What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected কালবেলা- সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

নদীটার ওপর মাত্র একটাই সেতু এবং সেটা কাঠের। গণফৌজকে ওই নদী পেরিয়ে যেতে হবে। মিছিল যখন নদীর কাছাকাছি এসে পড়ল তখন চিয়াং কাইশেকের সৈন্যরা মেশিনগান সাজিয়ে বসে গেছে নদীর অন্যপাড়ে। এদিন চিয়াং–এর অপর বাহিনী ইঁদুরকচে মিছিলকে ঠেসে ধরবার জন্যে পেছন থেকে ধাওয়া করে এল। সেচুয়ানের পার্বত্য অঞ্চলে এই ভীষণ নদীটির ওপর পুরোন আমলের ভাঙ্গাচোরা কাঠের ঝলপুল পার হতে হবে গণফৌজকে। অপর পাড়ে যে মেশিনগানগুলো প্রস্তুত সে খবরও এসেছে।

প্রথম দল এগিয়ে চলল দৃঢ় পদক্ষেপে। সেতুর মাঝামাঝি আসতেই শুরু হয়ে গেল গুলীবর্ষণ। চোখের নিমেষে মানুষগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল, লাল হল তাতু নদীর জল। পরের দল বন্দুক ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগোল ওই ছোট সেতুর ওপর দিয়ে কিন্তু মেশিনগান তাদের আলতো করে তুলে নিল এবারও। এবার গণফৌজ আরো মরিয়া হয়ে উঠল। মৃত্যু যেখানে অবশ্যম্ভাবী সেখানে মৃত্যুকেই ব্যবহার করা যাক জীবনকে অর্জন করতে। এবার কোন ছোট দল নয়, গণফৌজ নেমে পড়ল সার দিয়ে। মেশিনগানের আঘাতে মানুষ মরছে কিন্তু তার জায়গা নিয়ে পরের জন সেতুর ওপর আর একটু এগিয়ে আসছে। তার মৃতদেহ যেখানে পড়ছে তা থেকে পরবর্তী মুক্তিসেনা আরও কয়েক পা মিছিলকে এগিয়ে দিচ্ছে। এবার চিয়াং-এর বাহিনী নতুন অস্ত্র প্রয়োগ করল। ফ্রেম থ্রোয়ার ছুঁড়ে ওরা ঝুলনপুলের কাঠে আগুন ধরিয়ে দিল। দাউ দাউ করে জ্বলছে সেতু। মাঝপথেই পুড়ে নদীতে পড়ে গেল প্রথম সারির মানুষগুলো। কিন্তু পিছু হটলো না চীনের মুক্তিপৌঁজ, সেই লকে আগুনের সামনের দাঁড়িয়ে তারা এক অমানুষিক কাণ্ড করল। জ্বলন্ত পুলের ওপর দিয়ে অবিশ্রান্ত গুলীবর্ষণে টুপটাপ নদীর বুকে ঝরে যেতে যেতে প্রথম দলটা সেতু পার হল। চোখের সামনে ঝাঁকে ঝাঁকে জ্বলন্ত শরীর ছুটে আসছে দেখে চিয়াং–এর সৈন্যরা হতভম্ব। কতখানি আবেগ মানুষের বুকে পাহাড় হলে এইভাবে আত্মাহুতি দেওয়া যায় তার সন্ধান ওরা জানতো না। এই অতিমানবিক ঘটনা দেখে চিয়াংবাহিনীর সৈন্যরা ভয় পেল। তারা মেশিন গান ছেড়ে পালাতে লাগল এবার। দগ্ধ যারা তারা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। কিন্তু অর্ধদগ্ধ শ্রান্ত মুক্তিসেনারা এবার ওই পরিত্যক্ত মেশিনগানের গুলীর ছাতির আড়ালে নিরাপদ রেখে ওরা নদী পার করিয়ে নিয়ে এল।

পথে বাধা ছিল অনেক। হিংস্র চীনবিরোধী পার্বত্য উপজাতিদের গুপ্ত আক্রমণের ভয়, সুবিশাল চোরা গহ্বরসঙ্কুল তৃণভূমি অতিক্রম করার সমস্যা। মুক্তিফৌজ ওই পথ পেরিয়ে এল মাও সে তুং এর নেতৃত্বে। ষোল হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ের বরফ ডিঙ্গিয়ে দুহাজার মাইলের সেই ভয়ঙ্কর তৃণভূমি মাড়িয়ে হিংস্র উপজাতিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে উনিশশো পঁয়ত্রিশ সালের বিশে অক্টোবর গিয়ে পৌঁছালো পাও আন–এ। সৃষ্টি হল মুক্ত অঞ্চল। কোনসি প্রদেশের ইয়েনান হল সাতচল্লিশ সাল পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর রাজধানী। নব্বই হাজার মানুষ নিয়ে শুরু করা যাত্রা তখন তিরিশ হাজারে এসে ঠেকেছে কিন্তু সাফল্য তখন করায়ত্ত। তারপর সেই মুক্ত অঞ্চল ক্রমশ বিস্তৃত হতে লাগল। কিন্তু সেখানেও সমস্যা জমেছিল অনেক।

চিয়াং কাইশেকের শিক্ষিত সৈন্যরা মুক্ত এলাকা দখল করতে দৃঢ়প্রতিক্ষ। তারা আক্রমণ করছে। মুক্তিসেনাদের। পার্টির নেতৃত্বে আর যারা ছিলেন তাঁরা পিছু হটতে চাইলেন না। ভাবাবেগে বললেন, এত কষ্টে তৈরী করা এই মুক্ত অঞ্চরের এক ইঞ্চি জমিই বা আমরা ছাড়বো কেন? ঘরদুয়োর, জিনিসপত্র শত্রুকে দিয়ে পালিয়ে যাব? সব এলাকাতেই প্রতিরোধ করতে হবে। মাও সে তুংকে তারা বললেন, জঙ্গলে পাহাড়ে মার্কসবাদ বিকাশলাভ করে না।

মাও সে তুং এই মতকে মানলেন না। শুত্রপক্ষ যখন অনেক আধুনিক অস্ত্রে শক্তিশালী তখন মুখোমুখি লড়াই করা ঠিক নয়। বিনা বাধায় শত্রুকে মুক্তাঞ্চলে ঢুকতে দাও। তারপর আমাদের এলাকার মাঝামাঝি এসে যখন এই বিরাট বাহিনী ছাউনি গেড়ে বসবে তখন হঠাৎ আক্রমণ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করবো। সেই ছত্রভঙ্গ সেনাবাহিনীকে তারপর আলাদা আলাদা আক্রমণ করে নিশ্চিহ্ন করতে হবে।

ফল পাওয়া গেল হাতে হাতে। গেরিলাযুদ্ধের এই কৌশল বিপ্লবকে আর এক ধাপ এগিয়ে দিল। মার্কসবাদের প্রধান কর্মক্ষেত্র য়ুরোক থেকে এত দূরে এশিয়ার একটা দেশের পাহাড় জঙ্গলে মাকর্সবাদ লেনিনবাদের নির্দিষ্ট প্রয়োগে মাও সে তুং একটি জাতির জন্মান্তর সৃষ্টি করলেন।

লিফলেটের শেষ কথা এই সংগ্রাম আমাদের একমাত্র পথনির্দেশিকা থোক। অনিমেষ এখন চোখ বন্ধ করলেই সেই জ্বলন্ত ঝুলনপুলের ওপর ছুটে যাওয়া অগ্নিপুরুষদের দেখতে পাচ্ছিল। এই পথ, একমাত্র পথ।
 
দুদিন মাধবীলতা য়ুনিভার্সিটিতে আসেনি। না বলে-কয়ে হঠাৎ ডুব দেবার মেয়ে ও নয়। অনিমেষ অস্থির হয়ে পড়ল। নিমতার বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নেবার ইচ্ছা হলেও ঠিক সাহস হচ্ছিল না। সাহস না হবার কারণ ইদানিং ওদের বাড়িতে যে গরম হাওয়া বইছে তাতে ওর যাওয়াটা আগুনে আরও ঘি ঢালার মত না হয়ে যায়। মাধবীলতার সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা সহপাঠীরা ইতিমধ্যে জেনে গেছে। কিন্তু অনিমেষ কারো সঙ্গে যেচে মাধবীলতাকে নিয়ে কথা বলেনি। তাই এখন কী করা যায় তা আলোচনার মত কোন বন্ধুকে পেল না সে। পরমহংস থাকলে একরকম হতো কিন্তু সে এখন য়ুনিভার্সিটিতে শুধু নামটাই রেখেছে। ওর বাবা রিটায়ার্ড হবার সময় ছেলেকে নিজের ব্যাঙ্কে বসিয়ে গেছেন।

গতকাল একটা কাণ্ড হয়ে গিয়েছে। ক্লাস থেকে বেরিয়ে ও কফিহাউসের দিকে হাঁটছিল এমন সময় সুদীপ ওকে ডাকল, কি ব্যাপার অনিমেষ, তোমার পাত্তাই পাওয়া যাচ্ছে না। ভাবছিলাম তোমার খোঁজে হোস্টেলে কাউকে পাঠাবো। তুমি রোজ ক্লাস করছ?

শেষ প্রশ্নটার উত্তর দিল অনিমেষ হ্যাঁ।

সেকি! তাহলে আমাদের সঙ্গে দেখা করছ না কেন?

আজকাল আর সময় পাই না। পরীক্ষা আসছে। কথাটা বলেই অনিমেষের মনে হল এটা কোন যুক্তি নয়। বিমানরা এ-বছর পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্টের আশায় বসে আছে। ওদের তো পরীক্ষার জন্যে কাজকর্ম করতে কোন অসুবিধে হয়নি।

সুদীপ চুরুট বের করল, তুমি কি আর য়ুনিয়নের সঙ্গে যুক্ত থাকতে চাইছ না?

কয়েক মুহূর্ত ভাবল অনিমেষ। না, আর মিথ্যে কথা বলে কি লাভ! সে স্পষ্ট বলল, না।

কেন? সুদীপ চমকে উঠল।

আমার মনের সঙ্গে আপনাদের কাজকর্ম মিলছে না। যে-পথটাকে সমর্থন করতে পারছি না সে পথে হাঁটতে আমার বিবেকে বাধে।

তুমি কি ভেবেচিন্তে কথা বলছ?

না ভেবে বলছি এ ধারণা কেন হচ্ছে?

কারণ তোমার সম্পর্কে পার্টির নেতাদের কেউ কেউ ইন্টারেস্টেড। তোমার কি কারো সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল?

না তো। অনিমেষের মনে পড়ল সেই ভদ্রলোককে যিনি কাকার হোস্টেলে তাকে কৃতার্থ করতে চেয়েছিলেন।

সুদীপকে খুব হতভম্ব দেখাচ্ছিল, অনিমেষ, তুমি কি নেক্সট ইলেকশনে কনটেস্ট করছ না? তুমি নিশ্চয়ই জাননা এবার তোমাকে কি পোর্টফলিও দেওয়া হবে।

না সুদীপদা। আমাকে ছেড়ে দিন। আপনাদের পথ আমার জন্যে নয়।

সুদীপের মুখটা এখন ভেঙ্গেচুরে একাকার। সে যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।

অনিমেষ হেসে বলল, চলি, যদি চান তো আমার রেজিগনেশন লেটার পাঠিয়ে দেব। কারণ। এখনও তো কমিটি মেম্বার আছি আমি।

সুদীপ হঠাৎ বলে উঠল, তোমার সঙ্গে কি সুবাস সেনের যোগাযোগ হয়েছে?

কেন বলুন তো?

আমার তো তাই মনে হচ্ছে।

আপনি বুদ্ধিমান। অনিমেষ আর দাঁড়াল না। রাস্তায় নেমে মন খুব হালকা হয়ে গেল। ব্যাপারটা আজ নয় কাল পরিষ্কার করতেই হতো। আজ সুদীপ নিজে এগিয়ে এসে সেটা সহজ করে দিল। সুদীপ নিশ্চয়ই এখন বিমানকে গিয়ে একথা জানাবে এবং তারপর বাম ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে অনিমেষের সম্পর্ক যে নেই একথা ঘোষণা করা হবে। অনিমেষের মনে হচ্ছিল, অনেকদিন জ্বর ভোগের পর যেন আজ তার শরীর নিরুত্তাপ।
 
কফিহাউসে ওদের ক্লাসের দুতিনজন ছেলে আড্ডা দিচ্ছিল, অনিমেষ ওদের টেবিলে গিয়ে বসল। একটু অন্যমনস্ক ছিল বলে প্রথমে টের পায়নি, খেয়াল হতে বুঝল ওরা যেন কথাবার্তায় আড়ষ্ট হয়ে গেছে। কিংবা এতক্ষণ ওরা যা আলোচনা করছিল সে এসে পড়ায় তা পালটেছে। অনিমেষ বলল, একজন যার নাম প্রশান্ত হাসল, না না, বসো।

কিন্তু আমার মনে হচ্ছে করলাম। তোমরা কি নিয়ে আলোচন করছিলে?

ও ছেড়ে দাও। তোমার ভাল লাগবে না।

ভাল লাগবে না কেন?

আমরা সাধারণ মানুষ আর তুমি রাজনৈতিক কর্মী তাই।

প্রথম কথা তুমি যেটি বললে আমি তা নই। আর একজন রাজনৈতিক কর্মী যদি সাধারণ মানুষ না হয় তাহলে তিনি ক্রিমিন্যাল। বল।

রোগা মতন একটি ছেলে, অনিমেষ তার নাম জানেনা, বলল, সব কথা তো সবার সঙ্গে আলোচনা করা যায় না। এটা আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার।

অনিমেষ একটু হোঁচট খেল সে হাসবার চেষ্টা করে বলল, সরি। প্রশান্ত বলল, না, না, অনিমেষ, তোমার কিছু মনে করার কারণ নেই। আমরা স্ল্যাং নিয়ে আলোচনা করছিলাম তোমার মত সিরিয়াস ছেলের সামনে এসব কথা বলা ঠিক নয় তাই বলছি না।

স্ল্যাং? মানে অশ্লীল কথা? চোখ বড় বড় করল অনিমেষ। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হল আরো তিনজন নিজেরা যা আলোচনা করতে পারছে সহপাঠী হয়েও সে আলোচনায় তাকে জড়াতে দ্বিধা করছে। সামান্য য়ুনিয়ন করেই সে এভাবে দূরত্ব বাড়িয়ে ফেলেছে। এদের সঙ্গে মিশবার জেদ এল ওর। বলল, খুব ইন্টারেস্টিং সাবজেক্ট! আমি শুনতে পারি না?

প্রশান্ত বলল, কথ্যভাষায় যে অশ্লীল গালাগাল চলে আসছে তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কেমন পালটে যাচ্ছে। যেমন ধরো এককালে কেউ শালা শব্দটা ব্যবহার করে মনের ঝাল মেটাতো। তখন গুরুজন বা মেয়েদের সামনে কথাটা ব্যবহার করতে সাহস হতো না। এই শব্দটা প্রয়োগ করলে মারামারি পর্যন্ত হয়ে যেত। কিন্তু এখন ওটা জলের মত সহজ, মেয়েরাও বলে। এবং এখনকার রকবাজ ছেলেরা শালা ব্যবহারই করে না। এরকম আরো আছে, ভোদা, উজবুক, বুদ্ধু এইসব শব্দ ব্যাকডেটেড হয়ে গেছে।

রোগা ছেলেটি বলল, এখন দু-অক্ষর চার অক্ষরের শব্দ এগুলোকে রিপ্লেস করেছে। মজার কথা হল এরা যখন ওই শব্দগুলোকে উচ্চারণ করে তখন তার অর্থ বা অশ্লীলতা সম্পর্কে কোন রকম সচেতন না হয়েই করে। জিভের ডগায় এত সহজে এসে যায় যে ওরা তা নিজেই জানে না। কোনদিন দেখল গল্প-উপন্যাসেও শালা শব্দের মত এগুলো খুব স্বছন্দে লেখা হচ্ছে।

অনিমেষের বেশ মজা লাগছিল বিষয়টা শুনতে। সত্যি কথাই, পথেঘাটে আজকাল কিছু ছেলে পুরুষাঙ্গের একটি প্রতিশব্দ বিকৃতভাবে শালার বিকল্প হিসেবে বাক্যে ব্যবহার করে। তা নিয়ে তাদের সত্যি কোন বিকার নেই। ট্রামে-বাসে প্রকাশ্যে ওরা বলে যায় এবং আমার সেগুলো নীরবে শুনে থাকি। একটা শব্দ শ্লীল কি অশ্লীল তা আমরাই ঠিক করে নিই, আমরাই তা পরিবর্তন করতে পারি। অনিমেষ বলল, কথাটা ঠিক। তবে শুধু বাংলা ভাষা কেন, পৃথিবীর সব ভাষাতেই এটা হচ্ছে। লেখাতেও আসবে বইকি।

রোগা ছেলেটি বলল, শব্দ থেকে যদি গল্প বের হয় তাহলে আমরা চিৎকার করি। কিন্তু কতগুলো নিরীহ শব্দ পাশাপাশি দাঁড়ালে নিরীহত্ব হারিয়ে অশ্লীল শব্দের চেয়ে তীব্রতর হয়ে উঠে। তখন?

অনিমেষ বলল, ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না।

ছেলেটি হাসল, এটা অবশ্য আমার আবিষ্কার। রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতার লাইন আছে সেগুলোকে আপাতচোখে খুব নিরীহ দেখায় কিন্তু একটু ভাবলেই তা থেকে অন্য মানে বেরিয়ে আসে।

ভুরু কোঁচকালো অনিমেষ, অন্য মানে মানে? কি যা তা বলছ?

ছেলেটির হাসি থামছিল না। সে হাত নেড়ে বলল, এটা তো যে ভাবছে তার ভাবনার ওপর নির্ভর করে। কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষ হো হো করে হেসে উঠল।

ছেলেটি ততক্ষণে খুব সিরিয়াস, বলল, তাহলে বুঝতেই পারছ যে শুনছে সে-ও কেমন করে শুনছে। তার ওপর শ্লীল অশ্লীল নির্ভর করে।

অনিমেষ কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার চোখ দরজার দিকে যেতেই সে চুপ করে গেল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি আসছি।

মাধবীলতা তখন হলঘরে ঢুকে এদিকে তাকাচ্ছিল। অনিমেষকে দেখতে পেয়ে কাছে এগিয়ে এল, তোমার এখন কোন কাজ আছে?

অনিমেষ মাথা নাড়ল, না।

তাহলে চল। ওকে খুব চঞ্চল দেখাচ্ছিল।

এখানে বসবে না? অনিমেষ ওকে বুঝতে পারছিল না।

না! বড্ড ভিড় এখানে কথা বলা যাবে না। মাধবীলতা হলের বাইরে বেরিয়ে আসতে অনিমেষ সঙ্গী হল। খুব চঞ্চল দেখাচ্ছে ওকে, মুখে ঘাম, কপালে খুচরো চুল এসে পড়েছে। দুদিন অনুপস্থিত এবং এইরকম চঞ্চলতার কারণ না জানা অবধি অনিমেষের স্বস্তি হচ্ছিল না। খুব গম্ভীর দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। জামাকাপড়ও আজ অন্যদিনের মত উজ্জ্বল নয়।
 
কলেজ স্ট্রিট দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞাসা করল, কলেজ স্কোয়ারে বসবে?

একটু ভেবে মাধবীলতা জানাল, না, খিদেও পেয়েছে, বসন্তে চল। তারপর হেসে চিমটি কাটল, মানে?

এই দুপুর রোদে কলেজ স্কোয়ারে কারা বসে মশাই? ঠোঁট টেপা অবস্থায় গলা দিয়ে একরকম হাসির আওয়াজ তুলল মাধবীলতা।

বসন্তের বারান্দায় বসে দুটো মোগলাই পরোটার অর্ডার দিল মাধবীলতা। দিয়ে এক গ্লাস জল চকচক করে খেল। অনিমেষ দেখল ওর গলার নীলচে চামড়ার ভিতর দিয়ে জলটা যে নেমে যাচ্ছে। তা স্পষ্ট বোঝা গেল। রুমালে মুখ মুছে একটু শান্ত হলে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, এবার বল তো কি হয়েছে? মাধবীলতা ওর চোখের দিকে তাকাল। কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা এবং শেষ পর্যন্ত দুষ্টমিমাখা হাসিতে মাধবীলতার চোখদুটোকে উজ্জ্বল দেখল অনিমেষ। কথা না বলে তাকিয়ে থাকা সময়টায় বড় অস্বস্থি হয়। সে পরিস্থিতিটাকে সহজ করার জন্য বলল, দুদিন এলে না কেন, শরীর খারাপ হয়েছিল?

মাধবীলতা মুখে কিছু না বলে মাথা নাড়ল, না।

তাহলে? বাড়িতে কোন গোলমাল হয়েছিল?

এবার একটু গম্ভীর হল মাধবীলতা, সে তো লেগেই আছে। দুদিন দ্যাখোনি, আমি ভাবলাম নিশ্চয়ই বাড়িতে গিয়ে হাজির হবে।

অনিমেষ বলল, হতাম যদি জানতাম আমি গেলে তুমি কোন অসুবিধের পড়বে না। তবে আর দুতিনদিন না এলে কি করতাম জানি না।

থাক, আর বীরত্ব দেখাতে হবে না। এই জানো, আমার চাকরিটা হয়ে গেছে। হাসতে হাসতে বলল মাধবীলতা। হঠাই।

খুব আনন্দ হল অনিমেষের। একটু জোরেই সে বলে উঠল, সত্যি?

নিঃশব্দে হাসতে হাসতে মাথা নাড়ল মাধবীলতা, হ্যাঁ!

পরক্ষণেই অনিমেষের মনে বিষণ্ণতা ছড়াল, কিন্তু, তুমি কি পরীক্ষা দেবে না?

মাধবীলতা বলল, কেন দেব না? ক্লাস তো প্রায় শেষ হয়ে এল, বাকিটা মাঝে মাঝে এসে ম্যানেজ করে যাবে। আর পড়াশুনার ব্যাপারে তুমি রইলে।

আমি?

বাঃ, একসময় আমি তোমার নোটস টুকেছি তুমি করবে আমার জন্যে। বলে হাসতে লাগল মাধবীলতা। তারপর মাথা নেড়ে বলল, তোমাকে আমার জন্যে মোটেই চিন্তা করতে হবে না মশাই। ও আমি ঠিক ম্যানেজ কর নেব।

অনিমেষ উজ্জ্বল হল, যাক, তোমার খুব ভাল কপাল। কেউ চাকরি পাচ্ছে এখবর সচরাচর শোনা যায় না।

মাধবীলতা বলল, কপাল যদি বল তাহলে সেটা আমার একার নয়। আমাদের।

অনিমেষ মাধবীলতা মুখের দিকে অপলকে তাকাল। ওর খুব ইচ্ছে করছিল এখনই ওকে নিয়ে সরিৎশেখর এবং হেমলতার কাছে নিয়ে যায়।

মাধবীলতা বলল, এই, ওভাবে তাকাবে না।

কিভাবে?

জান না। আমাদের এখনও অনেক কিছুর জন্যে অপেক্ষা করতে হবে। ওভাবে তাকালে আমার সবকিছু গোলমাল হয়ে যায়।


অনিমেষ হঠাৎ বুকের মধ্যে এক ধরনের চাপ অনুভব করল। এ সময় অবধি তার যা কিছু ভাবনা চিন্তা তা সে একাই করেছে। ছেলেবেলা থেকেই একা একা থাকার জন্যে এটা হতে পারে। কিন্তু মাধবীলতার বন্ধুত্ব পাওয়ার পর নিজেকে নিশ্চিন্ত মনে হয়, যা এর আগে কখনও হয়নি।

পুরুষ মানুষ যদি কোন নারীর আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো ভালবাসা না পায় তাহলে তার বেঁচে থাকা অর্থহীন।

মাধবীলতা বলল, অনি, আবার কি ভাবছ?

অনিমেষ হেসে ফেলল, ডাকটা কত মিষ্টি লাগল ওর। এই প্রথম তাকে অনি বলে ডাকল মাধবীলতা। সেটা বুঝতে না দিয়ে বলল, আমি ভাবছি এবার থেকে তোমার দেখা পাব কি করে? তুমি রোজ কি আসবে?

কেন আসব না?

এতটা উজানে?

আসব। তোমাকে না দেখলে আমার ভাল লাগে না।

এই দুদিন তো দেখলাম!

রাগ করতে গিয়েও করল না মাধবীলতা, অমন করে বলো না। দুদিন ধরে এই চাকরিটার জন্যে যা চরকিবাজি করেছি! আসতে পারিনি বলে আমারই খারাপ লেগেছে। ভেবেছি একবারে এসে তোমাকে সুখবরটা দেব। দিলাম।

খাওয়া হয়ে গেলে মাধবীলতা কব্জি ঘুরিয়ে সময় দেখল। তারপর বলল, চল!

অনিমেষ বলল, কোথায়?

আমি যদি বলি নরকে, তুমি যাবে না?

চিন্তা করব। কারণ সেখানে নাকি বিশাল কড়াই-এ গরম তেল দিনরাত ফোটে, গেলেই চুবিয়ে দেয়।

ওঃ, কথায় তোমার সঙ্গে আমি পারব না। আমি শ্যামবাজার যাব। তুমি আমার সঙ্গে চল। প্লেট থেকে মৌরি তুলে দাঁতে কাটল মাধবীলতা।

কাজটা কি?

বাসস্থান খুঁজতে।

বাসস্থান? অনিমেষ হতভম্ব হয়ে গেল।

আমার একটা থাকার জায়গা চাই না? দুটো লেডিস হোস্টেলের খবর পেয়েছি। চলো, গিয়ে দেখি সেখানে জায়গা আছে কি না। গম্ভীর গলায় জানাল মাধবীলতা। এতক্ষণে সব কথা মনে পড়ল অনিমেষের। চাকরি পেলেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসবে বলে জানিয়েছিল মাধবীলতা। সেটা যে এতটা স্থির সিদ্ধান্ত তা অনুমান করতে পারেনি। হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে কিছু করে ফেললে সারাজীবন মেয়েটাকে এজন্যে আফসোস করতে হবে।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ব্যাপরটা কি এতই সিরিয়াস?

মানে? ভুরু কোঁচকাল মাধবীলতা।

এখনই হোস্টেলে থাকতে হবে এমন কিছু কি হয়েছে?

তুমি কি বলতে চাইছ আমি বুঝতে পারছি না।

যদি অ্যাডজাস্ট করে বাড়িতে থাকা যায়—

অনি, একটা মেয়ে ঠিক কিরকম পরিস্থিতি হলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে হোস্টেলে উঠতে চায় তা তুমি বুঝবে না। তারপর নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, তোমার কি ভয় হচ্ছে?

ভয়? কি ব্যাপারে?

আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলে তুমি জড়িয়ে পড়বে। মাধবীলতার গলা ভারী হয়ে আচমকা থেমে গেল।

সিসের বল যেন আচমকা কেউ অনিমেষের বুকের ভেতর গড়িয়ে দিল। সে দ্রুত মাধবীলতার হাত ধরে বলল, ছিঃ।
 
কিছুক্ষণ সময় লাগল সহজ হতে। মাধবীলতা বলল, বাবা বলেছেন যদি বিয়ের ব্যাপারে আমি স্বাধীনতা চাই তাহলে আর একমাসের মধ্যে যেন নিজের ব্যবস্থা করে বাড়ি থেকে চলে যাই। শর্ত দিয়েছেন। কোন আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে ওঠা চলবে না। অনেক ভেবেছি। তোমাকে ভালবাসার পর আর অন্য কোন পুরুষকে স্বামী বলে মেনে নিতে পারব না। এই সময় স্কুলের চাকরিটা না পাওয়া গেলে যে কি করতাম জানি না। আমি তোমার কাছে তো কখনো কিছু চাইব না অনি, শুধু অনুরোধ কখনো আমাকে ভয় পাইয়ে দিও না।

অনিমেষ এতক্ষণ চুপচাপ কথাগুলো শুনছিল। শুনতে ওর মনে হচ্ছিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওকে মাধবীলতার উপযুক্ত হতে হবে। এই মেয়েটির সামান্য অসম্মান মানেই তার বেঁচে থাকাটা লজ্জার। সে উঠে দাঁড়াল, চল।

মাধবীলতা মাথা নীচু করে হাঁটছিল। কিছুক্ষণ নীরবে চলতে চলতে অনিমেষের হঠাৎ মনে হল এই মেয়েটির সঙ্গে সেই মেয়েটির কোন মিল নেই। য়ুনিভার্সিটি থেকে প্রথম আলাপের দিন যে মেয়েটি ওর সঙ্গে শেয়ালদা অবধি হেঁটে গিয়েছিল সে ছিল ঝরণার মত তেজী, ছটফটে। আর এখন যে ওর সঙ্গে হাঁটছে সে নদীর মত গভীর, গভীর। প্রথমজনের সঙ্গে কথার খেলা করা যায়, এর মধ্যে সব কথা ডুবিয়ে দিতে হয়।

অনিমেষ মনে মনে বলল, আমাকে বিশ্বাস কর, বিশ্বাস কর।

কলেজ স্ট্রিটের ভিড়ের মধ্যে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ মাধবীলতা ওর হাত স্পর্শ করল। হয়তো কাকতালীয় কিন্তু অনিমেষ শিহরিত হল। ওর মনে হল, মুখ ফুঠে না বললেও মাধবীলতা ওর কথা বুঝতে পেরেছে।

রাজবল্লভ পাড়ার কাছে একটা মেয়েদের হোটেল আছে, একটুকুই জানত মাধবীলতা। সেখানে পৌঁছাতে বিকেল প্রায় ফুরিয়ে এল। দু-একজনকে জিজ্ঞাসা করতেই হদিস পাওয়া গেল। গিরিশ এভিন্যুতে ঢুকে একটা গলির মধ্যে হোস্টেলটা। মাধবীলতাই কথা বলল। অনিমেষ বাইরে দাঁড়িয়েছিল। কয়েক মিনিট বাদে বেরিয়ে এসে হাসল, হল না।

সিট নেই?

না। মাস কয়েক বাদে একটা খালি হতে পারে।

যাচ্চলে। মেয়েদের হোস্টেলেও এত ভিড়?

কি কথা বলছ! মাধবীলতা কপালে ভাঁজ আনল, কলকাতায় মেয়েদের একা থাকার কটা জায়গা আছে মশাই! পাড়ায় পাড়ায় ছেলেদের হোস্টেল, কিন্তু কোন মেয়ে একা থাকবে এটাই তোমরা ভাবতে পার না। এবার দেশবন্ধু পার্কের কাছে যাব।

ওখানেও যদি না পাওয়া যায়!

অন্য কোথাও দেখতে হবে।

ধরো, কলকাতার কোথাও যদি পাওয়া না যায়!

না আমি ধরতে পারব না। আমার দরকার তাই পেতে হবে।

কিন্তু দেশবন্ধু পার্কেও জায়গা পাওয়া গেল না। হোটেলের পরিচালিকার কাছে জানা গেল আমহার্স্ট স্ট্রীটে আর একটি হোস্টেল আছে চাকুরীজীবী মহিলাদের জন্যে। এছাড়া আরো দুটো মেস আছে উত্তর কলকাতায় যা মেয়েরাই চালান। মাধবীলতা নাছোড়বান্দা হল, আজই সে সবগুলোর খোঁজ নেবে। কারণ একদিন দেরি হলে অন্য কেউ সুযোগটা নিয়ে নিতে পারে। কিন্তু অনিমেষ রাজী হচ্ছিল না। সন্ধ্যে হয়ে আসছে, নিমতায় ফিরতে রাত হয়ে যাবে মাধবীলতার। এখন বাড়িতে যে টেনশন চলছে তাতে বেশী রাত করে ফেরা উচিত নয়। মাধবীলতাকে বোঝাল, হোস্টেলগুলোতে গিয়ে আজই খোঁজ নেবে সে, মাধবীলতার যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। যদি খালি থাকে কোথাও তাহলে সে ব্যবস্থা করে ফেলবে। কথাটা শুনে মাধবীলতা ব্যাগ খুলে একশটাকার নোট বের করল, তাহলে এটা রাখো, ব্যবস্থা করতে হলে তো টাকা লাগবে।

অনিমেষ টাকাটার দিকে তাকাল। কথাটা সত্যি। ওই টাকাটা হাত পেতে নিতে সঙ্কোচ হচ্ছিল ওর। তার উচিত নিজেই ওটা দিয়ে দেওয়া। কিন্তু এখন তার পক্ষে সেটা অসম্ভব। মাধবীলতা বলল, এটা আমার জমানো টাকা। নাও।

টাকাটা নিলেও মন থেকে কুয়াশা দূর হল না। টাকা দরকার। নিজে উপার্জন না করলে পৃথিবীতে সুস্থভাবে বেঁচে থাকা মাঝে মাঝে মুশকিল হয়। সঙ্গে সঙ্গে এর পালটা একটা যুক্তি মনে এলেও অনিমেষ স্বস্তি পেল না।



মোহনলাল স্ট্রীট ধরে ওঁরা হেঁটে আসছিল। হঠাৎ অনিমেষ নিজের নামটা শুনতে পেল। মহিলাকণ্ঠ, মাধবীলতাও শুনেছিল। পেছন ফিরে আবছা অন্ধকারে কাউকে দেখতে না পেয়ে অনিমেষ বলল, কেউ আমাকে ডাকল, না?

তাই তো শুনলাম।

এমন সময় একটি বাচ্চা মেয়ে ছুটতে ছুটতে পাশে গলি দিয়ে বেরিয়ে এল, আপনাকে ডাকছে।

কে?

বউদি।

অনিমেষ মাধবীলতার মুখের দিকে তাকাল। বউদিটি আবার কে সে জিজ্ঞাসা করল, ঠিক বলছ তো? অন্য কাউকে ডাকতে বলেনি তো তোমাকে?

মেয়েটি মাথা ঘুরিয়ে বেণী নাচাল, মোটেই না। ওপর থেকে তোমাদের দেখে বলল ওই লম্বা ভদ্রলোক আর হলুদ শাড়িপরা মেয়েটাকে ডেকে আন।

মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, তোমার বৌদির নাম কি?

জানি না। আমি অন্য বাড়িতে থাকি।

অনিমেষ মাধবীলতাকে জিজ্ঞাসা করল, কি করবে?

যাও একবার দেখে এসো। আমি দাঁড়াচ্ছি।

কিন্তু তোমার তো দেরী হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া কে না কে, অন্ধকারে ভুলও করতে পারে। চল, একসঙ্গে গিয়ে একটু দাঁড়িয়েই ফিরে আসি। অনিমেষের কথায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাধবীলতা গলিতে ঢুকল। একটু এঁকেবেঁকে একটা দোতলা বাড়ি সিঁড়ির কাছে গিয়ে মেয়েটি বলল, ওপরে চলে যান। অনিমেষ মাধবীলতাকে নিয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরে উঠতেই ভূত দেখার মত চমকে উঠল। দরজায় দাঁড়িয়ে নীলা হাসছে।
 
সবুজ ডোরাকাটা শাড়ি আর কালো জামা নীলার শরীরে, কিন্তু শরীরটাকেই চিনতে কষ্ট হয়। এই সামান্য সময়ের ব্যবধানে নীলার চেহারায় অজস্র ধুলো জমা পড়েছে। গালের হনু সামান্য উঁচু হয়েছে, চোখ ভেতরে।

অনিমেষের হতভম্ব মুখের দিকে তাকিয়ে নীলা হাসল। কোন কোন মেয়ে আছে সময় যার কাছ থেকে সব কেড়ে নিলেও হাসিটাকে দখল করতে পারে না। নীলার এই হাসি সেইরকম, অহঙ্কারী। বলল, অমন করে কী দেখছে, এসো।

তুমি! এখানে? অনিমেষ এতক্ষণে ধাতস্থ হয়েছে।

এখানেই তো থাকি। আমাদের বাড়ি। এসো ঘরে এসো।

অনিমেষ মাধবীলতার দিকে তাকাল। ওর চোখে কিছুটা কৌতূহল কিছুটা বিব্ৰত ভাব। ইশারায় ওকে নিশ্চিন্ত করে সঙ্গে আসতে বলল সে। নীলার পেছন পেছন বারান্দা ডিঙ্গিয়ে ঘরে ঢুকল ওরা। ঘরে ঢুকে নীলা বলল, এপাশের জানালায় দাঁড়িয়েছিলাম, হঠাৎ দেখতে পেলাম তুমি যাচছ। আমি তোমার নাম ধরে চেঁচিয়েছিলাম তুমি বুঝতে পারোনি, না?

কেউ আমাকে ডাকছে এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম, কিন্তু, –। অনিমেষ হাসল।

নীলার এই ঘরের সঙ্গে ওর হোস্টেলের কোন ফারাক নেই। আসবাব বলতে একটা বড় তক্তাপোশ, বিছানার চাদর পাতা, এক কোণায় আলনায় কয়েকটা ময়লা কাপড় ঝুলছে, ঘরের অন্য কোণায় স্টোভ এবং রান্নার জিনিসপত্র। ওপাশের ঘর থেকে নীলা দুটো কাঠের চেয়ার টানতে টানতে নিয়ে এল। এসে বলল, এখনও ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারিনি। বসো।

বাবার মুখে নীলার ব্যাপারটা শুনেছিল সে। কিন্তু ব্যাপারটা যে এই পর্যায়ে তা ভাবতে পারেনি। দেবব্রতবাবুর বাড়িতে সে যখন ছিল তখন দেখেছে ওঁরা কি বিলাসের মধ্যে বাস করতেন। সেই নীলা এখন যে ঘরটাকে আমার ঘর বলছে তার সঙ্গে ওই জীবনটাকে একটুও মেলানো যায় না। সে ঠিক করল নীলা যদি নিজে থেকে কিছু না বলে তাহলে কোন কৌতূহল প্রকাশ করবে না। নীলাকে চিরকাল এইরকম পরিবেশে দেখেছে এমন ভঙ্গি করবে।

মাধবীলতাকে বসতে বলে সে অন্য চেয়ারটা টেনে নিল। নিয়ে বলল, তোমার সঙ্গে এর আলাপ করিয়ে দিই, এর নাম মাধবীলতা।

মাধবীলতা হেসে বলল, আপনাকে আমি চিনি।

নীলা চোখ কপালে তুলল, ওমা, কেমন করে?

য়ুনিভাসিটিতে দেখেছি। আপনি বোধহয় আমার সিনিয়র ছিলেন।

নীলা চোখে হাসল, তোমরা এক ক্লাসে পড় বুঝি?

হ্যাঁ।

তাহলে তো এক-বছরের সিনিয়ার হবই। কিন্তু আমি তো অনেকদিন ওপাট ছেড়েছি। আমাকে চেনার তো কোন কারণ নেই। না না, তাই বলি কি করে। আমি যে অনেক ছেলের সঙ্গে ঘুরতাম, চেনা স্বাভাবিক। হাসল আবার সে। তারপর অনিমেষকে বলল, তোমার চেহারা কিন্তু বেশ পালটে যাচ্ছে।

কী রকম হচ্ছে?

মফস্বলের গন্ধটা আর একদম নেই। বেশ অ্যাট্রাকটিভ হয়েছে।

কথাটা বলার ধরণে এমন মজা ছিল যে মাধবীলতাও হেসে ফেলল।

অনিমেষ বলল, তুমি একটুও পালটালে না।

কে বলল? তুমি এই ঘরে বসেও বলছ আমি আগের মত আছি?

অনিমেষ যদি ভূল না করে তাহলে সে তীক্ষ্ণ অভিমানটাকে স্পর্শ করল যেন। সঙ্গে সঙ্গে সঙ্কুচিত হল সে। এই প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যেতে চায় সে। কিন্তু প্রশ্নটা করে নীলা ওর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে বলল, আমি তোমার কথা বলার ধরনটায় পরিবর্তন না হওয়াটাই বলতে চেয়েছিলাম, অন্য কিছু নয়।

নীলা দাঁতে ঠোঁট কামড়ালো। তারপর খুব দ্রুত নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বলল, এদিকে এসেছিলে কোথায়?
 
মাধবীলতা অনিমেষের দিকে তাকিয়ে হাসল। অনিমেষ সহজ গলায় বলল, ওর জন্য একটা হোস্টেল দেখতে, জায়গা পাওয়া গেল না।

তুমি কি বাইরে থাকো? এই, তখন থেকে তোমাকে তুমি বলে যাচ্ছি–কিছু মনে করো না। তুমিও আমাকে তুমি বলতে পারো। নীলা আবার সহজ।

না না ঠিক আছে। মাধবীলতা এমন ভাবে মাথা নাড়ল যেন তুমি বলাতে সে কিছু মনে করছে না কিন্তু নীলার প্রথম প্রশ্নটার জবাব দিল না সে। ব্যাপারটা যেন নীলার বুঝতে অসুবিধে হয়নি তা অনিমেষের চোখ এড়াল না। কারণ নীলার ঠোঁটে হাসিটাকে চলকে উঠেই মিলিয়ে যেতে দেখল সে।

এবার নীলা দরজার কাছে গিয়ে সেই বাচ্চা মেয়েটাকে ডেকে আনল। তারপর একটা ছোট কেটলি ঘরের কোণা থেকে নিয়ে ওর হাতে দিয়ে নীচু গলায় কিছু বলতেই সে ঘাড় নেড়ে ছুটে গেল। সেদিকে তাকিয়ে নীলা বলল, জানো অনিমেষ, এই বাচ্চাটা আমাকে খুব ভালবাসে। ও না থাকলে আমি খুব অসুবিধেয় পড়তাম।

কে হয় তোমার?

আমার! কেউ না। নীচের ভাড়াটেদের মেয়ে।

মাধবীলতা বলল, আপনি কি আমাদের জন্যে কিছু আনতে পাঠালেন?

নীলা বলল, কেন?

আমার কিন্তু একটুও খাবার ইচ্ছে নেই।

কেন?

মাধবীলতা অনিমেষের দিকে তাকাল। নীলা প্রশ্ন করছে একই ভঙ্গিতে এবং তাতে একধরনের জেদ ফুটে উঠছে। মাধবীলতা নীচু গলায় বলল, আমার ফেরার তাড়া ছিল।

বেশী দেরী হবে না। রাস্তার ওপাশেই চায়ের দোকান। নীলা নিঃশ্বাস ফেলল।

নীলার বাড়িতে চায়ের ব্যবস্থা নেই, দোকান থেকে আনাচ্ছে, অনিমেষ কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছিল না। তাছাড়া ও যতই সহজ ভঙ্গিতে কথা বলার চেষ্টা করুক, কোথাও একটা অস্বস্তি আছে তা বোঝা যাচ্ছিল। নীলার বর্তমান অবস্থার কারণ না জানলে কথাবার্তাও বেশীক্ষণ চালানো যায় না। সে হেসে বলল, তুমি বাড়িতে চা তৈরী করো না?

নীলা মাথা নাড়ল, সামনেই দোকান রয়েছে, ঝামেলা করে কি হবে?

ভদ্রলোককে দেখছি না!

ও বেরিয়েছে। আসবে এক্ষুণি। তোমাদের তো আবার হাতে সময়ই নেই, না হলে বলতাম একটু বসে যাও। নীলা কথাগুলো শেষ করতেই নীচে থেকে একটা লোক উঠে এল। আধবয়সী পাকানো চেহারা।

দিদিমণি, আমি নন্দ।

নন্দ, নন্দ কে?

অ। দাদাবাবু বুঝি আমার কথা বলেনি?

না তো।

আমার নাম নন্দ বকসী। দাদাবাবু আমাকে সাবলেটের কথা বলেছিলো। তা খুব ভাল ভাড়াটে আছে সন্ধানে। দেড় অবধি রাজী করানো যাবে মনে হয়। ঘরটা একটু যদি দেখান। লোকটা খুব বিনীত ভঙ্গিতে বলল।

নীলা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, ও ভাড়া দেবে বলেছে?

ভাড়া মানে, আইনসম্মত ভাড়া নয়। সাবলেট। নন্দ হাসলো, যা বাজার পড়েছে দিদিমণি, চিন্তা করবেন না, দাদাবাবু আমাকে সব বলেছে। খুব ছোট ফ্যামেলি, স্বামী-স্ত্রী আর তিনটে বাচ্চা।

নীলা বলল, ঠিক আছে, কিন্তু একটু যদি ঘুরে আসেন অসুবিধে হয়?

না, বিন্দুমাত্র নয়। এই ঘন্টাখানেক বাদে এলে হবে?

হ্যাঁ।

নন্দ বকসী চলে গেলে নীলা ঘুরে বলল, এমন জ্বালিয়ে মারে না লোকগুলো! বাড়তি আছে একটু জানলেই হল।

অনিমেষ লুকোচুরিটা স্পষ্ট বুঝতে পারল। নীলা অন্তত আর্থিক সুখে নেই। হঠাৎ ওর মনে হল মাধবীলতার জন্য ওরা হোস্টেল খুঁজে বেড়াচ্ছে, তার চেয়ে নীলাকে বললে কেমন হয়! নীলার যখন ঘরটা ভাড়া দিচ্ছেই তখন–সঙ্গে সঙ্গে মনে হল যে থাকবে তার সঙ্গে কথা না বলে প্রস্তাবটা করা উচিত হবে না।
 
এইসময় মেয়েটি চা নিয়ে এল। অনিমেষ দেখল যেভাবে হোস্টেলে বাইরে থেকে চা আনিয়ে ওরা ভাগ করে খায় সেভাবে নীলা দুটো কাপ আর একটা টিন থেকে বিস্কুট বের করে ডিশে ঢেলে এগিয়ে দিল। চায়ের স্বাদ এত বারোয়ারী যে কারো ঘরে বসে খেতে ইচ্ছে করে না। নীলা সেটা বেশ আরামেই ‘চাকরি’!

অনিমেষ হোঁচট খেল।

হ্যাঁ। ওর ওপর খুব প্রেসার পড়ছে। একা সামলে উঠছে না। অনেকগুলো স্কুলে অ্যাপ্লাই করেছি কিন্তু হচ্ছে না। কোথাও মেয়েদের চাকরি খালি আছে শুনলে আমাকে জানিও, কেমন? নীলা তক্তাপোশটার ওপর এসে বসল।

অনিমেষ আর পারছিল না, এবার জিজ্ঞাসা করেই ফেলল, মেসোমশাই, মানে তোমার বাবা এসব জানেন?

কপালে ভাঁজ পড়ল নীলার, এসব মানে?

তুমি চাকরি খুঁজছ। খুব প্রয়োজন।

নাঃ অন্তত আমরা বলতে যাইনি। সত্যি কথা বলতে কি বাবার সঙ্গে সেই বাড়ি ছাড়ার দিন থেকে আমার দেখা নেই।

নেই কেন?

তুমি কিছু শোননি?

মহীতোষকে লেখা দেবব্রতবাবুর চিঠির কথা মনে পড়তে ইচ্ছে করেই সে না বলল না, শুনেছি মানে এইটুকু যে তুমি নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছ, বাড়ি থেকে চলে এসেছ, ব্যাস।

তুমি সেটা শোনার পর আমাদের বাড়িতে যাওনি?

না। অস্বস্তি হচ্ছিল।

কেন?

ওঁরা ব্যাপারটাকে কী ভাবে নিয়েছেন জানি না তাই।

মেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে বাপ-মা কি ভাবে নেয়? ওঃ অনিমেষ, তুমি এখনও মফস্বলী রয়ে গেছ। তুমি গেলে অবশ্য খুব খাতির পেতে কারণ তোমার সঙ্গে আমি বের হইনি। কি ভাই, তুমি কিছু মনে করছ না তো! শেষের কথাটা মাধবীলতার উদ্দেশ্যে বলা। সে ওটা শুনে সামান্য হাসল।

চায়ের কাপ মাটিতে নামিয়ে রেখে অনিমেষ সোজা হয়ে বসল, এমন কি ব্যাপার হয়েছিল যার জন্যে একদম বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হল?

পে–রে–ম। চিবুকে ঠোঁটে হাসি চলকে উঠল নীলার। নিজেকে নিয়ে এরকম ঠাট্টা চেনাশোনা মেয়ের মধ্যে একমাত্র নীলাই করতে পারে। অনিমেষের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল কথাটা এখনকার নীলার মুখে একদম মানাচ্ছে না। নীলা এই সামান্য সময়েই বেশী ভারী, সেই চটুলতা আর নেই। ইচ্ছাকৃত ভাবে পুরোন সময়টাকে ধরার চেষ্টা কথাবার্তায়।

অনিমেষ হেসে ফেলল, তোমাকে যা দেখছি তার সঙ্গে এই অবস্থাটা মেলাতে পারছি না। হঠাৎ ফোঁস করে উঠল নীলা, কেন পারছ না? কেমন যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।

সেটা তোমার অক্ষমতা, আমার নয়। এইসময় মাধবীলতা উঠে দাঁড়াল।, তোমরা না–হয় কথা বল, আমি চলি। নীলা বলল, ওমা তা কি হয়! তোমাকে ছেড়ে অনিমেষ এখানে গল্প করবে বসে, এটা কি ভাল দেখায়?

মাধবীলতা বলল, তাতে কি হয়েছে। আমার সহ্য হবে না। এ আপনি কি বলছেন!

ঠিক বলছি। আচ্ছা তোমার সঙ্গে তো ওর বেশ জানাশোনা। কখনো তুমি ওকে আসতে বলেছ কোথাও আর ও সেখানে সময়মত আসেনি, এমনটা হয়েছে? প্রশ্নটা করে নীলা আড়চোখে অনিমেষের চেহারাটা দেখল।

মাধবীলতা হেসে ফেলল, মনে পড়ছে না।

তবেই দ্যাখো। কথাটা মাধবীলতাকে বলে নীলা অনিমেষকে জিজ্ঞাসা করল, তোমার মনে পড়ে পড়ছে। সেদিন আমার পায়ে খুব–।

অনিমেষকে থামিয়ে দিল নীলা, না, কোন কৈফিয়ত শুনতে চাই না। যে কোনো কারণেই হোক তুমি আসতে পারনি। আমি তোমাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছি না যে তুমি সাফাই গাইবে। আসলে সেদিন আমাকে খুব বড় একটা সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। একা ভেবে উঠতে পারছিলাম না বলে তোমাকে আসতে বলেছিলাম।
 
নীলা ওদের বারান্দা অবধি এগিয়ে দিল। এতক্ষণ নীলার কথাবার্তা বলার ধরন অনিমেষের ভাল লাগছিল না। কিন্তু একটা প্রশ্ন বার বার তাকে বিদ্ধ করছিল, নীলার স্বামী কে? এত বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে ও কোন ভাগ্যবানকে বিয়ে করল? যাকে করল তার আর্থিক অবস্থা যখন এইরকম তখন এমন কী বিশেষ যোগ্যতা তার আছে! সে স্বাভাবিক গলায় বলল, আর একদিন এসে তোমার মিস্টারের সঙ্গে আলাপ করে যাব।

যেও। আবাহনও নেই বিসর্জনও নেই।

চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত নীলাকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল অনিমেষ। বেশ রাত হয়েছে। মাধবীলতা দ্রুত হাঁটছিল। অনিমেষ পাশাপাশি চলতে চলতে বলল, কেমন দেখলে?

কী? মাধবীলতা কিছু ভাবছিল। প্রশ্নটা বুঝতে সময় নিল।

নীলাকে!

ভালই তো। হাসল মাধবীলতা, তোমার খুব বন্ধু ছিলেন উনি?

তা একরকম বলতে পারো, আবার নাও পারো। কলকাতায় আসার পর হাসপাতাল থেকে গিয়ে যাদের বাড়িতে আমি থেকেছিলাম সেই ভদ্রলোকের মেয়ে নীলা। তখন ও অত্যন্ত আধুনিকা, আমার পক্ষে পাল্লা দেওয়া মুশকিল ছিল এবং এবং সে চেষ্টাও আমি করিনি। আসলে আমি ওকে বুঝতেই পারি না। প্রথম দিনই ও আমাকে বলেছিল, ওর নাম নীলা এবং সেটা অনেকের সহ্য হয় না। বোঝো! অনিমেষ হাসল।

মুখের ওপর সত্যি কথা বলেছিলেন!

হ্যাঁ। কিন্তু সেই মেয়ে যখন এরকম আর্থিক অনটনে রয়েছে স্রেফ জেদের বশে বিয়ে করে, আজ কেমন অস্বস্তি হয়।

কেন? ইনি যদি বৈভবের চেয়ে এই কষ্টটাকেই আনন্দের মনে করেন তাহলে তোমার চিন্তা করার কি আছে! ভালবেসে যখন কেউ সিদ্ধান্ত নেয় তখন সে অনেক কিছু অবহেলায় ছেড়ে আসতে পারে। বিশেষ করে মেয়েরা। মাধবীলাতা গাঢ় গলায় কথাগুলো বলল।

কথাটা মানতে পারল না অনিমেষ, সব কৃতিত্ব মেয়েদের হবে কেন? পৃথিবীর সিংহাসন এক কথায় ছেড়ে দিয়ে ভালবাসাকে আঁকড়ে ধরেছিলেন যিনি তিনি পুরুষ। কথাগুলো বলার সময়েই মনে হল মাধবীলতা কি নিজের কথাই বলছে না? আজ যে হোস্টেল খোঁজার প্রয়োজন হল সেটা তো তাকে ভালবেসে কোন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে সেইজন্যই। অথচ তাকে এই মুহূর্তে কিছুই ছেড়ে আসতে হচ্ছে না। এ অবস্থায় ওর সঙ্গে তার তর্ক করা সম্পূর্ণ অনুচিত।

মাধবীলতা কিন্তু অনিমেষের কথাটাকে তেমন আমল দিল না। শ্যামবাজারের মোড়ে পৌঁছে বলল, তুমি কিন্তু কালকের মধ্যেই হোস্টেলের চেস্ট করবে, তো?

হ্যাঁ নিশ্চয়ই। তুমি ভেবো না। ওহো, তখন নীলার বাড়িতে বসে একটা কথা মাথায় এসেছিল। বলব বলব করেও বললাম না। অনিমেষ জানালো।

কী? মাধবীলতা মুখ তুলল।

নীলারা যখন একটা ঘর ভাড়া দিতেই চাইছে তখন সেটা তুমি যদি নিতে তাহলে কেমন হতো! হয়তো একটু বেশি খরচ হতো–। অনিমেষ তাকাল ওর দিকে।

যাঃ, তা কি হয় কখনো! আমি খাবো কোথায়? স্কুলে যা মাইনে দেবে সবই বেরিয়ে যাবে। তারপরেই গলা পালটে গেল মাধবীলতার, ওই মহিলাও আমাকে ভাড়া দিতেন না।

কেন? আমি বললে নিশ্চয়ই দিত।

তুমি ঠিক বুঝবে না।

উঁহু নীলাকে তুমি বুঝতে পারোনি।

তুমি বুঝেছ?

অনেকটা।

মাধবীলতা হাসল। তারপর নরম গলায় বলল, যে খুব শীগগীর মা হতে যাচ্ছেন এটা বুঝতে পেরেই?

অনিমেষ চমকে উঠল। যাচ্চলে! এতক্ষণ ওরা বসেছিল কিন্তু একবারও সে এসব চিন্তা করেনি। বিবাহিতা কিংবা অবিবাহিতা সিঁথি দেখে ঠাওর করতে পারে না। মেয়েরা কি-একটা কায়দায় সেটাকে বেশ লুকিয়ে রাখতে পারে। আবার নীলার সামনে বসে থেকেও ওর আসন্ন মাতৃত্ব সে টের পায়নি। এটাও কি আজকাল লুকিয়ে রাখা যায়? কিংবা মেয়েদের এইসব ব্যাপার মেয়েরাই বিশেষ চোখে দেখতে পায় যেটা পুরুষদের থাকে না।

অনিমেষ হাসল, না পারিনি, হার মানছি।

মাধবীলতা প্রসঙ্গ পালটালো, যা হোক, আমি হোস্টেলে থাকতে চাইছি আর পাঁচটা মেয়ের সঙ্গে। কোথাও ঘর ভাড়া করে থাকলে নানান কথা উঠবে। একটা মেয়ে একলা আছে জানলে লোকের কৌতূহল বাড়েই। তাছাড়া তুমিও তখন হুটহাট চলে আসবে আমার ঘরে সেটাও আমি চাই না।

অনিমেষ হকচকিয়ে গেল, আমি তোমার কাছে যাই এটা চাইছ না?

ভুল করলে। আমি হোস্টেলে থাকলে তুমি দেখা করতে যাবে বইকি। কিন্তু একটা ঘরে আমি একলা স্বাধীনভাবে আছি, সেখানে তুমি আস এটা আমি চাই না, মাধবীলতা নির্দ্বিধায় বলল।



তুমি তাহলে আমাকে বিশ্বাস করো না! অনিমেষের খুব খারাপ লাগছিল কথাগুলো শুনতে। আচমকা যেন মাধবীলতা সম্পর্কটাকে বদলে দিচ্ছে।

তোমাকে নয়, আমি নিজেকেই বিশ্বাস করি না। মুখ নীচু করল মাধবীলতা। যেন গভীর চাপ থেকে হুস করে ওপরে উঠে এল অনিমেষ, উঠেই মনে হল ওই চাপ কতটা কষ্টদায়ক এবং সেটা মাধবীলতাকে এই মুহূর্তে নুইয়ে ফেলেছে। এরকম অকপট স্বীকারোক্তি যে মেয়ে করতে পারে অনিমেষের ইচ্ছে করছিল মাধবীলতার হাতটা জড়িয়ে ধরে কিন্তু এই হাজার মানুষের ভিড়ে তা সম্ভব নয়।

এইসময় একটা আটাত্তরের সি বাস এসে থামতেই হাতল ধরে দাঁড়িয়ে রইল ভিড়ের মধ্যে যতক্ষণ অনিমেষকে দেখা যায়।

.
 
আমহার্স্ট স্ট্রীটের মেয়েদের হোস্টেলে জায়গা পাওয়া গেল। মাধবীলতা চলে গেলে অনিমেষ থ্রি বি বাস ধরে সোজা চলে এসেছিল এখানে। চট করে হোস্টেল কিংবা মেস বলে হয় না। লাল বাড়িটার সামনে চিলতে বাগান, সৌখিন মানুষের বাড়ি বলেই মনে হয়। রাত হয়েছে কিন্তু অফিস ঘরটা তখনও খোলা ছিল। অনিমেষ দেখল একজন বয়স্কা মহিলা টেবিলের ওপাশে বসে আছেন। চোখে চশমা, গোল মুখ, সাদা শাড়ি বেশ ভারিক্কী ভাব। দরজায় দাঁড়িয়ে নমস্কার করতেই ভদ্রমহিলা মুখ তুললেন, আসুন। গলার স্বরে ব্যক্তিত্ব স্পষ্ট।

আমি হোস্টেলের সুপারের সঙ্গে কথা বলতে চাই।

বসুন। অনিমেষ চেয়ার টেনে বসলে মহিলা হাসলেন, কি ব্যাপার বলুন।

আপনি কি অনিমেষ উতস্তত করছিল।

হ্যাঁ।

এই হোস্টেলে সিট খালি আছে?

আছে গতকাল খালি হয়েছে।

অনিমেষ স্নান করার তৃপ্তি পেল। যে ক’টা হোস্টেল ওরা আজ দেখেছে এইটে তার মধ্যে সবচেয়ে ভাল। এখানেই যদি জায়গা পাওয়া যায় তাহলে সৌভাগ্যই বলতে হবে। সে মহিলার দিকে ঝুঁকে বলল, এই হোস্টেলে জায়গা পেতে হলে কোন নিয়মকানুন পেরিয়ে আসতে হয় কি?

নিয়মকানুন? মহিলার চোখে সামান্য বিস্ময়, হ্যাঁ, বোর্ডারকে অবশ্যই মহিলা হতে হবে।

সে তো বটেই। আমি তা বলছি না। আমি জানতে চাইছিলাম এটা কি ওয়ার্কিং গার্লস হোস্টেল না স্টুডেন্টস হোস্টেল? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

মূলত এটা ছাত্রীদের হোস্টেল ছিল তবে এখন কেউ কেউ চাকরিও করে। মহিলা এবার সরাসরি প্রশ্ন করলেন, যার জন্যে জায়গা খুঁজছেন তিনি আপনার কে হন?

আত্মীয়। উত্তরটা অনিমেষ আগে থেকেই তৈরী করে রেখেছিল।

আপনি কি করেন?

আমি এবার এম. এ. দেব। আমিও হোস্টেলে থাকি।

আত্মীয় মানে, আপনার বোন?

বোনের মত বলতে গিয়ে অনিমেষ সামলে নিল। এক পলক মাত্র, তবু এর মধ্যেই অনিমেষ ঠিক করে ফেলল সত্যি কথাই বলবে। ওরা অন্যায় কিছু করছে না অতএব তার মুখোমুখি হতে বাধা কি। সে স্বাভাবিক গলায় বলল, আমার এক সহপাঠিনী সম্প্রতি স্কুলে চাকরি পেয়েছেন। কোন কারণে তার পক্ষে বাড়ি থেকে স্কুলে যাওয়া সম্ভব নয়। ওর জন্যেই জায়গা খুঁজছি।

মহিলা এতক্ষণ যে ভঙ্গিতে কথা বলছিলেন অনিমেষের উত্তর শোনার পর সেটা পালটে গেল। চেয়ারে হেলান দিয়ে তিনি কিছুক্ষণ অনিমেষকে দেখলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, তাহলে আত্মীয় বললেন কেন?

আমি আত্মীয় বলেই ওকে মনে করি।

আস্তে আস্তে মহিলার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। বললেন, কিন্তু এখানে থাকতে হলে বাবা মা অথবা ওরকম কাউকে গার্জেন হতে হয়। তাই নিয়ম।

সেটা সম্ভব নয়। আমি শুধু একথাই বলতে পারি আপনার হোস্টেলের অন্য মেয়েরা যে আচরণ করে সে তার থেকে ব্যতিক্রম হবে না। এইভাবে কথা বলতে অনিমেষের আর অসুবিধে হচ্ছে না। ওর চেতনায় একটা ক্ষীণ অনুভব হচ্ছিল যে এরকম কথা যেহেতু কোন বয়স্কা মহিলার পছন্দসই নয় তাই মাধবীলতা এখানে জায়গা পাবে না। তা সত্ত্বেও সে সত্যি কথা বলতে চাইল। মাধবীলতা প্রাপ্তবয়স্কা, নিজের ভালমন্দ বোঝে, তাকে কারো আশ্রয় বিনা এরা গ্রহণ করবেন না। প্রয়োজনে সে তর্ক করে যেতে পারে। এ ব্যাপারে স্পষ্ট কথা বলার সময় এসেছে।

উনি এম. এ. পড়ছেন বলছিলেন, তখন বাড়িতে থাকতেন?

হ্যাঁ।

এখন সেটা সম্ভব নয়?

নয় বলেই তো এসেছি।

এ ব্যাপারে ওঁর বাড়িতে লোক কোন আপত্তি করবেন না তো?

প্রাপ্তবয়স্কা বোর্ডার নিয়ে ঝামেলা হবে কেন?
 

Users who are viewing this thread

Back
Top