What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected মৌষলকাল - সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

পড়ানোর সময় দেখতাম অন্য মেয়েদের দিকে না তাকিয়ে আমার দিকে বেশি তাকাতেন। এই নিয়ে আমাকে ওরা খ্যাপাত। বলত স্যার তোর প্রেমে পড়ে গেছেন। আমি বিশ্বাস করতাম না। আমি তো মোটেই সুন্দরী নই। গায়ের রং শ্যামলা। ক্লাস টেনে আমার বাবা মারা যান। আমাদের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। দাদা তখন বি. এ. পড়ে। অনেক চেষ্টার পর বাবার অফিসে দাদার একটা চাকরি হওয়ায় আমরা উপবাস থেকে বেঁচে গেলাম। চাকরি পাওয়ার পর দাদা পালটে গেল। ও যা বলবে তা আমাদের শুনতে হত। স্কুল ফাইনালে আমার রেজাল্ট খারাপ হয়নি। পড়া বন্ধ করে বাড়ির কাজ করাতে চাইল মা। কিন্তু আমি রাজি হলাম না। টিউশানির টাকায় পড়তে চাইলাম। সেই সময়ে এই মাস্টারমশাই আমাকে খুব সাহায্য করতে লাগলেন। আমাকে আলাদা করে পড়তে সাহায্য করতেন। ফাইনাল পরীক্ষার পর দাদা আমার বিয়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠল। মা-ও ওকে সমর্থন করল। কিন্তু আমি কলেজে ভরতি হয়ে আরও পড়তে চাইছিলাম। দাদা তার বিরুদ্ধে। এইসময় মাস্টারমশাই আমাকে বাড়ি থেকে বের করে হাওড়ায় একটা ঘর ভাড়া করে রাখলেন। মা-দাদা দুজনেই জানিয়ে দিল যে তারা আর আমার মুখ দর্শন করবে না। সুজাতা চোখ বন্ধ করল।

তারপর? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।

আমি কলেজে ভরতি হলাম। নিজে রান্না করে খেয়ে কলেজে যাই। দুবেলা ছেলেমেয়ে পড়াই। তাতেও কুলায় না। মাস্টারমশাই সাহায্য করেন। কখন যে তাঁর প্রেমে পড়ে গেলাম জানি না। তিনি আমার সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর মতো ব্যবহার করতে লাগলেন কিন্তু কখনওই রাতে থাকতেন না। যেখানে থাকতাম সেই অঞ্চলটা বিহারি শ্রমিকদের এলাকা বলে কেউ ওঁর আসা যাওয়া নিয়ে আপত্তি করত না। কিছুদিন পরে আমি তাকে বিয়ের কথা বললাম। শুনেই খুব রেগে গেলেন। বললেন, আমাদের দুজনের বয়েসের অনেক পার্থক্য, বিয়ে করলে লোকে হাসাহাসি করবে। অথবা, আমাকে বিয়ে করলে ওঁর মা-ভাই-বোন প্রচণ্ড দুঃখ পাবে। ঝগড়া শুরু হয়ে যেত উনি এলেই। তখন, এক বিকেলে তিনি মদের বোতল নিয়ে এলেন। ঘরে বসে অনেকটা মদ খেয়ে গায়ের জোরে সাধ মিটিয়ে চলে গেলেন। আমার খুব ঘেন্না করতে লাগল এবং এটাই চালু হয়ে গেল। আমি ওঁর টাকা নেওয়া বন্ধ করলাম। আধপেটা খেয়ে থাকতাম। ছেলেবেলা থেকে আমার লেখালেখির শখ ছিল। তখন সময় কাটাতে যা মনে আসে তা লিখতাম। ওর বিরুদ্ধেও কত কথা লিখেছি। একদিন সেই লেখা হাতে পেয়ে আমাকে খুব মারলেন মদ খাওয়ার পরে।

তার পরদিন তিনি এলেন না। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তারপরে অনেকদিন তার দেখা পেলাম না। আমার হাতে তখন একটা টাকাও নেই। টিউশনিগুলো কী কারণে জানি না হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল। আমার পাশের ঘরে একজন বয়স্ক বিহারি মুসলমান থাকতেন। তাকে চাচা বলতাম। তার স্ত্রীকে চাচি। চাচি আমার অবস্থা বুঝতে পেরে চাচাকে বললেন কিছু একটা করতে। চাচা আমাকে নিয়ে গেলেন একটা কারখানায়। সেখানে তিনি কাজ করেন। চাচার অনুরোধ সত্ত্বেও মালিক প্রথমে রাজি হচ্ছিল

চাকরি দিতে। শেষ পর্যন্ত অন্য একটা কারখানায় চাচা আমাকে কাজ পাইয়ে দিলেন। মাল বইতে হত, ঝাড় দিতে হত। প্রতিদিন দশ ঘণ্টা কাজ করলে ষাট টাকা পাওয়া যেত। না করলে টাকা পাওয়া যেত না। মাসে পনেরোশো টাকার মতো হত। ঘরভাড়া দিয়ে দুবেলা খেতে পারতাম। কিন্তু অতবড় কারখানায় আমি একমাত্র মেয়ে, কর্মচারীদের বেশিরভাগই বিহারি। খুব অসুবিধে হত। আমার সঙ্গে অশ্লীল কথা বলার চেষ্টা করত। মালিককে বললে শুনতে হত, এই জন্যেই আমি মেয়েমানুষ রাখতে চাইনি। কাজ ছেড়ে দাও।

একমাস কাজ করে ছেড়ে দিলাম। একজন শ্রমিক আমাকে কুপ্রস্তাব দিয়েছিল। তখন আর একটা কারখানায় কাজ খুঁজে নিলাম। এই সময় মাস্টারমশাই উদয় হলেন। বললেন, বাড়ির চাপে বিয়ে করতে হল বলে এতকাল আসতে পারিনি। এখন থেকে আসব।
 
আমি চিৎকার করলে পাশের ঘরের চাচা-চাচি থেকে অন্যান্যরা ছুটে এলেন। তাঁরা মাস্টারমশাইকে শাসালেন, আমার ওপর অত্যাচার করলে ভবিষ্যতে ছেড়ে দেবেন না। মাস্টারমশাই আমাকে হুমকি দিয়ে চলে গেলেও পরের দিন ফিরে এসে জানালেন, আর আমি তোমাকে কিছু বলব না, শুধু বসে বসে কাজ করে চলে যাব।

আমি আর পারলাম না। যে কারখানায় কাজ করতাম সেখানকার একজন এই বস্তির ঘরের খবরটা দিল। আমি পালিয়ে এলাম এখানে। কিন্তু শনি আমাকে ছাড়ল না। ঠিক এই ঠিকানার খোঁজ পেয়ে গেল। তার নাকি বউয়ের চেয়ে আমাকে বেশি ভাল লাগে। কারখানার বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে এসব কথা শোনায় আমাকে। সুজাতা চুপ করল।

আজ এখানে আসবে বলেছে? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।

হ্যাঁ।

তুমি বসো। মাধবীলতা উঠে পড়ল। পাশের ঘরের চেয়ারে বসে অনিমেষ তখন কিছুর হিসেব লিখছিল, মাধবীলতা ঘরে ঢুকে বলল, এখন সুরেন মাইতিকে পাওয়া যাবে?

সে কী? তাকে কী দরকার? মুখ তুলল অনিমেষ।

সুজাতাকে যন্ত্রণা দিতে একটা লোক এখানে আসবে। লোকটা যাতে আর না আসে তার ব্যবস্থা করতে হবে। সুরেন মাইতি সেটা পারবে। মাধবীলতা বলল।

মাথা নাড়ল অনিমেষ, তুমি আমাকে সুরেন মাইতির সাহায্য চাইতে বোলো না।

অনিমেষের মুখের দিকে তাকিয়ে মাধবীলতা হেসে ফেলল।

আমি কি হাস্যকর কিছু বললাম? অনিমেষ বিরক্ত হল।

তুমি এখনও মৌলবাদী রয়ে গেছ।

আমি? মৌলবাদী? অবাক হয়ে গেল অনিমেষ।

নয়তো কী? ধর্ম এবং রাজনীতি নিয়ে যারা গোঁড়ামি করে তাদেরই তো মৌলবাদী বলা হয়, তাই না? সেই কবে কমিউনিজমের মন্দিরে ঢুকেছিলে, বেরুনো দূরের কথা, দরজা জানলাগুলো খুলতে চাইছ না। এদিকে পৃথিবীর আবহাওয়া কত বদলে গিয়েছে তা জেনেও চোখ খুলছ না। আবার দ্যাখো, এই তুমি রোজগার করতে পারছ না এই আক্ষেপে রেসের পেনসিলার হতে চেয়েছিলে। তখন ওই কাজটাকে সর্বহারার শ্রম বলে ভেবেছিলে। মাধবীলতা ধীরে ধীরে বলল।

এত কথা বলছ কেন?

সুরেন মাইতিকে তুমি সহ্য করতে পারছ না। কমিউনিস্ট পার্টির নীচতলার এক নেতা হয়ে সে ক্ষমতার অপব্যবহার করছে। যে কারণে তুমি বা তোমরা পার্টি ছেড়ে দিয়েছিলে বহু বছর আগে। অথচ সেই সুরেন মাইতির সঙ্গে দেখা হতে তোমাকে পাঁচ মিনিট ক্রাচ হাতে দাঁড়িয়ে কথা শুনতে হয়। উত্তর দাও। তাকে এড়িয়ে চলে আসতে পারো না। কিন্তু একটা ভাল কাজের জন্যেও সুরেন মাইতিকে অনুরোধ করতে গেলে তোমার মনে থেকে যাওয়া কমিউনিজমের অভিমান বড় হয়ে ওঠে। মাধবীলতা বলল, থাক, তোমাকে বলতে হবে না। আমিই যাব।

অনিমেষ বলল, আমি বুঝতে পারছি না, এসব ঝামেলায় না গিয়ে মেয়েটাকে আমাদের কাছেই থাকতে বলল। লোকটা এসে দরজা বন্ধ দেখে নিশ্চয়ই দাঁড়িয়ে থাকবে না।

আজ থাকবে না, কাল কী করবে সুজাতা? পরশু? মাধবীলতা বলল, ভালবাসার জন্য অনেক মাশুল দিয়েছে মেয়েটা। তুমি কখনও ভেবেছ, একটা মোটামুটি শিক্ষিত মেয়ে দুটো ভাতের জন্যে কারখানায় চাকরি করছে? কী চাকরি? না, মাথায় করে মাল বইছে আর তার চারপাশের পুরুষ শ্রমিকগুলো সারাক্ষণ লোভী চোখে ওর শরীর গিলছে। আমি আসছি।

চুলে চিরুনি বোলাতে গিয়ে বিরক্ত হল মাধবীলতা। তার চুলে এখনও অনিমেষের মতো সাদা ছড়িয়ে পড়েনি বটে কিন্তু অনেক পাতলা হয়ে গিয়েছে। আয়নার সামনে এসে নিজের মাথার দিকে তাকালেই মন বিরক্ত হয়।
 
উঠোনের দরজা টেনে দিয়ে মাধবীলতা দ্রুত গলি দিয়ে হেঁটে বস্তির বাইরে বেরিয়ে এল। যখন প্রথম এই বস্তিতে এসেছিল, তখন যারা সদ্য জন্মেছিল তাদের চেহারা এখন প্রৌঢ়ের হয়ে গিয়েছে। যারা এখন তরুণ অথবা যুবক, পাড়ার রকগুলো যাদের দখলে, তারা কোনও কারণ ছাড়াই তাকে কিছুটা সমীহ করে। খিস্তি খেউড় করার সময় তাকে দেখলে চুপ করে যায়। অবশ্য অর্কও একটা কারণ হতে পারে। অর্কর পরিকল্পনায় যে এই বস্তিতে কমিউনিটি কিচেন করার চেষ্টা হয়েছিল তা বাবা মায়ের মুখে ওরা শুনেছে। এই বস্তির মানুষের জন্যে কাজ করতে গিয়ে অর্ক পুলিশের আক্রোশের শিকার হয়েছিল, তিনমাস পরে ছাড়া পেয়েছিল, এই ঘটনাগুলো ওদের জানা। ওদের একজন

এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, মাসিমা, কাউকে খুঁজছেন?

ছেলেটিকে দেখল মাধবীলতা। পা থেকে মাথা পর্যন্ত অসভ্যতা মাখানো। সাত-আটটা পকেট জিনসে, হাঁটুর কাছে সযত্নে ছিঁড়েছে, গায়ে ডোরাকাটা গেঞ্জি।

মাধবীলতা বলল, হ্যাঁ। তোমরা কি এখানে অনেকক্ষণ আছ?

হ্যাঁ। সেই দুপুর থেকে।

সুরেনবাবুকে দেখেছ?

সুরেনদা এইমাত্র বাসায় ঢুকল। ডেকে দেব? ছেলেটি জিজ্ঞাসা করল।

যদি ওর কোনও অসুবিধে না থাকে!

আপনি আসুন–! ছেলেটি এগিয়ে গেল।

বস্তির একপাশে সুরেন মাইতিদের টালির বাড়ি ছিল আশি সাল পর্যন্ত। ওঁর বাবা এই অঞ্চলের কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় কর্মী হওয়ার পর সেই বাড়ি ভেঙে ছাদ ঢালাই করে একতলা বানিয়েছিলেন। বাবার মৃত্যুর পরে সুরেন মাইতি দোতলা করেছে। বাড়িতে ঢোকার পথ বস্তির দিক থেকে সরিয়ে রাস্তার দিকে করেছে।

রাত্রে ঘুমাতে যাওয়ার সময় ছাড়া সুরেন মাইতি কখনও একা থাকে না। ওর নীচের ঘরে এখন জনা তিনেক লোক।

ছেলেটি দরজার বাইরে থেকে ডাকল, সুরেনকাকা, একবার আসবেন?

কে? কে ডাকে? ভেতর থেকে গলা ভেসে এল, আবার কে ডাকছিস?

এবার দরজায় যে দাঁড়াল তাকে কখনও দ্যাখেনি মাধবীলতা। কিন্তু সে লক্ষ করল ছেলেটা বেশ নুয়ে পড়ল। আমি না, উনি, সুরেনকাকার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন।

কে আপনি? লোকটা প্রশ্ন করেই জানিয়ে দিল, উনি এখন ব্যস্ত আছেন।

অর্কদার মা। ছেলেটি জবাব দিল।

আই বাপ। ভেতর থেকে গলা ভেসে এল, সর, সর, একটু দাঁড়ান বউদি।

লোকটি দরজা থেকে ভেতরে চলে যেতে ছেলেটি বলল, এ সুরেনকাকার বডিগার্ড। সবসময় যন্ত্র রাখে সঙ্গে। নতুন এসেছে।

সুরেন মাইতি বেরিয়ে এল, আচ্ছা, আপনি কেন এলেন? ডেকে পাঠালে আমি নিজেই চলে যেতাম। ভেতরে গিয়ে বসবেন?

না, তার দরকার নেই। আপনার কাছে একটা অনুরোধ নিয়ে এসেছি।

অনুরোধ কেন বলছেন? অ্যাই, ছোঁড়া ভাগ এখান থেকে, শুধু পঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা গেলা। যা! ছেলেটিকে সুরেন মাইতি ধমকাতেই সে দ্রুত সরে গেল।

হ্যাঁ, বলুন। দুটো হাত জোড়া করে মুখের সামনে তুলল সুরেন মাইতি।

সুজাতা নামের একটি মেয়ে আমাদের গলিতে থাকে, আপনি নিশ্চয়ই জানেন।

আমি তো বউদি, মেয়েদের নাম বললে বুঝতে পারব না, বাবা বা স্বামীর নাম কী?

ও একাই থাকে। কারখানায় চাকরি করে।

ও হ্যাঁ। বাঙালি মেয়ে যে এত স্ট্রাগল করতে পারে আগে জানতাম না। শুনেছি, বেশ ভদ্র মেয়ে, কারও দিকে মুখ তুলে তাকায় না। মাথা নাড়ল সুরেন মাইতি।

ভুল শোনেননি।

এনি প্রবলেম?

হ্যাঁ। ওকে বিয়ে করবে বলে যে লোকটা বাড়ি থেকে বের করে এনেছিল, এনে পথে বসিয়েছে, ও এখন তার হাত থেকে বাঁচতে চায়। কিন্তু লোকটা খোঁজ করে এখানে এসে হাজির হয়েছে। ওর ঘরে বসে মদ খাবে, ওর ওপর অত্যাচার করবে, মেয়েটা আর সহ্য করতে পারছে না। আপনি যদি ব্যাপারটা দেখেন– মাধবীলতা বলল।
 
নিঃশব্দে কেঁপে কেঁপে হাসল সুরেন মাইতি। ভালবাসা হল ক্যান্সারের চেয়েও মারাত্মক অসুখ। ক্যান্সার হয়, লোক মারা যায়। ভালবাসা না মেরে সারা জীবন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্ত বার করে যায়। বুঝলেন বউদি, এইজন্যে আমি ভালবাসা থেকে দশ হাত দূরে থাকি। সুরেন মাইতি কথা বলার সময়েও যেন নিঃশব্দে হাসছিল।

কিন্তু সুজাতার ব্যাপারটা–। মাধবীলতার গলার স্বর বদলে গেল।

কোনও চিন্তা করবেন না। কখন আসবে লোফারটা।

সন্ধেবেলায়।

বেশি দেরি নেই। মেয়েটাকে বলবেন, লোফারটা এলে ঘরে যেন বসতে দেয়। কিন্তু যেই মদের বোতল খুলবে অমনি যেন খুব জোরে চিৎকার শুরু করে। ব্যস, তার পরের কাজটা আমার ছেলেরা করে দেবে। গম্ভীর হল সুরেন মাইতি।

প্রস্তাবটা একদম পছন্দ হল না মাধবীলতার। এ যেন ছাগলটাকে টোপ সাজিয়ে বাঘ মারা। সুরেন মাইতি কথা শেষ করতে চাইল, ঠিক আছে?

সুজাতা এত ভয় পেয়ে গেছে যে লোকটাকে ঘরে ঢোকানো দূরের কথা, মুখোমুখি হতে চাইছে না। মাধবীলতা বলল।

তা বললে কী করে হবে? লোকটাকে তো মদের বোতল সমেত হাতেনাতে ধরতে হবে। উইদাউট ব্লু-তে অ্যাকশন নেওয়া যায় না। সুরেন মাইতি বলল।

ঠিক আছে, ওকে বলে দেখছি। মাধবীলতা বলল, আপনার সময় নষ্ট করলাম।

না না ঠিক আছে। দেখুন কী হয়। সুরেন মাইতি বলল।

গলিতে ঢোকার মুখে দাঁড়িয়ে ছিল ওরা। যে ছেলেটি মাধবীলতাকে সুরেন মাইতির কাছে নিয়ে গিয়েছিল, সে এবং তার পাশে বিশ্বজিৎ। ছেলেটি বলল, মাসিমা বিশ্বজিৎদাকে চেনেন তো?

মাধবীলতা মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।

আপনার সঙ্গে কথা হয় না, কিন্তু ছেলেবেলা থেকেই তো দেখে আসছি।

হয়েছে? বিশ্বজিৎ বেশ ভদ্র গলায় জিজ্ঞাসা করল।

না। হল না।

কিছু যদি মনে করেন তা হলে ব্যাপারটা কী জানতে পারি?

একটু ইতস্তত করছিল মাধবীলতা। ততক্ষণে বস্তির পাঁচ-ছয়জন মহিলা কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছেন। শেষ পর্যন্ত সুজাতার সমস্যাটা বিশ্বজিৎকে বলল মাধবীলতা। সুরেন মাইতির প্রস্তাবটাও বাদ দিল না।

বিশ্বজিৎ মাথা নাড়ল, মহিলাকে তো রোজ দেখি। খুব নরম টাইপের মনে হয়। উনি এখন কোথায়?

আমাদের বাড়িতে।

ওখানেই থাকুন এই সন্ধেটা। আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরে যান।

কী করবে তোমরা?

আমরা কিছুই করব না। যা করবেন মা-বোনেরাই করবেন। বলে এতক্ষণ যাঁরা শুনছিলেন তাঁদের দিকে তাকাল সে। আপনারা তো সব শুনলেন।

একজন মহিলা বললেন, এসব কথা তো আমরা জানতামই না। ওকে বলুন, আমরা ওর সঙ্গে আছি।

ওর কথা শুনে অন্য মেয়েরাও মাথা নাড়তে লাগলেন।

বাড়িতে ফিরে এল মাধবীলতা। অনিমেষ বসে ছিল বারান্দায়। মাধবীলতাকে দেখে বলল, তুমি চলে যাওয়ার পর থেকে মেয়েটা কেঁদে চলেছে, জিজ্ঞাসা করলে জবাব দিচ্ছে না।

.
 
মাধবীলতা সুজাতার সামনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে?

সুজাতা মাথা নাড়ল। সে কথা বলতে চাইছে না দেখে মাধবীলতা অনিমেষকে ইশারা করল ঘরের ভেতরে চলে যেতে। মেয়েটার দিকে একবার তাকিয়ে ঘরে ঢুকে গেল অনিমেষ। মাধবীলতা বলল, এবার তুমি আমায় বলতে পারো। অর্কের বাবা এখানে নেই।

আমার ভয় লাগছে। কাঁপা গলায় বলল সুজাতা।

কীসের ভয়? মাধবীলতার কপালে ভাঁজ পড়ল।

যদি লোকজন এমন মার মারে যে ও মরে যায় বা পঙ্গু হয়ে যায়!

অবাক হয়ে গেল মাধবীলতা। যে জন্তুটা জীবন নরক করে দিচ্ছে, তার চূড়ান্ত ক্ষতি করতে চাইছে না মেয়েটা? খুব রাগ হয়ে গেল মাধবীলতার, বিরক্ত হয়ে বলল, তখন এসে ওইভাবে বললে কেন? আমার কী দরকার ছিল সুরেন মাইতির কাছে যাওয়ার?

আমি যে ওকে ভয় পাচ্ছি। আমি চাই না ও এখানে আসুক।

অথচ তুমি এও চাইছ লোকটাকে যেন বেশি মারধর করা না হয়।

মাথা নিচু করল সুজাতা, আসলে, উনি তো একসময় আমার অনেক উপকার করেছিলেন, সেসব মনে পড়লে–।

বেশ। তুমি গলিতে গিয়ে দ্যাখো বিশ্বজিৎকে পাও কি না? ওই যে ছেলেটা কংগ্রেস করে, ও-ই উদ্যোগ নিচ্ছে। যদি ওকে না পাও তা হলে ওই গলির মহিলাদের গিয়ে বলো তুমি চাও না ওই লোকটাকে কিছু করা হোক।

মাধবীলতা উঠে যাচ্ছিল, সুজাতা তার হাত ধরল, আপনি আমাকে বুঝতে পারছেন না।

আমার ন্যাকামি পছন্দ হয় না।

আমি ন্যাকামি করছি না, সুজাতা বলল।

যাও, বাইরে গিয়ে কথা বলো ওদের সঙ্গে।

সুজাতা গেল না। বারান্দায় বসে রইল।

ঈশ্বরপুকুর লেনের দৈনন্দিন জীবনে সেদিন অন্যরকম ঘটনা ঘটল। বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার কয়েক বছর পর থেকে ধীরে ধীরে পার্টির নব্য নেতারা সমস্ত ক্ষমতা হাতে নিয়ে ফেলেছিলেন। তাঁরা যা বলবেন, সেটাই শেষ কথা, তার জন্য জেলা কমিটির অনুমোদনও দরকার নেই। বামবিরোধী দলগুলো মাঝে মাঝে গলা খুললেও বেশির ভাগ সময় তাদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যেত না। ঈশ্বরপুকুর লেনে সুরেন মাইতিই শেষ কথা। মাসের এই সময়টা তাকে খুব ব্যস্ত থাকতে হয়। পাশের বেলগাছিয়ায় রেললাইনের কর্মবীরদের সঙ্গে হিসেব মিলিয়ে নেওয়া থেকে অর্থ আসছে এমন সব লাইনগুলোর তদারকি করতে হয় মাসের এই সময়।

সুরেন মাইতি যখন খবরটা পেল তখন রাত সাড়ে নটা। প্রথমে বিশ্বাসই করেনি সে। ঈশ্বরপুকুর লেনের বস্তির মহিলারা নাকি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে একটা লোককে আড়ংঘোলাই দিয়েছে। লোকটা মারা যায়নি কিন্তু প্রচণ্ড আহত হয়ে আর জি করে ভরতি হয়েছে। সুরেন মাইতির প্রথম প্রশ্ন ছিল, এটা কে অর্গানাইজ করল? আমাকে না জানিয়ে আমাদের কেউ কি করেছে?

একজন কমরেড জানালেন, না সুরেনদা। আমাদের কেউ লিড করেনি।

বুঝতে পেরেছি। ওই অর্কর মা-ই মেয়েদের খেপিয়েছে। ওর স্বামী নকশাল হওয়ায় চিরকালের জন্য পঙ্গু হয়ে পড়ে আছে, তাও হুঁশ হল না। আমরা যদি রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি না দিতাম তা হলে এখনও জেলে পচে মরত। সুরেন মাইতি ফোঁস ফোঁস করতে লাগলেন।

না দাদা। অর্কদার মাকে ধারেকাছে দেখা যায়নি।

একজন জানাল।

চালাক মেয়েছেলে। সামনে না এসে আড়াল থেকে মেয়েদের খেপিয়েছে।

সুরেন মাইতি নির্দেশ দিল, ওকে নয়, ল্যাংড়াটাকে ডেকে নিয়ে আয়।

.

এখনও উত্তেজনা ছড়িয়ে আছে ঈশ্বরপুকুর লেনে। জটলাগুলোতে এই নিয়ে আলোচনা চলছে। মেয়েরা যে ওই ঘরের সামনে অপেক্ষা করবে এবং লোকটা আসামাত্র প্রশ্ন শুরু করবে, এরকম দৃশ্য আগে এলাকার মানুষ দেখেছে। শুধু তাই নয়, মাধবীলতাদের বাড়ি থেকে সুজাতাকে ডেকে এনে মেয়েরা লোকটার সামনে জানতে চেয়েছিল ঠিক কী করেছে সে। লোকটাকে দেখামাত্র সুজাতার সব মন খারাপ উধাও হয়ে গিয়েছিল। যা সত্যি তাই বলেছিল সে। মিনিট পাঁচেক মার খাওয়ার পর লোকটা ধরাশায়ী হয়। পাড়ার ছেলেরা একটা ট্যাক্সি ডেকে আর জি করে পাঠিয়ে দেয়। মেয়েরাই বলেছিল আজকের রাত্রে সুজাতার নিজের ঘরে থাকা ঠিক হবে না। ওপাশের এক প্রৌঢ়া তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন হাত ধরে।
 
হঠাৎ উত্তেজনা মানুষের শেষ আড়াল যখন একবার ভেঙে ফেলে তখন সে আরও সাহসী হয়ে ওঠে। ওই লোকটা সুজাতার ঘরে বসে নাকি মদ্যপান করত। এ কথা প্রচার হতেই সবার মুখে একটা কথা ফিরতে লাগল, ঘরে বসে বস্তির কোনও পুরুষের মদ খাওয়া তো চলবেই না, নেশা করে টলতে টলতে কেউ যদি বাড়ি ফিরে আসে তা হলে তাকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। কথাটা চাউর হলে অনেক বয়স্ক থেকে তরুণের মুখ কালো হয়ে গেল। একজন প্রৌঢ় বললে, কত দেখলাম, আজকের বাঘ কাল মিনি বেড়াল হয়ে যাবে, দেখো।

মাধবীলতা খুশি হয়েছিল। লোকটিকে মেয়েরা শাস্তি দিয়েছে বলে শুধু নয়, সুজাতা তার কান্না ভুলে সত্যি কথা বলতে পেরেছে বলে। অনিমেষের সঙ্গে কথা বলছিল সে। এই সময় একজন কমরেড খবর নিয়ে এল, মেসোমশাই, সুরেনদা আপনাকে একবার দেখা করতে বললেন।

কেন? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

জানি না। এখনই চলুন।

মাধবীলতা বলল, এত রাত্রে ডাকলেই যেতে হবে নাকি? কাল সকালে যেয়ো। ভাই, সুরেনবাবুকে একটু বলবে–।

মাধবীলতাকে থামাল অনিমেষ, না, ঘুরেই আসি। চলো।

কমরেড যে অনিমেষকে সুরেন মাইতির বাড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছে, ছড়িয়ে থাকা জটলা করা মানুষগুলো দেখল, কিন্তু কিছু বলল না।

সুরেন মাইতির বাইরের ঘরে তখন কয়েকজন মানুষ। তার দেহরক্ষীও রয়েছে। অনিমেষ দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার? এত রাত্রে তলব করেছেন।

সুরেন মাইতি হাসল, আমারই যাওয়া উচিত ছিল। এত ঝামেলা, এই এরা তো যে যাঁর সমস্যা নিয়ে বসে আছেন–।

বলুন।

আজ বস্তিতে মেয়েরা যে কাণ্ড করেছে তা কি জানেন?

এখানেই যখন থাকি, না জেনে উপায় কী!

বটে। যে লোকটাকে এরা আড়ংধালাই দিয়েছে, সে গুরুতর আহত। পুলিশ গিয়েছিল ওর কাছে কী ঘটেছিল তা জানতে। হাসল সুরেন মাইতি, লোকটার জ্ঞান পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছে পুলিশ।

এসব কথা আমাকে বলছেন কেন? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

পুলিশ মার্ডার চার্জ আনলে আমি অবাক হব না। এখানে খবর হল, আপনার স্ত্রীর কাছে মেয়েটি আশ্রয় নিয়েছিল। আপনার স্ত্রী যে আমার কাছে এসে লোকটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন, সেটাই তো সত্যি। আমি বলেছিলাম, লোকটা যে লম্পট তার প্রমাণ চাই। কিন্তু আপনার স্ত্রী অধৈর্য হয়ে বস্তির মেয়েদের এমন খেপিয়ে দিলেন, এবং নিজে সামনে না এসে নির্বোধ মহিলাদের এগিয়ে দিলেন, সেটা ঠিক করেননি। লোকটির বয়ান পেয়ে গেলেই পুলিশ আপনার স্ত্রীকে গ্রেফতার করবে। অনিমেষবাবু, আপনি নকশাল আন্দোলন করতেন, জেলে গিয়েছিলেন, মানুষের সম্মান আপনি পেয়েছেন। কিন্তু একজনকে খুন করার ষড়যন্ত্রের জন্যে আপনার স্ত্রী যদি জেলে যান–ছি ছি ছি! মুখ মুছলেন সুরেন মাইতি।

এইভাবে মামলাটাকে সাজানো হবে? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।
 
পুলিশকে আপনি আমার চেয়ে ভাল চেনেন। ওরা যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। লোকে বলে, আমাদের দলের মন্ত্রীরা আপনার নাকি সহপাঠী ছিলেন। যান, কথা বলুন, তারা যদি সাহায্য করে আপনাকে!

আর কী বিকল্প আছে? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

সুরেন মাইতি বলল, লোকটা যদি আজ রাত্রে হাসপাতালের বিছানায় মরে যায় তা হলে পুলিশ ওর কাছে কোনও বয়ান পাবে না। কারও বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিতেও পারবে না। কিন্তু ঘটনাটা একটু খরচসাপেক্ষ এবং ঝুঁকিও নিতে হবে। তার চেয়ে আপনি আমার সঙ্গে থাকুন। একসঙ্গে কাজ করলে দুজনেরই উপকার হবে।

এইসময় একটি ছেলে এসে দাঁড়াল দরজায়, দাদা খবর পেয়েছি।

বল।

ব্যাপারটা বিশ্বজিতের মাথা থেকে এসেছে। যারা লোকটাকে আজ মেরেছে তাদের তিনজন যে কংগ্রেসকে ভোট দেয় তা আমি জানি। ছেলেটা বলল।

চোখ বড় হয়ে গেল সুরেন মাইতির, সে কী রে! কেঁচো ফণা তুলেছে? ঠিক আছে। এখন চুপ করে থাক। আমরা যেন কিছু জানিই না। এক সপ্তাহ কেরোসিনের ব্ল্যাক বন্ধ। মানুষ যেন ঠিকঠাক তেল পায়। মনে থাকবে?

একদম বন্ধ? পাশের ছেলেটার গলা সরু হল।

একদম। এই মুহূর্তে কিছুদিন মানুষের আস্থা পাওয়ার মতো কাজ করতে হবে। যাক গে, অনিমেষদা, আপনাকে মিছিমিছি কষ্ট দিলাম। বউদিকে বলবেন কোনও চিন্তা না করতে। মার্ডার চার্জটায় ওই বিশ্বজিৎই পড়বে। যান। এই, কেউ দাদাকে এগিয়ে দিয়ে আয়।

অনিমেষ বলল, না না, আমি নিজেই যেতে পারব। ঠিক আছে।

.

অনিমেষ এবং মাধবীলতা বসেছিল মুখোমুখি। অনিমেষ বলল, যত দিন যাচ্ছে তত এরা মানুষের শত্রু হয়ে উঠছে। কিন্তু এই শ্বাসরুদ্ধ পরিবেশ থেকে তো বের হওয়ার উপায় নেই।

মাধবীলতা বলল, তোমার মনে আছে, সাতষট্টি সালের নির্বাচনের আগে পশ্চিমবাংলার কেউ ভাবতেই পারত না কংগ্রেস ক্ষমতা থেকে চলে যাবে?

অনিমেষ মাথা নাড়ল, কিছুটা ঠিক। ততদিনে একটা প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছিল আমাদের, আন্দোলনের ভাবনা তো ওই সময়েই।

তোমার ভাবনাটা সঠিক নয়। বামপন্থী দলকে যুক্তফ্রন্ট করতে হয়েছিল কেন? কারণ তারা জানত মানুষ তাদের ওপর আস্থাবান নয়। প্রফুল্ল ঘোষ বা অজয় মুখোপাধ্যায়কে সামনে রাখতে হয়েছিল। অজয়বাবুকে দেখেই মানুষ ভোট দিল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। কিন্তু তবু যুক্তফ্রন্ট সরকার টিকতে পারল না। তারপর আর একবার চেষ্টা হয়েছিল, সেটাও টিকল না। জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল বলেই কংগ্রেস ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছিল।

মাধবীলতা বলল, বামফ্রন্ট জিতেছিল মানুষের নেগেটিভ ভোট পেয়ে। প্রথম কয়েক বছর তো মানুষ বেশ ভালই ছিল। এখন মানুষ হাঁসফাঁস করছে। অথচ কাকে ভোট দেবে তা বুঝতে পারছে না।

দ্যাখো জলের চাপ বেড়ে গেলে সে নিজেই পাহাড়ের ফাটল খুঁজে নেয়। আমি তাই ও নিয়ে ভাবি না। অনিমেষের কথা শেষ হওয়ামাত্র উঠোনের দরজায় শব্দ হল। মাধবীলতা সঙ্গে সঙ্গে উঠে গেল সেটা খুলতে।

অর্ক মায়ের পাশ দিয়ে উঠোনে পা রেখে অনিমেষের দিকে একবার তাকিয়ে মায়ের উদ্দেশে বলল, খেতে দাও, খুব খিদে পেয়েছে।

দুপুরে কিছু খাসনি? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

খেয়েছি। অর্ক ঢুকে গেল তার ঘরে।

দাঁড়িয়ে দুটো কথা বলবে তারও সময় নেই। এখন খাওয়া শেষ করেই বিছানায় পড়ে মড়ার মতো ঘুমাবে। অনিমেষ বিড়বিড় করল।

মাধবীলতা কথা না বাড়িয়ে রান্নাঘরে গেল। গ্যাস জ্বালিয়ে খাবার গরম করতে লাগল। হাতমুখ ধুয়ে পাজামা গেঞ্জি পরে অর্ক রান্নাঘরে এল, কই দাও।

কী ওটা?

তোমাদের ট্রেনের টিকিট।

সেকী! তুই যাবি না?

ছুটি পাব না। প্রচণ্ড চাপ। খামটা একটা কৌটোর ওপর রেখে দিয়ে হাত বাড়াল অর্ক, থালাটা দাও, দাঁড়িয়েই খেয়ে নিচ্ছি।

এত তাড়া কেন? পিঁড়ি এগিয়ে দিল মাধবীলতা, বসে খা।
 
পিঁড়ির ওপর বাবু হয়ে বসল অর্ক, বসে হাসল, এখন কলকাতা শহরে আর কোনও বাড়িতে পিঁড়িতে বসে খাওয়ার রেওয়াজ আছে কি না জানি না।

আছে কি নেই জানি না, আমার তো পিঁড়িতে বসে খেতে বেশ ভাল লাগে, মাধবীলতা হাসল, কিন্তু কাল ছুটি না পেলে দুদিন বাদে ছুটির জন্য বল।

বলব। তবে লাভ হবে বলে মনে হয় না। আমি ভুল করেছিলাম, পার কেস একটা টাকা নিতাম, কোনও কোনও সময় কেস না এলে চিন্তায় পড়তাম তাই ওরা যখন চাকরির অফার দিল তখন লুফে নিয়েছিলাম। তারপরেই চাপ বাড়তে লাগল। পার কেস যে টাকা পেতাম তা এখন নিলে মাইনের দ্বিগুণ হয়ে যেত! খাওয়া শুরু করল অর্ক।

বেশি লোভ করে কী দরকার। যা পাচ্ছিস তা থেকেও তো কিছু জমে যাচ্ছে।

বাবা খেয়েছে? বসে আছে কেন? শুয়ে পড়তে বলল।

ঘুম পেলে নিজেই শুতে যাবে। মাধবীলতা বলল, আজ এখানে কী হয়েছে শুনেছিস? তুই তো আবার কারও সঙ্গে কথা বলিস না।

শ্যামবাজারের মোড়ে বিশ্বজিতের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল।

ও। ছেলেটা বেশ ভাল। সুরেন মাইতি যখন জালিয়াতি করছিল তখন ওই ছেলেটাই বস্তির মেয়েদের ব্যাপারটা জানায়।

মা, এইসব ব্যাপারে একদম ইন্টারেস্টেড নই। মাধবীলতা ছেলের দিকে তাকাল, কোনও মেয়ে বিপদে পড়লে আমি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারব না।

খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়াল অর্ক, সেটা তোমার ব্যাপার। আমি অনুরোধ করব ওই খাম থেকে টিকিট বের করে কখন ট্রেন ছাড়ছে তা দেখে রাখো।

অর্ক কলতলা থেকে বেরুতে না বেরুতে মাধবীলতার গলা শুনতে পেল, সে কী রে, কাল দুপুরবেলায় ট্রেন? আমি ভেবেছিলাম, রাতের ট্রেনের টিকিট হবে।

অর্ক ঘুরে দাঁড়াল, টিকিট কাউন্টারের বাবুরা কম্পিউটার দেখে বলেছেন ওসব ট্রেনে কোনও জায়গা খালি নেই। তাই তিস্তা তোর্সায় কাটলাম। তখন বাড়ি ফেরার সময় শিয়ালদা স্টেশনের পাশ দিয়ে আসার সময় কৌতূহল হল। গিয়ে দেখলাম, অর্ডিনারি স্লিপারের অর্ধেক আর এসি থ্রি টায়ারের ওয়ান থার্ড খালি পড়ে আছে। রহস্যের সমাধান ফেলুদাও পারবে না।

রাতের সব কাজ শেষ করে শুতে এসে মাধবীলতা দেখল অনিমেষ ঘুমে কাদা হয়ে রয়েছে। ওপাশের ঘরে অর্কও নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছে।

আজ ওষুধ খেতে ভুলে গেছে সে। আজকাল ওষুধ না খেলে ঘুম আসে না। মাঝরাত্রে কাল দুপুরের জন্যে সুটকেস গোছাতে লাগল মাধবীলতা।

.

শিয়ালদা থেকে ট্রেন ছাড়ল দশ মিনিট দেরিতে। এসি থ্রি-টায়ারের টিকিট কেটেছে অর্ক। একটা কুপেতে ছয়জন। অনিমেষের উলটোদিকে একজন খাটো চেহারার হাসিহাসি মুখ ভদ্রলোক স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে এসেছিলেন। যেচে আলাপ করলেন তিনি।

কিছু মনে করবেন না, আপনাকে ওটা নিশ্চয়ই জন্ম থেকে বহন করতে হচ্ছে না?

হেসে ফেলল অনিমেষ, না।

গাড়ি ধাক্কা মেরেছিল তো? উঃ কলকাতায় দিন দিন গাড়ির সংখ্যা বেড়েই চলেছে, কিন্তু রাস্তা তো বাড়ছে না। আমি বলি কমছে। হকাররা দখল করে নিয়েছে যে। ভদ্রলোক এবার হাত জোড় করলেন, আমার নাম ভারতচন্দ্র দত্ত। এনি কোয়েশ্চেন?

নো। সুন্দর নাম।

এই মধ্যযুগীয় নামটা আমার পিতামহ নির্বাচন করেছিলেন। এই নাম যার সে মাস্টারি ছাড়া আর কী করতে পারে বলুন? স্কুলে দুপুরটা কেটেছে, সকাল বিকেল সন্ধে প্রাইভেট টিউশনি। রোজগার খারাপ করিনি। দুটো মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। এটি থার্ড। ভারতচন্দ্র চোখের ইশারায় মেয়েকে দেখালেন।

মেয়ে সঙ্গে সঙ্গে মায়ের হাত আঁকড়ে ধরল।

মা বললেন, তোমার মুশকিল কী জানো, কেউ শুনতে চাইছে কি চাইছে জানার আগেই ব্যক্তিগত কথা বলতে আরম্ভ করা।

মাস্টারি করার অভ্যেস। হাসলেন ভারতচন্দ্র, টিকিট কবে কেটেছেন?

মাধবীলতা জবাব দিল, ছেলে কেটে দিয়েছে।

বুদ্ধিমান ছেলে।

অনিমেষ হাসল, কীসে বুঝলেন?

এসি থ্রি-টায়ারে টিকিট করেছে। টু-টায়ারে করেনি।

বেশি ভাড়া দিতে হল না, তাই?

দূর! এসি টু-তে একটা কুপেতে চারজন। ট্রেন ছাড়লেই দুজন মদ্যপান শুরু করেন। পরদা টানা থাকে। একবার আমি আর আমার ওয়াইফ এসি টু টায়ারে যাচ্ছিলাম, কী বলব মশাই, ছেলের বয়সি ছোঁড়াগুলো, বোতলে বাড়ি থেকেই জলে সাদা মদ মিশিয়ে নিয়ে এসেছে দেখলে ধরতে পারবেন না, ভাববেন জল খাচ্ছে, আমাকেই অফার করেছিল। ভারতচন্দ্র বললেন।

স্বাদ নিলেন? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

নো, জীবনে খাইনি তো! তবে আই ওয়াজ টেম্পটেড। তারপর থেকে আর এসি টু টায়ারে যাই না। ওই যাঃ, আপনার নামই জানা হল না।

অনিমেষ মিত্র।

ছেলে কী করে?

হেলথ অ্যান্ড কেয়ারে চাকরি করে।

ম্যারেড? আপনার ছেলে যখন, তখন–। ভারতচন্দ্র শেষ করলেন না। মাধবীলতা বলল, দ্যাখো তো চা পাওয়া যায় কিনা?

এই চা খাবে? অনিমেষ উঠে দাঁড়াল।

ভাল চা কোথায় পাবে?

দেখি।

দরজা টেনে বাইরে এসে স্বস্তি পেল অনিমেষ। ভাগ্যিস মাধবীলতা কথা ঘুরিয়ে দিল! এই লোকটার সঙ্গে কাল ভোর পর্যন্ত থাকতে হবে।
 
মিনিট খানেক বাদে ফিরে এসে অনিমেষ দেখল কামরায় বসেই মাধবীলতা একটা চা-ওয়ালাকে পাকড়েছে।

তুমি খাবে?

না অনিমেষ জানলার পাশের খালি জায়গাটায় বসল।

আপনারা? ভারতচন্দ্রের স্ত্রী বললেন, আপনি নিন, আমরা নিচ্ছি।

আমার তো নেওয়া হয়ে গিয়েছে–।

ভদ্রমহিলা স্বামীকে বললেন, এই যে শুনছ–।

আমি আবার কী শুনব! উনি অফার করছেন, তুমি অ্যাকসেপ্ট করবে কি না সেটা তুমি ঠিক করবে। দাও ভাই, আমাকে এক কাপ দাও।

ভদ্রমহিলা এবং তাদের মেয়ে চা খেল না। দুটোর দাম দিয়ে দিল মাধবীলতা। ছেলেটা প্রথমে ছটাকা কাপ চেয়েছিল। তারপর কী মনে হতে বলল, ঠিক আছে, পাঁচ করেই দিন। বাইরে বেরোলে বুঝতে পারা যায় জিনিসপত্রের দাম আর কোনও সীমায় আটকে থাকছে না।

ট্রেনটা চলছিল মাঠ পেরিয়ে। মাঠে এখন শস্য নেই। ঘষা কাঁচের মধ্যে দিয়ে যে ছবিটা দেখা যাচ্ছে তা অনেকটাই অস্পষ্ট। এই যে মাঠ, গ্রাম, পঞ্চায়েত এগুলোর সঙ্গে বামফ্রন্ট একসময় আন্তরিকভাবে জড়িয়ে ছিল।

থাকলে এতগুলো বছর ধরে ওরা ক্ষমতায় থাকতে পারত না। এখন একটা শতাব্দীর শেষ আর একটার শুরু। ক্ষমতায় আসার পর বামফ্রন্ট চার চারটে নির্বাচনের মুখোমুখি হয়েছে। বিরোধীরা বলেছেন গত দুটো নির্বাচনে বামফ্রন্টের ক্যাডাররা গায়ের জোরে ভোট করেছে। তা হলে স্বীকার করতে হয় প্রথম দুটো নির্বাচন, ওই দশ বছর বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে মানুষের আজকের অভিযোগ তৈরি হয়নি। তা ছাড়া গত দুই নির্বাচনে যদি ক্যাডাররা গায়ের জোরে ভোট দিয়ে থাকে, অন্যকে ভোট না দিতে দেয়, তা হলে তার সংখ্যা কত? খুব বেশি হলে পনেরো থেকে কুড়ি ভাগ। ওইভাবে ভোট না করলেও বামফ্রন্ট স্বচ্ছন্দে জিতে যেত। একটা সময় আসবে যখন গালাগালি দিতে গিয়ে মানুষ বামফ্রন্টের সাতাত্তর সালের সরকারকেও কাঠগড়ায় তুলবে। খারাপ অনুভূতি খুব দ্রুত ভাবার স্মৃতিকে নষ্ট করে দেয়। এসব নিয়ে ভাবার কোনও মানে নেই জেনেও ভাবনাগুলো আপনি চলে আসে। সংসদীয় রাজনীতিকে এখন না মেনে উপায় নেই। কিন্তু ভারতবর্ষে কোনও নাগরিক ভোট না দিয়ে, রাজনীতি থেকে দুরে সরে গিয়ে দিব্যি থাকতে পারে। হঠাৎ কানে এল, এই যে স্যার, চলবে?

মুখ ফিরিয়ে তাকাল অনিমেষ। ভারতচন্দ্র তার সামনে একটি স্টিলের বাটি ধরে আছে, যাতে কয়েকটা পাটিসাপটা পড়ে আছে। ভারতচন্দ্রের হাসি আরও বিস্তৃত হল। অসময়ের পাটিসাপটা বলে অবহেলা করবেন না, নেবেন?

অনিমেষ অস্বস্তি নিয়ে মাধবীলতার দিকে তাকাল। মাধবীলতা বলল, ওঁর মিষ্টি খাওয়া বারণ।

ও হো। তা হলে বেঁচে থাকার অর্ধেক আনন্দ থেকেই আপনি বঞ্চিত!

যা বলেছেন।

বাটির ঢাকনা বন্ধ করে স্ত্রীর হাতে তুলে দিলেন ভদ্রলোক।

কিছুক্ষণ ট্রেনের দুলুনি উপভোগ করার পর ভারতচন্দ্র জিজ্ঞাসা করলেন, ছেলের সঙ্গে তো কথাবার্তা হল না, সঙ্গে মোবাইল নেই?

আছে, ভুল করে সুটকেসে রেখেছিলাম। ওখানে গিয়ে বের করব।

কী দরকার? নাম্বারটা বলুন। আমার মেয়ে আবার মোবাইলের ব্যাপারটা ভাল বোঝে। হারে, নাম্বারটা ধরে দে তো? ভারতচন্দ্র মেয়েকে বললেন।

মাধবীলতা হাত নাড়ল, না না। তোমাকে একটুও কষ্ট করতে হবে না। এখন আমার ছেলের কাজের সময়। এখন ও কিছুতেই ফোন ধরবে না।

সিরিয়াস টাইপ? ভাল ভাল। আপনারা পৌঁছাবেন ভোরবেলায়?

হ্যাঁ।

জলপাইগুড়ি থেকে আলিপুরদুয়ার এমন কোনও দূরত্ব নয়। চলে আসুন বেড়াতে বেড়াতে। কী বলে?

মহিলা হাসিমুখে মাথা নাড়লেন।

অনিমেষ চোখ বন্ধ করল। যারা অকারণে বেশি কথা বলে, অপরিচিতর সঙ্গে কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘনিষ্ঠজনের মতো ব্যবহার শুরু করে তারা হয় সোজা সরল অথবা ভয়ংকর ধান্দাবাজ হয়। এরকম আচরণ করার সময় নিশ্চয়ই টের পায় না যে পাশের মানুষ তাকে সন্দেহ করতে শুরু করেছে। যেহেতু এঁর সঙ্গে স্ত্রী ও কন্যা আছেন সন্দেহটা একটা জায়গা অবধি গিয়ে আটকে যাবে।
 
এই সময় মাধবীলতা বলল, এসি কামরায় আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। জানলা খোলা যাচ্ছে না। বাইরের পৃথিবীটা দ্যাখো এর মধ্যেই ঝাপসা হয়ে গেল।

গায়ে ধুলোবালি লাগছে না, সেটা ভাবো। অনিমেষ বলল।

ট্রেনটা চলছে দুলতে দুলতে। সন্ধ্যার অন্ধকারে কামরায় আলোগুলো তেমন উজ্জ্বল নয়। ভারতচন্দ্রবাবু হঠাৎ নিঃশব্দে উঠে গেলেন কামরার বাইরের টয়লেটের দিকে। মিনিট পাঁচেক পরে অনিমেষের নজরে পড়ল ভদ্রলোক দূরে দাঁড়িয়ে হাতের ইশারায় তাকে ডাকছেন। আসছি বলে ক্রাচ নিয়ে অনিমেষ উঠে দাঁড়াতে ভদ্রলোক চোখের আড়ালে চলে গেলেন। শক্ত দরজা ঠেলে বাইরে আসতেই ভারতচন্দ্র বললেন, এই দেখুন, এখানে নোটিশ টাঙিয়েছে, ধূপমান করলে এত টাকা ফাইন দিতে হবে।

ঠিক কথা।

মানছি। প্রশ্ন হচ্ছে একবার ধূমপান করলে যে অপরাধ তিনবার করলেও তো তাই। ফাইন কি তিনগুণ হয়ে যাবে? সমস্যায় আছেন ভদ্রলোক।

বোধহয় একবার দিলেই হবে।

গুড। ওখানে ধূমপানের কথা লেখা হয়েছে। কী ধরনের ধূম? বিড়ি, সিগারেট, চুরুট। গাঁজা খাওয়াও তো ধূমপান।

এটার ব্যাখ্যা আমি দিতে পারব না। অনিমেষ বলল।

এটা ধাঁধা না পাবলিক নোটিশ, আপনিই বলুন?

এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন কেন? বিরক্ত হল অনিমেষ। সামনে পিছনে তাকিয়ে নিল ভারতচন্দ্র, আপনাকে সত্যি কথাই বলি। এই যে অফিসের পর বাড়ি এসে যখন বাথরুমে ঢুকি তখন কিছুতেই পটি হতে চায় না। ওটা না হলে শরীর ফুলতে থাকে, আরাম করে শোওয়া যায় না। তখন সবে অফিসে ঢুকেছি। এক সহকর্মী বলল, ও কিছু নয়। একটু নেশার ছোঁয়া লাগালে পটি পেট ছেড়ে বেরুবার পথ পাবে না। ব্যস, অভ্যেস হয়ে গেল। সিগারেট থেকে সিকি ইঞ্চি তামাক বের করে সেই জায়গায় গাঁজা পুরে দিই। কয়েকটা টানেই তো পুড়ে যায়–! কিন্তু–

এখানে খেলে জেল হতে পারে।

সর্বনাশ! জেলের কথা অবশ্য এখানে লেখা নেই।

ড্রাই ড্রাগের মধ্যে পড়ে। গম্ভীর গলায় বলল অনিমেষ।

কী যে বলেন। সর্বত্র পাওয়া যায়। আমি আর পারছি না। এই বাথরুমের ভেতরে ঢুকে থাকি। আপনি একটু দাঁড়ান এখানে। কেউ ঢুকতে চাইলে বলবেন লোক আছে। প্লিজ!

ভেতর থেকে ছিটকিনি তুলে দিলেই তো হয়? অনিমেষ বলল।

অ। তা হলে তো ঘনঘন ধাক্কাবে। ভদ্রলোক সুট করে টয়লেটের দরজার ফাঁক গলে ভেতরে চলে গিয়ে ওটা বন্ধ করে দিলেন। একটা লোক গোটা দিনে কোনও নেশা করে না শুধু বিকেলের পর সিকি ইঞ্চি গাঁজা খায়। ভাবা যায়?

তিনি কোথায়? পেছন থেকে ভেসে আসা মহিলার কণ্ঠে মুখ ফেরাল অনিমেষ। ভারতচন্দ্রবাবুর স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছেন। বাধ্য হয়ে ইশারায় টয়লেটটা দেখিয়ে দিল অনিমেষ। ভদ্রমহিলা দরজার গায়ে পৌঁছে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, আপনি যেতে পারেন।

খুশি হল অনিমেষ চলে আসতে পেরে। এসে দেখল, মাধবীলতা একটা বই পড়ছে।

ভারতচন্দ্রবাবুর মেয়ে চোখ বন্ধ করে গাড়ির তালে ঢুলছে।

সে মেয়েটিকে বলল, বসে কেন, শুয়ে পড়ো তুমি।

মেয়েটা মাথা নেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। ওদিকের সব বাথরুম বন্ধ?

না। যেতে পারো।

মেয়েটি চোখের আড়ালে যেতেই অনিমেষ ঘটনাটা ঝটপট মাধবীলতাকে জানাল। চোখ বড় করল মাধবীলতা, সে কী! দেখে বোঝাই যায় না।

প্রত্যেক মানুষের হয়তো এরকম নিজস্ব ব্যাপার থাকে।

তোমার কী আছে?

অনিমেষ হকচকিয়ে গেল। তারপর বলল, যা তোমার নেই।

সেটা কী?

ভেবে বের করো। জীবনের সব প্রশ্নের উত্তর লিখে কেউ একটা মানেবই আজ অবধি করতে পারেনি। কথা বলতে বলতে অনিমেষ দেখল ভারতচন্দ্রবাবু ভিতরে ঢুকে তাকে ইশারা করছেন কাছে যাওয়ার জন্য। বাধ্য হল অনিমেষ। ভারতচন্দ্র বললেন, একশো টাকা ফাইন নিত বুক ফুলিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতি দেখে দেখে খেয়ে নিতাম। ভয় পেয়ে মশাই আর একটা সিগারেট যখ গেল। ডাবল লোকশান!

সে কী, কে নিল?

গৃহকত্রী। মাঝে মাঝে কয়েকবার শখ করে এই সময় তাকে দু-তিনটে টান দিতে দিয়েছি কলকাতায়। সন্দেহ করে ঠিক চলে গিয়েছে বাথরুমে। আমারটা শেষ করে ফেলেছিলাম, আর একটা বের করে দিতে হল।

ভারতচন্দ্র খুব বিরক্ত।

একটা সিগারেটের ওইটুকু গাঁজার দাম একশো টাকা!

উঃ মাথা নাড়লেন ভারতচন্দ্র। যেখানে সেখানে ও জিনিস পাওয়া যায় না। টাকা ফেললে তো লাভ হবে না, আর একশো কেন তার বেশিও রাখা যেতে পারে। বেঞ্চিতে বসে গজগজ করতে লাগলেন ভারতচন্দ্র।

ভদ্রমহিলা ফিরে এলেন, মুখে লালচে ভাব।

.

ভোর সাড়ে চারটের সময় ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। অনিমেষ নিশ্চয়ই ভাবল মাধবীলতা মাঝখানে। ওপরেরটা খালি, পাশেরটার নীচে বাবা, মাঝখানে মা, ওপরে মেয়ে। ট্রেন তখন নিউ জলপাইগুড়ি ছেড়েছে। অনিমেষ উঠল। আবার বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে নীরবে মাধবীলতাকে তুলল, আর বড়জোর পঁচিশ মিনিট। ওদের ঘুমাতে দাও।

পুরো ট্রেন ঘুমাচ্ছিল। কিন্তু বাণীনগর স্টেশন থেকে আচমকা ব্যস্ততা ছড়াল কামরায়। দেখা গেল জলপাইগুড়ি শহরে নামার লোক অনেক রয়েছে। অনিমেষ দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিল। ভোরের ঠান্ডা বাতাসের ছোঁয়া পেয়ে হঠাৎ, এত বছর পরেও তার শরীরে অদ্ভুত এক অনুভূতি হল। সমস্ত আকাশ, রোদ এখনও গায়ে না পাওয়া গাছেরা, ভেজা ঘাস যেন বলতে লাগল, আহা কী ভাল, কী ভাল।

চোখের সামনে চায়ের বাগান, ধানখেত, দূরের হাইওয়ে যেটা ময়নাগুড়ি, ধূপগুড়ি, স্বর্গছেঁড়া হয়ে ডুয়ার্সে চলে গিয়েছে যে রাস্তায় সে যাতায়াত করেছে কতবার তা হিসেবে নেই, যেন বুকের গভীর গভীরতর অংশ থেকে আচমকা বেরিয়ে এসে ওইখানে শান্ত হয়ে শুয়ে আছে। মাধবীলতা পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। অনিমেষ বলল, দেবী চৌধুরানির মন্দিরটা এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।

একদিন রিকশায় চেপে দেখে যাব।

ট্রেন থামল। জলপাইগুড়ি রোড স্টেশন। কুলিরা একটু হতাশ হল। ওরা বেশ ভারী হওয়া সত্ত্বেও মালপত্র বয়ে নিয়ে এল রিকশা পর্যন্ত।

কোথায় যাবেন বাবু?

হাকিমপাড়া। টাউন ক্লাব মাঠের কাছে।

উঠুন।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top