ মাথা নেড়ে ফিরে যাওয়ার জন্যে গেটের দিকে এগোতেই এক বৃদ্ধ গেট দিয়ে ঢুকে বললেন, চেনা লাগছে, অনিমেষ না?

হ্যাঁ। কিন্তু–!

আরে! আমাকে চিনতে পারছিস না? বারীনদার আড্ডায় যেতাম। তোর মনে নেই? এসি কলেজে পড়ার সময় নান্দীমুখ নামে একটা কাগজ বের করতাম। বারীনদা কভার আঁকতেন। তুই তো নকশাল হয়ে গিয়েছিলি, আমি ভাই তখন থেকেই সিপিএমেই আছি। আমি স্বপন।

যাক! তুই সিপিএমে এতদিন থেকেও আমাকে চিনতে পারছিস?

হাসল স্বপন, খোঁচা দিলি। আমি কিন্তু কোনওদিন কোনও পদে যাইনি। তাই সব জায়গায় যেতে পারি। নৃপেনদার সঙ্গে দেখা হয়েছে?

না। আজ আমার সাতাশ নম্বর। এরা বলছে কাল ভোর পাঁচটায় আসতে। অনিমেষ বলল।

তুই আয় আমার সঙ্গে।

স্বপন সাবলীলভাবে অনিমেষকে ভেতরে নিয়ে গেল। একেবারে নৃপেনবাবুর সামনে। তিনি তখন একজনকে বলছিলেন, না না, পুলিশের কাজে আমি ইন্টারফেয়ার করি না। আপনি দরকার হলে আদালতে যান।

স্বপন বলল, নৃপেনদা, একে চিনতে পারছেন? নৃপেনবাবুর যথেষ্ট বয়েস। হয়েছে কিন্তু চুল এখনও কালো। অনিমেষের মনে হল কালো রং ব্যবহার করেন উনি।

কে ভাই? আগে দেখেছি? নৃপেনবাবু বললেন।

আমি অনিমেষ মিত্র। অনিমেষ নমস্কার করল।

কিছুই স্বচ্ছ হল না। নৃপেনবাবু বললেন।

স্বপন বলল, অনিমেষ আগে আমাদের পার্টি করত। পরে নকশাল হয়।

ওরে বাব্বা। আপনি? আমার কাছে? নৃপেনবাবু চমকে উঠলেন।

.

নৃপেনদার যথেষ্ট বয়স হয়েছে কিন্তু দেখে বোঝা যায় না। অনিমেষ যখন স্কুলের শেষ পরীক্ষা দিচ্ছে তখন উনি কলেজ শেষ করে বেশ কয়েক বছর ধরে রাজনীতি করছেন। যেহেতু ওঁর বাবা কংগ্রেসের সমর্থক ছিলেন এবং নৃপেনদা তখন সিপিআই করতেন তাই তাকে নিয়ে শহরে আলোচনা হত।

আজ নৃপেনদার চেহারা দেখে অনিমেষের মনে হল উনি এখন বেশ ভাল আছেন।

অনিমেষ বলল, আপনার কাছে খুব জরুরি প্রয়োজনে এসেছি।

তা তো বুঝতেই পারছি। দেখো অনিমেষ, তুমি এককালে আমাদের সঙ্গে ছিলে, কী যে মতিভ্রম হল তোমার! শুনেছি জেল থেকে বেরুবার সময় তোমাকে আবার দলে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল যা তুমি প্রত্যাখ্যান করেছিলে। আরে, কত নকশাল তাত্ত্বিক আটাত্তর সালের পরে আমাদের সৌজন্যে সরকারি কলেজে চাকরি করেছে অথচ তুমি! যাক গে, প্রয়োজনটা কী, বলো!

এই শহরে আমাদের একটা বাড়ি আছে।

আরে বাবা জানি! তোমার দাদু আমার বাবার কাছে আসত।

ওই বাড়িটা আমরা বিক্রি করে দিতে চাইছি।

আমরা মানে?

আমার মা আর আমি।

তোমার আসল মা তো মারা গিয়েছেন?

অনিমেষ অবাক হল, নৃপেনদার স্মৃতিশক্তি দেখে। সে বলল, হ্যাঁ। ইনি খুব অসুস্থ, আর একা থাকতে পারছেন না। আমাদের পক্ষেও জলপাইগুড়িতে পার্মানেন্টলি থাকা সম্ভব নয়।

স্বাভাবিক। অসুবিধে হচ্ছে যখন তখন বিক্রি করে দাও।

দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

কেন?

আমাদের পাড়ার ভোম্বলবাবু বলছেন বিক্রি করতে হলে উনি যে কালীবাড়ি বানাবেন তার ফান্ডে বেশ কয়েক লক্ষ টাকা চাঁদা দিতে হবে।

অ। চোখ বন্ধ করলেন নৃপেনদা।

উনি একথাও বললেন, যে জমিতে মন্দির হবে সেখানে আপনাকে নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছেন।

হ্যাঁ হ্যাঁ এত করে বলল যে না গিয়ে পারিনি। আফটার অল, আমাদের পার্টির ছেলে!

আমার প্রশ্ন, মার্কসবাদী পার্টির সদস্য বা সমর্থক হয়ে কালীমন্দিরের জন্যে এত চাঁদা চাইছেন তা হলে আদর্শ বলে কি কিছু নেই?

প্রশ্ন শুনে খেপে গেলেন নৃপেনদা, আদর্শ? আদর্শ মানে কী? যার নড়ন চড়ন নেই? যুগ যুগ ধরে যাকে এক জায়গায় মাথায় নিয়ে থাকতে হবে? পরিবর্তিত পরিস্থিতি, বদলে যাওয়া সমাজব্যবস্থার সঙ্গে যদি আদর্শকে না মিশিয়ে দেওয়া হবে তা হলে তার জায়গা হবে ওয়েস্ট পেপার বক্সে। তা ছাড়া ওই কালীমন্দির হলে জনতাকে আরও কাছে পাওয়া যাবে। তাই না?

অবাক হওয়ার সীমা আর নেই, অনিমেষ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকল। তার দিকে তাকিয়ে নৃপেনদা বললেন, দেখো অনিমেষ আমিও তো প্রথম দিকে ক্লাস করেছি। যা শিখতাম তাই বক্তৃতায় বলতাম। কিন্তু একথাও তো

সত্যি, সাধারণ মানুষ আমাদের শিখে বলা অনেক শব্দের মানেই বুঝতে পারত না। আচ্ছা, ধরো বুর্জোয়া শব্দটির কথা। কজন সাধারণ কৃষক, শ্রমজীবী মানুষ এই শব্দটির মানে জানে? আমাদের মুখে শুনে শুনে তারা ভেবে নিয়েছে খুব খারাপ মানুষদের বুর্জোয়া বলা হয়। অর্থাৎ আমরা সাধারণ মানুষের কাছে যতই যেতে চাই, যতই তাদের হয়ে কাজ করি তারা আমাদের ভাষা পুরো বুঝতে পারে না। অন্তত অনেক কথা তো বটেই। সেটা কি উচিত? তাই মানুষের সহজ ভাষায় কথা বলাই উচিত। তাদের ভালোগার, তারা যাকে শ্রদ্ধা করে তাদের সম্মান জানালে ক্ষতির বদলে লাভ বেশি।
 
একটু চুপ করে থেকে নৃপেনদা বললেন, আমি ডোম্বলের সঙ্গে কথা বলব। কত টাকা চাঁদা দিতে বলেছে?

অঙ্কটা বলল অনিমেষ।

কততে তোমাদের বাড়ি বিক্রি হবে?

কুড়ি লাখ টাকার বেশি পাওয়া যাবে কিনা জানি না।

মাথা নাড়লেন নৃপেনদা, একটু বেশি চাইছে। ও কী বলছে?

এই টাকা শেষপর্যন্ত আমি পাব আর আমার টাকাটা পাওয়ার কথা নয়। তিরিশ বছর যখন আমার সঙ্গে বাড়ির কোনও সম্পর্ক নেই–।

অনিমেষকে থামিয়ে দিলেন নৃপেনদা। বাড়ি তুমি পাচ্ছ উত্তরাধিকারী হিসেবে। কিন্তু এটাও সত্যি তিরিশ বছর ধরে তুমি বাড়িটাকে যত্ন করা দূরের কথা কতটা দেখেছ তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। অবশ্য তুমি একা নও, তোমার সৎমাও সমানভাবে পাবেন। ঠিক আছে। আমি তোম্বলের সঙ্গে কথা বলব। ও যেন কোনও চাপ না দেয় তা দেখব। তবে তোমাদের সাধ্যমতো চাঁদা দিলে মন্দিরের কাজ দ্রুত শেষ হবে, মানুষের উপকারে লাগবে। ঠিক আছে?

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

আমাকে এখনই উঠতে হবে। ডি এম সাহেবের সঙ্গে মিটিং আছে। কোনও প্রয়োজন হলেই চলে এসো।

অনিমেষ উঠে দাঁড়াল, আজকে কপাল ভাল ছিল ওর সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল, তাই আপনার কাছে পৌঁছাতে পারলাম। শুনলাম ভোর পাঁচটার

সময় লাইন না দিলে আপনার সঙ্গে কথা বলা যাবে না।

কী করি বলো! শহরের মানুষের নানান সমস্যা, তারা দেখা করতে আসে। আমি যথেষ্ট কো-অপারেট করি! এক কাজ করো। সামনের টেবিল থেকে খবরের কাগজ টেনে নিয়ে তার একপাশের সাদা অংশে কিছু লিখে এগিয়ে দিলেন। অনিমেষ দেখল, ওটা টেলিফোন নাম্বার।

নৃপেনদা বললেন, খুব জরুরি হলে আমাকে ওই নাম্বারে ফোন কোরো। সকালে সাড়ে সাতটা থেকে আটটা আর রাত দশটা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে ফোন এলে কথা বলতে অসুবিধে হবে না আমার। আচ্ছা!

.

নৃপেনদার বাড়ি থেকে রিকশা নিয়ে কদমতলার মোড়ে আসতেই একটা দোকানের সামনে জগদীশবাবুকে দেখতে পেল অনিমেষ। দোকান বন্ধ করছে। কর্মচারী, তিনি লক্ষ রাখছেন। রিকশা দাঁড় করিয়ে অনিমেষ চেঁচিয়ে ডাকতেই তিনি দেখতে পেয়ে কাছে এলেন, ও আপনি! বলুন?

এবার খদ্দের এনে দিন। অনিমেষ বলল।

মানে? আপনাকে যে বলেছিলাম–।

মনে হচ্ছে সেই সমস্যার সমাধান হয়েছে। ভোম্বলবাবু মোটা টাকা চাদা চেয়েছিলেন, নৃপেনদা সেটা যাতে না দিতে হয় তা দেখবেন।

ওঁদের সঙ্গে কথা হয়েছে?

হ্যাঁ, আমি এখন নৃপেনবাবুর বাড়ি থেকেই আসছি।

আপনি তো কামাল করে দিলেন! একদিনের মধ্যে এই শহরে এই সাফল্য কেউ পায়নি। আপনি শিয়োর তো?

সেরকম আশ্বাস পেয়েছি।

তা হলে ঠিক আছে। ঘড়ি দেখলেন জগদীশবাবু। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি বাড়ি ফিরছেন?

হ্যাঁ।

আমি যদি মিনিট দশেকের জন্যে এখন যাই, মানে, বাড়িটাকে ভাল করে দেখে আসি তা হলে আপত্তি নেই তো? খদ্দেরদের তো বর্ণনা দিতে হবে।

জগদীশবাবু বললেন।

চলে আসুন, কোনও অসুবিধে নেই। রিকশায় উঠবেন?

না না। আমার দুচাকা আছে। সাইকেল।
 
জগদীশবাবু রিকশার পেছন পেছন সাইকেলে চেপে এলেন। বাড়ির ভিতর ঢুকে বাগান দেখে বললেন, বাঃ, প্রচুর গাছগাছালি, বেশ পরিষ্কার করে রাখা আছে। কতটা জমি?

বোধহয় এক বিঘে। অনিমেষ বলল, কাগজ দেখে ঠিক বলব।

ওতেই হবে। ওপাশেও তো বাড়ি আছে দেখছি!

আমাদের ভাড়াটেরা থাকেন।

উঠবেন তো?

মানে?

ভাড়াটে সমেত বাড়ি অনেকেই কিনতে চায় না। কিনলে দাম যথেষ্ট কমে যায়। পার্টি করে নাকি?

আমি জানি না। কথা বলতে হবে ওঁদের সঙ্গে।

বলুন। এটা জরুরি।

মাধবীলতা এসে দাঁড়িয়েছিল ভেতরের বারান্দায়। সদ্য স্নান সেরেছে। অনিমেষ অবাক হল, বহুকাল পরে মাধবীলতা হলুদ শাড়ি পরেছে। মাথায় হাতখোঁপা।

অনিমেষ জগদীশবাবুকে বলল, আমার স্ত্রী।

ও। নমস্কার, নমস্কার। এই অসময়ে কেউ বাড়িতে এলে যে বেশ অসুবিধে হয় তা আমি জানি। কটা ঘর আছে? জগদীশ জিজ্ঞাসা করলেন।

একটা বিশাল হলঘর ছাড়া সাতটা। বেশিরভাগ ঘরই তালাবন্দি। মাধবীলতা স্মিত মুখে বলল।

ব্যস। এতেই হবে। কোনও ফোন নাম্বার আছে?

মাধবীলতা নাম্বারটা বললে জগদীশবাবু নোট করে নিয়ে বললেন, আমিই ফোন করব। এই ধরুন, দিন তিনেকের মধ্যে। আচ্ছা, চলি।

জগদীশবাবুকে এগিয়ে দিয়ে এল অনিমেষ। বারান্দায় উঠতেই দেখল ছোটমা দাঁড়িয়ে আছেন মাধবীলতার পাশে। মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, কী হল?

অনিমেষ বিরক্ত গলায় বলল, এখন পার্টি কালীপূজা করবে, বলিও দেবে। কারণ পশ্চিমবাংলার মানুষ সেটাই চায়।

কী উলটোপালটা বলছ। উনি কী বললেন? মাধবীলতার কপালে ভাঁজ।

আমার অনুরোধ শোনার পর অনেক কথা বললেন নৃপেনবাবু। তারপর যেন একটু সদয় হলেন। বললেন, ভোম্বলবাবুকে বলে দেবেন যেন আমাদের ওপর চাপ না দেন। অনিমেষ জানাল।

যাক বাবা! ছোটমা কপালে দুটো হাত জোড় করে ঠেকালেন।

অনিমেষ হাসল, শুনে কী মনে হল জানো?

মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, কী?

হরিণের অনুরোধে বাঘ কথা দিয়েছে কয়েকদিন অম্বুবাচী করবে ফল খেয়ে। আমার খুব খিদে পেয়েছে। স্নান করে আসছি।

মাধবীলতার স্থির চোখের সামনে দিয়ে অনিমেষ চলে গেল।

.

বিকেলে ভাড়াটেদের সঙ্গে কথা বলতে গেল অনিমেষ। তাদের বাইরের ঘরের দরজায় পৌঁছাতেই বৃদ্ধ বেরিয়ে এলেন। অনিমেষ বলল, ছোটমার কাছে জানলাম আপনার নাম নিবারণবাবু। আমি অনিমেষ।

আচ্ছা, আসুন। বসুন। বসার ঘরের চেয়ার দেখিয়ে দিলেন তিনি।

চেয়ারে বসে অনিমেষ বলল, আমরা কয়েকদিন হল এসেছি।

হ্যাঁ। শুনলাম। কী করে পা ভাঙল? বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন।

পুলিশের কল্যাণে।

সে কী! পুলিশ মেরেছে? কেন মারল?

এমন কিছু বড় ঘটনা নয়। আমি আপনার কাছে এসেছি একটি জরুরি কথা বলতে। আপনি জানেন এই বাড়িতে আমার মা একাই থাকেন। কিন্তু তার বয়স হচ্ছে। শরীরও খারাপ। আর তার পক্ষে একা থাকা সম্ভব নয়।

আপনারা এসে থাকবেন?

সেটাও তো আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। যত্ন নেওয়ার কেউ না থাকায় বাড়ির অবস্থাও ভাল নেই। অনিমেষ বলল।

হ্যাঁ। আমাদের রান্নাঘরে জল পড়ছিল, সারিয়ে নিতে হয়েছে। বৃদ্ধ বললেন।

ও। মা চাইছেন, আমরাও একমত, বাড়িটা বিক্রি করে দিতে। এর জন্যে তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। তিনমাস সময় পাবেন। এর মধ্যে যদি অন্য বাড়িতে উঠে যান তা হলে ভাল হয়। অনিমেষ বলল।

অন্য কোথায় উঠে যাব ভাই! এতদিন এই বাড়িতে ভাড়া নিয়ে আছি। এখন নতুন জায়গায় ভাড়া নিতে গেলে যে টাকা চাইবে তা দেওয়ার সামর্থ্য তো আমাদের নেই। বৃদ্ধ বললেন।

কিন্তু ভাড়াটে হয়ে কারও বাড়িতে সারাজীবন কি থাকা যায়?

একথা কখনও ভাবিনি। তা ছাড়া আপনার মাকে জিজ্ঞাসা করে দেখুন, প্রতি মাসের ঠিক সময়ে তাঁকে ভাড়া দিয়ে গেছি কিনা! উনি একবার খুব অসুস্থ হয়ে ঘরেই পড়ে ছিলেন, আমার ছোটবউমা গিয়ে দিনরাত সেবা করে তাকে দাঁড় করিয়েছে। এসবের কোনও মূল্য নেই ভাই? বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন।

নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু বাড়ি বিক্রি করার সময় এই অংশ তো বাদ যাবে না। যিনি কিনবেন তিনি পুরোটাই নেবেন। অনিমেষ বলল।

আপনি তাদের বলুন ভাড়াটে হিসেবে আমাদের রেখে দিতে।

নিশ্চয়ই বলব। কিন্তু তিনি যদি রাজি না হন–!

তা হলে আপনি আমাদের এরকম বাড়ি এই ভাড়ায় দেখে দিন। উঠে যাব।

আমি কোথায় যাব বাড়ি খুঁজতে?

আপনি আমাদের এই অংশের জন্যে টাকা পাবেন, পাবেন তো?

হ্যাঁ।

নিজে খুঁজে দিতে না পারেন, এই অংশের মূল্য থেকে কিছু আমাদের দিন, আমরা তার সঙ্গে বাড়তি ভাড়া দিয়ে অন্যত্র উঠে যাব। বৃদ্ধ বললেন।

ঠিক আছে। ভেবে দেখি। অনিমেষ উঠে দাঁড়াল ক্রাচে ভর রেখে।

আচ্ছা, উঠছেন কেন? চা খাবেন না?

না।

এই প্রথম এখানে এলেন–!

এই প্রথম নয়। এই অংশের বাড়িতে আমি বাল্যকালে এসে থেকে গিয়েছিলাম। এর প্রতিটি ইট আমার চেনা। অনিমেষ বেরিয়ে এল।

.
 
গেটের কাছে আসতেই বাইকের আওয়াজ কানে এল। অনিমেষ বাঁদিক থেকে একটি মোটরবাইককে এগিয়ে আসতে দেখল। পাড়ায় দুদিকে যাওয়ার জন্যে অনেকেই শর্টকাট হিসেবে ব্যবহার করে এই রাস্তাটাকে কিন্তু বাইকটা সামনে এসে থামলে হেলমেট খুললেন চালক, অনিমেষ দেখল ভোম্বলবাবু হাসছেন।

আপনি? অনিমেষের মুখ থেকে বেরিয়ে এল।

আরে মশাই, আপনি কি নাবালক? রসিকতা বোঝেন না? হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করলেন ভোম্বলবাবু।

অনিমেষ দেখল কথা বলতে বলতে ভোম্বলবাবু গেট খুলে ভেতরে ঢুকলেন। তার বাইক বাইরেই রইল। কাছে এসে বললেন, আরে, আমি আপনার সঙ্গে রসিকতা করেছিলাম। আপনি সেটা সিরিয়াসলি নিয়ে নৃপেনদার কানে তুললেন। তার ফলে নৃপেনদা আমাকে ডেকে পাঠিয়ে হেভি ধমক দিলেন। অনিমেষের মুখ থেকে একটি আওয়াজ বের হল, ও!

মাসিমা আছেন তো? ভোম্বলবাবু জিজ্ঞাসা করলেন।

আছেন।

চলুন, এলাম যখন, তখন দেখা করে যাই।

দুই পা এগোতেই নিবারণবাবু বেরিয়ে এলেন বাইরে, দুটো হাত নমস্কারের ভঙ্গিতে ওপরে তুলে চেঁচিয়ে বললেন, এক মিনিট দাঁড়ান ভোম্বলবাবু–।

আবার কী হল? ভোম্বলবাবু চোখ ছোট করলেন। নিবারণবাবু কাছে এসে বললেন, এই ভদ্রলোক আমাদের খুব বিপদে ফেলে দিয়েছেন। বলছেন, বাড়ি বিক্রি করে দেবেন, তাই আমাদের উঠে যেতে হবে। এতদিন এখানে থাকলাম, হুট করে চলে যেতে বলাটা কি অত্যাচার নয়?

হুট করে চলে যাবেন কেন? এ তো আলু পটল বিক্রির মতো নয়। সময় লাগবে। ততদিনে বাড়ি খুঁজে নিন। ভোম্বলবাবু বললেন।

নতুন বাড়ি ভাড়া চাইলে এখন যা দিচ্ছি তার তিনগুণ দিতে হবে। কোথায় পাব অত টাকা! নিবারণবাবু হাত জোড় করেই থাকলেন।

আপনার ছেলে তো ডি এম-এর অফিসে চাকরি করে।

হ্যাঁ। সে আর কত মাইনে পায়। আমার পেনশনের টাকা দিয়ে–!

আপনাদের ফ্যামিলি মেম্বার কত?

সাতজন। ছোট ছেলের বিধবা বউটা তো বাপের বাড়ি ফিরে যায়নি।

বেশ করেছে। ভোম্বলবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, কত ভাড়া দেন?

দেড় হাজার টাকা।

হাসলেন ভোম্বলবাবু, বেশ সুখেই আছেন দেখছি।

ভোম্বলবাবু, আপনি আমাদের পাড়ার নেতা। বাড়ির সবাই আপনার পার্টিকেই ভোট দিই। আপনি যদি আমাদের না দেখেন কে দেখবে বলুন?

ভোম্বলবাবু কোনও কথা না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলেন।

নিবারণবাবু বললেন, আমার ছেলে বলছিল, সেনপাড়ার শেষে এরকম বাড়ির ভাড়া প্রায় চার হাজার টাকা। আমরা দেড় দিচ্ছি বাকিটা যদি ইনি দেন!

মানে? ভোম্বলবাবুও অবাক হলেন, কী বলতে চাইছেন?

উনি যদি বাড়ি বিক্রির টাকা থেকে তিন লক্ষ টাকা আমার নামে ব্যাঙ্কে ফিক্সড করে দেন তা হলে মাসে আড়াই হাজার সুদ পেয়ে যাব। তা হলে আর চিন্তা থাকবে না। দেড় প্লাস আড়াই মানে চার হয়ে যাবে।

আপনি তো ভাল অঙ্ক জানেন। ভোম্বলবাবু বললেন।

হেঁ হেঁ। স্কুল ফাইনালে লেটার পেয়েছিলাম।

ঠিক আছে আমরা পার্টিতে আলোচনা করে আপনাকে জানাব। চলুন অনিমেষবাবু।

ভেতরের বাগানের কাছে এসে ভোম্বলবাবু বললেন, লোকটা আপনাকে সমস্যায় ফেলবে। ম্যানেজ করবেন কীভাবে?

এখনও ভাবিনি। প্রস্তাবটা একটু আগে শুনলাম।

মুশকিল হল, পাবলিক সিমপ্যাথি পেয়ে যাবে তোকটা। তা ছাড়া পার্টি থেকে বলা হয়েছে, বাড়িওয়ালা ভাড়াটের ঝগড়ায় আমরা যেন না ঢুকি। ব্যাপারটা আপনার পক্ষে কঠিন হয়ে গেল। দেখুন, কেউ ভাড়াটে সমেত বাড়িটাকে কেনে কি না। তারপর তার হেডেক। বলতে বলতে বারান্দায় উঠে পড়লেন ভোম্বলবাবু। চারপাশে তাকিয়ে চেঁচিয়ে ডাকলেন, মাসিমা, ও মাসিমা, কোথায়?

ছোটমা বেরিয়ে এলেন তার ঘর থেকে, অর্ধেক মাথা ঘোমটায় ঢাকা।

নমস্কারের ভঙ্গিতে দুটো হাত এক করে ভোম্বলবাবু বললেন, আমাকে চিনতে পারছেন তো? আমি ভোম্বল।

ছোটমা মাথা নেড়ে নিঃশব্দে হ্যাঁ বললেন।

আপনার তো আর কোনও চিন্তা নেই। ছেলে, ছেলের বউ এসে গিয়েছে। কিন্তু আমার একটা দুঃখ হচ্ছে।

দুঃখ! ছোটমার মুখ থেকে শব্দটা বের হল।

হ্যাঁ। আপনারা তো বাড়ি বিক্রি করে আমাদের পাড়া ছেড়ে চলে যাবেন। অথচ এই পাড়ায় অনেক কষ্ট করে আমরা কালীবাড়ি করছি, আপনার মতো ধর্মপ্রাণ মানুষকে সঙ্গে পেলে জোর বাড়ত। দুঃখ সেই কারণে।
 
ভোম্বলবাবুর কথা শুনে অনিমেষের মনে হল একটি আধবুড়ো দামড়া খোকা সাজতে চাইছে।

তা আমি অনিমেষবাবুকে রসিকতা করে বলেছিলাম চাদা দিতে। উনি যা ইচ্ছে দেবেন আমরা মাথা পেতে নেব। চাদা তো জোরজুলুম করে চাওয়ার ব্যাপার নয়। শুনেছি আপনি রোজ পুজো করেন। আপনি ব্যাপারটা বুঝবেন। তা আপনার বউমা কোথায়? তার সঙ্গে একটু কথা বলে যাই। ভোম্বলবাবু অকারণে হাসলেন।

অনিমেষের মনে হল কোনও প্রাণী এত দ্রুত রং পালটাতে পারে না।

মাধবীলতা অনেকক্ষণ তাদের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে সংলাপ শুনছিল। ছোটমা তাকে বললেন, ইনি আমাদের পাড়ার জনপ্রতিনিধি।

ভোম্বলবাবু ঘুরে তাকিয়ে মাধবীলতাকে দেখে বললেন, নমস্কার, নমস্কার। আপনি আর একবার এই বাড়িতে এসেছিলেন, তাই তো?

হ্যাঁ।

সব শুনেছি। খুব স্যাক্রিফাইস করেছেন। তা আপনিও কি নকশাল ছিলেন? ভোম্বলবাবু জিজ্ঞাসা করলেন।

না।

তা হলে? সিপিএম না কংগ্রেস? আমি রাজনীতি করিনি।

ভোট দেন তো? না।

সে কী। কেন?

ওটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।

তা বটে। এখন তো একজন মহিলা পশ্চিমবাংলার নেত্রী হওয়ার জন্যে ছটফট করছেন। ভাবছেন, সব মেয়েরাই ওঁকে সমর্থন করবে। কোনও আদর্শ নেই, শুধু আমাদের গালাগালি দিয়ে পাবলিককে ভোলাতে চাইছেন। হাস্যকর ব্যাপার। তা আপনি জলপাইগুড়ির দ্রষ্টব্যস্থানগুলো ঘুরে দেখেছেন?

সুযোগ এবং সময় হয়নি।

সময় বের করুন, আমি সুযোগ করে দেব। গোরুমারা, চাপড়ামারি, হলং ফরেস্ট দেখলে মন ভরে যাবে। আচ্ছা, চলি। মাসিমা, ভাল থাকবেন। চলি অনিমেষবাবু, কোনও চিন্তা করবেন না। একটা কথা জানবেন, সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুলটাকে একটু বেঁকা করতে হয়। সব বলে দেব। ভোম্বলবাবু নিজেই বেরিয়ে গেলেন। একটু পরেই বাইকের আওয়াজ কানে এল।

মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, লোকটা কেন এসেছিল?

জানি না, বলল মাসিমার সঙ্গে দেখা করে যাই।

এই লোক সুরেনবাবুর চেয়ে অনেক বেশি শয়তান। তোমাকে কাল টাকা দিতে বলেছিল যে সে আজ বলছে রসিকতা করেছে।

নৃপেনদার জন্যে।

ছোটমা বললেন, তিনিও যে অভিনয় করছেন না তা কে বলতে পারে। কিন্তু একটা কথা ঠিক, তুমি তো কোথাও বেড়াতে যাওনি। যাও না, নিজেরাই ঘুরে এসো।

মাধবীলতা হাসল, আপনি যদি সঙ্গে যান তা হলে যেতে পারি!

আমি? এই শরীর নিয়ে? মাথা নাড়লেন, আমার তো সব দেখা।

কী কী দেখেছেন?

ছোটমায়ের মুখটা করুণ হয়ে গেল। মাধবীলতা এগিয়ে এল, বাড়িটার বিক্রির ব্যবস্থা হয়ে যাক, তারপর আমরা সবাই বেড়াতে যাব। এর মধ্যে অর্কও এসে যাবে। ও তো কিছু দেখেনি।

ছোটমা কিছু না বলে ভেতরে চলে গেলেন।

অনিমেষ বলল, আমার তো মনে হয় বিয়ের পর স্বৰ্গছেঁড়ার কোয়ার্টার্সে ঢুকেছিলেন, বেড়াতে আসা বলতে এই জলপাইগুড়ির বাড়িতে। এর বাইরের কোনও কিছুই ওঁর দেখা হয়নি।

তুমি তো বলেছিলে ওঁর বাপের বাড়ি এই শহরেই?

হ্যাঁ।

তারা কেন ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি?

তাঁদের কেউ আছেন কি না তাই জানি না। ওঁকে জিজ্ঞাসা করো।

না। উনি নিজের থেকে বলেননি যখন তখন জানতে চাওয়া ঠিক হবে না। ঘরে যাও, আমি চা করছি। মাধবীলতা রান্নাঘরে চলে গেল।

.
 

Users who are viewing this thread

Back
Top