What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected কালবেলা- সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

মাথা ঘামাচ্ছি কারণ আপনারা নিজের ইচ্ছে মতন সমস্ত ছাত্রছাত্রীকে কিছু করতে বাধ্য করতে পারেন না। পুলিশের সঙ্গে এনকাউন্টার আপনারাই করেছিলেন। ওদের খুঁচিয়ে দিয়ে য়ুনিভার্সিটিতে এসে লুকিয়েছেন যাতে আমরাও জড়িয়ে পড়ি। বাইরের গুন্ডা দিয়ে ট্রাম পুড়িয়েছেন নিজের বীরত্ব প্রমাণ করতে। কি ইস্যু নিয়ে এত কান্ড হল? সাধারণ ছাত্রের সঙ্গে কী সম্পর্ক? গতকাল কেবলে তিনজন কমুনিস্ট পুলিশের গুলীতে মারা গেছে এতএব আজ এখানে ধর্মঘট করো। অথচ সেকথা আপনারা বলছেন না ধর্মঘটের কারণ দেখাতে। কিন্তু ছেলেমেয়েরা বহুদূর থেকে কষ্টের পয়সা খরচ করে এখানে এসে দেখবে ক্লাস হচ্ছে না–এই হয়রানি এবং অপচয় কেন করালেন? আর সবশেষে একটা কথা, নিজের নাক কেটে কি অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করা যায়? একদিনের ধর্মঘট করা মানে একটা দিনের পড়াশুনো নষ্ট করা। এতে আপনাদের কি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে?

আমি এ ব্যাপারে আপনার সঙ্গে আলোচনা করতে ইচ্ছুক নই। আপনার যদি আপত্তি থাকে তাহলে আপনি ধর্মঘটে যোগ দেবেন না। ব্যাস। অনিমেষ চায়ের দাম দিল।

সে তো একশবার। আপনারা যা ইচ্ছে করবেন আর আমরা তা মুখ বুজে সহ্য করব এটা ভাববেন । আমরা ধর্মঘটের প্রতিবাদ করব। আমরা ছাত্রদের বলব ক্লাস করতে। শচীন কথা শেষ করা মাত্রই অনিমেষ ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে এল । কি পরিস্থিতিতে বিমানদা আজকের ধর্মঘট ডেকেছে সে জানে না কিন্তু সেদিন যে পুলিশ বাড়াবাড়ি করেছিল সেটা তো সত্যি।

য়ুনিয়ন রুম জমজমাট। কার্যনির্বাহক কমিটির সবাই এসগেছে। অনিমেষকে দরজায় দেখে সুদীপ চুরুট নামালো, এই যে অনিমেষবাবু আসুন।

কথাটায় ব্যঙ্গ মেশানো, অনিমেষ অবাক হল। এভাবে কথা বলার কী কারণ আছে তা বুঝতে পারল না সে।

একটা চেয়ার টেনে বসতেই বিমান বলল, কাল কি হয়েছিল তোমার?

অনিমেষ বলল, একটু পারিবারিক কাজে জড়িয়ে গিয়েছিলাম।

বিমান বলল, যাই হোক না কেন, একবার তোমার ঘুরে যাওয়া উচিত ছিল। পার্টির কাজ করতে গেলে ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলোকে এতটা গুরুত্ব দেওয়া চলবে না অনিমেষ। তাছাড়া তোমার কাছ থেকে আমরা তেমন কোন কাজও পাই না।

সুদীপ বেঁকানো গলায় বলল, দেখে তো মনে হচ্ছে স্নান-খাওয়া করো নি। তা এখানে আসতে পরামর্শ দিল কে?

এবার বিরক্তি চাপতে পারল না অনিমেষ, আমি কি এসে অন্যায় করেছি?

বিমান বলল, তুমি হোস্টেলে ছিলে না সকালে, খবর পেলে কি করে?

অনিমেষ বলল, আমাকে খবর দেওয়া হয়েছিল?

হ্যাঁ কিন্তু তোমাকে পাওয়া যায় নি।

আমি স্টেশনে গিয়েছিলাম । ফেরার পথে কোন কিছু না ভেবেই এখানে এসেছি।

আর এসেই সোজা ছাত্র পরিষদের সঙ্গে আলোচনায় বসে গেলে! সুদীপ বলল।

এবার অনিমেষ উঠে দাঁড়াল, আপনারা কি বলতে চাইছেন খুলে বলুন!

বিমান একটা হাত উপরে তুলে বলল, উত্তেজিত হবার মত কিছু হয় নি। বসো।

তারপর অন্য সবার দিকে তাকিয়ে বলল, কমরেডস, আমাদের অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে। আপনাদের কাছে আমার আবেদন যে, এ সময়ে কোন রকম আচরণ করবেন না যাতে পার্টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার জন্য এক সক্রিয় ষঢ়যন্ত্র শুরু হয়ে গেছে। আমরা যেন কেউ সেই ফাঁদে পা না দিই। আমাদের ছাত্র সংগঠনগুলো পার্টির এক একটা হাতের মত। অতএব, এই সংগঠনের গুরুত্ব অনেক। পুলিশ, কংগ্রেস সরকারে পুলিশ প্রকাশ্যে জঘন্য অত্যাচার করে ছাত্রসমাজকে কলুষিত করেছে। আমার এত তীব্র প্রতিবাদ করেছি। এই প্রতিবাদের প্রকাশ আজকের ছাত্র ধর্মঘট। আমরা জানি সাধারণ ছাত্ররা আমাদের পাশে আছেন। যদি কেউ বিরোধিতা করতে চান সেই দালালদের আমরা বাধা দেব। গতকাল কেবলে পুলিশ তিন জন কমরেডকে হত্যা করেছে। এই সুযোগে আমরা তারও প্রতিবাদ করব। আপনাদের কারো কিছু বলার আছে? বিমানের দৃষ্টি সবার মুখের ওপর বুলিয়ে এসে অনিমেষের ওপর স্থির হল। উত্তেজিত হলে মানুষের নার্ভ বিক্ষত হয়।
 
বিমানের বক্তৃতা অনিমেষের কানে অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল মাঝে মাঝে। তার সম্পর্কে অবিশ্বাস এদের মধ্যে এসেছে, এই বোধ তাকে নিঃসঙ্গ করছিল। বিমান জিজ্ঞাসা করল, অনিমেষ কিছু বলবে? সচেতন হল অনিমেষ। ঘাড় নেড়ে না বলে বসে পড়ল। বিমান বলল, কোন কোন ব্যাপারে সবাই একমত নাও হতে পারে কিন্তু প্রতি ব্যাপার নিয়ে যদি আমরা সমালোচনা করি তাহলে কোন কাজই শেষ হবে না। যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকের কর্তব্য হল হুকুম পালন করা। তাতে যদি মৃত্যুও হয় তবু তাই সই। কারণ আজকের মৃত্যু আগামীকালের পক্ষে আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়াবেই। আপনাদের কাছে আমার আবেদন, আমাদের আন্দোলন সফল করতে প্রত্যেকে সক্রিয় ভূমিকা নিন।

বিমান বসে পড়তেই সুদীপ উঠে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে সবাইকে দেখল। তারপর অত্যন্ত গুরুগম্ভর গলায় বলল, কমরেডস, আমি খবর পেয়েছি আজকের ধর্মঘট বানচাল করতে বুর্জোয়া শাসন ব্যবস্থা বদ্ধপরিকর। তাদের লালিত ছাত্রসংস্থা এর মদত দেবে। দুঃখের কথা, কিছু প্রতিবিপ্লবী বিপথগামী বন্ধু এদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। আমরা এর মোকাবেলা করব। আপনারা অন্যান্য কমরেডদের নিয়ে য়ুনিভার্সিটির প্রতিটি গেটে বিক্ষোভ সমাবেশ করুণ। কেউ যদি জোর করে ঢুকতে যায় তাহলে আমরাও চুপ করে বসে থাকব না।

কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে সবাই এক একটা গেটে চলে গেল। য়ুনিভার্সিটির অফিস খোলা, অধ্যাপকদের আসতে বাধা দেওয়া হবে না।

অনিমেষকে ডাকল বিমান, তুমি একটু আমার সঙ্গে এসো।

একটু ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে বিমান জিজ্ঞাসা করল, তোমার কি হয়েছে?

কিছুই হয়নি।

তুমি কি পার্টির প্রতি ভরসা হারাচ্ছো?

একথা কে বলল?

আমাদের কানে এসেছে তুমি এরকম কথাবার্তা বল।

না, আমি কখনও বলিনি। অনিমেষ ভাবতেই পারছিল না তার মনের কথা এরা টের পাচ্ছে কি করে! সে তো কারোর সঙ্গে আলোচনা করেনি।

কাল রাত্রে তুমি কি করছিলে?

মানে?

অনিমেষ বি ইজি। কাল রাত্রে তুমি হাতিবাগানে কি করছিলে?

এবার অনিমেষ শক্ত হল। ওরা কি সুবাসদার সঙ্গে তার দেখা হওয়া নিয়ে এসব বলছে? কিন্তু সুবাসদা তার পরিচিত, দেখা তো হতেই পারে।

সে বলল, ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে বেরিয়ে সুবাসদার সঙ্গে দেখা, আমরা চা খেলাম, গল্প করলাম।

কী গল্প?

এটা একদম ব্যক্তিগত প্রশ্ন নয়?

গুড। তুমি সহজ হতে পারছ না অনিমেষ। মনের মধ্যে ময়লা থাকলেই মানুষ গুটিয়ে যায়। তবু জিজ্ঞাসা করছি, কী কথা হয়েছিল?

অনেক দিনের আলাপ। দেখা হল দীর্ঘ ব্যবধানে। এ রকম ক্ষেত্রে যে রকম কথা হতে পারে আর কি। আপনার সঙ্গে দেখা হয়নি সুবাসদার?

না। সে দেখা করবে না। সুবাসকে পার্টি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে এ খবরটা তো তুমি শুনেছ ওরই কাছ থেকে। কেউ শাস্তি পেলে তার ব্রেন অনেক কিছু বানিয়ে নেয়। সুবাস তোমাকে প্রকাশ্যে রেস্টুরেন্টে যেসব কথা বলেছে তা অনেকেই শুনেছে। এসব কথা ওকে বলতে দিয়ে তুমি ভাল করনি। ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধ করার চেষ্টার জন্যে দল ওকে তাড়িয়েছে। এ রকম মানুষের সঙ্গে কোন রকম সংশ্রব না রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। আমার কথা বুঝতে পেরেছ।
 
বিমানের শেষ কথাগুলো যে সতর্কীকরণ তা বুঝতে অসুবিধে হল না অনিমেষের। এ নিয়ে অনেক তর্ক করা যেতে পারে কিন্তু অনিমেষ নিস্পৃহ থাকল। সুবাসকে ওর ভাল লাগে। সুবাস যে কথাগুলো বলেছে তা অযৌক্তিক বলে মোটেই মনে হয়নি। ও বুঝতে পারছিল এ ব্যাপারে যা কিছু সিদ্ধান্ত তা নিজেই নিতে হবে। এবং সেটা যতক্ষণ না নিতে পারছে ততক্ষণ বেফাঁস কথা বলা বোকামি হবে। মেইন গেটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে অনিমেষ ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছিল। গতকাল ওই রেস্টুরেন্টে এমন কোন পরিচিত মুখ ছিল না যে সুবাসের সঙ্গে তার আলোচনা এদের জানাতে পারে। তাহলে জানল কি করে? সুবাস যদি দল থেকে বিতাড়িত হয় তাহলে নিশ্চয়ই এদের বলবে না। ব্যাপারটা রহস্যময় অথচ কোন সূত্র খুঁজে পেল না সে। অনিমেষ বুঝল, রাজনীতি করতে গেলে তাকে সতর্ক হয়ে পা ফেলতে হবে।

অনিমেষরা শ্লোগান দিচ্ছিল। এখন দু–একজন করে ছাত্রছাত্রী আসতে শুরু করেছে। য়ুনিয়নের যারা যারা সমর্থক তারা ওদের সঙ্গে মিশে যাওয়ায় দলটাকে ভারী দেখাচ্ছিল। যারা কোন দলে নেই তারা দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা বুঝতে চাইছিল। য়ুনিভার্সিটির সব কটা গেটেই এই ধরনের বিক্ষোভ চলছে। ফলে ওদের ডিঙ্গিয়ে কেউ ভেতরে ঢুকতে পারছে না। পাশের দেওয়ালে পোস্টার সঁটা হয়েছে, পুলিশের বর্বর নির্যাতনের প্রতিবাদের আজ ছাত্র ধর্মঘট। এ কথাটাই বিভিন্ন শ্লোগানের মাধ্যমে অনিমেষরা বলছিল। কলেজ স্ট্রীটে এখন অফিস টাইমের ভিড়। ট্রাম–বাস থেকে লোকজন মুখ বের করে দেখছে ওদের। শ্লোগান থামিয়ে একটু এগ বিমান বক্তৃতা দিয়ে গেল একটা টুলের ওপর দাঁড়িয়ে। জ্বালাময়ী ভাষণ এবং সমগ্র ছাত্র সমাজের অপমান হিসেবে সে ঘটনাকে ধিক্কার জানাল।

ক্রমশ কলেজ স্ট্রীটে ভিড় জমছে। ছেলেমেয়েরা ফুটপাত উপচে রাস্তায় নেমে ওদের দেখছে। ট্রাম বাসগুলো এক সময় দাঁড়িয়ে গেল ভিড়ের জন্যে। এতক্ষণ কেউ ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে নি। এমন কি কোন অধ্যাপক বা অফিসকর্মীকেও আসতে দ্যাখেনি অনিমেষ। ওর মনে হল, এই রকম ধর্মঘট ডাকা ছাত্রছাত্রীরা বেশ আনন্দিতই হয়েছে। মুফতে একটি ছুটি পাওয়া গেল, বেশ চুটিয়ে আড্ডা মারা যাবে–ছুটির মেজাজ এখন ওদের। কি জন্যে ধর্মঘট, কেন সেটা করা হচ্ছে এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর কোন দরকার কেউ বোধ করছে না। শ্লোগান উঠছে ঢেউ–এর মত, হঠাৎ শুনলে প্রতিটি শব্দ আলাদা করে কেউ বুঝতে পারবে না। অনিমেষের মনে হচ্ছিল, পুরো ব্যাপারটাই কেমন যেন সাজানো অথবা চাপানো, কারো মনের সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই। যেন একটা ফর্মুলাকে অনুসরণ করে যাওয়া, সেটা যে কখন বাসি অকেজো হয়ে গেছে তার খোঁজ কেউ রাখে না।

অনিমেষের খিদে পাচ্ছিল। হোস্টেলে ভাত ঢাকা আছে কিন্তু এখন যদি সে হাতিবাগানে গিয়ে খেয়ে আসতে চায় তাহলে সেটা দৃষ্টিকটু হবে। স্নান না করে সে একটা দিনও থাকতে পারে না, সে না হয় আজ না করল। পকেটে এমন পয়সা নেই যে চট করে রাখালদার ক্যান্টিন থেকে খেয়ে আসবে। দাদুর জন্যে আচমকা যে খরচ হয়ে গেল তা সামলে এই মাসের বাকী কটা দিন কেমন ভাবে চালাবে বুঝতে পারছিল না অনিমেষ । খিদের কথা মনে হতেই এই চিন্তাটা এল।

ঠিক এই সময় প্রেসিডেন্সি কলেজের দিকে শ্লোগান উঠল । চীনা দালাল নিপাত যাক। বেআইনি ধর্মঘট মানছি না, মানব না। গুন্ডাদের আন্দোলনে ছাত্ররা থাকছে না থাকবে না। একজন একটু এগিয়ে দেখে এসে বলল, বড় জোর কুড়িজন ওদের দলে। চিন্তার কিছু নেই।

ও পক্ষে শ্লোগান কানে আসা মাত্রই এ পক্ষের গলা উত্তাল হল। ওদিকের আওয়াজ যত এগিয়ে আসতে লাগল তত টেনসন বাড়ছে। ক্রমশ অনিমেষ ওদের দেখতে পেল। মুকুলেশ সামনে, শচীনও আছে। প্রত্যেকের হাতে বই খাতা, যেন ক্লাস করতে আসছে। দুপক্ষের চিৎকারে কান পাতা দায়, য়ুনিভার্সিটির কার্নিশে বসা একটা চিল ভয় পেয়ে ডানা ঝাপটে উড়ে গেল আচমকা ।

গেটের কাছাকাছি ওরা আসতে পারল না। অনিমেষরা অনেকখানি জায়গা দখল করে রেখেছে। মুকুলেশ নিজের দলকে চুপ করিয়ে ওদের দিকে মুখ করে গলা তুলে বলল, আমরা এই ধর্মঘট মানছি না। আমাদের ভেতরে যেতে দিন।

বোধ হয় এইরকম অনুরোধের জন্য এরা প্রস্তুত ছিল না। শ্লোগান থেমে গেল হঠাৎই, সবাই চুপচাপ, কেউ উত্তর দিল না।

মুকুলেশ আবার বলল, যারা ধর্মঘট করবেন তারা যাবেন না, কিন্তু সেটা সবার ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার অধিকার আপনাদের নেই।

বিমান বা সুদীপ এই গেটে নেই এখন। অনিমেষ চট কর টুলে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, এটা যুনিয়নের সিদ্ধান্ত, ছাত্রদের তা মানতে হবে।

মুকুলেশ বলল, য়ুনিয়নের নয়, আপনাদের পার্টির সিদ্ধান্ত, সেটা মানতে আমরা বাধ্য নই । আপনারা সরে যান, আমরা ভেতর ঢুকব।
 
ঠিক তখনই হইচই বেধে গেল। মুকুলেশের দলের দুটো স্বাস্থ্যবান ছেলে এদের সরিয়ে জোর করে ভেতরে ঢুকতে গেল। এরা তাদের থামাতে হাতাতাতি বেঁধে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই কলেজ স্ট্রীট যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়ে গেল। ছেলেমেয়েরা, যারা এতক্ষণ নাটক দেখছিল তারা উধ্বশ্বাসে পালাতে শুরু করল। দেখা গেল সেই দুটো ছেলে রীতিমত প্রহৃত হয়ে মির্জাপুরের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। মুকুলেশরা উধাও। একটি ছেলেও ঢুকতে পারেনি। সবকটা গেটই অনিমেষদের দখলে। ফুটপাতের দোকানদাররা মালপত্র নিয়ে পালাচ্ছে। পরিস্থিতি সামলে নিয়ে অনিমেষরা শ্লোগান দিচ্ছিল জোর গলায়। খবর পেয়ে বিমান সুদীপ ছুটে এসেছে। প্রচণ্ড উত্তেজনায় সবাই কাঁপছে। ঠিক সেইসময় গেটের মুখে বোমা পড়ল। মাটিতে পড়েই যে শব্দ হল তাতে হকচকিয়ে গেল এরা। ধোয়ায় চারধার ঢেকে যাচ্ছে। পর পর কয়েকটা। কলেজ স্কোয়ারের দিক থেকে বোমাগুলো আসছে। আত্মরক্ষার জন্যে সবাই গেট ছেড়ে ভেতরে ঢুকে এল।

বোমা ছোড়ামাত্রই অনিমেষের মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। সে দ্রুত পায়ে বাইরে বেরিয়ে এসে লক্ষ্য করতে লাগল কোন দিক থেকে বোমাগুলো আসছে। এখন কলেজ স্ট্রীট খাঁ-খাঁ করছে। ট্রামগুলো পিছু হটছে। পুলিশ ভ্যানের আওয়াজ পেল সে। অনিমেষদের মনে হল কেউ একজন কলেজ স্কোয়ারের গেটের আড়ালে লুকিয়ে আছে। ছেলেটাকে ধরার উদ্দেশ্যে অনিমেষ রাস্তা পার হতেই আরো কয়েকটা বোমা তার মাথা টপকে ওপাশের ফুটপাতে গিয়ে সশব্দে ফাটল। ছেলেটি তাকে কাছে আসতে দেখে গেটের আশ্রয় ছেড়ে প্রাণপণে ভেতরে দৌড়ে গেল। অনিমেষ পিছু ধাওয়া করতে চেয়ে বুঝতে পারল তার পক্ষে সম্ভব নয় ওকে ধরা, জেরে পা ফেললেই থাই টন টন করছে।

গেটের ও পাশে আবার শ্লোগান উঠছে। বিমান চিৎকার করে ওকে ফিরে আসতে বলল। ফুটপাত ছেড়ে সে যখন সবে রাস্তায় পা দিয়েছে ঠিক তখনই আচম্বিতে একটা কালো ভ্যান তার পাশে এসে ব্রেক করল। অনিমেষ কিছু বোঝার আগেই দু-তিনটে পুলিশ ওর দুহাত ধরে টানতে টানতে ভ্যানের পেছনে তুলে দিল। ঘটনাটার আকস্মিকতায় অনিমেষ এমন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল যে কোন কথা বলতে পারছিল না। সে শুনল সার্জেন্ট বলছে, আর কেউ আছে?

নেহি স্যার, সব অন্দর মে।

অয়্যারলেসে বলে দাও, একটা হুলিগান অ্যারেস্টেড।

তারপর যান্ত্রিক কিছু কথাবার্তার মধ্যে অনিমেষ চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করল, আপনারা আমাকে অ্যারেস্ট করছেন কেন? কী করেছি আমি? কেউ উত্তর দিল না। পুলিশভ্যানটা তেমনি স্থির হয়ে আছে অথচ অনিমেষের বেরুবার পথ বন্ধ।

এই সময় অনিমেষের কানে এল গেট থেকে নতুন শ্লোগান উঠছে, পুলিশ তুমি নিপাত যাও। কমরেড অনিমেষ লাল সেলাম লাল সেলাম।

সার্জেন্টটা নখ দিয়ে দাঁত খুঁটতে খুঁটতে বলল, সেলাম আবার লাল হয় কি করে মাশাই?

দাঁতে দাঁত চেপে অনিমেষ বলল, শালা!

পুলিশভ্যানটা সঙ্গে সঙ্গে চলতে শুরু করল।
 
জীবনে প্রথমবার থানায় এল অনিমেষ। কলেজ স্ট্রীট ছাড়ার পর থেকেই ও চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল । ভ্যানের ভেতর গোটা ছয়েক কনস্টেবল এবং একজন সার্জেন্ট। তারাও ওকে তেমন পাত্তা দেয় নি, কারণ এতক্ষণ নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা সীমাবদ্ধ রেখেছিল। ভ্যানের জানলা দিয়ে অনিমেষ রাস্তায় নজর রেখেছিল। প্রতিদিনের কলকাতা স্বাভাবিক গতিতেই চলছে। দোকানপাট খোলা, লোকেরা হাঁটাচলা করছে। এই এক দৃশ্য অনিমেষ রোজ পথ চলতে দেখেছে কিন্তু আজ এই ভ্যানের তাব-ঘেরা ছোট্ট জানলা দিয়ে দেখতে ভীষণ ভাল লাগছিল। ক্ষুদ্র দিয়ে বিশালকে আঁকড়ে ধরার মধ্যে এক বেদনা-জড়ানো আনন্দ আছে। কিন্তু এতক্ষণ অনিমেষের মনে কোনরকম আতঙ্ক সৃষ্টি হয় নি । সে যে বন্দী এবং কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে তাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ও সেখানে তার ভাগ্য নির্ধারিত হতে পারে এসব চিন্তা তার মাথায় আসেনি। সে জানে ওরা অযথা তাকে ধরেছে। কোন অন্যায় যখন সে করেনি তখন ভুল বুঝতে পারলেই তাকে ছেড়ে দিতে হবে।

কিন্তু বিমানদের ব্যাপারটা নিয়েই ও বেশি চিন্তিত ছিল। তাকে ভ্যানে ভোলা মাত্রই অতগুলো ছাত্র একসঙ্গে শ্লোগান দিয়ে উঠল তার নাম ধরে। বুকভরা আন্তরিকতা না থাকলে অমন স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া হয়? বিমান এর আগে যে কথাগুলো বলেছে সেটা ভাল করে ভেবে দেখা দরকার । ভুলভ্রান্তি প্রতি দলের থাকে। কাজ করতে গেলে তা হওয়া স্বাভাবিক। সি পি আই সম্পর্কে তার কোনরকম মোহ নেই। কম্যুনিজমের প্রতি যে আকর্ষণ সে বোধ করে তার জন্যে বিমানদের সঙ্গেই কাজ করা উচিত। সুবাসদা যে কথাটা বলেছিল তাও হয়তো মিথ্যে নয়। দলের নেতৃত্ব কোন নতুন পথ দেখাতে পারছে না, দীর্ঘকাল নেতারা একই চেয়ারে বসে আছে, কোন সুনির্দিষ্ট কর্মপদ্ধতি ক্যাডারদের সামনে নেই। কিন্তু তবু যত অল্পই হোক কম্যুনিজমের প্রতিষ্ঠার জন্যে যে জঙ্গী মনোভাব দরকার তা বিমানদেরই আছে। একক বা বিচ্ছিন্ন হয়ে যে কাজ দুঃসাধ্য হবে, আদৌ সম্ভব হবে না, তা ওদের সঙ্গে থাকলেই হতে পারে। মতবিরোধ ঘটতেই পারে কিন্তু বৃহত্তর স্বার্থের জন্যে মানিয়ে চলা নীতি অনুসরণ করা উচিত।

সার্জেন্টের পেছন পেছন ঘরে ঢুকতেই একজন অফিসার ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, কী ব্যাপার?

কলেজ স্ট্রীট থেকে তুলে আনলাম।

কী অবস্থা?

একদল ঢুকবে অন্যদল ঢুকতে দেবে না।

সিরিয়াস কিছু?

নাঃ, দু-একটা ছুটকো বোমা ফেটেছে, ব্যাস।

তাহলে খামোকা একে আনতে গেলে কেন? ফরনাথিং ট্রাবল ইনভাইট করা। এখনি হয়তো ফোন আসবে সুড়সুড় করে ছেড়ে দিতে হবে। স্টুডেন্টস প্রব্লেম খুব ডেলিকেট ব্যাপার এটা তোমাকে বোঝাতে পারলুম না আজও। খুব বিরক্তির গলায় কথা বলছিলেন ভদ্রলোক। অনিমেষ দেখল ভদ্রলোকের মুখটা মোটেই পুলিশের মত নয়। মাথায় টাক থাকায় অনেকটা বিদ্যাসাগরের মত দেখাচ্ছে। পরনেও পুলিশী পোশাক নেই।

সার্জেন্ট বলল, একদম খালি হাতে ফিরে আসব?

অফিসার এর উত্তর না দিয়ে এমন একটা ভঙ্গি করলেন যে অনিমেষের হাসি পেয়ে গেল। সার্জেন্ট সেটা দেখে চিৎকার করে ধমকে উঠল তাকে।

অনিমেষ বলল, খামোকা চেঁচাচ্ছেন কেন?

ইউ শাট আপ। এমন মার মারব জন্মর জন্যে বোম ছোঁড়া বেরিয়ে যাবে। সার্জেন্ট একটা চেয়ার টেনে ধপ করে বসে ওর দিকে মুখ খেঁচালো।

বোমা? কে বোমা ছুঁড়ছে অফিসার চটপট জিজ্ঞাসা করলেন।

এই শ্ৰীমান স্যার। অল্পের জন্য ভ্যানে লাগেনি।

আই সি! চেহারা দেখে তো সুবোধ মনে হচ্ছিল। পুলিশ ভ্যানে বোমা মারার জন্যে কপালে কি জুটবে তা জানা আছে?

আমি বোম ছুঁড়িনি। উনি মিথ্যে কথা বলছেন! অনিমেষ বলল।

মিথ্যে কথা বলছি? দূর থেকে দেখলাম য়ুনিভার্সিটির গেটে বোম পড়ল। রাস্তা ফাঁকা। কাছাকাছি আসতেই দেখলাম তুমি ফুটপাত থেকে নেমে আসছ। এসব মিথ্যে কথা? ধমকানির সুরটা সার্জেন্টের গলা থেকে যাচ্ছিল না।

অফিসার ভদ্রলোকের মুখের চেহারা ততক্ষণে বদলে গেছে ।

অনিমেষ বলল, আমি বোম ছু৬ড়িনি, যে ছুঁড়েছিল তাকে ধরতে গিয়েছিলাম। কথাটা শেষ হতেই এক লাফে সার্জেন্ট ওর সামনে এসে দাঁড়াল। অনিমেষ কিছু বোঝার আগেই লোকটার দুটো হাত ওর সর্বাঙ্গে ঘোরাফেরা করতে লাগল । পকেট থেকে আরম্ভ করে কোমর কিছুই বাদ গেল না।

লোকটা হতাশ হয়ে আবার চেয়ারে ফিরে গেলে তারপর কয়েক সেকেন্ড চোখ কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বলল, স্যার, একে দুনম্বর দেওয়া দরকার। মিস্টিরিয়াস কেস। খালি হাতে বোমবাজকে ধরতে যাওয়ার গল্প শোনাচ্ছে! দাওয়াই না দিলে সত্যি কথা বলবে না।

তুমি খালি হাতে গিয়েছিলে? যদি বোম ছুঁড়তো তাহলে? অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন।

আমি অতটা ভাবিনি। তাছাড়া দেখামাত্র লোকটা পালিয়ে গেল। অনিমেষ সত্যি কথাটাই বলল।

লোকটা? কোন লোক? তুমি চেন?

কি আশ্চর্য! আমি চিনবো কেমন করে? ওকে কখনোই দেখিনি আমি।

কোন পার্টির লোক?

তা জানি না।

বোম ছুঁড়ছিল বলছিলেন, কাঁদের দিকে বোমগুলো ছুঁড়ছিল?

আমরা যারা গেটে ছিলাম তাদের দিকে।

তোমরা মানে যারা বন্ধ ডেকেছিলে?

হ্যাঁ।

তার মানে লোকটা তোমাদের এ্যান্টি পার্টি এই তো? অর্থাৎ ছাত্র পরিষদ করে নিশ্চয়ই, কি বল?

অনিমেষ টের পাচ্ছিল অফিসার তাকে কথার জালে ঘিরে ধরে কোন কিছু তার মুখ দিয়ে বলিয়ে নিতে চাইছে। সে সতর্ক হল, আমি গেটে দাঁড়িয়ে এসব কিছুই বলছি না। একটা লোক বোম্বিং করছিল এবং সে চাইছিল না আমরা গেটে দাঁড়িয়ে স্ট্রাইক কন্ডাক্ট করি। কিন্তু সে কোন দলের লোক তা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়, কারণ তাকে আমি চিনি না।
 
হঠাৎ অফিসার একসিট সাদা কাগজ আর কলম এগিয়ে দিয়ে বললেন, আজকে যা যা ঘটেছে তা এখানে লিখে নাম সই করে ঠিকানাটা দিয়ে দিন। আমি একটা রেকর্ড রাখতে চাই।

একমুহূর্ত ভেবে অনিমেষ কাগজটা টেনে নিল। সে যদি না লেখে তাহলে এরা কিছু করতে পারে । এই ঘরে ঢোকার আগে একটা খাঁচার ঘর সে দেখেছে। কয়েকটা অপরাধী মার্কা চেহারা সেই খাঁচাটায় শুয়ে বসে আছে। ওটাকে বোধহয় লক-আপ বলে। থানায় ধরে নিয়ে এলে ল–আপে রাখা হয়। পুলিশের লক-আপ সম্পর্কে নানান গল্প শুনেছে অনিমেষ। আজ কিরকম অভিজ্ঞতা হয় কে জানে! না লেখার পেছনে কোন অজুহাত খুঁজে পেল না সে। যা সত্যি কথা তা লিখতে দোষ কি?

এখনও কেউ তাকে চেয়ারে বসতে বলেনি। শব্দ করে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে কাগজটার ওপর ঝুঁকে পড়ল। সার্জেন্ট বলছিল, আমার মন বলছে এ বোম্বিং-এ ইভলন্ড। একটু ধোলাই দিলে।

লেট হিম রাইট।

লেখা শেষ করে অফিসারের দিকে কাগজটা এগিয়ে দিল অনিমেষ। সেটা হাতে নিয়ে অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, অনিমেষ মিত্র?

হ্যাঁ।

হোস্টেলে থাকা হয়?

হ্যাঁ।

সার্জেন্ট সোজা হয়ে বলল, কোন হোস্টেল? হোস্টেলগুলো স্যার ক্রিমিন্যালদের আড্ডা।

স্কটিশচার্চ।

বাড়ি কোথায়? অফিসার কাগজটা থেকে চোখ সরাচ্ছিলেন না।

জলপাইগুড়িতে।

এর আগে কখনো এ্যারেস্টেড হয়েছেন?

না।

এনি পুলিশ এনকোয়ারী?

হঠাৎ বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। পুলিশের খাতায় নিশ্চয়ই তার নাম আছে। হাসপাতালে যে পুলিশ অফিসারটি তাকে জেরা করতে গিয়েছিল তিনি নিশ্চয়ই তা রেকর্ড করে রেখেছেন। কথাটা এখন বললে আর দেখতে হবে না। সার্জেন্টটা ওকে বোমবাজ প্রমাণ করার জন্যে তো মুখিয়ে আছে। তার পায়ে বুলেট লেগেছিল জানলে রক্ষে রাখবে না। সেবার নীলার বাবার দৌলতে। ও ঘাড় নাড়ল, না।

এতক্ষণ ভাবতে হল কেন? প্রশ্নটা সার্জেন্টের ।

প্রশ্নটার উত্তর দিল না অনিমেষ। অনেক অপ্রিয় কথা চুপ করে থাকলে এড়ানো যায়। সার্জেন্ট বলল, আমি সিওর স্যার–

অফিসার বললেন, ছেড়ে দাও এসব কথা। অনিমেষবাবু, আমি চাই না ফরনাথিং কেউ হ্যারাসড হোক। আপনার স্টেটমেন্ট আমাদের কাছে থাকল। কিন্তু এর পর যদি কখনো আপনার সামান্য অভিযোগ পাই তাহলে ভীষণ বিপদে পড়বেন। মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে নিশ্চয়ই। কলকাতায় পড়াশুনো করতে এসেছেন তাই মন দিয়ে করুণ। যুনিয়নবাজী করে নিজের বারোটা বাজাচ্ছেন কেন?

অনিমেষ হাসল, উপদেশের জন্য ধন্যবাদ। তবে প্রত্যেকের বোমার ধরন-ধারণ আলাদা এটা মনে রাখাই ভাল।

কথাটা শেষ হওয়া মাত্রই অফিসারের মুখটা বুলডগের মত হয়ে গেল, গেট আউট, গেট আউট।

অনিমেষ সুযোগ নষ্ট করল না। দ্রুত পায়ে থানা থেকে বেরিয়ে এল। ওর ভয় হচ্ছিল যে কোন মুহূর্তেই অফিসার তার ভুল বুঝতে পেরে ওকে আটকাতে নির্দেশ দেবেন। এত সহজে নিষ্কৃতি পাওয়ার কথা ভাবা যায়?

রাস্তায় নেমে অনিমেষের অস্বস্তি শুরু হল । যে রকম সমারোহ করে তাকে নিয়ে আসা হল এভাবে কিছু না ঘটেই ছাড়া পাওয়া তার সঙ্গে ঠিক মানাচ্ছে না।

ব্যাপারটা যে সত্য বেমানান তা কয়েক মুহূর্ত বাদেই ভাল করে বোঝা গেল। য়ুনিভার্সিটির পথে কিছুটা এগিয়ে যেতেই ওদের দেখতে পেল অনিমেষ। জনা কুড়ি ছেলে শ্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে আসছে। ওদের সামনে সুদীপ, মুখখানা খুব গম্ভীর। ফুটপাথ দিয়ে আসছিল বলেই ওরা অনিমেষকে প্রথমে লক্ষ্য করেনি। অনিমেষ অনুমানই করতে পারেনি ছাত্রমিছিলটা ওরই উদ্দেশ্যে থানার দিকে এগোচ্ছে। শ্লোগানে নিজের নাম শুনতে পেয়ে চমকে গেল ও। তার জন্যে দল এত চিন্তা করছে নিজেকে ভীষণ মূল্যবান বলে মনে হল ওর। ফুটপাথ ছেড়ে সে ওদের সামনে এসে দাঁড়াল।
 
ভূত দেখার মত চমকে উঠল সবাই। অনিমেষকে কেউ এখানে আশা করেনি। সুদীপ অত্যন্ত বিস্মতের গলায় জিজ্ঞাসা করল, কি হল?

অনিমেষের হঠাৎই মনে হল সে যেন একটা অন্যায় করে ফেলেছে। এবং এই অন্যায়টি মোটেই ছোট মাপের নয়। সে নীচু গলায় বলল, ছেড়ে দিয়েছে।

তা তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু ছাড়ল কেন? সুদীপের গলায় অসহিষ্ণু ভাব।

ওরা ভেবেছিল আমি বোমা ছুঁড়েছি তাই ধরেছিল। কিন্তু ও. সি. বোধহয় বুঝতে পেরেছেন এটা ঠিক নয় কিংবা প্রমাণ করা যাবে না, তাই।

অসম্ভব। পুলিশ রাতারাতি চৈতন্যদেব হয়ে যায়নি। ভুল বুঝতে পারলেও ওরা দুদিন লক-আপে রেখে দেয়। মিস্টিরিয়াস ব্যাপার।

অনিমেষ অনুভব করল ওই এই বেরিয়ে আসায় সুদীপ আশাহত। ধারণাটার সমর্থন মিলল আর একটি কথায়। সুদীপের পাশে দাঁড়ানো একটি ছেলে বলে উঠল, এখন কি হবে সুদীপদা! ওকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে আমরা যে কালকেও ধর্মঘট ডেকেছি। এখন তো তার কোন মূল্য থাকবে না।

সুদীপ বলল, দ্যাটস দি পয়েন্ট। তোমার রিলিজের ব্যাপারের মধ্যে কিছু একটা আছে। যাক সেকথা। এখন হয় তোমাকে দুদিন কোথায় লুকিয়ে থাকতে হবে–না, না। সেটা আর সম্ভব নয়। নিজেই কথাটা ঘুরিয়ে নিল সে এতগুলো ছেলে যখন তোমাকে দেখতে পেয়েছে তখন খবর চাপা থাকবে না।

সঙ্গের ছেলেটি বলল, সুদীপদা, আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। আমরা অনিমেষকে সঙ্গে নিয়ে য়ুনিভার্সিটিতে ফিরে যাই। যেন থানায় বিক্ষোভ করে ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছি।

সুদীপ বলল, গুড । ইটস এ গুড প্রপোজাল। তাই কর। তারপর চাপা গলায় অনিমেষকে বলল, ইউ আর বিকামিং এ হিরো আউট অফ নাথিং।

অনিমেষকে কিছুই করতে হল না । মিছিলটা প্রচণ্ড উন্মাদনা নিয়ে ফিরে এল বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনিমেষকে চুপ করে থাকতে হল কিন্তু সেটাই তার কাছে খুব কষ্টকর হয়েছিল। ছোট্ট একটা জনসভায় সুদীপ আগামীকালের প্রস্তাবিত ধর্মঘট তুলে নেওয়ার কথা ঘোষণা করল। কিন্তু ব্যাপারটা খুব জোরালো এবং আন্তরিকতাপূর্ণ হচ্ছে না। এটা অনিমেষ স্পষ্ট অনুভব করছিল।

বিমানকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলল অনিমেষ। পুলিশ ওকে দিয়ে স্টেটমেন্ট লিখিয়ে নিয়েছে কিন্তু গায়ে হাত দেয়নি।

বিমান শুনে বলল, নিজের হাতে লিখে না দিলেই পারতে। এটাকে ওরা মুচলেকা বলে প্রচার করলে আমাদের ক্ষতি হতে পারে। তাছাড়া তোমার ওইভাবে রাস্তা পেরিয়ে ধাওয়া করতে যাওয়া উচিত হয়নি। বোমাটা তোমার শরীরে সোজাসুজি এসে পড়তে পারত। হঠকারিতা থেকে কোন সুফল পাওয়া যায় না। কম্যুনিজমের সার্থকতা ব্যক্তিগত কৃতিত্বে নয়, সামগ্রিক দলবদ্ধ উন্নয়নে। যাক আজ আমরা জিতেছি। একটি ছেলেও ক্লাস করতে ঢোকেনি।

অনিমেষ বলল, পুলিশের হাত থেকে এত সহজে নিষ্কৃতি পাওয়ার কোন কারণ নেই কিন্তু। মানে সুদীপের কথা শুনে মনে হচ্ছিল ও ঠিক বিশ্বাস করছে না ব্যাপারটা। অথচ আমি কিছুই জানি না।

বিমান হাসলো, হয়। এ রকম পরিস্থিতি হয়েই থাকে। যাক তুমি কিন্তু অনেকদিন পার্টি অফিসে যাওনি, আজ যাবে?

অনিমেষ এতক্ষণে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। সারাদিন স্নান খাওয়া নেই, তার ওপর এ রকম একটা টেনশন গেল, এখন খুব কাহিল লাগছিল। বিমান সেটা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বোধ হয় অনুমান করল, না, ঠিক আছে। তুমি হোস্টেলে ফিরে যাও। খাওয়া দাওয়া করে রেস্ট নাও। আগামীকাল আমার সঙ্গে যেও। জরুরী কাজের দায়িত্ব নিতে হবে।

কী কাজ? অনিমেষ কৌতূহলী হল।
 
নির্বাচন আসছে। বাই ইলেকশন। তোমাকে প্রচারে নামতে হবে। হাতে কলমে অন্তত পনের দিন কাজ কর। থিওরি আর প্রাকটিক্যালের মধ্যে কিভাবে ব্রিজ তৈরি করতে হয় শেখো। আচ্ছা, এসো।

অনিমেষ বেরিয়ে আসছে এমন সময় বিমানের কণ্ঠ ওকে থামালো, অনিমেষ সুবাসদের সম্পর্কে সতর্ক থেকে। যারা পথভ্রষ্ট তারা কখনোই এগোতে পারে না। ওকে?

এতক্ষণ বেশ চলছিল। হঠাৎ একদম আকাশ থেকে পেড়ে আনার মত যাওয়ার সময় সুবাসদার প্রসঙ্গ টেনে আনল বিমান। সমস্ত উদ্দীপনা নির্বাচনে কাজ করবে বলে যা অনিমেষকে আপ্লুত করেছিল সুবাসদার প্রসঙ্গ তুলতেই কেমন মিইয়ে যেতে আরম্ভ করল। বিমান কি সুপরিকল্পিতভাবে এই সময় সুবাসের নাম করে তাকে সতর্ক করে দিল?

অনিমেষ অনুভব করল, অবিশ্বাস এমন একটা জিনিস যা একবার কোথাও প্রবেশ করলে লক্ষ বার চুনকামেও দূর হয় না। কিন্তু তবু অনিমেষ নিজেকে প্রফুল্ল রাখতে চাইল। এতদিন পরে সে হাতে কলমে কম্যুনিজমের পক্ষে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে। আগামী মাসে পশ্চিম বাংলার দুজায়গায় উপনির্বাচন হতে যাচ্ছে। তাকে কোথায় পাঠানো হচ্ছে? অনিমেষ যেন এখনই অধের্য হয়ে পড়েছিল।

ট্রাম রাস্তায় পা দিতেই সে নিজের নাম শুনতে পেল। চিৎকার করে যে তাকে ডাকছে সে রাস্তার ওপারে । বেশ কিছুদিন পরমহংসকে দেখতে পায়নি অনিমেষ। এখন ওকে সামনে দেখে ভাল লাগছে । অমন খাটো শরীরেও কি উজ্জ্বল মুখ। কাছাকাছি হতেই পরমহংস জিজ্ঞাসা করল, বিপ্লব হল?

বলার ধরনে এমন একটা স্নেহমিশ্রিত শাসন আছে যা না হেসে পারল না অনিমেষ কোথায় আর হলো?

পরমহংস খপ করে ওর হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে পানের দোকানের সামেন আনল। তারপর গম্ভীর গলায় বলল, নিজের বদন চেয়ে দ্যাখো একটু। অনিমেষ দেখল দোকানের আয়নায় তার ছায়া পড়েছে । নিজের এ রকম বিধ্বস্ত চেহারা সে কখনো দেখেনি। এমন কি জলপাইগুড়ি থেকে ট্রেনজার্নি কর এসেও নয়। মাথার চুলগুলো নেতিয়ে পড়েছে, মুখ ময়লায় কালো, চোখের তলায় যেন কালি লেপে দিয়েছে। পরমহংসের গলা পেল সে, একদিনেই যদি এই হাল হয় তবে দেশে বিপ্লব করবেন উনি! ননীর পুতুল।

কুচকুচে কালো কচি দাড়িতে হাত বুলাতে বুলোতে অনিমেষ বলল, আচ্ছা বেশ।

পরমহংস বলল, আছি কোথায়? চিরজীবন হয় হাতল নয় পোস্ট অফিস হয়েই কাটালাম। তোমার মত মেয়ে-কপালে হয়ে জমানোর ভাগ্য চাই।

হাতল মানে?

চেয়ারে থাকে। না থাকলেও ক্ষতি নেই। থাকে একস্ট্রা আরামের জন্যে । যাক পুলিশ প্যাদায়নি তো?

না। হেসে ফেলল অনিমেষ ।

যাচ্চলে! হিরো হয়ে যেতে পারতে প্যাদালে । যে দুটো কারণে তোমার জন্য এখানে দাঁড়িয়েছিলাম–টিউশানি করার ইচ্ছে আছে?

আছে। কিন্তু আপাতত সময় পাব না। পার্টির কাজে বাইরে যেতে হবে।

বাঁচা গেল। পড়াশুনার ইতি হয়ে গেল তো?

তা কেন? অসুখ বিসুখের জন্যেও তো অনেকে কামাই করে।

ভাল। আমি এখন কাটছি। প্রয়োজন হলে খবর দিও।

কোথায় যাচ্ছ?

ফোকটে ছুটি পাওয়া গেল, পিচ ছেড়ে দু-একটা স্ট্রোক করে আসি। টিউশানি সেরে আসি। পরমহংস চলে যেতে যেতে আবার ঘুরে এল। রসগোল্লার মত মুখ করে বলল, দ্বিতীয় কথাটাই বলা হয়নি তোমাকে।

কী কথা?

ডান দিকের এই দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে সামান্য এগিয়ে সোজা দোতলায় চলে যাও। কুইক। কথাটা শেষ করে হন হন করে চলে গেল পরমহংস।

ধাঁধার মত লাগল কথাগুলো। অনিমেষ নির্দেশ মেনে বসন্ত কেবিনের দরজায় আসতেই নাকে খাবারের গন্ধ টের পেল। এতক্ষণ যা হয়নি এই মুহূর্তে প্রচণ্ড ক্ষুধার অস্তিত্ব টের পেল ও। ভেতরে ঢুকে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে আসতেই ওর মনে হয় শরীরের সব রক্ত ঢেউ হয়ে যাচ্ছে। কোনক্রমে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল অনিমেষ।
 
দোতলার হলের একটা কোণার টেবিলে মাধবীলতার সামনে যে মেয়েটি বসেছিল অনিমেষকে দেখতে পেয়েই সে উঠে দাঁড়াল, যাই ভাই। মাধবীলতা ঘাড় নাড়তেই মেয়েটি আড়চোখে অনিমেষকে একবার দেখে পাশ দিয়ে নেমে গেল।

রেস্টুরেন্টে আরো অনেকে আছে। আলটপকা ছুটি পাওয়ায় ছেলেমেয়েরা আড্ডা মারছে টেবিলে টেবিলে। এদের মধ্যে দু-একজোড়া এখনই বেশ প্রসিদ্ধ। ওরাও অনিমেষকে দেখছিল। খুব শান্ত ভঙ্গিতে সে মাধবীলতার সামনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, বসতে পারি। ছোট্ট একটা ভাঁজ ঠোঁটে পড়ল কি পড়ল না, কিন্তু চোখ দুটো অনেক কথা বলে ফেলল। মাধবীলতা ঘাড় নাড়ল সম্মতির।

অনিমেষ ঠিক উলটো দিকে আরাম করে বসে টেবিল থেকে একটা নিটোল জলের গ্লাস তুলে পুরোটা খেয়ে নিল।

মাধবীলতা তাকে দেখছে। এতক্ষণে সে একবারও চোখ সরায়নি। অস্বস্তি হচ্ছিল অনিমেষের বলল, কেমন আছেন?

চমৎকার। কথা বলল মাধবীলতা। শব্দের উচ্চারণে অনিমেষের মনে হল কথাটার মানে খুব খারাপ আছি, খুব।

এখানে কখন এসেছেন?

এসেছি।

কথাটা যেন একটা পেরেক ঠোকার মত, নিশ্চিত কিন্তু অবহেলায়। অনিমেষ মাধবীলতার মুখের দিকে তাকাতে পারছিল না। এই দুইদিন মেয়েটির কথা সক্রিয়ভাবে চিন্তা করেনি কিন্তু তার প্রতিটি মুহূর্তে মাধবীলতা জড়িয়েছিল সে টের পায়নি। বুকের মধ্যে রিমরিম শব্দ, চোখ খুললেই নিজেকে সম্রাট মনে হয়।

মাধবীলতা বলল, দুদিন কী হয়েছিল?

অনিমেষ কথা বলতে পেরে বেঁচে গেল। বলল, হঠাৎ আমার ঠাকুর্দা এসেছিলেন, আর তিনি খুব অসুস্থ ছিলেন বলে বেরোতে পারিনি। হোস্টেলে একা ওরকম মানুষকে রেখেও আসা যায় না। অথচ একটু ভাল বোধ করতেই আর থাকলেন না। আজই ফিরে গেলেন।

সেকি। তাহলে এলেন কেন?

আমাকে দেখতে। আমি ওর কাছে মানুষ হয়েছিলাম। সে অনেক কথা।

আমি শুনতে চাই।

কেন?

আমার মনে হচ্ছে শোনা দরকার।

কি কথা?

বেশ। তবে আজ থাক অন্যদিন।

আজই তো বলছি না। সময় হলে বলবেন।

অনিমেষ একটু চুপ করে থেকে বলল, আজ সব অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল।

মাধবলীতা বলল, আমি জানি।

আপনি কখন এসেছেন এখানে?

যেমন রোজ ক্লাস করতে আসি।

তাহলে আমাকে যখন ভ্যানে ভোলা হল তখন দেখেছেন?

দেখেছি।

ও।

কিন্তু আমি জানতুম আপনি ফিরে আসবেন।

মানে? অনিমেষ চমকে উঠল। সুদীপের প্রকাশ্য সন্দেহটা কি মাধবীলতার মনেও সঞ্চারিত হয়েছে।

আমি প্রার্থনা করেছিলাম তাই জানতাম।

হেসে ফেলল অনিমেষ, তাই বলুন কিন্তু কোন কিছু প্রার্থনা করলেই যদি পূর্ণ হতো তাহলে পৃথিবীতে কোন কষ্ট থাকতো না।

তা ঠিক। কিন্তু আমি যখন ভীষণভাবে কিছু চাইব তখন সেটা বিফল হবে না। কারণ আমি নিজের জন্যে কিছু চাইনি কখনো এবং এই প্রথম কিছু চাইলাম। হয়তো চাওয়া শুরু হলো।


বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল অনিমেষ। ওর কষ্ট এখন পরম পাওয়ায় নতজানু, আমি কিন্তু ভরসা করতে শিখলাম।

মাধবীলতা হাসল, আমরা কিন্তু কেউ কাউকে জানি না।

জেনে নেব।

জানার পর যদি আফসোস হয়!

আফসোস নয়, ভয় হতে পারে।

ভয়। ভয় কেন?

নিজের যোগ্যতা যদি না থাকে তাহলে

যোগ্যতা সেদিনই হারাবেন যেদিন অবহেলা করতে শিখবেন। চেহারা এমন হয়েছে কেন? আজ স্নান হয়নি?

সময় পেলাম কোথায়?

সেকি। খাননি?

ভেবেছিলাম হোস্টেলে ফিরে খাবো। হলো না।

মাধবীলতা সোজা হয়ে বসে বয়কে হাত নেড়ে ডাকল। অনিমেষ তাই দেখে আপত্তি জানাল, আরে করছেন কি–।

আপনি খাবেন তাই ব্যবস্থা করছি।

কিন্তু আমার কাছে পয়সা নেই।

এত দ্রুত মেঘ কখনো আসে না আকাশে, দুটো চোখে সমস্ত শরীর যেন জল ছুঁড়ে দিল। মাধবীলতার মুখ পলকেই লাল, ঠোঁট থরথর করছে। অনিমেষ কথাটা সহজ গলায় বলেছিল, বলেই বুঝতে পেরেছিল কি হয়ে গেল ব্যাপারটা। সে মাথা নীচু করে বলল, আমি বুঝতে পারিনি।

ভরসার কথা বলছিলেন না?

ক্ষমা চাইছি।

আপনার কোন দোষ নেই। দিতে পারার মধ্যে একটা অহংকার আছে তাই অনেকেই তা পারে। কিন্তু নিতে জানতে হয়। সেটা বড় কঠিন।

লতা–!

মাধবীলতা হাসল। চোখের কোণে মুক্তো অথচ মুখে শরতের প্রথম সকাল। নিচের ঠোঁট দাঁতে চেপে একটু দেখল অনিমেষকে, তারপর বলল, মনে আছে তাহলে। লতা বড় জড়িয়ে ধরে, বিরক্তি আসবে না তো কখনো?

অনিমেষ উত্তরটা দিতে গিয়ে দেখল বয় সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

মাধবীলতা চোখের জল মোছার চেষ্টা করল না। শান্ত গলায় বলল, পেট ভরে যায় এমন খাবার কী আছে তোমাদের?

ছেলেটি চটপট জবাব দিল, কষামাংষ আর মোগলাই পরোটা।

মাধবীলতা বলল, খুব তাড়াতাড়ি আনো। এক জায়গায়। আমাকে শুধু এক কাপ চা দাও।

সেটা শুনে আপত্তি করতে যাচ্ছিল অনিমেষ, হাত প্রসারিত করে মাধবীলতা বলল, একদম লজ্জা করতে হবে না।
 
সরিৎশেখরের চিঠি এল। ট্রেনে কোন অসুবিধে হয়েছিল কিনা সে বিষয়ে কিছু লেখেননি। তবে এখনও শরীর সুস্থ হয়নি। বাড়িতে তিনি এবং হেমলতা ছাড়া তৃতীয় কোন প্রাণী না থাকায় সাংসারিক কাজকর্ম তাকেই ওই শরীর নিয়ে করতে হচ্ছে। এখন যাওয়ার জন্য তিনি তৈরি, নিজের শ্রাদ্ধ করে এসে এক অদ্ভুত আনন্দের মধ্যে ডুবে আছেন। তবে তার একটাই আশংকা এবং সেটা হেমলতাকে নিয়ে। তার যাওয়ার আগে যদি হেমলতা যেতেন তাহলে নিশ্চিত হতে পারতেন সরিৎশেখর। এসব লেখার পর তিনি জানতে চেয়েছেন অনিমেষ পূজোর ছুটিতে জলপাইগুড়িতে আসছে কিনা। এবং সরিৎশেখর কলকাতায় তার কাছে থাকার দরুণ যে টাকা খরচ হয়েছে তার অংকটা জানালে তিনি সেটা ফেরত পাঠাবার ব্যবস্থা করবেন।

চিঠিটা পড়ে অনিমেষ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল। হাতে লেখা এক না হলে এটাকে দাদুর চিঠি হিসেবে মেনে নেওয়া শক্ত হত। দাদুর চিঠি মানেই কিছুটা উপদেশ এবং সেই সঙ্গে কড়া সমালোচনা। অথচ এই চিঠির ভাষার মধ্যে কেমন যেন শীতলতা ছড়ানো। স্বৰ্গছেঁড়া থেকে বাবার চিঠি আজকাল নিয়মিত আসে না। মাসের প্রথমে যে মানি অর্ডার পাঠান তার তলায় যেটুকু জায়গা তাই এখন বরাদ্দ। সরিৎশেখর চলে যাওয়ার পর তমালের মুখে জানতে পেরেছিল অনিমেষ, তিনি অনেক কিছু জেনে গেছেন। সেদিন সে যখন সন্ধ্যেবেলায় ডাক্তারের চেম্বারে গিয়েছিল তখনই তিনি তমালদের খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে অনিমেষের রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে অবহিত হয়েছিলেন কিন্তু চিঠিতে সেসবের কোন উল্লেখ নেই। শুধু এই প্রথমবার তিনি জানতে চেয়েছেন অনিমেষ ছুটিতে জলপাইগুড়িতে যাবে কিনা?

অনিমেষ অনুভব করছিল বাড়ির সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে সেটা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। না এই ছুটিতে সে বাড়িতে গিয়ে বসে থাকতে পারবে না। বিমানের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে। পার্টি অফিতে গিয়ে দিন টিন ফাইনাল করে এসেছে। আগামী উপনির্বাচনে দলের প্রার্থীর হয়ে প্রচারের জন্য দল কলকাতা থেকে যাচ্ছে তাকেও সেই সঙ্গে যেতে হবে। ছুটিটা পড়ছে বলে তার ক্লাস কামাই হবে না। অনিমেষ ঠিক করল, এসব কথা সরিৎশেখরকে খোলাখুলিই লিখে দেবে। ওদের উপনির্বাচনের জায়গাটা জলপাইগুড়ি থেকে খুব দূরে যদিও নয় তবু সে সময় পাবে কিনা আগে থেকে বলা যাচ্ছে না। কথাগুলো মাধবীলতাকে জানালো অনিমেষ। আজকাল কোন কিছু ওকে না বললে স্বস্তি পায় না সে। এখন প্রতিটিদিন শুরু হয় বুক জোড়া এক ধরনের চাপ নিয়ে। সে চাপ বুক থেকে সরে না যতক্ষণ মাধবীলতাকে সে না দেখছে। একটু একটু করে মাধবীলতা তার রক্তে মিশে যাচ্ছে। এখন ওদের দেখা কিংবা কথা হয় লাইব্রেরী, বসন্ত কেবিন, কিংবা কফি হাউসের তেতলায়। শেষের জায়গাটাই ওদের প্রিয়, কারণ দীর্ঘসময় এককাপ কফি নিয়ে বসে থাকা যায় এবং চার পাশে এত কথার বিড় যে স্বচ্ছন্দে নিজেদের কথা বলা যায়।

মাধবীলতাকে সে তার সব কথা বলেছে। মা যে রাতে মারা গেলেন সেই বর্ণনা শোনার সময় মাধবীলতা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিল। ছোটমার কথা শুনে অবাক হয়েছিল খুব। অনিমেষ তাঁর সঙ্গে কোন যোগাযোগ রাখে না জেনে অনুযোগ করেছিল। বলেছিল, তোমার ছোট মাকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।

কেন? অনিমেষের আজকাল একটা ব্যাপারে খুব মজা লাগে। মাধবীলতা যখন তার পরিবারের কারোর সম্বন্ধে কথা বলে তখন মনে হয় ও তাকে ভীষণ চেনে। আসলে অনিমেষের মুখে শুনে শুনে দাদু পিসীমাদের ছবিটা ওর মনে স্পষ্ট আঁকা হয়ে গেছে। এক এক সময় ও এমন কথা বলে যে অনিমেষের নিজেরই দ্বন্দ্ব লাগে, ওদের কে বেশি চেনে, সে না মাধবলীতা।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top