হঠাৎ সরিৎশেখর দুহাতে মুখ ঢাকলেন। কিছুক্ষণ তার শরীরটা নিশ্চয় হয়ে রইল। জলপাইগুড়িতে ভরদুপুরের খরা রোদেও হাওয়া বয়। সেই হাওয়ায় দাঁড়িয়ে অনিমেষ নতুন চোখে দাদুকে দেখল। এই সেই সরিৎশেখর যিনি তার সামনে এতকাল বিশাল বৃক্ষের মত মাথা উঁচু করে ছিলেন। এখন তাকে এ অবস্থায় দেখতে কিছুতেই মন চায় না।
অনিমেষ বুকের গভীর থেকে ডাকল, দাদু!
সরিৎশেখর খানিকবাদে মুখ তুললেন। একবার সতর্ক চোখে চারপাশে তাকিয়ে নিলেন। হেমলতাকে ধারে-কাছে দেখতে না পেয়ে বললেন, বারান্দা থেকে টুলটা নিয়ে এস।
অনিমেষ সামনে বসলে সরিৎশেখর কিছুটা সামনে নিলেন, আমি আর পারছি না। এভাবে বেঁচে থাকতে আমি পারব না।
অনিমেষ নড়ে উঠল, কি হয়েছে আমাকে বলুন।
সরিৎশেখর একটা কালো পাথরের মূর্তির মতো বসেছিলেন। শুধু ওঁর ঠোঁট দুটো নড়ছিল, সারা জীবনে আমি কিছু পাইনি। দুবার বিয়ে করেছিলাম কিন্তু ভাগ্যে সইল না। বড় মেয়েটা সেই বাল্যকালে বিধবা হয়ে ঘাড়ে চেপে রইল। বড় ছেলে দুষ্টগ্রহের মত সারাজীবন আমার চারপাশে ঘুরছে। আর আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। তোমার বাবা আমাকে টাকা দেয় কিন্তু আমি বুঝি সে বাধ্য হয়েই দেয়। কারণ তার মনে একটা নরমভাব আমার সম্পর্কে আছে। কিন্তু আমার সমস্যা নিয়ে সে মাথা ঘামাতে চায় না। তার ভাইদের ব্যাপারে সে নাক গলাতে চায় না। ছোটজনের সম্পর্কে আমি কিছু ভাবি না। শুনেছি সে এখন মস্কোতে আছে।
সরিৎশেখর একটানা কথা বলে দম নিতে থামলেন।
অনিমেষ সোজা হয়ে বসল। ছোটকাকা প্রিয়তোষ এখন মস্কোতে? কথাটা সে জানত না। কম্যুনিজম শব্দটা যার জন্যে সে প্রথম শুনেছিল তিনি নাকি পরবর্তীকালে সম্পূর্ণ বিপরীত পথে হেঁটেছেন–এরকম কথা কানে এসেছিল। এতদিন কলকাতায় থেকেও ছোটকাকাকে সে দ্যাখেনি। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে খোঁজখবর নেয় কিন্তু তেমন উৎসাহ পায়নি। আবার এও শুনেছিল ছোটকাকা দিল্লিতে আছে। এখন দাদুর মুখে ছোটকাকার রাশিয়ায় থাকার খবর পেয়ে সব হিসেব গুলিয়ে গেল তার।
সরিৎশেখর বললেন, প্রিয় ইজ ডেড টু মি। যে ছেলে ওই অবস্থায় গিয়ে নিজের বাবাকে স্মরণ করে না। তার কোন অস্তিত্ব আমি স্বীকার করি না। ছোট মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলাম কিন্তু সারাজীবন সে শুধু অসম্মানের কারণ হয়ে থাকল। তোমার মাকে নিয়ে এসেছিলাম নিজে পছন্দ করে, সেও চলে গেল। সারাজীবন আদর্শ নিয়ে কঠোর মানুষ হয়ে কাটিয়ে এই সব জুটলো। ধর্মকর্ম কোনদিন মানতে পারিনি। শান্তির জন্য সেখানে যাওয়া কাপুরুষতা বলে ভাবতাম। কিন্তু গত কয়েক বছরে আমি শেষ হয়ে গেছি। তোমার বাবা যে টাকা দেয় তাতে চলে না। এর কাছে ওর কাছে হাত পাতি। নিজেকে কেমন ভিখিরি মত মনে হয়। রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে শুনতে পাই কেউ অবাক হয়ে বলছে এই বুড়োটা এখনও বেঁচে আছে! এতদিন যেভাবে কাটিয়ে এসেছি এখন সেটা তাড়া করে বেড়ায় আমাকে। কেঁচোর মত থাকতে ইচ্ছে করে না একদম। আমার মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যাচ্ছে বুঝি তোমার জ্যাঠা যখন এসে জুড়ে বসেন তখন আমি প্রতিবাদ করতে পারি না। ভাবলাম নিজের শ্রাদ্ধ করে এলে শরীরের প্রতি জগতের প্রতি কোন মায়া থাকবে না। ভুল সব ভুল। অনিমেষ, আত্মহত্যা করতে পারব না, কিন্তু দীর্ঘজীবন বেঁচে থাকার মত পাপ আর কিছু নেই।
অনিমেষ এতক্ষণে শক্ত হয়ে গেছে। অজান্তেই নিজের ঠোঁট কামড়াচ্ছিল সে। দাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, কুষ্ঠরোগ একটা বাহানা?
ঘাড় নাড়লেন সরিৎশেখর, কাজ হয়েছে খুব। যেই শোনে আমার কুষ্ঠ হয়েছে সঙ্গে সঙ্গে দুদ্দাড় করে পালিয়ে যায়। তোমার জ্যাঠামশাই আর কাছ ঘেঁষছে না। ছোট পিসী আসবে না যদ্দিন বেঁচে আছি। শুধু তোমার বাবা মনে হয় কথাটা আধা বিশ্বাস করেছে। প্রতি সপ্তাহে আসে, আমার আপত্তি বলে কাছে আসে না। শহরের লোকজন প্রায় একঘরে করে দিয়েছে আমাকে। যতই আধুনিক হোক, মানুষ যখন কল্পনা করে নিজের শরীরের মাংস খসে খসে পড়ছে তখন সব আধুনিকতা ফুস করে উধাও হয়ে যায়। আমাকে এখন কেউ বিরক্ত করে না। আমার যা কিছু অভাব তাই নিয়ে একা একা চুপচাপ বসে থাকি। শুধু তোমার পিসীমাকে ঠকাতে আমার খারাপ লাগছে। মেয়েটা আমার যাই হোক আমাকে ছেড়ে যাবে না। কুষ্ঠ বলে সে আমলই দেয় না।
অনিমেষ অবাক হয়ে গেছিল। এভাবে কোন মানুষ নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে কখন! কেন? এইসময় হেমলতা বড়বড় করে বারান্দায় চলে এলেন, একদম ভুলে গেছি। হ্যারে তুই খেয়ে এসেছিস?
কেন বলুন তো?
না হলে আবার রান্না শুরু করি। শুধু সেদ্ধভাত ছাড়া আমরা কিছু খাই না। গোয়ালাটা যা বাজার করে দেয়–।
একটা বেজে গিয়েছিল খেয়াল আছে। এখন অনেক বেলা হয়ে গেছে। অনিমেষের ভেবে নিতে একটুও সময় লাগল না। পিসীমা যদি রান্না শুরু করেন তাহলে ওঁর নিজের খেতে হয়ত সন্ধ্যে হয়ে যাবে। সে স্বচ্ছন্দে বলল, আমি শুধু স্নান করব। আসার সময় খেয়ে এসেছি।
ঠিক বলছিস তো অনিবাবা?
অনিমেষ হাসল, ঠিক বলছি। আপনি চিন্তা করবেন না।
বেশ। তাহলে স্নান করে একটু বাতাসা দিয়ে জল খাস। স্নানটা করে নে বরং। গল্প করতে করতে বাবার আর খেয়াল নেই আসুন খাবেন।
অনিমেষ চমকে উঠল, এখনও খাওয়া হয়নি?
হবে কি করে? সকালে একটু সুজি দিয়ে দুধ দিয়েছিলাম তাই খেয়েই তো পেট ঢাক হয়ে আছে। সারাদিনে একবারই তো ভাত খায়, তাও এই সময়। কই আসুন, আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে। হেমলতা ডাকলেন।
সরিৎশেখর কোনরকমে উঠে দাঁড়ালেন। অনেকটা বেঁকে গেছেন এরই মধ্যে। হাঁটতে গিয়ে টলে গেলেন সরিৎশেখর। অনিমেষ চট করে তাকে ধরে ফেলে ধীরে ধীরে রান্নাঘরের দিকে হাঁটিয়ে আনছিল। সরিৎশেখর ফিস ফিস করে বললেন, মনে রেখ আমার কুষ্ঠ হয়েছে। অনিমেষ হাসল।
বারান্দার এক কোণায় টেবিলে খাবারের ব্যবস্থা। ধরে ধরে ওঁকে সেখানে তুলে দিতেই একই স্বরে বললেন, মাঝে মাঝে এক একটা দুপুর উপোস দেওয়া ভাল, ওতে শরীর সুস্থ থাকে।
অনিমেষ এবার আর হাসতে পারল না।
স্নান সেরে বাইরে বেরোতেই মনে হলো পেটের মধ্যে আগুন জ্বলছে। অথচ এখন আর খাওয়ার কথা বলা চলে না। চুল আঁচড়ে সে রান্নাঘরের সামনে আসতেই দৃশ্যটা চোখে পড়ল। চামচে করে দাদু ভাত মুখে দিচ্ছেন আর পিসীমা একটা হাতপাখা নিয়ে বাতাস করতে করতে পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। হঠাৎ একটা ঢোঁক গিলতে গিয়ে দাদু কাশতে শুরু করলেন। সমস্ত শরীর বেঁকে চুরে একাকার, চোখ উলটে যাচ্ছে। পিসীমা দুহাতে বুক মালিশ করতে করতে বিড় বিড় করতে লাগলেন। অনিমেষ ভয় পেয়ে একলাফে দাদুর সামনে গিয়ে হাজির হল। সরিৎশেখরের সামনে বড় বাটিতে ভাত ডাল আর একটা তরকারিগোছের কিছু গুলে একেবারে কাই করে দেওয়া হয়েছে। বোঝা যাচ্ছে শক্ত কিছু খেতে অসুবিধে বলে দাদুর জন্যে এই ব্যবস্থা। কিন্তু তাও তো গলায় আটকে গেছে ওঁর। একটু সামলে ঘাড় নেড়ে দাদু উঠে পড়লেন। তারপর এগিয়ে বেসিনে ঝুঁকে পিসীমার দেওয়া জলে মুখ ধুতে লাগলেন। অনিমেষ কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতেই বমির শব্দ শুনতে পেল। হুড়হুড় করে এতক্ষণের কষ্টের খাওয়া বেসিনে উগরে দিলেন সরিৎশেখর। অনেকটা শ্লেষ্ম খাবারের সঙ্গে বেরিয়ে যাওয়ার পর যেন খুব আরাম হল ওঁর। পিসীমার গলা শোনা গেল, আঃ এতক্ষণে যা খেলেন সব বমি করে দিলেন। ছি ছি ছি। এই করলে শরীর টিকবে? দেখলি অনিবাবা, কান্ডটা দেখলি?
তোয়ালেতে মুখ মুছে সরিৎশেখর আবার বাইরে এসে বসলেন। অনিমেষ দেখল দাদু এখনও হাঁপাচ্ছেন। কাছে গিয়ে বসতেই হাসবার চেষ্টা করলেন। অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, এখন কেমন বোধ করছেন! দাদু পেট তারই মতো শূন্য ভাবতে অস্বস্তি হচ্ছিল।
ভাল। পেটে কিছু পড়লেই খারাপ বোধ হয়।
একটা প্লেটে বাতাসা আর জল নিয়ে পিসীমা সামনে দাঁড়াতেই অনিমেষ খেয়ে নিল। অত্যন্ত সামান্য; কিন্তু খেয়ে নিতেই খিদে বোধটা চাপা পড়ে গেল। পিসীমা জিজ্ঞাসা করল, কদিন ছুটি তোর?
পূজোর কটা দিন থাকব।
পূজো তো দুদিন বাকি। তা এখানে থাকবি না স্বৰ্গছেঁড়ায় যাবি?
আজ একটু ওখান থেকেই ঘুরে আসি।
সেই ভাল। আমি আজকাল আর মাছ ডিম রাঁধতে পারি না। এইরকম নিরামিষ ঘ্যাট তোর একদম ভাল লাগবে না।
পিসীমা চলে যেতে দাদু বললেন, মানুষ সবসময় প্রিয়জনকে আঁকড়ে ধরতে চায়। কিন্তু একা একা থাকতে থাকতে একটা সময় আসে যখন অন্যলোকের ছায়াও সহ্য হয় না।
অনিমেষ বুঝতে পারল। পিসীমা–দাদুর এখনকার যে জীবন তা তাদের সুবিধে-অসুবিধে নিয়ে নিজেদের মত করে তৈরি। সেখানে একদিনের জন্য এসে দাঁড়ালেও সেই নিয়মটা ওদের পালটাতে হবে। আর তার পরে যখন আবার ওঁরা একা হয়ে যাবেন তখন এই পালটানো নিয়মটার কথা ভেবে ওঁরা কষ্ট পাবেন। তার চেয়ে স্বর্গছেঁড়ায় চলে যাওয়াই উচিত।
অনিমেষ দেখল দাদু ওর দিকে অদ্ভুত শান্ত মুখে চেয়ে আছেন। হঠাৎ যেন তার মাথায় একটা চিন্তা ছিটকে এল। সে বলল, মাঝে মাঝে একটা দুপুর উপোস দেওয়া ভাল, এতে শরীর সুস্থ থাকে।
কথাটা শুনে সরিৎশেখর চমকে উঠলেন। তারপরই সরু গলায় হো হো করে হাসতে লাগলেন। হেমলতা অনেকদিন পরে বাবার গলায় হাসি শুনে ছুটে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, কি হল, হঠাৎ হাসছেন যে?
হাসি না থামিয়ে ঘাড় নেড়ে সরিৎশেখর বললেন, ও তুমি বুঝবে না।
তিস্তার ওপর সুন্দর ব্রীজ তৈরি হয়ে যাওয়ায় জলপাইগুড়ি থেকে স্বৰ্গছেঁড়া মাত্র এক ঘণ্টায় পৌঁছে যাওয়া যায়। বাষট্টি সালের পর থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার জন্যেই রাস্তাগুলো চওড়া এবং ঝকঝকে চেহারা নিয়ে সীমান্ত অবধি চলে গেছে। স্কুলে পড়তে অনিমেষ দেখেছিল বসার জায়গা না থাকলে কেউ বাসে উঠতো না। আর এবার দেখল ছাদেও লোক বসেছে। শহরের মধ্যে উঠেছিল বলে সে কোনক্রমে জায়গা পেয়েছিল বসার, এখন মানুষের চাপে নিঃশ্বাস বন্ধ হবার যোগাড়। কিন্তু গাড়িটা ছুটছে খুব দ্রুত, এখানেই কলকাতা থেকে ফারাক।
ডুয়ার্সে লোক বাড়ছে। মদেশিয়া, নেপালী বা রাজবংশী নয়, ভাষা থেকেই বোঝা যায় পূর্ববাংলার মানুষেরা এখানে স্থায়ী বসতি করেছেন। ক্রমশ সংখ্যায় বেড়ে যাচ্ছেন। তারা কথাবার্তা আচারেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। একটা সময় আসবে যখন উত্তরবাংলার সঙ্করসংস্কৃতি গড়ে উঠবে, যার সঙ্গে পূর্ব বা পশ্চিমবাংলার কোন মিল থাকবে না।
জনসংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু জলপাগুড়ি শহর, তিস্তার ব্রীজ ছাড়ালেই দুধারে ফাঁকা মাঠ আর জঙ্গল। কচিৎ কখনো খড়ের চালের ঘর বা দূরে ছোট গ্রামের ইশারা, ময়নাগুড়ির আধাশহর এলাকাটুকু ছাড়ালে এই দৃশ্য পালটাবে না। আর ধুপগুড়ির পরই কেমন একটা পাহাড়ী গন্ধ নাকে আসে। গাছপালার চেহারাও পালটে যায়। ডুডুয় নদী ছাড়ালেই দুপাশে জঙ্গল ঘন হয়ে অন্ধকারে হারিয়ে যায়। মাঝখানের চওড়া হাইওয়ে দিয়ে বাস যখন ছোটে তখন ঝিঁঝির শব্দ কানে আসে। দেখতে দেখতে অনিমেষের মনে হচ্ছি, এই জায়গাগুলোর অদ্ভুত একটা নির্জন চেহারা আছে কিন্তু খুব শীগগীর মানুষ তা নষ্ট করবে। যেভাবে ডুয়ার্সে জনসংখ্যা বাড়ছে এরা আর নির্জন থাকবে বলে মনে হয় না। নিজের প্রয়োজন মেটাতে মানুষ অত্যন্ত নির্মমত হতে পারে। যদি জানা যেত গোলাপের কুঁড়ি সুখাদ্য তাহলে আমরা কখনই একটা ফুটন্ত গোলাপকে দেকতে পেতাম না।
এই মাঠ জঙ্গল ঝরণাগুরো চিরকাল একই রকম চেহারা নিয়ে রয়েছে। ভারতবর্ষ স্বাধীন হবার পর এতগুলো সরকার এলো গেলো কিন্তু এই জায়গাগুলোকে দেশের জন্যে ব্যবহার করার কথা কারো খেয়ালই হল না। ফলে এখানকার বিভিন্ন গায়ে ছড়িয়ে থাকা গরীব রাজবংশীদের জীবন সেই অন্ধকূপে আটকে আছে। সে যেন গতকাল ভোট ভিক্ষে করতে গিয়েছিল, এদের কাছেও ভোটের বাবুরা পাঁচ বছরে একবার আসে, স্বপ্ন দেখায়, তারপর কাজ মিটিয়ে চলে যায়। কলকাতার আশেপাশের গ্রামগঞ্জ পশ্চিমবাংলাকে যা দিতে পারে ডুয়ার্সের এই অবহেলিত জায়গাগুলো তার চেয়ে অনেক বেশি দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু সরকার যেমন এ ব্যাপারে উদাসীন তেমনি এখানকার মানুষরাও দেশ এ নিজেদের সম্পর্কে নিস্পৃহ। কিন্তু একটা সময় আসবেই যখন এই নিঃস্ব মানুষগুরো জ্বলে উঠবে, তখনই আস্থা পালটাতে পারে।
আংরাতাসা নধী পেরিয়ে এসে রাস্তাটা বাঁক নিতেই বুকের ভেতরটা আচমকা হালকা হয়ে গেল। খুব শান্ত একটা আরামবোধ তির তির করে সমস্ত শরীরে জুড়ে বসলো। অনিমেষ বা দিকের দিগন্ত ছোঁয়া চায়ের গাছগুলোর দিকে তাকালো। এখন বিকেল। শেষ আলোর রঙে এক ধরনের মায়া জড়ানো থাকে। দূরের খুটিমারী জঙ্গলের মাথায় নেমে আসা সূর্যের দিকে তাকালে সেই মায়াটাকেও যেন স্পর্শ করা যায়। স্বৰ্গছেঁড়া চা বাগানের ফ্যাক্টরীর ছাদ চায়ের গাছের মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সেই আলো মেখে। রাস্তায় এখন ঘরে ফেরা কুলিকামিনের ভিড়। অনিমেষ ভিড় বাঁচিয়ে কোনরকমে উঠে দাঁড়াল।
বুকের অ্যালবাম থেকে উঠে আসা ছবির মত কোয়ার্টারগুলো দাঁড়িয়ে, কোথাও সামান্য পরিবর্তন হয়নি। এই বিকেলে মনে হচ্ছে কেমন একটা ঝিমুনি চারদারে। সামনের ফাঁকা মাঠে চাপা ফুলের গাছ দুটো প্রায় নিষ্পত্র হয়ে দাঁড়িয়ে। এখন কি আর ছেলেমেয়েরা ওই মাঠে খেলে না? রাস্তা থেকে নামতেই ওদের বাড়ির সামনে যে পাতাবাহারের গাছগুলো গার্ড অফ অনার দেবার মত দাঁড়িয়ে থাকতো তারা অনেককাল আগেই উধাও। এখন কেমন ন্যাড়া ন্যাড়া লাগছে চারধার।
বারান্দায় উঠে দরজা বন্ধ দেখে সে মত পালটালো। একটু ঘুরে বাগানের টিনের দরজা খুলে ভেতরের উঠোনে ঢুকল। কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। এদিকের লিচুগাছগুলো বেশ ঝাঁকড়া হয়ে গেছে। উঠোন পরিষ্কার, তুলসীতলাটা নিকানো। কয়েক পা এগোতেই অনিমেষ থমকে দাঁড়াল। সেই বুড়ো কাঁঠালগাছটা নেই। ঝাড়ি কাকুর মুখে শোনা অদেখা ঠাকুরমাদের স্মৃতিজড়ানো ওই রসালো ফলের গাছটাকে না দেখে বুকের ভেতর কেমন হু হু করে উঠল। তার নিজের শৈশবে ওই গাছ যেন স্বপ্নের মত ছিল। মাটির তলায় কাঁঠাল পাকতো যখন তখন সেটাকে খুঁড়ে বের করতে কি মজাই লাগতো। গাছটা যেন তার সঙ্গে লুকোচুরি খেলত। অনিমেষের মনে হল, এই বাড়ি থেকে তার ভাললাগার স্মৃতিগুলো একটা একটা করে এইভাবে সরে যাবে। মন খারাপ হয়ে গেল ওর।
উঠোন ধরে একটু এগোতেই রান্নাঘর চোখে পড়ল। দরজা খোলা। একটা বাচ্চা মদেশিয়া ছেলে পা ছড়িয়ে বসে কাঠ ঠুকরো করছে। একে আগে কখনো দ্যাখেনি অনিমেষ। তাকে দেখতে পেয়ে ছেলেটা বিস্মিত হয়ে গলা তুলল, মাইজি!
ছোটমার গলা ভেসে এল, কি রে!
ছেলেটা বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে অনিমেষের দিকে। বোধহয় কি বলবে ঠিক করতে পারছে না। অনিমেষ তাকে সুযোগ দিল না, কণ্ঠস্বর ভারী করে বলল, একটু বাইরে আসুন।
কয়েক মিনিট নীরবে চলে গেল। তারপরে রান্নাঘরের দরজার আড়ালে ছোটমায়ের শরীরের অর্ধেকটা দেখা গেল। মাথায় ঘোমটা টেনে দেওয়া হয়েছে এরই মধ্যে, গলা থেকে স্বরটা বেরিয়ে পড়েছিল কে?
অনিমেষ হাসতেই মাথা থেকে কাপড় সরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল ছোটমা, ওমা তুমি! কি আশ্চর্য! কোত্থেকে এলে? গলা শুনে আমি একদম চিনতেই পারিনি। ওরকম করে কথা বলতে হয়। আমি ভাবলাম কে এমন হুট করে ভেতরে ঢুকে পড়ল! একটানা কথাগুলো বলে ছোটমা। অনিমেষ ছোটমাকে দেখছিল। একটা মানুষের চেহারা এত দ্রুত পালটে যেতে পারে! গোলগাল মুখ, শরীর বেশ ভারী, মাথার সামনের দিকের চুল একটু হালকা দস্তুরমত গিন্নীগিন্নী ভাব এখন। সেই রোগাটে অল্পবয়সী শরীরটা একদম হারিয়ে গেছে।
এই, মায়ের সঙ্গে ইয়ার্কি? তারপরই গলা পালটে বলল, খুব মোটা হয়ে গেছি, না? বিশ্রী দেখাচ্ছে?
উঁহু, এতদিনে তোমাকে মা মা দেখাচ্ছে। কথাটা বলার সময়েই অনিমেষের খেয়াল হল ছোটমার কোন ছেলেপুলে হয়নি।
যাক, বাঁচা গেল। তাহলে এখন একটু মান্যিগন্য করবে। কিন্তু নিজের চেহারাটা কি আয়নায় দেখা হয়? কী ছিরি হয়েছে!
কেন? খুব খারাপ দেখতে লাগছে?
রোগা, মাথায় বাবুই পাখীর বাসা, মুখে একরাশ জঙ্গল। খেতে পাও না নাকি? এই চেহারা নিয়ে তুমি দেশের কাজ করবে?
দেশের কাজ? অনিমেষ চমকে উঠল, এ খবর তোমাকে কে দিল?
ছোটমা বলল, বলছি, আগে বারান্দায় উঠে আরাম করে বসো, হাত মুখ ধোও। তোমার বাবা বলল, এবার আসবে না তুমি, কিন্তু আমার মন বলছিল ঠিক আসবে। দ্যাখো কেমন মিলে গেল! আঃ দাঁড়িয়ে রইলে কেন?
হাতমুখ ধোওয়ার পর ভেতরের বারান্দায় বসে মুড়ি–মুড়কি দিয়ে চা খেতে খেতে অনিমেষ ছোট মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সব কথা শুনল। তার কাজকর্মের কথা এখানে পৌঁছে গেছে। এমনকি অ্যারেস্টেড হয়ে থানায় যাবার গল্পও। নীলার বাবাই জানিয়েছেন এখানে। সে চিঠি পাবার পর থেকে মহীতোষ নাকি খুব গম্ভীর হয়ে গেছেন। ছোটমা বলল, আমার সঙ্গে তো কোনদিন মন খুলে কথা বলেন না কিন্তু তোমার জন্য উনি খুব ভেঙ্গে পড়েছেন এটা বুঝতে পারছি। তোমার কি পড়াশুনা করার ইচ্ছে নেই? অনিমেষ তখন অন্য চিন্তা করছিল। দেবব্রতবাবুর সঙ্গে তার যোগাযোগ নেই অনেককাল। সে নিজে নীলাদের বাড়িতে যায় না আর উনিও ওর খোঁজখবর নিতে আসেন না। তাহলে এত খবর কোত্থেকে পেলেন উনি। নীলা এখন ইউনিভার্সিটিতে আসা ছেড়ে দিয়েছে। ফাইন্যাল পরীক্ষায় বসার আগে না এলেও চলবে তার। ওদের সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই অনিমেষের। তাহলে? নিজের অজান্তেই দেবব্রতবাবুদের ওপর রেগে গেল অনিমেষ।
ছোটমা আবার জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি পড়াশুনা করবে না?
অনিমেষ বলল, এম-এ পরীক্ষা দেব, তোমাদের কোন চিন্তা নেই।
ছোটমা মাথা নাড়ল, তাহলে তোমার বাবা এত ভাবছে কেন? এম.এ. পাস করলেই তো তুমি বড় চাকরি পেয়ে যাবে, তাই না?
নাও পেতে পারি।
কেন?
এদেশে এম. এ. পাসের চেয়ে চাকরির সংখ্যা কম, তাই।
আমি এতসব বুঝি না।
তোমাকে বুঝতে কে বলেছে। তারপর বল, তোমরা সব কেমন আছ? প্রশ্নটা করা মাত্র ছোটমায়ের মুখের আলো নিভে গেল। খুব বিষণ্ন গলায় জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি জলপাইগুড়ি হয়ে আসছ?
কেন?
তোমার দাদুর–। ছোটমা ইতস্তত করল একটু, খুব খারাপ অসুখ হয়েছে। কারো সঙ্গে মিশছেন না। দিদি লোকজনকে ধরে বাজার করায়। তোমার বাবা রবিবারে দেখা করতে যান। তোমার দাদু ওনার সঙ্গেও কথা বলেন না। খুব মন ভেঙ্গে গেছে তোমার বাবার। ভেবেছিলেন তোমাকে চিঠিতে জানাবেন, তারপর–।
ঠিক এইসময় বাইরের দরজায় শব্দ হল। সঙ্গে সঙ্গে ছোটমা উঠে দাঁড়ালেন, উনি এসে গেছেন। শোন, উনি বকাবকি করলে চুপ করে থেকো, মানুষটা খুব অশান্তিতে আছে।
দ্বিতীয়বার শব্দটা হতেই ছোটমা দ্রুত ছুটে গেলেন। চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। অনিমেষ উঠে দাঁড়াল। মহীতোষের সঙ্গে এবার মুখোমুখি হতে হবে কিন্তু কোনরকম আড়স্টতা বোধ করছে না সে।
ঘরের ভেতরে জুতোর শব্দ এবং ছোটমায়ের চাপা গলা শুনতে পেল অনিমেষ। মহীতোষের গলা শোনা যাচ্ছে না। মিনিট কয়েক পরে মহীতোষ খালি পায়ে বারান্দায় বেরিয়ে আসতেই অনিমেষ কাছাকাছি হল। ছেলের দিকে এক পলক তাকিয়ে মহীতোষ জিজ্ঞাসা করলেন, কখন এলি?,
মিনিট কুড়ি হবে।
এখন তো ট্রেন ছিল না, জলপাইগুড়ি হয়ে এলি?
হুঁ।
শুনেছিস?
হুঁ।
আমি গেলে আমার সঙ্গেও দেখা করেন না। একমাত্র বড়দি ছাড়া কথা বলার কেউ নেই। প্রথমে চিকিৎসা নিজেই করাতে গিয়েছিলেন, এখন তাও ছেড়ে দিয়েছেন। আমি কি করব বুঝতে পারি না। চোখের সামনে আত্মহত্যা করছেন উনি, আমি পাগল হয়ে যাব। মহীতোষ একটা মোড়া টেনে নিয়ে বসলেন। অনিমেষ দুহাত বুকের উপর ভাঁজ করে দরজার পাশে দাঁড়িয়েছিল। ছোটমা ভাঁড়ার ঘরে বসে লনঠন জ্বালছেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ কেটে গেল। স্বৰ্গছেঁড়ায় সন্ধ্যে নেমে গেছে। পাতলা তুলোর মত আঁধারে বসে থাকা মহীতোষের দিকে তাকিয়ে অনিমেষের ছটফটানি শুরু হয়ে গেল। ঝড়ে বিধ্বস্ত গাছের মত লাগছে ওকে। ভাবভঙ্গিতে সেই তেজ একদম নেই। কেমন ম্রিয়মান হয়ে বসে আচেন মাথা সামান্য ঝুঁকিয়ে। ছোটমায়ের আশঙ্কামত দেবব্রতবাবুর চিঠি পেয়ে অনিমেসের ওপর ক্ষিপ্ত হবার কোন প্রকাশ এখনও দেখা যাচ্ছে না। বাবাকে এমন করে ভেঙ্গে পড়তে দেখে অনিমেষের খারাপ লাগছিল। মহীতোষ এর মধ্যে বেশ রোগা হয়ে গেছেন, মাথার চুল প্রায় সাদা।
দেখা করেনি নিশ্চয়।
মহীতোষের বলার ধরনে প্রথমে ঠাওর করতে পারেনি অনিমেণ, কে?
তোর দাদুর কথা বলছি।
ও। হ্যাঁ, হয়েছিল। অনিমেষ কথাটা বলতেই মহীতোষ ঘুরে ছেলের দিকে তাকালেন। অনিমেষ টের পেল ছোটমাও সঙ্গে সঙ্গে লণ্ঠনটা হাতে নিয়ে ভাঁড়ার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালেন। অনিমেষ এক পলক চিন্তা করল সত্যি কথাটা বলবে কিনা। দাদু যে আড়াল করে নিজেকে রেখেছেন সেটার কোন যুক্তি নেই। কিন্তু প্রত্যেকটা মানুষের নিজের মতন করে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। দাদু যদি ওভাবে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখে শান্তি পান–। সঙ্গে সঙ্গে আবার মনে হল ওভাবে কি শান্তি পাওয়া যায়? এও কি একরকম আত্মহত্যা নয়? দাদু অবশ্য তাকে নিষেধ করেছেন কারো কাছে ফাঁস করতে কিন্তু সেটা মান্য করার অর্থ হল দাদুকে আত্মহননে সাহায্য করা। সঙ্গে সঙ্গে এও মনে হল বাবা যেভাবে ভেঙ্গে পড়েছেন তাকে সাহায্য করা অবশ্যই কর্তব্য।
মহীতোষ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন, তার মুখের ওপর ছোটমার হাতে ধরা লণ্ঠনের আলো কাঁপছে। অনিমেষ খুব ধীরে ধীরে বলল, দাদু খুব কষ্টে আছেন।
শরীর কেমন দেখলি? লেপ্রসির চিহ্ন–। কথাটা মেষ করে উঠতে পারলেন না মহীতোষ। ওঁর গলায় কান্না এসে গেছে বুঝতে পারল অনিমেষ।
কয়েক পা এগিয়ে বাবার মুখোমুখি আর একটা মোড়ায় বসল অনিমেষ। তারপর বলল, দাদুর কষ্ট আপাতত অর্থের। তুমি যা দাও তাতে কলোয় না। জ্যাঠামশাই, ছোট পিসীমা তো আছেনই, আমরাও বোধহয় ওঁকে শান্তিতে থাকতে দিতে পারিনি। জানি না। আমি তো ছেলে হিসাবে কখনো কর্তব্যে ত্রুটি করিনি। তোকে টাকা পাঠিয়ে সাধ্যের মধ্যে যতটা সম্ভব ওকে দিই। কিন্তু প্রয়োজন হলে আমার কাছে চাননি কেন? মুখেটুকে ঘা দেখলি?
না। কারণ ওঁর লেপ্রসি হয়নি।
অনিমেষের কথা শেষ হতেই মহীতোষ একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠলেন। ছেলের কথাটা যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না তিনি। দুটো চোখ বড় হয়ে গেছে, মুখ হাঁ। ছোটমা লণ্ঠনটা মাটিতে নামিয়ে রেকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি বলছ?
এবার অনিমেষ সমস্ত কথা খুলে বলল। দাদুর বাড়িতে যাওয়ার পর যা হয়েছিল সব। ভেবেছিল এসব শুনলে ছোটমা এবং বাবা স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলবেন। কিন্তু তার বদলে সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার ঘটল। মহীতোষ শিমুর মত কাঁদতে আরম্ভ করলেন। দুহাতে মুখ ঢেকে তার ফোপানি সামলাতে পারছিলেন না। ছোটমা আস্তে আস্তে বারান্দা থেকে নেমে রান্নাঘরে চরে গেলেন। বেশ কিছুক্ষণ বাদে মহীতোষ শান্ত হলেন। কিন্তু অনিমেষ বুঝতে পারছিল এখনও বলার মত মনের অবস্থা তার হয়নি। ব্যাপারটা ঘোরাতেই সে বলল, দেবব্রত বাবুর চিঠি পেয়েছে?
কার? অন্যমনস্ক গলায় প্রশ্ন করলেন মহীতোষ।
দেবব্রতবাবুর।
ও হ্যাঁ।
কিন্তু তারপর আর কোন কথা নেই। অনিমেষ ভেবেছিল একথা মনে পড়লেই মহীতোষ ওর ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবেন, কিন্তু এমন নিরুত্তাপ আচরণের কোন কারণ খুঁজে পেল না সে। দুজনে চুপচাপ বসে আছে, কথা খুঁজে পাচ্ছে না অনিমেষ, অস্বস্তি হচ্ছিল। হঠাৎ মহীতোষ বললেন, ওঁর মেয়ের সঙ্গে তোর দেখা হয়?
বেশ কিছুদিন দেখা হয়নি কেন?
তুই ওদের বাড়ি যাস না?
সময় পাই না।
মেয়েটি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। এমন একটি ছেলেকে বিয়ে করেছে যে মোটেই ওর যোগ্য নয়। দেবব্রতবাবুর সঙ্গে এ নিয়ে খুব ঝগড়া হয়েছে ওর, তিনি মেয়ের মুখ দর্শন করবেন না বলে জানিয়েছেন।
নীলা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেছে? অনিমেষ যেন আকাশ থেকে পড়ল। নীলার মত প্র্যাকটিক্যাল মেয়ে এমন কাজ করল! তাহলে নিলা মোটেই প্র্যাকটিক্যাল ছিল না, ভান করত! কয়েকদিন আগে শচীন ওর সম্বন্ধে কিছু কথা বলতে চেয়েছিল, তা কি এই ব্যাপারটাই। কাকে বিয়ে করল নীলা? অনিমেষ হতভম্ব হয়ে গেল।
মহীতোষ নিজের মনেই বললেন, ছেলেমেয়েদের ওপর যদি ভরসা না রাখতে পারি তাহলে বেঁচে থাকব কি জন্যে? দেবব্রতবাবু মেয়েটাকে মনের মত করে গড়তে চেয়েছিলেন যাতে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে কিন্তু তার বদলে কি পেলেন? সাবালক হলে প্রত্যেকের নিজের মত চলার স্বাধীনতা আছে কিন্তু সেই সঙ্গে মনে রাখা উচিত, যারা তাকে ঘিরে এতদিন স্বপ্ন দেখে এল, তাদের প্রতি একটা দায়িত্বও রয়েছে। তোর জ্যাঠামশাই বা কাকা সেটা মনে রাখেনি কিন্তু আমার পক্ষে তো এড়ানো সম্ভব হয়নি।
অনিমেষ বুঝতে পারছিল এসব কথা তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা। কোন কারণে মহীতোষ তাকে সরাসরি প্রশ্ন করতে পারছেন না। কারণটা কি সেটা বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু স্পষ্ট ভাষায় সতর্ক করে দিচ্ছেন উনি। নীলার ব্যাপারটায় এতখানি অবাক হয়ে গিয়েছিল অনিমেষ যে কিছুই ভেবে উঠতে পারছিল না। চুপচাপ সে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বসে থাকল। এর মধ্যে একসময় মহীতোষ উঠে বাথরুমে গেছেন। অন্ধকারে চোখে রেখে অনিমেষ বুঝতে পারল একটা বয়স হলে খুব নিকট সম্পর্কগুলোর মধ্যে ছোট বড় দেওয়াল তৈরি হয়ে যায়। তখন পরস্পরকে স্পর্শ করা মুশকিল হয়ে পড়ে। দাদু পিসীমা যে বিচ্ছিন্ন জগতে বাস করছেন তার সঙ্গে বাবা এবং ছোটমায়ের খুব একটা ফারাক এখন নেই। আর এবার আরো সত্য হল, তার সঙ্গে ওঁদের ব্যবধানটা অনেক বেড়ে গেছে। হয়তো বাবা কিংবা দাদু ঠিক একই জায়গায় রয়ে গেছেন কিন্তু সে নিজে এমন দূরত্বে চলে গেছে যে ব্যবধান কমানোর কোন উপায় নেই। কিন্তু এজন্যে কোনরকম দুঃখবোধ তার হচ্ছিল না। আবার নিষ্কৃতি পাওয়ার আনন্দ টের পাচ্ছিল না মোটেই।
রুটিনমত মহীতোষ তাসের আসরে চলে গেলে অনিমেষ ভেবেছিল ছোটমায়ের সঙ্গে বসে গল্প করবে। কিন্তু এই ছোটমাকে দেখার পর থেকেই সেই কৈশোরের ছেলে মানুষ মেয়েটাকে সে খুঁজে পাচ্ছিল না। এখন এই মহিলা অনেক গিন্নীবান্নি ধরনের, স্নেহপ্রবণা এবং বাবার সঙ্গে মোটামুটি ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছে ব্যাপারটা নিশ্চয়ই সুন্দর কিন্তু অনিমেষ ওর সঙ্গে আড্ডা মারার মেজাজটাকে খুঁজে পেল না। রাত বেশী হয়নি দেখে সে বাড়ি ছেড়ে স্বৰ্গছেঁড়া ঘুরতে বেরিয়ে পড়ল।
মাঠ পেরিয়ে বড় রাস্তায় আসতেই অনিমেষ টর্চের আলোগুলো দেখতে পেল। রাস্তার দুধারে ঝাকড়া লম্বা গাছগুলোর গায়ে নীচ থেকে আলো ফেলা হচ্ছে যাতে বাদুড় শিকার করা যায়। মদেষিয়া ছেলেদের এই কর্মটি সে ছেলেবেলাতেও দেখেছে এবং এখনও তার কোন পরিবর্তন হয়নি। এই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে অনিমেষের মনে হল পশ্চিবঙ্গে এখানে-ওখানে বিল্পবের যত কথাই হোক, কম্যুনিজমের বিভিন্ন ব্যাখ্যা এবং প্রচার যাই চলুক না কেন, সাধারণ মানুষের ভঙ্গুর এবং অন্ধ আর্থিকদীনতাপ্রসূত আদিম জীবন একটুও পালটায়নি। মাঝে-মাঝে হেললাইট জ্বালিয়ে ছুটে যাওয়া গাড়ির আলোয় ছেলেগুলোকে দেখতে পাচ্ছিল সে। হাতে গুলতি নিয়ে উর্ধ্বমুখ হয়ে রয়েছে।
এদিকে বিদ্যুৎ নেই কিন্তু ওপাশের স্বৰ্গছেঁড়া আলোয় ঝলমলে। চা বাগানের কোয়ার্টার, ছাড়িয়ে সে বাজার এলাকায় ঢুকল। চমকে যাওয়ার মত পরিবর্তন হয়েছে জায়গাটার। ঝকঝকে দোকানপাট, মাইকে চাপা স্বরে গান বাঝছে। এতরকমের দোকান স্বৰ্গছেঁড়ায় কখনো ভাবা যায়নি। হাঁটতে হাঁটতে চৌমাথায় চরে এল অনিমেষ। চারধার দিনের মত পরিষ্কার। স্বৰ্গছেঁড়া তার সেই রহস্যময় চেহারাটা হারিয়ে ফেলেছে। এখন একটা ছোট শহরের থেকে এর কোন প্রভেদ নেই। ব্যাপারটা ভাল কিংবা মন্দ সেটা পরের কথা কিন্তু ব্যক্তি চেহারা হারিয়ে গিয়ে যখন দলের মধ্যে কিন্তু ঢুকে পড়ে তখন এক ধরনের নিঃসঙ্গতা বোধ হয়।
পুরোন বন্ধু-বান্ধবদের খোঁজ করতে ইচ্ছে করছিল। ওরা কি আর রাস্তাঘাটে আড্ডা মারে না? এখনও তো রাত তেমন বেশি হয়নি। কয়েক পা এগোতেই থমকে গেল সে। তাদের পার্টির অফিস হয়েছে স্বর্গছেঁড়ায়। ওপরে পতাকা টাঙানো রয়েছে। অফিসঘরের সামনে রাস্তার ওপর কয়েকজন অচেনা মানুষ গুলতানি করছে। হঠাৎ অনিমেষের খেয়াল হল, সে কাউকে না জানিয়ে নির্বাচনী প্রচারকর্ম ছেড়ে চলে এসেছে। এই জন্যে তাকে নিশ্চয়ই কৈফিয়ত দিতে হবে। বলা যায় না পার্টিবিরোধী কাজের জন্যে তাকে বহিষ্কার করাও হতে পারে। বহিষ্কার কথাটা মনে হতেই সুবাসদার কথা মনে এল। সে তো ভেতরে ঢোকার অনুমতিই পায়নি তাই বহিষ্কার হবার যোগ্যতাও নেই তার। শুধু দলের হয়ে কাজকর্ম করতে তাকে আর দেওয়া হবে না। একদম না বলে-কয়ে চলে আসাটা অন্যায় হয়েছে। নিয়মশৃঙ্খলা অবশ্যই মেনে চলা উচিত। এই কারণে শাস্তি পাওয়া সঙ্গত। কিন্তু গতকাল রাত্রে মনে হয়েছিল এই নির্বাচনী প্রচার ব্যাপারটা পুরোটাই ভাওতা। কম্যুনিজমে যারা বিশ্বাস করে তারা কেন জনসাধারণের কাছে ভোটভিক্ষে করবে? প্রসববেদনার কথা কোন মেয়েকে কি স্মরণ করিয়ে দিতে হয়। কম্যুনিস্টরা যদি তাদের আচরণ এবং কাজকর্মে ওই মতবাদকে জনসাধারণের সামনে বিশ্বাসযোগ্যভাবে তুলে ধরতে পারে তাহলে নির্বাচনের সময় প্রচার করুক না কেন মানুষ নিজের প্রয়োজনেই কম্যুনিস্টদের ভোট দিতে আসবে। তা সম্ভব হচ্ছে না কারণ এ দেশের কম্যুনিস্টরা সাধারণ মানুষের বিশ্বস অর্জন করতে পারেনি।
পার্টি অফিসের সামনে ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনেকেরই নজর পড়েছিল। এমন সময় ভেতর থেকে নিজের নাম ভেসে আসতে শুনল অনিমেষ। তার পরেই বিশুকে দেখতে পেল দরজায়। চেহারাটা খুব খারাপ হয়ে গেছে বিশুর। পাজামা, হ্যান্ডলুমের পাঞ্জাবী পরায় মনে হচ্ছে একটা হ্যাঙারে সেগুলোকে টাঙিয়ে রাখা হয়েছে। অনিমেষ এগিয়ে গেলে বিশু জিজ্ঞাসা করল, কবে এলি?
আজই।
আয়, ভেতরে আয়।
ছোট ঘর, সতরঞ্জিও পাতা। একদিকে কিছু পোস্টার স্তূপ করে রাখা। দুতিনজন লোক একটা লিস্ট নিয়ে কাজ করছে। দেওয়ালে লেনিনের ছবি।
অনিমেষ বলল, এখানে পার্টির অফিস হয়েছে জানতাম না তো।
বিশু বলল, কি জানিস তোরা। শহরে থেকে গ্রামের খবর রাখিস?
ওদের ঘিরে আরও কয়েকজন এসে বসল। অনিমেষ বিশুর কথাটা গায়ে মাখল না। হেসে বলল, তুই পার্টি করছিস জানতাম না তো।
বিশু বলল, আবার বলতে পারতাম কি জানিস তোরা–! বলে হাসল, কিছু হল না, না পড়াশুনা না চাকরি, পার্টির কাজ করছি। একটা নিয়ে তো থাকতে হবে। তবে এটা করার জন্যে একটা উপকার হয়েছে। সুনীল পালের স-মিলে সামনের মাস থেকে জয়েন করব।
সুনীল পাল এ তল্লাটের একজন বিখ্যাত কাঠের ব্যবসায়ী। কিন্তু পার্টি করলে তিনি কেন চাকরি দেবেন সেটা বুঝতে পারল না অনিমেষ। বুঝিয়ে দিল বিশু, ওদের মিলে মারাত্মক ধরনের শ্রমবিরোধ হয়েছিল। শিবুদা, আমাদের রোকল কমিটির সেক্রেটারী, মিটিয়ে দেন। আজই এই প্রতিশ্রুতিটা পাওয়া যায়।
অনিমেষ বলল, কিন্তু এটা তো প্রতিক্রিয়াশীলদের ঘুষ।
বিশু বলল, প্রতিক্রিয়াশীল? বড়লোক হলেই প্রতিক্রিয়াশীল হবে! কি চিন্তা সব! তাছাড়া আমরা সমাযের চারধারে ছড়িয়ে পড়তে চাই। সেজন্যে কিছু কিছু এ্যাডজাস্টমেন্ট করতেই হবে। শুনেছি বিড়লা টাটাদের পি. আর.ও. যারা তারা এককালের পাকা কম্যুনিস্ট।
অনিমেষ নীচু গলায় বলল, তাহলে তোমরা নিজেদের প্রয়োজনে পার্টি করছ!
কে করছে না? সবাই করছে। আমরা পাঁক তুলবো আর নেতারা চাটনি খাবে? এদেশের মানুষ কখনোই কম্যুনিস্ট হবে না। তারা যেই নিজের স্বার্থে ঘা পড়ে পড়বে তখনি কম্যুনিজমকে বাতিল করবে এইরকম ঠুকঠাক করতে করতে যতটুকু এগোন যায় ততটুকুই ভাল।
বেনোজল চারধারে। অনিমেষ উঠে পড়তে চাইল। বিশু এত তাড়াতাড়ি ছাড়তে রাজী নয় তাকে। দরজায় দাঁড়িয়ে বাপির কথা জিজ্ঞাসা করল অনিমেষ। বিশু বলল, বাপি এখন বিগ বিজনেসম্যান। দশটা ট্যাক্সি, গোটা চারেক লরি। দুনম্বর করে লাল হয়ে গেছে। শালা এখন কংগ্রেসকে ব্যাক করে। আমরা চাইলেও পয়সাকড়ি দেয়। তুই কি কলকাতা থেকে এলি না জলপাইগুড়ি হয়ে–?
আমি দাসপাড়ায় এসেছিলাম ইলেকশনের কাজে।
ইলেকশন?
তোদের পার্টির হয়ে প্রচারের জন্যে।
গুরু, তুমি আমাদের লোক? শালা এতক্ষণ নকশা করছিলে? দুহাতে জড়িয়ে ধরল সে অনিমেষকে।
তবে ওখানে কংগ্রেসকে হারানো মুশকিল। কেমন বুঝলি? খুব অন্তরঙ্গ গলায় বলল বিশু।
আমি না বলে-কয়ে চলে এসেছি।
সেকি, কেন?
আমার মনে হয়েছে পার্টি যা করছে তার কোন ভিত্তি নেই।
সবকিছুর মানে থাকে নাকি? আমরা যদি ক্ষমতা পাই কোনোদিন তাহলে সুদে আসলে পুষিয়ে যাবে।
তাতে দেশের কি হবে?
একটু একটু করে পালটাবে। এই রাষ্ট্রনৈতিক কাঠামোয় এর চেয়ে বেশী কিছু আশা করাই অন্যায়। তুই চলে এসে ঠিক করিসনি। আখেরে নিজেরই ক্ষতি করলি। বিশু গম্ভীর হয়ে গেল।
সে-রাতে বাড়ি ফেরার পথে অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে এবং কিছুদিন পরে কলকাতামুখী ট্রেনের কামরায় বসে অনিমেষ একটা সিদ্ধান্ত নিল। আমরা যতই নানান ডিজাইনের বস্তু শরীরে চাপাই না কেন তাতে শনীরের কোন হেরফের ঘটে না। পোশাকের চমকে ও ঔজ্জ্বল্যে চোখে সুখ লাগে হয়তো কিন্তু যতক্ষণ না শরীরটাকে সুস্থ করা যায় ততক্ষণ অবস্থা অপরিবর্তিত থাকবেই। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো শুধু পোশাকের কথাই ভেবে যাচ্ছে। কিন্তু অন্য কিছু করার পথ কোথায়? কলকাতায় ফিরে গিয়ে পার্টির নেতাদের খোলাখুলি কথাগুলো বললে কেমন হয়! পরক্ষনেই মনে হল তারও কি দুপা এগোনো এক পা পিছিয়ে যাওয়া নীতি অনুসরণ করা উচিত নয়? এখন চুপচাপ দেখে যাওয়া সওয়া দরকার। সে যেমন পার্টির এই পথ মেনে নিতে পারছে না তেমনি ওর মত অনেকেই সেকথা ভাবতে পারে। তাই সময় এলে পথ পরিস্কার হতে বাধ্য। ফোড়া পেকে গেলে পুঁজ না বেরিয়ে থাকতে পারে? অতএব এখন অপেক্ষা করা দরকার। এইসময় সে পরীক্ষাটা দিয়ে দিতে পারে।
মহীতোষ তাঁকে একটুও গালমন্দ করেননি। এ-থেকেই বোঝা যায় তাকে পেছনে জড়িয়ে রাখার মত কেউ নেই। এই দেশে এম.এ. পাস করা নিতান্তই অর্থহীন, তবু কাউকে খুশী করার জন্যে আমাদের তো প্রতিনিয়ত অনেক অর্থহীন কাজ করে যেতে হচ্ছেই। এই যেমন পার্টি করছি এমন অহঙ্কার করা।
অনিমেষের মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থাকল বিমান। ঘরে সুদীপ ছাড়া আর কেউ নেই। এতক্ষণ গড়গড় করে কিছুটা মিথ্যে বলার পর অনিমেষ এখন ভেতরে ভেতরে নার্ভাস বোধ করছিল। এই সময়টার জন্যে সে মনে মনে অনেক রিহার্সাল দিয়ে আসা সত্ত্বেও বুঝতে পারছিল তার দেখানো কারণ খুব জোরালো নয়। বিমান সুদীপের দিকে তাকিয়ে বলল কি মনে হচ্ছে?
নেভা চুরুট দেশলাই কাঠি দিয়ে ঠিক করতে করতে সুদীপ বল, চট করে মনে হবে ও মিথ্যে কথা বলছে কিন্তু মফস্বলের ছেলেদের মানসিকতা বড় ঘোলাটে। দেশের কাছাকাছি গেলে সব রকম দায়িত্ব বিস্মৃত হতে ওদের বেশী সময় লাগে না।
বিমান বলল, অনিমেষ, আমি তোমার কথায় কোন লজিক খুঁজে পাচ্ছি না। দাসপাড়ায় বসে তুমি খবর পেলে তোমার দাদুর অসুখ হয়েছে এবং কাউকে কিছু না জানিয়েই জলপাইগুড়ি চলে গেলে। সেখানে এতদিন থাকলে অথচ আমাদের কাউকে একটা চিঠি দিয়ে ব্যাপারটা জানাতে পারলে না। প্রথম কথা, দাসপাড়ায় তোমাকে ওই খবর দেবার জন্যে কে বসে থাকবে? দ্বিতীয়ত, খবর পেলে তোমার টিমকে জানানোর সময় ছিল না এটা অবিস্বাস্য। তৃতীয়ত, জলপাইগুড়ি থেকে তুমি দাসপাড়ায় ব্যাক করতে পারতে কিংবা আমাকে চিঠি দিতে পারতে।
অনিমেষ নীচু গলায় বলল, আপনাকে তো বললাম, খবরটা শুনে আমি এমন আপসেট হয়ে গেলাম যে কারো সঙ্গে দেখা করার জন্যে অপেক্ষা করতে পারিনি। চিঠি দেবার কথা ভেবেছিলাম কিন্তু কোন ঠিকানায় দেব বুঝতে পারিনি।
সুদীপ বলল, তোমাকে তো এতটা নির্বেধ বলে মনে হয় না! তুমি এই কথাটা স্পষ্ট বলতে পারছ না কেন অত কাছাকাছি গিয়ে তোমার খুব মন কেমন করছিল দেশে যাওয়ার জন্য এবং তুমি জানতে যে পারমিশন পাবে না তাই কেটে পড়েছিলে চুপচাপ।
অনিমেষ মাথা নাড়ল, না একথা ঠিক নয়।
বিমান বলল, আমি তোমার ব্যবহারে মর্মাহত। তোমার এই দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজের জন্য আমাকে অনেক কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে। তুমি উধাও হয়ে গেলে, তুমি তো খুনও হয়ে যেতে পারতে। সেক্ষেত্রে পার্টি কি জবাব দিত? মোদ্দা কথা তুমি পার্টির কাছে আমাকে অপদস্ত করেছ।
হঠাৎ সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, তোমার দাদুর খবরটা যদি আমরা যাচাই করি?
স্বচ্ছন্দে। অনিমেষ নড়েচড়ে বসল, শহরের অনেকেই জানে এখন।
কি হয়েছিল ওঁর?
লেপ্রসি।
অনিমেষ দেখল দুজনেই একসঙ্গে ভূত দেখার মত চমকে উঠল। দুজনের মুখের অবস্থা দেখে খুব কষ্টে হাসি চাপল সে। আমরা যতই মুখে প্রগতির কথা বলি না কেন, এইসব অকারণ আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে পারিনি। কিন্তু ব্যাপারটাকে সে কাজে লাগালো, ওই খবর পাওয়ার পর আমার মাথা ঠাণ্ডা থাকতে পারে? আমার ছেলেবেলায় দাদুর ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি।
গলার স্বর বদলে গেল বিমানের, দুঃখিত। কথাটা যদি য়ুনিয়নের ঠিকানায় জানিয়ে দিতে তাহলে এই ভুল বোঝাবুঝি হতো না। যাহোক, উনি কেমন আছেন?
চিকিৎসা চলছে। বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা আমাদের কাছে খুব শকিং।
নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। আমি চেষ্টা করব যাতে পার্টি তোমার সম্পর্কে কোন ভূল সিদ্ধান্ত না নেয়। কিন্তু এটাই শেষ সুযোগ। আমাদের মনে রাখা উচিত পৃথিবীর যেকোন ব্যক্তিগত সমস্যার চাইতে দলের কাজ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিমান খুব দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করল।
মাথা নাড়ল অনিমেষ, আমার মনে থাকবে। ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি চুকে যাবে বুঝতে পারেনি অনিমেষ। সে নিশ্চিত ছিল ছাত্র ফেডারেশন তাকে বাতিল করে দেবে। সেটা হলে তার আপাতত কিছুই করার থাকছে না! দেশের জন্যে কেউ যদি কিছু করতে চায় তাহলে তাকে একটা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হতেই হবে। পশ্চিম বাংলায় কংগ্রেসের বিকল্প দল এখন একটাই। যদিও ঘোলাজলের মত একই জায়গায় পাক খাচ্ছে তবু যা কিছু নাড়াচাড়া এই দলেই। বামপন্থী কমুনিস্ট দলের কাজকর্ম, মতবাদ এবং নেতৃত্ব সম্পর্কে কোন রকম আশা করার কিছু না থাকলেও খুব সামান্য কাজ এই দলে থাকলেই করা যাবে। সেই দুপা এগোন এবং এক পা পিছিয়ে যাওয়া ব্যাপার আর কি।
কলকাতায় ফিরে এসে তার মনে হয়েছিল কেউ তাকে মাথার দিব্য দেয়নি যে রাজনীতি করতে হবে। তার সহপাঠীরা, কলকাতায় লক্ষ লক্ষ মানুষেরা এসব না করে দিব্যি বেঁচেবর্তে আছে। এম.এ. পাশ করে একটা যেকোন চাকরি জুটিয়ে নিয়ে হাজারটা সমস্যার মধ্যে ওইরকম কাটিয়ে দেওয়া যায়। আজকের ভারতবর্ষে কেউ কি দেশের কথা ভেবে রাজনীতি করে? ব্রিটিশ আমলে যারা দেশের কথা ভাবতেন তাদের স্বদেশী বলা হতো। এখন বলা হয় না কেন? ব্রিটিশের বিকল্প যদি প্রক্রিয়াশীল শোষ করা হয় তো তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করাও তো স্বদেশী করা হতে পারে। মুশকিল হল স্বপাদেশিতাকে এমন সংকীর্ণ মনোভাবের প্রকাশ বলা হয়। অথচ বৃহত্তর ব্যাপারটার কোন মাথামুণ্ডু নেই একথা জানলেও কেউ মানতে চাইবে না।
কেন তার মনে হয় আমাদের দেমের মানুষগুলো স্বাধীন নয়? কেন মনে হয় লক্ষটা সংস্কার এবং অর্থনৈতিক দুর্দশা তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে যা থেকে লাভবান হয় একটিমাত্র শ্রেণী। যদি এই দেশের মানুষের আথর্থিক কাঠামোটা এক করা যেত তাহলে দেশের চেহারাটাই পালটে যেত। এটা ঠিক, আমাদের বর্তমান ব্যবস্থায় কোন দলেরই সেই কাজ করা সম্ভব নয়। সুদীপরা বলবে সীমাবদ্ধ সুযোগের মধ্যে যেটুকু কাজ করা যায় তাই করা উচিত। অনিমেষের মনে হয় এ এক ধরনের ফাঁকিবাজি। বিরোধীদল হিসাবে কংগ্রেসের সমালোচনা বা বিক্ষোভ দেখানোর মধ্যে একধরনের বাহাদুরি আছে কিন্তু গঠনমূলক কাজকর্ম যাতে দেশের সমগ্র মানুষ সামাজিক অর্থনৈতিক বৈষম্য ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে পারবে তা করা সম্পূর্ণ আলাদা। কম্যুনিজমের থিওরি বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। কারণ প্রতিটি দেশের মাটি এবং মানুষের মনের চেহারা এক না। কিন্তু এসব চিন্তা তার মাথায় আসে কেন? অনেক ভেবেছে অনিমেষ, কিন্তু নিজেকে নিষ্ক্রিয় করে রাখার সপক্ষে কোন কারণ খুঁজে পায়নি। চারপাশে এতরকম অসাধুতা যে নিজের মনের কাছেই দোষী হয়ে থাকতে হয়।
এই এবার জলপাইগুড়ি থেকে ফেরার সময় চোখের সামনে টিকিট চেকারকে ঘুষ দেবার জন্য যাত্রীদের হুড়োহুড়ি করতে দেখল। যারা দিচ্ছে এবং যে নিচ্ছে তাদের কেউ তথাকথিত প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণীতে পড়ে না। এসব দেখে তার মধ্যে কেন ছটফটানি শুরু হয়? সেই কোন শৈশবে বন্দেমাতরম শব্দটা উচ্চারণ করতে গিয়ে সমস্ত শরীরে এক ধরনের আবেগের কাটা উঠতো তাই বা কেন হতো? সেই সময়ে রক্তে রোপিত স্বদেশী চিন্তাটা এতকাল নানান তাপে চেহারা পালটে কি তাকে এই ছটফটানি দিয়ে গেছে? তাই যদি হয় তবে সুদীপ বিমানদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকাই উচিত। ওরা কিছু করুক না করুক কথাবার্তায় অনেক কিছু করার একটা পরিমন্ডল সুষ্টী করে। এটুকুই লাভ। অনিমেষের খেয়াল হল আজ বিমানদের আস্থা ফিরিয়ে আনবার জন্য দাদু তাকে পরোক্ষভাবে সাহায্যে করলেন। এই একটি মানুষের কাছে তার ঋন ক্রমশ বেড়েই যাচ্ছে এবং পৃথিবীর কোন দামে তা শোধ করা যাবে না।
কংগ্রেসের অবস্থা এখন ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে আসছে। নেতৃত্ব চিরকালই বৃদ্ধদের হাতে থাকে। পশ্চিম বাংলার কংগ্রেসীরা বিধান রায়ের পর নিজেরা কে কতখানি স্থবির প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর হয়ে পড়েছেন। তাদের অন্ধ বিশ্বাস গান্ধীজির নামের মধ্যে একটা জাদুমন্ত্র আছে যার দ্বারা দেশের মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা যায়। এই দেশ মন্ত্রীদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছাড়া কিছু নয়। বিরোধেরা শুধু চিকারেই নিজেদের অস্তিত্ব বজায় বাখে, তাই ওদের কাছ থেকে কোন ভয় নেই, মাঝে মাঝে দু–এক টুকরো রুটি ছুঁড়ে দিলেই যথেষ্ট। তারা যে মেহনত করে দেশের মানুষকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন তার দাবীতে চিরকাল তাদের গদিতে বসিয়ে রাখা দেশবাসীর পুত্র কর্তব্য। এইসব ধারণা থেকেই ভারতবর্ষে গণতন্ত্রের সৃষ্টি। যে গণতন্ত্রকে ধনিক–গণতন্ত্র বলা যায়। এই বুর্জোয়া ডেমোক্রেসি দিয়ে সমাজতন্ত্র হয় না। জংগ্রেস সেটি আমদানি করেছে। বামপন্থী দলগুলো যদি নির্বাচনে জেতে তাহলে ওই বুর্জোয়া ডেমোক্রেসির মধ্যে দিয়েই তাদের যেতে হবে।