What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected কালোচিতার ফটোগ্রাফ 🐅 (1 Viewer)

গান শেষ হওয়া মাত্র প্রদীপ মিসেস এভার্টের সামনে গিয়ে মাথা নাড়ল, গুড ইভনিং।

গুড ইভনিং প্রদীপ।

আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে কোনও সমস্যায় পড়েছেন।

সমস্যা ছাড়া তো জীবন নয়।

আমাকে বলুন, যদি কিছু সাহায্য করতে পারি।

না। এটা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের হাতের বাইরে। অনলি গভর্নমেন্ট ইচ্ছে করলে পারে। আমি এম পি-র কাছে গিয়েছিলাম, দরখাস্ত দিয়ে এসেছি।

আপনার কি সমস্যার কথা বলতে আপত্তি আছে?

না। এই যে বাড়ি, মাঠ, এসবের জন্যে আমি প্রতিমাসে আড়াইশো টাকা ভাড়া দিই। এ নিয়ে কখনও কোনও ট্রাবল হয়নি। হঠাৎ মিস্টার প্রধান আমাকে জানিয়েছেন যে তিনি এইসব জমি-জায়গা বিক্রি করে দিচ্ছেন একজন ব্যবসায়ীকে যিনি এখানে ফ্যাক্টরি খুলবেন। আমাকে উঠে যাওয়ার নোটিস দিয়েছেন উনি।

তারপর?

আমি কোথায় যাব এতগুলো বাচ্চাকে নিয়ে? আমি ওঁর কাছে অ্যাপিল করলাম। উনি বললেন পঞ্চাশ হাজার টাকা দিলে মাড়োয়াড়িকে সম্পত্তিটা বিক্রি না করে আমাকে দিতে পারেন। কিন্তু অত টাকা একসঙ্গে আমি পাব কোথায়? অসম্ভব। তাই সরকারকে লিখেছি যদি তাঁরা সাহায্য করেন।

পঞ্চাশ হাজার টাকা?

ইয়েস।

কোন মাড়োয়াড়ি এই জমিটা নিচ্ছে?

জানি না। এইসব ফুলের মতো বাচ্চাদের নিয়ে আমি কোথায় যেতে পারি তা ভেবে কূল পাচ্ছি না।

আপনার হাতে আর কতদিন সময় আছে?

তিনমাসের একটু কম সময়। তার মানে–

ঠিক আছে। আমি আপনার সঙ্গে সাতদিন পরে দেখা করব। ততদিন আপনি কোনও সিদ্ধান্ত নেবেন না।

এ ব্যাপারে তুমি কী করতে পারো প্রদীপ?

এই বাচ্চাগুলোর জন্যে আমি সব কিছু করতে পারি ম্যাডাম।

দেখো এমন কিছু করো না যাতে ঈশ্বর অসন্তুষ্ট হন। আগামীকাল ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছেন। আমার বিশ্বাস, একটা ভালো খবর কাল পাব।

তাহলে তো ভালো কথা। কিন্তু সেটা না হওয়া পর্যন্ত আজকাল আমি বিশ্বাস করতে পারি না। আচ্ছা, আজ আমি আসছি।

ম্যাডামের কাছ থেকে বিদায় নেওয়া যত সহজ, শিশুদের কাছ থেকে তত কঠিন। তবু খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রদীপ বাইক চালু করল। আর মিনিট দশেক সময় আছে। থাপা বলে গেছে এক ঘণ্টার মধ্যে তার সঙ্গে দেখা করতে। সে কঁচা পথটা ধরেই যে গতিতে বাইক চালাচ্ছিল তাতে আচমকা ব্রেক কষে থামানো মুশকিল। এখন এই সন্ধে হয়ে আসার সময়ে পথ পরিষ্কার থাকার কথা। কিন্তু বাঁক ঘুরতেই সে দেখতে পেল রাস্তা বন্ধ। দুটো জিপ ঠিক পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। এখন ব্রেক করলে ছিটকে যেতে হবে। পাশ দিয়ে রাস্তা নেই যে কাটিয়ে যাবে। মরিয়া হয়ে জিপের কাছে এসে সামনের চাকা ঝাঁকুনি দিয়ে ওপরে তুলল সে। বাইকে গতি এমন প্রবল ছিল যে বাইক উঠে গেল জিপের বনেটে এবং ছাদ ছুঁয়ে লাফিয়ে পড়ল ওপাশের পথে। পড়ার সময় ব্যালেন্স হারাতে-হারাতেও সামলে নিল প্রদীপ। এখন বাইক থামিয়ে ঘুরে গিয়ে লোকগুলোকে চ্যালেঞ্জ করা যায়, কিন্তু সময় নষ্ট হবে তাতে। প্রদীপ শুন্য রাস্তা ধরে দার্জিলিং থানার দিকে বাইক ছোটাল।

এরকম একটা দৃশ্য দেখবে জিপের আরোহীরা কল্পনা করেনি। ওরা ভেবেছিল সামনে বাধা দেখে বাইক থেমে যাবে। কিন্তু ওটা যে গতি বাড়িয়ে সার্কাসের খেলা দেখাবে তা কে জানত। অথচ ওই লোকটাকে ধরতেই তারা এসেছিল। ওদের বস-এর কাছে খবর গেছে একমাত্র একটি বাইকে করা আসা লোকের সঙ্গেই হোমের ম্যাডামের সংযোগ আছে। সেই লোক প্রত্যেক। সপ্তাহে অন্তত দু-দিন হোমে আসে। সরকারি মহল নিয়ে বস চিন্তা করে না। এই ছেলেটি কে, কী তার পরিচয়–বের করার দায়িত্ব দিয়েছিল ওদের ওপর। কিন্তু লোকটা যে এমন সার্কাস দেখাবে তা ওরা অনুমান করেনি।

আধঘণ্টা বাদে জলাপাহাড়ের রাস্তায় একটি সুন্দর বাংলো বাড়ির বারান্দায় বসে চা খেতে-খেতে বস্ যখন কাহিনিটা শুনল তখন তার মুখে অদ্ভুত হাসি ফুটল, তোমরা কজন ছিলে ওখানে?

স্যার, চারজন।

চারজন যখন একজনকে আটকাতে পারোনি তখন তোমাদের যে টাকা দেওয়া হয়ে থাকে তা ওকে দেওয়া যায়। কী বলো? আমি ঠিক বলছি কি না? বস একটুও উত্তেজিত নয়।

.
 
ঠিক সেই সময় থাপার সামনে ভদ্রলোকের মতো বসেছিল প্রদীপ।

নরবাহাদুর গুরুং তোমার বাবা?

ইয়েস স্যার।

কিন্তু তিনি সম্পর্কটা অস্বীকার করেছেন।

মানে?

আমি একটু আগে তাকে টেলিফোন করেছিলাম। তিনি বললেন, ওই নামে তার এক ছেলে ছিল কিন্তু এখন সে মৃত। তাকে ত্যাজ্যপুত্র করেছেন তিনি।

একথা বাবাই বলতে পারেন।

কেন একজন বাবা ছেলেকে ত্যাজ্যপুত্র করেন?

প্রদীপ মুখ তুলল, স্যার, এর জবাব উনি দিতে পারবেন।

তুমি কোথায় থাকো?

লা ডেন লা রোডে।

কোন বাড়িতে?

পোস্ট অফিসের নিচে।

কী করো তুমি?

টুকটাক বিজনেস।

দু-নম্বরি?

না স্যার। ওটা পারলে তো বাবার সঙ্গেই থাকতে পারতাম।

প্রদীপ গুরুং। আমি চাই না দার্জিলিং-এ কোনও গোলমাল হোক!

আমিও চাই না স্যার।

কয়েকদিন আগে ঘুমের রাস্তায় তিনটে ডাকাতি হয়েছে। প্রায় তিরিশ হাজার টাকার কমপ্লেন আছে। এ ব্যাপারে তুমি কিছু জানো?

স্যার।

এত তাড়াতাড়ি উত্তর দিতে হবে না। ভেবে দ্যাখো। আমি কাউকে ধরতে পারিনি বটে কিন্তু বর্ণনা পেয়েছি। তার একজনের সঙ্গে তোমার বেশ মিল আছে।

ফাঁদটা এগিয়ে আসছে। প্রদীপের শরীর শিরশির করে উঠল।

আমি এখনই তোমাকে কিছু বলছি না। ইচ্ছে করলে তোমাকে দুরমুশ করে সব কথা বের করে নিতে আমি জানি। সেটা পরে করা যাবে যদি তুমি নিজে থেকে না বলো। থাপার কথা শেষ হওয়ামাত্র টেলিফোন বাজল। রিসিভার তুলে হ্যালো বলার পর থাপার মুখ উজ্জ্বল হল, ইয়েস, অ্যাঁ? আচ্ছা! কী রকম দেখতে? আমার মনে হয় এ ব্যাপারে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি। হ্যাঁ, আপনি কমপ্লেন করছেন না? ঠিক আছে, ঠিক আছে! রিসিভার নামিয়ে রেখে থাপা সরাসরি তাকাল, ম্যাল থেকে বেরিয়ে তুমি কোথায় গিয়েছিলে?

কয়েকজনের সঙ্গে দেখা করতে।

কোথায়?

পরম আনন্দ-এ।

ওখানে তোমার কী দরকার?

হোমের বাচ্চাদের আমি ভালোবাসি।

সত্যি কথা বলছ না এর মধ্যে দুনম্বরি কিছু আছে?

আমি দু-নম্বরি কাজ করি না।

আস্তে কথা বলো। কেউ চেঁচিয়ে কথা বললে আমার মাথা ঠিক থাকে না।

আই অ্যাম সরি স্যার।

মাটি থেকে উঁচুতে বাইক তুলতে পারো?

অবাক চোখে থাপাকে দেখল প্রদীপ। এর মধ্যে লোকটার কাছে খবর এসে গেল? সে হাসার চেষ্টা করল, ইচ্ছে করলেই যে পারব তা নয়, হঠাৎ-হঠাৎ হয়ে যায়।

শোনো, প্রদীপ, আজ সকালে তোমার কাছে একটা বেআইনি রিভলভার ছিল?

না স্যার, রিভলভার ছিল না।

আমার লোক বলছে ছিল। কিন্তু ওটা যদি আবার তোমার কাছে ফিরে আসে তাহলে তোমাকে আমি পুঁতে ফেলব। কথাটা মনে রেখো। আমি তোমাকে দেখা করতে বলছিলাম যে কারণে সেটা আর প্রয়োজন হবে না।

কারণটা কী ছিল স্যার?

যখন প্রয়োজন হবে না তখন তোমাকে বলে আমার লাভ নেই।

থাপা হাত নাড়ল, তোমাকে আর-একটা কাজ দিতে পারি। কিছু রোজগার হতে পারে তোমার।

রোজগার হলে আমি রাজি স্যার।




একটা কাগজে ঠিকানা, নাম লিখে এগিয়ে দিল থাপা, এঁর সঙ্গে আজই দেখা করো। উনি তোমাকে খুঁজছেন, তোমারও উপকার হবে।

নাম-ঠিকানা পড়ল প্রদীপ। বিখ্যাত মানুষ। এই শহরে একে চেনে না এমন কেউ নেই।

ঠিক আছে, তুমি যেতে পারো।

স্যার। একটা রিকোয়েস্ট ছিল।

থাপা তাকাল। প্রদীপ বলল, পরম আনন্দ যিনি চালান তাঁকে নিশ্চয়ই আপনি চেনেন। অমন মানুষ হয় না। বাচ্চাগুলোও খুব ভালো। কিন্তু হোমের বাড়িটা যাঁর, তিনি বিক্রি করে দিচ্ছেন একজনকে। সেই লোকটা ফ্যাক্টরি বানাবে ওখানে। এর ফলে ওই বাচ্চাগুলোর মাথা গোঁজার জায়গা থাকবে না। আপনি ওদের বাঁচান স্যার।

ওই সম্পত্তি কার?

মিস্টার প্রধানের।

কেউ যদি তার পার্সোনাল প্রপার্টি বিক্রি করে দিতে চায় তা হলে আইন বাধা দিতে পারে না।

আমি জানি স্যার। শুধু মানবিকতার কারণে যদি কিছু করা যায়।

তোমার এতে কী স্বার্থ?

বাচ্চাগুলো আমাকে ভালোবাসে!

অদ্ভুত। তাহলে মিসেস এভার্টকে বলো প্রধানের কাছ থেকে সম্পত্তিটা কিনে নিতে।

হোমের সেই সামর্থ্য নেই। জনসাধারণের দানের ওপর হোম চলে।

তোমার যখন এত দরদ তখন তুমি কিনে নিয়ে হোমকে দান করে দাও।

টাকাটা আমার পক্ষে অনেক।

থাপা কাঁধ নাচাল, সরি প্রদীপ, আমার পক্ষে এ ব্যাপারে কোনও সাহায্য করা সম্ভব নয়। কেউ আইন ভাঙলে আমি তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারি কিন্তু–। ওয়েল, গুডবাই।
 
বাইরে বেরিয়ে এসে প্রদীপ দেখল দার্জিলিং শহরে ইতিমধ্যেই সন্ধের অন্ধকার ঘন হচ্ছে। একটু বাদেই কুয়াশারা নামবে দল বেঁধে, রাস্তা ভালো করে দেখা যাবে না। থাপার লেখা কাগজটা ওর হাতের মুঠোয় ছিল। সেটাকে পকেটে পুরে বাইক চালু করল সে। তারপর হেডলাইট জ্বেলে ছুটে গেল জলাপাহাড়ের পথে। ম্যাল পেরিয়ে ঘোড়ার আস্তাবলের কাছে এসে গতি কমাতেই সে ডাকটা শুনতে পেয়ে বাইক থামাল। দৌড়ে কাছে এল লিটন। বেঁটে, কিন্তু শরীরে ভালো শক্তি। মাথায় বুদ্ধি পুরোপুরি নেই। লিটন বলল, কোথায় থাকো? সারাদিন খুঁজে বেড়াচ্ছি!

কেন?

তোমার পিস্তল হাওয়া হয়ে গেছে?

তোকে কে বলল?

আগে বলল, হ্যাঁ কি না?

হাওয়া হয়নি। থাপার হাত থেকে বাঁচার জন্য সিঁড়িতে ফেলে দিয়েছিলাম।

বড় সিঁড়িতে তো? পরে আর পাওনি, ঠিক?

হ্যাঁ। কে বলল তোকে?

শানবাহাদুর নামে একটা লোক বাজারের পাশে ভাটিখানায় বসে এই গল্পটা সবাইকে শোনাচ্ছিল। এমনকী যে লোকটা পিস্তলটা পেয়েছিল পুলিশ তার বাড়িতেও নাকি সার্চ করতে গিয়েছিল অথচ কিছু পায়নি।

লোকটা আমার নাম বলেছে?

নাঃ। বর্ণনা দিচ্ছিল। বুড়ো ভানুপ্রসাদ সেটা শুনে এসে আমাকে বলে। শুনে আমার সন্দেহ হয়, ওটা তুমি হতে পারো!

তুই এখানে অপেক্ষা কর। আমি ঘুরে আসছি এখনই। তারপর কথা বলব। বাইক চালু করল প্রদীপ। লিটন কোমরে হাত দিয়ে ওর যাওয়া দেখল। তারপর পাশের চায়ের দোকানে। ঢুকল। প্রদীপ সম্পর্কে ওর প্রবল আস্থা আছে। ইদানীং সে প্রদীপের সঙ্গে ছায়ার মতো থাকে। প্রদীপ বাঁ হাতে পিস্তল চালিয়েও লক্ষ্যভেদ করতে পারে। তিন-তিনটে ছোট অপারেশন থেকে লিটন ছয় হাজার টাকা পেয়েছে। তাই এখন প্রদীপ যে আদেশ করবে তাই তাকে শুনতে হবে। সে সিগারেট পাকাতে লাগল একমনে।

গেট বন্ধ। হেডলাইটের আলো ফেলে হর্ন দিল প্রদীপ। একটু বাদে একজন বন্দুকধারীকে দেখা গেল। এক হাতের আড়ালে চোখ ঢেকে অন্যহাতে বন্দুক নিয়ে এগিয়ে আসছে।

কৌন হ্যায়?

আমার নাম প্রদীপ গুরুং। তোমার সাহেব আমাকে ডেকেছেন।

লোকটা কোনও কথা না বলে গেট খুলে দিল। ওর ভঙ্গি দেখে বোঝা গেল যে এই নামের লোক যে আসবে তা জানা ছিল। বাইক নিয়ে সোজা বাংলোর সিঁড়ির সামনে চলে এল প্রদীপ। নিচে নেমে দাঁড়ানো মাত্র একটি লোক এগিয়ে এল, প্রদীপ গুরুং?

ইয়েস।

আসুন।

লোকটিকে অনুসরণ করে সে যে ঘরে ঢুকল সেটিতে আসবাব বলতে চারটে সাদা সোফা এবং একটি সাদা রঙের টেবিল। প্রদীপকে সেখানে বসিয়ে লোকটা চলে গেল। পায়ের তলায় কার্পেট। দেওয়ালে কোনও ছবি নেই। ওপাশের দরজায় ভারী সাদা পর্দা ঝুলছে। দেওয়ালের রঙও সাদা। প্রদীপ উশখুশ করছিল। থাপা তাকে বলতেই সে এখানে চলে এল। থাপা বলেছে এই লোকটা তাকে যে কাজ দেবে তা করতে পারলে রোজগার হবে। কাজটা নিশ্চয়ই দুনম্বরি কিছু হবে না, হলে থাপা তাকে এখানে পাঠাত না।
 
এইসময় লোকটাকে ঘরে ঢুকতে দেখল প্রদীপ। এর আগে দূর থেকে সে দেখেছে। এত বড় মানুষের কাছাকাছি পৌঁছবার ক্ষমতা তার এখনও হয়নি। কাছ থেকে সাদা শার্ট, সাদা হাফস্লিভ সোয়েটার, সাদা প্যান্ট এবং সাদা চপ্পল মানুষটিকে তার বেশ সাদাসিধে বলে মনে হল। ফরসা গায়ের রঙের সঙ্গে চওড়া টাক চমৎকার মানিয়ে গিয়েছে। উল্টোদিকের সোফায় বসে তিনি বললেন, গুড ইভনিং।

গুড ইভনিং স্যার। আমি প্রদীপ গুরুং।

এ বাড়িতে ঢোকার সময় থেকে তো দু-দুবার নামটা বলেছেন। আমি থাপার কাছে কিছুটা শুনেছি, বাকিটা জেনে নিয়েছি। মোটর বাইক ভালো চালাতে পারেন?

এমন কিছু নয় স্যার। নম্র গলায় বলল প্রদীপ।

দু-নম্বরি করেন না কিন্তু দু-নম্বরি জিনিস রাখেন?

তার মানে?

গতকাল পর্যন্ত আপনার কাছে একটা বেআইনি পিস্তল ছিল।

এখন নেই ভাবলেন কী করে?

যন্ত্র বলে দিল আপনি কোনও অস্ত্র ছাড়া এখানে এসেছেন। গুড। আপনাকে আমার একটা কথা বলার আছে। আপনার মধ্যে যদি ক্ষমতা থাকে তাহলে তা ছোটমাপের বেআইনি কাজ করে নষ্ট করবেন না। থাপার কাছে প্রমাণ না থাকলেও তিন-তিনটে ছিনতাই-এর কাজ আপনি এবং আপনার সঙ্গী করেছেন, এটা আমি জানি। জানি কিন্তু প্রমাণ নেই। তাই আপনি চ্যালেঞ্জ করলে কিছু বলতে পারব না। চা না কফি?

প্রদীপের হঠাৎ শীত-শীত করছিল। এই লোকটি খুব শান্ত গলায় কথা বলছেন। মুখচোখে একটুও উত্তেজনা নেই। অথচ তার সম্পর্কে যেসব কথা বলে গেলেন তা ওঁর মতো মানুষ কী করে জানলো তা ওর জানা নেই।

সে মাথা নাড়ল, থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।

ও কে। শুনুন। আপনার মতো এনার্জেটিক ইয়ংম্যান আমি খুব পছন্দ করি। আমি আপনাকে একটা কাজ দিতে পারি। লেপার্ড দেখেছেন?

সিনেমায় দেখেছি।

হুম। ব্ল্যাক লেপার্ড।

না স্যার, রঙ মনে নেই।

এখান থেকে সত্তর মাইল দূরে সিকিম-টিবেট বর্ডারের কাছে কিছু ব্ল্যাক লেপার্ড এখনও আছে বলে শোনা যাচ্ছে। খুব বিরল প্রজাতির প্রাণী। আজ সকালে তাদের দুজনকে দেখা গিয়েছে। তারা তখন যৌনমিলনে ব্যস্ত ছিল।

ইমপসিবল।

হোয়াই?

এইসব প্রাণীদের মেটিং-এর সময় সাধারণত কেউ দেখতে পায় না।

সাধারণত। কিন্তু দেখেছে। সিকিমের একটা ট্যুরিস্ট বাস ওই সময় ওই পথ দিয়ে ওখানে পৌঁছে যায়। তাদের তিনজন যাত্রী ওই দৃশ্যের ছবি তোলে। বাসটা আজই গ্যাংটকে ফিরে গেছে। যাওয়ার পথে বাসের ড্রাইভার একটা পুলিশ স্টেশনে খবরটা দিয়ে যায়। পুলিশ স্পটে গিয়ে কিছুই দেখতে পায়নি।

আমাকে কী করতে হবে?

ওই তিনজন যাত্রীর নাম-ঠিকানা জোগাড় করতে হবে।

কেন?

ব্ল্যাক লেপার্ড ভারতবর্ষে নেই। আছে হিমালয়ের এই এলাকায়। এতদিন পর্যন্ত ওদের। অস্তিত্ব কেউ জানতই না। আমার হবি রেয়ার ফটোগ্রাফ কালেক্ট করা। আমি যখন জানতে পারলাম তিনজন ট্যুরিস্ট ওই ব্ল্যাক লেপার্ডের মেটিং দৃশ্যের ছবি তুলেছে তখন মনে হল ছবিগুলো একমাত্র আমার কালেকশনেই থাকবে। আমার টাকা আছে তাই ছবিগুলো আমি চাইতে পারি। তিনটে সাধারণ ট্যুরিস্ট ওই ছবি তুলে বাড়ি ফিরে তাদের অ্যালবামে সেঁটে রাখবে। কিন্তু আমার কাছে। থাকলে ওগুলো অন্যমাত্রা পাবে। ওই তিনজনের খবর পেলে আমি ছবিগুলো কিনে নেব। আজ ওরা গ্যাংটকে ফিরে গেছে। হয়তো ওদের ফিল্মের রোল শেষ হতে আরও দু-একদিন লাগবে। অতএব আমি আপনাকে ওই দু-একদিন সময় দিচ্ছি। ভদ্রলোক হাসলেন।

আপনি তো ট্যুরিস্ট কোম্পানির সঙ্গে যোগযোগ করলেই ওদের ঠিকানা পেতেন!

না পেতাম না। গ্যাংটকে সাইট সিয়িং টুর করে অন্তত পনেরোটা নামী কোম্পানি। এ ছাড়াও আনরেজিস্টার্ড কোম্পানি আছে। যারা ডেইলি টিকিট কিনে ওইসব বাসে ওঠে তারা নিজেদের ঠিকানা কোম্পানিকে দেয় না, কোম্পানি সেটা চায়ও না।

বুঝলাম। কিন্তু আমি ওদের কী করে খুঁজে বের করব?

সেটা আপনার সমস্যা।

এর জন্যে আমি কত টাকা পারিশ্রমিক পাব?

পাঁচ হাজার টাকা।

ওই তিন ক্যামেরায় তোলা ছবির দাম আপনার কাছে তিন হাজার?

নো। নট দ্যাট। হয়তো ওদেরও আলাদা টাকা দিতে হবে।

সেইজন্যে আপনার বাজেট জানতে চাইছি।

ধরুন, ছয় হাজার।

আমার পক্ষে কাজটা করা সম্ভব নয়।

কারণ?

অত কম টাকার জন্যে এমন ঝামেলা।

কত টাকা হলে কাজটা করতে পারবেন?

পঞ্চাশ হাজার।

মাই গড! আর ইউ ম্যাড?

নো স্যার। ব্ল্যাক লেপার্ডের মেটিং দৃশ্য পৃথিবীতে আর কারও কাছে আছে কি না জানি না। না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। সেক্ষেত্রে আপনি ছবিগুলোর বিনিময়ে কয়েক লক্ষ টাকা রোজগার করবেন! আমি কি পাগলের মতো কথা বলছি?

পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে আপনি কী করবেন?

সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।


আমি বোধহয় আন্দাজ করতে পারছি ইয়ংম্যান। প্রধানের জমিটার দাম পঞ্চাশ হাজার টাকা। তাই তো! বেশ, ইটস এ ডিল। ছবিগুলো নিয়ে আসতে পারলে আপনি প্রধানকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে হোমের নামে জমি ট্রান্সফার করতে পারবেন। আর এই নিন, তিন হাজার টাকা। এটা আপনার ইনসিডেন্টাল এক্সপেন্স। পকেট থেকে তিরিশটা একশো টাকার নোট বের করে প্রদীপের সামনে রেখে ভদ্রলোক গলা পাল্টালেন, এবার কাজের কথায় আসি। জায়গাটা এখান থেকে সত্তর মাইল দূরে হলেও গ্যাংটক থেকে মাইল পনেরো উত্তরে। এর খুব কাছাকাছি জনবসতির নাম টিংলা। টিংলা পর্যন্ত একটা বাস যায় দিনে একবারই। যে জায়গায় ব্ল্যাক লেপার্ড দুটোকে দেখা গিয়েছিল তার বর্ণনা আমি পাইনি। সেটা আপনাকেই উদ্ধার করতে হবে। আর এর জন্যে আপনি দুদিন সময় পাবেন।

সরি স্যার। আগামীকাল গ্যাংটক পৌঁছতেই দুপুর হয়ে যাবে। আমি অন্তত তিনদিন সময় চাইছি। তিনটে পুরো কাজের দিন। টাকাগুলো তুলে নিল প্রদীপ।

ভদ্রলোক পকেট থেকে কার্ড বের করলেন, এইটে আমার নিজস্ব টেলিফোন। আমি না থাকলে রেকর্ডার আপনার পাঠানো ম্যাসেজ রেকর্ড করে রাখবে।

ও কে স্যার। প্রদীপ উঠে দাঁড়াল। ভদ্রলোক হাসলেন। মাথা নেড়ে প্রদীপ যখন দরজার কাছে পৌঁছে গিয়েছে তখন ভদ্রলোক বললেন, আমি এক প্রোডাক্টে বিশ্বাস করি। চেষ্টা করেছিলাম তবু হয়নি এসব কথার কোনও মূল্য আমার কাছে নেই।

প্রদীপ নীরবে মাথা নেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
 
মতিলাল তার বিছানায় শুয়েছিল। আজকের বিকেলের ঘটনার পর থেকে ওর কেবলই মনে হচ্ছিল বেঁচে থেকে কোনও লাভ নেই। স্বামী হয়ে স্ত্রীকে কন্ট্রোল করতে পারেনি সেটা এক জিনিস, অনেকেই পারে না। স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় অনেকের। কিন্তু চোখের সামনে অন্য পুরুষের হাতে মার খেয়ে সুভদ্রা যেভাবে কেঁচো হয়ে গেল তা দেখার পর বেঁচে থেকে কী লাভ। মার খাওয়ার পর সুভদ্রা যদি চিৎকার করে তার সাহায্য চাইত তা হলে সে ছুটে যেত। তা না করে ও ওই লোকটার সঙ্গে ভেতরে ঢুকে গিয়ে দরজা বন্ধ করল–এর শাস্তি ওকে পেতেই হবে। সামনের মাস থেকে একটা পয়সাও দেবে না সুভদ্রাকে। সুভদ্রা যদি এখানে এসে ঝগড়া করে তা হলে সে হাত চালাবে। জীবনে কখনও মেয়েমানুষের শরীরে হাত তোলেনি সে, এবার তুলবে। ওই মেয়েকে বাঁচাবার জন্যে সে আগবাড়িয়ে গিয়েছিল বলে এখন আফসোস হচ্ছিল। এই সময় দরজায় শব্দ হল।

দরজা খুলতে ইচ্ছে করছিল না কিন্তু দ্বিতীয়বারের শব্দের সময় চাপা নারীকণ্ঠ কানে এল। অতএব উঠতে হল মতিলালকে। দরজা খুলতে ছিটকে ভেতরে চলে এল সুজাতা। মতিলাল দেখে পুলকিত হল। ওর কাঁধে সেই তিব্বতি ব্যাগ। ঘরে ঢুকে চারপাশে তাকিয়ে সুজাতা বলল, এম্মা! কী করে রেখেছ তুমি? ঘরটা যে নরক হয়ে উঠেছে।

মতিলাল বলল, তাতে কার কী?

সুজাতা তার শরীর থেকে চাদরটা খুলে টেবিলের ওপর রাখল। ব্যাগটা চাদরের ওপর। মতিলাল দেখল মেয়েটা একটা আঁটো ব্লাউজ ছাড়া কিছু পরেনি।

তোমার ঠান্ডা লাগে না?

সুজাতা নিজের শরীরের দিকে তাকাল, ওমা! তোমার এসব নজরে পড়ে নাকি! শোনো, দিদি আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। বলেছে আমাকে জব্দ করতে যাকে ডেকে এনেছিলি তার কাছে যা। আমি বললাম, যাওয়ার হলে যাব। শুনে বলল, গিয়ে দ্যাখ না। একটা কাঠের পুতুল ছাড়া কিছু না। মেয়েমানুষ আর পাশবালিশের কোনও তফাত বোঝে না। তাই নাকি?

মতিলাল জবাব দিল না। কথাগুলো কানে যাওয়া মাত্র সুভদ্রা সম্পর্কে তার বিদ্বেষ বাড়ছিল। সে নিজের ঘরে চলে গেল। তার খুব আফসোস হচ্ছিল। আজ দুপুরেও যদি সে সুভদ্রাকে প্রহার করত তা হলে সন্ধেবেলায় ওই দৃশ্য দেখতে হতো না।

সুজাতা চলে এল তার শোওয়ার ঘরের দরজায়, কী হল, বাক্যি নেই কেন?

ব্যাগটা এখানে আনো।

ব্যাগে কী ছিল?

সেটা আমি বুঝব।

চিনি, চা আর–!

মতিলাল তাকাল। নিশ্চয়ই দেখেছে সুজাতা। আর দেখেছে বলে আপনির বদলে তুমি তুমি করে কথা বলছে। সে নিশ্বাস চেপে বলল, আর?

পিস্তল। গুলিভরা পিস্তল। দিদি তোমার কাছ থেকে নিয়ে গিয়েছিল, না?

হ্যাঁ।

তোমার কাছে পিস্তল কেন? দিদিকে মারবে বলে?

সেটা পারলে খুশি হতাম।

তুমি খুব হিংসেয় স্কুলছ। তার মানে তুমি দিদিকে ভালোবাস।

পিস্তলটা কোথায়?

সুজাতা চলে গেল ওঘরে। ফিরে এল পিস্তল হাতে, কিন্তু দিল না। না দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আমাকে তোমার খারাপ লাগে?

আমি জানি না।

এখন থেকে আমি এখানে থাকব।

কেন?

আমার ইচ্ছে তাই। তুমি খেয়েছ?

হ্যাঁ। মিথ্যে কথা বলল।

পিস্তলটা বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে চোখের আড়াল হল সুজাতা। চট করে ওটাকে তুলে নিয়ে চোখের সামনে আনল মতিলাল। না। মানুষ খুন করতে পারবে না সে। কিন্তু বদলা নিতে হবে। কীভাবে বদলা নেওয়া যায়? পিস্তলটাকে একটা খালি জুতোর বাক্সের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখল সে। এবং তখনই ভুটানি মদের বোতল হাতে সুজাতা ফিরে এল, এই হুইস্কি তুমি খাও?

না।

তা হলে রেখেছ কেন?

একজন দিয়েছিল তাই এনেছিলাম।

গ্লাসে হুইস্কি ঢেলে কাঁচা খেল সুজাতা, বড্ড কড়া!

জল ছাড়া খাচ্ছ!

তুমি খাও।

না।

আমার দিব্যি, একটু খাও।
 
সুজাতার মুখের দিকে তাকিয়ে মতিলালের হঠাৎ যেন অন্যরকম লাগল। সে সুজাতার বাড়ানো গ্লাসটা নিয়ে মুখে ঢালল। সঙ্গে-সঙ্গে কান গরম, গলা জ্বলতে লাগল। প্রথম ধাক্কা কমে গেলে শরীরে যেন আগুন ছড়াল। সুজাতা দ্বিতীয়বার গ্লাসে ঢেলে নিজের গলায় ঢালল। ঢেলে আর-এক পেগ এগিয়ে দিল। মতিলাল বলল, না। আর না।

কেন?

আমার অভ্যেস নেই।

কী হবে খেলে? বাড়িতেই তো আছ। আমি আছি।

অতএব দ্বিতীয় গ্লাস মুখে ঢালল মতিলাল। তার শরীরে এখন গরম বাতাস পাক খাচ্ছে। গ্লাস-বোতল একপাশে সরিয়ে রেখে সুজাতা জামার বোতামে হাত দিল। একটু বাদে মতিলালের মনে হল এমন পেলব নারী-শরীর সে কখনও দেখেনি। দু-হাতে সুজাতাকে জড়িয়ে ধরে ওর ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরল সে। সুজাতা বলল, আঃ আস্তে। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

সমস্ত শরীরে ঝড়। বিছানায় দুটো শরীর যখন পরস্পরকে জানতে-জানতে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে তখন সুজাতা বলল, দিদি মিথ্যে কথা বলেছে।

ও মিথ্যুক।

তুমি আমাকে বিয়ে করবে? দু-হাতে মতিলালকে আঁকড়ে ধরেছিল সুজাতা।

আমি বদলা নেব।

কীসের বদলা?

উত্তর দিতে পারল না মতিলাল। উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা সে হারিয়ে ফেলছিল, কিন্তু সেই মুহূর্তেই বাড়িটাকে চমকে দিয়ে বাইরের দরজার বেলের বোতাম টিপল কেউ। শব্দটা মতিলালের নার্ভে আঘাত করতেই সমস্ত উত্তেজনা উধাও। সুজাতা নিচুস্বরে বলল, বাজাক। মনে হচ্ছে দিদি এসেছে।

ও না।

কী করে বুঝলে?

ও এভাবে বেল বাজায় না।

বাব্বা! বেল বাজানোর আওয়াজেও মানুষ চিনতে পারো নাকি তুমি। যাও, দ্যাখো। সুজাতা বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। ওর উন্মুক্ত শরীরের দিকে তাকিয়ে এই ঘর ছেড়ে যাওয়ার একটুও ইচ্ছে হচ্ছিল না মতিলালের। অনেক-অনেক দিনের পর সে যেন এক নতুন স্বাদ পাচ্ছিল একটু আগে। যে স্বাদ সুভদ্রা তাকে এক মুহূর্তের জন্যে কখনও দেয়নি।

নিজেকে ভদ্রস্থ করে দরজা খুলতেই দুটো লোককে দেখতে পেল মতিলাল। সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে বেশ হ্যান্ডসাম, সিনেমার নায়কের মতো দেখতে। পিছনের লোকটা বেঁটে কিন্তু বোঝা যায় শক্তিশালী। বাড়ির সামনে একটা মোটরবাইক দাঁড়িয়ে আছে।

মতিলাল জিজ্ঞাসা করল, কী চাই?

আপনার নাম মতিলাল? সামনের লোকটি জিজ্ঞাসা করল।

জি হ্যাঁ।

ভেতরে আসতে পারি?

কিন্তু আমি যে এখন খুব ব্যস্ত।

এদিকে আমার যে সময় নেই। আমাকে এখনই গ্যাংটকে যেতে হবে।

গ্যাংটকে? এত রাত্রে?

সেটা আমার সমস্যা।

ও। আসুন। তাড়াতাড়ি বলবেন যা বলার।

প্রদীপ এবং লিটন ঘরে ঢুকল। চারপাশে তাকিয়ে প্রদীপ একটা চেয়ারে গিয়ে বসল। মতিলাল বুঝতে পারছিল না এদের মতলব। তার মন পড়ে আছে পাশের ঘরে। সেখানে শুয়ে থাকা সুজাতা নিশ্চয় কথাবার্তা শুনে পোশাক পরে নিয়েছে। লোকদুটো আর সময় পেল না এখানে আসার।

হ্যাঁ, বলুন! মতিলাল বিরক্ত প্রকাশ করল।

মতিলালজী। আজ সকালে আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। আমি খুবই দুঃখিত। সেই সময় আপনাকে আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটু ধাক্কা দিয়ে ফেলেছিলাম যার ফলে আপনার এবং আমার, দুজনের হাত থেকে কিছু জিনিস পড়ে যায়। এখন অনুগ্রহ করে যদি আমার জিনিসটা আমাকে ফেরত দিয়ে দেন তা হলে চলে যাই। প্রদীপ শান্ত গলায় বলল।

কী জিনিস পড়ে গিয়েছিল? মতিলালের বুকে ড্রাম বাজতে লাগল। তার চেহারাটা মনে পড়ল। ওপর থেকে দ্রুত নেমে আসা যুবকটি যে তার সামনে বসে আছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। প্রদীপ উঠল। হাঁটতে হাঁটতে ঘরটা দেখল। মতিলালের চোখ তার ওপর ঘুরছিল।

প্রদীপ জিজ্ঞাসা করল, আমি আপনার সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করতে চাই। পিস্তলটা কোথায়?

অস্বীকার করতে গিয়েও পারল না মতিলাল পিস্তলটা যে আপনার তার প্রমাণ কী?

এই সময় লিটন বলে উঠল, এতো আজব চিড়িয়া। তোমাকে এখনও চেনেনি গুরু।

প্রদীপ হাসল, প্রমাণ লোকে কোর্টে দেয়। শুনুন। আপনি একজন সাধারণ মানুষ। খবর পেলাম আপানর বউ পালিয়ে অন্যের সঙ্গে প্রেম করছে। পিস্তল নিয়ে আপনি কী করতে পারবেন? তার চেয়ে আমার জিনিস আমাকে দিয়ে দিন।

ওটা আমার কাছে আছে তা আপনাকে কে বলল?

শানবাহাদুর। এখন সে মাতাল হয়ে পড়ে আছে।
 
ঠিক তখনই শোয়ার ঘরের দরজায় এসে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল সুজাতা। যতটা পোশাক সংক্ষিপ্তভাবে পরে নেওয়া সম্ভব তাই পরেছে সে। প্রদীপ দেখল মেয়েটাকে। সুন্দরী বলতে যা বোঝায় তেমন নয় কিন্তু মেয়েটার শরীর আছে আর সেটাকে ব্যবহার করতে জানে।

আমার এই বাড়িতে পুলিশ সার্চ করে গেছে, কিছু পায়নি।

পুলিশ যাতে না পায় সেই ব্যবস্থা আপনি করেছিলেন। ওটা যে পুলিশের হাতে পৌঁছয়নি। সেইজন্যে আপনাকে ধন্যবাদ। তার জন্যে কত টাকা দিতে হবে?

লিটন চাপা গলায় বলল, বস, সময় নষ্ট করছ।

পকেট থেকে দুশো টাকা বের করে টেবিলে রাখল প্রদীপ, দিন।

মতিলাল আর পারল না। সেখান থেকেই চিৎকার করে বলল, সুজাতা, ভেতরের ঘরে খাটের নিচে জুতোর বাক্স থেকে পিস্তলটা বের করে ওকে দিয়ে দাও। ঝমেলা চুকে যাক।

সুজাতা ঘরে ঢুকে যাওয়া মাত্র বাইরে গাড়ির শব্দ এবং হেডলাইটের আলো দেখা গেল। ওরা কিছু বুঝে ওঠার আগে থাপা কয়েকজন সেপাইকে সঙ্গে নিয়ে বাড়িতে ঢুকলেন। প্রদীপ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনি এখানে?

থাপা দু পকেটে হাত ঢুকিয়ে বলল, আমি তোমাকে এত বোকা বলে ভাবিনি প্রদীপ। পিস্তলটার খোঁজে এখানে আসার আগে তোমার চিন্তা করার দরকার ছিল। আমার হাতে এতদিন কোনও প্রমাণ না থাকায় তোমাকে ছুঁতে পারিনি। আজ তুমি ফেঁসে গেলে।

আপনি আজ কী প্রমাণ পেয়েছেন?

ওকে সার্চ করো। থাপা হুকুম দিতেই সেপাইরা এসে প্রদীপের শরীর হাতড়ে দেখল। লিটনকেও বাদ দিল না তারা। ওরা কিছু না পেতে থাপা মতিলালের সামনে গিয়ে দাঁড়াল, আজ তোর হাড় ভাঙব আমি। যা জিজ্ঞাসা করছি তার জবাব ঠিকঠাক দিবি। ও পিস্তলের খোঁজে এখানে এসেছে, তাই তো?

মতিলালকে এখন হতবুদ্ধি দেখাচ্ছিল। কোনওরকমে মাথা নাড়ল সে, হ্যাঁ। থাপার মুখে হাসি ফুটল, গুড। পিস্তলটা দিয়েছ ওকে? চুপ করে রইল মতিলাল। থাপা চিৎকার করল, কথা বল!

না। দিইনি। মতিলাল শোওয়ার ঘরের দরজার দিকে তাকাল।

সেখানে কেউ নেই।

কোথায় রেখেছ ওটাকে?

আমি রাখিনি।

কে রেখেছে? বাঁচতে চাও তো সত্যি কথা বলো।

আমি জানি না। কিছু জানি না।

থাপার নজরে পড়ল কিছু টাকা সামনে পড়ে আছে। নোটগুলো তুলে সে গুনল, দুশো। এইসময় প্রদীপ বলল, আপনি মিছিমিছি সময় নষ্ট করছেন স্যার।

সেটা আমি বুঝব। তোমাদের এই জুড়িকে যদি হাজতে ঢোকাতে পারি–! এই টাকা কি তুমি দিয়েছ ওকে?

আপনি তো পিস্তল খুঁজতে এসেছেন। টাকার খোঁজ নিয়ে আপনি কী করবেন?

কিছু বলতে গিয়ে থাপা চুপ করে গেল। তার চোখ মতিলালের ওপর। মতিলাল যেন অনেকক্ষণ থেকে বিপরীত দরজায় দিকে তাকিয়ে কিছু লক্ষ করার চেষ্টা করছে। থাপা চটপট শোওয়ার ঘরের দরজায় পৌঁছে গেল। ঘরে ঢুকেই সে চিৎকার করে উঠল, এই জানলা দিয়ে পালিয়েছে। কে ছিল এই ঘরে?

খ্যাপা মোষের মতো বেরিয়ে এল থাপা, এই ঘরে মেয়েছেলে ছিল। মেয়েদের পোশাক পড়ে আছে বিছানার ওপর। কে ছিল?

আমার–আমার–। মতিলাল ঢোঁক গিলল।

তোমার বউ? থাপা ধমকে উঠল।

না স্যার। বউ না। বউ-এর বোন!

ও বাব্বা। শালির সঙ্গে লীলা করছিলে নাকি? অনেক গুণ আছে দেখছি। কিন্তু জানলা দিয়ে শালি পালাল কেন? পিস্তলটা ওই নিয়ে গেছে?

আমি জানি না স্যার, কিছু জানি না।

থাপাকে এখন কিংবর্তব্যবিমূঢ় দেখাচ্ছে। প্রদীপ এগিয়ে গেল, স্যার, আপনি যে কাজটা পাইয়ে দিয়েছেন সেটা করতে হলে আমাকে এখনই গ্যাংটকে রওনা হতে হয়। আপনি বিশ্বাস করুন, আমি পিস্তলটা পাইনি।

কথাগুলো কানে গেল না যেন থাপার। মতিলালের দিকে তাকিয়ে সে বলল, তোমার শালিকে আমি আজ রাত্রেই তুলে আনছি। তারপর তোমাদের মজা দেখাব।
 
প্রায় ঝড়ের মতো বেরিয়ে গেল থাপা তার দলবল নিয়ে। লিটন এতক্ষণ একপাশে সিঁটিয়ে ছিল, এবার বলল, চলো গুরু, কেটে পড়ি।

প্ৰদীপ মতিলালের দিকে তাকাল। মতিলাল এখন দুহাতে মুখ ঢেকে বসে আছে। ওর শরীর কাঁপছে। প্রদীপ জিজ্ঞাসা করল, এটা কী হল?

আমি বুঝতে পারছি না। ও কেন পালাল?

পালিয়ে দার্জিলিং-এর কোথাও থাপার হাত থেকে লুকিয়ে থাকতে পারবে না। প্রদীপ ঘুরে দাঁড়াল, টাকাটা রইল। যদি পিস্তলটা আপনার হাতে আসে তাহলে ফিরে এসে ওটা নেব আমি।

বাইরে বেরিয়ে এল সে, পিছনে লিটন।

এখন বেশ ঠান্ডা। আকাশ পরিষ্কার। অন্ধকার রাস্তায় মানুষজন নেই। লিটন বলল, শালা বহুৎ হারামি। আমি বদলা নেব।

কার কথা বলছিস?

শানবাহাদুর। ভাবলাম নেশার ঘোরে কথা বলছে, আউট হয়ে গেল। পয়সা দিলাম তবু আমরা চলে আসার পরেই পুলিশকে খবরটা দিয়েছে।

ছুঁচো মেরে এখন লাভ নেই। গ্যাংটকে পিস্তলটা সঙ্গে থাকলে ভালো হতো। মোটরবাইকে উঠে পড়ল সে, কাল সকালের ফার্স্ট বাস ধরে গ্যাংটকে চলে আসবি, হোটেল ড্রিমল্যান্ডে গিয়ে খবর নিবি। ইঞ্জিন চালু করল প্রদীপ।

তুমি একা এতটা রাস্তা যাবে? আমি পেছনে বসি না।

না। একা যেতে আমার সুবিধে হবে।মোটরবাইক চালু করল প্রদীপ। লিটন হাঁটতে শুরু করল বিপরীত দিকে। মোড় ঘুরতেই হেডলাইটের আলোয় একটা মূর্তিকে দৌড়ে মাঝখানে চলে আসতে দেখল প্রদীপ। আলোর বৃত্তে দাঁড়িয়ে যে মূর্তিটা হাত নাড়ছে সে স্ত্রীলোক।

কাছাকাছি আসতেই চিনতে পারল প্রদীপ। সে বাইকটাকে থামাতেই সুজাতা ছুটে এল কাছে, আমাকে বাঁচান। আপনার পায়ে পড়ি, আপনি আমাকে বাঁচান।

আমি কীভাবে বাঁচাব?

আপনি তো গ্যাংটকে যাচ্ছেন।

তোমাকে কে বলল?

আমি শুনেছি। বাড়িতে ঢোকার সময় আপনি জামাইবাবুকে বলেছিলেন। আপনি আমাকে গ্যাংটকে নিয়ে চলুন। ওখানে আমার এক পিসি থাকে। ওখানে গেলে এখানকার পুলিশ আমাকে কিছু করতে পারবে না।

কাল সকালের বাস ধরে চলে যেও।

তার সুযোগই পুলিশ আমাকে দেবে না। আপনার পিস্তলটাকে বাঁচাতে গিয়ে এ আমি কী বিপদ ডেকে আনলাম। কেঁদে ফেলল সুজাতা।

পিস্তলটা বাঁচাতে গেলে কেন?

মনে হয়েছিল ওটা পেলে পুলিশ আপনাকে ছাড়বে না।

আমাকে তুমি চেনো না। আমাকে পুলিশ ধরলে তোমার কী?

আমি আপনাকে চিনি।

সে কি? কোথায় দেখেছ?

দেখেছি। দার্জিলিং-এই।

তুমি মিথ্যে কথা বলছ। তোমার জামাইবাবুকে বাঁচাতে চেয়েছিলে তুমি।

তা হলে পালাতাম না। জানলা দিয়ে পিস্তলটা ছুঁড়ে ফেলতাম বাইরে।

ওটা তোমার কাছে আছে?

হ্যাঁ।

আমাকে দাও।

না। আগে আপনি আমাকে গ্যাংটক নিয়ে যান, তারপর।

তোমাকে কীভাবে নিয়ে যাব? আমি তো এখনই বাইকে রওনা হচ্ছি।

বাইকের পিছনে বসে আমি যেতে পারব।

তোমার ঠান্ডা লাগবে। গায়ে তো বেশি জামা কাপড় নেই।

লাগুক। তবু এখান থেকে যেতেই হবে।

ঠিক আছে। তুমি স্টেশনের সামনে গিয়ে দাঁড়াও। আমি পনেরো মিনিটের মধ্যে আসছি। সাবধান, পুলিশ যেন তোমাকে দেখতে না পায়।

আপনি আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছেন না তো?

প্রদীপ হাসল, তোমাকে ফেলে আমি চলে যেতে পারি, কিন্তু আমার পিস্তলটাকে নিয়ে যাওয়াটা খুব জরুরি।

.
 
পনেরো মিনিট বাদে প্রদীপ যখন স্টেশনের পাশের রাস্তায় বাইক দাঁড় করাল তখন চারপাশে ঘন কুয়াশা। এতটা পথ মোটরবাইকে যাওয়ার সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে সে। এপাশ ওপাশে তাকাতেই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এল সুজাতা। তার দুই হাত বুকের ওপর। শীতে কাঁপছে সে। প্রদীপ ব্যাকসিটে রাখা ওভারকোট এগিয়ে দিল, এটা পরে নাও। টুপি, মাফলার আছে ওখানে। চটপট।

কৃতার্থ হয়ে আদেশ মান্য করল সুজাতা। তারপর বাইকের পিছনে উঠে বসল। দার্জিলিং ছাড়িয়ে বাইক এগিয়ে যাওয়া মাত্র সুজাতা ফিসফিস করে বলল, পিস্তলটা নেবেন না?

গ্যাংটকে পৌঁছবার পর নেওয়ার কথা।

সুজাতা হাসল। তারপর বলল, আপনি খুব ভালো।

প্রদীপ জবাব দিল না। এ রকম তৈল মর্দন মানুষ কোনও বিপাকে পড়ে করে, সেটা তার জানা আছে।

দার্জিলিং থেকে তিস্তাবাজার হয়ে কালিম্পংকে ডানদিকে রেখে মধ্যরাত্রে গ্যাংটকের দিকে ছুটে যাওয়াটা মোটেই আরামদায়ক নয়। কিন্তু প্রদীপ যাবতীয় প্রাকৃতিক প্রতিরোধকে উপেক্ষা করার চেষ্টায় ছিল। লিটনকে সঙ্গে না নিয়ে রওনা হওয়া ভুল হচ্ছিল সেটা কিছুটা দূর আসার পরই টের পেয়েছিল। এখন লিটনের বদলে সুজাতা পিছনে থাকায়, কোনও কথা না বলা সত্ত্বেও, তার মনে হচ্ছিল এই কষ্টকর যাত্রায় সে একা নেই। আর একটি মানুষের তপ্ত উপস্থিতি তাকে যথেষ্ট স্বস্তি দিচ্ছিল।

পাহাড়ি রাস্তায় সন্ধে ঘন হয়ে গেলে কেউ গাড়ি চালায় না। নিতান্ত বাধ্য না হলে কোনও গাড়িকে রাতদুপুরে এইসব পথে দেখা যায় না। একটানা যেতে-যেতে বাইক গরম হয়ে উঠেছে বেশ। প্রদীপ রাস্তার পাশে একটা সমান জায়গা পেয়ে বাইক দাঁড় করাল। নিচে পা দিতে গিয়ে বুঝতে পারল পায়ে ঝিঁঝি ধরে গেছে। সোজা হয়ে দাঁড়ানো যাচ্ছে না।

বাইক থেকে নেমে সুজাতা প্রথম কথা বলল, এখানে কেন?

ইনি বিশ্রাম চাইছেন। প্রদীপ পায়ে সাড় আনার চেষ্টা করছিল, উঃ কী ঠান্ডা!

পায়ে কী হয়েছে?

বাঁ পা অবশ-অবশ লাগছে। এক নাগাড়ে। ঠিক আছে।

প্রদীপ সোজা হল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, তোমার ঠান্ডা লাগছে না?

লাগছে। সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই।

এইভাবে এককথায় দার্জিলিং ছেড়ে চলে এলে, ওখানে কেউ চিন্তা করবে না?

আমার জন্যে কেউ চিন্তা করে না।

জামাইবাবু? দিদি?

দিদি তো মুক্তি পাবে। জামাইবাবু, হাসল সুজাতা, আজকের আগে আমার দিকে ভালো করে কখনও তাকাননি। আজ যে আমার মাথায় কী ঢুকল!

নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনলে!

ঠিক বলেছেন।

আমরা গ্যাংটকে পৌঁছে যাব ভোরের মধ্যে। ওইসময় পিসির বাড়িতে গেলে তিনি অবাক হবেন না? জানতে চাইবেন না কীভাবে এলে?

সেটাই তো স্বাভাবিক। একটা কিছু উত্তর দিতে হবে।

তুমি বিবাহিতা?

একসময় ছিলাম। এখন নই।

প্রদীপ আর কথা বাড়াল না।

ওরা গ্যাংটকে ঢুকল যখন তখন শহর ঘুমন্ত। ইতিমধ্যে আকাশের চেহারা বদল হয়েছে। সিকিমের আকাশে এখন গুঁড়ি-গুড়ি মেঘ। সূর্যদেবের ওঠার কোনও আয়োজনই নেই। রাস্তার আলোগুলো বুড়ি ডাইনির চোখ হয়ে জ্বলছে। প্রদীপ গলা তুলে জিজ্ঞাসা করল, কোথায় নামবে?

আপনি কোনদিকে যাচ্ছেন? গলা তুলতে হল সুজাতাকেও।

হোটেল ড্রিমল্যান্ড। বাড়ির কাছাকাছি না নামলে তোমার এখন একা হাঁটা ঠিক হবে না। তুমি আমার সঙ্গে চলো। আলো ফুটলে পিসির বাড়িতে চলে যেও।

আপনার কোনও অসুবিধে হবে না তো?

প্রদীপ জবাব দিল না।

হোটেল ড্রিমল্যান্ড কুলীন নয়। এর আগে দুবার গ্যাংটক এসে এখানেই উঠেছিল প্রদীপ। এই সময়ে কাউন্টারে লোক থাকার কথা নয় কিন্তু কয়েকজন ট্যুরিস্ট সাইট সিয়িং-এ যাচ্ছে বলে হোটেলের কর্মচারী জেগেছিল। ওদের দেখে লোকটা অবাক, আপনারা বাইকে করে এতটা রাস্তা এসেছেন? এই রাত্রে!

প্রদীপ হেসে বলল, ঘর হবে?

সিওর। ডাবল বেড?

লিটন আসবে দুপুরের আগেই। ওর জন্যে ব্যবস্থা রাখা দরকার।

প্রদীপ ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল।

লোকটি চাবি নিয়ে দোতলায় উঠে ঘর খুলে দিয়ে বলল, পরে একসময় খাতাপত্তরের কাজ করে নেব। চা খাবেন?

সিওর। সেইসঙ্গে কিছু স্ন্যাকস।

লোকটা চলে গেলে সুজাতা জিজ্ঞাসা করল, আপনি ডাবল বেড নিলেন কেন?

এবার খেয়াল হল প্রদীপের। সুজাতা কি তাকে সন্দেহ করছে?

সে হাসল, নিলাম।

আপনি কী করে ভাবলেন এখানে আমি থাকব?

সারারাত ধরে আমার বাইকের পিছনে বসে আসবে এটাও তো কখনও ভাবিনি।

আমি যাচ্ছি।

বসো। আমার এক বন্ধু আসবে সকালের বাসে, যে আমার সঙ্গে তোমার জামাইবাবুর বাড়িতে গিয়েছিল। ব্যবস্থাটা তার জন্যে। প্রদীপ বাথরুমে চলে গেল। গরমজলের কল খুলে মুখে দিল খানিকটা। আঃ, আরাম। বাইকের সাইড ক্যারিয়ারে যে অ্যাটাচিটা রয়েছে সেটা আনিয়ে নিতে হবে। দুদিন চলে যাবে এমন সব কিছু তাতে ঠাসা আছে।
 
বাইরে বেরিয়ে এসে সে বলল, তুমি তো এক বস্ত্রে এসেছ। এই মুহূর্তে আমিও তোমাকে সাহায্য করতে পারব না। তবু মুখটা ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো।

এগিয়ে যাওয়ার সময় নিচু গলায় সুজাতা বলে গেল, সরি।

দুঃখিত হওয়াটা সন্দেহ প্রকাশের কারণে এটা বুঝেও না বোঝার চেষ্টা করল প্রদীপ। এখন একটু ঘুমিয়ে নেওয়া দরকার। সকাল আটটার মধ্যে বেরিয়ে কাজ শুরু করতে হবে। চা এল। চা আর বিস্কুট। তাড়াতাড়ি সেগুলো শেষ করে একটা বিছানায় লম্বা হল প্রদীপ। আমি আটটা পর্যন্ত ঘুমাব। ততক্ষণ কথা না বললে উপকার করা হবে।

তা হলে এটা রাখুন। পিস্তলটা বের করে বিছানার ওপর রেখে সুজাতা বাথরুম চলে গেল।

সোওয়া আটটা নাগাদ ঘুম ভাঙল প্রদীপের। বিছানায় শুয়েই বুঝতে পারল সুজাতা ঘরে নেই। ও চোখ বন্ধ করল। মেয়েদের সম্পর্কে তার কোনও উন্নাসিকতা নেই। ঠিকঠাক প্রেমে পড়ার মতো কোনও মেয়ের দর্শন সে এখনও পর্যন্ত পায়নি। মেয়েরা এসেছে জীবনে কিন্তু তারা মেয়ে বলেই প্রেমে পড়তে হবে এমনটা কখনও মনে হয়নি। কেউ-কেউ এসে শরীরের স্বাদ দিয়ে চলে গেছে এবং এই কারণে তার কোনও পাপবোধ নেই। সেইসব মেয়েরা এসেছিল স্বেচ্ছায়, চলে যাওয়ার ব্যবস্থা রেখে। আজ দার্জিলিং থেকে গ্যাংটকের দীর্ঘপথটা যে মেয়ে পাড়ি দিয়ে এল তার পেছনে বসে, এই হোটেলের বন্ধ ঘরে শুয়ে রইল পাশের বিছানায় সে নিশ্চয়ই তাকে এখন সাধু-সন্ন্যাসী ভাবছে।

প্রদীপ উঠল। এবং তখনই চোখে পড়ল পাশের বিছানার ওপর তার এনে দেওয়া ওভারকোট মাফলার এবং টুপি পড়ে আছে। সে বাথরুমের দরজা খুলে দেখল সেখানেও সুজাতা নেই। সে ওকে শহরে ঢোকার সময় বলেছিল আলো ফুটলে চলে যেতে। সেইমতো কাজ করেছে মেয়েটা। শুধু যাওয়ার সময় বলে যেতে পারত। প্রদীপ হাসল, সে নিজেই তো বিরক্ত করতে নিষেধ করেছিল।

সাড়ে আটটা নাগাদ প্রদীপ পথে নামল। বাইক নিয়ে সোজা চলে এল বাজারের কাছে যেখানে পরপর ট্যুরিস্ট অফিসগুলো রয়েছে। বেশিরভাগ বাস ইতিমধ্যে ট্যুরিস্টদের দ্রষ্টব্য জায়গা দেখাতে চলে গিয়েছে। কিছু বাস তৈরি হচ্ছে।

ঘণ্টাখানেক ধরে একের পর এক অফিসে ঘুরে প্রদীপ দেখল কোনও কাজের কাজ হচ্ছে না। কোনও অফিসই বলতে পারছে না কাল সিকিম-তিব্বত বর্ডারে কোন বাস গিয়েছিল। খোঁজ নিয়ে জানা গেল রেজিস্টার্ড ট্যুরিস্ট কোম্পানি ছাড়াও বেশ কিছু সংস্থা মিনিবাসে ট্যুরিস্টদের নিয়ে ওদিকে বেড়াতে যায়। নবম অফিস থেকে হতাশ হয়ে বেরিয়ে প্রদীপ যখন ভাবছে কী করা যায় তখন তার মনে পড়ে গেল। যে বাসটা গতকাল ওদিকে গিয়েছিল তার যাত্রীরা ব্ল্যাক লেপার্ডদের মেটিং দেখেছে। তিনজন ট্যুরিস্ট তার ছবি তুলেছে। এমন বিচিত্র ঘটনার কথা শহরে ফিরে এসে কেউ আলোচনা করবে না এমন হতেই পারে না।

সামনে দাঁড়ানো একটা বাসের দিকে তাকাল সে। কয়েকজন যাত্রী উঠেছে। ড্রাইভার নিচে দাঁড়িয়ে। সে এগিয়ে গেল, আচ্ছা, ব্ল্যাক লেপার্ড দেখা যায় বলে শুনেছি। কোন বাসে গেলে দেখার সুযোগ পাব বলতে পারেন?

লোকটা অবাক চোখে তাকাল, ব্ল্যাক লেপার্ড?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

আমি তো এ জীবনে দেখিনি। দেখা যায় কে বলল আপনাকে?

কালই একটা ট্যুরিস্টবাসের সবাই দেখেছে। টিবেটিয়ান বর্ডারের কাছাকাছি।

আমি তো শুনিনি। আপনাকে কি কমলাপ্রসাদ বলেছে এই গল্পটা?

না। কমলাপ্রসাদ কে?

ড্রাইভার। হিমালয়ান ট্যুরিজমের বাস চালায়। ওর কথায় কান দেবেন না। দিনকে রাত করার মতো মিথ্যে কথা ওর জিভে। একদিন তো এসে বলেছিল ইয়েতির বাচ্চাকে দেখেছিল। বেচারা নাকি পথ হারিয়ে কাঁদছিল। হাঃ হাঃ হাঃ।

গল্পটা গল্পই হতে পারে। কিন্তু ড্রাইভার কাছাকাছি পুলিশ স্টেশনে খবর দিয়ে গিয়েছিল। সেই পুলিশ স্টেশনের খাতায় নিশ্চয়ই ড্রাইভারের পরিচয় পাওয়া যাবে। আর মিথ্যে হলে লোকটা পুলিশকে কি ভাওঁতা দেবার মতো সাহস পাবে?
 

Users who are viewing this thread

Back
Top