যিনি দরজা খুলে দিলেন তাকে সুন্দরী বললে কম বলা হবে। অহঙ্কার গাম্ভীর্যের সঙ্গে মিশে, চোখের চাহনি শরীরের গঠনের সঙ্গে মিলে এমন একটা ব্যক্তিত্ব এনে দিয়েছে যে চোখ চেয়ে থাকাও যায় না, আবার চোখ সরিয়েও নিতে ইচ্ছে করে না। পরমহংসকে দেখে মহিলা বললেন, আরে, পথ ভুলে নাকি? কি সৌভাগ্য। এসো, এসো।
পরমহংস বলল, সঙ্গে আমার বন্ধু আছে, অনিমেষ মিত্র, হোস্টেলে থাকে, জলপাইগুড়ির ছেলে।
মহিলার দুটো ভ্রূ ডানা মেলার মত ওপরে উঠল, জলপাইগুড়ি! ও মা, তাই নাকি! বসো, বসো। ছিমছাম সাজানো বাইরের ঘর। কোন বাড়তি আসবাব নেই। ওরা সোফায় বসার পর মহিলা সামনেই একটা গদি-মোড়া টুল টাইপের আসনে বলেন, জলপাইগুড়ির কোথায় থাকা হয়?
হাকিমপাড়া। অনিমেষ বলল। সত্যি, মহিলার ছারপাশে এমন একটা মিষ্টি আকর্ষণের মায়া জড়ানো যে ভাল না লেগে যায় না। বয়স হয়েছে, অবশ্যই চল্লিশের চৌহদ্দিতে, কিন্তু কোথাও সেটা তাকে আক্রমণ করতে পারনি। বিজ্ঞাপন ছাড়া এমনটি দেখা যায় না!
ও মা, হাকিমপাড়ায় যে আমার বাপের বাড়ি ছিল! কি মজা! হ্যাঁ, ওই যে ঝোলনা পুল, ওটার ঠিক ডান দিকে। বর্ষার সময় করলার জল একদম বাড়ির মধ্যে ঢুকে যেত। সেসব দিনের কথা ভাবলেই মন খারাপ হয়ে যায়। কি আনন্দে ছিলাম তখন। আপনাদের বাড়িটা কোনখানে?
অনিমেষ বলল, আমাকে তুমি বলবেন, আমি ওর সহপাঠী।
বেশ, বেশ। অতটুকু ছেলেকে আপনি বলতে ইচ্ছে করে না, আবার না বললে–।
অনিমেষ হেসে ফেলল, আমরা তো মফস্বলের ছেলে, আমাদের অত ভ্যানিটি নেই। ও হ্যাঁ, আমাদের বাড়িটা হল টান ক্লাব ছাড়িয়ে তিস্তা নদীর ধারে।
কোন বাড়িটা? বিরাম করদের বাড়ির কাছে?
না। কিন্তু বিরাম করকে আপনি চেনেন?
খুউব চিনি। ওঁরা তো এখন রিচি রোডে আছেন। দু মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, বড়জন আমেরিকায়, মেজটা বম্বেতে। ছোটটারকি একটা অসুখ হয়ে শরীর এত রোগা হয়ে গেয়ে যে ওকে নিয়ে বিরামবাবুদের চিন্তা। তুমি ওদের চেন নাকি? ভদ্রমহিলার চোখ সব সময় কথা বলে।
চিনতাম। কলকাতায় আসার পর আর দেখা হয়নি।
ওই তো, থার্টি ফোর বি রিচি রোডে ওরা থাকে, চলে যেও এক দিন।
দেখি।
আরে তখন থেকে কথা বলে যাচ্ছি, কি খাবে বল?
পরমহংস এতক্ষণ কথা শুনছিল, এবার বলল, দেশের লোক পেয়ে এমন মগ্ন হয়ে পড়লেন যে আমার কথা খেয়ালই নেই। খাব, কিন্তু আমার একটা প্রয়োজনে এসেছি।
সে তো জানি, দরকার ছাড়া আমার কাছে কেউ আসে না। আগে চা খাও, তারপর শুনব। বসো তোমরা। ভদ্রমহিলার হেঁটে যাওয়ার ভঙ্গীটায় অদ্ভূত মাদকতা আছে।
অনিমেষ পরমহংসকে নীচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, কে ইনি?
তোমার দেশওয়ালীভাই। নর্থ বেঙ্গলের লোকদের দেখেছি পরস্পরের প্রতি খুব টান থাকে, সেটা মনে পড়তেই নিয়ে এলাম।
কিন্তু এখানে কাকে পড়াতে হবে?
ওঁর ছেলে । উনি ইণ্ডিয়ান টোবাকোতে বড় চাকরি করেন।
ওঁর স্বামী?
ছিল, এখন ডিভোর্সি।
সে কি!
যাঃ, আঁতকে উঠলে! এই মন নিয়ে তুমি পলিটিক্স–সরি, মুখ ফসকে বেরিয়ে এসেছে। এরাও, আমার আত্মীয়, মানে এঁর হাজব্যান্ড।
বাব্বা, তোমার তো ভ্যারাইটিস আত্মীয়স্বজন আছে!
অনেকেই অনেকের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না। একমাত্র আমিই সেতু হয়ে আছি। তবে এ বাড়িতে অনেক দিন পরে এলাম।
দেওয়ালে কয়েকটা কিউরিও, একটা বাচ্চা ছেলের দারুণ উজ্জ্বল ছবি চোখ টানে। হঠাৎ অনিমেষের খেয়াল হল এই মহিলা বিরাম করের কথা বলছিলেন। জলপাইগুড়ির একালের কংগ্রেসী রাজনীতির নেতা বিরামবাবু নিশ্চয়ই আর সক্রিয় নন, থাকলে নাম শোনা যেতে। ওঁরা কলকাতায় আছেন কিন্তু কোন দিন দেখা করার বাসনা হয়নি। মুভিং ক্যাসেল কি এই মহিলার বন্ধবী? অবশ্য তার বয়স নিশ্চয়ই বেশী। মেনকাদি এবং উর্বশীর বিয়ে হয়ে গেছে, সময় কিভাবে চলে যায়! অনিমেষ আবিষ্কার করল উর্বশী নয়, এত দিন পরে রম্ভার জন্যে মনে কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। তার জীবনে রম্ভাই প্রথম যে নারী হবার আগেই ওকে চুমু খেয়েছিল। কি বিরক্তি এবং ক্রোথ সে সময় তাকে মেয়েটাকে ঘেন্না করতে সাহায্য করেছিল! এখন এই মুহূর্তে হাসি পায়। ভদ্রমহিলা যা বললেন তা যদি সত্যি হয় তা হলে রঙ্কাই এখন অসুস্থ! সেই স্বাস্থ্যবতী মেয়েটা। সেই দুপুরে শরীরে জ্বর নিয়ে শুয়ে–থাকা মেয়েটার সব অহঙ্কার সে মার করে দিয়েছিল নিলি হয়ে–এখন কেমন যেন মায়া লাগছে সে কথা ভেবে। অনিমেষের খেয়াল হল এই মহিলার নিশ্চয়ই ও বাড়িতে যাতায়াত আছে এবং রম্ভা যখন শুনবে যে অনিমেষ টিউশনি উমেদারি করতে এখানে এসেছে তখন নিশ্চয়ই ঠোঁট বেঁকাবে। মেয়েরা অনিমেষ ঘুরে বসল, এই, তুমি এখানে টিউশনির কথা বলো না।
অবাকহল পরমহংস, কেন?
না, আমি ঠিক করলাম, জলপাইগুড়ির লোকের বাড়িতে টিউশনি করব না। এটা ঠিক হবে না।
যত সব ফালতু সেন্টিমেন্ট। ভাল মাল দেবে বুঝলে!
দিক। তবু না, প্লিজ। এসব কথা পেড়ো না।
কিন্তু আমি যে বললাম প্রয়োজনে এসেছি।
কথাটা ঘুরিয়ে নিও, সে তুমি পারবে।
তোমার টাকার দরকার নেই?
আছে।
তা হলে?
আমার কতগুলো জমানো স্মৃতি আছে, সেগুলোকে বিক্ষত করে টাকা চাই না। এ তুমি ঠিক বুঝবে না।