What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected কালবেলা- সমরেশ মজুমদার (2 Viewers)

বামপন্থী দলগুলো নির্বাচনের মাধ্যমে কংগ্রেসকে সরাতে চাইছেন। ধনিক শ্রেণীর ব্যাকিং যদি না থাকে তাহলে ফললাভ কষ্টকর। আর সত্যিই যদি ফল পাওয়া যায় তাহলে বুঝতে হবে এতকালে দেশের মানুষ নিপীড়নের বিরুদ্ধে মাতা তুলে দাঁড়িয়েছে। তারা বামপন্থীদের ভোট দিচ্ছে এই ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্যে। কিন্তু একটা সাইকেলকে প্যাডেল ঘোরালে সামনের দিকেই নিয়ে যাওয়া যায়, পেছনদিকে প্রয়োজনেও চালানো যায় না। নির্বচনে জিতলে তাই বামপন্থীদের সম্পর্কে জনসাধারণ বাধ্য হয়ে মোহমুক্ত হবেন।

কিন্তু পাশাপাশি আর একটা ব্যাপার অনিমেষ লক্ষ্য করছিল। ভারতের মার্কসবাদী কমুনিস্ট পার্টি আগামী নির্বাচনের কথা স্মরণ রেখে কৃষক সভার মাধ্যমে ব্যাপক আন্দোলনের কর্মসূচী নিয়েছে খাস জমি বন্টন, বর্গাস্বত্ব, খাদ্য, কাজ মজুরি হল তালিকাভুক্ত। একটু একটু করে অর্থনৈতিক দাবি–দাওয়া থেকে নিম্নবিত্তশ্রেণী গণতান্ত্রিক অধিকারও ক্ষমতা দখলের জন্য বাবতে শুরু করেছে। দ্রব্যমুল্যে বৃদ্ধি, ব্যাপক রাজনৈতিক নির্যাতন জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলছিল। জনগনের একাংশ এর থেকে মুক্তি পাবার আশায় ক্রমশ রাজিৈতক পরিবর্তন কামনা করতে শুরু করেছে এই চেতনাটাকে কাজে লাগচ্ছে বামপন্থীরা। যদিও তাদের পথ বুর্জোয়া ডেমোক্রেসির বাধা পথেই শেষ হবে কারণ ব্যবস্থাটা যে এক। তবু এই আলোড়নের সময় যুক্ত থাকাই যে কোন কর্মীর উচিত। অনিমেষ বিমান-সুদীপদের সঙ্গে মিশে গেল।

আজকাল অনিমেষের হাতে তেমন পয়সা-কড়ি থাকে না। এবারে বাবার কাছে সে মুখ ফুটে বেশী টাকা চাইতে পারেনি। দাদুর অবস্থা দেখার পর তা সম্ভবও নয়। পরমহংসের মত টিউশানি যে তার পক্ষে করা সম্ভব নয় এটা বুঝতে পেরেছে। সামান্য কটা টাকার জন্যে ওরকম বাঁধা জীবন মেনে নেওয়া অসম্বব। অথচ কোন আশু সমাধান নেই।

দ্বিতীয় যে ব্যাপারটা জলপাইগুড়ি থেকে ফিরে এসে অনিমেষ শুরু করল সেটা হল পড়াশুনো। ইদানীং তার ঘরের টেবিলজুড়ে কম্যুনিজমেন ওপর লেখা নানান বই পত্রপত্রিকা ছড়ানো থাকতো। সব কাজ চুকিয়ে রাত্রের খাওয়ার পর নিয়ে বসত অনিমেষ। পড়তে গিয়ে অনিমেষ প্রথমে ভেবেছিল সে অসীম সমূদ্রে পড়বে। দীর্ঘদিন সংশ্রব না থাকায় একটু নার্ভাস হয়ে পড়েছিল। কিন্তু বাংলা এমন একটা বিষয় যে সামান্য মস্তিষ্ক থাকলে দখল নেওয়া কষ্টকর নয়। একমাত্র ভাষাতত্ত্ব বুঝতে তার অস্বস্তি হচ্ছিল। ব্যাপারটা ফাঁকিবাজি দিয়ে সম্ভব নয়। পালি প্রাকৃতও প্রথমে ওইরকম মনে হয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন পঠনের ফলে সব কিছুর মেডইজি বেরিয়ে যায়। অনিমেষ ঠিক করল, যাই হোক না কেন এম. এটা এবারেই সম্মানের সঙ্গে পাশ করতে হবে। কোন ফলশ্রুতি নেই, পাশ করলেও অন্ধকার–এসব জেনেও করতে হবে। কারণ নিজেকে অযোগ্য ভাবতে সে রাজি নয়। যে বাসনা নিয়ে এদেশের মানুষ রাজনীতি করে সেই বাসনাতেই তাকে পাশ করতে হবে।

মাধবীলতা এখন অদ্ভুত চুপচাপ। দাসপাড়ার অভিজ্ঞতা এবং তার পরের ঘটনা অনিমেষ ওকে বুঝিয়ে বলেছে। মাধবীলতা শুনেছে কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। যেন অনিমেষ যা করবে তা সে বুঝেসুঝেই করবে। ক্রমশ মেয়েটা যেন তার ওপর নির্ভরতা বাড়িয়ে ফেলছে। এ নির্ভরতা প্রতি মুহূর্তের অর্থনৈতিক চাহিদার নয়, মানসিকতার। অনিমেষ কোন অন্যায় করতে পারে না এরকম একটা বিশ্বাস ওর মনে অটল। সেই প্রথম দিকের জ্বলে ওঠা মেয়েটা যেন কোন জাদুমন্ত্রে এখন সমর্পণের ভঙ্গিতে বসে থাকে তার কাছে। যদি কোন কথায় বা কারনে ব্যথা পায় তাহলে চোখ তুলে শুধু চাহনিতেই বুঝিয়ে দেয় সে কথা। এরকম মেয়েকে আঘাত দেওয়া যায়না। অনিমেষ অনুভব করে, মাধবীলতা তার জীবনে থাকলে কোন অশুভ শক্তি তার ক্ষতি করতে পারবে না।

ভিয়েৎনামে আমেরিকা তার চুড়ান্ত আঘাতটি হানলো। যখন সাম্রাজ্যবাদি শক্তি মরিয়া হয়ে যায় তখন তার অন্ধতা আসে। কিন্তু এই নৃশংস আঘাতেও ভিয়েৎনামীরা ভেঙ্গে পড়র না। আমেরিকানরা কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছে। এদিকে সমস্ত বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষ আমেরিকার বিরুদ্ধে ধিক্কারে উত্তাল। বিক্ষোভ দেখানো হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায়। এমনকি আমেরিকাতেও এই দৃশ্য দেখা গেল।
 
পর পর কয়েকদিন ওরা আমেরিকান দুতাবাস আর চৌরঙ্গী তথ্যকেন্দ্রের সামনে বিক্ষোভ করল, আমেরিকার রাষ্ট্রপতির কুশপুত্তলিকা পোড়াল। ট্রাফিক বন্দ, নেতারা জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিচ্ছেন ভিয়েতনামীদের সপক্ষে। অনিমেষরা শ্লোগান দিচ্ছিল, দুনিয়ার সর্বহারা একহোক।

কিন্তু ট্রাম-বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিরক্ত মানুষেরা চাপা উষ্মা প্রকাশ করছিল। অবশ্য এতবড় মিছিলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কিছু বলার ক্ষমতা বা সাহস কারো নেই। অনিমেষ শুনল, একজন চাপা গলায় আর একজনকে বলছে, শালা আমাদের হাজারটা সমস্যার সমাধানের নাম নেই, কোথায় ভিয়েতনামে আমেরিকা কি করেছে তা নিয়ে কুমিরের কান্না কাঁদছে।

অনিমেষ কথাটা বিমানকে বলতেই বিমান ক্রুদ্ধ হল। সুরেন ব্যানার্জী রোডের রোদে দাঁড়িয়ে বলল, এই মানসিকতা কংগ্রেসী কুশাসনের ফসল। আমার ঘরে জল পড়ছে বলে অন্যের ঘরের আগুন নেভাতে ছুটব না?

অনিমেষ বলল, আমরা প্রতিবাদ করছি ঠিক আছে। কিন্তু ভিয়েৎনামীদের জন্যে আমাদের কিছু করা উচিত।

বিমান বলল, আমাদের সমর্থন ওদের কাছে পৌঁছে দিলে ওরা জোর পাবে।

তা ঠিক। অনিমেষ বলল, অন্যভাবে আমরা যদি সাহায্য করি তাহলে ওদের উপকার হয়, আমরাও কাজে কিছু করতে পারলাম বলে তৃপ্তি পাব।

কি ভাবে?

জামাকাপড়, ঔষধ, খাবার এসব পাঠিয়ে।

ভাল। কিন্তু আমাদের ফরেন সার্ভিস সেগুলো পৌঁছে দেবে কিনা কিংবা সরকার তাতে অনুমতি দেবে কিনা তো জানি না। ঠিকই বলেছ, ভিয়েৎনামী সংগ্রামীদের জন্য সাহায্য তোলা যায়, বিমান বলল।

সংগ্রামী শব্দটার পাশে সাহায্য কথাটা খুব খারাপ শোনালে অনিমেষের কানে। সে বলল, না, লোকের কাছে ভিক্ষে করব না। আমরা একটা বড়সড় অনুষ্ঠান করে টিকেট বিক্রী করে টাকা তুলে ঔষধ কিনতে পারি। আপনি কথা বলে দেখুন।

অনুমতি পাওয়া গেল। য়ুনিভার্সিটি য়ুনিয়ন থেকে ভিয়েৎনাম এইড কমিটি হল। সুদীপ কনভেনার, অনিমেষসম্পাদককয়েকদিন ধরে জোর আলোচনাচলল। ঠিক হল মহাজাতিসদনে অনুষ্ঠানটি হবে। সকালে হলে কম ভাড়া লাগে। যেরকমভাবে হোক খরচ কমাতে হবে। সবাই একমত হল যে কোনরকম হালকা গান-বাজনা বা নাটক হবে না। জনসাধারনকে উজ্জীবিত করতে পারে এইরকম অনুষ্ঠানসূচী করা দরকার। তখনই পালটা কথা এল, অর্থসংগ্রহ যদি প্রধান উদ্দেশ্য হয় তাহলে জাগরনের গানফান হলে টিকেট বেশী বিক্রী হবে না। দেখা গেল, কম্যুনিস্ট পার্টির গণনাট্য সংঘের সঙ্গে একদা যুক্ত থেকে যারা বিখ্যাত হয়েছেন তারা হয় পার্টি ছেড়ে দিয়ে লঘু অনুষ্ঠান করছেন। নয় ডানপন্তী কম্যুনিস্টবলে পরিচিত। ভারতীয় মার্কাসবাদি কম্যুনিস্ট পার্টির কালচারাল ফোরামে কোন কোন জনচিত্তজয়ী শিল্পী নেই। তাহলে? দুএকজন তাত্ত্বিক কিংবা প্রচুর কর্মী এবং বক্তা থাকা এক আর প্রকৃত শিল্পী থাকা অন্য কথা। তখন ঠিক হল ক্যুনিজমের প্রতি অনুগত অথচ কোন দলের সঙ্গে জড়িত নন এমন শিল্পীর সন্ধান করতে হবে। এই অবস্থায় সুদীপ প্রস্তার দিল নাটক অভিনয় করানোর। কলকাতার প্রখ্যাত দল জনবাণী সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কৌতূহল এবং শ্রদ্ধা প্রচুর। কারন এই দলের বিখ্যাত পরিচালক অভিনেতা এখন বাংলাদেশের নাট্যজগতের অন্যতম স্তম্ভ। চলচ্চিত্রে অভিনেতা হিসেবে সফল হলেও নাট্যকর্মেই নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন তিনি। তাঁর দল অত্যন্ত সুশৃংখল। ভারতীয় মার্কসবাদী কমুনিস্ট পার্টির সদস্য নন তিনি। কিন্তু জনবাণী দল সব সময় সর্বহারার জন্যে নাটক করে। প্রতিটি নাটকই প্রচন্ড জনসমর্থন পেয়েছে তার পরিবেশনা, প্রযোজনা এবয় প্রধান অভিনেতা পরিচালক সুবিমল গুপ্তের জন্যে। সুবিমলবাবুর নাটক গুলো কম্যুনিস্ট পার্টিকে প্রচন্ড সমর্থন করছে জনমানসগঠন করতে। মাঝে মাঝে পার্টির হয়ে পথ-নাটকও করছেন তিনি। এবং সবচেয়ে বড় কথা ওঁর সাম্প্রতিক নাটক ভিয়েৎতাম লাল সেলাম দারুণ জনপ্রিয় হয়েছে। প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হল।
 
অনিমেষ আরো দুজন ছাত্রের সঙ্গে সুবিমলবাবুর ফ্যান প্রত্যেকেই। কিন্তু ব্যাপারটা অনেকের চোখে ঠেকবে বলে সে এল না। সুবিমলবাবুর বাড়িতে ঢুকে অনিমেষ হকচকিয়ে গেল। সুন্দর সাজানো গোছানো এবং চারপাশে বৈভব ছাড়ানো। একজন সংগ্রামী কমুনিষ্ট মানসিকতার মানুষ এত আরামে এদেশে থাকেন? ঘরের দেওয়ালে লেনিনের বিরাট ছবির পাশে রবীন্দ্রনাথ রয়েছেন। চোস্ত পাজামা আর পাঞ্জাবী পরে হাতে চুরুট নিয়ে সুবিমলবাবু মোটা গলায় বললেন, আরে বসো বসো। তোমরা ঠিক সময়েই এসেছ বলে খুশী হলাম। তুমি বললাম বলে কিছু মনে করলে না তো?

অনিমেষ প্রথম দেখল সুবিমলবাবুকে কিন্তু তার সঙ্গীরা বেশ গদগদ হয়ে পড়েছে। তারা বলল, না, না, আপনি তুমিই বলুন।

ভেরি গুড। আমাদের দেশের তরুণ কমরেডদের দেখে খুশি হলাম। নাউ টেল মি, তোমাদের প্রব্লেম কি? মুখে চুরুট রেখেই কথা বললেন সুবিমলবাবু।

অনিমেষ নিজেই সামনের চেয়ারে বসে বলল, প্রব্লেম নয়। ভিয়েৎনামে আমরা কিছু ওষুধ পাঠাতে চাই।

খুব ভাল কথা। কনস্ট্রাকটিভ কাজ।

হ্যাঁ। এর জন্যে অর্থ দরকার। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মহাজাতি সদনে একটি অনুষ্ঠান করে টাকাটা তুলবো। আমরা চাই আপনি সাহায্য করুন। অনিমেষ হাসল।

কিভাবে?

ভিয়েৎনাম লাল সেলাম অভিনয় করুন। আপনি পাশে দাঁড়ালে হাউসফুল হয়ে যাবে।

কবে?

বারো তারিখে সকালে হল পাওয়া যাবে।

তোমাদের বাজেট কত?

বাজেট?

এ-বাবদ আমার দলকে কত দেবে?

আমরা ভাবিনি কিছু। খরচ যতটা কমানো যায় তত আমরা সাহায্য পাঠাতে পারব।

বুঝলাম।

বোধহয় ওইদিন আমি খালি আছি। ওয়েল, আমার দলকল শো-এর জন্যে অনেক বেশী নেয়। যেভাবে খরচ বাড়ছে সামলানো মুশকিল। তবু তোমরা তিন দিও।

তিন, তিন হাজার? হাঁ হয়ে গেল অনিমেষ।

নো বারগেন।

অনিমেষ পাথর হয়ে গেল। এই মানুষটি সর্বহারাদের বন্ধু? কম্যুনিস্ট পার্টির হয়ে পথসভা করেন? ভিয়েৎনামীদের সমর্থক? সে খুব নীচু গলায় বলল, এতটাকা দিলে আমরা তো কিছুই ওখানে পাঠাতে পারব না।

আই কান্ট হেল্প। একবার যদি সবাই জেনে যায় ওর কম আমি শো করেছি তাহলে আমার বাড়ির সামনে একমাইল লাইন পড়ে যাবেল শোর। সবাই বলবে ওই টাকায় করুন। কাকে ঠেকাবো তখন! তুমি হয়তো ভাবলে আমার মুখে এ কি কথা! রাইট। কিন্তু আমার রাজনৈতিক চিন্তা আর প্রফেসনাল এটিকেট এক নয়। হতে পারে না। একজন সরকারীকর্মী যেমন সরকার বিদ্বেষী শ্লোগান দিলেও সরকারের কাজ করে মাইনে নেন পেটের জন্যে। আমিও দুটোকে এক করতে পারি না।

অনিমেষ কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। মনে মনে ভীষণ ভেঙে পড়ছিল সে। কোন চিন্তা মাথায় আসছিল না। এ কি ধরনের কমুনিজম-মনস্কতা?

সুবিমলবাবু হঠাৎ হাসলেন, ঠিক আছে! তোমরা এক হাজার দিতে পারবে? অনলি ওয়ান থাউজেন্ড।

সঙ্গে সঙ্গে নড়ে উঠল অনিমেষ, নিশ্চয়ই।

দেন, টিকিট বিক্রী করো। বারো তারিখ বললে না? এগার তারিখে বিকেলে টাকাটা পৌঁছে দিও। আই উইল বি দেয়ার।
 
বাইরে বেরিয়ে এসে সঙ্গীরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ হল। অনিমেষের খারাপ লাগছিল নিজের কথা ভেবে। ভদ্রলোক যে ওকে নিয়ে খেলা করছিলেন তা সে বুঝতে পারেনি, না পেরে আজেবাজে চিন্তা করেছে। সুবিমলবাবুকে নিয়ে আজ সবাই গর্ব করে, তিনি কি ভিয়েৎনামের সাহায্য অনুষ্ঠানে না এসে পারেন? হু হু করে একদিনেই টিকেট বিক্রী হয়ে গেল। অনুষ্ঠানের আগের দিন টাকাটা পৌঁছে দেওয়া হল। মহাজাতি সদন টইটুম্বুর। সকালবেলাতেই জনবাণী এসে গেছে। মেকআপ নিচ্ছেন তাঁরা। অনিমেষকে নানান ঝামেলা সামলাতে ছুটোছুটি করতে হচ্ছে। সুদীপের সঙ্গে সুবিমলবাবু কথা বলছিলেন। অনিমেষ দেখল উনি এখনও মেক-আপ নেননি।

অভিনয় শুরুর একটু আগে সুদীপ বলল, আজকের অনুষ্ঠানের আগে কেন এটা করছি তা দর্শকদের বলা দরকার। সুবিমলবাবুও বলবেন।

পর্দা উঠল। অত মানুষের সামনে এই প্রথম অনিমেষ কথা বলল মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে। উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে দর্শকদের এবং জনবাণীকে ধন্যবাদ দিল সে। তারপর সুদীপ এসে বলল সে সুবিমলবাবুকে অনুরোধ করছে কিছু বলার জন্যে। সুবিমলবাবুর নামের আগে অনেক জনদরদী বিশেষণ দিল সে। উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে স্তম্ভিত অনিমেষ দেখল সুবিমলবাবুর আর একজন সঙ্গীর ওপর ভর দিয়ে কোনক্রমে মাইকের সামনে দাঁড়ালেন, আমি অত্যন্ত অসুস্থ। ডাক্তার আমাকে বিছানায় শুয়ে থাকতে বলছেন। কিন্তু ভিয়েৎনামের জন্যে ছাত্রবন্ধুরা যখন এই অনুষ্ঠান করছেন তখন কি আমি শুয়ে থাকতে পারি? না, আমি কোন বিশেষণের যোগ্য নই। একটু অভিনয় করতে চেষ্টা করি মাত্র। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে চিরকাল লড়ে যাব, জনসাধারণকে বোঝাবো তারা কি অবস্থায় আছেন। আমি একজন দৈনিক মাত্র। আমার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে তবু না এসে পারলাম না। আমার দল অভিনয় করবে, আপনারা সহযোগিতা করুন। আমার সঙ্গে বলুন আপনারা, ভিয়েৎনাম লাল সেলাম। সঙ্গে সঙ্গে হল ফেটে গেল শব্দে, লাল সেলাম, লাল সেলাম।

খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে স্টেজ থেকে বেরিয়ে এসে অনিমেষের মুখোমুখি পড়ে গেলেন সুবিমল বাবু। চুরুট বের করে বললেন, একটা দেশলাই দাও তো।

চোয়াল শক্ত করে অনিমেষ বলল, আমার কাছে নেই। আর একজন ছুটে এসে দিল তাকে। সেটা নিয়ে একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ অনিমেষকে দেখলেন সুবিমলবাবু। তারপর অদ্ভুত কায়দায় হাসলেন, দেশলাই-এর বাক্সটা দেখেছে? বারুদমাখানো কাঠিগুলোকে জলবাতাস থেকে বাঁচানোর জন্যে এই বাক্সটা দরকার। কোনটা দামী? বাক্স না কাঠি? দুটোই। তাই না?

কথাটা শেষ করে স্মার্টলি বেরিয়ে গেলেন হল থেকে। সেখানে তাঁর গাড়ি অপেক্ষা করছে। তখন নাটক শুরু হয়ে গেছে। আমেরিকান মিলিটারীর অত্যাচার দেখে দর্শকরা ধিক্কায় দিচ্ছে। জনবাণী দারুণ অভিনয় করছে। সুবিমলবাবুর বদলে যিনি করছেন তিনিই সর্বহারাদের কথা সমান দরদে মঞ্চে বলছেন।

অনিমেষ নাটক দেখছিল না। সমস্ত ব্যাপারটাই তার কাছে সাজানো, রঙিন বেলুনের মত মনে হচ্ছিল। বেলুনটা বাড়ে না কারণ সে জানে তাহলে ফেটে যেতে পারে। কিন্তু একটা সুচ দরকার, অবিলম্বে।
 
দাসপাড়ার উপনির্বাচনের কংগ্রেসপ্রার্থী বিপুল ভোটে জয়লাভ করলেন। কলকাতার মানুষ খবরের কাগজের এই সংবাদটাকে তেমন গুরুত্বই দিল না, যেন একটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার, জেতাটাই ছিল আশ্চর্যের। ভোটের ফলাফল বের হলে অনিমেষরা হিসেব করেছিল মোট ভোটের সত্তর শতাংশ বাক্সে পড়েছে। বাকী ত্রিশভাগ যারা ভোট দেয়নি তাদের সমর্থন পেলে কি কাণ্ড হতো বলা যায় না। দেখা গেল আগের বার বিরোধী প্রার্থী যত ভোট পেয়েছিল এবার তা থেকে হাজার খানেক বেড়েছে। বিমান বা সুদীপ এই নির্বাচন নিয়ে কোন কথা বলছে না। যা গিয়েছে তার সম্পর্কে ভেবে কিছু লাভ নেই। পার্টির নেতারা নিশ্চয়ই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ত্রুটিগুলো সামলে নেবেন সামনের বার। অনিমেষ জিজ্ঞাসা করতে বিমান জবাব দিয়েছিল, পর্যালোচনা চলছে।

সুবিমলবাবুর ব্যাপারটার পর থেকে অনিমেষ নিজের ভেতরে যেন আর উৎসাহ খুঁজে পাচ্ছিল না। এই মানুষটি দ্বৈতসত্তার কথা জেনেও পার্টি তাকে মূল্যবান বলে মনে করে, কমরেডের সম্মান দেয়, কথা শোনে কিন্তু আলোচনায় উৎসাহ পায় না।

এই সময় ভারতবর্ষ আর পাকিস্তান একটা যুদ্ধে লিপ্ত হল। সন্ধ্যের পরই কলকাতা শহর অন্ধকারে ডুবে যায়, তড়িঘড়ি মানুষ ঘরে ফিরে যাচ্ছে। যে কোন মুহূর্তেই পাকিস্তানের বোমারু বিমান কলকাতার আকাশে দু-একটা বোমা টুক করে ছেড়ে দিয়ে যেতে পারে। তাবে চীনের সঙ্গে যখন গোলমালটা লেগেছিল তখন কার মত দিশেহারা অবস্থা এখন নয়। মানুষ জানে পাকিস্তান যতই গর্জাক ভারত দখল করার হিম্মত নেই। কিন্তু এই মুহূর্তে ভারতবাসী কংগ্রেস সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে, বহুমুখী বিরোধীরা মুখ হয়ে আছে। তবু যুদ্ধটা ঠিক জমছে না।

এই যুদ্ধ অনেকটাই সাজানো, ফলাফল জানাই আছে৷ এইরকম বোধ পার্টির নেতাদের থেকে শুরু করে ক্যাডার পর্যন্ত সঞ্চারিত। সাধারণ মানুষও বেশ মজা পেয়ে গেছে। সিনেমা দেখবার ভঙ্গিতে কাগজে যুদ্ধের খবর পড়ে কারণ তারা সবাই জানে পাকিস্তানীরা কখনোই তাদের গায়ে হাত দিতে পারবে না। কিন্তু যুদ্ধের কারণেই কংগ্রেস সম্পর্কে তিক্ততা ক্ষীণ হয়ে গেল।

অবশ্য শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের আঁচ গায়ে লাগল। হু হু করে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাচ্ছে। ভারতবাসীর মত সব-সইয়ে জাত পৃথিবীতে বিরল। কোথাও কোন প্রতিবাদ নেই, যেন যুদ্ধ হলে দাম বাড়াটাই স্বাভাবিক কথা। চোখে সামনে মানুষ মানুষকে ঠকাচ্ছে এবং সেটাকে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই গ্রহণ করে সবাই। অনিমেষের মনে হয় সাতচল্লিশ সালের পনেরই আগস্টেই এদেশের মানুষের মেরুদণ্ডটিকে খুলে নিয়ে মাউন্টব্যাটেন–সাহেব দেশে চলে গেছেন।

যুদ্ধ যখন থেকে গেল খুব আফসোস হচ্ছিল ওর। পাকিস্তান কেন পূর্ববঙ্গকে ব্যবহার করল না? কেন ঢাকা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বোমারু বিমান উড়ে এসে কলকাতার ওপর বোমা ফেলল না? যদি কোন যাদুমন্ত্রে পাকিস্তানী সেনা পশ্চিমবাংলায় ঢুকে পড়ত তাহলে উত্তেজনার আগুন পোয়ানোর বিলাসিতা ছাড়তে হতো এদেরম মানুষকেইনজস্ব সুবিধেরে ছকে সাজানো রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা তখন হারিয়ে যেতে বাধ্য হতো। প্রতিরোধ শক্তি জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লেই ওই সব নেতাদের ছুঁড়ে ফেলতে একটুও সময় লাগত না। এই দেশে কমুনিজম প্রতিষ্ঠা করতে হলে সশস্ত্র যুদ্ধ চাই। ঘরে আগুন না লাগলে ঘরের প্রতি ভালবাসা টের পাওয়া যায় না। স্বার্থের পৃথক খোলসগুলোকে চূর্ণ করতে যুদ্ধ চাই, নইলে এই নিরাসক্তির ভান কখনোই ঘুচবে না।

অনিমেষ এখন বিশ্বাস করে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মানসিকতা পরিবর্তন করার ক্ষমতা কমুনিস্ট পার্টির নেই। শুধু প্রতিপক্ষকে গালিগালাজ করলে হয়তো একট সাময়িক সমর্থন পাওয়া যায় কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হলে যোগ্যতা অর্জন করতে হয়, সেটিই করা হচ্ছে না। যা কিছু চটজলদি আবেগকে পরিচালিত করে সাধারণ মানুষ তাকেই গ্রহণ করে। এদেশের কম্যুনিস্ট পার্টির তাবড় তাবড় নেতাদের চালচলন কথাবার্তার সঙ্গে বেশিভাগেরই ব্যক্তিগত জীবনের কোন মিল নেই। তাদের দেখে কোনরকম অনুপ্রেরণা যদি সাধারণ মানুষ না পায় তাহরে তাদের আদর্শে শ্রদ্ধাশীল হবে কি করে? সবচেয়ে বিস্ময়ের কথা কম্যুনিস্ট পার্টির মত সুশৃঙ্খল সংস্থা কংগ্রেস নয়। কম্যুনিস্ট ক্যাডাররা নিঃস্বার্থ হয়ে নেতাদের হুকুম মেনে নেয়। এরকম শক্তিশালী একনিষ্ঠ কর্মী পেয়ে নেতারা কি করতে চান বোঝা যাচ্ছে না। দলের নীচের তলার কর্মীরা কাজ করে ভাবাবেগে, নেতাদের পদক্ষেপ হিসেব করে। তারা আবেগ আনেন বক্তৃতার সময়, ব্যক্তিগত স্বার্থ হারাতে কেউ বিন্দুমাত্র রাজী নন।
 
মোটামুটি এই যখন দেশের রাজনৈতিক চেহারা তখন ঘোলাজলে পাক খেয়ে কি লাভ? অদ্ভুত হতাশাজনিত ক্লান্তি ক্রমশ অনিমেষকে আচ্ছন্ন করে ফেলছিল। এই সময় ছাত্র ইউনিয়নগুলো দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে দেশব্যাপী আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নিল। আন্দোলন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল করে মনুমেন্ট পর্যন্ত গিয়ে নেতাদের বক্তৃতা শোনা এই হল আন্দোলনে চেহারা। অনিমেষ দুদিন কংগ্রেস সরকার নিপাত যাও, খাদ্য চাই, বস্ত্র চাই, বাঁচার মত বাঁচতে চাই, দুনিয়ার ভুখা মানুষ হক হও, এক হও শ্লোগান দিতে গিদে গিয়েছে মিছিলের সঙ্গে। মাধবীলতাও চিল সঙ্গে। মিছিল মনুমেন্টের নীচে পৌঁছালে জায়গাটা এসময় সমুদ্রের চেহারা নিল। বাঁশের খুঁটির ওপর লাল কাপড়ের মঞ্জে নেতারা বসে সেই সমুদ্র দেখছিলেন। মাধবীলতা এই প্রথম এতসব নেতাদের একসঙ্গে দেখতে পেয়ে বেশ উত্তেজিত। এরা বিধানসভায় প্রায় সোরগোল তোলেন। কিন্তু এই গান্ধিজীমার্কা আন্দোলনে কি ফল ফলবে অনিমেষ বুঝতে পারছিল না। দেশের মানুষ বিক্ষুদ্ধ এই কথাটুকু বোঝানোর জন্যেই যদি এতো আয়োজন তাহরে সেটা কি কংগ্রেসী নেতাদের আজ অজানা আছে? তারা যদি সেই তথ্যটিকে উপেক্ষা করতে পারে তাহলে এই মিছিলের বিক্ষোভে কি এসে যায় তাদের। জনসাধারণের প্রাণশক্তির হাস্যকর অপব্যবহার ছাড়া ব্যাপারটা অন্য কিছু মনে হচ্ছে না অনিমেষের কাছে।

পর পর দুজন নেতা একই ভাষা এবং ভঙ্গিতে বক্তৃতা দিলেন। দেশে আজ বিপন্ন, কংগ্রেসী সরকারের শোষণে মানুষ দিশেহারা। এই সরকারকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কথাগুলো বলার সময় গলা কাঁপিয়ে অনেকটা যাত্রার ঢংয়ে হাত নেড়ে একটা নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি করে ফেললেন ওরা দুজনেই। কথা বলার সময় আবেগে মাঝে মাঝে কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল। ওঁদের চিৎকৃত ভাষণ যখন শেষ হল তখন বঙ্গে বর্গী পালার শেষে যে হাততালি পড়ে তারই অনুরণন মনুমেন্টের তলায় ছড়িয়ে পড়ল। বক্তৃতায় ক্লান্ত নেতাদের ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল তারা এই মাত্র ঘরে ঘরে অন্ন বিলিয়ে ফিরে এলেন। সবশেষে যিনি উঠলেন তার জন্যই জনতা উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিল। এর আগেও দেখেছে সে, আজও দেখল। গানের অনুষ্ঠানে ছোট বড় শিল্পীরা একে একে গেয়ে যান, কোন চাঞ্চল্য দেখা যায় না, শ্রোতাদের মধ্যে। কিন্তু শেষ নামটি যেই ঘোষিত হয় এবং বিখ্যাত শিল্পী যখন মঞ্চে এসে দাঁড়ান তখন হাততালি পড়ে, যেন এতক্ষণে অনুষ্ঠানটি সার্থক হল।

এখন যিনি বলতে এলেন তারও সেই ইমেজ। উনি যখন বলেন তখন যুক্তি দিয়ে বলবেন এটাই সবার ধারণা। এর আগের মিটিং-এ উনি প্রথমে বলেছিলেন বলে বাকী বক্তারা অসন্তুষ্ট হয়েছিল। কারণ তাদের কথা শোনার জন্য কেউ অপেক্ষা করেনি।

জনতাকে নড়েচড়ে বসতে দেখে অনিমেষ মাধবীলতাকে বলল, চিনতে পারছ ওঁকে?

মাধবলীতা বড় নেড়ে বলল, হ্যাঁ। বেশ ব্যক্তিত্ব আছে না?

অনিমেষ বলল, অন্তত যাত্রা করবেন না এটা বলা যায়।

মাধবীলতা বলল, তুমি অমন বেঁকা কথা বলছ কেন? তোমাদের পার্টির নেতা না?

অনিমেষ তর্ক বাড়ালো না। শুধু মাধবীলতার দিকে একবার তাকিয়ে বক্তৃতায় মন দিল। খুব শান্ত ভঙ্গি, প্রতিটি শব্দ আলাদা উচ্চারণ করেন। আবেগের বাড়াবাড়ি নেই। যেটা বলছেন তা কেন বছেন তা ওর জানা আছে। স্বভাবতই কংগ্রেসী সরকারকে আক্রমণ করে উনি কথা বলছিলেন। কিন্তু এসময় অনিমেষের মনে হল উনি খুব ভাল কথাশিল্পী। সুন্দর সাজানো কথা বিশ্বাসযোগ্য করে বলেন, কিন্তু কোন ধরাছোঁয়ার মধ্যে যান না। তার কথায় এমন একটা জাঁকজমক আছে যে লোকে সেইটে বুঝতেই পারে না। আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায় কারাবরণ এবং তারপরে বাংলা বন্ধ।

ধর্মতলা থেকে ফেরার সময় অনিমেষ সিদ্ধান্ত নিল এই রাজনীতি থেকে সে কিছুদিন সরে থাকবে। দশ হাজার লোককে পুলিশ এসপ্লানেড ইষ্ট থেকে ধরে বাসে করে খিদিরপুরে নামিয়ে দিলে কি ধরনের রাজনৈতিক লাভ হয় তা ওর মাথায় ঢুকবে না। এই কি কারাবরণ? অথবা সারাদেশ একদিনের জন্য অচল করে মোক্ষ লাভ হবে? এতে কি মনে হবে দেশের মানুষ তাদের পাশে আছে। এখনও যখন সাধারণ মানুষ মনে করে কম্যুনিস্টদের ভোট দিলে তারা দেশটাকে রাশিয়া কিংবা চীনের হাতে তুলে দেবে। পার্টির মধ্যে ইতিমধ্যেই বিরোধ শুরু হয়েছে। বেশি কিছু সক্রিয় কর্মী নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে বিরাগের পাত্র হয়েছেন। পার্টির মধ্যে একটা অনিশ্চয়তা চলছে এ সংবাদ বিভিন্ন ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসছিল। অনিমেষ হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল এম এ পরীক্ষাটা দিয়ে দেওয়া যাক মন দিয়ে কিছুদিন পড়াশুনা করে।
 
মৌলালির মোড়ে হেঁটে এসে মাধবীলতা বলল, ভীষণ টায়ার্ড লাগছে কোথাও বসি চল।

অনিমেষ দেখল মেয়েটার মুখটা কালো হয়ে গেছে, চোখের তলায় বেশ কালি। ওর হঠাৎ মনে হল মাধবীলতার এই চেহারা সে কোনদিন দ্যাখেনি। মুখের মধ্যে একটা খসখসে ভাব এসে গেছে, চাহনিতে ক্লান্তি বোঝা যায়।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে তোমার?

মাধবীলতা ভ্রূ কুঁচকে সেই চাহনিটা ব্যবহার করল, আমার! কী হবে?

অনিমেষ বুঝতে পারল মাধবীলতা যদি নিজে থেকে কিছু না বলে তাহলে শত চেষ্টা করেও ওর কাছ থেকে ব্যাপারটা জানা যাবে না।

মাধবীলতা হাসল, কি থেকে কি বলা। বললাম কোথাও চল বসি, না তোমার কি হয়েছে। বসতে চাইলে কিছু হতে হয় বুঝি।

অনিমেষ একটা ছোট খাটো চায়ের দোকান দেকতে পেয়ে বলল, চল এখানে বসি। তবে শুধু চা খেতে হবে।

মাধবীলতা বলল, সেটা আমি বুঝব।

দোকানটা নীচু ধরনের। অবস্থা যে ভাল নয় তা চেহারা দেখেই মালুম হয়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে যারা আড্ডা মারছিল তারা বেশ উৎসুক চোখে ওদের দিকে তাকাল। অনিমেষ সেটা দেখেও গা করল না। একটা ছোঁড়া এলে মাধবীলতা তাকে দুটো করে টোস্ট আর চা দিতে বলল। তারপর অনিমেষের দিকে ঘুরে জিজ্ঞাসা করলো, তুমি কিন্তু আজকাল সব কথা আমার কাছে বলো না।

কি কথা?

বিমানদের সঙ্গে তোমার ঠিক মিলছে না, না?

কি করে বুঝলে? অনিমেষ অবাক হল। এসব কথা ও কখনো মাধবীলতার সঙ্গে আলোচনা করেনি।

আমি কি ঠিক বলছি?

মোটামুটি।

যাক। তাহলে তোমাকে বুঝতে আমার ভুল হয় না।

অনিমেষ মাধবীলতার চোখে চোখ রাখতেই সে মুখ নামিয়ে নিল। কথাটায় এমন সুখ জড়ানো যে তা অনিমষেকেও স্পর্শ করল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে বলল, আসলে আমি এই দলের কাজকর্ম মানতে পারছি না। এরা যেভাবে চলছে এদের কোনদিনই কম্যুনিজম আসবে না। বুঝে সুঝে অন্ধ হয়।

মাধবীলতা বলল, তুমি কি অন্য কোন দলে যাবে?

অনিমেষ বলল, অন্য দল? ধ্যুৎ। সেগুলো তো আরো খারাপ। না কোন দলফল নয়, ভাবছি এখন মন দিয়ে পড়ব।

মাধবীলতা বলল, আমি তোমার রাজনৈতিক ব্যাপারে কোন কথা বলতে চাই না। তবে একটা অনুরোধ করব। হুট করে কিছু করে ফেল না। তুমি যদি বিমানদের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখতে চাও তবে ঝগড়া করে নয়, চুপচাপ কোন সংঘর্ষ ছাড়াই সরে দাঁড়াও। একদিনে করলে সেটা ধরা পড়ে যাবে তাই কয়েকদিন সময় নাও। তারপর হেসে বলল, কিন্তু এম এর রেজাল্টটা যেন ভাল হয়।

অনিমেষ বলল, তোমার চেয়ে নিশ্চয়ই ভাল হবে না।

মাধবীলতা দিয়ে যাওয়া টোস্টের ওপর গোলমরিচ ছড়াতে ছড়াতে বলল, আমার বোধ হয় পরীক্ষা দেওয়াই হবে না।

চমকে উঠল অনিমেষ সেকি! কেন?

মুখ না তুলে মাধবীলতা বলল, ওসব ছেড়ে দাও। বাড়িতে চিঠি দিয়েছ?

চোয়াল শক্ত হল অনিমেষের। কিছুক্ষণ ধরেই ও বুঝতে পারছিল মাধবীলতার কিছু হয়েছে যার জন্যে ওকে চিন্তা করতে হচ্ছে খুব এবং তার ছাপ পড়েছে চোখ মুখে। এতদিন ব্যাপারটা লক্ষ্য করেনি বলে সে নিজের ওপরই বিরক্ত হল। খুব গম্ভীর গলায় বলল, তুমি যদি কিছু না বলতে চাও তাহলে আমার পক্ষে এসব খাওয়া অসম্ভব।

হেসে ফেলল মাধবীলতা, ওমা কি ছেলে মানুষ! এখন কি আর রাগ করে খাবার নষ্ট করার বয়স আছে! খোকা কোথাকার!

ইয়ার্কিং মেরো না। তুমি যদি না চাও তাহলে অবশ্যই তোমার ব্যাপারে আমি কথা বলব না। কিন্তু সেটা জানা দরকার। অনিমেষ বলল।

মাধবীলতা বলল, অমনি রাগ হয়ে গেল।
 
অনিমেষ বলল, আমাকে কি এতই অপদার্থ ভাবো যে রাগ করবার যোগ্যতাও নেই! টেবিলের ওপর দুই কনুই, হাতের ওপর চিবুক, মাধবীলতা অনিমেষের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজেকে সামলাতে পারল না। বুকের মেঘ কখন যে টুক করে জল হয়ে চোখে গড়ায় তা যদি বোঝা যেত আগে ভাগে। অনিমেষ হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। তারপর চাপা গলায় বলল, এটা চায়ের দোকান।

দেওয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে চট করে দুচোখ সামলে নিলে মাধবীলতা। কিন্তু তার ভেতরটা ঠাণ্ডা হতে সময় লাগল আরো কিছুক্ষণ। ওরা নীরবে টোস্ট খেয়ে চায়ের কাপে হাত দিল। অনিমেষ কোন কথা বলছিল না। মাঝে মাঝে তার মাধবীলতাকে এত গভীর মনে হয় যে সে হাজার চেষ্টা করেও ডুব দিয়ে তল দেখতে পাবে না। চটুল হালকা টাইপের মেয়েদের সহজেই উপেক্ষা করা যায় কিন্তু মাধবীলতাকে নয়।

চা খেয়ে দাম দিল মাধবীলতা। তারপর রাস্তায় নেমে শিয়ালদা স্টেশনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল, বাবার জন্যেই বোধ হয় আমার এম এ পরীক্ষা দেওয়া হবে না।

মানে?

উনি মরিয়া হয়ে উঠেছেন আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য। আমি ওঁকে বলেছি এসব চিন্তা ছাড়তে। আমার মুখে এ রকম কথা উনি আশা করেননি। ফলে অগ্নিকাণ্ড আরম্ভ হয়ে গেছে। যা ইচ্ছে তাই বলছেন। আমাকে এখান থেকে বাইরে পাঠিয়ে দেবার পরিকল্পনা করছেন। যে পাত্রটিকে ওঁরা নির্বাচিত করেছেন সে বোধ হয় আমার কথা শুনে হাতছাড়া হয়ে গেছে, ফলে আরো দিশেহারা অবস্থা। আমি বলেছি পরীক্ষা অবধি অপেক্ষা করতে কিন্তু ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে তা করবে না। মাধবীলতা মাথা সোজা করে হাঁটছিল। যেন কথাগুলোর মধ্যে নিজের অবস্থাটাকে জরিপ করছিল।

অনিমেষের বুকের বেতরটা হু হু করে উঠল। সে মাধবীলতার জন্যে কিছু করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল। না যে কোন ভাবেই ওর এম. এ. পরীক্ষা দেবার ব্যবস্থা করতে হবে।

কিন্তু কেন ওরা এমন করছেন?

ওঁরা আমার ভাবগতিক দেখে ভাল বুঝছেন না তাই। হাসল মাধবীলতা, বোধ হয় বুঝতে পেরেছেন আমি মনের দিক থেকে একা নই।

তাতে কি হয়েছে?

কোন পিতামাতাই মেয়েদের নির্বাচনের ওপর আস্থা রাখতে পারে না। সব সময় ভাবে এই বুঝি বোকামি করল।

তুমি আমার কথা ওঁদের বলেছ?

হ্যাঁ।

কি বললেন, ওঁরা?

নাই বা শুনলে। শোন, আমি গত রবিবার একটা স্কুলে ইন্টারভিউ দিয়েছি। আমার এক বন্ধুর দিদি ওই স্কুলে কাজ করে। যদি চাকরিটা হয়ে যায় তাহলে বেঁচে যাব।

তুমি চাকরি করবে? পড়াশুনা করবে না?

সে পরে দেখা যাবে প্রাইভেটেও পরীক্ষা দেওয়া যায়। হয়তো চাকরিটার জন্যেই দিতে হবে সেসব এখনই ভাবছিনা। এখন যেটা সমস্যা হল সেটা একটা ভাল হোষ্টেল। তোমার জানা শোনা কোন হোষ্টেল আছে? মাধবীলতা অনিমেষের দিকে তাকাল।

অনিমেষ মাথা নাড়ল, না। তবে হোষ্টেলের খোঁজ নিতে পারি। কিন্তু তুমি বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসবে?

মাধবীলতা দাঁড়িয়ে পড়ল। দু পাশে বাড়ি ফেরা মানুষের ভিড়, হকারের চিৎকার। তারই মধ্যে স্পষ্ট গলায় জিঞ্জাসা করল, তুমি কি চাইছনা বাড়ি থেকে আমি বেরিয়ে আসি।

তুমি কি যথেষ্ট ভেবেছ?

আমার প্রশ্নের উত্তর দাওনি।

অনিমেষ একটুও ভাবলনা। বলল ওঁরা তোমাকে জোর করে অন্য কোথায় পাঠিয়ে বিয়ে দেবেন এটা আমি মানতে পারি? কিন্তু এতদিনের পরিচিত পরিবেশ আর আত্নীয় স্বজন ছেড়ে তুমি একা হোষ্টেলে এসে উঠবে এ ব্যাপারে তোমার কোন দ্বিধা আছে কিনা তাই জানতে চাইছিলাম। নিজের কাছে পরিষ্কার হলে পৃথিবীতে কে কি মনে করল তাতে কিছু আসে যায় না।
 
আমার সব কিছু পরিষ্কার যদি তুমি পাশে থাক। আমি কোন অন্যায় করিনি। বাবা যদি না মানতে পারেন তাহলে সেটা দুঃখের। আমি তো হোষ্টেলে একা থাকছিনা। তুমি তো আছ। তুমি কখনো আমায় ফেলে না গেলেই হল। মাধবীলতা হাসল। আত্নবিশ্বাস এবং লজ্জা একসঙ্গে চমকে উঠল যেন।

অনিমেষ বলল বড় আফসোস হচ্ছে।

মাধবীলতা ঘার বেকাল। কেন?

নিজেকে খুব অপদার্থ মনে হচ্ছে। তুমি যখন এত বড় ঝুঁকি নিচ্ছ তখন আমার হাতে একফোঁটা জোর নেই। এখনো বাবার পাঠানো টাকার ভরসায় থাকি। আমার উচিত তোমাকে বিপদ থেকে বাঁচানো কিন্তু দ্যাখো শুধু কথা ছাড়া আমি কিছুই করতে পারছি না। দেখি কি করতে পারি।

শেষের কথাটা একটু চিন্তা জরানো গলায় বলল অনিমেষ। মাধবীলতা বলল, এই তুমি কি চাও আমি এখানে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদি।

মানে?

আর একবার ওইসব কথা বললে আমি এমন সিন করব যে তুমি মজা বুজবে।

কিন্তু

কোন কিন্তু নয়। আমার কথা তোমার ভাবতে হবেনা। তুমি এম, এ, পাস করে…। না ভেবে কথাটা শুরু করে হঠাৎ থেমে গেল মাধবীলতা।

থামলে কেন? হাসল অনিমেষ। বাংলায় এম, এ, পাস করে কেউ চাকরি পায়না। আমি পরীক্ষা দেব দু তিন জন মানুষের ইচ্ছা পুরণ করতে। কিন্তু চাকরি যদি করতে হয় তাহলে বি, এ, পাসের ডিগ্রীটাই যথেষ্ট। তাছাড়া যদি বলি রাজনীতি করতে চাই লোকে আমাকে হাম্বাক ভাববে। যেন ওটা করার জিনিষ নয়। এককালে যারা সিরিয়াসলি কম্যুনিষ্ট পার্টি করত গণনাট্য করত এমন কয়েকজনকে আমি জানি তারা কি দুরবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। তাঁরা সারাজীবন চাকরি পাননি। অবস্থা যদি না পাল্টায় তাহলে এদেশে যারা রাজনীতি করতে চায় তারা না খেয়ে মরবে কিংবা চোরাপথে টাকা নিয়ে বিত্তশালী হবে। দ্বিতীয়টা আমার দ্বারা হবে না। অতএব আমার সঙ্গে ভাগ্যে হয়তো তুমি সারাজীবনের জন্যে পাকাপাকি অশান্তি ডেকে আনলে।

মাধবীলতা খুব মনযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনছিল। শেষ হলে বলল আমি এখন কোন কথা বলব না। যদি চাকরিটা পাই তাহলে এর জবাব পাবে। আমি যা করব তা করেই দেখাতে চাই। আগে থেকে লম্বা চওড়া কথা বলে কোন লাভ নেই। শুধু তুমি আমার একটাই কাজ করে দাও, এ মাসের মধ্যেই একটা ভদ্ৰ হোষ্টেল খুঁজে দাও। চাকরিটা যেহেতু দক্ষিণেশ্বরের দিকে নর্থে হোষ্টেল হলে ভাল হয়।

ওরা হাঁটতে হাঁটতে শিয়লদা ষ্টেশনের ভেতরে ঢুকে পড়েছিল। আজ হঠাৎ মাধবীলতাকে ওর ভীষন আপন মনে হচ্ছে। এই মেয়েটা শুধু অনিমেষের জন্যেই তার সব রকম নিরাপদ জীবনের মায়া ত্যাগ করে বেরিয়ে আসতে চাইছে এর চেয়ে বড় অহংকার তার কি আছে। কিন্তু একথাটা ভাবলেই নিজেকে ভিষন অসহায় মনে হয়। তার সামনে কত কি করার আছে অথচ সে কিছুই পারছে না। একজন প্রেমিক হিসেবে যেমন একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তেমনি কোন ফারাক নেই। দুটো হাত আছে কিন্তু তাতে একটাও আঙ্গুল নেই। ক্রমশ একটা অপদার্থ ছাড়া নিজেকে কিছুই মনে হচ্ছে না।

ট্রেনে উঠে মাধবীলতা বলল, শোন একদম মাথা গরম করবে না। সব কিছু আমার উপর ছেড়ে দাও।

সব কিছু মানে আমি সুদ্ধু?

আমার সবতো তুমিই।

ট্রেন চলে গেলে অনিমেষ যখন স্টেশন থেকে বেরিয়ে আসছিল তখন তার পা ভারী, ভীষন ক্লান্ত লাগছে হঠাৎ। মাধবীলতার শেষ কথাটা অন্য সময় শুনলে সম্রাট মনে হত। আনন্দে বুকের ভেতরটা আশ্বিনের সকাল হয়ে যেত। কিন্তু এখন, এখন সে খুশি হতে পারছে না কেন। সেই যে দুপুরটা যার শরীরে রোদ নেই মরা আলো ন্যাতানো, মাথায় মেঘের জলজ ছাতা, সময়টা যেন কাটতেই চায়না, ঠিক সেই রকম লাগছে।

হোস্টেলে ফিরেই শুনল তাকে কে একজন ডাকতে এসেছিল। দারোয়ান নাম বলতে পারল না। বলল, সাহেব ওপরে গিয়েছিলেন। সাহেব? অনিমেষ এদিক-ওদিক দেখল। কে এসেছিল না জানলে খুব অস্বস্তি হচ্ছে। হঠাৎ ওর মনে হল মাধবীলতার বাড়ি থেকে কেউ আসেনি তো? ওর বাবা? অনিমেষ ঠোঁট কামড়ালো। যদি তিনি আসেন তাহলে সে কি তর্ক করবে না ভদ্রলোককে বোঝাবে যে তিনি মেয়ের উপর ভুল করছেন?

ঠিক সেইসময় তমাল ঘর থেকে বেরিয়ে ওকে দেখে বলে উঠল, কখন ফিরলে?

এই তো।

তোমার কাকা এসেছিলেন।

কাকা?

তমাল আবার ঘরে ফিরে গিয়ে একটা কার্ড বের করে এনে ওর হাতে দিল, অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিলেন। বলেছিলেন আগামী কাল সকালে যেন তুমি অবশ্যই যাও। গ্র্যাণ্ড হোটেলে আছেন।

অনিমেষ চকচকে কার্ডটায় দেখল, প্রিয়তোষ মিটার লেখা, আর কিছুই নেই।
 
কার্ডটা হাতে নিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল অনিমেষ। প্রিয়তোষ মিটার যে ছোট কাকা তো বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। কিন্তু এ রকম আচমকা ছোট কাকা এই হোস্টেলে এলেন কোত্থেকে? ওঁর তো এখানে থাকার কথাই নয়। সেই কবে বাইরে চলে গেছেন, মস্কো বোধ হয়। দাদু তো সে রকমই বলেছিলেন, কবে ফিরে এলেন? কার্ডটায় আর কিছু লেখা নেই কিন্তু কাগজটা খুব দামী, ছুঁলেই বিদেশী বলে মনে হয়। ওর ইচ্ছে করছিল তমালকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করে কিন্তু তমাল ততক্ষণে নীচে নেমে গেছে। অনিমেষ নিজের ঘরে ঢুকল।

মিত্রকে মিটার বলা দুচক্ষে দেখতে পারে না অনিমেষ। বাঙালী পদবীগুলোকে এভাবে বিকৃত করলেই সাহেব হওয়া যায়? দারোয়ান অবশ্য ওকে সাহেব বলেছে। তার মানে ছোট কাকার চেহারাটা পালটে গেছে। সেই রোগাটে পাজামা পাঞ্জাবি। ভাবতে গিয়েই সচকিত হল। এই চেহারাটা তো সেই সময়ের যখন পুলিশ তাদের বাড়ি সার্চ করতে এসেছিল। কিন্তু তারপর যখন ছোট কাকা কলকাতা থেকে প্লেনে জলপাইগুড়িতে এসেছিলেন তখন তো রীতিমতই সাহেব। মন্ত্রীর পেছন পেছন প্লেন থেকে নেমে এসেছিলেন ছোট কাকা। চোখ বন্ধ করতেই দৃশ্যটা দেখতে পেল অনিমেষ, অ্যাশ কালারের স্যুট লম্বা সুরু নীল টাই, চোখে চশমা, হাতে বড় অ্যাটাচি ব্যাগ। তাহলে তো ছোট কাকা এতদিনে আরো কড়া সাহেব হয়ে গেছেন। আট নয় বছর তো হয়ে গেল। অনিমেষের মনে পড়ল পুলিশ আসার আগে যে রাতে ছোট কাকা নিঃশব্দে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল সেই রাতে সে প্রথম একটা কাগজে মার্কসবাদী শব্দটা দেখেছিল। ছোট কাকা তখন কট্টর কমুনিস্ট ছিলেন। তারপর যখন ফিরে এলেন তখন তিনি কী, বুঝতে পারেনি অনিমেষ। কংগ্রেসী বিরাম করের সঙ্গে যেমন দোস্তি তেমনি কম্যুনিস্ট নেতাদের সঙ্গেও ভাব করার চেষ্টা ছিল তখন। দালাল বলে টাকা বিক্ষোভও হয়েছিল তখন। আর এখন ছোট কাকা কোন ভূমিকায়? যে ভূমিকাতেই হোক সরিৎশেখর যখন প্রচণ্ড অর্থকষ্টে জর্জরিত তখন তিনি সাহেবী করে বেড়াছে, এটাকে ক্ষমা করা অসম্ভব। অনিমেষ ঠিক করল সে গ্র্যাণ্ড হোটেলে যাবে না। যে মানুষ অবহেলায় নিজের স্বার্থের জন্য বাবা দিদিকে ছেড়ে এতকাল বাইরে ডুব দিয়ে বসেছিলেন তার সম্পর্কে আজ আর কোন দুর্বলতা তার নেই।

সকাল বেলায় একজন দাড়িকাটা পাঞ্জাবী তার কাছে এল। অনিমেষ তখন এই পত্র নাড়াচাড়া করছে, দেখে অবাক হল।

নমস্কার করে লোকটা বলল, সাব গাড়ি লেকে আয়া।

ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কিসের গাড়ি?

সাব ভেজ দিয়া গ্র্যাণ্ড হোটেলসে।

ছোট কাকা তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ি পাঠিয়েছেন। অনিমেষের আর অবাক হওয়ার মত নার্ভ ছিল না। তাকে এত খাতির কেউ করতে পারে সামনে দাঁড়ানো লোকটার নিতী ভড়িঙ্গ দেখে ও দ্বিতীয় চিন্তা করল। যে কোন কারণেই হোক ছোট কাকার তাকে দরকার। সে যতই এড়াতে চাইবে তিনি ছাড়বেন না। এই লোকটিকে ফিরিয়ে দেবার পর তিনি যদি নিজে আসেন তাহলে খামোকা বিব্ৰত হতে হবে। মুখের ওপর তাকে কালকের ভাবনাগুলো বলা যাবে না। সম্পর্কটাকে তিক্ত না করে মানসিক সম্পর্কহীন একটা সাক্ষাৎকার সেরে আসাই ভাল।

ইচ্ছে করেই পাজামা পাঞ্জাবী পরল অনিমেষ। গ্র্যাণ্ড হোটেলে যেতে হলে যেসব পোশাকের কথা মনে পড়ে তা অবশ্য ওর নেই। না থাকলে মানুষ যেমন একটা বোহেমিয়ান ভাব দেখিয়ে উপেক্ষা করতে চায় সেও তেমনি ইস্ত্রি না করা পাঞ্জাবী গায়ে চাপালো। গাড়িতে বসে অনিমেষ বুঝতে পারল, এগুলোকে লাক্সারী ট্যাক্সি বলে। খুব যত্ন করে রাখা বলে বেশ আরামদায়ক। জিজ্ঞাসা করে জানল হোটেলের বড় সাহেবরা কলকাতায় থাকাকালীন দিন রাতের জন্য এ রকম গাড়ি ভাড়া করেন। সাধারণ মানুষের ক্ষমতার বাইরে এ গাড়ির ভাড়া।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top