What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected কালবেলা- সমরেশ মজুমদার (2 Viewers)

এই গল্পটা পড়ে অনেক আনন্দ পেলাম। আরো আপডেট চাই
ধন্যবাদ। অবশ্যই আপডেট হতেই থাকবে গল্প শেষ না হওয়া অবধি।
 
ভুলু নামের ওই বিদঘুটে ছেলেটি অনিমেষকে বারান্দা পার করে এই ঘরে বসিয়ে রেখে সেই যে উধাও হল আর দেখা নেই। আসার সময় সে লক্ষ্য করেছিল দু পাশের দরজা-জানলা বন্ধ । একটা বুড়ী ঝি ছাড়া কোন মানুষ এ বাড়িতে আছে বলে মনে হচ্ছিল না। আবরুটা এ বাড়িতে একটু বেশী কড়া, কিন্তু কেমন যেন গা-গিরসিরে। পরমহংসের আত্মীয় এরা কিন্তু তাকেও ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয় কিনা সন্দেহ আছে। এই ঘরের জিনিসপত্র প্রচুর। সবগুলোই ক্লাইভের আমলে কেনা হয়েছিল বোধ হয়েছে এবং এ ঘরের সব কটা দরজা-জানলা খোলা। কিছুক্ষণ পরে অনিমেষের মনে হল তাকে কেউ বা কারা লক্ষ্য করছে। দরজা বা জানলার বাইরে থেকে চুরি করে এভাবে দেখাটা বোঝা যাচ্ছে চুড়ির শব্দে। খুব অস্বস্তিকর ব্যাপার কিন্তু কিছু করার নেই। চট কর উঠে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালে দর্শকদের দেখা যাবে, কিন্তু তাতে লাভ কি!

বসে থাকাটা যখন আর সম্ভব হচ্ছে না তখন বাইরে নারীকণ্ঠ শোনা গেল, যা না, ভেতরে যা, মাস্টারের কাছে পড়তে হবে যখন তখন লজ্জা করে লাভ কি। মাস্টার হল বাবার মতন। বাইরে বোধ হয় ঠেলাঠেলি চলছে। ছাত্রীটি ঘরে ঢুকতে চাইছে না। নিজেকে কেমন চোর চোর মনে হল অনিমেষের। সুযোগ থাকলে তক্ষুণি রাস্তায় নেমে যেত সে।

ভুলুর পেছন পেছন খড়মের আওয়াজ তুলে শিয়ালতালুই ঘরে ঢুকলেন। ঢুকে গ্রাম ভারী গলায় বললেন, এদিকে আয়।

ডাকের সঙ্গে সঙ্গে সুড়সুড় করে যে চলে এল তাকে দেখে অনিমেষ সোজা হয়ে বসল।

শিয়ালতালুই বললেন, মন দিয়ে পড়াশুনা করবি। এই শেষবার, এবার যেন ফেল না হয় । মাস্টার, ফাঁকি দেবার চেষ্টা করো না। পড়াতে যে জানে সে গাধা পিটিয়েও ঘোড়া করতে পারে।

অনিমেষ তক্তপোশ থেকে দাঁড়াল, আমি কিন্তু সন্ধ্যে নাগাদ আসব। ছটা। ছটা থেকে সাড়ে আটটা। আড়াই ঘন্টা পড়ালেই যথেষ্ট।

রোজ?

রোজ না পড়ালে তুমি ছাত্রীকে পাস করাতে পারব হে? তা হলে মাস্টার রাখতে যাব কেন? আচ্ছা নাও, পড়াশুনা কর। শিয়ালতালুই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

এবার আবার ছাত্রীর দিকে তাকাল অনিমেষ। শরীরের কোথাও খাঁজ আছে বলে মনে হচ্ছে না, কারণ শাড়িটা ওকে আল খাল্লার মত জড়িয়ে রেখেছে। চট করে পিপের কথা মনে আসে। গায়ের রঙ অসম্ভব ফর্সা, মুখে একটা মিষ্টি ছাপ আছে।

চিবুক এখন প্রায় বুকের ওপর নামানো। আঁচলের আড়ালে রাখা হাতের আদলেই বিব্ৰত হল সে, এত মোটা মেয়ে সচরাচর চোখে পড়ে না। অনিমেষ কিছু বলার আগেই ভুলু বলল, মা তোকে প্রণাম করতে বলেছে না! প্রণাম কর!

কথাটা শেষে হতেই দম-দেওয়া পুতুলের মত শরীরটা অনিমেষের দিকে এগিয়ে আসতে অনিমেষ আঁতকে উঠল, না, না, প্রাণাম করতে হবে না।

ভুলু বলল, ছি, ছি, মাস্টার মশাই, মা বলেছে আপনি বাবার মতন, প্রণাম না নিলে খুকুর পাপ হবে। প্রণাম কর খুকু।

অতএব প্রণাম নিতে হল ।

মেয়েটির বোধ হয়, ঝুঁকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছিল। অনিমেষ বলল, বসো।

টেবিল চেয়ার নয়, এই তক্তাপোশের ওপর বসেই পড়াতে হবে। কিন্তু বইপত্র কিছু সঙ্গে আনেনি মেয়েটা। অনিমেষ ঠিক করল প্রথম দিন ওর কোর্স জেনে নেবে। অনেকটা দূরত্ব রেখে খুকু বসল। বসার সময় তক্তপোশের মচমচে শব্দটা কান এড়ালো না অনিমেষের। এই ছাত্রীকে পড়াতে হবে ভাবতেই বুকের মধ্যে একটা হিমভাব আসছে। অনিমেষ নিজের জায়গায় বসে দেখল ভুলু ঘরের এক কোণে একটা চেয়ারে বাবু হয়ে বসে এদিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটার দিকে নজর পড়ার পর অন্যরকম অস্বস্তি হতে আরম্ভ করল। ওকে কি পাহারা দেবার জন্যে বসিয়ে রেখেছে? ছেলেটার অস্তিত্ব উপেক্ষা করল অনিমেষ। তারপর গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করল, ক্লাস সেভেনে পড়?

তুমি বলতে সঙ্কোচ হচ্ছিল। এত বড় মেয়েকে প্রথমেই তুমি বলা অন্য সময় হয়তো অসম্ভব হতো, এখন পারল। সে নিজের মুখ-চোখে খুব ভারিক্কী ভাব রাখার চেস্টা করতেই মনে পড়ল তাকে এই বিশাল মেয়েটির বাবার মতন বলা হয়েছে। শরীর দেখলে বয়স ঠাওর হয় না। বলা যায় না, তার সমান বয়সীও হতে পারে। প্রশ্নটার জবাব তখনো আসেনি। অনিমেষ বিরক্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল, কি হল?
 
সঙ্গে সঙ্গে ভুলুর গলা ভেসে এল, বাবা তো বলেছেই কোন কেলাসে পড়ে, আবার নেক্কড়ি করে জিজ্ঞাসা করার কি আছে?

সে আমি বুঝব, তুমি চুপ করো। চাপা গলায় ধমকে উঠল অনিমেষ।

সঙ্গে সঙ্গে ভুলুর কপালে তি–চারটে ভাঁজ পড়ে গেল, আর অনিমেষ দেখল মেয়েটা খুব দ্রুত সামন–পেছনে ঘাড় নাড়ছে। অবাক হতে গিয়ে সামলে নিল, ঘাড় নাড়ার অর্থ সেভেনেই পরে।

কি কি পড়ানো হয়?

এবার কোন উত্তর নেই। হঠাৎ অনিমেষের সন্দেহ হল মেয়েটি কি কথা বলতে পারে না। বোবা মেয়েরাও তো পড়াশুনা করে। নিঃসন্দেহ হবার জন্য জিজ্ঞাসা করল, সে তুমি কি কথা বলতে পার না?

সঙ্গে সঙ্গে মাথাটা নড়বড় করে জানাল, হ্যাঁ।

তা হলে আমি যেটা জিজ্ঞাসা করেছি তার জবাব দাও।

ঠোঁট দুটো খানিক কাঁপল, তারপর খুব নীচু স্বরে সরু গলায় উত্তর এল, ইংরিজী, বাংলা ভূগোল, ইতিহাস, অঙ্ক, বিজ্ঞান, ড্রইং—

হেসে ফেলল অনিমেষ, না, না, আমি সে কথা জিজ্ঞাসা করছি না, তোমাদের কি কি বই পড়ানো হয়? তুমি তো সঙ্গে কোন বই আনোনি।

সঙ্গে সঙ্গে ভুলু উঠে দাঁড়াল, আমি নিয়ে আসছি বই। তারপর দরজা অবধি এগিয়ে থমকে দাঁড়াল। এক সেকেন্ড কি ভেবে বোনের দিকে ঘুরে বলল, আমি তো যেতে পারব না। আমাকে এখানে থাকতে বলেছে।

অনিমেষের মাথায় রক্ত উঠে গেল। এরকম নোংরা মানসিকতার মধ্যে কোন ভদ্রলোক পড়াতে পারে না। এর মেধ্যে খুকু উঠে দাঁড়িয়ে সেইরকম গলায় বলল, আমি বই নিয়ে আসছি, আপনি বসুন।

ছাত্রী ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর অনিমেষ ভুলুর দিকে তাকাল। সেই একরকম ভঙ্গীতে তাকে জুলজুল করে দেখছে। কপালে ভাঁজগুলো এখনও মেলায়নি। অনিমেষ ডাকল, এই, এদিকে এসো!

ভুলু খেকুড়ে গলায় বলল, কেন?

আমি ডাকছি তাই আসবে।

ইস, ডাকলেই হল! কাছে গেলে ধোলাই লাগবে, জানি না! মাস্টাররা খুব মারকুটে হয়, জানি বাবা। ঘন ঘন ঘাড় নাড়তে লাগল সে।

আমি তোমাকে খামকা মারতে যাব কেন, কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করব বলে তোমাকে কাছে ডাকছি। অনিমেষ গলার স্বর নরম করর চেষ্টা করল।

ভুলুকে একটু ভাবতে দেখা গেল। অন্যমনস্ক হলেই লালা গাড়িয়ে আসে, সেটাকে টেনে নিয়ে কয়েক পা এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, কি কতা?

তোমাকে এখানে কে থাকতে বলেছে?

বাবা।

তোমার বাবা বলেছেন! কেন?

আপনি বাইরের লোক, খুকী সোমও মেয়েছেলে তাই।

কোনরকমে ঢোক গিলল অনিমেষ, আগের মাস্টারের সময়ও তুমি থাকতে? মানে এইরকম পাহারা দিতে?

ঘাড় নাড়ল ভুলু, হু। তখন মা বলতো থাকতে। মা বলতো বুড়োরা নাকি খুব খচ্চর হয়।

কথাটা শুনে জমে গেল অনিমেষ। এরকম পরিবারের কথা তার কল্পনায় ছিল না। আগের মাস্টারের বয়স আশির ওপর ছিল তা গৃহকর্তা জানিয়েছেন। তবু পাহারা চলত। সে গম্ভীর গলায় বলল, কিন্তু আমি যখন পড়াবো তখন তোমার থাকা চলবে না।

ইস! সেই ফাঁকে যদি ফষ্টি-নষ্টি চালান! আমাদের বাড়িতে চাকর পর্যন্ত রাখা হয় না এ জন্যে। কথাটা শেষ করার আগেই ছাত্রী বইপত্র দুহাতে জড়িয়ে ঘরে ঢুকল।

ততক্ষণে অনিমেষের পড়ানো মাথায় উঠেছে। তাকে খাট থেকে নামতে দেখে ভুলু প্রস্তাব দিল, আমাকে যদি এক টাকা করে মাসে দেন তবে

তুমি ঘর থেকে বেরিয়ে যাও। হাত তুলে ওকে দরজা দেখাল অনিমেষ।

ওর গলার স্বরে এমন একটা কাঁপুনি ছিল যে ভুলু থতমত হয়ে এক লাফে দরজার বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর নিরাপদ দূরত্বে থেকে বলে উঠল, ইস্! খুব নেক্কড়বাজ!

কথাটার মানে বোধগম্য হল না। এই সময় ছাত্রীটি বলে উঠল, বই এনিচি, দেখুন।

অনিমেষ উঠে দাঁড়াল, খুকী, আজকে আমার পড়াবার মন নেই। যদি আবার আসি তখন তোমাকে পড়াবো। আজ আমি যাচ্ছি। তারপর হন হন করে বাইরে বেরিয়ে এল। কোনদিকে না তাকিয়ে সে সোজা বাইরের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল।

পরমহংস নেই কিন্তু শিয়ালতালুই খালি গায়ে বসে ওর দিকে তাকিয়ে আছেন। চোখাচোখি হতে নাক কুঁচকে বলে উঠলেন, এ কি, পড়ানো হয়ে গেল! মাস্টাররা যদি ফাঁকি দেয় তবে ছাত্রেরা কি শিখবে! না না, দুঘন্টার কম পড়ানো আমি পছন্দ করি না।
 
অনিমেষ হেসে ফেলল, দুশ্চিন্তা করবেন না। আমি এখানে পড়াব না ঠিক করেছি। আর একটা অনুরোধ করছি, পড়ানোর চেষ্টা না করে এবার ওর বিয়ে দেবার ব্যবস্থা করুন। নমস্কার। কোনরকমে প্যাসেজে নেমে পায়ে জুতো গলিয়ে দরজা খুলে রাস্তায় বেরিয়ে এল অনিমেষ।

ধারেকাছেও পরমহংস নেই। এভাবে একদম না বলে কয়ে চলে যাবে আশা করা যায় না। অবশ্য যদি থাকার হলে ও-বাড়িতেই সে থাকত। কিন্তু পুরো ব্যাপারটার জন্যে অনিমেষ পরমহংসের ওপর রাগ করতে পারছে না। বাড়াবাড়িটা যে এতটা দূর হবে সেটা হয়তো সে আন্দাজ করতে পারেনি। তাই কলকাতা শহরে এরকম পরিবার এখানে থাকতে পারে বিশ্বাস করা শক্ত। এরাও বাংলা দেশের মানুষ, যে দেশের স্টুডেন্টস ইউনিয়নগুলো ছাত্র ফেডারেশনের নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে। এই যে এত মিছিল হয়, আন্দালনে আগুন জ্বলে, তার সামান্য আঁচ এ-বাড়িতে লাগেনি। ঠিক জানা নেই, তবে নিশ্চয়ই এরকম বাড়ির সংখ্যা কম নয়।

কয়েক পা হাঁটার পর অনিমেষের নিজেকে খুব হালকা মনে হলে। যেন একটা ভারী পাথর তার কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছিল, হঠাৎ সরে গেছে। এতক্ষণ যে ধৈর্য ধরে ওখানে পড়েছিল সেটাই আশ্চর্যের। ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলার সময় ব্যাপারটা ঠাওর করে চলে আসতে পারতো। তা হলে কি টাকার লোভ, না ছাত্রীটিকে দেখবার আগ্রহ? ছাত্রীটি যে নীরেট হবে এটা অনুমান করা গিয়েছিল, কিন্তু ধৈর্য না রাখলে এরকম বাড়ির পূর্ণ চিত্র তো পাওয়া যেত না। টাকাটা পেলে অবশ্যই উপকার হতো, কিন্তু আত্মমর্যাদা বিকিয়ে দিয়ে নিশ্চয়ই নয়। অনিমেষ হেসে ফেলল, প্রথম রোজগার করতে গিয়েই তাকে এমনভাবে হোঁচট খেতে হল, যাচ্ছলে!

বি. কে. পাল এভিন্যুতে আসতেই চিৎকার করে কেউ তাকে ডাকছে শুনতে পেল অনিমেষ। পরমহংসের গলা, একটা চায়ের দোকান থেকে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে আসছে। কাছে এসে পরমহংস জিজ্ঞাসা করল, হয়ে গেল?

কি? অনিমেষ ভ্রূ কোঁচকালো।

দুটোই।

পরমহংসের মুখের দিকে তাকিয়ে রাগতে পারল না অনিমেষ । ছেলেটার মুখে এমন মজা–করা ভাব আছে যে রাগাও যায় না । ও বলল, হ্যাঁ বেশ পড়িয়ে-টড়িয়ে এলাম। ছাত্রীটি খুব ভাল।

ভাল মানে? পরমহংসের চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠল।

ভাল মানে ভাল। ইনটেলিজেন্ট। তুমি তো জল বাদ দিয়ে দুধটুকু খাও আর সহজ কথাটা বুঝতে পারো না! কপট বিরক্তি দেখাল অনিমেষ।

সঙ্গে সঙ্গে হতাশ ভঙ্গী করল পরমহংস, দুর শালা! যা ভেবেছিলাম তাই বলে কেটেছে, না ভক্কি দিয়ে?

আমি কেটেছি কে তোমাকে বলল?

কেন ছলনা করছ, গুরু! তালুইমশাই আমাকে ভাগিয়ে দেবার পর থেকে ওয়াচ করছি চায়ের দোকানে বসে। দেরি দেখে ভাবছিলাম ক্যালেণ্ডার হয়ে ঝুলে গেলে বোধ হয়। কিন্তু ওই গোবরে মেয়েটাকে যখন ইনটেলিজেন্ট বলছ তখন তুমি নির্ঘাত কেটে পড়েছ। পরমহংস নিশ্চিত গলায় জানাল।

হেসে ফেলল অনিমেষ, হ্যাঁ, ও মেয়েকে আমি পড়াতে পারব না, অসম্ভব। আর তুমি দেখে-শুনে ও বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ভাল করনি। ফালতু সময় নষ্ট হল।

কোন কিছু ফালতু নয় বন্ধু । যাকে উপেক্ষা করছ সেই একদিন তোমার উপকারে আসতে পারে । কাদের জন্যে দেশ উদ্ধার করবে তা চোখ চেয়ে দেখবে না? তালুইকে কি বললে?

বললাম, আমি পড়াব না, পারলে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিতে।

যাচ্ছলে! হয়ে গেল, ও বাড়ির দরজা আমার জন্যে ফর এভার বন্ধ হয়ে গেল। পড়াবে না সেটা বললেই হত, মেয়েটা সম্পর্কে জ্ঞান দেওয়ার কি দরকার ছিল! চলো।

আবার কোথায় যাবো?

আমার সঙ্গে এসো না! অলটারনেটিভ ব্যবস্থা রাখাই আছে–এটা ফেল করলে, আর একটা ফিট করে রেখেছি। বাড়ির দালালরা যেমন একসঙ্গে দু-তিনটে বাড়ি দেখায়। এটা হরি ঘোষ স্টপে, বেশী দুরে নয়।
 
অবাক হয়ে পরমহংসকে বলল অনিমেষ, সে কি! তোমার সন্ধানে কটা টিউশনি আছে? এজেন্সি নিয়েছ নাকি। তবে ওরকম বাড়ি হলে আমার গিয়ে দরকার নেই আগে থেকে বলে দিচ্ছি।

যাচ্চলে! অত গেরান্টি আমি দিতে পারব না। তা ছাড়া তোমাকে তো কেউ দিব্যি দেয়নি যে পড়াতে হবেই। ভাল লাগলে পড়াবে, নইলে নয়। আরে, এক-একটা ছেলে কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়তে পড়তে কত টাকা টিউশনি করে রোজগার করে ভাবতে পারবে না। আমাদের পাড়ার সুবলদা টিউশনি করতে করতে এম-এ পাস করল। তারপর চাকরি-বাকরি না পেয়ে টিউশনিটা বাড়িয়ে দিল। রোজ সকাল সাড়ে ছটা থেকে আটটা বাগবাজারে, সওয়া আটটা থেকে পৌনে দশটা শ্যামবাজারের, দুপুরে দুজায়গায় মেয়ে পড়ায়, মর্নিং স্কুল হওয়ার সেইটে সুবিধে, রাত্রে আবার দুটো। সপ্তাহ তিন দিন করে হলে সিক্স ইন্টু টু মাসে বারোটা টিউশনি, এক শো পঁচিশ করে ইচ, হাই ক্লাসের স্টুডেন্ট সব। নেট দেড় হাজার টাকা মান্থলি ইনকাম। চাকরি করলেও পেত না, বল?

অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, তা ঠিক। তবে লোকটার নিশ্চয়ই পার্সোনাল লাইফ বলে কিছু নেই, কোন কিছু সিরিয়াসলি চিন্তা করতে পারে না। যত টাকাই পাওয়া যাক এরকম চেন-বাধা হয়ে বেঁচে থাকার কোন মানে হয় না। অনিমেষ মরে গেলেও তা পারবে না। কিন্তু একটা এক্সট্রা ইনকাম তার যে খুব প্রয়োজন–সে কথা ঠিক। বাবা স্বৰ্গছেঁড়া থেকে যে টাকা পাঠাচ্ছেন এতগুলো বছরে তার অঙ্কটা বাড়েনি। বাড়ানো যে বাবার পক্ষে সম্ভবও নয় তা সে জানে। মাঝে মাঝে মনে হয় পারলে সে বাবাকে নিষ্কৃতি দিত–এই টাকা পাঠানোর কর্তব্য থেকে, ইউরোপ-আমেরিকায় ছেলেমেয়েরা তো রেস্টুরেন্ট হোটেলে চাকরের কাজ করে নিজেদের পড়াশুনার খরচ চালায়–সেরকম যদি একটা কিছু করা যেত।

সেন্ট্রাল অ্যাভিন্যু দিয়ে খানিকটা যাওয়ার পর পরমহংস বলল, আমাদের ডান দিকে কি বল তো? বিরাট রাস্তার ডান দিকে তাকিয়ে অনিমেষ পুরোনো ধাঁচের কিছু ঘরবাড়ি দোকানপাট ছাড়া আর কিছু দেখতে পেল না।

পরমহংস ওর মুখের ভাব লক্ষ্য করে মজা পেল, জানো না? যা, তুমি নেহাতই নাবালক। এই এলাকাটা ভুবনবিখ্যাত। কোথায় যেন পড়ছিলাম প্যারিসের বারবণিতারা, বঙ্গ সন্তানটি এই জায়গা ঘুরে গেছে জানলে, একদম ঠকাবার চেষ্টা করে না। ওরা আদর করে একে ডাকে গোলডি বলে।

গোলডি!

সোনাগাছি। কলকাতায় আছ আর সোনাগাছি কোথায় জান না? এই জনচেতনা নিয়ে তুমি রাজনীতি করবে, ইস্!

আচমকা অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, আজকাল প্রায়ই তুমি ওর রাজনীতি করার প্রসঙ্গ তুলছে কেন বল তো? এটা তো আমার ব্যাপার, তাই না?

পরমহংস অনিমেষকে কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেল । চুপচাপ হাঁটতে হাঁটতে অনিমেষের মনে হল কথাটা এভাবে না বললেও চলত, যা এতদিন দেখেছে তাতে ছেলেটাকে হাসিখুশী জমাটি বলেই মনে হয়েছে। কিন্তু রাজনীতির ব্যাপার নিয়ে এই–রকম শ্লেষ ভাল লাগে না, বিশেষ করে সে যখন সক্রিয় রাজনীতি করছেই না।

একটা পার্কের পাশ দিয়ে চলে আসার সময় বড় বড় বাড়ির দরজায় সাজুন্তি মেয়েদের দেখা গেল। সেই কলকাতায় প্রথম আসার পর বউবাজার, কিংবা জলপাইগুড়ির বেগুনটুলির গলিতে সে এদের দেখেছে, তাই চিনতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু তার পরেই পাড়াটা স্বাভাবিক, ভদ্রলোকের মনে হল। এরকম সহ-অবস্থান বোধ হয় কলকাতাতেই সম্ভব।

হরি ঘোষ স্ট্রীটের মাঝামাঝি বাড়িটা। এখন রাত হয়েছে, অন্তত সাড়ে সাতটা তো হবেই। পরমহংস বলল, সবে সন্ধ্যো।
 
যিনি দরজা খুলে দিলেন তাকে সুন্দরী বললে কম বলা হবে। অহঙ্কার গাম্ভীর্যের সঙ্গে মিশে, চোখের চাহনি শরীরের গঠনের সঙ্গে মিলে এমন একটা ব্যক্তিত্ব এনে দিয়েছে যে চোখ চেয়ে থাকাও যায় না, আবার চোখ সরিয়েও নিতে ইচ্ছে করে না। পরমহংসকে দেখে মহিলা বললেন, আরে, পথ ভুলে নাকি? কি সৌভাগ্য। এসো, এসো।

পরমহংস বলল, সঙ্গে আমার বন্ধু আছে, অনিমেষ মিত্র, হোস্টেলে থাকে, জলপাইগুড়ির ছেলে।

মহিলার দুটো ভ্রূ ডানা মেলার মত ওপরে উঠল, জলপাইগুড়ি! ও মা, তাই নাকি! বসো, বসো। ছিমছাম সাজানো বাইরের ঘর। কোন বাড়তি আসবাব নেই। ওরা সোফায় বসার পর মহিলা সামনেই একটা গদি-মোড়া টুল টাইপের আসনে বলেন, জলপাইগুড়ির কোথায় থাকা হয়?

হাকিমপাড়া। অনিমেষ বলল। সত্যি, মহিলার ছারপাশে এমন একটা মিষ্টি আকর্ষণের মায়া জড়ানো যে ভাল না লেগে যায় না। বয়স হয়েছে, অবশ্যই চল্লিশের চৌহদ্দিতে, কিন্তু কোথাও সেটা তাকে আক্রমণ করতে পারনি। বিজ্ঞাপন ছাড়া এমনটি দেখা যায় না!

ও মা, হাকিমপাড়ায় যে আমার বাপের বাড়ি ছিল! কি মজা! হ্যাঁ, ওই যে ঝোলনা পুল, ওটার ঠিক ডান দিকে। বর্ষার সময় করলার জল একদম বাড়ির মধ্যে ঢুকে যেত। সেসব দিনের কথা ভাবলেই মন খারাপ হয়ে যায়। কি আনন্দে ছিলাম তখন। আপনাদের বাড়িটা কোনখানে?

অনিমেষ বলল, আমাকে তুমি বলবেন, আমি ওর সহপাঠী।

বেশ, বেশ। অতটুকু ছেলেকে আপনি বলতে ইচ্ছে করে না, আবার না বললে–।

অনিমেষ হেসে ফেলল, আমরা তো মফস্বলের ছেলে, আমাদের অত ভ্যানিটি নেই। ও হ্যাঁ, আমাদের বাড়িটা হল টান ক্লাব ছাড়িয়ে তিস্তা নদীর ধারে।

কোন বাড়িটা? বিরাম করদের বাড়ির কাছে?

না। কিন্তু বিরাম করকে আপনি চেনেন?

খুউব চিনি। ওঁরা তো এখন রিচি রোডে আছেন। দু মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, বড়জন আমেরিকায়, মেজটা বম্বেতে। ছোটটারকি একটা অসুখ হয়ে শরীর এত রোগা হয়ে গেয়ে যে ওকে নিয়ে বিরামবাবুদের চিন্তা। তুমি ওদের চেন নাকি? ভদ্রমহিলার চোখ সব সময় কথা বলে।

চিনতাম। কলকাতায় আসার পর আর দেখা হয়নি।

ওই তো, থার্টি ফোর বি রিচি রোডে ওরা থাকে, চলে যেও এক দিন।

দেখি।

আরে তখন থেকে কথা বলে যাচ্ছি, কি খাবে বল?

পরমহংস এতক্ষণ কথা শুনছিল, এবার বলল, দেশের লোক পেয়ে এমন মগ্ন হয়ে পড়লেন যে আমার কথা খেয়ালই নেই। খাব, কিন্তু আমার একটা প্রয়োজনে এসেছি।

সে তো জানি, দরকার ছাড়া আমার কাছে কেউ আসে না। আগে চা খাও, তারপর শুনব। বসো তোমরা। ভদ্রমহিলার হেঁটে যাওয়ার ভঙ্গীটায় অদ্ভূত মাদকতা আছে।

অনিমেষ পরমহংসকে নীচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, কে ইনি?

তোমার দেশওয়ালীভাই। নর্থ বেঙ্গলের লোকদের দেখেছি পরস্পরের প্রতি খুব টান থাকে, সেটা মনে পড়তেই নিয়ে এলাম।

কিন্তু এখানে কাকে পড়াতে হবে?

ওঁর ছেলে । উনি ইণ্ডিয়ান টোবাকোতে বড় চাকরি করেন।

ওঁর স্বামী?

ছিল, এখন ডিভোর্সি।

সে কি!

যাঃ, আঁতকে উঠলে! এই মন নিয়ে তুমি পলিটিক্স–সরি, মুখ ফসকে বেরিয়ে এসেছে। এরাও, আমার আত্মীয়, মানে এঁর হাজব্যান্ড।

বাব্বা, তোমার তো ভ্যারাইটিস আত্মীয়স্বজন আছে!

অনেকেই অনেকের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না। একমাত্র আমিই সেতু হয়ে আছি। তবে এ বাড়িতে অনেক দিন পরে এলাম।



দেওয়ালে কয়েকটা কিউরিও, একটা বাচ্চা ছেলের দারুণ উজ্জ্বল ছবি চোখ টানে। হঠাৎ অনিমেষের খেয়াল হল এই মহিলা বিরাম করের কথা বলছিলেন। জলপাইগুড়ির একালের কংগ্রেসী রাজনীতির নেতা বিরামবাবু নিশ্চয়ই আর সক্রিয় নন, থাকলে নাম শোনা যেতে। ওঁরা কলকাতায় আছেন কিন্তু কোন দিন দেখা করার বাসনা হয়নি। মুভিং ক্যাসেল কি এই মহিলার বন্ধবী? অবশ্য তার বয়স নিশ্চয়ই বেশী। মেনকাদি এবং উর্বশীর বিয়ে হয়ে গেছে, সময় কিভাবে চলে যায়! অনিমেষ আবিষ্কার করল উর্বশী নয়, এত দিন পরে রম্ভার জন্যে মনে কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। তার জীবনে রম্ভাই প্রথম যে নারী হবার আগেই ওকে চুমু খেয়েছিল। কি বিরক্তি এবং ক্রোথ সে সময় তাকে মেয়েটাকে ঘেন্না করতে সাহায্য করেছিল! এখন এই মুহূর্তে হাসি পায়। ভদ্রমহিলা যা বললেন তা যদি সত্যি হয় তা হলে রঙ্কাই এখন অসুস্থ! সেই স্বাস্থ্যবতী মেয়েটা। সেই দুপুরে শরীরে জ্বর নিয়ে শুয়ে–থাকা মেয়েটার সব অহঙ্কার সে মার করে দিয়েছিল নিলি হয়ে–এখন কেমন যেন মায়া লাগছে সে কথা ভেবে। অনিমেষের খেয়াল হল এই মহিলার নিশ্চয়ই ও বাড়িতে যাতায়াত আছে এবং রম্ভা যখন শুনবে যে অনিমেষ টিউশনি উমেদারি করতে এখানে এসেছে তখন নিশ্চয়ই ঠোঁট বেঁকাবে। মেয়েরা অনিমেষ ঘুরে বসল, এই, তুমি এখানে টিউশনির কথা বলো না।

অবাকহল পরমহংস, কেন?

না, আমি ঠিক করলাম, জলপাইগুড়ির লোকের বাড়িতে টিউশনি করব না। এটা ঠিক হবে না।

যত সব ফালতু সেন্টিমেন্ট। ভাল মাল দেবে বুঝলে!

দিক। তবু না, প্লিজ। এসব কথা পেড়ো না।

কিন্তু আমি যে বললাম প্রয়োজনে এসেছি।

কথাটা ঘুরিয়ে নিও, সে তুমি পারবে।

তোমার টাকার দরকার নেই?

আছে।

তা হলে?

আমার কতগুলো জমানো স্মৃতি আছে, সেগুলোকে বিক্ষত করে টাকা চাই না। এ তুমি ঠিক বুঝবে না।
 
হোস্টেলে কেমন একটা থমথমে ভাব। এমনিতে খুব হইহল্লা না হলেও যে স্বাভাবিক চেহারাটা থাকে সেটা নেই। সবাই গুজগুজ করছে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে, যেন মারত্মক কিছু হয়ে গেছে! ওকে দেখতে পেয়ে গোবিন্দ এগিয়ে এল, আজকে এখানে একটা কেস হয়েছে।

কেস, কি কেস? অনিমেষ তাকাল!

অ্যাসিস্টেন্ট সুপারের ঘরে মহিলা এসেছেন।

আচ্ছা! অনিমেষ হেসে ফেলল, কখন?

সেই সন্ধ্যেবলায়, স্টিল চালিয়ে যাচ্ছে। উষ্মা গোবিন্দর গলায় ।

তাতে কি হয়েছে? অনিমেষের মজা লাগছিল।

কি হয়েছে মানে এ হোস্টেলের রুলস অ্যান্ড রেগুলেশণে স্পস্ট লেখা আছে কারো ঘরে মেয়েদের আসা চলবে না, সে মা কিংবা বোন যাই হোক না কেন। আমাদের প্রত্যেকের বেলায় নিয়মটা কড়াকড়ি করে রাখা হয়েছে। এ এস ব্যাচেলার, ওর ক্ষেত্রে তা শিথিল হবে কেন?

কথাটা ঠিক। এ নিয়ে কিছু দিন আগে থম্বোটার বন্ধুর সঙ্গে ওর কথা হয়েছিল। ছেলেটা ব্যবস্থাটাকে গালাগালি দিচ্ছিল! নিয়ম যা তা সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। প্রত্যেক ব্যবস্থার সাদা কালো দুটো দিকই আছে, তা নিয়ে অসন্তোষ থাকলেও লোকে মেনে নেয় যখন দেখে সবাই একই নিয়মে নিয়ন্ত্রিত। এক্ষেত্রে এ এস, নিয়ম ভেঙ্গে নিশ্চয়ই অন্যায় করেছেন। তবু কে বলতে চাইল, যিনি এসেছেন তিনি ওঁর মা বা বোন নয় তো?

গোবিন্দর সঙ্গে ততক্ষণে আরো অনেকেই জুটে গেছে। এতক্ষণ ধরে ব্যাপারটা নিয়ে ওরা জটলা করছিল, ফুঁসছিল, কিন্তু কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছিল না। এখন অনিমেষকে দেখতে পেয়ে অনেকেরই দেখা বা শোনা দৃশ্যটার কথা মনে পড়ল। য়ুনিভারসিটির জি এসের সঙ্গে অনিমেষের যোগাযোগ এবং পুলিশের গুলীতে একদা আহত হওয়ার গল্প। গোবিন্দ বলল, তুমি ক্ষেপেছ! সেরকম হলে আমরা কিছু বলতাম না। শ্রীলা এসেছ।

সে আবার কে?

স্কটিশের মক্ষীরানী । ফোর্থ ইয়ারের পাস ক্যান্ডিডেট। দারুণ অভিনয় করে।

ব্যাপারটা ভাল লাগল না অনিমেষের। কিন্তু এদের এতখানি উত্তেজনার তেমন কি কারণ আছে বোধগম্য হচ্ছিল না। ও শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল, সুপারকে ব্যাপারটা জানাও, জানিয়েছ?

সুপার নেই। তা ছাড়া সুপার কি আর এ এস-এর এগেনস্টে স্টেপ নেবে! ওরা সব এক জাতের লোক। ভিড়ের মধ্যে একটা গলা চেঁচিয়ে উঠল।

অনিমেষ বলল বেশ, তোমরা কি করতে চাও?

মেয়েটাকে এখান থেকে বেরুতে দেব না। একজন বেশ দৃঢ় গলায় জানাল।

সেটা অন্যায় হবে, সুপারের কাছে একটা রিটন কমপ্লেন করলে হয় না? সবাই সব করব। আর একটা গলা মিনমিন করল।

ছিঁড়ে ফেলবে, কোন কাজ হবে না। শালা প্রতি মাসে হাজার হাজার টাকা মারছে আমাদের কলা দেখিয়ে–ও করবে সুবিচার!

মাইরি, মার্বেল প্যালেস ভিখিরীদের এর চেয়ে ভাল খাবার দেয়। ডাল না তো, আমাশার পায়খানা! মাছগুলো ব্লেড দিয়ে কেটে আনে।


অনিমেষ হাত তুলে সবাইকে থামাল। গোলমালটা বাড়তে শুরু করলে কোথায় গিয়ে শেষ হবে তার ঠিক নেই। সে বলল, ব্যাপারটা যদি আমার ওপর ছেড়ে দাও তা হলে আমি চেষ্টা করতে পারে। আমি প্রথমে এ এস-এর সঙ্গে কথা বলব। তোমরা কি আমার সঙ্গে যাবে?

দেখা গেল সবাই এক সঙ্গে যেতে চাইছে। এত লোক গেলে কথা বলা যাবে না। গোবিন্দ আর একটি অবাঙালী ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে অনিমেষ কথা বলতে যাবে ঠিক করল, বাকী সবাই সিঁড়িতে অপেক্ষা করবে। ত্রিদিবকে এই ক্ষুব্ধদের মধ্যে দেখতে পাচ্ছিল না সে। হয়তো হোস্টেলেই নেই, কিংবা সে এইসব বারোয়ারী ঝামেলা পছন্দ করে না। হোস্টেলের সবই ভিড় করে এসেছে, কিন্তু থম্বোটার বন্ধু বা থম্বোটো আসেনি, যদিও আবাঙালী ছাত্রদের সংখ্যা কম নয়। এবারে তো থম্বোটার বন্ধুর অভিযোগ সবচেয়ে বেশী হওয়া উচিত ছিল।

দোতলায় উঠতে অনিমেষ থম্বোটোকে দেখতে পেল। রেলিং-এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।

অনিমেষ হেসে জিজ্ঞাসা করল, হ্যালো, হোয়ার ইজ ইওর ফ্রেণ্ড?

উত্তরে দু কাঁধ নাচিয়ে ঘাড় নেড়ে জানাল থম্বোটো, সে জানে না।

অনিমেষ এক বার ভাবল থম্বোটোর সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলবে কি না, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত পালটালো। সেটা হয়তো থম্বোটা বিদেশী বলে কিংবা ব্যাপারটাকে অতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত নয়, তাই।

অ্যাসিস্টেন্ট সুপারের ঘরটা একদম কোণার দিকে। বড় ঘর, সঙ্গে বাথরুম আছে। এই কোণা থেকে তাকালে হোস্টেলের বাকী অংশটা চোখে পড়ে। ব্যবস্থাটা এইভাবে করা যাতে দুজনের চোখের ওপর ছেলেরা থাকে। এখন অ্যাসিস্টেন্ট সুপারের ঘরের একটা দরজা ভেজানো, পর্দার ফাঁক দিয়ে আলো আসছে বাইরে।

অনিমেষরা দরজার বাইরে এসে দাঁড়াতেই গোবিন্দ বলল, চল, আচমকা ঢুকে হাতে হাতে ধরে ফেলি।

অবাক হয়ে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কি ধরবে? মেয়েটি তো আছেই!

ঘাড় নাড়ল অবুঝ ভঙ্গীতে গোবিন্দ, আরে, সে তো আছে। আমি মাল কট করার কথা বলছি। উল্টাপালটা অবস্থায় থাকলে সবাইকে ডেকে আনবো।

হঠাৎ অনিমেষের মনে হল ব্যাপারটা খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। এরা এই ঘটনাতে এত উত্তেজিত। আনিমেষ বলল, আমরা ভদ্রভাবে বলব এবং তোমরা যদি অন্য কিছু করতে চাও তা হলে আমি নেই।

গোবিন্দ হতাশ ভঙ্গীতে একবার ওর দিকে আর একবার নীচে অপেক্ষায় থাকা ছেলেদের দেখে কোনরকমে বলল, আচ্ছা, ঠিক আছে।

অনিমেষ ভেজানো দরজায় কড়া নাড়ল একবার। এরা এতক্ষণ কথা বলছিল প্রায় ফিসফিসিয়ে কিন্তু ঘরের ভেতর থেকেও তো কোন শব্দ বাইরে আসছিল না! দ্বিতীয়বার করা নাড়তেই এ এস-এর গলা শোনা গেল, আয়।

খুব স্বাভাবিক এবং একটুও নার্ভাসনেস গলায় নেই। ওরা অবাক হল। অনিমেষের মনে হল ভদ্রলোক বোধহয় বুঝতে পারেননি যে ওরা এসেছে।
 
দরজাটা ঠেলে অনিমেষ প্রথমে ভেতরে ঢুকল। জানলার ধারে টেবিলের ওপর ঝুঁকে এ এস কিছু লিখছেন। টেবিল ল্যাম্পের আলো ওঁর মুখ, শরীর এবং ঘরের একটা কোণে ছড়িয়ে আছে। ঘরে এক পাশে বই-এর আলমারি, আলনা আর স্প্রিং-এর খাট। অনিমেষ দেখল একটি মেয়ে সেই খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। শোয়ার ভঙ্গীতে বোঝা যায় যে সে গভীর ঘুমে মগ্ন। এরকম দৃশ্য দেখতে পাবে বলে সামান্য প্রস্তুত ছিল না গোবিন্দরা স্বভাবতই হকচকিয়ে গেল ।

এ এস লিখতে লিখতেই জিজ্ঞাসা করলেন, কি চাই?

আপানার সঙ্গে কথা আছে। অনিমেষ শান্তস্বরে বলল।

চমকে মুখ ঘোরালেন এ এস। মাঝবয়সী ভদ্রলোক এতটা অবাক হয়ে গিয়েছিলেন খানিকক্ষণ মুখ থেকে কথা সরছিল না। হয়তো ভেবেছিলেন ঠাকুর চাকর কেউ এসেছে। তাই খেয়াল করেননি। এখন ওদের দেখে চট করে বিছানায় নজর বুলিয়ে নিলেন। সেখানে কোন প্রতিক্রিয়া নেই। ঘুমুলে মানুষ শিশু হয়ে যায়।

কথা? কিসের কথা? চশমাটা চোখ থেকে সরিয়ে নিলেন ভদ্রলোক।

আপনি একটু বাইরে আসুন। অনিমেষ একটুও উত্তেজিত হচ্ছিল না।

বাইরে যাব কেন? হোয়াট ডু ইউ মিন?

আমরা যে বিষয়ে কথা বলতে এসেছি সেটা ওঁর সামনে শুনতে হয়তো আপনার ভাল লাগবে না। আইন সবার ওপর সমান প্রযোজ্য।

কথাটা বলার সময় লক্ষ্য করল অনিমেষ মেয়েটি ধীরে ধীরে চোখ খুলে শুনছে কথাগুলো। যদিও এখনও উপুড় হয়ে রয়েছে তবু মুখ বালিশের ওপর পাশ ফিরে রাখার ফলে চোখের পাতার নড়াচড়া দেখতে পাচ্ছে সে।

বুঝতেই পারছি না কি বলতে চাইছ!

ভিজিটারদের জন্যে একটা ঘর বাইরে আছে। আপনি সেটা না ব্যবহার করে একজন মহিলাকে ঘরে নিয়ে এসেছেন। এটা অন্য ছেলে করলে তার বিরুদ্ধে ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন নেওয়া হতো।

অপ কোর্স! কিন্তু সে নিয়মটা আমাকে মানতে হবে কে বলল?

কারণ আপনি এই হোস্টেলে থাকেন।

দেখো ছোকরা, এতক্ষণ অনেক বাড়াবাড়ি করেছ, কিন্তু আমি আর এলাউ করব না । তুমি ভুলে যেও না আমি অ্যাসিস্টেন্ট সুপারিনটেনডেন্ট এবং তার জন্য ফ্রি কোয়ার্টার পাচ্ছি। বাট–ইউ আর টু পে ফর অল । তোমরা ছাত্র আর আমি কলেজে পড়াই। কোন সাহসে তোমাদের সঙ্গে আমার কমপেয়ার করছ আমি বুঝতে পারছি না। ভদ্রলোক উত্তেজিত হয়ে পড়লেন।

ঠিকই, আপনি সবই ঠিক বললেন, শুধু আইনটা সবার জন্যই এটা ভুলে গেলেন। আপনি ঘরে মহিলাকে আসতে দিলে সেটা অন্যদের চিত্তচাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। অনেকেই তাই চাইবে, যেহেতু আপনার আদর্শ সামনে আছে। তা ছাড়া হোস্টেলের রুলস অ্যাণ্ড রেগুলেশনে কোথাও বলা নেই যে ছাত্রদের একরকম চলতে হবে আর অবিবাহিত এ এস-এর সাত খুন মাফ। এটা কি ঠিক বললেন?

পরের ব্যাপারে নাক গলানো বাঙালীর নোংরা অভ্যেস। একটুও না নড়ে মহিলাটি কথা বললেন। অনিমেষ দেখল মহিলা কথাটা বলার বলার পর আবার চোখ বন্ধ করলেন।

এ এস বললেন, গেট আউট ফ্রম হিয়ার! আমি তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে চাই না। অনিমেষের পেটের ভেতরে হঠাৎ একটা যন্ত্রণা জন্ম নিল । সে তবু স্বাভাবিক গলায় বলার চেষ্টা করল, কথা আপনাকে বলতে হবে।

মানে?

আমরা যা চাইছি তাই শুনতে হবে।

তুমি আমাকে হুকুম করছ? হাউ ফানি!

হ্যা! কারণ আইন আপনি ভেঙ্গেছেন।

তা কি করতে হবে আমাকে?

ওই মহিলাকে এখনই বাইরে পৌঁছে দিয়ে এসে ছেলেদের কাছে ক্ষমা চান। কারণ ওরা খুব উত্তেজিত।

হো-য়া-ট। জ্বলোকের চোয়াল যেন ঝুলে গেল।

এই সময় মেয়েটি তড়াক করে খাটের ওপর উঠে বসল। ওঠার সময় কাপড়ে টান পড়ায় ওর শরীরের কিছু কিছু জায়গা উন্মুক্ত হয়ে গেলেও সে একটুও অপ্রস্তুত না হয়ে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ঠিকঠাক করে নিল। অনিমেষ দেখল মেয়েটি যথেষ্ট সুন্দরী। এমন একটা সৌন্দর্য যার ধার আছে কিন্তু আধার নেই। একে কোন দিন অনিমেষ দেখেনি। হয়তো ও কলেজ ছাড়ার পর ভরতি হয়েছে। মেয়েটি বলল, হু ইজ হি?

আমার নাম অনিমেষ মিত্র, এই হোস্টেলের একজন বোর্ডার । শুনুন, আমার অনুরোধ আপনি এখনই এখান থেকে চলে যান। যথেষ্ট রাত হয়ে গেছে এবং ছেলেরা উত্তেজিত।

এ এস উঠে দাঁড়ালেন, তুমি–তুমি আমার সামনে ওকে অপমান করছ? আই উইল টিচ ইউ, তোমাকে আমি হোস্টেল থেকে তাড়াবো। ভীষণ বাড় বেড়ে গেছে তোমাদের গেট আউট, গেট আউট ফ্রম মাই রুম!

এতক্ষণে যন্ত্ৰনাটা সারা শরীরে ছড়াল। অনিমেষ প্রথমে ঠাওর করতে পারছিল না সে কি করবে। কিন্তু এত উত্তেজনার মধ্যে সে সূক্ষ্মভাবে একটা চিন্তা করতে পারছিল যে হুট করে কিছু করে ফেলা ঠিক হবে না। সে গোবিন্দদের দিকে তাকিয়ে বলল, উনি যখন ভাল কথায় শুনবেন না তখন আমাদের বাধ্য হতে হচ্ছে ওকে শিক্ষিত করার ব্যবস্থা করতে। চল।

কথাটা শোনামাত্র মেয়েটি খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। যেন এক রাশ বিদ্রুপের নোংরা জল ওদের ওপর ছিটিয়ে দিয়ে আনন্দ পেল সে।
 
বারান্দায় বেরিয়ে এসে অনিমেষ দেখল সিঁড়ির মুখটায় ভিড় মৌমাছির চাকের মত জমে আছে। সঙ্গীদের নিয়ে ওদের কাছে এগিয়ে যেতে ছেলেরা চুপ করল। সবাই বেশ উৎকণ্ঠার সঙ্গে ওর দিকে তাকিয়ে। অনিমেষ বলল, এ এস কোন কথা শুনতে চাইছেন না। আইন নাকি ওঁর ওপর প্রয়োজ্য নয়। আমাকে ভয় দেখিয়েছেন হোস্টেল থেকে তাড়িয়ে দেবেন বলে। রেগে গিয়ে যা-তা কথা বললেন।

সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণ হল যেন, ছেলেরা চিৎকার করে গালাগাল শুরু করে দিল এ এস-এর নাম ধরে। এই গালাগালগুলো হজম করা অনিমেষের পক্ষেও খুব শক্ত ব্যাপার, কারণ সবগুলোই আদিরসাত্মক ও মেয়েটিকে জড়িয়ে ইতর ভাষায় বলা। কেউ কেউ চাইছিল লোকটাকে বাইরে বের করে একটু শিক্ষা দিতে। কিন্তু অনিমেষ বাধা দিল। সবাইকে চুপ করতে সে হাত তুলে অনুরোধ করতে লাগল। শেষ পর্যন্ত গলাগুলো নেমে এলে সে প্রস্তাব দিল, খামকা এমন কিছু আমরা করব না যাতে এ এস সব সুবিধে পেয়ে যান। আমাদের অভিযোগ হল আইন সবার জন্যে এবং এ এস সেটা মানছেন না। তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ কেউ মাথা গরম করো না। এ এস-কে বাইরে যেতে হলে এই বারান্দা দিয়েই যেতে হবে। আমরা সবাই এখানে বসে থাকব। আমাদের মাড়িয়ে তো তিনি যেতে পারছেন না! যতক্ষণ না ভদ্রলোক তার সবরকম আচরণের জন্য ক্ষমা না চাইছেন ততক্ষণ তাকে যেতে দেব না। কি, রাজী?

ঢেউ-এর মত শব্দটা গড়িয়ে এল, সবাই রাজী।

গোবিন্দ প্রশ্ন তুলল, কিন্তু এই মেয়েটা? ও যেতে চাইলে কি হবে?

অনিমেষ হেসে ফেলল প্রশ্নটা বলার ধরনে, না, ওঁকেও যেতে দেওয়া হবে না। কারণ আমি তাকে অনুরোধ করছিলাম চলে যেতে, তিনি বিদ্রূপ করেছেন।

ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠল, ওকে আপনি বলে সম্মান দিও না, অনিমেষদা। কলেজে কত ছেলের বারোটা বাজিয়েছে তা জান না।

আর একজন বলল, তোর বাজায়নি তো?

প্রায় বাজিয়ে দিয়েছিল। তিন মাস ধরে আমার পয়সায় খেয়ে শেষে বলে কিনা তোমরা ছেলেরা সব এক রকম। একটু প্রশ্রয় দিলেই নিজেকে জমিদার ভাবতে শুরু কর।

কথাটা শেষ হলেই সবাই হইহই করে উঠল।

মহূর্তের মধ্যে বারান্দাটা ভরতি হয়ে গেল। সবাই যেন ফুর্তির সঙ্গে গুলতানি শুরু করে দিল। এখন কারো পক্ষে ওদের ডিঙ্গিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এর মধ্যে কে একজন গিয়ে থম্বোটোকে ধরে নিয়ে এল ওখানে। সকলের অনুরোধে সে রেলিং-এ ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে মাউথ অর্গানে ঠোঁট রাখল। একটা ঝমঝমে সুর ক্রমশ হোস্টেলটায় ছড়িয়ে পড়ল। সুরটার মধ্যে এমন একটা মাদকতা আছে যে ছেলেরা একসময় হাততালি দেওয়া শুরু করল তালে তালে। দেওয়ালে ঠেস দিয়ে মাটিতে বসে অনিমেষ এই সুরের মধ্যে থেকেও অন্য কথা ভাবছিল । পেটের যন্ত্রনাটা এখন থিতিয়ে এলেও সমস্ত শরীর অবস করে দিয়েছে। এটা কেন হয় জানা নেই, কিন্তু উত্তেজিত হলেও যদি এইরকম শারীরিক অবস্থা হয় তা হলে?

হঠাৎই সব বাজনা কথাবার্তা আচমকা থেমে গেল। এ. এস. ঘরের বাইরে এসেছেন। সবাই এখন ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছে। এতগুলো ছেলেকে একসঙ্গে যাতায়াতের পথের ওপর বসে থাকতে দেখে এ, এস, যে চিন্তিত তা বুঝতে কোন অসুবিধে হচ্ছিল না। ভদ্রলোক দু পা এগিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়ে গম্ভীর গলায় বললেন, ব্যাপারটা তোমরা ঠিক করছ না। তোমাদের এজন্য শাস্তি পেতে হবে।

সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে কেউ একজন সিটি দিয়ে উঠল, শেয়ালের ডাক ডেকে উঠল কেউ কেউ। এ. এস. চিৎকার করে উঠলেন, স্টপ ইট, সরে যাও এখান থেকে! রাত দশটা বাজে, যে যার নিজের ঘরে ফিরে যাও ইমিডিয়েটলি।

রাসলীলা শেষ হয়ে গেল নাকি? একটা গলা ভেসে এল।

রাসসীলা? কে বলল কথাটা? ছাত্রী অধ্যাপকের কাছে পড়তে এলে তোমরা এইরকম ব্যবহার করবে, ছি ছি!

সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো গলা ছি–ছি–ছি–ছির ধুয়ো তুলল।

এ. এস. এবার অনিমেষের দিকে তাকালে, তুমি তো এদের নেতা, এদের এখান থেকে সরে যেতে বলো।

অনিমেষ বসে বসেই মাথা নাড়ল, তা হয় না, স্যার। প্রথমে আপনাকে ক্ষমা চাইতে হবে।

এবার মেয়েটিকে দেখা গেল। ঘর থেকে বেরিয়ে সে যেভাবে হেঁটে আসছে তাতেই বোঝা যায় যে বেচারার মনের জোর কমে এসেছে। সোজাসুজি অনিমেষের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, আমাকে এবার যেতে দিন।
 
গলার স্বরে এমন একটা কাকুতি ছিল যে অনিমেষ মেয়েটির মুখের দিকে না তাকিয়ে পারল না। মেয়েরা কি দ্রুত নিজেদের মুখ পালটে ফেলতে পারে। সে ঘাড় নেড়ে বলল, আপনি ওঁকে ক্ষমা চাইতে বলুন।

এ এস বললেন, আঃ, তুমি ওদের সঙ্গে কথা বলছ কেন?

মেয়েটি হাত নেড়ে তাকে সরিয়ে দিয়ে বলল, আচ্ছা বলুন, আমার কি দোষ? আমি তো স্যারের কাছে পড়তে এসেছিলাম। হোস্টেলের নিয়মকানুন আমার জানার কথা নয়। যদি উনি অন্যায় করে থাকেন তবে তার দায় আমাকে বইতে হবে?

নেকু রে নেকু–খাও ঢুকু ঢুকু। ছড়া কেটে বলল কেউ।

এ, এস, বললেন, সরে এসো, এই স্কাউনড্রেলগুলো।

মেয়েটি ফুঁসে উঠল, আঃ, চুপ করুন। অনেক বীরত্ব দেখিয়েছেন। ওরা ইচ্ছে করলে আপনাকে ছুঁড়ে নীচে ফেলে দিতে পারে তা জানেন? শুনুন, আপনি মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবুন, একটা মেয়ের পক্ষে এভাবে আটকে থাকা সম্ভব? আমি বাড়িতে কি কৈফিয়ত দেব? মেয়েটি আবার অনিমেষের শরণাপন্ন হল।

নেকু রে নেকু খাও ঢুকু ঢুকু! ছড়া উঠল।

অনিমেষ এবার ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। তারপর মেয়েটির মুখের দিকে একটু তাকিয়ে জবাব দিল, একটু আগের আপনি আর এই আপনি কি এক? যদি তা না হন তা হলে ওঁকে বলুন ক্ষমা চাইতে।

বেশ, আমি ওঁর হয়ে ক্ষমা চাইছি। মেয়েটি বুকে হাত দিল।

ওরে কে কার হচ্ছে দেখ। টিপ্পনী কাটল কেউ ।

কিন্তু আমার যে দেরি হয়ে যাচ্ছে! মেয়েটি প্রায় কেঁদে ফেলল।

বাঃ, একটু আগে তো দেখলাম বেশ আরাম করে ঘুমুচ্ছিলেন। পড়তে এসে কেউ বুঝি ঘুমোয়? গোবিন্দ কথা বলল।

এমন সময় নীচে থেকে কেউ চিৎকার করে জানাল, সুপার এসেছে।

কথাটা শুনে অনিমেষ ছেলেদের দিকে ঘুরে বলল, তোমরা কেউ এখান থেকে নড়বে না। আমি ওঁকে ডাকছি।

ভিড় বাড়িয়ে রেলিং-এর ধারে গিয়ে অনিমেষ নীচে তাকাল। বাস্কেট বলের মাঠের মাঝখানে সুপার দাঁড়িয়ে আছেন। বেঁটেখাটো মানুষটিকে আরো বেঁটে দেখাচ্ছে ওপর থেকে। অনিমেষ চিৎকার করল, স্যার, আপনি একটু ওপরে আসুন।

ভদ্রলোক ওপরে আসবার সময় যেটুকু সময় পেয়েছিলেন তাতেই জেনে গিয়েছিলেন কি ঘটনা ঘটেছে। সিঁড়ির শেষ ধাপে উঠে দাঁড়াতেই অনিমেষ তার সামনে দাঁড়িয়ে স্যার, হোস্টেলের আইন ভেঙ্গেছেন বলে আমরা এ, এস,-কে বলতে গিয়েছিলাম, তাতে উনি খামকা অপমান করেন। তাই ছেলেরা ওকে ঘেরাও করেছে যতক্ষণ না উনি ক্ষমা চান!

কি আইন? ভদ্রলোকের গলা খুবই সরু।

মেয়েদের নিয়ে ঘরে যাওয়াটা গুরুতর অপরাধ। অনিমেষ জানাল।

ওসব আইন আমাকেও মানতে হবে? এ. এস,-এর গলা ভেসে এল।

সুপার বললেন, এরকম ঘটনা এই হোস্টেলে প্রথম হল। যা হোক, কি চাইছ তোমরা?

অনিমেষ বলল, ওঁকে ক্ষমা চাইতে হবে।

সুপার জিজ্ঞাসা করলেন, তাতেই তোমরা খুশী হবে?

আর এরকম ঘটনা যাতে আর না ঘটে তার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। এখানে অনেক ছেলে আছে যারা এর সুযোগ নিতে চাইবে।

আ–চ্ছা! আপনি অ্যাপলজি চেয়ে ব্যাপারটা শেষ করুন। সুপার ছেলেদের মাথা ডিঙ্গিয়ে তাঁর অ্যাসিস্টেন্টের উদ্দেশে বললেন।

স্ট্রেঞ্জং আপনি এ কথা বলছেন? সুপারের দিকে বিস্ময়ে প্রশ্নটা ছুঁড়লেন এ এস।

এবার মেয়েটি বলে উঠল, ঠিকই তো। অন্যায় করলে দোষ স্বীকার করতে লজ্জা নেই কিছু।

ইউ স্টপ! চেঁচিয়ে উঠলেন এ. এস. আপনি কি এই ছেলেদের কাছে ক্ষমা চাইতে বলছেন আমাকে?

হ্যাঁ। একজন মেয়ে এখানে সারা রাত আটকে থাকলে সম্মান বাড়বে না। সুপার কথা শেষ করে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেলেন। তার কোয়ার্টারে যাওয়ার রাস্তা এদিক দিয়ে নেই।

এবার সবাই এ, এস.-এর মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে। ভদ্রলোক দুটো হাত শূন্যে নাচালেন, তারপর বললেন, ওয়েল, যদি এটা অন্যায় হয় আমি তার জন্য ক্ষমা চাইছি।

সঙ্গে সঙ্গে একটা খুশির শব্দ বোমার মত ফাটল। অনিমেষে বলল, তা হলে আইন সবার জন্য, মানছে?

ভদ্রলোক এবারে ঘাড় নেড়ে নিজের ঘরে ফিরে গেলেন। উৎফুল্ল ছেলেরা নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়ল মেয়েটাকে দেখার জন্য।

মেয়েটি এবার অনিমেষকে বলল, একটু কষ্ট করবেন?

বলুন

বুঝতেই পারছেন এখন আমি সবার চোখে কি রকম ছোট হয়ে গেছি। একা একা নীচে নামতে ভয় করছে। আপনি একটু এগিয়ে দেবেন? সত্যি সত্যি ভয় পাবার মত মুখ করল মেয়েটি।

অনিমেষের মাথায় চট করে একটা মতলব খেলে গেল। সে নিরীহ মুখ করে বলল, এতটা ভয় পাওয়ার কোন কারণ ছিল না, তবু আপনি যখন বলছেন তখন আমি একজনকে সঙ্গে দিচ্ছি।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top