What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected কালবেলা- সমরেশ মজুমদার (3 Viewers)

ছেলেরা সবাই সরে গেলেও ছোটখাটো জটলা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। অনেকেই দূর থেকে মেয়েটিকে লক্ষ্য করে বেশ মজা পাচ্ছে। অনিমেষ সেই ছেলেটিকে খুঁজছিল যে মেয়েটিকে আপনি বলে সম্মান দিতে নিষেধ করেছে এবং বারোটা বাজানোর কথা বলেছিল। ছেলেটির সঙ্গে ওর তেমন আলাপ নেই কিন্তু মুখে চেনা। চট করে তাকে খুঁজে না পেয়ে অনিমেষ গোবিন্দকে মৃদু স্বরে ছেলেটিকে ডেকে আনতে বলে সহজ গলায় জিজ্ঞাসা করল, আপনি কোথায় থাকেন?

দ্রুত একটা হাসির আলতো ঢেউ উঠল মেয়েটির ঠোঁটে, বলল, কেন বলুন তো?

এত রাতে যেতে অসুবিধে হবে কিনা জানতে চাইছি।

তাই বলে আমি সারা রাত এখানে থাকতে পারি না।

অনিমেষ মনে মনে বলল, এতক্ষণ তো ছিলেন সামনামানি ঘাড় নাড়ল, তা নিশ্চয়ই নয় । বেশি দূর হলে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতাম।

আপনি যাবেন?

না, আমি খুব ক্লান্ত!

সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি অদ্ভুত চোখে ওর দিকে তাকাল। মেয়েটির রূপে যে ধারালো চমক আছে সেটা এত প্রখর যে কোন স্নিগ্ধতা সেখানে ছায়া ফেলে না। এই তাকানোর ভঙ্গী তাই শুধু কটাক্ষই হয়ে রইল। হাসল মেয়েটি, এত সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়েন আপনি! না, আমি একাই যেতে পারব।

ঠাট্টা করার লোভ সামলাতে পারল না অনিমেষ, অবশ্য আপনি যার কাছে এসেছিলেন তাঁরই উচিত ছিল আপনাকে পৌঁছে দেওয়া।

উচিত? ছেলেরা যখন দেখে বদনামের নোংরা গায়ে লাগবে না তখন তারা আকাশ ছুঁতে পারে, একটু সেরকম অবস্থায় পড়লে গুটিয়ে কেন্নো হয়ে যায় । আমি ঋণ শোধ করতে এসেছিলাম, অনেক হয়েছে। কথাগুলো বলতে বলতে মেয়েটি উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল, ঠিক সে সময় গোবিন্দ ছেলেটিকে নিয়ে ফিরে এল।

অনিমেষ এগিয়ে গিয়ে ছেলেটিকে বলল, শোন ভাই, তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। উনি তো তোমাদের ক্লাসমেট, তুমি তাই ওঁকে একটু বাস-স্টপ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে এস। রাত হয়েছে, ওঁর একা যাওয়া ঠিক নয়।

এরকম প্রস্তাবের জন্য প্রস্তুত ছিল না ছেলেটি, বলল, কিন্তু হোস্টেলের গেট বন্ধ হয়ে গেছে, এখন যাওয়া অসম্ভব।

অনিমেষ হাসল, আমি সুপারের পারমিশন নিয়ে নেব। স্পেশাল কেস হিসেবে যেতে পার। তোমরা একসঙ্গে পড়, তাই বলছি।

ছেলেটি খুব বিব্রত বোধ করছে দেখে অনিমেষের মজা লাগছিল। সে বলল, মেয়েদের সম্মান রাখা আমাদের কর্তব্য। যান, আপনি ওর সঙ্গে চলে যান।

ধন্যবাদ। মেয়েটা বলেই দ্রুত নামতে শুরু করল। একান্ত অনিচ্ছায় ছেলেটি ওর সঙ্গ নিল।

ওরা চলে গেলে গোবিন্দ চাপা গলায় বলল, নির্ঘাত যেতে যেতে ভাব হয়ে যাবে।

অনিমেষ বলল, তুমি একবার সুপারকে ওর কথা বলে এসো, ভাই। আমার শরীরটা ভাল লাগছে না, আমি ঘরে যাচ্ছি।

নিজের ঘরের দরজায় তালা নেই। তার মানে ত্রিদিব ফিরে এসেছে। এতক্ষণে অনিমেষের খেয়াল হল যে ওপরের ভিড়ে ত্রিদিবকে সে দেখেনি। সবাই গিয়েছে আর ও ঘরে বসে রইল। ঘরে ঢুকে আলোটা জ্বালতে যেতেই ত্রিদিবের জড়ানো গলা কানে এল, নো লাইট, প্লিজ।

অনিমেষ হেসে বলল, আজকেও খেয়েছ?

ত্রিদিব প্রথমে কিছু বলল না। অনিমেষ নিজের খাটে গিয়ে বসলে ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞাসা করল, তোমার বিপ্লব হয়ে গেল?

বিপ্লব? অনিমেষ বিস্মিত।

কাজকর্মগুলো নাকি বাড়ি থেকেই শুরু করতে হয়। তুমি তোমার বিপ্লব হোস্টেল থেকেই আরম্ভ করলে। ব্রাভো ব্রাদার। যখন ফিরলাম তখন শুনছিলাম তুমি বক্তৃতা দিচ্ছ। এই প্রথম নেতা হয়ে গেলে, গুড সামনে খোলা ময়দান, এগিয়ে যাও, ফরোয়ার্ড মার্চ। সম্ভাবনার ঢেউ আছে তোমার মধ্যে, তোমার হবে। নাটুকে গলায় বলল ত্রিদিব।

কি যা–তা বকছ অনিমেষ বিরক্ত হল।

যা-তা নয়, বন্ধু। এ ঘটনা কাল অন্য ছেলেরা জানবে। অটোমেটিক্যালি তুমি হিরো হয়ে যাবে। নেক্সট স্টেপ য়ুনিভার্সিটির ইলেকসনে জেতা, তারপর ইউনিয়নের সেক্রেটারী, তারপর এম এল এ মন্ত্রী। স্বর্গের সিঁড়ি–উঠে যাও।

তুমি মাতাল হয়ে গেছ। অনিমেষ সহজ করার চেষ্টা করল । একটা মেয়েকে নিয়ে তুমি যা করলে তার চেয়ে মাতাল হওয়া ঢের ভাল।
 
য়ুনিভার্সিটিতে ঢোকার মুখেই বিমানের সঙ্গে দেখা। ওকে দেখে হাত নেড়ে ডাকল। বিমান বলল, তোমার পাত্তা নেই কেন? এটা খুব অন্যায়।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, আমায় খুঁজছিলেন?

খুঁজছিলাম মানে? তিন দিন তোমার ক্লাসে ছেলে পাঠিয়েছি, তারা এসে বলল তুমি নেই। গত কাল তোমার হোস্টেলে গিয়ে পাওয়া যায়নি। যাক, তুমি একটু অফিসে এসো, দরকার আছে।

এখন ক্লাস ফাঁকি দিলে মনে কোন অস্বস্তি হয় না। বাংলার ক্লাস না করে কোন ছাত্র ইচ্ছে করলে ভাল রেজাল্ট করতে পারে। কতগুলো ধরা-বাঁধা প্রশ্ন এবং তার বস্তাপ। উত্তর মানেই পরীক্ষায় সেকেন্ড ক্লাস পাওয়া–এই সত্য অনিমেষের জানা হয়ে গেছে। সেদিন কোথায় যেন পড়ছিল আগেকার দিনে ম্যাট্রিক পাস করার চেয়ে এখন ডক্টরেট পাওয়া সহজ। লোকসাহিত্য বা জয়দেব সম্পর্কে প্রচারিত বইগুলো থেকে ছেঁকে নিয়ে সাজিয়ে দিলেই সেই সাবজেক্টের থিসিস হয়ে যায়। আর যার অধীনে কাজ হচ্ছে তার ভালবাসা পেলেই নামের আগে ডক্টরেট বসে যাবে। কিন্তু ইদানিং ব্যাপারটার অসারতা এত স্পষ্ট যে চট করে কেউ নিজেকে ডক্টরেট বলে পরিচয় দেয় না, বিশেষত বাংলায়।

অনিমেষ বিমানকে বলল, চলুন।

ছেলেমেয়েরা যে যার ক্লাসে কিংবা আড্ডায় যাচ্ছে। এখন য়ুনিভার্সিটিতে মেয়েদের সংখ্যা বোধ হয় ছেলেদের থেকে বেশি। এতরকমের সাজগোজ একসঙ্গে দেখে মাথা ঠিক রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে মাঝে মাঝে। কিছুদিন হল অনিমেষ টের পাচ্ছে সে যখন ওদের পাশ দিয়ে যাওয়া-আসা করে তখন তাকে নিয়ে ফিসফাস আলোচনা হয়। সম্ভবত সেই মিটিং-এর আবিষ্কারের কথা এখন জনে জনে ছড়িয়ে যাচ্ছে।

হাঁটতে হাঁটতে বিমান বলল, কাল তোমাদের হোস্টেলে খুব কান্ড হয়েছে শুনলাম।

অনিমেষ অবাক হয়ে বিমানের দিকে তাকাল, আপনি কি করে জানলেন, বিমানদা?

সব খবরই আমাদের কাছে আসে। তুমি লিড করেছিলে?

লিড মানে আমিই কথা বলেছিলাম এ এস-এর সঙ্গে। ভদ্রলোকের ভাবভঙ্গী খুব একটা ভাল ছিল না। সুপার না এসে গেলে কি হতো বলা যায় না। ওঁর কথায় ভদ্রলোক ক্ষমা চাইলেন। অনিমেষ বলতে বলতে ভাবছিল যদি সুপার না আসতেন তা হলে একটা হাতাহাতি হয়ে যাওয়া বিচিত্র ছিল না।

বিমান বলল, যা হোক, নেতৃত্বটা তোমার হাতে ছিল জেনে আমি খুশি।


একটু ইতস্তত করে অনিমেষ বলল, কিন্তু ব্যাপারটা খুবই বাজে। ওরকম একটা ইস্যু নিয়ে হইচই করতে আমার প্রথমে ইচ্ছে ছিল না, শেষে জড়িয়ে পড়লাম। ঘটনাটা এত সামান্য।

হাত তুলে অনিমষকে থামিয়ে বিমান ঘুরে দাঁড়াল, সব সময়ে একটা কথা মনে রাখবে, লাইম লাইটে আসতে গেলে সুযোগের সদ্ববহার করতে হবে। যেটাকে সামান্য মনে হচ্ছে তাকে যদি একটু মোচড় দিয়ে ঘুরিয়ে দিতে পার সেটাই অসামান্য হয়ে যেতে পারে। ধরো, কালকে যদি তোমরা ওই ইস্যুটার সঙ্গে আরো কতগুলো পয়েন্ট যোগ করতে তা হলে আজ তুমি সারা কলকাতায় পরিচিত হয়ে যেতে।

কি রকম? অনিমেষ কৌতুকবোধ করল।

অত্যন্ত জঘন্য খাবার, হোস্টেল কর্তৃপক্ষের তোমাদের টাকায় ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স বাড়ানো এবং হোস্টেলের কোয়ার্টার অসৎ কাজে ব্যবহার–স্রেফ এই তিনটে ইস্যু যোগ করে দিলে কলকাতার সব হোস্টেলের বোর্ডারদের সঙ্গে পেতে। কারণ, প্রথম অভিযোগটা এত কমন যে সবাই একমত হবেই। আজ যদি সারা দেশের হোস্টেলগুলোয় ওরকম ঘেরাও প্রতিবাদ শুরু হয়ে যেত তা হলে সবার সঙ্গে সংযোগরক্ষার জন্যে একটি হলে তার নেতৃত্ব তোমারই থাকত। এত হোস্টেল এবং তার বোর্ডারের সংখ্যা বিরাট হওয়ায় খবরের কাগজে ব্যাপারটা গুরুত্ব পেত এবং তুমি নেতা হিসেবে নিজের জায়গা করে নিতে পারতে। না, না, অনিমেষ, তুমি ভুল করেছ এ সুযোগ না নিয়ে। কাল যদি একবার আমার সঙ্গে আলোচনা করতে তা হলে–। আফসোসের ভঙ্গীতে হাত ছুঁড়ল বিমান।

চোখের সামনে অবলীলায় বিমান যে ছবিগুলো একে গেল তা অনিমেষ স্পষ্ট দেখতে পেল। এবং দেখে কিছুক্ষণ বিস্ময়ে ওর মুখে কথা ফুটল না। এই জটিলভাবে সহজ করে তোলার নামই বোধ হয় রাজনীতি। সে নীচু গলায় জবাব দিল, বিমানদা, ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটে গেল যে ভাববার সময় পাইনি।

বুঝেছি, এবং সেখানেই আমার আপত্তি। তোমাকে একটা সরল সত্য বুঝিয়ে দিই। ধরো রামকৃষ্ণ মিশনে যিনি দীক্ষা নিয়েছেন তিনি কতগুলো উপদেশ জানেন এবং সেভাবেই জীবনযাপন করেন। তার জীবনে যদি কোন সমস্যা আসে তা হলে সমাধান তিনি সেই উপদেশমতই সমাধান করবেন। এই ভদ্রলোক থাকেন কলকাতায়। এবার আর একজনের কথা ভাবো যিনি থাকেন কানপুরে। দেখা যাবে তিনি যদি দীক্ষিত এবং একনিষ্ঠ হন তা হলে তার কার্যকলাপ কলকাতার ভদ্রলোকের প্রায় কার্বনকপি হবে। কেন হবে বল তো? বিমান প্রশ্নটা করে উত্তরের জন্য য়ুনিয়ন অফিসের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল।

এক হবে কারণ ওঁদের আদর্শ এক। অনিমেষ সহজ গলায় বলল।

আমি হলে অবশ্য বলতাম এক তো নাও হতে পারে। ধর্মীয় বিশ্বাস ও বোধ দাঁড়িয়ে থাকে অন্ধ আত্মসমর্পণের ওপর, তাই তার ভিত নড়ে যাওয়া বিচিত্র নয়–সব সময় এক হবেই কেউ গ্যারান্টি দিতে পারে না। মানুষের অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়ে ধর্ম তার শেকড় গাড়ে। কিন্তু যে মানুষ মার্কসবাদে বিশ্বাস করে সে সেটা পরীক্ষায় সত্য জেনেই করে। বাতাস-জলের মত মার্কসবাদ মানুষের প্রয়োজন। এখন তার নানারকম ব্যাখ্যা এবং প্রয়োগ হচ্ছে কিন্তু মূল সত্য তো অবিকৃত। তুমি যদি তোমার বোধ ও বুদ্ধি মার্কসবাদে শুদ্ধ করতে তা হলে গত কাল কারো জন্যে অপেক্ষা করতে হতো না। তোমার কর্মপদ্ধতি এবং তার ফলাফল দেখেই তুমি বুঝতে পারতে আমার সঙ্গে কোন পার্থক্য নেই। বিমান হাসল, হতাশ হয়ো না কমরেড, প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তুমি যা করেছ তা অনেক, কিন্তু এ থেকে ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষিত হলে বেশি লাভবান হবে।
 
এই সাতসকালেই যুনিয়ন অফিস জমজমাট। ইলেকশন আসছে। কাজকর্ম প্রচুর। অনিমেষ দেখল সুদীপদাকে ঘিরে বেশ বড় একটা দল কাগজপত্র নিয়ে বসে আছে। সুদীপদার মুখে আধাপোড়া এবং বোধ হয় নেবা চুরুট। কয়েক সেকেন্ডেই অনিমেষ বুঝতে পারল বিভিন্ন ক্লাসের ক্যান্ডিডেট সিলেকশন চলছে যারা ছাত্র ফেডারেশনের ব্যানারে দাঁড়াবে।

সুদীপ ওকে দেখে চীৎকার করে বলল, এই যে এসে গেছ! তা তোমার মতলবটা কি বল তো?

সবাই ওর দিকে ঘুরে দেখছে, অনিমেষ বিব্রত বোধ করল। প্রশ্নটার মানে সে ধরতে পারছে না।

সুদীপ বলল, একদম বোবা হয়ে গেলে যে! এদিকে শুনছি বেশ নেতা হয়ে গেছ, চারধারে নাম হয়েছে, আর আমাদের এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে!

অনিমেষের মুখে রক্ত জমল, কি যা-তা বলছেন!

সুদীপদা বলল, গত কাল তোমাদের এ এস-কে খুব টাইট দিয়েছ খবর পেলাম। ভালো করেছ। ব্যাটা এককালে কম্যুনিস্টদের গালাগাল দিত।

কথাটা প্রথম শুনল অনিমেষ। এ, এস সম্পর্কে এরা যে খবর রাখে ওরা হোস্টেলে থেকেও তা জানে না। ওর হঠাৎ মনে হল যারা রাজনীতি করে তাদের অনেক গোপন কান এবং চোখ আছে, তাই কোন কিছুই তাদের অজানা থাকে না। মুশকিল হল সে নিজে দুটোর বেশি প্রকৃতির কাছ থেকে পায়নি। অনিমেষ দেখল ঘরে ঢুকেই বিমান নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সবত্র কর্মব্যস্ততা, তাই এভাবে একা একা দাঁড়িয়ে থাকতে খারাপ লাগছিল। অথচ নিজে আগ বাড়িয়ে কিছু করতে সঙ্কোচ হচ্ছিল। বাঁ দিকের দেওয়াল ঘেঁষে দুজন পোস্টার লিখছে। অনিমেষ শুনল, যে সচরাচর লিখে থাকে সে আসেনি বলে ওরা হিমসিম খাচ্ছে। সুদীপ আবার লিস্ট নিয়ে ছেলেদের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত এখন অনিমেষ ছেলে দুটোর কাছে গিয়ে বলল, আমি একটু সাহায্য করতে পারি?

একটা ছেলে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে হেসে উঠে দাঁড়াল, আপনার অভ্যেস আছে?

অনিমেষ বলল, না, অভ্যেস নেই। তবে বাংলা অক্ষর তো, চেষ্টা করে দেখতে পারি?

ছেলেটা বলল, খুব সোজা নয়। বড় হরফ হতে হবে, সেই সঙ্গে গোটা গোটা এবং তাতে এমন স্পীড থাকবে যে সংগ্রামী মনে হবে। নিন দেখুন, পারেন কিনা!

ছেলেটা একটা কাগজ ওর হাতে ধরিয়ে দিল, তাতে তিনটে লাইন লেখা । আমাদের সংগ্রাম চলছে চলবে, বাম ছাত্র ঐক্য জিন্দাবাদে, নির্বাচন অধিকার আদায়ের একমাত্র হাতিয়ার।

অনিমেষ দেখল প্রথমটা লেখা হয়েছে, সে তার পরের লাইনটা শুরু করল। লিখতে লিখতে ওর খেয়াল হল সেই ছেলেবেলায় কংগ্রেসের নৌকোতে রিলিফের কাজে যাওয়ার পর এই প্রথম সে কোন রাজনৈতিক মতবাদে বিশ্বাসীদের সহযোগী হয়েছে। ছোটবড় হয়ে যাচ্ছে, অনিমেষ খুব সাবধানে আঁকার চেষ্টা করছিল। একে লেখা না বলে আঁকা বলাই ভাল । ছেলেটা ঠিকই বলেছে লেখাগুলোর মধ্যে একটা সংগ্রামী চরিত্র ফুটে ওঠা দরকার এবং সেটা আঁকার কায়দার ওপরই নির্ভর করে। কিন্তু লিখতে লিখতে বুকের মধ্যে একটা তপ্ত ভাব অনুভব করছিল অনিমেষ। এই শব্দগুলোর মধ্যে এমন একটা ফোর্স আসে যা বন্দেমাতরমের মধ্যে নেই।

লেখা যখন শেষ তখন সুদীপের গলা শুনতে পেল অনিমেষ, সাবাস, হাতেখড়ি মন্দ হয়নি! ব্যাপারটা ওকে এতখানি আকৃষ্ট করে রেখেছিল যে অন্য দিকে খেয়াল ছিল না। এখন দেখল ওর পেছনে ছোটখাটো ভিড় জমে গেছে, সবাই পোস্টারগুলো দেখছে। সচেতন হয়ে সে নিজের লেখা দেখল। না, খারাপ হয়নি, বরং এগুলো সে নিজে লিখেছে তা বিশ্বাস করা শক্ত হয়ে পড়ছে। কোন দিন সে একাজ করেনি, কিন্তু এত ভাল কি করে হল! সে সুদীপকে বলল, প্রথম চেষ্টা তো–।

একটা চুরুট এগিয়ে দিল সুদীপ, নাও, এটা ধরাও।

বিমান চেয়ারে বসে কাজ করতে করতে বলে উঠল, কি ব্যাপার, অন্য কেউ চাইলে তো চুরুট ছাড়া হয় না, আজ হঠাৎ এত উদারতা, লক্ষণ ভাল নয়।

সুদীপ ঠাট্টার গলায় জবাব দিল, এই চুরুট সবার সহ্য হবে না।

বিমান বলল, তা হলে বলছ অনিমেষের সহ্য হবে।

সুদীপ বলল, মনে হচ্ছে।

অনিমেষ হেসে ফেলল, আমি খাই না, সুদীপদা।

বিমান কপট ভঙ্গীতে বলে উঠল, না বলতে নেই, অনিমেষ। ওটা খেলে দেখবে বেশ বুদ্ধিজীবী বলে মনে হবে নিজেকে। তা ছাড়া তুমি ভাগ্যবান, তাই ওটা পাচ্ছ। নিয়ে নাও চটপট।
 
অগত্যা অনিমেষ চুরুটটা নিল। ছোট্ট কিন্তু বেশ শক্ত চেহারার চুরুট। এর আগে সে কাউকে কাউকে দেখেছে চট খাবার আগে দেশলাই কাঠি দিয়ে মুখ ফুটো করে নিতে কিন্তু এটায় সেরকম প্রয়োজন আছে বলে মনে হল না। সুদীপ আগুন জ্বেলে সামনে ধরতে সে ওটা ধরাল। বিকট গন্ধ সহ ধোয়াটা নাকে যেতে অনিমেষের মনে হল দমবন্ধ হয়ে যাবে। ততক্ষণে সুদীপ নিজের জায়গায় ফিরে গিয়ে গম্ভীর গলায় ডাকল, অনিমেষ, এদিকে এসো।

সমস্ত শরীর গোলাচ্ছে, কোনরকমে কাশি চেপে অনিমেষ দেখল তার মাথা ঝিমঝিম করছে। সে কোনরকমে সুদীপের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

সুদীপ কতগুলো কাগজ থেকে একটা বেছে নিয়ে ওকে বলল, পুরো নাম সই কর। অনিমেষে যতটা সম্ভব দ্রুত কাগজটার ওপর চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারল এটা একটা নমিনেশন ফর্ম। ফিফথ ইয়ার বাংলার ক্যান্ডিডেট হয়ে তাকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে ছাত্র ফেডারেশনের পক্ষে। একটুও ইতস্তত না করে অনিমেষ সই করল সুদীপের কলমে। সুন্দর গোটা অক্ষরে লেখা অনিমেষ মিত্র, শব্দ দুটো ঝকঝক করছিল কাগজে।

সুদীপ বলল, তোমার ক্লাসের দুজন ছেলে চাই যারা প্রপোজ এবং সেকেণ্ড করবে। তোমার কেউ পছন্দের আছে?

অনিমেষ চট করে শুধু পরমহংস ছাড়া কাউকে মনে করতে পারল না।

ওপাশ থেকে একজন বলে উঠল, আমি করতে পারি।

সুদীপ বলল, হ্যাঁ, তুমি তো আছ। আর একজনকে ডেকে সই করিয়ে নিও।

অনিমেষ ছেলেটিকে দেখল, বাংলার ক্লাসে ওকে কখনো দেখেছে বলে মনে পড়ছে না, হয়তো লক্ষ্য করেনি।

এবার বিমান ওকে ডাকল। অনিমেষ ওর সামনে গিয়ে বসতেই বিমান বলল, অন্য ক্যাণ্ডিডেটদের সঙ্গে মিটিং হয়ে গেছে, তুমি বাকী ছিলে। এই ইলেকশনে আমাদের প্রতিপক্ষ দুজন। ছাত্র পরিষদ আর এস. এফ. রাইট। শেষ দলটা নিয়ে কোন চিন্তা নেই, কারণ ওদের শক্তি এত কম যে কিছু করে উঠতে পারবে না। ছাত্র পরিষদ প্রচুর টাকা ঢালছে। ওদের পোষ্টারগুলো দেখেই তা বুঝতে পারবে। এটা তো সবাই জানে ছাত্র পরিষদ হল কংগ্রেসের সংগঠন। এখন দেশের যা অবস্থা তাতে কংগ্রেসী সরকার খুব সুখে নেই। মানুষ ক্রমশ ওদের ওপর বিরক্ত হয়ে উঠছে। ছাত্র পরিষদের বিরুদ্ধে যখন আমরা প্রচার করব তখন ওই সেন্টিমেন্টটাকে কাজে লাগাব। ওরা হয়তো আমাদের চীনের দালাল বলে এক হাত নেবে কিন্তু মানুষ দুরের জিনিসের চেয়ে কাছের সমস্যাই বেশি প্রয়োজনীয় মনে করে। বুঝতে পারছ?

অনিমেষ হঠাৎ বলল, চীনের দালাল মানে ছাত্র ফেডারেশন চীনকে সমর্থন করে?

বিমান হঠাৎ গম্ভীর মুখে বলল, সেটা আলাদা প্রশ্ন। ভারত-চীন সীমান্ত-যুদ্ধ সম্পর্কে পার্টি সে বক্তব্য রেখেছে সেটা পড়ে দেখবে। কংগ্রেসীরা সেই বক্তব্যটার অপব্যাখ্যা করছে। কেউ যদি তোমাকে প্রশ্ন করে তুমি চীনের দালাল কি না তা হলে জবাব দেবে কারো ভালকে সমর্থন করা মানে দালালি নায়। মাও সে তুং যেভাবে পৃথক-শ্রমিককে সংগঠিত করে লংমার্চ করেছিলেন সেটা বিশ্বে মানবতার জ্বলন্ত মশাল বলে চিহ্নিত থাকবে। আমরা যদি এই মশালের আগুনে নিজেদের শুদ্ধ করি তা হরে কি দালালি হবে? এই হবে আমাদের বক্তব্য।

অনিমেষ বলল, তা হলে ওটাকে সীমান্ত-সংঘর্ষ বলব?

হ্যাঁ, কারণ ঘটনাটা কি তা আমরা জানি না। যে দেশ কম্যুনিজমের আদর্শে বুর্জোয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করে আজ মাথা তুলেছে, যে দেশের মহান নেতা মাও সে তুং, সে দশ আক্রমণকারী এটা স্বপ্নেও চিন্তা করো যায় না। আচ্ছা, এবার তোমার কাজ হবে ক্লাসের সব ছেলেমেয়েদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া। একআধটা কাজ যা চোখে পড়ার মত যদি করতে পার তা হলে সবার নজরে পড়বে। অবশ্য ওই মিটিং-এর পর তার আর প্রয়োজন নেই। কিন্তু ম্যান টু ম্যান ক্যাম্পেনের মূল্য আছে, সেটা শুরু করে দেবে। কখনো কোন অবস্থায় মাথা গরম করবেন সব সময় হাসিমুখ করে থাকবে। আর যদি কোন প্রবলেম সামলাতে না পারে তা হলে অফিসে যোগাযোগ করবে। অল রাইট? বিমান বুঝিয়ে দিল। সেদিন থেকেই ক্যাম্পেন শুরু হয়ে গেল। সুদীপ বক্তৃতা দিল। খুব ভাল বলে সুদীপ, বলার ধরনে এমন একটা তেজস্বিতা আছে যে চুপ করে শুনতে হয়।
 
ঘুরতে ঘুরতে অনিমেষের ক্লাসের সামনে আসতে ওরা দেখল টি, এন. জি. ক্লাস নিতে আসছেন। সুদীপ দ্রুত ভদ্রলোকের সামনে এগিয়ে বলল, স্যার, আপনাকে পাঁচ মিনিট সময় দিতে হবে।

টি. এন. জি. চশমাটা এক হাতে ঠিক করে নিয়ে হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, কি ব্যাপার?

ছেলেমেয়েদের দু-তিনটে কথা বলব। ইলেকশনের ব্যাপারে।

পাঁচ মিনিটেই যেন হয়ে যায়। টি. এন. জি. আবার পফের্সস রুমে ফিরে গেলেন।

সুদীপ অনিমেষকে নিয়ে ক্লাসে ঢুকল। ওদের দলের ছেলেরা দরজায় দাঁড়িয়ে। টি. এন. জি–র ক্লাস বলেই ঘরটা ভরতি। ছেলেমেয়েরা সবই উৎসুক হয়ে ওদের দেখছে। সুদীপ ডায়াসে উঠে বলল, বন্ধুগণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নির্বাচন আসন্ন। আপনাদের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করার জন্য আমরা ছাত্র ফেডারেশন (লেফট) আপনাদের সহযোগিতা চাইছি। এই নির্বাচনে আমাদের তরফ থেকে এই ক্লাসের প্রার্থী শ্ৰীঅনিমেষ মিত্র। আপনারা হয়তো অনেকেই জানেন যে অনিমেষ এই কংগ্রেসী সরকারের উগ্র দমননীতির শিকার হয়েছেন। এই সরকারের পোষ পুলিশ সম্পূর্ণ বিনা কারণে তার ওপর আক্রমণ চালায় এবং তাকে এমনভাবে গুলীবিদ্ধ করে যে চিরকালের মত তিনি শরীরে বুলেটের চিহ্ন নিয়ে বেঁচে থাকবেন। অনিমেষকে ভোট দেওয়া মানে সেই নৃশংসতার প্রতিবাদ জানানো । আমাদের হাতে বেশি সময় নেই, তবু আমি অনিমেষকে অনুরোধ করছি আপনাদের কিছু বলতে । অনিমেষ–।

মাথা নেড়ে অনিমেষকে ডায়াসে আসতে বলে সুদীপ গম্ভীর মুখে দরজার কাছে সঙ্গীদের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। সুদীপের বক্তৃতার সময় অনিমেষ ছেলেমেয়েদের প্রতিক্রিয়া দেখছিল। সবাই বেশ উৎসুক হয়ে তাকে লক্ষ্য করেছে। অনিমেষ অস্বস্তি থাকলেও বেশ স্মার্ট হবার চেষ্টা করছিল। হঠাৎ সুদীপ এভাবে তাকে ডাকবে চিন্তা করেনি, কারণ অন্যান্য ক্লাসে ক্যান্ডিডেটদের কিছু বলতে বলা হয়নি। সময় কম এবং সবাই ওকে উৎসুক হয়ে দেখছে বুঝতে পেরে অনিমেষের পেটের ভেতর চিনচিন ব্যথাটা শুরু হয়ে গেল। ও বুঝতে পারছিল এখন একটা ভুল পদক্ষেপ মানে চিরকালের মত হাস্যকর হওয়া । পায়ের স্টেপ ঠিক রেখেও এমন ভান করে ডায়াসে উঠে এল যে এটা খুবই সাধারণ ব্যাপার। যে-কোন মুহূর্তে শরীরে ঘাম হতে পারে বা কথা জড়িয়ে যেতে পারে জেনেও ও কথা শুরু করল, বন্ধুগণ, আমি অনিমেষ মিত্র, আপনাদের সতীর্থ, আগামী নির্বাচনে আপনাদেরই সমর্থন চাইছি। কবে, কখন কি কারণে পুলিশ আমাকে গুলীবিদ্ধ করেছিল কিংবা আমার একটি অমূল্য বছর কিভাবে হাসপাতালে শুয়ে নষ্ট হয়েছে সেসব বলে আপনাদের মন নরম করতে আমি চাই না। আমি এখন সুস্থ, যদিও বুলেটের দাগ উল্কি হয়ে আছে, থাকবে। আমি মফস্বলের ছেলে, জলপাইগুড়িতে কংগ্রেসের সমর্থক ছিলাম। সেখানে দেখেছি ক্ষমতার কি কদর্য প্রয়োগ, দেখেছি স্বার্থের কি নোংরা ব্যবহার! একটা বাড়ি তৈরি করতে গেলে যেমন নির্দিষ্ট প্ল্যান লাগে, একটা দেশকে গঠন করতেও তেমনি পরিকল্পনা প্রয়োজন। সেই পরিকল্পনা হল একটা নির্দিষ্ট মতবাদ যা দরিদ্রের মুখে অন্ন দেবে এবং একটা শ্রেণীহীন সমাজব্যবস্থার কথা ভাববে। ছাত্র ফেডারেশন লেফট মনে করে সেটা কমুনিজমের পথে সম্ভব। এর ফল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেখেছি। কেউ কেউ বলতে পারেন, আমরা ছাত্র, রাজনীতির এই জটিলতায় আমরা কেন যাব? বাড়িতে যদি আগুন লাগে তা হলে ছোটরাও বালতি হাতে ছুটে যায়, তাই না? আমরা প্রতিবাদ করতে পারি অরাজকতার বিরুদ্ধে। এইসব ছোট প্রতিবাদ এক হয়ে যে শক্তি ধরবে তা কিন্তু আমাদেরই উপকারে আসবে। বন্ধুগণ, আমি আপনাদের কাছে সমর্থন চাইছি যাতে প্রতিবাদ করতে পারি। ধন্যবাদ।

কথা বলতে বলতে খেয়াল ছিল না, এখন অনিমেষ আবিষ্কার করল তার সেই নার্ভাসনেসটা একদম নেই। খুব সহজে সে বলে গেছে। কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ, তারপরই তুমুল হাততালিতে ঘর ভরে গেল যেন । মেয়েরাই বেশি শব্দ করছে।

অনিমেষ শান্ত মুখে দরজার কাছে আসতেই সুদীপ বলল, আর একটা চুরুট খাবে? দ্রুত ঘাড় নাড়ল অনিমেষ না, না, বাপস!

ওটা এই বক্ততা দেওয়ার চেয়ে অনেক বেশি কষ্টকর। তা ছাড়া আমি তো মফস্বলের ছেলে, বুদ্ধিজীবী হতে পারব না। হাত জোড় করল অনিমেষ।

সুদীপের মুখে কিছুক্ষণ কথা ফুটল না। তারপর সঙ্গীদের বলল, শ্রীমান অনিমেষ মিত্রের দীক্ষা হয়ে গেছে। এখন উনি সাবালক।
 
বিকেলে হোস্টেলের ফেরার সময় অনিমেষ পরমহংসের সঙ্গে ফিরছিল। পরমহংস বলছিল, তুমি কালকে শোভনাদির ছেলেকে পড়াতে রাজী না হয়ে ভাল করেছ, এতক্ষণে মনে হল।

অনিমেষ অবাক হল, কেন?

এসব টিউশনি-ফিউশনিতে কি তোমাকে মানায়? তুমি হলে বর্ণচোরা আম। ওপরে লাজুক, ভেতরে আগুন। শালা কি বক্তৃতা দিলে আজ! একবার ভাবলাম মুখস্ত করেছ নাকি, তারপর দেখলাম, নাঃ। সব কটা মেয়ে বোল্ড আউট। মিডঃল স্টাম্প ছিটকে গেছে। তা এই তুমি ঘাড় গুঁজে ছাত্র পড়াচ্ছ–ভাবাই যায় না।

হো হো করে হাসল অনিমেষ, যে লোকটা বক্সিং লড়ে সে বউকে আদর করে না? কি আশ্চর্য! এসব বলে এড়িয়ে গেলে হবে না, তুমি আমার জন্যে টিউশনি দেখ।

শালা হাতের মোয়া, চাইলেই পাওয়া যায়, না? তারপর ফ্যাচাং করে রেখেছ। ঘটি হলে হবে না, চেনাশুনা বেরুলে চলবে না–দেখি, যদি পাই। তা তোমার চিন্তা কি! য়ুনিয়ন থেকে গ্যাম্বালিং হবে না?

গ্যাম্বলিং? অনিমেষ হতভম্ব।

ফালতু টাকা পাওয়া মানে গ্যাম্বালিং।

সেটা কংগ্রেসী য়ুনিয়নে হতো।

গুড। এখন থেকে ভাল স্পিন বোলিং রপ্ত করেছো। তোমার হবে। দেখ অনিমেষ, সব শালাই গাছে ওঠে কিছু হাতিয়ে নিতে । যারা আদর্শ-ফাঁদর্শ কপচায় তারাই রান আউট হয়ে যায়।

এই কথাগুলো হোস্টেলে ফিরে অনিমেষের মনে হচ্ছিল। এই দেশে মানুষ নিজের স্বার্থ ছাড়া অন্য কিছু চিন্তা করতে পারে না। সাধারণ মানুষের মানসিকতা এইভাবেই তৈরি করে দেওয়া হয়েছে।

ত্রিদিব নেই। ঘরে একা শুয়ে শুয়ে অনিমেষ আকাশ দেখছিল। অনেক দিন জলপাইগুড়ির চিঠি পাচ্ছে না। দাদু প্রতি সপ্তাহে চিঠি দিতেন, আজকাল তাও যেন অনিয়মিত হয়ে যাচ্ছে। ছোটমা তো দেয়ই না, টাকা পাঠানোর পর বাবা খবরাখবর জানতে চান। আসলে সে নিজে নিয়মিত লিখতে পারে না বলেই ওদের এই ঠান্ডা ভাব সেটা সে জানে। কিন্তু চিঠি লিখতে গেলে এত আলসেমি লাগে!

বাবা যদি আজকের খবরটা জানতেন তা হলে নিশ্চয়ই ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে অধ্যাপনা করুক এই তার ইচ্ছা । য়ুনিয়ন করছে জানলে টাকা বন্ধ করেও দিতে পারেন। বরং দাদু অতটা বিপক্ষে যাবেন না। অনিমেষ যখন কিছু করছে সেটা মন্দ নয় জেনেই করছে এই তাঁর বিশ্বাস।

দরজায় শব্দ হতে অনিমেষ বলল, খোলা আছে।

দারোয়ান মুখ বাড়াল, আপনাকে বড়া সাব বোলাচ্ছে।

বড়া সাব মানে সুপারিনটেনডেন্ট। সচরাচর টাকা বাকী না পড়লে তিনি খোঁজ নেন না। অনিমেষ দরজা বন্ধ করে বাস্কেটবল লন পেরিয়ে এদিকে চলে এল। সুপার ওঁর টেবিলে বসে ছিলেন। অনিমেষ যেতেই তিনি সামনে চেয়ারটা দেখিয়ে দিলেন।

অনিমেষ বলল, ডেকেছিলেন?

হা। আজ কলেজ কর্তৃপক্ষ একটা মিটিং ডেকেছিলেন। অনেক আলোচনার পর স্থির হয়েছে যে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট আর আণ্ডার-গ্রাজুয়েটদের একসঙ্গে হোস্টেলে রাখা চলবে না। কলেজ স্টুডেন্টদের জন্যে একদম আলাদা হোস্টেল হবে এগুলো। ব্যাপারটা সামনের মাসের এক তারিখ থেকেই কার্যকরী হবে।

অনিমেষ বলল, আপনি কি আমায় হোস্টেল ছেড়ে দিতে বলছেন?

সুপার বললেন, ব্যাপারটা সেইরকম।

কলকাতার কলেজে ভর্তি হবার পর থেকেই এই হোস্টেলে বছরগুলো কেটেছে। এখন কোথায় যাবে সে? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কারণটা কি শুধু এটাই, না গত রাত্রের ঘটনাটা এর পেছনে রয়েছে?

আমি ঠিক বলতে পারছি না।

আপনি বলবেন না।

অপ্রিয় কথা বলতে আমি চাই না।

আপনাদের এই অন্যায় আদেশের বিরুদ্ধে আমরা লড়তে পারি । এবং সেটা করতে আপনি বাধ্য করছেন।



অনিমেষ উঠে দাঁড়াতে সুপার বলে উঠলেন, আমার কথা শোন অনিমেষ, এ নিয়ে প্লিজ হইচই করো না। যদি স্ট্রাইক করো তা হলে কিছু ছেলের ক্ষতি হবে যারা এখনো স্কটিশ কলেজে পড়ে । তোমার তো থাকা নিয়ে কথা। আমি সেন্ট জন হোস্টেলের সুপারিনটেনডেন্টের সঙ্গে কথা বলেছি। ওখানে অনেক এম এ-র স্টুডেন্ট আছে। উনি তোমাকে একটা সিট দিতে রাজী হয়েছেন। আফটার অল, তোমার বাবা আমাকে পার্সোনালি রিকোয়েস্ট করেছেন তোমাকে দেখতে, তুমি আমার কথা রাখো।

অনিমেষ মাথা নাড়ল। তারপর ধীরে পায়ে বেরিয়ে এল বাইরে। সামনের লনে দুটো ছেলে বল নিয়ে পিটোপিটি করছে। খুব শান্ত পরিবেশ এখন। ওপরে বোধ হয় থম্বোটো মাউথ অর্গান বাজাচ্ছে। গত রাত্রের ঘটনার জন্যে এত তাড়াতাড়ি আঘাত আসবে কল্পনা করতে পারেনি সে। সামান্য এই ব্যাপারে যদি তাকে হোস্টেল ছেড়ে চলে যেতে হয়, বড় ব্যাপারে না জানি কি হবে। একবার বিমানদার সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। অনিমেষ দেখল, ত্রিদিব ঢুকছে। ও কাছে গিয়ে বলল, একটা ঘটনা ঘটেছে।

কি?

আমাকে সুপার হোস্টেল ছেড়ে দিতে বললেন।

জানতাম।

জানতে মানে?

অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি, জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি। দুহাত নেড়ে আবৃত্তি করল ত্রিদিব । তারপর গম্ভীর হয়ে বলল, ওরা তোমার ক্ষতি করতে গিয়ে ভাল করে ফেলল। কথাটার মানে পরে বুঝবে।
 
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নির্বাচনের ফলাফল প্রায় এক তরফা হয়ে গেল । ছাত্র পরিষদ যে কটা সিট পেয়েছে তা এত সামান্য যে ওদের ক্যাম্পে এখন লোকজন নেই বললেই চলে। হঠাৎই যেন উত্তেজনা হ্রাস পেয়ে গেছে, যেসব ছেলেরা ছাত্র পরিষদের হয়ে কাজকর্ম করেছিল তার এখন এমন নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে চলাফেলা করছে যেন ও ব্যাপারের সঙ্গে ওদের কোন সম্পর্ক নেই। দল হেরে গেলেই যে এমন করে পিছিয়ে যেতে হয় সেটা অনিমেষ জানত না, এখন জানল। বামপন্থী ছাত্র ফেডারেশন এখন তুঙ্গ। ডানেরা তো আমলই পায়নি। অনিমেষ ওর ক্লাসের শতকরা আশিটি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছে। বিমান বলেছিল, এটা তো জানা কথাই। বিধান রায়ের সিটের মত তোমার জেতা নিশ্চিত ছিল। বিধান রায় নাকি কখনই হারেননি। চৌরঙ্গী এলাকায় তাঁর একবার হারো-হারো অবস্থা হয়েছিল কিন্তু শেষতক জিতে গেছেন। মানুষের ব্যক্তিগত ভাললাগা পার্টির ওপরে গিয়ে তাকে জিতিয়ে দিত। অনিমেষ বোঝে ক্লাসের ছেলেরা যখন ওর সঙ্গে কথা বলে তখন বেশ সম্ভ্রামের সঙ্গেই বলে। হয়তো ওর মিষ্টি লাজুক চেহারা এবং সেই বুলেটের চিহ্ন ছেলেমেয়েদের মানসিকতায় ওর সম্পর্কে দুর্বলতা এনে দিয়েছে। আশ্চর্য! আজ যেটা চরম আঘাত মনে হচ্ছে কাল সেটা তুরুপের তাস হয়ে যেতে পারে– শিক্ষাটা জানা ছিল না, এখন জানল।

য়ুনিয়নের কাজকর্মে অনিমেষ এখন সক্রিয় কিন্তু কতগুলো ব্যাপারে ওর মনে কিছু অস্পষ্টতা থাকে। নির্বাচিত সদস্যদের সঙ্গে আলোচনার কোন প্রয়োজন হয় না। অনিমেষ লক্ষ্য করেছিল এ ব্যাপারে কারো কোন ক্ষোভ নেই। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কতগুলো নির্দিষ্ট নীতি ঠিক করে রেখেছেন, এই ইস্যুগুলো সামন এলে সেই নীতির আলোয় পথ ঠিক করে নেওয়া হয়। এক রকম বিশ্বাসে সকলে তা মেনে চলে।

অফিস-বিয়ারার নির্বাচনের সময় যে কটা নাম কানাঘুষায় শোনা যাচ্ছিল অনিমেষ তার মধ্যে ছিল। তার মধ্যে যে সম্ভাবনা আছে তা দল স্বীকার করেছে। ফিফথ ইয়ারের ছাত্র হওয়ায় সে আরো দুবছর বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকবে, তাই এখন থেকে যদি সে দায়িত্ব সম্পর্কে অভিজ্ঞতা পায় তাহলে সামনের বছরে যখন সিনিয়াররা থাকবে না তখন তাদের জায়গা নিতে পারবে। সুদীপের প্রস্তাব ছিল, সহসম্পাদকের দুটো আসনের একটায় অনিমেষকে নেওয়া হোক। কিন্তু সে ব্যাপারে কতগুলো অসুবিধার মধ্যে যেটা অন্যতম সেটা হল কলেজ জীবনে অনিমেষ ছাত্র ফেডারেশনকে কোন সাহায্য করেনি। সে সময় বিভিন্ন কলেজে ছাত্র ফেডারেশনের হয়ে যারা সত্যি খেটেছে এবং এই নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছে তাদের দাবী অবশ্যই অগ্রাধিকার পাবে।

এই ব্যাপারটা নিয়ে যখন চিন্তা ভাবনা হচ্ছে ঠিক সেসময় অনিমেষ একটা গোলমাল করে বসল । ভিয়েৎনামে আমেরিকার নৃশংস অত্যাচারের প্রতিবাদে ছাত্র সংসদ থেকে একটা কার্যক্রম নেওয়ার কথা উঠলে বিমান বলেছিল, সারা বাংলা ছাত্র ধর্মঘটের যে কার্যসূচি নেওয়া হয়েছে তার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে একদিন য়ুনিভার্সিটি স্টুডেন্টদের ক্লাস বয়কট করতে বলা হবে, ধরো আগামী মঙ্গলবার।

ব্যাপারটা যখন ঠিক হয়ে যাচ্ছে তখন অনিমেষ বলে ফেলেছিল, আচ্ছা, এই ব্যাপারটা নিয়ে একটু আলোচনা করলে হয় না?

সুদীপ চমকে ওর দিকে তাকিয়েছিল আর বিমান খুব ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করেছিল, কেন, তোমার কি পার্টির নির্দেশ মানতে আপত্তি আছে?

মাথা নেড়েছিল অনিমেষ, না, না, আমি সেকথা বলছি না। আলোচনা করলে সবার বুঝতে অসুবিধা হবে না, তাই।

ভিয়েৎনামে যে লড়াই চলছে সেটা তুমি স্বীকার করো তো?

নিশ্চয়।

তাহলেই হল। তারপর প্রসঙ্গটা অন্যদিকে চলে গেল। পরবর্তীকালে অফিস-বিয়ারারদের নাম ঘোষণা করার সময় অনিমেষকে সরিয়ে রাখা হল। অনিমেষের একটু সুবিধে ছিল যে সে কিছু আশা করেনি তাই তার কোন ক্ষোভ হল না। তবে সুদীপ ওকে একদিন আড়ালে ডেকে বলেছিল, অনাবশ্যক কৌতূহল না দেখালে তুমি অনেক উঁচুতে উঠতে পারবে অনিমেষ। পার্টির বিশ্বাস অর্জনের জন্য কাজ করে যাও।
 
পরমহংস একা নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রের সঙ্গে কথা বলার সময় অনিমেষের একটা খটকা লাগছিল। এরা কেউ কোন বিষয়ে তেমন আগ্রহী নয়। বাংলায় এম এ পড়তে এসেছে একটা ডিগ্রী পাওয়ার জন্য। যারা একটু আশাবাদী তারা পরবর্তীকালে ডক্টরেট করে কোনো কলেজে লেকচারারের কাজ পাবে বলে ভাবছে। বাকিরা হয় স্কুলে নয় আর কি যে করবে জানে না। কিন্তু মজার কথা হল, তা নিয়ে কারো তেমন দুশ্চিন্তা নেই। নিজের ভবিষ্যত নিয়ে যাদের এরকম নির্লিপ্ততা তারা তো ভিয়েৎনাম নিয়ে যে আন্দোলনের কথা অনিমেষরা ভাবছে সেটা ছাত্রদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা অত্যন্ত সত্যি কথা, অস্বীকার করার মানে হয় না। কথাগুলো বিমানের সঙ্গে আলোচনা করতে এখন ভয় পায় সে। বিমানের আলোচনা শুনলে মনে হয় যেন তামাম ছাত্ররা ওদের সঙ্গে একমত হয়ে ভিয়েনামের ঘটনার প্রতিবাদ জানাবে এবং এ ব্যাপারে কোন ছাত্রের দ্বিধা নেই। অনিমেষের মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, বিমানরা কি সাধারণ ছেলেদের সঙ্গে মেশে না? তাদের মনের খবর কি জানে না? নাকি, নিজেদের ধ্যানধারণা যাতে সবাই বাধ্য হয়ে মেনে নেয় সেই ব্যবস্থাই চায়।

অনিমেষ বোঝে যে, কতগুলো বিশেষ আদর্শ সামনে রেখে না এগোলে কোন কাজ করা যায় না। হয়তো সেটা ফর্মুলার চেহারা নিয়ে নেয় কিন্তু ছোটখাটো অসঙ্গতি বৃহত্তর স্বার্থের জন্য মেনে নিতে হয়। মাও সে-তুঙ, চে-গুয়েভারা, লেনিন কিংবা হো চি মিন যা করেছেন সেগুলো কি সব ক্ষেত্রে ত্রুটিহীন? কম্যুনিজম তাই প্রচ্ছন্নে একটা আদর্শের স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবকে মেনে নেয়–না মানলে কোন কাজ হয় না। গড়াতে গড়াতে বল এক সময় হয়তো গর্তে গিয়ে পড়বে, প্রতি পায়ে আলোচনার নামে দ্বিধা প্রকাশ মানেই তার গতি হ্রাস।

প্রতিবাদ দিবসে বিশ্ববিদ্যালয়ের লনে একটা বিরাট জমায়েত ডাকা হল। বিমান সেখানে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে ঘোষণা করল যে দুটো নাগাদ ছাত্রদের একটা মিছিল বেরুবে। তার আগে অফিস বিয়ারারদের এবং মেম্বারদের নিয়ে একটা গোপন বৈঠক হয়ে গেছে। তাতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে, পুলিশ যদি বাধ দেয় তাহলে গ্রেপ্তার এড়িয়ে প্রতিবাদ করা হবে। অর্থাৎ একটা গোলমাল সৃষ্টি করে এই প্রতিবাদকে লাইমলাইটে আনতে হবে যাতে দেশের মানুষ জানতে পারে। গ্রেপ্তার এড়ানো হবে এইজন্যে চুপচাপ এগিয়ে গিয়ে পুলিশভ্যানে উঠলে কোন কাজের কাজ হবে না। বিশেষ করে সমস্ত কলেজ স্ট্রীট এলাকায় যখন একশো চুয়াল্লিশ ধারা জারি করা হয়েছে।

অনিমেষ কিন্তু একটা প্রস্তুতির গন্ধ পাচ্ছিল। ব্যাপারটা সবাইকে জানানো হয়নি, কিন্তু সহজভঙ্গীতে যে পুলিশের মুখামুখি বিমানরা হবে না এটাও ঠিক। হঠাৎ ওর মন অভিমান এল, সেই ইলেকশনের পর থেকে সে নিয়মিত দুবেলা য়ুনিয়নের কাজকর্ম করে যাচ্ছে, কয়েকদিন পার্টি অফিসে গেছে সুদীপের সঙ্গে, কিন্তু তবু সে বিমানের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। একদিন বিমান বলেছিল, কম্যুনিস্ট পার্টির মেম্বারশিপ তো চার আনা দিয়ে কেনা যায় না, দীর্ঘদিন তাকে অনেক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে আসতে হয় যা তার বিশ্বস্ততা প্রমাণ করবে, অভিমান হলেই এই কথাটা মনে পড়ে। কে জানে হয়তো তারও এখন সেই অবস্থা চলছে।
 
ক্লাস বয়কটের ডাকটা কিন্তু খুব কার্যকরী হল না। বেশীরভাগ ছেলেমেয়েরা কেমন গা-এলানো ভাব দেখাচ্ছে, যেন সবাই দর্শক হয়ে থাকতে চায়, কেউ মঞ্চে উঠতে চাইছে না। অনিমেষরা করিডোরে ঘুরে ঘুরে ছেলেমেয়েদের চেঁচিয়ে বলতে লাগল, বন্ধুগণ, একটা দিন আমরা ক্লাস বয়কট করছি সাম্রাজ্যবাদীদের জঘন্য কার্যকলাপের প্রতিবাদে, প্রতিবাদ না করলে আমরা কিসের মানুষ? আপনারা সবাই নীচের লনে নেমে আসুন। লন থেকে আমরা মিছিল করে মার্কিন দূতাবাসে যাব এবং সেখানে আমাদের প্রতিবাদ জানাব।

জোর করে কাউকে বের করে আনার নির্দেশ ছিল না তাই দেখা গেল বিভিন্ন কলেজ থেকে আসা ছাত্র য়ুনিয়নের সদস্য ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্র একতৃতীয়াংশ ওই জমায়েতে এসেছে। অবশ্য তাতেই লন ভরে গেছে।

অনিমেষ যখন ছেলেমেয়েদের কাছে আবেদন জানাচ্ছিল তখন ওদের মুখগুলোকে কেমন মুখোশ বলে মনে হচ্ছিল। কোনো রকম প্রতিক্রিয়া হচ্ছিল না সেখানে। নিজের ক্লাসের সামনে দিয়ে যখন সে নেমে আসছে তখন ঘটনাটা ঘটল।

সিঁড়ির মুখটায় কয়েকটা মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। অনিমেষ ওদের দিকে একটুও লক্ষ্য না করে এদের নিস্পৃহতার কথা ভাবতে ভাবতে হাঁটছিল। এমন সময় একটি মেয়েলি গলা কানে এল, শুনুন!

অনিমেষ দেখল, মেয়েদের মধ্যে একজন তার সামনে এগিয়ে আসছে। বুকের ভেতর দ্রিমি দ্রিমি শুরু হয়ে গেল। সেই যে চোখ এতদিন ক্লাসের ছেলেদের মাথার ফাঁকে একটা সরলরেখায় তাকে ছুঁয়ে থাকত তা এখন সামনাসামনি। অনিমেষ আবিষ্কার করল ওর গলা শুকিয়ে কাঠ এবং নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এসেছে ।

আপনার সঙ্গে আমাদের কথা আছে। মেয়েটির গলার স্বর স্পষ্ট ।

বলুন। অনিমেষ নিজেকে ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছিল।

আপনারা কি চান?

মানে?

আমরা এখানে পড়াশুনো করতে এসেছি। এতদিন ধরে যে পরিশ্রম করেছি সেটাকে জলে ভাসাবার রাইট আপনাদের কে দিল?

এ সব কথা কেন বলছেন আমি বুঝতে পারছি না। অনিমেষ আন্দাজে ব্যাপারটা বুঝেও না বোঝার ভান করল। ও কি বলতে চাইছে সেটা শোনা দরকার।

আপনারা আজ ক্লাস বয়কট করতে বলছেন, কাল ধর্মঘট করতে হবে। এই করেই বছরটা যাক। আপনারা যদি পরীক্ষায় পাস না করেন তাহলে দল আপনাদের চিরদিন খাওয়াবে, কিন্তু আমরা কেন বলি হচ্ছি?

আজ তো আমরা কাউকে জোর করছি না। যারা মনে করবে প্রতিবাদ করা উচিত তারাই আসবে এটাই আমাদের আবেদন। অনিমেষ শান্ত গলায় বলল ।

আশ্চর্য! আপনারা একটা সাইকোলজিকাল প্রেসার ক্রিয়েট করছেন না? মেয়েটি যখন কথা বলছিল তখন অন্যান্যরা যে তাকে সমর্থন করছে এটা স্পষ্ট।

আপনি এম এ পড়ছেন। আপনার বোধবুদ্ধি সাধারণ মানুষের চেয়ে ওপরে। আপনি কি মনে করেন ভিয়েৎনামে আমেরিকা যে বর্বর অত্যাচার করছে বিবেকবান মানুষ হিসেবে আমাদের তার প্রতিবাদ করা উচিত। অনিমেষ সরাসরি মেয়েটির চোখের দিকে তাকাল।
 
পৃথিবীর সব জায়গায় যে অত্যাচার হচ্ছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার দায়িত্ব আপনাদের কে দিল? আর আজ নিজের নাক কেটে কি আপনি ডিয়োমে অত্যাচার বন্ধ করতে পারবেন? আপনি এখানে চেঁচালে আমেরিকা তা শুনে সুড়সুড় করে নতিস্বীকার করবে?

বাঃ, আপনি বিশ্বজনমতা কথা মূল্যহীন মনে করেন?

সুন্দর আপনাদের কতগুলো সিলেকটেড শব্দ আছে, সেগুলোর বাইরে আপনারা কিছু বলতে চান বা পারেন না। আজ ভারতবর্ষের লক্ষ মানুষ নানান ভাবে অত্যাচারিত, তাদের কথা না বলে, তাদের উপকার না করে আপনারা ভিয়েৎনাম নিয়ে মেতেছেন। ওখানে যারা লড়াই করছে তারা কিন্তু আপনাদের মুখ চেয়ে নেই। থাকলে আজকে লড়তে পারত না। আচ্ছা নমস্কার। আচমকা কথা শেষ বলে মেয়েটি সঙ্গীদের নিয়ে ক্লাসরুমে ঢুকে গেল।

ঠিক এ রকম আক্রমণের জন্য অনিমেষ প্রস্তুত ছিল না। কথাগুলো শুনতে শুনতে সে মেয়েটাকে কীভাবে বোঝাবে তা ভেবে নিচ্ছিল। কিন্তু এভাবে চলে যাওয়াতে সেটা সম্ভব হল না। ওই মেয়ে এত ভাবে, অনিমেষের সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল। তাহলে যে মুখগুলোকে তার মুখোশ বলে মনে হচ্ছিল সেগুলো সত্যি তা নয়? সেই বিখ্যাত কথা, আইডেন্টিফিকেশন না হলে কোন রেসপন্স পাওয়া যায় না–সেটা এক্ষেত্রেও প্রযোজ্য? অর্থাৎ ভারতবাসীর কাছে সিংহলই যেখানে সুদূর সেখানে ভিয়েনাম কম্বোডিয়া তো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। তাদের জন্য আন্দোলন করে জনমত গঠন করা সত্যের খাতিরে অবশ্যই যুক্তিযুক্ত কিন্তু তাতে জনসাধারণকে সক্রিয়ভাবে পাওয়ার চিন্তা বাতুলতা। যদি এ রকম কোন ইস্যু হতো–এই যে, প্রতি বছর এম এ পাস করে ছেলেরা বেকার থাকবে জেনেও সরকার যে সিস্টেমটা চালু রেখেছে সেটা ভেঙ্গে ফেলা দরকার, প্রতিটি ছেলের পূর্ণ শিক্ষার শেষে যোগ্য সংস্থানের ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে–এই শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হবে যদি দাবি ওঠে তাহলে সবাই সাড়া দেবে? অনিমেষের মনে হল দেবে।

জমায়েতে দাঁড়িয়ে অনিমেষ এইসব কথা ভাবছিল। কোন মানুষকে প্রথম দেখায় বিচার করা যে নেহাতই ছেলেমানুষী তা আজ প্রমাণ হল । কোনদিন কথা হয়নি, শুধু চোখে দেখে সে মেয়েটি সম্পর্কে যে কল্পনা তৈরী করেছিল তার সঙ্গে বাস্তবের কোন মিল নেই। মেয়েটি এত সিরিয়াস, এত স্পষ্ট কথা বলতে পারে এবং কী নির্লিপ্ত হয়ে নিজেকে আড়ালে রেখে দিয়েছে তা কি ওই চোখ দেখে আন্দাজ করা যায়?

অনিমেষ অনুভব করল আজ কথা বলার সময় মেয়েটির দিকে তাকিয়ে তার বুকের মধ্যে যে কাঁপুনি এসেছিল এখন তার একটুও অবশিষ্ট নেই। এক ধরনের রোমান্টিক ধারণার বদলে সে মেয়েটি সম্পর্কে অন্যরকম কৌতূহলী হয়ে উঠেছে।

মিটিংয়ের শেষে শ্লোগান উঠল, ভিয়েৎনাম যুগ যুগ জিও। আমেরিকার কালো হাত গুঁড়িয়ে দাও, ভেঙ্গে দাও। সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় যেন গমগম করছে এখন। কথা ছিল বিমানের ভাষণের শেষে ওরা এক জায়গায় চলে আসবে। অনিমেষ গিয়ে দেখল বিমান নির্দেশ দিচ্ছে কী করতে হবে। মিছিল একটা দিক দিয়ে কলেজ স্ট্রীটে নামবে না। হেয়ার স্কুলের গেট দিয়ে একটা মিছিল এগোবে, অন্যটা কলেজ স্কোয়ারের দিক দিয়ে। পুলিশ রয়েছে হ্যারিসন ব্রোড আর মেডিক্যাল কলেজের সামনে। এদিকটা যখন তারা বাধা পাবে তখন অন্য মিছিলটা ইডেন হোস্টেলের পাশ দিয়ে কুলুটোয় চলে যাবে। অনিমেষের ওপর নির্দেশ হল কলেজ স্ট্রীটের দিকে মিছিলের সঙ্গে যেতে।

এত চটপট সবাই ব্যাপারটা বুঝে নিল যে চমকে যেতে হয়। যেন কোন শিক্ষিত সৈন্য বাহিনীর মত মিছিলটা দুটো মুখ হয়ে এগোতে লাগল। সুদীপ কলেজ স্ট্রীটের মিছিলটাকে আকারে ছোট করে দিল। কারণ ওদের কাজ শুধু পুলিশকে ব্যস্ত রাখা।

সুদীপ অনিমেষ এবং আরো কয়েকজন এই ছোট মিছিলটাকে লিড করে শ্লোগান দিল, ইনকিলাব জিন্দাবাদ; ছাত্র ঐক্য জিন্দাবাদ; মার্কিন সরকার নিপাত যাক; তোমার নাম আমার নাম ভিয়েনাম ভিয়েনাম। ঢেউ–এর মতা শ্লোগানগুলো চারপাশে ছড়িয়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত উত্তেজনা এখন। অনিমেষ মুখ তুলে দেখল ওপরের বারান্দাগুলোয় ছেলেমেয়েরা ভিড় করে ঝুঁকে ওদের দেখছে।

সুদীপ সেটা লক্ষ্য করে বলল, একদিন ওরা আসবে অনিমেষ। রাতারাতি সবাই সৈনিক হবে এটা আশা করো না। ব্যবধান তো থাকবেই।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top