What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected কালবেলা- সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

এই সময় আরো কয়েকজন ছেলে ক্যান্টিনে ঢুকল। ওদের দেখে বিমান একটু গম্ভীর হয়ে গেল। সুবাসদাও একটু উসখুস করছিলেন। দলটা থেকে একজন এগিয়ে এল, বিমান, তোমার সঙ্গে কথা আছে।

কি ব্যাপার! বিমান ওদের দিকে তাকাল।

আমাদের ছেলেদের কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না। অনিমেষ দেখল যে ছেলেটি কথা বলছে তার মধ্যে কোন জড়তা নেই খদ্দরের পাঞ্জাবি আর ধুতি পরনে।

কে বাধা দিচ্ছে, আমরা?

অমাদের কাছে তাই খবর।

কি রকম?

নবাগত ছাত্রদের অভ্যর্থনা জানিয়ে যে সব পোস্টার দেওয়া হয়েছিল সেগুলো ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। ছাত্র পরিষদের একটাও পোস্টার চোখে পড়ছে না।

তুমি কি বলতে চাইছ ওগুরো আমরা ছিঁড়েছি। কেন ছিঁড়ব? ওই সব পোষ্টার পড়লে কি নতুন ছেলেমেয়েরা সব আমাদের বিরোধী হয়ে যাবে? দ্যাখ্যো মুকুলেশ, আমি চাই না কারো সঙ্গে গায়ে পড়ে বিরোধ করতে। তোমাদের যদি সত্যি কোন নালিশ থাকে তা হলে ডি-সির কাছে যাও, আমার কাছে এসেছ কেন?

আমার কি করব সেটা আমাদের বিবেচ্য। যেহেতু তুমি জি এস, আর বাম ছাত্র ফেডারেশন এই কাজ করছে তাই তোমাকে জানিয়ে রাখা হল। যদি একই রকম আচরণ চলতে থাকে তা হলে পরবর্তীকালে আমরা অন্য রকম ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হব।

কথা শেষ করে ছেলেটি চলে যাচ্ছিল, বিমান তাকে ডাকল। মুকুলেশ পেছন ফিরে তাকাতে বিমান বলল, তুমি আমাকে জান, এই রকম ভয় দেখিয়ে কোন কাজ হবে না। তোমাদের পোষ্টার কারা ছিঁড়ছে আমি জানি না, তবে ওইসব পোষ্টার লেখার আগে তোমাদের চিন্তা করা উচিত ছিল। নতুন ছেলেমেয়েদের ওয়েলকাম করতে আমাদের গালা-গালি করতেই হবে–এটা কি ধরনের ভদ্রতা? কই আমাদের পোস্টরে তো তোমাদের সম্পর্কে কোন কথা বলিনি। রাজনীতির প্রথম কথাই কি অভদ্রতা?

মুকলেশ হেসে উঠল, রাজনীতির পাট তোমার কাছ থেকে নেবার আগে আমার আত্মহত্যা করা উচিত। নতুন যে সব মুরগী ঢুকছে তাদের ব্রেন-ওয়াশ করতে পারো, আমাকে জ্ঞান দিতে এসো না। তোমরা কতটা ভদ্র তার বিরাট লিস্ট আমার কাছে আছে। যথাসময়ে ছেলেমেয়েদের কাছে সেটা রাখব।

বিমান একটু গলা চড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি আমাকে চোখ রাঙাতে এসেছ?

মুকুলেশ দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, তুমি জেনারেল সেক্রেটারী, তোমাকে চোখ রাঙানোর সাধ্য কি! কিন্তু মনে রেখ, এই দেশটা ভারতবর্ষ, চীনের দালানদের আমরা ক্ষমা করব না। যেমন এসেছিল তেমনি চলে গেল ওরা।

অনিমেষ দেখল সমস্ত ক্যান্টিনঘর এখন চুপচাপ। যারা ওপাশে ভাত খাচ্ছিল তারা তো বটেই, এমন কি ক্যান্টিনের বয়গুলো পর্যন্ত কাজ ভুলে বিমানের দিকে তাকিয়ে আছে। একটা নৈঃশব্দ কিছুক্ষণ সুতোর মুখে ঝুলতে থাকল। এতক্ষণ সুবাস সেন চুপচাপ শুনছিল, এবার নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, ব্যাপারটা কি?

সে নিজে হলে কি হতো কে জানে, কিন্তু অনিমেষ অবাক হয়ে দেখল বিমান খুব সহজেই স্বাভাবিক হয়ে গেল। মাথা নেড়ে হেসে বলল, সেই পুরনো চাল, পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করা। দিনরাত গালাগাল দেবে কিন্তু প্রতিবাদ করলেই ছাত্র ফেডারেশনের আক্রমণ বলে পোষ্টার পড়বে।

সুবাস জিজ্ঞাসা করল, পোস্টার ছেঁড়ার ব্যাপারটা কি?

বিমান কাঁধ ঝাঁকালো, আরো যাচ্ছে তাই কথা লিখছে! নবীন ছাত্ররা চীনের দালালদের চিনে রাখুন। একজন দেশদ্রোহী আপনার পাশেই আছেন, যার গেঞ্জি চীন থেকে আসছে। এইসব পোষ্টার দেখেতে দেখতে কোন ছেলে যদি মাথা গরম করে ফেলে এক-আধটা ছিঁড়ে ফেলে তা হলে আমি কি করতে পারি! ওদের চরিত্র সেই টিপিক্যাল গ্রাম্য ঝগড়াটে বুড়ীর মত হয়ে গেছে।

বিমল বলল, দক্ষিণীরা?

বিমান হেসে ফেলল, ভাল বলেছ। তাদের মতিগতি বোঝা যাচ্ছে না। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ওদের সংখ্যা সামান্য, শুনছি ছাত্র পরিষদের সঙ্গে একটা আঁতাত হচ্ছে ওদের। এক সময় সবার চরিত্র প্রকাশ পাবেই।
 
চার-পাঁচজন ছেলেকে খুব উত্তেজিত গলায় কথা বলতে বলতে এদিকে আসতে দেখল ওরা। সবাই অনিমেষের সমবয়সী, দু-একজনের চেহারা বেশ রাগী রাগী। ক্যান্টিনে ঢুকে ওরা সরাসরি কাছে চলে এল, কি ব্যাপার, শুনলাম মুকুলেশ নাকি তোমাকে মারতে এসেছিল? একজন খুব উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করল।

কে বলল? অনিমেষ তাজ্জব হয়ে শুনল কি নিরাসক্ত গলায় কথা বলছে বিমান!

সত্যি কিনা একবার বল । শালার লাশ নামিয়ে দেব আজই। এতবড় হেক্কড় যে তোমার গায়ে হাত তুলতে আসে! ফ্যক্ট?

বিমান ওদের উত্তেজিত মুখগুলার দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্তে ভেবে নিয়ে বলল, মারামারি করে কোন লাভ হবে না। এস এফ গুন্ডাদের পাটি নয়। ওটা যাদের ধর্ম তারা করুক। তোমার এত উত্তেজিত হয়ে পড়লে ওরা সেই সুযোগ নেবে।

আর একজন বলে উঠল, কিন্তু গুরু তোমাকে ইনসাল্ট করলে তো আমরা মুখ বুজে বলে থাকব না। মুকুলেশকে এর কিম্মত দিতে হবে। শালা কি গায়ে হাত তুলেছে?

বিমান হেসে ফেলল, তোমরা এত ক্ষেপে গেছ কেন? বলছি তো ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। আমি জানি কি করে এটা ট্যাকল করতে হবে।

চুপচাপ শুনছিল অনিমেষ একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে অবাক হচ্ছিল ও, ছেলেগুলোর প্রশ্নের উত্তরে বিমান একবারও বলছে না ছাত্র পরিষদের ছেলেরা তাকে মারেনি।

দলের আর একজন বলল, কিন্তু ওদের প্রশ্রয় দিলে শেষ পর্যন্ত রোকা যাবে না। খামোকা জি এস এর গায়ে হাত তুলবে আর আমরা সেটা সহ্য করব–শালারা টিটকিরিতে হাড় জ্বালিয়ে দেয়।

বিমান দুমূহুর্ত চিন্তা করে বলল, সুদীপ এসেছে?

না, দেখিনি। একজন জবাব দিল।

একটু দ্যাখো। তোমার ক্লাসে বলে এসো যে আজ তিনটের সময় লনে আসতে। যা বলার আমরা সাধারণ ছাত্রদের কাছে সরাসরি বলব।

গেট মিটিং?

না, গেট মিটিং নয়। জাস্ট একটা গেট টুগেদার।

মাইক বলব?

দরকার নেই। আমার গলা ওদের কাছে পৌঁছে যাবে। এ নিয়ে তোমরা কোন গোলমাল করো না। তিনটে অবধি অপেক্ষা করতে বল সবাইকে।

ওরা চলে গেলে সুবাস বলল, খুব টেনসন দেখছি।

হবেই। সরকার ওদের হাতে, যা ইচ্ছে করলেও ভাইস-চ্যান্সেলার চুপ করে থাকেন, সেটাই ওদের সুযোগ। এটা আমাদের ছেলেরা সহ্য করতে পারে না। যাক, বীরভূমে তোমার কেমন কাজ হচ্ছে বলো।

সুবাস সিগারেট ধরাল, ওখানে না গেলে সত্যি কিছুই জানতাম না। এখানে এই কোলকাতা শহরের মানুষের যে প্রবলেম আছে, পলিটিক্যাল যে সব ঝামেলা আছে, গ্রামে গেলে তুমি তার সঙ্গে কিছুই মেলাতে পারবে না। কমল্পিট ডিফারেন্ট ব্যাপার । এমন এক একটা গ্রাম আছে যেখানে স্বাধীনতা শব্দটার অর্থ জানে না এমন মানুষের অভাব নেই। জহরলাল, গান্ধী তাদের কাছে শিব নারায়নের মত ভগবানেরই একটা রূপ। ওরা কমুনিস্ট বলে যাদের জানে তারা থাকে অন্য দেশে। যেন বগী কিংবা রাক্ষসের মত ভয়ানক শুক্র তারাই কয়েকদিন আগে এই দেশটাকে জয় করতে এসেছিল, ভাগ্যিস গান্ধী দেবতার শিষ্যরা ছিলেন তাই দেশ রক্ষা পেয়েছে। এইরকম অবস্থায় কাজ করা যে কি দুরূহ তা তোমরা বুঝবে না। কিন্তু সত্যি কথা বলতে গেলে ওদের যত সহজে কোন সমস্যা বোঝনো যায়, শিক্ষিত মানুষকে তা সম্ভব নয়।

তুমি কোলকাতায় ফিরছ কবে পাকাপাকি ভাবে? বিমান উসখুস করল।

যবে পার্টি বলবে। তবে আমার ওখানে থাকতে ভালই লাগছে। চল, আজ উঠি, কথা বলতে বলতে দেরী হয়ে গেল অনেক। সুবাস উঠে দাঁড়াতেই বিমান যেন দাঁড়াতে পারল। অনিমেষের মনে হল বিমানের উসখুস ভাবটা নিশ্চয়ই সুবাসদা লক্ষ্য করেছিলেন। বিমানের পলিটিক্যাল ধ্যানধারণা সুবাসদার কথা মত হয়তো খুবই ভাল কিন্তু সুবাসদার দৃষ্টিভঙ্গী বিমানের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত এ ব্যাপারে অনিমেষের কোন সন্দেহ নেই।

ক্যান্টিনের দরজার গিয়ে সুবাস থমকে দাঁড়ার, ওই যা, চায়ের দামটা দেওয়া হয়নি। দাঁড়াও দিয়ে আসি।

বিমান বাধা দিল, দিতে হবে না। ওটা আমার নামে লিখে লাখবে। সুবাস শুনল না । দাম মিটিয়ে ফিরে এসে বলল, এই লিখে রাখা সিস্টেমটা খুব খারাপ ব্যাপার। খরচের হাত বেড়ে যায়, খেয়াল থাকে না।

বিমান বলল, তুমি তো খুব হিসেবী, সুবাসদা।

সুবাস বলল, আমাক খুব কম অর্থে মাস চালাতে হয় বিমান। অনিমেষ, তুমি কি এখন ক্লাসে যাবে? অনিমেষের খেয়াল হল ততক্ষণে দুটো পিরিয়ড অবশ্যই হয়ে গেছে। সবে শুরু হওয়া সেসনে পড়ানো এখনও সিরিয়াসলি শুরু হয়নি। ভবু খামোকা ক্লাসে না যাওয়ার কোন মানে হয় না। ও ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ।

সুবাস বলল, তা হলে আমি চলি । আবার কবে কোলকাতায় ফিরব জানি না, এলে দেখা করব। বিমানের সঙ্গে তোমার আলাপ হয়ে গেল এখন কাজকর্ম শুরু করতে কোন অসুবিধা নেই।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, আপনি আজই যাচ্ছেন?

না, কাল সকালে। কেন?

কারন নেই, এমনি জিজ্ঞাসা করলাম।

সুবাস অনিমেষকে একবার ভাল করে দেখল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, তুমি স্কটিশের কোন হোস্টেলটায় থাক? অনিমেষ ঠিকানাটা বলতে সুবাস মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে, যদি সময় পাই সন্ধ্যেবেলায় তোমার কাছে যেতে পারি। অনিমেষ এটাই চাইছিল। সুবাসদার সঙ্গে একটু আলাদা করে কথা বলা দরকার। কি কথা তা এই মুহূর্তে ওর মাথায় নেই, সমস্ত ব্যাপারটা কি রকম ছায়া হয়ে আছে।
 
ওরা ক্যান্টিনের সামনের প্যাসেজ দিয়ে বেরিয়ে আসছে হঠাৎ বিমান চেঁচিয়ে একজনকে ডাকল, সু–দী–প। বাঁ হাতে একটা মোটা চুরুট জ্বলছে, সুদীপকে এগিয়ে আসতে দেখল অনিমেষ। সমবয়সী একটি ছেলেকে চুরুট খেতে দেখতে খুব বেমানান দেখাচ্ছে। সিগারেট সবার হাতে মানিয়ে যায় কিন্তু ছেলেটি যে ভাবে চুরুট থেকে ধোঁয়া ছাড়াছে তাতে ওকে একটুও মানায় না। সুদীপের কথা বলার ঢংটাও অদ্ভূত। কেমন চিবিয়ে চিবিয়ে শব্দগুলো ওপর একটু জোর দিয়ে আলতো করে ছেড়ে দেওয়া। সুদীপ কাছে এসে বলল, মুকুলেশের ব্যাপারটা শুনলাম। চল ইউনিয়ন রুমে বসা যাক।

বিমান হাঁটতে হাঁটতে বলল, সুবাসদা, তুমি সুদীপকে চেনো তো!

সুবাস বলল, বাঃ আমি কি এখানে নতুন এলাম? সুদীপ হাসল না শব্দ করল অনিমেষ বুঝতে পারল না।

বিমান বলল, সুদীপ, এর নাম অনিমেষ, ফ্রেশার, স্কটিশ থেকে আসছে। সুদীপ ভ্রূ কুঁচকে বলল, স্কটিশ চার্চ? ওহো, ওখানকার একটা ছেলের কথা শুনলাম একটু আগে, খুব ইন্টারেস্টিং কেস।

ওরা লনে এসে দাঁড়িয়েছিল। বিমান জিজ্ঞাসা করল, কি রকম?

একটি ছেলে, নামটা কি যেন–কি যেন–, হ্যাঁ, ছেলেটি নাকি অ্যাকটিভলি পার্টির কাজকর্ম করে অথচ স্কটিশেন স্টুডেন্টস ফেডারেশনের সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখেনি। সবচেয়ে বড় খবর লাস্ট মুভমেন্টে ওকে নাকি পুলিশ গুলী করে মেরে ফেলতে চেয়েছিল, লাকিলি বেঁচে গেছে। অনেকে বুলেটের দাগ দেখেছে।

বিমান বলল, অদ্ভূত ঘটনা। এরকম একটা কেস কোন কলেজে আছে আর আমরা জানব না? ইম্পসিবল! সুবাসদা, তুমি জান?

সুবাসদা হেসে ফেলল। অনিমেষ খুব অবাক হয়ে গেল। এত দ্রুত গল্পটা বাড়তে বাড়তে এইখানে চলে এসেছে। এভাবে যদি এগোয় তবে শেষ পর্যন্ত সে বিরাট বিপ্লবী হয়ে যেতে পারে।

হঠাৎ বিমান অনিমেষের দিকে ঘুরে দাঁড়াল, আপনি তো স্কটিশ থেকে এসেছেন। ছেলেটিকে চেনেন? কি পড়ে?

কাঁচমাচু মুখে অনিমেষ বলল, ব্যাপারটা ঠিক সত্যি নয়।

সুবাস হাসছিল, এবার বলল, তোমরা যার কথা বলছ সে তোমাদের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। তবে ঘটনাটা হল পুলিশের বুলেট ওর পায়ে লেগেছিল এটা ঠিক, এক বছর নষ্ট হয়েছে, মারাও যেতে পারত কিন্তু কম্যুনিস্ট পার্টির সঙ্গে ওর কখনো কোন সম্পর্ক তৈরি হয়নি। বাকীটা সবার মনগড়া গল্প।

বিমান অনিমেষকে একদৃষ্টে দেখছিল, এবার প্রশ্ন করল, পুলিশ আপনাকে কেন গুলী করল?

অনিমেষ হেসে বলল, ভুল করে। দৌড়াচ্ছিলাম বলে ভেবেছিল আমিই বোমা মেরেছি। সুদীপ নিবে যাওয়া চুরুট ঠিক করতে করতে বলল, কিন্তু তবু আপনি অভিনন্দন যোগ্য। আমার আন্তরিক অভিনন্দন গ্রহণ করুন, কমরেড।

এই প্রথম কেউ তাকে কমরেড সম্বোধন করল। একই সঙ্গে অস্বস্তি এবং এক ধরনের খুশি অনিমেষকে টালমাটাল করল । কোনটার পাল্লা ভারী ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। সে মুখ নীচু করে বলল, আপনারা বোধহয় তিলকে তাল করছেন, আমি তার যোগ্য নই।

বিমান এক হাত দিয়ে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করল, আঘাতটা কেমন ছিল? অনিমেষ বিমানের এরকম সুহৃদয় ব্যবহারে আড়ষ্ট হয়ে উত্তর দিল, আমি প্রায় আট মাস বিছানায় শুয়ে ছিলাম। একটা বছর নষ্ট হয়ে গেছে।

তাই নাকি! তা হলে তো আমরা একসঙ্গে পাস করেছি। অনিমেষ, আপনার পায়ে কি এখনও বুলেটের দাগ আছে? বিমান গাঢ় গলায় জিজ্ঞাসা করল।

হ্যাঁ, ওটা মৃত্যু অবধি থাকবে। আমার থাইটা বীভৎস হয়ে আছে।

ভালই হল, আপনি আমাদের হাত শক্ত করে করুন। বিমান ওর সঙ্গে করমর্দন করল।

সুবাসকে সামান্য এগিয়ে দিয়ে অনিমেষ দোতলায় উঠে এল। অনেকক্ষণ ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে । বি সেকশনে ঢোকার তিনটে দরজা, অধ্যাপক যদি পড়ানোর ব্যাপারে বেশি মনোযোগ দেন তা হলে তাঁর পক্ষে লক্ষ্য করা সম্ভব নয় কেউ এল কি না। ওদিকে দেওয়াল ঘেঁষে মেয়েরা, এপাশে দরজার দিকে ছেলেরা বসে আছে। অনিমেষ ইতস্তত করছিল ঢুকবে কি না। এই ভাবে ফাঁকা করিডোরে দাঁড়িয়ে থাকাও ভাল দেখাও না। এখন যিনি বাংলা ছোটগল্প পড়াচ্ছেন তার সম্পর্কে বাংলা নিয়ে যারাই পড়ে তাদের অসীম দুর্বলতা। গত চার বছরে অনিমেষ ওঁর লেখা সব ছোটগল্প-উপন্যাস গোগ্রাসে গিলেছে। একটা অদ্ভূত জীবন যেন ছিটকে বেরিয়ে এসে হঠাৎ অন্যকরম আদল নিয়ে পাঠককে স্তস্তিত করে দেয় । ছোট গল্প যখন পড়ান তখন চট করে মনে হয় আমি প্যারিসের রাস্তায় হাঁটছি মোপার্সার হাত ধরে অথবা এডলেন আলান পোর সঙ্গে একটু আগে চা খেয়ে এলাম। পড়ানোটা এত আন্তরিক যে কান বন্ধ করতে ইচ্ছে করে না।
 
দরজার ধারে বসা দুতিনটি ছেলে অনিষেকে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করতে দেখে ইশারায় ভেতরে আসতে বলল। এরা স্কটিশ থেকে আসেনি। আলাপও হয়নি, কদিনের ক্লাসে শুধু চোখাচোখি হয়েছে মাত্র। মাথা নামিয়ে অনিমেষ চট করে দরজা ডিঙ্গিয়ে সামনের বেঞ্চিতে বসে পড়ল। দু-একজন তাকালো মাত্র কিন্তু কেউ কোন মন্তব্য করল না। অনিমষেকে যারা ডেকেছিল তাদের মধ্যে একজন, যে এখন ওর বামে বসে আছে, চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করল, কোন কলেজ?

স্কটিশ চার্চ, অনিমেষে উত্তর দিল।

চার্চ? ছেলেটা চোখ বড় করল, চার্চ না সার্চ? মেয়ে খোঁজার জায়গা? মাইরি তোমাদের কপাল সোনা দিয়ে বাঁধানো। আমাদের কলেজের ধারে কাছে মেয়ে ছিল না। দাঁত বের করে হাসল সে। ছেলেটিকে ভাল করে দেখল অনিমেষ। নীল ফুলহাতা শার্ট আর ধুতি পরনে, সাধারণ মানুষের তুলনায় যথেষ্ট বেঁটে। ওপরের দাঁতগুলো একটু উঁচু বলে মুখ খুললেই মনে হয় হাসছে। ছেলেটির কথা বলার ভঙ্গীতে এমণ একটা সহজ ব্যাপার ছিল যে অনিমেষ রাগ করতে পারল না। সে জিজ্ঞাসা করল, কোন কলেজ আপনার?

সিটি। কিন্তু নো আপনি-টাপনি। আমি শালা মেয়েদেরই ডাইরেক্ট তুমি বলছি।

এর মধ্যে কখন পড়ানো থেমে গিয়েছিল বুঝতে পারেনি অনিমেষ। হঠাৎ ছেলেটি পা দিয়ে ওর পায়ে টোকা মারতে দেখতে পেল ক্লাসসুদ্ধু সবাই ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। মুখ তুলে তাকাতেই অধ্যাপকের সঙ্গে চোখাচোখি হল। লম্বা মানুষটা নীচের ঠোঁট দাঁতে চেপে টেবিলে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছেন। একটা চাপা হাসি উঠল ঘরটায়, অনিমেষ বুঝতে পারছিল ওর মুখে রক্ত জমছে। অধ্যাপক এবার হাতের বইটা টেবিলের উপর মুড়ে রেখে খুব ধীর গলায় অনিমেষের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, খুব জরুরী কথা হচ্ছিল কি? উত্তর দিতে হলে উঠে দাঁড়াতে হয়, অনিমেষের মনে হল এর চেয়ে লজ্জা সে জীবনে কখনো পায়নি। ওই ছেলেটা যদি মিছিমিছি তার সঙ্গে কথা না জুড়াতো তা হলে এই পরিস্থিতিতে ওকে পড়তে হতো না। অনিমেষ উঠে দাঁড়িয়ে কোনরকমে ঘাড় নেড়ে না বলল।

আমরা কিন্তু একটু জরুরী কথা বলছিলাম, ছোটগল্প সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যে সংজ্ঞা দিয়েছিলেন সেটা এখন মানা যায় না। এ ব্যাপারে তুমি বোধহয় আমাদের সাহায্য করতে পারবে। অধ্যাপকের ঈষৎ সরু গলা অনিমেষকে কাঁপিয়ে দিল। ও অনুভব করছিল একটা বিরাট ফাঁদ ওর জন্য পাতা হচ্ছে এবং সেটা জানা সত্ত্বেও ওই ফাঁদে পা বাড়ানো ছাড়া তার কোন উপায় নেই।

অধ্যাপক বললেন, আচ্ছা, আজকালকার একটা গল্পের কথাই ধরা যাক। তুমি ইদানিং যেসব গল্প পত্রপত্রিকায় পড়েছ তার মধ্যে কোন গল্পটা তোমার সব চেয়ে ভাল লেগেছে, আমার ওই গল্পটা নিয়ে আলোচনা করতে পারি। অধ্যাপক ওর দিকে সহানুভূতির চোখে তাকালেন। সমস্ত ছেলেমেয়ের মুখ ওর দিকে ফেরানো। অনিমেষ বুঝতে পারছিল ওর সর্বাঙ্গে ঘাম জমছে। অনিমেষ চোখ বন্ধ করে গত পূজা সংখ্যা দেশ পত্রিকার সেই গল্পটা মনে করল। পড়তে পড়তে সমস্ত শরীর স্থির হয়ে গিয়েছিল। পড়া শেষ হল অনেকক্ষণ কথা বলতে পারেনি। প্রথমদিন ওই অধ্যাপকের ক্লাসে এসে সেই গল্পটার সঙ্গে ওঁকে মেলাতে চেষ্টা করেছিল সে। লেখকদের সঙ্গে লেখা মেলে না বোধহয়। মন ঠিক করে ফেলল অনিমেষ, তারপর পরিষ্কার গলায় জিজ্ঞাসা করল, আমি কি সত্যি কথা বলতে পারি?

আশ্চর্য! খামোকা মিথ্যে বলতে যাবে কেন? অধ্যাপক বিস্মিত হলেন।



এবার অনিমেষের মনে দ্বিধা নেই, সে গল্পটির নাম উচ্চারণ করল। সঙ্গে সঙ্গে অধ্যাপকের কপালে তিনটি ভাঁজ পড়ল, কোঁকড়া চুলে আঙুল বুলিয়ে ঠোঁট টিপে হেসে নিশব্দে পকেট থেকে রুমাল বের করে চশমার কাঁচ মুছতে লাগলেন। কয়েকটা মুহূর্তের অপেক্ষা, বোধহয় অধ্যাপকের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্যই, হঠাৎ ক্লাস ফেটে গেল হাততালিতে। সবাই প্রায় একসঙ্গে অনুরোধ করতে লাগল গল্পটি নিয়ে আলোচনা করতে। অধ্যাপক অনিমেষকে আর একবার দেখে টেবিল থেকে বই টেনে সবাইকে এক হাত তুলে থামালেন। তারপর বললেন, তুমি বুদ্ধিমান সন্দেহ নেই কিন্তু বুদ্ধিমানদেরও মনোযোগী হতে হয়। আচ্ছা, আমরা যেখানে থেমেছিলাম–

আবার পড়ানো শুরু হলো নতুন করে। অনিমেষ ধীরে ধীরে বেঞ্চিতে বসতেই পাশের ছেলেটি চাপা গলায় বলে উঠল, গুরু, একটা লেগ দেখি!

আর কথা বলতে এবার ভয় হল। সে জড়সড় হয়ে সামনে তাকিয়ে থাকল। অধ্যাপক তাকে যে ভাষায় তিরস্কার করলেন সে ভাবে কোন মানুষ তাকে কোনদিন করেনি। একটুও না রেগে যে ঠিক জায়গায় শাসনটাকে পৌঁছে দেওয়া যায় সেটা এই প্রথম অনুভব করল অনিমেষ। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ও মুখ নামাল। অধ্যাপকের সরু গলার মধ্যে এমন মাদকতা আছে, শব্দগুলো এমন গল্প হয়ে যায় যে সত্যি অন্য দিকে মন দিতে ইচ্ছে করে না। সামনে সারসার মাথা, অনিমেষ ছোটগল্পের ব্যাখ্যা শুনতে শুনতে হঠাৎ কেঁপে উঠল। সামনের মাথাগুলো সামান্য ফাঁক একটা সরল রেখায় অনেকটা দূরে চলে গিয়েছে। সেই রেখার শেষে যে বসে আছে তার দুটো চোখ এখন ওর মুখের ওপর নিবদ্ধ। অমন আয়ত গভীর দৃষ্টি যেন মনে হয় সমস্ত হৃদয় ওই চোখে মাখানো অনিমেষ বুকের মধ্যে অজস্র মাথাগুলো সামান্য নড়াচড়া করতেই চোখদুটো হারিয়ে গেল। বুকের মধ্যে থম ধরে গেছে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। অনিমেষ কোন কারণ বুঝতে পারছিল না। এরকম হল কেন তার? অধ্যাপকের পড়ানোটা কান দুটোয় পৌঁছাচ্ছে না। যেন ওর সব ইন্দ্রিয় হঠাৎ অকেজো হয়ে গিয়েছে। শুধু দুটো চোখ একটা পদ্মফুলের মত মুখের ওপর থেকে সরাসরি উঠে এসে তার রক্ত নিয়ে খেলা করে যাচ্ছে। এর মধ্যে ঘন্টা পড়েছে, অধ্যাপক ক্লাস রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে করিডোরে দাঁড়িয়ে পড়েছেন কখন টের পায়নি অনিমেষ। কে একজন এসে ওকে বলল, স্যার তোমাকে পরে প্রফেসারস রুমে দেখা করতে বলেছেন।

অনিমেষ বেরিয়ে আসছিল হঠাৎ পেছন থেকে শুনল, লেগটা দিলে না গুরু? সে অবাক হয়ে পেছন ফিরে তাকাতেই সিটি কলেজের ছেলেটিকে দেখতে পেল।

তোমাকে একটু প্রণাম করতাম। টি. জি.কে যেভাবে বোল্ড করলে গুগলি দিয়ে তুমি মাইরি সাধারণ মাল নও। সত্যি হাসল ছেলেটি।

অনিমেষ বলল, আমার নাম অনিমেষ, তোমার নাম কি? পরমহংস রায়। পরম বলে ডাকাই ভাল, শেষেরটা শুনলে খারাপ লাগে।

পরমহংস, অনিমেষের মুখ হাঁ হয়ে গেল। এরকম নাম কোন মানুষের হয়? ঘাড় নাড়ল ছেলেটি, হ্যাঁ, শুদ্ধচিত্ত সংযতাত্মা নির্বিকার ব্রহ্মানন্দে মগ্ন যোগীপুরুষ। আমার ঠাকুরদার আমাকে ওই ভূমিকায় দেখার বাসনা ছিল।

আরো তিন চারজন ছেলে ওদের ঘিরে দাঁড়িয়ে কথা শুনছিল, তারা এবার খুব জোরে হেসে উঠল। ওরা যখন কথা বলছে তখন অন্যান্য ছেলেমেয়েরা ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে করিডোরে যাওয়া-আসা করছে। বাংলা ক্লাসে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। অনিমেষ আড়চোখে তাদের দেখছিল। এখন সেই ঝিমঝিমে ভাবটা অনেক কম কিন্তু উত্তেজনা কমে গেলে ওর যেমন হয়, পেটের ভেতর চিনচিন করছিল। না, সেই চোখদুটোর দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। সম্ভবত সে ক্লাস থেকে বের হয়নি। এখন মুষ্টিমেয় ছাত্রী ওই ঘরে আছে, গেলেই দেখা হয়ে যাবে, কিন্তু অনিমেষের যেতে সাহস হচ্ছিল না। পরমহংস চা খাওয়ার প্রস্তাব করল কিন্তু অনিমেষের এখন কোথাও যেতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু সে ভেবে পাচ্ছিল না তার এরকমটা কেন হচ্ছে? স্কটিশে ওদের সঙ্গে প্রচুর মেয়ে পড়ত। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সাত্যিকারের সুন্দরী ছিল। কিন্তু কখনো তাদের দেখে ওর মনে এরকম চাঞ্চল্য আসেনি। নীপা বলে একটা মেয়ে ওদের সঙ্গে বাংলা অনার্সে ছিল। প্রথম দিনের পরই সে ওদের সঙ্গে তুই তোকারি করেছে, একটা ছেলের সঙ্গে নিজের কোন তফাত রাখোনি। অদ্ভূত ব্যাপার, ওদের সহপাঠীদের মধ্যে কেউই নীপাকে প্রেম নিবেদন করেনি। অথচ এখন ওই চোখদুটো দেখার পর থেকে ওর এরকমটা হচ্ছে কেন?

পরের ক্লাস আরম্ভ হবার সময় অনিমেষ দেখল সুদীপ করিডোর দিয়ে হেঁটে আসছে। হাতে তেমনি আধপোড়া চুরুট। ওকে দেখে সুদীপ একটা হাত নেড়ে দাঁড়াতে বলল। অনিমেষের সাথে তখনও পরমহংস ছিল। সে চাপা গলায় বলল, লিডার আসছে, তুমি চেন নাকি?

অনিমেষ ঘাড় নেড়ে এক পা এগোতেই সুদীপ কাছে এসে গেল, তোমাকে খুঁজছিলাম, এইটে তোমার ক্লাস?

হ্যাঁ।

তোমাকে আমারেদ ভীষণ প্রয়োজন কমরেড।

একটা অবাক গলায় অনিমেষ বলল, কেন?

শোন, তুমি অবশ্যই তিনটের সময় লনের মিটিং-এ যাবে আর বাঁ দিকের থামের নীচে দাঁড়াবে। যাতে প্লাটফর্ম থেকে তোমাকে স্পষ্ট দেখা যায়। নেবা চুরুটটা টানল সুদীপ।
 
তিনটের ক্লাসটা শেষ হলে অনিমেষ পরমহংসকে বলল, চল একবার নীচের লনে যাই।

পরমহংস বলল, ধ্যুৎ, ওখানে গিয়ে কি হবে! রোজ এক কথা, এস এফ বলবে তাদের মত ভাল দল আর কেউ নেই ছাত্র পরিষদ বলবে ওরাই ধোয়া তুলসীপাতা। এসব শুনে আমার কি লাভ হবে? ওসব ছেঁড়াছেঁড়ি খাওয়াখায়ির মধ্যে আমি নেই।

অনিমেষ হেসে ফেলল বলার ধরনে, তুমি দেশের কথা ভাবো না?

দেশের কথা? হাঁ করে তাকাল পরমহংস, তুমি তো হেভি খ্যাপা! দেশের কথা কেউ ভাবে নাকি! সবাই নিজের ধান্দা হাসিল করার জন্য দেশের নামটা ব্যবহার করে। যে যত দেশের কথা বলবে সে তত মাল গোটাবে।

অনিমেষ বলল, ঠিক আছে, তবু মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে যাই চল, তা ছাড়া স্টুডেন্টস লিডাররা নিশ্চয়ই আমাদের সমস্যা নিয়ে কথা বলবে, দেশের ব্যাপারটা তো এখানে জড়িত নয়। অনিমেষের একা যেতে ভাল লাগছিল না। স্কটিশে সে অনেককে বক্তৃতা করতে দেখেছে কিন্তু সেগুলো কেমন ছেলেমানুষী ব্যাপার। শোনার ইচ্ছে হতো না তেমন। আজ বিমানের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর একটা কৌতূহল ওর মনে জেগেছে, ওরকম ধীর স্থির এবং সুবাসদার কথামত পলিটিক্যালি কনসাস একটি ছেলে কেন একবারও দলের ছেলেদের বলল না কেউ ওর গায়ে হাত তোলেনি। নিশ্চয়ই হঠাৎ-ডাকা আজকের মিটিং-এ এ ব্যাপারে কিছু জানা যাবে।

পরমহংস বলল, আচ্ছা, প্রথম দিন, তোমার কথা ফেলব না। কিন্তু ম্যাক্সিমাম পাঁচ মিনিট, তারপর কেটে পড়ব।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি এখন বাড়ি ফিরে পড়াশুনা কর?

পরমহংস ঘাড় বেঁকিয়ে ওর মুখের দিকে পিটপিট করে তাকাল, তুমি মাইরি হয় ডুপ্লিকেন, নয় মেড ইন মফস্বল। কোনটা?

অনিমেষ হেসে বলল, প্রথমটা কি আমি বুঝতে পারছি না, তবে আমার বাড়ি ডুয়ার্সে।

তাই বল! নইলে এসব ফর্মা বেরয় মুখ থেকে! বাংলা নিয়ে এম এ বেশির ভাগ ছেলে পড়ে কেন জানো না? পড়ে যাতে ক্লাসের বাকী সময়টা আড্ডা মারা যায়। যারা ফার্স্ট ক্লাসের ধান্দায় থাকে তাদের কথা আলাদা, সেকেন্ড ক্লাস এম-এ’র জন্য পরীক্ষার আগে ছাড়া বাংলা পড়তে হয় না। আমি এখান থেকে বেরিয়ে কফি হাউসে যাব, তারপর হেঁটে চিৎপুরে গিয়ে টিউশানি সেরে বাড়ি ফিরব। পরমহংস জিভে একটা তিক্কুটে শব্দ করল।

এতক্ষণে সব ছেলেমেয়েরা ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেছে। আজ ওটাই শেষ পিরিয়ড ছিল। অনিমেষ দেখল তিনটি মেয়ে নীচু গলায় কথা বলতে বলতে ক্লাস থেকে বেরিয়ে করিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গের। তাদের একজনের মুখ নীচে নামানো, কিন্তু অনিমেষের বুঝতে একটুও অসুবিধে হল না এই সেই মেয়ে। ওরা তিনজনই কিন্তু একবারও এদিকে ফিরে তাকাল না। মুখ না দেখতে পেলেও অনিমেষ শরীরটাকে পেছন থেকে দেখে সম্পূর্ণ চেহারাটা অনুমান করে ফেলল। অত সুন্দর চেহারার মেয়ে অমন করে ওর দিকে চেয়েছিল কেন? শুধুই কৌতূহল? তার উত্তর শুনে অন্য ছেলেমেয়েরা খুশি হয়েছিল যেমন, তেমনি ওরা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল এইমাত্র। কিন্তু ওই চোখ দুটোর মধ্যে কেন অত কথা জমা থাকে?

পরমহংস ব্যাপারটা লক্ষ্য করছিল, চাপা গলায় বলল, পিচ খুব খারাপ গুরু। ডিফেনসিভ না খেললেই আউট হয়ে যাবে।

থতমত হয়ে অনিমেষ বলল, মানে?

পরমহংস পরিচয় করিয়ে দেবার ভঙ্গীতে বলল, ওনারা বেথুনের জিনিস। তিন দিনেই বুঝে গেছি নাকের ডগা আকাশে বেঁধে রেখে এসেছেন।
 
ওরা লনে এসে দেখল তেমন কিছু হয়নি। বড় জোর শখানেক ছেলে এবং কিছু মেয়ে একটা উঁচু চাতালের সামনে জমা হয়েছে। মাইকের কথা তখন নিষেধ করেছিল বিমান কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে একটা পোর্টেবল মাইক এসে গেছে। তাতে একজন ছাত্রবন্ধুদের কাছে সমানে আবেদন জানিয়ে যাচ্ছে সভায় দলে দলে যোগদানের জন্য। চাতারের পেছনে লাল কাপড়ে ছাত্র ফেডারেশনের ফেস্টুন টাঙানো। অনিমেষ আর পরমহংস সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে ওদের দেখছিল। হঠাৎ পরমহংস ওকে মনে করিয়ে দিল, এই, তোমাকে লিডার আদেশ করে গেল বাঁ দিকের থামের নীচে দাঁড়াতে, এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? চল ওপাশে গিয়ে দাঁড়াই।

কথাটা তখন খেয়াল করেনি, এখন মনে পড়তে অনিমেষ দ্বিধায় পড়ল। সুদীপ তাকে ওই জায়গাটা দাঁড়াতে বলেছিল যাতে মঞ্চ থেকে ওকে ওরা দেখতে পায়। মঞ্চ যদি ওই চাতালটা হয় তা হলে সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে দেখার কি দরকার? নাকি ওরা দেখতে চায় সে সভায় হাজিরা দিয়েছে, মন দিয়ে বক্তৃতা শুনছে? রাগ হয়ে গেল অনিমেষের সে এমন কিছু কথা দিয়ে আসেনি যে বিমানরা ওর ওপর এখন থেকেই কর্তৃত্ব করবে! মিটিং-এর বক্তব্য সে শুনতে চায়, কেউ দেখুক বা না দেখুক তার বয়ে গেল। সে পরমহংসকে বলল, এখান থেকেই বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, ওদিকে যাওয়ার দরকার নেই।

একটু বাদেই চাতালের পাশে দাঁড়ানো ছেলেমেয়ের সমবেত শ্লোগানের পর বিমান এসে মাঝখানে দাঁড়াল। ওর হাতে কিন্তু মাইক নেই। সবাই চুপ করতে ওর গলা শোনা গেল, বন্ধুগণ, আপনারা আমার সংগ্রামী অভিনন্দন গ্রহণ করুন। আজকের এই সভার পেছনে কোন প্রস্তুতি নেই, বিশেষ কারণে আমাদের মিলিত হবার প্রয়োজন হয়েছে। একটু থামল বিমান, অনিমেষ লক্ষ্য করল বিমানের বলার ভঙ্গী খুব স্বচ্ছন্দ, যেন এক টেবিলে বসে কথা বলছে। তা ছাড়া ওর গলার স্বর যে ওইরকম পর্দায় পৌঁছাতে পারে, না শুনলে অনুমান করা যায় না। ওরা যে এত দূরে আছে কিন্তু শুনতে একটুও অসুবিধে হচ্ছে না। বিমান তখন কেন মাইক প্রয়োজন হবে না বলেছিল এখন বোঝা গেল।

বন্ধুগণ! আপনারা জানেন ছাত্র ফেডারেশন কখনই হিংসায় বিশ্বাসী নয়। আমরা গণতান্ত্রিক উপায়ে দেশ এবং ছাত্রবন্ধুদের কাজ করতে চাই। মিথ্যে কুৎসা এবং ভন্ডামিকে আমরা ঘৃণা করি। কিন্তু আমাদের ওপর সেইসব জঞ্জাল চাপিয়ে দেবোর একটা ষড়যন্ত্র চলছে। আমাদের কমরেডদের দিনরাত প্ররোচনা করা হচ্ছে উত্তেজিত হতে। একবার যদি উত্তেজিত করতে পারে আমাদের কর্মীদের তা হলে যে ভুল তারা করবে তার ফসল তুলতে ওরা মুখিয়ে আছে। আমি আমার বন্ধুদের কাছে আবেদন করছি কোন অবস্থাতেই আপনারা উত্তেজিত হবেন না। আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে আমরা নাকি ওদের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলছি এবং নবাগত বন্ধুরা সেইসব মহামূল্যপোস্টার দর্শনে বঞ্চিত হচ্ছেন। ভাল কথা কিন্তু কে কখন কি পোস্টার ছিঁড়ছে তার কোন প্রমাণ ওঁরা আমাকে দেননি। আমরা হাওয়ার ওপর বাস করতে পারি না। আর তাদের পোস্টারে কি লেখা থাকে? না, তাদের উদ্দেশ্য বা কর্মপন্থার খবর সেখানে পাবেন না। নবাগত ছাত্রদের অভিনন্দন জানাচ্ছেন আমাদের গালাগালি দিয়ে। একটা পোস্টারে যদি আশি ভাগ আমাদের কথা লেখা থাকে তা হলে সেটা ওদের পোস্টার কি করে হল! আমি ওদের কাছে সামান্য ভদ্রতা আশা করেছিলাম, কিন্তু উলটে ওরা আমাকে চোখ রঙিয়ে গেল।
 
নতুন বন্ধুরা নিশ্চয়ই ভাবছেন আমি কাদের কথা বলছি। না, দক্ষিণপন্থী ছাত্র ফেডারেশন সম্পর্কে আমার কিছু বলার নেই। মানুষ যখন ধর্মচ্যুত হয় তখন তার মস্তিষ্ক স্থির থাকে না, না হলে আজ ওরা প্রতিক্রিয়াশীলদের সঙ্গে হাত মেলাবে কেন? আমি ছাত্র পরিষদের কথা বলছি। ওরা বলে এই দেশে স্বাধীনতা ওরাই এনেছে, এই দেশকে সোনায় মুড়ে দেবার জন্য ওরা সংগ্রাম করছে। আমরা নাকি চীনের দালাল, দেশের শত্রু। এই কথা নিয়ে আমি অনেকবার সভায় বলেছি, আমাদের বক্তব্য আপনারা জানেন। চীন না আমেরিকা, সে প্রশ্নে আমি যেতে চাই না। কিন্তু সোনায় মুড়ে দেবার ব্যাপারটা কার ক্ষেত্রে খাটে! দশটা পরিবারকে সোনায় মুড়ে দেবার জন্যে ওরা এই দেশের মানুষকে ছিবড়ে করে দিয়েছে সে কথা কেউ অস্বীকার করতে পারে? আমাদের গালাগাল না দিয়ে ওরা ভেবে দেখুক তারা কার দালাল। ওদের হাতে সরকার আছে, পুলিশ আছে, শুধু গায়ের জোর আর ভাতা দিয়ে সাধারণ মানুষকে কদিন দমন করে রাখা যায়? বিমান সামান্য থামল, শ্রোতাদের দিকে তাকিয়ে পরিস্থিতিটা বোধ হয় বুঝতে চাইল। পরমহংস চাপা গলায় বলল, এবার নির্ঘাত হাততালি পড়বে। কিন্তু কথাটা ঠিক হল না, বিমানের বক্তৃতায় শ্রোতাদের মনে কি প্রতিক্রিয়া হল বোঝা গেল না। কারণ, সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কয়েক মুহূর্ত মাত্র, বিমান আবার গলা তুলল, যারা আমাদের চীনের দালাল বলে জনসাধারণকে ধোকা দিচ্ছে তাদের জেনে রাখা উচিত আমরা জনসাধারণের সুখ-দুঃখে তাদের সঙ্গেই আছি, কারণ আমরাই তাদের লোক, কয়েকজন শিল্পপতির দালাল নই। বন্ধুগণ, বর্তমান কংগ্রেস সরকার দেশের অর্থনীতি থেকে শিক্ষা ব্যবস্থা সব জায়গায় অরাজকতা সৃষ্টি করতে চান যাতে মানুষের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যায় ছাত্র পরিষদের বন্ধুরা সেই কাজই করছে। আমি আপনাদের সামনে এরকম একটি জঘন্য কাজের নমুনা উপস্থিত করতে পারি। এই সরকারের পুলিশ, ছাত্র পরিষদের পুলিশ যে কত নির্মম তার শিকার আমাদের এক ছাত্রবন্ধু, যিনি তার জীবনের অমূল্য একটি বছর হারিয়েছেন। কমরেড অনিমেষ, আপনাকে অনুরোধ করছি আপনি দয়া করে এগিয়ে আসুন।

সমস্ত শরীর কাঁপয়ে একটা বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর অনিমেষ আবিষ্কার করল ওর হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। পরমহংস ওর বাহু ধরে বলে উঠল, এই তোমার নাম করছে! ওর কথা যাদের কানে গিয়েছিল তারা অবাক চোখে অনিমেষকে দেখতে লাগল । বিমানের ইচ্ছেটা বুঝতে পারছিল না অনিমেষ। সমস্ত ব্যাপারটাই একটা ধাঁধার মতন। ছাত্র পরিষদের ছেলেরা তাকে মেরেছে কিনা এই প্রশ্নের জবাবে সভা ডেকেছে বিমান। এখন ও সে প্রসঙ্গে না গিয়ে হঠাৎ তার নাম ধরে ডাকাডাকি কেন? তার একটা বছর নষ্ট হয়েছে এটা একান্তই নিজস্ব ব্যাপার, বিমানের এ ব্যাপারে কি বলার আছে। পুলিশ তো তাকে ছাত্র ধারণা করে গুলী করেনি।

বিমান আবার ডাকল, অনিমেষ, কমরেড, আপনি এগিয়ে আসুন। এটা দ্বিধা করার সময় নয়, সমবেত ছাত্রবন্ধুদের ব্যাপারটা জানানো দরকার। বিমানের চোখ বাঁ দিকের থামের কাছে, সেখানে সুদীপকে ব্যস্ত হয়ে কাউকে খুঁজতে দেখা গেল। এবার অনিমেষের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল কেন সুদীপ তাকে ক্লাসে এসে ওখানে থাকতে বলে গেছে। কিন্তু বিমান তো মিটিং ডাকার কথা বলেছে তার ব্যাপারটা জানবার আগেই, তা হলে আসল প্রসঙ্গে না গিয়ে ওকে নিয়ে পড়ল কেন?

উপস্থিত ছাত্রছাত্রীরা এখন উসখুস করছে। ব্যাপারটা যেন খুব মজার, জেনারেল সেক্রেটারী যার নাম ধরে ডাকছে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। বিমানের মুখ লাল হয়ে উঠেছে এর মধ্যে, পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছতে মুছতে সে চারপাশে তাকাচ্ছিল। হঠাৎ একটা ছাত্র অনিমেষকে বলল, আপনার নাম কি অনিমেষ? ওর বদলে পরমহংস ঘাড় নাড়তে ছেলেটি বলল, আপনাকে বিমান ডাকছে শুনতে পাচ্ছেন না?
 
এবার অনিমেষের মেজাজ গরম হয়ে গেল। তাকে ডাকলেই যেতে হবে? আর এই পরমহংসটা যদি তার নাম উচ্চারণ না করত তা হলে এতক্ষণে ওপাশ দিয়ে স্বাচ্ছন্দে বেরিয়ে যেতে পারত। কিন্তু এখন আরো অনেকের চোখ এদিকে পড়েছে। কি করা যায়? পরমহংস চাপা গলায় বলল, ওপেনিং ব্যাটসম্যানদের ভয় পেলে চলে না। সোজা ক্রিজে দাঁড়িয়ে ব্লক করতে শুরু করে দাও।

এর মধ্যে সুদীপ ওখানে পৌঁছে গেছে। অনিমেষের এক হাত ধরে সে প্রায় টেনে নিয়ে যেতে লাগল সামনে। প্রতিবাদ করার চেষ্টা করল অনিমেষ, আমি কি করব, আমাকে ডাকছেন কেন? সুদীপ কোন জবাব দিচ্ছিল না। বিমান ওদের দেখতে পেয়ে আবার গলায় জোর পেল, এই যে, আমাদের বন্ধু কমরেড অনিমেষ এসে গেছেন। কোন কোন মানুষ প্রচার চান না, নীরবে কাজ করে যেতে ভালবাসে, অনিমেষ সেইরকম একজন। অত্যন্ত লাজুক এই ছেলেটি তাই আমার ডাকে একটু বিব্ৰত হয়ে পড়েছেন। যা হোক, আমি যে মিথ্যে বলিনি সেটা একটু বাদেই আপনারা বুঝতে পারবেন।

ততক্ষণে আনিমেষ চাতালের কাছে পৌঁছে গেছে। বিমান এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে চাতালে তুলে দিল। অনিমেষ এমন নাভার্স হয়ে গিয়েছিল যে ওর গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছিল না। বিমান চাপা গলায় বলল, ডোন্ট গেট নার্ভাস। এটা খুব ইম্পর্টেন্ট সময়। কোন রকমে অনিমেষ বলতে পারল, আমি কি করব বিমানদা? বিমান কোন উত্তর না দিয়ে শ্রোতাদের দিকে তাকিয়ে হাত মাথার ওপর তুলে সবাইকে চুপ করতে বলল। গোলমাল একটু শান্ত হয়ে এলে বিমান আবার কথা শুরু করর, বন্ধুগণ, কমরেড অনিমেষ এখন আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছেন। উনি এ বছর বাংলা নিয়ে এম এ পড়া শুরু করেছেন। কিন্তু এই বছর ওঁর সিক্স ইয়ার হওয়ার কথা ছিল। কে তার এই সর্বনাশ করল, না আমাদের উপকারী বন্ধু পুলিশ। বিনা প্ররোচনায় সম্পূর্ণ অকারণে অনিমেষকে গুলী করে মেরে ফেলতে চেয়েছিল তারা। যখন অনিমেষ মাটিতে পড়ে একটু নিঃশ্বাসের জন্য ছটফট করছেন তখনও তারা অত্যাচার থামায়নি। আমাদের সৌভাগ্য যে তবু তিনি বেঁচে গেছেন আপনারা দেখুন, নিজের চোখে সেই বিভৎস অত্যাচারের নমুনা দেখুন। গঙ্গায় অনেক জল বয়ে গেছে, সময় থেমে থাকেনি, কিন্তু সেই রক্তাক্ত অত্যাচার ওর শরীরে চিরকালের জন্য ছাপ রেখে গেছে। কোন ভাওতা সেটা মুছে ফেলতে পারবে না। অনিমেষ, আপনি সঙ্কোচ করবেন না, আমাদের ছাত্রবন্ধুদের ওই দাগটি দেখান। কুলকুল করে ঘামতে লাগল অনিমেষ। ওর মাথায় আর কিছু ঢুকছিল না। কেন তাকে ওই দাগ দেখাতে হবে এবং সেটা করতে তার ইচ্ছে আছে কিনা এসব কথা তাকে আলোড়িত করছে। এখন যে-কোনভাবে সে নেমে যেতে পারলেই বাঁচে। সামনে সারি সারি মুখ উগ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছে তারই দিকে। পাশে বিমান ছাড়া সুদীপ এবং আরো কয়েকজন এসে দাঁড়িয়েছে। বিমান আবার চাপা গলায় কিছু বলল কিন্তু সেটা আর কানে ঢুকছে না অনিমেষের। কিন্তু তার পরনে প্যান্ট আর দাগটা হাঁটুর ওপরে, কি করে সহজ ভঙ্গীতে সেটা এত মানুষকে দেখানো যায়!

সুদীপ বলল, বৃস্টিতে আমরা যে ভাবে প্যান্ট রাস্তায় জল ভাঙ্গি সেভাবেই না হয় প্যান্টটাকে গুটিয়ে নিন কমরেড।
 
বক্তৃতা নয়, যেন নাটক দেখছে একটা, ছাত্রদের মধ্যে উৎসাহ হাজারগুন বেড়ে গেল। ঠেলেঠুলে চাতালের কাছে আসবার চেষ্টা করতে লাগল সবাই, যেন কাছাকাছি হলে ভাল করে দেখা যাবে এবং সে সুযোগ কেউ হারাতে চাইছে না। প্রথমে যত শ্রোতা ছিল এখন তার সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। সম্মোহিতের মত নীচু হয়ে ও প্যান্টের তরায় হাত দিল। একটা একটা ভাঁজ ফেলতে ফেলতে প্যান্টটা হাঁটুর ওপরে উঠে এল । ততক্ষণে ভাঁজগুলো মোটা হয়ে গেছে বেশ, পরের ভাঁজটা করতেই একটা অস্ফুট আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়ল সামনের মানুষগুলোর মুখ থেকে। তেলতেলে বীভৎস চামড়াটাকে পরমুহূর্তেই আড়াল করে প্যান্টটাকে নামিয়ে আনল অনিমেষ। বিমান ততক্ষণে কথার সূতো ধরেছে, বন্ধুগণ আপনারা নিজের চোখে আজ দেখলেন। কিন্তু যারা গুলী করেছিল তারা জানে না ওই বীভৎস চিহ্নটা আগামীকালের একজন সৈনিক তৈরি করে দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত লন কাঁপিয়ে হাততালি উঠল। বিমান চিৎকার করল, ছাত্র ঐক্য জিন্দাবাদ, সঙ্গে সঙ্গে প্রতিধ্বনি উঠল জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ। সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক–নিপাত যাক নিপাত যাক। দালালদের চিনে নিন–এই মাটিতে কবর দিন।

এক ফোঁটা এক ফোঁটা করে রক্ত অনিমেষের শরীরে যেন ফিরে আসছিল। ক্রমশ অন্ধ রাগ এবং তা থেকে জন্ম নেওয়া কান্না ওর দুটো চোখ ঝাপসা করে দিলে । আজ প্রকাশ্যে যে কাজটা সে করল সেটা করার জন্য কোন রকম মানসিক প্রস্তুতি তার ছিল না। মাঝে মাঝে স্নান করার সময় গোপনে ওই দাগটাকে সে দেখেছে, আঙ্গুল বুলিয়ে সেই যন্ত্রণাকে সে স্পর্শ করেছে, কিন্তু সেটা ছিল তার একদম নিজস্ব ব্যাপার। সেটাকে এমন প্রকাশ্যে হাজির করে সবার করুণা কুড়োতে যাওয়ার মধ্যে এমন একটা অপমান আছে যেটা এতক্ষণে তার ভিতর বাইরে জ্বলুনি ছড়াচ্ছে। নিজেকে সঙের মত মনে হচ্ছে এখন। ছাত্র ফেডারেশনের জয়ধ্বনি দিয়ে জমায়েতটা তখনই শেষ হল ।

ওরা চাতাল থেকে নেমে এলেও কিছু উৎসুক ছাত্র অনিমেষের চারপাশ ঘিরে ধরল। সবাই জানতে চাইছে কি অবস্থায় পুলিশ গুলী করেছিল, তখন অনিমেষ কি করছিল এবং ব্যাপারটা কত দিন আগে ঘটেছিল–এইসব। বিব্ৰত অনিমেষকে সরিয়ে আনল সুদীপ। সে ছেলেদের বলল, আপনারদের আগ্রহ স্বাভাবিক, কিন্তু অনিমেষ একটু আপসেট হয়ে আছে, প্লিজ এ নিয়ে এখন আলোচনা করবেন না। সুদীপ যখন ওকে নিয়ে এগোচ্ছে তখনও ছেলেরা পেছন পেছন আসছিল। তা দেখে সে অনিমেষকে বলল, ভিনি ভিডি ভিসি। এক দিনেই তুমি হিরো হয়ে গেলে। বাংলাদেশে ফিল্ম স্টারদেরই এইভাবে ক্রাইড ফলো করে। কনগ্রাচুলেশনস। সত্যি বলতে কি, অনিমেষের এখন একা হাঁটতে ভয় করছিল । এত লোক যদি তাকে নানান রকম প্রশ্ন শুরু করে তা হলে ও পাগল হয়ে যাবে। তা ছাড়া বিমানের সঙ্গে কথা বলা দরকার। এই রকম একটা ব্যাপার করার আগে বিমান কেন তার সঙ্গে পরামর্শ করেনি? সুবাসদা তার সঙ্গে বিমানের আলাপ করিয়ে দিয়েছিল মাত্র, তার মানে এই নয় যে বিমান ইচ্ছেমত সিদ্ধান্ত নেবে। সুদীপ তাকে যেখানে নিয়ে এল সেটাই যুনিয়ন রুম সেটা বুঝতে সময় লাগল। চতুর্দিকে নানা রকম ফেস্টুন, পোস্টার স্তূপ রাখা আছে। বেঞ্চিতে বেশ কিছু ছেলে সরবে আলোচনা করছে। গলায় স্বরে বোঝা যায় তারা এখন খুব খুশি। ওপাশের একটা টেবিলে বিমান কয়েকজনের সঙ্গে বলছিল, ওদের দেখে হাসল, এসো অনিমেষ, প্রথমবার য়ুনিয়ন অফিসে আসাটা একটু সেলিব্রেট করি। এই ক্যান্টিনে চা বলে এসো তো। পাশের একটি ছেলেকে কথাটা বলতেই সে ব্যস্ত ভঙ্গীতে চলে গেল।
 
ওদের দেখে দুটো চেয়ার খালি হয়ে গিয়েছিল আর একটাতে সুদীপ বসে দেশলাই-এর কাঠি দিয়ে চুরুটটা ঠিক করতে লাগল। অনিমেষ বসতেই বিমান বলল, তোমাকে অ্যাডভ্যান্স করগ্রাচুলেশন জানিয়ে রাখি, নেক্সট য়ুনিয়ন ইলেকশনে তোমাকে হারাতে পারে এমন কোন ক্যান্ডিডেট নেই।

অনিমেষ হাঁ হয়ে গেল। ইলেকশন? মানে যুনিয়নের নির্বাচনের কথা বলছে বিমান? সে ইলেকশনে দাঁড়াবে? সে দাঁড়ালে ছাত্ররা তাকে ভোট দেবে? চট করে বাবার মুখটা মনে পড়ে গেল ওর। কোন রকম রাজনীতি কিংবা যুনিয়নের মধ্যে যেতে তিনি পাই পাই করে নিষেধ করে গেছেন। এতদিন, স্কটিশের পড়ার সময়ে সে কখনই সেই আদেশ অমান্য করেনি। করেনি তার কারণ শুধু বাবা নন, সে নিজে ব্যাপারটা ঠিক ঠাক বুঝতে পারছিল না, পরবর্তী সময়ে দেশের কাজ করার যে ইচ্ছে শৈশবে ওর মনে জন্ম নিয়েছিল পনেরই আগষ্টের সকালে, নিশীথবাবু কংগ্রেসর পতাকার তলায় সেই ইচ্ছেটাকে নিয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত সুনীলদা বামপন্থী রাজনীতিতে তাকে আকৃষ্ট করেন। এখন এই কোলকাতায় বিগত কয়েক বছরের অরাজনৈতিক জীবনে সে নিজে মনে মনে অনেক কিছু ভাবত এবং সেই ভাবনাগুলো কংগ্রেস সমর্থনপুষ্ট ছিল না। তাই বলে কম্যুনিস্ট পার্টিতে সরাসরি কাজ করবে কিনা এ ব্যাপারটা কখনো স্পষ্ট ছিল না। ছাত্র ফেডারেশন করা মানে কম্যুনিস্ট পার্টি করা নয়। কিন্তু এতদিন সে জেনে গেছে যে কোন ছাত্রসংগঠনের কর্মপদ্ধতি এক একটা রাজনৈতিক দলের আদর্শে নিয়ন্ত্রিত হয়। অনিমেষ বিমানকে সরাসরি বলে ফেলল, আপনি আজ যে কাজ করলেন সেটা আগে জানলে আমি উপস্থিত থাকতাম না।

চা এসে গিয়েছিল, কাপটা এগিয়ে দিয়ে ভ্রূ কোঁচকাল বিমান, মানে?

এইভাবে নিজেকে এক্সপোজ করে সিমপ্যাথি পাওয়া খুব লজ্জার। তা ছাড়া ওই বুলেটের দাগটা পুলিশ আমাকে ছাত্র হিসেবে দেয়নি। ট্রাম পুড়ছিল, ওরা ফায়ার করেছে, আমি আহত হয়েছি মাঝখানে পড়ে গিয়ে। এর সঙ্গে আন্দোলনের কোন সম্পর্কে নেই। অনিমেষ সোজা চোখে বিমানের দিকে তাকাল।

হেসে ফেলল বিমান, তুমি নেহাতই ভাল মানুষ। ঠিক আছে, তুমি তো শিশু নও, যখন আমি তোমাকে ডেকে দাগটা দেখাতে বললাম তখন প্রতিবাদ করলে না কেন?

মুখ নামাল অনিমেষ, তখন কেমন হয়ে গেলাম, আর তা করলে আপনাকে অপমান করা হতো।

কথাটা শুনে শব্দ করে হেসে উঠল বিমান। ঘরের সবাই এবার ওদের দিকে তাকিয়ে দেখছে। বিমান হাসি শেষ করে বলল, তা হলে বোঝা যাচ্ছে তোমার কোন মানসিক সুস্থিতি নেই। দ্যাখো, মহাভারতেই তো আছে ভালবাসা এবং যুদ্ধে কোন রকম অন্যায় নেই। শঠতা সেখানে একটা জয়ের কৌশল মাত্র। আমরা চাই সমস্ত ছাত্রছাত্রী এই সংগঠনের সঙ্গে আসুক যাতে আমরা আরো সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে পারি। সব মানুষ যদি আজ কমনিস্ট পার্টির পাশে দাঁড়ায়, তা হলে রাতারাতি দেশের চেহারা বদলে যাবে। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি এবং বুর্জোয়া দল তা হতে দেবে না। তারা বাধা দেবে কায়েমী স্বার্থের দুর্গ আগলে রাখতে। তাই এখন লড়াই শুরু হয়ে গেছে। যুদ্ধে আনফেয়ার শব্দ অচল। তা ছাড়া পুলিশ যে তোমাকে গুলী করেছে এতে কোন মিথ্যে নেই, তাই না?

ঠান্ডা চা মুখে দিতে ইচ্ছে করছিল না। বিমানের কথাগুলোর ঠিক কিভাবে প্রতিবাদ করা যায়, বুঝতে না পেরে সে চুপ করে কিছুক্ষণ বসে থাকল। হঠাৎ বিমান কেমন অন্যরকম গলায় ওকে জিজ্ঞাসা করল, তোমার কি ইলেকশনে দাঁড়াতে ইচ্ছে নেই?

অনিমেষ সরর হয়ে বলল, আমি বুঝতে পারছি না।

কেন? সুবাসদা বলে গেলেন তুমি আমাদের মত এবং আদর্শকে সমর্থন করো। তা হলে এটাই তো একমাত্র রাস্তা। বিমান অবাক হল।

দেশের কাজে সঙ্গে য়ুনিয়নের কি সম্পর্ক?

বাঃ, কোন শিশু কি এক দিনেই হাঁটতে শেখে? তাকে একটা নিয়মের মধ্যে হতে হয়। ছাত্র ফেডারেশনে সক্রিয় কাজ করতে তুমি ছাত্রদের প্রব্লেম নিয়ে কিছু করতে চেষ্টা করবে। এটাকেই একটা মিনি দেশ ভাব না কেন! সেই সঙ্গে সাধারণ ছাত্রদের দেশের রাজনৈতিক ফোকরগুলো যদি চিনিযে দাও, তারা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের প্রতি যদি সহানুভূতি আনতে সাহায্য করে তা হলে এরাই যখন পরবর্তী কালে দেশের নাগরিক হবে তখন আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছানো অনেকটা সহজ হয়ে যাবে, তাই না?

এই সময় আরো কিছু ছেলে এসে বিমানের কাছে দাঁড়াল। ওদের দেখে বিমান অনিমেষকে বলল, কমরেড, আজ এই পর্যন্ত, আর এক দিন না হয় আমরা বসব। তুমি মন ঠিক করে নাও। দুর্বলতা থেকে কখনই কোন ভাল সৃষ্টি হয় না।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top