What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected কালবেলা- সমরেশ মজুমদার (2 Viewers)

মিছিলটা ট্রাম লইন অবধি গিয়ে একটু থমকে দাঁড়াল। অবশ্য শ্লোগান চলছে সমানে। উত্তেজনায় সবাই অস্থির। অনিমেষ ডাইনে বাঁয়ে তাকিয়ে কোন পুলিশ দেখতে পেল না। সুদীপ মিছিলটাকে নিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজ পর্যন্ত যেতেই কফি হাউসের গলি দিয়ে ভ্যানগুলো এগিয়ে এল। সামনে একটা জিপ, তাতে কয়েকজন অফিসার বসে আছে।

পুলিটা দেখে আরো জোরদার হল শ্লোগান। অনিমেষ লাইনের বাইরে এসে দাঁড়িয়ে হাত তুলে শ্লোগান দিচ্ছিল, সাম্রাজ্যবাদীদের দালালদের কালো হাত গুঁড়িয়ে দাও, ভেঙে দাও। সরবে তার সমর্থন বাজছিল গলায় গলায়। মার্কিন–দালাল কংগ্রেস সরকার নিপাত যাক নিপাত যাক, পুলিশ দিয়ে আন্দোলন ভাঙা যায় না, যাবে না, ভিয়েতাম লাল সেলাম লাল সেলাম, তোমার নাম আমার নাম ভিয়েনাম ভিয়েনাম।

চারপাশে ঝটপট দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ফুটপাতে সেকেন্ড হ্যাণ্ড বইওয়ালারা ছুটোছুটি করে নিরাপদে রাখছে তাদের বইপত্তর। বৃষ্টি আসার আগে যেমন আচমকা দমকা হাওয়ায় চারদিক আলোড়িত হয় এখন সেই অবস্থা।

সুদীপ বলল, মেইন মিছিলটা নিশ্চয়ই এতক্ষণে সেন্ট্রাল এভিন্যুতে চলে গেছে। আমরা আবার কলেজ স্কোয়ারের সামনে ফিরে যাই চল।

মিছিলের মুখ ফেরাতেই চোখে পড়ল কলুটোলা মির্জাপুর স্ট্রীটের মুখটার অজস্র পুলিশ লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। এখন অবস্থা হল এই যে ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যেতে হবে। কারণ দুদিকের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ট্রাম–বাস চলছে না, একটা ট্রাম হিন্দু স্কুলের সামনে আটক হয়ে রয়েছে। কয়েকজন নাছোড়বান্দা যাত্রী ছাড়া সেটা প্রায় ফাঁকাই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে এসে যেন সবাই আরো মুখর হয়ে উঠল। অনিমেষ শ্লোগান দিল, ছাত্র ঐক্য জিন্দাবাদ। গলায় গলায় সমর্থন ছড়াল জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ।

ঠিক সেই সময় জিপটা কাছাকাছি এগিয়ে এল । জিপের সামনে একজন অফিসার পোর্টেবল মাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করল, এই এলাকায় একশ চুয়াল্লিশ ধারা জারি আছে। আপনাদের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে রাস্তা ছেড়ে চলে যান। একশ চুয়াল্লিশ ধারা বলবৎ থাকলে মিছিল করা আইনত অপরাধ।

পুলিশ তোমার হুকুম আমরা মানি না, মানব না।

জুলুমবাজ পুলিশকে চিনে নিন–এই মাটিতে কবর দিন।

ভিয়েৎনাম লাল সেলাম–লাল সেলাম।

উত্তেজনা এখন এমন একটা জায়গায় যেখান থেকে ফিরে আসা অসম্ভব। সুদীপ চিৎকার করে বলল, কমরেড, কংগ্রেস সরকারের দালাল ওই পুলিশরা আমাদের ওপর জুলুমবাজি করতে চাইছে। কিন্তু আমরা প্রথমে এমন কিছু করব না যাতে ওরা সুযোগ পায়। মনে রাখবেন, রক্তে রাঙা ভিয়েনাম বাংলাদেশের আর এক নাম।

ঠিক সেই সময় দুম দুম করে আওয়াজ উঠল। পায়ের তলার রাস্তা কাঁপিয়ে দুটো বোমা ফাটল কুলুটোলার দিকে। অনিমেষ দেখল, একটা পুলিশ মাটিতে পড়ে ছটফট করছে। দুতিনটে ছিটকে ওপাশে পড়ে গেল। মুহূর্তে ওদিকটা ফাঁকা হয়ে গেল, পুলিশগুলো পড়িমরি করে মীর্জাপুরে রাখা ভ্যানগুলোর দিকে ছুটে গেলে।

ব্যাপারটার জন্যে একদম প্রস্তুত ছিল না অনিমেষ। হঠাৎ কান্ডটা হওয়ায় মিছিলের সবাই হকচকিয়ে গেছে। সুদীপ সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে সজাগ করিয়ে গলা তুলল, ইনকিলাব জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ।

সঙ্গে সঙ্গে প্রেসিডেন্সী কলেজের দিকে পুলিশ বাহিনীর সামনে দুমদাম বোমা এসে পড়ল। ধোয়ায় চারদিক এখন ঢাকা। ওদিকের পুলিশ পিছু হঠেছে। সমস্ত এলাকা এখন জনশূন্য। প্রদীপ চিৎকার করে বলল, কমরেডস, আপনারা গেটের সামনে চলে আসুন। ওরা যদি আক্রমণ করে তাহলে ভেতরে ঢুকে যাবেন। অনুমতি ছাড়া কোন শিক্ষাকেন্দ্রে পুলিশ ঢুকতে পারে না।
 
সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড় করে সবাই গেটের কাছে চলে এল। অনিমেষ তখন রাস্তায় মাঝখানে দাঁড়িয়ে । সে দুপাশে চোখ বুলিয়ে বোমার উৎসটা খুঁজল। প্রথম যে বোমা দুটো পড়েছে সেগুলোর দিকে তার খেয়াল ছিল না কিন্তু শেষের দুটো যে প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে পড়েছে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। এ ধরনের পরিকল্পনার কথা তার জানা ছিল না। সে মুখ তুলে দেখল বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যালকনিগুলোয় মেয়েদের ভিড় এবং তাদের নজর সব ওর দিকে। সুদীপ চিৎকার করে অনিমেষকে ডাকতেই টিয়ার গ্যাস চার্জ করল পুলিশ। ঠিক অনিমেষের সামনে একটা শেল এসে পড়ে ধোয়া ছাড়তে শুরু করল। অনিমেষ দেখল শেলটা এখনও অবিকৃত এবং ধোঁয়া একটা দিক থেকেই বেরুচ্ছে। চোখ জ্বলছে কিন্তু অনিমেষ পকেট থেকে রুমাল বার করে শেলটাকে তুলে কয়েক পা এগিয়ে পুলিশের দিকেই ছুঁড়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে ওপর থেকে একরাশ পায়রার পাখার ঝটপটানির মত সোচ্চার হাততালি বাজল। আর তারপরেই শুরু হয়ে গেল অনর্গল টিয়ার গ্যাসের শেল বৃষ্টি।

অনিমেষ সুদীপের কাছে সরে এলে সে বলল, ও-রকম হিরো হবার জন্য মাঝরাস্তায় দাঁড়াবার দরকার ছিল না। ওরা যে কোন মুহূর্তেই ফায়ারিং শুরু করতে পারে।

সেকথায় কান না দিয়ে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, বোমা ফাটাল কে? এ রকম হবে আগে জানতাম না!

সুদীপ খিঁচিয়ে উঠল, আমি কি জানতাম? পুলিশ নিজের লোক দিয়ে বোমা ফাটিয়ে প্যানিক সৃষ্টি করছে। অ্যাকসান নেবার জন্যেও একটা অজুহাত দেওয়া দরকার। এটাও বোঝ না

দুচোখ এখন জলে ভরা। ভীষণ চোখ জ্বলছে, একটু রগড়ালে জ্বলুনিটা বাড়ছে। কতগুলো ছেলে ভেতর থেকে কয়েকটা জল ভরা বালতি নিয়ে এল। দেখাদেখি রুমাল জলে ভিজিয়ে চোখে চাপা দিচ্ছিল। অনিমেষ দেখছিল একটি ছেলে, যাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বলে মনে হচ্ছে না, মাঝে মাঝে ছুটে রাস্তায় নেমে গিয়ে অদ্ভুত দক্ষতার সঙ্গে শেল কুড়িয়ে নিয়ে এসে বালতিতে ডুবিয়ে দিচ্ছে। এই সময় ওপরের বারান্দাগুলোয় মেয়েদের চিৎকার উঠল। পুলিশ এবার বারান্দা তাক করে শেল ছুঁড়ছে।

সুদীপ বলল, শালাদের কান্ডটা দেখছ। মেয়েরা ওদের কোন ক্ষতি করেনি তবু ওখানে শেল ছুঁড়ছে। একটা ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কি করা যায়?

আমরা অ্যাটাক করব। সুদীপের মুখ এখন শক্ত। কথাটা বলেই সে ছুটে গেল ওপাশে। অনিমেষ বুঝতে পারছিল না অ্যাটাক করব বলতে সুদীপ কি বোঝাচ্ছে? রাইফেলধারী পুলিশের সঙ্গে যুদ্ধ করার ক্ষমতা কি ছাত্রদের আছে। ঠিক সেই মুহূর্তে ওর মাথায় আর একটা বোধ উঁকি দিল। এখন যে ব্যাপারটা হচ্ছে সেটা কি হওয়া উচিত? যে ইস্যু নিয়ে ওদের বিক্ষোভ জানানোর কথা সেই ইস্যুটা তো ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে। আর সেটা এমন একটা ব্যাপার যে তা নিয়ে এত বড় কান্ড হওয়া ঠিক নয়। এ যেন মশা মারতে কামান দাগার মত ব্যাপার। হঠাৎ ওর খেয়াল হল বিমান নিশ্চয়ই এতক্ষণে আসল মিছিল নিয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। অর্থাৎ বিমানের যাওয়াটা নিরাপদ করার জন্যেই এখানে ওদের পুলিশকে ব্যস্ত রাখতে হবে।

একটা চিৎকার, সেই সঙ্গে হ্যাঁ হ্যাঁ–এ্যা–এ্যা শব্দে কতগুলো ছেলেকে ছুটে যেতে দেখে অনিমেষ থতমত হয়ে গেল। এ রকম শব্দ কি কারণে মানুষের গলা থেকে বের হয় কে জানে কিন্তু ছেলেগুলোকে কেমন অপ্রকৃতিস্থ দেখাচ্ছিল। আর সঙ্গে সঙ্গে প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনে অবিরাম বোমাবৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। অনিমেষ ব্যাপারটা বুঝে ওঠার আগেই দেখল, ওপাশের থেমে থাকা ট্রামটা দাউ দাউ করে জ্বলছে। আচম্বিতে তার মনে সেই ছবিটা ভেসে এল। প্রথম যে-রাতে সে কলকাতায় পা দিয়েছিল, এমনি করে একটা ট্রামকে জ্বলতে দেখেছিল।

শব্দ করে ট্রামের শরীরটা ফাটছে। যে ছেলেগুলো ছুটে গিয়েছিল তারা চক্ষের নিমেষে গা ঢাকা দিল । আর সেই মুহূর্তে যে শব্দ হল সেটা যে রাইফেল থেকে হচ্ছে তা অনিমেষকে বলে দিতে হবে না কাউকে। প্রাচী সিনেমার পাশের গলিতে এই রকম একটা শব্দ তার শরীরে ছিদ্রচিহ্ন রেখে গেছে। চিরকালের জন্য। সেদিন যে বোকার মতন গলির মাঝখান দিয়ে ব্যাগ হাতে ছুটেছিল সে আজ তড়িৎগতিতে গেটের আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়ল। ফায়ারিং হচ্ছে এই খবরটা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সোচ্চার হয়ে ছড়িয়ে যেতেই ওপরের বারান্দার ভিড়টা হাওয়া হয়ে গেল আচমকা।
 
অনিমেষ আড়াল থেকে দেখল, পুলিশ বাহিনী রাইফেল উঁচিয়ে এগিয়ে আসছে। জায়গাটায় থাকা বিপজ্জনক বুঝতে পেরে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ঢুকে পড়তে দেখতে পেল আড়ালে আবডালে ছেলেরা শেলটার নিয়ে নিয়েছে। দূরে দমকলের আওয়াজ ভেসে আসছে। গাড়িটা ক্রমশ এগিয়ে আসছে। চোখে চেপে ধরে ধরে ভেজা রুমালটা এখন প্রায় শুকনো। জ্বলুনিটা বাড়ছে। এখন কি করা যায়? কোন বিশেষ নির্দেশ দেয়নি বিমান। সুদীপকেও সে দেখতে পাচ্ছে না। পর পর কয়েকটা বোমা ফাটল আচম্বিতে, সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের ফায়ারিং শোনা গেল। অনিমেষ দৌড়ে দোতলায় উঠে এল। এপাশের বারান্দাটা ফাঁকা। একদম রাস্তার ধারে বলে কোন দর্শক এখানে নেই। সে উঁকি মেরে দেখল, দমকলের লোকেরা কাজে নেমে পড়েছে। অঝোরে জল ঝরছে ট্রামটার ওপরে। আর তখনই ইট বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। রাশি রাশি ইটের টুকরো এমনভাবে দমকলের লোকদের ওপর এসে পড়া শুরু হল যে ওদের পক্ষে কাজ করা শেষ পর্যন্ত অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। মেঘের আড়াল থেকে যুদ্ধ করার মত বিশ্ববিদ্যালয়ের আড়াল থেকে ইট পড়ছে এবং পুলিশের পক্ষে এই মুহূর্তে কি করা অসম্ভব।

যা হোক যা চাওয়া হয়েছিল তা সফল হয়েছে। আজকের এই ঘটনার কথা নিশ্চয়ই আগামীকালের কাগজে থাকবে। ব্যাপারটার প্রচার যত বাড়বে তত ভিয়েৎনাম সম্পর্কে ছাত্ররা যে উদ্বিগ্ন তা প্রকাশ পাবে। বিমান কি শেষ পর্যন্ত মার্কিন দূতাবাসে মিছিল নিয়ে পৌঁছাতে পারল? খবরটা এখন জানা যাবে না যদি কেউ না ফিরে আসে। হঠাৎ নীচে চোখ পড়তে অনিমেষ দেখতে পেল তিনটে পুলিশের জিপ হেয়ার স্কুলের দিক দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের লনে ঢুকে পড়েছে। কী ব্যাপার? সুদীপ বলেছেল পুলিশ নাকি অনুমতি ছাড়া এখানে থাকতে পারে না! তবে কি অনুমতি পেয়ে গেছে।

এতক্ষণে খেয়াল হল এত যে গোলমাল হচ্ছে, ছেলেমেয়েরা টিয়ার গ্যাসে নাস্তানাবুদ, কিন্তু ভাইস চ্যান্সেলার তো দূরের কথা কোন অফিসারকে এগিয়ে আসতে দেখা যায় নি। ওঁরা নিশ্চয়ই জানেন যে কিছুতেই ছাত্রদের বোঝানো সম্ভব নয়। অতএব হাল ছেড়ে বসে আছেন। পুলিশের খুব একজন বড় অফিসারকে ভাইস চ্যান্সেলারের ঘরের দিকে যেতে দেখতে পেল সে। কয়েক মিনিট যেতে না যেতেই অফিসারটি নেমে এসে কিছু বললেন ওর সহকর্মীদের। আর তারপরই বিশ্ববিদ্যালয়েচত্বর পুলিশে পুলিশে ছেয়ে গেল।

অনিমেষ সুদীপকে দেখতে পাচ্ছে না, ছাত্রদের তরফ থেকে কী করা উচিত এখন? হুকুম পাওয়া মাত্র পুলিশ ছুটে গেল সেই অংশটায় যেখান থেকে লুকিয়ে ইটবৃষ্টি করা হচ্ছে। কেউ কেউকে সতর্ক করার চেষ্টা করার আগেই একটা কনস্টেবল দুটো ছেলেকে টানতে টানতে ভ্যানটার কাছে নিয়ে এল। ছেলে দুটোকে চেনে না অনিমেষ এবং চেহারা দেখে মনে হয় না ওরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। কি করে এখানে এল কে জানে! ছাত্র আক্রমণ ছত্রভঙ্গ হতে বেশি সময় লাগল না। চারদিকে ধোয়া, ভাঙ্গা ইট কাঁচ ছড়িয়ে পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের দখল নিয়ে নিয়েছে। এই যদি পরিণতি হয় তাহলে এতসব কর! কি জন্যে? এবং এই পরিণতির কথা তো নিশ্চয়ই জানা ছিল। কয়েকটা ছাত্র একটা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এরকম লড়াই করতে পারে না। আর লড়াইটা কি নিয়ে হচ্ছে না, কয়েক হাজার মাইল দূরে একটি বিদেশী রাষ্ট্র অন্য একটি দেশের ওপর অত্যাচার করছে বলে প্রতিবাদ জানাতে। অনিমেষ মাথা নাড়ল আপন মনে, না এভাবে চলতে পারে না। হয়তো এরকম টুকরো টুকরো কিছু বিশৃঙ্খলতা সৃষ্টি করে প্যানিক সৃষ্টি করা যায় কিন্তু সেটা কি ফলপ্রসূ? বিশাল চত্বরটায় পুলিশ গিজগিজ করছে। অনিমেষ ফাঁকা দোতলার বারান্দা দিয়ে হেঁটে নিজের ক্লাসের সামনে এসে দেখল কুড়ি পঁচিশটা মেয়ে চোখে রুমাল দিয়ে বসে আছে।
 
যুদ্ধ হয় একটার পর একটা এবং শত্রু শক্তি ধ্বংস করা যায় একের পর এক। কল–কারখানা তৈরি হয় একটার পর একটা। চাষীরা চাষ করে একের পর এক প্লট। আমরা যে খাবার শেষ করতে পারব তাই নিই কিন্তু আমরা মুঠো মুঠো করেই তা খাই । সমস্ত খাবার একসঙ্গে খাওয়া অসম্ভব। একেই পিসমিল সলিউসন বলে। মাও সে তুং–এর বিখ্যাত এই উক্তিটিকে ব্যবহার করেছিল সুদীপ। একসঙ্গে কোন কাজ করা সম্ভব নয়। পিসমিল সলিউসন হচ্ছে একমাত্র উপায়। এই যে পুলিশ ছাত্র সংঘর্ষ হল সেটা হয়তো একটা ছোট্ট বিক্ষিপ্ত ঘটনা, কিন্তু এই ঘটনা থেকে আর একটা ঘটনা জন্ম নেবে। আজ যদি সারা দেশের মানুষ এই রকম ঘটনা অবিরত ঘটতে থাকে তাহলে কোন সরকারের পক্ষে তার মোকাবিলা করা অসম্ভব। ভারতবর্ষ ভিয়েত্রম হয়ে যাবে সেই সময় ।

সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। সাহসী ছেলেরা বেরিয়ে গেছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পুলিশের ভ্যান এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে এবং কলেজ স্ট্রীটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে। চারধারে একটা থিতিয়ে আসা ভাব কিন্তু কোন দোকানপাট খোলেনি, সামান্য যে কজন পথচারী হাঁটছে তারা যে সন্ত্রস্ত তা বোঝা যায়। পোড়া ট্রামটাকে এখনও সরিয়ে নেওয়া হয়নি। অবশ্য সেটার কিছু অবশিষ্ট আছে বলে মনে হয় না। এখন কোন রকম গোলমালের আশঙ্কা নেই। সমস্ত কলকাতা জেনে গেছে কলেজ স্ট্রীটে এই সংঘর্ষের কথা । খবর এসেছে বিমানের মিছিল এয়ার লাইনসের কাছেই পুলিশ আটকে দেয়। খুবই শান্তিপূর্ণ ছিল শোভাযাত্রা তাই ওখানে কিছু ঘটেনি। বিমান অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে তখনও ফিরে আসতে পারেনি কিন্তু একটি ছাত্র খবরটা পৌঁছে দিয়েছে।

সুদীপ চার পাঁচজনের একটা দলকে নিয়ে কথা বলছিল।

অনিমেষ বলল, আপনি যা বলছেন তা এসব ইস্যু নিয়ে সম্ভব নয়। তাছাড়া—

চুরুট ধরিয়ে এক হাতে ওকে থামতে বলে সুদীপ খানিকক্ষণ ওর মুখের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল, সেটা আমরা জানি। কিন্তু এভাবেই মানুষকে সচেতন করতে হবে। যে কোন লক্ষ্যে পৌঁছাতে গেলে সরাসরি যাওয়া সম্ভব নয়, কিছু ছলনার আশ্রয়ও নিতে হয়। আজকে এই ঘটনা না ঘটালে বিমান মার্কিন দূতাবাসে পৌঁছাতে পারত না।

কিন্তু মার্কিন দূতাবাসে পৌঁছে কি লাভ হল? ওরা শুনবে আমাদের কথা? এটাও তো একধরনের চাটুকারিতা। একটি ছেলে ফোঁস করে উঠল।

অনিমেষ চমকে ছেলেটাকে দেখল। ফরসা সুন্দর চেহারা কিন্তু এর আগে কখনো কথা বলতে দ্যাখেনি ওকে।

সুদীপ বলল, তোমাদের মনে রাখতে হবে আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। চীনের দালাল বলে গুলজারিলাল নন্দা যখন আমাদের চিহ্নিত করেছিল তখন আমাদের পার্টি সেক্টেটারী যে স্টেটমেন্ট দিয়েছেন সেটা পড়ে দেখো।

অনিমেষ বলল, কি সেটা?

তিনি বলেছিলেন, আমরা কোন রকমের সশস্ত্র যুদ্ধের কথা চিন্তা করছি না। আমরা আইনসম্মত দল এবং খোলাখুলি কাজ করতে চাই। আমি আর একবার স্পষ্টভাবে বলতে চাই যে তেলেঙ্গানা–মার্কা সশস্ত্র সংঘর্ষের জন্য আন্ডার গ্রাউন্ডে যাওয়ার কোন পরিকল্পনা আমাদের নেই।

ছেলেটি বলল, আমাদের সঙ্গে সি পি আই–এর তাহলে তফাৎ কি?

সুদীপ বলল, ওরা সুবিধাবাদী, রাশিয়ার তাবেদার।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, পার্টির যদি এই সিদ্ধান্ত তাহলে আজ আমরা সংঘর্ষে গেলাম কেন?


বিস্ময়ের চিহ্ন ফুটে উঠল সুদীপের মুখে, কে বলেছে আমরা সংঘর্ষে গেছে। পুলিশ সম্পূর্ণ বিনা প্ররোচনায় আমাদের ওপর কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়েছে, গুলী চালিয়েছে। ছাত্র আন্দোলনকে হেয় করার জন্য নিজেরাই গুন্ডা দিয়ে ট্রাম জ্বালিয়েছে। তুমি কি যারা ট্রাম জ্বালিয়েছে তাদের দেখেছ? ওদের কি ছাত্র মনে হয়েছে? তবে! দু-একটা ইট যা এখান থেকে ছোঁড়া হয়েছে তা প্ররোচিত হওয়ার পরই ছোঁড়া হয়েছে। ব্যাপারটা যে সমস্তটাই সাজানো তা বুঝতে এত অসুবিধে হয় কেন?

একটি ছেলে দৌড়ে এসে বলল, সুদীপ, রিপোর্টাররা এসেছে কথা বলতে চায়। কি করবে?

কি করবে মানে?

বিমান তো নেই।

আমরা আছি। ওদের ক্যান্টিনে বসাও আর রাখালদাকে চা করতে বল। আমি আসছি। ছেলেটি সুদীপের নির্দেশ নিয়ে চলে গেলে সে বলল, বোধ হয় কিছু মেয়ে এখনও আটকে আছে এখানে। তাদের বুঝিয়ে বল ভয়ের কিছু নেই, ওরা বাড়ি যেতে পারে। আমি রিপোর্টারদের সামলাচ্ছি।

সুদীপ খুব গম্ভীর ভঙ্গিতে য়ুনিয়ন অফিসের দিকে হাঁটতে লাগল। অনিমেষ শুনল, ফরসা ছেলেটি নিজের মনে কিছু বিড়বিড় করছে। বোঝা যাচ্ছিল সে আজকের ব্যাপারটায় মোটেই সন্তুষ্ট নয়। অনিমেষ নিজেও স্বস্তি পাচ্ছিল না।

সঙ্গীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অনিমেষ নিজেদের ক্লাসরুমের দিকে হাঁটছিল। এর আগে যখন সে মেয়েদের দেখেছিল তখন কোন কথা বলেনি। চুপ চাপ দরজা থেকে সরে সুদীপের খোঁজে নেমে এসেছিল। এখন সিঁড়ির মাঝামাঝি মুখোমুখি হয়ে গলে ওদের। ওরা নেমে আসছে।

আপনাদের যুদ্ধ শেষ হয়েছে?

অনিমেষ সেই চোখ দুটো নজর করল। এখন টকটকে জবাফুলের মত লাল। অনিমেষের নিজের অবস্থাও তাই কিন্তু অনেকটা সামলে নিয়েছে সে। আর একটি মেয়ে প্রায় ভেঙে পড়া গলায় বলে উঠল, ট্রাম-বাস চলছে না, না? আমি কি করে বাড়ি যাই বলুন তো?

কোথায় থাকেন আপনি? রোগা এবং আতঙ্কিত মেয়েটিকে দেখল অনিমেষ।

ঢাকুরিয়া।

ট্রেনে যাবেন?

না, না, ট্রেনে গেলে অনেক হাঁটতে হয়।

তাহলে সেন্ট্রাল এভিতে চলে যান। ওদিকে সব বাস পাবেন।

সে কি! এই যে একজন বলল, সব বাস-ট্রাম বন্ধ

সেটা শুধু কলেজ স্ট্রীটে। আপনারা ইডেন হোস্টেলের পাশ দিয়ে চলে যান। উত্তর বা দক্ষিণ দু দিকের গাড়ি পেয়ে যাবেন।

অনিমেষের কথায় উজ্জ্বল হল মুখগুলো। কুয়ো থেকে যেন টেনে তোলা হল ওদের।

নীচে নেমে এসে রোগা মেয়েটি জিজ্ঞাসা করল, পুলিশ গুলী করবে না তো?

অনিমেষ হাসল, কি আশ্চর্য! খামোখা পুলিশ গুলী করতে যাবে কেন?

আর একটি মেয়ে বলল, কেন? করেনি গুলী? কিছু বিশ্বাস নেই।

না, এখন সব থেমে গেছে। অনিমেষ আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল। সে লক্ষ্য করছিল, সবাই কিছু না কিছু বলছে কিন্তু সে প্রথম প্রশ্ন করার পর থেকে একজন একেবারে চুপ। যেন তার উত্তরটা না পাওয়া অবধি সে কথা বলবে না। অনিমেষ প্রশ্নের শ্লেষটা গায়ে না মাখার চেষ্টা করছিল অন্য মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে।

ততক্ষণে অন্যান্য ক্লাসের ছেলেমেয়েরা ইডেন হোস্টেলের পথে বেরিয়ে যেতে শুরু করেছে। প্রায় নিঃশব্দে ওরা হাঁটা শুরু করতে অনিমেষ অবাক হয়ে দেখল একজন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।

একটু অস্বস্তির গলায় সে জিজ্ঞাসা করল, আপনি যাবেন না?

সব অসুখেই কি এক ওষুধ খান আপনি?

মানে?

পরোপকার করতে গিয়ে এত তাড়াহুড়ো করছেন কেন? সেন্ট্রাল এভিন যে আমার পথ তা আপনাকে কে বলল?

অনিমেষ বলল, আপনি এত বেঁকিয়ে কথা বলেন কেন? সব সময় মানুষকে বিদ্ধ করে কি আনন্দ পান কে জানে? কোথায় থাকেন আপনি?

কেন? এখন কি আপনার ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আমাদের দেখাশোনা করার?

যদি বলি তাই। অবশ্য আপনার আপত্তি থাকলে আলাদা কথা।

এটাও কি সংগ্রামী পদক্ষেপ?

আর কিছু বলবেন? তাহলে একবারে বলে ফেলুন।

আপনাদের কান্ডকারখানা দেখে মাথা ঠান্ডা রাখা মুশকিল।

একটু ঠান্ডা করে বলুন কোন দিকে যাবেন?

মেয়েটি একটুক্ষণ অনিমেষের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, সেদিন বলছিলেন না যে মফস্বলের ছেলে আপনি। ওটা তো সহানুভূতি আদায়ের ছল, কিন্তু এর মধ্যেই–। কথাটা শেষ না করে হেসে ফেলল সে।
 
অনিমেষ দেখল ঠাস দাঁতের সারির একটা দিকে গজাতের আদল, যেটা হাসিটাকে আরো সুন্দর করেছে। সেটা চোখে পড়ায় অনিমেষ একটুও রাগতে পারল না কথাটা শুনেও। বলল, আপনি একনাগাড়ে ঝগড়া করে যাচ্ছেন।

মেয়েটি আবার গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করল। কলেজ স্ট্রীটের দিকে মুখ করে সে জিজ্ঞাসা করল, এদিক দিয়ে যাওয়া যাবে না?

আপনি কোথায় যাবেন এখনও বলেননি। যদি আপত্তি থাকে তবে

আপত্তির কি আছে! আমাদের বাড়ি বেলঘরিয়া। শিয়ালদা দিয়ে গেলে সুবিধে হয়। আপনি ওদিকে গেছেন?

না। আমি যদি শিয়ালদা অবধি যাই তাহলে–।

চলুন।

কলেজ স্ট্রীট দিয়ে যেতে অনিমেষের একটু, অস্বস্তি ছিল। কারণ এখনও প্রচুর পুলিশভ্যান ওদিকে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে কেউ নিশ্চিয়ই গোলমালের সময় তাকে মাঝরাস্তায় টিয়ারগ্যাসের শেল কুড়োতো দেখে থাকতে পারে। সুতরাং এখন মুখোমুখি হলে ওকে ধরে ফেলা বিচিত্র নয়। কিন্তু মেয়েটির কাছে এসব কথা বলতে সঙ্কোচ হচ্ছেল তার। সত্যিই তো শিয়ালদা যাওয়ার জন্যে সেন্ট্রাল এভিন্যু ঘোরার কোন মানে হয় না।

দু-একজন মানুষ সন্তর্পণে ফুটপাত ধরে হাটছে। পোড়া ট্রামটাকে সরিয়ে নেবার ব্যবস্থা হচ্ছে ততক্ষণে।

অনিমেষ বলল, আসুন, ওই কলেজ স্কোয়ার দিয়ে বেরিয়ে যাই।

ওরা যখন রাস্তা পার হয়ে এ ফুটপতে এল তখন একজন অত্যন্ত অবহেলায় হাত নেড়ে ওদের চলে যেতে বলল। মেয়েটি চাপা গলায় বলল, ওরা আমাদের কেয়ারই করছে না।

কলেজ স্কোয়ারের ভেতর ঢুকে একটু সহজ হল অনিমেষ। সামনেই বিদ্যাসাগরের স্ট্যাচু এবং সেটা জড়ভরতের মত তাকিয়ে। এইসব মূর্তিগুলো দেখলে ইদানিং অস্বস্তি হয় ওর। সে-সময়ের মানুষগুলোকে আমরা আস্তে আস্তে লিলিপুট বানিয়ে ফেলছি।

মীর্জাপুরের কিছু দোকান খোলা। মোড়ে মোড়ে জটলাগুলো বোধ হয় আজ দুপুরের ঘটনা নিয়ে ব্যস্ত। অর্থাৎ বিমানের পরিকল্পনা সার্থক হয়েছে। অবশ্যই এটাকে এক রকম জয়লাভই বলতে হবে। টুকরো টুকরো করে যদি সফলতা আসে একসময় সেগুলো জোড়া দিয়ে দিলেই পূর্ণতা পাবে।

মেয়েটি হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা আজকে যা করলেন তাতে আর কি ভাল হলো বলতে পারেন?

অনিমেষ বলল, একদম মেরুদণ্ডহীন আমরা নই সেটা প্রমাণ হল।

তাই নাকি? বাঁকা চোখে তাকাল মেয়েটি, পাড়ার গুন্ডারা যখন পুলিশের সঙ্গে বোমা নিয়ে লড়াই করে তখন তাদেরও মেরুদণ্ডহীন বলে মনে হয় না।

আশ্চর্য! দুটো ব্যাপার এক হল? ওরা লড়ছে কোন কারণ ছাড়াই–জাস্ট গুণ্ডামি করতে। অনিমেষ বিরক্ত হল।

মেয়েটি বলল, আপনাদের কারণটা কি? না, ভিয়েত্নাম আমেরিকা অত্যাচার করছে তাই কোলকাতার ট্রাম পোড়াও, পুলিশ মারো, সাধারণ মানুষকে অসুবিধেতে ফেলো–কি মহৎ ব্যাপার!

কুঁচকে গেল অনিমেষের, আপনি কি বলতে চাইছেন।

দেখুন, আমি সাধারণ মানুষের দলে। মাথায় যদি অন্য চিন্তা না থাকে তাহলে যে কেউ বুঝতে পারবে এগুলো হল স্টান্ট দেওয়ার চেষ্টা। নিজেদের অস্তিত্ব প্রমাণ করার সহজ রাস্তা। আচ্ছা, সত্যি কি আপনি নিজেকে কম্যুনিস্ট ভাবতে পারেন?

কম্যুনিস্ট। আমি ঠিক জানি না। তবে আমি এমন সমাজব্যবস্থা চাই যেখানে কোন বৈষম্য থাকবে না। সেটা তো আর আকাশ থেকে নেমে আসবে না, তাই তার জন্যে কতগুলো আদর্শ সামনে রেখে এগোতে হবে। সেক্ষেত্রে কম্যুনিজমের কোন বিকল্প নেই।

বেশ, আপনার দল যা করছে তা কি সাম্যবাদের লক্ষণ! কেন জানি না আমার মনে হচ্ছে আপনারা ভুল করেছেন।

আপনি কি কংগ্রেস সরকারকে সমর্থন করেন?

মোটেই না। কিন্তু আমার মনে হয় আপনাদের দল সরকারে এলে আর একটা কংগ্রেসী সরকার হবে। টাকার এ পিঠ আর ওপিঠ।
 
চট করে নিশীথবাবুর মুখ মনে পড়ে গেল অনিমেষের। জলপাইগুড়ির জেলা স্কুলের যে মাস্টারমশাই তাকে প্রথম দেশ সম্পর্কে সচেতন করেছিলেন। তারও তো একই বক্তব্য ছিল । কথাটা এখন স্পষ্ট মনে আছে, এ দেশে কম্যুনিস্ট সরকার হওয়া মুশকিল। যদি কখনো হয় দেখবে আমরা যা যা করেছি ওরা তারই নকল করছে আর যা করিনি ওরা সেটা করছে না। উপরন্তু ওদের বাড়তি সমস্যা হল যে ফ্রাঙ্কেনস্টেইনের এখন ওরা জন্ম দিচ্ছে তাদের সামলানো তখন মুশকিল হয়ে পড়বে। একজনকে ক্ষমতা থেকে সরাতে তুমি দশ রকমের ভাওতা দিতে পার, কিন্তু নিজে ক্ষমতায় এলে দেখবে সেই ভাঁওতাগুলো একশ রকমের হয়ে গেছে।

কমুনিস্ট পার্টির মাথা বা মাঝারি নেতাদের চেনে না অনিমেষ। কিন্তু প্রথম দিন থেকেই বিমানের কথাবার্তা ওর তেমন পছন্দ হয় না। সব সময় একটা চাপা মনোভাব, কেউ প্রতিবাদের ভঙ্গী করলে সেটা যেন বিমানের সহ্য হয় না। কিন্তু একজন লোককে দিয়ে সেটা যখন সত্য তখন অন্য কোন বিকল্প দলের কথা ভাবা যায় না। ছাত্র পরিষদের শচীন সেদিন ওদের যে মতবাদের কথা বলছিল কিংবা মুকুলেশ যা করতে চায় সেটা তো শুধুই ভাব-প্রবণতা। অবলম্বন ছাড়া কোন সার্থকতা আসে না। আসলে মানুষের সহজাত ধর্ম হল চট করে হতাশ হয়ে পড়া। কাজ শুরু করার আগেই যারা ব্যর্থ পরিণতির কথা চিন্তা করে তারা তো কিছুই করতে পারবে না।

মেয়েটি বলল, কি ভাবছেন তখন থেকে

অনিমেষের খেয়াল হল ওরা শিয়ালদা স্টেশনের কাছাকাছি চলে এসেছে। এদিকের অবস্থা প্রতি দিনের মত স্বাভাবিক। এই যে মাত্র মাইলটাকে দূরে অমন কান্ড হয়ে গেল তা এই এলাকা দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না। অনিমেষ বলল, কিছু না। পরে একদিন আপনার সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলব। আপনার ট্রেন কটায়?

এখনতো ঘন ঘন ট্রেন। আপনাকে এতদূর এনে কষ্ট দিলাম।

কষ্ট কি! শিয়ালদায় এলে আমার মন ভাল হয়ে যায়।

সেকি? কেন?

স্টেশনে ঢুকলেই রেলগাড়ি দেখতে পাই। আর রেলগাড়ি দেখলেই জলপাইগুড়ির কথা মনে পড়ে যায়। ছেলেবেলা এমন একটা জিনিস যা সব ক্ষত সারিয়ে দিতে পারে, অন্তত কিছুক্ষণের জন্যেও।

আপনার ক্ষত আছে? ঘাড় বেঁকিয়ে তাকাল মেয়েটি।

কথাটা শুনে চমকে তাকাল অনিমেষ। তারপর হেসে ফেলল, আপনি এমন সব প্রশ্ন করেন যার উত্তর দেওয়া যায় না।

তাহলে আপনার এমন কথা বলা উচিত নয় যার অর্থ আপনি জানেন না।

নর্থ স্টেশনের দরজায় এসে দাঁড়াতে মেয়েটি বলল, এবার আমি যেতে পারব, আপনাকে শুধু এটুকু করার জন্য ধন্যবাদ।

কিছুই করিনি।

তা ঠিক। আসলে আমরা মেয়েরা অনেক কিছু অলীক ভয় আগাম কল্পনা করে নিয়ে বিব্রত হই। একটা পুরুষ যা পারে আমিও তাই করতে পারি। কিন্তু যদি কিছু হয়, যদি যদি করে নার্ভাস হয়ে সব গুলিয়ে ফেলাটা আমাদের অভ্যেস হয়ে গেছে, কি করব বলুন? নইলে ক্লাস থেকে বেরিয়ে রোজকার মত আজও চলে আসতে পারতাম, এই যেমন এলাম। গজদাঁত বের করে হাসল মেয়েটি।

আমি সঙ্গে এলাম বলে এখন আফসোস হচ্ছে?

এটাও কিন্তু মেয়েদের অভ্যেস, গায়ে পড়ে কাদা মাখা।

ও কথা আমি একবারও বলিনি।

এই যাঃ, কি অভদ্র দেখুন তো আমি। আপনি কোথায় থাকেন জিজ্ঞাসাই করিনি। ঠোঁট টিপে হাসলে মেয়েটির চোখ কথা বলে।

হাতিবাগানের একটা হোস্টেলে

আপনি হোস্টেলে থাকেন? ও তাই!

মানে? আবার কি থিওরি আছে এ ব্যাপারে!

হোস্টেলের ছেলেরা একটু ডেসপারেট এবং স্বার্থপর হয়।

তাই নাকি? বাঃ, এটা তো জব্বর জানা হল।

একা একা থেকে ভাবতে শুরু করে আমি যা করছি তাই ঠিক।

বাঃ, গুড। জ্ঞান গ্রহণ করার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল অনিমেষ। হঠাৎ যাত্রীদের ভিড় বেড়ে গেল। অফিস–ফেরত মানুষেরা পড়ি কি মরি করে ছুটে যাচ্ছে ট্রেন ধরতে। গেটে যে টিকিট কালেক্টর দাঁড়িয়ে আছেন তার ভঙ্গি জগন্নাথের মত। হাত দুটো আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। মেয়েটি এবার চলে যাওয়ার ভঙ্গি করতে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, টিকিট কাটবেন না?

আমার মাসের টিকিট আছে।

হঠাৎ অনিমেষের ইচ্ছে হল ট্রেনে ওঠার । অনেকদিন ট্রেনে ওঠা হয়নি। জলপাইগুড়ি যাওয়া-আসা ছাড়া তো ট্রেনে ওঠার প্রশ্নই ওঠে না।

সে বলল, একটু দাঁড়াবেন, আমি টিকিটটা কেটে আনি।

কেন? আপনি কোথায় যাবেন? বিস্ময় মেয়েটির চোখে।
 
ট্রেনে চড়তে ইচ্ছে করছে খুব। বলে অনিমেষ দ্রুত গিয়ে কাউন্টারের সামনে দাঁড়াল। বোধ হয় এখন অফিসটাইম বলেই কাউন্টারের ভিড় কম। এখনকার যাত্রীদের মান্থলি আছে। যারা হঠাৎ–যাত্রী তারা এই সময়টাকে এড়িয়ে আসে। বেলঘরিয়া পর্যন্ত টিকিট কাটল অনিমেষ । হাতিরবাগান দিয়ে একটা বাস যাওয়া-আসা করে বেলঘরিয়া পর্যন্ত। ফেরার সময় সেটায় আসা যাবে।

অনিমেষকে আসতে দেখে মেয়েটি প্ল্যাটফর্মের ভেতরে ঢুকে গেল। পাশাপাশি কতগুলো গাড়ি দাঁড়িয়ে কিন্তু সেগুলোয় বাদুড়-ঝোলা ভিড়।

অনিমেষ বলল, আরে ব্বাস, এগুলোয় উঠবেন কি করে?

মেয়েটি বলল, আপনাদের কাছে যেটা অ্যাডভেঞ্চারের আনন্দ আমাদের সেটা প্রাণ বাঁচানোর দায়। নিজে সুখে থাকলে অবশ্য এ রকম করা যায়।

মানুষকে আঘাত দিয়ে আপনার এক ধরনের আনন্দ হয়, না?

মেয়েটি সেকথার উত্তর না দিয়ে বলল, আপনি আমার সঙ্গে হাঁটছেন এ দৃশ্য পরিচিত কেউ দেখলে কি কৈফিয়ত দেবে?

কৈফিয়ত কেন? আপনি আমার সঙ্গে হেঁটে অন্যায় করছেন নাকি?

এই সন্ধ্যেবেলায় একটা ছেলের সঙ্গে ঘুরঘুর করছি–সমাজটাকে তো আপনারই নিয়ন্ত্রণ করেন।

এখন সমাজ বলে কিছু নেই।

তাই নাকি? তাহলে সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা চান কেন?

থতমত হয়ে গেলে অনিমেষ। কি কথা থেকে কোন কথায় চলে এল এ মেয়ে। এতক্ষণে ওর মনে এক ধরনের হীনতাভাব ছাড়াতে শুরু করল। মেয়েটির সঙ্গে কথায় সে প্রতি মুহূর্তে হেরে যাচ্ছে।

কি, মুখ শুকিয়ে গেল কেন? ভয় নেই, কেউ জিজ্ঞাসা করলে আলাপ করিয়ে দেব ইনি একজন মহান কর্মী, আজ য়ুনিভার্সিটিতে বিপ্লব করে এসেছেন। একথা শুনলে কেউ আর অন্য কিছু ভাববে না।

মেয়েটি ওকে নিয়ে প্ল্যাটফর্মের শেষ প্রান্তে চলে এল। এদিকের লাইনে কোন গাড়ি নেই। যাত্রী হকার কুলিতে স্টশন গমগম করছে। সেই প্রথম রাতটার কথা মনে পড়ে যায় যেদিন সে একা জলপাইগুড়ি থেকে এসে শিয়ালদায় নেমেছিল। এখানে এসে প্রথমে বোঝা যায়নি কলকাতার এ্যালার্জি হয়েছে। একথাটা ত্রিদিবের মুখে শোনা। এই যে মাঝে মাঝে বিক্ষোভ, ট্রাম–বাস পোড়ানো নাকি অ্যালার্জির মত। চিংড়ি খেয়ে অনেকের শরীরে কয়েক দিনের জন্যে বেরিয়ে আবার যেমন মিলিয়ে যায় তেমনি। মেয়েটি জিজ্ঞাসা করল, কোথাকার টিকিট কাটলেন?

বেলঘরিয়া।

আপনার মতলবটা কি বলুন তো?

বুঝলাম না।

ন্যাকামি করবেন না। আপনি আমার বাড়িতে যেতে চাইছে নাকি?

আপনার আপত্তি থাকলে যাব না, অনিমেষের মজা লাগছিল।

নিশ্চয়ই আপত্তি আছে। আমি একটা উটকো লোককে বাড়িতে নিয়ে যেতে পারি না। বাড়িতে যখন জিজ্ঞাসা করবে কেন এল তখন আমি কি বলব? এ্যাডভেঞ্চার করতে এসেছে?

না। বলবেন বেড়াতে এসেছে।

আপনি আমাকে কি ভাবেন?

একজন শিক্ষিত মহিলা।

কোন শিক্ষিতা একদিনের আলাপে কোন ছেলেকে বাড়িতে নিয়ে যায় আদর করে কোন প্রয়োজন ছাড়া! আর আপনিই বা কেমন লোক অযাচিত হয়ে আমাদের বাড়িতে যেতে চাইছেন?

বললাম তো আপত্তি থাকলে যাব না।

শুনেছেন তো, আমার আপত্তি আছে।

বেশ যাব না।

তাহলে আমার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?

টিকিটটা যখন কেটে ফেলেছি তখন ট্রেনে উঠব। সেটায় নিশ্চয়ই আপনার আপত্তির অধিকার নেই।

তা নেই কিন্তু অন্য কম্পার্টমেন্টে উঠবেন। আপনি আমাকে সাহায্য করেছেন আমি ধন্যবাদ দিয়েছি। এর বেশি কিছু চাইবেন না।

আচ্ছা।

কিন্তু অনিমেষ সরে গেল না। মেয়েটির মত উদ্বিগ্ন করে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল সে। এখন প্ল্যাটফর্মটা ভরে উঠেছে। হঠাৎ খেয়ালে টিকিটটা কেটে একটু অস্বস্তি হচ্ছে এখন। মেয়েটি নিশ্চয়ই সহজ ব্যবহার করছে। যেকোন ভাল মেয়েই এরকম কথা বলবে। যদিও ওর বাড়িতে যাওয়ার বিন্দুমাত্র বাসনা ওর ছিল না কিন্তু খেপিয়ে দিতে ভাল লাগছে। মেয়েরা একবার রাগলে বোধ হয় থামতে জানে না, এর মুখ দেখে তাই মনে হচ্ছে। অনিমেষ চটপট আশেপাশে তাকিয়ে দেখল কেউ ওদের কথা শুনছে কিনা। দু-একজন দূর থেকে আচার খাওয়ার মত মেয়েটিকে দেখছে বটে কিন্তু কথা শোনার মত কাছাকাছি নেই। যদি ওর সঙ্গে বেলঘরিয়া স্টেশনে নেমে বাড়ি অবধি যায় তাহলে মেয়েটি কি করবে? ব্যাপারটা কল্পনা করতেই হাসি পাচ্ছিল ওর।
 
পাশে দাঁড়িয়ে অমন ক্যাবলার মত হাসবেন না। ফোঁস করে উঠল মেয়েটি।

অনিমেষ অবাক হওয়ার ভঙ্গি করল, আরে, আমি হাসতেও পারব না?

দূরে গিয়ে হাসুন।

আপনি বড্ড রেগে গেছেন। এরকম যদি অভ্যেস হয় তাহলে অবিলম্বে ডাক্তার দেখানো উচিত। কারণ এটা একটা অসুখ।

এই সময় ট্রেনটা এসে গেল প্ল্যাটফর্মে। যাত্রীরা নামতে না নামতে হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে গেল সেটায় ওঠার। একটু দূরে দাঁড়িয়ে অনিমেষ দৃশ্যটা আতঙ্ক নিয়ে দেখছিল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ট্রেনটা ভরে গেল মানুষে। এখনও প্রচুর লোক ছুটোছুটি করছে প্ল্যাটফর্মে একটু জায়গা পাওয়ার আশায়। চিৎকার চেঁচামেচিতে কিছু শোনা যাচ্ছে না। এই মানুষগুলো প্রতিদিন এভাবে গাদাগাদি করে যায়। মুখ দেখে বোঝা যায় না ওরা এতে অসন্তুষ্ট কিনা। অভ্যেস বোধ হয় সব কিছু সহজ করে দেয়। এ নিয়ে বিক্ষোভ নেই, তবে এটুকুও না পেলে মাঝে মাঝে অগ্নিকাণ্ড হয়। কতটুকু ন্যূনতম চাহিদা মানুষের তবু তাই মেটাতে সরকার অক্ষম। আচ্ছা কম্যুনিস্ট পার্টি তো এসব নিয়েও আলোচনা শুরু করতে পারে।

সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটার কথা মনে হতেই সে মুখ ফিরিয়ে দেখল সেখানে কেউ নেই। হঠাৎ কি করে যে ও উধাও হয়ে গেল বুঝতে না পেরে অনিমেষ চারপাশে তাকাতে লাগল। তবে কি ওই ভিড় ঠেলে মেয়েটি উঠে পড়েছে ট্রেনে? এরকম একটা অসম্ভব কাজ একটা মেয়ের পক্ষে এখন আর অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে না অনিমেষের। চোখের সামনে ও মেয়েদের ঠেলাঠেলি করতে দেখেছে।

হঠাৎ কেমন নিঃসঙ্গ মনে হল ওর। এতক্ষণ কথা কাটাকাটি করেও যা মনে হয়নি হঠাৎ ওকে না দেখে তাই হল। অনিমেষ ট্রেনের কামরাগুলোয় সাগ্রহে চোখ বোলানো শুরু করল। ভেতরে কেউ থাকলে এই ভিড়ে বাইরে থেকে কিছুতেই বোঝা যাবে না। এইভাবে কাউকে খুঁজে বের করা অসম্ভব। কিন্তু অনিমেষের মনে হল এ অবস্থাতেই যদি ওকে দেখতে পেয়ে যায় সে তাহলে অনেক কিছু ব্যাপার সত্যি হতে পারে । যেন নিজের ভাগ্য যাচাই করার জন্যে ও কামরাগুলো দেখা শুরু করল। এবং ভাগ্য এত কাছে অপেক্ষা করছে তা দেখে অনিমেষ অবাক হয়ে গেল। এই কম্পার্টমেন্টে লোক আছে কিন্তু অন্যগুলোর চেয়ে কম কারণ সামনে বড় বড় করে মহিলা এবং ফার্স্ট ক্লাশের চিহ্ন লেখা আছে। আর তারই জানলায় বসে মেয়েটি যে অনেকক্ষণ তাকে লক্ষ্য করছে এটা বলে দিতে হবে না । কিছুই হয়নি। এমন ভাবে করে অনিমেষ জানলার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, আপনি ফার্স্ট ক্লাসের প্যাসেঞ্জার?

বাধ্য হয়ে। আপনিও উঠতে পারেন কারণ এখানে অন্য শ্রেণীর লোকও উঠে থাকেন। আপনার অ্যাডভেঞ্চার হয়ে গেল?

সে কি, যাবেন না?

আর ইচ্ছে নেই।

এত তাড়াতাড়ি ইচ্ছে চলে গেল?

যার সঙ্গে যাব সেই যখন এরকম ভদ্রতা করতে পারল

ওকথা আপনার মুখে মানায় না।

কি কথা?

ভদ্রতা।

কেন? আমি কি কিছু অদ্ৰতা করেছি?

এতক্ষণ যার সঙ্গে এলেন, কথা বললেন, বাড়ি যেতে চাইলেন, একবারও তার নাম জানতে ইচ্ছে করল না? আমি মেয়ে এটাই কি আপনার কাছে সব?

অনিমেষ সোজা মুখের দিকে তাকাল। ট্রেনটা এবার ছাড়ছিল। মেয়েটে হাসল, নিজে কখনও ছোট হই নি, আজ হচ্ছি। আমার নাম মাধবীলতা মুখার্জী।

মাধবী?

উঁহু, ফুল নয়, আমি শুধুই লতা, মাধবীলতা।

অনিমেষ ট্রেনটার চলে যাওয়া যেন দেখতে পেল না।
 
এমন বিষধর সাপ আছে যে দাঁত বসালেই মুহূর্তে শরীর নীল হয়ে যায়, কোনো বৈজ্ঞানিক তার প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে পারেনি । অনিমেষ শুনেছে বিষ যখন শরীরে কাজ করে তখন আপাত যন্ত্রণার চাইতে নেশা মানুষকে আচ্ছন্ন করে, ঘুম পায়। এবং সেই খানিক ঘুম কখন চিরকালের হয়ে যায় সে টের পায় না।

নতুন হোস্টেলের এই ঘরে গতকালের রাত নিঝুম কেটেছে অনিমেষের। চোখের সামনে আকাশের চেহারা পালটানো, শেষ ট্রামের শব্দটা ডুবে গিয়ে হঠাৎ কলকাতা শীতল হলো এবং শেষ পর্যন্ত কখন প্রথম ট্রাম নতুন দিনটাকে টেনে নিয়ে এল সে টের পায় নি।

চোখের পাতায় জোনাকির মত আগুনের ফুলকি নেচে বেড়ায় যার সে ঘুমুবে কি করে। আর চোখ খুলতেই যার মুখ সে মাধবীলতা।

ভোরের প্রথম আলো যে এত আন্তরিক হয়, এত সহজ নরম অনুভূতি বুকে ছড়ায় জানা ছিল না অনিমেষের। এই আলো এখন পৃথিবীর অনেক জায়গায় এমন সোহাগী হয়ে রয়েছে। কিন্তু অনিমেষের মনে হল, তার মত এমন আপন হয়ে আর কারা কাছে যায়নি। জীবনে কখনো কোন নেশা করেনি বা তার সুযোগ আসেনি কিন্তু কাল থেকে নিজেকে কেমন নেশাগ্রস্ত মনে হচ্ছে। যেন সেই মারাত্মক সাপটা আচমকা ছোবল বসিয়ে দিয়ে গেছে এবং এখন তার আর কিছু করার নেই।

অথচ মাধবীলতাকে গতকাল দুপুরের আগে সে ভালভাবে চিনতই না। ক্লাসে মাঝে মাঝে চোখাচোখি হয়েছে কিন্তু সেই চোখের ভাষা পড়তে কখনোই সচেষ্ট ছিল না সে। কোন সংস্কারের বশে প্রতিরোধ শক্তি যে তাকে বিরত করেছিল তা নয়, এ সব ব্যাপারে সে নিজেই নিস্পৃহ ছিল। এবং ইদানিং রাজনৈতিক চিন্তাভাবনায় সে এমন ডুবে ছিল জীবনের এই দিকটা খেয়াল হয়নি। অথচ গতকালের ওই রকম উত্তেজনাময় ঘটনাগুলোয় যখন তার নার্ভ টানটান ঠিক তখন এমন করে সে নিহত হবে তা কে জানত। হেসে ফেলল অনিমেষ জানলায় দাঁড়িয়ে। অনেকদিন আগে শোনা কথাটা মনে পড়ল, সে জানে না কখন মরে গেছে।

কিন্তু মাধবীলতাকে সে চেনে না। ওর পারিবারিক পরিচয় তার জানা নেই। শুধু এটুকুই মনে হয়েছে মেয়েটি নরম এবং বোকা নয়। কোনো কোনো মেয়ে বোধ হয় সহজে আত্মসমর্পণ করার জন্য জন্মায় না, মাধবীলতা এই ধরনের মেয়ে। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্টেশন পর্যন্ত হেঁটে যাওয়ার সময় অনিমেষ দেখছে মাধবীলতার নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা আছে, এবং সেটাকে গুছিয়ে স্পষ্ট ভাসায় বলার ক্ষমতা ও রাখে। এ রকম সতেজ ডাঁটো আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথা বলতে কোনো মেয়েকে অনিমেষ দেখেনি। কলকাতায় এসে নীলার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। নীলা অবশ্যই খুব ডেসপারেট মেয়ে, কোন রকম ভিজে ব্যাপার ওর নেই। কিন্তু নীলা কখনোই আকর্ষণ করে না, বুকের মধ্যে এমন করে কাঁপন আনে না। যে কোন পুরুষ-বন্ধুর মত নীলার সঙ্গে সময় কাটানো যায়। তাছাড়া কয়েকটি বিশেষ ব্যাপারেই নীলার মানসিকতা বদ্ধ, মাধবীলতার মত এমন দ্যুতি ছড়ায় না।

অথচ গতকাল এমন কোন সংকেত বা ইঙ্গিত মাধবীলতা দেয়নি যে অনিমেষের এ রকম হতে পারে। বরং বলা যায়, মাধবীলতা সম্পূর্ণ নিরাসক্ত ভঙ্গিতে তাকে আহত করে কথা বলছিল। অথচ যেই ট্রেনটা চলে গেল স্টেশন ছেড়ে অমনি অনিমেষকে কেউ যেন আচমকা ছুঁড়ে দিল এমন এক অসীমে যেখানে শুধুই ভেসে থাকতে হয়, ভেসে যেতে হয়। হঠাৎ অনিমেষের খেয়াল হল সে যে মাধবীলতাকে ঘিরে এসব ভাবছে এটা তো সে সমর্থন নাও করতে পারে। এমনও হতে পারে মাধবী অন্য কাউকে ভালবাসে!

কথাটা মনে হতেই একটা অস্বস্তি শুরু হল। গতকাল থেকে যে জোয়ার সব কিছু ছাপিয়ে ফুঁসে উঠেছিল একটু একটু করে তা থিতিয়ে যেতে লাগল। মাধবীলতাকে সে জানে না এবং এ অবস্থায় নিজেকে প্রকাশ করে হয়তো খোলা হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া মাধবীলতার সামাজিক এবং পারিবারিক অবস্থাও তার অজানা। কাউকে পেতে হলে তার যোগ্য হতে হয়। অনিমেষের এই প্রথম মনে হল মানুষ হিসেবে তার যোগ্যতা কতখানি সে কখনো ভেবে দেখেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিতে প্রবেশের পর পড়াশুনায় মন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত তার আত্মবিশ্বাস আছে, ক্লাসের যা পড়ানো হচ্ছে একটু চেষ্টা করলেই সে রপ্ত করে নিতে পারবে।
 
কিন্তু এসব তো যোগ্যতা-বিচারে প্রতিকূল মতামত সৃষ্টি করবে। এই বয়সে নিশ্চয়ই অন্য কোন ভাবে নিজেকে যোগ্য করতে পারে না। যদি অর্থনৈতিক সাফল্য বা সামাজিক পদমর্যাদা যোগ্যতার মাপকাঠি হয় তাহলে মাধবীলতার নাগাল পাওয়া অবশ্যই দুঃসাধ্য। বাইশ বছর বয়স পর্যন্ত ও-দুটো সাফল্যের কথা তার চিন্তায় কখনো আসেনি। আজ মাধবীলতার জন্যে সেটা সম্ভব নয়। নিজের পছন্দমত কিংবা বলা যায় মনের মত পড়াশুনায় সে চিরকাল নির্ভর ছিল। হয়তো বাবার নির্দেশ মেনে বাংলার বদলে অর্থকরী বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করলে আজ এসব ভাবতে হত না।

অনিমেষ হেসে ফেলল, না, এজন্যে ওর কোন আফসোস নেই। দেশের জন্যে এককালে যে ধরনের সেন্টিমেন্ট কাজ করত ওর মনে, ইদানিং সেটা নেই বটে কিন্তু অন্য রকম দৃষ্টিতে দেশ–এই সমাজব্যবস্থাকে দেখতে শুরু করেছে। ইদানিং সে বুঝতে পেরেছে যে সাধারণ মানুষ নিজেকে ভারতীয় বলে অনুভব করে না। এই ভারতবর্ষে জন্মে বড় হয়েও কেউ ভারতবর্ষ নিয়ে কোন চিন্তা করে না। মানুষের চিন্তা-ভাবনা এখন তার ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির সঙ্গে জড়িত। এই দেশ নিজের এই অনুভূতি যখন মানুষের নেই তখন সামাজিক ব্যবস্থার পরিবর্তন কি করে আশা করা যায়! রাজনৈতিক দলগুলো তাদের বিশেষ বিশেষ চশমা দিয়ে সমস্যাগুলোকে দেখে। তবু অনিমেষের মনে হয় কম্যুনিস্ট পার্টি একমাত্র কাছের দল যার সঙ্গে কাজ করলে এই পরিবর্তন সম্ভব। একটা বিখ্যাত ইঞ্জিনিয়র বা ডাক্তার হওয়ার চেয়ে একজন আন্তরিক কর্মী হওয়া অনেক কাম্য মনে করে সে।

কিন্তু এসব কথা মাধবীলতাকে বোঝানো যাবে কি! যদি তাকে মাধবীলতা গ্রহণ না করে তাহলে কি ওর প্রতি অনিমেষের মনে যে অনুভূতি জন্ম নিয়েছে তা মিথ্যে হয়ে যাবে? শ্লেট মোছার মত ফেলা যায়? সেই ছেলেবেলায় সীতা তার বালক মনে যে ঢেউ তুলেছিল, যার প্রকাশ কখনই সোচ্চার হয়নি, তা তো নেহাত ছেলে মানুষী ছাড়া কিছু নয়, ধোঁয়া ধোঁয়া ছিল সব। কিন্তু যে অনুভূতি জলের দাগের মত এখন অস্পষ্ট হয়েও রয়ে গেছে তাকে কি অস্বীকার করা যায়? আসলে ভালবাসা কখনো কোন শর্ত মেনে আসে না, আমরা তার ওপর বাধা-নিষেধ আরোপ করি । কেন যে এমন হয়!

জীবনে আর কখনো এমন করে সময় পার করার তাগিদ অনুভব করেনি অনিমেষ। আজকের প্রথম ক্লাস বারোটায়। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা সময় হাতে। একটা মিনিট কাটতে যেন এক প্রহর লাগছে। বারোটা বাজলেই মাধবীলতার দেখা পাওয়া যাবে। এখন, চোখ বন্ধ করলেই সেই ঝকঝকে মুখ, সামান্য নীচু মুখের ভঙ্গীমায় ধরে রাখা দীঘল চোখের চাহনি–যেন বুকের গভীরে অনন্ত হয়ে মিশে যায়।

দরজায় শব্দ হতে অনিমেষ কপাট খুলল। এই হোস্টেলের কনিষ্ঠ চাকর চা নিয়ে দাঁড়িয়ে। দরজা খোলা মাত্র ঝড়ের মত টেবিলে কাপ রেখে উধাও হল। ইদানিং বাসী মুখে চা খাওয়ার অভ্যাস হয়েছে। বয়স বাড়ার সঙ্গে মানুষের অভ্যেস পালটে যায়। এই যেমন, চিরকাল সে নিজের জামাকাপড় নিজেই ধুয়ে নিত, জলপাইগুড়িতে থাকার সময় এই অভ্যেসটা হয়ে গিয়েছিল। আগের হোস্টেলেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু এখানে এসে ওই ছোকরা চাকরটা যখন পাঁচ টাকার বিনিময়ে সারা মাস কাজ করে দেবে বলল তখন অনিমেষ রাজী হয়ে গেল। পাঁচটা টাকা অত্যন্ত মূল্যবান ওর কাছে তবু ওই সময়টুকু বাঁচিয়ে আলসেমি করার বিলাসিতা এখন ভাল লাগে।

এই হোস্টেলটার চেহারা অবশ্য সব দিক দিয়েই আলাদা। নিয়ম-কানুনের কড়াকড়ি এখানে অনেকটাই শিথিল। এর একটা কারণ শুধু কলেজ নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও এখানে আছে। এমন কেউ শুধু সন্ধ্যেবেলায় আইন কলেজে পড়ার সুবাদে দিনে চাকরি করা সত্ত্বেও এ হোস্টেলের আবাসিক কিন্তু এটাকে একটা ভাল মেস ছাড়া কিছুই বলা যায় না।

চায়ের কাপ শেষ করতে না করতেই দরজায় শব্দ হল। এ-ঘরে সে একা। ছাদের ওপর এ রকম নির্জনে ঘর পাওয়া কপালগুণেই সম্ভব হয়েছে। মাঝে মাঝে অনিমেষের মনে হয়েছে ভাগ্যদেবী তাকে খানিকটা কৃপা করে থাকেন। এটা ভাবলে আত্মবিশ্বাস বেশ বেড়ে যায়। অনিমেষ দরজা খুলে দেখল দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখে বলল, বাবু এক বুড়া আপকো চুড়তা হ্যায়?

কাহা?

গেটপর বৈঠা হ্যায়।

কেন কোন বৃদ্ধ তাকে খুঁজতে এসেছে বোধগম্য হল না অনিমেষের। কলকাতায় এমন কোন বৃদ্ধের সঙ্গে ওর আলাপ নেই যে এখানে আসতে পারে। দারোয়ানকে বৃদ্ধকে ওপরে পাঠিয়ে দেবার কথা বলতে গিয়ে মত পরিবর্তন করে তাকে ফেরত পাঠিয়ে দিল। তারপর ধীরেসুস্থে নিজেকে মার্জিত করে সে খানিকটা সময় নিয়ে একতলায় নেমে এল। একতলায় এখন দারুণ কর্মব্যস্ততা । বিরাট চাতালে বাসন মাজা চলছে সশব্দে। এই সকালেই বাথরুমে লাইন পড়ে গেছে। অনিমেষ বাইরের গেটের দিকে এগিয কাউকে দেখতে পেল না। দারোয়ানটা টুলে বসে খইনি টিপছিল, জিজ্ঞাসা করতে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top