What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected কালোচিতার ফটোগ্রাফ 🐅 (1 Viewer)

হোটেলের গেটের পাশে কয়েকটা গাড়ির পাশে তার বাইকটা দাঁড় করানো আছে। নিঃশব্দে সেটাকে রাস্তায় নিয়ে এল সে। তখনই মনে পড়ল তেল ভরা দরকার। এখন এই মুহূর্তে শহরের কোনও পাম্প ভোলা থাকার কথা নয়। শহরের বাইরে কতদূরে পাম্প পাবে তাও জানা নেই। অতএব এখন পাম্পের সন্ধানে তাকে শহরে টহল দিতে হবে। কাজটা গতকাল সেরে রাখা উচিত ছিল। কিন্তু ভাগ্য প্রতিকূল ছিল না। বাস টার্মিনাসের কাছাকাছি পাম্পটায় আলো জ্বলছিল। দুজন মানুষ এত ভোরেও গুলতানি করছিল সেখানে। এদের বোধহয় শীতবোধ নেই।

তেল ভরতে-ভরতে একজন রসিকতা করল, পক্ষীরাজ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কোথায়?

রাজকন্যা খুঁজতে। প্রদীপ জবাব দিল।

নাম্বার প্লেট দার্জিলিং-এর দেখছি। বরফের ওপর বাইক চালানোর অভ্যেস আছে তো? তেল ভরতে-ভরতে লোকটা জিজ্ঞাসা করল।

নেই। করে নেব।

সামনে ঝুঁকে চালাবে না।

দাম মিটিয়ে শহর ছাড়ল প্রদীপ। একবার ভাবল লিটনের খবর নেবে কি না। তারপর মত পালটাল। কাপুরের কিছু হলে লিটন এতক্ষণ চুপ করে বসে থাকার ছেলে নয়। মাঝরাতেও তেমন খবর থাকলে দিয়ে যেত।

এখন অন্ধকার কেটে যাচ্ছে দ্রুত। আকাশ পরিষ্কার। মনে হচ্ছে চমৎকার সূর্যের দিন আসছে একটা। যদিও এই ভোরে বাইক চালাতে বেশ কষ্ট হচ্ছে হাওয়ার দাপটে। আপাদমস্তক। ঢাকা সত্ত্বেও ঠান্ডা যেন চুঁইয়ে ঢুকে পড়ছে। প্রদীপ স্পিড বাড়াচ্ছিল না। গতকাল যে ম্যাপটা দেখেছিল সেটাকে মনে করার চেষ্টা করছিল। রাস্তাটা এখন নেমে যাচ্ছে! চমৎকার পিচের মসৃণ রাস্তা। প্রদীপ এখন নিঃসন্দেহ কেউ তাকে অনুসরণ করছে না। এমন ফাঁকা পাহাড়ি রাস্তায় কেউ পেছনে এলে চট করে বোঝা যায়। মাঝে একটা ছোট্ট বসতি পড়ল। চায়ের দোকানে এর মধ্যে আগুন জ্বলছে। বাইকটাকে একপাশে দাঁড় করিয়ে সে দোকানের সামনে গেল, চা পাওয়া যাবে ভাই?

বৃদ্ধ সিকিমিজ মানুষটি মাথা নাড়ল। চারপাশ সুনসান। রাস্তার ওপাশে পাহাড়। পেছনে গোটা দশেক কাঠের বাড়ি। সেখানে কেউ বিছানা ছেড়েছে বলে মনে হয় না।

প্রদীপ জিজ্ঞাসা করল, এখান থেকে বর্ডার কত দূরে?

অনেক দূরে! বৃদ্ধ জবাব দিল, আজ বর্ডারে কী আছে?

তার মানে? কিছু আছে নাকি?

আমি জানি না। একটু আগে যারা চা খেয়ে গেল তারাও জিজ্ঞাসা করছিল বর্ডারের কথা।

প্রদীপ তাকাল, কতক্ষণ আগে?

এই তো। তখনও না ধোওয়া গ্লাস দেখাল বৃদ্ধ। দুটো গ্লাস।

ওরা কীসে এসেছিল?

জিপে।

এত ভোরে লোকে যায়?

খুব কম।

চা খেল প্রদীপ। এখনও গ্যাংটক থেকে কোনও গাড়ি আসছে না। ট্যুরিস্ট বাসের আসার সময় হয়নি। লোকদুটো কারা? তার আগে যখন এপথ দিয়ে গিয়েছে তখন নিশ্চয়ই ওদের তাড়া আছে, নইলে অন্ধকার থাকতেই গ্যাংটক ছাড়ত না। পেছনে কেউ থাকলে তাকে মাপা যায় কিন্তু সামনে যে গেছে তার মতলব বোঝা মুশকিল। এমন হতে পারে ওরা আরও নির্জন কোনও পাহাড়ি বাঁকে তার জন্যে অপেক্ষা করছে। সে সতর্ক হলেও কিছু করতে পারবে না ওরা যদি আচমকা আক্রমণ করে। পরমুহূর্তেই হাসি পেল। সে যে এই সাতসকালে হোটেল ছেড়ে বের হবে তা গতরাত্রে পাশে শুয়ে সুজাতাও জানত না। শত্রুপক্ষের আন্দাজ যত শক্তিশালী হোক, তারা অন্তর্যামী নয়। অতএব যারা গিয়েছে নিজেদের প্রয়োজনেই গিয়েছে।
 
আবার বাইক চালু করল সে। নিজের ইঞ্জিনের আওয়াজ ছাপিয়ে অন্য কোনও শব্দ তার কানে ঢুকছিল না। এখন রাস্তা ঘন-ঘন বাঁক নিচ্ছে। আগের জিপটা কতদূরে আছে তা ঠাওর করা অসম্ভব। ঘণ্টা ছয়েক টানা চলে এল প্রদীপ। এর মধ্যে ছোটখাটো অনেকগুলো জনবসতি ছাড়িয়েছে কিন্তু কোথাও জিপটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেনি সে। ক্রমশ গাছপালার চেহারা বদলাতে শুরু করেছে। এবার রাস্তার পাশে মিলিটারিদের প্রতীকচিহ্নগুলো নজরে আসছে। অর্থাৎ বর্ডার খুব বেশিদূরে নেই।

খানিকটা এগোতেই বাঁ দিকে একটা রাস্তা নেমে যেতে দেখে দাঁড়াল সে। রাস্তার মোড়ে যেসব বোর্ড পোঁতা তাতে বোঝা যাচ্ছে এদিকে মিলিটারিদের কোনও ডেরা রয়েছে। বর্ডারের কাছাকাছি সেটা থাকা সম্ভব। তখনই তার খেয়াল হল, ট্যুরিস্ট বাসগুলোর মধ্যে যেগুলো বর্ডারের কাছাকাছি আসে তারা নিশ্চয়ই বিশেষ পারমিট সঙ্গে রাখে। নিশ্চয়ই পারমিট ছাড়া বিশেষ পয়েন্টের ওপাশে যাওয়া বেআইনি। তেমন হলে সে কী করবে?

বাইক চালাল প্রদীপ। আগের জিপের ভাগ্যে যা আছে তার ক্ষেত্রেও নিশ্চয়ই একই হবে। তবে বাধা পেলে অন্য রাস্তা ধরা ছাড়া কোনও উপায় নেই। ঠান্ডা বাড়ছে। ওপর দিকে উঠতে হচ্ছে তাকে। এবং তারপরেই রাস্তায় গুঁড়ি-গুড়ি তুষার দেখতে পেল সে। গতি কমিয়ে পেছন দিকে ওজন রেখে সে কিছুটা চলতেই সদ্য যাওয়া জিপের চাকার দাগ দেখতে পেল। তুষারের ওপর চমৎকার চিহ্ন রেখে গিয়েছে জিপটা। একটু-একটু করে তুষার ঘন হচ্ছে। আশেপাশের গাছের পাতা সাদা হয়ে এসেছে। গাছগুলোও ঘন নয়। জিপের দাগের ওপর চাকা রেখে বাইক চালাচ্ছিল প্রদীপ। স্লিপ খাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও চালাতে সুবিধে হচ্ছিল তাতে।

একসময় বরফে চারপাশ ছেয়ে গেল। আর সেই বরফের ওপর তিরতিরে নরম রোদ যখন এসে পড়ল তখন মনে হল স্বর্গ যদি কোথাও থাকে তো সেটা এখানেই। খুব ধীরে প্রায় কুড়ি কিলোমিটার স্পিডে চালাচ্ছিল প্রদীপ। অনেকক্ষণ কোনও মানুষ বা জনপদ তার চোখে পড়েনি। এসব অঞ্চলে পাহাড়ের গায়ে যে গ্রাম থাকা খুবই স্বাভাবিক তা সে জানে। কিন্তু চোখে কিছু পড়ছিল না। আরও আধঘণ্টা যাওয়ার পর প্রদীপ বাইক থামাল। জিপটা সামনে এগোয়নি। চাকার দাগ হঠাৎ মূল পথ ছেড়ে উঠে গেছে ডান দিকে। সেই দাগটা স্পষ্ট। দুটো বড় গাছের ফাঁক দিয়ে যে পথ আছে তা বরফের আস্তরণ ভেদ করে বোঝা মুশকিল যদি না ড্রাইভারের জানা থাকে।

জিপের ড্রাইভার আর সরাসরি এগোতে চায়নি। কিন্তু ওই চোরা পথে যখন জিপ নিয়ে যাওয়ার সাহস দেখিয়েছে তখন বোঝাই যায় বাইক যেতে পারে। কিন্তু প্রদীপ সোজা এগিয়ে যাবে বলে ঠিক করল। ট্যুরিস্ট বাস ওই পথে কিছুতেই নামতে পারবে না। অতএব যে পথে বাসগুলো যাওয়া-আসা করে সেই পথে যাওয়াই ভালো। চেকপোস্ট এলে দেখা যাবে।

খানিকটা যেতেই প্রদীপ বুঝতে পারল খুব ভুল হয়ে গিয়েছে। সঙ্গে গগলস আনা উচিত ছিল। এখন চারদিকের পৃথিবীটা কীরকম ধূসর সাদা। তার ওপর রোদ পড়ায় চোখে প্রতিফলন পড়ছে। এই রকম আলো বা বরফের দিকে বেশিক্ষণ তাকানো যায় না। অনেক দূরে বরফের ওপর কিছু একটা দৌড়ে গেল। সেই কালো জন্তুটা আর যাই হোক ব্ল্যাক লেপার্ড নিশ্চয়ই নয়। ভদ্রলোক দারুণ গল্প ফেঁদেছিলেন। তার মতো ছেলেও সেই গল্প শুনে বিশ্বাস করে ফেলেছিল।

শেষপর্যন্ত একটা পুলিশ ফাঁড়ির সামনে পৌঁছে গেল সে। পাহাড়ের গায়ে বরফে ঢাকা পুলিশ ফাঁড়ির সামনে দুটো জিপ দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে কয়েক ঘর মানুষের বাস। মুদি এবং চায়ের চোকানে সদ্য ভোর হয়েছে যেন। বাইক থামিয়ে নেমে দাঁড়াল প্রদীপ। সম্ভবত এটাই সেই পুলিশ স্টেশন যেখানে বাস ড্রাইভার চন্দ্রনাথ খবরটা দিয়েছিল। আর সম্ভবত এই সেই পুলিশ স্টেশন যেখান থেকে খবরটা দার্জিলিং-এ পৌঁছে যায়। শেষের ব্যাপারটা তার অনুমান হতে পারে। হতে পারে ঘটনা অন্য। তবু সতর্ক হয়ে এগোল প্রদীপ।

কাঠের পুলিশ ফাড়ির সিঁড়িও বরফে ঢাকা। বারান্দায় উঠতে-উঠতে জামা এবং মাথা থেকে তুষার ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করছিল প্রদীপ। বারান্দায় কেউ নেই। প্রথম ঘরটার দরজায় দাঁড়িয়ে সে দেখতে পেল দুজন লোক ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বালিয়ে কথা বলছে। এদের দেখে নিচের দিকের পুলিশ কর্মচারী বলে মনে হল। পায়ের আওয়াজ পেয়ে ওরা তাকাল। প্রদীপ হাসার চেষ্টা করল, গুড মর্নিং।

সঙ্গে-সঙ্গে দুজন সোজা হয়ে দাঁড়াল। ভাবভঙ্গিতে মনে হচ্ছিল ওরা ওপরতলার কোনও অফিসারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। প্রদীপ তৎক্ষণাৎ গলা মোটা করল, অফিসার ইনচার্জ কোথায়?

উনি খুব অসুস্থ। গতকাল বিকেলে গ্যাংটকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে স্যার।

কী হয়েছে?

জুর। ম্যালেরিয়াও হতে পারে। একবার আমার ভাই-এর ওইরকম কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এসেছিল। সঙ্গী তাকে ইশারা করল ফালতু কথা না বলতে।

সেকেন্ড অফিসার?

নেই স্যার। আসলে আর একটু এগোলেই মিলিটারি বেস–।

বুঝতে পেরেছি।

বসুন স্যার। চা আনব? অ্যাই রাই, জলদি চা–।

লোকটা বলমাত্র রাই ছুটল চা আনতে।
 
প্রদীপ বসল না। আজ এখানে নিশ্চয়ই অচেনা উচ্চপদস্থ কারও আসার কথা আছে। কোনওরকম জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়া যখন এরা তাকে সেই ভূমিকায় ভাবছে তখন এদের নিয়ে তার চিন্তা করার কিছু নেই। সে দেখল, একটা কালো বেড়ালও ফায়ার প্লেসের পাশে বসে আগুন পোয়াচ্ছে। প্রদীপ বলল, তুমি দেখছি বেশ স্মার্ট। গুড। ডেডবডিটা কোথায়?

ডেডবডি? কার ডেডবডি?

শোনো, আমাকে সত্যি কথা বললে তোমার প্রমোশন আটকাবে না। লোকটা ঠোঁট চাটল। তারপর বলল, বড়বাবু নিষেধ করেছিল বলতে। তা হোক, বলছি। আমরা ওটাকে তুলে আনিনি। বরফ চাপা দিয়ে এসেছি।

সে কি? কেন?

স্যার, ডেডবডি আনা মানেই ঝামেলা। অনেক এনকুয়ারি করতে হয়। পাতার পর পাতা রিপোর্ট। তারপর বডি নিয়ে গ্যাংটকে যেতে হবে পোস্টমর্টেমের জন্যে।

অয়ারলেস না টেলিফোন, কী আছে?

দুটোই, তবে টেলিফোনের লাইন প্রায়ই খারাপ থাকে।

এখন কীরকম আছে?

ভালো।

বডিটা কোথায় চাপা দিয়েছ?

যেখানে মার্ডারটা হয়েছিল স্যার।

পেছনে টাঙানো ম্যাপের দিকে তাকাল প্রদীপ, ঠিক কোন জায়গায়?

লোকটা এগিয়ে গেল ম্যাপের দিকে। আঙুল তুলে জায়গাটা দেখাল। প্রদীপ লক্ষ করল। এর মধ্যে ওই জায়গাটার নিচে দাগ দেওয়া আছে। সে জিজ্ঞাসা করল, ওখান থেকে বর্ডার কতদূরে? কতক্ষণ লাগে যেতে?

স্যার, আধঘণ্টার পথ।

এই সময় চা নিয়ে রাই ফিরে এল। টেবিলের ওপর রেখে বলল, স্যার চেয়ারে বসে। খেয়ে নিন, এখানে যত গরমই হোক চট করে ঠান্ডা হয়ে যায়।

প্রদীপ চেয়ারে বসল। সম্ভবত অফিসার ইনচার্জের চেয়ার এটা। তার বেশ মজা লাগছিল। চা আনামাত্র বেড়ালটা চলে এল পায়ের কাছে। কোনওরকম শব্দ না করে তাকিয়ে রইল গ্লাসের দিকে।

স্যার বিস্কুট খাবেন? রাই জিজ্ঞাসা করল।

প্রদীপ কিছু বলার আগেই দ্বিতীয়জন খিঁচিয়ে উঠল, তোর মাথায় কী বুদ্ধি! একেবারে আনতে পারলি না? যাই, আমি নিয়ে আসি। লোকটা বেরিয়ে গেল। এবার রাই বলল, আমি। স্যার আপনার থাকার ব্যবস্থা করি।

লোকদুটো যেন সামনে থেকে চলে যেতে পারলে বাঁচে। গ্লাসটা হাতে ধরতেই উত্তাপে আরামবোধ হল। এইসময় বেড়ালটা ডেকে উঠল, মাও।

প্রদীপ বলল, এতো পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা। নাও, তুমি একটু গেল। সে গ্লাসের চা মেঝেতে ঢালতেই বেড়ালটা চকচক করে চেটে নিল। প্রদীপ চা মুখে দিতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার চোখ আটকে গেল বেড়ালটার ওপরে। ছটফট করে গড়াগড়ি খাচ্ছে বেড়ালটা। মুখ দিয়ে লালা গড়াচ্ছে। তারপর স্থির হয়ে গেল বেচারা।

প্রদীপ সোজা হয়ে বসল। মৃত বেড়ালটার ওপর থেকে চোখ সরিয়ে সে চারপাশে তাকাল। এটা একটা পুলিশ স্টেশন। যে দুটো লোক এখানে ছিল তারা পুলিশ। কিন্তু স্যার-স্যার বলে সম্মান দেখিয়ে ওরা তাকে বিষ মেশানো চা খাওয়াতে চাইল কেন? যদি বেড়ালটা তাকে বিরক্ত না করত তা হলে এতক্ষণে তার অবস্থা ওর মতো হতো। প্রদীপ উঠল। বেড়ালটাকে তুলে ফায়ারপ্লেসের কাছে নিয়ে গিয়ে এমন ভঙ্গিতে শুইয়ে দিল যাতে মনে হবে ও ঘুমাচ্ছে। তারপর আবার চেয়ারে এসে বসল। কী করবে সে এখন? এমন ভান করবে যে লোকগুলো ফিরে এসে ভাববে সে মৃত! কিন্তু তাহলে তো বেশিক্ষণ সেই অভিনয় করা যাবে না।

পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। বারান্দা থেকে রাই তাকে দেখতে পেয়ে যেন অবাক হয়ে গেছে। বেশ হতভম্ব হয়েই লোকটা দাঁড়িয়ে পড়ল।

প্রদীপ তাকে ডাকল, কী হল? এসো?

লোকটা ভূতগ্রস্তের মতো এগিয়ে এল।

বিস্কুট পাওয়া গেছে?

ইয়ে না, মানে, আনছি।

আরও দুটো গ্লাস নিয়ে এসো।

কেন? গ্লাস কেন?

এতখানি চা আমি একা খেতে পারব না। তোমরাও খাবে।

আমরা স্যার চা খেয়েছি।

তাতে কিছু হবে না। ঠান্ডায় বারংবার চা খাওয়া যায়।

না স্যার। খেলে আমার শরীর খারাপ হয়।
 
এই সময় দ্বিতীয় লোকটি ফিরে এল। প্রদীপ তার দিকে গ্লাস এগিয়ে দিল, নাও চা খেয়ে নাও। আমার পেটটা ঠিক নেই।

দ্বিতীয় লোকটা এগিয়ে আসছিল। প্রদীপ বাধা দিল না। লোকটা গ্লাস তুলে নিতে রাই। ছটফট করে উঠল, খেয়ো না। খবরদার বলছি।

লোকটা অবাক হয়ে তাকাল।

প্রদীপ উঠে তার হাত থেকে গ্লাস কেড়ে নিল, খেলে তোমার অবস্থা ওই বেড়ালটার মতো হবে। এই গ্লাসের চা ও কিছুটা খেয়েছে।

দ্বিতীয় লোকটা বিস্ফারিত চোখে বেড়ালটাকে দেখল। সে যেন কিছুই বুঝতে পারছিল না।

প্রদীপ গ্লাসটাকে চোখের সামনে ধরে বলল, আমাকে মারার জন্যে মিস্টার রাই এই গ্লাসে বিষ মিশিয়ে নিয়ে এসেছিল। তাই তো মিস্টার রাই?

আমি কিছু জানি না স্যার!

মিস্টার রাই জানে আমি কোনও সিনিয়ার পুলিশ অফিসার নই। তবু আমাকে স্যার স্যার বলে খাতির করছে। তোমাকে ও কী বলেছিল?

বলেছিল একজন বড় অফিসার আসবে। দ্বিতীয় লোকটির তখনও মাথা পরিষ্কার হয়নি।

কখন বলেছিল?

আধঘণ্টা আগে। শহর থেকে টেলিফোন এসেছিল।

কে ধরেছিল?

ও স্যার।

তোমার কিছু বলার আছে রাই?

পরশুদিন যখন একটা ট্যুরিস্ট বাসের ড্রাইভার এসে এখানে মার্ডারের কথা রিপোর্ট করে তখন অফিসার ইনচার্জ ছিলেন?

প্রদীপ রাই-এর দিকে এগিয়ে গেল।

ছিলেন।

তিনি গিয়েছিলেন এনকুয়ারি করতে?

না। শরীর খারাপ বলে রাইকে পাঠিয়েছিলেন। আমিও সঙ্গে গিয়েছিলাম। দ্বিতীয়জন বলল।

তারপর?

ঝামেলা বাড়বে বলে ও ডেডবডি বরফ চাপা দেওয়ার প্রস্তাব দিল। আমি রাজি হয়ে গেলাম।

এইসময় রাই যেন নার্ভ ফিরে পেল। আচমকা চিৎকার করে উঠল সে, এই মাথামোটা! কার কাছে এসব বলছিস? এই লোকটা পুলিশ নয়।

প্রদীপ এগিয়ে গেল ঘরের আর এক কোণে যেখানে টেলিফোনটা রয়েছে। রিসিভার তুলে ডায়াল টোন শুনল। তারপর বলল, এখানে ফিরে যে প্রথম সুযোগেই তুমি গ্যাংটকে টেলিফোন করে খবরটা দিয়েছিলে রাই। কোন নম্বরে?

আমি কিছুই করিনি।

টেলিফোনে ডায়াল করার ব্যবস্থা নেই। হঠাৎই অপারেটারের গলা শোনা গেল। প্রদীপ তাকে বলল, দার্জিলিং-এর লাইন চাই। জরুরি। পাওয়া যাবে?

লোকটা বলল, চেষ্টা করছি। নাম্বারটা বলুন।

প্রদীপ নাম্বার বলল। রিসিভার নামিয়ে রেখে প্রদীপ বলল, গ্যাংটকে তুমি যার সঙ্গে কথা বলেছ আমি তার বসের সঙ্গে কথা বলছি।

আমি কিছু জানি না।

তুমি সব জানবে।

আমি কাউকে ফোন করিনি।

তাহলে কেউ এখানে ফোন করেছিল?

একজন জানতে চেয়েছিল মার্ডারের ব্যাপারে কোনও রিপোর্ট কেউ করেছে কি না।

তুমি জানিয়ে দিয়েছিলে। এবং সে বলেছিল ডেডবডিটা হাপিস করে দিতে। প্রদীপ কথা শেষ করা মাত্র রিঙ হল। অপারেটার বলল, দার্জিলিং লাইনে আছে কথা বলুন।

একটু গলা তুলে প্রদীপ বলল, হ্যালো!

ওপাশ থেকে ক্ষীণ আওয়াজ এল, ইয়েস। হু ইজ স্পিকিং?

প্রদীপ।

তুমি কোথায়?

বর্ডারের কাছাকাছি পুলিশ স্টেশনে। মনে হচ্ছে আপনার তিন নম্বর ফটোগ্রাফারকে আজই পেয়ে যাব। এখন আপনার প্রতিশ্রুতি মতো টাকাটা রেডি করুন।

টাকার জন্যে চিন্তা করো না। দার্জিলিং-এ ফিরে এলেই তুমি পেয়ে যাবে।

দার্জিলিং-এ তুমি আমাকে কখনওই ফিরতে দেবে না। মনে-মনে বলল প্রদীপ।

কিন্তু এই পুলিশ স্টেশনের একটি লোক যার নাম রাই, তাকে নিয়ে সমস্যা হচ্ছে।

কী রকম?

লোকটা বলছে এখানে ব্ল্যাক লেপার্ড কোনওকালে ছিল না। সেদিন ওই স্পটে একটা খুন হয়েছে। ড্রাইভার নাকি সেইরকম রিপোর্ট করেছিল।

কে বলেছে? কী নাম বললে?

রাই।

খুন নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। তুমি তিন নম্বরকে বের করে সঙ্গে-সঙ্গে আমাকে রিপোর্ট করো। লাইনটা কেটে গেল অথবা কেটে দিলেন ভদ্রলোক।

রিসিভার নামিয়ে প্রদীপ হাসল, তাহলে মিস্টার রাই, এখন কী করবে?

আমি কিছু জানি না।

কিন্তু ওরা জানবে। আমার ফোন রেখেই গ্যাংটকে অর্ডার যাবে তোমাকে সরিয়ে ফেলার। যারা তোমাকে আমার এখানে আসার খবর দিয়ে বিষ মেশাতে বলেছিল তারাই তোমাকে সরাতে আসবে। পুলিশে চাকরি করে তুমি বেশ আরামে ছিলে, হঠাৎ কোন লোভের ভূত তোমার মাথায় চেপেছিল?
 
প্রদীপের বলার ভঙ্গিতে এমন কিছু ছিল যে লোকটা নিজেকে সামলাতে পারল না। একটা চেয়ারে বসে পড়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।

প্রদীপ অন্য লোকটিকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি এসব জানো?

লোকটা মাথা নাড়ল পুতুলের মতো, না।

প্রদীপ এগিয়ে গেল, এখনও যদি বাঁচার ইচ্ছে থাকে তাহলে সত্যি কথা বলো রাই।

লোকটা চোখ মুছল। শ্বাস টানল। তারপর বলল, আমি ট্রান্সফার চেয়েছিলাম। এই বরফের মধ্যে পড়ে থাকতে আমি আর পারছিলাম না। ওরা আমাকে কথা দিয়েছিল। একটা ছেলে আর একটা মেয়েকে খুঁজতে এসেছিল ওরা। বলেছিল কোনও খবর পেলেই যেন গ্যাংটকে জানিয়ে দিই। ওদের অ্যারেস্ট করা চলবে না, ভুল বুঝিয়ে ধরে রাখতে হবে। তার জন্যে টাকা তো দেবেই, বদলিও করাবে।

তারপর?

ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। ওরা সব পারে! আবার ককিয়ে উঠল লোকটা।

তুমি এখনও মরোনি!

কেন আপনি আমার নামে মিথ্যে কথা বললেন?

তুমি একটু আগে আমাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলে, তাই না?

আমাকে ওরা টেলিফোনে সেই হুকুম করেছিল।

কে করেছিল?

লোকটার নাম আমি জানি না।

কোত্থেকে করেছিল?

বোধহয় গ্যাংটক থেকে। অন্য একটা গলায় পেট্রলের দাম চাইতে শুনেছিলাম।

তার মানে সেই পাম্প থেকে যেখানে সে তেল নিয়েছিল। ওদের নেটওয়ার্ক বেশ মজবুত।

বডিটাকে সরিয়েছ?

না। এখনও পারিনি। একা পারা যায় না।

তোমার এই বন্ধুটিকে সঙ্গে নিলে পারতে।

তাহলে ওকে সব বলতে হতো।

কত টাকা পেয়েছ এর মধ্যে?

বিশ্বাস করুন, একটা টাকাও আমি পাইনি। লোকটা কথা বলছিল আর চমকে বাইরের দিকে তাকাচ্ছিল। প্রদীপ বলল, শোনো রাই, আমি নিশ্চিত তোমার জন্যে ওরা রওনা হয়ে গেছে। হয়তো আমার জন্যেও। তুমি এখনই এখান থেকে পালাও।

কোথায় যাব? চারপাশে বরফ।

যেখানে তোক গিয়ে লুকিয়ে থাকো। দুপুরে ট্যুরিস্ট বাসগুলো এলে তাতে উঠে বসো।

ট্যুরিস্ট বাস এখান থেকে প্যাসেঞ্জার তোলে না।

তুমি পুলিশ, তোমাকে তুলবে।

কিন্তু পারমিশন ছাড়া ক্যাম্প ছেড়ে যাওয়া নিযেধ।

তাহলে তোমার প্রাণ শরীর ছেড়ে যাবে।

এবার অন্য লোকটি কথা বলল, রাই, যা হওয়ার তা হয়েছে। তুই এক নম্বর গুহায় গিয়ে লুকিয়ে থাক। ওরা তোকে খুঁজে পাবে না।

রাই ছুটল। কয়েক মিনিটের মধ্যে একটা ব্যাগ আর দুটো কম্বল নিয়ে হাজির হল সে।

প্রদীপ জিগ্যেস করল, এক নম্বর গুহাটা কত দূরে?

এখান থেকে মিনিট চল্লিশ হাঁটতে হয়। ডান দিকের সরু পথ ধরে পাহাড়ের ওপরে।

গাড়ি যায় না?

একটা জিপ কাছাকাছি যেতে পারে উলটো দিক দিয়ে। আমি অনেকদিন যাইনি ওখানে। তুই গিয়েছিস?

অন্য লোকটি মাথা নাড়ল, না। তবে কোনও মানুষ তো ওখানে যাবে না।

চলো, তোমাকে আমি এগিয়ে দিচ্ছি। যেতে গিয়েও ঘুরে দাঁড়ায় প্রদীপ। অন্য লোকটির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি এখন একা থাকবে। ওরা এসে তোমাকে জিজ্ঞাসা করলে তুমি কী বলবে?

লোকটি বিপদে পড়ল। মাথা নেড়ে বলল, বলব আমি কিছু জানি না।

ওরা বিশ্বাস করবে না। তোমার ওপর এমন চাপ দেবে, সে সত্যি কথা বলতে বাধ্য হবে। তুমি যদি তোমায় সহকর্মীকে বাঁচাতে চাও তাহলে অন্য কথা বলতে হবে।

বলুন।

বলবে আমি এখানে আসার পর ওর সঙ্গে ঝামেলা হয়। আমি পিস্তল দেখিয়ে তোমাদের ভয় দেখাই। তারপর কোথাও ফোন করি। সেই সুযোগে আমার হাত থেকে বাঁচার জন্যে ও পালায়। কোথায় পালিয়ে গেছে তা তুমি জানো না।

আপনার কথা যদি জিজ্ঞাসা করে?

করবেই। বলবে আমি বাইক নিয়ে বর্ডারের দিকে চলে গেছি। ওরা যাই বলুক এর। বেশি তুমি কিছু জানো না। এর বেশি কথা বললে ওরা তোমাকেও ছাড়বে না।
 
বাইরে বেরিয়ে রাস্তার দিকে তাকাল প্রদীপ। ওরা কতটা পেছনে আছে বলা যাচ্ছে না। কিন্তু তৃতীয় ফটোগ্রাফারকে পাওয়ার আগেই ওরা তাকে সরিয়ে ফেলতে চাইল কেন? হঠাৎ মেরুদণ্ড শিরশির করে উঠল ওর। কাপুর এবং লিটনের অস্তিত্ব কি ওরা টের পেয়ে গেছে? লিটনকে অনুসরণ করে ওরা যদি সানশাইন হোটেলে পৌঁছায় তাহলে কাপুরকে খুঁজে বের করতে অসুবিধে হবে না। কাপুর সম্পর্কে লিটনের কৌতূহলই ওদের কাছে তৃতীয় ফটোগ্রাফারের হদিশ পাইয়ে দেবে। নিজের আঙুল কামড়াতে ইচ্ছে করছিল প্রদীপের। ইচ্ছে হচ্ছিল আবার ভেতরে ঢুকে টেলিফোনে সানশাইন হোটেলে খোঁজ নেয় লিটন কেমন আছে। এই সময় রাই বলে উঠল, স্যার!

লোকটার দিকে তাকাল প্রদীপ। জলে ভেজা বেড়ালের মতো অবস্থা। আর দেরি করলে সে দুজনের বিপদ ডেকে আনবে। বাইক চালু করে সে বলল, পেছনে বসো। যদি কোনও বদ মতলব থাকে তাহলে জেনো আমি তোমাকে নিয়ে মরব।

না স্যার! আমি বাঁচতে চাই, সত্যি বলছি।

উঠে বসো। কোন দিক দিয়ে যেতে হবে বলে দাও।

রাই-এর দেখানো পথে বাইক চালালো প্রদীপ। কিছুটা নামার পর গাড়ি যাওয়ার পথ ছেড়ে সরু পথ দিয়ে বাইক চালাতে লাগল সে। এত নরম তুষার রাস্তায় ছড়িয়ে যে বাইকে গতি তোলা যাচ্ছিল না। ইঞ্জিন আওয়াজ করছিল বিশ্রীভাবে। অনেকটা ওঠার পর যখন নিচের রাস্তা অদৃশ্য তখন বাইক দাঁড় করালো প্রদীপ। লোকটা বসে আছে পেছনে পুতুলের মতো। সে জিজ্ঞাসা করল, লাশটাকে কোথায় ঢেকে রেখেছ?

নিচের রাস্তায় স্যার। এখান থেকে কিছুটা এগিয়ে রাস্তার ডান দিকে তিনটে বড় ন্যাড়া গাছ পাশাপাশি আছে। দেখলে মনে হবে তিন ভাই। তার পেছনে।

মার্ডারটা কোথায় হয়েছিল?

ওখানেই।

এখান থেকে ওখানে পৌঁছবার কোনও শর্টকাট রাস্তা আছে?

আরও একটু এগোলে সোজা নিচে নেমে যেতে পারবেন। তবে বাইক যাবে না।

এক নম্বর গুহা আর কতদূরে?

এই পাহাড়ের ওপাশে। একটু এগোলেই দেখা যাবে।

আবার বাইক চালাল প্রদীপ। তুষারে চাকা আটকে যাচ্ছে। কোনওমতে মিনিট দশেক যাওয়ার পরে রাই বলল, এখানে আমাকে নামিয়ে দিন স্যার।

বাইক থামিয়ে প্রদীপ জিজ্ঞাসা করল, গুহাটা কোথায়?

আঙুল তুলে উঁচুতে দেখাল রাই। সোজা ওপরে উঠে যেতে হবে। বরফ ভেঙে ওঠা খুব মুশকিল। তারপর খানিকটা উত্তরে গেলে গুহাটাকে দেখা যাবে।

ঠিক আছে। তুমি ওখানে অপেক্ষা করো। ট্যুরিস্ট বাস কখন এখানে আসে?

দুপুর একটা নাগাদ। ফিরে যায় আধঘণ্টা পরে।

কিন্তু সেটা নিশ্চয়ই নিচের রাস্তা দিয়ে যায়।

হ্যাঁ স্যার। ওপাশ থেকে নামলে রাস্তাটা কাছে পড়বে।

তা হলে ওই বাস ধরার চেষ্টা করে বাস গ্যাংটকে ঢোকার আগেই নেমে পড়বে। কখনওই গ্যাংটকের স্ট্যান্ডে নেমো না।

না স্যার। আমার বাড়ি শহরে ঢোকার আগেই।

ঠিক আছে। তবে দয়া করে আজ নিজের বাড়িতে যেও না। যাও।

রাই নেমে গেল। হাত তুলে মাথায় ঠেকিয়ে সে বরফ ভেঙে পাহাড়ে উঠতে লাগল। যেহেতু রাস্তা থেকে এ জায়গাটা দেখা যায় না তাই সে নিশ্চিত ছিল।
 
বাইক চালিয়ে আর মাত্র দেড়শো গজ যেতে পারল প্রদীপ। বরফে এখন চাকা ঢেকে যাচ্ছে। নেমে পড়ে চারপাশে তাকাল। তার নজর পড়ল পিছনে কঁচা বরফে বাইকের চাকা চমৎকার দাগ রেখে উঠে এসেছে। সে দৌড়ে অনেকটা নিচে নেমে এল বাইক রেখে। তারপর পা দিয়ে দাগ মুছতে লাগল যতটা সম্ভব। আর আধঘণ্টা সময় পেলে নতুন পড়া তুষার এই মোছার দাগটাও ঢেকে দেবে। মুছতে মুছতে বাইকের কাছে পৌঁছে সে নিশ্বাস ফেলতে লাগল দ্রুত। এখন একেবারে ন্যাড়া পাহাড়ে সাদা বরফের ওপর দাঁড়িয়ে আছে সে। অল্প দূরত্ব থেকেই শত্রুপক্ষ তাকে দেখতে পারে। দূরপাল্লার অস্ত্রে তাকে টার্গেট করতে একটুও অসুবিধে হবে না। প্রদীপ চারপাশে তাকাল। এই বাইক নিয়ে নিচে আসা অসম্ভব। আবার এটাকে এভাবে ফেলে রাখাও যায় না। সূর্যের আলো পড়লে অনেকদূর থেকেও লোকে চকচকে জিনিসটা দেখতে পাবে। সে বাইকটাকে টেনে আরও একটু এগোতে চেষ্টা করল। এবং তারপরেই পাহাড়ের খাঁজটা চোখে পড়ল। ওই খাঁজে এতবড় বাইকটা খুব ভালোভাবে ঢুকে যাবে। এখানে এসে উঁকি না মারলে কারও চোখে পড়বে না। বাইকটাকে আড়ালে ঢুকিয়ে প্রদীপ চাকার দাগ মুছতে লাগল। চেপে চেপে বরফ সমান করা বেশ পরিশ্রমের কাজ।

মোটামুটি সন্তুষ্ট হয়ে সে ওপরে তাকাল। রাই-এর শরীরটা এখন একটা আরশোলার মতো দেখাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেছে লোকটা। একটা সাধারণ মানুষ হঠাৎ লোভে পড়ে যখন কিছু অন্যায় করে ফেলে তখন তার মাথা ঠিকঠাক কাজ করে না। রাই তাই করেছিল। আইনের চোখে ও অন্যায় করেছে। এমন সরকারি কর্মচারীর শাস্তি হওয়া দরকার। কিন্তু সেই শাস্তি দেবে সরকার। কয়েকটা ভাড়াটে খুনি নয়। নিচের রাস্তা কতটা নিচে না নামলে জানা যাবে না। বাইক লুকোনোর জায়গাটা ভালো করে লক্ষ করল সে। পাথরের একটা ফালিকে বেখাপ্পা লাগছে তীক্ষ্ণ ভাবে উঁচিয়ে থাকায়। ওটাই দিক দেখাবে। নিচের রাস্তা থেকে উঠে আসার সময় অনেকটা পথ বাইকের চিহ্ন থেকে গেছে। সে যেখান থেকে মুছতে শুরু করেছিল সেখানে এসে অনুসরণকারীরা ধাঁধায় পড়বে। অবশ্য এই অবধি আসতে ওদের যে সময় লাগবে তার। মধ্যে নতুন পড়া তুষার বাইকের চাকার দাগ মুছে ফেলবে বলে ওর বিশ্বাস হল।

ধীরে-ধীরে প্রদীপ নামতে শুরু করল। পাহাড়ে বরফ থাকলে ওঠা যত সহজ নামা তার চেয়ে ঢের বেশি কঠিন। সমস্ত শরীর ব্যবহার করতে হচ্ছিল প্রদীপকে। সামান্য অমনোযোগী হলেই পা পিছলে কয়েকশো গজ নিচে পড়ে যাবে সে। সে যেখান দিয়ে নামছে তার দুপাশে পাহাড়ের আড়াল। শুধু দুরের ভ্যালিতে না দাঁড়ালে কেউ তাকে দেখতে পাবে না। আধঘণ্টার প্রতিটি সেকেন্ড টানটান হয়ে নেমে প্রদীপ জিরোতে চাইল। নিচে, শ-দুয়েক গজ নিচে রাস্তাটা দেখা যাচ্ছে।

হঠাৎ আকাশে এক ঝাক মেঘ উড়ে আসায় ছায়া নামল বরফের ওপর। প্রদীপ শরীরটাকে একটা ন্যাড়া গাছের গুঁড়িতে আটকে চারপাশে দেখতে লাগল। মাথার ওপর মেঘ জমছে। রোদ আর কোথাও নেই। রাস্তাটা ফাঁকা। হঠাৎ পাহাড়টা যেন কেঁপে উঠল। গুলি ছোঁড়ার শব্দ প্রতিধ্বনিত হতে লাগল পাহাড়ে-পাহাড়ে।

প্রদীপ তাকাল। তার আশেপাশে কেউ গুলি ছোড়েনি এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত। কিন্তু গুলির শব্দ বলে দিচ্ছে এই পাহাড়ে সে এবং রাই ছাড়া অন্তত তৃতীয় কোনও ব্যক্তি রয়েছে। মিনিট পাঁচেক চুপচাপ পড়ে রইল সে। দ্বিতীয়বার কেউ গুলি ছুড়ল না। একেবারে অকারণে কোনও মানুষ গুলি ছুড়লে তাকে পাগল বলা যায়। সেরকম কোনও মানুষ এখানে আছে বলে বিশ্বাস হয় না। প্রদীপ নিজের পিস্তলটাকে স্পর্শ করল। ভাগ্যিস সুজাতা এটাকে নিয়ে মতিলালের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে পেরেছিল। তার মনে হল, সুজাতা মেয়েটা বড় নরম। ও এত নরম না হলেই ভালো হতো।
 
চওড়া রাস্তা থেকে যখন প্রদীপ কয়েক হাত ওপরে ঠিক তখনই ইঞ্জিনের শব্দ শুনতে পেল। একটা গাড়ি উঠে আসছে। বাঁ-দিকের মুখে এলেই গাড়ির আরোহীরা তাকে দেখতে পাবে। চকিতে চারপাশে তাকিয়ে নিল সে। তারপর যতটা সম্ভব দ্রুত সরে গেল বরফের উঁচু ঢিপির পিছনে। সম্ভবত এখানে একটা বড় পাথর ছিল, তাকে ঘিরে বরফ মাথা তুলেছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই জিপটাকে দেখতে পেল সে। খুব শ্লথগতিতে উঠে আসছে জিপটা। ড্রাইভার ছাড়া আরও তিনজন আরোহী রয়েছে বলে মনে হল। জিপের ছাদে তুষার পড়েছে। কিন্তু সামনের কাঁচ আড়াল করেনি। জিপটা ধীরে ধীরে তার সামনে চলে এল। এক ঝলকের জন্যে সে দুটো অস্ত্র দেখতে পেল। পেছনের লোকদুটো সেগুলো সতর্ক হাতে ধরে আছে। সীমান্তের এত কাছে এইসব অস্ত্রধারীরা কী সাহসে আসতে পারে তা ঈশ্বর জানেন। জিপটা উঠে গেল ওপরে।

প্রদীপ নিঃসন্দেহ ওর খোঁজে এরা এসেছে। হয়তো পুলিশ ফাঁড়ির সেপাইটার কথা এরা বিশ্বাস করেছে। পরক্ষণেই গুলির আওয়াজটা মনে পড়ল। এরা কি লোকটাকে গুলি করে এল? অসম্ভব বলে এখন কোনও কিছুই ভাবতে পারছে না সে।

এখন কী করা যায়? তাকে যেতে হবে ওপরে যতক্ষণ তিনটে গাছকে পাশাপাশি দেখতে না পাচ্ছে। জিপটা এগিয়ে গেছে ওই পথে। যদি ওরা কোথাও থেমে গিয়ে অপেক্ষাতে থাকে তা হলে সে বুঝতেও পারবে না। খানিকটা দোনামনা করে রাস্তায় নামল প্রদীপ। তার প্যান্ট এখন প্রায় হাঁটু পর্যন্ত ভিজে সপসপ করছে। জুতো চেপে বসেছে পায়ে। অথচ এগুলো খুলে ফেললে এক মিনিটও হাঁটতে পারবে না সে।

পাহাড়ের ধার ঘেঁষে ওপরে উঠতে লাগল প্রদীপ। এতে সুবিধে হল। পায়ের তলায় সদ্য জমা তুষার অনেক কম। সেগুলো বেশি পরিমাণে পড়েছে খোলা রাস্তায়। দ্বিতীয়ত সরাসরি শত্রুপক্ষের মুখোমুখি পড়তে হবে না তাকে। অবশ্য সোজা যদি ওরা চলে আসে তাহলে পালাবার কোনও পথ খোলা নেই।

কিছুক্ষণ এভাবে হাঁটার পর প্রদীপ বুঝতে পারল ঝুঁকিটা বড্ড বেশি নেওয়া হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কিছু করার নেই। পাহাড়ের গা বেয়ে এই বরফে হাঁটা অসম্ভব ব্যাপার। শত্রুপক্ষ জানে সে বাইক চেপে এসেছে। নিশ্চয়ই বাইকের শব্দ শুনতে চাইবে ওরা। এভাবে হেঁটে যাওয়ার কথা কি ভাববে?

ওপরে ওঠার সময় রাস্তাটা যেখানে বাঁক নিচ্ছে সেখানে পৌঁছে উঁকি মারতেই স্থির হয়ে গেল প্রদীপ। জিপটা দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার ধারে, গাছের গা ঘেঁষে। দুজন তোক জিপের পাশে দাঁড়িয়ে। একজন সিগারেট খাচ্ছে। অন্যজন অস্ত্র হাতে সতর্ক। বাকি দুজনকে দেখা যাচ্ছে ।

এখন আর এগিয়ে যাওয়া যাবে না। ওরা ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। কেন বোঝা যাচ্ছে না। হয়তো কোনও ফঁদ পাতছে তার জন্যে। জিপ থেকে সে মাত্র কুড়ি-পঁচিশ হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে। নিচ থেকে আর-একটা গাড়ি এই সময় উঠে এলে তাকে সহজেই দেখতে পাবে। সিগারেটটা গাছের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে লোকটা কিছু বলতেই অস্ত্রধারী মাথা নাড়ল। কিন্তু নড়ল না। এখন কোনওরকম দুঃসাহস দেখানো বোকামি। প্রদীপ ওপরের দিকে তাকাল। কোনওভাবেই ওদের। ডিঙিয়ে যাওয়া যাবে না।

এইসময় অন্য দুজনকে ওপর থেকে ফিরে আসতে দেখল প্রদীপ। একজনের হাতে অস্ত্র। ওরা কাছে আসার আগেই ওপরের পাহাড়ে জোর আওয়াজ উঠল। অনেকগুলো গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ। লোকগুলো নিজেদের মধ্যে দ্রুত কথা বলে নিল। একটা লোক দুটো অস্ত্র নিয়ে ছুটে গেল খানিকটা দূরে। বরফ সরিয়ে সেখানে অস্ত্র রেখে আবার বরফ চাপা দিয়ে দাগগুলো ঢাকতে লাগল। অন্য তিনজন তাকে দ্রুত কাজ সারতে বলছে। এবং সেইসময় ওপরের পাহাড়ে গাড়িগুলোর আওয়াজ আরও স্পষ্ট হল। একটা লোক জিপের বনেট খুলে ঝুঁকে পড়ল। প্রদীপের মনে হল লোকটা ইচ্ছে করে গাড়ির একটা তার খুলে ফেলল।
 
এবার মিলিটারি কনভয়টাকে দেখা গেল। একটার পর একটা মিলিটারি গাড়ি নেমে আসছে। প্রথম গাড়িটা জিপের পাশে পৌঁছেই থেমে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে পিছনের গাড়িগুলোও। প্রথম গাড়ি থেকে কয়েকজন সৈন্য নিচে নেমে ওদের সঙ্গে কথা বলতে লাগল। ওরা জিপের ইঞ্জিন দেখাচ্ছে। প্রদীপ অনুমান করল ওখানে দাঁড়িয়ে থাকার কারণ জিজ্ঞাসা করছে সৈন্যরা। ওরা নিশ্চয়ই জিপ খারাপের অজুহাত দিচ্ছে।

প্রদীপ পেছনে হাঁটতে লাগল। মোড়টা পার হতেই মিলিটারিরা যে তাকে দেখতে পেয়ে যাবে এটা খেয়াল করেনি এতক্ষণ, সে দ্রুত পাহাড়ের ওপর উঠতে চেষ্টা করল। পাথরের খাঁজের ওপর নরম বরফে পা ঢুকে যাচ্ছে। কোনওমতে শরীরটাকে টেনে তুলতে লাগল সে। তারপর উঁচু হয়ে এগিয়ে যেতে লাগল সামনে। এখন নিচ থেকে কেউ ওপরে মুখ না তুললে তাকে দেখতে পাবে না।

একটু বাদেই মিলিটারি কনভয়টা নিচে নেমে গেল। মাথা নিচু করে বসে রইল প্রদীপ। তারপর আর-একটু এগিয়ে গেল। এখন সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে চারজনকে। যে লোকটা অস্ত্র দুটো বরফের নিচে লুকিয়ে এসেছিল সে ওগুলো ফিরিয়ে আনল। এই নিয়ে নিজেরা বেশ হাসাহাসি করল। সম্ভবত মিলিটারিদের বোকা বানানোর আনন্দে।

ওদের একজন ঘড়ি দেখে কী বলতেই এবার জিপে উঠে বসল সবাই। জিপটা উঠে গেল ওপরে। মিনিট তিনেক বাদে অনেক দূরের রাস্তায় জিপটাকে দেখতে পেল। যদি পথে কাউকে নামিয়ে দিয়ে না যায় তাহলে আপাতত কোনও বিপদ নেই।

নামতে খুব অসুবিধে হচ্ছিল। শেষ ধাপে ব্যালেন্স না রাখতে পেরে প্রায় আছাড় খেয়ে রাস্তায় পড়ল প্রদীপ। কনুই এবং হাঁটুতে বেশ চোট খেল সে। উঠে দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছিল। ফিরে যেতে হলে তাকে বাইকটার কাছে পৌঁছাতে হবে। ততক্ষণ শরীরটাকে যে করেই হোক নিটোল রাখা দরকার। পিস্তলটা ভালো করে দেখে হাতে নিয়ে ও এগোতে লাগল। জিপটায় এই মুহূর্তে কোনও আরোহী আছে কি না এতদূর থেকে দেখতে পায়নি সে। অতএব বিপদ যে-কোনও সময় ঘটতে পারে।

শেষপর্যন্ত তিনটে নিষ্পত্র গাছকে পাশাপাশি নিবিড়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেল সে। তিনটে গাছ। লোকটা বলেছিল তিন ভাই। কিন্তু প্রদীপের মনে হল তিন নিঃসঙ্গ বুড়ি। রাস্তাটা এখানে ঘোড়ার নালের মতো বাঁক নিয়েছে। গাছদুটো তার ঠিক মাঝখানে। এখানে এসেই ট্যুরিস্টবাসের যাত্রীরা হত্যাকাণ্ড দেখেছিল। তিন ফটোগ্রাফার এখানেই ছবি তুলতে পেরেছিল। ব্যাপারটা সঠিক কি না বোঝা যাবে নিহত লোকটির মৃতদেহ গাছের পাশে খুঁজে পেলে। কিন্তু। গাছটা যদি মঞ্চ হয় তাহলে ছবি তোলার পক্ষে যুৎসই।

প্ৰদীপ রাস্তা ছেড়ে পাশের একটু সমান জায়গায় উঠে গেল যেখানে তিনটে গাছ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। বরফে চারপাশে ঢাকা। এসব অঞ্চলে হয়তো খুব কম সময় আসে যখন বরফ পড়ে না। প্রদীপ চারপাশে তাকাল। ঠিক কোন জায়গায় মৃতদেহ রয়েছে তা বোঝা যাচ্ছে না। পরশুর ঘটনার পরে অনেক বরফ জমেছে এখানে। লোকটা বলেছিল, তিনটে গাছের পাশে ওরা বরফ চাপা দিয়েছিল মৃতদেহটাকে। কয়েকমাস ওভাবেই থেকে যাবে যতক্ষণ না বরফ গলে যায়। প্রদীপ পা দিয়ে বরফ সরাতে লাগল। মিনিট দশেক চেষ্টার পর আচমকা শক্ত কিছু পায়ের নিচে পড়ায় সে ধীরে-ধীরে পা সরাল। শার্ট পরা একটা হাত বেরিয়ে এসেছে বরফ থেকে।
 
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে মানুষটাকে বের করে আনতে পারল প্রদীপ। বছর পঁচিশের একটি যুবক। বুকে গুলি লেগেছিল। মোক্ষম একটা গুলি। বরফের নিচে থাকায় শরীরে বিকৃতি আসেনি একটুও। সময় নষ্ট না করে প্রদীপ ওর পকেটে হাত দিল। বুক পকেটে হাত ঢুকিয়ে ও রুমাল, চিরুনি এবং পার্স বের করল। পার্সের ভাঁজ খুলতেই ছেলেটির ছবি একপাশে, অন্যপাশে সুন্দর। হাতের লেখায় নাম-ঠিকানা লেখা কার্ড। দিলবাহাদুর। সেবক রোড, শিলিগুড়ি। পার্সের ভেতর শচারেক টাকা এবং একটা চিঠি। চিঠিটা কোমল নামের একটি মেয়ের লেখা। লিখেছে এই দিলবাহাদুরকেই। চোখ বোলাল প্রদীপ। বাবার নামে অনেক অভিযোগ করে কোমল লিখেছে। তাকে উদ্ধার করতে। সে যেমন করেই হোক তিস্তাবাজারে গিয়ে দিলবাহাদুরের জন্যে অপেক্ষা করবে। দিলবাহাদুর তাকে নিয়ে যেখানে ইচ্ছে যেতে পারে, তার কোনও আপত্তি নেই। তবে আসার আগে দিলবাহাদুর যেন মনে রাখে পৃথিবীতে তার বাবার মতো নৃশংস মানুষ আর কেউ নেই। এখন তার ভালোবাসা আর বাবার প্রতি ভয়, এদুটো সম্পর্কে মন ঠিক করে নিক সে। তিস্তাবাজারে যদি সন্ধে নামে তা হলে ব্রিজের ওপর থেকে সে ঠিক জলে ঝাঁপ দেবে।

জিনিসগুলো পকেটে রাখার সময় প্রদীপ দিলবাহাদুরের গলায় হারটাকে দেখতে পেল। লকেট সমেত রুপোর হার। কোনওমতে মাথা দিয়ে বের করে নিল সে। এবার কী করা যায়? এই ছেলেটাকে আবার বরফ চাপা দিয়ে চলে যাওয়া ঠিক হবে না। সে মৃতদেহ টানতে টানতে রাস্তার মাঝখানে নিয়ে এল। যে-কোনও গাড়ি এই পথে গেলে দিলবাহাদুরের জন্যে থামতে বাধ্য।

এই সময় ওপর থেকে গাড়ির আওয়াজ ভেসে এল। প্রদীপ ছুটল। যতটা পারে নিচে গিয়ে যখন ওপরে ওঠার কোনও সম্ভাবনা দেখতে পেল না তখন খাদের দিকে তাকাল। এবং তখনই চোখে পড়ল রাস্তার ঠিক নিচে চমৎকার একটা আড়াল তৈরি করেছে বরফের স্তূপ। মুখ বের করা একটি পাথরকে সর্বাঙ্গে ঢেকে ফেলেছে বরফ। প্রদীপ সন্তর্পণে পা ফেলে-ফেলে। সেই স্কুপের পেছনে গিয়ে লুকোল। তার সামনে রাস্তা। অদূরে ছেলেটির মৃতদেহ পড়ে আছে। আর তার পেছনে কয়েক হাজার ফুট খাদ। একটু পা পিছলে গেলে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। সামনের বরফের ওপর চাপ দিতে গিয়ে সামলে নিল সে। বরফের স্তূপটা যেন দুলে উঠল। নিচের পাথর অবশ্যই আলগা রয়েছে।

ওপর থেকে জিপটা ফিরে আসছিল হতাশ হয়ে। রাস্তার ওপর মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে ড্রাইভার ব্রেক চাপল। ওরা যেন নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ঠিক তখনই নিচ থেকে গাড়ির আওয়াজ ভেসে এল। কোনও ভারী গাড়ি উঠে আসছে।

ইতিমধ্যে দুজন লোক নেমে পড়েছে জিপ থেকে। তাদের একজনের হাতে অস্ত্র রয়েছে। ওরা মৃতদেহটা খুঁজে দেখল। ওদের একটু ধাঁধায় ফেলার জন্যে প্রদীপ উপুড় করে রেখে এসেছিল মৃতদেহটাকে। যে লোকটির হাতে অস্ত্র সেই সে পা দিয়ে ছেলেটাকে চিৎ করে দিল। দিয়েই চিৎকার করল, একে এখানে কে আনল?

জিপ থেকে একজন জানতে চাইল, কে?

ছানু যাকে মেরেছে। সেপাইটা বলেছিল বডি হাফিস করে দিয়েছে।

যাওয়ার সময় ছিল না, এখন যখন আছে, তখন কেউ ওটাকে টেনে এনেছে।

কে এনেছে তা বুঝতে পারছি কিন্তু সেই মালটা কোথায়? বাইকের আওয়াজ আমি একবারের জন্যেও পাইনি।

আমি তোকে বলছি ও আমাদের বোকা বানাবার জন্যে হেঁটে এসেছে। লোকটাকে খাদে ফেলে দে। নিচ থেকে গাড়ি আসছে। কুইক।

কিন্তু গাড়িটা ততক্ষণে কাছাকাছি চলে এসেছে। সেটা বুঝতে পেরে লোকদুটো দৌড়ে জিপের ভেতর উঠে বসল। জিপটা ব্যাক করার সুযোগ পেল না, একটা ট্যুরিস্টবাস বাঁকের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। খানিকটা এগোতেই মৃতদেহ দেখতে পেল ড্রাইভার। সঙ্গে-সঙ্গে গাড়ি থামিয়ে দিল সে।

বাসের যাত্রীরা মৃতদেহ রাস্তার ওপর পড়ে আছে দেখে কলবল করতে লাগল। ড্রাইভার চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করল, খুন?

জিপের একজন জবাব দিল, তাইতো মনে হচ্ছে।

তাহলে পুলিশকে খবর দিতে হয়, ড্রাইভার চেঁচিয়ে উঠল।

ও নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। যাওয়ার পথে আমরাই দিয়ে যাব।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top