What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected কালবেলা- সমরেশ মজুমদার (2 Viewers)

কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করলেন মহিলা। তারপর বাঁ দিকের ড্রয়ার খুলে একটা ফর্ম বের করে অনিমেষের দিকে এগিয়ে দিলেন, আপনি সত্যি কথা স্পষ্ট বলতে পেরেছেন বলে আমার কোন আপত্তি থাকছে না। আই লাইক ইট। কিন্তু কোন রকম বাজে ঝামেলা আমি চাইব না, সেটুকু মনে রাখবেন।

একটা রূঢ় কথা বলতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে অনিমেষ ফর্মটা ভরতি করতে গেল। সঙ্গে কোন কলম নেই। ভদ্রমহিলা সেটা বুঝতে পেরে একটা কলম এগিয়ে দিলেন। নাম, বয়স, কি পড়ে অথবা অন্য কিছু করে কিনা, বাড়ির ঠিকানা, গার্জেনের নাম পর পর জানতে চাওয়া হয়েছে। সেগুলোর জবাব লিখতে লিখতে গার্জেনের নামের বেলায় অনিমেষ ইতস্তত করতে লাগল। ভদ্রমহিলা এতক্ষন লক্ষ্য রাখছিলেন। এবার হেসে বললেন, আপনার নাম ঠিকানা লিখুন।

ব্যাপারটা খুবই সামান্য কিন্তু নিজের নাম লিখতে গিয়ে অনিমেষ বুকের মধ্যে সিসিরানি অনুভব করল। এই প্রথম কাগজে-কলমে মাধবীলতার সঙ্গে তার নাম জড়িত হল। মাধবীলতা কোন অন্যায় করলে হোস্টেল কর্তৃপক্ষ তাকে জানাবে। যেন অত্যন্ত গুরুদায়িত্ব নিল সে আজ থেকে এইরকম বোধ হচ্ছিল।

ফর্ম ভরতি করে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, এখন কত দিতে হবে? এ

ক মাসের চার্জ, আর আনুষঙ্গিক কিছু।

পকেটে একশটা টাকা আছে। অনিমেষ ইতস্তত করল। এতে অবশ্যই কুলোবে না। সে বলল, এক কাজ করুন, এখনই রসিদ লিখবেন না। আমার কাছে একশ টাকা রয়েছে। ওটা আমি দিয়ে যাচ্ছি। আগামীকাল কিংবা পরশু বাকী টাকাটা দিয়ে দেব। ও সামনের মাসের পয়লা তারিখ থেকেই থাকবে। অসুবিধা হবে?

মহিলা বললেন, আপনার উচিত ছিল সঙ্গে টাকাটা আনা। যা হোক, এখন কিছু দিতে হবে না। দুদিনের মধ্যে টাকা দিয়ে যাবেন।

অনিমেষ উঠে দাঁড়াল, আপনাকে অজস্র ধন্যবাদ।

ভদ্রমহিলা কোন কথা বললেন না। কিন্তু অনিমেষ দেখল উনি ঠোঁট টিপে হাসছেন।

বাইরে বেরিয়ে আসতেই একটা হইচই শব্দ উঠল। কেশব সেন স্ট্রীট থেকে একদল ছেলে ছুটে আসছে। এপাশের লোকজন পালাচ্ছে। তারপরই দুম দুম করে কয়েকটা বোমা ফাটল চৌমাথায়। চারধারে লোক আতঙ্কে আড়ালে যচ্ছে। অনিমেষ ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা দেখল। একটা ছেলে, রোগা, ঢ্যাঙা, হাতে দুটো বোম নিয়ে মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে, শাসাচ্ছে কাউকে। তার ভয়ে জায়গাটা এখন মধ্যরাতের মত নির্জন।

অনিমেষের ইচ্ছে হল ওকে জিজ্ঞাসা করে কেন সে এমন করছে! কিন্তু তখনই ছেলেটা আবার দৌড়ে কেশব সেন স্ট্রীটে গেলে। কয়েক পা হাঁটতে হাঁটতে অনিমেষের খেয়াল হল এই জায়গাটা ভাল নয়। কাগজে দেখেছে প্রায়ই গোলমাল লেগে থাকে এখানে। বোমাবাজি হয়। এই রকম জায়গায় মাধবীলতাকে থাকতে হবে। ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তিত হতে গিয়েই হেসে ফেলল সে। আজ নয় কাল সারা বাংলাদেশেই যদি এরকম যায়, তাহলে?
 
পয়লা তারিখে খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গেল অনিমেষের। বালিশে মুখ রেখে কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে মাথাতেই মাথার ভেতর চিন্তাটা হঠাৎ নড়ে উঠল। আজ মাধবীলতা বাড়ি থেকে বেরিয়ে হোস্টেলে আসবে। কথা আছে, সকাল আটটার মধ্যে অনিমেষ বেলঘরিয়া ষ্টেশনে ওর জন্য অপেক্ষা করবে। নিমতা থেকে মাধবীলতা রিকশা নিয়ে সেখানে আসবে। তারপর ট্রেন ধরে শিয়ালদায় নেমে ওরা হোস্টেলে যাবে। প্রথম দিন অনিমেষ সঙ্গে গেলে মাধবীলতার সুবিধে হবে।

অনিমেষে চেয়েছিল নিমতার বাড়িতে যেতে। শেষবার সে নিজে মাধবীলতার বাবার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল। ভদ্রলোক জেদ ধরে আছেন সত্যি কিন্তু ভাল করে বোঝালে হয়তো বুঝতেও পারেন। কিন্তু মাধবীলতা তাতে কিছুতেই রাজী হয়নি। বলেছিল, আমার বাবা তোমাকে অপনাম করবেন আমি সেটা দাঁড়িয়ে দেখতে পারবো না। যা কিছু শুনতে হয় তা আমিই শুনবো।

অনিমেষ একটু ইতস্তত করে বলেছিল, ঠিক আছে তবু একটা কথা বলি, জানি তুমি রেগে যাবে শুনলে, কোনভাবেই কি অ্যাডজাস্ট করা যায় না?

মাধবীলতা রাগল না। ওর ঠোঁটে হাসির আদল ফুটল শুধু। তারপর খুব নীচু গলায় বলল, আমি আর টেনসন সইতে পারছি না। প্রতিদিন এক কথা শুনতে শুনতে আমার নার্ভ সহ্যের শেষ সীমায় এসেছে। তারপর খানিক চুপ করে বলল, তুমি এত চিন্তা করছ কেন? আমি নিজে একজন মেয়ে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে আমাকে হাজারটা চিন্তা করতে হয়েছে।

মাধবীলতা তাই একাই বাড়ি থেকে বের হতে চেয়েছে। বাড়ির কাছাকাছি যাতে অনিমেষ না যায় তাই বেলঘরিয়া স্টেশনে ওকে অপেক্ষা করাতে চেয়েছে। ব্যাপারটা অনিমেষের ভাল লাগেনি। মাধবীলতা তার জীবনের এই ঝুঁকির সঙ্গে ওকে জড়াতে চাইছে না এটা ভাবলেই নিজেকে অক্ষম বলে হচ্ছিল। এ মেয়ে যা কিছু করবে তা নিজের দায়িত্বে করতে চায়। অনিমেষের অস্বস্তিটা এইখানেই।

অনিমেষ দ্রুত তৈরী হয়ে নিল। হাতিবাগান থেকে বেলঘরিয়াতে পৌঁছাতে মিনিট চল্লিশেক লাগবে। ভেতরে ভেতরে খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ল অনিমেষ। একটি মেয়ে আজ তার জন্য জীবনের বাঁধা রাস্তার সব সুখ ত্যাগ করে বেরিয়ে আসছে এটুকু ভাবলেন নিজেকে সম্রাট বলে মনে হয়। জামাকাপড় পরতে পরতে অনিমেষ ভাবছিল যদি মাধবীলতা কোন কারণে বাড়ি থেকে না বেরুতে পারে তাহলে সে কি করবে? যদি বাড়ির লোকেরা জোরজবরদস্তি করে ওকে আটকে রাখে? অনিমেষ ঠিক করল যদি বেলা দশটার মধ্যেও মাধবীলতা স্টেশনে না আসে তাহলে সে কোন নিষেধ মানবে না। সোজা মাধবীলতার বাবার মুখোমুখি হবে। ব্যাপারটা ভাবতে গিয়ে নিজের অজান্তেই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল অনিমেষ। ঠিক এই সময়েই দরজায় শব্দ হল। চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে অনিমেষ বলল, কে?

এইসময় কেউ এসে কথা বললে দেরী হয়ে যাবে বলে অনিমেষ বিরক্ত হচ্ছিল। বাইরে থেকে কেউ সাড়া না দেওয়ায় সে একেবারে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দুহাতে দরজা খুলতেই চমকে উঠল। বাইরে এখন ঝকঝকে রোদ্দুর। আর সেই রোদ্দুর পেছনে রেখে মাধবীলতা দুইচোখে হাসছে। বুকের ভেতরটা হঠাৎ শরতের আকাশ হয়ে গেল অনিমেষের। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। কোনরকমে বলল, তুমি!



মাধবীলতা তখনও হাসছিল। সেই হাসিতে একই সঙ্গে আনন্দ আর সঙ্কোচ। দুটো চোখের চাহনি নিঃশব্দে অনেক কথা বলে দিচ্ছে ওর। একটা হলুদ শাড়ি পরে আসায় সমস্ত চেহারায় মিষ্টি ঔজ্জ্বল্য এসেছে। বিব্রত, অবাক অনিমেষের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, রাগ করেছে?

কি আশ্চর্য! রাগ করব কেন? কিন্তু তুমি এখানে এলে কী করে? অনিমেষের বিস্ময় তখনও কাটছিল না। এই সকালবেলায় মাধবীলতা ওপরে উঠে এল কিভাবে? সাধারণত কেউ দেখা করতে এলে দারোয়ান এসে খবর দিয়ে যায়। অনিমেষ দেখল সুন্দরী একটি মেয়ে ভেতরে এসেছে, এ খবর ঘরে ঘরে জানাজানি হয়ে যাচ্ছে। কারণ এক একটা অজুহাত দেখিয়ে অন্যান্য বোর্ডার বাইরে বেরিয়ে মাধবীলতাকে দেখছে। অস্বস্তি হল ওর। সেইসময় মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, তোমার ঘরে যেতে বলবে না?

আমার ঘর? অনিমেষ ঘরটার দিকে তাকাল। ওর খুব ইচ্ছে করছিল মাধবীলতাকে ভেতরে নিয়ে যেতে। কিন্তু পরমুহূর্তেই সচেতন হয়ে গেল সে। খবরটা প্রচারিত হতে বেশী সময় লাগবে না। হোস্টেলের নিয়মকানুন তো আছেই, একটি অবিবাহিতা মেয়ে ছেলেদের হোস্টেলে একা বসে গল্প করছে এ খবর য়ুনিভার্সিটিতে দারুণ মুখরোচক হবে। সে কোন কথা না বলে দরজায় তালা লাগিয়ে বলল, চল, বের হব।

মাধবীলতার কপালে ভাঁজ পড়ল, মানে?

আমাকে একটু বেরোতে হবে, কাজ আছে। অনিমেষ কপট গলায় বলল। ওকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে অনিমেষ সিঁড়ির দিকে এগোল। হোস্টেলের এই ছাদের ঘরে আজ অবধি কোন মেয়ের পদার্পণ হয়নি। যতটা করলে অভদ্রতা না মনে হয় ঠিক ততটা আগ্রহ নিয়ে বারান্দায় বারান্দায় ছেলেরা তোয়ালে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাধবীলতা অনিমেষের পেছনে নীচে নেমে এসে জিজ্ঞাসা করল, কোথায় কাজ আছে তোমার?

বেলঘরিয়া স্টেশনে। অনিমেষ গম্ভীর গলায় বলল।

ইয়ার্কি না? এতক্ষণে সহজ হল মাধবীলতা, এমন মুখের ভঙ্গি করেছিলে না যে মনে হচ্ছিল এসে খুব অন্যায় করেছি।

অন্যায় কিছুটা হয়েছে বইকি! ওইভাবে হুট করে ওপরে উঠে যাওয়া তোমার উচিত হয়নি। আফটার অল এটা ছেলেদের হোস্টেল। গেটে এসে অনিমেষ চারধারে নজর বুলিয়ে দারোয়ানকে দেখতে পেল না।

রাস্তায় নেমে মাধবীলতা বলল, বাঃ, সেটা আমি জানব কি করে। এখানে এসে দেখলাম কেউ নেই। একটু ভেতরে ঢুকে তোমার নাম জিজ্ঞাসা করতেই একজন ঘরটা বলে দিল। ডেকে দেবার কেউ না থাকলে আমি কি করব? কিন্তু তুমি আমাকে ভেতরে বসতে বললে না কেন?

নিজের ওপর বিশ্বাস নেই বলে।

অভদ্র! বলে মাধবীলতা মুখ ঘুরিয়ে নিল।

অনিমেষ ঘার ঘুরিয়ে ওর মুখখানা দেখল। আচমকা বেশ লাল দেখাচ্ছে। জরুরী কথা বলার ভঙ্গীতে সে বলল, এবার কাজের কথাটা বলো তো সাতসকালে কেন এখানে হাজির হলে? আর একটু দেরী হলেই তো আমি বেরিয়ে যেতাম।

মাধবীলতা তখনও স্বচ্ছন্দ নয়। অনিমেষের মুখের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, বলছি, কিন্তু তার আগে সত্যি করে বল তুমি রাগ করনি আমি তোমার ঘরে উঠে গিয়েছিলাম বলে।

অনিমেষ হেসে ফেলল, আচ্ছা মেয়ে তো! বললাম না আমি রাগ করিনি।
 
ওরা হাঁটতে হাঁটতে ট্রাম রাস্তায় চলে এসেছিল। সকালবেলায় কলকাতার চেহারাটা অনেক নরম থাকে। দোকানপাট এখনও খোলেনি, শুধু সিগারেট পানের দেকানগুলো ছাড়া। ফুটপাতে কলকাতাকে একদম অনুত্তেজিত দেখায়। মাধবীলতা বলল, চল, কোথাও বসে চা খেতে খেতে কথা বলি। সক্কাল থেকে স্থির হতে পারিনি।

ওরা পাশাপাশি হেঁটে হাতিবাগানে এল। এখন ভাল রেস্টুরেন্টগুলোর ধোওয়ামোছা চলছে। আটপৌরে চায়ের দোকানে খবরের কাগজ পড়তে আসা মানুষের ভিড়। অনিমেষ রাধা সিনেমার পাশে দোতলায় একটা রেস্টুরেন্টে উঠে জিজ্ঞাসা করল, চা পাওয়া যাবে?

ছোকরা মত একটা লোক, তখনও বেয়ারার পোশাক পরেনি, বলল, দেরী হবে।

কতক্ষণ?

ওদের দিকে তাকিয়ে লোকটা কি বুঝল কে জানে, জিজ্ঞাসা করল, শুধু চা?

অনিমেষ কিছু বলার আগেই মাধবীলতা বলল, টোস্ট পাওয়া যাবে? বোঝা যাচ্ছিল শুধু চা বললে লোকটা কাটিয়ে দিত।

বাঁ দিকে হাত তুলে বলল, বসুন দশ মিনিট।

রেস্টুরেন্টে সবে ঝাট পড়েছে। চেয়ারগুলো টেবিলের ওপর উলটে রাখা আছে। পেছনে থেকে লোকটা চেঁচিয়ে বলল, কেবিনে গিয়ে বসুন।

অনিমেষ রাস্তার ধারে কেবিনে ঢুকল। কেবিনটা ছোট। দেওয়াল ঘেঁষে টেবিল। পাশাপাশি দুজন বসতে পারে। ওরা বসতেই সামনের হাতিবাগান বাজারের ওপরটা চোখে পড়ল। পর্দাটা গোটানো থাকা সত্ত্বেও এখানে আলো কম। চেয়ারে বসে মাধবীলতা বলল, জানো, কাল রাত্তিরে এদকম ঘুমুতে পারিনি।

অনিমেষ তাকাল। মাধবীলতাকে প্রথম থেকে একটু অন্যরকম দেখাচ্ছিল। এখন কারণটা বুঝতে পারল। আজ অবধি কখনো সে ওকে ভোরে দ্যাখেনি তাই একটু আলস্য মাখানো অযত্ন মুখে চুলে। স্নানের পর মেয়েদের শরীরে যে টানটান তেজ থাকে তা ভোরবেলায় পাওয়া যায় না। ভোরবেলায় তাই মেয়েদের কাছের মানুষ মনে হয়। এতক্ষণ ওকে দেখার আনন্দে এবং উত্তেজনায় সমস্ত ব্যাপারটা গুলিয়ে গিয়েছিল। আজ সকালে মাধবীলতার বেরিয়ে আসার কথা। অথচ সে এখন তার সামনে বসে। এদিকে বলছে মত পালটেছে মাধবীলতা। গলা স্বাভাবিক রেখে সে জিজ্ঞাসা করল, ঘুম হয়নি কেন?

কোনদিন তো বাড়ির বাইরে থাকিনি। একা নতুন জায়গায় কিছুতেই ঘুম আসছিল না। নানান চিন্তা আসছিল আর ভেবেছি কখন সকাল হবে। মাধবীলতা হাসলো।

হকচকিয়ে গেল অনিমেষ, নতুন জায়গা মানে? তুমি কি গত কালই চলে এসেছ?

হ্যাঁ। মাধবীলতা একটা চাপা নিশ্বাস ফেলল।

কেন? কি হয়েছিল?

চলে আসতে হল। ভয় ছিল গতকাল থেকেই আমাকে থাকতে দেবে কিনা। কিন্তু সুপারকে বলতে দেখলাম রাজী হয়ে গেলেন। নইলে কি বিপদে পড়তে হতো!

কী হয়েছিল? আবার প্রশ্নটা করলো অনিমেষ।

বাড়িতে গিয়ে মাকে বললাম তোমরা যদি চাও তাহলে আমি হোস্টেলে চলে যেতে পারি। মা বলল, তোমার বাবার সঙ্গে বুঝে নাও, আমি এর মধ্যে নেই। বাবা আমাকে দেখা মাত্র জানতে চাইলেন আমি কারো প্রেমে পড়েছি কিনা। অস্বীকার করলাম না। তারপর যা হয়ে থাকে তাই হল। আমি নাকি ওঁর মুখ পুড়িয়ে দিয়েছি। দুধকলা খাইয়েছেন কালসাপকে। বললেন মত পরিবর্তন করতে। অসম্ভব শুনে জানিয়ে দিলেন আমার মুখ দর্শন করতে চান না। আমি যেন ওই মুহূর্তে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই। আমারও খুব রাগ হয়ে গিয়েছিল। জিনিসপত্র গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ওরা জানতেও চাইল না কোথায় যাচ্ছি। তবু একটা কাগজে নিজের ঠিকানাটা লিখে রেখে এলাম। ভালো লাগছিল না একটুও।

মাধবীলতা মুখ নামালো।

অনিমেষের কষ্ট হচ্ছিল, গাঢ় গলায় বলল, দ্যাখো, পরে অনুশোচনা করার চেয়ে সময় থাকতেই শুধরে নেওয়া ভাল। হাজার হোক তারা তোমার মা বাবা।
 
মাধবীলতা দাঁতে ঠোঁট কামড়ালো, এই একটা কথা তুমি কতবার বললে! তুমি কিছুতেই বুঝছ না একটা মেয়ে বাড়ির প্রতিকূল মনোভাবের বিরুদ্ধে কতক্ষণ লড়তে পারে? অনবরত চাপ দিচ্ছে সবাই বিয়ের জন্যে। উঠতে বসতে খোটা খেতে হচ্ছে। হয় হ্যাঁ বল নয় না। আজ থেকে দুবছর আগে হলে হ্যাঁ বলতে কোন অসুবিধে হতো না। স্বচ্ছন্দে বিয়ে হয়ে যেত আমার। বাবা বলতেন বড় ভাল মেয়ে, আমি দায় থেকে উদ্ধার পেলাম। কিন্তু এখন আমি কি করে রাজী হই! যে সব মেয়ে মনে করে মনের কোন সতীত্ব নেই আমি সেই দলের নই। শরীরের চেয়ে মন আমার কাছে কম মূল্যবান নয়। যে চোখে আমি তোমাকে দেখেছি সেই চোখে আমি অন্য পুরুষকে দেখব কি করে? কথা বলতে বলতে খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল মাধবীলতা।

অনিমেষ দেখল ওঁর মুখ কাঁপছে, আর তারপরেই চোখের দুটো কোণা চিক চিক করে উঠল। মাধবীলতার মুখে এখন ভাড়চুর। চোখ দুটো ভরা পুকুর। অনিমেষের বুকের মধ্যে পাথর গড়াতে লাগল। নিজের অজান্তেই ওই একটা হাত মাধবীলতার কাঁধে রাখল, কেঁদো না, তোমার চোখে জল একদম মানায় না। আমি সহ্য করতে পারব না।

সামলাতে সময় লাগল ওর। আঁচলে চোখ চেপে রাখল কিছুক্ষণ। তারপর ধরা গলায় বলল, আচ্ছা। বল তো, কোন বাবা-মা নিজের মেয়েকে এত সন্দেহ করে? কেন নিজের জেদ মেয়ের উপর চাপিয়ে দিয়ে আনন্দ পায়? আমি কি ছেলেমানুষ? এতদিন যেমন ছিলাম তেমনি কি ওদের কাছে আরো কিছুকাল থাকেত পারতাম না? তবে কেন এত জোরজবরদস্তি!

অনিমেষ জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। আকাশ এখন পরিষ্কার। সান্তনা দেবার ভঙ্গিতে বলল, কিছুদিন যেতে দাও দেখবে ওঁরা নিজেদের ভুল বুঝতে পারবেন। নিশ্চয়ই জেদ করবেন না আর। তুমি যদি কোন অন্যায় না কর তাহলে কেউ তোমার দোষ দেবে না।

না, কথাটা ঠিক নয়। আমি বাড়ি থেকে চলে এসেছি এই খবরটা আত্মীয়রা জানা মাত্রই দুর্নাম রটাতে শুরু করবে। কিন্তু তাতে আমার কিছু এসে যায় না। মাধবীলতার কাঁধ থেকে দুহাত দুপ্লেট টোস্ট আর দুটো চায়ের কাপ হাতে নিয়ে লোকটা চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ঘরটার চেহারা পালটে গেল। পর্দাটার দিকে তাকিয়ে অনিমেষের একবার মনে হল উঠে সরিয়ে দেয় ওটাকে। সেইসময় মাধবীলতা বলল, তুমি আমাকে কখনো কষ্ট দিও না।

একথা বলছ কেন?

আমার যেন মাঝে মাঝে মনে হয় তোমার কোথাও অস্বস্তি আছে।

কী রকম?

আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার ব্যাপারটায় যেন তোমার কোথাও অস্বস্তি আছে। সত্যি করে বল তো আমি কি তোমার ওপর কিছু চাপিয়ে দিচ্ছি?

লতা! অনিমেষ প্রতিবাদ করতে চাইল।

না অনি, আমি, যা করছি নিজের দায়িত্বেই করছি। তোমার যদি মনে হয় জড়িয়ে যাচ্ছ তাহলে স্বচ্ছন্দে সরে যেতে পরো। আমার খুব কষ্ট হবে, সারা জীবন হয়তো কাদব কিন্তু আমি তোমার গার কাঁটা হয়ে আছি এ আমার সহ্য হবে না। মাধবীলতার গলা বুজে এল।

অনিমেষ আর পারল না। চকিতে দুই হাতে মাধবীলতাকে জড়িয়ে ধরল সে। বোধহয় একটা সুতোর আড়ালে নিজেকে ধরে রাখছিল মাধবীলতা, আর পারল না। অনিমেষের বুকে মুখ রেখে হু হু করে কেঁদে ফেলল। তার দুহাত এখন অনিমেষের পিঠ আঁকড়ে ধরেছে। থর থর করে কাঁপছে শরীর। অনিমেষের সমস্ত শরীর এখন অচৈতন্য, মনের কোন বাঁধা নেই, দুহাতে মাধবীলতার মুখ তুলে স্পষ্ট গলায় বলল, আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারব না।

মাধবীলতার দুই চোখে জলের ধারা গড়ালো, ঠোঁট কাপলো, আমিও না। এই প্রথম কোন যুবতী শরীরকে বুকের ওপর অনুভব করল অনিমেষ। চোখের সামনে মাধবীলতার ভেজা স্ফীত ঠোঁট চুম্বকের মত তাকে টানছিল। ধীরে ধীরে মুখ নামালো অনিমেষ। তারপর সেই উষ্ণ নরম সিক্ত ঠোঁট আকণ্ঠ চুম্বন করল। দুজনের চোখ এখন বন্ধ, সমস্ত বিশ্বচরাচর যেন এই পর্দা ঘেরা ছোট্ট কেবিন হয়ে গেছে। ঠোঁটের স্পর্শের মধ্যে দিয়ে অনিমেষ মাধবীলতার সব অন্ধকার মুছিয়ে দিল, মাধবীলতা সব না-বলা কথা জেনে নিল।
 
চেতনা ফিরতেই মুখ সরিয়ে নিল মাধবীলতা। আস্তে আস্তে তার হাত শিথিল হল। যেন একটু লজ্জা পেয়েই সে সরে বসতে চাইল। মুখে এখনও একটা মিষ্টি অথচ নোনতা সুখের স্বাদ, অনিমেষ চোখ বন্ধ করল। আর তখনই সেই বন্ধ চোখের পাতায় আচমকা সেই দুপুরটা ছিটকে চলে এল। জলপাইগুড়ি শহরের বিরাম করের বাড়িতে সদ্য কিশোর অনিমেষ রম্ভার সামনে দাঁড়িয়ে। সামনের বিছানায় রম্ভা শুয়ে রয়েছে জ্বরতপ্ত শরীরে। মুখচোখ লাল, চুল উসকোখুসকো। অনিমেষ যখন তার অনুরোধে জ্বর দেখতে নীচু হয়েছিল তখনই করার আগেই দুটো জ্বরো ঠোঁট তাকে চুম্বন করেছিল। বিশ্রী, পোড়া বিড়ির স্বাদ পেয়েছিল যেন অনিমেষ। দাঁড়িয়ে উঠে নিজের ঠোঁট ঘিনঘিনে ভাব অনুভব করেছিল। জ্ঞানে কিংবা অজ্ঞানে সেই তার প্রথম চুম্বন। কিন্তু তার স্মৃতি অনেকদিন একটা অস্বস্তির চেহারা নিয়ে মনের ভেতর ছিল। আজ অনিমেষের মনে হল এতদিনে সেই বিশ্রী স্মৃতিটা ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার হয়ে গেল।

অনেকক্ষণ কেউ কোন কথা বলল না। শেষ পর্যন্ত অনিমেষ সামনে রাখা প্লেট টেনে নিয়ে বলল, খাও।

টোস্টে হাত না দিয়ে চায়ের কাপটা টেনে নিল মাধবীলতা। ধীরে ধীরে একবার চুমুক দিয়ে বলল, ভাল লাগছে না..

কেন, ঠান্ডা হয়ে গেছে? অনিমেষ হাত দিয়ে দেখল কাপটা গরম নেই।

মাধবীলতা তাই দেখে বলল, না, খাওয়া যাবে কিন্তু খেতে ইচ্ছে করছে না।

বুঝল না অনিমেষ, কেন?

সে তুমি বুঝবে না।

বাঃ, তুমিই তো চা খেতে চাইলে।

চেয়েছিলাম।

অনিমেষ ওর চোখে চোখ রাখতে চাইল কিন্তু, মাধবীলতা মুখ ঘুরিয়ে নিলে। অনিমেষ ধমকের সুরে বলল, খেয়ে নাও তো, সকাল থেকে কিছু খাওনি আর আজে-বাজে বকা হচ্ছে। খাও বলছি। টোস্টের প্লেটটা মাধবীলতার সামনে এগিয়ে দিল সে।

খাওয়া হয়ে গেলে মাধবীলতা বলল, আমি কিন্তু তোমার ভরসায় পরীক্ষা দেব!

আমার ভরসায়! আমি তো পড়াশুনা শুরুই করিনি।

এবার কর।

তুমি স্কুলে পড়ানো আর পরীক্ষার জন্যে তৈরী–দুটো পারবে?

পারতে হবেই।

আচ্ছা লতা, আমি ভবিষ্যতে কি করব বলে তুমি ভাবছ?

মানে?

আমি কি রকম চাকরি-বাকরি করব বলে তুমি আশা কর?

মাধবীলতা একটু ভাবল। তারপর বলল, ওসব আমি কিছুই ভাবিনি। একটা কিছু নিশ্চয়ই তুমি করবে, আর যাই করো আমি সমর্থন করবো।

এ কোন কথা হল? বাংলায় এম. এ. পাস করে চাকরি পাওয়া যাবে না। অধ্যাপনা বা মাস্টারী করার মত ব্রাইট রেজাল্ট আমার হবে বলে মনে হচ্ছে না। তখন কি হবে তাই ভাবছি।

আমার চাকরি তো রয়েছে।

আশ্চর্য মেয়ে।

কেন, আমার তো দুটো হাত-পাই আছে।

ইয়ার্কি করো না। আমার ব্যাপারে তুমি একটুও সিরিয়াস নও।

খুব বেশী সিরিয়াস বলেই কিছু ভাবি না।

তাছাড়া আর একটা ব্যাপার আছে। আমার যা শুনেছি তাতে লোক তোমাকে কি ভাবে নেবে তা জানি না। যদি—

ওসব কথা থাক। তোমার দাদু পিসীমার কথা যা শুনেছি তাতে আমার বিশ্বাস ওঁরা আমাকে নিশ্চয়ই ভালবাসবেন।

হঠাৎ অনিমেষের হাসি পেল। ওর মনে হল মেয়েদের মন সত্যিই বিচিত্র। এতদিনের রক্তের সম্পর্ক যাদের সঙ্গে তারা যাকে বুঝতে পারল না, সে বিশ্বাস করছে দুজন অপরিচিত লোক তাকে গ্রহণ করবে। যুক্তি নয়, হৃদয়াবেগই মেয়েদের সাহসী করে তোলে। কথা ঘোরাল অনিমেষ, আমার ভয় হচ্ছে হয়তো তোমাকে আমি সুখী করতে পারব না। সেদিন সুবাসদার সঙ্গে কথা হবার পর থেকে আমার চিন্তা-ভাবনা সব পালটে যাচ্ছে। যদি এমন সময় আসে যখন আমি বাধা-ধরা জীবনে না থাকি তাহলে তুমি কি করবে?

কিচ্ছু না। এখন যা করছি তাই করব। মাধবীলতা অনিমেষের হাত নিজের দুই হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, তোমাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম সেদিনই মনে হয়েছেল তুমি সাধারণ নও। ঘরসংসারের বাধা জীবনে তোমাকে মানায় না। সেটা করতে গেলে তোমার ওপর অন্যায় করা হবে। তোমার পক্ষে যেটা স্বাভাবিক তাই তুমি করবে। আমি কোনদিন তোমার বাধা হয়ে দাঁড়াবো না।

আচ্ছা, এত ছেলে থাকতে তুমি আমাকে ভালবাসলে কেন?

কি মনে হয় তোমার?

জানি না। কেন, তুমি কেন ভালবাসলে?

অনিমেষ মাধবীলতার চোখের দিকে তাকাল। সেই চোখ হাসছে। মনে মনে সে বলল, তোমায় না ভালবাসলে আমি মরে যেতাম। কিন্তু মুখে মুখে কিছু বলল না সে। কারণ মাধবীলতার চোখে হাসি এখন ঠোঁটে ছাড়িয়েছে। অনিমেষ হেসে ফেলল, শব্দ করে। ওদের দশটা আঙুল এখন পরস্পরকে আঁকড়ে ধরেছে বিশ্বাসে।
 
‘প্রথমেই জেনে নেওয়া দরকার আমরা কি চাই। আমরা যারা এখানে রয়েছি তারা কম্যুনিস্ট পার্টির সঙ্গে কাজ করেছি। মার্কসবাদের রীতিনীতি পদ্ধতিগুলোর সঙ্গে বিষেশ ভাবে পরিচিত। এদেশের কম্যুনিস্ট পার্টির নেতার ঔপনিবেশিক সংসদীয় কাঠামোয় নিজেদের মানানসই করে নিয়ে কয়েকটা রাজ্য সরকার গঠন করতে পারলেই উর্ধ্ববাহু হয়ে নৃত্য করবেন। আমরা মনে করি এই পথে সাধারণ মানুষের মুক্তি কখনই আসতে পারে না। এদেশের মানুষের কাছে ভোটের যে প্রলোভন রাখা হয় তার ব্যবহার আমরা জানি। গরীব মানুষগুলো নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর ভাওতাবাজির কাছে বারংবার ঠকে, ভোলে। কিন্তু প্রতিবাদ করার সাহস করে না। কম্যুনিস্ট পার্টিও ঠিক এই পথে এদের ব্যবহার করতে চলেছে।‘ এই অবধি বলে বক্তা একটু থামলেন।

ঘরে এখন পিন-ফেলা নৈঃশব্দ। অনিমেষ দেখল সবসমেত সাতজন এখন শ্রোতার ভূমিকায়। প্রত্যেকেই খুব গম্ভীর মুখে কথা শুনছে। সিঁথির এই বাড়িটায় আসতে ওরা খুব সতর্ক হয়েছিল। সুবাসদার সঙ্গে হরেকৃষ্ণ শেঠ লেনে নেমে অনেকটা হেঁটে এই বাড়িতে আসা। যিনি কথা বলছেন তাঁর নাম মহাদেব সেন। কম্যুনিস্ট পার্টি থেকে বিতাড়িত যারা হয়েছেন ইনি তাঁদের অন্যতম। এই ঘরে আর যারা উপস্থিত তাদের সঙ্গে কম্যুনিস্ট পার্টির সরাসরি সম্পর্ক ছিল। সে অর্থে অনিমেষে একটু বাইরের লোক। বিশেষভাবে পছন্দ করা খিছু মানুষ এখানে সমবেত হয়েছেন। অনিমেষের উপস্থিতি সুবাসদার সুপারিশেই। এতক্ষণ বক্তা যে কথাগুলো বললেন সেগুলো প্রত্যেকেরই জানা। মহাদেববাবু বললেন, আমার মনে হয় এইসব তত্ত্বের কথা আমরা সবাই জানি। আমি সোজাসুজি কথাগুলো বলছি এবার। যেহেতু এই নির্বাচন ব্যবস্থা, সামজিক অসাম্য এবং রাজনৈতিক দালালীতে আমার আর আস্থাবান নই তাই আজ ভারতবর্ষের বিন্নি প্রান্তে কিছু মানুষ নতুন চিন্তা–ভাবনা শুরু করেছেন। আমরা মনে করছি চীনের পথেই ভারতবর্ষের মুক্তি সম্ভব। চেয়ারম্যান মাও–এর কথায় আস্থা রেখেই হবে সশস্ত্র কৃষক গেরিলাদল সংগঠিত করে গ্রামে গ্রামে অঞ্চলভিক্তিক ক্ষমতা দখল। একসঙ্গে সমস্ত ভারতবর্ষে বিপ্লব আনার মত মানসিক এবং বাস্তব পরিস্থিতি এখনও তৈরী হয়নি। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চলে ক্ষতমা দখল এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করলে তার অনুপ্রেরণা দাবানলেন মতো আশেপাশের অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে। পরবর্তী পর্যায়ে এই কৃষক গেরিলাদল সমস্ত্র সন্ত্রামের ছোট ছোটা ঘাটগুলোকে বিস্তৃত করে সারা দেশে জনযুদ্ধের স্রোতে বাইয়ে দেবেন। গড়ে তুলতে হবে গণফৌজ, যে গণফৌজ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির মোকাবিলা করে তাদের উচ্ছেদ করবে।

আমরা জানি প্রতিরোধ আসবেই। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত কোন শ্রেণী বিনা আপত্তিতে কখনই আসন ছাড়েনি। ইতিহাস এই কথাই বলে। এই আপত্তির চেহারা হল সশস্ত্র বলপ্রয়োগ। আগেকার সব আইন, সব গণতন্ত্রের মুখোশ খুলো রেখে ওরা বেয়নেট নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে বিপ্লবীদের ওপর। একটা কথা জেনে রাখুন, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বাঁচার এই লড়াইয়ে তাদের সঙ্গে সামিল হবে আজকের কম্যুনিস্ট পার্টিগুলো। কারণ ইতিহাস বলছে যখনই কোন কঠিন সমস্যা এসেছে ভারতবর্ষের কম্যুনিস্ট পার্টিগুলো এমন সুবিধেজনক ভূমিকা নিয়েছে। যেখানে তাদের অস্তিত্ব স্থির থাকে। আমাদের এই জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে।

আমাদের মুল লক্ষ্য শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রমজীবী মানুষের সংগঠিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। অথবা সর্বহারার একনায়কতন্ত্র। অর্থাৎ এই ব্যবস্থায় শ্রেনী ক্রমাগত সংখ্যায় কমে না। উলটে বলা যায় বৃদ্ধি পায়। শ্রমিক শ্রেনী হল একমাত্র শ্রেণী যে অন্য শ্রেণীর মানুষকে গ্রহণ করতে পারে।
 
তাহলে আমাদের প্রধান কর্তব্য হল গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও করতে হবে। আপাতত আমাদের এই সংগঠনকে অল ইন্ডিয়া কো-অর্ডিনেশন কমিটি অফ কমুনিষ্ট রেভলিউশনারিজ নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। মোটামুটি এই ব্যানারে আমরা কাজ শুরু করব। আমরা যারা এখানে উপস্থি রয়েছি তাদের যদি কোন প্রশ্ন থাকে তাহলে খোলাখুলি করতে পারেন।

সুবাসদা বলল, আমার প্রথম জিজ্ঞাস্য হচ্ছে, আমরা যারা এই বিপ্লবে অংশগ্রহণ করছি তাদের নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া কতটা পরিষ্কার তা জেনে নেওয়া দরকার। আমার যা করতে চলেছি তার পরিণাম সম্পর্কে সবাই ওয়াকিবহাল তো? আমি খারাপ দিকটার কথা বলছি।

মহাদেববাবু বললেন, আমি তো তাই মনে করি। তার পর নিজের মনেই হাসলেন, সুবাস, তোমার দোষ নেই, আমাদের চিন্তাভাবনা দীর্ঘকালের অভ্যেসে একই খাতে বয়ে চলেছে। কিন্তু এখন বোধহয় সেটাকে পালটাবার সময় এসেছে। যারা জলে ঝাঁপ দেবে তারা তো জানেই জলে ডুবে যাওয়াই সম্ভব। এ নিয়ে তর্কের কি প্রয়োজন? তুমি সতর্ক করছ যদি সে ভয় পায় তাহলে আঁপ দেবে না, এই জন্যে? সেক্ষেত্রে সারাদেশের মানুষ যদি ভয় পায় তাহলে কোনদিন কোন কাজ হবে না সাঁতার শিখতে হলে তো জলে নামতেই হবে। তাহলে এই সতর্কীকরণ কেন? আর পারস্পরিক বোঝাপড়ার ব্যাপারটা মাধ্যবিত্ত মানসিকতা থেকেই বললে। ওভাবে কোন কাজ যে হয় না তা আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছি। কাজে নেমে লক্ষ্য এক হলে মানুষের প্রয়োজন তাদের একটা বোঝাপড়ায় আসতে বাধ্য করে এবং সেটাই কাম্য।

সুবাসদা এরকম কড়া অথচ পরিষ্কার জবাব পেয়ে আর কোন কথা বললেন না। অনিমেষের একটা চিন্তা অনেকক্ষণ থেকে মাথায় পাক খাচ্ছিল। মহাদেববাবুর কথা শেষ হতেই সে জিজ্ঞাস করল, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কার হাতে?

কোন ব্যক্তিবিশেষের হাতে নয়। তুমি কি লেটেস্ট ইস্তাহার পাওনি? মহাদেববাবু তাঁর ঝোলা থেকে হাতড়ে একটা কাগজ বের করে অনিমেষের দিকে এগিয়ে ধরলেন। অনিমেষ সেটাতে চোখ রাখল।

বর্তমান পরিস্থিতিতে কমিটি অফ কম্যুনিস্ট রেভলিউশনারীজ কি করতে চায় তা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা আছে। ইস্তাহারের বিষয়সবস্তু নিয়ে গত দুদিন তার সঙ্গে সুবাসদার যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে। এমনকি গত রাতে কলেজ স্ট্রিটে মহাদেববাবুর সঙ্গে আলাপ হবার পর এ নিয়ে কথা বলেছে সে। মার্কসবাদী কম্যুনিস্ট পার্টি থেকে বিতাড়িত কিংবা বেরিয়ে আসা নেতারাই চীনতে অনুসরণে সারা ভারতবর্ষে একটি অগ্নিবিপ্লবের সূচনা করতে চান। এখন তা ছড়িয়ে থাকা কিছু সতেজ মানুষের চিন্তাও আছে মাত্র। মহাদেববাবু এখনও তার দিকে তাকিয়ে আছেন দেখে অনিমেষ বলল, ঠিক আছে।

এ ব্যাপারে কোন প্রশ্ন নেই?

না।

আচ্ছা, এবার একটা খবর দিই। ঠিক এই মুহূর্তে কলকাতা শহর এবং বিভিন্ন জায়গায় আমাদের মত ছোট ছোট দলে আলোচনা এবং বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হচ্ছে। সব সময় মনে রাখতে হবে আমরা এক নই প্রদীপ জ্বালার আগে যেমন সলতে পাকানোর প্রয়োজন হয় তেনমি এখন আমাদের কাজ হচ্ছে বিপ্লবের জন্যে নিজেদের প্রস্তুত করা। আমাদের কয়েকটা বিষয়ে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। প্রথমত, সরকার আমাদের পছন্দ করবে না তা বলাই বাহুল্য। তারা একে রাষ্ট্রদ্রোহী কাজ বলে বিহ্নিত করবেই এবং বিনাবিচারে জেলে পুরবে আমাদের। এই জিনিসটি আমাদের এড়াতে হবে। আমরা চেষ্টা করব কোন অবস্তাতেই যেন পুলিশের হাতে না দরা পড়ি। যতটা সম্ভব গোপন কাজগপত্র যা আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মসূচির সঙ্গে জড়িত আছে তা নিজের কাছে না রাখাই ভাল। অবশ্য এক্ষেত্রে ওদের ছলনার অভাব হবে না। চেয়ারম্যানের যে কোন রচনা কিংবা রেডবুক কাছে থাকলেই ওরা সুযোগ পেয়ে যাবে। কোনভাবে যদি ধরা পড়তেই হয় তাহলে মনে রাখতে হবে যে কোন অত্যাচারের সামনে দাঁড়িয়েও ঠোঁট খোলা চলবে না। পুলিশ প্রলোভন দেখাবেই এবং সেই ফাঁদে পড়ে সতীর্থদের নাম যে বিপ্লবী ফাঁস করে দেয় তার শাস্তি মৃত্যু। প্রত্যেক কমরেড যেন এই কথাটা মনে রাখেন।

দ্বিতীয়ত, আমদের আশেপাশের রাজনীতি-অসচেতন মানুষকে চট করে এইসব কথা না বলাই ভাল। তারা উত্তেজিত হবে, গ্রহণ করতে না পারলে গুজব ছড়াবে এবং শেষ তা বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

অনিমেষ প্রশ্ন করল, কিন্তু জনসাধারণকে সঙ্গে না পেলে কি করে বিপ্লব সম্ভব?
 
অত্যন্ত বুদ্ধিমানের মত প্রশ্ন। চেয়ারম্যান যখন পদযাত্রা শুরু করেছিলেন তখন সাধারণ মানুষকে ঘরে ঘরে গিয়ে বোঝাতে হয়নি। তার বুঝেছিল এটা তাদের প্রয়োজন এবং তা বুঝেছিল বলেই তারা নিজেরাই ঘরে ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল। মহাদেববাবু উত্তর দিলেন।

ঠিক কথা। কিন্তু এদেশে তো কোন বিদেশী শত্রু রাজত্ব করছে না। কিংবা দেশী একনায়ক নেই। যারা সরকারে আছে তাদের নির্বাচন করেছে জনসাধারণই। এখানকার রাজনৈতিক দলগুলো মিটিং ডাকলে এখনও হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়। এই মানুষগুলোকে সঙ্গে পেতে হলে কি তাদের বোঝাতে হবে না? অনিমেষের সরাসরি।

তুমি রেডবুক পড়েছ?

হ্যাঁ।

প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কিভাবে কাজ করতে হয় তার একটা ধারণা নিশ্চয়ই হয়েছে তোমার?

হ্যাঁ, কিন্তু আমার মনে হয় সব থিওরি সর্বত্র খাটে না। এদেশের মানুষ অন্ধ ধর্ম বিশ্বাসী, ব্যাক্তিপূজারী এবং রাজনৈতিক দলগুলোর পাইয়ে দেবার টোপ খেতে অভ্যস্ত। এই খোরস ছেড়ে আচমকা এরা বেরিয়ে আসবে এমনটা ভাবা যেন আকাশকুসুম চিন্তা। তাই আমরা যা চাইছি তা কি এদের বোঝানো প্রথম কর্তব্য নয়? বিপ্লব তো জনসাধারণকে নিয়েই অনিমেষ খুব ভেবেচিন্তে ধীরে ধীরে কথাগুলো বলল।

যুক্তিপূর্ণ কথা এবং একথা কেই অস্বীকার করবে না। কিন্তু কিভাবে জনসাধারণকে বিপ্লব-সচেতন করা যায় তা নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব চিন্তা করছেন। আমরা নিশ্চয়ই জনসভা করে তাদের বোঝাতে পারি না কারণ সরকার তা হতে দেবেন না। তাছাড়া জনসভার বক্তৃতা মানুষের বুকের ভেতর কতটা পৌঁছায় সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। মহাদেববাবু চিন্তান্বিত গলায় বললেন।

অনিমেষের বাঁ পাশের ভদ্রলোক বললেন, আমার মনে হয় এখানে আমরা একটা বিষয় এড়িয়ে যাচ্ছি। এই শাসনব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন আনার জন্যে আমরা যে চেষ্টা করব তা তো কোন ব্যাক্তিবিশেষের জন্যে নয়। আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ দেখে যদি জনসাধারণ সেটা বুঝতে পারে তাহলে মিটিং করে তাদের বোঝাতে যেতে হবে না। একটা সময় আসবে যখন তারা নিজেরাই সব মুখোশ খুলে আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, এত নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে কি করে?

ভদ্রলোক বললেন, খুবই সহজ। ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষ অত্যাচারিত, নিঃস্ব। পৃথিবীতে এখন দুটো জাত আছে। একদল ধনহীন অন্যদল ধনবান। এই দুই দলই কে তাদের বন্ধু এবং কে শত্রু তা চিনতে ভুল করে না। আজকের কৃষক শ্রমিক খুব সহজেই আমাদের বুঝতে পারবে। সমস্যা হবে মধ্যবিত্তদের নিয়ে। তারাই গোট পাকাবে। তবে ঝড় যখন সত্যিই উত্তাল হয় তখন একটা কলাগাছ কতক্ষণ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে!

অনিমেষ কিন্তু এতটা নিশ্চিন্ত হতে পারছিল না। তার মনে হচ্ছিল কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব অবশ্যই এদিকটা চিন্তা করবেন এবং জনসাধারণকে সচেতন করার দায়িত্ব নেবেন। ট্রামে বাসে রাস্তায় একটা মানুষকে দেখেও মনে হয় না তারা বিপ্লব এলে যোগ দেবে। কেউ যখন ঝামেলায় জড়াতে চায় না তখন কি করে এত নিশ্চিত হওয়া যায়!

এইসময় মহাদেববাবু প্রস্তাব রাখলেন, অনিমেষ, জানি না তুমি এত সন্তুষ্ট হবে কিনা তবে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব একটা প্রস্বাব নিয়েছেন। তারা প্রতিটি এলাকায় জনসাধারণকে জানাবার জন্যে দেওয়াল পোস্টার লেখার কথা বলেছেন। যে সমস্ত মানুষ এখনও মনঃস্থির করতে পারছেন না এইসব পোস্টার দেখে তারা নিশ্চয়ই সক্রিয় হবেন। এটাকে পরোক্ষভাবে জনসচেতন করার চেষ্টা বলতে পারো।

কথাটা এমনভাবে বলা যে অনিমেষ চমকে মুখ তুলছিল। কিন্তু মহাদেববাবুর গলায় কোন্ জ্বালা ছিল না। কথা শেষ করে তিনি হাসছিলেন।

অনিমেষ বলল, আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না।

হাত নেড়ে ওকে থামিয়ে দিলেন মহাদেববাবু, না না, তোমাকে এজন্যে ক্ষমা চাইতে হবে না। যৌবনের ধর্মই হল যাচিয়ে নেওয়া। তুমি ঠিক কাজই করেছ। তবে একজন গেরিলা

সৈনিক হিসেবে কতগুলো নিয়ম পালন করতে হয়। অনেক কিছু চট করে মনের সঙ্গে না মিললেও মনে রাখতে হবে বৃহত্তর স্বার্থের জন্যে তাই মান্য করা উচিত। নেতৃত্বকে প্রতি পায়ে অস্বীকার করা মানে বিপ্লবকে হত্যা করা। তুমি নিজেও একদিন এই সমস্যায় পড়বে। হয়তো তখন তোমাকেই খুব কঠোর ব্যবস্থা এ কারণে নিতে হতে পারে।
 
সুবাসদা এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিলেন। হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, কিন্তু বিপ্লবের নেতৃত্ব কার হাতে থাকছে? জল যখন পাহাড় থেকে একবার নেমে পড়ে তখন সে কোনদিকে যাবে তা কি আগে থেকে অঙ্ক কষে বলা যায়? মহাদেবদা বললেন।

কিন্তু গরীব ভূমিহীন কৃষকেরা যদি নেতৃত্বে না আসে তাহলে তো বিপ্লব মধ্যবিত্তভিত্তিক হয়ে যাবে, তাই না?

অতিবশ্যই। এবং তারা যে আসবে না তা আমরা জানছি কি করে? অনিমেষের পাশের ভদ্রলোক বললেন, এটা তো তত্ত্বের কথা হল। যতদিন গরীব শ্রমিক নেতৃত্বে না আসছে মার্কসবাদী লেনিনবাদী যোদ্ধারা উপযুক্ত এবং আদর্শ সময় পেয়েও নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকবে?

অনিমেষের এ-সময় লেনিনের কথা মনে পড়ে গেল। লেনিন তো শ্রমিক কিংবা ভূমিহীন কৃষকের পরিবারের সন্তান ছিলেন না। অনিমেষ হেসে বলল, এই দেখুন, এখানে থিওরি আর জীবনের মধ্যে পার্থক্যটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। এই তত্ত্ব মানলে লেনিনের উচিত ছিল না রাশিয়ার বিপ্লবের নেতৃত্ব দেওয়া।

পাশের ভদ্রলোক খুশী হলেন। অনিমেষকে বললেন, ঠিক বলেছেন। সেইসঙ্গে আপনার একটু আগের কথা যাতে আপনি ভারতবর্ষের মানুষের অন্ধতা এবং নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে বিপ্লবের ব্যাপারটায় সন্দেহ করেছিলেন তার বিরুদ্ধে একটা যুক্তি রাখছি। মার্কস বলেছেন, একমাত্র প্রচন্ড ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাতেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্ভব। এই ছবিটা কি বিপ্লবের আগের রাশিয়ার সঙ্গে মেলে?

কথাবার্তা খুব জমে উঠলেও মহাদেববাবু বোধহয় আর বাড়াতে চাইলেন না। তিনি বললেন, আমার মনে হয় কিছু থিওরি সামনে রেখে কাজ শুরু না করলে আমাদের এগোন সম্ভব নয়। কিন্তু সবসময় যে থিওরি আঁকড়ে থাকতে হবেই তারও কোন মানে নেই। পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে আমাদের চলতে হবে। এ ব্যাপারে কাজে ভিন্নমত পোষণ করা নিশ্চয়ই উচিত নয়। আচ্ছা, এবার কাজের কথায় আসা যাক। আমাদের মধ্যে ওয়াল–পোস্টার লেখার অভিজ্ঞতা করো আছে?

দুজন ছেলে হাত তুলল।

মহাদেববাবু বললেন, খুব ভাল হল। বাইরের কাউকে দিয়ে এখনই পোস্টার লেখানো উচিত হতো। তোমরা রঙ নিয়ে রাত থেকেই লেগে পড়। দমদম স্টেশন থেকে চিড়িয়ামোড় আর ওদিকে সিঁথির মোড় পর্যন্ত দিন সাতেকের মধ্যে যতটা সম্ভব কভার করবে। মনে রাখতে হবে এমন সব দেওয়াল বেচে নেওয়া হবে যা সহজেই মানুষের চোখে পড়ে ঘন ঘন লেখার দরকার নেই, মোটামুটি জায়গাটা কভার চলবে। বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে।

ছেলে দুটির একজন বলল, সাতদিনে এতটা জায়গা, খুব বেশী মনে হচ্ছে না? দুজনের পক্ষে কি সম্ভব?

মহাদেববাবু বললেন, আমরা চেষ্টা করব। তোমাদের সঙ্গে আমরাও থাকব। সুবাসদা বলল, কি স্লোগান লেখা হবে বলে দিন মহাদেবদা।

মহাদেববাবু ঝোলা থেকে এটা কাগজ বের করে বললে, কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এখন এই স্লোগানগুলো লেখা হবে। বুর্জোয়া সংবিধান নিপাত যাক, পার্লামেন্ট শুয়োরের খোয়াড়, রেডবুক মার্কসবাদ লেনিনবাদের সংকলন, চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান, বন্দুকের নল শক্তির উৎস, মাও সে তুং সূর্যের চেয়ে বড় কারণ তার চিন্তাধারা পৃথিবীর সর্বত্র আলো দেয়, সংশোধনবাদ নিপাত যাক, বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক। তোমরা এইগুলো কপি করে নাও। মাহাদেববাবু কাগজটা ওদের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। ওঁর পড়ার গুণে ঘরে একটা অন্যরকম আবহাওয়া তৈরী হয়েছিল।

সুবাসদা বলল, মহাদেবদা, বর্তমান শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে আরো সরাসরি কিছু কথা থাকলে ভাল হতো না?

মহাদেববাবু বললেন, এখন সাধারণ মানুষের মনে এই ব্যাপারটা একটু আলোড়ন তুলুক তা কেন্দ্রীয় কমিটির চান। পরের স্টেজে ওগুলো আসবে।

অনিমেষের পাশের ভদ্রলোক বললেন, পুলিশ আমাদের লিখতে দেবে?

মহাদেবদা বললেন, না দেওয়াই স্বাভাবিক। আমাদের তৈরী হয়ে যেতে হবে। দুজন লিখবে দুজন এম প্রতিরোধ করবেই। সেজন্যে সংগঠন শক্তি আরো জোরদার করতে হবে।
 
আলোচনাসভা ভাঙলে সবাই এক এক করে বেরিয়ে যাচ্ছিল। আজ রাত বারোটার সময় দমদম স্টেশনের সাথে একটি ছেলে আসবে সরঞ্জাম নিয়ে। অনিমেষ আর সুবাসদা ওর সঙ্গী হবে। অন্যজন কাজ শুরু করবে সিঁথির মোড়ে। যে দুজন তার সঙ্গে থাকবে তারা সময় জেনে চলে গেল। অনিমেষ বেরিয়ে আসছিল কিন্তু মহাদেববাবু তাকে আর একটু বসে যেতে বললেন। সুবাদাকে বললেন, তুমিও থাক সুবাস। তারপর ঘর ফাঁকা হয়ে গেলে বললেন, সুবাস, আজকের সভা সম্পর্কে তোমার মতামত কি?

সুবাস বলল, ভাল কাজ হয়েছে।

কিন্তু অনিমেষ, তোমার কি দ্বিধা আছে?

অনিমেষ মাথা নাড়ল, না। আমি এখন বিশ্বাস করি এই পথেই দেশের মুক্তি সম্ভব। এদেশে কম্যুনিজম প্রতিষ্ঠা করতে গেলে বিপ্লব অবশ্যই প্রয়োজন। একথা ঠিক, বিদেশী শক্তি, কিংবা প্রচন্ড ডিকটেটরশিপ থাকলে কাজটা সহজ হতো, আমরা সহজেই জনসাধারণকে সঙ্গে পেতাম কিন্তু এ ছাড়া কোন উপায় নেই।

মহাদেববাবু বললেন, তেমায় একটা উলটো প্রশ্ন করি। কেন নেই?

অনিমেষ বলল, দেখুন, স্কুলে পড়ার সময় আমি কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। দেশপ্রেমের ব্যাপারটা আমাকেও স্পর্শ করেছিল। কিন্তু খুব অল্প দিনেই আমার মোহভঙ্গ হয়। কংগ্রেস একটা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে, একটা জানতে দেরী হয়নি। তারপরেই কমুনিষ্ট পার্টির দিকে আমি আকৃষ্ট হলাম। লেনিন, মার্কসের কথা এবং লেখা পড়ে বিশ্বাস করলাম এই হল একমাত্র পথ। কিন্তু এদেশের কম্যুনিসট পার্টির চেহারা যখন একটু একটু করে বুঝতে শুরু করলাম তখন অদ্ভুত বিষাদ এল। এদের কাজকর্মের সঙ্গে মার্কস কিংবা লেনিনের কোন সম্পর্কই নেই। বুঝলাম সংসদীয় গণতন্ত্রের এই কাঠামোয় কম্যুনিস্ট পার্টি এবং কংগ্রেসের মধ্যে পার্থক্যটা বেশী হতে পারে না। তখন মনে হতো যদি একটা বিদেশী শক্তি আমাদের আক্রমণ করত, সব ভেঙ্গে চুরমার করে দিত তাহলে তাদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে আমরা যে শক্তি পেতাম তা থেকে নতুন ভারতবর্ষ গড়া যেত। বলতে গেলে আমি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিলাম। এমন সময় সুবাসদার মাধ্যমে এই কর্মসূচী জানতে পারলাম। ঠিক এইরকম রাস্তাই তো আমি খুঁজছিলাম। তাই দ্বিধা থাকবে কেন?

মহাদেববাবু বললেন, তুমি যে কোন মুহূর্তে নিজেকে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত?

অবশ্যই।

তোমার বাড়িতে কে আছেন?

প্রশ্নটা শুনে অনিমেষ মহাদেববাবুকে দেখল। বাড়ির কথা এখানে কেন? বোধহয় ওর চাহনি দেখেই মহাদেববাবু বিশদ হলেন, আমি তোমার অ্যাটাচমেন্টের কথা জানতে চাইছি।

আমার ঠাকুরদা, বাবা, মা এবং পিসীমা।

ভাইবোন নেই?

না।

তুমি পরিবাবের একমাত্র সন্তান, ওঁরা তো তোমার ওপর নির্ভর করবেন!

আমি ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি দাদু পিসীমা এবং বাবা মা পরস্পরের ওপর নির্ভর করতেই অভ্যস্ত। আর আমার দাদুর কথা বলছি, এদেশের বর্তমান কাঠামো ভেঙ্গে ফেলতে যদি বিপ্লবের ঢেউ আসে এবং আমি যদি সেই আয়োজনে থাকি তাহলে তিনি অখুশী হবেন না। অনিমেষ বলল।

বেশ। সমস্যা তাহলে আর কিছু রইল না। অনিমেষের হাত ধরলেন মহাদেববাবু, তোমাকে যদি এই মুহূর্তে খুব বড় দায়িত্ব দেওয়া হয় তুমি নেবে?

বলুন।

গতকাল তোমার সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর কথাটা আমার মনে হয়েছে। আজ খোঁজখবর নিয়েছি, অবশ্য সুবাসও তোমার হয়ে বলেছে আমাকে। তোমার বাড়ি উত্তরবাংলায়। চা বাগানের মানুষেদের তুমি নিশ্চয়ই কিছুটা চেন। আমাদের কর্মসূচীর প্রথম পদক্ষেপ শহরের মানুষকে পরিস্থিতি–সচেতন করা এবং গ্রামে বা মফঃস্বলে শ্রমিক-কৃষক সংগঠিত করে এগিয়ে যাওয়া। আমি আজই এ নিয়ে কথা বলল, তুমি যদি রাজী থাকো তাহলে যে কোন মুহূর্তে তোমাকে ওখানে যেতে হতে পারে।

আমি রাজী।

খুশী হলাম।

আজ রাত্রে দেখা হবে তাহলে।

পৃথকভাবে ওরা বেরিয়ে এসে চিড়িয়ামোড়ে দেখা করতেই সুবাসদা বলল, অনিমেষ, তুমি কি ভেবেচিন্তে সব কাজ করছ?

প্রশ্নটায় একটু বিরক্ত হল অনিমেষ। প্রশ্নকর্তা যেহেতু সুবাসদা তাই সেটা প্রকাশ না করে বলল, একথা কেন বলছেন।

তোমার এম. এ. পরীক্ষা সামনেই।

তাতে কি হয়েছে!

এখনই কলকাতা ছাড়লে পরীক্ষা দিতে পারবে?

অনিমেষে হাসল, সুবাসদা, আমি যে বিষয় নিয়ে এম. এ. পড়ছি তার ডিগ্রি পাওয়া কিংবা না পাওয়ায় কোন পার্থকা নেই। তাছাড়া আমরা যা করতে চলেছি তা সম্ভব হলে এ ধরণের ডিগ্রীর কোন প্রয়োজন হবে না। আর শুধু পরীক্ষা দেওয়ার কথা যদি বলেন তাহলে তো তা যে কোন মুহূর্তেই এসে দিয়ে যাওয়া যায়।

তাহলে এতদিন এম. এ. পড়ছিলে কেন?

কিছু করতে হয় তাই। তাছাড়া আমি এম. এ. পড়ছি এই ভাবনাটা অনেককেই নিশ্চিন্ত রাখতে।

তোমার আর কারো কাছে জবাবদিহি দেওয়ার নেই?
 

Users who are viewing this thread

Back
Top