What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected কালবেলা- সমরেশ মজুমদার (2 Viewers)

প্রশ্নটা শুনেই অনিমেষের চোখের সামনে মাধবীলতার মুখ ভেসে উঠল। যে মেয়ে তার জন্যে এক কথায় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে তার সঙ্গে কথা বলাটা জরুরী ছিল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে হল আজ যদি সে পিছিয়ে আসতো তাহলে বাকী জীবনটা বেঁচে থাকার কোন কারণ থাকতো না। সে যাই করুক নিশ্চয় মাধবীলতা তাকে সমর্থন করবে। মাধবীলতা থেকে মোটেই ভিন্ন নয়। অনিমেষ উত্তর দিল, সুবাসদা, সেটা দেওয়া হয়ে গেছে।

সুবাসদা অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করল, কার কাছে?

আমার নিজের কাছেই। অনিমেষ হাসছিল।

সুবাসদা জিজ্ঞাসা করল, সিগারেট আছে অনিমেষ?

অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, না। তারপর চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে সিগারেটের দোকান খুঁজতে লাগল। এখন নিশুতি রাত। স্টেশনের দিকে গেলে অবশ্যই দু একটা দোকান খোলা পাওয়া যাবে কিন্তু এ তল্লাটে কোথাও আলো জ্বলছে না। কাশীপুর ক্লাবের পাচিলের ওপর ছেলেদুটো কাজ করছে। এ দিকটায় লোকজনের ঘন বসতি নেই বলে কাজেরও সুবিধে। অনেকটা জায়গা নিয়ে লেখা হচ্ছে বন্দুকের নলই শক্তির উৎস। লক্ষ্য করছিল অনিমেষ, ছেলেটার হাতের এক একটা টানে কি সহজে রেখাগুলো জ্যান্ত অক্ষর হয়ে যাচ্ছিল।

ঠিক বারোটার সময় ওরা মিলিত হয়েছিল। দমদম স্টেশনের চতুরটা তখন বাজারের মত সরগরম। সুবাসদা একটু উতস্তত করছিল ওখানে কাজ শুরু করতে। প্রথমেই লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা উচিত হবে না। ওরা তাই একটু সরে এসে লেখা শুরু করেছে। ছেলেদুটোর হাত খুব ভাল, এরই মধ্যে দুটো লেখা হয়ে গেছে।

রঙের কৌটো মাটিতে রেখে ছেলেদুটির একজন বলল, বিড়ি খাবেন?

সুবাসদা হাত বাড়ালো, বেশী থাকলে দাও।

পকেট থেকে দুটো বিড়ি বার করে ওদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ছেলেটি কাজে ফিরে গেল। সুবাসদা নিজেরটা ধরিয়ে অনিমেষের মুখের সামনে হাতের আড়ালে বাঁচানো আগুন এগিয়ে ধরল। অনিমেষ বিড়িতে টান দিতেই একটা কটু গন্ধ জিভে গলায় ছড়িয়ে পড়ল। শরীর গুলোচ্ছিল প্রথমে কিন্তু ক্রমশ ঠিক হয়ে এল। সুবাসদা বলছিলো, বিড়িটা অভ্যেস করাই ভাল। প্রথম কথা পয়সা খরচ কম, আর সবচেয়ে উপকারী যেটা সেটা হল, ক্যানসার হয় না।

বিড়ি-খেলে ক্যানসার হয় না?

শুনেছি সিগারেটের কাগজটার ধোঁয়াই সবচেয়ে ক্ষতিকর। বিড়িতে সেই ধোঁয়াটা নেই। বাংলাদেশের গ্রামের মানুষের কজনার ক্যানসার হয়?

বিড়ির টান এখন ভাল লাগছে। অনিমেষ ভাবছিল এবার থেকে বিড়িই খাবে। পয়সা সাশ্রয়ের চিন্তাটাই মাথায় ছিল। হঠাৎ মনে হল মাধবীলতার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে যদি সে বিড়ি খায় তাহলে কি প্রতিক্রিয়া হবে! সত্যি, আমরা কতগুলো ব্যাপার নিজেদের ইচ্ছেমতন সাজিয়ে নিই এবং তার ব্যতিক্রম হলেই আমাদের চোখে দৃষ্টিকটু লাগে। যেমন সিগারেট খাওয়ার বদলে বিড়িটার চল যদি শিক্ষিত মানুষের মধ্যেই স্বাভাবিক হতো তাহলে সে প্রতিক্রিয়ায় কথা ভাবতো না।

সামনের রাস্তা দিয়ে এখন কদাচই গাড়ি যাচ্ছে। নিস্তব্ধ এই রাত্তিরে দেওয়ালের গায়ে অক্ষরগুলো জন্ম নিচ্ছিল। বন্দুকের নলই শক্তির উৎস। লেখার ভঙ্গিতে একটা উদ্দাম বিদ্রোহের চেহারা আছে। বন্দুক শব্দটা দেখতে দেখতে অনিমেষের সামনে একটা ছবি ফুটে উঠল। কিউবার জঙ্গলে এগিয়ে যাওয়া বিপ্লবীসেনার হাতের বন্দুকের শেষ টোটা ফুরিয়ে যাওয়ার পরে মরিয়া হয়ে সে শত্রুকে আঘাত করছে লাঠির মত ব্যবহার করে। বন্দুকের বারুদের অভাব বুকের বারুদ পূর্ণ করেছে। সেই দেখা ছবিটাই এখন চোখের সামনে ভালস। বিপ্লবে বন্দুক অনিবার্য। অথচ সে কখনো বন্দুক স্পর্শ করেনি। অস্ত্র ব্যবহারে দক্ষতা না থাকলে শিক্ষিত প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হতে চাওয়া বোকামি ছাড়া কিছু নয়। দেশের সৈন্যবিভাগ শুধু এই ব্যাপারেই দীর্ঘকাল ধরে শিক্ষা পেয়ে এসেছে। তাদের বিরুদ্ধে একদম আনাড়ি হাতে বন্দুক ধরলে কয়েক মুহূর্তেই বিপ্লবের স্বপ্ন আকাশকুসুম হয়ে যাবে। তাহলে?
 
প্রদীপ জ্বালার আগে তাই সলতে পাকানোটা শেখা দরকার। এই প্রস্তুতিটা কি ভাবে হবে? নেতারা ব্যাপারটা নিয়ে নিশ্চয় চিন্তা করছেন। অস্ত্রশিক্ষা যখন একান্ত প্রয়োজন তখন তার শিক্ষকও দরকার। এদেশে যারা রাজনীতি করেন তাদের এই ব্যাপারে বিন্দুমাত্র অভিজ্ঞত নেই। আর যাই হোক ধুতি সামলে রাইফেল ছোঁড়া যায় না। সেক্ষেত্রে সামরিক শিক্ষিত মানুষের সাহায্য দরকার হবে। সেটা কি করে সম্ভব! ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষ দূর থেকে গাদাবন্দুক দেখার অভিজ্ঞতা নিয়েই বেঁচে আছে।

পরের সমস্যা হল, শক্তির উৎস বন্দুক যদি হয় তাহলে সেটা পর্যাপ্ত পরিমাণে সগ্রহ করা প্রয়োজন। আধুনিক সমরবিদ্যায় শিক্ষিত বাহিনীর সঙ্গে লড়তে গেলে আধুনিক অস্ত্রের প্রয়োজন। সেটা এদেশে সগ্রহ করা অসম্ভব। তাহলে? বিপ্লবের প্রাথমিক প্রয়োজনগুলো যদি না মেটানো যায়। ক্রমশ অস্থির হয়ে পড়ল অনিমেষ। টান না দেওয়ায় বিড়ি নিভে এসেছিল, বিরক্তিতে সেটাকে ছুঁড়ে ফেলল সে। সুবাসদা বোধহয় লক্ষ্য করেছিল ওর অন্যমনস্কতা, জিজ্ঞাসা করল কি হয়েছে?

অনিমেষ সুবাসদার মুখের দিকে তাকাল। অনিয়মে মুখটা কালো হয়ে আছে। ঠোঁটে বিড়ির লাল আগুন জোনাকির মত জ্বলছে। ওই আগুণটার দিকে তাকিয়ে অনিমেষের মনে হল সে নিশ্চয়ই খুব ভাবপ্রাবণ। তা না হলে একসঙ্গে কাজে নেমে সুবাসদা যা চিন্তা করে না তাই সে করছে কেন? কোন কাজ করতে গেলে তার মাথায় হাজারটা সম্ভাব্য ভাবনা চলে আসে।

সুবাসদা তাকিয়ে আছে দেখে অনিমেষ বলল, ভাবছিলাম এত বন্দুক পাওয়া যাবে? কথাটা সহজ করার জন্যে বলে ফেলে হাসল সে। সুবাসদা বুঝতে পারল না অর্থ, ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল, মানে?

বিপ্লবের জন্যে কত বন্দুক দরকার হিসেব করেছেন? এবার শব্দ করে হাসল অনিমেষ। মনের ভেতর যে প্রশ্নটা এতক্ষণ পাক খাচ্ছিল সেটাকে এত সহজ ভঙ্গিতে বের করে দিতে পেরে স্বস্তি পেল সে। সুবাসদার মুখের রেখাগুলো সহজ হয়ে এল, যদি প্রয়োজন হয় তাহলে ভারতবর্ষের প্রত্যেকটি মানুষ এক একটি বন্দুকে রূপান্তরিত হবে।

আমি আপনার সঙ্গে একমত। কিন্তু সরকারের সঙ্গে লড়তে গেলে অস্ত্র দরকার।

ও নিয়ে চিন্তা করো না। প্রয়োজন তীব্র হলে কোন কিছুই বাধা হয় না।

ওদিকে ততক্ষণে লেখাটা শেষ হয়ে গেছে। ছেলেদুটো জিনিসপত্র গুটিয়ে একটু সরে এসে নিজেদের শিল্পকর্ম দেখছিল। সত্যি খুব সুন্দর হয়েছে লেখা। অনিমেষ মনে মনে তারিফ করল। বেশ তেজ আছে অক্ষরগুলোর মধ্যে। ওরা পরবর্তী জায়গার জন্যে এগিয়ে গেল। শেট লেনের মুখে একটা ভাল জায়গা বেছে নিয়ে ওরা কাজে লেগে গেল। কোথাও সামান্য শব্দ নেই। পার্লামেন্ট শুয়োরের খোয়াড় লেখার আয়োজন চলল।

পাশের একটা রকে অনিমেষ বসেছিল। সুবাদা রাস্তার উল্টোদিকে জলবিয়োগ করে এসে দাঁড়াতেই গলি থেকে পাঁচ ছজন লোক দৌড়ে ওদের সামনে এসে থামকে দাঁড়াল। লোকগুলো অনিমেষদের বোধহয় এখানে আশা করেনি। একটু থতমত হয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ওরা দুতিনটে দলে বাগ হয়ে ছুটে গেল এপাশ ওপাশ চলে যাওয়া মাত্র দূরে কোথাও আওয়াজ উঠল। চিৎকার করছে কেউ এবং ক্রমশ শব্দটা বাড়তে লাগল। অনিমেষ চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করল, লোকগুলো কারা হতে পারে বলুন তো?

বুঝতে পারছি না। ওয়াগন ব্রেকার কিংবা ডাকাত হতে পারে।

কি করবেন?

শব্দটা এগিয়ে আসছিল। যেন অনেক লোক কাউকে তাড়া করে আসছে। ছেলেদুটোর একজন বলল, আমাদের আর এখানে থাকা উচিত হবে না।

সুবাসদাও মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। জলদি পা চালাও।

আঁকার জিনিসপত্র হাতে নিয়ে ওরা চিড়িয়ামোড়ের দিকে জোরে হাঁটতে লাগল। ওরা যখন রেডিও গলির মুখে পৌঁছেছে ঠিক তখন সামনের রাস্তায় দুটো হেডলাইটকে ছুটে আসতে দেখল। অনিমেষ চাপা কণ্ঠস্বর শুনতে পেল, লুকিয়ে পড়ো চটপট।

সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই জিপটা পাশে এসে দাঁড়াল শব্দ করে। দুতিনজন লোক লাফ দিয়ে নেমে চেঁচিয়ে উঠল, হ্যান্ডস আপ!
 
অনিমেষ সেই মুহূর্তেই আড়চোখে দেখতে পেল তার পাশে শুধু আঁকিয়ে ছেলেদুটোর একজন ভীতমুখে দাঁড়িয়ে আছে। সুবাসদা কথাটা বলেই কি করে যে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল কে জানে। লোকগুলোর নির্দেশ মান্য করার সময় ওদের হাতে চকচকে অস্ত্র নজরে পড়েছিল। একজন মোটামত লোক জিপে বসেই জিজ্ঞাসা করল, এত রাত্রে এখানে কি করছেন?

দুটো হাত মাথার ওপরে, অনিমেষ বলল, প্রয়োজন ছাড়া কেউ বের হয়?

লোকটা অত্যন্ত বিরক্ত হল, যা প্রশ্ন করেছি তার উত্তর দিন।

কাজ ছিল।

কি কাজ?

লেখালেখি।

লেখালেখি? রাত্তিরবেলায় রাস্তায় ঘুরে আপনারা পদ্য লিখছেন? শাট আপ! আমাকে পদ্য বোঝানো হচ্ছে? নাম কি।

অনিমেষ মিত্র।

ততক্ষণে দুজন পুলিশ ওকে সর্বাঙ্গে হাতিয়ে দেখেছে। ওর সঙ্গী ছেলেটিও বাদ পড়েনি কিন্তু তার হাত থেকে ওরা দুটো রঙ মাথা তুলি উদ্ধার করে বীরদর্পে অফিসারটির দিকে এগিয়ে গেল। নাম শুনে অফিসারটি ঘার ঘুরিয়ে পাশের লোকটিকে কিছু জিজ্ঞাসা করে মাথা নাড়ল, তারপর তুলি দুটো দেখতে পেয়ে বলল, কোন্ পার্টি।

পার্টিফাটি নয়।

পার্টি নয় তাহলে তুলি দিয়ে কি লেখা হচ্ছিল?

লেখা হয়নি, লিখব বলে ভাবছিলাম।

ভাবছিলেন? কি সেটা?

কলকাতাকে আরো সুন্দর করে তুলুন, কলকাতা তিলোত্তমা হবেই, কলকাতার অন্য নাম ভালবাসা, এইসব।

কথাটা শেষ হওয়া মাত্র হো হো করে হাসতে লাগলো অফিসার। পুলিশগুলোও দাঁত বের করল দেখাদেখি। হাসি শেষ করে অফিসার বলল, হয় মাথা খারাপ নয় কবিটবি হবে। নামটাও যেন কাগজে দেখেছি মনে হচ্ছে।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, আমি হাত নামাতে পারি এবার?

নামান। থাকা হয় কোথায়?

এতক্ষণ একটা জেদের ঘোরে কথা বলছিল অনিমেষ। অফিসার ঠিকানা জিজ্ঞাসা করতেই সে থিতিয়ে গেল। ঠিকানা জানার পর এরা যদি তাকে সেখানে নিয়ে যেতে চায় তাহলে; না ভুল ঠিকানা বলা চলবে না।

ঠিক সেই সময় শেঠ লেন থেকে তিন চারজন লোক খুব উত্তেজিত হয়ে বেরিয়ে পড়ল। তারা দমদম রোড় দিয়ে এদিকেই আসছিল। অফিসার সেদিকে তাকিয়ে বলল, এরা আবার কে?

পুলিশের জীপ দেখে লোকগুলোর উৎসাহ যেন আরো বেড়ে গেল। পুলিশ পুলিশ বলে চিৎকার করে ওরা ছুটে আসতে কনস্টেবল তিনজন এগিয়ে গেল অনিমেষদের পাশ থেকে। লোকগুলো একই সঙ্গে হাউমাউ করে কথা বলছিল। অফিসারের ধমকে ওরা একটুও শান্ত হচ্ছিল না। অনিমেষ বুঝল একটু আগে মারাত্মক কিছু হয়ে গেছে শেঠ লেনের ভেতর। কয়েকটা লোক একটা বাড়ির দরজা ভেঙ্গে ডাকাতি করেছে। বাধা দিতে গিয়ে বাড়ির একটি ছেলে খুন হয়েছে। ওরা যখন এইসব কথা পুলিশকে জানাচ্ছে তখন অনিমেষের পাশে দাঁড়িয়ে আঁকিয়ে ছেলেটি ফিসফিস করে বলল, চলুন পালাই।
 
অনিমেষ সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হয়ে ওদের দিকে নজর বোলালো। অফিসারের সামনে নালিশ জানাতে আসা লোকগুলো দেওয়ালের মত আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে। কনস্টেবলগুলো অনেকটা দূরত্বে মন দিয়ে কথা শুনছে। এখন যদি পালানো যায় তাহলে ধরা পড়ার সুযোগ কিছুটা কম। যদিও পালাবার রাস্তা একটাই, পেছনের রেডিও গলি কিন্তু সেটা অনেকটা দূর অবধি সোজা দেখা যাচ্ছে এবং রাস্তার আললাগুলো খুব উজ্জ্বল। ওই গলি দিয়ে দৌড়ালে এরা অনেকক্ষণ দেখতে পাবে। ছোটার সময় যদি পা বিশ্বাসঘাতকতা করে তাহলে হয়ে গেল। কিন্তু সুবাসার কোথায় গেল? অনিমেষ কাছেপিটে লুকোবার জায়গা দেখতে পেল না। পাশের ছেলেটি আবার জিজ্ঞাসা করল, কি করবেন?

পালানো যাবে না।

যাবে।

চোখের ইঙ্গিত করে ছেলেটি আচম্বিতে দৌড় শুরু করল। অনিমেষ। অনিমেষ জায়গাটা লক্ষ্য করেনি। পেছনের নর্দমার পাশ দিয়ে সরু একটা পথ বাড়িগুরোর মধ্যে ঢুকে গেছে। রেডিও গলি নয়, ছেলেটি ওই সরু পথের মধ্যে ছুটে গেল। এক পলকও নয়, অনিমেষ বুঝে নিল আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপদ নয়। ওর সঙ্গীর ছুটে যাওয়ার জবাবদিহি তাকেই করতে হবে। নিজের অজান্তেই পা চালালো অনিমেষ। সে যখন নর্দমা পেরিয়ে সরু পথটার মুখে, ঠিক তখনই পুলিশগুলোর নজর পড়লো এদিকে। সঙ্গে সঙ্গে হই হই আওয়াজ উঠল। একটা থান ইট অনিমেষের শরীর ঘেঁষে তীব্র বেগে ছুটে দেওয়ালে লেগে টুকরো হল। চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে অনিমেষ দেখল কতগুলো শরীর তার দিকে ছুটে আসছে।

অন্ধকার গলির ভেতরে অনিমেষ ঢুকে পড়ল। একপাশে সরু নর্দমা অন্যদিকে সাঁচির বেড়ার ঘর। এদিকটা যাতায়াতের পথ নয়। অনিমেষ প্রাণপণে ছুটছিল। পায়ের তলায় ভাঙ্গা ইট, রাজ্যের আবর্জনা, একটুও আলো চোখে পড়ছে না। সঙ্গী ছেলেটির কোন অস্তিত্ব বোঝা যাচ্ছে না। রাস্তাটা কোথায় গিয়েছে এসব ভাববার কোন অবকাশ নেই, অনিমেষ অন্ধের মত ছুটছিল। দুতিনটে মোড় পেরিয়ে হঠাৎ সতর্ক হয়ে গেল সে। সামনে চকচক করছে জলকাদা। অর্থাৎ নর্দমাটা এখানে অনেকটা চওড়া হয়ে গিয়েছে এবং আর এগিয়ে যাওয়ার কোন রাস্তা নেই। প্রায় খাঁচায় পড়া ইঁদুরের মত অনিমেষে পেছন দিকে তাকাল। অস্পষ্ট কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে এবার। কনস্টেবলগুলো কি এই পথে ঢুকে পড়েছে? হঠাৎ আঁকিয়ে ছেলেটির ওপর মেজাজ গরম হয়ে গেল অনিমেষের। কি দরকার ছিল এভাবে পালানোর? অষিসারটি বেশ ভালই ব্যবহার করছিল, তাছাড়া শেঠ লেনের লোকগুলোকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হতো ভদ্রলোককে। ছেলেটা যদি এই পথেই আসে তাহলে যাবে কোথায়? অনিমেষ নর্দমাটা পার হবার চেষ্ট করল না। উল্টেদিকে একটা তেতলা বাড়ির পেছনে দিক। চিৎকার চেঁচামেচিতে দোতলার ঘরে আলো জ্বলে উঠেছে। এপাশে সচিব বেড়ার ঘরগুলোর দিকে চকিতে নজর বোলাতে গিয়ে একটা ছোট ফাঁক চোখে পড়ল। কোনরকম দ্বিধা না করে অনিমেষ সেই ফাঁক দিয়ে এগিয়ে গেলে। বাঁশের কোণায় লেগে জামার হাতাটায় টান পড়তেই কেউ চিৎকার করল, কে?

জামাটাকে চাড়িয়ে অনিমেষ দ্রুত এগোতেই একটা উঠোন দেখতে পেল। যে কে বলে ডেকেছিল তার সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না কিন্তু সবাই যদি জেগে ওঠে তাহলে আর দেখতে হবে না। ওপাশের পথটায় কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। পুলিশগুলো নিশ্চয়ই এতক্ষণে নর্দমাটার কাছে এসে গেছে। অনিমেষ চারপাশে খালি বারান্দা দেখতে পেল। তারপর দ্রুত পা চালালো বাইরে বেরুবার পথটার দিকে। গলিটা সরু, দুপাশে বস্তিবাড়ি। বাঁ দিকের পথটা নিশ্চয়ই দমদম রোডে গিয়ে পড়েছে। ওদিকে এগোলে পুলিশের জিপের সামনে পড়তে হবে। কয়েক পা পেছনে এগোতে কাশির শব্দ কানে এল। অনিমেষ দেখল একটা দাওয়ার ওপর দ হয়ে বসে আছে কেউ, কাশিটা তারই গলা থেকে আসছে। অনিমেষের মনে হল লোকটা তাকে দেখেছে। কিন্তু দেখলে তো তার দিকে সরাসরি তাকাতো। ওভাবে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকবে কেন? অনিমেষ কি করবে বুঝতে না পেরে আর এক পা এগোতেই লোকটি বলল, খোকা এলি?
 
সঙ্গে সঙ্গে শক্ত হয়ে গেল অনিমেষ। লোকটি কারোর জন্য অপেক্ষা করছে এত রাত্রে। কিন্তু তাকে এত কাছে দেখেও ভুল করছে কেন? গলার স্বরে বোঝা যায় বেশ বয়স হয়েছে, ও খোকা, এলি নাকি?

নিজের অজান্তেই অনিমেষ বলল হু।

রাত কত হল? এত দেরী করতে হয় বাপ, আমি যে ঘুমোতে পারি না। বৃদ্ধ খক খক করে কাশতে লাগল এবার। ঠিক এই সময় ওপাশের বস্তিতে কথাবার্তা শোনা গেল। পুলিশগুলো ওখানে ঢুকলো কিনা কে জানে।

ও খোকা যা ঘরে যা, ওপাশে আবার হইচই হয় কেন?

বুড়োর গলায় উদ্বেগ ফুটে উঠল। জায়গাটায় দাঁড়ানো আর নিরাপদ নয়। অনিমেষ ইতস্তত করছিল। এতক্ষণে সে বুঝে গেছে বৃদ্ধ চোখে দেখতে পায় না। এত রাত্রেও ছেলের পথ চেয়ে জেগে বসে আছে। কোন কিছু চিন্তা না করে সে দাওয়ায় উঠে এল।

দরজাটা ভেজানো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে আর সাহস হচ্ছিল না। অথচ ভেতরে যেতেও কুণ্ঠা হচ্ছিল। কারণ ঘরের ভেতরে আর কে আছে সে জানে না। তাকে দেখে নির্ঘাৎ চিৎকার উঠবেই, এ বাড়ির সমস্ত লোকই আর অন্ধ হতে পারে না। এতএব ভেতরে পা দেওয়া মানে স্বেচ্ছায় ধরা দেওয়া। কিন্তু পুলিশগুলো কি ওদেরই শেঠ লেনের হত্যাকারী বলে ঠাউরেছে। সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষ ঠান্ডা হয়ে গেল।

অনিমেষ নিঃশব্দে বুড়োর দিকে এগিয়ে গেল। বুড়োকে সব কথা খুলে বললে কেমন হয়? বিনা কারণে পুলিশের রোষে পড়েছে জানলে যদি বুড়োর দয়া হয়। কিন্তু মুখ খোলার আগেই দরজায় শব্দ হল। অনিমেষ চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল দরজায় একটি রোগা শরীর দাঁড়িয়ে আছে। এত রোগা যে দেখলেও বিশ্বাস হয় না। আধো অন্ধকারেও সেই মুখ চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল। তারপরই চিৎকার করার জন্য মুখ হাঁ হল। অনিমেষ সঙ্গে সঙ্গে দুটো হাত জড়ো করতেই শব্দটা বের হল না।

আমাকে বাঁচান ফিস ফিস করে উচ্চারণ করল অনিমেষ দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে। রক্তহীণ শরীর, কোঠরে ঢোকা চোখ, বয়স বোঝা মুশকিল। বৃদ্ধা ওকে খুঁটিয়ে দেখছিল এবার। গলার স্বরে যেটুকু আওয়াজ হয়েছে তাতেই বোধ হয় বুড়োর খটকা লেগেছে। সঙ্গে সঙ্গে রেকর্ড বাজলো, কে, কে এল? খোকা এল না? অ খোকা।

ওপাশের বস্তি এখন জেগে উঠেছে। পুলিশগুলো বোধ হয় সবাইকে ডেকে ডুকে কিছু বলছে। রাত বেশী বলেই বোধ হয় মানুষের উৎসাহ কম। পুলিশ বস্তি থেকে বেরিয়ে সরু গলিটার চর্ট ফেলতে লাগল। আর একটু এগোলেই এ বারান্দাটা ওদের নজরে এসে যাবে।

আমাকে বাঁচান, আমি নির্দোষ। অনিমেষ আবার প্রার্থনা করল।

কে কথা বলে? বুড়োর গলায় সন্দেহ এবার।

খোকা। তীক্ষ্ণ একটা কণ্ঠস্বর বাজলো ওই রোগা শরীর থেকে।

অ খোকা। শুয়ে পড় বাবা, রাত ফুরিয়ে এল। তৃপ্তির গলা এবার।

টর্চের আলো এগিয়ে আসছে। অনিমেষ দেখল বৃদ্ধা দরজা থেকে সরে দাঁড়াল সামান্য। এবং প্রথম সুযোগেই সে ঘরের ভেতর চলে এল। ঘর অন্ধকার। কিছুই দেখতে পাচ্ছে না সে, কারণ বৃদ্ধ এর মধ্যেদরজা ভেজিয়ে দিয়েছে এবং তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরে জানতে চেয়েছে, কে তুমি? গলার স্বর উচ্চ গ্রামে নয় কিন্তু খুব জেদী এবং শীতল।

আমি রাজনীতি করি মা। শেষ শব্দটি উচ্চারণ করার আগে অনিমেষের একটুও মানসিক প্রস্তুতি ছিল না। তাই নিজের কানেই শব্দটা ঠেকলো

ভোটের লোক?

না না। আমরা অন্য রাজনীতি করতে চাই।

এ্যাই কে তুই?

বাইরে হাঁক উঠল।

আমি নিবারণ দাস, আপনারা কে? বুড়োর গলা।

পুলিশ। এখানে বসে আছিস কেন?

ঘুম আসে না বাবু। চোখে না ঘুমও আসে না।

আর একটি হেঁড়ে গলা বোধ হয় জরিপ করেই বলল, এ শালা অন্ধ।

এদিকে কাউকে আসতে দেখেছিস?

আমি তো চোখে দেখি না বাবু।

ফালতু সময় নষ্ট করছিস। ফিরে চল।
 
কয়েক মুহূর্তে বাদেই গলিটা নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কাঠ হয়ে দাঁড়িয়েছিল অনিমেষ। এতক্ষণের উত্তেজনায় শরীর আর খাড়া থাকতে চাইছিল না। সে হাঁটু গেড়ে অন্ধকারে বসে পড়ল। সেই সময় বাইরে থেকে বুড়োর চাপা গলা ভেসে এল অ খোকার মা, খোকা, আজ আবার কি করে এল, পুলিশ আসে কেন?

ঘুমোও তো চেঁচিয়ে পাড়া জাগিও না। বৃদ্ধা ধমকে উঠল।

হ্যাঁ, এইবার ঘুম আসছে মনে হয়। বুড়ো বিড় বিড় করল।

সাদা কাপড়টাকে ঘরের এক কোণে হেঁটে যেতে দেখল অনিমেষ। এই অন্ধকারও সে ঘরের মধ্যে দারিদ্র্যের একটা গন্ধ টের পাচ্ছিল। কেমন একটা চিমসে হাওয়া পাক খাচ্ছে এখানে। এবং তখনই সে টের পেল এখানে শুধু ওরা দুইজন নেই, আরো কয়েকটা নিঃশ্বাস পড়ছে মেঝেতে। ভাল করে দেখতে চেষ্টা করল অনিমেষ। হ্যাঁ বৃদ্ধা যেদিকে গিয়ে বসেছে সেদিকের মেঝেতে তিনটে শিশু শুয়ে আছে।

তুমি চোর ডাকাত নও তো?

আমাকে দেখে কি তাই মনে হয়?

চেহারা দেখে আজকাল কিঝছু বোঝা যায় না।

বিশ্বাস করুন আমি কোন অন্যায় করিনি। আমরা রাস্তায় পোস্টার লিখিছিলাম এমন সময় পুলিশ তাড়া করল। আমাদের লেখাগুলো ওদের পছন্দ নয়।

কি লেখা?

আমরা এদেশের নিয়মগুলো ভাঙ্গতে চাই। এই সব মন্ত্রী নেতাদের সরিয়ে এমন একটা সরকার আনতে চাই যেখানে ধনী দরিদ্রর কোন পার্থক্য থাকবে না।

জানি না তুমি সত্যি বলছ কিনা কিন্তু তোমাকে হুট করে এই ঘরে ঢুকতে দিলাম কেন জানো?

আপনার দয়া।

মোটেই না। বাইরের বুড়ো মানুষটা যদি ভুল বুঝেও নিশ্চিন্ত হয় তাহলে বাকী রাতটা একটু ঘুমতে পারবে। উটুকো লোককে এভাবে ঘরে ঢোকানো অন্যায় কিন্তু অন্ধ মানুষটার জন্য…বৃদ্ধার গলা বুজে এল। সামান্য কান্নার আওয়াজ ঘরে পাক খেল। অনিমেষ অনেকক্ষণ কথা বলতে পারল না। নিজেকে সামলে নিয়ে বৃদ্ধা বলল, ভোর হবার আগেই তুমি চলে যেও। মানুষটা জাগবার আগেই।

আচ্ছা।

খানিকক্ষণ চুপচাপ। রাত ঘন হলে কতগুলো নিজস্বতা সৃষ্টি করে। সেগুলো মাঝে মাঝে কানে আসছিল। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে এখন। সুবাসদারা ধরা পড়ল কিনা বোঝা যাচ্ছে না। যদি ধরা পড়ে তাহলে শেঠ লেনের ঘটনায় ফেঁসে যাওয়া বিচিত্র নয়। প্রথম রাতেই কি বিভ্রাট হল!

তোমার মা বাপ নেই। ঘরের কোণ থেকে গলা ভেসে এল।

কেন?

রাত্তিরে বাড়ি ফিরছ না, তাদের চিন্তা হবে না?

হঠাৎ অনিমেষের বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে এল। সত্যি এই কলকাতা শহরে তার জন্যে চিন্তা করার কেউ নেই। কথাটা মাথায় আসতেই বিদ্যুৎ ঝলকের মত একটা মুখ মনের মধ্যে চলকে উঠল। যতক্ষণ সে কোন অন্যায় করবে না ততক্ষণ সেই মুখ আমৃত্যু তাকে সমর্থন করে যাবে। অনিমেষ বলল, চিন্তা তো হবেই। কিন্তু ভাল কাজ করতে গেলে তো ঘরে বসে থাকলে চলবে না।

তুমি মদ খাও?

না।

বিয়ে করেছ?

না।

উত্তরটা শোনা মাত্র একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। সেই শব্দ এতদূরে বসেও যেন অনুভব করল অনিমেষ। বুড়োর গলায় খোকা ডাকটা এ মুহূর্তে তার কাছে জলের মত স্পষ্ট। খুব নরম গলায় সে জিজ্ঞাসা করল, এরা, কে?

আমার নাতি নাতনী।

ওদের মা বাবা?

মা চলে গেছে, বাপ মাতাল, অর্ধেক দিন বাড়ি ফেলে না। আমরা দুজন এদের পাহারা দিই। ঝি এর কাজে আর কটা টাকা পাই। এবার নিঃশ্বাস ভীষণ ভারী।


তারপর সব চুপচাপ। অনিমেষ আর কথা খুঁজে পাচ্ছিল না। কখন ভোর হয় এই আশায় বসে থাকা ছাড়া এই মুহূর্তে অন্য কোন চিন্তা নেই।

তোমরা কি লড়াই করে ভাল দিন আনবে, না আমাদের কাছে ভোট চাইতে আসবে? হঠাৎ বৃদ্ধা স্বাভাবিক গলায় কথা বলল।

আমরা ভোটে বিশ্বাস করি না।

তাহলে?

আমরা লড়াই করব।

পারবে?

পারতে হবেই।

কি জানি বাবা। নিঃশ্বাসের শব্দ, আবার সব শান্ত। কিন্তু সেটা খুব সামান্য সময়ের জন্যেই। গলির ভেতর আওয়াজ উঠল। জড়ানো গলায় কেউ গান গাইছে। সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারের মধ্যেই অনিমেষ দেখতে পেল বৃদ্ধা তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন। আর তারপরেই বাইরে বুড়ো কণ্ঠ বাজলো, কে এল? খোকা এলি? শুয়ে পড় বাপ।

তীরের মত বৃদ্ধা দরজা খুলে বেরিয়ে গেল বাইরে। তারপরেই হাইমাউ করে কান্না উঠল পুরুষ কণ্ঠের আওয়াজ এবং সঙ্গে বৃদ্ধার গলা, আঃ চুপ কর, পাড়ার লোক জাগবে, মদ খেয়ে কাঁদতে লজ্জা করে না, তুই না পুরুষ মানুষ।

তারপরেই খোলা দরজা দিয়ে বৃদ্ধা একটা দড়ি পাকানো শরীরকে টেনে হিঁচড়ে ঘরে নিয়ে এলা। লোকটাকে স্পষ্ট দেখা না গেলেও বোঝা যাচ্ছিল আর দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি ওর নেই। এমন কি ঘরে যে অন্য কেউ দাঁড়িয়ে আছে সে খেয়াল করার ক্ষমতাও ওর নেই। ছেলেকে বাচ্চাগুলোর পাশে ধীরে ধীরে শুইয়ে দিল বৃদ্ধা। শোওয়া মাত্র ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস পড়তে লাগল তার।

অনিমেষ দাঁড়িয়েছিল, বৃদ্ধা এগিয়ে এসে বলল, রাত শেষ হয়ে এসেছে তুমি যাও। সেই সময়েই বুড়োর গলা বাজলো ও খোকার মা, খোকা দুবার এল কি করে, আগে কে এসেছিল?

কেউই না। ঘুমোও তো। খিঁচিয়ে উঠল বৃদ্ধা। কিন্তু আমি যে শুনলাম।

ভুল শুনেছ।

অনিমেষ নিঃশব্দে বেরিয়ে এল বারান্দায়। বৃদ্ধা পেছন এসেছে। আকাশ ক্রমশ পরিষ্কার হচ্ছে। বারান্দায় এক কোণে বুড়ো গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। বস্তির মানুষ জাগবো জাগবো করছে এইবার।

অনিমেষ ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, আপনার কাছে আমি ঋণী হলাম।

বৃদ্ধা বলল, কি কথার ছিরি। তাড়াতাড়ি এখানে থেকে বেরিয়ে পড়। বলে দ্রুত ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল।

এক মুহূর্ত অনিমেষ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর ভারতবর্ষের একটা ক্ষুদ্র শরীকে ঘরের মধ্যে রেখে বের হয়ে আসা সময়ে সে রাস্তার দিকে হাঁটাতে লাগল।
 
খুব দ্রুত কাজ শুরু হয়ে গেল। শুধু পশ্চিম বাংলা নয়, ভারতবর্ষের বিভিন্ন অংশে কিছু মানুষ যারা এতকাল টুকোরো টুকরো ভাবনা চিন্তা করছিল তারা ক্রমশ পরস্পরের সঙ্গে হাত মেলাতে ব্যগ্র হয়ে উঠল। তলায় তলায় যে উত্তাপ জন্ম নিচ্ছে তার খবর চাপা থাকল না। কিন্তু ব্যাপারটার বাস্তবতা সম্পর্কে শাসকদল এবং কম্যুনিস্ট পাঠির যথেষ্ট সন্দেহ থাকায় ওরা তেমন আমল দিচ্ছিল না। কিন্তু ক্রমশ বাতাস ভারী হয়ে আসছিল।

অনিমেষ ওপর নির্দেশ ছিল যে কোন মুহূর্তে অ্যারেস্ট এড়ানোর জন্য তৈরি থাকতে এবং বিকল্প থাকার ব্যবস্থা করে রাখতে এখন পর্যন্ত পুলিশ তাকে সন্দেহ করছে এমন ভাসার কোন কারণ দেখে না অনিমেষ। এম. এ. পরীক্ষা এসে গেল বলে। অথচ পড়াশুনা হচ্ছে না বললেই হয়। পার্টির কাজে অনেক সময় কুড়ি ঘন্টাই কেঠে যাচ্ছে আকজাল। মাঝে মাঝে রাত্রে হস্টেলে ফেরাই হয় না। এ ব্যাপারে কাউকে কৈফিয়ত দেবার নেই। বলেই বাঁচোয়া। বিভিন্ন গ্রুপ মিটিং–এ তাকে থাকতে হচ্ছে। মহাদেব বাবুর ইচ্ছে অনিমেষ উত্তরবঙ্গের চা বাগানগুলোর দায়িত্ব নিক। এ ব্যাপারে অবশ্য অনিমেষেরও আপত্তি নেই। কিন্তু এখনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। শিলিগুড়ি ইউনিট এখন বেশ জোরদার হয়েছে। মোটামুটি ভাবে একই চিন্তা–ভাবনার শরীক মানুষগুলোর সঙ্গে অনিমেষের আলাপ পরিচয় হয়ে গিয়েছে।

শিলিগুড়ির কিছু দূরে একটি স্থান নির্বাচন করা হয়েছে মূল ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহারের জন্যে। একদিকে ভারতবর্ষ অন্যদিকে পাকিস্তান আর এক পাশে নেপাল। ভৌগোলিক বিচারে গেরিলা বাহিনীর হেড কোয়ার্টার হবার পক্ষে অতি উপযুক্ত জায়গা। দুটি বিদেশী রাষ্ট্র থাকায় কতগুলো বিশেষ সুবিধে পাওয়া যাবে। এলাকার চতুর্দিকে জঙ্গল এবং নদী পার হলেই নেপাল। মোটামুটিভাবে ওখানকার অধিবাসীরা কৃষিজীবী, বাঙ্গালী বর্ণ হিন্দু সংখ্যায় অল্প। এক ধরনের তেজী ভাব আছে মানুষের আচর-ব্যবহারে। এলাকাটির নাম নকশালবাড়ি।

নকশাবাড়ি ফাঁসি দেওয়া খড়িবাড়ি অঞ্চলে কাজকর্ম শুরু হয়ে গিয়েছে। কৃষকদের সশস্ত্র করে ওই এলাকাকে মুক্ত অঞ্চলে পরিণত করার কাজ গোপনে চলেছে। চীনের মত কেবলমাত্র গ্রামেই মুক্তাঞ্চল গঠন এবং তারপর গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও–এর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। দেশের কোন একটি জায়গা যদি লাল অঙ্গল বলে চিহ্নিত হয় তখন অন্যান্য অংশের নিষ্পেষিত কৃষক উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠবেই। ওদিকে অন্ধ্যের ওয়ারাঙ্গেলের জঙ্গল এলাকায় টিক একই উদ্দেশ্য নিয়ে বিপ্লবী বাহিনী সংগঠিত হয়েছে। এসব সত্ত্বেও একটা বিশেষ অভাব অনুভূত হচ্ছিল। আসন্ন বিপ্লবের কাজকর্ম পরিচালনা করার জন্য একজন সর্ব ভাবতীয় বিশ্বাসযোগ্য নেতা এগিয়ে আসছিলেন না। একজন লেনিন বা মাও সে তুং, হো চি মিন কিংবা ফিডেল কাস্ত্রো দূরের কথা চোখের সামনে চে গুয়েভারার মত সংগ্রামী পুরুষের অভব চোখে ঠেকছিল। অনিমেষরা মনে করে নেতা বিপ্লব তৈরি করে না, বিপ্লবই নেতার জন্ম দেয়। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে বিভিন্ন কর্মী বিবিন্ন রাস্তার কথা ঘোষণা করতে লাগলেন মাতবাদের নানা রকম ব্যাখ্যায় দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মীরা। কিছুটা থমকে পড়েছিল যার পরিণতিতে দলের মধ্যে বিভিন্ন উপদল গড়ে উঠল। অবশ্য একথা ঠিক তখন কোন দল হিসেবে সংগঠণ পূর্ণতা পায়নি। তবু শাখাগুলো চোখে পড়তে লাগল। একজন সর্বভারতীয় অবিসংবাদিত নেতার অভাব সবাই এ মহূর্তে অনুভব করছিল।
 
কিভাবে বিপ্লব শরু হরে, বিপ্লব চালাকালীন দলের ক্রিয়াকলাপ কি স্তরে থাকবে? যেহেতু নকশালবাড়ি আন্দোলন কৃষি ভিত্তিক আন্দোলন তাই শ্রমিকদের সঙ্গে এর সংযোগ কিভাবে সাধিত হবে? এ ধরনের তত্ত্বগত প্রশ্ন অনেকের মনে জাগছিল। কিন্তু অনিমেষরা এ নিয়ে বেশী ভাবছিল না। শ্ৰেণী শত্রু যে সে যদি বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাকে সরিয়ে ফেলতে হবে বিনা দুর্বলতায়। কোন রকম আপস করা চলবে না। বিদেশে নির্বাচিত গেরিলাদের পাঠিয়ে সমরশিক্ষায় শিক্ষিত করে নিয়ে এসে গেরিলাবাহিনী সংগঠিত করতে হবে। একটা যুদ্ধ জয় করতে হলে বিরাট বাহিনী নিরর্থক হয়ে দাঁড়ায় যদি তার উপযুক্ত রণকৌশল না থাকে। ইতিহাসে এর প্রমাণ ভুরি ভুরি মেলে। সঠিক রণনীতি থাকাসত্ত্বেও রণকৌশলের অক্ষমতার কারণে বিপ্লব মাথা থুবড়ে পড়েছে। ১৯১৭ সালের রাশিয়া বা মাও সে তুং–এর চীনের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাফল্যের মূল কারণ সঠিক রণকৌশলের পরিকল্পনা। এই রনকৌশল যে সব সময় তাত্ত্বিক পথেই চলবে তা মনে করার কারণ নেই। বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে বিপ্লবের প্রয়োজনেই তার রূপ নির্ধারিত হবে। ১৯১৭ সালের নভেম্বরে লেনিনের অভ্যুত্থানের আহ্বান কিংবা মাও সে তুং ১৯১৭-১৮ সালে দলের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের পরিপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মার্কসবাদী প্রথাগত রনকৌশলের পরিবর্তে গ্রামে গ্রামে মুক্তাঞ্চল গঠন করার যে ডাক দিয়েছেন তা এই সত্যতাই প্রমাণ করে। অনিমেষরা এই রণকৌশলে ব্যাপারে তত্ত্বের সঙ্গে কোন রকম আপস করবে না বলে ঠিক করল, যদি তা বিপ্লবকে থিতিয়ে দেয়। ফলে পাশাপাশি কাজ করতে গিয়ে অন্য মতবাদের সঙ্গে চাপা রেষায়েষি সে অনুভব করছিল। কিন্তু যাই হোক না কেন, একটা বিশ্বাস প্রত্যেকের মধ্যে ছিল, একথা যখন চাকা গড়াবে তখন সমস্ত হাত এক হয়ে তাকে মদত দেবে। মতবাদ যাই হোক না কেন, একথা তো ঠিক সবার মূল লক্ষ্য হল ভারতবর্ষে সর্বাত্মক বিপ্লব যা রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামো পালটে দেবে।

কলকাতা শহরের আশেপাশে ছোট ছোট দল তৈরি হয়ে গেল। একদিকে দমদম সিঁথি বরাহনগর বেলঘরিয়ায় অন্যদিকে বেলেঘাটা যাদবপুর টালিগঞ্জ এলাকায় কাজকর্ম জোরদার হতে লাগল। সমস্ত পশ্চিমবঙ্গ এখন অস্থির। সরকারের চাপানো লেভির চাপ বড় বড় জোতদাররা কংগ্রেস সম্পর্কে বিমুখ হচ্ছে। একজন বর্ষীয়ান কংগ্রেসী নেতাকে দল থেকে বিতাড়িত করায় তিনি ক্ষুদ্ধ হয়ে ওইে নামে পালটা দল গঠন করেছন বিক্ষুব্ধ কংগ্রেসীদের নিয়ে। সারাদেশের জোতদাররা তাকে সমর্থন করছে। সাধারণ জনসাধারণ জিনিপত্রের আকাশ ভঁয়া দাম, আইণ–শৃংখলার অভাবে বিপর্যন্ত। অনিমেষরা বুঝতে পারছিল, এই সময়েই কাজ শুরু করা উচিত। এখন এগিয়ে গেলে সাধারণ মানুষকে সহজেই সঙ্গে পাওয়া যাবে।
 
বেলঘরিয়াতে আজ গ্রুপ মিটিং ছিল। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এই সভাগুলো করতে হয়। এতদিন পুলিশের ভয় ছিল এখন অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোও ভয়ের কারণ হয়েছে। একটা গোপন সড়যন্ত্র চলছে। এ খবর তারও টের পেয়েছে। হয়তো এখনও বিশ্বসযোগ্য নয় কিন্তু স্বস্তিও হচ্ছে না। আজকের মিটিং–এ অনিমেষরা স্থির করল এলাকা দখল করতে হবে। একটা রাস্তা থেকে একটা পাড়া এবং সবশেষে সমগ্য এলাকা দখলে নিয়ে আসতে হবে। পুলিশের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষে যাওয়া হবে না। তবে পুলিশী অত্যাচার শুরু হলে গেরিলা কায়দায় তাদের প্রতিরোধ করতে হবে। এখন বিভিন্ন এলাকায় প্রচুর বোমা তৈরি হচ্ছে। সম্প্রতি দমদমে একটা গোপন ডেরায় বোমা তৈরি সময় বিস্ফারণ হয়ে দুটি ছেলে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। সেখানে হানা দিয়ে পুলিশ প্রচুর বোমা ও মশলা বাজেয়াপ্ত করার পর তাদের তৎপরাতা বেড়ে গেছে। কলকাতার পাঁচটি গোপন কেন্দ্রে পাইপগান তৈরি হচ্ছে অনবরত। পাকিস্তান যুদ্ধের কিছু মালপত্র ব্ল্যাক মার্কেটে রয়ে গেছে। সেগুলো কিনতে হলে ভাল টাকা পয়সা দরকার। প্রতি এলাকায় যথেষ্ট সম্পন্ন পরিবাগুলোর কাছে থেকে চাঁদা চাওয়া হবে। তবে কোন অবস্থাতেই দরিদ্র সাধারণ মানুষকে যাতে বিরক্ত করা না হয় এ বলে সতর্ক করে দিল অনিমেষ। কিন্তু এলাকা দখল করতে গেলে প্রথম প্রতিরোধ করবে রাজনৈতিক দল। এখন শহরতলির এইসব এলাকা তথাকথিত কম্যুনিস্টদের দখলে। পাকিস্থান থেকে আসা বাঙালীরা কলকাতার এই সব অঞ্চলে ছড়িয়ে আছেন স্বাধীনতার পর থেকেই। তারা নিঃস্ব অবস্থা থেকে আবার যখন মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইছেন তখন কংগ্রেস সরকার সম্পর্কে অনেক ক্ষোভ জমছিল। যার ফলশ্রুতি হিসেবেই কম্যুনিস্ট পার্টির প্রতি এদের সমর্থন গেছে। বিধান রায়ের আমলে কংগ্রেস নির্বাচনের সময় এই আসনগুলোকে বাদ দিয়েই তাদের জয়ের হিসেব করত। অতএব এইসব এলাকার কম্যুনিস্ট সংগঠন কখনই স্বেচ্ছায় কর্তৃত্ব হস্তান্তর করবে না। এক্ষেত্রে বল প্রয়োগ এড়ানো যাবে না। মিটিং-এ একটি ছেলে প্রশ্ন তুলল, অনিমেষদা, বোমা ছোঁড়া কিংবা পাইপগান চালানো অভ্যেসের ওপর নির্ভর করে। আমরা খবর পাচ্ছি অ্যাকশন শুরু হলে কিছু ছেলে। এককালে এরা অনেককেই কংসেগের পোষা গুন্ডা বলে চিহ্নিত কিন্তু নিজেদের মধ্যে গোলমাল শুরু হয়ে যাওয়ায় বাইরে বেরিয়ে এসেছে। এদের কি নেওয়া ঠিক হবে?

কয়েকদিন আগে মহাদেবদার সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে অনিমেষের। যারা সমাজ বিরোধী হিসেবে পরিচিত তাদে আন্দোলনে নিলে সাধারণ মানুষ ভূল বুঝতে পারে। উত্তরে মহাদেববাবুর দলের একজন তাত্ত্বিক নেতার বক্তব্য জানিয়েছিলেন, আন্দোলন শুরু হলে কে ভার কে মন্দ বিচার করা যথেষ্ট বোকামি হবে। মূল লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার জন্যে যে কোন হাতের সাহায্য নিতে হবে। যারা সমাজ বিরোধী বলে পরিচিত তাদের মধ্যে এক ধরনের বন শক্তি কাজ করে যেটাকে ঠিকঠাক ব্যবহার করলে কল্পনাতীত ফল পাওয়া যায়। কোন একটা মহৎ কাজে অংশ নিচ্ছি এই বোধ একবার ওদের মনে সঞ্চারিত হলে ওরা আমাদের গর্ব হয়ে দাঁড়াবে। কথাটা অনিমেষ মিটিং–এর বুঝিয়ে বলল। যদিও এ ব্যাপারে তা নিজেরই কিছু দ্বিধা আছে তবু এখানে সে প্রকাশ করল না। ছেলেটি এবার জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু কোন রকম রাজনীতি সচেতনতা ছাড়া শুধু ব্যক্তিগত আক্রোশ কিংবা মুনাফা লুটবার জন্য ব্যগ্র এই ছেলেগুলো যদি বিশ্বাসঘাতকতা করে তা হলে তা আমাদের পক্ষে বিরাট ক্ষতি হয়ে দাঁড়াবে না?
 
অনিমেষ হাসল, সারা ভারবর্ষের মানুষ যদি আজ বিপ্লবে অংশ নেয় তাহলে কি আমরা তাদের পরীক্ষা করব যে তারা রাজনীতি সচেতন কিনা? মার্কসবাদ না বুঝলে বিপ্লবে অংশ নেবার কোন অধিকার নেই এই রকম শর্ত রাখা কি? আর বিশ্বাসঘাতকতার কথা উঠলে তার সম্ভাবনা তো সব ক্ষেত্রেই হতে পারে। অত্যন্ত শিক্ষিত মার্কসবাদে দীক্ষিত নেতারা কি ঠিক সময়ে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি? সে ঝুঁকি তো আমাদের নিতে হবেই। আমার অভিজ্ঞতার বলতে পারি অশিক্ষিত মানুষ এবং আপাত চোখে যাদে সমাজ বিরোধী বলা হয় তাদের থেকে মুখোশ পরা শিক্ষিত মানুষের চরিত্র অনেক বেশি তরল হয়।

শেষ প্রশ্ন হল, প্রতিরোধ যদি মার্কসবাদী দলগুলো থেকেই আসে তবে তাদের মোকাবিলা করতে হলে বল প্রয়োগ করতেই হবে। এই ঘটনা কি বিপ্লবের ক্ষতি করবে না?

উত্তর দিতে অনিমেষ একটুও ভাবল না। নিজের বুড়ো আঙ্গুলটা ওপরে তুলে ধরে বলল, যদি কোন বিষাক্ত ঘায়ে এটিতে পচন ধরে তাহলে তাকে কেটে খেলতে আমি একটুও দ্বিধা করব না। নিজের আঙ্গুল বলে মায়া দেখালে কয়েকদিন পরে সমস্ত শরীরটায় পচন ধরবে। প্রতিক্রিয়াশীলদের চাইতে সংশোধনবাদীরা আমাদের কাছে বেশি ক্ষতিকার।

এলাকা দখল করতে হলে কি কি করতে হবে তার বিশদ পরিকল্পনা বুঝিয়ে দেওয়া হল। কোনমতেই হঠকারিতা করা চলবে না। এবং দলের সংকেত না পেলে কেউ এমন কাজ করবে না যা অন্যের সন্দেহ উদ্রেক করবে।

মিটিং শেষ করে বাইরে বেরিয়েই অনিমেষের মাধবীলতার কথা মনে পড়ল। এই জায়গাটা থেকে ওর বাবার বাড়ি এমন কিছু দূরে নয়। অথচ সেই বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর থেকে মেয়েটা আর একবারও এখানে ফিরে আসেনি। মাধবীলতা অনিমেষের সঙ্গে কথা বলার সময় ভুলেও এই সব প্রসঙ্গ তোলে না। এসব ব্যাপারে অত্যন্ত শীতল হয়ে গেছে সে।

এখন প্রত্যহ দেখা করার সুযোগ বা সময় হয় না। মাধবীলতার দৈনিক রুটিন অনিমেষের জানা। সময় পেলেই সে সেখানে হাজির হয়। অনিমেষ লক্ষ্য করেছে তাকে দেখা মাত্র মাধবীলতার মুখ কি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ওই মুখটির জন্যে পৃথিবীতে অনেক কাজ করে যাওয়া যায়। অনিমেষের নতুন চিন্তা–ধারার কথা মাধবীলতা জানে। যে মেয়ে এককালে বলত আমার বড় ভয় করে সে এখন খুব বদলে গেছে। এখন সে চুপচাপ ওদের কাজকর্মের কথা শোনে।

বেলঘরিয়া থেকে বেরিয়ে মানিক তলায় আসার কথা ছিল। মহাদেবদা রামানন্দ চ্যাটজী স্ট্রীটের একটা বাড়িতে থাকবেন। খুব জরুরী দরকার। যাদের সঙ্গে মিটিং করছিল এতক্ষণ তাদের একটি ছেলে ওকে সাইকেলে করে বি. টি. রোডে পৌঁছে দিয়ে গেল গলিপথে। চারধারে এখন নির্বাচনের হাওয়া লেগে গেছে। সাধারণ মানুষের ধারণা করতে পারছে না, তবু নেকেরু পরিবারের ওপর সারাদেশের একটা অন্ধ ভরসাবোধ আছে। সেই সুবাদেই জয় সম্পর্কে ওরা নিশ্চিত। সাইকেল আসতে আসতে অনিমেষ নির্বাচনের পৌস্টার দেখছিল। মার্কসবাদী কমুনিস্ট প্রার্থী তার প্রচারের সমর্থনে লেনিনের বাণী ব্যবহার করেছেন। এই ব্যাপাটাই অনিমেষের কাছে বিস্ময়ের মনে হয়। যা বিশ্বাস করি না, যে সব কথা জীবনে কখনো প্রয়োগ করব না তাই দেওয়ালে, পোস্টারে লিখে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করব নির্বাচিত হবার বাসনায়। এই সব লেখার পাশে নতুন লেখা এখন কারো চোখে না পড়ে থাকছে না। অনিমেষেরও দেখল নির্বাচনী পোস্টারের পাশে প্রায়ই জ্বল জ্বল করছে পার্লামেন্ট শুয়োরের খোয়াড়। নির্বাচন বয়কট করুন। সাধারন মানুষ এখনও মুখ না খুললেও বাতাসে একটা চাপা উত্তেজনা ক্রমশ জমছে এটা টের পাওয়া যায়।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top