অনিমেষ হতবাক হয়ে গেল। সুবাসদাকে দল থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে? সেই সুবাসদাকে? যে এতগুলো বছর দলের জন্যে প্রাণপাত করে গেল, নিজের ভবিষ্যতের দিকে না তাকিয়ে বীলভূমের গ্রামে দলের হয়ে কাজ করে বেড়াল, তাকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল অনিমেষের। কোন রকমে সে জিজ্ঞাসা করল, কবে হয়েছে এই ব্যাপারটা?
সুবাসদা হাসল, মাসখানেক। তুমি জানতে না দেখে অবাক হচ্ছি।
না আমি জানি না। বিমানদারা জানে?
অবশ্যই। ওরাই তো সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল আমাকে তাড়ানোর ব্যাপারে । দ্যাখ্যো, বিধান রায় মারা যাওয়ার পর থেকেই আমাদের নেতারা যেন গন্ধ পাচ্ছেন একদিন মন্ত্রিত্বটা দলের হাতে আসবে। তারপর থেকে সবার চালচলন মতামত দ্রুত পালটে যাচ্ছে। এটাই হল সবচেয়ে দুঃখের কথা। এখন কেউ কাউকে চটাতে চায় না। চোখ বুঝে অন্যায় এড়িয়ে যাচ্ছে সবাই।
তোমাদের কি কারণে এক্সপেল করা হল?
পার্টির বর্তমান কার্যধারার সমালোচনা করেছিলাম। মুখে যা বলা হয়েছিল কাজে তা হচ্ছে না। দীর্ঘদিন গ্রামে থেকে ওখানকার মানুষগুলোর কাছে ক্রমশ প্রতারক হয়ে যাচ্ছি। কম্যুনিজমের প্রথম কথাই হল মানুষের সমানভাবে বাঁচার অধিকার আদায় করতে হবে। অথচ দলের মধ্যে ছোটখাটো হিটলারের ছড়াছড়ি। নিঃস্ব মানুষের পার্টি কখনো জোতদারের ওপর নির্ভর করে চলতে পারে না। গত কুড়ি বছরে পার্টির নেতারা কতগুলো ফাঁকা বুলি আওড়ে যাচ্ছে যেগুলোর বাস্তব রূপায়ণের কোন চেষ্টা এদেশে হয় নি। এদেশের ক্যুনিজম তাই একটা হাওয়ার বেলুনের মত, ধরা-ছোঁয়া যায় না। আমরা বলেছিলাম নতুন রক্ত চাই নেতৃত্বে। যে মানুষগুলো এতগুলো বছরে দলকে সুনির্দিষ্ট পথে চালাতে পারল না তাদের সরে যেতে হবে। এর ফল একটাই হল, এবং আমরা জানতাম, আমাদেরই সরে যেতে হয়েছে।
অনিমেষ বলল, কিন্তু এ রকম করলে দল ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়বে। যত ভাঙ্গন হবে তত শত্রুপক্ষ উৎসাহিত হবে।
শত্রুপক্ষ? আমরাই তো আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু।
কিন্তু
শোন, কম্যুনিস্ট পার্টির দুটো ভাগ হল কেন? চীনা সমস্যা? মোটেই না। তুমি কি জানো, হোম মিনিস্টার যখন রেডিওতে ঘোষণা করেছিল যে কম্যুনিস্ট পার্টির একটা শাখা এই দেশে সশস্ত বিপ্লব আনতে চায় চীনের স্বার্থে তখন আমাদের প্রধান নেতা কি বলেছিলেন তাকে? সেই সকালে মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বলেছিলেন আমরা কম্যুনিস্টরা আইনসঙ্গত গণতান্ত্রিক কার্যধারায় বিশ্বাস করি। কোন রকম সশস্ত্র বিপ্লবের ধারেকাছে আমরা নেই। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তাহলে দল ভাগ হল কেন? কম্যুনিস্ট পার্টির ডান–বাম যদি একই পথে চলে তাহলে আলাদা হড়ি করতে হল কেন? সেটা নেতৃত্বের গোলমাল না আদর্শের সংঘাত তা এখন আমাদের বুজতে অসুবিধা হয় না।
সুবাসদা কথা বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিল। রেস্টুরেন্টের অনেকেই এদিকে এখন তাকাচ্ছে। এমন কি সামনের লোক দুটোও। সেটা বুঝতে পেরে সুবাসদা উঠে দাঁড়াল। দাম মিটিয়ে বাইরে এসে জিজ্ঞাসা করল, তুমি তো এখনও মানিকতলায় আছ, তাই না? অনিমেষ বলল, না। আমি এই গ্নে স্ট্রীট–হরি ঘোষ স্ট্রাটের মোড়ের হোস্টেলে এসেছি। আসবে?
আজ থাক। তোমাকে আমার দরকার। ব্যাপারটা ভাবো। এসব কথা এখনই কাউকে বলার দরকার নেই। আমি শিগগীরই দেখা করব।
হোস্টেলে ফিরে এসে অনিমেষ দেখল ওর ঘরে বেশ ভিড়। তমাল আর পাশের ঘরের দুটি ছেলে বেশ মেজাজে আড্ডা জমিয়েছে দাদুর সঙ্গে। সরিৎশেখর ডুয়ার্সের পুরোন দিনের গল্প বলছেন। তমাল চেয়ারে বসেছে আর দুজন জানালার কাছে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে।
অনিমেষ দরজায় দাঁড়াতেই বিছানায় বসা সরিৎশেখরের নজর পড়ল প্রথম, কথা থামিয়ে বললেন, এখানে ডাক্তারকে বোধ হয় সহজে পাওয়া যায় না!
অনিমেষ হেসে ঘাড় নাড়ল। দাদুর অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আগে হলে এ প্রশ্নটা করতেনই না। দেরী হলে বকাঝকা করে বাড়ি মাথায় করতেন। হঠাৎ অনিমেষের মনে পড়ল এই লোকটার ভয়ে এককালে স্বর্গছেঁড়ায় বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেত। অনিমেষ ওষুধগুলো টেবিলে রাখল, এখন শরীর কেমন আছে?
ভাল, বেশ ভাল। এই যে তোমার বন্ধু আমাকে সন্দেশ খাওয়ালো, চমৎকার খেলাম। ফোকলা মুখে হাসলেন সরিৎশেখর।
তমাল অনিমেষকে বলল, দাদুর কাছে তোমাদের ওখানকার গল্প শুনছি। দারুণ ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। চা বাগান কি করে পত্তন হল তার জীবন্ত সাক্ষী দাদু। আমরা তো সেই দুটো পাতা একটা কুঁড়ি থেকেই যেটুকু জেনেছি।
অনিমেষের এত ভিড় ভাল লাগছিল না। একেই ঘরটা ছোট তার ওপর এত লোক একসঙ্গে হলে ভাল করে দাঁড়ানো যায় না। সে বলল, বাবাকে চিঠি দেওয়া হল না। ভাবছি কাল সকালে একটা টেলিগ্রাম করে দেব!
হোয়াই? সরিৎশেখরের ভুরু কুঁচকে গেল।
অনিমেষ দাদুর দিকে তাকাল। এ রকম প্রশ্ন কেন? উনি এই অবস্থায় অসুস্থ হয়ে কলকাতায় এসেছেন এ খবর জানানোয় অন্যায়টা কি বাবা নিশ্চয়ই খুব চিন্তা করছেন।
আমার মনে হচ্ছে চিন্তাটা তোমারই বেশী হচ্ছে। তাছাড়া তোমার টেলিগ্রাম যাবার আগেই আমি পৌঁছে যাব। ওসব করতে যেও না। সরিৎশেখর ঘাড় নাড়লেন।
আপনি পৌঁছে যাবেন মানে?
আমি ঠিক করিছি কাল নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেসে চলে যাব।
সেকি! এই শরীর নিয়ে আপনি যাবেন কী করে! পথেঘাটে কিছু হয়ে গেলে আর দেখতে হবে না। শরীর ঠিক করে তারপর যাবেন। অনিমেষ খুব অসন্তুষ্ট গলায় বলল । যে লোকটা সকালবেলায় ওরকম ধুকেছে সেই সন্ধ্যেবেলায় এ রকম কথা বলছে?
সরিৎশেখর হাসছিলেন, আমার শরীরকে আমার চেয়ে বেশী নিশ্চয়ই কেউ বুঝবে না। যেটুকু দুর্বলতা আছে তা বয়সটার জন্যে। জলপাইগুড়িতে ফিরে গেলে সেটা ঠিক হয়ে যাবে।
এতক্ষণ ওরা চুপচাপ কথা শুনছিল। এবার তমাল বলল, কিন্তু দাদু, আরো দুতিন দিন থেকে গেলে দোষটা কি। শরীর ফিট হয়ে গেলে কালীঘাট দক্ষিণেশ্বর ঘুরে পূজো-টুজো দিয়ে তবে যান। আমাদের কাছে যখন এসেছেন তখন তাড়াতাড়ি ফিরে যাবেনই বা কেন?
সরিৎশেখর বললেন, বেঁচে থাকি যদি নিশ্চয়ই আবার আসব ভাই। অনিমেষ চাকরি-বাকরি করে ঘরদোর করুক তখন এসে থাকব। এখন এই খাঁচায় আমার পক্ষে থাকা অসম্ভব।
খাঁচা? অনিমেষ অবাক হল।
খাঁচা নয়! স্বর্গে আছি পাতালে যেতে হবে পায়খানা করতে। তাও যদি একই সঙ্গে কয়েকজনের প্রয়োজন হয় তাহলে লাইন দিতে হবে সেখানে। আমি মনে করি মানুষের শোওয়ার ঘর আর পায়খানা একই রকমের আরামদায়ক হওয়া উচিত। তার ওপর এই রকম কানের কাছে দিনরাত ট্রামের ঢং ঢং আওয়াজ অসহ্য। সরিৎশেখর মুখ বেঁকালেন।
অনিমেষ হেসে বলল, তাহলে বুঝুন আমি-আমরা কি রকম আরামে থাকি! সরিৎশেখর উত্তেজিত হলেন, এটা তোমাদের কি দুর্ভাগ্য তোমরা বুঝছ না। একটি ছাত্রকে যদি ন্যায্য পয়সা দিয়েও এই রকম নরকে থাকতে হয় তাহলে তার কাছ থেকে দেশ কি আশা করবে? এইভাবে তোমাদের মধ্যে একটা বিশৃঙ্খলা ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
পাশের ঘরের আর একটি ছেলে বলল, বিশৃঙ্খলা মানে?
সরিৎশেখর কঠিন মুখে বললেন, এখন কত রাত? এই সময় প্রতিটি ছাত্রের কি করা উচিত? আর তোমরা সঙ্গে গপ্পো করছ, এটা বিশৃঙ্খলা নয়?
কথাটা শুনে ছেলেদের মুখ কালো হয়ে গেল। অনিমেষ খুব অস্বস্তিতে পড়ল। দাদু যে এ রকম মুখের ওপর ওদের কথা শোনাবেন সে ভাবতে পারেনি। অবশ্য এটাই সরিৎশেখরের আসল চরিত্র। রেখে-ঢেকে কথা বলতে পারেন না।
তমাল উঠে দাঁড়াল, আমি কিন্তু আপনার কথা মানছি না। আমরা যারা হোস্টেলে থেকে পড়ি তারা জানি আমাদের পাশ করতেই হবে। এটা আমাদের দায়িত্ব। নিজেদের পড়া-শুনা আমরা নিজেদের সুবিধেমত সময়ে করে নিই। আপনার কাছে যেটা পড়াশুনার সময় বলে মনে হচ্ছে সেটা আমরা কাছে জিরোবার মনে হতে পারে। ধরুন সারাদিন ক্লান্তির পর ট্রামে-বাসে ঝুলে হোস্টেলে ফিরে পড়তে বসলে আমার ব্রেন তা অ্যাকসেপ্ট করবে না। অথচ রাত দশটার পর পড়লে ওটা আমার বুঝতে কোন অসুবিধা হচ্ছে না। কোনটা বিশৃঙ্খলা এবার বলুন?
সরৎশেখর কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক গলায় বললেন, আমি তোমাদের ঠিক বুঝতে পারি না। প্রায়ই কাগজে ছাত্রদের ট্রাম-বাস পোড়ানোর কথা পড়ি। তখন মনে হয় তোমরা যাতে পড়াশুনা ছাড়া সব কিছু কর তার জন্যে একটা প্ল্যান চলছে। হয়তো তোমরা ভাল ছেলে তাই এভাবে থেকেও একটা পথ বের করে নিয়েছ । কিন্তু যারা বুদ্ধিমান নয় তারা তো তলিয়ে যাবে।
এর পর আর কথা জমল না। দাদুর কথার সুর ওদের কানে লেগে আছে অনিমেষ বুঝতে পারছিল । এক একটা অজুহাত দেখিয়ে বা না দেখিয়ে ওরা চলে গেল। ঘর নির্জন হয়ে গেলে অনিমেষ বলে ফেলল, আপনি ওভাবে না বললেই পারতেন!
কিভাবে?
এই সরাসরি–মুখের ওপর।
অপ্রিয় সতি! সরিৎশেখর হাসলেন, তাহলে তুমি এটাকে সত্যি বলতে চাইছ?
হয়তো, আবার তা নাও হতে পারে। দাদু, আমরা জলপাইগুড়িতে সব কিছু যে-রকমভাবে দেখতাম এবং ভাবতাম, কলকাতায় এসে জানলাম সেটাই অন্যভাবে দেখা যায় বা ভাবা যায়। তাই এখানে সব কিছুই অন্য রকম। আসলে জলপাইগুড়ি আর কলকাতার পরিবেশ একদম আলাদা, সবাই পরিবেশ অনুযায়ী নিজেকে তৈরী করে নেয়।
সরিৎশেখর নাতিকে ভাল করে দেখলেন। তারপর বললেন, লন্ডনে দুপুর বেলায় বরফ পড়ে, সাহারায় আগুন জ্বলে আর কলকাতায় ঘাম হয়। কিন্তু ওই একই সময়ে তিনটে জায়গায় মানুষের বোধগুলোর কিন্তু পরিবর্তন হয় না। থাক ছেড়ে দাও এসব কথা । তোমার ডাক্তার কি বলল?
অনিমেষ ডাক্তারের কথা জানাল। সরিৎশেখর শুনে বললেন, ওসব আর দরকার হবে না। রাত্রে যদি ঘুম হয় তাহলেই হবে। এই বয়সে ওষুধপত্র শরীরকে কাহিল করে দেয়। তাহলে কাল সকালে আমাকে ট্যাক্সি ডেকে দিও।
আপনি কালকে যাবেনই?
হ্যাঁ।
কিন্তু কেন?
আমার ফিরে যাওয়া দরকার তাই।
তাহলে ট্রাক্সি ডেকে দিতে বলছেন কেন? আমিতো স্টেশনে গিয়ে সিট রিভার্জ করিয়ে আপনাকে বসার ব্যবস্থা করে দিতে পারি। আমার তো তাই করা উচিত।
কি দরকার। আমি তো এতটা রাস্তা একা একা ঘুরলাম, তুমি তো সঙ্গে ছিলে না। এখানে এসে আমি অকর্মণ্য হয়ে পড়েছিলাম বলেই তোমাকে বিরক্ত করেছি। আবার শরীরটা ঠিকঠাক হয়ে গেলে নিজেই চলে যেতে পারব। এই জন্যে মিছিমিছি তোমার একটা দিন নষ্ট হয়ে গেল। কাল স্টেশনে গেলে তোমার আর একটা দিন কলেজ নষ্ট হবে। সেটা আমি চাই না। সরিৎশেখরের গলা কেমন নিরাসক্ত লাগছিল।
অনিমেষের মনে হচ্ছিল দাদু অনেক দূরের মানুষ। সকালে দাদুকে দেখে বুকের মধ্যে যে আবেগের জোয়ার এসেছিল তা এই মুহূর্তে নিঃসাড়। এই মানুষটার বুকে হামাগুড়ি দিয়ে ওর শৈশব কেটেছে । রিটায়ার করে যখন সরিৎশেখর স্বৰ্গছেঁড়ার সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে জলপাইগুড়িতে চলে এলেন তখন সে সাত-আট বছরের বালক বাবা-মাকে ছেড়ে ওঁর সঙ্গ ধরেছিল। স্কুলের ক্লাসগুলো একটা একটা করে ডিঙ্গিয়েছে এই মানুষটার কড়া নিয়মের মধ্যে থেকে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে সরিৎশেখরকে কোনদিন চিনতে পারেনি।
একথা ঠিক, এরকম ঘরে থাকার অভ্যেস দাদুর নেই। হোস্টেলের বারোয়ারী ব্যবস্থা অসুবিধে হবে। কিন্তু তাহলেও এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছে না অনিমেষ । হঠাৎ তার খেয়াল হল দাদু কোথায় গিয়েছিলেন, কেন গিয়েছিলেন তা জিজ্ঞাসা করা হয়নি। সরিৎশেখর জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কিছু বলবে?
নীচু গলায় অনিমেষ বলল, আপনি কোথায় গিয়েছিলেন?
গয়া।
গয়া? গয়াতে কেন?
শ্রাদ্ধ করতে। আমার নিজের।
স্তব্ধ হয়ে গেল অনিমেষ। সরিৎশেখরের মুন্ডিত মস্তকে গুঁড়ি গুঁড়ি সাদা চুলের আভাস হঠাৎ তার চোখে কেমন অপ্রকৃত বলে মনে হচ্ছিল। কোন মানুষ জীবিত অবস্থায় নিজের শ্রাদ্ধ করে আসবে এটা কল্পনাতেও ছিল না তার। বিশেষ করে সেই লোক যিনি বৃদ্ধ বয়সেও ধর্মকর্ম মানেননি, দীক্ষাটিক্ষা নেননি। যা সত্যি মনে হয়েছে তাই করেছেন, আপোস করার জন্যে কোন দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেননি।
সে কোন রকমে বলতে পারল, আপনি এমন করলেন কেন?
তোমার খারাপ লাগছে?
হ্যাঁ।
কেন?
আমি আপনাকে! অনিমেষের কণ্ঠে আবেগের প্রবল্য হল। সে কোন রকমে বলতে পারল, শ্রাদ্ধের পর মানুষের জাগতিক সুখ দুঃখ—
রাইট। সরিৎশেখর সোৎসাহে ঘাড় নাড়লেন, ঠিক বলেছ। আমি এখন এক অর্থে মৃত। কিছুদিন থেকে ব্যাপারটা ভাবছিল । সারা জীবন ধরে আমি অনেক কিছু করেছি। একজন সাধারণ মানুষের যা যা করা উচিত সব। ইদানিং আমার কোন আকাঙ্খা ছিল না। খেতে ভালবাসতাম খুব, আজকাল শরীর খাবার নিতে পারে না। তোমার পিসীমা চাল-ডাল গলিয়ে একটা পিন্ডির মত করে দেয় তাই আধ ঘণ্টা ধরে গলায় ঢালি। গিলতেও কষ্ট হয়। যতদিন নিজের শক্তি ছিল ততদিন কারোর পরোয়া করিনি। কিন্তু অথর্ব হওয়া মাত্র অন্যের করুণা প্রত্যাশা করা ছাড়া আর কিছুই অসম্ভব। অর্থ কষ্ট বড় কষ্ট অনিমেষ । আমার মত মানুষ যতদিন বাঁচবে ততদিন সেটা অভিশাপের মত মনে হবে। তোমার বাবা আমাকে টাকা দেয়। দুতিন দিন দেরী হলে মনে হয় সে আমাকে অবহেলা করছে। এই মনে হওয়াটা থেকে আমাকে কে উদ্ধার করবে! যেহেতু সংসারে আছি তাই অথর্ব হলেও লোভ মোহ ক্রোধ থেকে আমার মুক্তি নেই। এগুলো যত থাকবে তত আমি জর্জরিত হব। কদিন আগে তোমার জ্যেঠামশাই সস্ত্রীক আমার কাছে চলে এল। অত্যন্ত জীর্ণদশা তার। খেতে পায় না। এসে এমন ভাব দেখাল যেন আমার সেবা না করলে তার ইহকাল নষ্ট হয়ে যাবে। যে ছেলেকে এককালে আমি ত্যাজ্যপুত্র করেছিলাম, বারংবার যার ছায়া আমি এড়িয়ে চলেছি তাকেই আমি মেনে নিলাম। আমি বুঝতে পারছি আমাকে সেবা করার নাম করে সে আমারই অন্ন ধ্বংস করতে চায়। আমি মরে গেলে ঘরবাড়ির দখল নিতে চায়, তবু আগেকার সেই শক্ত ভাবটা কোথায় চলে গেল আমার । আমাকে সে তেল মালিশ করে দেয়, হাতে ধরে কালীবাড়ি নিয়ে যায়, এই বৃদ্ধ বয়সে আর একা থাকতে হয় না আমাকে, এটাই আমার কাছে এত বড় যে আমি তার অতীতের সব অন্যায় ভুলে যেতে পারলাম। তোমার বাবার সেটা পছন্দ হল না। এককালে যে আমাকে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল, আমার সম্মান পাঁচ জনের কাছে লুটিয়ে দিয়েছিল, আবার তাকে আমি প্রশ্রয় দিচ্ছি সেটা সে মানতে পারছিল না। অনিমেষ, নিজে উপলব্ধি করলাম, যখন রক্তের জোর চলে যায় তখন মানুষ খুব লোভী হয়ে পড়ে। নিজেকে আমি এককালে যতটা কঠোর ভাবতাম এখন আবিষ্কার করলাম আমি আদপেই তা নই। শুধু জেদের বশে অন্য রকম চলার চেষ্টা করেছি মাত্র। এই সময় তোমার পিসীমা বলল, সে নাকি শুনেছে ওরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে আমি চলে গেলেই বাড়িটা পেয়ে যাবে। কবে যাব তাই চিন্তা। মুহূর্তেই আমি অন্য রকম হয়ে গেলাম। সেই দিনই ওদের আবার বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছি। যাওয়ার সময় আমার মুখের ওপর অশ্রাব্য গালাগাল দিয়ে গেল ওরা। পরে মনে হল এ রকমটা কেন আমি করলাম না? তাহলে ভালবাসাটা তো একটা লোভেরই অন্য পিঠ। হঠাৎ মনে হল লোভ সহ্য করতে পারলাম? ওই বাড়িটাকে আমি প্রাণ দিয়ে ভালবাসি বলেই কি ওটা নিয়ে কোন লোভ সহ্য করতে পারলাম না? তাহলে ভালবাসাটা তো একা লোভেরই অন্য পিঠ। হঠাৎ মনে হল পৃথিবীতে যে কটা দিন একটা মানুষের বেঁচে থাকা দরকার তার থেকে অনেক বেশি দিন আমি বেঁচে আছি। দীর্ঘজীবন বড় অভিশাপের! এক নাগাড়ে কথা বলে হাঁপিয়ে পড়েছিলেন সরিৎশেখর। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নীচু গলায় বললেন, পিছুটান মুছে ফেলব ঠিক করলাম। এক রাত্রে কাউকে কিছু না বলে চলে গেলাম গয়া। আমার মৃত্যুর পর লোকে ঘটা করে শ্রদ্ধা করবে আর লোকজনকে ডেকে খাওয়াবে এটা সহ্য হবে না। নিজের পাট নিজেই চুকিয়ে দিয়ে এলাম। এখন নিজেকে অন্য রকম মনে হচ্ছে যেন আকাশ থেকে মাটির দিকে তাকিয়ে সব কিছু দেখার মত মজা লাগছে। তোমার বন্ধুরা আমাকে দক্ষিণেশ্বর কালীঘাট দেখার কথা বলেছিল। ওসব জায়গায় যাবে যারা আমি তো তাদের দলে নই। আমার তো সব প্রয়োজন ফুরেয়েছে। এখন যে কদিন থাকব চোখ চেয়ে দেখব আর কান খুলে শুনব। কিন্তু এই দেখা বা শোনা আমার মনে কোন রেখাপাত করবে না। মানুষ বেঁচে থাকে আশা নিয়ে। আমি সেই ইচ্ছেটুকু গয়ায় রেখে এসেছি। জলপাইগুড়িতে ফিরে যাচ্ছি কারণ আমাকে এখনও কিছুদিন এই শরীরটাকে টানতে হবে। তোমার পিসীমা সেই বালবিধবা হবার পর থেকে আমার ঘাড়ে আছে। সে আমাকে বোঝে।
অনিমেষ মানুষটার দিকে অপলক তাকিয়েছিল। এখন সরিৎশেখরের ভঙ্গিতে, কণ্ঠস্বরে কেমন অন্যরকম চেহারা প্রকাশ পাচ্ছে। সে কিছুক্ষণ সময় নিল নিজেকে সংযত করতে। সরিৎশেখর উর্ধ্বমুখে বসে আছেন এখন। কিছুক্ষণ ঘরে কোন শব্দ নেই। শেষ পর্যন্ত অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, আপনি রাত্রে কী খাবেন?
কিছু না। সন্দেশটা খেয়ে পেট ভার হয়েছে। তুমি বরং এক গ্লাস জল দাও।
সরিৎশেখর উঠলেন। এখন থেকে পদক্ষেপ অনেকটা স্বাভাবিক। অনিমেষ দেখল উনি ছাদের কোণায় একা একা হেঁটে গেলেন। টেবিলে জল রেখে অনিমেষ দ্রুত বিছানাটা ঠিক করে দিল। ইচ্ছে করলে সে আজ রাতে অন্য কোন ধরে শুতে পারে। কিন্তু দাদুকে একা রেখে দিতে মন চাইছে না। সে একটা চাদর বিছিয়ে মেঝেতে শুয়ে থাকবে বলে ঠিক করল।
রাতের খাওয়া নিচে সেরে এল অনিমেষ। এসে দেখল সরিৎশেখর চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। ঘুমুচ্ছেন ভেবে নিঃশব্দে সে মেঝেতে বিছানা করছিল নিজের, সরিৎশেখর বললেন, কোন ঘরে খাট খালি নেই?
কেন?
মেজেতে শুলে অসুস্থ হতে পারো। যদি খাট খালি থাকে সেখানে শোও।
না, আমার কোন অসুবিধা হবে না।
তুমি কি ভাবছ একা থাকলে রাত্তিরে আমি মরে যেতে পারি?
একথা কেন বলছেন?
তুমি তো শুনলে আমার জন্যে ভাবনা করা নিষ্ফল। অবশ্য তোমার অসুবিধা হবে তেমন হলে। কিন্তু যে ছেলে পুলিশের সঙ্গে লড়াই করে তার এমন মন থাকা উচিত নয়।
আচমকা ইলেকট্রিক শক খাওয়া অনুভুতি হল অনিমেষের। ও মুখ তুলতে পারছিল না। দাদু একথা এতক্ষণ পরে কেন বললেন? পুলিশের সঙ্গে লড়াই তো সে কখনো করেনি। করতে যাওয়ার মত কোন পরিস্থিতিও হয়নি। অবশ্য কদিন আগে যুনিভার্সিটির সামনে যে ঘটনা ঘটেছিল সেটায় সে সক্রিয় অংশ নিয়েছিল। কিন্তু তাকে কি পুলিশের সঙ্গে লড়াই বলা যায়? কিন্তু প্রশ্ন হল দাদু সেকথা জানলেই বা কি করে? কলকাতায় সে এসেছে পড়াশুনা করতেই সে যে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ছে, বামপন্থী রাজনীতিতে সে বিশ্বস্ত এবং যুনিয়নের জন্য অনেকখানি সময় ব্যয় করে–এসব ব্যাপার তো সরিৎশেখরের জানার কথা নয়। পরীক্ষায় ফেল করেনি মানে বাবার পাঠানো টাকার অপব্যয় হয়নি। ছুটিতে সে যখন জলপাইগুড়িতে গিয়েছে তখন চুপচাপ বাড়িতে বসে থেকেছে। তার আচরণ দেখে কারোর বোঝার অবকাশ ছিল না যে সে কলকাতায় এসব ব্যাপার করছে। অনিমেষ বুঝতে পারছিল তার মুখের ওপর সরিৎশেখরের দুটো চোখ স্থির হয়ে আছে। অতএব তাকে এক্ষুণি একটা জবাব দিতে হবে। দাদুর কাছে মিথ্যে কথা বললে ছেলে–বেলায় বুক কেঁপে যেত, কখনই পারত না। সরিৎশেখরের মুখের দিকে না তাকিয়ে অনিমেষ হাসবার চেষ্টা করল, এ খবর আবার কোথায় পেলেন! পুলিশের সঙ্গে লড়াই করতে যাব কেন? আর সেরকম হলে আমাকে ওরা ছেড়ে দিত?
তুমি কমুনিস্ট পার্টিতে নাম লিখিয়েছ একথা মিথ্যে?
আপনি কোত্থেকে জানলেন?
আগে বল মিথ্যে কি না!
কম্যুনিস্ট পার্টিকে সমর্থন করি মানেই পুলিশের সঙ্গে যুদ্ধ করছি?
আজ করছ না, কাল করবে, পরশু করবে? সরিৎশেখর দৃঢ় গলায় বললেন, তুমি এখন ছাত্র। তোমার কর্তব্য ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে তৈরি করা, যোগ্য করা। তা না করে তুমি কম্যুনিস্ট হয়েছ। দেশে বিপ্লব আনতে চাও? এরকম একটা নেশায় তোমাকে ধরবে আমি চিন্তাও করিনি। যেদিন তুমি জলপাইগুড়ি থেকে প্রথম এসেছিলে সেদিন আমি তোমায় বলেছিলাম, তুমি কৃতী হয়ে ফিরে এসো, আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করব। কিন্তু তোমার স্কুলের এক মাস্টার যখন আমায় বলল যে তুমি য়ুনিয়ন করছ, দিনরাত পার্টি নিয়ে মত্ত আছে, আমার আর অপেক্ষা করার কোন প্রয়োজন থাকল না। বলতে পার এটাও একটা জাগতিক আকাঙ্খা। তোমার জন্যে একটা স্বপ্ন দেখা সেটা ভেঙ্গে গেলে কষ্ট হচ্ছিল খুব। তা গয়া থেকে ঘুরে এসে আমার সেই কষ্টটা আর নেই। এখন তোমার ভবিষ্যৎ নিয়ে আর আমার মাথা ঘামানোর প্রয়োজন দেখি না!
আপনি বোধ হয় একটু অতিরঞ্জিত সংবাদ পেয়েছেন। তাছাড়া কম্যুনিস্ট পার্টির হয়ে কাজ করলেই যে একটা ছেলের ভবিষ্যতের বারোটা বেজে গেল–এ ধারণা এখন অচল। অনিমেষ সরিৎশেখরের শেষ কথাটার কোন গুরুত্ব দিতে চাইল না। ও চাইছিল দাদুকে কম্যুনিজমের আলোচনার মধ্যে নিয়ে আসে যাতে ওঁর বদ্ধ ধারণা কিছুটা পালটে দিতে পারে।
কিন্তু সরিৎশেখর সেদিকে গেলেনই না। অনিমেষের কথা শুনে চুপচাপ শুয়ে থাকলেন।
রাত বেশি হলে ট্রামের শব্দ আরো বিকট হয়ে ওঠে। আলোচনাটা উঠেও থেমে গেল বলে অনিমেষ অস্বস্তি বোধ করছিল। আগে দাদুর কাছে খোলাখুলি মনের কথা বলতে পারত সে। আজকাল সেই ইচ্ছেটা আছে কিন্তু সরলতাটুকু কখন হারিয়ে গেছে। তাই যুক্তি দিয়ে তর্ক করে বোঝাতে হয় । একসময় সরিৎশেখর বললেন, তুমি কি এখন পড়াশুনা করবে?
অনিমেষ বলল, আজকে ভাল লাগছে না দাদু।
তাহলে আলোটা নিবিয়ে দাও। সরিৎশেখর পাশ ফিরে শুলেন।
সকালে সরিৎশেখর অন্য মানুষ। একদিনের বিশ্রামের পর শরীর একটু স্থির হওয়ায় আবার আগের ফর্ম ফিরে পেয়েছেন। জ্বর আসেনি আর। সেই ভোর রাতে যখন সবাই ঘুমাচ্ছে তখন অনিমেষকে ডেকে তুলেছেন। ঘুম চোখে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করেছিল, এই সময়ে উঠছেন কেন? অন্ধকার আছে। বাইরে।
দেরী নেই ভোর হবার; প্রাকৃতিক কাজকর্মগুলো সেরে নিই। আশা করি এখন লাইন পড়েনি।
তখন ঠাকুর–চাকরও ওঠেনি। নির্বিঘ্নে নীচের কাজ সেরে ওপরে উঠে এসে সরিৎশেখর বললেন, তোমাদের বাথরুম পায়খানায় কি চব্বিম ঘণ্টা আলো জ্বলে? ওরকম স্যাৎসেঁতে হয়ে থাকে সব সময়?
অনিমেষ বলল, পুরোন বাড়ি তো, তাই আলো ঢোকে না।
তুমি কলকাতার জন্য উপযুক্ত হয়েছ।
কথাটা হয়তো সরিৎশেখর অন্যমনস্ক গলায় বললেন, কিন্তু অনিমেষের মনে হল এর চেয়ে সত্যি আর কিছু নেই। কলকাতায় বাস করতে গেলে কতগুলো যোগ্যতার খুব দরকার হয়। বিবেক ভদ্রতা স্নেহ অথবা সৌজন্যের চিরাচরিত সংজ্ঞাগুলো এখানে প্রয়োজনমত অদলবদল করে নেওয়া হয় । যে মানুষ এসব বোঝে না তাকে প্রতি পদক্ষেপে ঠোকর খেতে হয়। অনিমেষ এই কয় বছর কলকাতা বাসের পর এসবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বোঝাপড়া করে ফেলেছে।
এখন আকাশে প্রচুর তারা। চারধার এত বেশি চুপচাপ যে মনে হয় এটা কলকাতা নয়। ঘুমের মধ্যে শেষ ট্রাম চলে গেছে আর প্রথম ট্রাম চলার এখনও সময় হয়নি। অদ্ভুত করুণ এবং বিষণ্ণ লাগছিল আকাশ। সারারাত জ্বলার পর এই সময় রাস্তার আলোগুলো এমন হলদে হয়ে যায় কেন? ছাদে দাঁড়িয়েছিল অনিমেষ এমন সময় সরিৎশেখর লাঠি হাতে ঘর থেকে বের হলেন। যে ময়লা পোশাকগুলো গতকাল খুলে রেখেছিলেন ঘরে ঢুকে আজ সেগুলো পরনে।
অনিমেষ এগিয়ে এলো, এখন কোথায় যাচ্ছেন?
একটু বেড়িয়ে আসি। কেন, তুমি মর্নিং ওয়ার্ক কর না?
ঠোঁট কামড়াল অনিমেষ। জলপাইগুড়ির সেই দিনগুলো। বছরের পর বছর এই মানুষটা প্রত্যেক ভোরে তাকে নিয়ে হেঁটেছেন তিস্তার পাশ দিয়ে। ওটা তো অভ্যাস হয়ে যাওয়ার কথা। কথায় বলে বাল্যের অভ্যেস আমৃত্যু থাকে। কিন্তু কলকাতায় আসার পর ওটা কখনো মনেই আসেনি। এখন ভোরে বরং ঘুম গাঢ় হয়। কলকাতায় যে যত দেরীতে ওঠে সে তত প্রতিভাবান।
অনিমেষ বলল, সে অভ্যেসটা চলে গেছে। কিন্তু এখানে মাঠ বা নদী খুব কাছাকাছি নেই, হাঁটবেন কোথায়?
কেন? এতবড় রাস্তা আছে। গাড়িঘোড়া না থাকলে ওখানে হাঁটতে তো কোন অসুবিধা নেই। তোমাদের সদর দরজা খোলা আছে?
অনিমেষ ভেবে পাচ্ছিল না গতকাল ওরকম ধুকতে ধুকতে আসা মানুষটি এরকম তাজা হয়ে যান কী করে। সে বলল, না গেট বন্ধ । আপনি চলুন আমি দারোয়ানকে ডেকে তুলি।
একটা শার্ট গলিয়ে নীচে নেমে দারোয়ানকে তুলতে একটু ঝামেলা করতে হল। এই কাকভোরে কেউ বাইরে যায় না।
ওরা বেরিয়ে গেলে দারোয়ান আবার দরজা বন্ধ করে দিল। সরিৎশেখর বললেন, তুমি এলে কেন?
শেষরাতে ঘুম থেকে উঠে অনেকদিন বাদে অনিমেষের এইসময় ভাল লাগছিল। একবার ঘুম চলে গেলে এরকম কাকভোকে খুব আপন মনে হয়। সে কোন উত্তর না দিয়ে সরিৎশেখরের সঙ্গে কলকাতার রাস্তায় হাঁটতে লাগল।
এখন পথ নির্জন। রাস্তার হলদেটে আলো ছাড়া আকাশে কোন আয়োজন শুরু হয়নি। ফুটপাতে কিছু ঘুমন্ত মানুষ ছাড়া লোকজন দেখা যাচ্ছে না। সরিৎশেখর লাঠি লুকে হাঁটছেন। এখন ওঁর চলা অত্যন্ত মন্থর। এককালে যার সঙ্গে সে হেঁটে তাল রাখতে পারত না এখন তার সঙ্গে পা মেলাচ্ছে হাঁটি হাঁটি করে। সরিৎশেখরের যে কষ্ট হচ্ছে হাঁটতে এটা বুঝতে পারল অনিমেষ। নেহাৎ জেদের বশেই হাঁটছেন তিনি। কি করবে বুঝতে পারছিল না সে। সেন্ট্রাল এভিন্যু ছাড়িয়ে ডান হাতি একটা পার্কের সামনে দাঁড়াল ওরা। অনিমেষ বলল, এখানে একটু বসবেন?
সরিৎশেখর স্বীকার করলেন, হ্যাঁ, বসলে একটু ভাল হতো।
পার্কে ঢুকে বিব্ৰত হল অনিমেষ। অনেকগুলো বেঞ্চি পার্কময় ছড়ানো কিন্তু তার একটাতেও বসার পাটাতন নেই। কেউবা কারা সযত্নে পার্কটাকে ড়ো করে রেখে দিয়েছে। দাদুকে নিয়ে এক একটা বেঞ্চির কাছে গিয়ে এদৃশ্য দেখে অনিমেষ ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছিল। এর জন্যে তার কোন দায়িত্ব না থাকলেও মনে হচ্ছিল কলকাতার মানুষ হিসেবে সে কতগুলো লজ্জার মুখোমুখি হচ্ছে।
সরিৎশেখর বললেন, আর চেষ্টা করো না। এবারে বরং ফেরা যাক।
খুব ধীরে ধীরে হাঁটছিলেন সরিৎশেখর। এখন ওঁর ক্লান্তি অত্যন্ত পরিষ্কার। কোন রকে বসলে হয় । কথাটা বলতে সাহস পাচ্ছে না অনিমেষ।
সরিৎশেখর বললেন, এই ন্যাড়া মাঠটাকে তুমি পার্ক বললে? ফুল নেই গাছ নেই এমনকি মাটিতে ঘাস নেই, বসার জায়গার কথা ছেড়েই দিলাম। কোন সংজ্ঞায় একে পার্ক বলা যায়? তবু তোমরা বলছ। বলছ অভ্যাসে। আসল জিনিসটা কখন হারিয়ে গিয়ে তার জায়গায় নকল জুড়ে বসল কিন্তু তোমরা টের পেলে না। আশ্চর্য।
অনিমেষ জবাব দিল না। ওর মনে হচ্ছিল দাদুর কথার কোন প্রতিবাদ আর এই মুহূর্তে সে করবে না। তর্ক করে এই বৃদ্ধকে আঘাত দিয়ে কি হবে একটা অনুভূতি ক্রমশ ওকে অধিকার করছিল–দাদুকে আর দেখতে পাবে না সে। ভবিষ্যতের কথা সে জানে না। হয়তো ভবিষ্যৎ তাকে অনেক কিছু দেবে। যেসব কল্পনা তার বুকে মুখ খোড়ে সেগুলো হয়তো সত্যিকারের চেহারা নেবে। কিন্তু যার কাছথেক সে দুহাত ভরে পেয়েছে সেই মানুষটি অতীত হয়ে যাবে। এতদিন পরে যে সরিৎশেখরকে সে দেখেছে তার সঙ্গে অতীতের সেই চেহারার কোন মিল নেই। যে মানুষ নিজের শ্রাদ্ধ করে এসেছে সে যেকোন মুহূর্তেই চলে যেতে পারে। অনিমেষের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল।
হঠাৎ সরিৎশেখর কথা বললেন, অনিমেষ, তোমার কুষ্ঠিতে আছে রাজদ্রোহের জন্য জেলবাস অনিবার্য। তুমি রাজনীতি করবেই। কিন্তু যাই করো নিজের কাছে পরিষ্কার হয়ে করো। আমি জানি না সকাল থেকে রাত্তিরে একবারও তোমার নিজেকে ভারতবাসী বলে মনে হয় কি না। চারধারে যা দেখি তাতে কেউ সে চিন্তা করে বলে মনে হয় না সাধারণ মানুষ নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত। নেতারা রাজনীতিকে সম্বল করে ক্ষমতা দখল করছে। এই দেশে বাস করে কেউ দেশটার কথা চিন্তা করে না। একটা যুবক নিজেকে ভারতবাসী বলে ভাবে না বা তা নিয়ে গর্ব করে না। তাহলে কী জন্যে তুমি রাজনীতি করবে? কেন করবে? আমি ঠিক বুঝি না তোমাদের। কিন্তু মনে হয়, তোমরা নানান জিনিস দিয়ে প্রতিমা বানাও শুধু প্রতিমার জন্যে, ভক্তিটুকুই তোমাদের নেই।
অনিমেষ নাড়া খেল। সেই সময় দূরে অন্ধকারের ফিকে কালোয় প্রথম ট্রাম চলার সাড়া পাওয়া গেল। একটা আলোর পিন্ড থরথরিয়ে ছুটে আসছে ওর দিকে। কান ফাটানো শব্দে ঘণ্টা বাজাচ্ছে ড্রাইভার । চবিতে দাদুর হাত ধরে ফুটপাতে উঠে এল অনিমেষ। যেন বুকের মধ্যে সপাং সপাং চাবুক মেরে শব্দের ঝড় তুলে ট্রামটা মিলিয়ে গেল ওদিকে।
সরিৎশেখর বললেন, চল। তোমার কলকাতা জাগল।
অনিমেষ চুপচাপ নিজের অতীতকে নিয়ে হাঁটা শুরু করল। না, দাদুর কথা শুনবে না সে। নিজে স্টেশনে গিয়ে ভাল জায়গা দেখে ট্রেনে বসিয়ে দিয়ে আসবে দাদুকে। কর্তব্য বা ঋণস্বীকার নয়, এ আর এক ধরনের দীক্ষা–যা বোঝানো যায় না, যে বোঝে সে বুঝে নেয়।
সরিৎশেখরকে জানলার কাছে বসিয়ে দিল অনিমেষ! রিজার্ভেসন পাওয়ার কোন উপায় নেই, কুলিকে একটা টাকা দিয়ে জায়গা কিনতে হল। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে সরিৎশেখরের দিকে তাকাতেই অনিমেষের বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল। সেই বিকেলটার কথা মনে হচ্ছিল। তার প্রথম কলকাতায় আসার বিকেল। সেদিন সে ছিল কামরায় আর সরিৎশেখর প্ল্যাটফর্মে । এবার সরিৎশেখরকে দেখার পর থেকেই কে যেন বুকের মধ্যে বসে বারংবার জানিয়ে যাচ্ছে, এই শেষবার। এরপর আর বৃদ্ধের দেখা পাবে না অনিমেষ। একটা বিরাট গাছ একটু করে শুকিয়ে একটা ছোট শেকড়ে দাঁড়িয়ে আছে । হাওয়ার তেজ বাড়লেই ঢলে পড়বে যেন। কিছু করার নেই, শুধু চোখে দেখা। এই যে সে স্টেশনে এসেছে এটাও পছন্দ ছিল না সরিৎশেখরের। তার জন্যে অনেক সময় নষ্ট করেছে অনিমেষ, আর নয় । কিন্তু সে কথায় কান দেয়নি। রাস্তায় কিছু খাবেন না জেনেও মিষ্টি দিয়েছে সঙ্গে। পিসীমাকে দাদুর প্রকৃত অবস্থা জানিয়ে একটা চিঠি দিতে হবে।
ঘাড় নাড়লেন বৃদ্ধ। তারপর বললেন, তোমার মায়ের কোন চিহ্ন তোমার কাছে আছে?
চমকে উঠল অনিমেষ, মা?
হুঁ। তোমার স্বৰ্গত মায়ের কথা বলছি।
সেই ছবিটার কথা মনে পড়ল। ছবিটা কোথায়? মায়ের সেই জ্বলজ্বলে চোখের ছবি যেটা বাবার ঘরে টাঙানো থাকতো।
সরিৎশেখর অনিমেষের মুখের দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, খুব ছেলেমানুষ ছিলে তুমি তিনি যখন চলে গেলেন। তবু, তোমার কি তাকে মনে পড়ে?
চোখ বন্ধ করলেই টকটকে লাল জ্বলন্ত চিতা। আগুন তখনও গ্রাস করেনি শরীর। দুটো পা আর হাঁটু-ছোঁয়া চুল তখনও চিতার বাইরে। রক্তের দাগ শুকিয়ে যাওয়া কালো দুটা হাত সে চোখের সামেন ধরে আছে–পরিষ্কার দেখতে পেল। কিন্তু এখন, এই মুহূর্তের আগে মাকে তো তেমন করে মনে পড়েনি তার। এমন কি মাধবীলতাকে দেখার সময় মনে হয়েছিল মা এরকমই দেখতে ছিল। এই ছবিটা তো চোখের সামনে আসেনি। সে ছবিটাও তো এখন মনে পড়ছে। মৃত্যুর রাতে মা তাকে বলেছিল, আমি যদি না থাকি তুই একা একা আকাশের দিকে তাকিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলিস, আমি ঠিক শুনতে পাব। অনি, আমি তোকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারব না রে।
দুচোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। অনিমেষ চেষ্টা করে নিজেকে ঠিক করল। কলকাতায় আসার পর ওসব কথা মনেই পড়ে না। মা ক্রমশ ধূসর হয়ে এক সময় হারিয়ে গেছে কখন। আজ দাদু এভাবে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জিজ্ঞাসা না করলে হয়তো… সে মুখে বলল, হ্যাঁ, পড়ে। কিন্তু একথা জিজ্ঞাসা করছেন কেন?
হঠাৎ তাকে মনে পড়ল, তোমার মুখ দেখে–। অনিমেষ, জীবন বড় জটিল। নিজেকে ঠিকঠাক রাখা খুব মুশকিল। তাই একটা অবলম্বন দরকার হয় এগিয়ে যাওয়ার জন্যে, তোমার মা তোমাকে ঘিরে কত স্বপ্ন দেখতেন। আজ তিনি নেই। তাঁর কথা ভেবে চোখের জল ফেলা কোন কাজের কথা নয়। কিন্তু দুদিন তোমায় আমি দেখলাম। যাই করো, শুধু মনে রেখো কেউ একজন তোমায় লক্ষ্য করে যাচ্ছে। তাই কখনো অসৎ হয়ো না।
অনিমেষ জানলায় হাত রেখেছিল। পলকেই সে টের পেল হাতের তলায় জানলা নড়ছে। তারপর একটু একটু করে এগিয়ে যেতে লাগল সেটা। একটার পর একটা কামরা অনিমেষকে অতিক্রম করে গেল। সরিৎশেখরের মুখটা কখন অনেক মুখের আড়ালে হারিয়ে গেল। স্টেশন ছাড়ার সময় কেন যে সবাই সতৃষ্ণ চোখে প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকিয়ে থকে। ট্রেনটা সম্পূর্ণ বেরিয়ে না যাওয়া অবধি অনিমেষ নড়ল না।
এখন অফিসের সময় । শিয়ালদা স্টেশনের বাইরে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল অনিমেষ। পিলপিল কর মানুষজন ছুটে যাচ্ছে সার্কুলার রোডের দিকে। ঘন ঘন লোকাল ট্রেনগুলো শহরতলী থেকে মানুষ বয়ে এনে ছেড়ে দিচ্ছে কলকাতায়। প্রত্যেকে এত ব্যস্ত যে কারো পেছনে তাকানোর সময় নেই। অনিমেষ দেখল মানুষের চেহারা মোটামুটি একই। যেহেতু এদের প্রয়োজন অভিন্ন তাই ভঙ্গিতেও ফারাক নেই। হঠাৎ তাকালে সেই ছবিটার কথা মনে পড়ে যায়। ঝড়ের আভাস পেয়ে যেভাবে নানান চারপেয়ে জন্তুরা পাগলের মত ছুটে যায় আশ্রয়ের জন্য ধুলোর বন্যা বইয়ে, ঠিক তেমনি। তাড়াহুড়া এমন যে, কেউ কাউকে সামান্য সৌজন্য দেখাচ্ছে না। আবার এই মানুষই পৃথকভাবে, একা থাকলে অত্যন্ত ভদ্ৰ শিষ্টাচারসম্পন্ন হবে। কি করে মানুষের এতগুলো মুখ হয়! এদের দিকে তাকিয়ে থাকতে সরিৎশেখরের কথাটা মনে পড়ল। এই যে লোকগুলো ঘুম থেকে উঠেই ভাত খেয়ে ট্রেনে চাপে, শিয়ালদার নেমে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে অফিস যায় বাদুড় ঝুলে, সারাদিন খবরের কাগজ পড়ে, পরচর্চা করে এবং কিছু কাজ করে কাটিয়ে দেয়, আবার বিকেলে শেয়ালদা থেকে বাজার নিয়ে ট্রেনবন্দী হয়ে রাত দশটায় বাড়ি ফেরে–তারা কী ধরনের মানুষ? বেঁচে থাকার জন্য প্রতিটি সংসারের আয়-যন্ত্র; রাত্রে সন্তান উৎপাদন এবং দিনে পরচর্চা এখন রক্তে মিশে গেছে। কেউ নিজেকে কি ভারতবাসী বলে মনে করে? এই দেশ আমার এরকম বোধ কখনো কি তাদের চিন্তিত করে একমাত্র সমালোচনা ছাড়া এরা রাজনীতির ধারেকাছে ঘেঁষে না। যারা তাদের পাইয়ে দেয় সেই রাজনৈতিক দলগুলোকে এরা সমর্থন করে । আদর্শের বালাই নেই। তাহলে, এই যে মানুষের ভারতবর্ষ সে কতটা উন্নতি করবে? হাত-পা মাথা বিহীন একটা জন্তুর মত মুখ থুবড়ে পড়ে আছে দেশটা। এবং তার জন্যে কারো বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। কম্যুনিস্ট পার্টি এদের কথা কিভাবে চিন্তা করে অনিমেষ জানে না। পার্টির প্রথম সারির নেতাদের সঙ্গে তার আলাপ নেই। কম্যুনিষ্ট পার্টি সর্বহারার পার্টি। কিন্তু এই সব মানুষ কিছুই হারাতে রাজী নয়। ওর মনে হল এই রকম দরকচা মারা মানুষগুলোকে কখনই কম্যুনিজমে বিশ্বাসী করানো যাবে না। একটা বড় আঘাত সে যুদ্ধই হোক কিংবা শাসনযন্ত্রের দুর্বার পীড়নই হোক–যা ব্যক্তিগত ঘেরাটোপগুলোকে ছত্রাকার করবে, তা না এলে মানুষে মানুষে জানাশোনা হবে না।
স্টেশনের বাইরে এসে অনিমেষের খেয়াল হল গতকাল খবরের কাগজ পড়েনি। সরিৎশেখরকে নিয়ে সে এমন ব্যস্ত ছিল যে কোনদিকে তাকাবার সময় পায়নি। হ্যারিসন রোডের দেওয়ালে টাঙানো একটা বামপন্থী কাগজের সামনে সে দাঁড়াল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর পুলিশী হামলার তীব্র নিন্দা করেছেন নেতারা। ভিয়েতনামে আমেরিকা বিষাক্ত বোমা ব্যবহার করছে। রাশিয়ায় পৌঁছে ভারতীয় ডেলিগেটরা লেনিনের সমাধিতে মালা দিয়েছেন। কেমন যেন সব সাজানো সাজানো ব্যাপার, অনিমেষ তৃপ্তি পেল না। আজ অবধি কোন কম্যুনিস্ট নেতা বললেন না, ভারতবর্ষ আমাদের দেশ। এই দেশের জন্যেই এখানে কম্যুনিজম প্রয়োজন। প্রতিটি মানুষকে দেশকে ভালবেসে সংগ্রামী হতে হবে। সব সময় বিদেশের কথা বলে একটা অস্পষ্ট ধোয়াটে বৈপ্লবিক আবহাওয়া তৈরি করা হয়। কি লাভ কে জানে। তাছাড়া এতগুলো বছর নেতারা কাজ করলেন কিন্তু কপা এগিয়েছেন তা তারাই জানেন। এখনও শহরের মানুষকে কম্যুনিজম সম্পর্কে আগ্রহী করা সম্ভব হয়নি। গ্রামে তো আরো দূর অস্তৃ। ভারতবর্ষের অনেক প্রদেশ তো কম্যুনিজম বলতে বিদেশী কিছু বোঝে। তাহলে? এদিকে কংগ্রেসীরা তিল তিল করে অবক্ষয়ের দিকে এগোচ্ছে কিন্তু সে সুযোগ নেবার কোন বাসনা বাম নেতাদের নেই । কংগ্রেসীদের অবস্থা যদুবংশের মুষলপর্বের মতন। এটাই তো প্রকৃত সময়। মাঝে মাঝে খুব রাগ হয় অনিমেষের। কিন্তু সেই যে দামী কথা, সীমাবদ্ধ ক্ষমতার মধ্যেই তোমাকে কাজ করতে হবে; মন চায় তবু মেনে নিতে হয়।
অনিমেষ ভেবেছিল হোস্টেলে ফিরে স্নান-খাওয়া সেরে কলেজে যাবে। কিন্তু মীর্জাপুরের কাছাকাছি এসে ভাবল একবার য়ুনিভার্সিটিটা ঘুরেই যাই। এখন সাড়ে দশটা বাজে। বারোটার আগে ক্লাস আরম্ভ হবে না। স্বচ্ছন্দে হোস্টেল থেকে তৈরি হয়ে আসা যেত। কিন্তু এক কাপ চা খাওয়ার ইচ্ছা তীব্র হল। রাখালদার ক্যানটিনে এখনও আট পয়সায় চা পাওয়া যায়। লনে ঢুকতেই দেখল চারধারে পোস্টার। ছাত্র ধর্মঘট। পুলিশী অত্যাচারের প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। যদিও সে গতকাল খবরের কাগজ পড়েনি তবু কেউ তো একথা বলেনি! তমালদের মুখেও তো শোনা যেত তাহলে। এখনও ছেলেমেয়েরা কেউ আসেনি। অনিমেষ ক্যান্টিনে ঢুকে দেখল কয়েকজন ভাত খাচ্ছে, কোণার দিকে ছোট্ট একটা জটলা। ওরা যে ছাত্র পরিষদের ছেলে বুঝতে অসুবিধে হল না। অনিমেষকে দেখতে পেয়েই ওদের গলার আওয়াজ নীচে নেমে এল। একজনকে চিনতে পারল সে। শচীন। নীলার বন্ধু । একদিন কফি-হাউসে এই ছেলেটির সঙ্গে তার অনেক কথা হয়েছিল। বেশ ভদ্র ছেলে। অনিমেষ রাখালদাকে একটা চায়ের কথা বলে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে হাসল। ওর এই চিনতে পারার ভঙ্গিটায় শচীন অবাক হল। অনিমেষ গলা তুলে বলল, ভালো আছেন?
গায়ে পড়ে কথা বলা ওর অভ্যেস নয় কিন্তু মনে হচ্ছিল ছেলেটি কোন কারণে আড়ষ্ট হয়ে আছে। ব্যাপারটা জানার জন্য কৌতূহল হচ্ছিল।
শচীন এবার উঠে এল। সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, কিছু বলছেন?
অনিমেষ দেখল শচীনের বলার ভঙ্গিতে একটা শীতলতা আছে। তবু সে আবার জিজ্ঞাসা করল, অনেকদিন দেখিনি, খবর কি সব?
কি খবর চান?
অনেকদিন নীলাকে দেখিনি। কেমন আছে ও? অনিমেষের মনে হল নীলার কথা বললে শচীন সহজ হবে।
শচীনের কপালে ভাঁজ পড়ল। অনিমেষকে খুঁটিয়ে দেখে বলল, আপনি কিছু জানেন না?
কি ব্যাপার, কি হয়েছে? অনিমেষ অবাক হল।
ওদের বাড়িতে যাননি এর মধ্যে?
না, বেশ কিছুদিন আমার যোগাযোগ হয়নি?
তাহলে নিজে গিয়েই জেনে আসুন। আজ তো আপনারা ধর্মঘট ডেকেছেন, চলে যান আজকেই। কাছেই তো। শচীন এমন ভঙ্গী করল যেন তারা কথা শেষ হয়ে গেছে, এবার ফিরে যাওয়া যেতে পারে।
অনিমেষ বলল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনার কি সব কথা খুলে বলতে অসুবিধে আছে?
এই সময় ছেলেটা চা দিয়ে যেতে সে ইশারায় শচীনকে এক কাপ দিতে বলল। শচীন আপত্তি জানিয়ে বলল, আপনি গতকাল বিকেলে জানতেন যে আজ ধর্মঘট করা হবে! আপনিও তো একজন ছাত্র-প্রতিনিধি!
অনিমেষ এ রকম প্রশ্ন আশা করেনি। ও বুঝতে পারল শচীন এই ধর্মঘটকে কেন্দ্র করেই তার সম্পর্কে এক বিরূপ ধারণা নিয়ে কথা বলছে। অনিমেষ উত্তর দিল, আমি গতকাল অনুপস্থিত ছিলাম। থাকলে নিশ্চয়ই জানতে পারতাম। সিন্ধান্ত নিশ্চয়ই সর্বসম্মত।
মিথ্যে কথা। আমাদের খবর, কালকেও আপনাদের পরিকল্পনা ছিল না ধর্মঘট করার। পুলিশ যাদের অ্যারেস্ট করেছে তারা কেউ ছাত্র নয়। কিন্তু গত রাত্রে পার্টির নির্দেশে বিমান নিজে এই ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে।
কথাটা শুনে চমকে গেল না অনিমেষ। এটা হতেই পারে। সাধারণ সম্পাদককে যদি পার্টি নির্দেশ দেয় তবে নিশ্চয়ই সে মান্য করবে। এতে অন্যায়টা কিসের। সে বলল, এটা তো আমাদের ভেতরের ব্যাপার, আপনারা মাথা ঘামাচ্ছেন কেন?