অনিমেষ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল, বলল, আয়। আমার কেবলই দেরি হয়ে যায়। কাল আসার কথা ছিল, আজ এলাম। বারান্দায় দুটো চেয়ার রাখা ছিল, তার একটায় বসল দেবেশ। অন্যটায় অনিমেষ।
দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে দেবেশ জিজ্ঞাসা করল, কদ্দিন পরে এলি?
বহু বছর পরে।
একাই?
না। মাধবীলতাও এসেছে।
কই, ডাক, আলাপ করি।
বাড়িতে নেই। বাজারে গিয়েছে।
বাজারে? তোর বউ বাজারে গেছে?
কেউ যদি গিয়ে খুশি হয় তো যাক না।
জলপাইগুড়িতে এখন কোনও কোনও মহিলা বাজারে যান বিকেল বেলায়। এইসময় কাউকে তো যেতে দেখিনি। তোর ছেলেমেয়ে কজন?
একজন। তোর কী খবর?
এসেছি একা। যাব একা। পৃথিবীর কোনও মেয়ে আমাকে বিয়ে করতে চায়নি, তাই করা হয়নি। তুই যখন স্বর্গভেঁড়া থেকে আসতিস তখন দোমহনি নামে একটা জায়গা পড়ত, মনে আছে?
দোমহনি নয়, ময়নাগুড়ি থেকে বার্নিশঘাটে চলে আসতাম। তবে দোমহনি কোথায় তা আমি জানি।
তার কাছেই আমার আস্তানা। দশজন বুড়োবুড়িকে নিয়ে। দেবেশ বলল।
বুঝলাম না।
দশ বিঘে জমি বহুদিন আগে খুব অল্পদামে পেয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে চালাঘর বানিয়ে আছি আমরা। যেসব মানুষের রোজগার নেই, খাবার দেওয়ার কেউ নেই, মরার পর মুখে আগুন দেওয়ার মতো কোনও আত্মীয় স্বজন নেই, তারা আমার সঙ্গে থাকে। বছর দশেক হয়ে গেল। এর মধ্যে চারজন চলে গেল, তাদের জায়গায় নতুন চারজনকে এনেছি। মনে হচ্ছে। ওদের মধ্যে দুজনের যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। দেবেশ বলল।
এই দশজনের থাকা-খাওয়ার খরচ তুই চালাচ্ছিস? অনিমেষ অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করল।
থাকার খরচ তো নেই। খাওয়ার খরচ–। হাসল দেবেশ, আয় না। একদিন। নিজের চোখে দেখে আসবি।
যাব। খুব ইন্টারেস্টিং বলে মনে হচ্ছে।
ভাই। আমি তো একা বিপ্লব, সমাজসেবা কিছুই করতে পারব না। জীবনভর কোনও রাজনীতিতে বিশ্বাস করতে পারিনি। শুনেছি তুই বিপ্লব করতে গিয়েছিলি, জেলে ছিলি। নিজের একটা পা তার জন্যে সেলামি দিতে হয়েছে, আমার সে সব করার ক্ষমতা বা সাহস ছিল না। আমি একটা কথা বুঝেছি। সেই বোঝার কাজটা করে বেশ শান্তি পাই। যাদের নিয়ে করি তারা পরের দিনের স্বপ্ন দেখে, যা আগে দেখত না। কবে যাবি বল? দেবেশ জিজ্ঞাসা করল।
এই তো এলাম। একটা বড় কাজ করতে হবে। সেটা আগে করি।
কী কাজ?
এই বাড়িতে আমার ছোটমা একা থাকেন। ওঁর পক্ষে আর থাকা সম্ভব হচ্ছে না। তাই বাড়িটাকে বিক্রি করতে হবে।
ছোটমা– আমার দ্বিতীয় মা। দাদু,বাবা, বড়পিসিমা চলে গেছেন। উনি আছেন।
তাই বাগান পরিষ্কার করাচ্ছিস?
প্রশ্নটা শুনে হেসে ফেলল অনিমেষ। না না। সাপখোপ জন্মাচ্ছে, শেয়াল বাচ্চা দিয়েছে ওখানে, তাই। ভাবছি এখানকার কাগজে বিজ্ঞাপন দেব।
তুই এক কাজ কর, কদমতলার মোড়ে একটা স্টেশনারি দোকান আছে। দোকানের মালিক জগদীশবাবু। সবাই চেনে। লোকটা বাড়ি কেনা-বেচার দালালি করে। ওর কাছে যা। ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
তোর চেনা?
আগে চিনতাম। অনেক বছর যোগাযোগ নেই।
এই সময় অনিমেষ দেখল ছোটমা তার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ইশারায় তাকে ডাকছেন। সে ক্রাচ নিয়ে এগিয়ে যেতেই ছোটমা বললেন, চা করেছি। সঙ্গে কি থিন অ্যারারুট বিস্কুট দেব।
ক্রাচ সামলে দুটো কাপ হাতে নেওয়া সম্ভব নয়। অনিমেষ ডাকল, দেবেশ, এদিকে আয়। দেবেশ উঠে এলে বলল, এর নাম দেবেশ। আমরা সহপাঠী ছিলাম।
মাথা নেড়ে ছোটমা ভেতর থেকে দুটো চায়ের কাপ নিয়ে এলেন।
অনিমেষ লক্ষ করল, একদিকে চিড় লাগা-কাপটা তাকে দিলেন ছোটমা।
বিস্কুট লাগবে? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।
না না। মাথা নাড়ল দেবেশ, আমি চা খাই না। কিন্তু উনি নিজের হাতে দিলেন বলে আজ খাব।
অনিমেষ লক্ষ করল ছোটমায়ের মুখে তৃপ্তির ছাপ ফুটে উঠল।
.
দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে দেবেশ জিজ্ঞাসা করল, কদ্দিন পরে এলি?
বহু বছর পরে।
একাই?
না। মাধবীলতাও এসেছে।
কই, ডাক, আলাপ করি।
বাড়িতে নেই। বাজারে গিয়েছে।
বাজারে? তোর বউ বাজারে গেছে?
কেউ যদি গিয়ে খুশি হয় তো যাক না।
জলপাইগুড়িতে এখন কোনও কোনও মহিলা বাজারে যান বিকেল বেলায়। এইসময় কাউকে তো যেতে দেখিনি। তোর ছেলেমেয়ে কজন?
একজন। তোর কী খবর?
এসেছি একা। যাব একা। পৃথিবীর কোনও মেয়ে আমাকে বিয়ে করতে চায়নি, তাই করা হয়নি। তুই যখন স্বর্গভেঁড়া থেকে আসতিস তখন দোমহনি নামে একটা জায়গা পড়ত, মনে আছে?
দোমহনি নয়, ময়নাগুড়ি থেকে বার্নিশঘাটে চলে আসতাম। তবে দোমহনি কোথায় তা আমি জানি।
তার কাছেই আমার আস্তানা। দশজন বুড়োবুড়িকে নিয়ে। দেবেশ বলল।
বুঝলাম না।
দশ বিঘে জমি বহুদিন আগে খুব অল্পদামে পেয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে চালাঘর বানিয়ে আছি আমরা। যেসব মানুষের রোজগার নেই, খাবার দেওয়ার কেউ নেই, মরার পর মুখে আগুন দেওয়ার মতো কোনও আত্মীয় স্বজন নেই, তারা আমার সঙ্গে থাকে। বছর দশেক হয়ে গেল। এর মধ্যে চারজন চলে গেল, তাদের জায়গায় নতুন চারজনকে এনেছি। মনে হচ্ছে। ওদের মধ্যে দুজনের যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। দেবেশ বলল।
এই দশজনের থাকা-খাওয়ার খরচ তুই চালাচ্ছিস? অনিমেষ অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করল।
থাকার খরচ তো নেই। খাওয়ার খরচ–। হাসল দেবেশ, আয় না। একদিন। নিজের চোখে দেখে আসবি।
যাব। খুব ইন্টারেস্টিং বলে মনে হচ্ছে।
ভাই। আমি তো একা বিপ্লব, সমাজসেবা কিছুই করতে পারব না। জীবনভর কোনও রাজনীতিতে বিশ্বাস করতে পারিনি। শুনেছি তুই বিপ্লব করতে গিয়েছিলি, জেলে ছিলি। নিজের একটা পা তার জন্যে সেলামি দিতে হয়েছে, আমার সে সব করার ক্ষমতা বা সাহস ছিল না। আমি একটা কথা বুঝেছি। সেই বোঝার কাজটা করে বেশ শান্তি পাই। যাদের নিয়ে করি তারা পরের দিনের স্বপ্ন দেখে, যা আগে দেখত না। কবে যাবি বল? দেবেশ জিজ্ঞাসা করল।
এই তো এলাম। একটা বড় কাজ করতে হবে। সেটা আগে করি।
কী কাজ?
এই বাড়িতে আমার ছোটমা একা থাকেন। ওঁর পক্ষে আর থাকা সম্ভব হচ্ছে না। তাই বাড়িটাকে বিক্রি করতে হবে।
ছোটমা– আমার দ্বিতীয় মা। দাদু,বাবা, বড়পিসিমা চলে গেছেন। উনি আছেন।
তাই বাগান পরিষ্কার করাচ্ছিস?
প্রশ্নটা শুনে হেসে ফেলল অনিমেষ। না না। সাপখোপ জন্মাচ্ছে, শেয়াল বাচ্চা দিয়েছে ওখানে, তাই। ভাবছি এখানকার কাগজে বিজ্ঞাপন দেব।
তুই এক কাজ কর, কদমতলার মোড়ে একটা স্টেশনারি দোকান আছে। দোকানের মালিক জগদীশবাবু। সবাই চেনে। লোকটা বাড়ি কেনা-বেচার দালালি করে। ওর কাছে যা। ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
তোর চেনা?
আগে চিনতাম। অনেক বছর যোগাযোগ নেই।
এই সময় অনিমেষ দেখল ছোটমা তার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ইশারায় তাকে ডাকছেন। সে ক্রাচ নিয়ে এগিয়ে যেতেই ছোটমা বললেন, চা করেছি। সঙ্গে কি থিন অ্যারারুট বিস্কুট দেব।
ক্রাচ সামলে দুটো কাপ হাতে নেওয়া সম্ভব নয়। অনিমেষ ডাকল, দেবেশ, এদিকে আয়। দেবেশ উঠে এলে বলল, এর নাম দেবেশ। আমরা সহপাঠী ছিলাম।
মাথা নেড়ে ছোটমা ভেতর থেকে দুটো চায়ের কাপ নিয়ে এলেন।
অনিমেষ লক্ষ করল, একদিকে চিড় লাগা-কাপটা তাকে দিলেন ছোটমা।
বিস্কুট লাগবে? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।
না না। মাথা নাড়ল দেবেশ, আমি চা খাই না। কিন্তু উনি নিজের হাতে দিলেন বলে আজ খাব।
অনিমেষ লক্ষ করল ছোটমায়ের মুখে তৃপ্তির ছাপ ফুটে উঠল।
.