What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected কালবেলা- সমরেশ মজুমদার (2 Viewers)

মাধবীলতা বলল, কত বড় হৃদয় থাকলে তবেই এভাবে তোমাকে আপন করে নেওয়া যায় সেটা তুমি বুঝবে না। তোমার ছোট মার নিজস্ব দুঃখ কিংবা কষ্টের কথা তোমরা কোনদিন জানতে পারোনি, পেরেছ?

কি দুঃখ নিজের সন্তান নেই বলে বলছ?

সে তো আছেই । কিন্তু সে কষ্ট ভুলে থাকা যায় যদি স্বামীর ভালবাসা কেউ বুক ভরে পায়। তোমার ছোট মা সেটা পাননি। তোমার বাবা কখনোই তাকে ভালবাসেননি। মাধবীলতার গলায় আত্মপ্রত্যয়।

কি বলছ। ওঁরা এতদিন একসঙ্গে আছেন।

অনিমেষকে থামিয়ে দিল মাধবীলতা, একসঙেগ অনেকদিন থাকলেই বুঝি ভালবাসা যায়। এই শহরে তো একসঙ্গে এতগুলো মানুষ চিরকাল আছে তবু মানুষে মানুষে ভালবাসাবাসি হল না কেন?

কি আশ্চর্য, এ দুটো ব্যাপার এক হল? দুজন মানুষ একসঙ্গে থাকলে পরস্পরকে গভীর ভাবে জানতে পারে, নিজেদের ত্রুটিগুলো সংশোধন করে নিতে পারে, পরস্পরের জন্যে তখন টান জন্মায় আর হাজার হাজার মানুষ যতই একসঙ্গে থাকুক এই নৈকট্য কখনোই গড়ে ওঠে না, দুটোকে এক করছ কেন?

বেশ, ওই ভাবে থাকতে থাকতে তুমি যেটাকে টান বললে সেটা এলেই তাহলে ভালবাসা পাওয়া গেল কি বল? মাধবীলতার মুখে দুষ্টুমি।

আমি কি ভুল বলছি। অনিমেষ একটু বিব্ৰত হল ।

নিশ্চয়ই। দুটো মানুষ সারা জীবন শুধু প্রয়োজনের জন্যে পরস্পরের ওপর নির্ভর করে কাটিয়ে দিতে পারে। দুজনে কেউ কাউকে একটুও ভালবাসল না হয়তো। শুধু প্রয়োজনই কাছাকাছি ওদের ধরে রাখল। আবার দুজন দুই বিপরীত মেরুতে বাস করেও পরস্পরকে ভালবাসতে পারে সারাজীবন। বুঝলে মশাই। কথাটা শেষ করে টেবিলে রাখা অনিমেষের হাতে আলতো করে চিমটি কাটলো মাধবীলতা।

বুঝলাম। অনিমেষ গম্ভীর হবার চেষ্টা করল, এবার বল ভালবাসা কি জিনিস? মানুষ মানুষকে কেন ভালবাসে?

কথাটা শোনামাত্র চোখ বড় হয়ে গেল মাধবীলতার। তারপরেই প্রচণ্ড শব্দে সে হেসে উঠল। সমস্ত শরীর কাঁপছে তার হাসির দমকে, দুহাতের চেটোয় নিজের মুখ ঢেকেও সামলাতে পারছে না। এ রকম দৃশ্য এবং শব্দ আশেপাশের অনেক টেবিলকে সচকিত করেছিল, তারা বেশ মজা দেখার মুখ করে এদিকে তাকিয়ে আছে এখন। অনিমেষ চাপা গলায় বলল, এই কি হচ্ছে। এভাবে হাসিতে ফেটে পড়ার কি কারণ সে বুঝতে পারছিল না।

কোন রকম নিজেকে সামলে মাধবীলতা বলল, অনেকদিন এত প্রাণ খুলে হাসিনি, তোমার জন্য সেটা পারলাম। বলেই আবার হাসতে লাগল, অবশ্য নিঃশব্দে।

তোমাকে কোন কথা সরল মনে জিজ্ঞাসা করা যায় না। অনিমেষ গম্ভীর হল ।

আমি তোমাকে এখন ভালবাসা শেখাবো?

শেখাতে কে বলেছে, আমি জাস্ট আলোচনা করছিলাম।

বেশ, তাহলে সরাসরি কথা হোক। তুমি রোজ আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য এত ব্যস্ত হও কেন? দুটো বড় চোখ অনিমেষের মুখের ওপর স্থির দৃষ্টি ফেলল। সেই চাহনির দিকে তাকিয়ে অনিমেষ ভেতর ভেতরে একটা কাঁপন অনুভব করল। সে কোন রকমে বলল, তুমি জানো?

কথা এড়িয়ে যাচ্ছ।

বেশ, তোমাকে না দেখতে পেলে আমার ভাল লাগে না, খুব কষ্ট হয়। ঘুম ভাঙ্গার পরই তোমার মুখটাকে দেখতে পাই আর ঘুমিয়ে না পড়া পর্যন্ত ও মুখ চোখের সামনে থেকে সরে না।

মারাত্মক ব্যাপার।

কেন?

যে কোন মুহূর্তে এ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যেতে পারে কিন্তু হচ্ছে না।

মানে?

চোখের সামনে যদি আমি ছাড়া কিছু না থাকে তাহলে তুমি হাঁটাচলা পড়াশুনা করছ কি করে? সে সবই করছ অথচ

কি আশ্চর্য । এতো মোটা কথা বলছ কেন? চোখ কি শুধু রক্ত মাংষেরই? মনের যে চোখ আছে কান আছে সেটা অস্বীকার করতে পারো?
 
এবার পথে এসো। প্রত্যেক মানুষের এ রকম দ্বৈত সত্তা আছে। মুশকিল হল অনেকেই ওই দ্বিতীয়টির ব্যবহার জানে না। তারা প্রথমটি নিয়েই সারাজীবন কাটিয়ে দেয়। কিন্তু এবার আমার ভয় হচ্ছে তোমার এই মন কদ্দিন থাকবে?

আমরণ!

মরণ কি শুধু শরীরের? মনেরও নয় কি?

আমি এত বুঝি না। আমি জেনেছি তোমাকে ছাড়া আমি সম্পূর্ণ নই।

কিন্তু এ জানায় যদি ভুল হয়

না। এটা আমি আমার সমস্ত রক্ত দিয়ে অনুভব করি। কিন্তু আমি তো একজন সাধারণ বাঙালী মেয়ে। তোমার সামনে বিরাট জগৎ। রাজনীতিতে তুমি গা ভাসাচ্ছ, নতুন সমাজ ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখো তুমি, একবার যদি ঝড় উঠে তুমি উত্তাল হবে। তখন আমি কি করব?

তুমি আমার সঙ্গে থাকবে।

আমার যদি সে ক্ষমতা না থাকে।

অনিমেষ মাধবীলতাকে খুঁটিয়ে দেখল। তারপর গলার স্বর নামিয়ে জিজ্ঞাসা করল, লতা, তুমি কি আমার রাজনীতিতে জড়ানো পছন্দ কর না?

মাধবীলতা হাসল, পাগল!

তবে?

আমার ভয় করে, খুব ভয় হয়।

এই হল মাধবীলতা। অনিমেষ যখন ছায়া চায় তখন ছায়া দেয়; কিন্তু যেই কুড়েমি করে তখনই রোদে পুড়িয়ে মারে। শুধু এই জন্য অনিমেষ মাঝে মাঝে ওকে বুঝতে পারে না। যুনিয়নের কাজে অনেক সময় ক্লাস করা হয় না। মাঝে মাঝে মনে হত এম এ ক্লাসের বিপুল কোর্স সবাই না জানা থেকে যাচ্ছে কিভাবে পরীক্ষা দেবে–হিম হয়ে যেত শরীর। এম এ না পাস করতে পারলে চিরকাল বাবার কাছে চোরের মত থাকতে হবে। মাধবীলতা তাকে প্রতিদিনের ক্লাসনোটস দিয়ে যেতে লাগল। অধ্যাপক যখন নোটস দিতেন তখন সে কার্বন ব্যবহার করে টুকে রাখত। কোন কোন রাতে হোস্টেলে শুয়ে সেই নোটসে চোখ রেখে অনিমেষ যেন মাধবীলতাকে দেখতে পেত, কল্পনায় মাধবীলতার হাতের গন্ধ নাকে আসতো। কিন্তু নিজের বুকের এ ছটফটানি সে কখনো মাধবীলতার মধ্যে দেখেনি। আর এই না দেখতে পাওয়ার জন্য কষ্ট হয়। কেন মাধবীলতা তাকে তার মত আঁকড়ে ধরে না, কেন পরের দিন কখন দেখা হবে এই প্রশ্ন কখনো করে না, তা বুঝতে পারে না অনিমেষ। মাধবীলতার এই নির্লিপ্ত আচরণে মাঝে মাঝে তার সন্দেহ হতো সে সত্যি তাকে ভালবাসে কিনা কিন্তু পরক্ষণেই এমন এক একটা কান্ড করতো মাধবীলতা যে অনিমেষ এসব চিন্তার জন্য নিজেকে অপরাধী ঠাওরাতো।

হ্যাঁ, সে মাধবীলতাকে সব বলেছে। এমন কি উর্বশী যে জ্বরো মুখে সেই জলপাইগুড়ির কৈশোরে তাকে চুমু খেয়েছিল তাও। কিন্তু অনিমেষ মাধবীলতার কিছু জানে না। কোন উগ্রতা না থাকলেও অনিমেষের বুঝতে অসুবিধে হয় না মাধবীলতারা অত্যন্ত স্বচ্ছল । কিন্তু কোনদিন তাকে নিজের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানায়নি। এই ব্যাপারটা খুব অস্বস্তি আছে অনিমেষের। অনেকদিন ভেবেছে মুখ ফুঠে বলেই ফেলবে কিন্তু সংকোচে সেটা সম্ভব হয়নি।

এর মধ্যে দুএক রবিবার সে চুপচাপ বেলঘরিয়ায় গিয়েছিল। স্টেশন ছাড়িয়ে যে রাস্তাটা নিমতার দিকে গিয়েছে সেদিকেই মাধবীলতার বাড়ি। এলোমেলো ঘুরে এসেছে সে, কোনদিন দেখা পায়নি।

কথাটা ওকে জানাতে খুব গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। বলেছিল, একটা দিন দেখা না করে থাকতে পারো না কেন? এর পরে হয়তো মাসের পর মাস না দেখা করে থাকতে হবে। অনি, আমার জন্য তোমার সব কাজকর্ম নষ্ট হোক এটা আমি চাই না। নিজেকে সংযত করো, এ রকম তরল হওয়া তোমাকে মানায় না।

অনিমেষ বুঝতে পারে না তার এমন কেন হল। চিরকাল সে যেভাবে কাটিয়ে এল এখন সে রকম থাকতে পারছে না কেন? সেই ছোটবেলায় জলপাইগুড়িতে মা-বাবাকে ছেড়ে আসবার পর সে এক রকম একাই। নিজের ভাল লাগা মন্দ লাগার কথা বলার মত কেউ ছিল না কাছাকাছি। দাদু কিংবা পিসীমার সঙ্গে বয়সের ব্যবধান তাকে ওদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল। আত্মকেন্দ্রিকতা মানুষকে অনেক কিছু থেকেই নিবৃত্ত করে। আনন্দ কিংবা দুঃখের উচ্ছাস তার নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, অন্যে তা জানতেও পারত না। বোধ হয় এইভাবেই সংযম জন্ম নেয় এবং নিয়েছিলও। অথচ মাধবীলতাকে দেখার পর সেই দীর্ঘ সময়ে গড়া দুর্গ এক মুহূর্তেই ধূলিসাৎ হল, অনিমেষ নিজেকে ধরে রাখতে পারে না এবং মাধবীলতার এই রকম সতর্কীকরণ কানে বড় খারাপ শোনায়।

কিন্তু সংযম অবশ্যই প্রয়োজন। ওকে না দেখতে পেলেই এই যে শূন্যবোধ এটাকে চাপা দেওয়া দরকার। আর কদিন বাদেই পূজোর ছুটি। তখন মাসখানেকের জন্য কলকাতা ছেড়ে যেতে হবে। কথাটা মাধবীলতাও জানে। মাধবীলতার কি তাকে এক মাস না দেখতে পেলে কোন কষ্ট হবে না। না অনিমেষ ঠিক করল নিজেকে পরিবর্তিতত করবে এইভাবে সহজে ধরা দিয়ে বসবে না।

আজ বিকেলে মাধবীলতা বলল, রোজ রোজ ট্রেনে যাই আজ বাসে যাব। এখন ছুটির সময়। ট্রাম বাসগুলো বাদুড়ঝোলা হয়ে যাচ্ছে। ওদিকে তাকিয়ে অনিমেষ বলল, তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

মাধবীলতা রাস্তা পার না হয়ে ধর্মতলাগামী একটা প্রাইভেট বাসে উঠে পড়ল। উলটোমুখ বলে বাসটা খালি। ধর্মতলায় বোঝাই হয়ে বেলঘরিয়ায় ফিরবে। জানলার পাশে একটা জায়গায় বসে মাধবীলতা বলল, সব সমস্যার সমাধান আছে শুধু রাস্তাটা খুঁজে নিতে হয়।

অনিমেষ বলল, ডবল ভাড়া দিতে হবে।

মাধবীলতা বলল, প্রয়োজনে তাই দিতে হয় বই কি।

অনিমেষ একটু উষ্ণ গলায় বলল, তুমি সব কথাই দুরকম মানে সাজিয়ে বল। কেন, সহজ কথাটা সহজ গলায় বললে মান যায় নাকি!

মাধবীলতা আস্তে আস্তে জানলার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল।

অনিমেষ খেয়াল করেনি, অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তা দেখছিল। ওয়েলিংটনের মোড় পার হতেই বাসটা দ্রুত ভরে গেল। লেডিস সিট উপচে মেয়েরা দাঁড়িয়ে রয়েছে। ছেলেরা যারা রড ধরে রয়েছে তারা মাধবীলতার দিকে বিরক্ত হয়ে তাকিয়েছে। কোন মেয়ে সাধারণ সিটে বসলেই পুরুষরা সেটাকে মানতে পারে না। অথচ সেগুলো তো শুধু পুরুষদের জন্যই নির্দিষ্ট নয়, তবু।

অনিমেষ কিছু বলার জন্য ডাকল এই! ডাকটা না শোনার মত নয়, মাধবীলতা মুখ ফেরালো না। অনিমেষ অবাক হয়ে আবার ডাকতেই সামনে দাঁড়ানো লোকগুলো ওদের দিকে তাকালো। এবারও মাধবীলতার কোন পরিবর্তন দেখা গেল না। অনিমেষের খুব অস্বস্তি এবং এক ধরনের ভয় হল। পাশ থেকে সে যেটুকু দেখছে তাতে বুঝতে পারছে মাধবীরতার মুখের প্রতিটি ভাজ এবং টান টান। দাঁত দিয়ে হয়তো নিচের ঠোঁট চেপে রেখেছে। সে ডাকছে অথচ মেয়েটা সাড়া দিচ্ছে না, এই তথ্যটা যদি আশপাশের লোকজন টের পেয়ে যায় তাহলে ওদের ঔৎসুক্য আরো বেড়ে যাবে। এই মুখ অনিমেষের অচেনা। যদি হঠাৎ কোন রুঢ় কথা বলে বসে তাহলে এদের কাছে নির্ঘাৎ অপমানিত হবে বলে আবার ডাকতে তার ভয় করছিল। সে চেষ্টা করল নির্লিপ্ত হয়ে বসে থাকতে। কিন্তু কিছুতেই তার বোধগম্য হচ্ছেল না। মাধবীলতা কেন এ রকম আচরণ করছে। তাদের মধ্যে কোন ঝগড়াঝাটি হয়নি, আঘাত লাগতে পারে এমন কিছু সে করেনি, তবে? ওই মুখ দেখতে অনিমেষের খুব কষ্ট হচ্ছিল কিন্তু আর কথা বলার মত সাহস সে পাচ্ছিল না।
 
বাসটা এখন স্ট্যান্ডে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। ইডেন গার্ডেনের পাশে বাবুরঘাটে স্টিমারের ডাক শোনা যাচ্ছে। চার পাশে নানান রকম হকার আর বেড়াতে আসা মানুষের ভিড় জায়গাটাকে মেলার চেহারা দিচ্ছিল। অনিমেষ দেখল জোড়ায় জোড়ায় ছেলেমেয়ে ইডেন থেকে ঢুকছে আর বের হচ্ছে। অনিকের ভঙ্গিতে একটা চোর চোর ভাব আছে। ইডেন কিংবা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, যেসব জায়গায় সবাই প্রেম করতে যায়, সেখানে মাধবীলতাকে নিয়ে সে কখনো যায়নি। য়নিভার্সিটির চার পাশে যেসব। খোলামেলা রেস্টুরেন্ট আছে সেখানেই কথা বলেছে ওরা। প্রেম করলেই সকলে বোধ হয় নির্জনতা খোঁজে চায়ের দোকানের কেবিনে গিয়ে ঢোকে। আশ্চর্য ওদের মাথায় সে রকম চিন্তা আসেনি কেন? অনিমেষের খেয়াল হল সে এখনও মাধবীলতার হাত পর্যন্ত ধরেনি। এই যে এখন সে পাশে বসে আছে স্বাভাবিকভাবেই ওর শরীরে স্পর্শ লাগছে কিন্তু এই মুহূর্তেই সে সম্পর্ক সচেতন হল অনিমেষ। এবং হওয়ার পর আরো সংকুচিত হয়ে পড়ল।

মাধবীলতা হঠাৎ কথা বলল। বাইরে থেকে মুখ সম্পূর্ণ না ফিরিয়ে চাপা গলায় উচ্চারণ করল, ওই রকম হলে খুশি হন জানি, তা আমার কাছে কেন ওই একটা জুটিয়ে নিলেই পারেন।

কথাটা বুঝতে কয়েক পলক গেল, অনিমেষ চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল একটি জোড়া ইডেনের দিকে ঢুকছে। মেয়েটি খিল খিল করে হাসছে তার একটা হাত ছেলেটির কোমরে আর ছেলেটির হাত মেয়েটির কাঁধে। কি কারণে ওরা অমন হাসছে বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু আশপাশের লোকজনের কৌতুকের চোখ ওদের গ্রাহ্যবস্তু নয় এটা বোঝা যাচ্ছিল। যে কোন মানুষের চোখে ওদের ভঙ্গিতে একটা বেলেল্লাপনা ধরা পড়বে, অনিমেষের খারাপ লাগল । কিন্তু মাধবীলতার ইঙ্গিত বোঝামাত্রই তার মুখে রক্ত জমে গেল। তার সম্পর্কে এতটা নীচ ইঙ্গিত করতে পারল ও? শুধু শারীরিক প্রয়োজনেই সে মাধবীলতাকে কামনা করে? এই তাহলে তার সম্পর্কে ধারণা? অনিমেষের মনে হল এখনই এই সিট থেকে উঠে যায়। এই অপমানের পর আর পাশাপাশি বসে থাকা যায় না। কিন্তু সেই মুহূর্তেই আর একটা অনুভূতি তাকে আচ্ছন্ন করল। মাধবীলতাকে হারিয়ে সে থাকবে কী করে। ক্রোধ মানুষকে অন্ধ করে। হয়তো কোন কারণে মাধবীলতা নিজেকে বেসামাল করে ফেলায় এই রকম দায়িত্বজ্ঞানহীন কথা বলছে। কিন্তু মন যখন শান্ত হবে তখন নিশ্চয়ই এই কথাটার জন্যে সে লজ্জা পাবে।

পালটা যুক্তি খুঁজে পেতে অনিমেষ সিট ছেড়ে উঠল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও একটা হীনমন্যতাবোধ তাকে আচ্ছন্ন করে রাখল। বুকের ভেতর একটা ভারী কিছু অনড় হয়ে আছে। বাসটা চলতে শুরু করলেও অবস্থার কোন পরিবর্তন হল না। ভিড়ের চাপাচাপিতে আশেপাশের মানুষরা আর তাদের ভাল করে নজর করছে না দেখে অনিমেষ চাপা গলায় বলল, তুমি এ রকম করে বলতে পারলে?

মাধবীলতা উত্তর দিল না। যেন অপরিচিত সহযাত্ৰীনীর মত চুপ করে বসে থাকল অনিমেষ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, শুনছো।

মাধবীলতা নির্বিকার কিন্তু ওপরের একটা মুখ বলে উঠল, কিছু বলছেন?

অনিমেষ হতভম্ব হয়ে মুখ তুলে দেখল একটি টিয়াপাখির নাক বসানো মুখ ওর দিকে ঝুঁকে পড়েছে। সে চটপট বলে উঠল, না না কিছু বলিনি।

কিছু বলছেন না তো তখন থেকে বিড়বিড় করছেন কেন?

রাগ হয়ে গেল এই গায়ে পড়া ভাব দেখে। অনিমেষ বলল, কি যা তা বলছেন!

যা-তা বলছি! আই বাপ!, লোকটা মুখ ঘুরিয়ে আশেপাশের ঝুলে থাকা মুখগুলোকে বলল, তখন থেকে দেখছি মেয়েটিকে জ্বালাতন করছে, বিড়বিড় করে কথা বলে যাচ্ছে, আবার চোখ রাঙ্গানো দেখেছেন!
 
বাসে ট্রামে এই হয়েছে আজকাল। মেয়েরা যে নিশ্চিন্তে একা একা যাবে তার উপায় নেই। কান ধরে বাস থেকে নামিয়ে দেওয়া উচিত। আর একটি কিলবিলিয়ে উঠল। অনিমেষ মহা ফাপড়ে পড়ল। আশেপাশের সবাই তো বটেই ওপাশের মহিলারা পর্যন্ত ঝুঁকে তাকে লক্ষ্য করছে। সে দ্রুত মাধবীলতাকে দেখল। তেমনি নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বাইরের দিকে তাকানো। যেন ছুটন্ত ফুটপাতগুলোর পৃথিবীর যাবতীয় দেখার জিনিস ছড়িয়ে আছে। বাসের ভেতর এখন যে কথাবার্তা চলছে তা ওর কানে মোটেই যায়নি। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে চট করে সামলে নিল অনিমেষ। এখন চলে যাওয়া মানে এই লোকগুলোর ইঙ্গিতকে সত্যি প্রমাণিত করা। একটি হেঁড়ে গলা বলে উঠল, ভদ্রভাবে যদি বসে থাকতে না পারেন তাহলে ঘাড় ধরে বের করে দেব বাস থেকে।

মাথায় আগুন জ্বলে গেল অনিমেষের, চিৎকার করে বলল, মুখ সামলে কথা বলুন।

একটা হুড়োহুড়ি শুরু হওয়া মাত্র কন্ডাক্টরের গলা শোনা গেল, বাসের ভেতরে নয়, বাইরে গিয়ে করুণ। ও দাদারা।

কলকাতার মানুষ নিজে দর্শক হয়ে দূরত্বে থাকতে ভালবাসে। অন্য কেউ শুরু করে দিলে ছুঁক ছুঁক করতে পারে এইমাত্র। সমস্বরে গলাগুলো কন্ডাক্টরের উদ্দেশ্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, নামিয়ে দিন তো মশাই, মেয়েদের বিরক্ত করবে আর বললে চোখ রাঙ্গাবে। এদের জন্যেই ছেলেদের বদনাম হয়।

ভিড় ঠেলে কন্ডাক্টর অনিমেষের সামনে এসে দাঁড়াতেই অনিমেষ বসে পড়ল। উত্তেজনায় ওর শরীর এখন থর থর করে কাঁপছে। এবং উত্তেজিত হলেই পেটে যে চিন চিনে ব্যথা ছড়িয়ে পড়ে সেটাও বাদ গেল না। কন্ডাক্টর কড়া গলায় জিজ্ঞাসা করল, ও মশাই, কোথায় যাবেন আপনি?

হাতিবাগান বলতে যাচ্ছিল অনিমেষ কিন্তু তার আগেই একটা হাত কন্ডাক্টরের উদ্দেশ্য এগিয়ে গেল। গম-রঙ্গা সেই হাতের কবজিতে একটা মকরমুখী বালা। হাতের শেষে আঙ্গুলের চাপে একটা এক টাকার নোট ধরা মাধবীলতার গলা শুনল অনিমেষ, দুটো বেলঘরিয়া দিন।

দুজন কে? কন্ডাক্টর টাকাটা ভাঁজ করে আঙ্গুলের ফাঁকে খুঁজে পয়সা বের করছিল। হাত দিয়ে অনিমেষকে দেখালো মাধবীলতা।

কন্ডাক্টর এ গাল হেসে বলল, আপনারা এক সঙ্গে, ও হ্যা কলেজ স্ট্রীট থেকেই তো উঠেছিলেন।

কথাটা শেষ করে আশেপাশের জনতার দিকে বাঁকা গলায় জানালো, আপনারা মাইরি সব জায়গায় সিনেমা করেন।

এক পলকেই অনিমেষ দেখল আশেপাশের মুখগুলো হাওয়া বেরুনো মুখের মত ঝুলছে। কিন্তু কারোর দিকে তাকাতে ওর ইচ্ছে করছিল না। এই সময় লোকগুলোকে একহাত নেওয়া যেতে পারত কিন্তু তার প্রবৃত্তি হল না। হীনমন্যতা কাটিয়ে উঠতে পারছিল না অনিমেষ। কারণ মাধবীলতা টিকিট কাটার পর আবার একই ভঙ্গিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। বাসের ভেতরে যে নাটকটা হয়ে গেল সে সম্পর্কে যেন মোটেই ওয়াকিবহাল নয়।

অনিমেষের খেয়াল হল দুটো বেলঘরিয়ার টিকেট কাটা হয়েছে। কেন? ও রহস্যটা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করল। এবার স্বাভাবিক গলায় কিন্তু অন্য কেউ স্পষ্ট শুনতে পেল না। মাধবীলতা ঘাড় না ঘুরিয়েই জবাব দিল, ইচ্ছে করলে হাতিবাগানে নেমে যেতে পারেন।

এবার জেদ চেপে গেল নিমেষের। হাতি বাগান শ্যামবাজার পেরিয়ে বাসটা যখন বি টি রোড ধরল তখনও ওরা তেমনি চুপচাপ বসে। লাস্ট স্টপে নামার পর মাধবীলতার সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করবে সে। তখন নিশ্চিয়ই এই ঝুলন্ত মুখগুলো আশেপাশে থাকবে না। এটা না করলে হোস্টেলে ফিরে কিছুতেই স্বস্তি পাবে না অনিমেষ।
 
বিকেলটা দুদ্দাড় করে ছুটে গেল অন্ধকারে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আলো জ্বলে উঠছে চার ধারে। এত দেরী করে মাধবীলতা কখনো বাড়ি ফেরে না। আজ এই বাসে চড়ে যাওয়ার আবদারের জন্যই এটা হল । বাড়ি ফিরে বকুনিটা অবশ্যই জোট উচিত আজ। অনিমেষ নড়েচড়ে বসল।

বেলঘরিয়ার স্টেশনের সামনে যখন বাসটা থেমে গেল তখন অল্পই যাত্রী তাতে। মাধবীলতার পেছন পেছন নীচে নামতেই অনিমেষ বলল, দাঁড়াও।

মাধবীলতা দাঁড়াল তারপর নীচু গলায় বলল, এখানে নাটক করতে হবে না।

কিন্তু আমার কিছু কথা আছে। এভাবে অপমান করলে কেন?

এখানে দাঁড়িয়ে আমি কথা বলতে পারব না। হাঁটতে হাঁটতে কথা বল।

তোমার বাড়ির দিকে যাব?

আমাদের পাড়ার অনেকেই এখন তোমাকে দেখছে। এখান থেকে চলে গেলে আমার বদনামের গল্পটা ছড়াবে। তার চেয়ে বাড়িতে যাওয়াটা শোভন হবে। এসো। মাধবীলতা পা বাড়াল।

এর আগে কখনই অনিমেষকে বাড়িতে যেতে বলেনি মাধবীলতা। আজকের এই রকম আচরণের পর এই নিয়ন্ত্রণটা কেমন বেমানান ঠেকছে। তাছাড়া একটা পরিস্থিতির চাপে পড়েই তাকে যেতে বলছে ও। কিন্তু এখান দাঁড়িয়ে থাকা আরো খারাপ দেখায়। আশেপাশের চায়ের দোকান থেকে অনেক চোখ এখন এদিকে সেঁটে আছে। অনিমেষ মাধবীলতাকে অনুসরণ করল।

লেবেল ক্রসিং পেরিয়ে মাধবীলতা খানিক ইতস্তত করল। অনিমেষ পাশাপাশি হাঁটছিল, জিজ্ঞাসা করল, কী হল?

আমাদের বাড়ি তোমার ভাল লাগবে না।

কেন? অনিমেষ প্রশ্নটা করতেই একটা সাইকেল রিকশা এগিলে এল, আসেন দিদিমণি। মাধবীলতা রিকশাওয়ালার দিকে চেয়ে একটু হাসল। অনিমেষ বুঝল ওরা সবাই মাধবীলতাকে চেনে। মাধবীলতা রিকশায় উঠতে উঠতে বলল, যা থাকে কপালে, উঠে পড়ুন, নিজের চোখে দেখে যদি মতিগতি পালটায়।

পাশাপাশি বসতে কোন অসুবিধে হল না। রিকশাওয়ালা যে রকম দ্রুত চালাচ্ছে তাতে অনিমেষের ভয় হচ্ছিল যে কোন মুহূর্তেই দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। অবিরাম হর্ণের শব্দে ওরা ঘিঞ্জি এলাকাটা পেরিয়ে এলে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, আমাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে তোমার এত কুণ্ঠা কেন?

মাধবীলতা কথা বলল না, কিন্তু সেই টিপিক্যাল হাসিটা হাসল যার কোন স্পষ্ট মানে ধরা যায় না। অনিমেষের এ রকম হাসি শুনলে খুব রাগ হয় কিন্তু বাসে যে ঘটনাটা ঘটল তার জন্যে এখন কথা বাড়ালো না। শুধু বলল, তোমার যদি আমাকে বিরক্তিকর মনে হয় সোজাসুজি বলে দিও। আমি কি করব সেটা আমার ব্যাপার, ওটা আমাকে বুঝতে দাও।

অন্ধকারে মাধবীলতার ঠোঁটের কোণে সামান্য ভাঁজ পড়ল। অনিমেষের মনে হল এটা হাসির চেয়েও মারাত্মক।

ফাঁকা রাস্তা পেয়ে রিকশাওয়ালা জোর প্যাডেল ঘোরাচ্ছে। তার মানে মাধবীলতাকে অনেকখানি এসে রোজ ট্রেন ধরতে হয়। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, এটাও কি বেলঘরিয়া?

না, মিতা। একদম মফস্বল লাগছে, তাই না?

হ্যাঁ, কিন্তু ভাল লাগছে।

এক আধ দিনই লাগে। পুরোন হলে আর কিছুই আকর্ষণীয় থাকে না। ওর বলার ধরনটা এমন যে দ্বিতীয় অর্থটি বুঝতে অসুবিধে হল না।

প্রায় মাইল দেড়েক যাওয়ার পর একটা গলিতে ঢুকে মাধবীলতা ভাড়া মিটিয়ে রিকশাটাকে ছেড়ে দিল। ডান দিকে অন্ধকারেও একটা বড় পানা পুকুর দেখা যাচ্ছে। বাঁ দিকের বাড়িগুলো বাগানসুদ্ধ কিন্তু বয়সের আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত । মাধবীলতা বলল, আপনি আমার কাছ থেকে একটা বই নিতে এসেছেন।

অনিমেষ কথাটা অনুধাবন করার আগেই গেট খুলে ভেতরে ঢুকে ডাকল, আসুন।
 
গেটের ওপরই মাধবীলতার ঝাড় বাগান থেকে ফুলের গন্ধ আসছে। সামনেই একটা ভাঙ্গাচোরা পুরোন আমলের দোতলা বাড়ি। দু-একটা ঘরে আলো জ্বলছিল মাত্র। পেছনে পুকুরের আভাস। মাধবীলতা রোয়াকে উঠে অনেক্ষণ কড়া নাড়ার পর দরজা খুলল । একজন নুয়ে পড়া বৃদ্ধা খ্যানখেনিয়ে উঠলেন, এতক্ষণে আসা হল মেয়ের। ইদিকে তোর বাপ মা এতক্ষণ বসে থেকে থেকে চলে গেল খিদিরপুর।

খিদিরপুর কেন?

অঞ্জলির মামাতো ভাই এয়েছে না? তোকে নিয়ে যেতে বলেছিল।

অ। মাধবীলতা ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, আসুন।

কে ওখানে? বৃদ্ধার গলা শুনে অনিমেষ ইতস্তত করল এগোতে।

আমার সঙ্গে পড়ে। তুমি চায়ের জল বসাও যাও। আসুন দাঁড়িয়ে রইলেন কেন?

অনিমেষ অত্যন্ত সন্তর্পণে উঠে এল। বৃদ্ধা তাকে জরিপ করছেন। অনিমেষ বুঝতে পারছিল না ওকে প্রণাম করবে কিনা। মাধবীলতার কে হন উনি বোঝা যাচ্ছে না। মাধবীলতার পেছন পেছন একটা ঘরে গিয়ে ঢুকতেই মাধবীলতা বলল, বসুন। আমি আসছি।

অনিমেষ সেকেলে ঘরটাকে দেখল। দু-তিনটে চেয়ার, একটা তক্তাপোষ। জানালাগুলো বন্ধ । বাইরে বুড়ির গলা শোনা গেল, একটা উটকো ছেলেকে হট করে বাড়িতে ঢুকালি বাপ-মা শুনলে কি বলবে?

সে আমি বুঝবো তুমি চা বসাও।

আজ বাদে কাল যার বিয়ে

কে বলেছে?

অঞ্জলির মামাতো ভাই কি জন্যে এসেছে?

বেশি বাজে কথা না বলে এখন যাও।

কয়েক সেকেন্ড বাদেই মাধবীলতা ঘরে এল। এসে বলল, এই আমাদের বাড়ি। মা বাবা এখন নেই তাই আলাপ করাতে পারলাম না।

উনি কে?

কদুমাসী। ভাল নাম কাদম্বিনী। আমাকে মানুষ করেছেন।

আমি আসায় বোধ হয়

একেই আমার মাথায় আগুন জ্বলছে। এ বাড়িতে এভাবে কথা বলবেন না। আর কদ্দিন থাকা যাবে কে জানে।

কেন?

শুনতে পাননি? বিয়ের জন্য ছোটাছুটি শুরু করেছেন সবাই।

অনিমেষ কথা বলল না। একবার ভাবল বলে, ভালই তো কিন্তু পারল না।

হঠাৎ মাধবীলতা কেমন শান্ত অথচ দৃঢ় গলায় প্রশ্ন করল, আমার কিছু হলে তুমি ভার নিতে পারবে?

সমস্ত রক্ত এখন বুকের মধ্যে। আর এ রকম সময়ে পৃথিবীটাকে হাতের মুঠোয় মনে হল অনিমেষের। সে পরিষ্কার গলায় বলল, হ্যাঁ।

ওরা অনেকক্ষণ আর কথা বলল না। এর মধ্যে বৃদ্ধা এসে চা দিয়ে গেছে। এক চুমুকে সেটা শেষ করে অনিমেষ উঠে দাঁড়াল, আজ যাই।

মাধবীলতা মুখে কিছু না বলে ঘাড় কাত করল। তারপরই হঠাৎ উঠে এসে সামনে দাঁড়িয়ে সেই অদ্ভুত মায়াময় চাহনিতে অনিমেষকে ভরিয়ে দিল। একটা হাত আলতো করে অনিমেষের বুকের ওপর রাখল মাধবীলতা, আমাকে ক্ষমা কর।

কেন? নিজের হৃৎপিণ্ড যেন মাধবীলতার হাতের তলায় এমন অনুভব অনিমেষের। মাধবীলতা তো কোন অন্যায় করেনি, তাহলে ক্ষমা কিসের।

হাত না সরিয়ে মাধবীলতা বলল, লোকে যে যাই বলুক, আমার কিছু যায় আসে না। কিন্তু তুমি কড়া গলায় কিছু বললে আমি সইতে পারব না।

অনিমেষ গাঢ় গলায় বলল, আমি কি কিছু বলেছি? এবার থেকে আমি সহজ কথাটা সহজ গলায় বলব।

অনিমেষের মনে পড়ল বাসে উঠে সে ওই কথাটা বলার সময় খুব বিচ্ছিরিভাবে ধমকেছিল। কিন্তু সেটা তার মনে ছিল না, নেহাৎ অভ্যেসেই কথা বলা। তাই যে এই মেয়ের এমন করে লেগেছে তা কে জানত।

সে মাধবীলতার মুখের দিকে তাকাল। ওকে ভীষণ আদর করতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু কিছুতেই হাত উঠল না ওপরে। মুখ নামিয়ে সে ওর চুলের ঘ্রাণ নিয়ে বলল, আমি আর তোমাকে আঘাত দেব না। উজ্জ্বল হাসিতে মাধবীলতার মুখ এখন মাখামাখি। হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, দেখো, আমি ঠিক তোমার মত হব। কোন রকমে পরীক্ষাটা অবধি যদি এড়াতে পারি তাহলে আর কোন চিন্তা করি না। চলে যেতে ইচ্ছে করছিল না মোটেই। তবু অনিমেষ বলল, যাই।

মাধবীলতা বলল, না। বল আসি।

হাসল অনিমেষ। আচ্ছা। আসি তাহলে।

গেট অবধি পৌঁছে দিল মাধবীলতা। ভীষণ হালকা লাগছে এখন, অনিমেষ গলিটা পেরিয়ে এসে পেছনে তাকাল আবছা অন্ধকারে মাধবীলতার শরীরের আদল দেখা যাচ্ছে। নিজেকে এখন সম্রাটের মত মনে হচ্ছে তার। ওর মাথায় কোন চিন্তাই জায়গা পাচ্ছিল না। এখনও যে বাবার টাকায় তাকে মাস চালাতে হয়, অনিশ্চিত রাজনৈতিক জীবনের মধ্যে সে নিজেকে জড়াতে যাচ্ছে, ব্যক্তিগত কোন আয়ের সংস্থান নেই, মাধবীলতার ভার নিতে হলে এই কলকাতায় একটা বাড়ি নিদেনপক্ষে একটা ঘর দরকার এবং সেটা পেতে হলে টাকা চাই এসব অত্যন্ত নগণ্য মনে হল। এসব সমস্যা নিয়ে আকাশ পাতাল ভেবে কোন লাভ নেই। মাধবীলতা যদি তার পাশে এসে দাঁড়ায় তাহলে সব সমস্যাই সমাধানের পথ খুঁজে পাবে । অনিমেষ দৃঢ় আত্মবিশ্বাসে স্টেশনের দিকে হাঁটতে লাগল।
 
খুব দ্রুত ঘটে যাচ্ছিল ঘটনাগুলো। জীবনটা কি এই রকম? যখন কিছু ঘটে না তখন দমবন্ধ গ্রীষ্মের দুপুরের মত থমকে থাকে সব কিছু। আর যখন ঘটার পালা আসে তখন উত্তাল ঢেউ এর মত কোন কিছু গ্রাহ্য না করে বেপরোয়া ছুটে চলে। সেই রকম ছুটে যাওয়ার সময় যেন এই দিনগুলো। অনিমেষ পেছন ফিরে তাকাবার সুযোগ পাচ্ছিল না।

সুবাসদার সঙ্গে দেখা হয়নি অনেকদিন। খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছে সে কিন্তু সঠিক সংবাদ পাওয়া যায়নি। এই নিয়ে দুবার সুবাসদা নিজে আসবে বলে আর আসেনি। এখন অনিমেষদের কাজকর্ম খুব বেড়ে গেছে। পার্টি অফিস য়ুনিভার্সিটি করতে করতে অনেকটা সময় ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। নতুন নতুন লোকের সঙ্গে নিত্য পরিচয় হচ্ছে। কিন্তু পুরোন যারা রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট নয়, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে আসছে। যেমন পরমহংস। যেদিন সময় পায় সেদিন ক্লাস করতে গেলে দেখা হয়। একই রকম আছে ছেলেটা। এই যেমন আজ দেখা হতেই বলল, মালকড়ির শেয়ার পাচ্ছ মনে হচ্ছে গুরু। কামিয়ে নাও যত পারো। অনিমেষ হকচকিয়ে বলল, শেয়ার পাচ্ছি মানে?

পরমহংস বলল, তুমি যদি ভূত হও তাহলে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবে। তা নাহলে এখান থেকে ফায়দা তুলবে।

অনিমেষ প্রতিবাদ করতে গিয়ে থেমে গেল। কোন লাভ নেই। যে নিয়মটা চালু হয়ে গেছে তার বাইরে চিন্তা করতে আমরা অভ্যস্ত নই। এই মুহূর্তে তার পকেটে মাত্র দুটো টাকা পড়ে আছে। মাসের শেষ হতে অনেক দেরী এবং এতবড় কলকাতায় তাকে ওই টাকায় মাসটা চালাতে হবে। পরমহংস ওর মুখের পরিবর্তন লক্ষ্য করে বলল, এক সময় তুমি টিউশুনি করবে বলে খেপে উঠেছিলে। অথচ এখন সেসব কথা ভুলেও বল না। তার মানে তোমার টাকার দরকার নেই। ঠিক কিনা?

অনিমেষ বলল, তা নয়। আসলে আমি বোধ হয় খুব উদ্যোগী ছেলে নই। যা মাথায় আসে তাই করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ি। তাছাড়া পার্টির কাজে এত সময় দিতে হয় যে ধরাবাধা অনেক কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এই কাজ করতে কেউ মাথার দিব্যি দেয়নি। কিন্তু আমি এ কাজ না করেও পারব না। তার ফলে অনেক আর্থিক কষ্টের মধ্যে আমার দিন কাটাতে হয়। বিশ্বাস করো রাজনীতি করে যারা পয়সা পায় তাদের সঙ্গে আমার এখনও আলাপ হয়নি এবং সেই ভূমিকায় নিজেকে দেখার কোন আগ্রহ নেই।

পরমহংস বলল, এ রকম নেশার কোন মানে আমি বুঝতে পারি না। যখন সময় চলে যাবে তখন দেখবে তোমার স্কোরে একটাও রান জমেনি। তুমি কি ভাবছ এই করে দেশের চেহারা পালটে দিতে পারবে? মিছিমিছি নিজেকে নষ্ট করার কোন মানে হয়!

অনিমেষ বলল, এই রকম চিন্তা যদি সবাই করে তাহলে আগামী দশ বছর পরে দেশের কি অবস্থা হবে তা ভাবতে পারো?

পরমহংস বলল, এখন কথাটা মানছ না, পরে বুঝবে। তুমি যাই বোঝাতে চাও দেশের সাধারণ মানুষ তা বুঝবে না। তারা একটা জিনিসই জানে, যে তাদের ব্যক্তিগত প্রয়োজন মেটাবে সেই তাদের বন্ধু। ওসব ইজম টিজমে ওদের কিছু যায় আসে না। সব শালা আমরা দারোগা বাবু হয়ে বসে আছি। হাঁসে ডিম পাড়ুক আমরা হাফবয়েল খাব। তা তোমার পরীক্ষা টরীক্ষা দেবার ইচ্ছে আছে?

অনিমেষ বলল, কোন লাভ নেই দিয়ে তবুও দেব।

পরমহংস বলল, লাভ নেই জেনেই তো এম এ পড়তে এসেছিল বাংলায়। দুবছর ভাল ভাল মেয়ের সঙ্গে আড্ডা মারার এই সুযোগ কি কেউ ছাড়ে? কপালে কোন ব্যাংক বা সরকারি অফিসের কেরানীগিরি অপেক্ষা করছে তা তো জানি। কিন্তু পরীক্ষা না দিলে প্রেস্টিজ থাকে না। তুমি তো ক্লাস করছো না, পড়াশুনা হচ্ছে কি?

অনিমেষ বলল, লাস্ট দুমাসে ম্যানেজ হবে না? তুমি কি বল?

রামকৃষ্ণর মত মুদ্রা করল হাতের আঙ্গুলে পরমহংস। তারপর বলল, ও হ্যাঁ মনে পড়েছে তোমাকে শোভনাদি খুঁজছিল একদিন দেখা করো।

কেন, কি ব্যাপার?

টিউশুনির জন্যে গিয়েছিলে বোধ হয় সেই ব্যাপারেই।

ভদ্র মহিলা বেশ ভাল। অন্যমনস্ক গলায় বলল অনিমেষ।

তাই নাকি? স্পিন ধরেছে মনে হচ্ছে।

ইয়ার্কি মেরো না। মহিলার মুখে একটা ব্যথার ছায়া ঘোরে।

দয়া করে সেই ছায়াটা সরাবার চেষ্টা করো না, তাহলেই উনি আরো ব্যথা পাবেন। তোমার বান্ধবী আসছেন, আমি চলি।
 
পরমহংস ঘুরে দাঁড়াতেই অনিমেষ দেখল মাধবীলতা আসছে। বেলঘরিয়া থেকে ফিরে আসার পর ওর সঙ্গে দেখা হয়নি অনিমেষের। সাদা জামা সাদা শাড়িতে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। সে পরমহংসের হাত ধরে বলল, এই, পালাবে না।

মাধবীলত সামনে এসে দাঁড়িয়ে হাসল, কি খবর?

অনিমেষ বলল, কোথায় ছিলে?

লাইব্রেরীতে। আমাদের তো পাস করতে হবে।

একে চেন?

সঙ্গে সঙ্গে পরমহংস সামান্য ঝুঁকে নমস্কার করে বলল, ঈশ্বর, এও আমাকে শুনতে হল, অনিমেষ আমার পরিচয় দিচ্ছে।

অনিমেষ দেখল মাধবীলতা হাসছে এখনো। সে বলল, তোমরা কি আগে থেকেই–।

পরমহংস হাত নেড়ে জানাল, অফকোর্স। আমিই তো ফাস্ট ওর পেছনে লাইন দিই তুমি তো পেছন থেকে ওভারটেক করে চেয়ার দখল করলে। আমার কপালই এই রকম বন্ধুরাই শত্রু হয়। ওর বলার ভঙ্গী এমন যে মাধবীলতা হাতের খাতা দিয়ে ওকে কপট আঘাত না করে পারল না। শরীর খর্বকায় বলে পরমহংস মাথা নীচু করে এক পাশে সরে গিয়ে উচ্চ গ্রীমে হাসতে শুরু করল। অনিমেষের মনে পড়ল, তার এ্যারেস্ট হওয়ার বিকেলে এই পরমহংসই ওকে খবর দিয়েছিল বসন্ত কেবিনের ওপরে মাধবীলতা বসে আছে। সে ব্যাপারটা বলতেই পরমহংস বলল, দারুণ ব্যাপার হয়েছিল সেদিন। আমি য়ুনিভার্সিটির উলটো ফুটে থেকে দেখলাম তুমি ফালতু ফালতু শহীদ হয়ে গেলে।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ফালতু ফালতু মানে?

নিরীহ হরিণ শাবকের মত তুমি রাস্তা পার হচ্ছিলে আর পুলিশ ভ্যানটার তখন একটা কেস দেখাবার প্রয়োজন ছিল তাই টুক করে তোমায় তুলে নিল। কোনরকম বিপ্লব বিদ্রোহ নয়, ঠাকুরঘরে ঢোকার মত তুমি ভ্যানের ভেতরে ঢুকে গেলে।

অনিমেষ হাসল, তারপর?

তারপর আর কি? পুলিশ চলে গেলে তুমি ছাত্রদের কাছে বিপ্লবী হয়ে গেলে। কমরেড অনিমেষের মুক্তি চাই, বাপস। মেয়েরা গুজব ছড়াবে লাগল। অনেক লড়াই করে তুমি ধরা দিয়েছ এইসব। তা এ মহিলাও বোধ হয় সেই সব গুজবের একটি শ্রবণ করে বসন্ত কেবিনে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আমি কি ছাই সেসব জানতাম। দেখলাম একা হরিণ কচি ঘাস খাচ্ছে। দেখে নির্মল হৃদয়ে পাশে গিয়ে বসলাম, নিজের পরিচয় দিয়ে লাইন করার চেষ্টা করলাম।

মাধবীলতা ঠোঁট কামড়ে বলল, কিসের লাইন?

একটা মোগলাই পরোটা আর চায়ের।

ওমা! মাধবীলতা হতবাক।

অনিমেষ বলল, খাওয়ালো না?

খাওয়াবে কি! এক ডজন অমাবস্যা মুখে নিয়ে বসে থাকলে কাউকে খাওয়ানোর কথা মনে আসে! আমি শালা আলাপ জমাবার জন্যে কারেন্ট টপিক ব্যবহার করতেই ফেঁসে গেলাম। আফসোসের মুখ করল পরমহংস।

ডিটেলস প্লিজ।

যেই বললাম, অনিমেষ একটা দারুণ ছেলে। চেনেন নিশ্চয়ই? আমাদের সঙ্গে পড়ে মাই ফ্রেন্ড। আজ পুলিশকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ভ্যানে উঠে বাড়ি চলে গেল। অমনি এই মহিলা ভেঙ্গে পড়লেন।

মোটেই না, একদম ইয়ার্কি করবেন না। খুঁসে উঠল মাধবীলতা।

বেশ, তাহলে একা একা বসন্ত কেবিনে কি করছিলেন?

আশ্চর্য। আমি ওখানে চা খেতে যেতে পারি না?

একা একা?

হ্যাঁ। আপনারা যেটা পারেন সেটা একটা মেয়ের পক্ষে কি পারা অন্যায়?

হাত জোড় করল পরমহংস, ক্ষমা করুন, আমার অন্যায় হয়ে গেছে। কিন্তু এতসব শোনার পরও যদি হৃদয় না গলে তাহলে আফসোসের কথা।

হৃদয় গলবে কি কারণে?

বাঃ আমি যদি খবর না দিতাম তাহলে অনিমেষ আপনার কাছে যেত? সেই সুবাদে আমার একটা মাটন ওমলেট আর কফি পাওনা হয়ে আছে।

ঠিক আছে, এত করে যখন বলছেন, আর একদিন খাওয়াবো। আজ আমার কাছে বেশি পয়সা নেই।

নেই তো কি হয়েছে, ধার দিচ্ছি।

মানে? আপনার কাছ থেকে ধার নিয়ে আপনাকেই খাওয়াতে হবে? কি ডেঞ্জারাস লোক। কপালে চোখ তুলল মাধবীলতা!
 
উপনির্বাচনটি নিয়ে উত্তরবাংলায় কোনো উত্তাপ নেই।

কংগ্রেসের কাছে আসনটির সঙ্গে অনেক মর্যাদা জড়িয়ে আছে। মন্ত্রীরা ঘন ঘন এসে জনসাধারণকে বুঝিয়ে যাচ্ছেন। এসবের দরকার ছিল না আগের নির্বাচনে। যিনি এই আসনে দাঁড়াতেন তাঁর নামটাই একটা মন্ত্র চিল। ভদ্রলোকের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে দাঁড়িয়েছেন এবার। পারিবারিক অধিকারে আসনটি তার হবেই জানা সত্ত্বেও কোন ঝুঁকি নেতে চাননি তিনি, তাই মন্ত্রীদের যাওয়া আসা বিরোধীরা কখনোই নিজেদের বিরোধের দুরত্ব কমিয়ে ফেলতে পারে না। এসব অঞ্চলে ফরোয়ার্ড ব্লকের পরিচিতি আছে সুভাষ বোসের কল্যানে। গ্রামের চাষাভূষো মানুষ এখনও তাদের নেতাজীর পার্টি বলে মনে করে। সি পি আই, সমাজতন্ত্রী দলগুলোও কাজকর্ম করছে। পার্টি ভাগ হবার পর সি পি এম অধিকতর সক্রীয়। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে কেউ লড়াই করার অধিকার ছাড়তে রাজী নয়। নির্বাচনে যোগদান না করল জনসাধারণের কাছে পার্টির নাম বাঁচিয়ে রাখা যায় না–এরকম একটা বোধ এদের প্রত্যেকের। ফলে বিরোধী ভোট ভাগ হয়ে যাওয়া কংগ্রেসের পক্ষে চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার মত নির্বাচনে জেতা সহজ হয়।

কিন্তু এবার উপ নির্বচান বলেই হোক কিংবা অন্য কোন কারণেই হোক বিরোধীরা মোটামুটি একটা সমঝোতায় এসে প্রার্থীদের সংখ্যা কমিয়ে এনেছে। মুশকিল হল যারা নমিনেশন পায় না তারা দল ছেড়ে নির্দল হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। সেটাও এবার এড়ানো গেছে। মোটামুটি দ্বিমুখী লড়াই বলা যেতে পারে। উপনির্বাচনটি ঘিরে তাই কর্মীদের মধ্যে বেশ উত্তাপ ছড়াচ্ছে। কলকাতা থেকে এসে অনিমেষ সেটা প্রথম দিনেই টের পেয়ে গেল। কিন্তু যারা নির্বাচন করবেন তারাই নিরুত্তাপ।

দাসপাড়ার পার্টি অফিসে বসে ওরা পরিকল্পনা করছিল। কলকাতা থেকে অনিমেষের সঙ্গে যারা এসেছেন তারা নির্বাচনের কাজে অত্যন্ত অভিজ্ঞ। লোকাল কমিটির সঙ্গে যৌথ দায়িত্ব নিয়ে প্রচারের কাজ চালিয়ে যাওয়া হবে। বিভিন্ন পরিকল্পনা হচ্ছিল। সৌমেন সেন বলে একজন প্রৌঢ় অনিমেষেদের নেতা। তিনি বললেন, ডোর টু ডোর ক্যাম্পেনেই ভাল ফল দেয়। যা সময় আছে তাতে এলাকাটা চষে ফেলা যাবে। কতগুলো গ্রুপে ভাগ হয়ে গিয়ে আমরা কাজে লাগতে পারি। মনে রাখতে হবে এখানকার সাধারণ মানুষের একমাত্র জীবিকা চাষবাস। তাই আমাদের কথাবার্তা জমি এবং চাষ দিয়েই শুরু করাই ভাল। আমি বলতে চাইছি ওদের সঙ্গে এমনভাবে কথা বলতে হবে যাতে ওরা আমাদের নিজেদের লোক বলে চিন্তা করে।

লোকাল কমিটির একজন সদস্য কথাগুলো শুনে হাসলেন, আপনি যা বললেন তা শুনতে ভাল লাগল। কিন্তু বাস্তবে বোধহয় এটা একদমই কাজ দেবে না। কারণ দরজায় দরজায় ঘুরলে কেউ আপনার সঙ্গে কথাই বলবে না। মোড়ল যা বলে দেবে তাই এদের কাছে শেষ কথা। মোড়ল দেখবে তাকে কোন দল কিরকম সুবিধে দিচ্ছে, তার ওপর সে নির্দেশ দেবে। সবচেয়ে মুশকিল হল এই মোড়লগুলোর বেশির ভাগই কংগ্রেসী।

সৌমেনবাবু বললেন, ব্যাপারটা হয়তো ঠিক কিন্তু পুরোটা নয়। কারণ গত নির্বাচনের ফল দেখে বোঝা যায় মোট ভোটের আটচল্লিশ শতাংশ পেয়েছে কংগ্রেস। তাহলে বায়ান্না শতাংশ বিরোধী ভোট গতবার ভাগ হয়েছিল। এই ভোট যারা দিয়েছিল তাদের সঙ্গে প্রথমে যোগাযোগ করতে হবে।

লোকাল কমিটির ভদ্রলোকটি বললেন, অঙ্কের হিসেব যে এখানে মিলবে না সেটা কাজ শেষ হলে বুঝতে পারবেন।
 
অনিমেষ সেটা প্রত্যক্ষ করল। নির্বাচনের কোন অভিজ্ঞতা তার ছিল না। এখনো সে নিজে ভোট দেয়নি। স্কটিশের হোস্টেলে থাকতে ভোটার লিস্টে তার নাম ওঠেনি। ভোটের দিনে ছেলেদের একটা মজার খেলা ছিল, কে কত জাল ভোট দিতে পারে তার ওপর বাজী ধরা হতো। অনিমেষ এখনো পোলিং বুথে ঢোকেনি। কিন্তু কলকাতা থেকে এখানে নির্বাচনের কাজে আসার সময় যে উৎসাহটা ওকে উত্তপ্ত করেছিল তা হল সাধারণ গ্রামের মানুষকে দেখা, জানা। কলকাতা শহরে নির্বাচনী প্রচার সে দেখেছে। পার্কে পৰ্কি গরম গরম বক্তৃতা, মাঝে মাঝে প্রার্থীর দল নিয়ে গলিতে গলিতে হাতজোড় করে ঘুরে যান। লোকে ঠিক করেই রাখে কাকে ভোট দেবে এবং তাই দিয়ে চলে আসে। গ্রামে নিশ্চয়ই তা হবে না। এখানে মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়ে যদি ভারতবর্ষের বর্তমান অর্থনৈতিক দুরবস্থার কথা, মানুষের বাঁচার অধিকার কোন পথে আসবে তার একটা স্পষ্ট ছবি যদি লাঙ্গল থেকে হাত নামানো চাষীদের বোঝানো যায় তাহলে সত্যিই কাজের কাজ হবে–এই রকম বিশ্বাস নিয়ে এসেছে। শহর দিয়ে গ্রাম নয়, গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরতে হবে। এবং তা করতে গেলে গ্রামের মানুষকে সচেতন করা অবশ্যই প্রয়োজন। এইসব থিওরিগুলোর বাস্তব রূপায়ণের এত সুন্দর সুযোগ পেয়ে খুব খুশি হল অনিমেষ। সৌমেনবাবু বুঝিয়ে দিলেন ঠিক কি কি কথা বললে কম্যুনিস্ট প্রার্থীর সমর্থনে ভোট পড়বে। প্রথমে অভুক্ত কঙ্কালসার মানুষের ছবিতে রাস্তাঘাট ছেয়ে ফেলা হল। ছবির তলায় বড় করে লেখা, আজকের ভারতবর্ষ–কে দায়ী? কিন্তু দুদিন বাদেই সেই পোস্টারগুলো উড়ে গিয়ে জুড়ে বসল ক্যালেন্ডারের মত গান্ধী নেহরু রবীন্দ্রনাথের ছবি; পাশে জোড়া বলদ। কলকাতায় প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো পরস্পরের পোস্টারগুলো বাঁচিয়ে রাখে সৌজন্যবশত, বোঝা গেল এরা তার ধার ধারে না। রেষারেষি শুরু হয়ে গেলে সেটা কিছুতেই থামতে চায় না, খুন–খারাপি অত্যন্ত সামান্য কথা।

পাকিস্তান সীমান্ত খুব কাছেই; আবার শিলিগুড়ির সঙ্গে দূরত্ব বেশি নয়। একটা বাস যাতায়াত করে দাসপাড়া–শিলিগুড়ির মধ্যে। পশ্চিম বাংলায় কলকাতার পর আধুনিক শহর বলতে শিলিগুড়িকেই বোঝায়। ব্যবসাকেন্দ্র এবং স্মাগলিং–এর কল্যাণে শহরটা কসমোপলিটন চেহারা নিয়ে ফেলেছে। অতচ তার চৌহদ্দী ছাড়ালেই যে গ্রামগুলো সেখানে এখনও প্রাৗগতিহাসিক চেহারা বর্তমান। একশ বছর আগেও যেভাবে জমি চাষ হতো, খাদ্যভাবে ভুগতো এবং সন্তান উৎপাদন করত, আজও তার হেরফের হয়নি। এদের কাছে শিলিগুড়ির সঙ্গে নুয়র্কের কোন ফারাক নেই। উত্তরবাংলার পাঁচটা জেলায় পাঁচটা সদর শহরেই যা কিছু রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ–তার আঁচ এদের গায়ে লাগে না। মানুষগুলোর চেহারা কুচবিহার জলপাইগুড়িতে মোটামুটি এক। রাজবংশী সম্প্রদায় মাটি থেকে ফলস তোলেন, চিরকালের অবহেলিত হয়ে আছেন ওঁরা। শহরের মানুষেরা এই সুযোগ নিয়ে ওদের নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করে। সরলতার শিকার হয়ে মানুষকে বিশ্বাস করে নিজেদের অন্ধকারকে আরো গাঢ় করা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই এখন। রাজবংশীরাই এখানকার মাটির মানুষ, এঁদের ভোটেই জেতা–হারা নির্ভর করে। জোড়াবলদের ওপর একটা আত্মিক টান আছে এঁদের। মোড়লদের নির্দেশ সেই টানকে আরো জোরালো করে।

শিলিগুড়ি ছাড়িয়ে ইসলামপুরের দিকে এলেই দুপাশের যে গ্রামগুলো তার চরিত্র আলাদা। পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুরা একটু একটু করে শিকড় গাড়ছে মাটিতে কিন্তু যারা সংখ্যায় ভারী এবং মাটির কর্তৃত্ব যাদের হাতে তাদের মেজাজটাও সবসসয় টানটান। মুসলমান সম্প্রদায়ের এই আধিক্যই গ্রামগুলোর চরিত একটু অন্যরকম করেছে। এঁরা যা বোঝেন তার বেশি বুঝতে চান না কিছুতেই। কংগ্রেসের বিকল্প কিছু এদের ভাবনাতে আসে না। পাশেই সীমান্ত ছাড়িয়ে পাকিস্তান কিন্তু সে ব্যাপারে এঁদের কোন ভাবপ্রবণতা নেই। অনিমেষের কাজ এদের সঙ্গেই, এই এলাকার মানুষদের প্রভাবিত করতে হবে কংগ্রেসের বিরদ্ধে ভোট দিতে।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top