What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected কালবেলা- সমরেশ মজুমদার (2 Viewers)

ব্যথার পা মাটি থেকে সামান্য ওপরে রেখে থম্বোটার বন্ধুর কাঁধে ভর রেখে অনিমেষ অন্য পায়ে লাফাতে লাফাতে ট্যাক্সির দিকে এগোল। অনিমেষ লক্ষ্য করল এতে আর ব্যথাটা লাগছে না। শুধু থাই-এর কাছটায় সিরসির করছে। হঠাৎ ওর খেয়াল হল এই ছেলেটির সঙ্গে গতকাল রাত্রে থম্বোটোর ঘরে তার প্রায় মারামারি হবার উপক্রম হয়েছিল। ভারতীয়দের সম্পর্কে একটা হীন মন্তব্য এর মুখ থেকে বেরিয়েছিল। সেই মুহূর্তে এই ছেলেটিকে ওর খুব বাজে টাইপের মনে হয়েছিল। কিন্তু এইরকম পরিস্থিতিতে ও যেভাবে ট্যাক্সি থেকে নেমে এসে অযাচিত ভাবে তাকে সাহায্য করছে গত কালের ঘটনার পর তা কি আশা করা যায়? মানুষের চরিত্র চট করে বোঝা মুশকিল এই সত্য আর একবার প্রমাণিত হল। হাঁটতে হাঁটতে অনিমেষ টের পেল, থম্বোটার বন্ধুর শরীর থেকে অদ্ভূত নেশাধরানো একটা অচেনা গন্ধ বের হচ্ছে। এরকম সচরাচর কোন চেনা মানুষের শরীরে অনিমেষ পায়নি। ট্যাক্সিতে উঠে কোনরকমে বসতে না বসতেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। আচমকা গুলীবর্ষণ শুরু হলে যেমন বিশৃঙ্খল অবস্থা শুরু হয়ে যায় তেমনি বাসস্টপে দাঁড়ানো মানুষেরা এলোমেলো দৌড়ে একটা ছাউনি খুঁজতে লাগল । থম্বোটোর বন্ধু দরজা বন্ধ করে সামনের সিটে গিয়ে বসতেই অনিমেষ ট্যাক্সির অন্য যাত্রীর দিকে তাকাল। পেছনের সিটের ওপাশের জানলা ঘেঁষে ভদ্রমহিল্লা বসে আছেন। এরকম আধুনিক বেশবাসের মহিলাদের উত্তর কলকাতায় দেখা যায় না। অনেক সময় ব্যয় করলে এই রকম প্রসাধন করা যায়। মাথার চুল কোমরের সামান্য নীচে, ফুলে ফেঁপে মেঘের মত হয়ে রয়েছে । হাতকাটা জামা শঙখরঙা বাহুকে এমন সুঠাম সৌন্দর্য দিয়েছে যে চোখ সরানো দায় হয়ে ওঠে। চোখ চোখি হতেই ওর রক্তাক্ত ঠোঁট দুটো সামান্য ফাঁক হয়ে চিকচিকে দাঁতের প্রান্ত দেখা গেল। অনিমেষ অনুমান করল মহিলা হাসছেন।

থম্বোটোর বন্ধু ড্রাইভারের পাশে বসে এদিকে শরীরটাকে ঘোরাল, এনি, অ্যাক্সিডেন্ট? সব কথা সব জায়গায় বলতে ইচ্ছে করে না, অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ। নো ব্লিডিং? আবার প্রশ্ন করে থম্বোটার বন্ধু উত্তর শুনে নিশ্চিন্ত হল। বৃষ্টির মধ্যে ট্যাক্সিটা কিছু দূর যেতেই দাঁড়িয়ে গেল। সামনে জ্যাম। ঠাসাঠাসি হয়ে রয়েছে গাড়িগুলো। বৃষ্টির ছাঁট থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য অনিমেষ ওর দিকে জানলার কাঁচ তুলে দিতে দিতে খেয়াল করল থম্বোটোর বন্ধুর নামটাই তার জানা হয়নি অথচ এর ট্যাক্সিতে সে সিফট নিচ্ছে।

থম্বোটোর বন্ধু বিরক্ত গলায় বলল, ভেরি ব্যাড ট্রাফিক সিস্টেম, ভেরি ব্যাড। এই মুহূর্তে অনিমেষেরও সেটাই মনে হচ্ছে। যেরকম বৃষ্টি চলছে তাতে আর কিছুক্ষণ বাদেই ঠনঠনে কালীবাড়ির সামনে এক কোমর জল দাঁড়িয়ে যাবে। তখন হবে আর এক মুশকিল। ট্যাক্সিওয়ালা বেশ বৃদ্ধ, বোধ হয় উত্তর প্রদেশের লোক, তেমন জল জমে গেলে যদি যেতে রাজী না হয় তা হলেই সোনায় সোহাগা। এই সময় বেশ শব্দ করে কোথায় বাজ পড়তেই মহিলা আঁতকে উঠলেন, ও গড, আমার ভয় করছে। মুখ ফিরিয়ে অনিমেষ দেখল ভদ্রমহিলা সত্যিই ভয় পেয়েছেন। দুটো হাতে কান চাপা দিয়েছে, চোখ আধবোজা। খুব সুন্দরী মেয়েদের ভয় পাওয়া চেহারাটা আদৌ সুন্দর হয় না এটা জানা ছিল না।

থাম্বোটোর বন্ধু ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করল, হাউ ইজ ইওর পেইন?

না, এখন আর ব্যথাটা লাগছে না। হেলান দিয়ে বসতে পেরে শরীরে স্বস্তি ফিরে এসেছে। অনিমেষ ঘাড় নেড়ে হাসতেই ছেলেটা বলল, দেন, মিট মাই ফ্রেন্ড, শিলা সেন। ভেরি হোমলি, রিয়েল সুইট।

এইভাবে কারো সঙ্গে কখনো পরিচিত হয়নি অনিমেষ, মহিলার দিকে তাকিয়ে সে দুটো হাত জোড় করল, আমার নাম অনিমেষ।

সামান্য মাথা দুলিয়ে মহিলা অভিবাদন গ্রহণ করলেন। তারপর কপালে দুটো রেখা ফুটিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি অসুস্থ?

অনিমেষ না বলতে গিয়েও পারল না, পায়ে একটু আঘাত লেগেছে।

পায়ে? কোথায়? মহিলা এতক্ষণে যেন সিরিয়াস হলেন।

অনিমেষ প্যান্টের ওপর দিয়ে জায়গাটা দেখাল।

ওখানে, ওখানে আঘাত লাগল কি করে? ওখানে তো কোন জয়েন্ট নেই।

লাগল, লেগে গেল। অনিমেষ হাসল।

হঠাৎ থম্বোটোর বন্ধু বলে উঠল, আই কান্ট ফলো ইউ। ইংলিশ প্লিজ।

সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভূত মেকী গলায় মহিলা বলে উঠলো, ইস, সব যেন ওকে বুঝতে হবে! আমরা ভাই বাংলায় কথা বলব, না? কেলে ভুতটা ইংরেজিও ভাল জানে না!
 
চমকে উঠল অনিমেষ। ভদ্রমহিলা একি ভাষায় কথা বলছেন? হয়তো এই মহিলার জন্যে কাল রাত্রে থম্বোটোর বন্ধু হইচই করেছিল। এই মহিলাকেই সম্ভবত দারোয়ান রাত আটটার পর আটকে দিয়েছিল। যার জন্যে থম্বোটার বন্ধু অত আন্তরিকভাবে ক্ষিপ্ত হতে পারে তার মুখ থেকে এ ধরনের কথা কল্পনা করা যায় না। তাহলে কি মহিলা শুধু মাত্র কোন স্বার্থের জন্য এই বিদেশী আফ্রিকান ছেলেটির সঙ্গে মিশছেন? কি স্বার্থ হতে পারে সেটা? হঠাৎ ওর খেয়াল হল কলিকাতা শহরটা একটা বিচিত্র জায়গা। কদিন আগে একটা কাগজে পড়ছিল এখানে কয়েক হাজার সুন্দরী কলগার্ল বাস করেন যাদের চেহারা এবং কথাবার্তা খুবই অভিজাত এবং চাক্ষুষ কিছু বোঝা সম্ভব নয়। ইনি কি সেই শ্রেণীর? না, তা হতেই পারে না। সেই বাল্যকাল থেকে, জলপাইগুড়ির বেগুনটুলির পাশের গলিতে যাওয়া ইস্তক, অনিমেষের একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়েছিল, মেয়েরা অভাবের তাড়নায় পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করে। সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায় কোন মেয়ে ওই জীবনযাপন করতে কেন চাইবে? এই মহিলা যে পোশাক এবং প্রসাধন ব্যবহার করেছেন তাতে দারিদ্র্যের কোন চিহ্ন নেই। সে রকম মেয়ে হলে সুদূর আফ্রিকা থেকে এসে থম্বোটোর বন্ধু কেন একে বন্ধু বলে পরিচয় দেবে?

মহিলা হাসলেন এবার, সত্যি সত্যি, কি ভাবছেন?

অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, না তেমন কিছু না।

মহিলা বললেন, তা হলে কিছু একটা তো বটেই। আপনিও কি ওর সঙ্গে একই হোস্টেলে থাকেন? মানে যে হোস্টেলে সব বাচ্চারা থাকে?

থম্বোটোর বন্ধু এবারে অধীর গলায় চেঁচিয়ে উঠল, ইংলিশ, ইংলিশ।

সাট আপ। মহিলা ধমক দিলেন। গলার স্বর চড়ায় উঠলে একটুও পেলবতা থাকে না অনিমেষ লক্ষ্য করল। ডোন্ট বিহেভ লাইক এ কিড। উচ্চারণে সামান্য জড়তা নেই এবং আশ্বর্য ব্যাপার, সাপের মাথায় ধুলোপড়ার মত থম্বোটোর বন্ধু কেমন মিইয়ে গেল বকুনি শুনে। জুলজুল চোখে মহিলার দিকে তাকিয়ে কিছু বোঝার চেষ্টা করতে মহিলা স্তোক হাসি হাসলেন, ইউ নটি বয়। অনিমেষ দেখল থম্বোটার বন্ধু তাতেই নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুরে সোজা হয়ে বসে সামনের পাড়িগুলো লক্ষ্য করতে লাগল এবার।

মহিলা বললেন, এরা এমনিতে খুব রাফ হয়, কিন্তু ট্যাকল করতে পারলে এদের মত সহজ শিশু পৃথিবীতে আর সেই। হ্যাঁ, বলছিলাম, আপনাদের হোস্টেলের অমন নিয়ম কেন?

অনিমেষ বলল, ওটা কলেজ স্টুডেন্টদের থাকার জায়গা। তাই কিছু কিছু নিয়ম করতেই হয়। আমরা যারা কলেজ ছাড়িয়ে গেছি তারাও নিয়মটাকে মানি।

মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি কলেজে পড়েন না?

এটা এক রকমের কলেজ বটে, আমি এম এ পড়ি।

ও মা, তাই নাকি! কি ভাল ছেলে গো! হোস্টেলে থাক, তোমার বাড়ি কোথায় ভাই?

জলপাইগুড়ির কাছে একটা চা-বাগানে।

চা-বাগান? ও মা নিজেদের চা-বাগান আছে? মহিলা দ্রুত অনিমেষের গা ঘেঁষে এসে বসলেন, চা বাগান খুব সুন্দর জায়গা, না? দার্জিলিং-এ যেতে আমি দু চোখ ভরে দেখেছি। কেমন স্বপ্নের মত দেখতে না? আমার খুব যেতে ইচ্ছে করে।

অনিমেষ হকচকিয়ে গিয়েছিল মহিলার ভাবভঙ্গীতে। একটু ধাতস্থ হয়ে সে প্রতিবাদ করতে গেল যে তাদের নিজেদের কোন চায়ের বাগান নেই। চায়ের বাগানের মালিকরা প্রচুর টাকার মালিক, তার বাবা একটি ইওরোপীয় মালিকানায় পরিচালিত চা-বাগানে চাকরি করেন মাত্র। কিন্তু এ কথাগুলো বলার আগেই থম্বোটোর বন্ধু চিৎকার করে উঠল সামনের সিট থেকে। চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে হয়ে গেল অভিনব দৃশ্য। থম্বোটোর বন্ধু তিড়িং করে লাফিয়ে জুতোসুদ্ধ গাড়ির সিটের ওপর বসে বিশুদ্ধ মাতৃভাষায় অনর্গল কিছু বলে যেতে লাগল যার এক বর্ণ অনিমেষ বুঝতে পারছে না। উত্তেজিত এবং ভয় পাওয়া মুখ, দুটো আঙুল সামনের পা রাখার জায়গার দিকে উঁচিয়ে ধরেছে। বুড়ো ট্যাক্সি ড্রাইভার প্রথমে ঘাবড়ে গিয়েছিল কালো সাহেবের চালচলন দেখে। কিন্তু সিটের উপর জুতো তুলে উঠে বসতে দেখে সে নিশ্চয়ই বিরক্ত হয়েছিল। কারণ সাহেবের উত্তেজনার কারণটা অনুসন্ধান করতে তাকে নীচের দিকে ঝুঁকে তাকাতে দেখা গেল। অনিমেষ উঠে ব্যাপারটা কি বোঝার চেষ্টা করতে গিয়ে থমকে গেল। এখন কোনরকম নড়াচড়া আবার যন্ত্রণাটাকে ফিরিয়ে আনতে পারে। ভদ্রমহিলা ট্যাক্সির মধ্যে যতটা পারেন উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করায় তার শরীরের অনেকটা অনিমেষের ওপর চেপে গেছে, একজন রমণীর শরীর নাম শুধুমাত্র, প্রবল চাপের জন্যই অনিমেষের প্রাণ বেরুবার দায়। এতক্ষণে ড্রাইভার বস্তুটিকে আবিষ্কার করে ফেলেছে। একটি নধর কালো কুচকুচে আরশোলা হাতের মুঠোয় নিয়ে সে বিরক্তির সঙ্গে একবার সবাইকে দেখিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল বাইরে।
 
যেন সোডার বোতল খুলে গেল হঠাৎ, মহিলা খিলখিল করে উম্মাদ ভঙ্গীতে হাসতে হাসতে পেছনের সিটে লুটিয়ে পড়লেন। অনিমেষ দেখল ওঁর গায়ের আঁচল নীচে লুটিয়ে পড়েছে, বড় গলার কালো সিল্কের ব্লাউজ তার বিশাল বক্ষকে আবদ্ধ করতে পারছে না। অনিমেষ নিজের অজান্তেই সেদিকে তাকিয়েছিল। হাসতে হাসতেই সেটা লক্ষ্য করে মহিলা। অদ্ভূত ভঙ্গীতে অনিমেষকে টুসকে দিয়ে আঁচল ঠিক করে নিয়ে বলে উঠলেন, ওরে বাবা, কি বীরপুরুষ রে! একটা আরশোলা দেখে ভিরমি খাচ্ছেন, আবার মুখে বড় বড় রাজ সিংহের দেশের লোক আমি, গরিলার দেশের লোক আমি।

বাইরে ফুটপাতের পাশে পড়ে থাকা আরশোলাটার দিকে জুলজুল করে তাকিয়েছিল থম্বোটার বন্ধু। উত্তেজনাটা এখন থিতিয়েছে। তারপর পা দুটো সন্তর্পণে নীচে নামিয়ে আর একবার ভাল করে দেখে নিল জায়গাটা, দেখে পেছনের সিটের দিকে ফিরে মুক্তোর মত দাঁত বের করে হাসল, আই কান্ট স্ট্যান্ড।

খুব গর্বের কথা, আবার চেঁচিয়ে বলা হচ্ছে। মহিলা টিপ্পনী কাটলেন। এতক্ষণে ট্যাক্সিটা আবার চলতে শুরু করেছে। সামনের জট খুলতেই গাড়িগুলো শামুকের মত এগোচ্ছে। একটু বাদেই মনে হল ওরা বিরাট নদীর মধ্যে এসে পড়েছে। ফুটপাত দেখা যাচ্ছে না। জলের ঢেউ দুপাশের দোকানের মধ্যে ঢুকে পড়ার উপক্রম। থম্বোটোর বন্ধু সোৎসাহে বলে উঠল, হাউ ফানি, উই আর সেইলিং।

অনিমেষেরও মজা লাগছিল কিন্তু সেই সঙ্গে একটা ভয়ও ছিল, যদি ইঞ্জিনে জল ঢুকে যায় তা হলে চিত্তির। এখানে জলবন্দী হয়ে কতক্ষণ বসে থাকতে হবে কে জানে। ড্রাইভার সামনে নিজের মনে গালাগাল দিয়ে যাচ্ছে। একটু একটু করে জল ভেঙ্গে গাড়ি এগোচ্ছে যেন কতটা পথ আসা হল। অদ্ভূত উত্তেজনার মধ্যে বিদ্যাসাগর কলেজ ছাড়িয়ে আসতে সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। এখন আর জল কিংবা জ্যাম নেই। ভেজা রাস্তা দিয়ে এগোতে দেখা গেল সারবন্দী হয়ে ট্রাম দাঁড়িয়ে আছে। অনিমেষ বলল, খুব জোর বাঁচা গেল।

মহিলা চোখ বড় করে বললেন, গাড়িটা আটকে থাকলে খারাপ লাগত নাকি? বেশ তো আমরা অনেকক্ষণ গল্প করতে পারতাম।

অনিমেষ এর উত্তরে কি বলবে বুঝতে না পেরে হাসল ।

কিন্তু আমি ভাবছি, পায়ে যখন এত যন্ত্রণা, হাঁটা যাচ্ছে না তখন একা একা হোস্টেলে থাকা যাবে কি করে। ওটা তো আর বাড়ি নয় যে কেউ সেবাশুশ্রূষা করবে।

অনিমেষ বলল, না, না একটু শুয়ে থাকলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

মহিলা বললেন, যদি না হয়। আমার ইচ্ছে করছে বাড়িতে নিয়ে যাই। কারো কষ্ট হচ্ছে ভাবলে এত খারাপ লাগে, মন কেমন হয়ে যায়।

অনিমেষ লজ্জা পেল, আপনি কিছু ভাবলেন না।

মহিলা বললেন, ভাবব না কি কথা! আলাপ হল আর ভাবব না? ঠিক আছে, কেমন থাকা হচ্ছে আমায় যদি জানিয়ে দেওয়া হয় তা হলে নিশ্চিন্ত হই। আমার নম্বর হচ্ছে পঁয়ত্রিশ চারটে শূন্য। মনে থাকবে? খুব সোজা। শুধু এক্সচেঞ্জ নম্বরটা মনে রাখলেই হল, তারপর সব ফাঁকা। ইংরেজীতে বললাম না, সামনের দুটো কান এদিকে খাড়া হয়ে আছে। কথা বলতে বলতে, গলার স্বর নীচে নেমে এল, ফিসফিস শোনাল।

এত অল্প পরিচয়ে, বলতে গেলে মাত্র কয়েক মিনিটের বলা যায়, কোন মহিলা এ রকম আন্তরিক ভঙ্গীতে আমন্ত্রণ জানাতে পারে। অনিমেষের মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। হঠাৎ ওর মনে হল তার নিজের মনে নিশ্চয়ই কু আছে। মহিলা তার আহত হবার সংবাদ শুনে স্নেহপ্রবণ হয়ে তার সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে চাইতে পারেন তাতে অস্বাভাবিক কি আছে? সে হয়তো মিছেই ব্যাপারটাকে সন্দেহের চোখে দেখছে।
 
হেদার আগের গলি দিয়ে ট্যাক্সিটাকে ঘোরাতে বললেন মহিলা। স্কটিশের পাশ দিয়ে ট্যাক্সি অনেকটা এগিয়ে একটা লাল রঙের বাড়ির সামনে থামতেই মহিলা একটু অপ্রসন্ন চোখে বৃষ্টির দিকে তাকালেন। এখন বৃষ্টির সেই তেজটা নেই, কিন্তু যেভাবে পড়ছে তাতে একটু হাঁটলেই ভিজে যাওয়া অসম্ভব নয়।

এই বৃষ্টির মধ্যেই থম্বোটোর বন্ধু লাফিয়ে নেমে পড়ল ট্যাক্সি থেকে। নেমে গাড়িটাকে পাক দিয়ে এ পাশের দরজায় এসে সেটাকে খুলে ধরল, মে আই গো উইদ ইউ? মহিলা পুতুলের মত ঘাড় নাড়লেন, নট টু নাইট ডার্লিং। তারপর অনিমেষের দিকে ফিরে বললেন, চলি ভাই, মনে থাকে যেন। কথা শেষ করেই উনি প্রায় দৌড়ে খোলা জায়গাটা পেরিয়ে লাল বাড়িটার ভেতরে ঢুকে গেলেন। অনিমেষ দেখল নামবার আগে মহিলা দ্রুত হাতে আঁচলটাকে ঘোমটার মত আড়াল করে নিয়েছিলেন এবং চলে যাওয়ার সময় একবারও পেছন ফিরে তাকলেন না। বৃষ্টির জন্য রাস্তা ফাঁকা, রকগুলোতেও কেউ নেই।

থম্বোটার বন্ধু অকপটে সেই চলে যাওয়া দেখল। বৃষ্টিতে ভিজে যে একসা হয়ে গেছে সেদিকে একটুও খেয়াল নেই। তারপর শব্দ করে একটা নিশ্বাস ফেলে অনিমেষের পাশে উঠে বলল, সিট ভিজে যাচ্ছে বলে ড্রাইভার বিরক্ত প্রকাশ করতেই সে ঘাড় নেড়ে হাউহাউ করে, নিজের ভাষায় কিছু বলে সোজা হয়ে বসল। অনিমেষ ড্রাইভারকে কিছু মনে না করতে বলে হোস্টেলের ঠিকানাটা জানিয়ে দিতে আবার ট্যাক্সি চলা শুরু করল।

থম্বোটার বন্ধু অনিমেষের হাতের ওপর হাত রেখে জিজ্ঞেস করল, শি টকড অ্যাবাউট মি?

অনিমেষ বুঝল মহিলাকে জরিপ করার চেষ্টা করছে ছেলেটা। সে ঘাড় নেড়ে জানাল, হ্যাঁ।

টেল মি হোয়াট শি টোলড ইউ!

অনিমেষ খুব অস্বস্তিতে ওর দিকে তাকাল। মহিলার কথাবার্তা খুব স্বচ্ছন্দ ছিল না। বোঝাই যাচ্ছিল থম্বোটার বন্ধু সম্পর্কে মহিলার কিছুমাত্র আন্তরিক ধারণা নেই। কিন্তু ওসব কথা এই ছেলেটিকে কি করে বলা যায়। এর হাবভাবে মহিলাটি সম্পর্কে প্রচন্ড আগ্রহ স্পষ্ট। ও রকম চললে শেষ পর্যন্ত হয়তো চূড়ান্ত আঘাত পাবে ছেলেটি। অনিমেষের মনে হল কথাটা থম্বোটাকে খুলে বলা যায়। যদি কিছু সাবধানবাণী ওকে শুনতে হয় তা হলে তা থম্বোটার মুখ থেকেই শোনা ভাল । কিন্তু এখন একে কি বলা যায়! তীব্র চাহনি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে অনিমেষ বলল, শি টোলড মি দ্যাট ইউ আর এ ভেরি গুড বয়। অ্যান্ড অল দিজ প্রেইজি ওয়ার্ডস।

চোখ বন্ধ করল থম্বোটার বন্ধু। তারপর খুব গাঢ় গলায় বলল, আই নেভার লফড ওম্যান বিফোর হার। শি ইজ সামথিং।

হোস্টেলের সামনে ট্যাক্সিটা দাঁড়াতে থম্বোটোর বন্ধু ভাড়া মিটিয়ে দিল । প্রায় পনের টাকার মত মিটারে উঠেছে। অনিমেষ দেখল ওর পার্সে থোকা থোকা নোট। চট করে অনুমান করা যায় না টাকার অঙ্কটা। এত টাকা কোন দিন একসঙ্গে হাত দিয়ে ধরেনি অনিমেষ। পার্সটা যেভাবে ছেলেটা হিপ পকেটে গুঁজে রাখল তাতে বিন্দুমাত্র সতর্কতা নেই। ট্যাক্সি থেকে নামতে গিয়েই সমস্ত শরীর দুলে উঠল অনিমেষের। এতক্ষণ যে বসেছিল সেটা ছিল এক রকম, ব্যথাটার কোন অস্তিত্ব ছিল না। এখন মাটিতে পা দিয়ে শরীরের ভার রাখতেই মনে হল থাই থেকে একটা আগুনের গোলা পাক খেয়ে কোমরে উঠে এল। যন্ত্রণাটাকে দাঁত চেপে সামলালো অনিমেষ । দুচোখে পলকেই জল এসে গেল । থম্বোটোর বন্ধু সমস্ত ঘটনা চুপচাপ লক্ষ্য করছিল। এখন বৃষ্টি টুপটাপ পড়ছে। নিঃশব্দে এগিয়ে এসে অদ্ভূত কায়দায় ছেলেটা অনিমেষকে কাঁধে তুলে নিল । ব্যাপারটা এমন আকস্মিক এবং সহজ ভঙ্গীতে ঘটল যে অনিমেষ হতবুদ্ধি হয়ে গেল। খুব কায়দা করে ওকে ধরে ছেলেটি সিঁড়ি অবধি হেঁটে গেল। থম্বোটোর বন্ধুটি মোটেই স্বাস্থ্যবান নয় কিন্তু ওর গায়ে যে এত শক্তি আছে তা অনুমান করা যায় না। সাবধানে সিঁড়ির গোড়ায় ওকে নামিয়ে দিয়ে ছেলেটা জিজ্ঞাসা করল, হোয়াটস ইত্তর রুম নাম্বার?

অনিমেষ জানাতেই সে দ্রুত ওপরে উঠে গেল। রেলিং ধরে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকল অনিমেষ।
 
হোস্টেলের গেটটা ভেজানো ছিল, থম্বোটার বন্ধু সেটাকে ঠেলে ঢুকছে। বাঁ দিকে দারোয়ানের ঘর থেকে তুলসীদাসী রামায়ণের সুর ভেসে আসছে। এখন বোধ হয় প্রায় নটা বেজে গেছে। এতক্ষণ খেয়াল হয়নি, এবার অনিমেষের মনে হল আবার কি ওকে হাসপাতালে গিয়ে এক বছর বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে। প্রচন্ড আশঙ্কায় কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল অনিমেষ। এইভাবে পঙ্গুর মত সমস্ত জীবন কাটানোর চাইতে মরে যাওয়া ঢের ভাল। সারা জীবন টিপটিপ করে বেঁচে থাকার কোন মানে হয় না। নানারকম কণ্ঠস্বর ভেসে এল ওপরে, অনিমেষ দেখল ত্রিদিব আরো কয়েকজনকে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে নীচে নেমে আসছে। এক দৌড়ে কাছে এসে অনিমেষকে জিজ্ঞাসা করল ত্রিদিব, কি হয়েছে? শুনলাম খুব উন্ডেড হয়েছ। অনিমেষ দেখল আরো কয়েকজন তাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে আর প্রত্যেকের মুখচোখে উদ্বেগ স্পষ্ট; অনিমেষ খুব অস্বস্তিতে পড়ল, এরকমটা হবে ভাবেনি সে। সিঁড়ির ওপর দিকে থম্বোটার বন্ধু নির্লিপ্তের মত দাঁড়িয়ে ছিল, চোখাচোখি হতে হাত নেড়ে চলে গেল নিজের ঘরের দিকে। যেন ওর কর্তব্য শেষ, এরকম ভাব।

অনিমেষ বলল, ট্রামে উঠতে হঠাৎ জখম পায়ে ব্যথা হল। তারপর থেকে আর হাঁটতে পারছি না। এখন যন্ত্রণাটা না হাঁটলে হচ্ছে না।

ত্রিদিব ধমকে উঠল, নিশ্চয়ই রানিং ট্রামে উঠছিলে?

অমিমেষ অস্বীকার করল না, হ্যাঁ, বুঝতে পারছি না জোড়া হাড় ভাঙল কি না!

ভিড়ের মধ্যে দুর্গাপদ ও গোবিন্দকে দেখতে পেল অনিমেষ। গোবিন্দ ত্রিদিবকে বলল, সিক রুমে নিতে হবে?

অনিমেষ বলল, না, না, সিক রুমে নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই। তোমরা একটু হেল্প করো, নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ি।

ওরা কোন কথা শুনল না, অনিমেষকে ধরাধরি করে মাথার ওপর তুলে সন্তর্পণে ওর ঘরে ফিরিয়ে আনল। খাটে শুইয়ে দিয়ে ত্রিদিব ভিড়টাকে সরাল। ঘরে শুধু গোবিন্দ আর দুর্গাপদ রয়ে গেল। ত্রিদিব গোবিন্দকে ফিসফিসিয়ে কিছু বলতে সে ছুটে বেরিয়ে গেল।

দুর্গাপদ জিজ্ঞাসা করল, ব্যাথাটা ঠিক কোথায় হচ্ছে?

অনিমেষ হাত দিয়ে থাই দেখাতে ওরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। অনিমেষের মনে হল এরা খুব ঘাবড়ে গেছে।

ত্রিদিব জিজ্ঞাসা করল, জায়গাটা দেখেছ?

ঘাড় নাড়ল অনিমেষ। তার নিজের পক্ষে প্যান্টের পা গুটিয়ে থাই দেখা সম্ভব নয়। আর নিশ্চয়ই জায়গাটার বাইরে কিছু হয়নি, রক্তটক্ত বেরুবার প্রশ্ন উঠতে পারে না।

ত্রিদিব বলল, ইজি হয়ে শুয়ে থাক, কোন চিন্তা করো না, আমি দেখছি।

দুর্গাপদ ওর শার্ট খুলে নিল, ঘামে গেঞ্জি সপসপ করছে। সেটাকে খুলে ফেলতে বেশ আরাম লাগল। ত্রিদিব প্যান্টের বোতামে হাত দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আন্ডার প্যান্ট পরা আছে?

প্রশ্নটা শুনে হেসে ফেলল অনিমেষ। কাল রাত্রে মদ্যপান করে এসে ত্রিদিবরা ওর ওপর যখন জুলুম করেছিল, জোর করে উলঙ্গ করেছিল তখন একথা একবারও চিন্তা করেনি। অথচ আজ খুব ভদ্রভাবে জেনে নিচ্ছে যাতে অনিমেষ লজ্জায় না পড়ে। ওকে হাসতে দেখে ত্রিদিব জিজ্ঞাসা করল, হাসির কি হল?

অনিমেষ বলল, কিছু না। আন্ডার প্যান্ট পরাই আছে। তোমরা আমাকে একটু ধর, আমি নিজেই প্যান্ট চেঞ্জ করে নিচ্ছি।

ওরা সে কথায় কান না দিয়ে প্যান্টটা সন্তর্পণে অনিমেষের শরীর থেকে এমনভাবে খুলে নিল যাতে ওর একটুও ব্যথা না লাগে । দুর্গাপদ অনিমেষের থাই-এর ওপর ঝুঁকে পড়ে ভাল করে দেখে বলল, কোথাও তো ফোলা দেখছি না, কিন্তু তোমার বুলেট মার্কের নীচে বেশ কিছুটা জায়গা লাল হয়ে আছে। বোধ হয় ওখানেই কিছু হয়েছে।
 
ত্রিদিব লাল জায়গাটায় হাত রেখে বলল, ওরে ফাদার! একদম গেছে। গর্ত হয়ে গিয়েছে। একদম নড়াচড়া করবে না চুপচাপ শুয়ে থাকো। একটা পাতলা চাদর নিজের বিছানা থেকে তুলে এনে সে অনিমেষের কোমর অবধি ঢেকে দিল।

একটু বাদেই গোবিন্দ ফিরে এর, সঙ্গে হোস্টেলের ডাক্তার আর হোস্টেলের মেনেজার মিস্টার দত্ত। হোস্টেলের ডাক্তারকে সবাই আড়ালে ঘোড়ার ডাক্তার বলে। ওঁর চিকিৎসায় নাকি কখনো কোন রুগী সারে না। সব রকম অসুখেই তিনি একই মিকচার আর ট্যাবলেট ঘুরিয়ে দেন। এককালে ছেলেরা এ নিয়ে রাগারাগি করেছে। কোন ফল হয়নি। উনি ছেলেদের কাছ থেকে কোন ফি নেন না, হোস্টেলের সঙ্গে তার একটা মাসকাবারী ব্যবস্থা আছে। অথচ এই হোস্টেলের কারো কোন অসুখ হলে বাইরের অন্য কোন ডাক্তারকে ডাকা যাবে না, ইনি যদি সুপারিশ না করেন।

ডাক্তার সেন হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞাসা করলেন, কি হয়েছে, কি হয়েছে।

একটা কথা দুবার বলা তার অভ্যেস, কথা বলেন হড়বড়িয়ে। ত্রিদিব বলল, ওর পায়ে খুব লেগেছে ট্রামে উঠতে গিয়ে, হাঁটতে পারছে না।

লেগেছে মানে কি? ট্রাম থেকে পড়ে গিয়েছে? একটা চেয়ার বিছানার পাশে টেনে এনে বসলেন ডাক্তার সেন।

ত্রিদিব বলল, না, উঠতে গিয়ে।

পেশেন্ট কে, পেশেন্ট কে? পেশেন্টকে বলতে দিন। ডাক্তার সেন বললেন।

অনিমেষ যতটা পারে সংক্ষেপে আজকের ঘটনাটা বলতেই ডাক্তার হুম বলে মিস্টার দত্তের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন, মশা মারতে কামান দাগা মশাই। এর জন্যে আমাকে ডাকার কোন দরকার ছিল না, কোন দরকার ছিল না। সিম্পল ব্যাপার, শিরায় টান লেগেছে, ছেলেমানুষের কারবার।

কথা শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন ডক্টর সেন। অনিমেষ বন্ধুদের চোখে মুখে প্রতিক্রিয়া দেখে দ্রুত বলে ফেলল, আমার পায়ের ঠিক এই জায়গায় হাড় পাঁচ বছর আগে ভেঙ্গে দু-টুকরো হয়ে গিয়েছিল।

অ্যাঁ? চমকে উঠলেন ডক্টর সেন, ওখানকার হাড় হাউ? অ্যা

ক্সিডেন্টে। অনিমেষ মিস্টার দত্তের সামনে বুলেটের কথাটা বলতে চাইল না। আবার ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে অনিমেষের পা থেকে চাদর সরিয়ে ফেললেন ডক্টর সেন। পুরোনো অপারেশনের জায়গাটা চোখে পড়তেই বিড়বিড় করে বললেন, মেজর অপারেশান হয়েছিল দেখছি। তারপর ধীরে ধীরে দুহাত দিয়ে অনিমেষের পা ধরে সেটাকে ভাঁজ করলেন, লাগছে ফিলিং পেইন?

না, হাঁটুর কাছ কোন ব্যথা নেই, অনিমেষ জানাল।

এবার থাই-এর মাংস ঠুকে ঠুকে দেখলেন ডাক্তার সেন আর একই প্রশ্ন করে চললেন। কিন্তু অনিমেষ কোন ব্যথা অনুভব করছিল না। পকেট থেকে রুমাল বের করে ডাক্তার সেন নাকের ডগা মুছে নিয়ে অন্য পকেট থেকে প্যাড বের করলেন। তারপর খসখস্ করে প্রেসক্রিপশান লিখে অনিমেষের হাতে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, আজ রাত্রে খুব ব্যথা যদি হয় তবে অ্যানাসিন টাইপের কোন ট্যাবলেট খেয়ে নিও। চলি। আর দাঁড়ালেন না তিনি, মিস্টার দত্তের সঙ্গে হনহন করে বেরিয়ে গেলেন।

অনিমেষের হাত থেকে প্রেসক্রিপশনটা নিয়ে ত্রিদিব চেঁচিয়ে সবাইকে পড়ে শোনাল, অ্যাডভাইস কনসালট এনি অর্থপেডিক ইমিডিয়েটলি। যা শালা! এর জন্য তোকে ডাকব কেন? ঘোড়ার ডাক্তার! গোবিন্দ খিঁচিয়ে উঠল, ঘোড়ার ডাক্তার হলে তবু কথা ছিল, এ ব্যাটা নিশ্চয়ই কাকেদের চিকিৎসা করে। কারণ, কাকেদের কখনো অসুখ করে না।

দুর্গাপদ এগিয়ে এসে অনিমেষের বিছানায় বসল, তোমার কি এখন অস্বস্তি হচ্ছে অনিমেষ?

অনিমেষ বলল, আমি উঠে দাঁড়ালে বুঝতে পারব।

দুর্গাপদ বলল, তা হলে ওঠার দরকার নেই। স্বাভাবিক বুদ্ধিতে বলে যদি কারো হাড় ভাঙ্গে তবে তা সেট না করা পর্যন্ত যন্ত্রণা অসহ্য হয়। আমার মনে হচ্ছে তোমার পায়ের কোন লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেছে। আমার দাদার একবার হয়েছিল। ডাক্তার বলেছিলেন লিগামেন্ট ছিঁড়লে যেন কখনো মালিশ না করা হয়, ক্রেপ ব্যান্ডেজ দিয়ে বেঁধে রাখাই যথেষ্ট।

ত্রিদিব বলল, কিন্তু ব্যান্ডেজটা করবে কোথায়?

দুর্গাপদ এবার অনিমেষের পা নিয়ে পড়ল। মিনিট কয়েকের মধ্যে সে থাই-এর নীচের দিকে হাঁটুর সামান্য ওপরে একটা জায়গা আবিষ্কার করে ফেলল যেখানে হাত দিলেই অনিমেষ চিৎকার করে উঠছে। জায়গাটায় কোন বড় শিরা নেই। চিৎকারের সময় অনিমেষের মুখ নীল হয়ে যাচ্ছে এটা লক্ষ্য করল সবাই।

ত্রিদিব চাপা গলায় বলল, সাধে কি ঘোড়ার ডাক্তার বলেছি, খালি বাকতল্লা!

গোবিন্দ বলল, গরম সেঁক দিলে হয় না?

দুর্গাপদ বলল, সেঁক দিলে খারাপ হবে না তো?

গোবিন্দ বলল, বাড়িতে তো সবাইকে সেঁক দিতেই দেখেছি।
 
দ্রুত ব্যবস্থা হয়ে গেল। কিচেন থেকে একটা ছোট্ট কয়লার উনুন নিয়ে আসা হল। দুর্গাপদ যখন সেঁক দিচ্ছে তখন বেশ আরাম হচ্ছিল অনিমেষের। অনেকক্ষণ পরে স্বস্তি আসায় ওর দু-চোখ বুঁজে এল এক সময়।

দুর্গাপদ জিজ্ঞাসা করল, অনিমেষ, তুমি খাবে না?

এখন ঘুম ছাড়া আর কিছু ইচ্ছে করছে না অনিমেষের। সে চোখে বুঁজে মাখা নাড়ল না, খাবে না। দুর্গাপদ আর পিড়াপিড়ি করল না।

তখন নিশ্চয়ই মধ্যরাত, অনিমেসের ঘুম ভেঙ্গে গেল। হুঁশ ফিরতেই ওর মনে হল পেটে ছুঁচো ডন মারছে। ধীরে ধীরে উঠে বসতেই সে অদ্ভূত দৃশ্য দেখতে পেল। ত্রিদিবের বিছানায় বসে গোবিন্দ আর দুর্গাপদ তাস খেলছে। পাশে মাটিতে রাখা কয়লার উনুনটা নিবে গেছে কখন। ত্রিদিব তাতেই ভাঁজ করা কাপড়টা গরম করার চেষ্টা করে তার পায়ে সেঁক দিয়ে চলেছে। অনিমেষ এমন হতভম্ব হয়েছিল যে মুখ থেকে তার কথা সরল না। এই ছেলেগুলো তাকে সেবা করার জন্য একটা রাত জেগে আছে। অথচ গত কাল এদেরই অন্যরকম চেহারা ছিল, মাতাল তিনটি যুবক অশ্লীলতার চূড়ান্ত করেছিল।

ওকে জাগতে দেখে ত্রিদিব সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করল, কেমন, আরাম পাচ্ছ?

অনিমেষ থাই-এর তলায় হাত দিয়ে আবিষ্কার করল, সেই পিন-ছোঁয়া যন্ত্রনা একদম নেই, শুধু জায়গাটা অসাড় হয়ে আছে। লজ্জিত গলায় অনিমেষ বলল, আমি ঠিক হয়ে গেছি, তোমাদের আর রাত জাগতে হবে না, এবার শুয়ে পড়।

খেলা থামিয়ে গোবিন্দ বলল, আরে শুরু রাত আর কোথায়? আর মাত্র এক ঘন্টা তার পরেই ফুড়ুত করে আকাশ ফরসা হয়ে যাবে। বাট, তুমি ফিট তো?

দুটো হাতে বিছানায় ভর দিয়ে অনিমেষ বলল, একবার উঠে দাঁড়ালে বুঝতে পারব। সঙ্গে সঙ্গে হাঁ হাঁ করে উঠল ত্রিদিব, না, না, আজ রাত্রে উঠতে হবে না।

দুর্পাপদ জিজ্ঞাসা করল, কেন? উঠে দেখুক গড়বড় আছে কিনা।

কাল সকালে দেখবে। উঠলে যদি ব্যথা লাগে তা হলে এখনই মন খারাপ হয়ে যাবে আমার। যতক্ষণ অনিমেষের ব্যথা না হচ্ছে ততক্ষণ মনে হবে ও সুস্থ হয়ে গেছে। ত্রিদিব হাসল ।

দুর্গাপদ চাপা গলায় বলে উঠল, কবিরা মাইরি এক নম্বরের এসকেপিস্ট।

খিদে পাচ্ছে খুব, কিন্তু ঘরে কিছু নেই যা খাওয়া যায়। ত্রিদিবের স্টকে অবশ্য বিস্কুট থাকে, ক্রিম দেওয়া বিস্কুট। হোস্টেলের ঠাকুরকে ডাকতে গেলে মারতে আসবে। অনিমেষ ত্রিদিবকে বলল, কয়েকটা বিস্কুট দাও তো খাব।

বিস্কুট? অবাক চোখে তাকাল ত্রিদিব, এত রাতে বিস্কুট কেন? ওহো, তুমি তো রাত্রে কিছু খাওনি। যা শালা! এক লাফে উঠে ত্রিদিব তার সেলফ থেকে চৌকো টিনটা বের করে ঢাকনা খুলল। তারপর হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, ইস, বিকেলে কিনব ভেবেছিলাম, একদম ভুলে গেছি। মাপ কর গুরু, একদম ইয়াদ ছিল না, দু-তিনটে ভাঙ্গা পড়ে আছে।

খাবার কিছু না পেয়ে অনিমেষ ভাবল চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লে নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়বে, ঘুমালে খিদে লাগবে না। কিন্তু খিদে যখন প্রবল হয় তখন যে ঘুম আসতে চায় না! সে এক গ্লাস জল চাইল। জল খেয়ে পেট ভরানো যাক।

দুর্গাপদ বলল, খালি পেটে জল খাবে? তার চেয়ে একটু মাল দিয়ে জল খাও। ওতে প্রোটিন আছে। পেটও ভরবে, নার্ভ ঠিক থাকবে আর যন্ত্রণা দূর হবে।

ত্রিদিব সম্মতির দ্বার নেড়ে লুকোনো জায়গা থেকে কালকের বোতলটা বের করে দ্রুত হাতে একটা গ্লাসে সামান্য ঢেলে জল মিশিয়ে ওর দিকে বাড়িয়ে দিল আঃ, দারুণ ফুলেভার, খেয়ে নাও, অমৃত।

অনিমেষ অবিশ্বাসের গলায় বললে, যাঃ, খামকা মদ খেতে যাব কেন? ত্রিদিব বলল, মদ কথাটা খারাপ। টেক ইট অ্যাজ মেডিসিন, অ্যাজ হেলথ টনিক। শরীর সুস্থ করার জন্য খাওয়া । নাও, হাঁ করো, সেবা করতে দাও।
 
প্রায় পাঁচ বছর অনিমেষ কলকাতা শহরকে দেখছে। যদিও যাতায়াতের চৌহদ্দিটা খুব সীমিত তবু একটা ধারণা ওর মনে বদ্ধমূল হয়ে যাচ্ছে যে এখানকার মানুষ অত্যন্ত আত্মকেন্দ্রিক। ব্যক্তিগত প্রয়োজনের বাইরে আর কিছুতেই তাদের আগ্রহ নেই। আর আগ্রহ বলে সে মনে হয় সেটার জন্য যদি মূল্য দিতে হয় তবে তারা সে ব্যাপারে নিজেদের জড়াবেই না। খুব সামান্য কারণে পথে ঘাটে ভিড় জমে যায়, কিন্তু যখনই জনতা বোঝে এর পর তারা জড়িয়ে যাবে তখনই তারা সরে পড়তে আরম্ভ করে।

নির্জন দুপুরে ত্রিদিবের আনা একটা পত্রিকা পড়ছিল অনিমেষ। কলকাতা শহরের বয়েস বড় জোর দেড় শ বছর। তার আগে ইতস্তত কিছু জায়গায় মানুষের বসতি ছিল। কলকাতার অরিজিন্যাল বাসিন্দা বলে কেউ নিজেদের দাবি করতে পারে না। চব্বিশ পরগণা, হাওড়া, হুগলি এবং বর্ধমানের কিছু বর্ধিষ্ণু পরিবার যাদের অর্থকৌলিন্য চাষের দৌলতে পরিচিত ছিল তারাই ইংরেজের সঙ্গে কর্মসুত্রে মিলিত হবার জন্য কলকাতায় এসে বসতি স্থাপন করেন। প্রথম মহাযুদ্ধের পর কলকাতার চেহারা খুলল। তখন শ্যামবাজার থেকে বউবাজার অঞ্চলের বাসিন্দারাই ছিলেন শহরের মাতব্বর। ব্রাহ্মণদের তখনো কলকাতায় আগমন হয়নি ব্যাপক হারে। আসলে বাংলা দেশের বিভিন্ন গ্রামে যে সব তর্কালঙ্কার কিংবা ন্যায়রত্নরা ধর্মের দোহাই পেড়ে আধিপত্য করতেন তাদের বংশধররা পড়েছিলেন বিপাকে। তাদের অহঙ্কার সন্তানদের ইংরেজী শিক্ষা গ্রহণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল আর অব্রাহ্মণরা জীবিকার প্রয়োজনে দ্রুত ওই শিক্ষা গ্রহণ করে। রাজপুরুষের অনুগ্রহ না থাকলে কোন ধর্মই আধিপত্য পায় না, ফলে সেইসব তর্কালঙ্কারের সন্তানদিরা ইংরেজী শিক্ষার দিকে যখন ঝুঁকলেন তখন অন্যান্যেরা অনেক এগিয়ে গেছে। বাঙালীর চরিত্রে চাকরি করার যে প্রবণতা জন্ম নিল তা তার রক্তে মিশে গেল। ধর্মের দোহাই দিয়ে যখন আর বাঁচা যায় না তখন বাংলা দেশের দূর-দুরান্ত থেকে হল কলকাতা অভিযান। ঈশ্বরচন্দ্রকে তাঁর বাবার হাত ধরে হেঁটে আসতে হয়েছিল কলকাতায় শুধু পয়সার অভাবে।

কলকাতা হল সরগরম। শ্যামবাজার থেকে বউবাজারকে বলা হয় ঘটি এলাকা। পূর্ববঙ্গের মানুষ তখনও কলকাতায় বিদেশী এবং কালীঘাট-বেহালার কিছু মানুষ অনেক আগে থেকেই রয়ে গেলেও তারা ঠিক এদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারলেন না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে কলকাতার চেহারা রাতারাতি পালটে গেল। হু হু করে পূর্ববঙ্গ থেকে মানুষ আসছে। কলকাতা বেলুনের মত ফুলে জায়গা করে নিচ্ছে। এই নেওয়া এখনও শেষ হয়নি। উত্তর কলকাতায় মানুষ যাদের আভিজাত্যের গর্ব ছিল আকাশ ছোঁয়া, তাদের কলসী গড়িয়ে গড়িয়ে তলানিতে ঠেকল। নতুন সম্প্রদায় জন্ম নিল দক্ষিণ কলকাতায়, পূর্ব বঙ্গের ধনবান শিক্ষিত মানুষের কোন যোগাযোগে থাকল না। স্বাধীনতার পর কলকাতা অন্যরকম চেহারা নিয়ে নিল। বেলঘরিয়া থেকে যে কলকাতার শুরু তা থমকে দাঁড়াচ্ছে গড়িয়ায় গিয়ে। কিন্তু এই কলকাতার চেহারাটা কতগুলো খন্ডে ভাগ হয়ে গেল যেটা আপাতদৃষ্টিতে বোঝা যাবে না। বেলঘরিয়া-দমদম এলাকার সঙ্গে টালিগঞ্চ-যাদবপুর-গড়িয়ার মানুষদের চরিত্রগত মিল বেশী, কারণ এইসব এলাকার মানুষ পূর্ববঙ্গ থেকে প্রায় নিঃস্ব হয়ে এসে কলোনী স্থাপন করেছিলেন। দেশত্যাগের নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতা এদের জীবনযাত্রার ধরন পশ্চিবঙ্গবাসীদের থেকে অনেক ধারলো করে দিয়েছে। অত্যন্ত পরিশ্রমী এবং জেদী হওয়ায় ক্রমশ এঁরা কলকাতার ওপর নিজেদের অধিকার কায়েম করেছেন। কিন্তু স্বাধীনতার পরের কলকাতা কোন ভাবপ্রবণতার সঙ্গে জড়িত থাকল না। উত্তরে চিৎপুরের গোড়া থেকে কাশীপুরের বিস্তৃত অঞ্চল অবাঙ্গালী এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেল। বড়বাজারের সঙ্গে উত্তর ভারতের কোন শহরের তেমন পার্থক্য নেই। বস্তুত কলকাতার বাঙ্গালীরা বড়বাজারের কোন কোন এলাকাকে বিদেশ বলে মনে করে। মারোয়াড়ী সম্প্রদায়ের ওখানে একচ্ছত্র আধিপত্য। পূর্বে রাজাবাজার এলাকায় কয়েক হাজার অবাঙ্গালী মুসলমানের বসবাস। ট্যাংরা চীনে পাড়া হিসেবে চিহ্নিত। ধর্মতলা এলাকায় বাঙ্গালী পরিবার গোণাগুণতি! পাশেই পার্ক সার্কাস পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় ইংরেজ শাসনের আর এক ফসল অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের নিজস্ব এলাকা। খিদিরপুর-মোমিনপুর এলাকা অবাঙ্গালী মুসলমানদের জন্য নির্দিষ্ট হতে চলেছে। অর্থাৎ মূল কলকাতার যে এলাকা সেখানে বাঙ্গালীরা খুবই সংখ্যালঘু। প্রবন্ধের শেষে লেখক তার বক্তব্য শেষ করেছেন এই বলে যে, এই কসমোপলিটন শহর বিক্ষিপ্তভাবে কোন ঘটনায় ফুঁসে উঠতে পারে কিন্তু কখনো একই ভাবপ্রবণতায় আলোড়িত হতে পারে না।
 
এখন ঘরে কেউ নেই। ত্রিদিব কলেজে চলে গিয়েছে। কাল রাত থেকে জব্বর ঘুমিয়েছে অনিমেষ । ঘুম যখন ভাঙ্গল তখন প্রায় এগারটা। ওর যাতে অসুবিধে না হয় তাই ত্রিদিব ঘরের জানলাগুলো বন্ধ করে দিয়ে গেছে। মাথার পাশে কিছু পত্রিকা আর একটা চিরকুট পেয়েছিল অনিমেষ। ঠাকুরকে বলে গেলাম খাবার ঘরে দিয়ে যাবে। আজ হাঁটার চেষ্টা করো না।

হাঁটার কথাটা পড়তেই চলকে এল চিন্তাটা। তার পা গত কাল দারুণ জখম হয়েছিল, হাঁটতে গেলে যন্ত্রণায় অস্থির হচ্ছিল সে। সারা রাত শুয়ে থাকায় সে এ কথাটা যেন ভুলেই গিয়েছিল। হাত দিয়ে শুয়ে শুয়েই পা টিপে দেখল অনিমেষ । না কোথাও লাগছে না। কিন্তু মাটিতে পা পেতে দাঁড়ালেই ওটা মালুম হবে। যেন ব্যাপারটা ভোলার জন্যেই সে বিছানা ছেড়ে উঠছিল না। দু-তিনটে পত্রিকা উলটে পালটে সময় কাটাচ্ছিল। কিন্তু কতক্ষণ এভাবে পারা যায়! হাতমুখ ধোয়া দরকার তা ছাড়া বাথরুমে যাওয়ার বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। অনিমেষ আশা করছিল এখনই ঠাকুর খাবার নিয়ে আসবে। ঠাকুর এলে তার কাঁধে ভর দিয়ে ওসব সেরে নিতে বাথরুমে যেতে পারবে সে। কিন্তু ঠাকুরের জন্যে আর অপেক্ষা করা যাচ্ছে না।

অনিমেষ ঘরে একবার নজর বুলিয়ে নিল। না, একটা লাঠি জাতীয় কিছু নেই যেটায় ভর দিয়ে হাঁটা যায় । কপালে যা আছে তাই হবে এইরকম ভেবে অনিমেষ প্রথমে ভাল পা মাটিতে রাখল। তারপর সন্তর্পণে অন্য পা নামিয়ে ভাল পায়ে শরীরের ভার রেখে আস্তে আস্তে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। না, এখনও কোন যন্ত্রণা ঝাঁপিয়ে পড়ছে না, কিন্তু যে-কোন মুহূর্তে সেটা দাঁত বসাবে। অনিমেষ কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে খানিক। এতক্ষণ যেটা সামান্য ছিল সোজা হয়ে দাঁড়াতেই সেটা প্রবল হল। বাথরুমে যাওয়া অবশ্যই প্রয়োজন। বিপদটাকে ইচ্ছে করে ডেকে না এনে আর একটু শুয়ে থেকে ঠাকুরের অপেক্ষা করা যদি যেত! দ্বিধায়, ভয়ে ভয়ে, সে জখম পা সামান্য বাড়িয়ে একটু একটু করে শরীরের ভার রাখতে লাগল। না, ব্যথা লাগছে না, ধীরে ধীরে সমস্ত ভার ছেড়ে দিতে থাই-এর কাছটায় সামান্য চিনচিন করতে লাগল মাত্র। অনিমেষ এত অবাক হয়ে গিয়েছিল যে ওই মুহূর্তে সে সব প্রাকৃতিক প্রয়োজনের কথা ভুলে গিয়ে নিজের পা দুটো লক্ষ্য করতে লাগল। কি আশ্চর্য! কালকের যন্ত্রণাটা এখন বেমালুম হাওয়া হয়ে গেল? অনিমেষ দুরুদুরু বুকে পায়ের ওপর আবার চাপ রাখল। হয়তো দাঁড়িয়ে আছে বলে কিছু বোঝা যাচ্ছে না, হাঁটতে গেলেই টের পাওয়া যাবে। ঠিক এই সময় ঠাকুর হুড়হুড়িয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকল। এক হাতে খাবারের থালা, অন্য হাতে জলের গ্লাস। অনিমেষকে দাঁড়াতে দেখে সে অবাক হয়ে গেল যেন, ত্রিদিববাবু কইল আপুনি হাঁটিতে পারবা নাই, ঠ্যাং ভাঙ্গি গেছে!

ত্রিদিব কি বুঝিয়েছে অনুমান করে নিয়ে অনিমেষ বলল, সবটা ভাঙ্গেনি, তুমি খাবারটা টেবিলে রেখে এসে আমাকে একটু ধরবে? .. .

ঠাকুরের হাঁটা-চলা সব সময় দ্রুত, মুহূর্তেই সে অনিমেষের কাঁধ ধরল। অনিমেষ হাঁসফাঁস করে উঠল, আরে, এভাবে নয়। তুমি চুপচাপ দাঁড়াও, আমি তোমাকে ধরে হাঁটব।

কিন্তু সেটা ঠাকুরের পছন্দ নয়। সে জিজ্ঞেসা করল, হাঁটিবার কি কারণ?

অনিমেষ বলল, বাথরুমে যাব। ঠাকুর হাসল, আপুনায় খাটিয়ার নীচে একটা পাত্র রাখি গেছে জমাদার। ওইটার মধ্যে করি ফেলেন। ..

খবরটা জানত না অনিমেষ। কিন্তু ব্যবস্থাটা মনঃপূত হল না তার। সে একটু জোরেই আদেশ করল, যা বলছি তাই শোন, তুমি বাথরুমের দিকে হাঁটো।

ঠাকুরের শরীরে ভর রেখে কয়েক পা হাঁটতেই অনিমেষ আবিষ্কার করল কালকের সেই মারাত্মক ব্যথাটা মোটেই নেই, থাই-এর কাছে কোন শিরা সামান্য চিনচিন করা ছাড়া তার কোন অসুবিধেই হচ্ছে না। এটা কেমন করে সম্ভব মাথায় ঢুকছে না, কিন্তু অদ্ভূত একটা স্বস্তিতে মন এখন শান্ত হয়ে যাচ্ছে। আনন্দ যখন খুব প্রবল হয় তখন বিস্ফোরণে নয়, চুপচাপ সেটার অনুভবেই বোধ হয় পূর্ণতা পায়। অনিমেষ ঠাকুরকে ছেড়ে দিয়ে ধীরে ধীরে বারান্দায় বেরিয়ে এল। চারপাশে এখন কড়া রোদ ছড়ানো, দুচোখ বন্ধ করে আলো সইয়ে নিল সে।

.
 
ভরদুপুরে স্নান করে ভাত খেয়ে বেশ আরাম হল। সিগারেট পেলে বেশ হতো। অনিমেষ খোলা জানলার পাশে চেয়ার পেতে মৌজ করে বসেছিল। কাল যে দারুণ ভয় সে পেয়েছিল সেটা মিথ্যে হওয়ায় এখন খুব হাল্কা লাগছে। ট্রামে উঠতে গিয়ে এমন কিছু বেকায়দায় লাগেনি যে পায়ের জোড়া হাড় ফের ভাঙ্গতে পারে। কিন্তু ব্যাথা হওয়া মাত্র সে কথাটাই মনে এসে বদ্ধমূল হয়েছিল। এমন কি, হোস্টেলের ডাক্তার পর্যন্ত স্পেশালিস্ট দেখিয়ে দিলেন। এই জন্যেই বোধ হয় সবাই ওঁকে ঘোড়ার ডাক্তার বলে। অনিমেষ সিদ্ধান্তে এল, ওটা নিশ্চয়ই মাসল পেইন, শিরায় টান ধরেছিল আচমকা। মানুষ কত সহজে ভয় পেয়ে যায়!

আজ ক্লাস কামাই হল। এত বেলা অবধি ঘুমিয়ে এখন আর একরকম আলস্যি এসে গেছে। কালকের কথাগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল অনিমেষ। বিমান ধরেই নিয়েছে সে ছাত্র ফেডারেশন করবে। এ কথা ঠিক সে ছাত্র ফেডারেশনকে সমর্থন করে এই কারণে যে কংগ্রেসকে সমর্থন করার কোন যুক্তি তার কাছে নেই। কিন্তু তাই বলে যে ভাবে বিমান তাকে সবার কাছে উপস্থিত করল সেটা কখনই শোভন নয়। নাকি তাকে সামনে খাড়া করে বিমানরা একটু যুদ্ধে এগিয়ে গেল । সুবাসদার সঙ্গে কাল যদি অমন করে দেখা না হয়ে যেত তা হলে এসব ঘটনা ঘটত না। হোস্টেলে এসে। কিন্তু সুবাসদা আসেননি। হয়তো বৃষ্টির জন্য সেটা সম্ভব হয়নি। বিমানদের চেয়ে সুবাসদাকে তার অনেক গভীর এবং কাছের মানুষ বলে মনে হচ্ছে। অথচ ওরা দুজনেই এক দলের সক্রিয় কর্মী।

ছাত্র য়ুনিয়নের কথা ভাবতেই শচীনের কথাগুলে মনে পড়ল। কংগ্রেসের সমর্থনে এবং কম্যুনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে শচীন যাই বলুক, নিশ্চয়ই তার পালটা বক্তব্য রাখা যেতে পারে। কিন্তু শচীনের কথাগুলো আরো ভাল করে শোনা দরকার । শচীনের কথা মনে হতেই চট করে নীলার মুখ ভেসে এল। নীলা একা পায়চারি করতে ওদের ফেলে রেখে বেরিয়ে গিয়েছিল। কথাটা ভাবতেই অনিমেষ সোজা হয়ে বসল। আজ নীলা তাকে বাসস্টপে অপেক্ষা করতে বলেছিল। কথাটা স্মরণেই ছিল না তার। এখনও সেখানে যাওয়ার যথেষ্ট সময় আছে, কিন্তু অনিমেষ আবিষ্কার করল বেরুতে একদম ইচ্ছে করছে না। আলসেমি এমন পেয়ে বসেছে যে ইচ্ছে করছে আবার শুয়ে পড়ে। নীলা নিশ্চয়ই বাসস্টপে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করবে এবং অনিমেষ না গেলে বিরক্ত হওয়া খুব স্বাভাবিক। কেউ আসবে বলে না এলে মেজাজ ঠিক থাকে না। আজ পর্যন্ত কোন মেয়ে কোথাও ওর জন্য অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকেনি। এবং যে মেয়ে সোজাসুজি কথা বলে সে দাঁড়িয়ে থাকবে ভাবলেই এক ধরনের বুক-ভরা আনন্দ হয়, তবু অনিমেষ দোনামোনা করতে লাগল। এ কথা ঠিক, তার পায়ের দোহাই দিয়ে সে নীলার রাগ কমাতে পারবে। ঘরের মধ্যে চলাফেরা করতে লাগছে না বটে কিন্তু রাস্তায় বের হয়ে ট্রাম-বাসে চড়তে গেলে যদি আবার কালকের মত যন্ত্রণা শুরু হয়ে যায়, সবাই বলবে তার আজকের দিনটা অন্তত রেস্ট নেওয়া উচিত এবং সে তাই করছে। অনিমেষ এত সব যুক্তি খাড়া করেও ঠিক স্বস্তি পাচ্ছিল না।

আরো কিছুক্ষণ বসে থেকে শুয়ে পড়বে বলে অনিমেষ যখন উঠে দাঁড়িয়েছে তখন দরজায় শব্দ হল। আস্তে আস্তে জায়গাটুকু পেরিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই দারোয়ানকে দেখতে পেল সে। তার শরীরের দিকে দ্রুত একবার নজর বুলিয়ে নিয়ে দারোয়ান জিজ্ঞাসা করলো, শরীর ঠিক আছে বাবু?

তার শরীর খারাপ হয়েছিল বলে সবাই খবর নিতে আসছে দেখে অনিমেষের ভাল লাগল, এখনও ঠিক–তবে কালকের থেকে ভাল।

আপনি গেটে যেতে পারবেন?

কেন?

একজন মেয়েছেলে আপনার খবর নিতে এসেছে।

মেয়েছেলে? অনিমেষ হকচকিয়ে গেল। মেয়েছেলে মানে নিশ্চয়ই নীলা । কিন্তু ও খবর পেল কি করে? তিনটে বাজতে তো এখনও কিছু দেরি আছে। ওর পরিচিত এই হোস্টেলের কোন ছেলেকে নীলা চেনে না যে তার মুখে খবর পেয়ে দেখতে আসবে। নাকি মেয়েদের সেনসটিভনেস এত বেশী যে ঠিক মনে মনে জেনে যায় কি হয়েছে। মেয়েরা যাদের ভালবাসে তাদের সম্পর্কে তারা নাকি এই রকম অনুভব করতে পারে। কিন্তু নীলার সঙ্গে তো তার সেরকম সম্পর্ক নয়। অনিমেষ দারোয়ানকে বলল, তুমি আমার সঙ্গে চল, সিঁড়ি ভেঙে নামতে সাহায্য লাগতে পারে।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top