হিমালয়ান ট্যুরিজমের অফিসে ঢুকে পড়ল প্রদীপ। টেবিলের ওপাশে একটি মাঝবয়সি সুন্দরী সিকিমিজ মহিলা কাগজপত্র দেখছিলেন, মুখ তুলে হাসলেন, গুডমর্নিং।
গুডমর্নিং। বসতে পারি?
সিওর। বলুন, আপনার জন্যে আমরা কী করতে পারি?
ভদ্রমহিলা এখন একা অথচ আমরা শব্দটি ব্যবহার করলেন। অর্থাৎ ইনি ট্যুরিস্টদের সঙ্গে এইভাবে কথা বলে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। প্রদীপ হাসল, ম্যাডাম, আপনার গলার হার একটু অদ্ভুত রকমের। কিছু মনে করবেন না, ওগুলো কি নীলমুক্তো?
মহিলা এবার ছড়িয়ে হাসলেন, আপনার চোখ দেখছি জহুরির।
ধন্যবাদ। আপনাদের সংস্থায় কমলাপ্রসাদ নামে কোনও ড্রাইভার আছে?
কেন বলুন তো?
আমি শুনলাম গতকাল কমলাপ্রসাদ যে বাস নিয়ে ট্যুরে গিয়েছিলেন সেই বাসের যাত্রীরা ব্ল্যাক লেপার্ড দেখেছেন। ব্ল্যাক লেপার্ড ভারতবর্ষে দেখতে পাওয়া যায় না। এই ব্যাপারটা আমাকে বিস্মিত করেছে।
কমলাপ্রসাদ ব্ল্যাক লেপার্ড দেখেছে? কই আমরা তো একথা জানি না। এমন একটা। খবর চেপে রাখার লোক ও নয়।
আপনি ওর ঠিকানাটা দিতে পারেন?
প্রদীপ প্রশ্ন করতেই একটা রোগা বেঁটে লোককে অফিসে ঢুকতে দেখা গেল। ভদ্রমহিলা হাসলেন, কমলাপ্রসাদ, কালকে তুমি ব্ল্যাক লেপার্ড দেখেছ?
কালকে দেখিনি।
কবে দেখেছিলে?
মাসখানেক আগে। সিনেমায়। প্যাসেঞ্জার লিস্ট দেখি।
এই ভদ্রলোক তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান।
কমলাপ্রসাদ প্রদীপের দিকে তাকাল। প্রদীপ হাসল, আমার নাম প্রদীপ গুরুং। গতকাল আপনি টিবেটিয়ান বর্ডারে ট্যুরিস্টদের নিয়ে গিয়েছিলেন?
জী হ্যাঁ।
ওখানে ব্ল্যাক লেপার্ড দেখার পর পুলিশ স্টেশনে জানিয়েছিলেন?
কমলাপ্রসাদ হেসে উঠল শব্দ করে, লোকে বলে আমি গল্প বানাই। কিন্তু আমাকে নিয়ে যে গল্প বানাতে পারে সে তো আরও বড় গুলবাজ।
প্রদীপ হতাশ হল, আপনি কিছু দেখেননি?
না স্যার। দেখে থাকলে সেটা অফিসে এসে জানাতাম। না দেখে-দেখে গল্প বানিয়ে এখন আমি ক্লান্ত। সত্যি যদি দেখার মতো কিছু পেতাম, সেটা ব্ল্যাক লেপার্ড হোক অথবা ইয়েতি হোক, আমার চেয়ে খুশি কেউ হতো না।
আপনি গতকাল কোন রুটে গিয়েছেন?
কমলাপ্রসাদ দেওয়ালে টাঙানো ম্যাপটার দিকে তাকাল। একটা স্কেল টেবিল থেকে তুলে সে দেখাল গ্যাংটক থেকে বেরিয়ে কোন-কোন রাস্তায় সে বাস নিয়ে ঘুরেছে। প্রদীপ উঠে দাঁড়িয়ে লক্ষ করল।
সিকিম-টিবেট বর্ডারটা কোনদিকে?
এদিকে। স্কেল সরাল কমলাপ্রসাদ।
ওদিকে আপনাদের কোনও বাস গিয়েছিল?
না। ওখানে সাধারণত এভারেস্ট ট্যুরিজমের বাস যায়।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
এভারেস্ট ট্যুরিজমের অফিসে পৌঁছে প্রদীপ দেখল এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক বসে আছেন। সরাসরি প্রশ্ন না করে প্রদীপ জিজ্ঞাসা করল, আজ আপনাদের কোনও বাস তিব্বত বর্ডারে যাবে?
না।
গতকাল গিয়েছিল?
হ্যাঁ।
গতকাল যিনি বাসটা চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারি?
কেন বলুন তো?
ব্যাপারটা ব্যক্তিগত।
তা ব্যক্তিগত ব্যাপার যখন তখন অফিসে এসেছেন কেন? চন্দ্রনাথের বাড়িতে গিয়ে দেখা করুন। যত্তসব ঝুটঝামেলা।
চন্দ্রনাথের বাড়িটা কোথায়?
জিজ্ঞাসা করে নিন। বাইরে অনেক লোক আছে তাদের জিজ্ঞাসা করুন। লোকটা খেঁকিয়ে উঠল। প্রদীপের মনে হল এই চন্দ্রনাথের সঙ্গে লোকটির সম্পর্ক নিশ্চয়ই ভালো নয়। বাইরে বেরিয়ে আড্ডারত কিছু লোকের কাছে সে চন্দ্রনাথের খবর পেয়ে গেল। এখন এ সময় নাকি চন্দ্রনাথ বাড়িতে থাকার লোক নয়। তাকে পাওয়া যাবে হংলুর ভাটিখানায়। জায়গাটা কোথায় জেনে নিয়ে বাইকে উঠে বসল প্রদীপ। লোকটা যদি মাতাল হয় তা হলে গিয়ে কোনও লাভ হবে না।
হংলুর ভাটিখানা খুঁজে পেতে অসুবিধে হল না। এই সকাল পার হতে-না-হতেই সেখানে মাতালদের ভিড় জমে গেছে। প্রশ্ন করে করে চন্দ্রনাথের সামনে যখন পৌঁছল তখন নেশায় চোখ বন্ধ করে বসে আছে। লোকটার স্বাস্থ্য এখনও ভালো। চল্লিশের কাছাকাছি বয়স। মুখে খোঁচা দাড়ি দাঁড়িয়ে।
প্রদীপ ওর পাশে বসে জিজ্ঞাসা করল, কগ্লাস খেয়েছেন?
চোখ না খুলে চন্দ্রনাথ জবাব দিল, এই প্রশ্নের জবাব আমি আমার বউকেও দিই না। তুমি কে?
আমি আপনার খোঁজে এভারেস্ট ট্যুরিজমে গিয়েছিলাম। বুড়োটা খুব খারাপ ব্যবহার করল!
করবেই! শালা আমাকে সহ্য করতে পারে না। গতকাল ফিরে এসে যেই বলেছি আজ আর বেরুতে পারব না অমনি ওর মেজাজ খারাপ হয়েছে। কেন রে শালা, আমি কি তোর বাপের চাকর যে রোজ-রোজ গাড়ি চালাব? চোখ খুলে মাথা নাড়ল চন্দ্রনাথ।
ঠিক কথা।
কিন্তু ভাই, আমার খোঁজে কেন?
প্রদীপ বুঝল লোকটার মাথা পরিষ্কার আছে এখনও। সে বলল, কাল আপনি বাস নিয়ে বর্ডারের দিকে গিয়েছিলেন?
গিয়েছিলাম। কিন্তু ও ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। পুলিশ?
না। আমি পুলিশ নই। আমি ধরে নিচ্ছি আপনি কিছু জানেন না। কিন্তু আপনার বাসে তিনজন ট্যুরিস্ট ছিল যারা ক্যামেরায় ছবি তুলেছে। তাদের চেনেন?
যাচ্চলে। কত লোক রোজ গ্যাংটকে বেড়াতে আসছে। তারা টিকিট কেটে বাসে ওঠে। আমি সেই বাস নিয়ে এখানে ওখানে যাই। তারা কে কী করে আমি চিনব কী করে?
ঠিক কথা। তবু মনে করে দেখুন, কিছু মনে পড়ে কি না। প্রদীপ একটা কুড়ি টাকার নোট বের করে চন্দ্রনাথের সামনে রাখল। বাঁ-হাতে নোটটা তুলে নিয়ে চন্দ্রনাথ চোখ বন্ধ করল, ক্যামেরা কার কার হাতে ছিল এখন মনে নেই। বিকেলে গ্যাংটকে ফিরে এসে যে যার হোটেলে চলে গেল। তবে একজন লোক খুব মোটা ছিল। আড়াইজন মানুষের মতো মোটা। অথচ মাথাটা ছিল আপেলের মতো গোল। বাস থেকে নেমে লোকটা একজনকে জিজ্ঞাসা করছিল হলিডে হোটেলে যাওয়ার রাস্তাটার কথা। আমি একটু অবাক হয়েছিলাম। আসতে পারল অথচ যেতে পারছে না কেন?
ওই লোকটা ছাড়া আর কেউ?
একটা বিদেশি বুড়ি ছিল। খুব বকবক করছিল! ওই বুড়িই আমাকে বলেছিল থানায় খবর দিতে। ওখানে তো থানা নেই, একটা পুলিশ ফাঁড়িতে খবর দিয়ে এসেছিলাম।
ওই বুড়ি কোন দেশের?
তা বলতে পারব না। বিদেশিনীদের আমার একরকম লাগে। তবে বুড়ি উঠেছে ট্যুরিস্ট লজে। কারণ ফেরার সময় ওই লজের সামনে ওঁকে নামিয়েছি। চন্দ্রনাথ বলল।
আপনার বাসে কাল কজন যাত্রী ছিল?
আটজন।
রাস্তায় বেরিয়ে প্রদীপ নিজের বাইকের গায়ে হাত বোলাল। দুটো নাম পাওয়া গেল। বুড়ি ক্যামেরায় ছবি না তুললেও ক্যামেরাম্যানদের হদিশ দিতে পারেন। যারা সবসময়ে টিকটিক করেন তারা অনেক কিছু মনে রাখেন। সে সোজা ট্যুরিস্ট লজে চলে এল।
ভদ্রমহিলা ঘরে ছিলেন। নিজেকে সাংবাদিক হিসাবে রিসেপশনে পরিচয় দিয়ে সে ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা বলতে চাইল। রিসেপশন ভদ্রমহিলাকে সেকথা জানাতে তিনি অপেক্ষা করতে বললেন। লাউঞ্জে চেয়ার সাজানো। তার একটায় বসল প্রদীপ। এখন ঘড়িতে যে সময় তাতে লিটনের ইতিমধ্যে এসে যাওয়ার কথা। কাজ প্রথম দিকে মোটেই এগোচ্ছিল না। কিন্তু চন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর মনে হচ্ছে আজ বিকেলেই দার্জিলিং-এ ফিরে যেতে সে পারবে। তারপর পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে সোজা হোমে চলে যাবে। অবশ্য যদি লোকটা টাকা দিতে ঝামেলা করে তাহলে মুশকিল। সে ঠিক করল ছবিগুলো লিটনের কাছে রেখে সে আগে বাংলোয় গিয়ে দেখা করবে। লোকটা যদি দুনম্বরি করে তা হলে জীবনে ছবি পাবে না। প্রদীপ দেখতে পেল এক মধ্যবয়সিনী বিদেশিনী এদিক ওদিক তাকাতে-তাকাতে এগিয়ে আসছেন। মহিলার পরনে সাদার ওপর নীল বৃত্ত আঁকা সাধারণ গাউন।
ভদ্রমহিলা সামনে এসে দাঁড়ালেন। লম্বায় প্রায় পাঁচ ফুট নয়, দশ। মুখের চামড়া শুধু বলছে ওঁর বয়স হয়েছে কিন্তু শরীর এখনও মজবুত, ইয়েস?
প্রদীপ বলল, আমার নাম প্রদীপ গুরুং। আমি একজন সাংবাদিক।
ও। এতক্ষণে খবরটা পেয়েছেন? বসুন-বসুন। আমার নাম লিসা। ভদ্রমহিলা বসলেন। কিন্তু ওঁর মুখ আবার চলতে শুরু করল, এরকম একটা ঘটনা ঘটে গেল, পুলিশকেও জানানো হল কিন্তু কেউ যে মাথা ঘামাচ্ছে তা এতক্ষণ বুঝতে পারিনি। আসলে, কিছু মনে করবেন না, আপনাদের দেশের ব্যাপার-স্যাপারগুলো আমার মাথায় ঠিক ঢুকছে না।
আপনি কতদিন আছেন এখানে?
কালই চলে যাব। একা-একা এখানে যে কী বোরিং ব্যাপার। সময় কাটাবার কোনও ব্যবস্থাই নেই। অথচ কাঠমাণ্ডুতে কিন্তু অন্য আবহাওয়া।
ম্যাডাম, গতকাল আপনি ক্যামেরা নিয়ে গিয়েছিলেন?
কপাল খারাপ। আমার ক্যামেরাটা হঠাই বিগড়ে গিয়েছিল। নইলে ক্যামেরা ছাড়া আমি কোথাও এক পা যাই না। খুব দামি ক্যামেরা বলে এখানে সারাতে দিতে চাই না।
আপনার বাসে তিনজন লোকের হাতে ক্যামেরা ছিল। তাদের মনে আছে?
না। আমি তো সহযাত্রীদের দেখব বলে এখানে আসিনি। বাসের জানলা দিয়ে প্রকৃতির এত কিছু দেখার জিনিস ছেড়ে সহযাত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকব তেমন বয়স আমার নেই। তবু ওই লোকটা খুব বিরক্ত করছিল।
কোন লোকটা?
তোমাকে কী বলব। অনেক মোটা মানুষ আমি দেখেছি কিন্তু অমন মোটা কখনও দেখিনি। উঃ। শুনেছিলাম বেশি মোটা হয়ে গেলে মানুষের মন থেকে কুচিন্তা চলে যায়। এর তো পুরোমাত্রায় আছে। ও ছবি তুলেছিল। আর পাশের লোকটাকে অনবরত ক্যামেরা সম্পর্কে বক্তৃতা দিচ্ছিল।
সেই লোকটা কেমন?
আমি লক্ষ করিনি। একে মনে আছে কারণ ওই চেহারা আর দ্বিতীয়ত আমাকে ডিনার খাওয়াতে চেয়েছিল বলে।
আপনি একাই এসেছেন ম্যাডাম?
নিশ্চয়ই। সারা পৃথিবী একা ঘুরে বেড়াই আমি।
অনেক ধন্যবাদ ম্যাডাম। প্রদীপ উঠে পড়ল।
পুলিশ কোনও অ্যাকশন নিয়েছে?
না। স্পটে গিয়ে পুলিশ কিছুই দেখতে পায়নি।
তা পাবে কী করে? এমন অলস মানুষ আমি কখনও দেখিনি।
বাইরে বেরিয়ে এসে একটা টেলিফোন বুথে ঢুকে এস টি ডি করল প্রদীপ। প্রথমবারেই লাইন পাওয়া গেল। এবং ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলে তিনিই রিসিভার তুললেন। স্যার আমি গ্যাংটক থেকে বলছি।
বুঝেছি।
আমি ট্যুরিস্টবাসটাকে খুঁজে বের করেছি।
গুড।
একজন ফটোগ্রাফারের হদিশ পেয়েছি। তার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি।
লোকটার নাম রণতুঙ্গা। এত মোটা মানুষ জীবনে দেখেনি প্রদীপ। রিসেপশনে খবর দিতে ঘরেই ডেকে পাঠিয়েছিল তাকে। কোনওরকম ভনিতা না করে প্রদীপ তাকে সরাসরি বলল, মিস্টার রণতুঙ্গা, আপনি টিবেটিয়ান বর্ডারে যে ছবিগুলো তুলেছিলেন সেগুলো আমার চাই।
মাংস এবং চর্বিতে লোকটার দুকান প্রায় ঢাকা। সেই অবস্থায় যেভাবে তাকাল তাকে অবাক হওয়া নিশ্চয়ই বলা চলে।
এখানে বুঝি চাইলেই সব কিছু পাওয়া যায়?
তার মানে?
আমি তো অনেক কিছু চাইছি অথচ কিছুই পাচ্ছি না। একটা ক্যাসিনো নেই যে জুয়ো খেলব! এমনকী একটি ভালো মহিলা এসকর্ট পর্যন্ত পাচ্ছি না। আর আপনি এসে যেই বললেন। ছবিগুলো চাই আর আমি দিয়ে দেব?
প্রদীপ বুঝল লোকটা বোকা নয়। সে বলল, ওই ছবিগুলো নিয়ে আপনি কী করবেন?
যা ইচ্ছে তাই করতে পারি।
আপনি কটা ছবি তুলেছেন?
তোলার সময় হিসেব করিনি। তাছাড়া আমার ফিল্ম এখনও শেষ হয়নি।
আপনার পাশে আর এক ভদ্রলোক, খুব নামী ফটোগ্রাফার বসেছিলেন।
কে বলেছে নামী ফটোগ্রাফার? লোকটা ক্যামেরার সি বোঝে না। ওর উচিত হটশটে ছবি তোলা। অ্যাপারচার লেন্স সম্পর্কে কোনও আইডিয়াই নেই।
তাই নাকি?
ইয়েস। আমি একটু কথা বলেই বুঝতে পেরেছি। রণতুঙ্গা বলল, ভদ্রলোক ব্যবসাপত্তর। করেন। কলকাতায় তো ছবিই তোলেন না।
বাঙালি?
হতে পারে। ড্রিমল্যান্ড না কি একটা হোটেলে উঠেছে।
নামটা কী?
জিজ্ঞাসা করিনি। ওরকম নির্বোধ ফটোগ্রাফারের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। রণতুঙ্গার হঠাৎ খেয়াল হল, আমার কথা আপনাকে কে বলল?
আপনাদের বাসে এক বিদেশিনী মহিলা ছিলেন। তাঁর নাম লিসা। উনি বলছিলেন আপনার ক্যামেরা সেন্স খুব ভালো।
বলছিল? অথচ আমি যখন কথা বলতে গেলাম তখন খেঁকিয়ে উঠল। গাল চুলকাল রণতুঙ্গা, শুনুন মশাই, আপনি কি পুলিশের লোক?
না। আমি একজন সাংবাদিক।
তা হলে খুব ভালোই হল। আমি যে ছবি তুলেছি, মানে আমার কাছে যে ওই ঘটনার ছবি আছে তা ভুলে যান। আমি জানি পুলিশ খবর পেলেই ফিল্মটা নিয়ে যাবে। আমিও ঝুটঝামেলায় জড়িয়ে যাব। আমার আজ সকালেই চলে যাওয়া উচিত ছিল। কাল ফিরে আসার সময় আমরা আলোচনা করেছিলাম পুলিশ জানতে পারলে এই ছবির জন্যে আমরা বিপদে পড়ব। আপনাকে বলছি, এই ছবি আমাদের পত্র-পত্রিকায় ছাপাতে চাই আমি।
প্রদীপ হাসল, আমাদের দেশের পুলিশের মাথা ঘামানোর মতো বিষয় অনেক আছে, এটা একধরনের মানুষের কাছে খুব মূল্যবান হলেও আমাদের পুলিশ এ নিয়ে চিন্তিত হবে না।
সে কি? রণতুঙ্গা অবাক হয়ে বলল।
হ্যাঁ। আমি আপনাকে একটা অফার করছি। ছবিগুলোর জন্যে শ-পাঁচেক দিতে পারি।
অসম্ভব।
প্রদীপের খুব ইচ্ছে করছিল এই সময় পিস্তলটা বের করতে। লোকটার গোল মুখের ওপর ওটা উঁচিয়ে ধরলে ফিল্ম না দিয়ে পার পাবে না। কিন্তু পরে চিৎকার-চেঁচামেচি করতে পারে। সে বাইকে চেপে এসেছে। হোটেল থেকে পুলিশে খবর দিলে ওঁরা তাকে ঠিক খুঁজে বের করবে। অতএব তাড়াহুড়ো নয়। ধীরস্থির হয়ে কাজটা করতে হবে।
প্রদীপ হাসল। ঠিক আছে। তা হলে একটা সাহায্য করুন। আপনাদের বাসে তৃতীয় একজন ক্যামেরাম্যান ছিলেন। তার কথা মনে আছে?
হ্যাঁ। লম্বা। খুব স্বাস্থ্য ভালো। রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার। নাম জানি না।
কোন হোটেলে উঠেছেন?
তাও জানি না। তবে লোকটা আজকেও একবার ওই স্পটে যাবে বলেছিল। বাইরে বেরিয়ে এল প্রদীপ। তারপর পাবলিক বুথ থেকে ফোন করে রণতুঙ্গার কথা জানিয়ে দিল। এখন কেউ ফোন ধরেনি। আনসারিং মেশিন জানাল তিনি বাড়িতে নেই। প্রদীপ ঘটনাটা বলে আশ্বস্ত করল। পরে আর-একবার চেষ্টা করবে ছবি পেতে।
ড্রিমল্যান্ডে ফিরে প্রদীপ দেখল লিটন রিসেপশনের সামনে মুখ কালো করে বসে আছে। তাকে দেখে উঠে এল। তুমি গুরু অবাক করলে!
কেন?
হোটেলে এসে তোমার কথা জিজ্ঞাসা করতে বলল বেরিয়েছে। ঘরে যেতে চাইলাম কিন্তু ওরা চাবি দিল না। তুমি বলে যাওনি?
সরি লিটন, একদম খেয়াল ছিল না। খারাপ লাগছিল প্রদীপের।
কিন্তু তোমার ঘরে নাকি একজন মহিলা আছে?
মহিলা?
তোমার সঙ্গে একই বাইকে এসেছে। তুমি মাইরি দার্জিলিং থেকে একা রওনা হলে, পথে আবার মহিলা জোটালে কোত্থেকে?
জোটাইনি, নিজেই জুটে গিয়েছিল, কিন্তু এখন সে চলে গেছে। প্রদীপ রিসেপশনে গেল। এক্সকিউজ মি, এক বাঙালি ভদ্রলোক, কলকাতায় থাকেন, ব্যবসা করেন, কোন রুমে আছেন বলুন তো?
বাঙালি কোনও ভদ্রলোক তো এখন হোটেলে নেই স্যার।
গতকাল ছিলেন?
গতকাল? না স্যার।
কলকাতার কোন বিজনেস ম্যান?
হ্যাঁ। এস. কে. শর্মা। উনি একটু আগে শিলিগুড়ি চলে গিয়েছেন।
শিলিগুড়ি?
হ্যাঁ। আজ সন্ধেবেলার দার্জিলিং মেলে ওঁর ফার্স্টক্লাসে রিজার্ভেশন করা আছে।
প্ৰদীপ অসহায়ের মতো তাকাল। লোকটা হাতছাড়া হয়ে গেল। এখন চেষ্টা করলে সে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে গিয়ে লোকটাকে ধরতে পারে কিন্তু এই মুহূর্তে গ্যাংটক ছেড়ে সে যায় কী করে? লিটনকে পাঠানো যায়। সে দূরে বসা লিটনের দিকে তাকাল। লিটন ইতিমধ্যে চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করেছে। না, ওকে একা পাঠালে কাজ হাসিল না করতে পারলে গায়ের জোর দেখিয়ে ফেলতে পারে। তার চেয়ে দার্জিলিং-এ ফোন করে ব্যাপারটা জানিয়ে দিলেই হয়। সে রিসেপশনিস্টকে বলল দার্জিলিং-এ একটা টেলিফোন করবে।
.
রিসিভার তুললেন তিনিই, হ্যালো।
স্যার, আমি প্রদীপ বলছি।
নতুন কোনও খবর?
হ্যাঁ স্যার। দ্বিতীয় ফটোগ্রাফারকে খুঁজে পেয়েছি।
সো নাইস অফ ইউ। থাপা আমাকে ঠিক লোক দিয়েছে। ওর নাম?
এস কে শর্মা। কলকাতায় বাড়ি, বিজনেসম্যান। এখন গ্যাংটকে নেই।
কোথায় গিয়েছে?
আজই শিলিগুড়ি রওনা হয়ে গিয়েছে।
কোনও ঠিকানা?
নো স্যার। ঠিকানা নেই। কলকাতার ঠিকানা জোগাড় করতে পারি কিন্তু উনি দার্জিলিং মেলের ফার্স্টক্লাসের প্যাসেঞ্জার। আজকের ট্রেন।
গুড। তোমাকে আর শর্মাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। এবার তিন নম্বর ফটোগ্রাফারকে খুঁজে বের করতে চেষ্টা করো। লাইনটা ডেড হয়ে গেল।
লিটনকে নিয়ে ঘরে এল প্রদীপ। চাবি খুলে খাটে গড়িয়ে পড়ল সে। অত তাড়াতাড়ি যে কাজ উদ্ধার হবে তা কে ভেবেছিল। দুজনের সম্পর্কে তার দায়িত্ব অনেকটা শেষ। শুধু রণতুঙ্গার কাছ থেকে ফিল্মের রোলটা উদ্ধার করতে হবে। তিন নম্বর লোকটি এক্স মিলিটারি ম্যান। সহজ হবে না ব্যাপারটা। লোকটা আজও ওই স্পটে গিয়েছে। চান্স পেয়ে আরও কিছু ছবি তোলার ধান্দা নিশ্চয়ই। যেন ছেলের হাতের মোয়া। লিটনকে বাথরুমে ঢুকে যেতে দেখল সে। এবং তখনই দরজায় শব্দ হল।
প্রদীপ বলল, কাম ইন।
দরজা খুলল সুজাতা। প্রদীপ উঠে বসল, কী ব্যাপার?
সুজাতার অবস্থা বেশ উদভ্রান্ত। বোঝাই যাচ্ছে সারারাতের কষ্টকর বাইক-যাত্রার পর সে একটুও বিশ্রামের সুযোগ পায়নি। সুজাতা দুর্বল গলায় বলল, আমি আসতে পারি?
নিশ্চয়ই। প্রদীপ খাট থেকে নেমে দাঁড়াল।
ঘরে ঢুকল সুজাতা। তারপর এগিয়ে গিয়ে ধপ করে বসে পড়ল চেয়ারে।
কী হয়েছে? পিসির দেখা পেয়েছ?
না। পিসি শিলিগুড়িতে চলে গিয়েছে। বাড়ি তালা বন্ধ।
ও। এতক্ষণ কোথায় ছিলে?
আমার এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলাম। ওর স্বামীর সঙ্গে গোলমাল, আমাকে থাকতে দিতে ভরসা পেল না। আমি এখন কী করি? কোথায় যাই। আমার সঙ্গে টাকাকড়িও নেই। দুহাতে মুখ ঢাকল সুজাতা। ওর শরীর কাঁপছিল।
বেল বাজিয়ে বেয়ারাকে ডাকল প্রদীপ। লোকটা এলে তিনটে গরম চা আর স্যান্ডউইচ আনতে বলল। তারপর সুজাতার দিকে তাকাল, আর যেখানেই যাও নিশ্চয়ই দার্জিলিং-এ যাবে না।
সুজাতা মুখ তুলে তাকাল, কিছু বলল না। কিন্তু ওর দুটো চোখের দিকে তাকিয়ে প্রদীপের মায়া হল। হঠাৎই মেয়েটার অসহায়ত্ব বড় হয়ে দেখা দিল তার কাছে।
সে হুকুম করল, উঠে দাঁড়াও।
চোখের দৃষ্টি পালটাল সুজাতার। তাতে প্রশ্ন।
এগিয়ে গিয়ে তার হাত ধরে দ্বিতীয় খাটের কাছে নিয়ে এল প্রদীপ। সেখানে বসিয়ে দিয়ে বলল, শুয়ে পড়ো। টেক রেস্ট। খাবার এলে উঠে খেয়ে নিও। তুমি ঘুমাও যতক্ষণ ইচ্ছে। না, যা বলছি তাই করো। আমি রেগে গেলে খুব খারাপ লোক হয়ে যাই।
সুজাতার চোখে এবার স্বস্তি এল। ধীরে-ধীরে সে বিছানায় শুয়ে পড়তেই প্রদীপ তার শরীরের ওপর কম্বল টেনে দিল। দার্জিলিং-এর সন্ধেবেলায় যখন ও মতিলালের বাড়িতে এসেছিল তখন সামান্যই শীতবস্ত্র পরেছিল। তাড়াহুড়োতে পালিয়ে আসার সময় তার কিছুটা মতিলালের শোয়ার ঘরে ফেলে আসায় এখন অবস্থা বেশ কাহিল। ফলে কম্বলের আরাম এবং অনেকক্ষণ বাদে শোওয়ার আরাম পেয়ে সুজাতার চোখ জুড়ে এল। ব্যাপারটা লক্ষ করে প্রদীপ কম্বলটাকে আর-একটু টেনে দিতেই বাথরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এল লিটন, গুরু আমি শালা কানে বেশি শুনছি।
তাই নাকি? প্রদীপ নির্লিপ্ত গলায় বলল।
সত্যি বলছি। আমার মনে হচ্ছিল এই ঘরে মেয়ে কথা বলছে। যাক গে, আমি এখন পুরো ফিট। এখন হুকুম করো কী করতে হবে!
গ্যাংটক শহরটায় ঘুরে বেড়াও, আর কী করবে!
রেগেমেগে কিছু বলতে গিয়ে বিছানার দিকে নজর যেতেই হকচকিয়ে গেল লিটন। কম্বলে মোড়া থাকায় শরীরের কোনও অংশ সে দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু অনুমান করতে অসুবিধে হচ্ছিল না। প্রদীপের দিকে তাকিয়ে সে নিঃশব্দে জানতে চাইল কে শুয়ে আছে? প্রদীপ বলল, যার কথা জিজ্ঞাসা করছিলি সে। বেচারা কাল সারারাত ঘুমায়নি, সকাল থেকে রাস্তায় ঘুরেছে, খুব টায়ার্ড!
টায়ার্ড? লিটন চোখ ছোট করল।
তাই তো মনে হল।
ও কি এই ঘরে থাকবে?
ঠিক করেনি এখনও।
মেয়েছেলে এই ঘরে থাকলে আমি এখানে থাকব না।
সেটাই তো স্বাভাবিক।
তার মানে?
ঘরে দুটো খাট আছে। তৃতীয়জনের শোওয়ার ব্যবস্থা তো নেই।
উঃ। তাই বলে তুমি একটা উটকো মেয়েকে এই ঘরে শুতে দেবে?
মেয়েটা যাকে বলে উটকো তা নয়, কিন্তু আমি তোকে বলেছি এখনও ভাবিনি কী করব!
এই সময় বেয়ারা চা এবং স্যান্ডউইচ নিয়ে এল। লোকটা চলে যাওয়ার পর প্রদীপ দ্বিতীয় বিছানার দিকে ঝুঁকে ডাকল, শুনছ? এই। চটপট চা খেয়ে নাও। শরীর ভালো লাগবে!
সুজাতা কম্বল সরাল। বোঝা গেল সে একটুও ঘুমায়নি।
লিটনের চোখ বিস্ফারিত।
আরে! একে তো আমি দেখেছি! কোথায় যেন দেখেছি!
মাথায় হাত দিল সে।
প্রদীপ হাসল, কাল রাত্রে মতিলালের বাড়িতে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, পিস্তল আনতে গিয়ে পুলিশের ভয়ে হাওয়া হয়ে গিয়েছিল? ওরেব্বাস, তখন থাপার মুখটা একরকম হয়ে গিয়েছিল। অ্যাই, তোমাকে পেলে থাপা চিবিয়ে খেয়ে নেবে। এ জীবনে দার্জিলিং-এ যেও না। তারপর প্রদীপের দিকে তাকাল লিটন, ও তোমার সঙ্গে মোটরবাইকে এতটা পথ এসেছে?
হ্যাঁ। তুই চলে যাওয়ার পর ওর দেখা পেয়েছিলাম।
এলেম আছে। আরে হাঁ করে দেখছ কী, খেয়ে নাও। স্যান্ডউইচের প্লেট এগিয়ে দিল লিটন, পেটে কিছু পড়লে তবেই ঘুম আসবে।
সুজাতা কথা না বলে খাবার এবং চা খেয়ে আবার শুয়ে পড়ল। ওরা ধীরেসুস্থে চা খেয়ে ঘরের বাইরে চলে এল। লিটন বলল, মেয়েটাকে নিয়ে এখন কী করবে গুরু?
একটা লোকের কাছে তোকে যেতে হবে। লোকটা গতকাল ওর ক্যামেরায় কিছু ছবি তুলেছে। মনে হয় ফিল্মটা এখনও ক্যামেরার মধ্যেই আছে। লোকটা উঠেছে হলিডে হোটেলে। সারাদিন ঘরে বসে থাকার লোক ও নয়। যদি ক্যামেরা নিয়ে বের হয় তাহলে ওকে ফলো করে সুবিধেমতন ক্যামেরা ছিনিয়ে নিবি। যদি ঘরে ক্যামেরা রেখে বের হয় তাহলে ওটাকে হাতিয়ে নিয়ে আসতে হবে। কিন্তু কেউ যেন টের না পায়। লিটনের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে কথাগুলো বলল প্রদীপ। লিটন হাত নাড়ল, কিন্তু এই মেয়েটা কোথায় থাকবে?
আমি তোকে এতক্ষণ যা বললাম তা কানে ঢোকেনি?
ঢুকেছে। লোকটার নাম কী?
রণতুঙ্গা। প্রদীপ বলল, লোকটা প্রচণ্ড মোটা। কিন্তু মারপিট করার দরকার নেই। লোকটা যদি পুলিশের কাছে যায় তাহলে যেন তোর নামে কমপ্লেন করার সুযোগ না পায়।
বুঝলাম। ছবিগুলো খুব দামি?
না হলে আমি গ্যাংটকে আসতাম না।
হলিডে হোটেলটা কোথায়?
এখান থেকে বেরিয়ে বাঁ-দিকের রাস্তাটা ধরে মিনিট পাঁচেক এগোলেই দেখতে পাবি। বড় হোটেল। সাবধানে কাজ করতে হবে।
ঠিক হ্যায়।
কোনও প্রমাণ না রেখে ক্যামেরা নিয়ে চলে আসতে হবে। লিটন হাসল, কোনও ব্যাপার নয়। কিন্তু আমি থাকব কোথায়?
থাকতে হবে কি না এখনই বলতে পারছি না। কাজ হয়ে গেলে আজই দার্জিলিং-এ ফিরে যাব। না যেতে পারলে ঘর নেওয়া যাবে।
আমরা দার্জিলিং-এ ফিরে গেলে মেয়েটা কোথায় যাবে?
সেটা আমাদের দুজনের চিন্তার বিষয় নয়।
তুমি কি হোটেলে থাকছ?
না। আমি যেখানেই যাই ঠিক তিনটের সময় হোটেলে ফিরে আসব।
অসহায় মেয়েদের জন্যে লিটনের সবসময় মায়া হয়। এজন্যে জীবনে কম ঝামেলা পোয়াতে হয়নি তাকে। কিন্তু এই মেয়েটাকে দেখে তার অসহায় বলে মনে হচ্ছিল না। হলিড়ে হোটেলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে সে মনে করার চেষ্টা করল। ওরা যখন মতিলালের বাড়িতে ঢুকে লোকটার সঙ্গে কথা বলছিল তখন ওই মেয়েটা বেডরুম থেকে বেরিয়ে এসে দরজায় কায়দা করে দাঁড়িয়েছিল। বন্ধুরা যাকে বলে খাব-খাব চেহারা, মেয়েটাকে তখন সেইরকম দেখাচ্ছিল। ওর শরীরে পোশাকও ছিল খুব অল্প। পুলিশ আসার আগে মেয়েটা পিস্তল আনতে ঘরে ঢুকেছিল এবং তারপর আর পাত্তা পাওয়া যায়নি। থাপা বলেছিল, ও জানলা দিয়ে পালিয়েছে। কেন পালাল? ওর যদি কোনও দোষ না থাকে তাহলে পালাতে গেল কেন? তারপর রাস্তায় গুরুর সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়াটাও অদ্ভুত ব্যাপার। আচ্ছা, ওরা ওই মতিলালের ঘরে যাওয়ার আগে মেয়েটা অত অল্প পোশাক পরে বেডরুমে কী করছিল? মতিলাল যদিও বলেছে মেয়েটা তার শালি হয়, তবু হঠাই লিটনের মনে হল সে মেয়েটাকে যতটা অসহায় বলে মনে করছে ততটা ও নয়। হয়তো সম্পূর্ণ উলটো। হয়তো গুরুকে ফাঁদে ফেলার জন্যে মেয়েটাকে ব্যবহার করছে কেউ! গুরুকে সাবধান করে দিতে হবে। এতটা পথ রাত্তিরবেলায় গুরুর পেছনে বাইকে বসে এসেছিল বলে গুরুর একটু দুর্বলতা হতেই পারে। কিন্তু সে নিজে কখনও কোনও মেয়ের শরীরের প্রতি দুর্বল হয়নি। অসহায় বলে সাহায্য করতে গিয়ে ধাক্কা খেলেও ওই বদনাম কেউ দিতে পারবে না। গুরুর সব ভালো, শুধু।
হলিডে হোটেলটা বেশ কেতাদুরস্ত। রিসেপশনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলে রণতুঙ্গার খবরও জানা যায় কিন্তু সেটা করা ঠিক হবে না। রিসেপশনিস্ট তার মুখ মনে রাখবে। পুলিশ যদি কখনও জিজ্ঞাসা করে তাহলে বর্ণনা দিয়ে দেবে। লিটন রিসেপশনের সামনে দিয়ে এমন গম্ভীরভাবে হেঁটে গেল যেন সে এই হোটেলেই থাকে। ভাগ্যিস কাউন্টারে এখন কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে, তাই রিসেপশনিস্ট তাকে খেয়াল করল না।
দোতলায় উঠে সে একটা বেয়ারাকে দেখতে পেল। লোকটা কার্পেট পরিষ্কার করছে। ক্লিনার চালিয়ে। লিটন জিজ্ঞাসা করল, এতে ভালো পরিষ্কার হয়?
একরকম হয়।
তা হলে একটা কিনতে হবে।
লোকটা মাথা নাড়ল, না সাহেব। এর চেয়ে ঝাড়ুই ভালো। এতে মন ভরে না।
তুমি অনেকদিন এখানে আছ?
হ্যাঁ। একেবারে গোড়া থেকে।
তা হলে তো অনেক লোককে চেন।
তা চিনি না! সব ফিল্মস্টারকে চিনি। অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে আমার ছবি আছে।
বাঃ। আচ্ছা, এখানে এক ভদ্রলোক আছেন, খুব মোটাসোটা, মিস্টার রণতুঙ্গা!
খুব মোটা?
খুব।
হ্যাঁ-হ্যাঁ। দুশো ছয় নম্বর ঘর।
লিটন হেসে এগিয়ে গেল। লোকটা আবার মেশিন চালু করল।
দুশো ছয় নম্বরের সামনে পৌঁছে লিটন দেখল দরজা বন্ধ। লোকটা ঘরেও থাকতে পারে। করিডোরে এখন কেউ নেই। কিন্তু এভাবে দাঁড়িয়ে থাকাও ঠিক নয়। গুরু বলেছে হয় লোকটাকে। বাইরে রাস্তায় পেলে ক্যামেরা ছিনতাই করতে নয় ও ঘরে না থাকলে ভেতরে ঢুকে ওটা হাতিয়ে নিতে। এখন লোকটা ঘরে আছে কি না সে বুঝবে কী করে?
হঠাৎ ছেলেমানুষি বুদ্ধি মাথায় এল। সে জোরে জোরে দুবার দরজায় শব্দ করে বেশ কিছুটা দূরে চলে গেল। ওই ঘরের দরজা যদি কেউ খোলে তাহলে সে কিছু জানে না এমন ভাব করে নিচে নেমে যাবে। লিটন লক্ষ করল কেউ দরজা খুলল না।
এইসব দরজায় ল্যাচ-কি লাগানো, বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই ভেতরে কেউ আছে কি না। কিন্তু ওই শব্দ কেউ উপেক্ষা করতে পারে না। হয় লোকটা খুবই ঘোড়েল, ঘাপটি মেরে পড়ে আছে, নয় ঘরেই নেই। পরক্ষণেই খেয়াল হল লোকটা ঘাপটি মেরে পড়ে থাকবে কেন? এমন কোনও ঘটনা তো ঘটেনি যে ও কাউকে ধরার জন্যে অমন করতে যাবে। তার চেয়ে সরাসরি গিয়ে নক করাই ভালো। লোকটা, রণতুঙ্গা না কী যেন নাম, দরজা খুললে বলবে, সরি, রুম ভুল হয়ে গিয়েছে। অবশ্য গুরু তাকে বলেনি এভাবে দরজা নক করতে। তাকে বলা হয়েছে লোকটা বাইরে বের হলে ফলো করে ক্যামেরা ছিনিয়ে নিতে, নয় ও ঘরে না থাকলে। লিটন মাথা নাড়ল। ধরা যাক লোকটা সে আসার আগেই বেরিয়ে গেছে। কাউকে জিজ্ঞাসা না করলে সেটা জানা যাবে না। আর জিজ্ঞাসা করলে সাক্ষি থেকে যাবে। লিটন এগিয়ে গেল। নিজেকে বোঝাল, কখনও কখনও পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এখনই সেইরকম। অবস্থা। সে দরজায় নক করল। পরপর তিনবার। একমাত্র মড়ার মতো ঘুমিয়ে না থাকলে ধরে নেওয়া যেতে পারে লোকটা ঘরে নেই। দ্বিতীয়বার নক করল সে। তারপর দুপাশে তাকিয়ে নিল। হোটেলে যারা আছে তারা দুপুরের এই সময়টায় নিশ্চয়ই বেড়াতে বেরিয়েছে। কর্মচারীদের বিশ্রামের সময় এখন। অতএব তার পোয়া বারো। সে পকেট থেকে একটা রিঙ বের করল। চাবি, ছুরি থেকে কী নেই ওই রিং-এ। এক নজরে তাকিয়ে সরু শক্ত মুখ বেঁকানো একটা তার বের করল লিটন। তারপর চাবির গর্তে ঢোকাল। তার গুরু অনেক ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত একথা সে মানে। কিন্তু কোনও-কোনও ব্যাপারে তার নিজের যে হাতযশ আছে সেটা প্রমাণ করার সুযোগ পেলে সে গর্বিত হয়। দুটো আঙুলের মাঝখানের তারটা যখন গর্তের ভেতর ঘুরছিল তখন তার চোখ হোটেলের করিডোরে পাক খাচ্ছিল। যদিও কার্পেট পাতা তবু কেউ এদিকে আসছে বুঝতে পারলেই তাকে এখান থেকে সরে যেতে হবে।
মৃদু শব্দ হল এবং দরজাটা খুলে গেল। চটপট তারটা বের করে রিঙ পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে দুপাশে দেখে নিয়ে দরজার পাল্লায় চাপ দিতেই সেটা খুলে গেল। ঘর এখন অন্ধকার। তার মানে লোকটা ঘরে নেই। এখন লোকটা সঙ্গে ক্যামেরা নিয়ে বের হলে ঘরে ঢুকে কোনও লাভ হবে না। নিঃশব্দে দরজা ভেজিয়ে দিতেই লকটা আওয়াজ করল। ভেতর থেকে খুলতে কোনও অসুবিধে নেই। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সে ঘরটাকে দেখার চেষ্টা করল। তারপর দেওয়াল হাতড়ে সুইচ খুঁজে পেয়ে আলো জ্বালাল।
ধক করে হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠেছিল তার। একরাশ আলো আঁপিয়ে পড়তেই ও লোকটাকে দেখতে পেল। বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। চোখদুটো বিস্ফারিত। দুটো হাত দুদিকে ছড়ানো। এত মোটা মানুষ সে আগে দেখেছে কি না মনে করতে পারল না। লোকটা মরে গেছে। লিটন থরথর করে কেঁপে উঠল। নিশ্চয়ই মরে গেছে। মৃতরাই ওইভাবে তাকিয়ে থাকে। সে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। লোকটার গলায় সরু কিছু চেপে বসার ছাপ। এমনভাবে বসেছিল যে গলার। ওপরে গোল হয়ে কেটেছে এবং রক্ত উপচে পড়ে গলা লাল হয়ে গেছে। লোকটাকে কেউ খুন করেছে এবং সেটা বেশিক্ষণ আগে নয়।
প্রচণ্ড নার্ভাস হয়ে গেল লিটন। গ্যাংটকের এই আবহাওয়াতে বন্ধ ঘরেও কারও ঘাম হয় না, কিন্তু ওর কপালের চামড়া চকচক করে উঠল। কেউ লোকটাকে খুন করে গেছে, এখনই এই ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে যাওয়া উচিত। দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই তার ক্যামেরার কথা মনে এল। লিটন দাঁড়াল। খাটের ওপর কিছু নেই। টেবিলের এক পাশে পড়ে রয়েছে ক্যামেরাটা। মৃতদেহের পাশ কাটিয়ে সে চলে এল কাছে। হাত বাড়াতে গিয়ে থমকে দাঁড়াতে হল তাকে।
ক্যামেরাটা খোলা পড়ে আছে। যে এসেছিল সে ফিল্মটা নিয়ে চলে গেছে।
পাশের টয়লেটের দরজাটা আধ-ভেজানো। লিটনের কেমন সন্দেহ হল। কাঁধ দিয়ে দরজা ঠেলতেই ভেতরটা দেখতে পাওয়া গেল। কেউ নেই। ওর মনে হয়েছিল সে আসতে আততায়ী ভেতরে লুকিয়ে থাকতে পারে। এইসময় টেলিফোন বেজে উঠল ঝনঝনিয়ে। শব্দটা এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যে প্রায় লাফিয়ে উঠেছিল লিটন। পকেট থেকে রুমাল বের করে সে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। টেলিফোনটা বেজেই চলেছে। ধীরে-ধীরে নব ঘোরাল লিটন। দরজা ঈষৎ ফঁক করে করিডোরের কিছুটা দেখতে পেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেও কাউকে যাওয়া আসা করতে না দেখে বাইরে পা রেখে দরজাটা চেপে দেওয়া মাত্র সেই লোকটাকে মেশিন নিয়ে এগিয়ে আসতে দেখল। লিটনের মনে হল তার শরীর থেকে সমস্ত রক্ত কেউ শুষে নিয়েছে। লোকটা মেশিন থামিয়ে জিজ্ঞাসা করল, দেখা হয়েছে?
মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল লিটন।
আমার কাছে একদম ঠিকঠাক খবর পাবেন। লোকটা আবার মেশিন চালু করতেই লিটন হাঁটতে লাগল। নিচে এসে দেখল রিসেপশন ফাঁকা। রিসেপশনিস্ট টেলিফোন কানে নিয়ে অপেক্ষা করছে। সে কোনদিকে না তাকিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এল।
এখন কী করা যায়? খবরটা যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি গুরুকে দেওয়া দরকার। তিনটের আগে গুরুকে হোটেলে পাওয়া যাবে না। সেই মেয়েটা শুয়ে আছে ওখানে। তাছাড়া, আততায়ী যদি কাছাকাছি থাকে, যদি তার নজরে পড়ে সে ওই ঘরে ঢুকেছিল তাহলে নিশ্চয়ই এখন তাকে অনুসরণ করবে। সেক্ষেত্রে নিজের হোটেল চিনিয়ে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। লিটন উলটোদিকে হাঁটতে লাগল। এইরকম একটা বিপদ থেকে এমন সুন্দর বেরিয়ে আসা মানে তার কার্যক্ষমতা আরও বেড়েছে। গুরুর কাছে এই নিয়ে পরে গর্ব করতে পারবে। বারংবার পেছনে তাকাচ্ছিল লিটন। লোকজন হাঁটছে। তাদের মধ্যে যে কেউ একজন হত্যাকারী হতে পারে। ও হঠাৎ রাস্তা পালটাল। চোরা সিঁড়ি ভেঙে নিচের দিকে দ্রুত হাঁটতে লাগল। এ রাস্তা ও রাস্তা ঘুরে লিটন আচমকা একটা ছোটখাটো রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়ল।
একটা চেয়ারে বসে সে ডবল ডিমের অমলেটের হুকুম দিতেই সামনের চেয়ারে আওয়াজ হল। লিটন চমকে তাকাতে প্রদীপ বলল, একটা নয়, দুটো দিতে বল।
আরে, গুরু তুমি? কোনওমতে নিজেকে সামলে লিটন হাঁকল, একটা নয়, দুটো অমলেট।
হোটেল থেকে বেরিয়ে দৌড়চ্ছিলি কেন?
তুমি কী করে দেখলে?
আমি ওই রাস্তা দিয়ে আসছিলাম, হঠাৎ তোকে দেখতে পেলাম। ফিল্ম এনেছিস?
না। প্রদীপের কথায় বিশ্বাস হল না লিটনের। সে যাতে বিপদে না পড়ে সেইজন্যে পেছনে ছিল গুরু, এরকম ধারণা হল তার।
গুরু, লোকটা খতম হয়ে গেছে?
সে কি? অবাক হয়ে গেল প্রদীপ।
চারপাশে তাকিয়ে নিয়ে নিচু গলায় লিটন সমস্ত ঘটনা বলে গেল।
তারপর মন্তব্য করল, আমাদের আগে আর কেউ ওই ফিল্মের ধান্দায় গিয়ে লোকটাকে খুন করে এসেছে।
ওই ঘরে ঢুকতে তোকে কে-কে দেখেছে?
কেউ দ্যাখেনি।
ভালো করে ভেবে দ্যাখ।
কার্পেট ক্লিনারের কথা বেমালুম ভুলতে চাইল লিটন, আমি ঠিক বলছি।
যদি কেউ দেখে তা হলে তোর উচিত এক্ষুনি দার্জিলিং-এ ফিরে যাওয়া।
দার্জিলিং-এ? লিটন বিচলিত হল।
হ্যাঁ। সেখান থেকে আজ রওনা হয়েছিস, রাতের মধ্যে ফিরে গেলে ওখানে কেউ জানতে পারবে না তুই এখানে এসেছিলি। এখানকার পুলিশ তোর বর্ণনা পেলেও কিছু করতে পারবে না।
লিটন সজোরে মাথা নাড়ল, দূর। তোমাকে এখানে একা ফেলে আমি যেতে পারি না। প্রদীপ লিটনের দিকে তাকাল। ওর বিশ্বাস হচ্ছিল না। লিটন কিছু একটা চেপে যাচ্ছে এখানে। থেকে যাওয়ার লোভে। সেই দৃষ্টির সামনে লিটন ক্রমশ অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করল। হঠাৎ সে বলে বসল, এমন কিছু ব্যাপার নয়।
একটা লোক খুন হয়েছে। তার কাছে গতকাল আমি গিয়েছিলাম আজ তুই তার ঘরে ঢুকেছিলি। অতএব খুব সামান্য ব্যাপারও পরে বড় হয়ে উঠতে পারে।
আমি যখন ওর ঘর থেকে বের হই তখন একটা বুড়ো আমাকে দেখেছিল। লোকটা হোটেলের কার্পেট পরিষ্কার করে মেশিন দিয়ে। কিন্তু ওর কোনও সন্দেহ হয়নি। লিটন বলল, তা ছাড়া, ও বেশি কথা বলে। আমার বর্ণনাও ঠিকঠাক করতে পারবে না। তারপরই মনে পড়ে গেল কথাটা, গুরু, আমি যখন ওই ঘর থেকে চলে আসছিলাম সেইসময় হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠেছিল।
টেলিফোন?
হ্যাঁ। কেউ ওই লোকটাকে ফোন করেছিল।
্না করলে তুই তাড়াতাড়ি বের হতিস না।
তার মানে? লিটনের কপালে ভাঁজ পড়ল।
ওটা আমিই করেছিলাম।
খাওয়া শেষ হয়ে গেলে প্রদীপ বলল, ব্যাপারটা এবার গোলমেলে বলে মনে হচ্ছে। এই রণতুঙ্গা লোকটার কোনও শত্রুর এখানে থাকার কথা নয়। ও বেড়াতে এসেছিল।
লিটন মাথা নাড়ল, আরে এটা তো সহজ ব্যাপার। ফিল্মটার জন্যে খুন হয়েছে লোকটা।
হ্যাঁ। ব্ল্যাক লেপার্ডের মেটিং দৃশ্য কত মূল্যবান যে তার জন্যে একটা লোককে খুন করা যায়? তা ছাড়া, এখানকার ট্যুরিস্ট ব্যুরো বলছে কেউ কখনও ব্ল্যাক লেপার্ডের কথা শোনেনি।
ব্ল্যাক লেপার্ড?
হ্যাঁ, কালো চিতা। যার ছবি তোলার জন্যে লোকটা মরে গেল। তার মানে আমরা ছাড়াও আরও একটা দল গ্যাংটকে এসেছে ওই ছবিগুলোর সন্ধানে। ব্যাপারটা দার্জিলিং-এ জানানো দরকার। প্রদীপ ঘড়ি দেখল।
চারটে নাগাদ ট্যুরিস্ট বাসগুলো সাধারণত ফিরে আসে। আজ দুপুরের পর থেকেই এখানে ঠান্ডাটা হঠাৎ বেড়ে গেছে। ঠান্ডা বাড়লে রাস্তায় লোক কমে যায়। প্রদীপ আর লিটন বাইক নিয়ে স্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছিল। একটার পর একটা বাস ফিরছে। প্রদীপ যাত্রীদের লক্ষ করছিল। লোকটাকে দেখেই বোঝা যাবে যে মিলিটারিতে ছিল একসময়। মুখগুলো খুঁটিয়ে দেখে হতাশ হচ্ছিল সে।
কিছুক্ষণ আগে দার্জিলিং-এ টেলিফোন করেছে সে। একটা ব্যাপার তাকে কিছুটা চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। রণতুঙ্গার খুন হওয়ার খবরটা পেয়ে ভদ্রলোক কোনও প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। শুধু বললেন, তোমার এখনও অনেক কাজ বাকি। ওই হোটেলের কাছাকাছি যেও না। আমি চাই না কোনও ঝামেলায় তুমি জড়িয়ে পড়ো।
প্রদীপ বলেছিল, মনে হচ্ছে আমার কোনও অ্যান্টি পার্টি এখানে কাজ করছে।
হতে পারে। এখনও একজন ফটোগ্রাফারকে খুঁজে বের করতে হবে তোমাকে।
তাহলে আমার পঞ্চাশ হাজার টাকা?
তুমি পাবে।
খটকা লাগছে দুটো জায়গায়। রণতুঙ্গার ছবি অন্য লোক নিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তার সঙ্গে কথার খেলাপ করছেন না ভদ্রলোক। উনি ইচ্ছে করলে টাকার অঙ্ক কমিয়ে দিতে পারতেন। হঠাৎ এই উদারতার মানে কী? দ্বিতীয়ত, এস. কে. শর্মা এখন শিলিগুড়িতে। আজ রাত্রে দার্জিলিং মেল ধরবে লোকটা। তার কাছে ছবি আছে। তাকে ধরলে দুজন ফটোগ্রাফারকে খুঁজে বের করা বাকি! আর উনি বললেন একজনের কথা। শর্মার দায়িত্ব কি উনি অন্য কাউকে দিচ্ছেন? দিয়ে থাকলে তো তাকে ওঁর পঞ্চাশ হাজার টাকা দেওয়ার কথা নয়। প্রদীপ কিছুই বুঝতে পারছিল না।