What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected কালবেলা- সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

অনিমেষ বাইরে বেরিয়ে এসে দেখল বিকেল শেষ হতে চলেছে। সামনে একদম ফাঁকা। কোন রকম ছাত্রছাত্রী ধারে-কাছে নেই। সাধারনত সে কলেজ স্ট্রীটের দরজা দিয়ে আসা-যাওয়া করে, আজ হেয়ার স্কুলের পাশে রাস্তাটা দিয়ে বেরুল। দরজার সামনেই বিরাট পোস্টার, সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা, বিয়েৎনাম থেকে হাত ওঠাও। পাশের ছবিতে দেখা যাচ্ছে একটা আমেরিকান বেয়নেটের ডগায় ভিয়েতনামী শিশুকে গেঁথে রাক্ষুসে হাসি হাসছে। ছবিটা অনেকক্ষণ দেখল অনিমেষ। ভিয়েনামের ঘটনা এতদিনে তার জানা হয়ে গেছে। হো চি মিন নামের একজন মানুষের নেতৃত্বে নিরক্ষর অসহায় ভিয়েনামীরা আজ এক হয়ে আমেরিকান মিলিটারীর বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। কোথায় আমেরিকা আর কোথায় ভিয়েতনাম, তবু সেখানে সাম্রাজ্য অটুট রাখার বাসনায় আমেরিকা পাশবিক শক্তি প্রয়োগ করে একটা দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষকে দাবিয়ে রাখতে চাইছে। কেন? শুধু ক্ষমতার অহঙ্কার মানুষকে কতটা উন্মত্ত করতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ । ছবিটা মাথায় নিয়ে অনিমেষ হেঁটে প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনে চলে এল। ততক্ষণে ওর পরমহংসের কথা মনে পড়ল। সেই সুদীপ যখন ওকে চাতালের দিকে ধরে নিয়ে গের তারপর আর ওর দেখা মেলেনি। তখন ওর ওপর খুব ক্ষেপে গিয়েছিল অনিমেষ কিন্তু এখন আর রাগটা নেই। পরমহংস তো ইচ্ছে করে তাকে বিপাকে ফেলবে বলে নাম ধরে ডাকেনি। ছেলেটার সঙ্গে আজই আলাপ কিন্তু বেশ ভাল লেগেছে অনিমেষের। খুব সহজ হয়ে ফটাফট কথা বলতে পারে। মনে পড়ল পরমহংস বলেছিল মিটিং থেকে বেরিয়ে কফি হাউসে যাবে, সেখান থেকে টিউশানি । ওর পোশাক দেখে অবস্থা খারাপ বলে মনে হয় না, তবু টিউশানি করে কেন? অনিমেষের মনে হল বাবার পাঠানো গোণাগুণতি টাকায় তাকে যখন খুব কষ্ট করে চালাতে হয় তখন সেও তা পরমহংসের মত টিউশানি করতে পারে। কিন্তু তাকে কে টিউশানি দেবে? কোলকাতায় এসে কোন পরিবারের সঙ্গে সে ঘনিষ্ঠ হয়নি এক দেবব্রতবাবু ছাড়া। পরমহংসকে বললে হয়। অবশ্য জীবনে সে কখনো কাউকে পড়ায়নি, কিন্তু একটু দেখে নিলে স্কুলের যে-কোন ছাত্রকে না পড়াতে পারার কোন কারণ নেই।

প্রেসিডেন্সি কলেজের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে অনিমেষ দেখল ট্রাম-বাসে বেজায় ভিড়। অফিস ছুটি হয়ে গেছে। সাধারণত ও যখন ফেরা তকন ভিড় থাকে না। এখন এখান থেকে ট্রামে ওঠা অসম্ভব। ঠিক উলটো দিকে ইন্ডিয়ান কপি হাউসের সাইন বোর্ডটা চোখে পড়ল ওর। পরমহংসকে ওখানে গেলে পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু ছেলেটা যখন দেখল সে একটা বিপদে পড়েছে, তাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন সে মিটিং মেষ না হওয়া অবধি ওর জন্য অপেক্ষা করর না কেন? কোলকাতায় বোধ হয় কেই কারো বন্ধু হতে পারে না। পরমহংসের ওপর একটু অভিমান জমতে না-জমইে হেসে ফেলল অনিমেষ। ছেলেদের সঙ্গে আজ দুপুরেই প্রথম আলাপ হল আর সে অনেক কিছু ভেবে বসছে। চট করে নিজের পছন্দ মত ভাবার এই স্বাভাবটা যে সে কবে ছাড়াতে পারবে!

ট্রামরাস্তা পেরিয়ে সে গলিটার মধ্যে চলে এল। কফি হাউসের দরজার পাশেই এক মাঝবয়সী মানুষ সিগারেট বিক্রি করছে। অনিমেষকে দেখে সে খুব পরিচিত হাসি হাসল। অবাক হল অনিমেষ, লোকটা তাকে চেনে নাকি, এমন ভঙ্গী করছে যেন আগেও দেখা হয়েছে। অনিমেষ মুখ নামিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে ও অবাক হয়ে গেল। পর পর অনেকগুলো লিটল ম্যাগাজিনের বিজ্ঞাপন, প্রত্যেকেই এক একটা দারুণ বিস্ফোরণ সংখ্যা বের করছে বলে দাবি করছে। দোতলায় উঠতে মনে হল একটা বাজার কাছাকাছি রয়েছে। খুব চেঁচামেচি করে কেনাবেচা চলছে সেখানে। দরজার পঁড়িয়ে হকচকিয়ে গেল অনিমেষ। বিরাট হলঘর জুড়ে টেবিল–চেয়ার আর তাতে ভরতি মানুষ। এত বড় রেস্টুরেন্ট সে কখনো দ্যাখেনি। সবাই একসঙ্গে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে, আর সেই শব্দরাশি অনেক উঁচু ছাদের তলায় পাক খেয়ে অদ্ভূত আওয়াজ তুলছে। অনিমেষ এই ভিড়ের মধ্যে পরমহংসকে দেখতে পেল না। চট কর কাউকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। বোকার মত কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সে ফিরে যাবে বলে ভাবছে, তকন লক্ষ্য করল কয়েকজন ছেলে ওর দিকে তাকিয়ে নিজেদের মধ্যে কি বলাবলি করছে। সে মুখ ঘোরাতেই একজন উঠে এসে জিজ্ঞাসা করল, বসবনে? নিজেদের টেবিলে দেখাল সে। একটু ঘাবড়ে গিয়ে অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, না।

আপনাকে আজ মিটিং-এ দেখলাম। হাসল ছেলেটি। আপনার কোনো অসুবিধা হয় না? সে তার পায়ের দিকে ইঙ্গিত করল। অনিমেষ এই প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতে চায় না, সে দ্রুত ঘাড় নেড়ে দরজার দিকে ফিরে গেল । খুব বিরক্তি লাগছিল তার, এখন থেকে কত রোককে যে এই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে! নিজের কোন গোপন দুঃখ বা যন্ত্রণা যদ্দিন নিজের থাকে সে একরকম, কিন্তু সেটা জানাজানি হয়ে গেলেই তার ধার কমে যায়।
 
দরজার বাইরে এসে অনিমেষ দেখল ওপরের সিঁড়ি দিয়ে কিছু ছেলেমেয়ে হইহই করে নীচে নামছে। তার মানে তেতলাতেও বসার জায়গা আছে! কৌতূহল নিয়ে অনিমেষ পায়ে পায়ে ওপরে উঠে এল। দুদিকে দুটো দরজা। ডান দিকেরটা দিয়ে ঢুকতেই লবি মতন একটা জায়গা, দুপাশে দুটো ব্যালকনি, অনেকটা ইংরেজি স্টুড অক্ষরের আদলে। তেতলায় মেয়েদের সংখ্যা বেশি, কারণ প্রতিটি টেবিলে শাড়ি চোকে পড়ছে। টিক এই সময় নিজের নাম শুনতে পেল অনিমেষ। চিৎকার করে যে ডাকছে সে পরমহংস তাতে সন্দেহ নেই। অনিমেষ দেখল বাদিকের ব্যালকনির একদম কোণায় একটা বিরাট ফ্যানের সামনের টেবিলে ওরা বসে আছে। পরমহংস আর তিনটে মেয়ে। ও ইতস্তত করে ঘাড় নেড়ে পরমহংসকে উঠে আসতে বললে পরমহংস তেনি চেঁটিয়ে বলল, এখানে একটা চেয়ার আছে, চলে এস।

অপরিচিত মেয়েদের মধ্যে গিয়ে বলসে অনিমেষের সঙ্কোচ হচ্ছিল, কিন্তু এরপরে আর দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। তিনটি মেয়েই এবার তাকে ঘাড় বেঁকিয়ে দেখছে। অগত্যা পায়ে পায়ে সে ওদরে টেবিলটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। খালি চেয়ারটায় কতগুলো বই রাখা ছিল, মেয়েরা সেগুলো তুলে নিতে পরমহংস বলল, তুমি তো গুরু বর্ণচোরা আম। ট্রথম আলাপে আমাকে এমন ভড়কি দিলে যে আমি ভাবলাম– । যাক, মাঠে নেমেই তা হলে সেঞ্চুরি করে ফেলল! বসে বসো।

পরমহংস সব সময় হাসে কিনা বোঝা যায় না দাঁত উঁচু থাকার জন্যে। কিন্তু অনিমেষ বুঝল কথাটার মধ্যে একটু ঠাট্টা মেশানো আছে। চেয়ারে বসে সে বলল, তুমি না বলে চলে এলে কেন?

যাচ্ছলে । তোমাকে ভি আই পি রিসেপশন দেওয়া হচ্ছে আর আমি ফেকলুর মত দাঁড়িয়ে থাকব। আমি ভাই জনতার লোক, রাজনীতি বুঝি না। তা হঠাৎ এখানে?

তোমাকে খুঁজতে এলাম।

সত্যি ?

বাঃ, মিথ্যে বলতে যাব কেন? তখন বললে না কফি হাউসে আসবে?

নাঃ, তোমার দ্বারা রাজনীতি হবে না। আজকের ওসব ব্যাপারের পর তো তোমার আমার কথা খেয়ালই করা উচিত নয়। যাক, ওসব ব্যাপারে পরে কথা বলব। তুমি তো এদের কাউকে চেন না! পরমহংস মেয়েদের দিকে হাত দেখাল।

এক পলক মুখগুলো দেখে নিয়ে অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, না। পরমহংস বলল, আমিও চিনতাম না, এরা সবাই বাংলা নিয়ে এমন এ পড়ে, অন্য সেকশনে।

ওদের মধ্যে যার চেহারা খুব রোগা সে জিজ্ঞাসা করুল, আপনিও কি বাংলা?

অনিমেষ মাথা নেড়ে হাঁ বলল।

মেয়েটি বলল, বাংলায় এম এ যেসব ছেলেরা পড়ে তাদের নিয়ে দারুণ দারুণ গল্প আছে।

পরমহংস বলল, সেই চিরিড়য়াকানার বাঘের গল্প তো! ও পুরোনো হয়ে গিয়েছে।

বাকী দুজন একসঙ্গে হেসে উঠল পরমহংসের বলার ধরনে। অনিমেষ গল্পটা শুনেছে কিন্তু ও পরমহংসের দিকে প্রশংসার চোকে তাকাল। গল্পটা শুনলেই নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অন্ধকারটা ভারী হয়ে আসে, কিন্তু ওর বলার ভঙ্গীতে এমন একটা মজা আছে যে মনটা খারাপ হওয়ার সুযোগ পেল না।

রোগা মেয়েটা পরমহংসকে বলল, আপনি পরিচয় করিয়ে দিলেন না তো ওর সঙ্গে! পরমহংস হাত উলঠে বলল, আমাকে কে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল? অমি তো নিজে থেকে আপনাদের টেবিলে এসে জুড়ে বসলাম।

এবার আর একটি মেয়ে জবাব দিল, আপনি পরমহংস, চোখ, কানগুলো বন্ধ করে রেখেছেন, সবাই তো তা নয়।

পরমহংস বলল, অ। ইনি হচ্ছেন নবনীতা, আত্রেয়ী এবং অনন্যা। আর এর নাম অনিমেষ, স্কটিশ থেকে পাশ করেছে। আর খুব বড় নেতা হবার সুযোগ ওর সামনে অপেক্ষা করছে।

রোগা মেয়েটি, যার নাম আত্রেয়ী, বলল, বুঝলাম না।

পরমহংস বলল, যারা ব্রিটিশ আমলে এক দিন জেল খেটেছিল তারই মন্ত্রী হবার সুযোগ আগে পেয়েছে স্বাধীনতার পর। আর এখন যারা পুলিশের হাতে ধোলাই খাবে তারা মন্ত্রী হবে আগামীকালে । অনিমেষের পায়ে বিরাট দাগ আছে পুলিশের বুলেটের। ওকে কে মারে!
 
তিনজনই অবাক চোখে অনিমেষকে দেখল । অনিমেষ পরমহংসের ওপর রাগতে পারছে না কিন্তু এখানে কিছু বলাও যায় না। আত্রেয়ী বলল, আপনাকে পুলিশ গুলী করেছিল কেন? আপনি কি অ্যাকশন করেছেন কখনো?

অ্যাকশন! অনিমেষ ঘাড় নেড়ে বলে উঠল, না, না, ওটা একদম নিছক দুর্ঘটনা। পরমহংস বাড়িয়ে বলছে। তারপর কথা ঘোরাতে জিজ্ঞাসা করল, আপনারা কোন কলেজে পড়তেন?

অনন্যা জবাব দিল, বেথুন। শব্দটা শুনেই অনিমেষের সেই চোখ দুটো মনে পড়ল। পরমহংস বলছিল সেও নাকি বেথুন থেকে এসেছে। অনিমেষ নীচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, আপনাদের কলেজে কি বাংলার ছাত্রী বেশি?

আত্রেয়ী জবাব দিল, না আমরা পাঁচজন এক সেকশনে আছি। আরো নজন আছে। সবসুদ্ধু চৌদ্দ, কেন?

প্রশ্নট অনিমেষকে একটু বিপাকে ফেলে দিল। সে একটু ইতস্তত করে জবাব দিল, না মানে, আরো কয়েকজন বেথুন থেকে এসেছেন শুনে মনে হল ওখানে বাংলার ছাত্রীর সংখ্যাই বেশি।

আত্রেয়ী বলল, কি বোকা কথা বলছেন, চৌদ্দজন মোটেই বেশি নয়।

নবনীতা বলল, আর কাদের কথা শুনেছেন?

অনিমেষ পরমহংসের দিকে তাকালে সে চোখ টিপে বলে উঠল, ছাড়ো তো যত আজে–বাজে কথা। অনিমেষ, মেয়েদের কাছে মেয়েদের সম্পর্কে কখনো কৌতূহল দেখাবে না।

আত্রেয়ী বলন, আপনার খুব অভিজ্ঞতা আছে মনে হচ্ছে?

পরমহংস মাথা নেড়ে বলল, শরৎচন্দ্র থেকে বিমল মিত্তির আমি গুলে খেয়েছি।

কথা বলার ধরনে সবাই হেসে উঠলে অনিমেষ হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।

হঠাৎ পরমহংস অনিমেষকে চটজলদি বলে ইঠল, এই, চোখ বন্ধ কর তো।

কেন? অনিমেষ অবাক হল।

কর না! একটা মজার জিনিস বলব। এই কফি হাউসটা এককালে বক্তৃতার জায়গা ছিল। বড় বড় নেতারা এখানে বক্তৃতা দিতেন। এর নাম ছিল এ্যালবার্ট হল। সেইসব বক্তৃতা নাকি সারা দেশে সমুদ্রের ঢেউ তুলতো। এখনও এতদিন বাদে এই কফি হাউসে বসে সেই সমুদ্র গর্জন শুনতে পারে। পরমহংস বলল।

সবাই একসঙ্গে অবিশ্বাসের গলায় বলল, কি রকম?

পরমহংস ম্যাজিসিয়ানের ভঙ্গীতে বলল, প্রথমে দুটো কান হাতের চেটোর চেপে ধরো, ধরেছ, হ্যাঁ, এবার চোখ বন্ধ কর। এক মিনিট বাদে চোখ না খুলে কান থেকে হাত সরিয়ে নাও।

ওর কথামত ওরা ঠিকঠাক করে গেল। চারজনই একসঙ্গে এরকম ব্যাপার করছে–দৃশ্যটা ভেবে হাসি পাচ্ছিল অনিমেষের । কিন্তু সে যখন কান থেকে হাত সরিয়ে নিল চারপাশে কেমন গুমগুম শব্দ শুনতে পেল। যেন কিছু গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে আর আসছে। এটা যে বিভিন্ন টেবিল থেকে ওঠা কথার আওয়াজ সেটা বুঝে বেশ মজা লাগছিল ওর। এমনি আচমকা টের পাওয়া যায় না। কিছুক্ষণ কান বন্ধ থাকার ব্যাপারটা এই চেহারা নিয়েছে। পরমহংস বলল, কি, সমুদ্র গর্জন শোনা যাচ্ছে?

চোখ খুলে অনিমেষ হেসে বলল, আমি এখনো সমুদ্র দেখিনি, তাই ঠিক–।

অনিমেষের কথা আটকে গেল। ও দেখলো একটি ছেলের সঙ্গে নীলা ওপাশের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল। এই কয় বছরে নীলার স্বাস্থ্য ভরাট হয়ে অন্য রকম আদল এনেছে। ওর সঙ্গের ছেলেটিকে সে কখনো দ্যাখেনি। খালি টেবিল না পেয়ে নীলা চারপাশে চোখ বোলাতে অনিমেষকে দেখতে পেল। যেন নিজের চোখকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না নীলার চোখমুখের অভিব্যক্তি এইরকম।
 
অনিমেষ উঠে দাঁড়িয়েছিল। নীলাকে অনেক দিন বাদে দেখছে সে। ওর সেই প্রেমিকের অনুরোধের পর আর যাওয়া হয়নি দেবব্রতবাবুর বাড়িতে। কিন্তু নীলার সঙ্গে এখন যে ছেলেটি দাঁড়িয়ে সে কে? ওর প্রেমিকের নামটা মনে করতে চেষ্টা করল অনিমেষ। হ্যাঁ, শ্যামল, শ্যামল এখন কোথায়? শ্যামলের সঙ্গে নীলার সম্পর্ক তৈরি হয়নি? না হলে শ্যামল আত্মহত্যা কিংবা খুন দুইই করতে পারে বলে মনে হয়েছিল তখন। সেরকম কিছু হলে অবশ্যই কাগজে খবরটা পড়তো সে।

এভাবে দাঁড়িয়ে থাকাটা অভদ্রতা। অনিমেষ পরমহংসকে বলল, আমি একটু আসছি। চেয়ারগুলো বাঁচিয়ে নীলাদের কাছাকাছি আসতেই সে একটা ঠাট্টার গলা শুনতে পেল, আরে ব্বাস, আমি নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছি না, আমি কি ঠিক দেখছি? অনিমেষ হেসে বলল, এত অবাক হবার কি আছে। এখানে তো সবাই আসতে পারে। তারপর?

আগে তো কখনো দেখিনি! নীলার বিস্ময় যেন কাটাছিল না।

আমি আজ প্রথম এলাম। জানালো অনিমেষ, এসে অবশ্য মাথা ধরে যাচ্ছে। কি চিৎকার চেঁচামেচি, লোকে বসে থাকে কি করে!

নীলার সঙ্গী বলল, আপনি আজ প্রথম এলেন? অবশ্য প্রথম দিন ওরকম মনে হয়, পরে এমন নেশা ধরে যায় এখানে না এলে ভালে লাগে না। বাংলা সাহিত্য শিল্পের আঁতুরঘর হল কফি হাউস। এখানে লিটল ম্যাগাজিনের আন্দোলন করে এক একজন বড় সাহিত্যিক হয়েছেন। রোজ এলে বুঝবেন নেশার ধরনটাই আলাদা।

নীলা তখনও একদৃষ্টে অনিমেষকে দেখছিল। সেটা লক্ষ্য করে অনিমেষ বলল, বাবা কেমন আছেন?

আমার সঙ্গে কখনো দেখা হলে জিজ্ঞাসা করবে বলে এতদিন অপেক্ষা করছিলে? জানতে ইচ্ছে করলে তো নিজেই যেতে পারতে। নীলা চোখ সরাচ্ছিল না।

আসলে যাব যাব করেও যাওয়া হয়ে ওঠে না। অনিমেষ পাশ কাটাতে চাইল। এইসময় একটা টেবিল খালি হতেই নীলার সঙ্গী দ্রুত গিয়ে সেটা দখল করে ডাকল, চলে আয়, ভ্যাকেন্সি হয়ে গেছে।

নীলা হেলতে দুলতে একটা চেয়ারে গিয়ে বসল । অনিমেষ লক্ষ্য করল নীলাকে একজন পূর্ণযুবতী মহিলার মত দেখাচ্ছে। বালিকাদের শরীরে যেসব ছেলেমি ভাব থাকে তার বিন্দুমাত্র ওর মধ্যে নেই।

ভরাট লাবণ্যময়ী নদীর মত শান্ত ভঙ্গীতে হেঁটে গেল নীরা। ওই টেবিরে যেসব মেয়ে এখনও বসে আছে তারা কেউ এখনও এই জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি । নীলাকে এখন চট করে ফিল্ম স্টার অথবা বনেদী বাড়ির বউ হিসেবে ভেবে নেওয়া যায়।

নীলাদের টেবিলে গিয়ে বসবে, না পরমহংসদের কাছে ফিরে যাবে, দোনমনা করছিল অনিমেষ। এত দিন বাদে নীলাকে দেখে ভাল লাগছে, ওর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। আবার পরমহংসদের টেবিলে ফিরে গেলে এক ফাঁকে ওকে টিউশনি যোগাড় করে দেবার কথা বলে রাখা যেত। সামান্য আলাদা রোজগার এখন বিরাট সাহায্যের হবে। অনিমেষ দেখল নীলা ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। অনিমেষ ঠিক করল প্রয়োজন তো চিরকাল থাকবে কিন্তু এই মুহূর্তের ইচ্ছেটাকে জোর করে দাবিয়ে রাখা আরও মুর্খামি। সে নীলাদের টেবিলে এসে বসল। নীলা এখনও হাসছে। দুটো উজ্জ্বল চোখ কি রকম কৌতুকে হেসে ওঠে। অনিমেষ একটু অপ্রতিভ ভঙ্গীতে জিজ্ঞাসা করল, হাসির কি হল?

নীলার সঙ্গী বলল, তোর মাইরি এই পেছনে লাগা হ্যাবিটটা গেল না।

নীলা সে কথায় কান না দিয়ে বলল, চেহারা অনেক চকচকে হয়েছে, চোখের চাহনি, কথাবার্তা এবং মাথার চুল অনেক মার্জিত হয়েছে। মোটামুটি কলকাতা শহর তোমাকে একজন প্রেমিকের চেহারা দিয়ে দিয়েছে।

অনিমেষের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, চমৎকার আবিষ্কার।

হঠাৎ নীলা গম্ভীর হয়ে বলল, কফি হাউসে প্রথম দিন এসেই ওই মেয়েগুলোর সঙ্গে আড্ডা মারতে আরম্ভ করেছ। তোমার মেয়ে ভাগ্য খুব ভাল দেখছি।
 
স্তম্ভিত হয়ে গেল অনিমেষ। কোন মেয়ে এরকম কথা ছেলেদের সঙ্গে বলতে পারে? কথাটা এমনিতে মনে হয় নিরীহ কিন্তু অশ্লীল ইঙ্গিতটুকু তো এড়ানো যায় না।

নীলা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যাখ্যা করল কলকাতায় প্রথম এসে অজ্ঞাতকুলশীল হয়ে হাসপাতালে পড়ে ছিলে। আজ অবধি কেউ কখনো শুনেছে কোন নার্স গায়ে পড়ে একজন পেশেন্টের খবর তার পরিচিতের কাছে পৌঁছে দেয়। তারপর যখন জ্ঞান এল তখন চোখ খুলেই আমাকে দেখতে পেলে। অবশ্য তখন তোমার চোখের দৃষ্টি ছিল নিপাট ভালমানুষের। এর পর এত কলেজ থাকতে বেছে বেছে স্কটিশে ভর্তি হওয়া হল। কফি খাবে তো?

একই ভঙ্গীতে শেষ প্রশ্নটা উচ্চারণ করতে অনিমেষ চট করে জবাব দিতে পারল না। ও দেখল পেছনে একটা উর্দিপরা বেয়ারা এসে দাঁড়িয়েছে।

উত্তরের অপেক্ষা না করে নীলা তিনটে কফি দিতে বলল। তারপর হেসে অনিমেষকে জানালো, অনেক জ্ঞান দিয়ে ফেললাম বিপ্লবীকে। যদি বাসনা থাকে তবে প্রমীলা-রাজ্যে ফিরে যেতে পারো। নীলার সঙ্গী বলল, বাঃ, কফি বলে দিয়ে এখন যেতে বলছিস কেন?

নীলা বলল, আমি তো যেতে বলছি না। বলেছি যদি চায় তো যেতে পারে, কি, তাই বলিনি অনিমেষ? এ কি, এমন ঝিমিয়ে গেলে কেন?

নীলার বাকচাতুর্যে মুগ্ধ হয়ে গেল অনিমেষ। মেয়েরা খুব স্মার্ট ভঙ্গীতে কথা বললে তাদের একটা সৌন্দর্য আসে। নীলাকে তাই এখন সুন্দরী দেখাচ্ছে। কোন ওপরচালাকি নয়, নীলা যে কথাগুলো বলল প্রতিটির ওপর যেন পূর্ণ কর্তৃত্ব ছিল ওর। অনিমেষ খুব আস্তে অথচ স্পষ্ট গলায় বলে ফেলল, তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।

সঙ্গে সঙ্গে নীলার ভ্রূদুটোয় কুঞ্জন লাগল। আর নীলার সঙ্গী হো হো করে হেসে বলে উঠল, রাইটলি সার্ভড। নীলা এভাবে তোকে রিটার্ন দিতে আর কাউকে দেখিনি।

নীলা গম্ভীর হতে গিয়ে হেসে ফেলল, যা ভেবেছিলাম তা তো নয়। কলকাতার জল যে এরকম ভিজে বেড়াল করে দেয় তা জানতাম না। তা বেশ, আমাকে সুন্দর দেখে কি করতে ইচ্ছে করছে?

অনিমেষ কথাটা একদম না ভেবে উচ্চারণ করেছিল। সত্যি, নীলাকে ওর খুব সুন্দরী মহিলা মনে হচ্ছে । সামান্য মোটা হওয়ার গায়ের চাপা রঙের ওপর শোভন পালিশ এসেছে। মুখের কোথাও দাগ নেই, বুকের দিকে তাকাতে অস্বস্তি হয়। কিন্তু কথাটা নিয়ে এমন ঠাট্টা জুড়ে দেবে নীলা সেটা বুঝতে পারলে সে সতর্ক হত। ও দেখল নীলার সঙ্গে কথা বললে খুব স্মার্টলি বলতে হবে যাতে ওকে কোন সুযোগ না দেওয়া হয়। আক্রমণই খুব বড় প্রতিরোধ। সে মুখ তুলে বলল, বেড়াল তো চিলকাল ভিজে থাকে না যদি তার গায়ে জল ঢেলে না দেওয়া হয়। আমি তো কোন বেড়ালকে সাধ করে বৃষ্টিতে ভিজতে দেখিনি। তা তুমি যদি এরকম চেহারা করতে পার তো আমি নাচাব, বলতেই হবে। কি রকম চেহারা? নীলা ঠোঁট কামড়াল।

বেশ বুক-থমথমে চেহারা। অনিমেষ সাহসী হল।

প্রেমে পড়ে গেছ?

অনিমেষ খুব জোর সামলে নিয়ে বলল, পড়ে গেলে তো হাত পা ভাঙ্গবে, তখন কি আর উপভোগ করা যায়? তার চেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে যাওয়া ভাল।

নীলা আচমকা চোখ বন্ধ করল, তারপর বলল, শ্যামলের সঙ্গে এক দিন দেখা হয়েছিল? অনিমেষ অভিনয় করল, শ্যামল? কোন শ্যামল?

নীলা বিরক্তি চাপা গলায় উত্তর দিল, আমার এক বন্ধুর দাদা যার কথা এক দিন বলেছিলাম ।

অনিমেষ নীলার সঙ্গীর দিকে তাকাল। ছেলেটার মুখচোখ ভদ্র, দুআঙ্গুলে সিগারেট চেপে ওদের কথা শুনছে। এর সঙ্গে নীলার সম্পর্কটা কি ধরনের? দুজনে যদি প্রেম ট্রেম করে তবে তুই–তোকারি করছে কেন? ছেলেটার চোখের চশমা বেশ পুরু কিন্তু মুখের আদলে এখনও কৈশোর মাখানো। শ্যামলের প্রসঙ্গ নীলা ওর সামনে তুলতে কোন সঙ্কোচ বোধ করছে না যখন তখন অনিমেষ স্বচ্ছন্দে কথা বলতে পারে। সে বলল, হ্যাঁ, একটি ছেলে যে নিজের নাম বলেছিল শ্যামল, আমার কাছে এসেছিল।

কি কথা হয়েছিল?

ঠিক মনে নেই, অনেক দিন হয়ে গেল। কেন?

তোমার কি বলতে আপত্তি আছে।

না, না। মনে আছে, খুব পাগলামো করেছিল। তোমাকে না পেলে সে আত্মহত্যা কিংবা খুন অথবা এ দুটোই করতে পারে বলে জানিয়েছিল। কোনটাই করেনি, এবং করবে না সেটা জানতাম। নীলা হাসল।

কি রকম?

যারা প্রেম প্রেম বলে গলাবাজি কর তাদের সেটা তলানিতে ঠেকে গিয়েছে।

অনিমেষ নীলাকে পূর্ণ চোখে দেখল। কি নিরাসক্ত ভঙ্গীতে কথাগুলো উচ্চারণ করল ও। চোখ না সরিয়ে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, শ্যামলের সঙ্গে তোমার কোন সম্পর্ক নেই?

আশ্চর্য! এত কথার পর এই প্রশ্নটা তোমার মাথায় এল? অনুযোগের ভঙ্গীতে অনিমেষকে একবার দেখে নিয়ে বেয়ারাকে জায়গা করে দিল নীলা কফির কাপ রাখতে । .
 
অনিমেষের খুব জানতে ইচ্ছে করছিল কেন নীলা শ্যামলকে ত্যাগ করেছে? যে প্রেমের জন্য শ্যামল অমন মরিয়া হয়ে উঠেছিল সেই প্রেমে কি সততা ছিল না? সৎ না হলে মানুষ কখনও বুকের ভেতর থেকে কথা বলতে পারে? নাকি নীলাই শ্যামলকে নিয়ে খেলা করেছে, খেলার ইচ্ছে শেষ হলে আর সম্পর্ক রাখেনি। ওর মনে পড়ল শ্যামল সেদিন জানিয়েছিল নীলা নাকি অনিমেষের অনুরক্ত। সে কথা নীলাই শ্যামলকে জানিয়েছে। ব্যাপারটা যে হাস্যকরভাবে মিথ্যে এ কথা শ্যামলকে বলেছিল অনিমেষ।

নীলা এখন কফি করছে কিন্তু তার হাবভাবে একটুও আগের আলোচনার ছায়া নেই। খুব সহজে, যেন একটা বাসে চেপে কিছু দূর এগিয়ে অন্য বাস ধরার মত প্রসঙ্গ পালটে নিতে কোন অসুবিধে হয়নি ওর। অনিমেষ ভাবল নীলাকে এবার সরাসরি জিজ্ঞাসা করবে কেন তার নাম করে সে শ্যামলকে অজুহাত দেখিয়েছিল? নীলার সঙ্গে তো সেরকম সম্পর্ক তার কোন দিন গড়ে ওঠেনি।

কফির কাপ এগিয়ে দিয়ে নীলা বলল, থাক ছেড়ে দাও ওসব কথা। তুমি কেমন আছ বল?

ভালই। কফিতে চুমুক দিতে গিয়ে অনিমেষের খেয়াল হল তার পকেটে খুব সামান্য পয়সা পড়ে আছে। যদি নীলা তাকে দামটা দিয়ে দিতে বলে তা হলে খুব ফ্যাসাদে পড়ে যাবে সে। এই কফির কাপগুলোর দাম তার জানা নেই।

নীলা বলল, মিষ্টি ঠিক হয়েছে? তোমাকে বাড়িতে দুচামচ দিতাম।

অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ।

এতক্ষণে নীলার বন্ধু কথা বলল, আপনি কি স্কুল থেকেই ছাত্র ফেডারেশন করছেন? অনিমেষ অবাক হল, ছাত্র ফেডারেশন? না তো! আমাদের স্কুলে ওসব ছিল না।

নীলা বলল, ও জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলে পড়ত। মফস্বলের ছেলে খুব তাড়াতাড়ি কালার চেঞ্জ করে কলকাতায় এলে কোন থিওরি খাটে না।

অনিমেষ বলল, অনর্থক গালাগাল দিচ্ছ। আমি কোন কালেই পার্টি করিনি।

ছেলেটি এবার হেসে উঠল, তাই নাকি? কিন্তু আপনার মিথ্যে কথাটা খুব কাঁচা হল।

মিথ্যে? নিমেষ উত্তেজিত হল, আপনি আমার চেয়ে আমাকে বেশি জানেন?

তা কি করে সম্ভব? ছেলেটি হাসল, কিন্তু একটু আগে আমরা আপনাকে দেখে এসেছি। সাধারণ কোন ছেলে হলে বিমান অমন ভেল্কি দেখাত না।

অনিমেষ বুঝতে পারল আজ বিকেলে ইউনিভার্সিটি লনের ঘটনাটা ছেলেটি দেখেছে। আমরা বলতে কি নীলাও ওর সঙ্গে ছিল? কিন্তু এতক্ষণ ও বিষয়ে নীলা কোন কথা বলেনি কেন?

নীলা অনিমেষকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল, তোমার সঙ্গে ওর আলাপ করিয়ে দেওয়া হয়নি।

ছেলেটি নীলাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আলাপ অনেকক্ষণ হয়ে গিয়েছে। আমার নাম শচীন, আপনার চেয়ে এক বছরের সিনিয়র। আপনার নাম আজ ইউনিভার্সিটির সবাই জেনে গিয়েছে। আমি ঠিক বলতে পারছি না আপনার ভূমিকাটা কি, হিরো অব ক্লাউন!

নীলা বলল, সিনিয়র বলে বাড়তি কিছু দাবি করার চেষ্টা করো না। অনিমেষ অ্যাকসিডেন্টের জন্য একটা বছর নষ্ট করেছে। আসলে ও আমাদের ব্যাচের ।

শচিন বলল, অ্যাকসিডেন্ট? মানে বিমান যে ঘটনাটাকে ক্যাপিটাল করল?

নীলা ঘাড় নাড়ল।



অনিমেষ শচীনকে খুব ঠাণ্ডা এবং নিরীহ বলে ধরে নিয়েছিল। কিন্তু এখন এসব কথাবার্তা বলার ধরনে ওর ধারণা পালটে গেল। ছেলেটা প্রসঙ্গ পেলে খুব অ্যাগ্রেসিভ কথাবার্তা বলে, তখন তার হুল গভীর বিদ্ধ হয়। বিমান সম্পর্কে যে বক্রোক্তি শচীন করল তা থেকে মানে এইরকম দাঁড়ায় সে ছাত্র ফেডারেশনের সমর্থক নয়। কিন্তু নিরাসক্ত হলে কেউ আক্রমণ করে না, তা হলে সে নিশ্চয়ই অন্য কোনও দলকে সমর্থন করে।

অনিমেষ এবার নীলাকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি আজ ওখানে ছিলে?

নীলা কথা না বলে ঘাড় নাড়ল। হ্যাঁ।

তোমার কি রি-অ্যাকশন?

কোন রি-অ্যাকশন নেই। কারণ, পৃথিবীতে একটি জিনিসের ওপর আমার কোন আগ্রহ নেই, সেটা পলিটিকস।

অনিমেষ একটু জেদী গলায় বলল, পলিটিক্স ছেড়ে দাও, ছাত্র ফেডারেশনের সভায় বিমান আমাকে ডেকে মঞ্চে তুলে সবাইকে বুলেট মার্ক দেখাল, তুমিও দেখলে, তাতে তোমার কোন প্রতিক্রিয়া হয়নি?

নীলা হেসে বলল, এমন প্রশ্ন করো না যার মাথামুণ্ড নেই। একট ইয়াং ছেলের পুরুষ্টু থাই দেখতে কোন মেয়ের খারাপ লাগবে?

বজ্রাহতের মত বসে থাকল অনিমেষ। এরকম একটা সিরিয়াস বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছে আর নীলা কি অকপটে অন্য কথা বলে ফেলল। তখন সবার সামনে দাঁড়িয়ে যা হয়নি মূহূর্তে অনিমেষ আবিষ্কার করল ওর দুকানে রক্ত জমে গরম হয়ে যাচ্ছে। শচীন হেসে ফেলল নীলার উক্তি শুনে। বেশ বোঝা যাচ্ছে ওরা নীলার মুখে এ ধরনের কথাবার্তা শুনতে অভ্যস্ত। স্কটিশচার্চে মেয়েদের মুখে শারা শুনেছে অনিমেষ । ত্রিদিব বলে কোন কোন মেয়ে নিজেদের মধ্যে এত মুখ খারাপ করে কথা বলে যে ছেলেরা শুনলে হাঁ হয়ে যাবে। হয়তো ঠিক। কিন্তু নীলা যে নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে কথাটা বলল তাতে কোন অন্যায়বোধ মাখানো নেই কিন্তু মেয়েদের মুখে শুনতে অস্বস্তি হয়।

শচীন জিজ্ঞাসা কল, আপনার কি রি-অ্যাকশন?

অনিমেষ শচীনকে বলল, দেখুন, আমি কলকাতায় পড়তে এসেছিলাম। যেদিন এলাম সেদিন এখানে প্রচণ্ড গণ্ডগোল। যারা আন্দোলন করছিল তাদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হচ্ছিল। কিন্তু আমার এক হাতে বেডিং অন্য হাতে স্যুটকেস, আমি যে বোম ছুঁড়তে যাচ্ছিলাম না তা একটি বালকও বুঝবে, তবু পুলিশ আমাকে গুলী করল। গুলীটা আর একটু ওপরে লাগলে আজ এই কথাগুলো আমি বলার সুযোগ পেতাম না। কি দোষ ছিল আমার? পুলিশ যদি আমায় অ্যারেস্ট করে প্রশ্ন করত তা হলেই জানতে পারত সত্যি কথাটা। আমার জীবন, আমার ক্যারিয়ার নিয়ে ছেলেখেলা করল ওরা। এমন কি হাসপাতালে পুলিশ যেসব প্রশ্ন করেছে, যে ভাষায় সন্দেহ প্রকাশ করেছে, আমি তা কখনো ক্ষমা করতে পারব না। আপনি বলছেন হিরো না ক্লাউন আপনি বুঝতে পারছেন না। আমার বুলেটের দাগ যদি আরো কিছু ছেলের মন তৈরি করতে সাহায্য করে তাহলে আমার ক্লাউন সাজতে আপত্তি নেই।
 
কথাগুলো এমন স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে এল যে অনিমেষ নিজেই অবাক হয়ে গেল। সামান্য আগে যে ব্যাপারটা নিয়ে এমনভাবে ভাবেনি। বিমানের ঘটনাটা তার মনে খুব অস্বস্তি এনে দিয়েছিল, রাগও হয়েছিল তার। কিন্তু যেই শচীন এটা নিয়ে ব্যঙ্গ করল সঙ্গে সঙ্গে নিজের অজান্তেই একটা প্রতিরোধ তৈরি হয়ে গেল। আর কিছু না থোক, তার জীবনের একটা বছর সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে গেছে ওই গুলীটার জন্যে এ কথা তো ঠিক। শচীন কথাগুলো মন দিয়ে শুনে বলল, আপনার কথা আমি মানতে পারলাম না।

অনিমেষ কোঁচকালো, তার মানে?

শচীন বলল, আগুনে হাত দিলে হাত পুড়বেই এই সত্য ভুলে গিয়ে যদি আপনি হাত পুড়িয়ে আগুনকে গালাগালি দেন তা হলে সেটা হাস্যকরই হবে। আপনি যখন দেখলেন পুলিশের সঙ্গে কিছু লোকের সংঘর্ষ চলছে, বোম ফাটছে, তখন আপনার সেই স্পটে যাওয়াটাই তো অন্যায়। গোলমালের মধ্যে পুলিশের পক্ষে কি করে জানা সম্ভব কে নির্দোষ কে দোষী?

অনিমেষ বলল, আমি সেদিনই প্রথম কলকাতায় এসেছি, এখানকার হালচাল কিছুই জানতাম না। তা ছাড়া– ।

নীলা এতক্ষণে কথা বলল, শুনেছিলাম সেদিন কার্ফু ছিল এবং তুমি দৌড়চ্ছিলে।

অনিমেষ বলল, ওরকম পরিস্থিতিতে না দৌড়ে উপায় ছিল না।

শচীন বলল, তা হলে বুঝুন। কার্ফুতে বাইরে বেরিয়ে আপনি প্রথম অন্যায় করেছেন। সে সময় পুলিশ স্বচ্ছন্দে আপনাকে গুলি করতে পারে আইন ভঙ্গ করার অপরাধে। মুশকিল হল, আমরা নিজেদের ত্রুটিগুলো কখনোই লক্ষ্য করি না।

অনিমেষ অস্বস্তিতে পড়ল। হ্যাঁ, ব্যাপারটা এদিক দিয়ে চিন্তা করলে শচীনের যুক্তিকে অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু মন থেকে মেনে নিতে পারছে না অনিমেষ। দেশের মানুষ খাবারের জন্য সরকারকে অনুরোধ করে সাড়া না পেয়ে ফুঁসে উঠেছিল। সরকার তাদের খাবার না দিয়ে কার্ফু জারি করে পুলিশ লেলিয়ে দিল–এই ব্যাপারটাই মেনে নেওয়া যায় না। সে জিজ্ঞাসা করল, তার মানে আপনি পুলিশের কাজ কর্ম সমর্থন করছেন?

এই ক্ষেত্রে করছি, তবে সব সময় যে পুলিশ গঙ্গাজল হয়ে থাকে তা বিশ্বাস করি না। এরকম ঘটনার প্রচুর নিদর্শন আছে। একটা সরকার যেটা জাতীয় সরকার–তার কোন ভাল কাজ নেই এ হতে পারে না। আমাদের দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে কম্যুনিস্টদের কি ভূমিকা ছিল? আজ যদি ওরা ক্ষমতায় আসে দেশের মানুষের সব অভাব এক দিনে দূর হয়ে যাবে? প্রতিটি মানুষ সৎ বিবেকবান নাগরিক হয়ে যাবে? পুলিশ তার চরিত্র পালটাবে? নেভার। পুলিশ চিরকাল পুলিশই থাকবে। দুশো বছর ধরে ইংরেজ এই দেশ থেকে যে জিনিসটা সযত্নে মুছে দিয়ে গেছে সেটা হল প্রশাসনযন্ত্রের মর‍্যালিটি। সেটা ফেরত পাওয়া খুব সোজা ব্যাপার নয়, অনিমেষ। শচীন খুব শান্ত ভঙ্গীতে কথা বলছিল।

অনিমেষ বলল, তাই বলে নিজের দেশের মানুষের ওপর গুলি চালাতে হবে?

শচীন হেসে ফেলল, দরকার হরে করতে হবে বইকি। লেনিনকে পৃথিবীর সব মানুষ শ্রদ্ধা করে। লেনিন একটা বিরাট ব্যক্তিত্ব; নিজের হাতে দেশ গড়েছেন। কম্যুনিস্টরা তাকে গুরু বলে স্বীকার করে। ওয়েল, বিপ্লবের পর সেই লেনিন কি বলেছিলেন? রাশিয়ার তখন প্রচণ্ড খাদ্যাভাব। এদিকে যেখান থেকে খাবার আসবে সেখানে গোলমাল শুরু হয়েছে। বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে রেলওয়েম্যানরা ধর্মঘট শুরু করেছে। ধর্মঘট যে কোন শ্রমিকের হাতিয়ার এ কথা লেনিন এক সময় বলেছেন। তাই কিছু করা যাচ্ছে না। সেই মুহূর্তে এমন সময় নেই যে ওদের সঙ্গে আলোচনায় বসে দ্রুত ফয়সালা করা যায় দাবিগুলোর। লেনিনকে জানানো হলে তিনি বললেন ওদের ধর্মঘট তুলে নিতে বলো। যদি তা না করে তা হলে ফোর্স অ্যাপ্লাই কর। দেশের সাধারণ মানুষ যখন অনাহারের সম্মুখীন তখন তাদের কথাই আগে ভাবতে হবে। এর জন্যে প্রয়োজনে গুলী চালাতে যেন পুলিশ কোন দ্বিধা না করে। মনে রাখবেন কথাগুলো লেনিনের মুখ থেকে বেরিয়েছিল। খাদ্য নিয়ে তিনি কম্যুনিস্ট থিওরিতে বিশ্বাস করেননি। এই ভূমিকা যদি এ দেশের সরকার নেন তাহলে চীৎকার উঠবে ফ্যাসিস্ট ফ্যাসিস্ট বলে। আমার জানতে ইচ্ছে হয় আপনারা কি চান? একটা সুখী ভারতবর্ষ, না নিজেদের জগাখিচুড়ি মতবাদের প্রতিষ্ঠা এবং তা থেকে মুনাফা?
 
অনিমেষ মন দিয়ে শচীনের কথা শুনল। লেনিনের এই কাজ সে অকপটে সমর্থন করছে, ব্যাপারটা তার ভাল লেগেছে। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ইজমের চেয়ে মানবতা অনেক বড়, এই সত্য লেনিন মেনে নিয়েছিলেন বলে সে খুশী হল। চোখ বন্ধ না করেই সে দেখতে পেল খাদ্যবাহী একটা গাড়ি স্টেশন থেকে বেরিয়ে আসার মুখে ধর্মঘট শ্রমিকেরা বাধা দিচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্য এর ফলে নতুন সরকার নিশ্চয়ই দাবি মেনে নেবে। লেনিনের নির্দেশে পুলিশ তাদের বুঝিয়েও নিরস্ত করতে পারেনি। ধর্মঘট যেহেতু শ্রমিকের হাতিয়ার ওরা নির্ভয় ছিল। কিন্তু সেই মুহূর্তে পুলিশ গুলী চালাল। অবাক শ্রমিকের চোখের সামনে দিয়ে ট্রেনগুলো বেরিয়ে আসছে স্টেশন থেকে। দেশের না খেতে-পাওয়া মানুষের দরজায় খাবার পৌঁছে দিতে ট্রেনটি গর্জন করে ছুটে যাচ্ছে। ছুটন্ত ট্রেনটির নাম মানবতা।

শচীন এবং নীলা অনিমেষকে লক্ষ্য করছিল। অনিমেষের হুঁশ হতে সে অপ্রতিভ হয়ে পড়ল। ইদানিং এই ব্যাপারটা বেড়ে গেছে। কথা বলতে বলতে বা একা একাই হঠাৎ কোন প্রসঙ্গ বা ঘটনা মন ছুঁয়ে গেলেই নিজের অজান্তে অন্যমনস্ক হয়ে যায়। কয়েক মুহূর্তের জন্যে বাস্তব থেকে অনেক দূরে সরে যেতে হয় তখন। কফি খেতে খেতে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি যেন বলছিলেন?

শচীন আবার বলল, আপনি কেন রাজনীতি করবেন? একটা সুখী ভারতবর্ষ পেতে, না কতগুলো ফর্মুলার পেছনে ছুটতে? মার্কস, মাও সে তুং কিংবা লেনিন যে কথা বলেছেন সেই নির্দেশিত পথে এই দেশকে মানুষ করতে চান?

অনিমেষ বলল, কেন নয়? ওঁরা তো সেভাবেই নিজেদের দেশ গড়েছেন।

এতক্ষণ নীলা একটাও কথা বলেনি। হঠাৎ সে ঘাড় নেড়ে বেয়ারাকে ডেকে দাম মিটিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল, তোমরা কথা বল, আমি যাচ্ছি।

অনিমেষ অবাক হল, মানে?

মাথা ধরে গেছে। এই সব ইউজলেস কথাবার্তা বলে তোমরা কি আনন্দ পাও জানি না, কিন্তু আমার সহ্য হচ্ছে না। অনর্থক সময় নষ্ট করে কোন লাভ নেই। নীলা ব্যাগ হাতে তুলে নিল।

শচীন বলল, কিন্তু তুই কোথায় চললি? এরকম তো কথা ছিল না।

নীলা বলল, কোন কথা কি আদৌ ছিল?

শচীন বলল, না,আমি ভেবেছিলাম তুই আমার সঙ্গে সেখানে যাবি।

না, আজ আর ভাল লাগছে না। এখন একটু রাস্তায় হাঁটব। নীলা বলল।

আমি সঙ্গে যাবো? শচীন উঠে দাঁড়াল।

না। একা একা হাঁটতেই ভাল লাগবে। অনিমেষ–। নীলা ফিরে তাকাল। অনিমেষও উঠে দাঁড়ায়েছিল। ও ঠিক বুঝতে পারছি না নীলাকে। এতক্ষণ কথা বলার নেশায় নীলার কথা সত্যি ভুলে গিয়েছিল সে। মেয়েরা কি উপেক্ষা বেশীক্ষণ সহ্য করতে পারে না, এতক্ষণ চুপ করে থেকে নীলা আচমকা ওর অস্তিত্ব বোঝাবার জন্য উঠে চলে যাচ্ছে! সে নীলার দিকে তাকিয়ে হাসল, বল।

তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা ছিল! নীলা আস্তে আস্তে উচ্চারণ করল।

বল।

এখন নয়।

ও, এখন তো তুমি একা একা হাঁটবে। নীলার দিকে তাকিয়ে অনিমেষ হাসিটা জিইয়ে রাখল।

নীলা দুটো চোখ বড় করে অনিমেষের মুখের দিকে তাকিয়ে বল, হ্যাঁ। কাল চারটে নাগাদ যুনিভার্সিটির সামনের বাস স্ট্যান্ডে এসো।

নীলা আর দাঁড়াল না। শচীনকে একটু অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল। সেটা নক্ষ্য করে অনিমেষ তাকে জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার বলুন তো?

কাঁধ নাচালো শচীন, ও এইরকম। কোনভাবেই অ্যাসেসমেন্ট করা যায় না। আমরা যারা ওর খুব ঘনিষ্ঠ তারাও ওকে বুঝতে পারি না। বরফের মত। মুঠোয় ধরে অনুভব করতে করতেই জল হয় আঙুল গলে বেরিয়ে যায়। যাক, ছেড়ে দিন এসব কথা । আপনি তা হলে এর আগে কখনো অ্যাকটিভ পার্টিই করতেন না?

প্রসঙ্গ ফিরে আসায় অনিমেষ অবাক হল, না।

আমার যুক্তি আপনার কেমন লাগল?

সমস্ত যুক্তির পাল্টা যুক্তি আছে।

বেশ। এক দিন আসুন না, আরো খোলাখুলি আলোচনা করতে কোন অসুবিধা নেই।
 
শচীন বিদায় নিয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যেতে অনিমেষ ঘাড় ঘুড়িয়ে কফি হাউসের দিকে তাকাল। চারধার গমগম করছে। প্রতিটি টেবিলের একান্ত কথা একসঙেগ জুড়ে গিয়ে এই হলের মধ্যে ছোটাছুটি করছে। অনিমেষ দেখল পরমহংস তাকে হাত নেড়ে ডাকছে। এতক্ষণ লক্ষ্য করেনি, এখন দেখল ওদের টেবিলে লোক কমেছে। একটি মেয়ে, যার নাম নবনীতা, সে বোধ হয় এর মধ্যে কখন উঠে গেছে। এই হলের মধ্যে দাঁড়িয়ে বাইরেটা ঠিক বোঝা যায় না তবে সন্ধ্যে হয়ে গেছে অনেকক্ষণ এটা ঠিক। এই সময়েও মেয়েরা সমানে আড্ডা মেরে যাচ্ছে। তাদের বাড়িতে কেউ কিছু বলে না বোধ হয়। আটটার মধ্যে হোস্টেলে ফিরতে হবে। এটা অবশ্য পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ছেলেদের জন্য আবশ্যক নয়, তবু অনিমেষ কোন দিন নিয়ম ভাঙেনি।

পরমহংস হলল, চোট খেলে গুরু?

অনিমেষ হতভম্ব হয়ে গেল। পরমহংসের কথাবার্তা কোত্থেকে শুরু হয় সেটা আন্দাজ করা মুশকিল।

সে জিজ্ঞাসা করল, মানে?

মহারানি তোমাদের মাটিতে বসিয়ে রেখে দিব্যি হাওয়া হয়ে গেলেন।

ওর কথা শেষ হতে না-হতেই মেয়েরা একসঙ্গে হেসে উঠল, যেন ব্যাপারটা খুব মজার। অনিমেষ কিছু বুঝতে না পেরে একবার পরমহংস আর একবার মেয়েদের দিকে তাকাতে লাগল। সেটা লক্ষ্য করে আত্রেয়ী বলে উঠল, আপনার মাথায় যেন কিছুই ঢুকছে না।

অনিমেষ বলল, সত্যি কিছু ঢুকছে না।

আত্রেয়ী চোখ ছোট করল, ওই মেয়েটিকে আপনি কতদিন চেনেন?

কেন?

নীলা মুখার্জি তো বিদ্যাসাগর থেকে এসেছে, স্কটিশ থেকে নয়। তা ছাড়া ও আমাদের এক বছরের সিনিয়র। আগে বলুন, চেনাশোনা হল কি করে?

পারিবারিক সূত্রে আমরা পরিচিত। অনিমেষ বিস্তারিত বলল না । তিনটে মুখই যেন হঠাৎ বিব্রত হয়ে পড়ল। আত্রেয়ীর খুব স্বাভাবিক হবার চেষ্টাটাই অনিমেষের কাছে অস্বাভাবিক ঠেকল। পরমহংস বলে উঠল, সরি গুরু, সেমসাইড হয়ে গেছে।

অনিমেষ হেসে ফেলল। একটা কিছু ওরা হঠাৎ চেপে যাচ্ছে বুঝতে পেরে সে সহজ হবার ভান করল, কেন, ব্যাপারটা কি? অনেক বছর পর ওর সঙ্গে দেখা হল।

তোমার রিলেটিভ?

ঘাড় নাড়ল অনিমেষ, না, না। জাস্ট পরিচিত।

এবার আত্রেয়ী বলল, তা হলে একটা কথা বলি, নীলা মুখার্জী থেকে দূরে থাকবেন।

কেন? অনিমেষের এবার মজা লাগছে।

পরমহংস এবার গুছিয়ে বসল, আরে গুরু যুনিভার্সিটিতে পা দিয়েই যার গল্প শুনলাম সে হল ওই নীলা মুখার্জী। যুব-হৃদয় সম্পর্কে স্পেশালিস্ট। অধ্যাপক থেকে বেয়ারা সবাই ওর কাছে নেতিয়ে থাকে। অথচ ওর চেয়ে সুন্দরী মেয়ে অনেক আছে, আর নীলা মুখার্জী তো মোটামুটি শ্যামলাই। তবু মাইরি মেয়েটার মধ্যে এমন একটা চমক আছে, যেটা চুম্বকের মত টানে সবাইকে। কোন ছেলেকে ওর সঙ্গে সাত দিনের বেশী দেখা যায় না। সেই রাক্ষসের মত, যার প্রতিদিন একটা করে মানুষ লাগত। নীলা মুখার্জি সম্পর্কে এই ধারণাটা চলতি আছে।

শুনতে শুনতে অনিমেষের কোন প্রতিক্রিয়া হচ্ছিল না। ও বলল, আচ্ছা?

আত্রেয়ী বলল, সেই লক্ষীরানীর সঙ্গে আপনাকে এতক্ষন বসতে দেখে কফি হাউসের অনেকের বুকে সমবেদনা জমেছে। বিভিন্ন টিবিলে এমন অনেক বসে আছে যারা এক দিন আপনার ভুমিকায় ছিল।

অনিমেষ বলল, কিন্তু ওর সঙ্গে একজন ছেলে-বন্ধু ছিল।

আত্রেয়ী জানালো, বোধ হয় লেটেস্ট কেউ।

অনিমেষ হেসে বলল, আপনারা অনেক খবর রাখেন তো। তবে আমার সঙ্গে নীলার সম্পর্ক এমন ধরনের যে কোন দিন আমাকে ওই ভুমিকায় দেখবেন না।

অনন্যা এবার কথা বলল, মফস্বলের ছেলেরা দারুণ মিচকে হয়।

হঠাৎ কবজি ঘুরিয়ে সময় দেখে লাফিয়ে উঠল পরমহংস, আরে ব্বাস, আমার চাকরি চলে যাবে!

আত্রেয়ী অবাক হয়ে বলল, চাকরি? এই সময়ে চাকরি?

পরমহংসের দাঁত সামান্য উঁচু হওয়ায় মুখটা সব সময় হাসি হাসি দেখায়, তোমাদের মত আলালের ঘরের দুলালী নই তো খুকী, আমাদের খেটে খেতে হয়। দেড়শ টাকার ট্যুশনি–না গেলে বামআর ছুঁড়বে বুড়ো।

অনন্যা ফুঁসে উঠল, আললের ঘরের দুলালী মানে?

পরমহংস মাথা ঘুরিয়ে জবাব দিল, বাপের পয়সায় এম-এ পড়তে এয়েছ বেশ মোটা একটা কাতলা বিয়ের বাজারে গাঁথবে বলে। তোমাদের আর কি চিন্তা!

অনন্যা তিক্ত গলায় বলল, কি অদ্ভূত জ্ঞান! সেদিন দশটার সময় বাসে আসছিলাম, আধবুড়ো লোকগুলো চেঁচিয়ে উঠল ,অফিস টাইমে মেয়েছেলে ওঠে কেন? যেন আমরা চাকরি করে বাপ মা ভাইকে খাওয়াই না। এইটিনথ সেঞ্চুরির মানসিকতা নিয়ে প্রগতির গলাবাজি করতে বাংলাদেশের পুরুষদের জুড়ি নেই।


পরমহংসের মুখটা এই প্রথম নিষ্প্রভ দেখাল। অনিমেষ এতক্ষণ অনন্যাকে ভাল করে লক্ষ্য করেনি, এই কথা শোনার পর এক নিমেষে অন্যরকম ধারণা জন্মাল।

আত্রেয়ী বলে উঠল, ঠিকই বলেছিস। যাক, আমরা সবাই উঠব। বেয়ারাটাকে ডাকুন, দাম মিটিয়ে দেওয়া যাক।

পরমহংস খুব দ্রুত নিজের অবস্থা সামলে বলে উঠল, আমি বাদ।

আত্রেয়ি বলল, মানে?

পরমহংস আত্নসমর্পনের ভঙ্গীতে বলল, তোমরা মাইরি অন্নপূর্ণার জাত আর আমি চিরকাল ভিখিরী শিব। তোমাদের বক্ষে নিয়েই তো চলে আমার।

অনন্যা ফুঁসে উঠল, ইস। অন্নপূর্ণা-শিবের রিলেশনটা জানা আছে? অত সস্তা না। ঠিক আছে, আমিই দিয়ে দিচ্ছি।

পরমহংস বলল, কেন, অনিমেষ শেয়ার করবে।

অনন্যা মাথা নড়ল, কেন? উনি তো এখানে কিছু খাননি!

বিল মিটিয়ে নিচে নামতে অনিমেষের মনে হল সে যেন অদ্ভূত শান্ত এক জগতে পা দিল। সামনে ট্রাম বাস রিকশা চলছে, কিনতু সেটা কফি হাউসের তুলনায় এত নির্জন যে দুটো কান খাঁ খাঁ করতে লাগল। মেয়েরা চলে যেতে পরমহংসের সঙ্গে ট্রাম ধরার জন্য রাস্তা পেরিয়ে অনিমেষ কথাটা বলে ফেলল।

পরমহংসু বলল, ট্যুশনী! তোমারও অবস্থা টাইট নাকি?

অনিমেষ স্বীকার করল, পেলে খুব উপকার হত। অবশ্য আমি আগে কাউকে পড়াইনি।

পরমহংস বলল, দুর, ওর জন্য কোন এলেম লাগে না। যে যত ভাল ম্যানেজমাস্টার সে তত ভাল টিউটর। ঠিক আছে, আমি দেখছি।

একটা রানিং ট্রামে ওঠার জন্য সে দৌড় শুরু করল। অনিমেষ সেই চেষ্টা করতে গিয়ে থমকে গেল, পায়ে খচ করে উঠেছে, চোখ বন্ধ করে ব্যথাটা সামলাল সে।
 
পরমহংস চলে যাওয়ার পর অনিমেষ অসহায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই বাঁদুর ঝোলা বাসট্রামে ওঠা তার পক্ষে সম্ভব নয়। টনটন করছে অপারেশনের জায়গাটা। এতদিন দিব্যি ছিল কখনো কষ্ট হয়নি। আজ ট্রামে ওঠার চেস্টা করতে গিয়ে আচমকা এই ব্যথাটা শুরু হয়ে গেল। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলে তবু সহ্য করা যায়, কিন্তু সামনে পা ফেললে মনে হচ্ছে চোখের সামনে লক্ষ আগুনের ফুলকি নাচচ্ছে। জোড়া হাড়টা কি খসে গেল? যাঃ, তা যদি হতো তা হলে নিশ্চয় এতক্ষণ তার হুঁশ থাকত না। সোজা হয়ে থাকলে ব্যথাটা সব সময় থাকছে না, মাঝে মাঝে থাই থেকে একটা ঘূর্ণির মত পাক খেয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। ডাক্তার বলেছিল ষাট বছর বয়স অবধি কোন অসুবিধা হবে না। তারপর ওখানে বাতের যন্ত্রণা হতে পারে। কিন্তু মাত্র পাঁচ বছর বাদেই এই রকমটা হয়ে গেল? হয়তো পা বেকায়দায় পড়েছিল, অনিমেষ ঘামে ভিজে চোখ বন্ধ করল । এই যদি শরীরের অবস্থা হয় তা হলে সে জীবনে কোন কিছুই করতে পারবে না! একটা অক্ষম পঙ্গু মানুষের পক্ষে কোন স্বপ্ন দেখা বড় রকমের ভ্রান্তি। নিজের বিছানায় শুয়ে পড়তে অনিমেষ ব্যাকুল হয়ে উঠল। অথচ হেঁটে যে এখান থেকে হোস্টেলে ফিরে যাবে তা অসম্ভব। অনিমেষ দেখল দূরে একটা রিকশা দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু দুজন বৃদ্ধা রিকশাওয়ালার সঙ্গে দর কষাকষি করছেন। রিকশা করে হোস্টেলে ফিরে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। এখান থেকে যা দফুরত্ব তাতে ওরা এক টাকার কম নিশ্চয়ই নেবে না। অথচ পকেটে শুধু সেটুকুই রয়েছে। কাছেপিঠে আর রিকশা নেই। অনিমেষ অপেক্ষা করছিল যদি ওই বৃদ্ধারা বিফল হয়ে রিকশাওয়ালাকে ছেড়ে দেন। কিন্তু ওর নাকের ডগা দিয়েই রিকশাওয়ালা তাদের নিয়ে বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রীটে ঢুকে গেল।

অনিমেষ যখন সাতপাঁচ ভাবছে তখন হাওয়া উঠল। এতক্ষণ লক্ষ্য করেনি কোন ফাঁকে কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি এসে যাবে এই আশঙ্কায় রাস্তাঘাটের চেহারা পালটে যেতে লাগল দ্রুত। বাসস্টপে যারা দাঁড়িয়ে ছিল তারা মরিয়া হয়ে এক-একটা বাসে ওঠার চেষ্টা করছে। বৃষ্টি নামার আগেই সবাই বাড়ি ফিরতে চাইছে। অনিমেষ হাল ছেড়ে দিল। তার পক্ষে যখন কিছু করা অসম্ভব তখন খামোকা চিন্তা করার অর্থ হয় না। আসুক বৃষ্টি, একসময় রাত আরো গভীর হলে নিশ্চয়ই ট্রাম খালি হবে, তখন কোনরকমে উঠে পড়লেই হবে। হোস্টেলের গেট বন্ধ হয়ে গেলে সুপারিন্টেডেন্টকে সত্যি কথা বলে দিলেই হবে, তাতে তিনি যদি অসন্তুষ্ট হন তা হলে হবেন। পেছনে ফুটপাতের ওপর যে বই-এর দোকানগুলো হয়েছে তার একটায় ভাল ছাউনি আছে। অনিমেষ চেষ্টা করল সেই ছাউনির তলায় গিয়ে দাঁড়াতে। বৃষ্টি এলে নিশ্চয়ই হুটোপুটি শুরু হয়ে যাবে।

ব্যথাটা এখন আর পাক দিয়ে উঠছে না। কিন্তু হাঁটা যাচ্ছে না কিছুতেই । অনিমেষ পাশ ফিরতেই মনে হল একটা গাড়ি দ্রুত গতিতে ওর সামনে দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। কেউ চেঁচামেচি করছে শুনে সে গাড়িটার দিকে তাকাতে অবাক হয়ে গেল। থম্বোটোর-সেই রুমমেট ট্যাক্সির জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে তাকে ডাকছে হাত নেড়ে। পেছন থেকে বোঝা যাচ্ছে থম্বোটোর বন্ধু একা নেই । অনিমেষ এমন হকচকিয়ে গিয়েছিল যে প্রথমে সে ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি কি করবে। বাসস্টপে দাঁড়ানো কয়েকজন ছুটে গেল ট্যাক্সিটার কাছে। থম্বোটার বন্ধু হাত নেড়ে তাদের না বলল। ও নিশ্চয়ই হোস্টেলে ফিরছে, অনিমেষের মনে হল আকাশ থেকে যেন দেবদূত থম্বোটোর বন্ধুর চেহারা নিয়ে এসেছে, এরকমটা ভাবাই যায় না। এক পা এগোতেই অনিমেষের থাই থেকে কোমর অবধি একটা আগুনের বল ছুটে গেল। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত হয়ে গেল, চোখে জল এসে যাওয়ার উপক্রম। সে দেখল থম্বোটোর ট্যাক্সির দরজা খুলে প্রায় দৌড়ে ওর কাছে চলে এল, হোয়াত, হ্যাপেন্ড?

এক হাত দিয়ে নিজের পা দেখাল অনিমেষ, আই ক্যান নট ওয়াক। অফুল পেইন। থম্বোটোর বন্ধু ডান হাতে অনিমেষের পিঠে একটা বেড় দিয়ে বলল, সাপোর্ট সাপোর্ট।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top